Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডভেঞ্চার ভয়ংকর – হিমাদ্রিকিশোর দাসগুপ্ত

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প325 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    শিকারি শিকার

    ‘নিয়ে যান দাদা, নিয়ে যান৷ কোত্থেকে যে হঠাৎ এই কুকুরটা এখানে হাজির হল কে জানে! মনে হয় কেউ ছেড়ে দিয়ে গেছে৷ কারো বাড়ির পোষা কুকুর ছিল৷ নইলে গলায় বকলস থাকবে কেন? পুষতে না পেরে হয়তো ধাবার সামনে ছেড়ে দিয়ে গেছে, এখানে প্রাণীটা খাবার পাবে বলে৷ কিন্তু আমার হয়েছে জ্বালা৷ ও যেমন আপনার পায়ে পায়ে ঘুরছে তেমনই অন্য কাস্টমারদেরও পায়ে পায়ে ঘোরে৷ সবাই তো আর সমান হয় না৷ অনেকে কুকুর দেখলে ভয় পায়৷ এই তো সেদিন একদল লোক গাড়ি থেকে নেমেছিল এখানে খাবার খাবে বলে৷ কিন্তু কুকুরটা দেখে একজন মহিলা ভয় পেয়ে এমন চিৎকার করল যে সবাই আবার গাড়িতে উঠে চলে গেল৷ কত ক্ষতি হল আমার৷ আপনি নিয়ে গেলে আপদ যায়৷’—একটানা কথাগুলো বলে শৌনকের পায়ের সামনে দাঁড়ানো কুকুরটার দিকে তাকাল মাঝবয়সি ধাবা-মালিক৷

    মাঝারি আকৃতির একটা পাহাড়ি কুকুর৷ দো-আঁশলা ধরনের৷ গায়ের লোমটা একটু বড়ো৷ পুরুষ৷ ঘাড় তুলে তাকিয়ে আছে শৌনকের দিকে৷ আসলে বাস থেকে নেমে ধাবায় ঢুকে কুকুরটাকে দেখেই শৌনকের মনে পড়ে গেছিল তার সদ্যপ্রয়াত আদরের কুকুর জিকোর কথা৷ যদিও জিকো পথকুকুর ছিল না, কলকাতার নিউমার্কেট থেকে কেনা জিকো বংশ-মর্যাদাতে বেশ কুলীন ছিল, তবুও এই সাদা-কালো ছোপ ছোপ কুকুরের বাচ্চাটাকে দেখেই প্রায় চমকে উঠেছিল শৌনক৷ কুকুরটা যেন প্রায় জিকোর মতোই দেখতে৷ আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কুকুরটার প্রেমে পড়ে গেছে শৌনক৷ অবশেষে সে প্রস্তাব দিয়ে ফেলল ধাবা- মালিককে—‘কুকুরটা আমাকে দেবেন? আমি এটাকে কলকাতা নিয়ে যাব৷’

    আর তার কথা শুনেই ওই জবাব ধাবা-মালিকের৷

    শৌনক খুশি হয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে৷ আপনার কাছে কোনো চেন হবে? এখানে কোনো দোকান থাকলে কিনে নিতাম৷ ওকে নিয়ে যেতে হবে তো৷ চেন থাকলে সুবিধা হবে৷ যা পয়সা লাগবে আমি দেব৷’

    লোকটা বলল, ‘চেন তো আমার কাছে নেই৷ হাতখানেক লম্বা একটা নাইলনের দড়ি দিচ্ছি৷ সেটা গলায় বেঁধে আপাতত কাজ চালান৷’

    সেইমতোই ব্যবস্থা হল৷ লোকটা দড়ি আনল৷ শৌনক সেটা বেঁধে দিল মাঝারি আকৃতির কুকুরটার গলায়৷ দোকানের পাওনা আগেই মেটানো হয়ে গেছিল৷ এবার সে ধাবা-মালিককে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি তো ফরেস্ট দেখার জন্য যাব৷ কীভাবে যাব? থাকার জায়গা পাব ওখানে?’

    ধাবা-মালিক বলল, ‘ফরেস্টের গেট এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূর৷ যেভাবেই যান, পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ ওখানে কিছু ছোট হোটেল আছে৷ রাতে থেকে সকালে পারমিট নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে হবে৷ ওদিকে যাবার জন্য লোকাল বাস আছে ঠিকই, কিন্তু কুকুর নিয়ে বাসে উঠতে দেবে না বলেই মনে হয়৷ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান৷ যদি শেয়ারের কোনো ছোট গাড়ি পান বা ফাঁকা গাড়ি পান, তা ধরে চলে যাবেন৷’

    শৌনক কুকুরটার দিকে তাকিয়ে পিঠে কিটব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘চল জিকো৷ এবার আমরা রওনা হই৷’

    হ্যাঁ, এ নামেই সে ডাকবে কুকুরটাকে৷ জিকো কোনো আপত্তি করল না৷ বরং লেজ নেড়ে উঠে দাঁড়াল শৌনকের সঙ্গে বাইরে যাবার জন্য৷ শৌনকের মনে হল জিকো যেন আবার ফিরে এসেছে তার কাছে৷

    জিকোর গলায় নাইলনের দড়িটা ধরে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল শৌনক৷ কালো পিচরাস্তা একদিক থেকে এসে এঁকেবেঁকে চলে গেছে অন্যদিকে৷ পথের দু-পাশে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়শ্রেণি৷ জঙ্গল ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে৷ বিকেল চারটে বাজে৷ শিলিগুড়ি থেকে বাসে চেপে এসে বেলা আড়াইটে নাগাদ খুব খিদে পেয়েছিল বলে নেমে পড়েছিল এখানে৷ সূর্যদেব এখন দিনশেষের রোদ ছড়াচ্ছেন পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলের ওপর৷ অনেক অনেক দূরে পাহাড়গুলোর মাথার ওপর দিয়ে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ এ অঞ্চলটা ভারত-নেপাল সীমান্তের তরাই অঞ্চল৷

    রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধাবমান গাড়িগুলো থামাবার জন্য হাত নাড়তে লাগল শৌনক৷ কিন্তু গাড়িগুলো থামছে না৷ হয় তাদের অপরিচিত পথচারীকে গাড়িতে তোলার ইচ্ছা নেই, অথবা শৌনকের সঙ্গে কুকুরটাকে দেখেই তারা থামছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বেশ বড় প্রাইভেট গাড়ি শৌনক হাত দেখাবার পর তাকে অতিক্রম করে বেশ অনেকটা এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল৷ তারপর ধীরে ধীরে পিছনের দিকে আসতে শুরু করল৷ গাড়িটা কি তাকে নিতে চায়? জিকোর গলার দড়িটা ধরে গাড়িটার দিকে ছুটল শৌনক৷ কালো কাচ তোলা সাদা রঙের একটা এস. ইউ. ভি৷ শৌনক গাড়িটার কাছে পৌঁছতেই চালকের আসনের কাচটা একটু নেমে গেল৷ ভিতর থেকে উঁকি দিল একটা মুখ৷ তাকে দেখে শৌনকের মনে হল লোকটা নেপালি বা স্থানীয় কোনো পাহাড়ি মানুষ হবে৷ লোকটা তাকে প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘কিধার যানা হ্যায়? ইয়ে কুত্তা আপকা হ্যায়?’ শৌনক বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে জবাব দিল, ‘আমি ট্যুরিস্ট৷ কলকাতা থেকে আসছি৷ ফরেস্ট দেখতে যাব৷ হ্যাঁ, কুকুরটা আমারই৷ আপনি কি ফরেস্ট গেটে যাচ্ছেন? আমাকে পৌঁছে দেবেন? যা ভাড়া লাগবে দেব৷’

    গাড়ির মাঝখানের আসনে কালো কাচের আড়ালে কেউ একজন আছে৷ কারণ ড্রাইভার তার দিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা স্বরে কী যেন কথাবার্তা বলল প্রথমে৷ তারপর শৌনককে বলল, ‘গাড়িতে উঠে পড়ুন৷’

    গাড়ির মাঝের দরজাটা খুলে গেল৷ কুকুরটাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে শৌনক গাড়িতে উঠে পড়ল৷

    ৷৷ ২৷৷

    গাড়িতে উঠেই শৌনক দেখতে পেল যে ভিতরে বসে আছে তাকে৷ লোকটার পরনে দামি জ্যাকেট, গালে চাপদাড়ি, চোখে কালো চশমা, মাথায় একটা ক্যাপ৷ লোকটাকে প্রথম দর্শনেই কেমন যেন চেনা মনে হল শৌনকের৷ লোকটা তাকিয়ে আছে কুকুরটার দিকে৷ কুকুরটাকে পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করতেই চলতে শুরু করল গাড়ি৷ লোকটাই প্রথমে ভরাট গলাতে প্রশ্ন করল, ‘কুকুরটার গলাতে চেনের বদলে দড়ি কেন? রাস্তা থেকে ধরলেন নাকি? কুকুরটা তো এখানকারই মনে হচ্ছে!’

    শৌনক হেসে জবাব দিল, ‘না, ঠিক রাস্তা থেকে নয়৷ আমি কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছি৷ ধাবায় খেতে নেমেছিলাম৷ সেখান থেকেই সংগ্রহ করলাম৷ চেন তো পেলাম না৷ তাই তার বিকল্প হিসাবে দড়ির ব্যবস্থা করেছি আপাতত৷’

    লোকটা বলল, ‘ভারী সুন্দর দেখতে কুকুরটা৷’

    শৌনক আবারও হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর৷ সেজন্যই তো নিলাম৷ কলকাতাতে ওকে নিয়ে ফিরতে একটু কষ্ট হবে ঠিকই৷ তবুও নিলাম৷ খুব বেশি বয়স হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে না৷’

    লোকটাও এবার হেসে বলল, ‘তবে আপনার কষ্টটা লাঘব হবে যদি কুকুরটা আমাকে দিয়ে দেন৷’

    শুধু লোকটার চেহারা নয়, তার কণ্ঠস্বরও যেন খুব বেশি চেনা মনে হল শৌনকের৷ তার প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে শৌনক একটু ইতস্তত করে তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আপনাকে কোথাও দেখেছি? কেন জানি না আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে!’

    শৌনকের কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইল লোকটা৷ তারপর চশমা আর টুপি খুলে একটানে খুলে ফেলল তার নকল চাপদাড়ি৷ শৌনক এবার তাকে চিনতে পেরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল৷ এ ভদ্রলোকের সঙ্গে এর আগে সামনাসামনি পরিচয় না হলেও শৌনক তাকে সিনেমা আর টেলিভিশনের পর্দাতে বহুবার দেখেছে! বাংলা সিনেমার অ্যাকশন হিরো রাজা দেববর্মা৷ লোকে যাকে সংক্ষেপে রাজা বর্মা বলে৷ শৌনক যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না তার পাশেই বসে আছেন বিখ্যাত অভিনেতা রাজা বর্মা! যাকে লোকে টিকিট কেটে দেখতে যায়! শৌনকের চোখে-মুখে প্রচণ্ড বিস্ময়ের ভাব দেখে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই৷ এখানে এই উত্তরবঙ্গে একটা শু্যটিং-এর কাজে এসেছিলাম৷ কাজ মেটার পর জঙ্গলে যাচ্ছি৷ আমরা যেখানেই যাই সেখানেই লোকজন আমাদের ঘিরে ধরে৷ তাই ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল৷ এখন অবশ্য সে প্রয়োজন নেই৷ ফাঁকা রাস্তা৷’

    প্রাথমিক বিস্ময়বোধ কাটিয়ে উঠে শৌনক বলল, ‘আসলে আমি ভাবতেই পারছি না আমি আপনার পাশে বসে আছি! আপনাকে পর্দায় কত দেখেছি!’

    রাজা বর্মা হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘দেবেন আমাকে কুকুরটা? এমন একটা কুকুর পোষার শখ আমার৷’

    শৌনক তাকাল কুকুরটার দিকে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার বড় মায়া পড়ে গেছে কুকুরটার ওপর৷ শৌনক হয়তো বলত, ‘আচ্ছা নিন৷’ কিন্তু কুকুরটার দিকে তাকিয়ে শৌনকের মনে পড়ে গেল তার মৃত পোষ্য জিকোর কথা৷ কুকুরটা যেন অবিকল জিকোর মতো দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে শৌনকের দিকে৷ সে যেন তাকে বলছে—‘আমাকে কাউকে দিয়ো না তুমি৷ আমি তো জিকোই৷ তোমার কাছে আবার ফিরে এলাম৷’

    ‘নিন’ আর বলতে পারল না শৌনক৷ কিছুটা বিব্রত ভাবে বাধ্য হয়ে একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, ‘আমাকে মার্জনা করবেন৷ আসলে ওই ধাবা-মালিক আমার পরিচিত৷ তাঁর নিকটাত্মীয় আমার বাড়ির পাশেই থাকেন৷ ধাবা-মালিককে আমি কথা দিয়েছি কুকুরটা আমি কাউকে দেব না৷ তিনি যে আমাকে কুকুরটা দিচ্ছেন সেটা ওই আত্মীয়কেও ফোনে জানিয়েছেন৷ বিশ্বাসভঙ্গ হলে ব্যাপারটা খারাপ হবে৷ আমার প্রতিবেশী, ধাবা-মালিকের আত্মীয়ও অসন্তুষ্ট হবেন৷’

    শৌনকের কথা শুনে চুপ করে গেলেন রাজা বর্মা৷ আর নতুন জিকো যেন শৌনকের কথা শুনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই মুখ ঘষতে লাগল তার পায়ে৷ সামনের রাস্তা চিরে এগিয়ে চলতে লাগল গাড়ি৷

    বেশ কিছুক্ষণ পর আবার মুখ খুললেন রাজা বর্মা৷ তিনি বললেন, ‘আপনার কি হোটেল বুক করা আছে?’

    শৌনক বলল, ‘না, নেই৷ আসলে আমি একা মানুষ, সংসার বা বন্ধুবান্ধব তেমন কেউ নেই৷ একটা ছোট ব্যবসা করি৷ আর ইচ্ছা হলেই বেরিয়ে পড়ি নানা জায়গায় ঘুরতে৷’

    কথাটা শুনে রাজা বর্মা বললেন, ‘এটা ট্যুরিস্ট সিজন৷ ফরেস্ট গেটে সামান্য ক’টা হোটেল আছে৷ আগাম বুকিং না থাকলে ঘর পাবেন না৷ এই ঠান্ডার দেশে রাস্তায় কাটাবেন কীভাবে? কি তেজপ্রতাপ, তাই তো?’

    ড্রাইভার বলল, ‘সহি বাত সাব৷ ঘর নেহি মিলেগা৷’

    কথাটা শুনে শৌনক চিন্তিত ভাবে বলল, ‘তবে কী করা যায় বলুন তো?’

    অভিনেতা রাজা বর্মা একটু যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে আপনি আপনার সারমেয় সমেত আমার সঙ্গে যেতে পারেন৷ আপনি জানেন কি না জানি না, এই তরাই অঞ্চলে একসময় আমাদের পূর্বপুরুষের একটা জমিদারি ছিল৷ দেশ স্বাধীন হবার পর সরকার সম্পত্তি কেড়ে নিলেও জঙ্গলের মধ্যে এখনও একটা পুরোনো বাংলো আছে আমাদের৷ আমি নিজে সেলিব্রিটি, তা ছাড়া জমিদারের বংশধর হিসেবে সে বাংলোতে থাকার জন্য আমার কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না৷ আমি দু-রাত নিরুপদ্রবে সেখানে থাকার জন্যই যাচ্ছি৷ জঙ্গল ঘেরা নির্জন বাংলো৷ ওয়াইল্ড লাইফেরও দেখা মেলে৷ তবে আগেই বলে রাখছি সেখানে ইলেকট্রিসিটি বা আরামের ব্যবস্থা নেই৷’

    কথাটা শুনে উৎফুল্ল ভাবে শৌনক বলল, ‘এ তো সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ আপনার সঙ্গে দুটো রাত কাটাব, এর থেকে বড় ব্যাপার কী হতে পারে? আমার কোনো অসুবিধা হবে না৷’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে চলুন আমার সঙ্গে৷’

    এরপর রাজা বর্মার সঙ্গে টুকটাক নানা কথা বলতে লাগল শৌনক৷ অধিকাংশ কথাই নানা সিনেমাতে রাজা বর্মার অভিনয়ের প্রশংসা করে৷

    পিচরাস্তা ছেড়ে একসময় কাঁচা পথ ধরল গাড়ি৷ দিনান্তের ঘরে ফেরা পাখির কলকাকলিতে দু-পাশের গভীর জঙ্গল মুখরিত৷ বেশ অনেকটা পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলার পর একটা ভাঙাচোরা একতলা কাঠের বনবাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা৷ অনুচ্চ কাঠের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে দরজার কপাটহীন বাংলোটা৷ গাড়ি থেকে নেমে রাজা বর্মা বললেন, ‘প্রায় দেড়শো বছর আগে আমার প্রপিতামহ এই বাংলোটা বানিয়েছিলেন৷ তিনি আর ব্রিটিশ রাজপুরুষরা তখন শিকার খেলতে আসতেন এখানে৷ এ তল্লাটে সেসময় প্রচুর বাঘ ছিল৷’ তাঁর কথা শেষ হতেই কুকুরটা চারপাশে একবার দেখে নিয়ে শৌনকের দিকে তাকিয়ে ‘ভুক ভুক’ শব্দে ডেকে উঠে যেন বলল, ‘বেশ জায়গাতে আনলে তো তুমি!’ শৌনক তার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিল৷ গাড়ি থেকে মালপত্র নামানো শুরু হল৷ তার মধ্যে একটা রাইফেলও দেখতে পেল শৌনক৷ রাজা বর্মা হেসে বললেন, ‘এটা লাইসেন্সড আর্মস৷ তেজপ্রতাপ ক’দিন আগে এখানে এসেছিল বাংলোটাকে সাফসুতরো করার জন্য৷ বাঘের ডাক শুনেছিল ও৷ তাই নিরাপত্তার কারণেই বন্দুকটা এনেছি৷’

    শৌনকের পিঠের কিটব্যাগ ছাড়া মালপত্র বলতে আর কিছু নেই৷ রাজা বর্মার মালপত্র নামার পর বাংলোটাতে উঠে এল শৌনকরা৷ সার বাঁধা চারটে ঘর আছে বাংলোতে৷ কিন্তু মাঝের ঘর দুটোর ছাদ ফুটো বলে দু-প্রান্তের ঘরে, একটাতে রাজা বর্মা আর তাঁর সঙ্গীর, আর অন্যটাতে শৌনকের থাকার ব্যবস্থা হল৷ তেজপ্রতাপ একটা পলিথিন শিট আর কয়েকটা মোমবাতি দিয়ে গেল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল বাইরে৷ মোমবাতি জ্বালাবার পর জিকোর গলার দড়ি খুলে দিল শৌনক৷ ছাড়া পেয়ে সে ভুক ভুক শব্দ করে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ সঙ্গে আনা শুকনো খাবার দিয়ে শৌনক এরপর খাওয়া সারল৷ জিকোকেও খেতে দিল৷ খাওয়ার পর দরজার সামনে গিয়ে শুয়ে পড়ল জিকো৷ শৌনকের দিকে তাকিয়ে চাপা ডাক ছেড়ে সে যেন বলল, ‘শুয়ে পড়ো৷ কোনো চিন্তা নেই, আমি তো পাহারাতে রইলাম৷’ তার দিকে তাকিয়ে হেসে সত্যি শুয়ে পড়ল শৌনক৷ বাইরে চাঁদ উঠেছে৷ চাঁদের আলোতে বাংলোর চারপাশের বড় বড় গাছগুলো যেন কেমন একটা ভূতুড়ে অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ভেসে আসছে সেখান থেকে৷ সে শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল শৌনক৷

    ৷৷ ৩৷৷

    পরদিন জিকোর ডাকেই ঘুম ভাঙল শৌনকের৷ ধড়মড় করে উঠে বসে ঘড়ি দেখেই শৌনক বুঝতে পারল তার ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গেছে! বেলা প্রায় আটটা বাজে! আসলে কলকাতা থেকে আসার সময় রেলের জেনারেল বগিতে রাত জেগে আসতে হয়েছিল শৌনককে৷ তাই এদিন উঠতে দেরি হয়ে গেছে৷ কিন্তু রাজা বর্মা কী ভাবছেন কে জানে৷ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল শৌনক৷ সকালের আলোতে চারপাশ উদ্ভাসিত৷ পাখির ডাক ভেসে আসছে জঙ্গল থেকে৷ বারান্দাতে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তেজপ্রতাপের সঙ্গে কী যেন কথা বলছিলেন রাজা বর্মা৷ ছ-ফুট লম্বা, নির্মেদ ফর্সা দেহে সকালের আলোতে যেন জৌলুশ ঠিকরে পড়ছে৷ সত্যিই, পর্দার বাইরেও নায়কোচিত চেহারা রাজা বর্মার৷ শৌনক আর জিকো তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মাঝবয়সি রাজা বর্মা বললেন, ‘গুড মর্নিং ইয়ংম্যান৷ ভালো ঘুম হয়েছে তো?’

    শৌনকও তাঁকে সুপ্রভাত জানিয়ে একটু লজ্জিতভাবে বলল, ‘আমার উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল৷’

    রাজা বর্মা প্রথমে জিকোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্ট্রিট ডগ হলেও আপনার কুকুরটা কিন্তু বেশ৷ সারারাত এই বারান্দার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে ও আমাদের পাহারা দিয়েছে৷ তেজপ্রতাপ গাড়িতে শুয়েছিল৷ ও দেখেছে৷’

    এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘আপনি তৈরি হয়ে নিন৷ একটু পর আমরা জঙ্গল দেখার জন্য রওনা হব৷ ফিরতে বিকেল হবে৷’

    শৌনক বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি৷ কিন্তু জিকোকে সঙ্গে নেওয়া যাবে তো?’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই৷ ও না গেলে আমাদের যাওয়াটাই যে মাটি হবে৷’—কথাটা বলে হাসলেন তিনি৷

    বেলা ন’টা নাগাদ বাংলো ছেড়ে নেমে জঙ্গলের দিকে রওনা হল শৌনকরা৷ রাজা বর্মার পরনে এখন শিকারিদের মতোই খাকি রঙের পোশাক, মাথায় ক্যাপ, পায়ে রাবার সোলের জুতো৷ তেজপ্রতাপের কাঁধে বন্দুক৷ আর তাদের সঙ্গে জিকোর গলার দড়ি হাতে শৌনক৷ জঙ্গলে প্রবেশ করার পর শৌনক জানতে চাইল, ‘এ জঙ্গলে কী কী প্রাণী আছে?’

    তেজপ্রতাপ জবাব দিল, ‘হরিণ আছে, দাঁতাল শূকর আছে, নেকড়ে আছে আর চিতা আছে৷’

    শৌনক বলল, ‘বাঃ, চিতাও আছে!’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘চিতা, মানে চিতাবাঘ৷ ইংরিজিতে যাকে আমরা লেপার্ড বলি৷ এ দেশের শেষ দুটো চিতাশাবককে একশো বছর আগে শিকার করেছিলেন রেওয়ার মহারাজা৷ আপনার ভাগ্য ভালো থাকলে চিতার দর্শনও মিলে যেতে পারে৷ তবে ভয় নেই, সঙ্গে বন্দুক আছে৷ আর আমার বন্দুকের নিশানা মন্দ নয়৷ আফ্রিকার বেশ কয়েকটা দেশে আমি শিকার করেছি৷’

    শৌনক বিস্মিতভাবে বলল, ‘আপনি শিকার করেন এ কথা কোথাও পড়িনি বা শুনিনি তো!’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘সব কথা কি আর পাবলিক ইন্টারভিউতে বলা যায়, নাকি বলা উচিত? এ দেশে তো শিকার নিষিদ্ধ৷ কিন্তু আমার বাপ-ঠাকুর্দা শিকার করতেন৷ রক্তে শিকারের নেশা আছে৷ তাই যেসব দেশে শিকার নিষিদ্ধ নয়, সেসব দেশে আমি শিকারের জন্য যাই৷’

    ক্রমশই গভীর বনে প্রবেশ করতে লাগল শৌনকরা৷ বেশ ফুর্তিতে আছে জিকো৷ মাঝে মাঝেই সে লাফিয়ে উঠে ধরতে যাচ্ছে রাস্তার পাশে ঝোপের গায়ে উড়ন্ত প্রজাপতিকে৷ কখনও আবার ভুক ভুক শব্দে ডেকে উঠছে৷ রাজা বর্মা বললেন, ‘বেশ গলার জোর আছে তো কুকুরটার?’

    তেজপ্রতাপ বলল, ‘হ্যাঁ, এই তো চাই৷’

    আর এরপরই একদল চিতল হরিণকে দেখতে পেল শৌনকরা৷ আর তাদের দেখেই জিকোর কী লাফালাফি! দড়ি ছিঁড়ে যেন তাদের তাড়া করতে চায় সে৷

    ঘণ্টাখানেক চলার পর শৌনকরা জঙ্গলের ভিতর এমন একটা জায়গাতে উপস্থিত হল, যেখানে বড় গাছের আধিক্য কম হলেও চারপাশ বড় বড় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ৷ জমিটা সেখানে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছে৷ রাজা বর্মা বললেন, ‘আমরা এখন নেপালের ভূখণ্ডে প্রবেশ করলাম৷ জঙ্গলের ওপ্রান্তে মাইলখানেক দূরে একটা নেপালি গ্রামও আছে৷ তেজপ্রতাপের বাড়ি ওখানেই৷’

    কথাটা শুনে শৌনক বিস্মিতভাবে বলল, ‘তার মানে তো অন্য দেশ! আমাদের ঢুকতে কেউ বাধা দেবে না? আমরা কি এখন তেজপ্রতাপের বাড়ি যাব?’

    রাজা বর্মা জবাব দিলেন, ‘না, ওখানে যাব না৷ এদিকটাতে নেপালের পুলিশ বড় একটা আসে না৷ তা ছাড়া এখন…৷’

    কী যেন একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন রাজা বর্মা৷

    কিন্তু এরপরই একটা জিনিস খেয়াল করল শৌনক৷ সেই ঝোপঝাড়পূর্ণ জায়গাটাতে প্রবেশ করার পরই জিকোর উৎসাহ কেমন যেন স্তিমিত হয়ে এল৷ বাতাসে ঘ্রাণ নিতে নিতে চারপাশের ঝোপগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পথ চলতে লাগল সে৷ রাজা বর্মা আর তেজপ্রতাপের মধ্যেও যেন একটা সতর্ক ভাব৷ আরও বেশ কিছুক্ষণ ঝোপঝাড় ভেঙে চলার পর শৌনকরা একটা গাছের তলায় এসে দাঁড়াল৷ তাদের সামনে একটা ছোট উন্মুক্ত জমি৷ তাকে ঘিরে জঙ্গল৷ আর এরপরই শৌনক খেয়াল করল, যে গাছের নীচে এসে তারা দাঁড়িয়েছে তার গায়ে একটা মই লাগানো৷ আর শুকনো গাছের ডাল দিয়ে তৈরি মইটা গিয়ে শেষ হয়েছে মাটি থেকে হাত পনেরো উঁচুতে গাছের ডালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা মাচাতে! তেজপ্রতাপ তার ব্যাগের ভিতর থেকে একটা নলের মতো জিনিস বের করে বন্দুকটাতে লাগাতে লাগল৷ রাজা বর্মা বললেন, ‘শৌনকবাবু, আপনি মাচায় উঠে পড়ুন৷’

    বিস্মিত শৌনক বলল, ‘তার মানে?’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘মানে হল এখানে একটা চিতাবাঘ আছে৷ বাঘিনি আসলে৷ একটা মানুষও মেরেছে সে৷ সেটাকে মারতেই এসেছি৷ আপনি আগে উঠে পড়ুন৷ একটা ছোট কাজ সেরে আমরাও উঠছি৷’

    শৌনক বলল, ‘আপনি শিকার করতে এসেছেন! কিন্তু শিকার তো নিষিদ্ধ!’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না৷ তেজপ্রতাপ রাইফেলে সাইলেন্সার লাগাচ্ছে৷ কেউ কিছু জানবে না৷ তা ছাড়া চিতাটা মারা হয়ে গেলেই আমরা আবার ইন্ডিয়ার ভূখণ্ডে ফিরে যাব৷ নিন, মই বেয়ে মাচায় উঠুন৷’

    তাঁর কথার জবাবে কী বলবে তা বুঝে উঠতে পারল না শৌনক৷ রাজা বর্মা সেলিব্রিটি হলেও আগে এ ব্যাপারটা জানলে কিছুতেই সে এখানে আসত না৷ এখন যে শৌনক ফিরে যাবে তার উপায়ও নেই৷ পথ চিনে বাংলোতে ফিরতে পারবে না সে৷ সবচেয়ে বড় কথা, চিতাবাঘটা যদি সত্যিই কাছাকাছি থাকে তবে সে তো মারাত্মক ব্যাপার৷

    রাজা বর্মা আবার তাড়া দিলেন, ‘নিন উঠুন৷ নীচে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না৷’

    শৌনক তাকাল কুকুরটার দিকে৷ সে যেন কেমন একটু গুটিয়ে গেছে৷ শৌনক কুকুরটার দিকে চোখ রেখে অগত্যা বলল, ‘কিন্তু ওকে কীভাবে ওপরে তুলব?’

    তেজপ্রতাপের হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে রাজা বর্মা বললেন, ‘ও নীচেই থাকবে৷ ওর দড়িটা তেজপ্রতাপকে দিন৷’

    শৌনক জানতে চাইল, ‘নীচে কোথায়?’

    রাজা বর্মা ফাঁকা জমিটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে ফাঁকা জমির মাঝখানে একটা খোঁটা পোঁতা আছে দেখুন৷ এই মাচা, ওই খোঁটা, সব ব্যবস্থা করে রেখেছে তেজপ্রতাপ৷ ওই খোঁটাতেই বাঁধা থাকবে কুকুরটা৷’

    শৌনক বলল, ‘মানে?’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘মানে আর কিছুই না, কুকুরটাই হল বাঘ শিকারের টোপ৷ তবে আপনার কুকুরের কোনো ক্ষতি হবে না কথা দিলাম৷ ওকে দেখে চিতাটা ফাঁকা জমিতে বেরোলেই আমি চিতাটাকে নিকেশ করে দেব৷’

    ব্যাপারটা শুনে প্রথমে যেন কথা আটকে গেল শৌনকের৷ সে কোনোরকমে বলল, ‘বাঘ মারার জন্য তো ছাগলের টোপ দেওয়া হয় বলে জানতাম৷ কিন্তু কুকুরের টোপ!’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘হ্যাঁ, কুকুরের টোপ৷ তবে তা চিতার খাবারের জন্য নয়৷ ঘৃণা তৈরির জন্য৷ চিতারা কিছুতেই কুকুরদের সহ্য করতে পারে না৷ বিশেষত গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলের চিতারা তো নয়ই৷ কারণ, খাবারের খোঁজে তারা রাতে গ্রামে ঢুকলেই কুকুরেরা চিৎকার করে জাগিয়ে দেয় গ্রামের লোককে৷ এই চিতাটার ক্ষেত্রেও বারকয়েক এ ঘটনা ঘটেছে৷ কুকুরের প্রতি চিতাবাঘের জাতক্রোধ আছে৷ ওর ডাক চিতাটাকে ঠিক টেনে আনবে৷’

    শৌনকের কাছে এবার স্পষ্ট হয়ে গেল তার মতো একজন সাধারণ মানুষকে রাজা বর্মার মতো বিখ্যাত মানুষ কেন সঙ্গী করে এনেছেন৷ এই কুকুরটার জন্যই তাকে সঙ্গী করা হয়েছে!

    পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শৌনক বলে উঠল, ‘না, কিছুতেই জিকোকে আমি টোপ হতে দেব না৷ চলুন, ফিরে চলুন৷’

    শৌনক কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা বর্মার সুন্দর মুখটা হঠাৎই যেন কেমন কঠিন হয়ে উঠল৷ রাইফেলের নলটা শৌনকের চিবুকে স্পর্শ করালেন তিনি৷ কী হিমশীতল সেই স্পর্শ! রাজা বর্মা চাপা ধমকের স্বরে বললেন, ‘আর একটাও কথা নয়৷ অনেক সময় নষ্ট করেছেন৷ এ রাইফেল থেকে বাঘের দিকে গুলি বেরোলে যেমন শব্দ হয় না, তেমনই মানুষের দিকে বেরোলেও নয়৷ শেষবার বলছি, উঠে পড়ুন৷’

    হতভম্ব হয়ে গেল শৌনক৷ তার সামনে এ লোকটা কে? যাকে সিনেমার পর্দাতে দেখে তালি দেয় লোকে? হতভম্ব শৌনকের হাত থেকে এরপর এক ঝটকায় কুকুরের দড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে অনিচ্ছুক কুকুরটাকে টেনেহিঁচড়ে ফাঁকা জমিটার দিকে নিয়ে চলল তেজপ্রতাপ৷ আর রাইফেলের খোঁচা খেয়ে বাধ্য হয়ে মাচায় চড়ে বসল আতঙ্কিত বিহ্বল শৌনক৷ কুকুরটাকে ফাঁকা জমির মাঝখানে খোঁটায় বেঁধে তেজপ্রতাপ ফিরে আসার পর সে আর রাজা বর্মাও মাচায় চড়ে বসল৷ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জমিটা৷ আর তার মাঝখানে বাঁধা আছে অসহায় কুকুরটা৷ চারপাশে কোথাও শৌনক বা কোনো মানুষকে দেখতে না পেয়ে কুকুরটা অনেকটা কান্নার স্বরে ডাকতে লাগল৷ রাজা বর্মা জমিটার দিকে বন্দুক তাক করে বললেন, ‘বাঃ এই তো চাই৷ এ ডাকই ডেকে আনবে চিতাটাকে৷’

    অরণ্যের নিস্তব্ধ দুপুর৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ একটা পাখির ডাকও না৷ কোনো অজানা কারণে যেন নিঃশব্দ হয়ে আছে চারপাশের পৃথিবী৷ মাঝে মাঝে কুকুরটা কেঁদে উঠছে৷ সেই কান্না যেন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে হতাশ, অপমানিত শৌনক তাকিয়ে আছে মাঠের মাঝখানে বাঁধা অসহায় অবলা প্রাণীটার দিকে৷ সে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা৷ পর্দায় যে মানুষকে দেখে লোকে তালি দেয়, পর্দার বাইরে সে মানুষটা এমন হিংস্র হতে পারে! রাজা বর্মার দৃষ্টিও মাঠের দিকে নিবদ্ধ৷ নিশ্চুপ এক হিম দৃষ্টি!

    ঘণ্টাখানেক সময় তখন অতিক্রান্ত হয়েছে৷ হঠাৎই যেন আতঙ্কে প্রচণ্ড চিৎকার শুরু করল কুকুরটা৷ ছটফট করে গলার দড়িটা ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে৷ রাজা বর্মা সোজা হয়ে বসে চাপাস্বরে বললেন, ‘মনে হয় চিতাটা কাছে চলে এসেছে৷ বাতাসে ওর গন্ধ পেয়ে ছটফট করছে কুকুরটা৷’

    তেজপ্রতাপ বলল, ‘হ্যাঁ, সাব৷ আমাদের বুদ্ধি কাজে লেগেছে৷’

    পাগলের মতো দড়ি ছেঁড়ার চেষ্টা করছে কুকুরটা৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেজপ্রতাপ আঙুল তুলে দেখাল ফাঁকা জমিটার একটা দিকে৷ রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিলেন রাজা বর্মা৷ তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে শৌনক দেখতে পেল ঝোপের আড়াল থেকে ফাঁকা জমিতে এসে দাঁড়িয়েছে একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘিনি! সূর্যের আলোতে তার কালো ছোপ আঁকা হলুদ গা সোনার মতো উজ্জ্বল লাগছে৷ ঝোপ থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে তাকিয়ে আছে ছটফট করতে থাকা কুকুরের বাচ্চাটার দিকে৷ কুকুরটার প্রতি বিজাতীয় হিংস্র ঘৃণাতে মাঝে মাঝে তার লেজটা চাবুকের মতো মাটিতে আছড়াচ্ছে!

    বাঘিনি মনে হয় বুঝতে পারল কুকুরটা আটকে আছে৷ তাই ধীরেসুস্থে সে এরপর এগোতে থাকল তার জাতশত্রু নিধনের জন্য৷ এ তার ঘৃণার শিকার৷

    কুকুরটার হাত দশেক তফাতে গিয়ে থামল বাঘটা৷ এবার সে ঝাঁপ দেবে শিকারের ওপর৷ কামড়ে, থাবার আঘাতে চিরদিনের মতো থামিয়ে দেবে তার ছটফটানি৷ আর ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই নিজের অজান্তেই যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে এল শৌনকের গলা থেকে৷ এর পরমুহূর্তেই একসঙ্গে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটল৷ শৌনকের আতঙ্কিত চিৎকার শুনে চিতাবাঘটা গাছের দিকে তাকাল৷ আর রাজা বর্মাও চালিয়ে দিলেন গুলি৷ আর কুকুরটাও ঠিক সেই মুহূর্তেই কীভাবে যেন খোঁটা থেকে দড়ি ছিঁড়ে ফেলল৷ রাইফেলে সাইলেন্সার লাগানো আছে বলে কোনো শব্দ হল না৷ শুধু তার নলের মুখে একটা বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল৷ গুলি বাঘের গায়ে লেগেছে কি না বোঝা গেল না৷ শুধু প্রচণ্ড গর্জন করে বাঘটা শূন্যে সাত-আট হাত লাফিয়ে উঠল৷ তারপর মাটিতে পড়ে বিরাট এক লাফে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ আর জিকোও ছুটে হারিয়ে গেল ঠিক তার উল্টোদিকের জঙ্গলের ভিতরে৷ বাঘটার রক্ত-জল-করা গর্জন কিছুক্ষণ আশেপাশে অনুরণিত হবার পর সব কিছু আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷ শৌনকদের সামনে ফাঁকা জমিতে শুধু পড়ে আছে খোঁটায় বাঁধা কুকুরটার দড়ির একটু অংশ৷

    বেশ কিছুক্ষণ পর গাছ থেকে নামল সবাই৷ রাজা বর্মা অসন্তুষ্টভাবে শৌনককে বললেন, ‘আপনার চিৎকারের জন্য সব মাটি হল৷ তবু আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু মনে রাখবেন এ গল্প কাউকে আপনি করলে সে তা বিশ্বাস করবে না৷ বরং আপনার বিপদ হবে৷ আমার অনেক ক্ষমতা৷’ এই বলে তিনি রাইফেলটা দেখালেন শৌনককে৷

    শৌনক তবুও একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘কিন্তু আমার কুকুরটা?’

    রাজা বর্মা বললেন, ‘ওকে আর পাওয়া যাবে না৷ বাঘটা ওকে মারবেই৷ ওকে খুঁজতে যাওয়া মানে বাঘের মুখে পড়া৷ আপনি খুঁজতে চাইলে খুঁজুন৷ আমরা চললাম৷’—এই বলে তিনি বন্দুক উঁচিয়ে ফেরার পথ ধরলেন৷ অগত্যা শৌনককেও তাঁদের অনুসরণ করতে হল৷ বিকেল নাগাদ সেই ভাঙা বাংলোতে ফিরে এল তারা৷

    ৷৷ ৪৷৷

    নিজের ঘরে যাবার আগে রাজা বর্মা বললেন, ‘যা দেখলেন, যা শুনলেন সব ভুলে যাবেন৷ কাল সকালে আমরা এ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাব৷ বাইরে বেরিয়ে সুবিধাজনক কোনো জায়গাতে আপনাকে নামিয়ে দেব৷’ শৌনক তাঁর কথার কোনো জবাব দিল না৷ বাংলোর রেলিংহীন বারান্দাতে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন রাজা বর্মা৷ বাংলোর সামনে ফাঁকা জমিতে অনেকক্ষণ একলা দাঁড়িয়ে রইল শৌনক৷ রাজা বর্মার সঙ্গী গাড়ির দরজা খুলে ভিতরের একটা সিটে বসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে৷ ঠোঁটের কোণে যেন শৌনকের উদভ্রান্ত অবস্থা দেখে ব্যঙ্গের হাসি৷ তার দিকে দৃষ্টি পড়তেই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল শৌনক৷ তার বারবার মনে পড়তে লাগল জিকোর কথা৷ এখন কী করছে কুকুরটা? সে কি খুঁজে বেড়াচ্ছে শৌনককে? নাকি বাঘিনিটা তাকে এতক্ষণে মেরে ফেলেছে? সূর্য ডুবে গিয়ে অন্ধকার নামল একসময়৷ অগত্যা বাধ্য হয়েই শৌনক বাংলোতে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ সারাদিন খাওয়া হয়নি৷ কিন্তু তার খিদে পাচ্ছে না৷ এমনকি মোমবাতি জ্বালাতেও ইচ্ছা করল না৷ অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে সে ভাবতে লাগল সারাদিনের ঘটনার কথা৷ রাজা বর্মার প্রতি তার সব শ্রদ্ধা মুছে গিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও সে অসহায়৷ রাজা বর্মাকে কোনো শাস্তি দেবার ক্ষমতা তার নেই৷ বাইরের অন্ধকার একসময় গাঢ় হল৷ তারপর সেই অন্ধকার মুছে গিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করল৷ খোলা দরজা দিয়ে সেই চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে ঘরের অন্ধকার খানিক মুছে দিল৷ রাত ন’টা নাগাদ একটু জল খেয়ে শৌনক শুয়ে পড়ল৷ ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া বাইরে কোনো শব্দ নেই৷ রাজা বর্মার ঘরের দিক থেকেও কোনো শব্দ এল না৷ তিনি কী করছেন তা জানার বিশেষ ইচ্ছাও নেই শৌনকের৷ কাল কখন এই মানুষটার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারবে, তার জন্যই এখন শৌনকের প্রতীক্ষা৷ শুধু একবার বাংলোর নীচ থেকে ভেসে আসা গাড়ির দরজা বন্ধ করার অস্পষ্ট শব্দ শুনল শৌনক৷ সম্ভবত গাড়ির ভিতর শুয়ে পড়ল ড্রাইভার তেজপ্রতাপ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুম নেমে এল শৌনকের চোখেও৷

    শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল শৌনকের৷ মশার দল ছেঁকে ধরেছে তাকে৷ দু-চারবার চড়-চাপাটি দিয়ে মশা মারার পর সে বুঝল এ মশার ঝাঁক যাবার নয়৷ কাজেই সে উঠে বসল৷ তার হাতঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের কাঁটায় রাত সাড়ে তিনটে বাজে৷ আর ঘণ্টাখানেক পর থেকেই তো ভোরের আলো ফুটবে৷ মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে একসময় ঘরের সামনে বারান্দায় এসে দাঁড়াল শৌনক৷ চাঁদের আলোতে নীচের ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা৷ বাংলোর চারপাশ ঘিরে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর আড়ালে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার৷ সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শৌনকের আবারও মনে হল, কুকুরটা এখন কী করছে? সে আদৌ বেঁচে আছে তো?

    কিন্তু এরপরই হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল শৌনকের৷ বাংলোর যে অংশে রাজা বর্মার ঘর, সেদিকের জঙ্গলের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা প্রাণী৷ ফাঁকা জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার সে যেন ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের দিকে তাকাল৷ এরপর দ্রুত ছুটে এসে লাফিয়ে উঠল বারান্দাতে, ঠিক যে ঘরে রাজা বর্মা শুয়ে আছেন, সে ঘরের সামনে৷ প্রথম দর্শনে তাকে শেয়াল ধরনের কোনো প্রাণী ভাবলেও এবার তাকে চিনতে পেরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল শৌনক৷ আরে এ যে তার কুকুরটা! জিকো! কুকুরটার মুখে কী যেন একটা ধরা আছে! কিন্তু সেটা কী তা বোঝার আগেই রাজা বর্মার ঘরে ঢুকে পড়ল কুকুরটা৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অবশ্য আবার সে বাইরে বেরিয়ে এল৷ তখন তার মুখে কিছু নেই৷ সে একবার বারান্দা থেকে ঘাড় তুলে নীচে যে পথ দিয়ে এসেছে সেদিকে তাকাল৷ তারপর বারান্দার অন্যদিকে তাকিয়ে শৌনককে দেখতে পেয়ে সোজা ছুটে এল তার কাছে৷ শৌনক তাকে ধরে আদর করতে যাবার আগেই জিকো তার প্যান্ট কামড়ে ধরে তাকে ঘরের ভিতর দিকে টেনে নেবার চেষ্টা করতে লাগল৷ কুকুরটা কি খেপে গেল নাকি? ও এমন করছে কেন? কিন্তু এরপরই জিকোর আচরণের কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেল শৌনকের কাছে৷ একটা চাপা ঘড়ঘড় শব্দ জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল, তারপর জিকো যে পথে জঙ্গল থেকে বাইরে বেরিয়েছিল, ঠিক সে পথেই ঝোপ-জঙ্গলের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল একটা বিরাট চিতাবাঘ! তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে! তাকে দেখামাত্রই শৌনক কুকুরটার সঙ্গে পিছু হটে বারান্দা থেকে ঘরের ভিতর কিছুটা ঢুকে গেল৷ আড়াল থেকে সে দেখতে লাগল বাঘটাকে৷ বাঘটা মাটি শুঁকতে লাগল আর তাকিয়ে দেখতে লাগল বারান্দার অপর প্রান্তে রাজা বর্মার ঘরের দিকে! কী যেন বোঝার বা খোঁজার চেষ্টা করছে চিতাবাঘটা৷

    ঘরের ভিতর থেকে বাঘটার দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে রইল শৌনক৷ ছোট একটা লাফ দিয়ে কুকুরটা যে পথে বারান্দায় উঠেছিল, সে পথেই বাঘটাও বারান্দায় উঠে এল৷ আর মুহূর্তখানেকের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝটাপটির শব্দ ভেসে এল রাজা বর্মার ঘর থেকে৷ বাঘটাকে দেখতে না পেলেও শৌনক বুঝতে পারল রাজা বর্মার ঘরে ঢুকেছে সে৷ সাইলেন্সার খোলা ছিল৷ ঘরের ভিতর থেকে ভেসে এল রাইফেলের প্রচণ্ড শব্দ৷ তা শুধু বাড়িটাকেই নয়, কাঁপিয়ে তুলল বাড়ির চারপাশের জঙ্গল৷ বন্দুকের শব্দের পরই ঘরের ভিতর থেকে রাজা বর্মার প্রচণ্ড আর্ত চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ শৌনক ঘরের ভিতর থেকেই এরপর দেখল, বাঘটা লাফিয়ে নামল বারান্দা থেকে৷ অর্থাৎ বাঘটার কিছু হয়নি৷ আর এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ঘুমচোখে গাড়ি থেকে নেমে এল তেজপ্রতাপ৷ সে মনে হয় শুধু বন্দুকের শব্দই শুনেছে, বাঘটাকে খেয়াল করেনি৷ বাঘটার সামনে পড়ে গেল সে৷ বাঘটার মুখে কিছু একটা ধরা ছিল৷ সেটা সে মুখ থেকে নামিয়ে রেখে তীব্র একটা গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তেজপ্রতাপের ওপর৷ তেজপ্রতাপকে মাটিতে পেড়ে ফেলল বাঘটা৷ শৌনক যেন ‘মট’ করে একটা শব্দ শুনল৷ হয়তো বা ঘাড় ভাঙার শব্দ! একটা আর্তনাদ করার সুযোগও পেল না সে৷ তার নিথর দেহের ঘাড়টা কামড়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বাঘটা৷ তারপর সে মুখের থেকে যে জিনিসটা নামিয়ে রেখেছিল সেটা তুলে নিতে গেল৷ সে জিনিসটা তখন গড়াতে গড়াতে উপস্থিত হয়েছে গাড়ির সামনে হেডলাইট যেখানে পড়েছে সেখানে৷ নড়ছে সেই বলের মতো ছোট্ট জিনিসটা৷ এবার আর সেটা কী তা বুঝতে অসুবিধা হল না শৌনকের৷ বাঘের বাচ্চা! সদ্যোজাত শাবকটাকে আবার মুখে তুলে নিল বাঘিনি৷ তারপর কয়েকটা লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে৷ গাড়ির সামনে পড়ে রইল তেজপ্রতাপের নিথর দেহটা৷ আর একটা মোটা রক্ত ধারা তখন রাজা বর্মার ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের আলোতে বাইরের বারান্দায় জমতে শুরু করেছে৷ ঘরের সামনের দেওয়াল ধরে পাথরের মূর্তির মতো বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থাতে দাঁড়িয়ে রইল শৌনক৷

    ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হল বনরক্ষী বাহিনীর লোকরা৷ গুলির শব্দ আর বাঘের ডাক শুনে আলো ফুটতেই উপস্থিত হয়েছে তারা৷ নীচের জমিতে তেজপ্রতাপের মৃতদেহ আর ঘরের ভিতর রাজা বর্মার মৃতদেহ আবিষ্কার করল তারা৷ রাজা বর্মার মুখ দেখে তাকে অবশ্য তখন চেনা যাচ্ছে না৷ শৌনককে দেখতে পেয়ে তাকে এসে ঘিরে ধরল বনরক্ষীরা৷ একজন বনরক্ষী শৌনককে বলল, ‘আপনি সঙ্গে ছিলেন! এ তো বাঘের কাণ্ড দেখছি! দুজনকেই মেরে রেখেছে!’

    শৌনক বলল, ‘হ্যাঁ, একটা চিতাবাঘ হানা দিয়েছিল৷ মানে বাঘিনি৷’

    অপর এক বনকর্মী স্বগতোক্তি করল, ‘বাঘিনি এখানে কীভাবে এল! একটা বড় চিতাবাঘিনি আছে ঠিকই, কিন্তু সে তো এদিকে আসে না৷’

    ঠিক এই সময় শৌনকের প্যান্টের নীচের অংশ ধরে কে যেন টান দিল৷ শৌনক দেখল তার প্যান্ট টেনে তার দিকে তাকিয়ে আছে জিকো৷ সে যেন শৌনককে বলছে, ‘কাউকে কিছু বোলো না৷’

    শৌনকের চোখে ভেসে উঠল একটা ছোট্ট দৃশ্য৷ নীচ থেকে বারান্দায় উঠে মুখে কী যেন একটা ধরে রাজা বর্মার ঘরে ঢুকে পড়ল কুকুরটা! হয়তো বা তাকে টোপ বানাবার কারণে রাজা বর্মাকে শাস্তি দেবার জন্য শিকারিকে সে চিতাবাঘিনির শিকার বানাল৷

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্ধকার যখন নামল – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
    Next Article সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    Related Articles

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    আঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }