Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    দ্য ম্যান অব দ্য ক্রাউড

    যাদের বই পড়ার খুবই বাতিক রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি–খবরদার! একটা বই কিন্তু কোনোদিনই পড়ার জন্য উৎসাহি হবেন না। সবার মুখেই একই কথা, এ-বইটা নাকি না পড়াই ভালো। এই বিশেষ বইটা জার্মান ভাষায় লেখা হয়েছে। সে যা-ই হোক, এটাকে কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলবেন।

    সত্যি কথা বলতে কি, বহু গোপন ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে যা না বলা যেমন ভালো, ঠিক তেমনই না শোনাও কম ভালো নয়।

    একটা ব্যাপার প্রায়ই লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, পাপের বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলার জন্য অনেকেই মৃত্যুর সময় দারুণ অস্থির হয়ে পড়ে, রীতিমত কাড়াতে থাকে। চোখের সামনে তাদের সে অসহ্য যন্ত্রণা দেখা যায় না।

    এতকিছু সত্ত্বেও গোপন কথা কিন্তু শেষপর্যন্ত অন্ধকার গোপন অন্তরালেই থেকে যায়। বিভীষিকায় ভরপুর মনটা কেবলমাত্র কবরের অন্ধকারে আশ্রয় পাওয়ার পরই শান্তি, স্বস্তি লাভ করে, আগে নয়। একমাত্র সেখানেই কৃত অপরাধের অবসান ঘটতে পারে, তার আগে নয়–অবশ্যই নয়।

    দিন কয়েক আগেকার কথা। সেদিন সন্ধ্যায় আমি লন্ডনের ডি-কফি হাউসের অতিকায় জানালায় ধারে চেয়ার পেতে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম।

    দীর্ঘদিন আমাকে রোগ শয্যায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কাটাতে হয়েছে। এখন একটু একটু করে রোগটা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। ক্রমে স্বাভাবিকতা ফিরে পাচ্ছি। আগের শক্তি সামর্থ্য ফিরে আসছে, মনও ক্রমেই চাঙা হয়ে উঠছে। এমন সময়টা যেমন আনন্দদায়ক, ঠিক তেমনই আরামদায়কও বটে। ধীর গতিতে শ্বাস নেয়া আর ছাড়ার মধ্যেও কম আনন্দ পাওয়া যায় না। আর ছোটখাট কষ্ট-যন্ত্রণাগুলোও কম আনন্দের সন্ধান দেয় না।

    আমি রেস্তোরাঁর জানালার ধারে চেয়ারের শরীর এলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের ওপর চোখের মণি দুটো বুলিয়ে আর চুরুট থেকে অনবরত ধোয়া ছেড়ে কাটিয়ে দিয়েছি। আর ঘরে যারা আসা যাওয়া করছে, তাদের চাল-চলন আর কথাবার্তা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেছি। আসলে কাজ না থাকলে যা হয়।

    তারপর সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ঘনিয়ে এলে ঘোলাটে কাঁচের মধ্যদিয়ে রাস্তার ওপর চোখের মণি দুটোকে অলসভাবে বুলোতে লাগলাম।

    লন্ডনের যে কয়টা রাস্তায় সারাদিন অস্বাভাবিক ভিড় আর ঠেলা-ধাক্কা লেগেই থাকে, তাদের মধ্যে এটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। না, কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য বললে ঠিক বলা হবে না, এটাতেই সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায়। মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়ার মিছিল যেন সবসময় লেগেই থাকে।

    আর দিনের বেলা তো ঠেলা-ধাক্কা এড়িয়ে পথ চলাই সমস্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে ভিড় বাড়তে বাড়তে এমন একপর্যায়ে পৌঁছায় যা আর কহতব্য নয়।

    ল্যাম্পপোস্টগুলোর মাথায় টিম টিম করে বাতি জ্বালার পর যে দিকেই চোখ ফেরানো যাক না কেন, দেখা যায় কেবল মাথা। যেন রাস্তা দিয়ে মাথাগুলো মিছিল করে চলেছে। দেখলাম, পিঁপড়ের মতো সাড়ি বেঁধে মাথা যাচ্ছে আর আসছে। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ যেমন ক্রমাগত বয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে একই গতিতে, একই তালে।

    কিন্তু কই, ইতিপূর্বে এ-জায়গায় তো মানুষকে এমন মিছিল করে যেতে দেখিনি।

    জানালা দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আমি জনসমুদ্রের মেলা চাক্ষুষ করে চলেছি। এভাবে কিছুটা সময় কাটানোর পর হোটেলের যাবতীয় আকর্ষণ উপেক্ষা আমি অপলক চোখে পথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ঠায় বসেই রইলাম।

    কই, এতক্ষণ ব্যাপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিনি, দেখার প্রয়োজনও বোধ করিনি এতটুকুও। কেবলমাত্র পথচারীদের নাচন-কোদনের দিকেই নিজের চোখ ও মনকে ব্যস্ত রেখেছি।

    শেষপর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে লক্ষ করলাম, অসংখ্য আকৃতি আর প্রকৃতি, পোশাক পরিচ্ছদ, চালচলন, মুখভঙ্গি আর পদচালনা আর মুখাবয়ব প্রভৃতি।

    পথচারীদের মধ্যে অধিকাংশকে খুবই আত্মতুষ্ট মনে হলো। কাজকর্মই যেন তাদের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। পৃথিবীতে অন্য আর যে সব ব্যাপার স্যাপার আছে সবকিছুতেই তারা যেন দারুণ উদাসীন।

    পথচারীদের ব্যাপার দেখে আমার মনে এ-ভাবনাই জাগল যে, লম্বা-লম্বা পায়ে হেঁটে গেলেই বুঝি মুক্তি-পথের সন্ধান পেয়ে যাবে। এর-ওর গুঁতো খেয়ে এলোমেলো হয়ে-যাওয়া পোশাক-পরিচ্ছদ গোছগাছ করতে করতেই তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে চলেছে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। অন্য আর একটা দল যাদের গান শেষ করা সম্ভব নয়। এরাও কিন্তু একইরকম ব্যস্ত হয়েই পথ পাড়ি দিচ্ছে। আর চোখ-মুখ লাল করে, এক নিকাসে কথা বলে চলেছে পথ চলতে চলতেই। এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সামান্যতম সময়ও তাদের নেই। আশ্চর্য তাদের ব্যস্ততা।

    সব মিলিয়ে তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারে এবং মার্জিত রুচিসম্পন্ন নর-নারী, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।

    পথচারীদের মধ্যে কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শেয়ার বাজারের দালাল, কেউ উকিল আবার কেউ-বা নিছকই বনেদী পরিবারের মানুষ। এদের কেউ-ই কিন্তু জোর করে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না।

    জনসমুদ্রের মাঝে কেরাণি জাতটাকে খুব বেশি করে আমার নজরে পড়ছে। এদের মধ্যে আবার দুটো বিশেষ ভাগ রয়েছে। নামজাদা প্রতিষ্ঠানের অধঃস্তন কেরাণিরা আঁটসাঁট কোট-প্যান্ট, চকচকে ঝকঝকে বুট জুতা, তেল জবজবে চুল আর সচেতন ঠোঁট নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে।

    পাশের লোকদের পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যাবার মুহূর্তে তারা বড়ই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে। এ থেকেই অনুমান করে নেওয়া যেতে পাওে, এরা সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের দলভুক্ত?

    পরনের বাদামি, না হয়তো কালো কোট আর পা-জামা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা কেরাণিকূল। আরাম-আয়েশ করে বসতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেভাবেই ঢিলেঢালা করে পা-জামাটা তৈরি। আর এরা গায়ে ওয়েস্ট কোট অবশ্যই চাপাবে, আর গলায় জড়াবে মাফলার। আর সবাই চওড়া জুতা পায়ে দিয়ে থপ থপ করে পথ পাড়ি দিচ্ছে। লম্বা মোজা জোড়াকে টানাটানি করে একেবারে হাঁটু অবধি তুলে দিয়েছে।

    আর এদের প্রায় প্রত্যেকের চুল নেই বললেই চলে। আবার কারো কারো মাথায় ইয়া বড় টাক চক চক করে। অদ্ভুত কায়দায় ডান কানটা, বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দিনের পর দিন কলম গুঁজে রাখায় কানের হাল এরকম হয়েছে।

    কোটের পকেটে খুঁজে দেওয়া হয়েছে গোলাকার ঘড়ি। তার ধাতব স্টেকলটায় আলো পড়ে ঝকঝক করছে। এগুলো সবই যে সাবেকি আমলে তৈরি ঘড়ি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অভিজাত ফুটিয়ে তোলার সাধ্যাতীত প্রয়াস এভাবেই চালানো হয়েছে। শুধু কি এ-ই? মাথা থেকে টুপিটা খুলে এহাত-ওহাত করে নাচাতে নাচাতে কেউ কেউ চলছে, এরকম দৃশ্যই বিরল নয়। আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কেরাণিরা কত কায়দাই যে জানে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

    খুবই চটপটে স্বভাবের মনে হচ্ছে, তাদের এক নজরে দেখলেই ধরে নেওয়া যায়, পকেট মারা এদের নেশা। বড় বড় শহরের জনবহুল রাস্তায় এরা দলে দলে ঘুরে বেড়ায়। এদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর চালচলন দেখলেই এদের চিনে নেওয়া যায়, এরা কোন ধান্ধায় পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এরা যত, যা-ই বলুক না কেন, সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ বলে এদের কিছুতেই ভুল হবে না। এদের পরিচয় পাওয়া যায়, কোমরের চওড়া বেল্ট–আগ বাড়িয়ে আলাপ জমানো আর কথা বলার আগ্রহ দেখে।

    আর জুয়াড়িদের চিনতেও অসুবিধা হবার কথা নয়। ওই যে হরেক রকমের পোশাক-পরিচ্ছদ গায়ে চাপিয়ে খুশি মেজাজে পথ চলেছে, ওরা কারা? জুয়াড়ি। হয় জুয়ার আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছে, নতুবা সান্ধ্য জুয়ার আড্ডায় সামিল হতে চলেছে। দেখেছেন না, কেমন সবাই কেতাদুরস্ত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর ঝলমলে পোশাক গায়ে চাপিয়ে একেবারে ফুলবাবু সেজে এরা পথচারীদের ভিড়ে এমনভাবে মিশে পথ চলেছে যে, কার বাপের সাধ্য এদের পেশা সম্বন্ধে সামান্যতমও ধারণা করতে পারবে।

    কিন্তু যাদের বিভিন্ন পরিবেশ এবং এখানকার মানুষের বিভিন্ন পেশা সম্বন্ধে কিছু ধারণাও আছে, তাদের চোখে জুয়াড়ি নিজেদের লুকোবার চেষ্টাকে অপচেষ্টা ছাড়া আর কি-ই বলা যেতে পারে। এদের কেউ ফুলবাবু সেজেছে আর কেউ বা পাদরির পোশাক গায়ে চাপিয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেছে।

    আরও দুটো লক্ষণ দেখে জুয়াড়িদের অতিরিক্ত দুটো দলকে চিনতে অসুবিধা হলো না। তাদের একটা লক্ষণ হচ্ছে, চাপা গলায় কথাবার্তা বলছে। আর দ্বিতীয়ত অন্যান্য আঙুল থেকে এমনভাবে নব্বই ডিগ্রি কোণে ঠেলে তুলেছে বুড়ো আঙুলটাকে যেন তাস সাফাইয়ের অভ্যাসটা রপ্ত করছে। আসলে তার সাফাইয়ের কারসাজির ব্যাপারটা সর্বক্ষণ এদের মাথায় ঘুরপাক খায়।

    আর দুরকম ঠকবাজ পথে ভিড়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখা যায়–যারা কথা বেচে লোক ঠকিয়ে মালকড়ি কামায়। এদের একদল রীতিমত রাজা-বাদশা সেজে রয়েছে। আর অন্য দলটা মিলিটারির কায়দায় থেকে পা ঠুকছে।

    পথচারীদের শ্রেণি বিভাগ করতে করতে ভিড় ঠেলে এক সময় হাজির হলাম ইহুদি ফেরিওয়ালাদের মেলে। কথাবার্তা আচরণ দেখলে মনে হবে এদের থেকে নিরীহ মানুষ পৃথিবীতে আর মিলবে না। কিন্তু নজর এদের বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ। মালকড়ি দেখলেই যেন অতর্কিতে ছোঁ মেরে বসবে।

    আর দেখলাম অদৃষ্টবিড়ম্বিত ভিখারীদের। যারা ভাগ্যেরনিদারুণ আঘাতে জর্জরিত হয়েও আশায় আশায় ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন কিছুতেই মরতে রাজি নয় বলেই এর-ওর সামনে ভিক্ষাপাত্রটা ধরছে। একজনের কাছ থেকে হতাশ হয়েও আবার সেটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে অন্য জনের সামনে। এরা ভালোই জানে, জীবনে বাঁচা মানেই লড়াই, লড়াই করেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হবে।

    বিধাতা লাঞ্ছিত ভিখারীগুলোর আয়ু প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বুঝতে পেরেনও লোকের সহানুভূতি প্রার্থনা করে। নিতান্ত ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে নিরানন্দ কুঠরির দিকে যাওয়ার পথেও গুণ্ডা বদমায়েসদের গা জ্বালা করা ফচকিমি আর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে খেয়ে অল্প-বয়সী মেয়ে ভিখারী সমানে চোখের পানি ঝরাচ্ছে।

    আবার এমন একদল মেয়েকে দেখা যাচ্ছে যারা ঝলমলে পোশাকে প্রায় অস্তমিত যৌবনকে ঢেকে রেখে গায়ে মুখে রঙের প্রলেপ গায়ে চাপিয়ে পাপের ধান্ধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর খদ্দের পাকড়াও করার ধান্ধায় প্রতিনিয়ত ছোঁক ছোঁক করছে।

    আর গলা পর্যন্ত মদ গিলে মদ্যপরা উদাসীনভাবে, বার-বার এদিক-ওদিক ঠোকার খেতে খেতে পথ পাড়ি দিচ্ছে। আর কারো পা এমন টলমলে, যে কোনো মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে পারে। তাদের কারো গায়ে দীনবেশ, কারো পোশাক ছিন্নভিন্ন আর হরেক দাগ-লাগা। এরা সংখ্যা অগণিত। তাই তাদের কত আর বিবরণ দেওয়া সম্ভব?

    আর দলে দলে কাতারে কাতারে চলেছে বিচিত্র পোশাক গায়ে চাপিয়ে, গায়ে কালিঝুলি মাখা কয়লা খিনর শ্রমিক, কারখানার শ্রমিক, কুরিকামারী, রাজমিস্ত্রি, ব্যালে নাচিয়ে, বাজনা বাজিয়ে, বাদর খেলুড়ে আর ঝাড়দারের দল। হরেকরকমভাবে গতর খাঁটিয়ে পয়সা রোজগার করে এরা দিনের শেষে মাথা গোঁজার আস্তানায় ফিরে চলেছে। আমার জানালার ধার দিয়ে যাবার সময় এরা এমন বিচিত্র স্বর আর অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছিল, যা শুনে আমার কান ঝালাপালা করেই দিচ্ছিল না কারো কথায় হাসি রেখা দায় হয়ে পড়ছিল, আবার কারো কথায় চোখের কোণে পানি ভিড় করার উপক্রম হয়ে পড়ছিল।

    সত্যি বিচিত্র লন্ডন শহর। আরও বিচিত্র এখানকার মানুষগুলোর চরিত্র আর জীবনযাত্রা প্রাণালী!

    এভাবেই কর্মক্লান্ত মানুষগুলো দিনের শেষে নিজের নিজের আস্তানায় ফিরছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। অন্ধকার ক্ৰমে গাঢ় হয়ে পড়ায় গ্যাসের বাতিগুলো যেন ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল।

    রাত বাড়ার সঙ্গে দ্র-সম্ভ্রান্ত নাগরিকরা নিজ-নিজ আস্তানায় মাথা গুঁজে অবশিষ্ট রাতের ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিতে লাগল। হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তা-ই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে কালসীটে পড়া রাতে রানিরা দলবেঁধে অন্ধকার গহ্বর থেকে আলোয় বেরিয়ে আসতে লাগল। তাদের যে না এসে উপায় নেই, কারণ, অন্ধকারের। অতিথি-রাজপুত্ররা যে বুকভরা তৃষ্ণা নিয়ে অনবরত হাপিত্যেশ করে চলেছে। তাদের। তৃপ্তিদানের দায়িত্ব যে অলিখিতভাবে তাদের ওপরই বর্তেছে। তাদের যত দেখছি ততই আমার আগ্রহ ঘনীভূত হচ্ছে।

    আমার চোখের সামনে বিচিত্র সব মানুষের মিছিল। বিচিত্র চরিত্রের লেবেল গায়ে এঁটে সবাই নিজনিজ গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের চোখের চাহনি লন্ডন শহরের চরিত্র স্পষ্টতর করে তুলেছে। সত্যি অদ্ভুত শহর লন্ডন।

    আমার কৌতূহল, আগ্রহ উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আমি চেয়ারটাকে সামান্য টেনে কাঁচের জানালাটার একেবারে গা-ঘেঁষে বসলাম। অত্যুগ্র আগ্রহ নিয়ে আমি আবার জানালা দিয়ে পথের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই বিশেষ একটা মুখের ওপর আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। আমার হাল এমন হলো যে, কিছুতেই সে চোখটার ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

    কোন মুখ, কার মুখ এটা? এ মুখের মালিকের বয়স কম হলেও পয়ষট্টি থেকে সত্তর তো হবেই। আশ্চর্য ব্যাপার। নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত হলাম। ওই ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে লোকটার মুখে এমনকি আছে যার জন্য আমাকে এমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে!

    সে মুখটা থেকে চোখ দুটোকে সরাতে তো পারলামই না উপরন্তু আমার সত্ত্বাটা যেন অত্যাশ্চর্য মুখটার অদ্ভুত অধিকারীর ওপর আমার মানব মনের কথা জানবার, চিনবার আর বুঝবার আগ্রহ উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

    আমার মনটা কেন হঠাৎই এমন উদ্গ্রীব হয়ে পড়ল? ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে গোছের লোকটার বিশেষতৃগুলোই আমার চোখ আর মনকে এমন করে প্রভাবিত করেছে।

    কী মহাসমস্যাই না পড়া গেল। ওই ছন্নছাড়াটার বিশেষত্বগুলো যে কি তা কাউকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ পীড়াপীড়ি করলে আমি শুধুমাত্র এটুকুই বলতে পারব, ওই রক্তমাস চামড়ার মুখটায় এমন সব ভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল, যার তুলনা অন্য কোনো মানুষের সঙ্গেই করা সম্ভব নয়। সত্যি বলছি, এমন কোনো মুখের আদল, অন্য কারো মুখে ইতিপূর্বে কোথাও দেখিনি, ভবিষ্যতেও দেখব বলে সন্দেহ যথেষ্টই। তার বিবরণ নেহাৎ যদি দিতেই হয় তবে একটাই উদাহরণ আমার মাথায় আসছে, নরকের পিশাচ বুঝি দলছুট হয়ে লন্ডনের পথে নেমে এসেছে।

    অকস্মাৎ আমার মনের জমাটবাধা বিস্ময়টুকু কেটে গেল। আমি হঠাৎ একেবরে হঠাৎ চমকে উঠলাম। এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, অখ্যাতির কুটিল ইতিহাসকে।

    আমি মুহূর্তের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, রাতের এ অতিথির মুখটাকে কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেব না, কিছুতেই না। মুখটার অধিকারী ছন্নছাড়া লোকটাকে অনুসরণ করব। মোদ্দাকথা, আমি আঠালির মতো তার সঙ্গে লেগে থাকব।

    তার পিছন পিছন গিয়ে আমি অজানাকে জানব, অচেনাকে চিনে নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝোলাটাকে বোঝাই করে নেব। মুহূর্তের মধ্যেই হাত বাড়িয়ে ওভারকোটটা নিয়ে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। বাজপাখির মতোই ক্ষীপ্রগতিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

    আমি পথে নেমে রাতের অতিথিকে আর দেখতে পেলাম না। এটুকু সময়ের মধ্যে সে যে কোথায় মিলিয়ে গেল, কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। অনুসন্ধিৎসু চোখে এদিক-ওদিক তাকালাম। না ভো ভো।

    আপন মনে বলে উঠলাম–যা বাবা! উদ্ভট লোকটা কী কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেল নাকি?

    লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলাম। অতর্কিতে দেখতে পেলাম, আমার বাঞ্ছিত লোকটা লম্বা লম্বা পায়ে চলে যাচ্ছে। আমি ততধিক ব্যস্ত পায়ে হেঁটে অচিরেই তাকে ধরে ফেললাম। সে আপন মনে হেঁটেই চলেছে।

    আমি তার সঙ্গে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করেই চললাম। কোনো পরিস্থিতিতে তার একেবারে কাছাকাছি গেলাম না। সে যাতে বুঝতে না পারে, আমি তার পিছু নিয়েছি, সেজন্য বিড়ালের মতো সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে চলতে লাগলাম। তবে এও সত্য যে, আমি আঠালির মতো তার সঙ্গে সেঁটেই রইলাম।

    রাতের অতিথি হাঁটতে হাঁটতে গ্যাস বাতির কাছাকাছি যেতেই আমি এবার তার মুখটাকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেলাম।

    লোকটা কিন্তু খুব ধিঙি লম্বা নয়, বরং মোটামুটি বেঁটেখাটই বলা চলে। আর খুবই রোগাটে। হাড়ের ওপর মাংস নেই বললেই চলে। আপাত দৃষ্টিতে খুবই ক্ষীণজীবি বলেই মনে হয়। তার গায়ের জামাটামা সবই ছেঁড়াফাড়া আর ময়লা তেল চিটচিটে। তবে সবই দামি কাপড়েরর আর ডিজাইনও মনোলোভা।

    আমি তাকে অনুসরণ করতে করতে বার-বার তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ। করতে লাগলাম। এক সময় সচকিত হয়ে একটা বিশেষ বস্তুর ওপর আমার দৃষ্টি স্থিও, নিবদ্ধ হয়ে গেল। পথের ধারের গ্যাসের উজ্জ্বল বাতিতে তার পাতলা পোশাকের আড়াল থেকে লুকিয়ে রাখা ছোরার ফলাটা আর হীরার আর চোখের সামনে ঝলমলিয়ে উঠল।

    বস্তু দুটোর দিকে আমার নজর পড়তেই আমার আগ্রহ চড়চড় করে বেড়ে যেতে লাগল। তাকে অনুসরণের ইচ্ছাও মুহূর্তে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল।

    ইতিমধ্যে রাত বাড়তে বাড়তে অনেকই হয়ে গেছে। কুয়াশাও বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমেল বাতাস বইতে লাগল। ব্যস, যা আশঙ্কা করেছিলাম কার্যত হলো তাই। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। সে কী বৃষ্টি। আকাশে যেন কুঁড়েফেঁড়ে গেছে। একা রামে রক্ষা নেই, তার ওপর সুগ্রীব দোসর।

    বরফ-শীতল বৃষ্টির পানিতে ভিজে আমি একদম জবজবে হয়ে গেলাম। যাকে বলে একেবারে কাক ভেজা। তার ওপর হিমেল বাতাস যেন রেষারেষি করে আমাকে রীতিমত জেঁকে ধরল। আমার কঙ্কালের ওপর বৃষ্টি আর বাতাস এমন নির্মমভাবে তাণ্ডব চালাতে লাগল যে, আমার হাড়গুলো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি শুরু করে দিল। আর দাঁতের পাটিতে পাটিতে এমন ঠোকাঠুকি চলতে লাগল যেন বাদ্যকর তারনিপুণ হাতে অনবরত বাদ্য বাজিয়ে চলেছে।

    আবহাওয়ার এমন আকস্মিক পরিবর্তন পথে মিছিল করে এগিয়ে চলা মানুষগুলোর মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষিত হলো। সবার মধ্যে অস্থিরতা তো দেখা দিলই, সে সঙ্গে ঝপটপ অসংখ্য ছাতা খুলে গেল।

    আমি বৃষ্টি আর বাতাসের খপ্পরে পড়ে ঠাণ্ডায় ঠক্ করে কাঁপলেও ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা অব্যক্ত পুলকানন্দ অনুভব করতে লাগলাম। সবেই তো ব্যামো থেকে উঠেছি, আবারওনির্ঘাৎ ব্যামোর কবলে আত্মসমর্পণ করতে হবে জেনেও অভাবনীয় আনন্দটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে উৎসাহ পেলাম না।

    নিরাপত্তা অবলম্বন করতে গিয়ে আমি কেবলমাত্র মুখে একটা রুমাল বেঁধে নিলাম।

    বৃষ্টি নামতেই পথচারীরা এমন ঠ্যালাধাক্কা আর গুঁতোগুতি শুরু করে দিল যে, যেন রীতিমত দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেল।

    পথে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেলেও আমি কিন্তু বিচিত্র দর্শন বুড়োটাকে কিছুতেই আমার নজরের বাইরে চলে যেতে দিলাম না। বরং অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

    আধঘণ্টা ধরে পথচারীরা এমন তুমুল কাণ্ডে মেতে রইও যার ফলে যে কোনো মুহূর্তে বুড়োটা আমার নজরের বাইরে চলে যেতে পারত। কিন্তু আমার সতর্কতা আর নিষ্ঠা তাকে সে সুযোগ দিল না। তবে এমন আকস্মিক বিপদের মুহূর্তে আমি এগিয়ে গিয়ে সাধ্যমত তার কাছাকাছি–উভয়ের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে নিয়ে বুড়োটাকে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম।

    খুবই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। আমি এতক্ষণ ধরে বিচিত্র দর্শন বুড়োটাকে নীরবে অনুসরণ করেছি, এর মধ্যে সে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও পিছন ফিরে তাকায়নি। রে আমার উপস্থিতি সম্বন্ধেও ধারণা করা সম্ভব হয়নি।

    আরও কিছুটা এগিয়ে বুড়োটা আড়াআড়ি একটা গলির মতো পথ ধরল।

    এবার কিন্তু বড়টার মধ্যে হঠাৎ একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। সে এখন যেন আগের চেয়ে ধীর-পায়ে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ পাড়ি দিতে লাগল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, যেন নিছক হেঁটে যাওয়ার জন্যই সে হেঁটে চলেছে। তার এ-হাঁটার পিছনে সামান্যতম উদ্দেশ্যও নেই।

    আমি এবার গতি আর একটু বাড়িয়ে দিলাম। কারণ হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক আমার মন-প্রাণ জুড়ে বসল।

    গলি-পথটা যেমন সরু, ঠিক তেমন দীর্ঘও বটে। অহেতুক এমন একটা পথে চক্কর মারতে গিয়েই পুরু একটা ঘণ্টা কেটে গেল। শেষের দিকে ভিড় কিছুটা হালকা হয়ে এলো দেখলাম, একটা পার্কের দিকে বুড়োটা এগিয়ে চলেছে।

    পার্কটা চৌকোণা, বেশ বড়সড়ই। চারদিকে গ্যাসের আলো জ্বলছে। দিনের আলোর মতোই ঝলমল করছে। আর ভেতরে লোক গিজগিজ করছে।

    পার্কে ঢোকামাত্র বুড়োটার মধ্যে আবার পরিবর্তন লক্ষিত হলো। আগের সেই আচরণ তার মধ্যে আবার প্রকাশ পেল।

    দেখলাম, তার থুতনিটা নিজের দিকে অনেকটা ঝুলে পড়েছে। চোখের মণি দুটো আগের মতোই অনবরত ঘুরতে লাগল। তার ধারের কাছ দিয়ে যারা যাচ্ছে, তার না। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ফেলছে, তাদের দিকে এমন কটমট করে তাকাচ্ছে, যেন জ্যান্ত গিলে ফেলবে এক-একজনকে।

    এতক্ষণ পথচারিদের ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এত যার ব্যস্ততা, যাকে বলে ছটফটানি পার্কে ঢোকার মুখে গিয়ে কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, ভেতরে ঢুকল না।

    পার্কের গেটের কাছে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থাকার পর এক সময় সে সচল হলো। পর পর সাতবার পার্কটাকে চক্কর মারল।

    পার্কটাকে চক্কর মারার কাজ সেরে বুড়োটা যে-পথে এখানে এসেছিল, ঠিক সে পথ ধরেই আবার ফিরতে লাগল। কিন্তু ফিরল না। যাওয়া আর ফিরে আসা–আবার যাওয়া আবার ফিরে আসা চলতে লাগল বার কয়েক। আরে ব্যস! এ কী কাণ্ড করছে বিচিত্র দর্শন বুড়োটা!

    একটু পরে হঠাৎ পিছন ফিরে সে একেবারে আমার সামনে চলে এসেছিল। তার হাবভাব দেখে আমিও সুড়ৎ করে এক পাশে চলে এসেছিলাম।

    ভিড়ের মধ্যে এভাবে আসা-যাওয়া করে বুড়োটা আরও একটা ঘণ্টা কাটিয়ে দিল। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেল সে সঙ্গে বাতাসের তীব্রতাও গেল অনেকাংশে বেড়ে। ফলে পথচারীদের সংখ্যা কমতে কমতে অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে।

    এখন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যাপারটা লক্ষ করেই বুড়োটা যেন রাগে ফেটে পড়ার যোগাড় হলো। ক্রোধে সে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগল। ক্রোধের চেয়ে তার মধ্যে হতাশার সঞ্চারই যেন হয়েছে। ফলে মধ্যে যেন হঠাৎ অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখা দিল। হঠাৎ সে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত পা চালিয়ে সে পাশের একটা প্রায় জনবিরল পথে ঢুকে পড়ল।

    লম্বা-লম্বা পা রেখে সে প্রায় সিকি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফেলল। তার ভাবগতিক দেখে আমি তো একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। এ বয়সে এমন লম্বা লম্বা পায়ে কেউ যে হাঁটতে পারে, এটা ভেবেই আমি থ বনে গেলাম।

    বুড়োটাকে নজরে নজরে রাখতে গিয়ে আমার তো মাথার ঘাম পায়ে পড়ার যোগাড় হলো।

    আর কিছুটা পথ এগোতেই বুড়োটার সামনে একটা বাজার পড়ল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে সে যেন আগেকার আচরণ ফিরে পেল। মনে হলো বাজারটা তার খুবই চেনাশুনা। সে একে ধাক্কা দিয়ে, ওকে গুতো দিয়ে ভিড় ঠেলে বাজারটার ভেতরে যেতে লাগল। এমনও আগেকার মতো চোখ কটমট করে প্রত্যেকের দিকে তাকাতে আরম্ভ করল, যা দেখে আমারই যারপরনাই বিরক্তি বোধ করতে লাগল।

    বাজারে চক্কর মেরেই বুড়োটা দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে দিল। সে তো দুকনুইয়ের চাপে ভিড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে চলতে লাগল। কিন্তু আমি? আমার ভাগ্য সত্যি ভালো যে পায়ে পড়া ছিল এমন একটা জুতা, যা পড়ে এক মাইল হাঁটাহাঁটি করলেও সামান্য। আওয়াজও হয় না। এ জন্যই বুড়োটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি আমরা তার পিছনে জোকের মতো লেগে রয়েছি।

    লোকের ভিড়ের মধ্যেই সে দোকানে দোকানে ঢুকে এটা-ওটা অনেক কিছুই দেখল। কিছু তো কিনলই, না এমনকি কোনোকিছুর দাম-দর পর্যন্ত করল না।

    তার অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আমার বিস্ময়কে অধিকতর বাড়িয়ে দিল। আমি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, কিছুতেই বুড়োটার পিছন ছাড়ব না। এর শেষ কোথায় আমাকে দেখতেই হবে।

    সুবিশাল ঘড়িটায় এগারোটার ঘণ্টা বাজল। বাজারের, এমনকি পথে লোকজনের মধ্যে ঘরে ফেরার ব্যস্ততা দেখা গেল।

    একটা দোকানি দোকানের ঝাঁপ ফেলার সময় তার একটা কোণা আচমকা বুড়োটার মাথায় লাগল। সে ক্রুর দৃষ্টিতে তার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকাল। মুখে টু-শব্দটিও করল না। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে এ-গলি, সে-গলি পেরিয়ে সে আবার ডি-হোটেলের সামনের পথে ফিরে এলো। বলাবাহুল্য আমিও এলাম তার পিছন পিছন।

    রাত অনেকই হয়েছে। তবুও এ অঞ্চলনিরিবিলি হয়ে তো পড়েইনি বরং এখন প্রায় জমজমাটই রয়েছে। উজ্জ্বল আলোয় পথঘাট দিনের মতোই ঝলমল করছে। বৃষ্টি জোরেই পড়ছে।

    লোকজনের ভিড় কিছুটা কমে যাওয়ায় বুড়োটার চোখে-মুখে কেমন যেন বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটে উঠল। ভিড়ের অভাবে যেন, সে মিইয়ে গেছে।

    ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুড়োটা আগের মতোই লম্বা-লম্বা পায়ে নতুন একটা পথ ধরে নদীর দিকে এগিয়ে চলল। সে কিন্তু একের পর এক গলি পেরিয়ে নদীর পাড়ে না গিয়ে হঠাৎ একটা রঙ্গালয়ের সামনে পৌঁছে গেল। সবেমাত্র একটা শো ভেঙেছে। পিঁপড়ের ঝাঁকের মতো লোক রঙ্গালয়ের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল, আনন্দ-তৃপ্ত দর্শকরা।

    নতুন করে মানুষের ভিড় দেখে বুড়োটার চোখে-মুখে যেন হাসির ঝিলিক খেলে যেতে লাগল। সে যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেল, এমনই একটা ভাব তার মধ্যে প্রকাশ পেল। আসলে ঠেলাধাক্কার মধ্যে পড়তেই তার অস্বস্তি ভাবটা কেটে গেল। এতক্ষণ যে ভেতরে ভেতরে মিইয়েছিল এখন সে-ই যেন স্বস্তির নিকাস ফেলে বাঁচল। নৈরাশ্যের মেঘ কেটে যাওয়ায় তার সামনে যেন আশার আলো দেখা দিল।

    লোকজনের ভিড় যেদিকে বুড়োটা সেদিকেই লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে দলে ভিড়ে গেল। আমি তার কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে তিলমাত্র বুঝতে না পেরে অন্ধের মতো তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

    নাটক দেখে বেরিয়ে দর্শকরা নিজের নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পথে-পথে ভবঘুরের মতো ঘুরতে যাবেই বা কেন? লোক কমতে কমতে শেষমেশ মাত্র তিনজন এসে ঠেকল।

    একটা প্রায় অন্ধকার গলিপথ ধরে এ-তিনজন থেকেও লোক কমে যাওয়ায় বুড়োটা বিমর্ষ মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। গম্ভীর মুখে কি যেন ভাবল কয়েক মুহূর্ত ধরে। পরমুহূর্তেই তার মধ্যে যেন অদ্ভুত একটা উত্তেজনা ভর করল। এবার উল্কার বেগে একের পর এক গলি পেরিয়ে সে শহরের একেবারে উপকণ্ঠে হাজির হলো।

    এটাকে শহরের সবচেয়ে কুৎসিত এবং সবচেয়ে খারাপ অঞ্চল বলে সবাই জানে। দারিদ্র এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গি, জঘন্যতম অপরাধ করতেও এখানকার মানুষ কিছুমাত্রও ইতস্তত করে না। ঢাকনা-খোলা নালা-নর্দমা প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধ ছড়ায়, বাতাসকে বিষাক্ত করে রাখে। পথের দুধারে যেখানে সেখানে কাঠের ভাঙা কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে এটা জঘন্যতম এক পরিবেশ।

    এমনই এক বিশ্রি পরিবেশের মধ্যদিয়ে বুড়োটা হুটোপাটা করে এগিয়ে চলতে লাগল। আমি যে এখনও তার পিছনে চিনে জেঁকের মতো লেগে রয়েছি, আশা করি এ-কথা আর নতুন করে না বললেও চলবে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই কানে ভেসে এলো অগণিত মানুষের চিৎকার চাঁচামেচি হৈ হুল্লোড়। উঁকি-ঝুঁকি মেরে তাদের দেখতে পেলাম। এরা শহরের সবচেয়ে জঘন্যতম মানুষ। সমাজ থেকে বিতাড়িত মানুষের দলে আমরা এসে পড়েছি, নিঃসন্দেহ হলাম।

    এখানে, এ পরিবেশে পৌঁছেই বুড়োটা যেন আবার উল্লসিত হয়ে পড়েছে। মিইয়ে পড়া লোকটার মধ্যে যেন প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে হাসির ঝিলিক।

    কয়েক পা এগোতেই আমরা আচমকা অত্যুজ্জ্বল আলোতে এসে পড়েছি। বুড়োটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফলে বাধ্য হয়েই আমাকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। এক ভজনালয়ে গেলাম যেখানে নিয়মিত পিশাচ পূজা হয়।

    রাত প্রায় শেষ। পুব-আকাশে দেখা দিল রক্তিম ছোপ।

    কয়েকজন পিশাচ প্রকৃতির জন্য নিশীথ অপদেবতার মন্দিরে জনাকয়েক লোক তখনও আনাগোনা চলছে। বুড়োটা অকস্মাৎ প্রায় অশ্রুস্বরে হেসে উঠল। একে ভয়ার্ত চিৎকার বললেই হয়তো ঠিক বলা হবে।

    বিচিত্রদর্শন বুড়োটা পৈশাচিক প্রকৃতির মানুষগুলোর ভিড়ে মিশে গেল। তার চোখে-মুখে লক্ষ করলাম, বন্য-শূন্য দৃষ্টি।

    অপার্থিব সে ভাবকে প্রকাশ করার মতো ভাব বা ভাষা কোনোটাই আমার নেই।

    এভাবে উন্মাদের মতো সবাই বার কয়েক এদিক-ওকিদক ছুটোছুটি হুটোপাটা করল। ব্যাপার দেখে মনে হলো এবার মন্দিরের দরজায় তালা পড়বে।

    আমি হঠাৎ বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়লাম, বুড়োটার চোখে এক অবর্ণনীয় বেদনার চিহ্ন লক্ষ করলাম। সে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থামল না।

    সে লন্ডন শহরের কেন্দ্রস্থলের উদ্দেশ্যে বিপুল বিক্রমে ধেয়ে চলতে লাগল। সে কী ক্ষীপ্রতার গতি! মুহূর্তের জন্যও সে থামল না। ফলে তার পিছন পিছন আমি তো প্রায় উন্মাদের মতো ছুটতে লাগলাম।

    উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে যখন ডি-হোটেলের সামনে পৌঁছে গেলাম তখন পুব আকাশে সবে সূর্য উঁকি মারতে শুরু করেছে।

    শহরের বুকে তখন অল্প অল্প করে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে, ঠিক এখানেই আমি চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলাম। এরই ফলে আমাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। বুড়োটা কিন্তু থামল না। গত রাতের মতোই সে একে ঠেলে, ওকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। আর পথচারীদের দিকে বন্যশুন্য চাহনি নিক্ষেপ করে এগিয়ে যেতে লাগল আগের মতোই।

    সারাদিন একই রকমভাবে বুড়োটা পথে পথে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। সে থামল না  কিছুতেই।

    আমি এবার হঠাৎ তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। তার চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুড়োটা কিন্তু আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা কথাও বলল না।

    তখনই আমি বুঝতে পারলাম, নিঃসন্দেহ হলাম, এ বুড়োটার পিছন পিছন সারাজীবন ধরে হাঁটলেও তার গোপন কথা, তার গূঢ় রহস্য আর অতীত কাহিনী জানা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, কোনোদিনই না।

    সে যখন পথচারীদের ঠেলে-ধাকে গুতিয়ে গাতিয়ে আমার গা ঘেঁষে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল তখন ঘাড় ঘুরিয়ে আমি স্বগতোক্তি করলাম–চিনেছি, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমিই তো এ শহরের পাপাত্মা। পথচারীদের ভিড়ের ছন্নছাড়া ভবঘুরে অপরাধ। একা থাকতে তুমি উৎসাহি নও। ভিড়ের মধ্যে মিশে তোমার অপরাধকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই তোমার যত আগ্রহ। কিছু কিছু বইয়ের ভেতরে প্রবেশ করা যেমন সঙ্গত নয়, ঠিক এমনই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কিছু মানুষের নাম-গোত্র জানতে উৎসাহি হওয়াওনির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

    না, আর কোনোকিছু বলতে, কিছু করতে চেষ্টা করা নিতান্তই মুখামি। হে নরকের কীটের মতো দুরাত্মা, তোমাকে শতকোটি প্রণাম। তোমার শ্রীচরণে হাজারবার মাথা ঠুকতেও আমি কুণ্ঠিত নই।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }