Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডভেঞ্চার ভয়ংকর – হিমাদ্রিকিশোর দাসগুপ্ত

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প325 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ড্রাগনের ডিম

    ঢেউতোলা ঢালু ছাদওয়ালা বিরাট তোরণটাই যেন নিজেই একটা প্রাসাদের মতো৷ তার আড়ালে রয়েছে প্রাকারবেষ্টিত এক প্রাচীন নগরী৷ তোরণের ঠিক মাথায় টাঙানো রয়েছে কমিউনিস্ট চীনের রূপকার ‘মাও-জে-দং’ বা ‘মাও-সে-তুং’-এর ছবি৷ যদিও তোরণের ওপাশে যে প্রাচীন নগরী রয়েছে তা চৈনিক রাজতন্ত্রের ঐতিহ্যেরই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে৷ তোরণের বাইরে প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে দীপাঞ্জনকে প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘আমরা যে নগরীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, এ নগরীকে বলা হয় ‘নিষিদ্ধ নগরী’৷ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ফরবিডন সিটি’—ভুলে-যাওয়া নগরী৷ প্রায় ছ’শো বছর আগে চীনের ‘মিং’ বংশের রাজারা প্রাকারবেষ্টিত এই নগরী নির্মাণ করেন তাদের নিজস্ব বাসস্থান হিসাবে৷ সম্রাট, রাজপুরুষ আর তাদের নিজস্ব লোকজন ছাড়া এ নগরীতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ ছিল৷ বিনা অনুমতিতে কেউ এই তোরণ অতিক্রম করলে তার মৃত্যুদন্ড হতো৷ তাই এই নগরীর নাম হয় ‘নিষিদ্ধ নগরী’৷ সাধারণ মানুষের লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিপালিত হতো এ-নগরীর জীবনযাত্রা৷ নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো প্রাকারবেষ্টিত এ নগরীর জীবনযাত্রার কথা একসময় লোকে ভুলেই গেছিল৷ তাই এর নাম ‘ফরবিডন সিটি’—ভুলে যাওয়া নগরী৷ দীপাঞ্জন বলল, ‘প্রাণচঞ্চল আধুনিক বেজিং শহরের মধ্যে এমন একটা প্রাচীন নগরীর আজও টিকে থাকা সত্যিই অদ্ভুত! চলুন এবার ভিতরে যাবার জন্য এগোনো যাক৷ শুনেছি এ নগরী নাকি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর অন্তর্গত অন্যতম প্রাচীন শহর, যেখানে স্থাপত্যগুলো মোটামুটি আজও অক্ষুন্ন আছে৷’

    চারটে প্রবেশ তোরণ আছে এই নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করার জন্য৷ তার মধ্যে এই ‘মেরিডিয়ান গেট’ বা ‘মাধ্যাহ্নিক তোরণ’-ই প্রধান৷ সূর্য যখন মধ্যাহ্নে অবস্থান করে তখন নগরীর দক্ষিণ-পূর্বের ওই তোরণের মাথার ওপর হলুদ বর্ণের বিশাল ঢালু ছাউনিটা সোনার বর্ণ ধারণ করে, আলোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এই তোরণ৷

    ট্যুরিস্টদের দীর্ঘ লাইন তোরণের সামনে৷ তাতে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপাঞ্জন আর জুয়ান৷ নানা দেশের পর্যটকদের ভিড় লাইনে৷ যারা চীনে দীপাঞ্জনদের মতো বেড়াতে আসে তারা চীনের ‘গ্রেট ওয়াল’ দেখার পাশাপাশি এই নিষিদ্ধ নগরীও দেখতে আসে৷ বেশ কয়েক দশক আগে পর্যন্ত এই পুরোনো স্থাপত্য পর্যটকদের কাছেও নিষিদ্ধ ছিল৷

    একপ্রস্থ সিকিউরিটি চেকের পর প্রফেসর জুয়ান আর দীপাঞ্জন তোরণ অতিক্রম করে প্রাসাদনগরীর ভিতরে প্রবেশ করল৷ সামনে একটা বিশাল পাথুরে চত্বর৷ সেটা চলে গেছে বিশাল একটা প্রাসাদের দিকে৷ কাছে-দূরে যেদিকেই চোখ যায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে কাঠ আর পাথরের তৈরি ছোট-বড় নানা স্থাপত্য৷ তাদের ঢেউ খেলানো হলুদ রঙের ঢালু ছাদে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যকিরণ৷ প্রতিটা স্তম্ভ, দেওয়াল আর কার্নিশের গায়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকা আছে লাল অলংকরণ, কাঠ বা পাথরের অদ্ভুতদর্শন নানা প্রাণীর মূর্তি, বিশেষত ড্রাগনের মূর্তি৷ টিকিটের সাথে যে গাইড বুকলেটটা দেওয়া হয়েছে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল দীপাঞ্জনরা৷ তাতে লেখা আছে, ১৪০৬ থেকে ১৪২০ সালের মধ্যে তৈরি হয় ওই রহস্যময় নিষিদ্ধ নগরী৷ সাত লক্ষ কুড়ি হাজার বর্গ মিটার এর আয়তন৷ নয়শো আশিটা ভবন আছে পাঁচশো বছরের প্রাচীন এই শহরে৷ রাজপ্রাসাদে একটা সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম আছে৷ সেই মিউজিয়াম আর অন্য ভবন মিলিয়ে প্রায় দশলক্ষ প্রাচীন বস্তুর সংগ্রহ আছে এখানে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘এত বড় জায়গা আমরা কীভাবে দেখা শুরু করব?’

    বুকলেটের মধ্যে একটা গাইড ম্যাপও আছে৷ সেটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জুয়ান বললেন, ‘আমাদের তো কোনও তাড়া নেই৷ ঘুরতে-ঘুরতে প্রথমেই রাজপ্রাসাদ আর মিউজিয়ামটা দেখি৷ তারপর নগরীর অন্য অংশগুলো ঘুরে দেখব৷’

    চারপাশ দেখতে-দেখতে দীপাঞ্জনরা এগোতে লাগল৷ অসংখ্য ট্যুরিস্টের ভিড়৷ কিন্তু তবুও চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা চীনা স্থাপত্যের ঘরবাড়িগুলোকে কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হয়৷ কত রহস্য যে ওই প্রাচীন স্থাপত্যের আড়ালে লুকোনো আছে কে জানে! ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য এই প্রাচীন নগরীর প্রাচীন বেশে সজ্জিত হয়ে নানা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু লোক৷ তাদের পরনে লম্বা ঝুলের রংচঙে সিল্কের পোশাক৷ পায়ে চ্যাপ্টা শুঁড়তোলা হাঁটু-পর্যন্ত ঢাকা পাদুকা৷ রেশমের কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে চামড়ার ওপর রুপো আর জরির কাজ-করা তলোয়ারের খাপ৷ মাথায় টুপি আর মুখমন্ডলে ছুঁচালো গোঁফ, যা এসে মিশেছে চিবুকের দাড়ির সাথে৷ যেন ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে এই মানুষগুলো৷

    রাজপ্রাসাদটা দেখা যাচ্ছিল দূর থেকেই৷ স্বাভাবিক নিয়মেই এই প্রাসাদ-নগরীর সবচেয়ে বড় প্রাসাদ যেটা তার সামনে শ্বেতপাথরে মোড়া, কারুকাজ-করা রেলিং আর মূর্তি-শোভিত ফুটবল মাঠের মতো বিরাট প্রাঙ্গণ৷ রাজাদের আমলে সেখানে নানা উৎসবে সমবেত হতো নগরীর বাসিন্দারা৷ ট্যুরিস্টদের ভিড় থিকথিক করছে যে জায়গাতে, সেই ভিড়ে মিশে দীপাঞ্জনরা হাজির হল প্রাসাদের সামনে৷ এই প্রাসাদ থেকেই একসময় সুবিশাল চীনা সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো৷ এ-প্রাসাদ আজ মিউজিয়াম৷ প্রাসাদের বহির্গাত্রে সোনারুপোর গিল্টি, অলংকরণ৷ তোরণের স্তম্ভের গায়ে রয়েছে চৈনিক রাজবংশের প্রতীক ‘সোনার ড্রাগন’৷ সিকিউরিটির লোক ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে৷ বহু অমূল্য অ্যান্টিক আছে এ প্রাসাদে৷ আরও একপ্রস্থ সিকিউরিটি চেকিং-এর পর অন্য ট্যুরিস্টদের সাথে তারা পা রাখল বিশাল প্রাসাদ মিউজিয়ামের অন্তঃপুরে৷ এক হাজার কক্ষ আছে এ-প্রাসাদে৷ ভূগর্ভস্থ কক্ষও নাকি আছে৷ তবে মাটির ওপরের কিছু কক্ষই শুধু ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত৷ এ-প্রাসাদ যেন সোনার তৈরি৷ চারপাশেই শুধু সোনা৷ তারা প্রথমে উপস্থিত হল দরবার কক্ষে৷ হল-ঘরের মতো বিশাল কক্ষটার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই সোনা বা সোনার অলংকরণে মোড়া৷ আর অবশ্যম্ভাবীভাবে সেখানে রয়েছে মিং রাজবংশের প্রতীক সোনার ড্রাগন মূর্তি৷ জুয়ান দরবার-কক্ষটা দেখতে-দেখতে বললেন, ‘আমি ইউরোপের অনেক দেশ ঘুরেছি, তুমিও ঘুরেছো৷ ইউরোপীয়রা তাদের যেসব সম্পদ নিয়ে গর্ব অনুভব করে তা অধিকাংশই প্রাচ্য থেকে লুন্ঠিত৷ নিজস্ব সম্পদ বলতে যা বোঝায়, বৈভব বলতে যা বোঝায়, তা প্রাচ্যের সম্রাটদের তুলনায় ইউরোপীয়দের কিছুই ছিল না৷ বাকিংহাম প্যালেসের দরবার-কক্ষের জৌলুস ম্লান হয়ে যাবে এই দরবার কক্ষের কাছে৷ তাও তো অতি মূল্যবান সামগ্রীগুলো নিশ্চই এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সরকারি তোষাখানায় রাখা হয়েছে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘ঠিক তাই৷ আমার দেশের কোহিনূর মণি নিয়ে গিয়ে রানির মুকুটের শোভাবর্ধন করেছে ব্রিটিশরা৷ বলেছি হায়দরাবাদের নিজামের কোশাগারে এতো মুক্তো ছিল যে তা দিয়ে নাকি লন্ডনের পিকাডালি সার্কাস প্রাঙ্গণ ঢেকে দেওয়া যেত৷ পাশ্চাত্যের বৈভব আসলে প্রাচ্যের দান৷ অথচ সাদা চামড়ার লোক দেখলেই এখনও অনেকে মাথা ঝোঁকায়৷’

    মিউজিয়ামের অন্য ঘরগুলো এবার এক এক করে দেখা শুরু করল দীপাঞ্জনরা৷ তার কোথাও রয়েছে চৈনিক সম্রাটের স্বর্ণখচিত সিংহাসন, সোনার কাজ-করা রাজপুরুষদের পরিধেয়, অস্ত্রশস্ত্র, কোথাও রয়েছে মিং আমলের বিখ্যাত পোর্সেলিনের ফুলদানি, বাসনপত্র, মূর্তি, আর নানা আকৃতির নানা ভঙ্গিমার সোনা-রুপোর ড্রাগন মূর্তির ছড়াছড়ি৷ প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘খেয়াল করে দেখো যে, যেসব জিনিস সোনার নয়, তার মধ্যে কিন্তু হলুদ বর্ণের আধিপত্য আছে৷ আসলে সোনালি বর্ণ বা হলুদ রং ছিল চীনা রাজবংশের আভিজাত্যের প্রতীক৷ রাজা এবং অভিজাতরা স্বর্ণখচিত পোশাক পরে আসতেন রাজদরবারে৷ বাকিরা পরতেন হলুদ বর্ণের পোশাক৷ নইলে নাকি রাজদরবারে তো বটেই, এ-প্রাসাদেও প্রবেশের অনুমতি মিলতো না নগরবাসীদের৷ তাই সর্বত্র এই হলুদ রঙের ব্যবহার৷’

    ঘন্টাতিনেক সময় লাগল দীপাঞ্জনদের এই প্রাসাদ মিউজিয়াম খুঁটিয়ে দেখতে৷ তারপর বাইরে বেরিয়ে এল তারা৷ দীপাঞ্জন আর জুয়ান একে-একে অন্য স্থাপত্যগুলোও দেখা শুরু করল৷ দেখার যেন কোনও শেষ নেই৷ এ-নগরীর বাসিন্দারা সবাই রাজকার্যে নিয়োজিত থাকত৷ তাদের কেউ ছিলেন সভাসদ, সৈনাধ্যক্ষের মতো অভিজাত ব্যক্তি, আবার কেউ ছিলেন নর্তকী, রক্ষী বা ভৃত্য সম্প্রদায়ের মানুষ৷ স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য এ-নগরীতে গড়ে উঠেছিল তাদের পদমর্যাদা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন আকারের বাসস্থান৷ তবে ছোট হোক বা বড় হোক, সব বাসস্থান বা গৃহগুলোই ছিল নগর স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ৷ একই ধরনের স্থাপত্য, দেওয়ালগুলোর বহির্গাত্রে নানা কারুকাজ, মাথার ওপর ঢেউ-খেলানো সোনালি বর্ণের ছাদ৷ রাজনির্দেশেই নির্মিত হয়েছিল এ-নগরীর প্রতিটা ভবন, উপাসনালয়৷ শুধু প্রাসাদই নয়, কৃত্রিম পাহাড় আর নদীও রচিত হয়েছিল নগরীতে৷

    ঘুরতে-ঘুরতে জুয়ান বললেন, ‘কিছু অদ্ভুত মানুষও নাকি বাস করতেন এই নগরীতে৷ তাঁরা কেউ অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন সন্ন্যাসী, কেউ জাদুকর, কেউ-বা অ্যানফাসিস্ট৷ নানা গুপ্তবিদ্যার চর্চাও এই প্রাচীন নগরীতে হতো রাজ অনুগ্রহে৷ এমনকি সোনা তৈরির পদ্ধতিও নাকি জানা ছিল এ-শহরের কোনও কোনও লোকের৷ আর এসব ব্যাপারের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যই নাকি আমজনতার প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ ছিল৷’

    বেশ অনেকক্ষণ ঘোরার পর একটা বেঞ্চে এসে বসল তারা৷ এ-জায়গাটাতে ট্যুরিস্টদের তেমন ভিড় নেই৷ আশেপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট-ছোট বাড়ি৷ এ-বাড়িগুলো প্রাচীন, এবং অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য স্থাপত্যগুলোর সঙ্গে৷ দীপাঞ্জন চারপাশের ঘরবাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ-জায়গাগুলোতে সম্ভবত রাজাদের ভৃত্যশ্রেণির লোকেরা বসবাস করত৷’

    জুয়ান বললেন, ‘আমারও তাই মনে হয়৷’

    কথা বলছিল জুয়ানরা৷ এমন সময় একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ মাথায় টুপি, গলা থেকে একটা বেতের ঝুড়ি ঝুলছে৷ তাতে রাখা সেরামিকের তৈরি ছোট-ছোট খেলনা, ফুলদানি, মূর্তি ইত্যাদি৷ দীপাঞ্জনদের সামনে এসে সে বলল, ‘খেলনা নেবে? মূর্তি নেবে? ভালো পুতুল নেবে? তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, মিং রাজাদের প্রতীক ছিল ড্রাগন? এ-মূর্তি বাড়ি নিয়ে যাও তোমাদের সৌভাগ্য বাড়বে৷ সৌভাগ্যের প্রতীক এই সোনার ড্রাগন৷’

    ট্যুরিস্টদের কাছে খেলনা বিক্রি করতে হয় বলে ইংরাজি জানে ছেলেটা৷ পেটের দায়ে খেলনা ফেরি করছে৷ এর মধ্যেই খেলনা বিক্রি করার জন্য পেশাদারী ঢং শিখে নিয়েছে৷

    এরপর সে বাস্কেট থেকে একটা ছোট ফুলদানি নিয়ে মাটিতে ফেলল৷ ঠং করে শব্দ হলেও সেটা ভাঙল না৷ মাটি থেকে ফুলদানিটা কুড়িয়ে নিয়ে সে বলল, ‘হার্ড সেরামিক৷ খুব শক্ত৷ নেবেন? যা নেবেন সব মাত্র পাঁচ ইয়েন করে৷’

    দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, ‘কিছু নেবেন নাকি?’

    জুয়ান বললেন, ‘একটা করে ড্রাগন-মূর্তি নেওয়া যেতে পারে৷ সৌভাগ্য ফেরানোর জন্য না-হলেও এ-জায়গার স্মৃতি হিসাবে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘দুটো ড্রাগন মূর্তি দাও৷’

    খুশি হল ছেলেটা৷ ইঞ্চি চারেক লম্বা দুটো ড্রাগন মূর্তি সে তুলে দিল জুয়ানের হাতে৷ খুব সুন্দর মূর্তিগুলো৷

    দীপাঞ্জন তাকে টাকা দেবার পর লম্বা বেঞ্চটার এক কোণে বসল ছেলেটা৷ ঝুড়িটা গলা থেকে নামিয়ে রেখে ঢোলা পাজামার পকেট থেকে একটা পাউরুটি বের করে খেতে শুরু করল৷

    দীপাঞ্জনরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল৷ জুয়ান বললেন, ‘এসব জায়গাতে যদি রাতে থাকা যেত তবে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি লাভ করা যেত৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘ঠিক তাই৷ আমিও তাই ভাবছিলাম৷ কিন্তু সিকিউরিটির লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের সে অনুমতি দেবে না৷ আর দিলেই-বা থাকতাম কোথায়৷’

    জুয়ান হেসে বললেন, ‘সে না-হয় এখানেই কোনও প্রাসাদের ভিতর শুয়ে পড়া যেত৷’

    কথা বলতে লাগল তারা৷ বাচ্চা ছেলেটা এরপর তার জিনিসপত্র নিয়ে উঠে চলে গেল৷

    ৷৷২৷৷

    কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর জুয়ান বললেন, ‘চলো এবার ওঠা যাক৷ নিষিদ্ধনগরীর বাকি প্রাসাদগুলো দেখি৷ তবে একদিনে মনে হয় পুরো শহরটা দেখা হবে না৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন৷ তবে আজ পুরোটা না দেখা হলে কাল আবার আসা যেতে পারে৷ আমরা তো এ দেশে বেড়াতেই এসেছি৷ অন্য কাজের চাপ তো নেই৷’

    কথাগুলো বলে বেঞ্চ থেকে উঠতে যাচ্ছিল দীপাঞ্জন৷ কিন্তু লম্বা কাঠের বেঞ্চের অন্য প্রান্ত থেকে একটা জিনিস গড়িয়ে এলো তার কাছে৷ একটা ডিমের মতো দেখতে জিনিস৷ দীপাঞ্জন তো প্রথমে সেটাকে রাজহাঁসের ডিম ভেবেছিল৷ একটু অবাক হয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিল সে৷ আর সেটা হাতে নিয়েই দীপাঞ্জন বুঝতে পারল সেটাও সেরামিকের তৈরি৷ ভালো করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটা দেখল দীপাঞ্জন৷ না, সেটার মধ্যে কোনও প্যাঁচ বা ছিদ্র নেই৷ নিরেট বলে মনে হয়৷ তবে জিনিসটা মনে হয় বেশ পুরোনো৷ তবে ডিম্বাকৃতি সেই বস্তুর সাদা রঙের উজ্জ্বলতা আর তেমন নেই৷ দীপাঞ্জন জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখার পর প্রফেসর জুয়ানের হাতে দিল৷ তিনিও সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘জিনিসটা খুব অদ্ভুত, কিন্তু কী এটা?’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘যাই হোক-না কেন, এটা মনে হয় ওই বাচ্চা ছেলেটার কাছেই ছিল৷ গড়িয়ে চলে এসেছে আমার কাছে৷’

    দীপাঞ্জনের কথা শেষ হতে-না-হতেই তারা দেখল সামনের বাড়িগুলোর গোলোকধাঁধা থেকে ছুটতে-ছুটতে বেরিয়ে আসছে ছেলেটা৷ সে আগে কী করে দেখার জন্য প্রফেসর তার কোটের পকেটে জিনিসটা পুরে হাত দিয়ে পকেটটা আড়াল করে ফেললেন৷ ছেলেটা সোজা ছুটে এল তাদের কাছে৷ প্রথমে সে বেঞ্চের যে প্রান্তে বসেছিল, সেখানে তাকিয়ে নীচু হয়ে বেঞ্চের তলাটা দেখতে লাগল৷ ডিমটা যে ছেলেটারই তা বুঝতে আর অসুবিধা হল না দীপাঞ্জনদের৷ প্রফেসর এবার তার পকেট থেকে অদ্ভুত জিনিসটা বার করে সেটা ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি কি এটা খুঁজছো?’

    জিনিসটা দেখেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ছেলেটার মুখ৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ এটাই খুঁজছি৷’ —এই বলে সে জুয়ানের হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে সম্ভবত তা অক্ষত আছে কিনা দেখতে লাগল৷

    দীপাঞ্জন ছেলেটাকে প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’

    ছেলেটা জবাব দিল, ‘ড্রাগনের ডিম৷’

    কথাটা শুনে দীপাঞ্জন হেসে বলল, ‘তুমি ড্রাগনের ডিম বিক্রি করো বুঝি?’

    ছেলেটা ডিমটাকে পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে প্রথমে বলল, ‘না, এটা বিক্রির জিনিস নয়৷ ভাগ্যিস তোমরা জিনিসটা ফিরিয়ে দিলে৷ নইলে অনর্থ হতো৷ ঠাকুর্দা আমাকে আস্ত রাখতো না৷’

    তারপর বলল সে, ‘আচ্ছা তোমরা কি এখানে ঘর ভাড়া নেবে? তোমরা আলোচনা করছিলে৷ আর সেটাই কানে আসাতে আমি ঠাকুর্দাকে খবরটা দিতে গেছিলাম৷ কখন যে ডিমটা পকেট থেকে রুটি বার করার সময় বাইরে বেরিয়ে পড়েছে বুঝতে পারিনি৷ ঠাকুর্দার সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দেখি ডিমটা নেই! সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলাম এখানে৷’

    ছেলেটার কথা শুনে জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘তোমার ঠাকুর্দা কি ঘর ভাড়া দেন? কোথায় তোমার বাড়ি?’

    ছেলেটা প্রথমে জবাব দিল, ‘না, দেয় না৷ কিন্তু তার একটু টাকার দরকার তাই লোক খুঁজছেন৷ অনেক সময় অনেক ট্যুরিস্ট এখানে থাকতে চায়৷ এই শহরের ভিতর যারা থাকে তারা অতিথি হিসাবে থাকতে দিলে তবেই থাকা যায়৷ দাদু রাজি আছেন৷ একশো ইয়েন করে ভাড়া লাগবে৷’

    তারপর সে কাছেই একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘ওর পিছনেই আমাদের বাড়ি৷’

    একশো ইয়েন, যা ভারতীয় মুদ্রায় হাজার টাকার কিছু বেশি৷ দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, ‘একবার দেখবেন নাকি?’

    জুয়ান বললেন, ‘চলো, দেখা যেতে পারে৷ ভালো লাগলে থাকাও যেতে পারে৷’

    দীপাঞ্জনরা এরপর ছেলেটার সাথে পা বাড়ালেন বাড়িটা দেখতে যাওয়ার জন্য৷ হাঁটতে-হাঁটতে দীপাঞ্জন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী? তুমি পড়াশোনা করো না?’

    ছেলেটা জবাব দিল, ‘আমার নাম ওয়াং৷ হ্যাঁ পড়াশোনা করি৷ তবে দাদুর শরীরটা ক’দিন ভালো না৷ কাজে বেরোতে পারছিলেন না৷ তাই আমি ফেরি করতে বেরিয়েছিলাম৷’

    পাথর আর কাঠের তৈরি প্রাচীন বাড়িঘর সব৷ অনেক বাড়িঘরের দেওয়ালেই এখনও ড্রাগন-মূর্তি আঁকা আছে৷ যদিও সময়ের ভারে তার সোনালি উজ্জ্বলতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে৷ যে বাড়িটা ছেলেটা চত্বর থেকে দেখিয়ে ছিল, সে-বাড়িটার গা ঘেঁষে একটা গলিতে ঢুকলো দীপাঞ্জনরা৷ চারপাশে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেক ক’টা বাড়ি৷ কেমন যেন গোলকধাঁধার মতো জায়গাটা৷ তবে কোনও লোকজন আছে বলে মনে হয় না৷ বেশ কয়েকটা ছোট গলি এঁকেবেঁকে পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওয়াং৷ মাঝারি আকৃতির একটা বাড়ি৷ ঢালু ঢেউখেলানো কাঠের ছাদ অন্য বাড়িগুলোর মতোই৷ বাড়ির বারান্দার এক কোণে একটা চিনা লন্ঠন ঝুলছে৷ ওয়াং সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ডিমের ব্যাপারটা দাদুকে বোলো না কিন্তু৷ আমি তাকে ডাকছি৷’ এই বলে চিনা ভাষায় হাঁক দিল ওয়াং৷

    একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন সেই হাঁক শুনে৷ মাথার চুল, দাড়ি সব সাদা৷ পরনে ফুলছাপ লম্বা ঝুলের শাটিনের পোশাক৷ হাতে লাঠি৷ দীপাঞ্জনের মনে হয় লোকটার বয়স অন্তত আশির ওপরে হবে৷’

    দীপাঞ্জনদের দেখার পর লোকটা বলল, ‘ওয়াং বলল আপনারা ঘর ভাড়া খুঁজছেন৷ থাকতে পারেন এখানে৷ তবে তার আগে আপনাদের পরিচয়টা জানা দরকার৷’

    প্রফেসর জুয়ান তার আর দীপাঞ্জনের পরিচয় দিলেন৷ লোকটা বলল, ‘আমার নাম ঝাং৷ দেখুন ঘর পছন্দ হয় কি না৷ তবে বাড়িতে কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, লন্ঠনই ভরসা৷’

    বৃদ্ধ ঝাং-এর সাথে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল দীপাঞ্জনরা৷ সঙ্গে ওয়াং-ও৷ বেশ কয়েকটা ঘর বাড়িতে৷ তবে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট৷ বাড়িটাতে ঢুকেই ওয়াং অন্যদিকে চলে গেল৷ বৃদ্ধ ঝাং তাদের নিয়ে প্রবেশ করলেন একটা ঘরে৷ সাধারণ একটা ঘর৷ কাঠের চৌকির মতো একটা শোবার জায়গা৷ দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা টেবিল৷ তার ওপর সেরামিকের তৈরি কিছু প্লেট-বাটি ইত্যাদি বাসন রাখা আছে৷ আর ঘরের কোণে রাখা আছে একটা কুঁজো৷ বিবর্ণ হলেও ঘর এবং বাড়িটা বেশ পরিচ্ছন্ন৷ ঝাং বললেন, ভাড়াটা নিশ্চয়ই ওয়াং আপনাদের বলেছে৷ একশো ইয়ান লাগবে৷ ভাড়াটা আপনাদের একটু বেশি মনে হলেও আপানাদের দায়িত্ব তো আমাদের নিতে হবে৷ ধরে নিন এই একশো ইয়েনের মধ্যে ওটা যোগ করা আছে৷’

    জুয়ান বললেন, ‘দায়িত্ব নিতে হবে মানে?’

    ঝাং বললেন, ‘এখানে সরকারিভাবে ভাড়া দেবার নিয়ম নেই৷ যে কারণে ভাড়ার রশিদ দেওয়া হয় না৷ সরকারি খাতায় আপনারা এ-বাড়িতে আমার অতিথি হিসাবে থাকতে পারেন৷ তবে নাগাড়ে তিনদিনের বেশি নয়৷ শুধু আপনারা বিদেশি বলে নয়৷ আমরা যে, ক’জন এখন এই পুরানো শহরে বাস করছি তারা ছাড়া এ-দেশের অন্য লোকের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য৷ আর অতিথি হিসাবে থাকার সময় আপনারা যদি এই পুরোনো শহরের কোথাও কোনও ক্ষয়ক্ষতি করেন, তার পুরো দায়িত্ব আমার থাকবে৷ কোথাও একটা টালিও যদি ভাঙেন বা দেওয়ালের গায়ে কিছু যদি লেখেনও, তার জন্য আপনাদের আগে আমাকে জেলে যেতে হবে৷ আপনাদের আচরণের সব দায়িত্বই আমার৷’

    জুয়ান বৃদ্ধের কথা শুনে হেসে বললেন, ‘সে দায়িত্ব সম্ভবত আমাদের ক্ষেত্রে নিতে হবে না৷ এ-জায়গার মর্ম আমরা বুঝি৷’

    বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ‘তবে কি থাকবেন আপনারা?’

    দীপাঞ্জনদের লাগেজ বেডিং-এর হোটেলে থাকলেও তাদের কিট ব্যাগে এক সেট করে জামাকাপড় ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে৷ কাজেই তাদের হোটেলে না ফিরলেও চলে৷ ঘরটা মোটামুটি পছন্দ হয়েছে তাদের৷ তাই নিজেদের মধ্যে সামান্য আলোচনা সেরে নিয়ে তারা বৃদ্ধকে জানালো যে তারা আগ্রহী৷

    ঝাং বললেন, ‘তবে এখানকার সরকারি দপ্তরে অনুমতিপত্র নিতে যেতে হবে আমাদের৷ অবশ্য এখনও যাওয়া যায়৷ পরেও যাওয়া যায়৷ বিকাল চারটের মধ্যে গেলেই হল৷’

    ঘড়ি দেখল দীপাঞ্জনরা৷ দুপুর একটা বাজে৷ জুয়ান বললেন, ‘কাজটা বরং এখনই মিটিয়ে দেওয়া যাক৷ তারপর এখানে ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়ে বিকালে আবার বাইরে যাব৷’

    বৃদ্ধ বলল, ‘তাহলে একটু দাঁড়ান৷ আমি আমার কাগজপত্র বার করি৷ সেগুলো নিয়ে আমাকে আপনাদের সাথে যেতে হবে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, আসুন৷ আমরা বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছি৷’

    ঝাং অন্য ঘরে চলে গেলেন৷ আর দীপাঞ্জনরা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল৷

    মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঝাং ছেলেটাকে চিনা ভাষায় বকাবকি করতে-করতে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এলেন৷ তার হাতে রোল-করা একতাড়া কাগজ৷ বকুনি খেয়ে ছেলেটা বারান্দার এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল৷ আর বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এল৷ দীপাঞ্জনরা এগোল তার সাথে-সাথে৷ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বৃদ্ধ গজগজ করতে-করতে বললেন, ‘একদম মানুষ হল না ছেলেটা৷ কোনও কথা শোনে না আমার৷ আমি যখন থাকবো না তখন মজা টের পাবে৷’

    হাঁটতে-হাঁটতে জুয়ান জানতে চাইল, ‘এ-বাড়িতে আপনি আর ওয়াং ছাড়া আর কে কে থাকেন?’

    ঝাং বললেন, ‘কে আর থাকবে! ওয়াং-এর বাবা-মা তো তাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দুজনেই চোখ বুজলো৷ আমি যেদিন চোখ বুজবো সেদিন ও জানবে এ-পৃথিবী কেমন!’

    দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারল, ‘কোনও কারণে ওয়াং-এর ওপর চটে গেছেন বৃদ্ধ৷’

    এ-প্রসঙ্গে আর কোনও কথা না-বলে দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘আপনি এখানে কবে থেকে আছেন?’

    ঝাং জবাব দিল, ‘আমার জন্ম তো এ-জায়গাতেই৷ অন্তত বারো-চোদ্দো পুরুষ ধরে আমরা এখানে আছি৷ বলতে গেলে এই শহর তৈরি হবার কিছুকাল পর থেকেই৷’

    জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘আপনার পূর্বপুরুষরা কী করতেন?’

    বৃদ্ধ বললেন, ‘সম্রাটদের ভৃত্যের কাজ করতেন৷ প্রথমে মিং সম্রাটদের? তারপর বাইং সম্রাটদের৷ তখন সম্রাটদের ভৃত্য মানে বিরাট ব্যাপার ছিল৷ সবাই সমাদর করতো৷ তারপর ধীরে-ধীরে একদিন সব শেষ হয়ে গেল…৷’

    দীপাঞ্জন প্রশ্ন করল, ‘আপনি কী করেন?’

    ঝাং জবাব দিলেন, ‘এক সময় সেরামিকের খেলনা-পুতুল ইত্যাদি বানাতাম৷ এখন বয়স হয়েছে৷ বানাতে পারি না৷ কিনে ফেরি করি৷’

    নানা কথা বলতে-বলতে তারা পৌঁছে গেল একটা বাড়িতে৷ সরকারি দপ্তর সেটা৷ সেখানে ঢোকার আগে ঝাং বললেন, ‘ওরা জিজ্ঞেস করতে পারে যে আমি ভাড়া দিচ্ছি কি না? আপনারা বলবেন এখানে বেড়াতে-বেড়াতে আমার সাথে আপনাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে৷ আমার অনুরোধে আপনারা থাকবেন আমার এখানে৷’

    বাড়িটার ভিতর ঢুকে সরকারি কর্মীদের সামনে হাজির হল সবাই৷ প্রথমে ঝাং-এর সাথে চিনা ভাষায় কী সব কথাবার্তা হল সে লোকগুলোর৷ ঝাং-এর অনুমান মতোই সরকারি কর্মীরা জানতে চাইল যে ঘর ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কি না৷ দীপাঞ্জন তাদের জানালো যে, না, তেমন কোনও ব্যাপার নয়৷ এরপর দীপাঞ্জনদের পাসপোর্ট-ভিসা ইত্যাদি কাগজপত্র পরীক্ষা করা হল, বেশ কয়েকটা ছাপানো কাগজে তিনজনকে সইও করতে হল৷ তারপর তাদের হাতে নিষিদ্ধ নগরীতে থাকার অনুমতিপত্র দেওয়া হল৷ এরপর টেলিফোন বুথ থেকে হোটেলে ফোন করে দীপাঞ্জনরা জানিয়ে দিল যে তারা আর হোটেলে ফিরছে না৷

    কাজকর্ম মিটিয়ে তারা যখন বাড়ি ফিরল তখন বেলা দু’টো বাজে৷

    ৷৷ ৩৷৷

    ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম নিয়ে আবার বাইরে বেরোনোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এল তারা৷ বারান্দায় এসে তারা দেখতে পেল ওয়াং দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে দেখে দীপাঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদু তোমাকে বকছিলেন কেন?’

    ওয়াং বলল, ‘তাড়াহুড়োতে ডিমটা ঠিকমতো রাখতে পারিনি যে বেতের ঝুড়ির মধ্যে সেটা রাখা থাকে৷ তাছাড়া ঝুড়ির ডালাটাও ঠিকমতো বন্ধ করতে পারিনি৷ দাদু ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন৷ তাই বকাবকি করছিলেন৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘দাদু যখন বারণ করেন, তখন দাদুর জিনিস নাও কেন?’

    ওয়াং বলল, ‘বা রে! দাদুই তো বলল ডিম থেকে ড্রাগনের ছানা ফোটার সময় হয়েছে৷ ড্রাগন নাকি তার ডিম ফেরত নিতে আসবে৷ কিন্তু তার আগেই যদি ছানা ফুটে যায়? পালিয়ে যায়? তাই ডিমটা নিয়ে আমি ঘুরছিলাম৷ এই যেমন তখন দাদু ঘুমাচ্ছেন, আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছি৷ ড্রাগনের ছানা বাইরে বেরোতে গেলেই খপ করে চেপে ধরব৷’

    দীপাঞ্জন হেসে বলল, ‘আচ্ছা তুমি পাহারা দাও, আমরা একটু বেড়িয়ে আসি৷’

    বারান্দা থেকে নেমে গলিগুলো অতিক্রম করে আবার প্রাসাদ চত্বরে উপস্থিত হল দীপাঞ্জনরা৷ এই নিষিদ্ধনগরী দুটো অংশে ভাগ করা৷ রাজপ্রাসাদ আর তার চারপাশের কিছু অংশ নিয়েই ‘ইনার কোর্ট’৷ বড় প্রাসাদগুলো সেখানেই, আর বাকি অংশটা ‘আউটার কোর্ট’৷

    জুয়ান বললেন, ‘গাইডবুকে লেখা আছে যে প্রাসাদ চত্বরে মিউজিয়ামগুলো চারটের সময় বন্ধ হয়ে যায়৷ এগুলো আবার কাল সকালে দেখব৷ চলো, আমরা আউটার কোর্টটাই দেখি৷’

    সেইমতো অন্যদিকে হাঁটতে লাগল দীপাঞ্জনরা৷ যেদিকে তারা এগোল, সেদিকে বড় প্রাসাদ মিউজিয়াম নেই বলে অতিউৎসাহী ট্যুরিস্ট ছাড়া লোকজন খুব একটা আসে না৷ নিঃসঙ্গ প্রাচীন ঘরবাড়িগুলো দিনের শেষ আলোতে নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷ থামের গায়ে সোনালি গিল্টির অলঙ্করণ খসে গেছে, ছাদের রংও বিবর্ণ হয়ে গেছে৷ চলতে-চলতে একটা ছোট চত্বরে উপস্থিত হল তারা৷ হঠাৎই একটা মাঝারি আকৃতির বাড়ির দিকে চোখ পড়তে তারা সে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল৷ খুব পুরোনো একটা বাড়ি৷ তার চালের ওপর সারসার ড্রাগনের মূর্তি বসানো৷ আর বাড়ি বা ছোট্ট প্রাসাদটার সামনে বেদির ওপর পরপর পাঁচটা ড্রাগন মূর্তি আছে৷ একটা হলুদ রঙের ড্রাগন৷ আর তার দু’পাশে লাল, কালো, সবুজ, সাদা রঙের ড্রাগন মূর্তি৷ তাদের সাজপোশাক, শরীরের গঠনের কিছু-কিছু পার্থক্য থাকলেও মূর্তিগুলোর ভঙ্গি এত জীবন্ত যে মনে হয় এখনই তারা নড়ে উঠবে৷ বলতে গেলে ওই মূর্তিগুলোই বাড়িটার কাছে দীপাঞ্জনদের টেনে নিয়ে দাঁড় করালো৷ তবে এ-বাড়িটা পরিত্যক্ত বলেই মনে হল৷ কপাটহীন দরজার ভিতর জমাটবাঁধা অন্ধকার খেলা করছে৷

    জুয়ান বলল, ‘মনে হচ্ছে এ-বাড়িটা উপাসনালয় গোছের কিছু ছিল৷ চারপাশে ড্রাগন মূর্তির কেমন ছড়াছড়ি দেখছ! আর কত রকমের কত ধরনের ড্রাগন!’

    হঠাৎই বাড়িটার ভিতর থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এল৷ আর তারপরই বাড়ির ভিতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এল৷ তাকে দেখে চাইনিজ বলেই মনে হল দীপাঞ্জনদের৷ মাঝবয়সী লোকটার পরনে কালো রঙের দামি স্যুট৷ হাতে একটা ছোট টর্চ৷ বাড়িটার বাইরে বেরিয়েই সামনে দীপাঞ্জনদের দেখতে পেয়ে একটু থতমত খেয়ে গেল লোকটা৷ তারপর হেসে বলল, ‘ট্যুরিস্ট নিশ্চয়ই?’

    জুয়ান হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ৷’

    লোকটা বলল, ‘মূল গেট থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছেন দেখছি৷ পাঁচটায় কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে যাবে৷ তাড়াতাড়ি ফিরুন৷ নইলে আটকা পড়ে যাবেন৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আমাদের সে সমস্যা নেই৷ আমরা রাতে এখানেই থাকব৷ অনুমতি নেওয়া হয়েছে৷ আসলে আমরা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে এ-জায়গা দেখতে চাই৷’ এ-কথা বলার পর দীপাঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনার পরিচয়টা?’

    লোকটা জবাব দিল, ‘আমি একজন গবেষক৷ এই যে ড্রাগন মূর্তি দেখছেন, ড্রাগনের ছবি দেখছেন, তা নিয়ে আমি গবেষণা করছি৷ আমি সাংহাইতে থাকি৷ আমার নাম শাও-ফু৷’

    কথাটা শুনে প্রফেসর জুয়ান উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘আমি প্রফেসর জুয়ান৷ জাপানের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক৷ আর আমার এই বন্ধু সেনও ইতিহাসের ব্যাপারে আগ্রহী৷’

    দীপাঞ্জনের নাম শুনে ভদ্রলোক মৃদু বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘শেন? কিন্তু আপনাকে দেখে তো চাইনিজ বলে মনে হচ্ছে না!’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আমি ভারতীয়৷ আমার নাম দীপাঞ্জন সেন৷ ‘সেন’ হল পদবি৷ প্রফেসর আমাকে ‘শেন’ বলে ডাকেন৷’

    জুয়ান এবার সামনের ড্রাগন মূর্তিগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে ভদ্রলোককে বললেন, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তবে ওই ড্রাগন মূর্তিগুলোর তাৎপর্য একটু বুঝিয়ে দেবেন?

    শাও বললেন, ‘না-না, আপত্তির কী আছে, বুঝিয়ে বলছি৷’ এই বলে দীপাঞ্জনদের নিয়ে মূর্তিগুলোর একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, মিং রাজবংশের সময়েই এই নগরী গড়ে ওঠে৷ ১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব ছিল৷ তারপর শিং বা চিং বংশের রাজারা ক্ষমতা দখল করেন৷ তারা কিন্তু আসলে ছিলেন মাঞ্চু৷ এই শহরের মতো এই ড্রাগন মূর্তিগুলোও তারাই নির্মাণ করান৷ পশ্চিমের সংস্কৃতিতে ড্রাগনকে নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর নরকের প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও চিনা সংস্কৃতিতে ড্রাগনের ধারণা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো৷ ড্রাগনরা এখানে সৌভাগ্যের দেবতা বা প্রকৃতির নানা রূপ হিসাবে পূজিত হন৷ যেমন, সবুজ বা ডিলং ড্রাগন হল পৃথিবীর দেবতা, নীল বা জিয়াওলিং হল সমুদ্রের দেবতা, কালো বা শেনলং হল বৃষ্টির দেবতা, সাদা ড্রাগন হল সাপের দেবতা, লাল রঙের ড্রাগন হচ্ছে স্বর্গের দেবতা৷ আর সোনালি রঙের যে ড্রাগনগুলো দেখতে পাচ্ছেন তারা হল ‘ড্রাগন কিং’ বা ড্রাগনদের রাজা৷ চিনা সম্রাটদের এক সময় ড্রাগনদের অর্থাৎ দেবতার সন্তান বলে মনে করা হতো৷ ড্রাগনের ছবি আঁকা পোশাক, অলঙ্কার বা অন্য কোনও কিছু জিনিস একমাত্র তারাই ব্যবহার করতে পারতেন৷ সাধারণ জনগণের তা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ছিল৷’ কথা শেষ করলেন ভদ্রলোক৷

    দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘এ-বাড়িটার ভিতর কী আছে?’

    শাও জবাব দিলেন, ‘এটা আসলে একসময় ড্রাগন কিংবা সোনালি বর্ণের ড্রাগনের মন্দির ছিল৷ বহু যুগ হল পরিত্যক্ত৷ তেমন কোনও জিনিসপত্র নেই ভিতরে৷ হ্যাঁ, দেওয়ালের গায়ে ড্রাগনের নানা প্রাচীন ছবি আছে৷ সেগুলো দেখতেই ভিতরে ঢুকেছিলাম, কিন্তু প্রাণ হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল৷’

    জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘প্রাণ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হলো কেন?’

    লোকটা বলল, ‘ভিতরটা সাপের আড্ডা৷ ঘরগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়ার মতো একটা শব্দ কানে এলো, ‘হি-স-সস!’ শব্দ শুনে টর্চের আলো ফেলতেই দেখি একগাদা ডিম নিয়ে বসে আছে বিরাট বড় একটা সাপ! আমার ধারণা অন্তত হাত দশ-বারো লম্বা হবে সেটা৷ কিং কোবরা৷ কারণ টর্চের আলো পড়তে সে যখন তার অর্ধেক দেহ তুলে ফণা ধরে উঠে দাঁড়াল তখন তার উচ্চতাই অন্তত আমার বুক সমান হবে৷ কোনওরকমে তার চোখে আলো ফেলতে-ফেলতে পিছু হঠে দূরে সরে গেলাম৷ চোখে আলো পড়াতে প্রাণীটা তার কর্তব্য ঠিক করতে পারছিল না৷ তাই হয়তো বেঁচে গেলাম৷’

    জুয়ান হেসে বললেন, ‘হয়তো-বা আপনার জন্য আমরাও বেঁচে গেলাম৷ আমরা তো এই প্রাচীন মন্দিরটার ভিতর ঢুকতে যাচ্ছিলাম৷ সঙ্গে টর্চও নেই৷ ভয়ঙ্কর কান্ড হতে পারত!’

    শাও বললেন, ‘হ্যাঁ, তা তো হতে পারত৷ এত বড় আর মোটা সাপ আমি দেখিনি৷ চারপাশে এত ড্রাগনের মূর্তি আর ছবি যে প্রাণীটাকে দেখলে কেউ ড্রাগন বলে ভাবতে পারে৷ একটা ড্রাগন যেন তার ডিম নিয়ে বসে আছে! ড্রাগনের ডিম!’

    কথাটা শুনে দীপাঞ্জন বলল, ‘ড্রাগনের ডিম কিন্তু আমরা দেখেছি৷’

    শাও জানতে চাইলেন, ‘তার মানে? ড্রাগনের ডিম!’

    জুয়ান হেসে বললেন, ‘আমরা এখানে ঝাং নামের এক সেরামিকের খেলনা বিক্রেতার বাড়িতে উঠেছি৷ ওর নাতির কাছে সেরামিকের তৈরি একটা ডিমের মতো জিনিস দেখেছি৷ বাচ্চাটা বলল ওটা ‘‘ড্রাগনের ডিম’’৷’

    প্রথমে শাও একটু চুপ করে রইলেন, তারপর হেসে জানতে চাইলেন, ‘আপনারা এখানে ক’দিন থাকবেন?’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘এ-জায়গা তেমনভাবে দেখা হয়নি৷ কাল মিউজিয়াম দেখব৷ কালকের দিনটা তো আছি৷ তেমন হলে হয়তো আরও একটা দিন থেকে যেতে পারি৷ ভালো লাগার ওপর নির্ভর করছে৷’

    শাও বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো করে বেড়ান৷ তবে খুব পুরোনো জায়গা তো তাই একটু সাবধানে বেড়াবেন৷ এই যেমন আমি সাপের মুখে পড়েছিলাম৷ আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো৷ এবার আমাকে ফিরতে হবে ওদিকে৷’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরাও ফিরব৷’

    ৷৷ ৪৷৷

    ‘ড্রাগন কিং’-এর সেই মন্দির চত্বর ছেড়ে দীপাঞ্জনরা রওনা হলো তাদের ঘরে ফেরার জন্য৷ হাঁটতে-হাঁটতে জুয়ান মিস্টার শাওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এখানে কোথায় উঠেছেন? এখন কোথায় যাবেন?’

    শাও জবাব দিলেন ‘প্রবেশ তোরণের পাশেই সরকারী অতিথিনিবাসে৷ গবেষণার কাজে এসেছি বলে সুযোগ মিলেছে সেখানে থাকার৷’

    একসময় তাদের আস্তানার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেল দীপাঞ্জনরা৷ শাও বললেন, আমিও এবার অতিথিনিবাসে ফিরে যাব৷ কিন্তু ঠিক এইসময় কাছেই এক জায়গাতে একটা ছোটো ভিড় দেখা গেল৷ স্থানীয় বাচ্চা ছেলেদেরই ভিড়৷ দু-চারজন ট্যুরিস্টও আছে৷ দীপাঞ্জনদের মনে হলো সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ যেন কোনও খেলা দেখাচ্ছে৷ কৌতূহলবশত দীপাঞ্জনরা এগোলো সেদিকে৷ একটু ইতস্তত করে শাও-ও পা বাড়ালেন সে দিকে৷ হ্যাঁ, সেখানে খেলা দেখাচ্ছে এক চীনা যুবক, আর তাকে ঘিরে একটা ছোট বৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে ছেলেরা ও কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ ট্যুরিস্ট৷ মার্শাল আর্টের খেলা৷ যে খেলা দেখাচ্ছে তার পরনে সিল্কের ঢোলা পাঞ্জাবীর মতো জামা আর পাজামা৷ কোমরের কাছটা একখন্ড চওড়া জরির কাপড় দিয়ে বাঁধা৷ কপালের সামনের দিকটা একটু কামানো ছেলেটার আর মাথার পিছন থেকে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে একটা লম্বা বেণী৷ বৃত্তের মধ্যে অসম্ভর ক্ষিপ্র গতিতে একটা চেন দিয়ে বাঁধা দুটো ছোটো লোহার দন্ড বা ‘ন্যান-চা’ ঘুরাচ্ছে সে৷ ব্রুস লি-র সিনেমাতে যেমন দেখা যায়৷ অবিশ্বাস্যভাবে সে ঘুরিয়ে চলেছে হাতের জিনিসটা, আর তার সাথে সাথে কখনও শূন্যে লাফিয়ে উঠে বনবন করে পাক খাচ্ছে আবার কখনও ডিগবাজি খাচ্ছে৷ অদ্ভুত শারীরিক দক্ষতা তার৷ যুবকটির খেলা দেখে কখনও-বা হাততালির ঝড় উঠছে, আবার কখনও খুচরো পয়সা উড়ে যাচ্ছে তার দিকে৷ দীপাঞ্জনরাও দেখতে লাগল তার খেলা৷ মার্শাল আর্টের এমন খেলা এর আগে সিনেমাতেই দেখেছে, চোখে দেখেনি তারা৷ দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতার অসাধারণ যুগলবন্দী৷ ‘ন্যান-চা’-র খেলা শেষ হবার পর সে মাটি থেকে একটা তলোয়ার উঠিয়ে নিল৷ বাঁকানো নয়, লম্বা সোজা চীনা তলোয়ার৷ তার খাপটা খুলে ফেলতেই দিন শেষের সূর্যালোক ঝিলিক দিয়ে উঠলো হাত তিনেক লম্বা ধারালো ব্লেডটা৷ কোমরবন্ধটা আর একটু শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তলোয়ারের খেলা দেখাতে শুরু করল ছেলেটা৷ একটা বেশ বড় কচি বাঁশের টুকরো সে প্রথমে এক হাতে অদ্ভুত কৌশলে ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে৷ বাঁশটা একদম সোজাভাবে আবার নেমে এল, আর দু-হাতে তলোয়ার ধরে বাঁশটাকে লক্ষ করে অদ্ভুতভাবে তলোয়ার চালালো ছেলেটা৷ বাঁশটা যখন মাটিতে পড়ল তখন সেটা আর একটা টুকরো নয়, চার-পাঁচ টুকরো হয়ে গেছে৷ বাঁশটা শূন্যে থাকতেই তাকে শশা কাটার মতো টুকরো করে ফেলেছে খেলোয়ারের তলোয়ার৷ ঠুং-ঠাং করে এবার কয়েন পড়তে লাগল ছেলেটার চারপাশে৷ জুয়ানও পকেট থেকে একটা দশ ইয়েনের নোট বার করে ভিড়ের মধ্যে থেকে বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে৷ হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে নোটটা নিয়ে মাথাটা একটু নমস্কারের ভঙ্গিতে ঝুঁকিয়ে হয়তো-বা জুয়ানের উদ্দেশেই তাকে খেলা দেখাবার জন্য তলোয়ার ঘোরাতে শুরু করল৷ নিজের শরীরের চারপাশে পাখার ব্লেডের মতো তলোয়ার ঘোরাচ্ছে ছেলেটা৷ যেভাবে সে তলোয়ার চালাচ্ছে সেটা যে শুধু অতি দক্ষতার ব্যাপার তাই নয়, বিপজ্জনকও বটে৷ সামান্য ভুলচুক হলেই আহত হবার সম্ভাবনা তার৷

    কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার সে ঘটনাটাই ঘটল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে৷ হঠাৎই ঠং করে শব্দ তুলে মাটিতে ছিটকে পড়ল তলোয়ারটা৷ আর ছেলেটা তার বামবাহু চেপে ধরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ সবাই বুঝতে পারল আর এখন খেলা দেখাবে না সে৷ মুহূর্তর মধ্যে ভিড়টা ভেঙে গেল৷ দীপাঞ্জন দেখতে পেল তাদের পাশ ছেড়ে মিস্টার শাও পা বাড়িয়েছেন ফেরার জন্য৷

    একসময় ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা৷ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু তারা তিনজন৷ সেই খেলোয়াড়, দীপাঞ্জন আর প্রফেসর জুয়ান৷ দীপাঞ্জনরা এবার খেয়াল করল ছেলেটার চেপে-ধরা জায়গা থেকে কনুই চুঁইয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছে মাটিতে৷ ব্যাপারটা দেখেই তাকে সাহায্য করার জন্য দীপাঞ্জন আর জুয়ান তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ দীপাঞ্জন তার হাতটা ধরে বলল, ‘দেখি কী হয়েছে আপনার?’

    চেপে ধরা জায়গা থেকে নিজের অন্য হাতটা সরিয়ে নিল খেলোয়াড়৷ কনুইয়ের ওপরের বাহুর কাছে সিল্কের পোশাকটা বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে৷ আর তার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা ক্ষত৷ খুব গভীর না-হলেও তলোয়ারের খোঁচাতে অন্তত তিন ইঞ্চি চিরে গেছে জায়গাটা৷ রক্ত গড়াচ্ছে৷ দীপাঞ্জন আর জুয়ানকে ক্ষতটা দেখাবার পর সেই যুবক আবার সে জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, ‘খুব ধারালো তলোয়ার তো! খুব সামান্য ছোঁয়াতেই এ-ব্যাপারটা ঘটে গেল! আগে কোনওদিন এমন হয়নি আমার!’

    জুয়ান বললেন, ‘কাছেই আমাদের থাকার জায়গা৷ আমরা ট্যুরিস্ট৷ আমাদের কাছে ব্যান্ডেজ-ওষুধ আছে৷ সঙ্গে চলো, রক্ত বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ বাঁধা প্রয়োজন৷ তারপর ডাক্তারের কাছে যাও৷’

    কথাটা শুনে একটু ইতস্তত করে সেই যুবক বলল, ‘আচ্ছা চলুন৷’

    ছেলেটার পাশে একটা ঝোলা মতো ছিলো৷ দীপাঞ্জন ছেলেটার জিনিসপত্রগুলো ভরে ফেলল তাতে৷ তলোয়ারটাও সাবধানে খাপের ভিতর পুরে ফেলল৷ তারপর সেগুলো নিয়ে রওনা হল তাদের আস্তানার দিকে৷ ক্ষতস্থানটা চেপে ধরে তাদের অনুসরণ করল খেলোয়াড়৷ গন্তব্যের দিকে এগোতে-এগোতে জুয়ান তার কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি কি এখানেই থাকো? কী নাম তোমার?’

    সে জবাব দিলো, ‘আমার নাম ‘তাও লি মিং৷ হ্যাঁ, আপাতত এখানেই আছি৷ পথে-পথে ঘুরে মার্শাল আর্টের খেলা দেখাই৷ আপনারা কোন দেশের মানুষ?’

    জুয়ান নিজেদের নাম-পরিচয় দিলেন তাকে৷ সে হেসে বলল, ‘তোমরা দুজনেই তবে আমার প্রতিবেশী দেশের মানুষ৷’ কথা বলতে-বলতেই তারা পৌঁছে গেল ঝাং-এর বাড়ির সামনে৷ বাড়ির বাইরে বারান্দা মতো জায়গাটাতে ওয়াং দাঁড়িয়ে আছে৷ তার হাতে একটা ছোট খাঁচার মধ্যে বেশ বড় আকারের দুটো সাদা ইঁদুর৷ জুয়ান প্রথমে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার দাদু কই?’

    সে জবাব দিলো, ‘বাড়িতেই তো ছিল৷ সে ঘুম থেকে ওঠার পর আমি বাইরে গেছিলাম ইঁদুর আনতে৷ আর তখন দেখছি দাদু নেই, দরজা বন্ধ করে কোথায় যেন বেরিয়েছে৷’

    তাও-কে বারান্দাতে দীপাঞ্জনের সাথে বসিয়ে রেখে জুয়ান বাড়ির ভিতর ঢুকলেন মেডিক্যাল কিটসটা আনার জন্য৷ তাও চীনাভাষায় কথা বলতে শুরু করল ওয়াং-এর সাথে৷ তাদের কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছেন না দীপাঞ্জন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়ান ফিরে এলেন ওষুধের ছোট ব্যগটা নিয়ে৷ তাও কে তিনি বললেন, ‘তোমার জামাটা খুলে ফেল৷ ব্যান্ডেজ বাঁধতে সুবিধা হবে৷’

    কথাটা শুনে তাও একটু ইতস্তত করে বলল, ‘খুলছি,তবে৷ একটু তাড়াতাড়ি করবেন যা করবার৷’—এই বলে সে জামাটা খুলে ফেলল৷ আর তার সাথে-সাথেই একটা জিনিস চোখে পড়ল দীপাঞ্জনদের৷ তাওয়ের শরীরে একটা বিরাট উল্কি আঁকা আছে৷ ড্রাগনের ছবি৷ ড্রাগনের মুখটা তাও-এর বুকে আঁকা৷ আর তার দেহটা বুক থেকে নেমে বগলের নীচ দিয়ে পাঁজর ছুঁয়ে ঘুরে গিয়ে লেজটা তাওয়ের পিঠে গিয়ে সাপের ফণার মতো শেষ হয়েছে৷ হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে একটা ড্রাগন যেন সত্যিই তার নখরযুক্ত পা দিয়ে তাও-এর বুক আর পাঁজর আঁকড়ে ধরেছে৷ দীপাঞ্জন তা দেখে বলেই ফেলল, ‘খুব সুন্দর উল্কি তো!’

    কথাটা শুনে তাও প্রথমে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর উল্কি৷’ তারপর রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটু যেন ব্যস্ত হয়েই বলল, ‘সূর্য ডুবে যাবে৷ একটু তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজটা বাঁধুন৷’

    জুয়ান ততক্ষণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বার করে ফেলেছেন৷ প্রথমে ক্ষতস্থানটা জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে ভালো করে মোছা হল৷ তারপর রক্ত বন্ধ করার জন্য পুরু করে মলম মাখিয়ে তাতে ব্যান্ডেজ জড়ানো হল৷ আর কাজটা শেষ হতেই গায়ে জামাটা দ্রুত পরে নিল তাও৷ ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজ যতক্ষণ চলছিল ততক্ষণ ওয়াং-এর সঙ্গে কিচিরমিচির করে কী যেন বলে চলল তাও৷ ব্যান্ডেজ করার পর জামা পরে উঠে দাঁড়াতেই ওয়াং তাওয়ের তলোয়ারটা মাটি থেকে তুলে নিল৷ আবারও কিচিরমিচির করে দুজনের মধ্যে কিছু কথা হল৷ তারপর ওয়াং হেসে তলোয়ারটা তাওয়ের হাতে তুলে দিলো, আর তাও-ও হেসে ওয়াং-এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল৷ যেন তাদের মধ্যে কোনও মজার কথা বিনিময় হল৷ তবে তাদের কথার মধ্যে ‘ড্রাগন’ কথাটা বেশ কয়েকবার ছিল৷

    দীপাঞ্জন তাওয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাদের ভাষাটা আমরা কিছুই বুঝতে পারি না৷ নিশ্চয়ই কোনও মজার কথা হল?’

    প্রশ্ন শুনে তাও হেসে বলল, ‘ও বলল, ও বড় হয়ে আমার মতো খেলা দেখাবে, মার্শাল আর্ট শিখবে৷ আমি ওর কথা শুনে জানতে চাইলাম ওর সাহস আছে কিনা? জবাবে ও বলল, আমাদের এখানে সবার থেকে ওর সাহস বেশি৷ সে এটা এখনই প্রমাণ করতে পারে৷ বড় হয়ে সে শুধু তলোয়ার-এর খেলাই নয়, জ্যান্ত একটা ড্রাগন নিয়ে খেলা দেখাবে৷ একটা ড্রাগনের বাচ্চা সে নাকি পেতে চলেছে৷’

    কথাটা শুনে দীপাঞ্জন আর জুয়ান বুঝতে পারল ওয়াং তার দাদুর মুখের গল্পটা সত্যিই বিশ্বাস করে বসে আছে৷ সে ভাবছে ওই সেরামিকের ডিম ফুটে সত্যিই ড্রাগনের ছানা বেরোবে৷ তাওয়ের কথা শুনে তাই দীপাঞ্জন আর জুয়ান দুজনেই হাসল ওয়াং-এর দিকে তাকিয়ে৷

    দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ নগরীর রাজপ্রাসাদের বিরাট চূড়ার আড়ালে সূর্য মুখ লুকোতে শুরু করেছ৷ ধীরে-ধীরে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে এই প্রাচীন নগরীর বুকে৷ সেদিকে একবার তাকিয়ে ‘তাও-লি’ দীপাঞ্জনদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ জানাবার ভাষা নেই৷ অপরিচিত লোকের জন্য আপনারা অনেক কষ্ট করলেন৷ এবার আমাকে ফিরতে হবে৷’

    তাওয়ের কথা শুনে জুয়ান বললেন, ‘এটা সামান্য ব্যাপার৷ আমাদের কর্তব্য ছিল৷ কৃতজ্ঞতা জানাবার মতো কিছু হয়নি৷ হ্যাঁ, যাও৷ তবে ডাক্তার দেখিও আর টিটেনাস নিও৷ আমরা যতটা জানি করলাম৷’

    কথাটা শুনে তাও হাসল৷ তারপর ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হারিয়ে গেল দীপাঞ্জনদের চোখের আড়ালে৷

    তাও চলে যাবার পর দীপাঞ্জন মজা করে ওয়াংকে বলল, ‘কালকের মধ্যেই যদি ডিমটা ফুটে যায় তবে বেশ ভালো৷ আমরা তবে ড্রাগনের ছানাটা দেখে যেতে পারব৷’

    ওয়াং বলল, ‘দাদু বলেছে ড্রাগনের ছানা ফোটার সময় হয়েছে৷ কাল পূর্ণিমা, পূর্ণিমার রাতে নাকি ড্রাগনের ছানা ফোটে৷ সমস্যা হল কাল রাতে নাকি ড্রাগন আসবে তার ছানাসমেত ডিম নিতে৷ এখন দেখি আমি কী করি?’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা বেশ মুশকিলের৷ দেখো যদি তাকে বুঝিয়ে ছানাটা তোমার কাছে রাখতে পার৷’

    ওয়াং চিন্তান্বিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, কোনও একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ছানাটাকে আমার কাছে রাখা যায়৷ এই ইঁদুর দুটো তো ড্রাগনের বাচ্চাটার জন্যই আনলাম৷ ডিম ফুটে বেরোবার পর নিশ্চয়ই খিদে পাবে৷ তখন খেতে দেব৷’

    ওয়াং-এর এ-কথা বলার পরই দীপাঞ্জনরা দেখল লাঠিতে ভর দিয়ে খটখট শব্দ তুলে ওয়াং-এর দাদু বুড়ো ঝাং এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে৷

    বারান্দায় উঠে বৃদ্ধ প্রথমে দীপাঞ্জনদের দেখে বললেন, ‘বেড়ানো কেমন হল?’

    দীপাঞ্জন জবাব দিল, ‘ভালোই৷ আশপাশটা ঘুরে দেখলাম৷ ড্রাগন কিং-এর পুরানো মন্দিরটার ওদিকে গেছিলাম৷ তবে ভিতরে ঢুকিনি৷ এক ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকেছিলেন, তার মুখে শুনলাম বাড়িটার ভিতরে একটা বিরাট সাপ নাকি তার ডিম নিয়ে বসে আছে৷’

    বৃদ্ধ শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন৷ ওখানে যে বিরাট সাপ থাকে তা আমরা অনেকে জানি৷ কিং কোবরা৷ কেউ-কেউ আবার ওকে ড্রাগনের রূপ ভাবে৷ ড্রাগন কিং৷ ওর খাবারের জন্য ছোটখাট প্রাণী ছেড়ে আসে মন্দিরে৷’

    জুয়ান বলল, ‘কিন্তু আমাদের মতো ট্যুরিস্টদের ব্যাপারটা জানার কথা নয়, যে-কোনও সময় তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷’

    ঝাং বললেন, ‘সাধারণত ট্যুরিস্টরা ওখানে যায় না৷ রাজপ্রাসাদ, মিউজিয়াম এসব দেখতে-দেখতেই সময় ফুরিয়ে যায় তাদের৷ আর ‘ড্রাগন কিং’ কাউকে কামড়েছে বলে শুনিনি৷ তবে সে এবার ডিম পেড়েছে বলে জানা ছিল না৷’

    এ কথা বলার পর বুড়োর হঠাৎ নজর পড়ল ওয়াং-এর দিকে৷ আর তার হাতে ইঁদুরের খাঁচাটা দেখেই মনে হয় খেপে গেলেন বৃদ্ধ৷ নিজেদের ভাষায় কী যেন চিৎকার করতে লাগলেন ওয়াং-এর উদ্দেশ্যে৷ আর ওয়াং-ও ইঁদুরের খাঁচাটা দেখিয়ে কী যেন বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল তার দাদুকে৷ কিন্তু বুড়ো ঝাং-এর রাগ যেন ক্রমশ বেড়েই চলল৷ একসময় তিনি কাঁপা-কাঁপা হাতে তাঁর লাঠিটা তুললেন তার নাতির পিঠে বসিয়ে দেবার জন্য৷ ভয় পেয়ে ওয়াং দীপাঞ্জনের শরীরের পিছনে নিজেকে আড়াল করল৷ দীপাঞ্জন লাঠিটা ধরে ফেলে বলল, ‘এ-বয়সে উত্তেজনা ঠিক নয়৷ যদি আপনি সমস্যাটা জানান তবে আমরা সমাধানের চেষ্টা করতে পারি৷’

    ঝাং লাঠিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘সমস্যা তো বটেই৷ আমি মরছি নিজের জ্বালাতে, তার ওপর আবার ও দুটো ইঁদুর জোগাড় করে এনেছে৷ কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুরের জোড়াটা গাদা-গাদা বাচ্চা দিতে শুরু করবে৷ সারা বাড়ি ইঁদুরে ভরে যাবে৷ তারা জিনিসপত্তর কাটবে, খাবার খেয়ে নেবে৷ সাপ-খোপও প্রচুর আছে এ তল্লাটে৷ ইঁদুরের খোঁজে তখন সাপও এসে হানা দেবে এ-বাড়িতে৷ এ-সব আমি সহ্য করব না৷ কাল সকালেই যদি ও বাড়ি থেকে ইঁদুর দুটো বিদায় না করে, তবে ইঁদুর সমেত ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেব৷’

    এই শেষ বাক্যটাই সম্ভবত চিনা ভাষায় নাতির উদ্দেশে বলে৷ এরপর রাগে গজগজ করতে-করতে লাঠি হাতে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল৷ ওয়াং চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ জুয়ান তাকে নরম গলাতে বললেন, ‘দাদু যখন ব্যাপারটা চাইছেন না, তখন ইঁদুরগুলো যেখানে থেকে এনেছ সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে এসো৷’

    জুয়ানের কথায় কোনও জবাব দিলো না বাচ্চাটা৷ খাঁচাটা নিয়ে সেও এরপর বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল৷ দীপাঞ্জন, জুয়ানও এরপর বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে নিজেদের ঘরে ফিরে এল৷ ঘরের ভিতর থেকে তারা বেশ কিছুক্ষণ ধরে শুনতে পেল নাতিকে তখনও বকাঝকা করে চলেছেন বুড়ো ঝাং৷ তারপর একসময় ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল সে শব্দ৷

    ৷৷ ৫৷৷

    দীপাঞ্জনরা ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল নিষিদ্ধ নগরীতে৷ দীপাঞ্জনদের সাথে একটা চার্জার লাইট আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা তারা অযথা জ্বালালো না৷ এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই৷ ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে চার্জ দেওয়া যাবে না৷ তাই সেটা রাতে খাবার সময়, আর বিশেষ প্রয়োজনে জ্বালাবে বলে ঠিক করলো৷ অন্ধকারে বসে গল্পগুজব করতে তাদের দুজনের কোনও সমস্যা হবে না৷ পরদিনের বেড়ানো নিয়ে আলোচনা শুরু করল দীপাঞ্জন-জুয়ান৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপাঞ্জনদের ঘরের পুরোনো দরজার ফুটোফাটা দিয়ে বাইরে থেকে একটা আলোকরেখা প্রবেশ করল৷ আর তারপরই একটা বাতি হাতে বৃদ্ধ ঝাং দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকলেন৷ তার হাতের আলোটা আসলে একটা চিনা লন্ঠন৷ না, ব্যাটারিচালিত লন্ঠন নয়, তেলের বাতি৷ কারুকাজ-করা একটা বাটির মতো পাত্র৷ তার মুখের পলতেতে আগুন জ্বলছে৷ আর তার চারদিকে তারের খাঁচার গায়ে লাল সিল্কের কাপড় দিয়ে ঘেরা৷ তার গায়ে সোনালি রং দিয়ে আঁকা আছে ড্রাগনের ছবি৷ জিনিসটার মাথায় একটা আংটা মতো আছে ওপর থেকে বাতিটাকে ঝোলানোর জন্য৷ বৃদ্ধ সেটা নিয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই নরম লাল আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরটাতে৷ ঝাং-এর মুখেও সেই লাল আভাতে তার বলিরেখাগুলো ফুটে উঠেছে৷ জিনিসটা দেখে প্রফেসর বেশ চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘ভারী সুন্দর জিনিস তো! আর বেশ পুরানো মনে হচ্ছে৷’

    ঝাং বললেন, ‘হ্যাঁ, খাটি চিনা লন্ঠন৷ তেলের পাত্রের গায়ে রুপোর প্রলেপ দেওয়া৷ একসময় এ-লন্ঠন ব্যবহার করা হতো রাজপ্রাসাদে৷ ড্রাগনগুলোও খাঁটি জরি দিয়ে বোনা৷ এ-লন্ঠনের বয়স আমার জন্মেরও আগে৷ যত্ন করে তুলে রাখি৷ আপনারা এলেন বলে বার করলাম৷ আমার পূর্বপুরুষরা একসময় রাজপ্রাসাদে এই লন্ঠন জ্বালাবার কাজ করতেন৷’

    কথাগুলো বলে একটু থেমে ঝাং বললেন, ‘আপনাদের পছন্দ হলে লন্ঠনটা আমি আপনাদের বিক্রি করতে পারি৷ মাত্র এক হাজার ইয়েন দাম নেব৷ কিউরিও শপে এর দাম তিনগুন৷ তাও হয়তো দেখা যাবে তিনমাস আগে কোনও ফ্যাক্টরিতে বানানো হয়েছে সেটা৷’

    দীপাঞ্জন বললেন, ‘এত সুন্দর জিনিসটা আপনি বিক্রি করতে চাইছেন!’

    বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ৷ চাইছি আমার নাতিটার জন্যই৷ এখনও বড় হল না ছেলেটা৷ আমার বয়স হয়েছে৷ মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ি৷ আমার যদি হঠাৎ কিছু হয় তবে ওর কী হবে! সেরামিকের খেলনা বেচে যে সামান্য আয় হয় তা তো খাবার আর ওষুধ কিনতেই চলে যায়৷ এবার ভাবছি ছেলেটার জন্য যতটা সম্ভব টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখার চেষ্টা করে যাব৷ সে জন্যই লন্ঠনটা বিক্রি করব বললাম৷ আরও কিছু ছোটখাট প্রাচীন জিনিস ছিল আমার কাছে৷ রুপোর পেয়ালা-পিরিচ এসব৷ অভাবের তাড়নাতে একটা-একটা করে বিক্রি করে দিয়েছি৷ এখন এই লন্ঠনটা আছে৷’

    তার কথা শুনে জুয়ান বললেন, ‘আপনার প্রস্তাবটা আমরা ভেবে দেখব৷’

    দেওয়ালের একপাশে কড়িবরগা থেকে একটা হুক লাগানো লাঠি নেমে এসেছে দীপাঞ্জনদের মাথার একটু ওপর পর্যন্ত৷ বৃদ্ধ সেখানে গিয়ে লাঠির গায়ে হুকের সাথে লন্ঠনটা ঝুলিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন৷ ঘরের বাইরে বেরোবার আগে আরও একবার থামলেন ঝাং৷ দীপাঞ্জনদের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু বিষণ্ণভাবে বললেন, ‘জানেন, ইচ্ছা করলেই আমি বড়লোক হয়ে যেতে পারতাম৷ ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়েও আর চিন্তা থাকত না৷ কিন্তু…৷’ এই বলে থেমে গেলেন বৃদ্ধ৷

    দীপাঞ্জন বলল, ‘কিন্তু কী?’

    ঝাং বললেন, ‘না, কিছু না৷ বুড়ো হয়েছি তো, মনের খেয়ালে নানা বাজে কথা বলে ফেলি৷’ এই বলে ধীর পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন ঝাং৷ তিনি চলে যাবার পর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দীপাঞ্জন বললো, ‘ঝাং মনে হয় কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না৷’

    জুয়ান বললেন, ‘ছেলেটাকে ও যতই বকুক-মারুক৷ ওর কথা শুনে বুঝলাম নাতিটাকে ও সত্যিই খুব ভালোবাসে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই৷’

    এরপর তারা দুজন পুরোনো দিনের গল্প শুরু করল৷ কখনও তাদের দুজনের প্রথম সাক্ষাত সেই ‘তেজক্যালিপোকার পিরামিড’-এর গল্প, কখনও আফ্রিকার ‘চাঁদের বাজনা’র গল্প, কখনও বা ‘ডাকাউ ক্যাম্পের’ গল্প৷ কত রোমাঞ্চকর স্মৃতি রয়েছে তাদের মনের ঝুলিতে! গল্প করতে-করতেই কখন যেন রাত ন’টা বেজে গেল৷ খাওয়া সেরে, ঝুলন্ত বাতিটা ওপর থেকে নামিয়ে, নিভিয়ে দিয়ে এরপর শুয়ে পড়ল তারা৷ সারা বাড়িটা নিস্তব্ধ৷ সম্ভবত বহুক্ষণ আগেই দাদু-নাতি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ঘুমিয়ে পড়েছে এই প্রাচীন নগরীও৷ কথা বলতে বলতে তারা দু’জনও ঘুমিয়ে পড়ল৷

    কিন্তু মাঝরাতে একে-একে তাদের দু-জনেরই ঘুম ভেঙে গেল গরম আর মশার দাপটে৷ কিছুক্ষণ দুজনেই বিছানাতে এপাশ-ওপাশ করার পর দুজনেই উঠে বসল৷ জুয়ান বললেন, ‘আমি জানলাটা খুলি, তুমি ব্যাগ থেকে গায়ে মাখার মশার ক্রিমটা বার করো৷ গায়ে মেখে শুতে হবে, নইলে নির্ঘাত চীনা ম্যালেরিয়া হবে৷’

    খাট থেকে দুজনেই নামল৷ জুয়ান জানলাটা খুলতেই বাইরের চাঁদের আলো প্রবেশ করলো ঘরে৷ ব্যাগ হাতড়ে মলমের কৌটোটা বার করল দীপাঞ্জন৷ ঠিক সেই সময় জুয়ান বললেন, ‘দেখো একটা লোক মনে হয়!’

    কথাটা শুনে দীপাঞ্জন গিয়ে দাঁড়ালো জুয়ানের পাশে৷ রাত একটা বাজে৷ চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রাচীন নগরীর বুকে৷ নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে অতি প্রাচীন কাঠামোগুলো৷ তাদের ছায়া মাটিতে পড়ে বাড়িগুলোর গায়ে আলো-আঁধারীর সৃষ্টি করেছে৷ জানলার ঠিক বাইরে একটা পাথুরে চত্বর আছে বাড়ির এপাশটাতে৷ আর তাকে ঘিরে প্রাচীন ঘরবাড়িগুলো দাঁড়িয়ে৷ এদিক দিয়ে এ-বাড়িতে এসে ওঠেনি দীপাঞ্জনরা৷ জুয়ান আঙুল তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করল চত্বরের গায়ের একটা বাড়ির দিকে৷ বললেন, ‘ওই যে, ওই বাড়ির দেওয়ালের গায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেখো লোকটা৷ ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে দীপাঞ্জন দেখতে পেল লোকটাকে৷ বাড়িটার দেওয়াল ঘেঁষে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা৷ তার পরণে সম্ভবত কালো পোশাক৷ তাই অন্ধকারের মধ্যে প্রায় মিশে আছে৷ পাছে লোকটা দীপাঞ্জনদের দেখে ফেলে সে জন্য জুয়ান জানলার পাল্লা দুটো টেনে দিয়ে তার মধ্যে সরু একটা ফাঁক রাখলেন৷ তার মধ্যে দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে লোকটাকে লক্ষ করতে লাগল তারা৷ চত্বরের গায়ের বাড়িগুলো একে অন্যর থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে৷ লোকটা এরপর অতি দ্রুত তার জায়গা ছেড়ে পাশের বাড়িটার গায়ে গিয়ে দাঁড়ালো৷ তারপর আবার তার পরের বাড়িটার গায়ে৷ এভাবে যেন সে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল দীপাঞ্জনদের বাড়িটার কাছাকাছি৷ একসময় দীপাঞ্জনদের কাছাকাছি শেষ বাড়িটার গায়ে এসে দাঁড়াল সে৷ হ্যাঁ, লোকটার শরীর আপাদমস্তক অনেকটা বোরখার মতো দেখতে কালো পোশাকে মোড়া, মুখেও কাপড় ঢাকা৷ দীপাঞ্জনদের বাড়িটার কাছে আসতে হলে লোকটাকে অন্তত পঞ্চাশ ফুট ফাঁকা জায়গা এবার পেরোতে হবে৷ সেটা পেরোবার আগে কিছুক্ষণের জন্য থামল লোকটা৷ সতর্ক হয়ে সে যেন একবার দেখে নিল কেউ কোথাও আছে কিনা৷ তারপর মাত্র কয়েকটা লাফ৷ মনে হয় যেন চত্বরটার ফাঁকা অংশটা প্রায় উড়ে পেরিয়ে এসে আশ্রয় নিল দীপাঞ্জনদের চোখের আড়ালে, সম্ভবত তাদেরই বাড়ির দেওয়ালের গায়ে কোনও একটা জায়গাতে৷ দীপাঞ্জন চাপা স্বরে জুয়ানকে বলল, ‘বাইরে বেরিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে একবার দেখবেন নাকি?’

    জুয়ান বললেন, ‘না থাক, দরকার নেই৷ এই প্রাচীন নগরীতে রাতেরবেলাতে কে কোন উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের জানা নেই৷ কোনও ঝামেলাতে জড়িয়ে গেলে মুশকিল৷ আমরা বরং এখানেই দাঁড়িয়ে দেখি লোকটা আবার এ পথে ফেরে কি না৷ দেখলে তো লোকটা কেমন উড়ে পেরিয়ে এল জমিটা! মার্শাল আর্টের ট্রেনিং না-থাকলে এটা সম্ভব নয়৷ এখানে অনেকেই এই আর্ট জানে৷ ওর ওই উড়ে যাওয়াটা আর একবার দেখতে ইচ্ছা করছে৷ একইভাবে নিশ্চয়ই সে ফিরে যাবে৷’

    লোকটার লাফিয়ে উড়ে যাওয়া দেখার প্রত্যাশাতে জানলার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল তারা দুজন৷ কিন্তু এরপরই অন্য একজনকে দেখতে পেল দীপঞ্জনরা৷ দুটো বাড়ির মাঝের রাস্তা দিয়ে চত্বরের দিকে এগিয়ে আসছে অন্য একজন৷ সে কিছুটা এগিয়ে আসার পরই তাকে চিনতে পারল দীপাঞ্জনরা৷ জুয়ান বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন, ‘ওয়াং এত রাতে কোথা থেকে বাড়ি ফিরছে?’

    দীপাঞ্জনরা দেখতে লাগল তাকে৷ ওয়াং-এর হাত থেকে কি যেন একটা ঝুলছে৷ ধীরেসুস্থেই চত্বরটা পেরিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওয়াং৷ বাড়ির কাছে চলে এল সে৷ তার হাতের জিনিসটা একটা লন্ঠন৷ সেটা নেভানো৷ দীপাঞ্জনদের জানলার কাছাকাছি এসে একবার থামল সে৷ তার ঢোলা জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেন কোনও কিছুর উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল৷ তারপর জানলার সামনে দিয়ে এগোল সম্ভবত বাড়ির সামনের অংশতে আসার জন্য৷ হ্যাঁ, মিনিটখানেকের মধ্যে বাড়ির কোনও একটা জায়গা থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন তাদের কানে এল৷ সম্ভবত ওয়াং বাড়ি ঢুকলো৷ জানলার সামনে আরও মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর জুয়ান হাই তুলে বললেন, ‘না, এবার শুয়ে পড়ি৷ ও লোক কখন ফিরবে কে জানে? হয়তো-বা অন্যপথেই ফিরবে৷ কাল সকাল-সকাল উঠতে হবে৷ মিউজিয়ামটা ভালো করে দেখতে হবে৷’

    দীপাঞ্জনেরও আবার ঘুম পাচ্ছিল৷ মশার মলম গায়ে মেখে আবার শুয়ে পড়ল তারা৷

    ৷৷ ৬৷৷

    ভোরে ঘুম থেকে উঠবে ভাবলেও পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে সকাল আটটা বেজে গেল তাদের৷ বাইরে বেরোবার জন্য ঘরের লাগোয়া বাথরুম থেকে স্নান সেরে নিল তারা৷ তারপর প্রাতরাশ সাঙ্গ করে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে যখন তারা বেরোল তখন প্রায় ন’টা বাজে৷ ঝাং আর ওয়াং-এর ঘরের দরজার পাল্লাটা ভেজানো আছে৷ হয়তো-বা ঘরের মধ্যেই রয়েছে তারা৷ তাদের অবশ্য দীপাঞ্জনদের তখন প্রয়োজন নেই৷ দীপাঞ্জন আর জুয়ান তাই তাদের না-ডেকে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ল৷ নির্মল সকাল৷ দিনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সোনালি গিল্টি-করা প্রাসাদগুলোর ঢেউখেলানো ছাদে, প্রাচীন বাড়িঘরগুলোর কারুকাজ করা থামগুলোর গায়ে৷ এক ঝাঁক পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে৷ সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর পরিবেশ৷ লোকজন খুব কম চোখে পড়ছে৷ যাদের দেখা মিলছে তাদের দেখে মনে হয় তারা সবাই এই নিষিদ্ধ নগরীরই বাসিন্দা৷ কাঠের বালতিতে জল নিয়ে ফিরছে কেউ, আবার কেউ-বা বাড়ির সামনের রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে৷ বাইরের ট্যুরিস্টরা এখনও ভিতরে প্রবেশ করা শুরু করেনি৷

    প্রাসাদ মিউজিয়াম খুলবে সকাল দশটাতে৷ হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে দীপাঞ্জনদের৷ তাই তারা প্রাসাদ মিউজিয়ামের দিকে তখনই পা না-বাড়িয়ে ধীরে সুস্থে চারপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করলো৷ কত প্রাচীন বাড়িঘর, মন্দির, উপাসনাকক্ষ চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে এই মহাচিনের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে৷ চৈনিক সাম্রাজ্যের কত উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিল একসময় এসব ঘরবাড়িগুলোর বাসিন্দারা৷ কিন্তু মহাকাল বড় নির্মম, নিষ্ঠুর৷ সেসব কিছুই কেড়ে নেয়, যেমন সে কেড়ে নিয়েছে এ নগরীর একসময়ের সব জৌলুসকে৷ ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে জুয়ান বললেন, ‘এই নিষিদ্ধ নগরী শুধুমাত্র ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটই নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম কাষ্ঠনির্মিত নগরী৷ চিন সাম্রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের বনভূমি থেকে দুর্মূল্য ‘ফোবে’ কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল এ-নগরী তৈরি করার জন্য৷ এ-কাঠের বৈশিষ্ট্য হল লোহার মতো শক্ত কিন্তু হালকা৷ সব থেকে বড় কথা হল এ-কাঠে কোনো ঘুণপোকা ধরে না৷ যে কারণে পাঁচশো বছর পরও কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি-প্রাসাদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে৷

    ঘুরতে-ঘুরতে একসময় গতকালের সেই চকটাতে পৌঁছে গেল৷ যেখানে গত বিকালে খেলা দেখাচ্ছিল তাও৷ তার মনে পড়াতে জুয়ান বললেন, ‘ছেলেটার হাতের ক্ষতটা কেমন আছে কে জানে? ওর বাসস্থান চেনা থাকলে একবার খোঁজ নেওয়া যেত৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ তা খোঁজ নেওয়া যেত৷ ওর গায়ের ড্রাগনের উল্কিটাও বড় সুন্দর আর অদ্ভুত৷ এত বড় উল্কি আমি আগে কারো গায়ে দেখিনি৷’

    সেই চত্বর বা চক পেরিয়ে এরপর প্রাসাদ মিউজিয়ামে যাবে বলে পা বাড়াল দীপাঞ্জনরা৷ ইতিমধ্যে সাড়ে ন’টা বেজে গেছে৷ ঠিক দশটাতে মিউজিয়াম খুলবে৷ কিন্তু কিছুটা তফাতেই একটা গলির মুখে ছোটখাটো ভিড় নজরে পড়ল তাদের৷ দু-সার দিয়ে বেশ কিছু প্রাচীন ঘরবাড়ি রয়েছে সেখানে৷ তার মুখটাতে মানুষের জটলা৷ দু-একজন পুলিশকর্মীও আছে মনে হয়৷ সম্ভবত কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে সেখানে৷ দূর থেকে সেই ভিড়ের মধ্যে মিস্টার শাওকেও দেখতে পেলেন তারা৷ আর তিনিও তাদের দেখতে পেয়ে সেই ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এলেন৷ তিনি আসছেন দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপাঞ্জনরা৷ তিনি তাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই দীপাঞ্জন আর জুয়ান তাকে সুপ্রভাত জানালো৷ শাও গম্ভীর মুখে প্রথমে বললেন, ‘সুপ্রভাত৷’ তারপর বললেন, ‘সত্যিই আজ সুপ্রভাত কিনা জানা নেই৷ সকালে হাঁটতে বেরিয়েই ওখানে যা কান্ড দেখলাম!’

    জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘কী কান্ড ঘটেছে ওখানে?’

    শাও বললেন, এসব জায়গাতেও দেখছি শান্তি নেই৷ খুন হয়েছে৷ একটা লোককে তার বাড়ির মধ্যে তলোয়ার দিয়ে ঘুমের মধ্যে দু-টুকরো করে ফেলা হয়েছে৷’

    ‘কে খুন হয়েছে? আর কে খুন করেছে?’ বিস্মিতভাবে জানতে চাইল দীপাঞ্জন৷

    মিস্টার শাও বলল, ‘যিনি খুন হয়েছেন তার নাম কিং ঝাও৷ বুড়ো লোক৷ এ-নগরীর প্রাচীন বাসিন্দা৷’

    এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘গতকাল একটা ছেলে মার্শাল আর্ট দেখাচ্ছিল না? তাকেই পরশু ঘর ভাড়া দিয়েছিল বুড়োটা৷ সবার ধারণা, সেই ছেলেটাই খুনটা করেছে৷ দেহের পাশেই তার রক্তমাখা তলোয়ারটা পড়ে আছে৷ আর ছেলেটাও বেপাত্তা৷’

    জুয়ান বললেন, ‘সে হঠাৎ বুড়োটাকে খুন করতে যাবে কেন? তার মুখ দেখে তো আমাদের সরল-সাধাসিধে বলেই মনে হয়েছিল৷’ যদিও তাকে নিজেদের সাথে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ক্ষতস্থানে শুশ্রুষা করার ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই মিস্টার শাওকে বললেন না প্রফেসর জুয়ান৷

    শাও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার একটা অনুমান আছে৷ জানেন তো এ-নগরীর বাসিন্দাদের কাছে অনেকসময় নানা দুর্মূল্য প্রাচীন সামগ্রী পাওয়া যায়৷ বংশপরম্পরায় তাদের কাছে রয়েছে সেসব জিনিস৷ পুলিশ আর সরকারি নজরদারি এড়িয়ে গোপনে সেগুলো কেনাবেচাও হয়৷ তারপর তো পাচার হয়ে যায় এ-নগরীর বাইরে, দেশের বাইরে, লক্ষ-লক্ষ ডলারে বিক্রি হয় সেসব অ্যান্টিক জিনিস৷ আমার ধারণা বুড়োটার কাছে তেমনই কিছু জিনিস ছিলো সেটা নিয়ে বুড়োটাকে মেরে চম্পট দিয়েছে লোকটা৷ আপনারা চললেন কোথায়?’

    জুয়ান জবাব দিলেন, ‘প্রাসাদ মিউজিয়াম দেখতে৷’

    মিস্টার শাও বললেন, ‘এগোন তবে৷ সময় তো হয়ে এল৷ আমাকেও আমার কাজে যেতে হবে৷ এই বলে শাও রওনা হয়ে গেলেন অন্যদিকে, আর দীপাঞ্জনরাও এগোল প্রাসাদের দিকে৷ সকালবেলায় একটা খুনের খবর পেয়ে, বিশেষত খুনের সাথে তাওয়ের নাম সন্দেহর প্রথমে আছে জেনে মনটা কেমন যেন তেতো হয়ে গেল দীপাঞ্জনদের৷ চলতে-চলতে দীপাঞ্জন শুধু একবার বলল, ‘তাও কে দেখে কিন্তু আমারও সরল চিনা যুবক বলেই মনে হয়েছে৷ সে কি এ কাজ করতে পারে?’

    জুয়ান বললেন, ‘কে জানে? কিন্তু সে নিরুদ্দেশই-বা হল কেন?’

    দীপাঞ্জনরা যখন প্রাসাদ মিউজিয়ামের কাছে পৌঁছলো প্রায় দশটা বাজে৷ বাইরের পর্যটকরা ইতিমধ্যে দলে-দলে ঢুকতে শুরু করেছে নিষিদ্ধ নগরীতে৷ জড়ো হচ্ছে পাঁচশো বছরের প্রাচীন মিং রাজপ্রাসাদের সামনে৷ টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিল তারা৷ দশটা বাজতেই তারা প্রবেশ করলো ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই প্রাসাদে৷ দীপাঞ্জনরা ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারল বাইরে থেকে বোঝা না-গেলেও এটা কোনও একটা প্রাসাদ নয়, ছোট-বড় নানা প্রাসাদের সমষ্টি৷ সেগুলোকে নিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে নানা মিউজিয়াম প্রদর্শনীকক্ষ৷ প্রাসাদের ভিতর বেশ কয়েকটা জলাশয়ও আছে৷ শাপলা ধরনের ফুল ফুটে আছে তাতে, আর আছে রঙিন মাছের ঝাঁক৷ এছাড়া বাগান তো আছেই৷ সবকিছু বেশ সুন্দরভাবে সাজানো৷ কমিউনিস্ট চিন রাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী হলেও তারা দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য আর ইতিহাসের প্রতি গভীর যত্নশীল৷

    টিকিটের সাথে একটা বুকলেটে প্রাসাদ-মিউজিয়ামের একটা ম্যাপ, আর কোথায় কী দ্রষ্টব্য আছে তা লেখা আছে৷ সেটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জুয়ান বললেন, ‘এত বড় মিউজিয়াম খুঁটিয়ে দেখা একদিনে সম্ভব নয়৷ এখানে শুধু তৈলচিত্রই আছে পঞ্চাশ হাজার৷ যতটুকু পারি আজকে দেখি৷ তেমন হলে কালকের দিনটাও থেকে যাব মিউজিয়াম দেখার জন্য৷ চলো, আমরা প্রথমে দরবার-হলটা দেখি৷ তবে, ওর ছবি তোলা নিষেধ৷

    গাইডবুকের নির্দেশ মেনে তারা প্রথমে পৌঁছলো একটা প্রাসাদের অভ্যন্তরে বিশাল দরবার-হলে৷ সেখানে বসে একসময় তাদের বিরাট সাম্রাজ্য শাসন করতেন চিনা সম্রাটরা৷ বিশাল ঘরটা শ্বেতপাথরে মোড়া৷ থামগুলো সব চন্দন কাঠের৷ তার ওপর সোনা-রুপোর নকশা৷ সিলিং-এও শোলার কারুকাজ৷ ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে সম্রাটদের প্রাচীন তৈলচিত্র৷ আর সর্বত্রই বসানো আছে মিং সম্রাটদের প্রতীক সোনালি ড্রাগনের বা ড্রাগন কিং-এর স্বর্ণখোদিত মূর্তি৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে বিরাট কাচের আধারের মধ্যে রয়েছে সম্রাটের সিংহাসন৷ দীপাঞ্জন আর জুয়ান গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে৷ বিরাট সিংহাসনটা নিরেট সোনার তৈরি৷ কত রকমের হিরে-জহরত-পান্না যে তাতে বসানো আছে তার হিসাব নেই৷ সিংহাসনের মাথার দু-পাশে দুটো ড্রাগন মূর্তি আছে৷ তাদের চুনির চোখ, সোনার আঁশে ঢাকা দেহ৷ এমনকি সিংহাসনের নীচে সম্রাটদের পা রাখার জন্য যে জায়গা, সেখানেও হিরে বসানো৷ প্রাচ্যের সম্রাটদের বৈভব কেউ দেখতে চাইলে তাকে একবার এই দরবার হলে আসতেই হবে৷ দরবার-হল দেখার পর একে-একে প্রাসাদ মিউজিয়ামের অন্য অংশগুলোও দুজনে দেখে বেড়াতে শুরু করল৷ দরবার কক্ষ ছেড়ে তারা প্রথমে প্রবেশ করল রাজঅন্তঃপুরে৷ সেখানে বসবাস করতেন সম্রাটরা৷ শ্বেতপাথর আর দামি কাঠেমোড়া রাজঅন্তঃপুরে কত রকমের প্রাচীন মূর্তি আর ছবি আছে তার হিসাব নেই৷ সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীদের শয়নকক্ষের ভিতরে অবশ্য প্রবেশের অনুমতি নেই৷ বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে হয় কাচের পর্দার আড়াল থেকে৷ বৈভব আর শিল্পের চূড়ান্ত রূপ রয়েছে একসময় ব্যবহূত সেই ঘরগুলোতে৷ খাট ইত্যাদি সোনার তো বটেই, ঘরের মেঝেতে পর্যন্ত সোনার ইট বসানো৷ একের পর এক দ্রষ্টব্য প্রাসাদ দেখে চলল দীপাঞ্জনরা৷ সময় গড়িয়ে চলল৷ তার সাথে বাড়তে লাগল ভিড়ও৷

    বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা প্রাসাদে প্রবেশ করল তারা৷ যে প্রাসাদ এক সময় রাজপরিবারের শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো৷ পরিচারক-পরিচারিকাদের তত্ত্বাবধানে দিনের বেলা শিশুরা থাকত এখানে৷ সম্রাটদের শিশুদের বৈভবও তো সম্রাটদের মতোই হবে৷ তাই সোনার দোলনা, চাকা লাগানো হাতির দাঁতের গাড়ি, সোনার সুতোয় বোনা তাদের পোশাক আর অসংখ্য তৈলচিত্র রাখা আছে সেখানে৷ সেসব দেখতে-দেখতে হঠাৎই একটা তৈলচিত্র সামনে জুয়ান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ তারপর সেই তৈলচিত্রর প্রতি দীপাঞ্জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ওই দেখো৷’

    ছবিটার দিকে তাকাল দীপাঞ্জন৷ তিনজন পাঁচ-ছ বছরের বাচ্চার ছবি৷ তাদের পরনে রাজকীয় টুপি, জুতো, পোশাক, অলঙ্কার বলে দিচ্ছে তারা সম্রাটের সন্তান৷ পোশাকে ড্রাগনের ছবিও আঁকা৷ যা একমাত্র সে-যুগে রাজপরিবারের সদস্য ছাড়া কেউ ওই প্রতীক ব্যবহার করত না৷ বাচ্চাগুলো পা ছড়িয়ে বসে কতগুলো বলের মতো জিনিস নিয়ে খেলছে৷ ভালো করে দেখার পর দীপাঞ্জন বুঝতে পারল সেগুলো বল নয়, ডিমের মতো দেখতে৷ ওয়াং-এর কাছে দেখা সেই ড্রাগনের ডিমের মতো৷

    দীপাঞ্জন ফিরে তাকাল জুয়ানের দিকে৷ তিনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ৷ ছবির ডিমগুলোর আকার দেখে মনে হচ্ছে এদের আকার ওয়াং-এর সেই ড্রাগনের ডিমের মতোই৷ অর্থাৎ, এ-জিনিসগুলো এক সময় সম্রাটপুত্রদের খেলার সামগ্রী ছিল৷ এবার অনুমান করতে পারছি বৃদ্ধ ঝাং কেন ডিমটা আগলে রাখতে চান৷ জিনিসটা দুর্মূল্য অ্যান্টিক৷ প্রচুর দাম হবে৷ বাচ্চা ছেলেটা জিনিসটা হারিয়ে ফেলতে পারে৷ যেমন আর একটু হলেই আমরা না-থাকলে জিনিসটা সে হারিয়ে ফেলছিল৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘কিন্তু ড্রাগনের ডিম ফিরিয়ে নিতে আসার গল্পটা, যেটা বলল ওয়াং৷’

    জুয়ান বললেন, ‘এমন হতে পারে ওয়াং যাতে ডিমে হাত না-দেয়, সেটা নিয়ে বাইরে না-যায় সেজন্য ওই গল্প ফেঁদেছে ওই বৃদ্ধ৷ আবার এমনও হতে পারে যে ডিমটা অ্যান্টিক জিনিস হিসাবে কাউকে বেচে দিতে চলেছে ঝাং৷ যেমন, আমাদের সে লন্ঠন বেচতে চাইলো৷ নাতির ভবিষ্যতের জন্য টাকা রেখে যেতে চাইছে সে৷’

    কথাগুলো বলার পর ঘড়ি দেখে জুয়ান বললেন, ‘বেশ বেলা হয়েছে, খিদেও পাচ্ছে৷ আপাতত আজকের মতো মিউজিয়াম দেখা শেষ করি৷ কালকের দিনটাও এখানেই থেকে যাব৷ এখন চলো ঘরে ফিরি৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন৷’

    দরজার দিকে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই দীপাঞ্জনের হঠাৎ একটা লোকের ওপর দৃষ্টি পড়ল৷ কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে একজন চিনা৷ পরনের পোশাক দেখে তাকে স্থানীয় লোক বলেই মনে হল৷ লোকটার ডান গালে একটা কাটা দাগ আছে৷ দীপাঞ্জনের সাথে চোখাচোখি হতেই সে অন্যদিকে চলে গেল৷

    দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, ‘দেখলেন লোকটাকে?’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, এ-লোকটাকে কিছুক্ষণ আগে যেন আরও একটা জায়গাতে দেখলাম বলে মনে হলো৷ গালে কাটা দাগওয়ালা লোক৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আগে দেখেছেন! ও এমনভাবে চলেই বা গেল কেন? আমাদের ফলো করছে নাকি?’

    জুয়ান বললেন, ‘কে জানে! কিন্তু আমাদের ফলো করার মতো তো কোনও ব্যাপার ঘটেনি৷’ কথা বলতে বলতে এরপর সে ঘর, প্রাসাদ-কমপ্লেক্স ছেড়ে ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াল তারা৷ কিছুটা এগোতেই তারা একটা ঘরের দরজার সামনে মুখোমুখি হয়ে গেল মিস্টার শাওয়ের৷ জুয়ান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এখানে?’

    শাও বললেন, ‘হ্যাঁ, একটু আগেই এলাম৷ আসলে এখানে একটা বিশেষ ধরনের ড্রাগন মূর্তি আছে, সেটা দেখতেই এলাম৷ আপনাদের দেখা শেষ?’

    জুয়ান জবাব দিলেন, ‘আপাতত আজকের মতো৷ এত বড় মিউজিয়াম কি কয়েক ঘণ্টাতে ভালো করে দেখা যায়? ভাবছি কালকের দিনটাও থেকে যাব৷’

    এ-কথা বলার পর জুয়ান বললেন, ‘আপনাকে একটা তথ্য দিই, হয়তো সেটা কোনও কাজে লাগতে পারে৷’

    ‘কী তথ্য?’

    জুয়ান হেসে বললেন, ‘ড্রাগনের ডিম কিন্তু আছে বা ছিল৷ আসলে সে জিনিসটা হল সম্রাট শিশুদের খেলার জিনিস৷ সম্রাটদের তো ড্রাগন বলে ডাকা হতো৷ তাই হয়তো ওই খেলনা ডিমকে ‘ড্রাগনের ডিম’ বলে৷’

    মিস্টার শাও কথাটা শুনে প্রথমে বললেন, ‘এ-ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না৷ ছবিটাও দেখিনি৷ আসলে এখানে এত ছবি আছে যে সব ছবি চোখে পড়ে না৷ তবে আমার গবেষণা ড্রাগনের ছবি, মূর্তি এসব নিয়ে, খেলনা নিয়ে নয়৷’ এ কথা বলার পর মিস্টার শাও বললেন, ‘আরও একটা দিন এখানে থাকবেন তো বলছেন, কিন্তু অনেকেই খুনের ঘটনাটার পর এ-জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন৷ আপনার আমার মতো বাইরের বেশ কিছু লোক তো এই নিষিদ্ধ নগরীতে রয়েছি৷ পুলিশ নাকি আমাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করবে বলে শুনছি৷ আমি তো ভাবছি আজই ফিরে যাব, কে আর ঝামেলাতে জড়াতে চায়?’ কথাগুলো বলে মিস্টার শাও পা বাড়ালেন অন্যদিকে, তিনি চলে যাবার পর জুয়ান বললেন, ‘সত্যিই যদি পুলিশের হাঙ্গামাতে পড়তে হয় তবে মুশকিলের কথা৷ যদিও আমাদের ভয়ের কিছু নেই৷ তাও-লি নামের ছেলেটাকে আমরা শুশ্রূষা করেছিলাম মাত্র৷ সে যদি অপরাধী হয়েও থাকে আমরা তো আর তার অপরাধের সঙ্গী নই৷’

    প্রাসাদ-কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এরপর ফেরার পথ ধরল দীপাঞ্জনরা৷

    ৷৷ ৭৷৷

    বাড়িতে ফিরে এসে বাইরের বারান্দাতে উঠতেই ভিতর থেকে বৃদ্ধ ঝাং-এর চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ কানে এল দীপাঞ্জনদের৷ তারা অনুমান করলো, নির্ঘাৎ আবার দাদু-নাতির মধ্যে ঝগড়া বেঁধেছে৷ তারা বাড়ির ভিতর ঢুকে বুঝতে পারল অনুমান সত্যি৷ জাং-এর ঘরের দরজা খোলা৷ ঘরের ভিতর লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ঝাং চিনা ভাষাতে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াং৷ সে যেন মাঝে-মাঝে দাদুকে কিছু বলার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু তার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে বুড়ো৷

    ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুয়ান একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে?’

    প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ তার শনের মতো চুল-দাঁড়িওয়ালা মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ-ছেলে আমাকে আর বাঁচতে দেবে না৷ আমার ক্ষতি করেই ছাড়বে৷ আমি রাতে আফিম খেয়ে ঘুমাই৷ আমার হুঁশ থাকে না৷ উঠতেও একটু বেলা হয়৷ আর সেই সুযোগে ঘর থেকে একটা জিনিস সরিয়ে ফেলেছে ও৷ কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করছে না৷ জিনিসটা যে আজ রাতেই আমার দরকার৷’

    দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘কী জিনিস?’

    প্রশ্ন শুনে একটু থেমে গেলেন বৃদ্ধ৷ তারপর বললেন, ‘খুব পুরানো একটা জিনিস৷ ওই যে ওই তাকে একটা ছোট বেতের ঝুড়ির মধ্যে রাখা ছিল৷ এখন নেই৷ যেভাবেই হোক আজকের মধ্যে ওটা ফেরত চাই আমার৷’

    দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারল যে ডিমটার ব্যাপারে বলতে গিয়েও চেপে গেলেন বৃদ্ধ৷ পুরানো জিনিসটা আসলে কী জিনিস তা বাইরের লোককে জানতে দিতে চান না তিনি৷ সেটা যে দীপাঞ্জনরা ঘটনাচক্রে ওয়াং-এর মাধ্যমে দেখেছে তা জানা নেই বৃদ্ধের৷

    দীপাঞ্জনদের কথাটা বলে আবার চিনা ভাষায় সুর চড়াতে লাগলেন বৃদ্ধ৷ ওয়াং-এরপর আবারও কিছু একটা বলল, ‘আর কথাটা শুনে বৃদ্ধ ঝাং খেপে গিয়ে তার লাঠি দিয়ে এক ঘা দিলেন ওয়াং-এর পায়ে৷ লাফিয়ে উঠল ওয়াং৷ ঝাং তার পায়ে দ্বিতীয়বার লাঠির গা দেবার আগেই ওয়াং এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে ছুটলো বারান্দার দিকে৷ বৃদ্ধ ঝাং রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, ‘নির্ঘাত ওই জিনিসটা সরিয়েছে রাতেরবেলাতে৷ রাতে দরজা দিয়ে শুয়েছিলাম আমি৷ বাইরের লোক ঘরে কীভাবে ঢুকবে৷ ওয়াং দরজা খুলে বেরিয়েছিল৷ জিনিসটা আমি কীভাবে ফেরাবো তাকে৷ আজই তো সেটা যার জিনিস সেটা সে ফেরত নিতে আসবে৷’

    জুয়ান প্রশ্ন করলেন, ‘কার জিনিস?’

    প্রশ্নটা শুনে বৃদ্ধ একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘সে লোককে আপনারা চিনবেন না৷ তবে ওয়াং যদি ওটা ফিরিয়ে না-আনে তবে আমি আত্মহত্যা করব৷ তখন ও বুঝবে ব্যাপারটা৷ না-খেয়ে মরবে৷’

    গতকাল গভীর রাতে ওয়াংকে ফিরতে দেখেছিল দীপাঞ্জনরা৷ ঝাং-এর অনুমান কি তবে সত্যি? দাদু জিনিসটা অন্য কাউকে দিয়ে দেবে বলে কি সরিয়ে ফেলেছে বেতের ঝুড়িটা? জুয়ান বৃদ্ধকে বললেন, ‘আপনি মাথা ঠান্ডা করুন৷ আপনার সমস্যার কথা আমরা বুঝতে পেরেছি৷ আমরা একবার ওয়াং-এর সাথে বলে দেখি৷’

    বৃদ্ধ বললেন, ‘দেখুন বলে৷’

    জুয়ান আর দীপাঞ্জন আবার বারান্দাতে বেরিয়ে এল৷ এক কোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াং৷ তার চোখের কোণে জল৷ জুয়ান তার কাছে এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রেখে সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, ‘ডিমের ঝুড়িটা কোথায়, তুমি জানো?’

    মাথা নেড়ে ওয়াং বলল, ‘ঝুড়ি আমি নিইনি৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘তবে কাল রাতে তুমি কোথায় গেছিলে? আমরা কিন্তু তোমাকে ফিরতে দেখেছি৷’

    কথাটা শুনেই ওয়াং চমকে উঠে তাকাল দীপাঞ্জনের দিকে৷ তারপর বলল, ‘ইঁদুরগুলো ছেড়ে আসতে গেছিলাম৷’

    ‘অত রাতে ইঁদুর ছাড়তে বাইরে বেরিয়েছিলে?’ একটু সন্দিগ্ধভাবেই প্রশ্ন করল দীপাঞ্জন৷

    ওয়াং বলল, ‘হ্যাঁ, ঘুম আসছিলো না৷ দাদুর ওপর রাগ হচ্ছিল৷ তাই রাতেই ইঁদুর ছাড়তে গেছিলাম৷ আমি যখন বাড়িতে ফিরলাম তখনও কিন্তু ঝুড়িটা ওখানেই ছিল, ডিমও ভিতরেই ছিল৷ আমি দেখেছি৷’ শেষ কথাগুলো বেশ দৃঢ়ভাবেই বলল ওয়াং৷

    এরপর সে বলল, ‘দাদু বলেছে ডিমের ঝুড়ি না-পেলে আর বাড়ি ঢুকতে দেবে না৷ ঠিক আছে আমি আর বাড়ি ফিরব না৷ কালকের তাও-লির সাথে দেখা হয়েছে আমার৷ আমি ওর সাথে চলে যাব৷ পথে-পথে মার্শাল আর্ট দেখাব৷ দাদু আর আমাকে খুঁজে পাবে না৷’ এ-কথাগুলো বলে দীপাঞ্জনদের আর কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে বারান্দা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ওয়াং৷ তারপর ছুটতে-ছুটতে দীপাঞ্জনদের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল৷

    ওয়াং-এর মুখে তাও-লির নাম শুনে বেশ অবাক হয়ে গেল দীপাঞ্জনরা৷ জুয়ান বললেন, ‘তাও-কে তো পুলিশ খুঁজছে শুনলাম৷ ওয়াং কি জানে তাও কোথায়? ছেলেটা শেষে না বিপদে পড়ে!’

    দীপাঞ্জনরা আবার বাড়ির ভিতর ফিরল৷ নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঝাং৷ দীপাঞ্জনদের উদ্দেশে ঝাং বললেন, ‘ওয়াং কিছু স্বীকার করলো?’

    জুয়ান জবাব দিলেন, ‘সে বলল ঝুড়িটা সে নেয়নি৷ কাল রাতেও নাকি সে ঘরেই দেখেছে ঝুড়িটা৷ তারপর রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেল৷’

    ঝাং বললেন, ‘কোথায় যাবে আর? একটু পরই ভাত খেতে ফিরে এল বলে৷’ এ-কথা বলে চীনা ভাষায় ওয়াংকে সম্ভবত গালাগালি করতে-করতে দরজা বন্ধ করে দিলেন বৃদ্ধ৷ দীপাঞ্জনরা ঘরে ফিরে এল৷

    ঘরে ঢুকে বন্ধ জানলার পাল্লাটা খুলল দীপাঞ্জন৷ দুপুর রোদে শূন্য বাড়ির পিছনের চত্বরটা৷ বাইরে তাকিয়ে আবার সে সেই লোকটাকে দেখতে পেল৷ জুয়ানকে সে বলল, ‘ওই দেখুন মিউজিয়ামের গালকাটা সেই লোকটা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে৷’

    সত্যিই চত্বরের ওপাশে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেই লোকটা দীপাঞ্জনদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ জুয়ান জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে লোকটা হয়তো বুঝতে পারল যে দীপাঞ্জনরাও তাকে লক্ষ্য করছে৷ হয়তো সে জন্যই এরপর সে যে-বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিল, তার পাশেরগলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল৷

    জুয়ান বললেন, ‘এবার কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটা আমাদের অনুসরণ করছে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘কিন্তু আমাদের অনুসরণ করার তো কোনো কারণ নেই৷’

    জুয়ান বললেন, ‘ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না৷ তবে কেন জানিনা আমার মন বলছে যে আজ রাতে কোনও একটা ঘটনা ঘটতে পারে৷ আমাদের একটু সতর্ক থাকা প্রয়োজন৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আজ রাতেই তো ড্রাগনের তার ডিম ফেরত নিতে আসার কথা৷’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা কী তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে৷ রাত জাগতে হবে আমাদের৷ চলো এখন ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে নিই৷ রাত জাগতে অসুবিধা হবে না তবে৷’

    শুকনো খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিল তারা৷ তারপর ঘুমিয়ে পড়ল৷ ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে বেশ মজার একটা স্বপ্ন দেখল দীপাঞ্জন৷ এক বস্তা ডিম নিয়ে কলকাতার রাস্তায় সেগুলো বিক্রি করতে বেরিয়েছে সে আর জুয়ান৷ জুয়ান চিৎকার করে খদ্দের ডাকছেন, ‘ড্রাগনের ডিম৷ ড্রাগনের ডিম৷ মাত্র দশটাকা জোড়া৷ নিয়ে যান, নিয়ে যান৷ ড্রাগনের বাচ্চা এই ডিম ফুটে বেরোলো বলে৷ এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না৷’ অনেক লোক জড়ো হয়েছে চারপাশে৷ বেচাকেনা চলছে৷ হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন বৃদ্ধ ঝাং৷ তিনি জুয়ানকে বললেন, ‘ও তোমরাই তবে আমার ডিম চুরি করে এনেছ! আমার ডিম ফেরত দাও৷’

    জুয়ান বললেন, ‘আমরা তো চুরি করিনি৷ তাও লি আমাদের ডিমগুলো দিয়েছে৷’

    বুড়ো বললেন, ‘কোথায় সেই হতভাগা?’

    সঙ্গে-সঙ্গে তাও সেখানে এসে উপস্থিত৷ তাওকে দেখেই ঝাং তার লাঠিটা তলোয়ারের মতো বাগিয়ে ধরলেন৷ তাও লি তার তলোয়ার খুলে ফেলল৷ তারপর সে কী যুদ্ধ তাদের মধ্যে৷ মার্শাল আর্টের যুদ্ধ৷ নেচে-নেচে, লাফিয়ে লাফিয়ে, শূন্যে-শূন্যে উড়ে লড়াই৷ সবাই লড়াই দেখতে লাগল৷ কিন্তু হঠাৎ কে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘ডিম ফুটেছে৷ ড্রাগনের বাচ্চা বেরিয়েছে৷’

    দীপাঞ্জনরা দেখল সত্যি ডিমের ঝুড়ির ভিতর থেকে ড্রাগনের বাচ্চা বেরোচ্ছে৷ ড্যাবডেবেচোখে বাচ্চাটা চারপাশে তাকাচ্ছে৷ আর ঠিক এইসময় কোথা থেকে যেন উদয় হল ওয়াং৷ বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে সে ছুটতে শুরু করল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঝাং আর তাও-ও যুদ্ধ থামিয়ে, ‘আমার ড্রাগন, আমার ড্রাগন’ বলে ওয়াং-এর পিছু ধাওয়া করল৷ এ পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল দীপাঞ্জনের৷ জুয়ান আগেই উঠে বসেছেন৷ তিনি দীপাঞ্জনকে বললেন, ‘পাঁচটা বাজে৷ চলো বাইরে থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যাক!’

    বিছানা থেকে উঠে পড়ল দীপাঞ্জন৷

    ৷৷ ৮৷৷

    কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল তারা৷ ঝাং-এর ঘরের দরজা খোলা৷ কিন্তু ঘরের ভিতর তিনি বা ওয়াং নেই৷ তবে বারান্দাতে বেরিয়ে এসে তাকে দেখতে পেল দীপাঞ্জনরা৷ লাঠিতে ভর দিয়ে চিন্তান্বিত মুখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন ঝাং৷ দীপাঞ্জনদের দেখে তিনি বললেন, ‘ঘুরতে যাচ্ছেন?’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, আশপাশটা একটু ঘুরে আসি৷’

    ঝাং বললেন, ‘ভেবেছিলাম ওয়াং ফিরে আসবে৷ কিন্তু সে এলো না৷ তার ভাত পড়ে আছে৷ আর আমারও খাওয়া হয়নি তার জন্য৷ যদি রাস্তায় তাকে দেখেন তবে তাকে বলবেন যে সে যেন তাড়াতাড়ি তখনই বাড়ি ফিরে আসে৷ ওকে নিয়ে যে কী করব বুঝে পাই না৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আচ্ছা তাকে দেখলেই আমরা ধরে নিয়ে আসব৷’

    চিন্তান্বিত মুখে বারান্দাতে ওয়াং-এর ফেরার প্রতীক্ষাতে দাঁড়িয়ে রইলেন বৃদ্ধ৷ আর দীপাঞ্জনরা রাস্তায় নেমে পড়ল৷

    হাঁটতে-হাঁটতে জুয়ান বললেন, ‘এবারও বুঝলাম ওয়াংকে একটু মারধোর-শাসন করলেও তাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন ঝাং৷ নাতির জন্য এত বেলা পর্যন্ত না-খেয়ে বসে আছেন৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, ওয়াংকে দেখতে পেলে সত্যি তাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরত আনতে হবে৷ তাও লি যদি সত্যিই একজন অপরাধী হয়ে থাকে আর ওয়াং যদি তার পাল্লায় পড়ে থাকে তবে বিপদ হবে৷’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটাই চিন্তার ব্যাপার৷’

    চারপাশে তাকাতে-তাকাতে ধীর পায়ে দুজনে হাঁটতে লাগল৷ দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে এই ভুলে যাওয়া নগরীর মাথায়৷ চারদিক ফাঁকাও হয়ে গেছে৷ বিকেল পাঁচটাতে গেট বন্ধ হয়ে যায়৷ ট্যুরিস্টরা সব ফিরে গেছে৷ তাছাড়া এ-দিকটাতে ট্যুরিস্টরা তেমন একটা আসে না, তেমন কিছু দেখার নেই বলে৷ গতদিনের মতোই জুয়ানরা বিকালবেলা প্যালেস কমপ্লেক্সের দিকে না গিয়ে এগোলো অন্যদিকে৷ মাঝে-মাঝেই ছোট ছোট চত্বর৷ আর তাকে ঘিরে পুরোনো দিনের ঘর-বাড়ি-মন্দির৷ তার সামান্য কয়েকটাতেই লোকজন থাকে, বাকিগুলো শূন্য-পরিত্যক্ত৷ রাস্তার পাশে একটা চত্বরে ওয়াং-এর বয়সী একদল ছেলেকে ‘ন্যান-চা’ নিয়ে মার্শাল আর্ট প্র্যাকটিস করতে দেখে জুয়ান এগিয়ে গেলেন তাদের দিকে৷ একজনকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা ওয়াংকে দেখেছ? ওই যে সেরামিকের খেলনা বিক্রি করে৷’

    জুয়ানের কথা শুনে একটা ছেলে বলল, ‘ও সেই খ্যাপা ওয়াং৷ বুড়ো ঝাং-এর নাতি? না, সে আমাদের সাথে খেলে না৷ আমরা তাকে দেখিনি৷’

    জবাব পেয়ে আবার হাঁটতে লাগলেন তারা৷ জুয়ান বললেন, ‘ওয়াং-এর মধ্যে বয়সের তুলনায় একটু বেশি শিশুসুলভ আচরণ থাকার জন্যই মনে হয় ওর সমবয়সীরা ওকে ‘খ্যাপা ওয়াং’ বলে৷’

    দীপাঞ্জন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ঠিক৷ নইলে ডিম ফুটে ড্রাগনের ছানা বেরোবে, ড্রাগন ডিম নিতে আসবে—এ গল্পও বিশ্বাস করতো না৷’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, এ-ধরনের সরল ছেলেদেরই তো ভুলিয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া সহজ৷ সত্যিই, ইতিমধ্যে তাও ওকে কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে?’

    হাঁটতে থাকেন তারা৷ সূর্য ডুবে যাচ্ছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটা চত্বরে পৌঁছে গেল তারা৷ এ-জায়গাটা সেই ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের বেশ কাছাকাছি৷ একসার বাড়ির পিছন থেকে তার চুড়োটা দেখা যাচ্ছে৷

    জুয়ান বললেন, ‘চলো ও-দিকটাতে আর একবার ঘুরে আসি৷’

    কিছুটা এগোবার পরই আবারও তারা দেখতে পেল মিস্টার শাওকে৷ ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের দিক থেকেই আসছিলেন তিনি৷ দীপাঞ্জনদের মুখোমুখি হয়ে গেলেন তিনি৷ জুয়ান তার উদ্দেশে বললেন, ‘আপনার সাথে আবারও দেখা হয়ে গেল আমাদের৷ ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ফিরে গেছেন৷’

    শাও বললেন, ‘হ্যাঁ, তেমনই ইচ্ছা ছিলো৷ কিন্তু হঠাৎই ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের ওদিকে আরও একটা মন্দিরে কিছু দুষ্প্রাপ্য ড্রাগনের মূর্তির সন্ধান পেলাম, তাই সিদ্ধান্ত বাতিল করলাম৷ মনের মধ্যে যে ভয় নেই তা নয়৷ তবু রয়ে গেলাম৷ ও জায়গা থেকেই এখন ফিরছি ছবি তুলে৷ এই বলে তিনি তার পকেট থেকে একটা আধুনিক ডিজিটাল ছোট ক্যামেরা বার করে দেখালেন৷

    শাও এরপর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা তো আজ রাতেও ওই বুড়ো সেরামিক বিক্রেতার বাড়ি থাকছেন?’

    দীপাঞ্জন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আজ এবং কাল দুটো দিনই৷’

    শাও বললেন, ‘আমিও আপনাদের কথাই ভাবছিলাম৷ যদি দেখা হয় আপনাদের সাথে তবে খবরটা আপনাদের জানাতে পারি ভেবে৷’

    জুয়ান বললেন , ‘কী খবর?’

    শাও বললেন, ‘সরকারি অতিথিনিবাসে আমার পাশের ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ আপনারা যে-বাড়িতে আছেন সেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই নিশ্চয়ই৷ ওখানে আলো, ফ্যান, টেলিভিশন সব বন্দোবস্ত আছে৷ আমি কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলেছি৷ আমার সহকর্মী পরিচয়ে আপনারা সেখানে থাকতে পারেন৷ আর তার জন্য বেশি ভাড়াও গুনতে হবে না আপনাদের৷’

    মিস্টার শাও-এর প্রস্তাবটা লোভনীয় সন্দেহ নেই৷ কথাটা শুনে দীপাঞ্জন তাকাল জুয়ানের দিকে৷ একটু ভেবে নিয়ে জুয়ান, মিস্টার শাওকে বললেন, ‘আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ৷ তবে এখন আর সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে না৷ তাছাড়া বাড়ির মালিক ঝাং জানেন যে আমরা আজ রাতে তার বাড়িতেই থাকব৷ আজকের রাতটা আমরা ওর ওখানেই থাকি, তেমন হলে কালকের রাতটা না-হয় আপনার ওখানে গিয়ে থাকা যাবে৷’

    জুয়ানের জবাব শুনে চুপ করে গেলেন মিস্টার শাও৷

    দীপাঞ্জন এরপর মিস্টার ঝাংকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এদিকে দশ-বারো বছর বয়সী কোনও ছেলেকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন?’

    ‘কেন বলুন তো?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন মিস্টার শাও৷

    জুয়ান বললেন, ‘আমরা যে সেরামিক বিক্রেতার বাড়িতে আছি, ছেলেটা সেই বৃদ্ধের নাতি৷ দাদুর সাথে ঝগড়া করে না-খেয়ে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়েছে৷ বাড়ি ফেরেনি৷ এদিকে নাতির জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে৷’

    কথাটা শুনে মুহূর্তখানেক ঠোঁট কামড়ে চুপ করে যেন ভাবার চেষ্টা করলেন শাও৷ তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷ একটু আগেই তেমন একটা ছেলেকেই দেখলাম. ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের কাছেই একটা ব্ল্যাক প্যাগোডা কালো রঙের পরিত্যক্ত মন্দির আছে৷ আমার সামনে দিয়েই তো বাচ্চাটা সেই মন্দিরে ঢুকল৷’

    জুয়ান বললেন, ‘চলো তো দেখি সেখানে ওয়াংকে পাওয়া যায় কিনা?’

    মিস্টার শাও বললেন, ‘চলুন আমিও যাচ্ছি আপনাদের সাথে, প্যাগোডাটা দেখিয়ে দিচ্ছি৷’

    দীপাঞ্জনরা হাঁটতে শুরু করল মিস্টার শাও-এর সাথে৷ প্রথমে সেই ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের কাছে পৌঁছল তারা৷ তারপর তাকে বাঁ পাশে রেখে এগোলো কিছুটা দূরে একলা দাঁড়িয়ে থাকা কালো রঙের একটা প্যাগোডার দিকে৷ এ জায়গাটা জনশূন্য৷ সূর্য ডুবে গেছে৷ আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপত্যের ভিতর জমাট বাঁধতে শুরু করেছে অন্ধকার৷ বাড়িটার সামনে এসে মিস্টার শাও বললেন, ‘চলুন দেখা যাক ছেলেটা ভেতরে আছে কিনা? সাপখোপের ভয় ছাড়া এখানে অন্য কোনও ভয় নেই৷’

    এই বলে তিনি প্রথমে প্রবেশ করলেন তোরণের ভিতর৷ মিস্টার শাও-এর পিছনে প্রফেসর জুয়ান আর সবার শেষে দীপাঞ্জন৷ দীপাঞ্জন হঠাৎই ভিতরে ঢোকার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল৷ আর তখনই আবার সে দেখতে পেল সেই গালকাটা লোকটাকে৷ ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ লোকটা যে সত্যিই তাদের অনুসরণ করছে তা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল দীপাঞ্জন৷ কিন্তু মিস্টার শাওয়ের সামনে জুয়ানকে কথাটা এখনই জানানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে না-পেরে তাদের পিছন-পিছন প্যাগোডাতে ঢুকে পড়ল দীপাঞ্জন৷ সামনে একটা লম্বা বারান্দা৷ সেটা সোজা গিয়ে মিশেছে প্রার্থনা-কক্ষে৷ পুরু ধুলোর রাশি ছড়িয়ে আছে মাটিতে৷ তারা এগোল সেই প্রার্থনা-কক্ষের দিকে৷ প্রার্থনা-কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা৷ বিশাল ঘরটার মধ্যে আধো অন্ধকার খেলা করছে৷ মূর্তি ইত্যাদি কিছু জিনিসপত্রও আছে মনে হয়৷ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে একবার হেঁচে রুমালে নিজের মুখ-চাপা দিয়ে মিস্টার শাও বললেন, ‘আমার আবার ডাস্ট এলার্জি শুরু হল৷ এই ধুলো ভর্তি ঘরে আমি ঢুকব না৷ আপনারা ঢুকে দেখুন ছেলেটা কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা! আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি৷’

    প্রার্থনা-কক্ষের ভিতর প্রবেশ করল দীপাঞ্জন আর জুয়ান৷ ধুলো-ভর্তি ঘর৷ ভাঙা মূর্তি-সহ নানা জঞ্জাল পড়ে আছে নানা জায়গাতে৷ ছাদের থেকেও একটা অংশ খসে পড়েছে মেঝেতে৷ আবছা আকাশ দেখা যাচ্ছে৷ এ ঘরে কোনও জানলা নেই৷ ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল দুজন৷ তারা দেখার চেষ্টা করল ওয়াং কোথাও আছে নাকি? জুয়ান হাঁক দিল, ‘ওয়াং তুমি কোথাও আছো?’

    ওয়াং-এর কোনও উত্তর এলো না৷ তবে অন্য একটা শব্দ হলো৷ ঘরের অন্ধকারটা হঠাৎই যেন গাঢ় হয়ে গেল৷ দীপাঞ্জনরা দেখতে পেল মিস্টার শাও বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ দীপাঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতে-দিতে বলল, ‘মিস্টার শাও দরজা বন্ধ করলেন কেন? দরজা খুলুন, দরজা খুলুন৷’

    কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাবার পরও দরজা খুলল না, আর শাওয়ের সাক্ষাৎ মিলল না৷

    দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, ‘এখানে ঢোকার সময় সেই গালকাটা লোকটাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷ মনে হচ্ছে সে আসলে শাওয়ের সঙ্গী৷ আমাদের ওপর শাওই তাকে দিয়ে নজরদারী করাচ্ছিলেন৷ কিন্তু শাও আমাদের এভাবে আটকে দিলেন কেন?’

    জুয়ান বললেন, ‘আমার ধারণা আমরা আজকে রাতে ঝাংয়ের বাড়িতে থাকি, তা তিনি চান না৷ সে জন্যই এখানে আটকে দিলেন৷ আর একই কারণে তিনি আমাদের অতিথি নিবাসে পাঠাবার চেষ্টা করছিলেন৷ তবে এর পিছনে কি উদ্দেশ্য তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না!’

    দীপাঞ্জন চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগল বাইরে বেরোবার আর কোনও উপায় আছে কিনা৷ অন্য কোনও দরজা-জানলা নেই ঘরে৷ প্রাচীন হলেও দেওয়ালের কাঠ খুব পুরু৷ মাথার ওপরের ছাদে মানুষ গলবার মতো ছিদ্র আছে বটে, কিন্তু তা অনেক ওপরে৷ দেওয়াল বেয়ে সেখানে পৌঁছবার উপায় নেই৷ ক্রমশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যেতে লাগল ঘরটা৷

    ৷৷ ৯৷৷

    ঘণ্টাখানেক পর আবার দীপাঞ্জনদের চারপাশে অন্ধকার কাটতে শুরু করল৷ চাঁদ উঠতে শুরু করেছে বাইরে৷ মাথার ওপরের ছাদের বড় ফোকরটা দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরে৷ রাত আটটা নাগাদ প্রায় পরিস্কার আলোতে ভরে গেল ঘরটা৷ ফোকর দিয়ে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে৷ যেন ঘরটাতে আলো দেবার জন্যই ঘরের ঠিক মাথার ওপরেই উঠেছে চাঁদটা৷ বিরাট বড় পূর্ণিমার চাঁদ৷

    সেদিকে তাকিয়ে জুয়ান বললেন, ‘যাক আলোটা অন্তত পাওয়া গেল৷ দিনের আলো ফুটলে ঠান্ডা মাথায় এ-ঘর থেকে বেরোবার উপায় ভাবতে হবে৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, ওদিকে বাইরে কী ঘটছে কে জানে? আজ তো ঝাং-এর কাছে ড্রাগনের ডিম ফিরিয়ে নিতে আসার কথা৷ ওয়াং-ও বাড়ি ফিরল কিনা কে জানে?’

    জুয়ান বলল, ‘আমার ধারণা ওই ড্রাগনের ডিমের সাথেই সব ঘটনা যুক্ত৷’

    এরপর আর কোনও কথা না-বলে চুপচাপ বসে রইল তারা দুজন৷ বাইরে রাত বেড়ে চলল, ন’টা-দশটা-এগারোটা বারোটা…

    তখন রাত প্রায় দেড়টা হবে৷ চোখে একটু ঝিমুনি লেগে গেছিল দীপাঞ্জনদের৷ জুয়ানের খোঁচা খেয়ে দীপাঞ্জন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ওপর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মাথার ওপরের সেই ফোকর দিয়ে উঁকি মারছে একটা মুখ৷

    তাকে চিনতে পারল দীপাঞ্জনরা৷ এ যে ওয়াং৷

    প্রফেসর জুয়ান তার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দরজা খুলে দাও ওয়াং৷ আমাদের এখানে আটকে রাখা হয়েছে৷’ কিন্তু পরক্ষণেই কোনও জবাব না-দিয়ে ফোকরের মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওয়াং৷

    আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার বাইরে একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল৷ তবে কি ওয়াং দরজা খুলতে এল? দীপাঞ্জনও এবার উঠে দাঁড়াল৷

    দরজা খুলে গেল ঠিকই৷ কিন্তু যে দরজা খুলল সে ওয়াং নয়, মিস্টার শাও৷ ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি৷

    তাকে দেখে জুয়ান ত্রুুদ্ধভাবে বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি আমাদের আটকে রেখে গেছিলেন কেন?’

    শাও জবাব দিলেন, ‘আমি চাইনি আপনারা ঝাং-এর বাড়িতে রাত্রিবাস করুন৷ তাই ভেবেছিলাম এখানে আর আসব না, আপনাদের সাথে আর দেখা হবে না আমার৷ কিন্তু আসতেই হল৷ আপনাদের আটকে না-রাখলে ভুল করতাম৷ আপনারা যে ঝাং-এর থেকে জিনিসটা হাতিয়ে ফেলেছেন তা বুঝতে পারিনি৷

    দীপাঞ্জন বলে উঠল, ‘কী বাজে কথা বলছেন আপনি? আপনার ইচ্ছা হলে আপনি আটকে রাখবেন আমাদের? আমরা কোনও জিনিস হাতাইনি৷’

    শাও বললেন, ‘নিশ্চয়ই হাতিয়েছেন৷ ঝাং-এর ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমি সেটা পাইনি৷ এবার ড্রাগনের ডিমটা দিন৷ কাছে না-থাকলে কোথায় সেটা লুকিয়ে রেখেছেন বলুন? আপনাদের ঘরেও যে সেটা নেই তা আমি খুঁজে দেখে এলাম৷’

    জুয়ান বললেন, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? ডিম আমরা নিইনি৷ আমরা এবার বেরোবো৷ পাগলামি ছাড়ুন৷’

    শাও বলে উঠলেন, ‘ওই ডিমের খোঁজ না-দিলে কোনো দিন আর এ-ঘরের বাইরে বেরোতে পারবেন না৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘দেখি কীভাবে আটকান? এখান থেকে বেরিয়ে আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাব আপনার নামে৷’

    এই বলে দীপাঞ্জন এগোতে যাচ্ছিল, কিন্তু শাও তার ডানহাতটা দীপাঞ্জনের দিকে তুলে ধরলেন৷ চাঁদের আলোতে দেখা গেল ঝিলিক দিচ্ছে একটা রিভলবার৷ থেমে গেল দীপাঞ্জন৷

    শাও বললেন, ‘এক পা এগোলে মাথার খুলি ফুটো করে দেব৷ আমার হাতে বেশি সময় নেই, ডিমটা কোথায়? পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে জুয়ান একটু নরম স্বরে বললেন, ‘আপনি কিন্তু সত্যিই ভুল ভাবছেন মিস্টার শাও৷ ও ডিম আমাদের কাছে নেই৷’

    শাও, দাঁত কিড়মিড় করে বললেন বিশ্বাস করি না৷ হয় তোমরাও আমার মতো ডিমের সন্ধানে এসেছিলে অথবা মিউজিয়ামের ছবিটা দেখার পর ডিমটা হাতিয়েছ৷ বেশি চালাক সাজার জন্য তোমরা ওই ডিমের কথা বারবার বলছিলে৷’

    দীপাঞ্জনরা মিস্টার শাওয়ের কথার কী জবাব দেবে তা বুঝতে না-পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷

    মিস্টার শাও বললেন, ‘নিন, বলে ফেলুন৷ আমার হাতে নষ্ট করার মতো সময় নেই৷’

    জুয়ান বললেন, ‘এমনও তো হতে পারে, জিনিসটা অন্য কেউ সরিয়েছে?’

    শাও বললেন, ‘যে সেটা নেবার জন্য এসেছিল সে এখন খুনের দায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে৷ তাছাড়া আজ সকাল থেকে সারাদিন বাড়িটার ওপর নজর ছিল আমার৷ সে সেখানে যায়নি৷’

    এ-কথা বলেই মিস্টার শাও হিংস্রভাবে বললেন, ‘আর সময় নষ্ট করা যাবে না৷ আমি পাঁচ গুনব৷ তারপর গুলি চালাব৷ মানুষ মারতে আমার হাত কাঁপে না৷ কাল রাতেই একজনকে তলোয়ারের কোপে দু-টুকরো করেছি৷’

    কথাটা শুনে চমকে উঠল দীপাঞ্জনরা৷ শাও রিভলবার তাক করে গুনতে শুরু করলেন, ‘এক-দুই-তিন… ৷’ ঠিক এই মুহূর্তেই ঘরটা যেন এক নিমেষের জন্য আবছা হয়ে গেল৷ কারো শরীরের আড়ালে যেন ঢেকে গেল চাঁদটা৷ আর তারপরই আকাশ থেকে উড়ে নেমে এসে শাও আর দীপাঞ্জনদের মাঝে এসে দাঁড়ালো কালো পোশাক-পরা একজন৷ তবে তার মুখের ঢাকনা খোলা থাকায় তাকে চিনতে পারল সবাই৷ লোকটা হল তাও-লি৷ তার হাতে একটা ন্যান-চা৷ পোশাকের ভিতর পেটের কাছটা খুব ফোলা৷ ছোটোখাটো কোনও একটা জিনিস রাখা৷

    তাকে দেখে মিস্টার শাও বলে উঠলেন, ‘তুমি পালাওনি এখনও৷ তোমাকে যে খুনের দায়ে পুলিশ ধরবে?’

    তাও-লি বলল, ‘সে দেখা যাবে৷ তোমাকে কাল বিকালে খেলা দেখাবার সময় আমি চিনতে পেরেছিলাম হুয়ান৷ সেজন্যই আমার মনসংযোগ নষ্ট হয়, তলোয়ারের আঘাত লেগে হাত চিরে যায়৷ আমি ঠিকই ভেবেছিলাম যে তুমি ঘুমন্ত লোকটাকে খুন করেছ আর এই নিরীহ লোকদুজনকেও মারতে যাচ্ছিলে৷ ডিমের ঝুড়ি ওদের কাছে নয়, আমার কাছে৷’ এই বলে সে হাত দিয়ে তার ফোলা পেটটা দেখাল৷’

    তাও-লি-র কথা শুনে শাও ওরফে হুয়ান নামের লোকটা বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হল৷ দাও ওটা দিয়ে দাও৷ সময় নষ্ট করো না৷’

    তাও-লি বলে উঠল, ‘তোমার সময় এবার সত্যি শেষ হয়ে এসেছে৷ কথাটা বলেই সে হুয়ানকে সম্ভবত আক্রমণ করার জন্য বিদ্যুৎগতিতে ন্যান-চা ঘোরাতে শুরু করল৷

    হুয়ান চিৎকার করে উঠল, ‘জিনিসটা তুমি দেবে না৷ দেখাচ্ছি মজা৷’ এই বলে সে রিভলবার তাক করল তাও লি-র দিকে৷ তারপর গুলি চালিয়ে দিল৷

    কিন্তু সে গুলি তাও লি-র শরীর স্পর্শ করল না৷ ফ্যানের ব্লেডের মতো ঘুরতে থাকা ন্যান-চা তে গুলিটা আঘাত পেয়ে অন্যদিকে ছিটকে পড়ল৷ পাকা মার্শাল আর্ট খেলুড়েরা ন্যান-চা ঘুরিয়ে গুলি আটকে দিতে পারে এ কথাটা কোথায় যেন পড়েছিল দীপাঞ্জন৷ এবার সে চাক্ষুষ করল ব্যাপারটা৷

    ন্যান-চা ঘুরিয়ে হুয়ানের চারপাশে পাক খেতে শুরু করল তাও লি৷ হুয়ানও পিস্তল বাগিয়ে চারদিকে ঘুরে চলেছে দ্বিতীয়বার গুলি চালাবার জন্য৷ কিন্তু ঠিক সেই সময় কোথা থেকে উদয় হল ওয়াং৷ আর তাকে দেখতে পেয়েই হুয়ান এক লাফে তার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে পাকড়ে ধরে মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলল, ‘কেউ কিছু করার চেষ্টা করলে বাচ্চাটাকে গুলি করে মারব৷ ন্যান-চা ফেলে দাও৷’

    ন্যান-চা ঘোরানো থেমে গেল তাও লি-র৷ তারপর সে ন্যান-চা ফেলে দিল হাত থেকে৷

    হুয়ান নামের লোকটার ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসি৷ সে তাও লিকে বলল, ‘ডিমের ঝুড়িটা বার করে মেঝেতে নামিয়ে রাখ৷ তারপর সবাই হাত মাথার ওপরে তুলে ঘরের শেষ প্রান্তে দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও৷’

    তাও লি এ-নির্দেশ পালন করার আগে একটু ইতস্তত করতেই হুয়ান তার রিভলবারের নলটা ওয়াং-এর হাঁ-করা মুখের মধ্যে গুঁজে দিল৷ হিংস্র চাহনি লোকটার চোখে৷ যেন এখনই গুলি চালিয়ে বাচ্চাটাকে শেষ করে ফেলবে সে৷ অগত্যা তাও লি তার পোশাকের ভিতর থেকে ঝুড়িটাকে বার করে আনল৷ ঢাকনাওয়ালা ছোট্ট একটা বেতের ঝুড়ি৷ সে সেটাকে মাটিতে নামিয়ে দু’হাত মাথার ওপর তুলে দেওয়ালের দিকে পিছু হটতে লাগল৷ একই কাজ করল দীপাঞ্জনরাও৷ দু-হাত তুলে তারা সার বেঁধে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল৷

    বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে ঝুড়ির দিকে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগল হুয়ান৷ ঝুড়িটার সামনে এসে ওয়াংকে এক ধাক্কা দিয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল৷ তারপর তার রিভলবার দীপাঞ্জনদের দিকে তাক করে হুয়ান হাঁটু মুড়ে বসল ঝুড়িটার সামনে৷ বাঁ-হাত দিয়ে সে ঝুড়ির ঢাকনাটা খুলে ফেলল ডিমটাকে নেবার জন্য৷

    ঝুড়ির ভিতর তার বাম হাতটা ঢোকালো হুয়ান৷ আর এর দু-এক মুহূর্তের মধ্যেই হুয়ানের মুখটা যেন আকস্মিক কোনও যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল৷ ঝুড়ি থেকে হাতটা বার করে আনল হুয়ান, হাতটা একটু উঁচু করে চোখের সামনে মেলে ধরল৷ বিস্ফারিত হুয়ানের চোখ৷ চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হুয়ান তারপর হাতটা ঝাড়া দিতে লাগল কোনও ভয়ঙ্কর আতঙ্কে৷ এরপর হঠাৎই যেন সে স্থির হয়ে যেতে লাগল৷ হাত দুটো শিথিল হয়ে গেল৷ রিভলবারটা মাটিতে খসে পড়ে শব্দ তুলে একটা গুলি ছিটকে বেরিয়ে গেল৷ কয়েকবার দুলে উঠল লোকটা৷ তারপর দড়াম করে ছিটকে পড়ল মাটিতে৷ তার দেহের ধাক্কায় ঝুড়িটা গড়িয়ে গেল কয়েক হাত৷ প্রথমে ব্যাপারটা বোধগম্য হল না কারোরই৷ এটা লোকটার কোনও চালাকি নয় তো৷ হুয়ান আর নড়ছে না দেখে তাও লি হঠাৎই মার্শাল আর্টের ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা তাক করল মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা হুয়ানের দিকে৷ দীপাঞ্জন আর জুয়ানও ছুটে এসে তার পাশে দাঁড়ালো৷ মাটিতে পড়ে আছে হুয়ান৷ বিস্ফারিত চোখ, ঠোঁটের কোণ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে৷ আর এরপরই তারা দেখল লোকটার বাঁ হাতের তালুতে কালো ফিতের মতো ইঞ্চি তিনেক লম্বা কী যেন একটা নড়ছে৷ দীপাঞ্জনরা এরপর তাকাল ঝুড়িটার দিকে৷ সেটা উল্টে তার ভিতর থেকে ডিমের ভাঙা খোলস বেরিয়ে পড়েছে৷ ডিম ফুটেছে ঠিকই, তবে তার ভিতর থেকে ড্রাগনের বাচ্চা নয়, বেরিয়েছে সাপের বাচ্চা৷ যে কামড়ে ধরে আছে হুয়ান নামের লোকটার হাত৷

    ৷৷ ১০৷৷

    ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাও লি বলে উঠল, ‘কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার৷ কাল মাঝরাত থেকে তো ঝুড়িটা পেটের মধ্যে নিয়ে ঘুরছিলাম৷ ভাগ্যিস ডিমটা ভিতরে আছে দেখে নিয়ে ঝুড়িটা আর খুলিনি৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘তুমি ঝুড়িটা পেলে কী ভাবে? ওয়াং দিয়েছিল?’

    মাটিতে পড়ে-থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে তাও লি বলল, ‘এ লোকটা হল একজন দাগী অপরাধী৷ সাংহাইতে মাদক আর চোরাই প্রত্নবস্তুর ব্যাবসা চালায়৷ ওকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ও আমার পিছু ধাওয়া করে এখানে হাজির হয়েছে৷ সাংহাইতে আমার একটা ছোট কিউরিও-শপ আছে৷ সেখানেই আমার সাথে ওর পরিচয়৷ আমি তখনও ওর আসল পরিচয় জানতাম না৷ অসতর্ক মুহূর্তে আমি একবার ডিমের গল্পটা ওর কাছে করে ফেলেছিলাম৷ ঝাং-এর কাছ থেকে চিনা ক্যালেন্ডারের ড্রাগন পূর্ণিমার দিন আমার ডিমটা ফেরত নেবার কথা ছিল৷ কিন্তু হুয়ানকে দেখতে পেয়েই বুঝতে পারলাম পূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না৷ ধোঁকা দিতে হবে হুয়ানকে৷ তাই নিজেই নিজের প্রাপ্য জিনিস চুরি করার জন্য গতরাতে হানা দিলাম, আপনাদের ওখানে ঝাং-এর ঘরের দরজা খোলাই ছিল৷ ঘুমাচ্ছিল সে৷ ডিমের ঝুড়িটা খুঁজতে যাচ্ছি এমন সময় ওয়াং ফিরে এল৷ আমি খাটের তলায় লুকিয়ে পড়লাম৷ চাঁদের আলো ঢুকেছিল ঘরে৷ দেখলাম ওয়াং এসে তাকে রাখা ঝুড়িটা নিয়ে কী যেন করল৷ তারপর সে বিছানাতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই আমি ঝুড়িটা নিয়ে তার ভিতর ডিম আছে দেখে সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম…৷

    জুয়ান বললেন, ‘তার মানে কালো পোশাক-পরা আমরা যাকে আমাদের ঘরের ভিতর থেকে বাইরে দেখেছিলাম সে হলে তুমি৷ আমার কেমন যেন একবার সন্দেহ হয়েছিল৷ মার্শাল আর্ট জানা না-থাকলে ও ভাবে কেউ লাফাতে পারে না৷’

    তাও লি বলল, ‘তাই হবে৷’

    দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘তারপর?’

    তাও লি বলল, ‘আমি সোজা ফিরে গেলাম আমার আস্তানাতে৷ সেখানে ফিরে দেখি ভয়ঙ্কর কান্ড৷ খুন হয়ে গেছে বাড়ির মালিক৷ কী কুক্ষণেই যে আমার পোশাক গায়ে দিয়ে সে ঘুমাতে গিয়েছিল৷ আমি বুঝতে পারলাম হুয়ানই খুনটা করেছে আমাকে মেরে ফেলে ডিমটা নিয়ে পালাবার জন্য৷ কিন্তু খুনটা দেখেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ ভাবলাম আমাকে লুকোতে হবে৷ আর সুযোগ বুঝে এই নিষিদ্ধ নগরী ছেড়ে পালাতে হবে৷ তাই ডিমের ঝুড়ি নিয়ে আমি এসে লুকিয়ে পড়লাম ড্রাগন কিং-এর মন্দিরের একটা ঘরে৷ সেখানেই আজ সকালে ওয়াং-এর সাথে দ্বিতীয়বার দেখা আমার৷ সে অবশ্য এখনও জানত না যে ঝুড়িটা আমার কাছে আছে৷ তারপর দুপুরে সে আবার এলো৷ আমরা বাড়ির ভিতর থেকে দেখলাম, হুয়ানের সাথে আপনারা এ-বাড়িতে ঢুকছেন৷ তখন কিন্তু আমার এও সন্দেহ হয়েছিল যে আপনারা হুয়ানের লোকও হতে পারেন৷ রাতে তাই চালে উঠে দেখতে গেছিলাম ভিতরে আপনারা কী করছেন? আর তারপর…৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘এই হুয়ানের সাথে আর একজন লোক ছিল৷ গালে কাটা দাগ৷ এ বাড়িতে ঢোকার সময়েও আমি তাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷

    দরজার কাছ থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আমিই সেই লোক৷’

    দীপাঞ্জনরা কন্ঠস্বর শুনে তাকাল দরজার দিকে৷ ঘরে প্রবেশ করল গালে কাটা দাগওয়ালা সেই লোকটা৷ তখন পুরোদস্তুর পুলিশের ইউনিফর্ম তার পরনে৷ সঙ্গে আরও কয়েকজন পুলিশকর্মী, ও সব শেষে একজন পুলিশকর্মীর কাঁধে ভর দিয়ে লাঠি হাতে বৃদ্ধ ঝাং৷ তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা৷ ওয়াং ঝাংকে দেখতে পেয়েই একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে৷

    গালে কাটা দাগ লোকটা বললেন, ‘আমার নাম অফিসার ফোডোং৷ হুয়ানের ঝুড়িতে হাত ঢোকানো থেকে আপনাদের কথোপকথন আমি এতক্ষণ ধরে দরজার আড়াল থেকে শুনেছি৷ মিস্টার তাও, আপনি যদি আজ সকালে বা কাল রাতে খুনটা দেখার পর পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতেন তাহলে ব্যাপারটা এত কঠিন হত না৷ আপনারাও বিপদে পড়তেন না, আর বৃদ্ধ ঝাংকেও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে হত না৷ ঝাং-এর বাড়ি ডিমটার জন্য হানা দিয়েছিল হুয়ান৷ ডিম না-পেয়ে গুলি চালিয়েছিল৷ মাথার চামড়া ঘেঁষে গুলিটা বেরিয়ে গেছে৷ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলেন ঝাং৷ হুয়ান ভেবেছিল যে মরে গেছে৷ আমরা গিয়ে ঝাং-এর জ্ঞান ফেরাই৷ কাজটা করে এখানে চলে এসেছিল সে৷ কথাগুলো বলে অফিসার ফোডোং এগিয়ে গেলেন হুয়ানের দেহের দিকে৷ ততক্ষণে মরে কাঠ হয়ে গেছে হুয়ান৷ সাপের বাচ্চাটা তখনও কামড়ে ধরে আছে তার হাত৷ সেদিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘কী ভয়ঙ্কর বিষ এই ছোট্ট সাপটার, একটা মানুষকে মেরে ফেলল৷’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না ড্রাগনের ডিম সাপের ডিমে বদলে গেল কীভাবে?’

    তাও লি বলল, ‘আমি কিন্তু ঝুড়িটা ঝাং-এর ঘর থেকে নেবার পর একবারও খুলিনি৷ কারো কাছে রাখতেও দিইনি৷’

    কথাটা শুনে বৃদ্ধ ঝাং বলে উঠলেন, ‘তুমিই তবে ডিমটা সরিয়েছিলে? কে তুমি?’

    কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে ঝাং-এর দিকে তাকিয়ে রইল তাও লি৷ তারপর সে একটানে তার জামাটা খুলে ফেলল৷ মাথার ওপর থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক তাও লি-র শরীরের ওপর৷ তার গায়ের সেই বিরাট ড্রাগনের উল্কির ওপর৷ শরীরটাকে মোচড় দিয়ে উল্কিটা ভালো করে দেখাল তাও লি৷ আর সেটা দেখেই বৃদ্ধ ঝাং ধীরে-ধীরে বসে পড়ে মাথা ঝোঁকাল৷ তার গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল—ড্রাগন৷

    তাও লি বলল, ‘হ্যাঁ ড্রাগন৷ মিং সম্রাটের শেষ বংশধর তাও লি মিং৷ এই উল্কি চিহ্ন দেখিয়েই তো ড্রাগনের ডিমটা আজ রাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আমার৷ যে ডিম বংশ-পরম্পরায় তোমরা রেখেছিলে তোমাদের কাছে৷’

    ঝাং বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার পূর্বপুরুষদের মতো আমিও প্রতি ড্রাগন-পূর্ণিমাতে অপেক্ষা করে থেকেছি কবে আপনারা আপনাদের ডিম ফিরিয়ে নেবেন বলে৷’

    দীপাঞ্জন বুঝতে পারল, ঝাং যে তার নাতিকে ‘ড্রাগন’ আসবে বলেছিল সেটা মিথ্যা নয়৷ মিং রাজবংশের লোকদের ‘ড্রাগন’ নামেই সম্বোধন করা হত৷ পুলিশ অফিসার ফোডোং-ও এবার তার মাথার টুপিটা খুলে ফেললেন মিং রাজবংশের শেষ প্রতিনিধিকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য৷

    বৃদ্ধ ঝাং এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও-ডিম আমার কাছে নেই৷ ডিমটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না৷ এর জন্য আপনি যা শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নেব৷ শুধু আমার নাতির যেন কোনও অভিশাপ না-লাগে৷’ কান্নায় যেন ভিজে এল বৃদ্ধ ঝাং-এর গলা৷

    পুলিশ অফিসার ফোডোং বললেন, ‘কিন্তু জিনিসটা গেল কোথায়? সেটা তো খোঁজা দরকার৷’

    সবাইকে চমকে দিয়ে ওয়াং এবার বলল, ‘ওটা কোথায় আছে আমি জানি৷ ড্রাগন কিং-এর মন্দিরে যে ঘরে সাপ ডিম নিয়ে বসে আছে সেই ডিমের মধ্যে৷ দাদু বলেছিল ড্রাগন আসবে ডিম নিতে৷ দাদু তাকে ডিমটা দিয়ে দেবে৷ তাই গতকাল রাতে দাদু আফিম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি ঝুড়ি থেকে ডিম নিয়ে ওখানে যাই৷ তারপর ডিমটা সাপের ডিমের মধ্যে রেখে সাপের একটা ডিম নিয়ে ফিরে এসে সেটা রেখে দিয়েছিলাম ঝুড়িতে৷’

    কথাটা শুনে দীপাঞ্জন বলে উঠল, ‘এমন ভয়ঙ্কর কাজ তুমি করলে কীভাবে?’

    ওয়াং বলল, ‘সঙ্গে ইঁদুর নিয়ে গেছিলাম যে৷ সাপটা অনেক দিন খায়নি৷ ঘরের কোণে দড়ি বেঁধে ইঁদুর ছাড়তেই সে ডিম ছেড়ে ইঁদুর খেতে গেল৷ আর আমিও ডিম পাল্টে নিলাম৷’

    তার সাহসের কথা শুনে তাও লি মিং এগিয়ে এসে তার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘সত্যিই তুমি মার্শাল আর্ট শেখার উপযুক্ত৷ আমি শেখাব তোমাকে৷’

    পুলিশ অফিসার ফোডোং বললেন, ‘চলুন এবার এখান থেকে ফেরা যাক৷ ডিমটা উদ্ধারের যা ব্যবস্থা করার আমি করছি৷ ভোরের আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷’

    ৷৷ ১১৷৷

    সকাল হয়েছে৷ বৃদ্ধ ঝাং-এর ঘরে বসেছিলেন সবাই৷ তাও লি মিং পুলিশ অফিসার ফোডোং, ঝাং, ওয়াং, দীপাঞ্জন, জুয়ান সবাই৷ ব্ল্যাক প্যাগোডা থেকে তারা সবাই এখানেই ফিরে এসেছে৷ অফিসার ফোডোং তার কর্মীদের পাঠিয়েছেন ড্রাগনের ডিমটা উদ্ধার করে আনার জন্য৷ তাও লি মিং গল্প করছিলেন কীভাবে তাদের মিং বংশের পতন হয়েছিল৷ পালাবার সময় তার পূর্বপুরুষরা ডিমটা রেখেছিলেন তাদের অতি বিশ্বাসী এক ভৃত্য ঝাং-এর এক পূর্বপুরুষের কাছে৷ কীভাবে মিং সম্রাটদের উত্তরপুরুষরা বিগত সাড়ে তিনশো বছর ধরে পূর্বপুরুষদের থেকে জেনেছেন ডিমটা কোথায় আছে সে গল্প৷ কেউ-কেউ নাকি ডিমটা এসে দেখেও গেছিলেন ঝাং-এর পূর্বপুরুষদের কাছে৷ এসব নানা গল্প শুনতে-শুনতেই ডিমটা নিয়ে ফিরে এল পুলিশকর্মীরা৷ ডিমটা পুলিশ অফিসারের হাতে তুলে দিয়ে তারা জানাল, ‘সাপ আর তার বাচ্চারা নাকি আর নেই৷ সব ডিম ফুটে বেরিয়ে গেছে৷ এই একটিই ডিম সেখানে ছিল৷’

    পুলিশ অফিসারের ডিমটা তুলে দিলেন তাও লি মিং-এর হাতে৷ পূর্বপুরুষের জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন৷ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ৷ এই ডিম নিয়ে শৈশবে খেলা করতেন তার পূর্বপুরুষেরা৷

    জিনিসটা যার সম্পত্তি সেটা তার হাতে ফেরত যাওয়াতে বৃদ্ধ ঝাং-এর মুখেও আনন্দের আভাস৷ হঠাৎ জুয়ান বললেন, ‘একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, যে সম্রাটদের এত সোনা-হিরে-জহরত ছিল তাদের শিশুরা সেরামিকের ডিম নিয়ে খেলত কেন? আর এ-জিনিসটার বর্তমানে একটা অ্যান্টিক মূল্য আছে সত্যি, কিন্তু খুব বেশি তো নয়৷ তার জন্য এত খুন-জখম-গোপনীয়তা কেন?’

    প্রশ্নটা শুনে মিং সম্রাটের বংশধর কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে জুয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়৷ এ-প্রশ্ন অন্যদের মাথাতেও আসা উচিত ছিল৷ যারা হিরে-জহরতের মধ্যে মানুষ হতেন, মিং সম্রাট পরিবারের শিশুরা নিছক সেরামিকের ডিম নিয়ে খেলতে পারে না৷ সত্যিটা তবে আপনাদের জানাই৷ এই বলে তিনি নখ দিয়ে ডিমের ঠিক মাঝবরাবর চারপাশে খুঁটতে শুরু করলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানের চলটা খসে একটা প্যাঁচ দেখা দিল৷ তাও লি মিং মোচড় দিয়ে ডিমটা দুখণ্ড করতেই জানলা দিয়ে আসা সূর্যালোকে ডিমের ভিতরটা ঝিলিক দিয়ে উঠল৷ ডিমের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ইঞ্চি দুই লম্বা একটা সোনার ড্রাগন মূর্তি৷ দুর্মূল্য পাথরখচিত তার শরীর৷ জিনিসটার কত দাম হতে পারে তা ধারণা নেই দীপাঞ্জনদের৷ হয়তো-বা কয়েক কোটি টাকা৷ তাও লি মিং বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনই একটা করে ড্রাগন মূর্তি লুকানো থাকতো প্রত্যেকটা ডিমের মধ্যে৷ যা বাইরের কেউ জানত না৷ দুঃসময়ে কাজে আসত জিনিসগুলো৷’

    দীপাঞ্জন আর জুয়ান চেয়ে রইল আশ্চর্য সুন্দর দুর্মূল্য প্রাচীন সেই ড্রাগন মূর্তির দিকে৷ আর সেটার দিকে তাকিয়ে ওয়াং বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘ডিম ফুটে ড্রাগনের ছানা বেরোল৷’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্ধকার যখন নামল – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
    Next Article সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    Related Articles

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    আঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }