Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    বেরোনিস

    বেরোনিস

    দুঃখ বহুরকম। বিশ্বের মন্দভাগ্য বহুরকমের।

    দুঃখ-দুর্দশা রংধনুর মতোই দৃঢ় দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত। আর তার রঙও ওই ধনুকের মতোই অদ্ভুত ধরনের, তবে একই রকম স্পষ্ট আর সংযোজিত। রঙধনুর মতোই। দিগন্ত জুড়ে অবস্থান করছে।

    কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এমনটা কি করে সম্ভব হলো যে সুন্দরের কাছ থেকেই আমি বিশেষ এক প্রকার অসুন্দরকে লাভ করলাম। এ যে রীতিমত অদ্ভুত, একেবারে। অবিশ্বাস্য কাণ্ড!

    শান্তির চুক্তি সম্পাদিত হল। তাতে আমার ভাগ্যে শান্তি তো জুটলাই না, বরং অবর্ণনীয় দুঃখই পেলাম। নীতিশাস্ত্রে যেমন আছে, ভালো থেকেই আসে খারাপ, ঠিক তেমনিই বাস্তবেও আনন্দ-ফুর্তিই দুঃখ-যন্ত্রণাকে ত্বরান্বিত করে থাকে।

    এক সময়ের অসীম আনন্দ আজ তা-ই অবর্ণনীয় দুঃখে পর্যবসিত হয়েছে। যদি–ই হয় তবে আজকের দুঃখ-যন্ত্রণার উদ্ভব ঘটেছিল অতীতের কোনো-না-কোনো অনাবিল আনন্দ-ফুর্তি থেকে।

    আমি এক সময়, দীক্ষা নিয়েছিলাম। অতএব আমার একটা দীক্ষান্ত নাম অবশ্যই আছে–এগাউসসেটা। কিন্তু আমার পারিবারিক নামটা যেন আবার জানতে চাইবেন না। দুঃখিত ওটা আমি বলতে পারব না, মানে ইচ্ছে করেই বলব না।

    অথচ এ-কথা খুবই সত্য যে, উত্তরাধিকার বলে পাওয়া আমার বসতবাড়িটা জরাজীর্ণ, ধূসর আর বিষণ্ণ হলঘরগুলোর চেয়ে বেশি প্রশংসিত ও সম্মানিত কোনো বাড়ি এদেশে নজরে পড়ে না। আমার বংশটা নাকি স্বপ্নবিলাসী। স্বপ্ন দেখে দেখেই আমার পূর্বসূরীরা নাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

    আমার পূর্বপুরুষদের রেখে-যাওয়া প্রাসাদটার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান ঘরটার দেওয়ালের গায়ে অঙ্কিত ফ্লেস্কো চিত্র, যা যে কোনো শিল্পরসিকের মনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। আর শোবার ঘরগুলো কেবলমাত্র যে বৈচিত্র্যে ভরপুর তাই নয়। এদের শিল্পনৈপুণ্যও অপলক চোখে তাকিয়ে দেখার মতোই বটে। অস্ত্রাগারে গেলে নিতান্ত বে-রসিককেও তার গায়ের ভাস্কর্যশৈলী চাক্ষুষ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এত কিছু সত্ত্বেও বিশেষ করে প্রাচীন শিল্পরীতিতে অঙ্কিত চিত্রাবলী চিত্রসংগ্রহশালার দরজায় হাজির হলে চোখ দেখানো অবশ্যই দায় হয়ে পড়বে। এবার গ্রন্থাগার-কক্ষটার গঠন বৈচিত্র্যের মুখোমুখি চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠবে, কোনো সন্দেহই নেই। আর সব শেষে গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত গ্রন্থগুলোর প্রত্যেকটা এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে যে, বহু চেষ্টা করেও একের সঙ্গে অন্যের এতটুকুও সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া ভার। বসতবাড়িটার যা-কিছু বিবরণ দিলাম, সবকিছুই মানুষের সে বিশ্বাসের যথেষ্ট স্বাক্ষর বহন করছে, স্বীকার করতেই হবে।

    আমার জীবনের গোড়ার দিককার স্মৃতি সে কক্ষটা আর গ্রন্থাগারটার বইগুলোর সঙ্গেই জড়িত, সীমাবদ্ধও বটে। তবে সে সম্বন্ধে আমি আর মোটেই মুখ খুলছি না।

    আমার মা এ-প্রাসাদটাতেই দেহ রেখেছিলেন। আমিও এখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম। কিন্তু এমন কথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন যে, ইতিপূর্বে আমার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আত্মার অতীত অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। এ-মতবাদে আপনারা কী বিশ্বাসী? ভালো কথা, এ ব্যাপারে আমরা একমত না-ই হলাম। মানুষে মানুষে মতো পার্থক্য তো থাকতেই পারে। এ-ব্যাপারে আমি আস্থাভাজন বিশ্বাস আছে বলে অন্যকে জোর করে বিশ্বাস করাবার তিলমাত্র ইচ্ছাও আমার নেই।

    তবে একটা কথা, বায়বীয় একটা মূর্তির কথা আমার মনে আজও বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে, বিদেহী আর অর্থপূর্ণ কয়েকটা চোখ, গানের কলির মতো সুরেলা অথচ অস্পষ্ট, পরিবর্তনযোগ্য, নির্দিষ্ট আকারবিহীন, অস্থির-চঞ্চল একটা গভীর স্মৃতি। আবার ছায়ার মতোই আমার সঙ্গে যেন প্রতিনিয়ত সেঁটে রয়েছে। যতদিন আকাশে সূর্যের অস্তিত্ব থাকবে, পৃথিবীতে সূর্যালোক বিরাজ করবে, ততদিন তার হাত থেকে। অব্যাহতি পাওয়া আমার সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।

    যে ঘরে আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম। পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলাম। সে কালকে অস্তিত্বহীন জ্ঞান করেছি হঠাই জেগে উঠেছিলাম এক বাড়ির মুল্লুকে- সম্পূর্ণ কাল্পনিক এক প্রাসাদে মঠসুলভ ভাবনা-চিন্তা আর পাণ্ডিত্যের এক অনৈসর্গিক মুলুকে। সে জন্যই তো অত্যাশ্চর্য এবং নিষ্পলক চাহনি মেলে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম। পুঁথিপত্র ঘেটে ঘেটে আমার শৈশব আর বাল্যকালটা কাটিয়েছি আর দিবাস্বপ্নে বিভোর থেকে যৌবনটাকে ব্যয় করে দিয়েছি। এটা তেমন বিশেষ করে বলার মতো ব্যাপারই নয়।

    কিন্তু বিশেষ করে বলার মতো ব্যাপার একটা অবশ্যই আছে। কি সেটা? একের পর এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, যৌবনের মাঝামাঝি পৌঁছেও আমি পূর্বপুরুষদের প্রাসাদটা আঁকড়েই আমি পড়ে রইলাম। অবাক হবার মতো ব্যাপার হচ্ছে, আমার । জীবনের আনন্দ-ফুর্তি আর উদ্দামতা চাপা পড়ে গেল স্থবিরতার চাপে পড়ে। আর আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আমার যাবতীয় ভাবনা-চিন্তাগুলো কেমন একেবারে পাল্টে গেল।

    এবার থেকে পৃথিবীর যাবতীয় বাস্তব ব্যাপার স্যাপার আমার কাছে স্বপ্নময় হয়ে উঠল, আর স্বপ্নের জগতের অস্বাভাবিক-অসংযত ধ্যান ধারণাগুলো কেবলমাত্র আমার নিত্যকার জীবনের সম্বলই যে হয়ে উঠল তা-ই নয়, আসলে আমার একান্ত অস্তিত্বে পরিণত হয়ে গেল। মোদ্দা কথা, আসল ছেড়ে আমি নকলকেই আঁকড়ে ধরলাম।

    .

    এবার আসল প্রসঙ্গে যাচ্ছি। বেরেনিস আর আমার সম্পর্কের কথাটা আপনাদের বলেই ফেলি। আমরা সম্পর্কে ছিলাম ভাই-বোন।

    আমার পূর্বপুরুষের পৈত্রিক প্রাসাদেই আমরা দুজনে এক সঙ্গে কাছাকাছি পাশাপাশি বড় হয়েছি। তবে এও সত্যি যে, আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পথে, স্বতন্ত্র উপায়ে গায়ে-গতরে বেড়ে উঠতে লাগলাম–আমি রোগাটে, মনমরা–আর সে বনহরিণীর মতো চঞ্চলা, রূপসি, তন্বী, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, উচ্ছসিতা।

    আমি মঠে পুঁথিপত্রের পাতা নিয়ে মঠের কক্ষে বন্দি থাকতাম, আর সে আপন খেয়াল খুশিতে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত।

    আমি একান্তভাবে নিজের মধ্যে বাস করতাম। একাগ্র ধ্যানে দেহ-মন সঁপে দিয়ে দিন কাটাতাম, আর সে বাধা বন্ধনহীনভাবে জীবনের পথে পথে চক্কর মেরে বেড়াত। কিন্তু সে পথে যে কোনোদিন অন্ধকার কালো ছায়ায় চাপা পড়ে যেতে পারে সে। ভাবনা-চিন্তা মুহূর্তের জন্যও তার মাথায় আসত না।

    বেরেনিস। তার নামটা স্মৃতির কোণে ভেসে উঠল, বেরেনিস। আর তার নামটা মনে পড়ামার স্মৃতির বিবর্ণ ধ্বংসস্তূপ থেকে হাজার হাজার কলহাস্য মুখর উদ্বেলিত মুখাবয়ব সে ডাক শোনামাত্র সচকিত হয়ে উঠল।

    উফ! তার ছবি আমার সামনে কত স্পষ্ট হয়ে যে দাঁড়িয়েছে, ঠিক যেমনভাবে, সে রূপ নিয়ে যে প্রথম জীবনের আনন্দমুখর দিনগুলোতে আমার মুখোমুখি দাঁড়াত।

    উফ! কী যে অদ্ভুত সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক সে ছিল, তা ভাষায় বর্ণনা করা। বাস্তবিকই সাধ্যাতীত। আহা! তার রূপ-সৌন্দর্য এমন অবর্ণনীয় ছিল যে, মনে হত আলহিমের বনে যেন একটা পীর মনের খেয়ালে অবস্থান করছে। অনেক ঝর্ণার মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে বেশি বেগবতী–চঞ্চলা।

    তারপর? তারপরই সবই রহস্যে ঘেরা আর আতঙ্কে ভরপুর। সে কাহিনী এমন রহস্য আর আতঙ্ক সৃষ্টিকারী যা বলা সঙ্গত হবে না। রোগ, এক ভয়ঙ্কর রোগের কবলে সে পড়ল। আর দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনেই তার ওপর দিয়ে পরিবর্তনের। এক তীব্র জোয়ার দ্রুত বয়ে গেল, তার দেহ-মন ছেয়ে ফেলল, তার অভ্যাস, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে এক সূক্ষ্ম আর ভয়ঙ্কর প্রভাবের সঙ্গে তার সত্তাটাকে পর্যন্ত বিঘ্নিত ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল।

    উফ্‌। মৃত্যু চোখের পলকে এলো আর চলে গেল। যাবার সময় তার শিকারকে– সে গেল কোথায়? কোথায় চিরদিনের মতো চলে গেল? আমার পক্ষে তাকে চেনা সম্ভব হত না, কিছুতেই না। আর যা-ই হোক, অন্তত বেরেনিস বলে তাকে চিনতে পারা আর আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

    হায়! ব্যাধি মারাত্মক! এক রোগই আমার বোনটার মধ্যে স্থায়ী আসন নিল। কিন্তু প্রধান রোগ তার দৈহিক আর নৈতিক সত্তায় মারাত্মক আলোড়ন সৃষ্টি করল, আর তার সহযোগি হয়ে যে সব রোগ তার শরীরে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে এমন একটা রোগের নাম করা যেতে পারে, এমন একটা অনার রোগের যা সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আর অপ্রতিরোধ্য। আর একে অধিকাংশ লোকই ‘ভিমরি’ রোগ নামে অভিহিত করে থাকে। এর লক্ষণ, সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়া। আর সংজ্ঞা এমনই লোপ পেয়ে যায় যাকে একমাত্র মৃত্যুর সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। আর এ-রোগটার কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় খুবই অল্পক্ষণের মধ্যে।

    আর এরই মধ্যে আমার নিজের রোগ–হ্যাঁ, আমার নিজের রোগটা সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে আমি যেন সেটার অন্য কোনো নামকরণ না করি। আর নিজের রোগটাও তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। আর সেটা শেষপর্যন্ত একেবারে নতুনত্ব এবং অসম্ভব বিষয়কেন্দ্রিক উন্মত্ততা রূপ নিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় অনবরত বেড়েই চলল। আর আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলল।

    আমার যে বিষয়কেন্দ্রিক উন্মত্ততা রোগটাকে মনোমালিন্য বলে অভিহিত করা যেতে পারে। আর যদি মনোম্যানিয়া নামেই রোগটা বর্ণনা দিতে হয়–এক বিশেষ ধরনের মানসিক বিকার।

    এ তো আরও একেবারে অসম্ভব-অবিশ্বাস্য কোনো ব্যাপার নয়, যে আমার রোগটার যথাযথ বিবরণ দিয়ে আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না। আসল সমস্যাটা কোথায় জানেন? এ ব্যাপারে অজ্ঞ, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মনে এ বিশেষ রোগটা সম্বন্ধে ধারণা দান করা সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

    ক্লান্তি অবসাদবিহীনভাবে একটা বইয়ের বিশেষ অলংকরণ বা অক্ষরগুলোর দিকে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের দিকে অপলক চাহনি মেলে চেয়ে-থাকা; প্রচণ্ড গ্রীষ্মে প্রায় সারাদিন ঘরের মেঝে বা পর্দার গায়ে তির্যকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ছায়ার দিকে চেয়ে চেয়ে একনিষ্ঠভাবে কাটিয়ে দেওয়া, চুল্লির জ্বলন্ত একটা অঙ্গার বা মোমবাতির শিখার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সারাটা দিন স্থবিরের মতো বসে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলা, আর একনাগাড়ে বার বার দীর্ঘ সময় ধরে একটা কথাই বলে-বলে শেষপর্যন্ত তাকেই ভুলে-যাওয়া, নতুবা দীর্ঘ সময় ধরে কর্মহীনভাবে শরীরটাকে পুরোপুরি সুস্থির করে রাখার ফলে গতিশক্তির অথবা শরীরটার অস্তিত্ববোধকেই হারিয়ে ফেলা রোগের প্রভৃতি লক্ষণ অন্যান্য অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প ক্ষতিকারকও খুবই সাধারণ উপরোক্ত লক্ষণগুলো সত্যিই তেমন ক্ষতিকারক নয়।

    আমার রোগের বিবরণ কিঞ্চিৎ হলেও দিলাম তো বটেই। যাক, আমার ব্যাধি যন্ত্রণার সাময়িক বিরতির ফুরসতটুকুতে আমার বোন বেরেনিসের ব্যাধির প্রকোপ দেখে আমি সত্যি খুবই মর্মাহত হই, তার শান্ত-স্বাভাবিক জীবনের সে পরিণতি আমার মনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। মন-প্রাণকে অস্থির করে তোলে। আর আমি গালে হাত দিয়ে বিষণ্ণ মনে বসে তার নিষ্ঠুর ব্যাধির অসহনীয় যন্ত্রণার কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ভাবি। কেবল ভাবনা আর ভাবনা। এ-ভাবনার বুঝি আর শেষ নাই, সীমা নাই।

    তবে একটা কথা খুবই সত্য যে, বেরেনিসের শারীরিক যাবতীয় পরিবর্তনের চেয়ে তার দৈহিক পরিবর্তনের ব্যাপার, বিশেষ করে তার ব্যক্তিসত্তার ভয়ঙ্কর বিকৃতির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে আমার মন বেশি উৎসাহি। তার শারীরিক পরিবর্তনটুকু দেখে আমার মন-প্রাণ যে কী পরিমাণ বিষিয়ে ওঠে, তা ভাষায় ব্যক্ত করা অর্থাৎ কথার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণার সঞ্চার আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়।

    তার অত্যুজ্জ্বল দিনগুলোতে, তার সর্বাঙ্গ দিয়ে রূপের জৌলস ঠিকরে বের হত, যখন সে সত্যিকারের রূপসি ছিল তখন কিন্তু আমি তাকে ভুলেও ভালোবাসিনি, কোনোদিনই না একটা মুহূর্তের জন্যও নয়।

    প্রথম প্রত্যূষের ধুসর আলোকরশ্মির ভেতর দিয়ে মধ্যাহ্নে লতাপাতা আর ঝোঁপ ঝাড়ের ছায়ায়, রাতে আমার গ্রন্থাগারের অখণ্ড নীরবতার মধ্যে হঠাৎই সে আমার চোখের সামনে উদয় হত। আমি কিন্তু তাকে তখন অবশ্যই জীবিত বেরেনিসরূপে পেতাম না। তবে কোন কোন রূপে? ঘুমের ঘোরে স্বপ্নরাজ্যের বেরেনিসরূপে! ইহলোকের কোনো পার্থিব জীবরূপে নয়, তার বিমূর্ত সত্তা হিসেবে।

    বেরেনিস তখন প্রশংসার যোগ্য, প্রশংসার বিষয় ছিল না, ছিল বিশ্লেষণ করার মতো বিষয়। আর অন্তরের ভালোবাসা দান করার উপযুক্ত পাত্র নয়, জটিল ভাবনা চিন্তা করার মতো পাত্র। তার আকস্মিক উপস্থিতিতে।

    কিন্তু এখন? এখন তাকে দেখামাত্র আমি সচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, শিউরে উঠি, গায়ের রোমগুলো অতর্কিতে একসঙ্গে খাড়া হয়ে ওঠে। যদি হঠাৎ দেখতে পাই, সে গুটিগুটি আসছে তবে মুহূর্তের মধ্যে আমার মুখ কালো হয়ে ওঠে। তবে এও সত্য যে, তার এ-রূপ চাক্ষুষ করামাত্র আমার বুকটা যেন ফেঁটে যেতে চায়, ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। হ্যাঁ, ঠিক তখনই–সে মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে যায়, বেরেনিস আমাকে ভালোবাসত, দীর্ঘদিন ধরেই সে আমাকে ভালোবাসত। আর আমি? আমি এক অশুভ মুহূর্তে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও করেছিলাম। আর আমি মনের দিক থেকে অনেকখানি এগিয়েও গিয়েছিলাম।

    বেরেনিস আমার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত আমাদের উভয়ের সম্মতিক্রমে বিয়ের দিন নির্ধারিত হল। বিয়ের ব্যাপারে তার আগ্রহ আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।

    আমাদের বিয়ের দিন ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। আর সে সময়ই এক শীতের বিকালে আমি লাইব্রেরির ভেতর দিককার একটা ঘরে বসে। হাতে একটা খোলা-বই। হঠাৎ বইটা থেকে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম, বেরেনিস আমার কাছাকাছি, একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে যে কখন চুপি চুপি ঘরে ঢুকেছে, বুঝতেই পারিনি।

    হঠাৎই আমার মধ্যে কেমন একটা অভাবনীয় পরিবর্তন, অদ্ভুত ভাবান্তর ঘটে গেল, বলতে পারব না। আমার উত্তেজনাপূর্ণ কল্পনার জন্য, কুয়াশার চাদরে মোড়া স্যাঁতাতে আবহাওয়ার জন্য, ঘরের ভেতরের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পূর্বমুহূর্তের আলো-আঁধারির জন্য, নতুবা ছাই রংবিশিষ্ট পর্দাগুলো তার চারদিকে ঝুলে থাকার জন্যই হোক, কিন্তু কেন যে তার অবয়বটা এমন অস্পষ্ট হয়ে দোল খাচ্ছিল আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আসলে বহুভেবেও আমি নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না।

    যা-ই হোক, সে মুখে কুলুপ এঁটে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, টু-শব্দটাও করল না। যাকে বলে একেবারে নির্বাক নিষ্পন্দভাবে যে দাঁড়িয়ে রইল।

    আর আমি? সমগ্র পৃথিবীটার বিনিময়েও আমি শত চেষ্টা করেও মুখে কোনো কথা, এমনকি অর্থহীন কোনো শব্দও জোগাতে পারলাম না। এমন অভাবনীয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত একটা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ফলে আমার শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে সচকিত হয়ে পড়ল। আর ঘাড়ের কাছ থেকে একটা হিমেল স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে দ্রুত নিচের দিকে নেমে গেল।

    একটা নিরবচ্ছিন্ন দুর্বিষহ উল্কণ্ঠা আমাকে চেপে ধরল। তীব্র কৌতূহল আমার মন-প্রাণ ছেয়ে ফেলল। কর্তব্য স্থির করতে না পেরে আমি কপালের চামড়ায় বিস্ময়ের ভজ এঁকে চেয়ারে হেলান দিয়ে নিশ্চল-নিথরভাবে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমার শ্বাসক্রিয়াও যেন বন্ধ হয়ে গেছে।

    আমার ফুসফুস নিঙড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্রায় অস্ফুট স্বরে, উচ্চারণ করলাম–‘হায় ঈশ্বর! তার একী হাল দেখছি! শরীরটা যে শুকিয়ে একেবারে পোড়াকাঠ হয়ে গেছে। তার দেহের কোথাও আগেকার সে রূপ লাবণ্যের চিহ্নও যে নজরে পড়ছে না। এ আমি কাকে দেখছি! এ-ই কি আমার বাগদত্তা বেরেনিস, নাকি অন্য কেউ!

    আমার জ্বলন্ত দৃষ্টি তার সর্বাঙ্গে বার কয়েক চক্কর মারার পর শেষপর্যন্ত তার মুখের ওপর স্থির হল।

    আমি মুহূর্তে সচকিত হয়ে খাড়াভাবে বসে পড়লাম। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তা চকের মতো ফ্যাকাশে কপালটা যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর চক-চকও করছে অস্বাভাবিক। অতীতের কুচকুচে কালো চুলের গোছার কিছুটা অংশ সামনের দিকে ঝুলে-পড়ে ফ্যাকাশে কপালটার বেশ কিছুটা অংশ ঢেকে দিয়েছে।

    চোখের মণি দুটোনিষ্প্রভ, প্রাণহীন। মনে হচ্ছে চোখের কোটর দুটোতে মণির অস্তিত্বও বুঝি নেই।

    তারনিষ্প্রভ চোখের মণি দুটো থেকে আমার দৃষ্টিকে তুলে নিয়ে তার পাতলা, কুচকুচে কালো ঠোঁট দুটোর ওপর রাখলাম। মুহূর্তেই ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হল। অর্থপূর্ণ হাসির ছোপ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। ঝকঝকে দাঁতগুলো আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হল। পরমপিতার ইচ্ছায় যেন আমাকে আর কোনোদিন সে দৃশ্যের সম্মুখীন হতে না হয়। আজ যখন তা আমাকে দেখতেই হল, তার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন? কেন আমি পৃথিবী ছেড়ে লোকান্তরে চলে গেলাম না।

    আমি ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম, তাকিয়ে দেখলাম, আসলে আচমকা দরজা বন্ধ হওয়ায়, দরজার পাল্লা দুটোর ঠোকাঠুকির আওয়াজ হতেই আমাকে আচমকা ঘাড় ঘোরাতেই হল। দেখলাম, আমার বোন বেরেনিস ঘর ছেড়ে চলে গেছে। ঘর ছেড়ে গেছে বটে, কিন্তু আমার মনের গোপন কন্দর ছেড়ে তো চলে যায়নি। তাড়িয়ে দিলেও সে যাবে না। যেতে পারে না, দাঁতের পাটি দুটোর ভৌতিক ঝকঝকানি তো আমার মনের আড়ালে যাবে না। সাদা–একেবারে বরফের মতো সাদা, কোথাও তিলমাত্র দাগ নেই। এনামেলের ওপর সামান্যতম ছায়াপাতেও হয়নি। আরও আছে। কোথাও কিছুমাত্রও ক্ষয় হয়নি।

    একটা কথা তো আর মিথ্যা নয়, তার সে ক্ষণিকের হাসিটুকুই যে দাঁতের পাটি আমার স্মৃতিতে সুস্পষ্ট ছাপ এঁকে দিয়েছে। তখন তার মনোলোভা দাঁতগুলোকে যেমন সুন্দর দেখেছিলাম এখন সেগুলোকেই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।

    দাঁত। দাঁতের পাটি। দাঁতের সে পাটি দুটো এখানে উপস্থিত, সেখানে উপস্থিত, সর্বত্র উপস্থিত–একেবারে আমার চোখের সামনে উপস্থিত, হাতের নাগালের মধ্যে উপস্থিত। লম্বা, সরু আর ঝকঝকে চকচকে দাঁতগুলো ঠোঁট দুটো দিয়ে চেপে ধরে রাখা হয়েছে।

    ব্যস। সে মুহূর্তেই আমার মনোম্যানিয়া ভয়ঙ্কররূপে দেখা দিয়েছে। আমার প্রাণাধিকা বেরেনিসের অত্যাশ্চর্য অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের বিরুদ্ধাচারণ, প্রতিরোধের যাবতীয় প্রয়াসই দারুণভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে। বাইরের জগতের অগণিত দ্রব্য সামগ্রির মধ্য থেকে দাঁত ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাবনা আমার মনের কোণে স্থান করে নিতে পারে না। তার কবল থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। অন্য যাবতীয় বস্তু, যাবতীয় উৎসাহ–আগ্রহ সে একটামাত্র চিন্তায় ডুবে গেল। আমার মনের চোখের সামনে অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব লোপ পেয়ে গিয়ে তারাই শুধুমাত্র তাদের উপস্থিতিই অনুভব করতে পারছি। কেবলমাত্র তারাই আমার অন্তরের অন্তঃস্থলের মূলমন্ত্রে। পরিণত হয়ে গেল।

    আমি সব রকমের আলোকরশ্মিতে, সব রকম প্রেক্ষাপটে তাদের চাক্ষুষ করলাম। তাদের বৈশিষ্ট্যকে বিচার-বিশ্লেষণ করলাম। আর তাদের গঠন প্রকৃতি নিয়েও কম ভাবনা-চিন্তা করলাম না। তাদের পরিবর্তনের ব্যাপার-স্যাপার নিয়েও আকাশ-পাতাল ভাবলাম। কেবল ভাবনা, ভাবনা, আর ভাবনায় আমি তলিয়ে রইলাম।

    ক্রমে সন্ধ্যার আলো-আঁধারীর খেলা শুরু হয়ে গেল। আমাকে ঘিরে নেমে সন্ধ্যার অন্ধকার। সে অন্ধকার ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হল। ক্ষণিকের জন্য থমকে থাকল। তারপরেই চলে গেল। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আমার চারিদিকের অন্ধকার।

    অন্ধকার কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে দিনের আলো নেমে এলো। ফুটফুটে ঝকঝকে দিন। একটু একটু করে দ্বিতীয় রাতের চারদিকে জমতে লাগল, ক্রমে আমাকে ঘিরে ফেলল।

    সে অন্ধকার নির্জন-নিরালা অন্ধকার ঘরটায় আমি চেয়ার আঁকড়ে বসে রয়েছি তখনও সে একই চিন্তা আমার মাথার চারদিকে ভিড় করে রয়েছে, আমি চিন্তার সমুদ্রে পুরোপুরি ডুবে রয়েছি। এমন সে ঝকঝকে দাঁতের পাটি দুটোর ভৌতিক উপস্থিতি বীভৎস স্পষ্টতায় পরিবর্তনশীল আলো-আঁধারীতে নিঃশব্দে ভেসে বেড়াচ্ছে।

    শেষপর্যন্ত সে স্বপ্নের ঘোরে স্পষ্ট আমার কানে বাজতে লাগল ভয়ঙ্কর আতঙ্ক মিশ্রিত দুঃখে এক করুণ চিত্তার। পরমুহূর্তেই বাতাসের কাঁধে ভর করে ভেসে এলো বহু সমবেত কণ্ঠের চিল্লাচিল্লির আওয়াজ; সে সঙ্গে দুঃখ-যন্ত্রণামিশ্রিত, ভাঙা-ভাঙা স্বর।

    আমি যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

    লাইব্রেরির একটা দরজার পাল্লা ফাঁক করে দেখলাম ঠিক পাশের ঘরটাতে এক পরিচারিকা দাঁড়িয়ে প্রায় বিলাপ ছেড়ে কেঁদে চলেছে।

    দরজায় আমাকে দেখে বলল–‘হায়! বেরেনিস—

    ‘বেরেনিস! কী হয়েছে।’

    আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সে আবার বলতে শুরু করল—

    ‘বেরেনিস ইহলোক ত্যাগ করেছেন।‘

    ‘সে কী! এমনকি ঘটল যে হঠাৎ সে ইহলোক ত্যাগ করেছে!’

    ‘খুব সকালেই তার দেহে তাপম্মার রোগের প্রকাশ ঘটে। আর এখন রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কবর খোঁড়ার কাজ মিটে গেছে।

    আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে নীরব চাহনি মেলে তার মুখের। দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    সে বলে চলল–এদিকে সমাধির আয়োজনও সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, আমি কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাজ এঁকে বজ্রাহতের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    .

    আমি ঘরটার চারিদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলাম, আমি লাইব্রেরিতে, চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে নীরবে বসে রয়েছি আর একা, একদম একাই বসে রয়েছি।

    সে মুহূর্তে আমার মনে হল, উত্তেজনাপূর্ণ স্বপ্ন দেখে যেন এইমাত্র জেগেছি।

    আমি জানি, সময় এখন মাঝরাত। আর এও ভালোই জানি, সূর্যপাটে বসলেই বেরেনিসের মৃতদেহটাকে সমাধিস্থ করা হয়ে গেছে।

    কিন্তু তার মাঝখানের ভয়ঙ্কর সময়টা সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু আমার জানা নেই, ধারণাও নেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সে বিশেষ সময়টার স্মৃতি বিভীষিকাময়। আর সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকার কারণেই সে বিভীষিকা আরও অনেক, অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। আর অধিকতর দ্ব্যর্থবোধক হওয়াতেই আতঙ্কটা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

    আমার জীবনের সে অতীত-কাহিনী সম্পূর্ণটা লেখা হয়েছে সেটা অস্পষ্ট, ভয়ঙ্কর ও দুর্বোধ্য টুকরো-টুকরো স্মৃতি গেঁথে গেঁথে, সেদিনের স্মৃতিটা সে কাহিনীরই ভয়ঙ্কর একটা পাতা। আমি সেটাকে পড়ার জন্য বহুবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমার পক্ষে কিছুতেই পড়া সম্ভব হয়নি। অথচ মাঝে-মধ্যেই বাতাসে ভেসে-আসা দূরাগত শব্দের ভূতের এক মেয়েলি গলার কর্কশ ও বুকফাটা আর্তচিৎকার আমার কানে একনাগাড়ে বেজেই চলল।

    আমি একটা কাজ সমাধা করেছি। কি সেটা, তাই না? প্রশ্নটা আমি বার বার গলা ছেড়ে নিজেকেই নিজে করেছি। আর ঘরের অনুচ্চ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি উত্তর দিয়েছে– ‘কি? কি সেটা?

    বাতিদানে একটা মোমবাতি জ্বলছে। পাশের টেবিলে বাতিদানটা রক্ষিত আছে। আর তার গায়েই ছোট্ট একটা বাক্স রয়েছে। সত্যি বিচিত্র ধরনের সে বাক্সটা। এটাকে আমি ইতিপূর্বেও বহুবার দেখেছি। কারণ আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক এটা নিয়েই প্রতিবার আমাদের বাড়ি আসতেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা এখানে, আমার টেবিলের ওপর আসার কারণটি কি? আরও আছে। এটাকে দেখামাত্র আমার সর্বাঙ্গে কম্পন অনুভূত হলই বা কেন? বহু চিন্তা-ভাবনা করেও এর রহস্যভেদ করতে পারলাম না। আসলে এ সবের কোনোই ব্যাখ্যা নেই।

    শেষমেশ একটা বইয়ের খোলা-পাতায় আমার নজর গেল। সে মুহূর্তেই নিচে দাগ-দেওয়া একটা বাক্য সবচেয়ে বেশি করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল!

    বাক্যটা পড়তে পড়তে আমার মাথার চুলগুলো সজারুর কাটার মতো খাড়া হয়ে উঠল। এর কারণ কি? আর কেনই বা আমার প্রতিটা শিরা-উপশিরার রক্ত জমাট বেঁধে গেল। এ-সব রহস্য ভেদ করার শত চেষ্টা করেও আমাকে পুরোপুরি হতাশ হতে হল।

    আমি চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে উদ্ভত রহস্যগুলোর সমাধানের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি ঠিক তখনই লাইব্রেরির দরজায় বার-কয়েক মৃদু টোকা হল। আমি যন্ত্রচালিতের মতো তড়া করে সোজা হয়ে বসে পড়লাম। দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে উকর্ণ হয়ে রইলাম। ঠিক তখনই সমাধিস্থ মৃতের মতো আলতোভাবে পা টিপে টিপে ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে এক চাকর ঘরে ঢুকে এলো।

    চাকরটার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। গলা নামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলল। একে সগতোক্তিও বলা চলে।

    সে কি বলল, তাই না? কেবলমাত্র টুকরো টুকরো কয়েকটা বাক্য আমার কানে এলো।

    তার মুখে শুনলাম, সুতীব্র ও তীক্ষ্ণ একটা আর্ত চিৎকারে রাতের নীরবতা ভেঙে গেল। পড়ি কি মরি করে বাড়ির সবাই ছুটে এসে এক জায়গায় জড়ো হল। শব্দের উৎসটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে খোঁজও করা হল। কথাটা বলতে বলতে উত্তেজনায় তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। আর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হয়ে এলো। সে অনুচ্চ কণ্ঠে, প্রায় ফিসফিস করে বলল–একটা সমাধি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে, কালো কাপড়ে মোড়া শবদেহ যারপরনাই বিকৃত হয়ে গেছে, অথচ সে স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বুক দ্রুত ওঠা-নামা করছে জীবিত, এখনও সে জীবিত রয়েছে।

    সে আমার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল, আমার পোশাক পরিচ্ছদের দিকে ইশারা করল। আমার পোশাকের অর্ধাংশ কাদায় মাখামাখি। আর তার বহু জায়গায় রক্তের ছোপ, জমাট বাঁধা রক্ত।

    আমি একটা কথার টু শব্দটিও করলাম না। সে ধীর-পায়ে এগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। ধীর-মন্থরভাবে আমার হাতটা চেপে ধরল। তার হাতে মানুষের নখের আঁচড়।

    সে দেয়ালে হেলান দিয়ে কাৎ করে রাখা একটা জিনিসের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

    আমি মিনিট কয়েক অপলক চোখে সে দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা কোদাল কাদামাখা বড়সড় একটা কোদাল।

    আমি বিকট আর্তনাদ করে অতর্কিতে লম্বা একটা লাফ দিয়ে আবার টেবিলটার কাছে ফিরে গেলাম! বাক্সটাকে দুহাতে চেপে ধরলাম। সেটাকে খোলার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম। ব্যর্থ হলাম। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই হল।

    আমার কাঁপা কাঁপা হাতের বন্ধন থেকে ফসূকে গিয়ে বাক্সটা অকস্মাৎ মেঝেতে পড়ে গেল। চোখের পলকে সেটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে কয়েকটা দাঁত তোলার যন্ত্রপাতি মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। আর? হাতির দাঁতের সাদা, ঝকঝকে চকচকে অথচ ছোট কয়েকটা বস্তু মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। আমি আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সেগুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }