Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    হপ ফ্রগ

    আমাদের রাজা মশাই ছিলেন একজন সত্যিকারের পরিহাস-প্রিয় আমুদে মানুষ। তার মতো পরিহাস-প্রিয় মানুষ আর কেউ দেখে থাকলেও আমার চোখে অন্তত দ্বিতীয় কেউ পড়েনি।

    রাজা মশাইয়ের হাস্যরসসিক্ত কথাবার্তা শুনলে আমার মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মত, তিনি বুঝি পরিহাসের জন্যই পৃথিবীতে জীবনধারণ করছেন।

    আমি বহুবারই লক্ষ্য করেছি তার কাছে যথার্থ রসসিক্ত একটা গল্প বেশ রস দিয়ে দিয়ে পরিবেশন করতে পারলেই তার অনুগ্রহ লাভ নিশ্চিত হয়ে উঠত। তাই তো রাজা মশাইয়ের রাজসভার নয় জন মন্ত্রিই ছিলেন সত্যিকারের রসিক প্রবর। তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রসবোধ খুব টনটনে ছিল। আর এ রসবোধের জন্য রাজ্যে তাদের খ্যাতিও ছিল যথেষ্টই।

    বিশাল বপুর অধিকারী রাজা মশাইয়ের মতোই মন্ত্রিরাও ছিলেন বিশালদেহী। যাকে বলে প্রত্যেকেই রীতিমত স্থূলদেহী। গা দিয়ে যেন তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। আর অনুকরণযোগ্য হাস্যরস তো সবার মধ্যে ছিলই।

    আমার অবশ্য এরকম কোনো তথ্য জানা নেই যে, হাস্যরসের অধিকারী অর্থাৎ যথার্থ রসবোধ থাকলে কেউ সুবিশাল বপুর অধিকারী হন কি না, অথবা স্থূলদেহের মধ্যে এমন বিশেষ কিছুর উপস্থিতি থাকে কি না যা তার মধ্যে রসবোধের সঞ্চার ঘটায়, তাকে পরিহাসপ্রবণ করে তোলে কি না।

    তবে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে ধারণা লাভ করতে পেরেছি, তা হচ্ছে–হাস্যরসিক অথচ ক্ষীণদেহী কোনো ব্যক্তি বিরলই বটে।

    রাজা মশাই অন্য কোনোরকমে কলাকুশলতা, তার ভাষায় জ্ঞানবুদ্ধির ঢেকী– দের নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে নারাজ। অর্থাৎ বুদ্ধির মাপকাঠি দিয়ে তিনি কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে তিলমাত্র উৎসাহিও নন।

    হাস্যরস, রঙ্গ-রসিকতা তার প্রজাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক এটাই তার আন্তরিক অভিপ্রায়। আর যারা আচার ব্যবহার আর কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে রসবোধের বীজ ছড়াতে ব্রতী, তাদের তিনি পঞ্চমুখে প্রশংসা তো করেনই এমনকি অনুগ্রহ দানেও ধন্য করে থাকেন। শুধু কি এ-ই? তার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি তার বিস্তারকেও হাসিমুখে বরদাস্ত করেন। তবে এও খুবই সত্য যে, সূক্ষ্ম রসিকতাকে তিনি কেবলমাত্র যে অবজ্ঞা করতেন তা-ই নয়, যারপরনাই ক্লান্তি বোধ করেন। তখন কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় বিতৃষ্ণায় তার মন-প্রাণ ভরে উঠত।

    আর বিখ্যাত লেখক র‍্যাবেশ-এর গর্গান্টুয়া নামক বইটার কথাশিল্পী ভলতেয়ার এর লেখা জাদিগ বইটার তুলনাই তার কাছে অনেক, অনেক বেশি প্রিয়। মোদ্দা কথা, মৌলিক কোনো পরিহাসের তুলনায় বাস্তব পরিহাস তার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। আর তা বেশিমাত্রায় রুচিকর বলেও বিবেচিত হয়।

    আমি এখন যে কাহিনীর অবতারণা করতে চলেছি, তখন রাজসভা থেকে বিদুষক-বৃত্তিটা পুরোপুরি লোপ পায়নি। বরং তারা স্বয়ং রাজা মশাই ও সভাসদদের দ্বারা যথেষ্ট সমাদৃতই হতেন।

    সত্যি কথা বলতে কি, তিনি বিশাল মহাদেশের রাজ-রাজড়া বিদূষকদের যথেষ্ট সমাদরের সঙ্গেই নিজ নিজ রাজদরবারে স্থান দিতেন। আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে, উপযুক্ত বেতনদানের মাধ্যমে তাদের পুষতেন।

    বিদুষকরা হরেক রঙের পোশাক গায়ে চড়িয়ে আর ঘণ্টাসহ বিচিত্র ধরনের টুপি মাথায় চাপিয়ে রীতিমত হাসির উদ্রেককারী সাজেনিজেদের সাজিয়ে তুলত। আর তারা প্রত্যেকেই ছিল এক-একটি চলমান হাসির যন্ত্র। সোজা কথা, তারা ছিল স্বভাবরসিকপ্রবর। হাসির কথা আর গল্প থাকত তাদের জিভের ডগায়। যে কোনো সময়, যে কোনো পরিবেশে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাদের একমাত্র কর্তব্য। আর বিনিময়ে তাদের বরাতে জুটত রাজার টুকরো টুকরো অনুগ্রহ। রাজা খুশি হয়ে যেটুকু অনুগ্রহ দাক্ষিণ্য তার দিকে ছুঁড়ে দিত, তা মাথা পেতে নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকত।

    আমাদের মতো রাজা মশাইও একজন সত্যিকারের হাস্যরসিক। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, সাতজন মন্ত্রীর মতো সাতজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির–রাজা মশাইয়ের নিজের কথা না হয় ছাড়ান দেওয়াই হলো এরও দরকার অবশ্যই ছিল। আসলে এ জ্ঞান গুণের বোঝার ভারসাম্য অব্যাহত রাখার জন্যও তো একজন বোকাসোকা লোকের উপস্থিতি চাইই চাই।

    রাজা মশাইয়ের বেতনভুক হাস্যরসিকটি, মানে বিদুষক বলে সমধিক খ্যাত। সে অবশ্যই কেবলমাত্র একজন বিদুষকই ছিল না। রাজা মশাই তাকে তার বিদুষক হিসেবে প্রাপ্য সমাদরের তিন গুণ সমাদর দিয়েছিল। কারণ কি? কারণ তো অবশ্যই ছিল। বিদুষকের গুণাবলীর ধারক ছাড়াও সে ছিল একজন বামন আর পঙ্গু।

    যে আমলের কথা বলছি, তখন বামন ও ভাঁড় দুই রাজসভার শোভা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করত। তাই সমাদরও পেত সবচেয়ে বেশিই।

    আসলে একজন সত্যিকারের ভাড় অর্থাৎ হাস্যরসিকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রাণখুলে হাসার একজন পঙ্গু অর্থাৎ অষ্টাবক্র মানুষকে দেখে তার চলাফেরা লক্ষ্য করে হাসিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা ছাড়া রাজা মশাইকে দিন কাটাতে হবে এ-কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।

    কিন্তু আমি তো একটু আগেই বলে রেখেছি, হাস্যরসিকদের নব্বই শতাংশই হচ্ছে রীতিমত স্থূলদেহী, গোলাকার আর একটু আধটু গোবরগণেশ গোছের মানুষ। তাই তো একাধারে তিনগুণের অধিকারী আমাদের রাজা মশাইয়ের সভার ভাড় রসিক লাল-কে নিয়ে রাজা মশাই মহানন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন। হাসিখুশির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে পারলে একজন আমুদে মানুষের আর কী-ই বা চাইবার থাকতে পারে।

    রসিকলাল নামটা গীর্জার পুরোহিত দীক্ষান্তকালে বিদুষকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয় না।নির্ঘাৎ অন্য কোনো কারণ এর পিছনে ছিল। হ্যাঁ, কোনো-না-কোনো কারণ তো অবশ্যই ছিল। কি সে কারণ, তাই না? অন্য দশজন স্বাভাবিক লোকের মতো হাঁটাহাঁটি করতে অক্ষম, অষ্টাবক্রদেহে এঁকে বেঁকে হাঁটাচলা করত বলে রাজসভার সাত মন্ত্রীই আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়ে তার নামকরণ করেছিল রসিকলাল।

    সত্যি করে বলতে গেলে, রসিকলাল বিচিত্র এক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে হাঁটাচলা করত। তার চলার ভঙ্গিটা ছিল সত্যি অদ্ভুত লাফিয়ে সে চলত, এমন কথা বলা যায় না। আবার চলার সময় শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে চলত এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে? এ-দুয়ের মাঝামাঝি এমন এক চোখে লাগার মতো ভঙ্গিতে সে হাঁটাচলা করত যাকে বলাচলে উপরোক্ত ভঙ্গি দুটোর মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি।

    কোনো কথা বলা বা হাস্যরসসিক্ত কথা বলে কারো মধ্যে হাসির উদ্রেক ঘটানোর দরকার তার হতো না। সে তারনিজস্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পথ পাড়ি দিচ্ছে দেখলেই পথচারীরা হেসে গড়াগড়ি যাবার জোগাড় হতো।

    তাই তো রাজসভার ভাঁড় রসিকলাল বিশাল বপু, জালার মতো ইয়া বড় ভুঁড়ি আর অস্বাভাবিক বড় মাথার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল রাজ্যসভায় রাজা মশাইয়ের একমাত্র সান্ত্বনা, একমাত্র নির্ভরস্থল।

    কথাটা খুবই সত্য যে, বিকৃত পা দুটোর সাহায্যে চলাফেরা করতে তার খুবই কষ্ট স্বীকার করতে হতো। হবার কথাও তো বটে। এমন অষ্টাবক্র পা দুটোর সাহায্যে পথ পাড়ি দেওয়া, কম কথা। তবে সৃষ্টিকর্তা বিধাতা-পুরুষও কিন্তু তার এ ভয়ানক সমস্যাটা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসিন ছিলেন না। সে যাতে পায়ের সমস্যা থেকে কিছুটা অন্তত অব্যাহতি পেতে পারে সে কথা বিবেচনা করে হাত বাহু দুটোকে সাধারণের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি পেশীবহুল এবং অমিত শক্তির আধার করে তৈরি করে দিয়েছেন। কেন? পায়ের সমস্যা দূর করতে হাতের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন কি? আছে, প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এর পিছনে যুক্তি হচ্ছে, হাত দুটোর ওপর নির্ভর করে সে যাতে মই বা ঝুলন্ত দড়ি-বেয়ে অনায়াসেই ওঠা-নামা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারে তার জন্য হাতের শক্তিসামর্থ্য, তো একটু বেশি মাত্রায়ই দরকার।

    আর দড়ির মাধ্যমে চলাফেরায় রসিকলাল অভাবনীয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। কার্যত দেখা গেল, চলাফেরার ব্যাপারে তার ব্যাঙের চেয়ে অনেক বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যেত বানর, হনুমান আর কাঠবিড়ালীর সঙ্গেই। গাছে চড়ার কাজে সে ছিল স্বাভাবিক হাত-পাওয়ালা মানুষের চেয়েও অনেক বেশি পটু–ওস্তাদ।

    রসিকলালের জন্ম কোথায় হয়েছিল, কোন্ দেশ থেকে যে সে এখানে উদয় হয়েছিল আমি কেন, সে অঞ্চলের কারোই জানা ছিল না। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটুকু জানা সম্ভব হয়েছিল, আমাদের রাজার প্রাসাদ থেকে বহু যোজন দূরবর্তী এমন কোনো এক অসভ্য জংলিদের দেশ থেকে এসে সেখানে উদয় হয়েছিল যার নাম বাপের জন্মেও কেউ কোনোদিন শোনেনি।

    রাজা মশাইয়ের সেনাপতিরা রসিকলাল আর তার চেয়ে সামান্য বেঁটেখাটো ও নৃত্য পটিরসী এক কিশোরীকে জোর জবরদস্তি ধরে এনে তার পায়ে নিবেদন করে উপহার দিয়েছিল।

    এমন চমৎকার লোভনীয় উপহার পেয়ে রাজা মশাই যে মন্ত্রিদের ওপর খুবই প্রীত হয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

    ব্যস, সেদিন থেকেই দুই ক্ষুদে নারী-পুরুষ রাজপ্রাসাদে বন্দি হয়ে গেল। এখানে কাছাকাছি-পাশাপাশি বন্দি জীবনযাপন করতে করতে তাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠবে তাতে অবাক হবার কোনো কারণই থাকতে পারে না। আর এভাবেই ক্রমে তারা একে অন্যের দারুণ কাছাকাছি চলে গেল। বন্ধু হয়ে উঠল।

    আরে ধুৎ–! কথায় কথায় মাত্রাতিরিক্ত বেঁটেখাটো কিশোরিটার নামটাই তো বলা হয়ে উঠল না। যাক, তার নাম ছিল ত্রিপেত্তা। রসিকলালের বান্ধবী ত্রিপেত্তাও রাজপ্রাসাদের মানুষগুলোর কাছে কম আদরণীয় ছিল না। কারণ, ত্রিপেত্তা বামন ছিল ঠিকই। তবে এও সত্য যে, বামন হলেও ত্রিপেত্তার রূপ-লাবণ্য ছিল বাস্তববিকই অতুলনীয়। এক ঝলক দেখলেই মোহিত হয়ে যেতে হতো, চোখে বাধা লেগে যাবার যোগাড় হতো। তাই তো রূপসি কিশোরী সবার চোখেই আদরনীয় ছিল। আর এ কারণেই রাজসভায় তার প্রভাব বাড়তে বাড়তে একেবারে তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল।

    রসিকলালের পক্ষে ইচ্ছা থাকলেও ত্রিপেত্তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পারত না। তবে তাকে সাহায্যের দরকারও তেমন পড়ত না। কারন নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়েই যে নিজের একটু-আধটু সমস্যা থাকলে অনায়াসেই দূর করতে তো পারতই বরং প্রয়োজন সে-ই সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে রসিকোল সমস্যামুক্ত করত। এভাবে তারা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুখেই দিন গুজরান করতে লাগল।

    তবে দেখা যেত ত্রিপেত্তা প্রয়োজনে রসিকলালকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করত।

    উপলক্ষটা আমার পক্ষে এখন আর বলা সম্ভব নয়, ভুলেও গেছি। রাজা মশাই একবার এক মুখো, নৃত্যের আয়োজন করেছিলেন। রীতিমত জাঁকজমকপূর্ণ মুখোশনৃত্য। আর আমাদের রাজপ্রাসাদে মুখোশনৃত্য মানেই ছিল রসিকলাল আর ত্রিপেত্তা-র নাচ। নাচের আসরে যারাই নাচুক না কেন, তাদের দুজনকে নাচতে হবেই, হবে। তাদের নাচছাড়া প্রাসাদে মুখোশ নাচ? অসম্ভব! রাজা মশাই-ই কেবল নন, মন্ত্রীরাও যে এমন অসম্ভব কথা ভাবতেই পারেন না। এতে রসিকলাল-এর পটুত্ব বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাচার বহর দেখে সব বয়সী। আর রুচিশীল মানুষই একেবারে থ বনে যেত। যাকে বলে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত।

    উৎসবের দিন এগিয়ে এসেছে। চারদিকে দারুণ তোড়জোড় চলতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেই বামন নর্তকী ত্রিপেত্তার চোখের সামনেই প্রাসাদের সুবিশাল হলটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঝলমলে করে তোলা হলো। আর মুখোশনৃত্যের জন্য যেমন সষ্টি করা দরকার সেদিকে দক্ষ শিল্পীদের নজর কম ছিল না।

    প্রকৃতির কোলে একমটু একটু করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। হলঘরে দর্শকদের ভিড় যেন উপছে পড়ছে। সবাই প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাচ্ছে।

    কর্মকর্তাদের ব্যস্ততার অন্ত নেই। কেউই হাত-পা গুটিয়ে নিশ্চন্ত হয়ে বসে নেই, কারণে-অকারণে ছোটাছুতি মত্ত। কেবলমাত্র রাজা মশাই আর তাঁর সাত মন্ত্রির চোখে মুখে ইতস্ততের ছাপ থাকলেও ব্যস্ততার কোন চিহ্নই নেই। কিন্তু কেন যে তারা এমন ইতস্তত করছিলেন তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এটা কারণ হলে হতেও পারে, অস্বাভাবিক স্থূলদেহী আর জালার মতো ইয়া পেল্লাই ভুঁড়ির অধিকারী হওয়ার জন্যই মনস্থির করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আর এরই ফলে হয়তো বা তারা চেয়ার আঁকড়ে স্থবিরের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে মুখোশ নাচ শুরুর প্রতীক্ষায় বসে ছিল।

    এদিকে নাচ শুরু হবার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও সবাই কেবল ছুটোছুটিতেই ব্যস্ত দেখে রাজা মশাই অনন্যোপায় হয়ে রসিকলাল আর ত্রিপেত্তাকে তলব করে পাঠালেন। এ বিপদের সময় তারাই যে শেষ সম্বল, একমাত্র ভরসা।

    রাজা মশাইয়ের তলব পেয়ে তারা ব্যস্ত পায়ে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তাঁকে। অভিবাদন সেরে আদেশের প্রতীক্ষায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    রাজা মশাই তার সভাসদ সাত মন্ত্রিকে নিয়ে মৌজ করে এরে পর এক মদের পেয়ালা উজাড় করে চলেছেন।

    রসিকলাল আর ত্রিপেত্তা রাজা মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিলেন, তার মেজাজ মর্জি মোটেই ভালো নয়।

    রাজা মশাই ভালোই জানেন, রসিকলাল মদ পছন্দ করে না, এমনকি স্পর্শও করে না। দু-চার বার জোর করে মদের পেয়ালা তার গলায় ঢেলে দিয়ে লক্ষ্য করেছেন, মদ পেটে পড়ামাত্র পঙ্গু লোকটা প্রায় উন্মাদশা হয়। চিৎকার করতে তিড়িং বিড়িং করে অনবরত লাফাতেই থাকে। উন্মত্ততা তো অবশ্যই সুখকর নয়।

    তবে এ-কথা খুবই সত্য যে, রসিকালের বাস্তব রসসিক্ত কথাগুলো রাজা মশাইয়ের খুবই প্রিয়। সে যখন রসাল দিয়ে দিয়ে কথা বলে তখন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে সুস্থিরভাবে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনতে পারেন। তার মধ্যে এতটুকুও বিরক্তি প্রকাশ পায় না। তবে তার মেজাজ চাঙা করে তোলার জন্য রাজা মশাই জোর করে দু-চারবার তার গলায় মদের পেয়ালা ঢেলে দিয়েছিলেন।

    রসিকলাল সঙ্গীনীকে নিয়ে রাজসভায় ঢুকে অভিবাদন সেরে করজোড়ে সামনে দাঁড়াতেই রাজা মশাই ঠোঁট থেকে মদের পেয়ালাটা নামিয়ে বললেন–এই যে রসিকলাল, তোমার অনুপস্থিত বন্ধুবান্ধবদের স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে এক পেয়ালা গলায় ঢেলে নিয়ে মেজাজটাকে একটু চাঙা করে নাও।

    রসিকলাল মুচকি হেসে আবার নতজানু হয়ে অভিবাদন সারল। রাজা মশাই পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন নাও হে, দেরি করো না। মদ গিলে চাঙা হয়ে নিয়ে দু-একটা নতুন খেল দেখাও তো। একেবারে নতুন চরিত্র যা সচরাচর দেখা যায় না–দেখাও। সাফ কথা শোন, একঘেয়ে রঙরসের কথা আর অভিনয় দেখে দেখে অশ্রদ্ধা ধরে গেছে। নতুন কিছু চাই।

    মদের পেয়ালাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে এবার বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? হাত বাড়াও, নাও ধর। এক ঢোক গিলেলেই দেখবে, ভেতরটা চনম নিয়ে উঠেছে, বুদ্ধি খোলতাই হয়ে যাবে। নাও–ধর।

    পাওয়ার প্রতি বামন রসিকলাল-এর তেমন আগ্রহ না থাকলেও তা পেয়ে যাওয়ায় প্রত্যাখ্যান করতে উৎসাহি হলো না। হাত বাড়িয়ে পেয়ালাটা নিয়ে সোজা গলায় ঢেলে দিল। এবার রাজা মশাইয়ের হুকুম তামিল করতে গিয়ে কয়েকটা তামাসা দেখাবার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের মতো করে পরিবেশন করতে পারল না, জমলও না মোটেই। আসলে সে তারিখটা ছিল অদৃষ্টবিড়ম্বিত ভাঁড়ের জন্মদিন। রাজা মশাইয়ের মুখে অনুপস্থিত বন্ধু-বান্ধবদের স্বাস্থ্যপান করার কথাটা শোনামাত্র তার মনটা হঠাৎ বিষিয়ে যায়, দুচোখ ভরে পানি আসে। তাই সে রাজা মশাইয়ের হাত থেকে মদের পেয়ালাটা নিয়ে তাতে অনেকগুলো ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছিল।

    বামন রসিকলাল ক্ষণিক ইতস্ততের পর মদের পেয়ালাটা গলায় ঢালা মাত্র রাজা মশাই গলা ছেড়ে হো-হো রবে হেসে উঠছিলেন। এখন আবার আগের মতোই হাসতে হাসতে বললেন–কি হে, রসিকলাল, কি হে, এক পেয়ালা মদের কেমন খেল্ দেখলে তো? আয়নার কাছে গিয়ে দেখে নিতে পার, এরই মধ্যে তোমার চোখ দুটো কেমন লাল হয়ে উঠেছে, আর কেমন ঝিল্লা দিচ্ছে!

    হায়রে হতভাগা বামন। মদের গুণে ঝিল্লা দিচ্ছে, নাকি চোখের জলে মোমবাতির আলো পড়ে চকচক করছে! সে কাঁপা কাঁপা হাতে পেয়ালাটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। এবার প্রায়-উন্মাদের মতো চাহনি মেলে রাজা মশাই ও তার পাশে অবস্থানরত। মন্ত্রী মহোদয়ের দিকে চোখের মণি দুটোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাল।

    এদিকে রাজা মশাই রসিকতায় সাফল্য লাভ করেছেন দেখে সবার মনই আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল।

    ইয়া পেল্লাই ভুঁড়ি ও নাদুসনুদুস চেহারাধারী মন্ত্রি মহোদয় বিশ্রি স্বরে ফিকফিক করে হেসে বলল–আর দেরি কেন হে বামন দেব, তোমার খেলা আবার শুরু করে দাও।

    অবশ্যই, অবশ্যই; এগিয়ে এসো হে রসিকলাল, আমাদের একটু সাহায্য কর। অদ্ভুত অদ্ভুত চরিত্র আমরা দেখতে চাই। নাও, শুরু করে দাও তোমার কেরামতি।

    সাত-সাতজন মন্ত্রী সমস্বরে হেসে উঠল। সে কী বিকট হাসি! রসিকলালও নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ক্ষীণস্বরে হলেও অর্থপূর্ণ হাসি হাসতে লাগল।

    রাজা মশাইয়ের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার যোগার হলো। তিনি বলে উঠলেন–তুমি যে খুব গড়িমশি শুরু করলে হে রসিকলাল! তোমার মতলবটা শুনি? তামাসা দেখাবার মতো তোমার মধ্যে কি কিছুই নেই। তুমি তো অবাক করলে হে!

    মদের নেশা রসিকলালকে রীতিমত জেঁকে ধরেছে। সে নেশার ঘোরটাকে একটু সামলে নিয়ে কোনোরকমে জবাব দিল–রাজা মশাই আমি কিন্তু শুধু শুধু গোমড়া হয়ে বসে নেই।

    তবে? মুখে কলুপ এঁটে–।

    আমি নতুন কোনোকিছুর কথাই বলছি কিন্তু মহারাজ।

    নতুন কিছু। স্বেচ্ছাচারী রাজা গুলি-খাওয়া বাঘের মতো হিংস্র স্বরে গর্জে উঠলেন–বহুৎ আচ্ছা! তোমার মতলবটা কি? বলতেই বা চাচ্ছ কি, শুনি? উফ! এবার ব্যাপারটা খোলসা হয়েছে। মদ আরও মদ চাচ্ছ, তাই না?

    রাজা মশাই মদভর্তি আর একটা পেয়ালা পঙ্গু বামন ভঁড় রসিকলালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–এই যে, নাও–গেল!

    মদের পেয়ালাটার দিকে সে কিন্তু হাঁ করে তাকিয়েই রইল। আর ঘোঁৎ ঘোৎ করে শ্বাস নিতে লাগল।

    ক্রোধোন্মত্ত রাজা মশাই অধিকতর হিংস্র স্বরে গর্জে উঠলেন–নাও, ধর বলছি! শয়তানের দিব্যি দিয়ে বলছি, তার ক্রোধ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় কথাটা আর তার পক্ষে শেষ করা সম্ভব হলো না।

    বামন ভাড় আগের মতোই ইতস্তত করতে লাগল।

    রাজা রেখে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন।

    মন্ত্রি ও অন্যান্য সভাসদদের মুখে ফুটে উঠল বিদ্রুপের হাসি। ত্রিপেত্তা এতক্ষণ রসিকলালের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে ব্যাপার স্যাপার দেখছিল। ক্রমে তার মুখটা মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। পরিস্থিতি প্রতিকূল অনুমান করে সে সিংহাসনের দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে নতজানু হয়ে অভিবাদন করে করজোড়ে মিনতি করল–মহারাজ, এ-অধমের অপরাধ মার্জনা করে দিন।

    তার ঊদ্ধত্যে রাজা মশাই যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। কি করা ও বলা উচিত, কীভাবে রাজার উপযুক্ত ক্ষোভ প্রকাশ করবেন তা মুহূর্তের মধ্যে ভেবে উঠতে পারলেন না। শেষমেশ মুখে টু-শব্দটিও না করে উত্তেজনায় ফুঁসতে ফুঁসতে সজোরে এক ধাক্কা মেরে ত্রিপেত্তাকে দূরে ঠেলে দিলেন। তারপরই পেয়ালার সবটুকু মদ তার মুখে ঢেলে দিয়ে ক্রোধে ফুঁসতে লাগলেন।

    বেগতিক দেখে রূপসি বেঁটে মেয়েটা কোনো কথা না বলে দ্রুত টেবিলের তলায় তার নিজের জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিল। মুখে একটা কথাও বলল না।

    মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল সভাপ্রাঙ্গণে নেমে এলো শ্মশানের নীরবতা। পরমুহূর্তেই সে নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে একটা খুবই মৃদু অথচ কর্কশ খস্ খস্ শব্দ সবার কানে এলো।

    রাজা মশাই ভঁড় বামন রসিকলালের দিকে তর্জনি তুলে চিৎকার করে উঠলেন– তুমি কেন এমন বিশ্রি শব্দ করছ? কেন? কেন? কেন আমি জানতে চাই।

    ভাঁড় বামনটার হাবভাব দেখে মনে হলো তার মদের ঘোর অনেকটাই কেটে গেছে। নিস্পলক চোখে স্বেচ্ছাচারী রাজার দিকে তাকিয়ে বলল–আমি? আমি শব্দ করেছি, বলছে? কিন্তু আমি কেন শব্দ করতে যাব, বলুন তো রাজা মশাই?

    সভাসদদের মধ্য থেকে একজন কিছু সময় উকৰ্ণ হয়ে শব্দটা শোনার পর আমতা আমতা করে বললেন–না, শব্দটা বাইরে থেকেই ভেসে আসছে মনে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্য নীরবে লক্ষ্য করে এবার বললেন–মহারাজ, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, জানালার কাছে খাঁচায় বসে হতচ্ছাড়া কাকাতুয়াটা তারের গায়ে শক্ত ঠোঁটটা ঘষে ঘষে শান দিচ্ছে। শব্দটা শুনে তো এটাই মনে হচ্ছে।

    কথাটা শুনে মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে রাজা মশাই–তাই নাকি? আমি কিন্তু শপথ করে বলতে পারতাম শব্দটা নির্ঘাৎ এ-হতচ্ছাড়াটার দাঁতের শব্দ।

    কথাটা কানে যেতেই বামন ভাড় ফিক করে হেসে ফেলল। রাজা মশাই একজন হাস্যরসিক। কারও হাসিতে তার তো আপত্তি করা শোভা পায় না। ঠিক সে মুহূর্তেই তার মুখ থেকে একপাটি বড় আর বিশ্রি দাঁত বেরিয়ে এলো। আর সে সঙ্গে সে যতখুশি মদ খাওয়ার বাসনা প্রকাশ করল।

    ভড়ের কথা রাজা মশাই ক্রোধসম্বরণ করে শান্ত হলেন, স্বাভাবিকতা ফিরে পেলেন।

    বামন রসিকলাল আর এক পেয়ালা মদ গলায় ঢেলে মুখোশনৃত্য পরিবেশনে মন দিল। তার মধ্যে কোনোরকম বেসামাল ভাবই দেখা গেল না।

    এবার সে রাজা মশাইয়ের দিকে ফিরে করজোড়ে নিবেদন করল, মহারাজ, কি করে যে কি হয়ে গেল আমি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। তবে মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে তার মুখে মদের পেয়ালা ঢেলে দেবার পরমুহূর্তেই, মহারাজ এ-কাজটা করলেন, আর খাঁচার কাকাতুয়াটা দরজার বাইরে থেকে অদ্ভুত শব্দটা করতে লাগল। আর তার ঠিক পরমুহূর্তেই আমার মধ্যে নতুন একটা ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমাদের অনেক গ্রাম্য নৃত্যের মধ্যে একটা মুখোশনৃত্যের আসরে আমরা প্রয়ই সেটা দেখিয়ে থাকি। কিন্তু এখানে তো সেটাই একেবারে নতুন মনে হবে, ঠিক কি না?

    রাজা প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলেন–হুম্!

    কিন্তু রাজা মশাই দুর্ভাগ্যের বিষয়টা হচ্ছে, আটজন লোক না হলে যে নাচটা দেখানো সম্ভব নয়। মানে আটজন–

    আরে ধ্যুৎ! তখন থেকে কেবল আটজন-আটজন করে যাচ্ছ। এই তো আমরাই আটজন হচ্ছি। এবার বল তো তোমার ওই নতুন নাচটার কি নাম?

    নাম? মহারাজ, আমরা এটার নাম দিয়েছি, আট শৃঙ্খলিত ওরাংওটাং নাচ।

    চমৎকার! চমৎকার নাচ! আমরাই অভিনয় করব।

    নাচটার আসল মজাই হচ্ছে, নাচটা দেখে মেয়েরা যে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে, তাতেই।

    রাজা মশাই ও মন্ত্রীরা সমস্বরে বলে উঠলেন–চমৎকার! চমৎকার!

    বামন ভঁড় এবার বলল–আপনারা ভাববেন না, আমিই আপনাদের ওরাংওটাং সাজিয়ে দেব। দেখবেন, আপনারা যেন এক-একটা সত্যিকারের ওরাংওটাং বনে গেছেন। সবাই ভাববে আপনারা আসল জন্তু। সবেমাত্র জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। তবে এও সত্য যে, আপনাদের দেখে সবাই যতটা ভয় পাবে, অবাকও হবে ঠিক ততটাই।

    তার কথা শেষ হতে না হতেই রাজা মশাই সোল্লাসে বলে উঠলেন–চমৎকার! চমৎকার মতলব! রসিকলাল, আমি তোমাকে নিজে হাতে মানুষ মানুষ সাজিয়ে দেব। চমৎকার হবে তাই না?

    বামন ভাঁড় বলে চলল–মহারাজ, সবার মধ্যে গোলমালটাকে বাড়িয়ে তোলার জন্যই শেঁকলগুলো ব্যবহার করা হবে যাতে অনবরত ঠুং-ঠাং-ঠুং-ঠাং আওয়াজ হয়। ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠবে যে, সবাই ভাববে পাহারাদারদের জিম্মা থেকে আপনারা দলবেঁধে পালিয়ে এসেছেন। একটা মুখোশনৃত্যে শেঁকলবাধা আট-আটটা ওরাং ওটাংকে দেখে সবাই সত্যিকারের ওরাংওটাং বলে ভুল করে বসবে। তবে আপনারা সবাই বনের জানোয়ারের মতো হরদম তর্জন গর্জন করতে থাকবেন। আর ছুটতে ছুটতে এসে দামি ও চকচকে পোশাক পরিহিত নারী পুরুষদের ভিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফালাফি দাপাদাপি শুরু করে দেবেন। কী মজা

    রাজা মশাই বলে উঠলেন তা-তো হবেই–হতে বাধ্য।

    বামন ভাঁড়ের মুখোশনৃত্যে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মন্ত্রীরানিজনিজ আসন ছেড়ে উঠে এলেন।

    বামন ভাড় রসিকলাল ব্যস্ত-হাতে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রত্যেককে ওরাং ওটাং সাজিয়ে দিল। জব্বর সাজ হয়েছে। সবাই বলবে, সবে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছেন?

    আসলে ব্যাপারটা ভালোই দাঁড়াল। এখানে সে সময়কার এবং সে অঞ্চলের গল্পের অবতারনা করা হচ্ছে বিশেষ করে সেখানকার মানুষ ওরাংওটাং নামধারী বিচিত্র ধরনের জানোয়ার বড় একটা চোখে দেখেছে। আর যেহেতু বামন ভাড় অতিমাত্রায় রং ব্যবহারের মাধমে তাঁদেও এক-একটা বীভৎস জানোয়ারের রূপদান করেছে, তাতে কারে সন্দেহ করার কথাই নয় যে, সবাই সত্যিকারের ওরাংওটাং নয়। অতএব দর্শকরা চোখের সামনে এতগুলো অদ্ভুতদর্শন জানোয়ার দেখতে পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। তার ওপর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে যখন মুখোশনৃত্যের নামে তাণ্ডবনৃত্যে মেতে উঠবে তখন তাকে তারা পুলকানন্দে যে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে আশ্চর্য কি?

    এখন ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই ও মন্ত্রীদের সাজগোজের ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু-আধটু আভাস দেওয়া যাক। বামন ভাড় রসিকলাল প্রথমেই তাদের সবার গায়ে মোজার কাপড়ের তৈরি একটা করে আঁটসাঁট শার্ট। তার ওপর পড়েছে একই রকম আঁটসাট পা-জামা। এবার তাদের গায়ে আচ্ছা করে আলকাতরা মাখিয়ে দেওয়া হলো শরীরের কোথাও এতটুকুও ফাঁক রাখা হলো না।

    উপস্থিত দর্শকদের দু-একজন আলকাতরার ওপর পাখির ছোট ছোট পালক সেঁটে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বামন ভাঁড় কিন্তু সে পথেই গেল না। সে একগাট্টি শন পাটের ধবধবে আঁশ নিয়ে এলো। হাত দিয়ে সেগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিয়ে সবার গায়ে সেঁটে দিল শন-পাটের আঁশে আলকাতরার প্রলেপ পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল। ফলে তারা প্রত্যেকে যেন এক-একটা অবিকল লোমশ জানোয়ারে পরিণত হয়ে গেল। বেড়ে মতলব, চমৎকার সাজ।

    এবার লোহার লম্বা শেঁকল দিয়ে সবাইকে এমন করে জড়িয়ে দেওয়া হলো যাতে চলাফেরা ও লাফালাফি দাপাদাপি করতে অসুবিধা না হয়। উপরন্তু নাচের সময় শেঁকলে-শেঁকলে তো লেগে ঠুং-ঠাং আওয়াজ করবে।

    শেঁকল দিয়ে বাঁধার পর্ব সেরে বামন ভাঁড় এবার সবাইকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে দিল। পুরো ব্যাপারটা যাতে স্বাভাবিক বলে সবাই ভেবে নিতে পারে সে জন্য শেঁকলের প্রান্ত দুটোকে বৃত্তের মধ্যে নিয়ে এসে একটা খুঁটির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা এখন এমন দাঁড়াল যে, জঙ্গল থেকে ওরাংওটাংদের পাকড়াও করে নিয়ে এসে এখানে খুঁটিটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। আবার এও ভাবা যেতে পারে, সম্প্রতিকালে বোণিওতে সিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং এবং অন্য জানোয়ারদের ধরার জন্য যেভাবে ফাঁদ তেরি করা হয় এও ঠিক সে-ব্যবস্থাই করা হয়েছে। বোর্ণিও ছাড়া অন্য কয়েকটা দেশে বানর ও হনুমান প্রভৃতি প্রাণীদের ধরার জন্যও এই একই পদ্ধতিতে ফাঁদ তৈরি করে তাদের পাকড়াও করা হয়।

    বামন ভাঁড় রসিকলের ইচ্ছা ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই ও মন্ত্রিদের প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত একইভাবে, বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। উদ্দেশ্য, হৈ-হট্টগোলে মত্ত দর্শকরা হলঘরে ঢুকে কাণায় কাণায় ভর্তি করে ফেললে, পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত স্বাভাবিক হয়ে এলে তবেই তাদের নাচের আসরে হাজির করা হবে।

    আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত রাজা মশাই ও মন্ত্রীরা দীর্ঘসময় ধরে একই জায়গায় কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। তার ওপর আলকাতরা আর শন পাটের আঁশগুলোও তাদের কর্ম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল না। ফলে ঘড়িতে ঢং-ঢং করে দশটার ঘণ্টা বাজতেই তাদের ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেল। সবাই ছুটাছুটি দাপাদাপি শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শেঁকলে লাগল টান। ব্যস, তারা হুড়মুড় করে এ ওর ঘাড়ে পড়তে লাগল। আর বিকট স্বরে আর্তনাদও শুরু হয়ে গেল। তারপর শুরু হলো মেঝেতে রীতিমত গড়াগড়ি জড়াজড়ি আর মরিয়া হয়ে আর্তনাদ। সে এক বীভৎস দৃশ্য!

    রাজা মশাই লক্ষ্য করলেন নাচিয়ে ওরাংওটাংদের মধ্যে উত্তেজনা চরম রূপ নিয়েছে আর খুশিতেও রীতিমত ডগমগ। তার মন আনন্দে নেচে উঠল।

    বামন ভাঁড় যেমন ভেবেছিল, অদ্ভুতদর্শন হিংস্র জানোয়ারগুলোকে দর্শকরা ওরাং ওটাং ভাবুক আর না-ই ভাবুক অন্তত কোনো-না-কোনো জানোয়ার তো অবশ্যই ভাববে। কার্যত ঘটলও ঠিক তা-ই। মহিলারা এতগুলো হিংস্র জানোয়ারকে এক সঙ্গে দেখে কেবলমাত্র ভিত-সন্ত্রস্তই হয়ে পড়ল না, সবাই সম্বিৎ হারিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল।

    মুহূর্তে পরিস্থিতি এমনই খারাপ হয়ে পড়ল যে, রাজা মশাইয়ের নির্দেশে মন্ত্রিরা যদি অস্ত্রপাতি গুদামে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে না রাখত, তবে হয়তো তাকে ভয়ঙ্কর একটা রক্তারক্তির দৃশ্যই চোখের সামনে দেখতেই হত। আর মন্ত্রী মহোদয়ের নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নতুনতর চমকদার নাচ দেখার বাসনার প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।

    এদিকে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে শেষপর্যন্ত চরম রূপ নিল। তারা প্রাণভরে ভিত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য হলঘরের সদর-দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। হায়? এ কী সর্বনাশা ব্যাপার, দরজা যে বন্ধ! রাজা মশাইয়ের কড়া হুকুম দরজা যেন বন্ধ রাখা হয়। কোনো পরিস্থিতেই খোলা চলবে না। কেউ যদি তার এ আদেশ অমান্য করে তবে অবশ্যই তার গর্দান নেওয়া হবে। অতএব কার এমন বুকের পাটা যে, দরজা খুলবে। আর দরজাগুলোর চাবি বামন ভাঁড়ের জিম্মায়, টাকে গুঁজে রাখা হয়েছে।

    একটু পরেই রাজা মশাই অদ্ভুত সাজে সজ্জিত সাত মন্ত্রীকে নিয়ে একেবারে জনপূর্ণ হলঘরটার কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হলেন।

    এবার হৈ হট্টগোল আর চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার মধ্যেই যেন পালিয়ে আত্মরক্ষার তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আবার নিজের নিরাপত্তার জন্যও অনেকে অতিমাত্রায় ঠেলাঠেলি গুঁতোগুতি শুরু করে দিল। কারণ, ভিড়ের চাপে পায়ের তলায় পড়ে চ্যাপটা হওয়ার আশঙ্কাও কম নেই।

    ঠিক তখনই সবাই একেবারে অভাবনীয় এক দৃশ্যের মুখোমুখি হলো। দেখা গেল, শেঁকল থেকে যে সুদৃশ্য ঝাড়বাতিটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যেটাকে তখনকার মতো স্থানান্তরিত করা হয়েছে, সেটা ক্রমেই নিচে নামছে। সেটা নামতে নামতে তিন ফুটের মধ্যে নেমে এসেছে। পরে আর নামবে কি না তাই বা কে জানে?

    এদিকে রাজা মশাই সাত মন্ত্রী–ওরাংওটাংদের নিয়ে হলঘরটা চক্কর মেরে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হলেন, সে শেঁকলটা অবশ্যই হাতের নাগালের মধ্যে অবস্থান করছে। বামন ভঁড়টা তার আঁকা-বাঁকা পায়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাদের পিছন পিছন সর্বক্ষণ হাঁটাহাটি করতে করতে নানাভাবে উৎসাহিত করতে লাগল। এবার সে খুবই অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। ঝাড়বাতির শেঁকলটার সঙ্গে ওরাংওটাংদের বেঁধে রাখা শেঁকলের প্রান্ত দুটোকে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে বেঁধে দিল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে শেঁকলে এমন টান লাগল যে, সাত-সাতটা জানোয়ারই অদ্ভুতভাবে শূন্যে ঝুলতে লাগল।

    ইতিমধ্যে মুখোশ নৃত্যের দলটার ভয়-ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে গেছে। এতক্ষণে ওরাংওটাংরূপী মন্ত্রি মহোদয় নিশ্চিত হতে পেরেছেন, পুরো ব্যাপারটা একটা পরিকল্পনামাফিকই সম্পন্ন করা হচ্ছে। আর পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই মজা আনন্দ লাভ সম্ভব হচ্ছে, আরও হয়তো হবে। এবার তারা আকস্মিক আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে অট্টহাসি হাসিতে ফেটে পড়ার যোগাড় হলেন। বামন ভাঁড় চেঁচিয়ে উঠল–ছেড়ে দাও, ওদের আমার হাতে ছেড়ে দাও। তার কর্কশ ও উচ্চগ্রামের কণ্ঠস্বর সবার কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে হলঘরের সর্বত্র ঘুরপাক খেতে লাগল–ওদের আমার হাতে ছেড়ে দাও।

    তারপর সে আবার আগের মতো তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল–মনে হচ্ছে ওরা আমার পরিচিত, চিনি। মুখোশগুলো উঠিয়ে মুখগুলো দেখতে পারলেই নিঃসন্দেহ হতে পারব–ওরা কারা, কী-ই বা ওদের পরিচয়।

    কথা বলতে বলতে সে অনবরত হাত-পা ছুঁড়ে ব্যাঙের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ভিড় ঠেলে একেবারে দেওয়ালের কাছে চলে গেল। একেবারে ছো মেরে পরীর হাত থেকে জ্বলন্ত বড় মশালটাকে ছি নিয়ে নিয়ে একই রকমভাবে লাফাতে লাফাতে আগের জায়গাই ফিরে এলো।

    একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে বার কয়েক লাফালাফি দাপাদাপি করার পর অতর্কিতে বানরের মতো একটা লম্বা লাফ দিয়ে একেবারে রাজা মশাইয়ের মাথার ওপর চেপে বসল। হাত বাড়িয়ে ঝুলন্ত সেঁকলের প্রান্তটা ধরে অদ্ভুত কৌশলে বানরের মতোই ঝুলতে ঝুলতে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল এবার হাতের জ্বলন্ত মশালটাকে উঁচু করে ধরে, পরমুহূর্তেই সেটাকে এদিক-ওদিক বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওরাং ওটাং-এর দলটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্ত। ওরা কারা তা আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারব, এবং বলে দিতে পারব।

    হলঘরের সবাই এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার যোগাড় হলো। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল, হাসতে হাসতে এওর গায়ৈ লুটিয়ে পড়তে লাগল। আর বামন ভঁড়নিজে বার বার অদ্ভুত কৌশলে ও বিচিত্র স্বরে শিস দিতে লাগল।

    ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে ঝুলন্ত শেঁকলটা একটামাত্র হেঁচকা টানে অনেকখানি ওপরে উঠে গেল। আর সেটার সঙ্গেই বিভ্রান্ত ও অস্থিরচিত্ত ওরাংওটাংও যন্ত্রচালিতের মতোই ওপরে উঠে গিয়ে বামনের মতোই ঝুলতে লাগল।

    তারা তখন স্কাইলাইটা আর হলঘরটার মেঝের প্রায় মাঝামাঝি একটা জায়গায় বানরের মতোই ঝুলতে লাগল, থেকে থেকে দোলও খেতে লাগল।

    বামন ভাঁড় তখনও কিন্তু তাদের আগের দূরত্বে অবস্থান করে হাতের জ্বলন্ত মশালটাকে তাদের দিকে হেলিয়ে ধরে রাখল। তার মশাল আর চোখ-মুখের ভাব ভঙ্গি এমন যেন তাদের পরিচয় জানার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

    ওরাংওটাংদের ঝুলন্ত অবস্থা আর মুখের ভঙ্গি চাক্ষুষ করে হলঘরের সবাই যেন বিস্ময়ে ভিমরি খাওয়ার যোগাড় হলো। মিনিট কয়েক কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হলঘরে নেমে এলো যেন কবরখানারনিস্তব্ধতা। কেবলমাত্র একটা ফ্যাসফ্যাস শব্দ সে নিচ্ছিদ্র নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে থেকে থেকে ঘরময় চক্কর মারতে লাগল, রাজা মশাই। এবং তার সভাসদ মন্ত্রীরা আগেও যে-রকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। নীরব চাহনি মেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে সবাই উৎকর্ণ হয়ে শব্দটার উৎস সম্বন্ধে ধারণা নেবার চেষ্টা করল। শব্দটা যে কোথা থেকে আসছে, সে বিষয়ে এবার কারো মনে তিলমাত্র সন্দেহই রইল না। শব্দটার উৎসস্থল বামন ভাঁড়ের দাঁতের পাটি দুটো। সে দুটোর বার বার ঠোকাঠুকির ফলেই সে বিচিত্র শব্দটা সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহও রইল না। আর তার মুখ থেকে অনবরত ফেণা ঝরছে। রাজা মশাই আর

    তার সভাসদ মন্ত্রীদের উলটে-থাকা মুখের দিকে কৌতূহলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।

    ক্রোধোন্মত্ত বামন ভাঁড় শেষমেষ বলে উঠল–উফ! যে! আঃ হা! বহু চেষ্টার পর এবার বুঝতে পারলাম, ওরা সত্যিকারের ওরাংওটাং নয়। আর এও বুঝতে পারলাম ওরা কারা।

    পরমুহূর্তেই মশালটাকে রাজা মশাইয়ের গায়ের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে তার মুখটাকে ভালোভাবে দেখার ভান করতে লাগল। ব্যস, চোখের পলকে তার গায়ের ফোলানো ফাঁপানো শোন পাটের আঁশগুলোর গায়ে আগুন ধরে গিয়ে চোখের পলকে সবকিছু পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল। আর ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই বানরের মতো তিড়িংবিড়িং করে লাফা-লাফি দাপাদাপি করতে লাগল।

    এদিকে হলঘরে, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে হাহাকার হা-হুঁতাসে লিপ্ত হলো। সাধ থাকলে তাদের সামান্যতম সাহায্য করাও সম্ভব হলো না।

    শেষপর্যন্ত মশালের আগুনের শিখা ক্রমে বাড়তে লাগলে বামন ভাঁড় উপায়ন্তর না দেখে শেঁকল বেয়ে উপরে উঠে আগুনের এলাকার বাইরে উঠে যেতে লাগল। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে দর্শকরা কিছুক্ষণের জন্য আবার নীরব হয়ে গেল। সবাই একেবারে নির্বাক-নিস্তব্ধ।

    বামন ভাঁড় সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। সে আবার মুখ খুলল–আমি কি বলছি, আপনারা ধৈর্য ধরে শুনুন।

    দর্শকরা প্রায় সমস্বরে বলে উঠল কী? কী বলতে চাইছ?

    মুখোশধারীরা কোন চরিত্রের মানুষ, এখন আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি।

    ওরা কারা? কোন চরিত্রের মানুষ খোলসা করে বল।

    ওদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং মহারাজা, আর অন্যান্যরা হচ্ছে তার সভাসদ– মন্ত্রী।

    রাজা মশাই! আমাদের রাজা মশাই!

    হ্যাঁ, ঠিক তাই। যে রাজা একটা অসহায় নিরীহ ম্র স্বভাবের মেয়েকে আঘাত করতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হন না, আর সাত মন্ত্রীর চরিত্র এমনই যে, যারা এমন একটা জঘন্য অত্যাচাকে হাসিমুখে সমর্থন করেন।

    এ কী অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছ হে? আমাদের রাজা মশাই–

    দর্শকদের কথার জবাব দিতে গিয়ে বামন ভাড় এবার অধিকতর দৃঢ়তার সঙ্গে বলল–হ্যাঁ, ঠিক তাই। যা বললাম, শতকরা একশো ভাগই সত্য। যাক গে, এবার আমার নিজের পরিচয় দিচ্ছি। সবাই শুনুন আমি নিজেই তো তোমাদের ভালোলাগা ভাড়, রসিকলাল।

    আর এও শুনে রাখ, আমার সর্বশেষ তামাশা এটাই।

    সে কী কথা হে! সর্বশেষ তামাশা বলছ কেন? তুমি কি আর—

    না, আমি আর কোনোদিনই তামাশা দেখাতে উৎসাহি হব না।

    বামন ভড়ের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই আলকাতরা আর শনপাট–অস্বাভাবিক দাহ্য পদার্থ দুটোর সংমিশ্রণে জ্বলন্ত আগুনে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হতে শুরু করল।

    কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আট-আটটা ঝলসানো, আধ-পোড়া কালো মৃতদেহ শেঁকলের গায়ে ঝুলতে লাগল।

    মৃতদেহগুলোকে লক্ষ্য করে পঙ্গু বামন ভঁড় রসিকলাল তার হাতের জ্বলন্ত মশালটা দুম্ করে ছুঁড়ে দিল। পরমুহূর্তেই বানরের মতো দ্রুত গতিতে সিলিং পর্যন্ত উঠে স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে চোখের পলকে লাপাত্তা হয়ে গেল।

    হলঘর ভর্তি দর্শকরা ঘাড় বাঁকিয়ে কৌতূহলমিশ্রিত অনুসন্ধিৎসু নজরে বামন ভড়টার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু হায়! সে যে কোথায় অদৃশ্য, কর্পূরের মতো উবে গেল, তার হদিশ কেউ-ই পেল না।

    দর্শকদের সবাই নিঃসন্দেহ হল, ত্রিপেত্তাই হলঘরটার ছাদের ওপর অবস্থান করে তার প্রাণের বন্ধু বামন ভাঁড় রসিক লালের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে সহায়তা করেছে।

    তারপর? সবশেষে? সবশেষে তারা দুজনেই গোপনে নিজেদের দেশে চম্পট দিয়েছে। তাদের আর কেউ কোনোদিন চোখে দেখতে পায়নি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }