Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    দ্য লিটারারি লাইফ অব থিংগাস বব এসকোয়ার

    মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। বয়স যে বেড়েছে, এ তো আর মিথ্যা নয়, শেক্সপিয়র কখন পরলোকগমন করলেন, আমাকেও অচিরেই তার পথ ধরতে হবে। তাই ভেবেচিন্তে মনস্থির করে ফেললাম, আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার সাহিত্য-জগৎ থেকে অবসর নিতে হবে।

    খ্যাতিট্যাতি যেটুকু পেয়েছি তা ভাঙিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেব।

    কিন্তু মাথায় যে কর্তব্যও রয়েছে কম নয়, ভবিষ্যৎ-সাহিতব্রতীদের জন্যও তো কিছু রেখে যাওয়া কর্তব্য। তাই মনস্থ করে ফেললাম, ভবিষ্যৎ সাহিতব্রতীদের জন্য কিছু সাধনার কলাকৌশল রেখে যাব।

    বিশ্বাস করি, আমার সাহিত্য-জীবনের গোড়ার দিককার ছবিটা তাঁদের সামনে তুলে ধরতে পারলেই সে কাজ সম্পাদন করা হয়ে যাবে।

    এ তো মিথ্যে নয়, জনসাধারণের চোখের সামনে বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার নাম বহু লেখার মাধ্যমে পড়েছে–জেনেছে।

    আমাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। তাদের অন্তরের গোপন করে আমার মানটা বহু উত্তেজনারই তো সঞ্চার করেছে।

    তাই ভেবেচিন্তে আজ আমি বুঝতে পারছি, যে পথ ধরে আমি শীর্ষে পৌঁছেছি, সে পথের অন্তত কিছু নজির ভবিষ্যতের পথচারীদের সুবিধার্থে রেখে যাব, আমার উচিতও বটে, তা-ই যদি করি তবেই তো আমি নিজেকে মহত্বের অধিকারী বলে মনে করতে পারব।

    একটা কথা তো খুবই সত্য যে, বহুদূরের পূর্বসূরীদের নিয়ে বেশি ঘ্যানর ঘ্যানর করা যে কোনো মানুষের পক্ষে মাত্রার বাইরে চলে যাওয়া বলে মনে করা হয়। বেশি ধানাইপানাই সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাকে তো বাড়াবাড়ি করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না।

    আমি এখন কেবলমাত্র আমার বাবার সম্বন্ধে দু-চার কথা বলব। আমার বাবা ছিলেন একজন খুবই সাধারণ মানুষ–ক্ষৌরকার। গোড়ার দিকে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চুল-দাড়ি কামিয়ে তাদের মাথা-মুখ সাফসুতরা করে দেওয়াই ছিল তার পেশা। পরে অবশ্য একটা চুল-দাড়ি কামাবার কারখানা খোলেন। স্মাগ নগরের একজন নামজাদা ক্ষৌর ব্যবসায়ী।

    নগরের সম্ভ্রান্ত, গণ্যমান্য মানুষগুলো বাবার চুলদাড়ি কাটার দোকানে ভিড় জমাতেন। তারা অনেকেই এমন এক-একজন পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, যার মুখের দিকে চোখ পড়লেই বুকের ভেতরে রীতিমত ধুকপুকানি শুরু হয়ে যেত, সম্মান, খাতির দেখানোর জন্য মন ছটফট করত।

    সত্যি কথা বলতে কি, বাবার দোকানের খরিদ্দারদের এক-একজনকে আমি ভগবানের সমান মনে করতাম।

    তাদের দাড়িতে সাবান মাখাবার সময় তারা যখন মুখ দিয়ে অনর্গল বাছাবাছা কথা বলতে আরম্ভ করত, তখন আমি জ দুটো কুঁচকে, হাঁ করে যেসব কথা শুনতাম, না, শুনতাম বললে একটু কমিয়েই বলা হবে, গিলতাম বলাই উচিত।

    দাড়ি কামাতে বসে গ্যাডফ্লাই পত্রিকার সম্পাদক সাহেব একেবারে পঞ্চমুখে বিশুদ্ধ বব-তেল-এর প্রশংসা শুরু করতেন। এ যে কী তোফা তোফা শব্দের ফুলঝুরি নিজে না শুনলে কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

    আসলে বিশুদ্ধ বব-তেল-এর আবিষ্কারক আমার পরম পূজনীয় বাবা। সত্যি বলছি, সম্পাদক সাহেবের বক্তব্যের তোড়ে এ-তেলের বিক্রি তরতর করে বাড়তে বাড়তে একেবারে পঞ্চমে উঠে গিয়েছিল। ব্যস, আমার বাবাও ভাবে একেবারে গদগদ হয়ে গিয়েছিলেন। ওই সম্পাদক সাহেবের কাছ থেকে চুল-দাড়ি কামানোর মজুরি বাবদ একটা কানাকড়িও নিতেই না। ব্যস, মুফতেই দিব্যি তার কাজ চলে যেতে লাগল।

    আরে, তখন থেকে আমার বাবা আর তার কারবার সম্বন্ধে কেবল ধানাইপানাই-ই করে যাচ্ছি, কিন্তু এখনও তার নামটাই আপনাদের বলতে ভুলে গেছি! যাকগে, বলছি শুনুন–টমাস বব ছিল আমার বাবার নাম। আর তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল টমাস বব অ্যান্ড কোম্পানি। আর আমার নিজের নাম? সে না হয় পরেই বলব, ঠিক আছে তো?

    কেবলমাত্র গল্প-কথার মাধ্যমেই নয়, গ্যাড-ফ্লাই পত্রিকার সম্পাদক সাহেব দাঁড়িতে সাবান মাখার সময় আমার বাবার তৈরি ববতেল নিয়ে ছড়া বা নিয়ে গুনগুন করে আবৃত্তি করে যেতেন। চমৎকার ছড়া। শ্রুতিমধুর তো বটেই। আমি পাশে দাঁড়িয়ে উল্কীর্ণ হয়ে শুনতাম আর মনে রীতিমত পুলকের সঞ্চার ঘটত।

    বিশ্বাস করুণ আমার মাথায় একদিন যেন আকাশবাণী, যাকে সবাই দৈববানী বলে, আবার স্বর্গীয় ব্যাপারও বলা চলে। আমি হঠাৎ–একেবারে হঠাৎই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার মানে বিখ্যাত হওয়ার উপায় উদ্ভাবন করে ফেললাম। বাধা-বন্ধনহীন পথের হদিস যাকে বলে না।

    ব্যস, আর মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আমি পরম শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবের চরণে লুটিয়ে পড়লাম।

    আমার আকস্মিক কাণ্ড দেখে আমার বাবা তো রীতিমত ভড়কে গেলেন। আমি তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে ভাবাপুত কন্ঠে বললাম–বাবা, তোমার চরণে আমার একটা নিবেদন আছে।

    বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে নীরবে আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

    আমি পূর্বস্বর অনুসরণ করে বললাম–বাবা, ব্রাশ দিয়ে সাবান ঘেটে ফেণা সৃষ্টি করার জন্য তো আমি পৃথিবীতে আসিনি।

    বাবা ক্ষীণকণ্ঠে বললেন–কী বলতে চাইছিস, খোলসা করে বল।

    শোনো বাবা। আমি সম্পাদক, কবি, সাহিত্যিক হতে চাই।

    সম্পাদক! কবি! কবি-সাহিত্যিক হবি!

    হ্যাঁ, আমার একান্ত ইচ্ছা বব-তেল নিয়ে ছড়া আর প্রবন্ধ রচনা করতে চাচ্ছি।

    কি বলছিস, কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না। নাপিতের ছেলে ক্ষুর ছেড়ে কাগজ-কলম ধরবে–এ কী অসম্ভব খেয়াল তোর মাথায় ঢুকেছে।

    হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ করে দাও, আমার একান্ত অনুরোধ।

    বাবা আমতা আমতা করে বললেন–বাছা, তোর নামটা যেন কী?

    এই তো আমার নাম। আমার এক ধনকুবের আত্মীয়, এ-নামে টাকার পাহাড় গড়ে ফেলেছিলেন।

    বাবা আর টু-শব্দটিও না করে ঝট করে আমার কান ধরে টেনে পায়ের কাছ থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে দিতে মুখ বিকৃত করে বিশ্রি সুরে বলেছিলেন–বাছা, তোর নামটা যেন কি, হ্যাঁ, অবিকল বাবার মতোই হয়েছিস বটে। মুণ্ডুটা যখন তালের মতো ইয়া বড় তখন মগজও প্রচুর পরিমাণেই আছে।

    আমি নিতান্ত অপরাধীর মতো নীরবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

    বাবা পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–বাছা, তোর ইয়া বড় মাথা আর মগজের কথা বিবেচনা করে আমি মনস্থ করেছিলাম, তোকে একজন আইন ব্যবসায়ী–উকিল বানাব। ও কারবার এখন ভব্যসভ্য-দ্রলোকের নয়। রাজনীতিবিদদের টাক ফাঁকা, টাকা-পয়সা আমদানি ধরতে গেলে বন্ধ। একটু ভালো করে ভাবলে, স্বীকার করতেই হয়, সম্পাদকের ব্যবসা-ট্যাবসায় মালকড়ি ভালোই আমদানি হয়। মোদ্দা কথা, লাভজনক কারবার।

    বাবার কথায় আমার আত্মায় যেন একটু হলেও পানি এলো।

    বাবা বলে চললেন–সম্পাদকের কারবারে আমদানি তো ভালো হয়-ই, সে সঙ্গে কবিতা-টবিতাও সৃষ্টি করতে পারে। অধিকাংশ সম্পাদক করেনও তা-ই। তা যদি করতে পারিস তবে আর তোকে ঠেকায় কে। ব্যস, একটামাত্র ঢিলে দু-দুটো পাখি কুপোকাত করা হয়ে যাবে–কম কথা!

    বাবার কথায় আমার বুকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ উতাল-পাথাল করতে লাগল।

    বাবা আগের মতোই ভাবাপুত কণ্ঠে বলে চললেন–তবে আর মিছে দেরি করে কী হবে। একটা ঘর আর কাগজ, কলম-কালি ও একটা গ্যাড-ফ্লাই পত্রিকা দিচ্ছি ঝুলে পড়। দেখিস, যেন আর কোনোকিছুর জন্য হাত পাতবি না।

    আমি মাত্রাতিরিক্ত ভাবাপুত কণ্ঠে বললাম–বাবা, একটা কথা জেনে রাখো, আমি অকৃতজ্ঞ নই। মানে বেইমানি কাকে বলে জানি না। আমি তো ভালোই জানি তোমার দরাজ হাত। কিন্তু আর কোনোকিছুর বাঞ্ছ আমার নেই, চাইছিও না।

    বাবা ম্লান হাসলেন, বুঝতে পারলাম।

    আমি কিন্তু তাতে এতটুকুও দমলাম না। পূর্বস্বরেই বলে চললাম–বাবা, তোমাকে বেশ জোরের সঙ্গেই আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে একজন রত্নের বাবা বানাবই বানাব।

    বাবার সঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি কবি হওয়ার সাধনায় জোর কদমে মেতে গেলাম। আমার পরিকল্পনা, কবি হওয়ার পরই সম্পাদক হব। ব্যস, আমাকে আর ঠেকায় কে।

    বব-তেলের ছড়াগুলোর মতোই আরও কয়েক ছড়া বা নিয়ে ফেলব–বাসনা নিয়ে আমি ছড়াগুলো আর কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলাম।

    কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, কলম আর চলতে চায় না। অবিরাম মাথা চুলকাতে শুরু করলাম। গা দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগল, আর মাথার ঝিমঝিমানি তো রইলই। কিন্তু ছড়াগুলো বার-বার পড়েও ছাইভস্ম কিছু উদ্ধার করতে পালাম না।

    বহু চেষ্টা চালিয়ে নিঃসন্দেহ হলাম, ছড়াটড়া বানানো আমার কর্ম নয়। আমার কলমের ডগা দিয়ে ওসব মাল বেরোবার নয়। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে একেবারে হাল ছেড়ে না দিয়ে মনে মনে একটা মতলব আঁটলাম। অবশ্য এরকম এক-আধটা মতলব দুনিয়ার সবার মাথাতেই খেলে যায়।

    মতলবটা কি, তাই না। বলছি–এক বিকেলে শহরের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে এক বইয়ের দোকানে খুবই নামমাত্র দামে একগাদা পুরনো বই খরিদ করে ফেললাম।

    বইগুলো পুরনো তো বটেই, কিন্তু কতযুগ আগে যে সেগুলো ছাপাখানা থেকে বেরিয়েছে তার হিসেব পাওয়া ভার। আর তাদের নামও কারো শোনা নেই, পাতা উলটে কেউ দু-চার পাতাও পড়েনি।

    বইগুলোর মধ্যে একটা বইয়ের নাম দেখলাম। ইনফারনো-র অনুবাদ। অনুবাদক দান্তে নামে একজন। বইটা খুলে তার বেশ কিছুটা অংশ খস্ খস্ করে বড় বড় হরফে নকল করে নিলাম।

    বইটার পাতা নকল করতে গিয়ে আগে লিনো একটা লোকের নাম পেলাম। এ-ই নাকি নানা কাণ্ড কারখানার নাটের গুরু।

    তারপর পাঁজা থেকে আরও একটা বই হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। এখন তার লেখকের নামটা কিছুতেই স্মরণে আনতে পারছি না। বইটায় বেশ কিছু সংখ্যক পদ্য ছাপা ছিল। সেটা থেকেও বেশ কয়েকটা পাতা ঝটপট নকল করে নিলাম।

    বইটার যে সব পাতায় ভূত-প্রেত, দত্যি-দানো আর পরী-টরীর কথা নিয়ে পদ্য ছাপা রয়েছে, সে সব পাতার লেখা ঝটপট নকল করে নিলাম।

    এবার হাতে তুলে নিলাম, তেসরা নামের একটা বই। এর লেখক আবার অন্ধ, চোখে মোটেই দেখতে পান না। আর জাতি? হয়তো গ্রিকট্রিক কিছু একটা হবে।

    কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই সে বইটা থেকে হাত চালিয়ে গোটা পঞ্চাশেক কবিতা টুকে নিলাম।

    এবারের বইটার নাম চৌঠা। এটাও এক অন্ধপুরুষের লেখা। আর এ বিষয়বস্তু পবিত্র বাতি, প্রস্তরখণ্ড প্রভৃতি। এসব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে বহু জায়গায়ই আলোচনা করা হয়েছে দেখলাম। এ-বইটারও কিছু পাতা ঝপটপ টুকে নিতে ছাড়লাম না।

    কবিতাগুলো কিন্তু নিকৃষ্টমানের নয়। একটা কথা আমার মনে বার বার ঘুরপাক খেতে লাগল, একজন অন্ধের পথে আলো দেখা কি করে সম্ভব। বহু ভেবেও এর কিনারা করতে পারলাম না। আবার না বলেও পারছি না, কবিতাগুলো মন্দ নয়– অনায়াসেই ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যেতে পারে।

    নকল-করা কবিতাগুলোকে এবার চারটি আলাদা আলাদা খামে ভরে সোজা পাঠিয়ে দিলাম চার নামকরা পত্রিকার দপ্তরে। চারজন সম্পাদক সাহেবের ঠিকানায় তাগ্লোডেলডোে নামটা ছদ্মনাম হিসেবে স্বাক্ষর করে চারটি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। চিঠি কটা ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে তবে আমি স্বস্তি লাভ করি।

    চিঠি চারটি পাঠিয়ে ফলাফল লাভের প্রত্যাশায় আমাকে অধীর প্রতীক্ষায় থাকতেই হলো। তারপর যে অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গেল, তা আর বলার মতো নয়। আমার কাছে ব্যাপারটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত মনে হলো। কাণ্ডটা কি, তাই না? বলছি তবে–চার-চারজন সম্পাদক সাহেবই নিজের নিজের পত্রিকার পাতায় আমার কবিতাগুলো আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়লেন। শুধু কি তাই? আমার পাঠানো কবিতা গুলোকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে পাতার পর পাতা লিখল–আমি যে নকল-করা কবিতা সম্পাদকের দপ্তরে পাঠিয়েছি এবং সেগুলো সবই ছদ্মনামে পাঠিয়েছি তা-ও তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ ও জ্বালাময়ী বাছা-বাছা শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ফাস করে দিল। আমার কুকর্মের সমালোচনার মাধ্যমে আমাকে যতভাবে অপদস্থ করা যেতে পারে। কিছুই লিখতে দ্বিধা করলেন না।

    লজ্জায় আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। মাথা মাটির সঙ্গে মিশে গেল। অন্যের কবিতা নকল করে কবির সম্মান করার ধান্ধা আমার মন থেকে ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আমার মধ্যে কবি হওয়ার সাধ আর নামমাত্রও রইল না।

    কিন্তু এও খুবই সত্য যে, এভাবে আছাড়টা খাওয়ায় আমার কিন্তু শিক্ষা একটা অবশ্যই হলো। সততাই সবচেয়ে বড় কৌশল। ছলচাতুরীর মাধ্যমে কিছুই হবার নয়। মৌলিক কোনো কিছু রচনা না করলে ফায়দা কিছুই হবে না।

    আমি এবার মৌলিক কিছু রচনা করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলাম। এবার কাগজ-কলম নিয়ে বাপ-বেটা উভয়েই বব-তেল সম্বন্ধীয় কবিতা সামনে নিয়ে। উদ্দেশ্য উভয়ের মিলিত প্রয়াসে কবিতা রচনা করা। ঘণ্টা ধরে মাথা চুলকে বার-বার কলমটা নাড়াচাড়া করলাম। না, কাজের কাজ কিছুই হলো না। এখন উপায়? না, কোনো উপায়ই হাতের কাছে পেলাম না। কিন্তু হতাশ হয়ে এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে তো আর চলবে না।

    শেষপর্যন্ত ভাগ্য ঠুকে, মনের জোর সম্বল করে কোনোরকমে দুটো ছত্র লিখে ফেললাম :

    বব-তেল নিয়ে কবিতা রচনা।

    কী ঝক্কী ঝামেলা–চালবাজ।

    বব-তেল ধারণাটা যেহেতু গ্যাডফ্লাই পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তাই আমার সদ্যরচিত দুছত্রের কবিতাটা প্রতিদ্বন্দ্বি পত্রিকা মণ্ডামিঠাই পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের দপ্তরে।

    হোক না কবিতাটা মাত্র দুটো ছত্রের। আমি তো জানি, কবিতার বিচার বড় বা ছোট দিয়ে হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছোট কবিতা উৎকর্ষতার বিচারে ইয়া বড় কবিতাকে ছাপিয়ে যায়। কোন্ বই, নাকি পত্রিকার পাতায় যেন পড়েছিলাম– লেখার আয়তন আর প্রতিভার আয়তন মাপে সমান হয় না। কবিতার আয়তন হোক না ছোট কিন্তু তাতে আকাশছোঁয়া প্রতিভার ছাপ মিলতে পারে।

    আমার পাঠানো লেখাটা যথাসময়ে মণ্ডা মিঠাই প্রতিকার সম্পাদক সাহেবের দপ্তরে পৌঁছে গেল। সম্পাদক সাহেব যথার্থ জহুরি বটে। প্রকৃত জহর চিনতে তার এতটুকুও ভুলচুক হয় না। তিনি বিচার-বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে ঠিক রত্নটাকে চিনতে এতটুকুও ভুল করলেন না।

    তিনি মোটেই সময় নষ্ট না করে, পরদিনের পত্রিকার পাতায়ই আমার-পাঠানো দুছত্রের কবিতাটা একটা বর্ণও না পাল্টে হুবহু ছাপিয়ে দিলেন।

    কেবলমাত্র কবিতার ছত্র দুটো ছেপে দিয়েই কর্তব্য শেষ করলেন, তা নয়, দুছত্রের কবিতায় তার ছছত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখে তবে ক্ষান্ত হলেন। সম্পাদকীয় মন্তব্যটা মোটামুটি এ রকম–এ নবীন প্রতিভাদর চালবাজ ব্যক্তিটা কে? প্রথম আবির্ভাব মুহূর্তেই বাজীমাত করে দিলেন! গ্যাড ফ্লাই পত্রিকায় চালবাজ ছদ্মনামটা যে এভাবে সম্পাদক সাহেবের মনকে প্রভাবিত করতে পারে তা কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। তিনি যখন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অত্যুত্র আগ্রহী, তখন তাকে ধন্য করা তো দরকারই বটে।

    এক সকালে গুটিগুটি তার বাড়ির দরজায় হাজির হলাম। কড়া নাড়লাম। দরজা খুলে পরিচারক মুচকি হেসে জানাল, আমার বাঞ্ছিত সম্পাদক সাহেব বাড়িতেই রয়েছেন।

    পরিচারকের পিছন পিছন আমি সম্পাদক সাহেবের বৈঠকখানায় হাজির হলাম। আমাকে একটা চেয়ার টেনে বসতে দিয়ে পরিচারক বুড়োটা অন্দরমহলে চলে গেল।

    একটু পরেই আমার বাঞ্ছিত সম্পাদক সাহেব আমাকে আদর-অভ্যর্থনার কোন। ত্রুটিই রাখলেন না।

    ভদ্রলোকের নাম মি. কাঁকড়া। তিনি গ্যাড-ফ্লাই পত্রিকাটাকে নিজের মনের মতো করে সংক্ষেপ করে নিয়েছেন। এটাকে তিনি ফ্লাই অর্থাৎ মাছি বলে সম্বোধন করেন।

    সত্যি কথা বলতে আমি যখন মাছি-র প্রতি কটুক্তি করেছি তখন সম্পাদক সাহেব যে আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন না এ-তো খুবই স্বাভাবিক কথা। আমার ওপর কিছু না কিছু হম্বিতম্বি তিনি করবেনই করবেন। আমাকে তো ঘাবড়ে গিয়ে মুষড়ে পড়লে চলবে না। মনকে শক্ত করতে হবে। সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য তৈরি না থেকে উপায় নেই।

    তবে মি. কাঁকড়ার সঙ্গে কথা বলে আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারলাম, তিনিই আমার হয়ে যা জবাব দেবার দেবেন। অবশ্য ব্যক্তিগত কারণেই তিনি আমার প্রতি সহানুভূতিটুকু প্রদর্শন করবেন। অতএব আমাকে ঘাবড়ালে যেমন চলবে না, আবার ঘাবড়াবার দরকারও কিছু নেই।

    মি, কাঁকড়ার কথায় আমি পরিষ্কার বুঝে নিলাম, মণ্ডামিঠাই আর মাছি পত্রিকা দুটোর মধ্যে বিরোধ খুবই বেশি। দা-কুমড়ো যাকে বলে। কিন্তু আমার তো মনে হয় যথেষ্ট সদ্ভাব থাকাই উচিত ছিল। কার্যত কিন্তু বিপরীত সম্পর্কই উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান।

    ব্যস, আর যাবে কোথায়! আমি সম্মান-দক্ষিণা আশা করছি, জানতে পেরেই সম্পাদক ভদ্রলোকের মাথায় যেন আচমকা বজ্রাঘাত হলো। চোখের পলকে মি. কাকড়া হাতলওয়ালা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন। চোখ-উলটে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার যোগাড় হলেন তিনি। নিচের চোয়াল থেকে ঠোঁটটা অস্বাভাবিক রকম ঝুলে পড়ল। চোয়াল দুটো ছড়িয়ে প্রকাণ্ড হা সৃষ্টি হলো। হাঁসলে ঠোঁট দুটোকে ফাঁক করলে যেমন বিরাট হা তৈরি হয়, তার মুখটাও অবিকল সে রকমই হয়ে গেল।

    সম্পাদক কাকড়া সাহেব এমনি বিশ্রি ভঙ্গিতে কয়েক মুহূর্ত এলিয়ে পড়ে থাকার পর এক সময় অতর্কিতে পালিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে যন্ত্রচালিতের মতো ঘণ্টার দড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য–ঘণ্টা বাজিয়ে কাউকে ডাকা। কিন্তু কেন যে তিনি এ-কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আজও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি না।

    দুপা এগিয়ে গিয়েই মি. কাকড়া থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি কেন যে এমন হন্তদন্ত হয়ে ঘণ্টার দড়িটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, আর কেন যে সামান্য এগিয়ে গিয়েও আবার দুম্ করে থেকে গেলেন, এর কারণ মাথামুণ্ডু কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না।

    যা-ই হোক, তিনি ঘণ্টার দড়িটার দিক থেকে বিদ্যুঙ্গতিতে ফিরে এসে সুড়ুৎ করে টেবিলের তলায় সিঁধিয়ে গেলেন। ঠিক তেমনি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে এলেন হাতে ইয়া মোটা একটা রুলার নিয়ে।

    টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি হঠাৎ রুলারটা মাথার ওপরে তুললেন। এমন একটা ভাব তার মধ্যে প্রকাশ পেল যেন, মুহূর্তের মধ্যেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা করে বসবেন। কিন্তু কার্যত তিনি কিছুই করলেন না। ধীরে ধীরে রুলারটাকে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে আনলেন।

    দু-তিন পা এগিয়ে তিনি হতের রুলারটাকে নামিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন।

    আবার, আবারও প্রকাণ্ড হা করলেন। হা-করা অবস্থাতেই মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিলেন। তার এরকম আচরণের উদ্দেশ্যও আজ পর্যন্ত আমার কাছে পরিষ্কার হলো না।

    যাক গে, মি. কাঁকড়া এবার মুখে হাঁসের মতোই বিশ্রি স্বর উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে এসে আগেকার সে হাতলওয়ালা চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর যা বললেন, তাকে তোতলানো ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। তিনি বলতে লাগলেন–

    শুনুন, মণ্ডা মিঠাই পত্রিকায় যারা লেখা লেখেন, মানে যাদের লেখা ছাপা হয় তারা সম্মান দক্ষিণাস্বরূপ কিছুতো পানই না, বরং মোটা অর্থের সম্মান দক্ষিণা সম্পাদকের পকেটে গুঁজে দিয়ে যান। অবশ্যই প্রত্যাশা করে না। তবে সম্পাদক মি. কাঁকড়া আপনার ব্যাপারে কিছু ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন।

    মি. কাঁকড়া দাঁতের পাটি বের করে, বিশ্রি স্বরে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললেন– দেখুন ভাই, আপনার সম্বন্ধে আমি অন্যরকম ভেবে রেখেছি, বুঝলেন কিছু?

    আমি তার অন্যরকম ভাবনাটা সম্বন্ধে সামান্যতমও আঁচ করতে না পেরে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

    সম্পাদক সাহেব পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন–আরে ওই যে, বলছিলাম না ভাই, লেখা ছাপার জন্য আপনার কাছ থেকে আমি সম্মান-দক্ষিণাস্বরূপ কিছুই নেব না। কেবলমাত্র এবারের লেখাটার জন্যই নয়, পরপর কয়েকটা লেখা আমার পত্রিকায় ছাপার জন্য কোনোরকম সম্মান-দক্ষিণাই আমি দাবি করব না।

    কথা বলতে বলতে মি. কাকড়া আবেগে-উচ্ছ্বাসে এমনই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে, চোখের পানি আটকিয়ে রাখা কিছুতেই তার পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে বার বার চোখের পানি মুছতে লাগলেন।

    তার আচরণে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, আরও লিখব, আর সেগুলো যথা সময়ে তার দপ্তরে পৌঁছে দিয়ে যাব।

    আমার এরকম অকস্মাৎ মুগ্ধ হয়ে যাবার পিছনে কারণও রয়েছে যথেষ্টই। আসলে এ রকম সম্মান বরাতে তো এর আগে কোনোদিন জোটেনি। আমি নিজের। অজান্তে, ভালোভাবে তলিয়ে বোঝার চেষ্টা না করেই তার মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছি দেখে খুবই কষ্ট হল, আর নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হলো।

    আমার আচরণ এবং কৃতকর্মের জন্য মার্জনা ভিক্ষা প্রভৃতি নিয়ে আমি দিব্যি একটা ছোটখাট ভাষণও দিয়ে ফেললাম। তারপর মি. কাঁকড়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

    এ-ঘটনার দিন কয়েক পরেই আর এক পকেট সুনাম আমার বরাতে জুটে গেল। আর এবারের সুনামটা এলো প্যাচা পত্রিকা মারফত। সে পত্রিকার পাতাতে যে কী ফলাও করে আমার প্রশংসা করা হলো যা বাস্তবিকই আমার ধারণার বইরে।

    তারপর মাত্র দিন দুই যেতে না যেতেই ব্যাঙ পত্রিকা আমাকে তো রীতিমত তুঙ্গে তুলে দিল। তারা নানাভাবে আমার লেখার সুখ্যাতি করল।

    আরও আছে। এবার ছুঁচো পত্রিকা আমাকে নিয়ে বাজারে রীতিমত হৈ চৈ বাধিয়ে দিল। তারা পঞ্চমুখে আমার লেখার প্রশংসা করে প্রবন্ধ ছাপল।

    আমার নামযশ বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আরও একটা খবর আমার কানে এলো।

    খবরটা কি?

    মণ্ডা মিঠাই পত্রিকার বিক্রি দিন দিন বাড়তে বাড়তে এখন পাঁচ লক্ষে পৌঁছে গেছে। আর এ-পত্রিকা কর্তৃপক্ষ লেখকদের ইদানিং খুব বেশি সম্মান দক্ষিণা দিচ্ছে। হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়েই দুটো ব্যাঙ আর পেঁচা পত্রিকা এ-খবরটা ফলাও করে ছেপে ফাঁস করে দিল। আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকাগুলো যা করে থাকে, এ ই আর কি।

    সম্পাদক কাঁকড়া সাহেব এবার একদিন আমাকে বললেন–আপনাকে একটা কথা বলা খুবই জরুরি হয়ে পরেছে।

    আমি হাসতে হাসতে বললাম–জরুরি যদি হয়েই থাকে তবে আপনি নির্দিধায় বলতে পারেন। বলুন, কি আপনার বক্তব্য?

    আপনি এবার থেকে মি. টমাস হককে কিছু কিছু করে মালকড়ি দেবেন।

    আমি ভ্র দুটো কুঁচকে তার মুখের দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকালাম।

    আমার আকস্মিক ভাবান্তরটুকু তার নজর এড়াল না। তিনি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন–সে কী ভাই! এমন ভাব নিয়ে তাকাচ্ছেন যেন কিছু বুঝতে পারেননি।

    আমি বার কয়েক ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে বললাম–নামটা যেন কি বললেন, মি. টমাস হক, তাই না?

    হ্যাঁ, টমাস হক।

    কিন্তু এ-ব্যক্তিটা কে তা তো আমাকে সবার আগে জানতে হবে? এ মহাপুরুষটি কে, বলুন তো?

    আমার মুখের কথাটা শেষ হতে না হতেই মি. কাঁকড়া আবার আগের মতোই বিশাল হা করলেন। এমন একটা ভাব করলেন যে সবে আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন–আরে ভাই, টমাস হক একটা ছদ্মনাম। আর এটা আমার নিজের নাম।

    আমি বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়েই রইলাম।

    তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগলেন–টমাস হককে সংক্ষেপে টম্যাহক বলা হয়। টমাহক মানে আদিম আমেরিকানদের যুদ্ধ-কুঠার। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবশ্য টমাহক মানে নিষ্ঠুর সমালোচক–নিষ্ঠুরভাবে সমালোচনা করা, এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো তো?

    হু! আমি গম্ভীর মুখে প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম। পর মুহূর্তেই ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লাম।

    আমার অবস্থা দেখে কাঁকড়া সাবেব বললেন–আপনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, মালকড়ি ছাড়া আপনার পক্ষে এখন সম্ভব নয়, ঠিক ধরিনি?

    আমি চেয়ার আগলে বজ্রাহতের মতো শক্ত হয়ে চেয়ার আগলে বসেই রইলাম।

    কাঁকড়া ভদ্রলোকটি বলে চললেন–মালকড়ি যদি নেহাৎ-ই এখন ছাড়তে না পারেন, তবে কুছ পরোয়া নেই ভাই। অনবরত লেখা ছেড়ে যান।

    মুহূর্তের জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে তিনি আবার মুখ খুললেন– এক কাজ করুন না ভাই, মাছি পত্রিকার সম্পাদককে আপনিই টম্যাহক ছদ্মনামে লেখালেখির মধ্য দিয়ে আচ্ছা করে একটু জব্দ করে দিন।

    আমি? মাছি পত্রিকার সম্পাদককে আমি–

    আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–আরে ভাই, আপনার যা প্রতিভা, তার কাছে এটা নেহাৎ-ই একটা ছেলে খেলামাত্র।

    ভদ্রলোক কথার মারপ্যাঁচে আমাকে এমন ওপরে তুলে দিলেন যে, আমি ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে যাবার যোগাড় হলাম। তারপরই বাড়ি ফিরে সোজা আমার লেখার ঘরে চলে এলাম।

    আমি তো আগেই বলে রেখেছি, নকলিবাজি ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমার ঝোঁক মৌলিক রচনার দিকে। ফলে লেখার ঘরে ঢুকেই আমি পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাগজ কলম নিয়ে মৌলিক কিছু রচনা করতে প্রয়াসী হলাম। তাই বলে মামুলি কোনো কিছু লিখে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। আমাকে সে যুদ্ধ কুঠারে কোপ মারতেই হবে। কাগজ-কলম নিয়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করার পর হতাশ হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম।

    বুঝে নিলাম, এত সহজে এবারের যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। জোর কসরৎ চালাতে হবে। ভাবতে ভাবতে নিলামের দোকানে হাজির হলাম। সস্তাদামে কিছু পুরনো বই খরিদ করে বাড়ি ফিরলাম।

    পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে গভীর সাধনায় লিপ্ত হলাম। সাধ্যমত ব্যস্ত হাতে একটা বইয়ের একের পর এক পাতা ওলটাতে আরম্ভ করলাম। দরকারি কিছু অংশ কাচি চালিয়ে ঝটপট কেটে নিলাম। তারপর ছত্রগুলোকে লম্বালম্বা টুকরো করে আলাদা করে ফেললাম।

    এবার ভাড়ার ঘর থেকে একটা খালি জলপাই তেলের টিন নিয়ে আবার পড়ার ঘরে ফিরে এলাম। টিনটার মাথায় একটা ছিদ্র করে তার ভেতর দিয়ে কেটে রাখা। ছত্রগুলোকে ভেতরে গলিয়ে দিতে লাগলাম। আচ্ছা করে ঝাঁকালাম। এবার কিছু কঠিন কঠিন শব্দও আলাদা করে কেটে একই রকমভাবে ভেতরে ঢুকিয়ে আবার বার কয়েক ঝাঁকিয়ে নিলাম।

    এবার একটা ফুলস্কেপ কাগজে ডিমের কুসুম আর সাদা অংশ আচ্ছা করে ফেঁটিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিলাম। এবার এটার ওপর জলপাইয়ের তেলের টিনটা উপুড় করে ধরলাম। তারপর একের পর এক ছত্র কাগজটার ওপর সাজিয়ে নিলাম। জিনিসটা কিন্তু চমৎকার হয়ে উঠল। বিশ্বের বিস্ময় ছাড়া একে অন্য কিছু ভাবাই যায় না।

    লেখাটাকে এবার পাঠিয়ে দেওয়া হলো মণ্ডামিঠাই পত্রিকার দপ্তরে। পরদিন সকালের সংস্করণেই লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। ব্যস, আর দেরি নয়, মাছি পত্রিকার সম্পাদক বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে মারা গেলেন। আগে পৃথিবীর কেউ-ই তার নাম শোনেনি।

    সম্পাদক কাকড়া সাহেব আমাকে এবার টম্যাহ নামটা দিয়ে দিলেন। আমি এ নামেই পরিচিত হতে লাগলাম। আর আমাকে পত্রিকার অফিসে একটা চাকরিও দিলেন। তবে বেতন কিন্তু দিলেন না। বেতনের পরিবর্তে তার কাছ থেকে কেবল উপদেশই পেলাম। তিনি অবলীলাক্রমে হাসতে হাসতে বললেন–শুনুন জনাব, এর চেয়ে বড় আর কোনো লাভই নেই।

    তার উপদেশগুলো হচ্ছে–বিরক্তিকর বাবাকে দূর করে দিতে হবে। আর তা যদি পারা যায় তবে স্বাধীন লেখক হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

    আমি তার উপদেশ শিরধার্য করে সে রকম কাজই করলাম। পৃথিবীর বুক থেকে টমাস বব চিরদিনের মতো সরে গেলেন।

    সত্যি বলছি, তারপর থেকেই আমি বাস্তবিকই ভারমুক্ত হয়ে গেলাম। আর কোনো ঝক্কি ঝামেলাই আমার ঝড়ে রইল না।

    একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, আমার টাকা কড়ির টানাটানি খুবই চলছিল। তবে নাক আর চোখ কাজে লাগিয়ে তা-ও কোনোরকমে সামলে নিতে পারলাম। নাকের সামনে যা-কিছু ঘটেছে, চোখে যা-কিছু দেখেছি–তা নিয়েই আদমি মানবের কায়দা কৌশল অনুযায়ী যুদ্ধ-কুঠার চালিয়েছি।

    ব্যস, আমার লেখার ব্যবসা রীতিমত জমজমাট হয়ে উঠল। কুঠার! কুঠারকে সবাই ভয়ে সমঝে চলতে লাগল। কুঠারের ভয়েই পকেটে জোর করে মালকড়ি খুঁজে দেয়।

    বেশি দেরি লাগল না। এমন মালকড়ি আমদানি হতে লাগল যে, আমি দু-চার দিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে গেলাম।

    একটার পর একটা পত্রিকা খরিদ করতে লাগলাম। বব-তেলকে নিয়ে যে কাগজগুলোয় আজেবাজে কথা দেখেছিলাম, সবার আগে সেগুলোকেই খরিদ করে নিলাম।

    এখন বাজারে আমি একা, একদমই একা। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কারো অস্তিত্বই নেই।

    সম্পাদক কাঁকড়া আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি অক্কা পেলে তার পত্রিকার মালিকানা স্বত্ত্ব তার ওপরই বর্তাবে। কার্যত হলও তা-ই, তবে এখন আমি বড়ই ক্লান্ত। আসলে বয়স হয়েছে, বুড়ো হতে চলেছি। তবুও দিনের আলোয় আর চাঁদের আলোয় যুদ্ধ-কুঠার সমান তালে চালিয়েই যাচ্ছি। এটা মোটেই ক্লান্তি নয়। যুদ্ধে কিছুমাত্র অনীহাও নেই। আমি পুরোদমে কুঠার চালিয়েই চলেছি।

    তার নমুনা তো পেলেনই তাই না? আগামী প্রজন্ম এর থেকে শিক্ষানিক, আমি তবে এখন বিদায় নিচ্ছি। বিদায়!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }