Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প498 Mins Read0
    ⤶

    শেরউড বনের শিঙা

    ৷৷ ১ ৷৷

    ‘টাওয়ার অব লন্ডন।’ গগনচুম্বি বিরাট স্থাপত্যের ভিতরে প্রবেশ করার প্রধান ফটকে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল প্রফেসর জুয়ান আর দীপাঞ্জনাকে। পাশেই টিকিট কাউন্টার । তার গায়ে বোর্ড ঝুলছে, তাতে লেখা—’নো অ্যাডমিশন’ অর্থাৎ ‘প্রবেশ নিষেধ কাউন্টারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একজন লোক। তার পরনে লাল রঙের লম্বা ঝুলের পোশাক, পিতলের গুলসাঁটা চওড়া কোমরবন্ধে সোনালি জরির কাজ করা লম্বা তলোয়ারের খাপ, পায়ে ঝকঝকে পালিশ করা হাই হিল বুট, মাথায় ওলটানো টবের মতো দেখতে টুপি। এ ধরনের পোশাক পরা লোকের ছবি এর আগে বইতে দেখেছে দীপাঞ্জন। এরা হল ‘রয়াল গার্ড’ অর্থাৎ ‘রাজরক্ষী’, চলতি কথায় এদের বলা যেতে পারে রাজার পুলিশ’। লন্ডনের রাজকীয় স্থাপত্যগুলো এরা রক্ষণাবেক্ষণ করে, রানি বা রাজপুরুষরা যখন বাকিংহাম প্যালেস থেকে বাইরে আসেন তখন এরাই তাঁদের ‘গার্ড অব অনার’ দেয়, দেহরক্ষীরও কাজ করে। ‘রয়াল গার্ডের’ কাজ খুব সম্মানীয় পেশা। একটা সময় ছিল যখন শুধু ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনই এ কাজ করার সুযোগ পেত।

    নোটিশ বোর্ডটি দেখে জুয়ান সেই লোকটার দিকে তাকাতেই সে বেশ মার্জিতভাবে বলল, ‘আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত আপনাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দিতে পারছি না বলে। ভিতরের মিউজিয়ম নতুনভাবে সাজানোর কাজ চলছে। তাই এক সপ্তাহ ভিতরে দর্শকদের প্রবেশ নিষেধ ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। তবে এই স্থাপত্যের চারপাশের বাগান আপনারা ঘুরে দেখতে পারেন, সেখানে বিশ্রাম নিতে পারেন।’

    দীপাঞ্জনরা একটু হতাশ হল রয়াল গার্ডের কথা শুনে। আসলে মিউজিয়াম সংস্কারের ব্যাপারটা জানা ছিল না তাদের। এখানে আসার আগে কোনো ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে বা গাইডের সঙ্গে কথা বললে তারা নিশ্চয়ই মিউজিয়াম বন্ধের ব্যাপারটা তাদের জানিয়ে জিত। দীপাঞ্জনরা নিজেরাই সকালে হোটেল থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে লন্ডন দেখার জন্য। প্রথমেই তারা এসে উপস্থিত হয়েছে টাওয়ার অব লন্ডন’ দেখতে । যে স্থাপত্য শুধু লন্ডনের নয়, ইউরোপের অন্যতম প্রসিদ্ধ দুর্গ প্রাসাদ। প্রায় হাজার বছর ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে টেমস নদীর ধারে ।

    রয়াল গার্ডের কথা শুনে জুয়ান দীপাঞ্জনকে বললেন, ‘কী আর করা যাবে। আমরা তো এখানে চার-পাঁচ দিন থাকব, সুযোগ পেলে আবার একদিন এসে মিউজিয়মটি দেখে যাব। আপাতত বরং এর বাইরের অংশটাই ঘুরে দেখি।’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন। চারপাশটাই আপাতত ঘুরে দেখা যাক । সদর দরজার পাশ থেকেই পাথরবাঁধা রাস্তা চলে গেছে স্থাপত্যটাকে বেড় দিয়ে। সে পথেই ধীর পায়ে চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটতে শুরু করল দুজন। বাইরে থেকে স্থাপত্যটাকে দেখতে দেখতে জুয়ান বললেন, ‘অন’ দিন হলে নিশ্চয়ই এখানে গাইড পাওয়া যেত তার মুখে অনেক কথা জানা যেত। তবে ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ সম্পর্কে যতটুকু আমি জানি তা তোমাকে বলি?’

    ‘হ্যাঁ বলুন’, বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলল দীপাঞ্জন। জুয়ান ‘মেসো আমেরিকান ইতিহাস’ নিয়ে চর্চা করলেও, অন্য ইতিহাসের ব্যাপারে বেশ জ্ঞান আছে তাঁর।

    প্রফেসর জুয়ান বলতে শুরু করলেন, দুর্গ প্রাসাদ আমাদের এশিয়া মহাদেশেও আছে। বিশেষত তোমাদের ভারতের রাজস্থানে বহু জায়গাতে। তবে এশিয়ার দুর্গগুলোর সঙ্গে ইউরোপের দুর্গগুলোর স্থাপত্যগত পার্থক্য আছে। আমাদের দুর্গগুলো অনেক বেশি জায়গা নিয়ে ছড়ানো থাকে, আসলে সেগুলো একটা ছোটখাট নগরী, আর এদের দুর্গ প্রাসাদগুলো সাধারণত উচ্চতায় বেশি হয় দৈর্ঘ্যপ্রস্থ তাপেক্ষা : দুর্গর স্তম্ভগুলো অনেকটা ত্রিভুজের বাহুর মতো ওপর দিকে উঠে যায়। যদিও টাওয়ার অব লন্ডন অনেকটাই প্রশস্ত। একুশটা টাওয়ার বা স্তম্ভ ধরে রেখেছে ইংল্যান্ডের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী এই প্রাসাদকে। দুর্গপ্রাসাদের ঠিক মাঝখানে যে ‘হোয়াইট টাওয়ার’ দেখতে পাচ্ছ ওটাই সবচেয়ে প্রাচীন। ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে নর্মান বিজেতা টাওয়ার ও এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে তিনি প্রসিদ্ধ ‘ইলিয়াম দি কংক্যুয়েরর’ নামে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে অন্য টাওয়ারগুলো, ইউরোপের প্রসিদ্ধ বন্দিশালা বা ঘাতকশালা হিসাবে, কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় এটা কিন্তু সাধারণ দুর্গই ছিল। মূলত সামরিককার্য পরিচালিত হত এখান থেকে। পরবর্তীকালে এর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কারণে, এ জায়গা থেকে বন্দিদের পালানো প্রায় অসম্ভব বলে একে বন্দিশালায় পরিণত করা হয়। কুখ্যাত জায়গা হয়ে ওঠে টাওয়ার অব লন্ডন।’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, টাওয়ার অব লন্ডন’ যে কুখ্যাত বন্দিশালা ছিল তা আমি বইতে পড়েছি।’

    জুয়ান বললেন, “ঠিক তাই। রাজদ্রোহী ডিউক, ব্যারন, আর্ল প্রভৃতি অভিজাত পরিবারের মানুষ থেকে সাধারণত জনতা, বহু মানুষকে বন্দি অথবা হত্যা করা হয় এখানে। সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারের মধ্যে যে ষড়যন্ত্র চলত তার ফলশ্রুতি হিসাবে রাজপরিবারের সদস্য বা রাজারানিরাও বিভিন্ন সময়ে এখানে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন । যেমন, রাজা অষ্টম হেনরির স্ত্রী অ্যানি বোলিয়েন, দুই রাজপুত্র প্রিন্স এডোয়ার্ড ও প্রিন্স রিচার্ড, যিনি পরে সিংহাসনে বসেন, রানি লেডি গ্রে প্রমুখ। এছাড়া এখানে কারাবাসকারী আরও একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন স্যার ওয়াল্টার র‍্যালে। যিনি আমাজন অববাহিকায় ইনকারে স্বর্ণনগরী ‘এল-ডো-রে-ডো’ খুঁজতে গিয়েছিলেন। রানি অ্যানি বোলিয়নের শিরশ্ছেদ করা হয় গ্রিন টাওয়ার বলে এখানকার এক টাওয়ারে। তারপর রানির ছিন্ন মুণ্ডু বর্ণায় গেথে টাওয়ারের জানলা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল যাতে নীচে চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা সেই মুণ্ডু দেখে বুঝতে পারে যে রাজার বিরুদ্ধাচরণ করলে কী ঘটতে পারে।! “টাওয়ারে পাঠানো হবে’-এ কথা শুনলেই লন্ডনে এমন কোনো মানুষ ছিল না যার বুক কাঁপত না। এখানে শেষ প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৪১ সালে। জার্মান গুপ্তচর জোসেফ জ্যাকবকে গুলি করে মারা হয় এখানে।

    বাইরে থেকে দুর্গপ্রাসাদটা দেখতে দেখতে এগোতে থাকল তারা। পাথরের ব্লক বসানো রাস্তার এক পাশে সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন। ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে পর্যটকের দল। কেউবা লনের মধ্যে বসে গল্প করছে। কারুকাজ করা ধাতব বেঞ্চ রয়েছে লনের মধ্যে। লাল পোশাকের রয়েল গার্ডরাও ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। একটার পর একটা টাওয়ার অতিক্রম করতে করতে দীপাঞ্জনরা স্থাপত্যটার পিছন দিকে এসে উপস্থিত হল। এদিকটায় টুরিস্ট বেশি নেই। ঘাসে ছাওয়া লনের শেষপ্রান্তে লোহার রেলিং এর ফাঁক দিয়ে টেমস নদী চোখে পড়ছে। তাতে ভাসমান প্রমোদ তরিগুলোকে দূর থেকে খেলনার মতো দেখাচ্ছে। চারপাশ খুব নিস্তব্ধ। লন্ডন শহরের যাবতীয় কোলাহল, ব্যস্ততা যেন এই টাওয়ার অব লন্ডনের’ সামনে এসে থেমে যায়। চারপাশে আধুনিক স্থাপত্যর মাঝখানে হাজার বছর ধরে নিজের আভিজাত্য আর ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ার অব লন্ডন।’

    টাওয়ার সংলগ্ন সবুজ লনে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল জুয়ান আর দীপাঞ্জন। জুয়ান টাওয়ারের গল্প শোনাচ্ছিলেন দীপাঞ্জনকে, হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস প্রত্যক্ষ করল তারা। লনের মাঝখানে যে পাথর বিছানো রাস্তা আছে সেখানে এসে হাজির হল একজন রয়াল গার্ড। তার হাতে একটা কাঠের বালতি। লনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে একটা ব্যাটন দিয়ে ঠকঠক শব্দ করতে লাগল কাঠের বালতিটাকে। আর সে শব্দে কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিক ওদিক থেকে লাফাতে লাফাতে ছুটে এল বেশ কয়েকটা ‘র‍্যাভেন’ বা দাঁড়কাক। কাকগুলো এসে কোনোটা লোকটার কাঁধে, কোনোটা মাথায়, কোনোটা বাহুতে উঠে বসল। আর লোকটা তাদের ডানায় হাত বুলিয়ে কাঠের বালতি থেকে খাবার তুলে দিতে লাগল দাঁড়কাকগুলোর ঠোটে। ঠিক যেমন পোষা পায়রাদের খাওয়ানো হয় ঠিক তেমনই। কাকা যে এমন পোষ মানে এর আগে তা কোনোদিন দেখেনি দীপাঞ্জন। সে জুয়ানকে বলল, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে দাঁড়কাক পোষা হয় !

    জুয়ান বললেন, “কাকগুলোকে দেখে মনে পড়ে গেল, এখানে ‘রাভেন টাওয়ার’ নামে একটা টাওয়ার আছে বলে বইতে পড়েছি। কাকগুলো তাহলে হয়তো ওখানেই থাকে। এ ব্যাপারে আর কিছু আমার জানা নেই ।

    জুয়ানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলে উঠল, ‘আপনাদের ডানদিকে যে টাওয়ারটা দেখতে পাচ্ছেন ওটাই র‍্যাভেন টাওয়ার। ওখানেই যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছে কাকগুলো।’

    মৃদু চমকে উঠে পাশে তাকাতেই দীপাঞ্জনরা দেখতে পেল কখন যেন একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। মাঝবয়সি এক ইংরেজ। পায়ে জুতো, পরনে লংকোট, মাথায় হ্যাট।

    দীপাঞ্জনরা তার দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘মার্জনা করবেন, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনাদের কথা কানে এল তাই জবাবটা দিয়ে দিলাম।’ দীপাঞ্জন এবার খেয়াল করল লোকটার হাতে একটা ফাঁকা খাঁচাও ধরা আছে।

    তার কথা শুনে জুয়ান বললেন, ‘মার্জনা নয়, আপনাকে বরং ধন্যবাদ জানাই ব্যাপারটা জানাবার জন্য। তা এই দাঁড়কাকগুলো কি পোষা হয় এখানে?’

    লোকটা জবাব দিল, “হ্যাঁ, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে এখানে নিয়মিতভাবে দাঁড়কাক পোষা হয়। এটা একটা সংস্কার এবং এটা বর্তমানে টাওয়ার অব লন্ডনের একটা ঐতিহ্য। ছটা দাঁড়কাক সব সময়ে ছেড়ে রাখা হয় টাওয়ার অব লন্ডনে। আর একটাকে খাঁচায় রাখা হয়। হঠাৎ যদি কোনো দাঁড়কাক মারা যায় বা নিখোঁজ হয়ে যায় সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য। ছ-টা দাঁড়কাকবিহীন এই স্থাপত্য থাকতে পারে না।’

    লোকটার কথা শুনে জুয়ান বললেন, ‘বেশ চমকপ্রদ ব্যাপারতো! কিন্তু এর পিছনে কী কারণ আছে? এ সংস্কার কেন?’

    লোকটা মাথার থেকে টুপিটা খুলল। তারপর মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার নাম রিচমন্ড। আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’ প্রশ্নটা করে দীপাঞ্জনের পাশে বেঞ্চের শূন্যস্থানটা দখল করে বসল সে।

    দীপাঞ্জনরা নিজেদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার পর লোকটা বলল, ‘আপনাদের আগ্রহ দেখে ভালো লাগল। তাই বসলাম। গল্পটা আপনাদের বলি, দাঁড়কাক পোষার চল তিন-সাড়ে তিনশো বছর ধরে হলেও কাকেরা কিন্তু এই দুর্গপ্রাসাদের আদি বাসিন্দা। কেউ কেউ বলেন, টাওয়ার তৈরি হবার পর থেকেই কাকগুলো ওখানে আশ্রয় নেয় ৷ আবার কারও মতে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন শহর ও তার উপকণ্ঠে যে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড হয় তখন প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গল থেকে দাঁড়কাকগুলো এসে আশ্রয় নেয় এই টাওয়ারে। তবে এই টাওয়ারে কাকগুলো থাকার একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারণ পাওয়া যায়। এই টাওয়ারেই এক সময় শিরশ্ছেদ করা হত বন্দিদের। অথবা হাত-পা কেটে শাস্তি দেওয়া হত। আর ওই যে টাওয়ারের মাথায় যে গবাক্ষ দেখছেন, সেখান থেকে ছিন্নমুণ্ড, কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ছুড়ে ফেলা হত আমরা যেখানে বসে আছি ঠিক এখানে! মাংসর লোভেই এখানে এই টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েছিল কাকগুলো। তবে সেই সময় কাকগুলোকে এখনকার মতো ঠিক পোষা বলা যাবে না। রানি অ্যানি ব্যোলিয়নের ছিন্ন মুণ্ড থেকে চোখ খুবলে খেয়েছিল কাকগুলো। যাইহোক সপ্তদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলেন। কাকগুলো মাঝে মাঝে ঠোটে করে মানুষের মাংস, হাড়ের টুকরো প্রাসাদের এখানে সেখানে নিয়ে ফেলত । ব্যাপারটা পছন্দ না হওয়াতে তিনি ধুঁয়ো দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন কাকগুলোকে। বেচারা কাকগুলো গৃহহীন হয়ে উড়তে উড়তে অনেকদূর চলে গেল নতুন বাসস্থানের খোঁজে। কিন্তু যেদিন হঠাৎ প্রবল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল এই প্রাসাদ। শুধু এই প্রাসাদেই ভূমিকম্প, অন্য জায়গাতে কিন্তু নয়। টাওয়ারগুলো দুলতে থাকল, খসে পড়তে লাগল পাথর। যেদিন কাকগুলোকে তাড়ানো হল আর আর ভূমিকম্প হল সেদিন রাতে প্রাসাদের অন্ধকার অলিন্দ থেকে এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন রাজা চার্লস। ‘তুমি যদি অন্তত ছ-টা দাঁড়কাক প্রাসাদে রাখতে না পারো তবে এ প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবে…।’

    একটানা কথাগুলো বলে একটু থামল রিচমন্ড নামের লোকটা। তারপর আবার বলতে শুরু করল, অদৃশ্যবাণী শুনে ভয় পেয়ে গেলেন রাজা। পরদিন সকালেই তিনি লোক পাঠালেন এক জায়গাতে অন্তত ছটা দাঁড়কাক জোগাড় করে আনতে। তিনদিন সম লেগেছিল ছ-টা কাক আনতে। আর এই তিনদিনই নিয়মিত ভূমিকম্প হয় প্রাসাদে। কাক যেদিন আনা হল সেদিন থেকে ভূমিকম্প বন্ধ হল। মাঝে একবার দুটো কাক উড়ে গেছিল, ঠিক সেদিনই আবার ভূমিকম্প হল। সেই থেকে সবার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয় যে অন্তত ছ-টা কাক সবসময় রাখতে হবে এখানে। নইলে প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। সেই থেকে ছ-টা কাক সবসময় এখানে থাকে। ওদের ডানা সেলাই করা থাকে যাতে ওরা উড়ে পালাতে না পারে।’

    রিচমন্ডের কথা শুনে জুয়ান বললেন, ‘গল্পটা আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু এমনতো হতে পারে যে ধোঁয়া বা অন্য কোনো কারণে নয়, ভূমিকম্প হবে বুঝতে পেরেই দূরে পালিয়ে গেছিল দাঁড়কাকগুলো। পশুপাখিদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় আঁচ করার ক্ষমতা থাকে।’ রিচমন্ড শুনে বলল, “তা থাকে আমিও জানি। তবে ভূমিকম্প কিন্তু শুদু এই দুর্গপ্রাসাদেই হত। সারা লন্ডন শহরে নয়। এ ব্যাপারটা কিন্তু খেয়াল রাখবেন। যুগ যুগ ধরে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে এ কথা—‘র‍্যাভেন যেদিন থাকবে না, টাওয়ার অব লন্ডন’ও আর থাকবে না।’ কথাটা কিন্তু প্রবাদে পরিণত হয়েছে।’

    জুয়ান এরপর এ প্রসঙ্গে আর বিতর্কে না গিয়ে লোকটাকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি এখানেই থাকেন ?

    রিচমন্ড বলল, ‘না, আমি এখানে থাকি না। আমি থাকি এখান থেকে একশো কুড়ি মাইল দূরে নটিংহ্যামে।’ তবে জায়গাটা ঠিক নটিংহ্যাম বললে ভুল হবে। বর্তমান নটিংহ্যাম বলতে যা বোঝায় সেই শহর থেকে আরও কুড়ি মাইল দূরে এক পল্লিগ্রামে। ওখানে একটা পাঁচশো বছরের প্রাচীন জমিদারবাড়ি আছে। আসলে সেটাও একটা ছোটোখাটো দুর্গ প্রাসাদ ‘আর্লের জমিদার বাড়ি’। আমি সেখানেই থাকি। এখানে এসেছিলাম একটা দাঁড়কাক দিতে।’

    ‘দাঁড়কাক দিতে!’, দীপাঞ্জন বলে উঠল।

    রিচমন্ড বলল, “হ্যাঁ দাঁড়কাক দিতে। রাজা দ্বিতীয় চার্লস যেখান থেকে দাঁড়কাক সংগ্রহ করে টাওয়ার অব লন্ডন’কে বাঁচিয়ে ছিলেন সেটা আমাদের অঞ্চল। বিভিন্ন সময় আর্লের জমিদারবাড়ি থেকে এখানে দাঁড়কাক পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য এই প্রাসাদেই একটা দাঁড়কাক প্রজননকেন্দ্র বানানো হয়েছে। সংবাদপত্রে কদিন আগে খবর বেরিয়েছিল যে একটা দাঁড়কাক নাকি অসুস্থ। তাই আমার মালিক আর্ল সেভার্ন একটা কাক দিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মুশকিল হল যে কাকটা এরা কিছুতেই নিল না।’

    ‘কেন, নিল না, কেন?’ জানতে চাইল দীপাঞ্জন ।

    রিচমন্ড যেন একটু হতাশভাবে বলল, ‘দিনকাল, আইনকানুন সব পালটেছে। বাইরে থেকে এখন আর ওরা কাক নেয় না। এখানেই কাকের ছানা ফোটায়। এতে পাখিদের মধ্যে রোগ সংক্রমণের ভয় কম থাকে। তবে টাওয়ারের কর্তৃপক্ষ কাক নেয়নি শুনলে দুঃখ পাবেন বৃদ্ধ আর্ল। তাঁর মর্যাদায় আঘাত লাগবে। তাই কাকটাকে এখানেই ছেড়ে দিলাম। রয়াল গার্ডরা অবশ্য ব্যাপারটাতে বিশেষ আপত্তি করল না। বাইরের কাকগুলো অনেক সময় এখানে তো উড়ে আসে।’—এই বলে রিচমন্ড তার হাতের শূন্য খাঁচাটা একটু তুলে ধরে দীপাঞ্জনদের দেখাল।

    জুয়ান বললেন, ‘নটিংহ্যামের অনেক নাম শুনেছি। সে জায়গাটা কেমন? আসলে আমি এখানে একটা সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলাম। ফেরার আগে হাতে দু-তিনদিন সময় আছে। লন্ডনের আশেপাশের জায়গাগুলো একটু ঘুরে দেখতে চাই।’

    রিচমন্ড বললেন, ‘রবিনহুডের গল্পে নটিংহ্যামের কথা আছে। সেজন্য অনেকে ওখানে বেড়াতে যায়। তবে ন-শো বছর আগের সেই নটিংহ্যাম তো আর নেই। এখন সেটা আধুনিক শহর। শেরউড বনও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু আমরা যেখানে থাকি সেখানে কিছুটা অরণ্য আছে। আর শহর যেভাবে বাড়ছে তাতে বিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে সেটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে তার আগে একবার দেখে আসতে পারেন জায়গাটা।’

    জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘ওখানে থাকার বন্দোবস্ত কী আছে?’

    রিচমন্ড প্রথমে জবাব দিল ‘নটিংহ্যামে অনেক বড়ো বড়ো হোটেল আছে। আর তারপর বলল, ‘আপনারা যদি ইতিহাস পছন্দ করেন আর নিরিবিলিতে থাকতে চান তবে শেরউডের ভিতর আর্ল জমিদারবাড়িতেও থাকতে পারেন। দুশো পাউন্ড দিলে আমি সেখানে কদিন থাকার সব ব্যবস্থা করে দেব। অনেক প্রাচীন জিনিস আছে সে বাড়িতে। তার মধ্যে কিছু জিনিস এই টাওয়ার বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও নেই। আরও একজন ভদ্রলোক লন্ডন থেকে কাল ভোরের ট্রেনে যাচ্ছেন। তাহলে আমি এক সঙ্গে তিনজনের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারি? ভদ্রলোকও শুনলাম কী একটা সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলেন এখানে । আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। আইরিশ ভদ্রলোক। প্রাচীন ইংল্যান্ড নিয়ে চর্চা করেন।

    জুয়ান বললেন, ‘আপনারা কি হোটেলের মতো বাড়িটা ভাড়া দেন?”

    রিচমন্ড বলল, ‘না, ঠিক তা নয়। আসলে দুর্গবাড়ির মালিক জানেন না ব্যাপারটা। কিন্তু টাকার জোগান না পেলে আমি বৃদ্ধ আর্লের খাবার খরচ, চিকিৎসার খরচ চালাব কীভাবে? বংশপরম্পরায় আমরা আর্লদের ভৃত্যের কাজ করি। বুড়ো মানুষটাকে ফেলে চলেও যেতে পারছি না। তাই মাঝে মাঝে টুরিস্টদের নিয়ে গিয়ে ওঠাই ওখানে, যখন দেখি আর খরচ চলছে না। আর্ল বেশ গর্ব অনুভব করেন এই ভেবে যে এখনও তাদের বংশগরিমা দেখতে লোক আসে।’

    জুয়ান বললেন, ‘বুঝলাম। তা আইরিশ ভদ্রলোকের নাম কী?’

    ‘লর্ড শ্যানন।’—জবাব দিল রিচমন্ড।

    ‘লর্ড শ্যানন? নামটা যেন চেনা লাগছে!’ এই বলে জুয়ান তার কোটের পকেট থেকে সেমিনারের ছোটো পুস্তিকা বার করলেন। কয়েকটা পাতা ওলটাবার পর একটা পাতায় চোখ রেখে বললেন, ‘হ্যাঁ পেয়েছি। এই জন্যই নামটা চেনা লাগছিল। সেমিনারের প্রথমদিন উনি বক্তৃতা করেছিলেন মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের ইতিহাস নিয়ে। সঙ্গী হিসাবে লোকটা মন্দ হবে না কারণ তিনিও দেশের ইতিহাস জানেন।’

    এ কথা বলার পর তিনি রিচমন্ডকে বললেন, “ঠিক আছে আমরা যাব। কী ভাবে যাব বলুন?”

    -এর রিচমন্ড বলল, ‘কাল সকাল ন-টায় একটা ট্রেন আছে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। ঘণ্টা দুই- মধ্যে আপনাকে পৌঁছে দেবে নটিংহ্যামে। প্ল্যাটফর্মের বাইরে আমি অপেক্ষা করব আপনাদের জন্য।’

    আরও সামান্য কিছু কথাবার্তা বলে রিচমন্ড চলে যাবার পর দীপাঞ্জনরা টাওয়ার চত্বর থেকে বেরিয়ে বাকিংহ্যাম প্যালেস আর ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে দেখে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাটিয়েছিল। পরদিন সকালবেলা ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশন থেকে তারা রওনা দিল নটিংহ্যামের উদ্দেশ্যে।

    ৷৷ ২ ৷৷

    দু-ঘণ্টা মতো মনোরম যাত্রাপথ পেরিয়ে তারা নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছে গেল নটিংহ্যামে । আধুনিক শহর নটিংহ্যাম। স্টেশনের বাইরে পা রেখেই দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারল আধুনিকতার পাশাপাশি একটা প্রাচীন ঐতিহ্যের মেলবন্ধন আছে লন্ডনের মতো এ শহরেও । ঐতিহ্যের ব্যাপারে ব্রিটিশরা অন্য জাতির তুলনায় বরাবরই বেশ রক্ষণশীল। প্রাচীনত্বকে তারা ভালোবাসে, মর্যাদা দেয়। আধুনিক ঘরবাড়ির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের বাড়ি ঘর। এবং সেগুলোই যেন বেশি সম্ভ্রম আকর্ষণ করে লোকের মনে। ওইসব স্থাপত্যই জানিয়ে দেয় এ শহর ভুঁইফোড় কোনো শহর নয়, এ শহর ইতিহাসের অঙ্গ, এর একটা আলাদা গন্ধ আছে, যে গন্ধ গগনচুম্বি অট্টালিকা সমৃদ্ধ নিউইয়র্ক বা হংকং-এ পাওয়া যাবে না। সে সব শহর যত ঝলমলেই হোক না কেন।”

    পার্কিং লটে পৌঁছে একটু অপেক্ষা করার পরই তারা রিচমন্ডকে দেখতে পেল। একজন ভদ্রলোককে সঙ্গে করে সে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের মধ্যেই হবে। পরনে ওয়েস্টকোট, চোখে চশমা, মাথায় হ্যাট, হাতে একটা ছড়ি। প্রফেসর জুয়ানের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমি লর্ড শ্যানন। গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। দর্শক আসনে বসে গতকাল, ‘মেসো আমেরিকান সভ্যতা’ নিয়ে আপনার বক্তৃতা শুনলাম এবং অনেক কিছু জানলাম।’ জুয়ান দীপাঞ্জনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দুর্ভাগ্য আপনার বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি দ্বিতীয় দিন এসে পৌঁছেছি। তবে সে আক্ষেপ আশাকরি আপনার সাহচর্যে পুষিয়ে নিতে পারব। আপনিতো এ দেশের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। এই ঐতিহাসিক জায়গাতে আপনার মতো লোকের দুর্লভ সাহচর্য পাব আমরা।’

    শ্যানন হেসে বললেন, ‘জানার যে কোনো শেষ নেই তা আমি আপনি দুজনেই জানি। তবে এ জায়গা সম্বন্ধে যতটুকু জানি তা নিশ্চই বলার চেষ্টা করব।’

    জুয়ান এরপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রিচমন্ড বলল, “এবার আপনার গাড়িতে চলুন। অনেকটা পথ যেতে হবে, গাড়িতে যেতে যেতে কথা বলতে পারবেন। ঘণ্টা তিনেকের মতো সময় লাগবে যেতে।’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ বলুন। কিন্তু আপনিতো বলেছিলেন মাত্র কুড়ি মাইল পথ। অত সময় লাগবে কেন? আপনার গাড়ি কোনটা ?”

    রিচমন্ড হেসে বলল, ‘হ্যাঁ কুড়ি মাইলই পথ। গাড়ি এই চত্বরের বাইরে আছে। ও গাড়ি ঢুকলে এ চত্বরটা নোংরা হতে পারে বলে গাড়িটা বাইরে রাখতে হয়েছে।

    রিচমন্ডের কথার অর্থ কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল দীপাঞ্জনরা। চত্বরের বাইরে বেরিয়ে রিচমন্ড তাদের এনে দাঁড় করাল একটা ঘোড়ার গাড়ির সামনে। দু-ঘোড়ায় টানা কালোরঙের একটা ফিটন গাড়ি। ঘোড়াগুলোও কালো। গাড়ির ছাদে মালপত্র ওঠাতে ওঠাতে রিচমন্ড বলল, ‘আমার মালিক আর্ল সেভার্ন খুব প্রাচীনপন্থী। ভাবনা-চিন্তার দিক থেকে তিনি এখনও সেই আর্ল-ব্যারন-ডিউকের যুগেই পড়ে আছেন। ওখানে যন্ত্রচালিত গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক বলতে শুধু খবরের কাগজ। আমি তাকে কোনোদিন দুর্গপ্রাসাদের বাইরে বেরোতে দেখিনি। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি ঢুকতে দেননি তিনি। তাঁর সামনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায় না। এতে হয়তো আপনাদের কিছুটা কষ্ট হবে, কিন্তু আপনারা একটা অতি প্রাচীন গন্ধ অনুভব করতে পারবেন সেখানে। যারা এটা বোঝে না তারা টাকা দিলেও আমি তাদের সেখানে নেই না।’

    শ্যানন শুনে বললেন, “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমরা প্রাচীনগন্ধ খুঁজতেই ওখানে যাচ্ছি। তাই পরিবেশটা ওরকম হওয়াই দরকার।’

    দীপাঞ্জনরা চড়ে বসল গাড়িতে। রিচমন্ড বসল কোচয়ানের আসনে। ঘোড়ার নলের খটাখট শব্দ তুলে চলতে শুরু করল গাড়ি। প্রথম শহরের মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি। পথের দু-পাশে বড়ো বড়ো আধুনিক বাড়ি-ঘর-দোকানপাট। আর তার মাঝে মাঝে আপন গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়ান যুগের নানান স্থাপত্য। বড়ো বড়ো থামওয়ালা সব ঘর বাড়ি সুদৃশ্য কাঠের প্যানেলে ঘষা কাচ ঢাকা দরজা জানালা । বাড়িগুলোর কোনোটার মাথায় বসানো আছে নানা ধরনের মূর্তি, দেয়ালের গায়ে রয়েছে কারুকাজ। দীপাঞ্জন একটা জিনিস খেয়াল করল, কলকাতার রাস্তায় কেউ যেমন পুরোনো বেডফোর্ড গাড়ি দেখলে হাসাহাসি করে তেমন এই ঘোড়ার গাড়ি দেখে পথচারীরা কিন্তু কেউ হাসাহাসি করছে না। বরং আধুনিক গাড়িগুলোর পাশে তাদের গাড়িটাকে দেখে বেশ সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। এক বৃদ্ধ পথচারী ভদ্রলোক তো গাড়িটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে মাথার টুপি খুলে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন গাড়ির দিকে। অর্থাৎ এরা প্রাচীন ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করে।

    চলতে চলতে শ্যানন বললেন, ‘আমরা যে জায়গা দিয়ে যাচ্ছি এটা এক হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন জনপদ। তবে তখন অবশ্য এ জায়গাতে একটা দুর্গ ছিল শুধু, আর তাকে ঘিরে ছোটো ছোটো অ্যাংলো স্যাক্সনদের গ্রাম। ওরাই ছিল এখানকার আদিবাসিন্দা। নর্মানরা এদেশ দখল করার পর এখানে দুর্গ বানায়। তখন এ শহর ঘেরা ছিল গভীর বনে। শেরউড বন। রাজা সেখানে হরিণ শিকার করতে আসতেন। তার বাসস্থান ও নিরাপত্তার জন্যই দুর্গ বানানো হয় এখানে। যদিও মহাকাল সে দুর্গকে এখন গ্রাস করে নিয়েছে, তার অস্তিত্ব নেই এখন।

    দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, রবিনহুডের ব্যাপারটা কি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি, নাকি শুধুই লোককথা? ‘শেরউড বন’ নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় রবিন হুডের কাহিনি। “অসহায়, নিপীড়িত মানুষের ত্রাতা’ শেরউডবনের রবিন হুড!’

    প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শ্যানন বললেন, ‘রবিনহুডের গল্প যে সময়কার সেটা হল দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ নর্ম্যানরা তখন দখল নিয়েছে দেশটার। রাজা ছিলেন ‘রিচার্ড দি লায়ন হার্ট’। কিন্তু তিনি সুদূর প্রাচ্যে জেরুসালেমকে মুক্ত করার জন্য ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডে যোগ দিতে চলে গেলেন এবং যাবার আগে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন ভাই জন প্ল্যান্টাজেনেটকে। স্যাক্সনদের ওপর জনের নর্মান বাহিনী নানারকম অত্যাচার করত। কারণ স্যাক্সনরা ছিল আগের রাজার অনুরক্ত। যাকে বিতাড়িত করে সিংহাসন দখল করে নর্ম্যানরা। সংঘর্ষ লেগে থাকত নম্যান স্যাক্সনদের মধ্যে। রাজার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়াই করা সম্ভব নয় বলে স্যাক্স বিদ্রোহীরা জঙ্গলে আত্মগোপন করত এবং অতর্কিতভাবে হানা দিত নর্মান শেরিফ শাসকদের ভিতর। স্যাক্সন বিদ্রোহীদের অন্যতম ঘাটি ছিল শেরউড বনাঞ্চল। এই গভীর বনাঞ্চলে তারা আত্মগোপন করত। অস্ত্রপ্রশিক্ষণ দিত। গেরিলা যুদ্ধ চালাত।—এ ঘটনাগুলো কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্যি। নর্ম্যানরা কিন্তু তাদের ডাকাত বলত। শেরউড বনের পথে তারা সুযোগ পেলেই রাজার খাদ্যশস্য, ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র লুণ্ঠন করত। এমনকি একবার তারা লুঠ করেছিল রাজা জন যে জহরতের মালা গলায় দিতেন সেই জহরতের ছড়া। রাজা যে মণিকারকে তা নতুন করে বাঁধতে দিয়েছিলেন তার থেকেই লুঠ হয় সেটা। ঐতিহাসিক গবেষকদের মধ্যে ধারণা হল হতে পারে স্যাক্সন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কোনো নেতার নাম ছিল ‘রবিন’। যার কথা পল্লবিত হয়ে প্রথমে ইংল্যান্ডে তারপর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রবিনহুডের সুস্পষ্ট উপস্থিতির কোনো প্রমাণ ঐতিহাসিকরা সংগ্রহ করতে পারেনি। সম্প্রতি দ্বাদশ শতকের একটা চিঠি উদ্ধার করা হয়েছে একজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে। রেশমের কাগজের ওপর সেই চিঠিতে কাসকেট নামক সেনাধ্যক্ষ তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ন্যাটিংহ্যামের শেরিফকে জানাচ্ছে যে ন্যাটিংহ্যাম দুর্গে আরও রক্ষী প্রয়োজন। কারণ সে খবর পেয়েছে যে ‘শিঙাধারী বিদ্রোহী দস্যু র‍্যাভেন’ শেরউড অরণ্য ছেড়ে বেড়িয়ে এসে নর্মানদের আক্রমণ করতে পারে। চিঠিটা দ্বাদশ শতকেই লেখা। বিজ্ঞানীরা সেটা পরীক্ষা করে দেখেছেন ‘রবিন’ হল একটা ছোট্ট সুন্দর পাখি, আর ‘র‍্যাভেন’ হল ‘কুৎসিত কাক’। হতে পারে স্যাক্সনদের কাছে যে ‘রবিন’ নর্মানদের কাছে সে ‘র‍্যাভেন’ বা কুৎসিত কাক। নর্মানরা হয়তো ঘৃণায় রবিনকে র‍্যাভেন বলত। যাইহোক চিঠি কিন্তু এখন রবিন বা র‍্যাভেনের উপস্থিতির ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিচ্ছে।’

    গড়ি চালাতে চালতে দীপাঞ্জনদের কথোপকথন শুনছিল রিচমন্ড। সে এবার বলল, জহরত লুণ্ঠনের গল্প আমি শুনেছি। মণিকারের নাম ছিল মরিস। রাজা মণিকারকে ডিউক উপাধি দিয়েছিলেন। জহরতগুলো খোয়া যাবার অপরাধে রাজা তাকে প্রাণদণ্ড দেন। ন্যাটিংহ্যাম দুর্গে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাকে। তবে আমি এ ঘটনাকে এতদিন গল্পকথা ভাবতাম। এবার অন্য একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। আর্লদুর্গে কিন্তু প্রচুর র‍্যাভেন আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কাকেদের আস্তানা বাড়িটা। একটা সময় ছিল যখন কাকেদের পরিচর্যা করার জন্যই লোক থাকত বাড়িতে। বর্তমান আর্লের ঠাকুরদার আমলে একটা ছেলে গুলতি দিয়ে একটা কাক মেরেছিল বলে তার বাবাকে ধরে এনে ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হয়। দাঁড়কাক আর্ল বংশের ঐতিহ্যের প্রতীক। দোহাই, আপনাদের ওখানে দিয়ে দাঁড়কাক সম্বন্ধে কুৎসিত শব্দ বা ও ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহার করবেন না।’

    জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘আর্ল জমিদার বাড়িতে কে কে থাকেন ?

    রিচমন্ড বলল, ‘এক সময় অনেকেই থাকত। তাদের কেউ কেউ বয়সজনিত কারণে মারা গেছে, কেউবা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন ওখানে থাকার মধ্যে আছেন আর্ল সেভার্ন, আমি আর একপাল দাঁড়কাক।’

    কথা চলতে চলতেই শহর ছেড়ে একসময় বেরিয়ে পড়ল গাড়ি। পল্লিগ্রামের পথ ধরে দুলকি চালে চলতে শুরু করল ঘোড়ার গাড়ি। পথের দুপাশে কাঠের বাড়ি-ঘর, কোথাও গমের খেত কোথাও বা চিনি বিটের খেত। কোথাও আবার বীজ বপনের জন্য ঘোড়া দিয়ে লাঙল দিচ্ছে কৃষকরা। কিছু জায়গাতে আবার বিস্তীর্ণ ফুলের খেত। গল্প করতে করতে এগিয়ে চলল দীপাঞ্জনরা। বক্তা মূলত শ্যানন। দীপাঞ্জন আর জুয়ান শ্রোতা। শ্যানন কোনো সময় বলে যেতে লাগলেন টিউডর রাজবংশের ইতিহাস, কখনও বা ভিক্টোরিয়ান যুগের কথা, কখনও বা নর্ম্যান স্যাক্সনদের লড়াইয়ের গল্প। ঘণ্টা খানেক চলার পরে ঘোড়াদের জল খাওয়ানোর জন্য ছোট গঞ্জের মতো এক জায়গাতে গাড়ি থামানো হল। দীপাঞ্জনরা তিনজন সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। তারপর আবার পথ চলা।

    এক সময় দূরে দিগন্ত রেখায় তরুবীথি দেখা দিল। রিচমন্ড বলল, ‘হল শেরউড বন।’ সোজা রাস্তা চলে গেছে বনের মধ্যে দিয়ে। সে পথেই ঢুকল ঘোড়ার গাড়ি। পথের দু-পাশে ওক, পাইন, ওয়াল নাটের ঘন জঙ্গল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীন বনভূমি। গাড়িটা বনপথে প্রবেশ করা মাত্রই একটা অন্যরকম শিহরণ জাগল দীপাঞ্জনের মনে। ন্যাটিংহ্যামশ্যায়ারের শেরউড বনের গল্প, রবিনহুডের গল্প। রবিনহুডের গল্পের অন্য চরিত্রগুলোর কথাও তার মনে আছে। ন্যটিংহ্যামের শেরিফ পেটমোটা মাওরে, রবিনের সঙ্গী টেকো ফ্রায়ার টাক, ধনুর্ধর লিটল্ জন, কত সব চরিত্র আর শেরউড বন তখন ছবির বইয়ের পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে উঠে আসত দীপাঞ্জনের কল্পনায়। আর আজ সে সেই যে গল্পকথার শেরউড বনে গভীর জঙ্গল, সেই আলোছায়ার খেলা, সেই নির্জনতা। মাঝে মাঝে পাখির শিস শোনা যাচ্ছে। যেমন সাংকেতিক শিক দিত রবিনহুড। দীপাঞ্জনের মনে হতে লাগল এই হয়তো অরণ্য ফুঁড়ে আবির্ভূত হবে রবিন ও তার অনুচররা রবিনের সেই চেনা মুখ, ছুচালো ছাগল দাড়ি চিবুকে, মাথার পালক গোঁজা টুপি, হাতে সরলরেখার মতো লম্বা তলোয়ার, পরনে কাঁধে আর হাতে ঝালর লাগানো মধ্যযুগীয় পোশাক, কোমরে শিঙা গোঁজা। যে শিঙা বাজিয়ে সে ডাক দিত বা সতর্ক করত তার সঙ্গীদের। দীপাঞ্জনের মনে হল সে যেন টাইম মেশিনে করে পৌঁছে গেছে আটশো বছর আগে ইংল্যান্ডের এই বনে।

    বনপথে যেতে যেতে শ্যানন বললেন, ‘এই বনাঞ্চলগুলোই কিন্তু নর্মান-স্যাক্সনদের বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল। এখানকার আদি অধিবাসী স্যাক্সনদের প্রধান নির্ভরশীলতা ছিল এই বনাঞ্চল। এখান থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করত। নর্মানরা ক্ষমতা দখলের পর শেরউড বন ‘রাজার বন’ বলে ঘোষিত হল। রাজার বনে স্যাক্সনদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা হরিণ শিকার নিষিদ্ধ হল। কেউ হরিণ শিকার করলেই তাকে ফাঁসিতে লটকানো হত। রাজার বনে হরিণ শিকার করতে পারবে শুধু রাজা। তার অনুগত নর্মান শেরিফরা ‘অরণ্যের অধিকার ও নর্ম্যান স্যাক্সনদের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ। সে সময়ের জনজীবন কাঠ আর খাদ্যদ্রব্যর জন্য অনেকাংশে বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ছিল।’ শ্যাননের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দীপাঞ্জনরা দেখতে পেল একটা বেশ বড়ো হরিণ সামনের রাস্তা পেরিয়ে একপাশের বন ছেড়ে অন্য দিকের বনে ঢুকে গেল। রিচমন্ড বলল, ‘এখনও এই বনে বেশ কিছু হরিণ আছে।’

    দীপাঞ্জন রবিনহুড গল্পে শেরিফ মওব্রের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলল, ‘রাজার বনে হরিণ শিকার করা নিষিদ্ধ।

    রিচমন্ডসহ সবাই হাসল তার কথা শুনে। রিচমণ্ডসহ সবাই এই উদ্ধৃতি পড়েছে রবিনহুডের গল্পে।

    বনপথ ধরে আরও ঘণ্টাখানেক চলার পর শেষ দুপুরে এক সময় জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দীপাঞ্জনদের চোখে পড়ল একটা প্রাচীন দুর্গ প্রসাদ।

    ৷৷ ৩ ৷৷

    জঙ্গলের মধ্যে আর্লদের জমিদার বাড়ি বা আর্লদের প্রাচীন প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল দীপাঞ্জনদের গাড়ি। নিছক প্রাসাদ বা বাড়ি না বলে এই স্থাপত্যকে মনে হয় দুর্গ বলাই ভালো। বহিঃগাত্রে কোনো দৃষ্টিনন্দন অলংকরণ নেই। নিষ্প্রাণ কঠিন পাথরের স্তম্ভ দেয়ালগুলো খাড়া হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে। নীচ থেকে দেখলে মনে হয় দুর্গর স্তম্ভগুলো যেন অনেক উঁচুতে উঠে এক সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রাসাদের মতো দৃষ্টিনন্দন ঝুলবারান্দাও নেই বহিঃদেশে। তার পরিবর্তে আছে অসংখ্য ছোটখাটো অন্ধকার গোলাকার গবাক্ষ। সম্ভবত গবাক্ষগুলোর আড়াল থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্যে তির নিক্ষেপ করা হতো । দুর্গ প্রাসাদে যে চারটে স্তম্ভ আছে তার গায়ের ছিদ্র আর মাথার ওপরের পাথরের জাফরি ঘেরা গম্বুজ দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো আসলে ছিল ‘নজর মিনার’। গাড়ির ভিতর থেকেই দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারল এক সময় গভীর পরিখা কাটা ছিল দুর্গের চারধারে। প্রবেশ মুখে ছিল একটা ‘ড্র-বিজ’। কপিকল ঘুরিয়ে লোহার সাঁকোটা তুলে নিলেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত এই দুর্গ প্রাসাদের। এখন অবশ্য স্থায়ীভাবে মাটির সঙ্গে এঁটে আছে সাঁকোটা। শুধু সেই সাঁকোর গায়ে আটকানো লোহার মোটামোটা ছিন্ন শিকলগুলো জানান দিচ্ছে যে একসময় সাঁকোটা ওঠানো নামানো যেত। আর একটা জিনিস অবশ্যই চোখে পড়ল তাদের। দুর্গ প্রাসাদের গায়ে, তির ছোড়ার গর্তে, গবাক্ষে অসংখ্য দাঁড়কাকের বাসা। কার্নিশগুলোতে বসে আছে সার সার দাঁড়কাক। যেন তারা এই দুর্গ স্থাপত্যরেই অংশ। কোনো কোলাহল বা চাঞ্চল্য নেই তাদের মধ্যে। ডু-ব্রিজ পেরিয়ে দুর্গ প্রাসাদের তোরণের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়ি। পাথরে তোরণের মাথার ওপর থেকে নেমে আসা চওড়া লোহার পাত দিয়ে তৈরি এক প্রাচীন খাঁচা গতিপথ রুদ্ধ করেছে গাড়িটার। সেই খাঁচার মাটি সংলগ্ন অংশগুলো বল্লমের ফলার মতো তীক্ষ্ণ। শতশত বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় লোহার পাতগুলো কালো হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও তার গায়ে কোথাও মরচে পড়েনি। মহাকালের প্রহরীর মতো সে আজও দাঁড়িয়ে দুর্গ-প্রাসাদের ভিতর শত্রু সেনা বা অবাঞ্ছিত লোকদের প্রবেশ রোধ করতে পারে। তার সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রিচমন্ড। সেই তোরণের পাশে প্রাকারের ফাঁক গলে সে ভিতরে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘড়ঘড় শব্দে মাথার ওপরে উঠে গেল খাঁচাটা। উন্মুক্ত হয়ে গেল প্রবেশপথ। সম্ভবত কপিকল ঘুরিয়ে ভিতর থেকে সেটা টেনে তুলল রিচমন্ড। তারপর আবার বাইরে বেরিয়ে কোচয়ানের আসনে উঠে বসে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করল ভিতরে পাথরের শান বাঁধানো প্রাচীন দুর্গ চত্বরে এসে থামল ঘোড়ার গাড়িটা। তার ভিতর থেকে মাটিতে নামল তারা তিনজন। দীপাঞ্জনদের সামনেই দুর্গর মূল স্থাপত্যে প্রবেশ করার জন্য লোহার পাত বসানো ভারী কাঠের এক বিশাল দরজা। সেই দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করার আগে রিচমন্ড বলল, ‘আপনাদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। বয়সের ভারে আর প্রাচীন বইপত্র পড়ার কারণে অনেক সময় অসংলগ্ন কথা বলেন আর্ল সেভার্ন। এমন কথা বলেন তিনি যাতে মনে হয় তিনি মধ্যযুগেই রয়ে গেছেন। তিনি মনে মনে এমনটাই ভাবেন। তাঁর অসংলগ্ন কথাবার্তার প্রতিবাদ করতে যাবেন না। তাঁকে তাঁর ভাবনা নিয়েই থাকতে দিন। এতে আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মনে আঘাত দিয়ে লাভ নেই। আমি প্রথমে আপনাদের তাঁর কাছেই নিয়ে যাব।’

    সেই কাঠের দরজা ঠেলে দীপাঞ্জনরা ভিতরে প্রবেশ করতেই একটা প্রাচীন গন্ধ এসে লাগল দীপাঞ্জনদের নাকে। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। একের পর এক কক্ষ অলিন্দ সিঁড়ি পাড় হয়ে দীপাঞ্জনরা এগিয়ে চলল রিচমন্ডের পিছন পিছন। আলো ছায়া খেলা করছে দুর্গর ভিতর। কোথাও ঘরের কোনো জমাট বাঁধা অন্ধকার, কোথাও আবার প্রাচীন গবাক্ষ দিয়ে আলো চুঁইয়ে ঢুকছে ভিতরে। আর তারই মধ্যে কোথাও দেয়ালের গায়ে ঝুলছে বিরাট শাখা-প্রশাখার মতো শিংওলা হরিণের মাথা, সাবেক কালের অস্ত্রশস্ত্র । কোথাও আবার সিঁড়ির কোণে দাঁড় করানো আছে প্রাচীন যোদ্ধাদের বর্ম। হঠাৎ সেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আপাদমস্তক শিরস্ত্রাণ আর বর্ম পরে বর্শা হাতে কোনো প্রহরী যেন দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের কোণে। এ সব দেখতে দেখতে দীপাঞ্জনরা এক সময় দুর্গর দ্বিতলে উঠে এল। সাধারণ বাড়িঘরের উচ্চতার নিরিখে অবশ্য একে চারতলাও বলা যেতে পারে। একটা লম্বা অলিন্দ পেরিয়ে দীপাঞ্জনদের নিয়ে রিচমন্ড প্রবেশ করল বেশ বড়ো একটা ঘরে। ঘরের ভিতর একটা মোমদানিতে মোম জ্বলছে। তার আভা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। ঘরের ঠিক মাঝখানে অনেকটা সিংহাসনের মতো, চেয়ারে বসে আছেন এক অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক। তার মাথার চুল আর বুক পর্যন্ত নেমে আসা দাঁড়ি ধবধবে সাদা শনের মতো। এমনকি তাঁর ভ্রূ পর্যন্ত সাদা। দেহের চামড়াও সাদা মোমের মতো। তাঁর পরনে লাল রঙের পোশাক। তাতে জরির কোমরবন্ধ। যদিও বয়সের ভারে সেই জ়রি এবং লম্বা ঝুলের গাউনের মতো পোশাকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। চেয়ারের হাতলে রাখা এক হাতের আঙুলে অনেক কটা রঙিন আংটি আছে। ধবধবে ফরসা আংটি পরা সেই শীর্ণ আঙুলগুলোর শেষ প্রান্তে অনেক দিনের না কাটা লম্বা নখ। তবে তা তার গাত্রবর্ণের মতোই সাদা। আর্লের অন্য হাতে ধরা আছে একটা ভেড়ার সিং এর শিঙা । শ্যাননকে ইশারায় টুপি খুলতে বলে, নিজের মাথার টুপি খুলে আর্ল সেভার্নের কাছে গিয়ে দাঁড়াল রিচমন্ড । তারপর সে আর্লের উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বলল, ‘মহামান্য আর্ল হুজুর, অতিথিদের নিয়ে ফিরে এসেছি আমি। আর্ল মনে হয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। রিচমন্ডের কণ্ঠস্বর শুনে ঘন নীল চোখ মেলে তার দিকে তাকালেন তিনি। তারপর বললেন, ‘ও তুমি ফিরে এসেছ? তা মহামান্য রাজা চার্লস আসার জন্য কিছু সংবাদ পাঠিয়েছেন কি? কাল তো তুমি দাঁড়কাকটা নিয়ে গেছিলে তাকে উপহার দেবার জন্য।

    দীপাঞ্জনরা অনুমান করল যে বৃদ্ধ আর্ল সম্ভবত সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় চার্লসের কথাই বলছেন। তাঁর কথার জবাবে রিচমন্ড বলল, ‘হ্যাঁ, তিনি আপনার উপহার গ্রহণ করেছেন, এবং অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন আপনাকে ।

    রিচমন্ডের কথা শুনে অশীতিপর আর্লের ঠোটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘তুমি দেখো এই গ্রীষ্মে রাজা নিশ্চয়ই হরিণ শিকার করার জন্য শেরউড বনে আসবেন এবং আমার আতিথ্য গ্রহণ করবেন।

    রিচমন্ড তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘আমি আপনার পক্ষে থেকে তাঁকে সেই আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছি। আশা করি তিনি আপনার আতিথ্য গ্রহণ করবেন।’

    রিচমন্ডের কথা শুনে আবারও বাচ্চা ছেলেদের মতো হাসলেন অতিবৃদ্ধ আর্ল । তারপর রিচমণ্ডকে বললেন, ‘রাজার বনে হরিণ শিকার কিছু নিষিদ্ধ। দুর্গের সৈনিকদের বোলো তারা যেন নিয়মিত জঙ্গলে যায় যাতে কেউ হরিণ শিকার না করে।’

    রিচমন্ড বলল, ‘আপনার রক্ষীরা নিয়মিতভাবে বন পাহারা দেয় হুজুর। আপনার কোনো চিন্তা নেই।’—এ কথা বলার পর রিচমন্ড তার কিছুটা তফাতে দাঁড়ানো দীপাঞ্জনদের দেখিয়ে আর্লকে বলল, ‘অতিথিরা আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে হুজুর। এদের কেউ এসেছে সুদূর ভারতবর্ষ বা জাপান থেকে, কেউ আয়ারল্যান্ড থেকে। আপনার প্রাসাদের ঐতিহ্যের কথা শুনে এরা এসেছে। আপনি অনুমতি দিলে এরা এ প্রাসাদে রাত্রিবাস করবে।’

    বৃদ্ধ এবার চোখ তুলে তাকালেন দীপাঞ্জনদের দিকে। তারা তিনজনেই মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল তাঁকে। দীপাঞ্জনদের নামগুলো এরপর রিচমন্ড একে একে জানিয়ে দিল। বৃদ্ধ আর্লের সঙ্গে সে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের। বৃদ্ধ আর্ল ভাসা ভাসা চোখে কিছুক্ষণ দীপাঞ্জনদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ‘ভারতবর্ষ, সে তো অনেক দূর । আয়ার্ল্যান্ডটা অবশ্য আমাদের দেশেই। তবে ‘ডিউক শ্যানন’ নামটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। রাজার হয়ে আমরা, আর্ল, ব্যারন, ডিউকরাই তো দেশটা শাসন করি। ওদের আমার অতিথিশালায় নিয়ে যাও। রক্ষীদের বলো বন থেকে হরিণ মেরে আনতে। নরফাক্কের ব্যারন আমার জন্য যে পানীয়ের পিপেটা পাঠিয়েছেন, সেখান থেকে পানীয় নিয়ে আর হরিণের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করো অতিথিদের। যেন আর্ল প্রাসাদের বদনাম না হয় ৷ আর একটা কথা, আমি এই শিঙা বাজালেই যেন রক্ষীরা প্রস্তুত হয় অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্য। রিচমন্ড বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন প্রভু। আমি সব ব্যবস্থা করছি। এখন আমি এদের অতিথিশালায় নিয়ে যাচ্ছি। পরে এরা আবার আসবে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আর আপনার শিঙা ফোঁকা ও অভিবাদনের কথা রক্ষীদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। যাই তবে?

    বৃদ্ধ ডিউক বলল, ‘হ্যাঁ যাও। আর রিচার্ডকে এ ঘরে দিয়ে যাও। তাকে খাবার দিতে হবে।’

    ‘এদের অতিথিশালায় পৌঁছে রিচার্ডকে আপনার কাছে দিয়ে যাচ্ছি।’—এই বলে আলকে আর একবার অভিবাদন জানিয়ে দীপাঞ্জনদের নিয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এল রিচমন্ড। তারপর সে দীপাঞ্জনদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘দেখলেন তো ওর মাথাটা কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেছে৷ উনি ভাবছেন উনি রয়েছেন সেই মধ্য যুগে। তেমনই কথাবার্তা বলেন উনি। মাঝে মাঝে কোনো সময় হয়তো তারও ঘোর কাটে।

    জুয়ান বললেন, ‘চার্লসের ব্যাপারটা তো বুঝলাম। তিনি টাওয়ার অব লন্ডনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস। কিন্তু রিচার্ড কে? রাজা রিচার্ড?’

    রিচমন্ড এবার হেসে ফেলে বলল, ‘না, এ রিচার্ড রাজা রিচার্ড নয়। এ রিচার্ড হলো একটা বড়ো দাঁড়কাক। নীচের কবর ঘরে থাকে। জানেন তো দাড়কাকরা দীর্ঘজীবী হয়। কাকটা আর্ল সেভার্নের বাবার আমলের। আর্লের বয়স আশি বছর। আর রিচার্ডের বয়স তারও বেশি। আর্লের ধারণা, রিচার্ড যত দিন বেঁচে থাকবে তিনিও ততদিন বাঁচবেন।’ দীপাঞ্জন আর জুয়ান দুজনেই বেশ অবাক হলো এ কথা শুনে। দীপাঞ্জন এরপর জানতে চাইল, ‘কবর ঘরটা কী? গুম ঘর নাকি ? ”

    অলিন্দ দিয়ে দীপাঞ্জনদের নিয়ে সামনের দিকে এগোতে এগোতে রিচমন্ড বলল, ‘প্রাচীন অভিজাত পরিবারের প্রথা ছিল পরিবারের সদস্যদের, বিশেষত পুরুষদের প্রাসাদ বা দুর্গের মধ্যে কোনো একটা ঘরে কবরস্থ করার। শত্রুপক্ষ যাতে মৃত্যুসংবাদ চট করে জানতে না পারে সে জন্যই প্রত্যেক প্রাসাদ বা দুর্গে একটা করে কবর ঘর থাকত। এখানেও মাটির তলায় তেমন একটা ঘর আছে। আপনাদের দেখাব সেটা। এখানকার প্রাচীন অস্ত্রাগারটাও দেখার মতো। নর্মান-স্যাক্সন আমলের বিভিন্ন অস্ত্র, যন্ত্রণাদায়ক যন্ত্র আছে সেখানে। আর আছে বেশ কিছু প্রাচীন অলংকার ও জহরত। সেগুলোর একটা বেচলেই হয়তো বাকি জীবনটা আর অর্থ কষ্টে কাটাতে হয় না আর্লকে। লন্ডনে তাঁকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাও করানো যায়। কিন্তু আর্ল তার একটাও বেচবেও না ।

    শ্যানন শুনে বললেন, ‘তাই নাকি? কিন্তু এখানে তো মিউজিয়ামের মতো কোনো রক্ষী নেই। জিনিসগুলো চুরি করতে পারে কেউ।’

    রিচমন্ড দীপাঞ্জনদের এনে থামল একটা জায়গাতে, সেখানে দেয়ালের গায়ে পাশাপাশি দুটো দরজা। রিচমন্ড বলল, ‘এ দুটো আপনাদের থাকার ঘর।’ তারপর সে শ্যাননের কথার জবাবে বলল, ‘প্রথমত বলি, এতবড়ো দুর্গে কোথায় সে জিনিসগুলো রাখা থাকে তা বাইরের লোকের পক্ষে জানা মুশকিল। দ্বিতীয়ত বলি এ প্রাসাদে চুরির চেষ্টা যে কখনও হয়নি তা নয়। তবে তা সফল হয়নি। এ প্রাসাদের অদৃশ্য রক্ষী আছে। তবে নিরাপত্তার কারণে তাদের সম্বন্ধে বলা যাবে না।’ এক অদ্ভুত কথা বলে দীপাঞ্জনদের ঘর দেখিয়ে এরপর পরে আসবে বলে চলে গেল রিচমন্ড।

    একটা ঘরে দীপাঞ্জন আর জুয়ান, আর অন্য ঘরে ঠাঁই হলো শ্যাননের। দীপাঞ্জনদের ঘরটা মাঝারি আকারের। একটা ভিক্টোরিয়ান আমলের পালঙ্ক আর দুটো কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল আছে সে ঘরে। দেয়ালে ঝুলছে পোকায় কাটা একটা ভাল্লুকের মাথা, আর মরচে পড়া একটা তলোয়ার। ঘর সংলগ্ন একটা বারান্দা আছে। সেখানে দাঁড়ালে চোখে পড়ে শেরউডের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। ঘরে বাতাস আসছে সেদিক থেকে। দুর্গ প্রাকারের মাথা থেকে এক ঝাঁক দাঁড়কাক উড়ে গেল জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের মাথার আকাশে এক পাক খেয়ে তারা আবার ফিরে দুর্গ প্রাসাদে। ধীরে ধীরে বেলা পড়ে আসছে।

    দীপাঞ্জন, জুয়ানকে জিজ্ঞেস করল, ‘রিচমন্ডের শেষ কথাগুলো কিন্তু বেশ অদ্ভুত। এ প্রাসাদে অদৃশ্যরক্ষী আছে। ও কি অদৃশ্যরক্ষী বলতে কোনো ভূত প্রেত অপদেবতার কথা বলছে? অনেক সময় এ সব প্রাচীন দুর্গ প্রাসাদ ইত্যাদি নিয়ে নানা অতিপ্রাকৃত কাহিনি শোনা যায়। প্রাচীন প্রেতাত্মারা নাকি তাঁর উত্তরপুরুষদের আর পারিবারিক সম্পত্তি রক্ষা করে। নাকি আমাদের দেশের মতো যখের কাছে এরা সম্পত্তি গচ্ছিত রাখে ?

    জুয়ান বলল, ‘কথাটা আমারও অদ্ভুত লাগল। কিন্তু দামি জিনিস রক্ষা করার জন্য প্রেতপ্রহরীদের ওপর কী কেউ নির্ভর করে ?

    জুয়ান এরপর বললেন, ‘এই দুর্গে প্রাসাদটা কিন্তু বেশ লাগছে আমার। পুরোটা ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে।’

    দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কদিন থাকব আমরা?”

    জুয়ান জবাব দিলেন, ‘কাল রাতটাও থাকব। পরশু ভোরে রওনা দেব।’

    আধঘণ্টা পর ঘরে ঢুকল রিচমন্ড। এক হাতে একটা মোমদানিতে বড়ো মোমবাতি, অন্য হাতে ট্রেতে সাজানো ধূমায়িত চায়ের কাপ। সেগুলো সে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বলল, ‘চা-পান করে বাইরে আসুন। আজ আপনাদের আমারি আর পানিসমেন্ট রুমটা দেখাই। সারা দুর্গ এখন ঘুরিয়ে দেখানো যাবে না। এখানে আলোর ব্যবস্থা নেই। দুর্গের অন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো আমি কাল আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাব।’

    চা-পান করে কিছুক্ষণের মধ্যেই অলিন্দে এসে দাঁড়াল তারা দুজন। লর্ড শ্যাননও ঘর থেকে বেরিয়ে রিচমন্ডের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন। রিচমন্ড সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলল অস্ত্রাগারের দিকে। নানা বাঁক, ছোটোছোটো পাথরের সিঁড়ি, নানা খুপরি খুপরি দরজার অসংখ্য গোলকধাঁধা পেরিয়ে তারা হাজির হলো বিশাল এক দরজার সামনে। লোহার চওড়া পাটি বসানো কাঠের দরজাতে বিরাট বড়ো একটা তালা ঝুলছে। রিচমন্ড পকেট থেকে একটা লম্বা চাবি বার করে তালাটা খুলে ফেলে দীপাঞ্জনদের নিয়ে প্রবেশ করল অন্ধকার ঘরটাতে। তারপর একটা জানালা খুলতেই পশ্চিমের শেষ আলো এসে আলোকিত করে তুলল ঘরটা। বেশ বড়ো ঘর। তার চারপাশের দেয়ালের গায়ে টাঙানো আছে নানা ধরনের অস্ত্র। দেয়ালের কোণগুলোতে দাঁড় করানো আছে শিরস্ত্রাণসমেত বর্মগুলো । রিক যেন মানুষের মূর্তি। সিলিং থেকে ঝুলছে প্রায় পনেরো ফুট লম্বা কয়েকটা ধাতব শূল। সেগুলো দেখিয়ে রিচমন্ড বলল, ‘দেয়ালের কোণে রাখা বর্ম আর শুলগুলো দিয়ে মধ্যযুগে নাইটরা লড়াই করতেন। ঘোড়ায় চেপে এই দানবীয় শূল নিয়ে দু-প্রান্ত থেকে নাইটরা ছুটে আসতেন পরস্পরকে বিদ্ধ করার জন্য। অসীম শক্তিধর ছিলেন তারা শূল আর বর্মর ওজনই ছিল চারশো পাউন্ড। এ দুর্গেও একবার নাইটদের লড়াই হয়েছিল। নাইট এডোয়ার্ড আর নাইট ব্রাইটহুডের মধ্যে নীচের চত্বরে। নাইট এডোয়ার্ড নিহত হন তাতে।’

    জুয়ান বললেন, ‘নাইটদের যুগ মানে তো অনেককাল আগের ঘটনা?’ রিচমন্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেককাল আগের ঘটনা। আসলে এ দুর্গ প্রথমে বানিয়ে ছিল নর্ম্যানরা। তখন অবশ্য এটা কলেবরে অনেক ছোটো ছিল। কিন্তু স্যাক্সনদের আক্রমণে নর্মান সেনারা দুর্গ ছেড়ে পালাবার পর এটা স্যাক্সনদের অধিকারে আসে। কিন্তু স্যাক্সনরাও এক সময় দুর্গ ছেড়ে চলে যায়। পরিত্যক্ত দুর্গ হয়ে ওঠে কাকের বাসা। বর্তমান আর্লের প্রথম পূর্বপুরুষ যিনি এখানে প্রথম এসে থাকতে শুরু করেন তিনি ছিলেন শিকারি। দাবিহীন এই দুর্গে তারপর তাঁর বংশধররাও থাকতে শুরু করেন। শিকারজাত পশুপাখির মাংস-চামড়া ইত্যাদি রাখা হত এখানে। হয়তো সে জন্যই কাকেদের সমাগম এ দুর্গে বেশি হয়ে ওঠে। স্যাক্সন-নর্মানদের লড়াই তখন স্তিমিত হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে তখন নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজা দ্বিতীয় চার্লস একবার শেরউড বনে শিকার করতে এসে এ দুর্গের সন্ধান পান। কিন্তু কাক ভরতি ভাঙাচোরা ছোটো দুর্গ দেখে তিনি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কিন্তু এ দুর্গের কথা তার মনে আসে টাওয়ার অব লন্ডনের ঘটনার সময়। যখন তিনি কাকের সন্ধান করছেন। আর্ল সেভার্নের পূর্বপুরুষ স্টুয়ার্ট তখন এখানে বাস করছেন। রাজার পাঠানো লোকদের তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে দুর্গ বুরুজের খাঁজের থেকে ছ’টা দাঁড়কাক ধরে দেন। রক্ষা পায় টাওয়ার অফ লন্ডন। দ্বিতীয় চার্লস খুশি হয়ে স্টুয়ার্টকে ডেকে পাঠান লন্ডনে। তিনি তাকে ‘আর্ল’ অর্থাৎ জমিদার উপাধিতে ভূষিত করেন ও দুর্গ সংলগ্ন কয়েক মাইল এলাকার ভূমিস্বত্ব প্রদান করেন ও অর্থ সাহায্য করেন দুর্গ পুর্ননির্মাণের। প্রথম আর্ল স্টুয়ার্টের হাত ধরে নতুন ভাবে গড়ে ওঠে এই দুর্গপ্রাসাদ। রাজার শর্ত ছিল একটাই। টাওয়ার অফ লন্ডনকে রক্ষা করার জন্য যখনই দাঁড়কাকের প্রয়োজন হবে তখনই সরবরাহ করতে হবে এখান থেকে। তাই কোনো অবস্থাতেই কাকেদের এখান থেকে তাড়ানো চলবে না। সেই থেকে কাকেদের পাকাপাকি বাসস্থান এ জায়গা। এক সময় রাজকোষ থেকে এখানে অর্থ আসত দাঁড় কাকেদের পরিচর্যার জন্য। একটু খেয়াল করে দেখবেন এই দাঁড়কাকগুলোর প্রজাতি সাধারণ দাঁড়কাকের থেকে বড়ো।’

    আর্মারি বা অস্ত্রাগারের অন্য জিনিসগুলো এরপর দেখতে লাগল তারা। কত ধরনের তীরধনুক, তলোয়ার, বর্শা, ভল্ল, ঢাল, লোহার ঝালরের মতো বর্ম। একটা যুদ্ধ কুঠার তোলার চেষ্টা করল দীপাঞ্জন। কিন্তু দুহাতে ধরেও জিনিসটা ফুট খানিকের বেশি ওপরে ভুলতে পারল না। অথচ রিচমন্ড বলল যে যোদ্ধারা নাকি ঘোড়ার পিঠে চেপে এ কুঠার এক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করত! কত অসীম শক্তিধর ছিল তারা!

    আর্মারি দেখার পর আবার অলিন্দ সিঁড়ির গোলকধাঁধা পেরোতে শুরু করল তারা। এগোতে এগোতে শ্যানন বললেন যে ইচ্ছা করেই নাকি দুর্গ প্রাসাদের নকশা সে সময় জটিলভাবে বানানো হতো। যাতে শত্রুপক্ষ ভিতরে ঢুকলে ঠিক মতো পথ চিনতে না পারে। কিছুক্ষণের মতোই তারা এসে দাঁড়াল একটা সুড়ঙ্গ মতো জায়গাতে। সামনে একটা দরজা। তার তালা খোলার পর সে ঘরে ঢুকল দীপাঞ্জনরা। পকেট থেকে একটা মোমবাতি বার করে জ্বালাল রিচমন্ড। সে ঘরে একটাই মাত্র জানলা সেটা আবার লোহার পাত দিয়ে আটকানো। রিচমন্ড বলল, ‘এটা দুর্গের পিছন দিকের একটা ঘর। বাইরে থেকে অস্তিত্ব বোঝা যায় না। এ ঘরের কোনো শব্দ বাইরে যায় না। তবে বাইরের শব্দ এ ঘরে বসে শোনা যায়। অবাধ্য প্রজাদের এ ঘরে এনে শাস্তি দেওয়া হতো। কেউ যন্ত্রণায় মারা গেলে তাকে জানলা দিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হতো। ঘন অরণ্য ছিল ওখানে। জানোয়ারের দল এসে খেয়ে যেত তার দেহ।’

    আলো আঁধারি ঘরটার দেয়ালে অসংখ্য গজাল পোঁতা। তার থেকে শিকল ঝুলছে এখনও। ওখানেই বাঁধা হতো ধরে আনা লোকদের। বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিস রাখা আছে ঘরের মধ্যে। ঘরের ঠিক মাঝখানেই রাখা অনেকটা ঢেঁকির মতো দেখতে ঢালু একটা পাটাতন। ওর ওপর শুইয়ে পিঠে চাবুর মারা হতো হতভাগ্য লোকদের। এক একটা করে যন্ত্রণা ঘরের জিনিসগুলো দেখাতে দেখাতে তার কর্ম পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে লাগল রিচমন্ড ৷ লোহার তৈরি জুতো, পায়ে পরিয়ে তার নাটের প্যাচ ঘুরিয়ে ভেঙে দেওয়া হতো পায়ের পাতা। রয়েছে কাঠের ভারী মুগুর। যা দিয়ে মেরে মাথা বা হাত-পা ভেঙে দেওয়া হতো। একটা বড়ো লোহার সাঁড়াশি দেখিয়ে রিচমন্ড বলল, তা দিয়ে নাকি বন্দিদের জিভ টেনে ছেঁড়া। তার কথা শুনে শিউরে উঠতে লাগল দীপাঞ্জনরা। মধ্যযুগীয় বর্বরতার চূড়ান্ত নিদর্শন এই ঘরটা!

    সেই ঘর ছেড়ে একসময় বেরিয়ে এল তারা। নিজেদের ঘরে ফেরার জন্য তারা অলিন্দ ধরে হাঁটছে হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দে চমকে উঠল তারা। সেই শব্দে সারা অলিন্দ দুর্গ প্রাসাদ যেন কেঁপে উঠতে লাগল। দাঁড়কাকের ডাক।

    রিচমন্ড বলল, ‘সারাদিন কাকগুলো চুপচাপ থাকে। কিন্তু সূর্যোদয়ের সময় আর সূর্য ডোবার সময় তারা একযোগে ডেকে ওঠে। সে ডাক দুর্গবুরুজে, প্রাকারে, প্রতিধ্বনিত হয়ে এমন অদ্ভুত শব্দের সৃষ্টি করে।”

    বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই অদ্ভুত শব্দ অনুরণিত হতে থাকল দুর্গ-প্রাসাদের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। তারপর ধীরে ধীরে সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল একসময়। শেরউড বনের মাথায় অন্ধকার নেমে এল।

    ৷৷ ৪ ৷৷

    মোম জ্বালিয়ে ঘরে বসে গল্প করছিল দীপাঞ্জন আর জুয়ান। দীপাঞ্জনদের ঘরে পৌঁছে দেবার এক ঘণ্টা পর আবার রিচমন্ড ফিরে এসে বলল, ‘আপনাদের বিরক্ত করার জন্য মার্জনা চাচ্ছি। আর্ল সেভন আপনাদের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন। আসলে মাথাটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে তো। এক এক সময় এক এক খেয়াল চাপে ওর মাথায়। আপনাদের সঙ্গে উনি কী কথা বলবেন কে জানে? কিন্তু আবার না গেলে আমার ওপর রাগারাগি শুরু করবেন।’

    জুয়ান বললেন, ‘আমরা কোনো বিরক্তি বোধ করছি না। আমরা তো ঘরেই বসে আছি, তার চেয়ে আর্লের সঙ্গে কথা বলে আসাই ভালো।’

    ঘর ছেড়ে বেরোল দীপাঞ্জনরা। শ্যাননকেও ডাকা হলো। তিনি বেশ উৎসাহিত হলেন আর্ল ডেকেছেন বলে৷

    রিচমন্ড একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখেছিল দীপাঞ্জনদের দরজার বাইরে একটা কুলুঙ্গিতে। সেটা হাতে করে দীপাঞ্জনদের সঙ্গে নিয়ে সে এগোল অলিন্দ ধরে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই এই নির্জন প্রাসাদটা যেন আরও নিঝুম হয়ে গেছে। অলিন্দের প্রতিটা কোণে জমাট বেঁধে আছে চাপচাপ অন্ধকার। অলিন্দ থেকে নীচের পাথর বাঁধানো প্রাচীন চত্বরটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদ উঠতে শুরু করেছে আকাশে। তার আলো এসে পড়েছে জাফরিঘেরা অলিন্দে, নীচের সুপ্রাচীন চত্বরে। কেমন যেন আধিভৌতিক পরিবেশ বিরাজ করছে অলিন্দ, নীচের চত্বর সহ চারদিকে! গা ছমছমে পরিবেশ চারদিকে। এই পরিবেশ দেখে রিচমন্ডকে দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘এইসব প্রাচীন দুর্গ বা প্রাসাদে নানা অতৃপ্ত আত্মার দেখা মেলে বলে শুনেছি। যেমন টাওয়ার অফ লন্ডনে’ নাকি রানি অ্যানি ব্যেলিয়নের প্রেতাত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে কেউ কেউ! এখানে তেমন কিছু নেই?’ টাওয়ার অফ লন্ডনে প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াবার কথা অবশ্য দীপাঞ্জনের জুয়ানের মুখ থেকে শোনা। সেটাই বলল সে। চলতে চলতে দীপাঞ্জনের প্রশ্ন শুনে হঠাৎই যেন একটু থমকে দাঁড়িয়ে দীপাঞ্জনের মুখের দিকে তাকাল রিচমন্ড। তারপর আবার এগোতে এগোতে বলল, ‘হ্যাঁ, তেমন একজন আছে এখানে। আমি একবার তাঁকে দেখেছি। আর্ল সেভার্ন আর এ দুর্গ প্রাসাদে যারা আগে কাজ করতেন, তারা অনেকেই তাঁকে দেখেছেন। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের পর সিংহাসনে বসেন রাজা দ্বিতীয় জেমস। তারপর স্টুয়ার্ট রাজবংশের বদলে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন অরেঞ্জ রাজবংশের রাজা তৃতীয় উইলিয়াম। তখন এখানকার দুর্গধীপ আর্ল রোলান্ড। তাঁর এক বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন তাঁর নাম জর্জ। রাজা উইলিয়ামের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। আর্ল রোনান্ডের ধারণা হয় তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই জর্জ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন এবং রাজা উইলিয়ামকে প্রভমিত করে আর্ল জমিদারির দখল নেবেন। সে সময় কিছু দাঁড়কাক মারা যায় প্রাসাদে। যে কারণে রোনাল্ডের ওপর রুষ্ট হন রাজা। দাঁড়কাক মৃত্যুর খবরটা নাকি রাজার কানে পৌঁছে নিয়েছিলেন জর্জই। যাই হোক প্রমাদ গুনলেন দুর্গধীপ রোনাল্ড। তিনি ঠিক করলেন জর্জকে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। জর্জকে কিছু বুঝতে দিলেন না তিনি। একদিন তিনি তাঁকে নিয়ে যাত্রা করলেন শেরউড বনে হরিণ শিকার করতে। সঙ্গে আর্লের একান্ত বিশ্বস্ত কিছু অনুচর। কিন্তু তিনদিন পর তিনি জর্জকে ছাড়াই ফিরলেন দুর্গ প্রাসাদে। সবাইকে তিনি বললেন হরিণের পিছু ধাওয়া করতে করতে নাকি জর্জ হারিয়ে গেছেন শেরউড বনের গভীরে। সে সময়ে শেরউড বন কয়েকশো মাইল বিস্তৃত ছিল। আসলে ঘটনা হলো, তিনি বনের মধ্যে হত্যা করেছিলেন তাঁর ভাইকে। জর্জের মৃতদেহ যাতে কেউ শনাক্ত না করতে পারে এরপর তিনি সে জন্য জর্জের মুণ্ডু কেটে এনে লুকিয়ে ফেলেন এ দুর্গের কোনো এক জায়গাতে। কেউ তার সন্ধান পায়নি। জর্জের প্রেতাত্মা সেই কাটা মুণ্ডুর খোঁজে ঘুরে বেড়ায় এ প্রাসাদে। আমি তাকে একবার দেখেছি স্পষ্টভাবে। জ্যোৎস্না আলোতে কবর ঘরের নীচ থেকে বেরিয়ে আসছিল সে। তাঁর পরনে কালো গাউন। রক্তাক্ত কবন্ধ। আল সেভার্ন সহ অনেকেই বিভিন্ন সময় দেখেছে তাঁকে।

    দীপাঞ্জনরা ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না। এমনি দীপাঞ্জন কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল। কথা বলতে বলতেই তারা প্রবেশ করল আর্ল সেতারে কক্ষে বর্তমানে রয়েছেন সে ঘরে। এ ঘরটা সে ঘর নয়, যে ঘরে দীপাঞ্জনদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল বৃদ্ধ আর্লের। ঘরে একটা মশলা জ্বলছে। দেয়ালের চারপাশে কাঠের র‍্যাকে সাজানো আছে চামড়ায় মোড়া মোটা মোটা বই। দেখেই বোঝা যায় এটা লাইব্রেরি। টেবিলের ওপর আর্লের সেই শিঙাটা, কিছু বই আর সংবাদপত্র রাখা আছে। সংবাদপত্রগুলো টাটকা। এক হাত দিয়ে একটা আতসকাঁচ ধরে কী একটা মোটা বই দেখছিলেন আর্ল সেভার্ন। বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন তিনি। দীপাঞ্জনদের সঙ্গে নিয়ে টেবিলের সামনে উপস্থিত হয়ে আর্লকে রিচমণ্ড বলল, ‘অতিথিরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন হুজুর।’

    ‘কেন দেখা করতে এসেছে?’ মৃদু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন আর্ল ।

    রিচমন্ড বলল, ‘আপনিই তো ওনাদের সাক্ষাৎ করার জন্য ডাক পাঠিয়েছেন।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আর্ল জুয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কী রাজার বনে হরিণ শিকার করতে এসেছ?”

    জুয়ান জবাব দিলেন, ‘না, মহামান্য আর্ল। আমরা আপনার দুর্গ দেখতে এসেছি।’ দুর্গ দেখতে এসেছ? নাকি জর্জের কাটা মুণ্ডু খুঁজতে?”

    জুয়ান বললেন, “তা নয়। দুর্গ দেখতেই এসেছি।’

    আর্লের এবারও কথাটা বিশ্বাস হলো না। তিনি প্রথমে বললেন, ‘এ বার বুঝেছি তোমরা কারা। রবিন তোমাদের পাঠিয়েছে।’ তারপর চারপাশে তাকিয়ে তার কথা যেন কেউ শুনতে না পায় এমন ভাবে গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, ‘রবিনকে বোলো, তার জিনিসটা যত্ন করে রেখেছি আমি ।

    শ্যানন এবার প্রশ্ন করলেন, ‘কোন্ জিনিসটা ?”

    আর্ল বললেন, ‘যে জিনিসটা সে রেখে গেছিল এখানে। পরে নিয়ে যাবে বলেছিল….. রিচমন্ড চাপা স্বরে বলল, ‘ওনার মাথাটা এখন একদম গেছে। কালতো পূর্ণিমা, আসলে অমাবস্যা-পূর্ণিমা এলে ওর মাথার গণ্ডগোলটা একটু বাড়ে।”

    শ্যানন কথাটা শুনে মৃদু হেসে আর্লকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ঠিক আছে রবিনকে আমরা খবরটা দিয়ে দেব।’ আর্ল সেভার্নও যেন আশ্বস্ত হলেন তাঁর কথা শুনে। তিনি শ্যাননকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কী স্যাক্সন? তোমার নাম যেন কী ?” ‘লর্ড শ্যানন।’ জবাব দিলেন শ্যানন।

    ‘লর্ড শ্যানন, লর্ড শ্যানন…নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন শুনেছি মনে হয় !” বিড়বিড় করে কথাগুলো বললেন আর্ল। এ কথাটা তিনি প্রথম সাক্ষাতেও বলেছিলেন। হয়তো শ্যাননের নামের আগে ‘লর্ড’ শব্দটা আছে বলেই তাঁর নামটা চেনা লাগছে এমনও হতে পারে।’

    সেভার্ন এরপর আর্লের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘অতিথিরা এখন তাহলে ফিরে যাক হুজুর। আপনারও ডিনারের সময় হয়ে গেছে।’

    আর্ল বললেন, ‘হ্যাঁ যাক তবে। ডিনারে আমি শূকরের রোস্ট, আর হরিণের মাংসের পুর দেওয়া রুটি খাব।’

    রিচমন্ড বলল, “আচ্ছা হুজুর। তাই খাবেন।’ কথাগুলো বলে দীপাঞ্জনদের নিয়ে ঘরের বাইরে যাবার সময় শ্যানন বললেন, ‘ওঁর টেবিলে একটা টাটকা সংবাদপত্র দেখলাম সেটা পাওয়া যাবে কি? আসলে এখন ঘরে ফিরে তো কোনো কাজ নেই, সংবাদপত্রর পাতা উলটে একটু সময় কাটানো যেত।’

    দীপাঞ্জনরা সে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল আর রিচমন্ড আর্লের টেবিল থেকে সংবাদপত্রটা এনে দিল শ্যাননের হাতে। দীপাঞ্জন দেখল সেটা লন্ড টাইমস্-এর একটা ট্যাবলয়েড সংস্করণ। কাগজটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘এখানে খবরের কাগজ দেখে খুব অবাক হলাম। কাছে পিঠে তো আর কোনো ঘরবাড়ি নেই। কাগজঅলাদের খরচ পোষায়?’

    রিচমন্ড বলল, ‘হকার আসে না, ডাকে আসে। সকালবেলা একটা ডাকগাড়ি যা এখান দিয়ে। সেই ফেলে দিয়ে যায়। আপনার কাগজটা গতকালের সংস্করণ। ডাকে আসে বলে একদিন পরে আসে কাগজটা। আর্লের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগসূত্র বলতে এই কাগজটাই বাকি সময় তিনি আর্ল-ব্যারন-ডিউকদের কাহিনি পড়েন। পারিবারিক ইতিহাস পড়েন।’

    জুয়ান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ওঁনার পূর্বপুরুষরা নর্মান না স্যাক্সন ছিলেন?”

    রিচমন্ড বললেন, ‘এটা কিন্তু একটা মজার ব্যাপার। আর্লের প্রথম যে শিকারি পূর্বপুরুষ এখানে এসে থাকতে শুরু করেন, তিনি ছিলেন একজন দলছুট নর্ম্যান। সে অর্থে আর্ল হলেন নর্ম্যান। যে যুগে এখানে দুর্গ গড়ে উঠেছিল সে যুগে নর্ম্যান-স্যাক্সনদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক হলেও আর্ল সেভার্নের আদি পূর্বপুরুষদের সঙ্গে কোনো অজানা কারণে স্যাক্সনদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তারা কোনোদিন হামলা চালায়নি এ দুর্গে। কথা বলতে বলতে আলো-আঁধারি অলিন্দ দিয়ে এগোচ্ছিল দীপাঞ্জনরা। হঠাৎই একটা বাঁকের অন্ধকার থেকে বিশাল একটা ছায়া যেন উড়ে এল দীপাঞ্জনদের দিকে । রিচমন্ডের হাতে ধরা মোমবাতিটা দপদপ করে কেঁপে উঠল। বাতাসের একটা ঝাপটা লাগল দীপাঞ্জনদের গায়ে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েল দীপাঞ্জনরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ছায়াটা দীপাঞ্জনদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে হারিয়ে গেল পিছনের অন্ধকারে।

    দীপাঞ্জনের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে দেখে রিচমন্ড হেসে বলল, ‘ও হলো সেই রিচার্ড। এ দুর্গের সবচেয়ে প্রাচীন বাসিন্দা। নীচের কবর ঘরে থাকে। রোজ রাতে একবার উড়ে এসে আর্লের ঘরে ঢোকে। আর্লের হাত থেকে খাবার খায়। আর্ল গল্প করেন ওর সঙ্গে। এমনি দাঁড়কাকের থেকেও ও আকারে বড়ো। আলো ছায়ার খেলায় ওকে আরও বড়ো দেখাল এখন। আর্ল সেভার্নের মতো ওকেও কিন্তু ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করতে হয় আমাকে।’

    দীপাঞ্জনদের ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল রিচমন্ড। তারপর সে আবার ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে খাবার দিয়ে গেল। হরিণের মাংসের রোস্ট আর নরফক্সের ব্যারানের পাঠানো পানীয় নয়। সাধারণ মাংসের স্যুপ আর পাউরুটি। মহামান্য আর্লের জন্যও নাকি এই খাবারই বরাদ্দ। তবে আর্লকে খাবার দেবার সময় নাকি বলতে হবে যে রুটিটা নাকি বাকিংহাম প্যালেসের উপহার। আর সুরুয়া বানাবার জন্য তাঁর সেরা ভেড়াটা নজরানা দিয়েছে আর্লের এক অনুগত প্রজা।—এ কথা যাবার আগে নিজেই জানিয়ে গেল রিচমন্ড। খাওয়া সেরে বেশ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল দীপাঞ্জনরা।

    বেশ রাতে হঠাৎই কেন জানি ঘুম ভেঙে গেল দীপাঞ্জনের। বাতি নেভালেও দরজা খুলে শুয়েছিল তারা। চোর ডাকাতের ভয় নেই বলে। তাদের মাথার পিছনে খোলা দরজা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। হঠাৎ তার কানে এল একটা খটখট শব্দ, যেন কাঠের জুতো পায়ে ঘরের সামনের অলিন্দে কেউ হাঁটছে! আর এরপরই সে খেয়াল করল মাঝে মাঝে ঘরটা কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ খোলা দরজার পাল্লার যে ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে যে জায়গাটা মাঝে মাঝে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কি পায়চারি করছে ঘরের সামনে? হ্যাঁ, খটখট শব্দটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কখনও সেটা কাছে আসছে, কখনও বা একটু দূরে চলে যাচ্ছে! এই শব্দটাই সম্ভবত ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে দীপাঞ্জনের। সে শব্দটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলো। কিন্তু এত রাতে কে হাঁটে? শ্যানন কি ঘুম আসছে না বলে পাশের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পায়চারি করছেন? নাকি রিচমন্ড? শব্দটা হয়েই চলেছে খট খট। খট খট। মাঝে মাঝে একটু থামছে, তারপর আবার হচ্ছে।

    ব্যাপারটা দেখার জন্য নিঃশব্দে খাট ছেড়ে নেমে দীপাঞ্জন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। বাইরে তাকাতেই সে দেখতে পেল তাকে, এবং চিনেও ফেলল তাকে। অলিন্দের গায়ে রেলিং এর ওপর গম্ভীরভাবে পায়চারি করছে সে। বিশাল একটা কাক। সাধারণ দাঁড়কাকের চেয়ে সে দ্বিগুণ বড়ো, পাতি কাকের চারগুণ হবে। রিচার্ড!

    মাঝে মাঝে সে তার বিরাট ঠোঁটটা ঠুকছে রেলিং-এ, আর সে জন্যই খটখট শব্দটা হচ্ছে, প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা ঠোঁট তার। তবে তাকে দেখে হেসে ফেলল দীপাঞ্জন। মনে মনে ভাবল, এ ভাবেই মানুষ ভয় পায়, ভূত দেখে! দীপাঞ্জন অলিন্দে বেরিয়ে রেলিং-এর কাছে যেতেই কাকটা তার বিশাল ডানা মেলে চাঁদের দিকে উড়ে গিয়ে দুর্গের অন্য প্রান্তে এক বুরুজের মাথায় গিয়ে বসল। তারপর ওপর থেকে ঘাড় নীচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করতে লাগল। দীপাঞ্জন গিয়ে দাঁড়াল রেলিং এর ধারে। নিঝুম দুর্গ প্রাসাদ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মাথার ওপর থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে দুর্গ প্রকারে। অলিন্দে, বুরুজে, নীচে শান বাঁধানো পাথুরে চত্বরে। চাঁদের আলোতে যেন আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে এই দুর্গ প্রাসাদ। হাজার বছর ধরে কত ইতিহাস জমা হয়ে আছে এই দুর্গ প্রাসাদে, কত হাসি-কান্না চাপা পড়ে আছে এই পাথরগুলোর আড়ালে! শুধু হাজার কেন? একশো বছরই বা কম কীসে? তার মধ্যেই তো ঘটে যায় কত ঘটনা ? ওই যে চাঁদের আলোতে বুরুজের মাথায় বুড়ো কাকটা বসে আছে একমাত্র সেই হয়তো দেখেছে সব কিছু,—এসব কথা ভাবতে ভাবতে নীচের চত্বরের দিকে তাকাল দীপাঞ্জন। চারপাশ স্তব্ধ আর দেয়াল দিয়ে ঘেরা চত্বরটা চাঁদের আলোতে খাঁ খাঁ করছে। বড় বড় স্তম্ভগুলোর ছায়া এসে পেড়ছে চত্বরে। এক সময় হয়তো নর্ম্যানরা, স্যাক্সনদের ওই চত্বরে বেঁধে আনত তাদের যন্ত্রণা ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। ওখানেই হয়তো লড়াই হত নাইটদের, ঘোড়ার খুরের শব্দ আর অস্ত্রর ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠত চত্বর, উৎসবের সময় বিউগল আর ড্রাম বাজত, ওই চত্বরের মাঝেই হয়তো শিকার করতে এসে দুর্গে ঢুকে ঘোড়ার পিঠে বলদর্পী ভঙ্গিতে একদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। কিন্তু সময় সব কিছু কেড়ে নেয়। সেদিনের সেই কোলাহল মুখর চত্বর আজ নিঝুম, ম্লান।

    চত্বরটার দু-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা থামগুলোর আড়ালে ছোটো-বড়ো অনেক ঘর রয়েছে। ওপরে ওঠার বেশ কিছু সিঁড়িও রয়েছে সেখানে। চত্বরের দিকে রেলিং ধরে তাকিয়ে ছিল দীপাঞ্জন। হঠাৎই তার মনে হলো একটা থামের ছায়া যেন নড়ছে। আর তারপরই সে এক অদ্ভুত, অকল্পনীয় দৃশ্য দেখতে পেল। থামের আড়ালের অন্ধকার থেকে চাঁদের আলোতে বেড়িয়ে এল এক অদ্ভুত মূর্তি। পরনে তার মধ্যযুগীয় লম্বা ঝুলের কালো আলখাল্লার মতো পোশাক, কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে লম্বা তলোয়ার। দেখে মনে হয় সেই পুরুষ যথেষ্ট দীর্ঘকায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো দীপাঞ্জন ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছে সেই মূর্তির কোনো মাথা নেই! কবন্ধ মূর্তি সেটা! নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু সেটা কবন্ধই। চাঁদের আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মুণ্ডুর পরিবর্তে যে জায়গাতে মাথা থাকে সেখানে ঘাড়ের ওপর দগদগে একটা ক্ষত। যেন এক কোপে তার মুণ্ডুটা কেটে ফেলা হয়েছে এখন। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তার পরই মূর্তিটা লম্বা লম্বা পা ফেলে চত্বর পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্যদিকের আড়ালে। আর এরপরই বুরুজের মাথার ওপর থেকে কাকটা শোঁ করে চত্বরের দিকে নেমে গেল। নীচে নেমে সে বাঁক নিয়ে সে সেই কবন্ধ মূর্তি যেদিকে অদৃশ্য হলো সেদিকেই অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। দীপাঞ্জনের মাথার ভিতর কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই মুণ্ডুহীন আর মূর্তি কী জর্জের প্রেতাত্মা? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে সে ভাবতে লাগল দৃশ্যটার কথা। সময় কাটতে লাগল। আর তার পরই একসময় হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে সেই অদ্ভুত শব্দে যেন কাঁপতে লাগল সেই দুর্গপ্রসাদ। যে শব্দ তারা শুনেছিল সন্ধ্যার আগে। অসংখ্য দাঁড়কাকের চিৎকার আর তার প্রতিধ্বনি। অন্ধকারের মধ্যে যেন আরও বীভৎস মনে হচ্ছে সেই শব্দ। থরথর করে দেয়ালগুলো কাঁপছে। সেই শব্দ শুনে জুয়ান ধড়ফড় করে উঠে বসে বললেন, ‘আলো ফুটল নাকি! কাক ডাকছে?”

    ৷৷ ৫ ৷৷

    দীপাঞ্জন আর জুয়ান এসে দাঁড়িয়েছিল ঘরের পিছনে এক চিলতে বারান্দায়। কাকের ডাকের আরও ঘণ্টা দুই পর ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করল শেরউড বনের মাথায় ৷ কাকের ঝাঁক ঘুরপাক খাচ্ছে তার ওপর। দুর্গের প্রধান বুরুজের মাথাটা ক্রমেই আলোকিত হয়ে উঠছে। জুয়ান বললেন, ‘তোমার কথা শুনলাম। কিন্তু প্রেতাত্মা বলে তো কিছু হতে পারে না, ওটা মানুষের দুর্বলতা। যেমন অলিন্দের রেলিং-এ রিচার্ডের হাঁটার ব্যাপারটাই ধরো। তোমার বদলে অন্য কেউ হলে সে ভাবতেই পারত যে প্রাচীন দুর্গ অলিন্দে কোনো প্রেতাত্মার পদধ্বনি ওটা। জর্জের গল্পটা তুমি শুনেছ। অনেক সময় পরিবেশের প্রভাবে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে মানুষের। জর্জের গল্প শোনার পর ঘুম চোখে তেমনই কিছু হয়ে থাকতে পারে তোমার। তবে মাঝ রাতে হঠাৎ কাক ডেকে ওঠার ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। সেটা আমিও শুনেছি, দীপাঞ্জন বলল, “না, ঘুমের ঘোরে নয়, আমি নিশ্চিত দেখেছি সেই কবন্ধ মূর্তিকে। আমার কোনো দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি।’

    জুয়ান বললেন, ‘তুমি যখন এত জোর দিয়ে বলছ যে তুমি তাকে দেখেছে তবে দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথার আসা যাক। তাহলে হয়তো কেউ কবন্ধ মূর্তি সাজছে।’ ‘কিন্তু কেন?” জানতে চাইল দীপাঞ্জন।

    জুয়ান বললেন, ‘এ প্রাসাদে তো কোনো রক্ষী নেই। এমন হতে পারে যে কেউ কবন্ধ মূর্তি সেজে ঘুরে বেড়ায় এ প্রাসাদে, যাতে কেউ এ প্রাসাদে না ঢোকে। প্রাচীন প্রাসাদের সঙ্গে এসব ভৌতিক ঘটনা মিশিয়ে দেওয়া সহজ। আমার ধারণা ওই লোকটা রিচমন্ড নিজেই। সেই কিন্তু আমাদের জর্জের গল্পটা বলল। সে হয়তো এই ভাবেই পাহারা দেয় এই দুর্গ। সেই গল্পটা বলেছে আমাদের। এমনও হতে পারে সে দেখাতে চেয়েছে আমাদেরকে এই অলৌকিক ব্যাপার। যাতে আমরা ব্যাপারটা প্রচার করি বাইরে। আবার এমনও হতে পারে যে সে যেখানে অদৃশ্য হলো সেদিকেই কোথাও লুকানো আছে আর্লদের ধন সম্পদ। বাইরে থেকে দেখে কে কী মতলব নিয়ে চলছে তা তো চট করে বোঝা যায় না। আমাদের সে অবিশ্বাস করতেই পারে। হয়তো ওই জায়গা থেকে আমাদের দূরে রাখার জন্য কবন্ধ সেজেছে। ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাস জাগাবার জন্য সে নিজেও ওই কবন্ধ মূর্তি দেখেছে বলে আমাদের জানিয়েছে, যাই হোক এ ব্যাপার নিয়ে রিচমন্ডের সঙ্গে কোনো আলোচনার দরকার নেই, এমনকি ডিউক শ্যাননের সঙ্গেও নয়। তিনি নিশ্চয়ই হাসাহাসি করবেন ব্যাপারটা শুনে। আর এমনিতেই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ব্রিটিশ-আইরিশদের এক অদ্ভুত ধারণা আছে। ভারতবর্ষ মানেই সাধু আর যোগীদের দড়ির খেলা। আর ভারতবাসী মানেই তুকতাক, ভূতপ্রেত এসব বিশ্বাসী। অথচ মধ্যযুগের ইউরোপ বা তিনশো বছর আগের ইংল্যান্ড কুসংস্কারের ব্যাপারে ভারতীয় বা এশীয়দের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল।’

    দীপাঞ্জন বলল, “না, কবন্ধ মূর্তির ব্যাপারে আমি কাউকে কিছু বলছি না। তবে সত্যটা জানা দরকার।’

    জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা জানতে আমিও আগ্রহী। তেমন হলে আজ রাতে দুর্গ প্রাসাদটা দুজনে মিলে ঘুরে দেখতে পারি। দেখা যাক কোনো কবন্ধ মূর্তি বা জর্জের প্রেতাত্মার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয় কিনা?”

    আলো ভালো করে ফোটার আরও কিছুক্ষণ পর বেলা ছ’টা নাগাদ দীপাঞ্জনরা পিছনের ঝুল বারান্দা ছেড়ে সামনের অলিন্দে এসে দাঁড়াল। গতরাতে ঘুম ভেঙে উঠে দীপাঞ্জন ঠিক যে জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সে জায়গাতে এসে নীচের দিকে তাকাল । নতুন সূর্যর আলোতে চত্বরের অন্ধকার কেটে গেছে। পাথরের চৌখুপ্পিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চত্বর সংলগ্ন নীচে দুটো জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, ওই যে ওই স্তম্ভর আড়াল থেকে বেরিয়ে সেই অদ্ভুত মূর্তি শানবাঁধানো জায়গাটা পেরিয়ে এদিকের এই পলেস্তরা খসা স্তম্ভর আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছিল!’

    জুয়ান বললেন, ‘ওই মূর্তি যে স্তম্ভর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল বলছ, দোতলার সিঁড়ি কিন্তু ওর কাছাকাছি দিয়েই নীচে নেমেছে। রিচমন্ডের কাছ থেকে কায়দা করে জানতে হবে সে দোতলায় থাকে কিনা? আর ওই স্তম্ভর ওদিক দিয়ে বাইরে বেরোবার রাস্তা আছে কিনা? তাহলেই একটা অনুমান করা যাবে সেই স্কন্ধ কাটা এই দুর্গ প্রাসাদেই থাকে নাকি বাইরের লোক?”

    জুয়ান এরপর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাদের কানে এল একটা সম্ভাষণ—‘গুড মর্নিং।’ অলিন্দের উলটো দিক থেকে হেঁটে আসছে ডিউক শ্যানন। দীপাঞ্জনদের কাছে এসে থামলেন তিনি।

    দীপাঞ্জনরাও তাঁকে প্রথমে সুপ্রভাত জানাবার পর জুয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সাত সকালে কোথায় গেছিলেন?’

    জুয়ানের কথার জবাবে শ্যানন বললেন, ‘সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙেছে আমার। প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আমার। দিনের আলোতে দুর্গর কিছু অংশ ঘুরে এলাম ৷ দুর্গটা সত্যিই প্রাচীন। রিচমন্ড মিথ্যা বলেনি। এ ব্যাপারে কিছু পড়াশোনা আর বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার আছে। দুর্গটা নর্ম্যান-স্যাক্সন আমলেই তৈরি হয়। ওই যে ওই বুরুজটা দেখছেন ওটা তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।’—এই বলে তিনি হাতের তর্জনী তুলে সেই বুরুজটার দিকে দেখালেন যেখানে চাঁদের আলোতে উড়ে গিয়ে বসেছিল রিচার্ড।

    দীপাঞ্জন ওই ব্যাপারটাও বলেছে জুয়ানকে। বুরুজের ব্যাপারটা শ্যানন বলতেই জুয়ান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাল মাঝ রাতে কাকের ডাক শুনেছেন? ওই ডাক শুনেই তো ঘুম ভেঙে গেল আমার।’

    তার কথা শুনে শ্যানন প্রথমে বললেন, ‘কই, না তো!’

    তারপর হেসে বললেন, ‘অবশ্য সে ডাক না শোনার পিছনে একটা কারণ আছে। আমি অনিদ্রার রোগী। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়। কাল রাত ন’টায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছি। জানেন, ঘুমের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি আমি। দেখলাম জর্জের সেই মুণ্ডুকাটা ছায়ামূর্তি আর আর্ল সেভার্ন দাবা খেলছেন বুরুজের মাথায় বসে । কী অদ্ভুত স্বপ্ন!’

    শ্যাননের কথা শুনে মুহূর্তর জন্য দৃষ্টি বিনিময় হলো জুয়ান আর দীপাঞ্জনের মধ্যে। দীপাঞ্জনের চোখে ভেসে উঠল সেই অদ্ভুত মূর্তি।

    শ্যানন এরপর বললেন, “রিচমন্ড নিশ্চয়ই এসে পড়বে। যাই আমি ঘরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়েনি। আপনারাও তৈরি হয়ে নিন। দুর্গর আনাচ-কানাচ ঘুরে দেখতে হবে। সম্ভব হলে শেরউড বনের ভিতরেও যাব?”

    এ কথা বলে লর্ড শ্যানন নিজের ঘরে ঢুকে যাবার পর দীপাঞ্জনরাও নিজেদের ঘরে ঢুকল। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্রেতে ধুমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল রিচমন্ড। টেবিলে ট্রেটা নামিয়ে রেখে সে জানতে চাইল ঘুম কেমন হল?’

    জুয়ান হেসে বললেন, “ভালোই, তবে তিনটে নাগাদ কাকের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ওই সময়টাতে ঠিক ভোর বলা যায় না। আপনি তো বলেছিলেন যে শুধু সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ওরা ডাকে?”

    রিচমন্ড বলল, ‘হ্যাঁ, তাই ডাকে। ঋতু অনুসারে ভোর সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। অত আগে অন্ধকারে সাধারণত ওরা ডাকে না।’

    “তবে কেন ডাকল কেন?’ জানতে চাইল দীপাঞ্জন।

    একটু চুপ করে থেকে রিচমন্ড বলল, ‘হ্যাঁ, ডাকটা আমিও শুনেছি। আর একটা চাঞ্চল্যও লক্ষ করছি ওদের মধ্যে। ভোর হলে সাধারণত ওরা বুরুজ, কার্নিশ ছেড়ে নীচে নেমে চত্বরে বসে হাঁকডাক শুরু করে। রোজ ওদের সেখানে খাবার দেওয়া হয়। আজ দেখছি ওরা আকাশে ওড়াউড়ি করছে এখনও। খাবার খেতে নীচে নামেনি। আমার ধারণা, জঙ্গল থেকে ভাম বা বনবিড়াল জাতীয় কোনো প্রাণী এসে হানা দিয়েছিল ওদের ডেরায়। সাপও হতে পারে। কাকগুলো তাই ভয় পেয়ে ডেকে উঠেছিল একসঙ্গে। কাকেদের মধ্যে সামাজিক বোধ প্রবল। একজন আক্রান্ত বা বিপদগ্রস্ত হলে সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একথা বলার পর রিচমন্ড বলল, ‘আপনারা চা-ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে থাকুন।

    আমি একটু পরে আসছি। আপনাদের দুর্গ আর কিছু জিনিস দেখাব ৷

    রিচমন্ড কিন্তু আবার ফিরে আসতে বেশ দেরি করল। ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে তার জন্য বেশ কিছুটা সময় দীপাঞ্জনদের অপেক্ষা করতে হলো তার জন্য । প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ সে এল। দীপাঞ্জনদের উদ্দেশ্যে সে বলল, ‘মার্জনা করবেন আসতে দেরি হলো বলে। আসলে আর্লের মাথা গরম হয়ে গেছে। তাকে একটু ঠান্ডা করে আসতে হলো।’

    শ্যানন জানতে চাইলেন, ‘সাত সকালে তার মাথা গরম হল কেন ?

    রিচমন্ড বলল, ‘রোজ ভোরবেলা তার খবরের কাগজ চাই। সকাল সাতটার মধ্যে ডাক বিভাগের গাড়িটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে যায় দুর্গের ঢোকার মুখে লোহার ফটকে। কিন্তু ইদানীং তারা মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছে কাগজ দিতে। নতুন লোক এসে দায়িত্ব নিয়েছে গাড়িটার। তারপর থেকে ঘটনাটা ঘটছে। আজও তারা কাগজ দিয়ে যায়নি। অথচ লর্ড ভোরবেলা জানলা দিয়ে দেখেছেন তাদের গাড়িটাকে চলে যেতে। তাই খাপ্পা হয়ে গেছেন তিনি। তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছুটা ঠান্ডা করলাম। যদিও এখন তিনি ডাক বিভাগের সম্বন্ধে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লিখতে বসেছেন খোদ রানি এলিজাবেথকে।’

    রিচমন্ড এরপর বলল, ‘চলুন এবার। যা যা দেখানোর আছে আপনাদের দেখিয়ে আনি। দিনের আলোতে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পেয়েছে দুর্গ। আসলে গত দিন দীপাঞ্জনরা যখন দুর্গে এসে পৌঁছেছিল তখন সূর্য পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করেছে। অলিন্দ, গবাক্ষ দিয়ে সকালে বেশ কিছুক্ষণ আলোকিত হয় দুর্গর। ঘর, অলিন্দ, সিঁড়ির ধুলোমাখা ধাপগুলো। তারপর তারা ধীরে ধীরে ডুবে যায় বিস্তৃতির অন্ধকারে। অলিন্দর গা ঘেঁসেই সার সার ঘর তার কোথাও রাখা আছে লোহার বেড় দেওয়া আদ্যিকালের কাঠের পিঠে, কোথাও গোড়ার রেকাব, জিন, সাজসজ্জা, এছাড়াও নানা প্রাণীর স্টাফ করা মাথা, ধাতুর মূর্তি ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ ঘরই খালি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরু ধুলোর আস্তরণ জমা হয়েছে সেখানে। তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে জুয়ান, রিচমন্ডকে বললেন, ‘এত ঘর এ দুর্গে! আপনি থাকেন কোথায়?’ রিচমন্ড বলল, ‘দোতলাতেই। কাল আপনারা রাতে যে ঘরে আর্লের সঙ্গে দেখা করলেন তার কাছেই একটা ঘরে। আর্লের শয়নকক্ষও ওই লাইব্রেরির পাশেই। ‘

    রিচমন্ড দীপাঞ্জনদের নিয়ে দুর্গর গোলকধাঁধায় কিছুক্ষণ হাঁটার পর এসে থামল একটা ঘরের সামনে। কাঠের শক্ত দরজার ওপর মোটা লোহার গরাদওয়ালা আর-একটা দরজা আছে সেখানে। দুটো দরজাতেই বড়ো বড়ো লোহার তালা ঝুলছে। দুর্গর তালাগুলো যেমন বিশাল, তেমন চাবিগুলোও বড়ো বড়ো। রিচমন্ড তার পোশাকের ভিতর থেকে প্রায় ছ ইঞ্চি লম্বা দুটো চাবি বার করে করে পরপর দরজা দুটো খুলে ফেলল। আলোকিত হয় উঠল ঘর। ঘরটাতে কোনো জানলা নেই। ঘরে পা রেখেই দীপাঞ্জনদের যেটা প্রথমেই চোখে পড়ল তা হলো, দেয়ালের গায়ে চেনে বাঁধা প্রাচীন এক কঙ্কাল। তার দেহের কিছু খসে খসে পড়েছে বয়সের ভারে। ঘরের মধ্যে রয়েছে লোহার পটি দেওয়া বেশ কিছু সিন্দুক আর বড়ো বালতির আকারের অসংখ্য জালা। রিচমন্ড বলল, এটা ছিল দুর্গের তোষাখানা। ছোটো ছোটো জালাগুলোর মধ্যে সোনার মোহরে ভরা থাকত আর সিন্দুকগুলোর মধ্যে অলংকার।’

    কথা বলতে বলতে সে এগিয়ে গেল একটা সিন্দুকের কাছে, চাবি দিয়ে তালা খুলে সিন্দুকের থেকে একটা মাঝারি বাক্স এনে টেবিলের ওপর রাখল। দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘ওই কঙ্কালটা কে? রত্নাগারের পাহারাদার ?”

    বাক্সটা খুলতে খুলতে রিচমন্ড হেসে ফেলে বলল, ‘ওর বয়স তিনশো বছর। পাহারাদার নয় চোর ছিল। আগে এ ঘরে একটা জানলা ছিল। কীভাবে যেন সে তিনশো ফুট উঁচু এই ঘরে রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে দেয়ালের খাঁজ বেয়ে উঠে জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সোনার মোহরটোহর বস্তায় পুরে ছিল ঠিকই, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পালাবার সময় সে ধরা পড়ে গেল রক্ষীদের হাতে। তাকে এ ঘরে এনে শিকলে বাঁধা হলো দেয়ালের সঙ্গে। খাবার চাইলেই তার মুখে সোনার মোহর গুঁজে দেওয়া হত। ও ভাবেই মারা গেল লোকটা। তারপর থেকেই সে ওখানেই আছে।’

    কথা বলতে বলতেই বাক্সটা খুলে তার ভিতরের নীল মখমলের আস্তরণটা সরিয়ে ফেলল রিচমন্ড। সঙ্গে সঙ্গে যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল বাক্সর ভিতরটা। তার ভিতর রাখা আছে বেশ কিছু প্রাচীন গহনা, জহরত। একটা মুক্তোর ছড়া দীপাঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিয়ে রিচমন্ড বললে, ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তো কোনো কিছু ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হবে না, এটা হাতে নিয়ে দেখুন, এটা হলো রাজা জেমসের উপহার। আর এই যে পান্না বসানো সোনার ব্রোচ, এটা আর্ল সেভার্নকে দিয়েছিল রানি ভিক্টোরিয়া।’ মুক্তোর মালাটা হাতে নিতেই দীপাঞ্জনের শরীর শিরশির করে উঠল। তার মনে হলো সে যেন ইতিহাসকে স্পর্শ করছে! এরপর আরও কিছু মূল্যবান জিনিস, হিরে বসানো আংটি, সোনার লকেট ইত্যাদি বাক্স থেকে বার করে দীপাঞ্জনদের দেখাল সে। বিস্মিত জুয়ান জিনিসগুলো দেখতে দেখতে বললেন, ‘এ সবের মূল্যতো বেশ কয়েক লাখ ডলার হবে। তোষাখানা তবে এখনও সম্পদে ভরতি!’

    তার কথা শুনে রিচমন্ড একটু সতর্ক ভাবে বলল, “না, জিনিসগুলো এখানে থাকে না। অন্য জায়গাতে থাকে। আপনাদের দেখাবার জন্য জিনিসগুলো বার করে এনেছি। যেখানের জিনিস সেখানে আবার রেখে আসতে হবে।’

    রত্ন দেখাবার পর রিচমন্ড ঘরের বাইরে এসে তালা দিয়ে বলল, ‘আপনাদের নীচে সমাধিক্ষেত্র দেখাতে নিয়ে যাব। কিন্তু তার আগে ছাদটা দেখিয়ে আনি, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় সেখান থেকে। ওখানে একটা দেখার জিনিসও আছে।’ রিচমন্ডের পিছু পিছু আবার এগোতে শুরু করল তারা, একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে তারা পৌঁছোল দুর্গপ্রাকারে। প্রাকারের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ফুটপাঁচেক চওড়া পথ এগিয়েছে ওপর দিকে প্রাকারটা যেভাবে ওপরের দিকে উঠে গেছে সেভাবে। পথের এক পাশে খাঁজকাটা অনুচ্চ প্রাচীর, অন্য পাশে অনেক নীচে দুর্গর ভিতরের শানবাঁধানো জমি। বেখেয়ালে নীচে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। দীপাঞ্জনদের নিয়ে সে পথ ধরে সাবধানে ছাদের দিকে এগোতে এগোতে রিচমন্ড বলল, ‘এক সময় এ পথ ধরে টহল দিত রক্ষীরা। প্রাচীরের গায়ে যে ফুটোগুলো দেখছেন সেগুলো বানানো হয়েছিল তির চালাবার জন্য। আর কিছু নালি আছে সেগুলো দিয়ে ওপর থেকে গরম তেল ঢালা হতো শত্রুর দুর্গ আক্রমণ করলে।’

    গল্প শুনতে শুনতে ছাদে উঠে এল তারা। ছাদতো নয় যেন একটা ফুটবল মাঠ। শেরউড বনভূমির মাথার ওপর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। দীপাঞ্জনরা ছাদে উঠতেই মাথার ওপর পাক খেতে থাকা কাকগুলো একবার কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে রিমচন্ড বলল, ‘কাকগুলো এখনও উত্তেজিত হয়ে আছে কেন কে জানে?

    আপনাদের দুর্গ দেখানো শেষ হলে দেখি ওদের খাবার দিয়ে নীচে নামানো যায় কিনা?” ছাদের মাঝখানে রাখা আছে কাঠ আর লোহার তৈরি একটা অদ্ভুত যন্ত্র। তারা গিয়ে দাঁড়াল সেটার সামনে। ফুট আটেক একটা খাড়া স্তম্ভর ওপর একটা কুড়ি ফুট লম্বা ঢেঁকি যেন বসানো আছে ৷ ঢেঁকির এক দিকের মাথায় বসানো আছে বিরাট লোহার ঝুড়ি। রিচমন্ড বলল, ‘এটা হলো দানব গুলতি। সে যুগে এ জিনিসের খুব চল ছিল। ঝুড়িতে হাজার পাউন্ড ওজনের পাথর খণ্ড বসিয়ে বেশ দূর পর্যন্ত ছোড়া যেত। এ হলো কামানের পূর্বপুরুষ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দীপাঞ্জনরা ঘুরে বেড়াল ছাদে। দাঁড় কাকগুলো ডেকেই চলেছে তাদের মাথার ওপর। এরপর নীচে নামার পথ ধরল তারা। দুর্গ প্রাকারের গা ধরে ঠিকই তবে অন্য দিক দিয়ে। সে পথে এগোবার সময় রিচমন্ড একটু সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘একটু সাবধান। প্রাকারের এ অংশে অনেক কাকের বাসা আছে। আচমকা ঠোকর খেয়ে নীচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। দু-একজন এভাবে মারাও গেছে। তবে আমি আছি সঙ্গে। তেমন কিছু হবে না। ওরা চেনে আমাকে’ কয়েকপা এগোতেই দীপাঞ্জনরা দেখল সত্যিই প্রাচীরের খাঁজে খাঁজে রয়েছে বিরাট বিরাট অসংখ্য দাঁড়কাকের বাসা। তার কয়েকটাতে ছানাপোনাও আছে। বাসা তৈরির কাঠখড়কুটো আর কাকের বিষ্ঠায় ভরে আছে সে জায়গা । বড়ো বড়ো ঠোঁটের দাঁড়কাকগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে দীপাঞ্জনদের মাথার ওপর। ঠোকোর খাবার ভয়ে সবাই বেশ সাবধানে পার হলো সে জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল দীপাঞ্জনদের মতো উঁচু ছাদ থেকে একদম নীচে চত্বরটাতে নামতে।

    ৷৷ ৬ ৷৷

    নীচে নেমে চত্বরের মাঝখানে দাঁড়াল তারা। রিচমন্ড বলল, ‘এবার আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি আর্লদের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র দেখাতে। রিচমন্ড দীপাঞ্জনের ঠিক সেই জায়গাতেই নিয়ে ঢুকল যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছিল সেই গতরাতের ছায়ামূর্তি। স্তম্ভের আড়ালে লম্বা একটা বারান্দা, তার লাগোয়া সার সার ঘর। দীর্ঘদিন দরজাগুলো খোলা হয় না। পুরু ধুলো জমে আছে চৌকাঠে। সে অলিন্দ পেরোবার পর প্রায় একশো ফুট লম্বা একটা জায়গা। তার দু-পাশে উঁচু প্রাচীর, তবে মাথার ওপর ছাদ নেই। শান বাঁধানো পাথুরে মেঝে পেরিয়ে তার শেষ প্রান্তের দিকে এগোতে এগোতে রিচমন্ড বলল, ‘এ জায়গার নাম হলো ‘ডুয়েল কোর্ট।’ অভিজাত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সে যুগে অনেক বিবাদের শেষ নিষ্পত্তি হতো ডুয়েল বা দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে। বিশেষত সম্পত্তি বা বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ের বিরোধের নিষ্পত্তির জন্যই ডুয়েল লড়াই হতো। দেয়ালের গায়ে অনেক জায়গাতে যে আঁচড়ের মতো দাগ দেখছেন তা হলো তলোয়ারের আঘাত । তলোয়ারের ডুয়েল হতো এখানে। দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শেষে পরিবারের মৃত সদস্যকে নিয়ে যাওয়া হত ভূগর্ভস্থ কবরখানায় সমাধি দেবার জন্য। বাইরের কেউ ব্যাপারটা জানতে পারত না। বেশ কয়েকবার লড়াই হয়েছে এ জায়গাতে।’

    ডুয়েল কোর্ট পেরিয়ে তারা প্রবেশ করল ছাদ ঢাকা এক অলিন্দে। কিছুটা এগিয়েই একটা দরজা। তবে তার পাল্লা নেই। হতে পারে এককালে পাল্লা ছিল এখন সেটা খসে পড়েছে। দরজা থেকে সার সার সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের অন্ধকারে। দরজার পাশেই কুলুঙ্গিতে একটা মশাল রাখা ছিল। সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্রে নামতে শুরু করল রিচমন্ড। বেশ অনেকটা নামার পর তারা এসে প্রবেশ করল সমাধিক্ষেত্রে। লম্বাটে বেশ বড়ো সমাধিক্ষেত্র। অন্তত সেটা দেড়শো ফুট লম্বা আর তিরিশ ফুট চওড়া। দরজা থেকে একটা সরু পথ চলে গেছে সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে। একপাশে দেয়ালের মাথায় বেশ বড়ো একটা গবাক্ষ আছে। তার ফাঁক গলে কিছুটা আলো ঢুকছে ভূগর্ভস্থ ঘরটাতে। সেই আলোতে আর রিচমন্ডের মশালের আলোতে সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়া সরু পথটার দু-পাশ জেগে আছে সার সার পাথরের তৈরি শবাধার মাটি খুঁড়ে নয়, শবাধারেই শায়িত করে রাখা হত মৃতদেহ। সমাধিক্ষেত্রের দু-পাশে দেয়ালের মাথার দিকে বেশ কিছু তাক আছে। সেখানেও রাখা আছে পাথরের তৈরিবেশ কিছু ছোটো বাক্স। দীপাঞ্জন জানতে চাইল ‘ওগুলি কী ? ”

    রিচমন্ড বলল, ওগুলি হলো পরিবারের শিশু সদস্যদের শবাধার। ওগুলো খুব প্রাচীন। কয়েকটার বয়স আট নশো বছর হবে? রিচমণ্ডের পিছন পিছন শুঁড়িপথ ধরে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোল তারা। দু-পাশে রয়েছে শবাধারগুলো। প্রাচীন সব শবাধার। বিবর্ণ হয়ে গেছে তাদের গায়ে থাকা ফুল লতাপাতার অলংকরণ, কোনোটার মাথার ক্রশ হেলে পড়েছে, কোনোটার ঢাকনা খসে পড়েছে। দীপাঞ্জন দু-একটা ভাঙা শবাধারের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল। না, হাড়গোড়ের কোনো চিহ্ন নেই ভিতরে। সব ধুলো হয়ে মিশে গেছে কফিনের ভিতর। এক সময় তারা ঘরটার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছোল। সেখানকার কফিনগুলো একটু ভালো অবস্থার। অর্থাৎ তাদের বয়স এক-দুশো বছর। অন্যদের তুলনায় তাদের নবীনই বলা যায়। সেখানে একটা প্রায় নতুন পাথরের কফিন রাখা আছে। সেটার ঢাকনা সরিয়ে রিচমন্ড বলল, ‘এটা বছর খানেক আগে লন্ডন থেকে আনিয়েছি। এর ভিতর কে শোবেন জানেন? আর্ল সেভার্ন। তাঁর নির্দেশেই আগাম প্রস্তুতি সেরে রেখেছি।’

    কিছুক্ষণ সে জায়গাতে দাঁড়িয়ে থেকে তারা আবার সবাই ফিরতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার সেই কবরখানায় চোখ আটকে গেল মাথার ওপরের দেয়ালের এক জায়গাতে। সেখান থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আধো অন্ধকারে সেখানে জেগে আছে এক জোড়া লাল চোখ। আরে সেই বিশাল কাকটা। রিচার্ড। দেয়ালের মাথার ওপরের দিকে তাকে রাখা একটা ছোটো কফিন বাক্সে বাসা বানিয়ে তার মধ্যে বসে আছে সে। খড়কুটো ঝুলছে বাক্সর গর্তর মধ্যে থেকে তার গা বেয়ে। বাক্সর মধ্যে বসে কাকটা তাকিয়ে আছে দীপাঞ্জনদের দিকে। দীপাঞ্জন ব্যাপারটা সম্বন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করল অন্যদের। তারাও তাকাল বাক্সটার দিকে। রিচমন্ড হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি ওখানেই থাকেন। রাত হলে ওই গবাক্ষ দিয়ে বা বাইরে বেরিয়ে দুর্গ টহল দেন। আমি ছোটবেলা থেকে ওকে ওখানেই দেখছি। যে বাক্সটায় উনি বসবাস করেন ওটা হল হেনরির শবাধার। প্রথম আর্লের মৃত শিশুপুত্র ছিলেন তিনি।’

    লর্ড শ্যানন এবার বললেন, ‘মাফ করবেন। এবার ওপরে উঠলে ভালো হয়। আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। এখানে বাতাস বড়ো কম।’

    সমাধিক্ষেত্রটা মোটামুটি সবার দেখা হয়ে গেছিল। তাই তারা এবার ওপরে উঠে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ডুয়েল কোর্ট অতিক্রম করে ফিরে এল সেই চত্বরে।

    সেখানে ফিরে এসে রিচমন্ড বলল, ‘আমি এবার কাকেদের খাবারের ব্যবস্থা করি। দুর্গে যা যা দ্রষ্টব্য আছে তা আপনাদের দেখালাম। আপনারা এবার নিজেরা ঘুরে দেখতে পারেন অন্য অংশগুলো। তবে একটু সাবধানে। প্রাচীন জায়গাতো। সাপখোপ থাকতে পারে কোথাও।’

    শ্যানন বলল, “আমি বরং একটু জঙ্গলের ভিতর ঘুরে আসি। যাবেন নাকি আপনারা ?” জুয়ান বলল, ‘আপনি ঘুরে আসুন। এখন বেশ রোদ। আমরা বিকালে যাব ওদিকটাতে। এখন এই দুর্গ প্রাসাদেই ঘুরে বেড়াই।’

    রিচমন্ড শ্যাননকে বললেন, ‘দুর্গের মূল ফটক খুলতে হবে না। ওর পাশে বেশ বড়ো একটা ফোকরা আছে। সেখান দিয়েই আপনি যাওয়া আসা করতে পারবেন।’

    তার কথা শুনে শ্যানন চলে গেলেন সেদিকে। রিচমন্ডও বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর সেই চত্বর ছেড়ে অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই জুয়ান আর দীপাঞ্জন প্রবেশ করল দুর্গস্থাপত্যের ভিতরে। কত কক্ষ, কত অলিন্দ, প্রাকার, বুরুজ। তারা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল কেল্লাটা।

    ঘুরতে ঘুরতে জুয়ান এক সময় বললেন, ‘তোমার দেখা কবন্ধ মূর্তিটা কী তবে? ভূগর্ভস্থ কবর খানাতেই গেছিল? ওদিকের রাস্তাটা তো কবরখানাতেই গিয়ে শেষ হয়েছে। দীপাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, ওদিক দিয়ে তো আর বেরোবার পথ নেই। কিন্তু সে কবরখানায় গেল কেন? তার কাটামুণ্ডুর সন্ধানে নাকি?’ কথা শেষ করে মৃদু হাসল দীপাঞ্জন ।

    জুয়ান বললেন, ‘এমন হতে পারে যে রিচমন্ড যে অলংকার রত্নগুলো আমাদের দেখাল সেগুলো? সমাধিক্ষেত্রের কোথাও লুকোনো থাকে। আমাদের দেখানোর জন্য সে? ছদ্মবেশে আনতে যাচ্ছিল সেগুলো। অথবা সে জায়গা থেকে লোকজন কে দূরে রাখার জন্য সে ছদ্মবেশ ব্যবহার করে। সাধারণত কবরস্থানের মতো জায়গা এড়িয়ে চলে সাধারণ মানুষ, এমনকি চোরেরাও। তার ওপর সেখানে যদি স্কন্ধকাটা দেখা যায় তাহলে তো কথাই নেই ৷ ধন-সম্পদের চেয়ে প্রাণের মায়া বড়ো। কেউ ঘেঁষবে না সেখানে। কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাই সমাধিক্ষেত্রের পাথরের কফিনগুলো কিন্তু আদর্শ জায়গা। কেউ সাহস করে হাত দেবে না ওর ভিতরে।’

    একটা সিঁড়ি পড়ল দীপাঞ্জনদের সামনে। সেটা দিয়ে তারা ওপরে উঠতে শুরু করল। ওপরে উঠতে উঠতে জুয়ান বললেন, তুমি একটা জিনিস খেয়াল করছে কিনা জানি না, আমি করেছি। রিচার্ড যে বাক্সটায় থাকে, মানে সেই ছোটো পাথরের শবাধারটা মনে হয় কেউ হাত দিয়ে টেনেছিল। তার ভিতরে ঘাঁটাঘাঁটিও করে থাকতে পারে। কারণ অন্য বাক্সগুলো যেমন তাকের দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে আছে সেটা তেমন নেই। বাক্সর একটা কোণা তেরছাভাবে বেরিয়ে এসেছে তাক থেকে। কিছু টাটকা খড়কুটো আর ধুলোবালি ও পড়েছিল মাটিতে। তার ওপর আমি জুতো পরা মানুষের পায়ের ছাপ দেখেছি। সেটাও টাটকা।’

    কথা বলতে বলতেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল তারা। এ জায়গাটা চিনতে পারল দুজনেই। আরে ওইতো আর্লের লাইব্রেরি রুম। এখানেই কোনো ঘরে থাকেন বৃদ্ধ আর্ল এবং রিচমন্ড ।

    দীপাঞ্জন, জুয়ানের কথা শুনে বললেন, “তাহলে কী? রিচার্ডের বাক্সে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা আছে বা হয়েছিল?’

    জুয়ান বললেন, ‘অসম্ভব কিছু নয়। কালতো আমরা চলে যাব। আজ চলো সমাধিক্ষেত্রে আমরা রাত কাটাই। এই সিঁড়িটা যখন খুঁজে পেলাম তখন এটা দিয়েই দোতলা থেকে নেমে যাব। কেউ কিছু টের পাবে না। কবন্ধ মূর্তির ব্যাপারটা আমাদের জানা দরকার। নইলে সারাজীবন মনের মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিষয় সম্বন্ধে একটা খটকা থেকে যাবে। রিচমণ্ড যদি অলংকারগুলো ওখান থেকেই এনে থাকে তবে নিশ্চয়ই ওখানেই আবার রাখতে যাবে। আর রাতটাকেই সে বেছে নেবে এ কাজের জন্য। আসল সত্যটা উদ্ঘাটন হওয়া দরকার। আমরা শুধু লুকিয়ে থেকে দেখব সে আসল ব্যাপারটা কী?”

    দীপাঞ্জন প্রশ্ন করল, ‘কী ভাবে লুকোব আমরা?”

    জুয়ান উত্তর দিলেন, ‘কেন? ওখানে যে ভাঙা শবাধারগুলো আছে তার মধ্যেই লুকোব ওটাই সেরা জায়গা…’

    জুয়ান হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কাছেই একটা ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং আর্ল সেভার্ন। তাঁর এক হাতে উঁচিয়ে ধরা আছে সেই শিঙটা । আর অন্য হাতে ধরা একটা হাসের পালকের কলম। সম্ভবত লিখতে লিখতে বেরিয়ে এসেছেন তিনি তাঁকে দেখে দুজনের কথাবার্তা থেমে গেল। আর্ল বেশ কিছুক্ষণ ঘোলাটে চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমরা কি ডাক বিভাগের লোক? নিশ্চয় আমার লেখা চিঠি পেয়ে রাজা তোমাদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন? সংবাদপত্র দাওনি কেন? একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পড়া আমার বাকি রয়ে গেল।’

    জুয়ান মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে অভিবাদন করে বললেন, ‘না আমরা ডাক বিভাগের লোক নই। আমরা আপনার প্রাসাদের অতিথি। লন্ডন থেকে এসেছি। আপনি কী খবর সংবাদপত্রে পড়তে চাইছেন বলুন? আমাদের জানা থাকলে আপনাকে জানাচ্ছি।’

    আর্ল বললেন, “ওই যে ওই খবরটা। সেটা বেরোচ্ছে সংবাদপত্রে। নরফক্সের ডিউক নাকি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাইছে! শুনেছ খবরটা ?”

    আর্লের কথা শুনে একটু চুপ করে থাকলেন জুয়ান। অসংলগ্ন কথা বলছেন আর্ল। এর কী বা জবাব দেবেন তিনি? একটু আমতা আমতা করে জুয়ান বললেন, ‘না, এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’

    আর্ল এ কথা শুনে বেশ রুষ্ট ভাবে বললেন, ‘শোনোনি এ কথা? যত সব অপদার্থের দল! নরফক্সের ডিউক রাজার সম্পদ লুঠ করার চেষ্টা করছে শেরউড বনে। তোমরা যখন ব্যাপারটা কিছুই শোনোনি তখন আমি একাই লড়াই করব তার বিরুদ্ধে। আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। আজ রাতেই যুদ্ধ হবে। যুদ্ধ যুদ্ধ’-একথা বলতে বলতে শিঙায় ফুঁ দেবার ভঙ্গিতে সেটা মুখের কাছে উঁচিয়ে ধরে আবার ঘরে ঢুকে গেলেন আর্ল। দীপাঞ্জনরা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আবার এগোতে শুরু করল সামনের দিকে। কিন্তু মিনিট দশেক সময়ের পরই হঠাৎ নীচের চত্বরে ভারী কিছু পড়ার শব্দ আর মানুষের আর্ত চিৎকার চমকে উঠল তারা। কাকের দল মনে হয় নীচে নেমেছিল। তারা চিৎকার করতে করতে নীচ থেকে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ওপরে উঠতে লাগল। যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে দাঁড়কাকগুলো। দীপাঞ্জনরা যে জায়গাতে দাঁড়িয়ে সেখানে অলিন্দের রেলিং এত উঁচু যে নীচে ঝুঁকে দেখা যাবে না। কাকের কোলাহলের মধ্যে থেকে নীচ থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ ।

    নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। দীপাঞ্জনরা পিছু ফিরে সিঁড়ির দিকে ছুটতে শুরু করল নীচের চত্বরে পৌঁছোবার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল সেখানে ৷

    চত্বরের ঠিক মাঝখানে দু-পা ছড়িয়ে বসে আছে রিচমন্ড। রক্ত ছুঁয়াচ্ছে তার দেহ থেকে। কিছু দূরে উলটে পড়ে আছে গমের ঝুড়ি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রচুর গম। আর্তনাদ করছে রিচমন্ড।

    দীপাঞ্জনরা ছুটে গেল তার দিকে। তার সামনে নীচু হয়ে বসে জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘আপনার আঘাত লাগল কী ভাবে?’

    রিচমন্ড বলল, ‘দাঁড়কাকগুলোকে গম খাওয়াচ্ছিলাম। ওরাও নীচে নেমে গম খাচ্ছিল, হঠাৎ ওই পাথরটা ওপর থেকে কাঁধে খসে পড়ল! এই বলে সে বাঁ হাতের আঙুল নির্দেশ করল কিছুটা তফাতে পড়ে থাকা একটা বেশ বড় পাথর খণ্ডর দিকে। তার নীচে চেপ্টে গেছে একটা কাক। পাথরের চাপে পাখিটার প্রাণ বেরিয়ে গেছে। পালক ছিটিয়ে আছে চারপাশে। জুয়ান আর দীপাঞ্জন পরীক্ষা করল রিচমন্ডের কাঁধের ক্ষতচিহ্নটা। কেটে গেলেও আঘাত তেমন কিছু মারাত্মক নয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আর যন্ত্রণায় বিহ্বল হয়ে গেছে রিচমন্ড। তবে পাথরটা মাথায় পড়লে তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। খুব বাঁচা বেঁচেছে সে! ধরাধরি করে প্রথমে তাকে দাঁড় করানো হলো। দীপাঞ্জন বলল, “কিন্তু পাথরটা খসে পড়ল কোথা থেকে?’

    যন্ত্রণাকাতর গলায় দীপাঞ্জন আর জুয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে রিচমন্ড বলল, “মনে হয় ওই টাওয়ারের মাথা থেকে। দীপাঞ্জন মাথা তুলে তাকাল ওপর দিকে। টাওয়ারের বা বুরুজের মাথায় একটা ছোটো ঘর আছে। সে দিকে তাকাতেই দীপাঞ্জনের মনে হলো একটা মূর্তি যেন দাঁড়িয়েছিল সেখানে! সে তাকাতেই মূর্তিটা সরে গেল! ব্যাপারটা অবশ্য তার মনের ভুলও হতে পারে। দোতলায় উঠে জুয়ান নিজেদের ঘরে ছুটলেন সঙ্গে আনা ফাস্ট এইড বক্সটা আনতে। আর দীপাঞ্জন, রিচমন্ডকে নিয়ে পৌঁছোল তার ঘরে। জুয়ান খুব দ্রুতই ফিরে এলেন। রিচমন্ডের ঘরের দরজার বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল দীপাঞ্জন । ঘরে ঢুকে দুজনে মিলে রিচমন্ডের কাঁধে ব্যান্ডেজ বেঁধে ব্যথার ওষুধও খাওয়ানো হলো তাকে। জুয়ান বললেন, ‘আপাতত আপনি বিশ্রাম নিন। আশা করি কাল সকালে আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

    দীপাঞ্জন তাকে বলল, ‘আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। দুর্গ তো মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। বড়ো টাওয়ারটা আর জঙ্গল নিজেরাই দেখে নিতে পারব। আচ্ছা ওই টাওয়ারে ওঠার রাস্তা কোটা বলুন তো?’

    রিচমন্ড শুশ্রূষার জন্য তাদের দুজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘এই ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে একটু এগোলে বাঁ হাতে দেয়ালের গায়ে একটা সরু পথ আছে। সেটা আপনাদের টাওয়ারের সিঁড়ির দরজাতে পৌঁছে দেবে। দরজা খোলাই থাকে । ‘

    এরপর দীপাঞ্জনরা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে দীপাঞ্জন বলল, “চলুন ওই টাওয়ারে একবার উঠব। ওখান থেকেই পাথর খসে পড়েছে। ওপর দিকে তাকিয়ে আমি কাকে যেন দেখলাম মনে হয়! ব্যাপারটা মনের ভুলও হতে পারে। তবু দেখে আসি।’ জুয়ান কথাটা শুনেই বললেন, ‘তবে চলো ওদিকে।’

    রিচমন্ডের নির্দেশ মতোই এগোল তারা। কিছুটা এগিয়ে গলিপথটা দেখতে পেল তারা। কিন্তু সেখানে ঢোকার মুখেই এমন একজন সেখান থেকে বেরিয়ে এল যে আর একটু হলে তার সঙ্গে ধাক্কা লাগল জুয়ানের। তিনি আর্ল সেভার্ন। তাঁর হাতে তখনও ধরা আছে সেই শিঙাটা। দীপাঞ্জনদের দেখে তিনি বললেন, ‘যুদ্ধ যুদ্ধ! সব তৈরি হও। আজ রাতেই আমি আমার সেনা নিয়ে আক্রমণ করব ডিউককে।’ কথাগুলো বলতে বলতে তিনি নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। জুয়ান বললেন, ‘কোথা থেকে এলেন আর্ল। উনিই ওই বুরুজে উঠে রিচমন্ডকে শত্রুপক্ষের সেনা ভেবে পাথর ছুড়ে মারেননি তো? এ সব মানুষ কিন্তু কল্পনায় অনেক কিছু দেখেন। এ ব্যাপারটাও কিন্তু বেশ সম্ভাবনা আছে।’ দীপাঞ্জন বলল, ‘চলুন আগে এগিয়ে দেখা যাক।’

    সেই গলিতে ঢুকে কিছুটা এগিয়েই তারা একটা খোলা জায়গাতে এসে পড়ল। তার এক পাশ থেকে দুর্গ প্রাকারের গা বেয়ে খাড়া সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে দুর্গর বাইরে জঙ্গলের দিকে। তবে তার অস্তিত্ব সম্ভবত দুর্গর বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আর সেই সিঁড়ির উলটোদিকেই বুরুজের মাথায় ওঠার দরজা। বুরুজ বা টাওয়ারটা নীচ থেকে উঠে এসে ছাদ ছাড়িয়ে উঠে গেছে সোজা ওপর দিকে। দরজাটা বুরুজের গায়েই এবং সেটা খোলা। তারা দুজন তার ভিতরে প্রবেশ করে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। খুব স্বল্প পরিসর। একজনের পিছনে অন্যজন এভাবে তারা উঠে এল বুরুজের মাথার ঘরটাতে। না, সেখানে কেউ নেই। ঘরের চারদিকেই অলিন্দ। সেখান থেকে পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে দুর্গর ভিতরের চত্বর, পুরো দুর্গ, আর শেরউড অরণ্য। বেশ কিছু বড়ো পাথরের টুকরো পড়ে আছে ঘরটার মধ্যে। ঠিক যেমন পাথরের টুকরো রিচমন্ডের ঘাড়ে পড়েছিল। জুয়ান বললেন, ‘ও পাথরটা সম্ভবত এখান থেকেই ফেলা হয়েছিল। এত উঁচু থেকে ফেলা বলে ঠিক মতো লক্ষ ভেদ হয়নি। আর্লই কি ফেললেন পাথরটা?’ কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর আবার নীচে নেমে এল তারা। বুরুজ থেকে বাইরে বেড়িয়ে নীচে নামার সিঁড়িটার দিকে তাকিয়ে জুয়ান বললেন, ‘এ পথে দুর্গের বাইরে থেকেও কিন্তু দুর্গে ঢোকা যায়, বুরুজেও আসা যায়। এমনও হতে পারে তোমার দেখা ওই প্রেতাত্মা হয়তো রিচমন্ড নয়, সে বাইরে থেকে কিছু খুঁজতে আসে দুর্গে বা কবর ঘরে।’ দীপাঞ্জন বলল, ‘আজ রাতেই হয়তো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে আমাদের কাছে।’

    ঘরে ফিরে এল জুয়ান আর দীপাঞ্জন। তার বেশ কিছুক্ষণ পর তারা শ্যাননকে ফিরতে দেখলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীপাঞ্জন তাকে বলল, ‘একটা ঘটনা ঘটেছে। নীচের চত্বরে রিচমন্ডের ঘাড়ের ওপর পাথর খসে পড়েছে। অল্পর জন্য সে রক্ষা পেয়েছে। কাঁধে আঘাত লেগেছে। যদিও চোট তেমন গুরুতর নয়। বুরুজের ওপর থেকে পাথরটা পড়ছে।’ দীপাঞ্জনের কথা শুনে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল শ্যাননের চোখেমুখে। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘একটা কথা বলি আপনাদের। এ জায়গাটা মোটেই সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। অনেক দুর্গ দেখেছি আমি, কিন্তু এমন গা ছমছমে জায়গা দেখিনি। রিচমন্ড যে স্কন্ধকাটার গল্প বলল হয়তো সেই ফেলেছে পাথরটা? রাতটা কাটিয়ে সকাল হলে চলে যেতে পারলে ভালো। আর বনটাও কেমন যেন গা ছমছমে! মনে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে কারা যেন কথা বলছে! তার কথা শুনে দীপাঞ্জনের পিছন থেকে গলা বাড়িয়ে জুয়ান বিস্মিতভাবে বললেন, ‘আপনি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করেন?’ শ্যানন গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ করি। অনেক নামকরা বৈজ্ঞানিকরাও ভূত-ভগবানে বিশ্বাস করতেন। আপনারা হাসবেন বলে আগে বলিনি, ওই সমাধিক্ষেত্রে অন্ধকারের মধ্যে আমি একটা ছায়া সরে যেতে দেখেছি। তারপর রিচার্ড নামের দাঁড়কাকটাও কী বিরাট বড়ো আর অদ্ভুত দেখতে! কাক কখনও মাটির নীচে অন্ধকার ঘরে থাকে শুনেছেন? আমরা ধারণা ও একটা কাকরূপী প্রেতাত্মা। এমনকি ও নিজেই সেই স্কন্ধকাটা হতে পারে।

    শ্যানন তার কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে দীপাঞ্জনরা হাসতে পারল না। আঘাত পেতে পারেন ভদ্রলোক। ‘কাল সকালে এ জায়গা ছাড়তে পারলে বাঁচি।’ এই বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন ভদ্রলোক।

    দুপুরটা ঘরেই কাটিয়ে দিল দীপাঞ্জনরা। বিকালে আলো একটু পড়লে ঘর ছেড়ে বেরোল তারা। শ্যাননের ঘরের দরজা বন্ধ ৷ জুয়ান বললেন, ‘বাইরে বেরোবার আগে চলো একবার রিচমন্ডের অবস্থাটা দেখে আসি। তার ঘরে পৌঁছে গেল তারা। দরজা খোলাই ছিল। বই পড়ছিল সে। দীপাঞ্জনদের দেখে সে বলল, ‘এখন অনেকটাই সুস্থ, আশা করছি কাল আপনাদের ন্যাটিংহ্যাম স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারব। জুয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি বিশ্রাম নিন। জঙ্গলটা দেখা হয়নি। আমরা বরং সেখানে বেড়িয়ে আসি।’

    রিচমন্ডের সঙ্গে সাক্ষাতের পর নীচে নেমে প্রধান ফটকের লাগোয়া ফাটল গলে বাইরে বেরিয়ে এল। দুর্গটাকে বেড় দিয়ে তারা পৌঁছে গেল পিছন দিকে। জঙ্গলটা প্রায় দুর্গর পিছনদিক থেকেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। শেরউড বনে ঢুকল তারা। এ যেন এক অন্য পৃথিবী। পাইন, বার্চ, রোজউড আরও চেনা-অচেনা নানা গাছ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শ্যানন ঠিকই বলেছিলেন, বাতাসের শব্দ শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ বা কারা যেন গাছের গুড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে, ছোটোবেলায় ছবির বইতে পড়া রবিনহুডের সেই শেরউড বন! ভাবতেই কেমন যেন রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল দীপাঞ্জনের। সময় এগিয়ে চলল। শেরউড বনের মাথার ওপর সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে ছায়া ঘনাতে শুরু করল। দুর্গাপ্রাকারে হঠাৎ শোনা গেল দাঁড়কাকদের সেই অদ্ভুত কলরব। বেশ কিছুক্ষণ ধরে জঙ্গলের মধ্যেই অনুরণিত হলো সেই ডাক। অন্ধকার নামার সংকেতধ্বনি। জঙ্গল ছেড়ে দীপাঞ্জনরা ফেরার পথ ধরল।

    যে দিক থেকে দুর্গটাকে বেড় দিয়ে পিছনে গেছিল তারা। ফেরার সময় তারা ঠিক উলটো দিক থেকে বেড় দিয়ে এগোতে থাকল। উদ্দেশ্য ছিল বাইরের চারপাশ থেকে দুর্গটা একবার দেখে নেওয়া। দুর্গপ্রাকারের গা ঘেঁষেই হাঁটছিল তারা। হঠাৎ জুয়ান বললেন, ‘আরে ওটা কী?’

    ঝোঁপটার কাছে গিয়ে জিনিসটা কুড়িয়ে নিল তারা। রোল করা খবরের কাগজ। লন্ডন টাইমস এর ট্যাবলয়েড সংস্করণ, তার তারিখ দেখে জুয়ান বললেন, ‘তারিখটা দেখছি গতকালের। অর্থাৎ যে কাগজটা আজকে দেবার কথা ছিল। এটাইতো আর্ল খুঁজছিলেন, তাহলে কী দায় এড়াতে ডাক বিভাগের লোক এটা এখানে ফেলে গেছে?’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘আরও একটা ব্যাপারও হতে পারে। ওই দেখুন মাথাতেই তো বেশ কয়েকটা কাকের বাসা, আমি ওদের বাসাতেও কাগজ পিজবোর্ডের অনেক বড়ো বড়ো টুকরো দেখেছি। ছোটো রোল করা কাগজ। এমনও হতে পারে ডাকবিভাগের লোক ঠিক জায়গাতে কাগজটা রেখে গেছে আর কাগজটা ঠোঁটে করে এখানে এনে ফেলেছে।’

    জুয়ান বললেন, হ্যাঁ, তা হতে পারে!’ কাগজটা তিনি পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন। তারা দুর্গে ফিরে আসতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল।

    নিজেদের ঘরে ফিরে এল দীপাঞ্জনরা। জুয়ান বললেন, শ্যাননের ঘরের দরজা বন্ধ দেখলাম। সম্ভবত উনি আর বাইরে বেরোননি। রাত আটটা নাগাদ রিচমন্ড খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হল ঘরে। দীপাঞ্জনরা তাকে দেখে বেশ অবাকই হলো। খাবারের ট্রে নামিয়ে রেখে সে বলল, ‘এখন বেশ সুস্থ বোধ করছি তাই খাবার নিয়ে এলাম। জঙ্গল কেমন দেখলেন ?”

    জুয়ান বললেন, ‘খুব ভালো। অনেক পুরোনো গাছ আছে। তবে হরিণ দেখিনি।’ এ কথা বলার পর তিনি পকেটে হাত দিলেন কুড়িয়ে পাওয়া কাগজটা ফেরত দেবার জন্য। ঠিক সেই সময় শ্যানন দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সম্ভবত রিচমন্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি উঠে এসেছেন। রিচমন্ডকে দেখে তিনি বললেন, ‘শুনলাম আপনার আঘাত লেগেছিল! যাক এখন সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। সত্যি আপনার সাহস আছে! এত বড়ো ভূতুড়ে দুর্গ প্রাসাদে একা থাকেন কী করে কে জানে!

    রিচমন্ড হেসে বলল, ‘একা কেন? আর্ল আছেন, তারপর আছে ওই জর্জের প্রেতাত্মা।’ শ্যানন বললেন, ‘আর্লকে তো ঠিক সুস্থ মানুষ বলে ধরা যায় না। আর ওই… দীপাঞ্জনের মনে হলো ওই প্রেতাত্মার প্রসঙ্গটা ওঠায় যেন কেমন মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক। তাই আর বেশি কথা না বলে রিচমন্ডকে বললেন, ‘আমার ঘরে তাড়াতাড়ি খাবারটা দিয়ে যান। খাবার খেয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব আমি। কাল কিন্তু তাড়াতাড়ি বেরোব। গাড়িটা তৈরি করে রাখবেন।’

    এ কথা বলে, দীপাঞ্জনদের শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে শ্যানন ফিরে গেলেন । তিনি চলে যাবার পর জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘মহামান্য আর্লের খবর কী?”

    রিচমন্ড বলল, “তিনি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। তবে শোবার আগে আমাকে জানিয়েছেন যে লন্ডন থেকে ঘোড়সওয়ার রাজার কোনো পত্র নিয়ে আসতে পারে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে যেন ডেকে তোলা হয়।’

    এ কথা বলার পর রিচমন্ড বলল, ‘আমি এবার আসি। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব। কাল আপনাদের ন্যাটিংহ্যামে পৌঁছোতে হবে ।

    রিচমন্ড ঘর ছেড়ে বেরোবার পর জুয়ান বললেন, ‘ওহো, কথায় কথায় কাগজটাই দিতে ভুলে গেলাম রিচমন্ডকে। ডিনার করে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নাও। তারপর নৈশ অভিযানে বেরোব ।’

    ৷৷ ৭ ৷৷

    বেশ বড়ো সোনার থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে শেরউড বনের মাথায়। তার আলো এসে পড়েছে দুর্গ প্রাসাদে চাঁদের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকা নশো বছরের প্রাচীন বুরুজে, দুর্গপ্রাকারে, অলিন্দে, নীচের চত্বরে। তবে প্রাকারের খাঁজ, অলিন্দের বাঁক বা স্তম্ভর আড়ালে যেখানে চাঁদের আলো প্রবেশ করছে না, সেখানকার অন্ধকার যেন আরও গাঢ় মনে হচ্ছে আজ। স্তম্ভ মিনারের ছায়াগুলোতে লাগছে আরও বেশি দীর্ঘ। দুর্গ প্রাকারের খাঁজে, ছাদের কার্নিসে বসে ঘুমোচ্ছে সার সার দাঁড়কাক। তারা কেউ নড়ছে না। যেন তারা এই প্রাচীন স্থাপত্যরাই নিশ্চল অংশ।

    কোথাও কোনো শব্দ নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল দীপাঞ্জনরা। শ্যাননের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার পাল্লায় কান রেখে শ্যাননের নাক ডাকার শব্দ শুনল দীপাঞ্জন ৷ মার্জারের মতো নিঃশব্দে অলিন্দ পেরিয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল, মাঝে মাঝে মাথার ওপরের গবাক্ষ দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়ছে পাথুরে ধাপগুলোতে সিঁড়ির বাঁকে। আলো ছায়ার খেলায় সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন যোদ্ধা নাইটদের বর্মগুলোতে অনেক সময় জীবন্ত মনে হচ্ছে। যেন তারা নড়ে উঠছে! এই বুঝি তারা হাতে ধরা বর্ষা উঁচিয়ে থামতে বলবে।

    সেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল দীপাঞ্জনরা। থামের আড়াল থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তারা দেখল চত্বরটা। চাঁদের আলোতে নিষ্প্রাণ চত্বরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না, কেউ কোথাও নেই। মূক, নিঃসঙ্গ চত্বরটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো তার ফেলে আসা যৌবনের কথা ভাবছে। যোদ্ধাদের লোহার জুতোয়, রাজা, আর্ল, ডিউকদের ঘোড়ার খুরে, বন্দিদের নগ্ন ক্ষতবিক্ষত পায়ে তার বুকের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লেখা হয়েছে কত কাহিনি, কত ইতিহাস !

    চারপাশে কেউ নেই এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হবার পর দীপাঞ্জনরা চত্বরে নেমে নিঃশব্দে দ্রুত জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে উঠল উলটো দিকের থামের আড়ালে। তারপর অলিন্দ পার হয়ে উপস্থিত হল ডুয়েল কোর্টে। মাথার ওপর থেকে সরাসরি চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই মৃত্যু উঠানে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে আঁকা প্রাচীন যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন, তলোয়ারের দাগ। আর সেই জায়গার শেষপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র নামার দরজাটা।

    ডুয়েল কোর্টও পেরিয়ে তারা পৌঁছে গেল দরজার সামনে। দরজার ভিতরে যেন গহ্বর হাঁ করে আছে। জুয়ান একটা পেনসিল টর্চ জ্বালালেন। নীচে নামা শুরু হলো। তারা পৌঁছে গেল ভূগর্ভস্থ সেই কক্ষে। গবাক্ষ দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে। সেই আলোতে আবছাভাবে জেগে আছে সাদা পাথরের বড়ো বড়ো কফিন বাক্স বা শবাধারগুলো । জায়গাটাতেও কেউ নিশ্চিত হবার পর সিঁড়ির বাঁকের আড়াল থেকে নেমে পড়ল কবরখানায়। দুপাশে সারসার শবাধার। ডালা ভাঙা শবাধারগুলোর মধ্যে খেলা করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার। তারা তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে প্রায় ঘরটার শেষ প্রান্তে পৌঁছোল। কাছেই দেয়ালের শাখায় খাঁজের মধ্যে রাখা সেই বাক্সটা। রিচার্ডের বাসস্থান। তবে সে সেখানে নেই। সম্ভবত নৈশ ভ্রমণে বেরিয়েছে। কাছেই একটা ডালা ভাঙা শবাধার পছন্দ হলো তাদের। দৈর্ঘ্যে অন্তত সেটা ছ’ফুট আর গভীরতায় চার ফুট হবে। অনায়াসে তার মধ্যে দু-জন ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারবে। যার শবাধার তিনি নিশ্চয়ই বেশ দীর্ঘকায় ব্যক্তি ছিলেন। জুয়ান দীপাঞ্জনকে ইশারা করলেন শবাধারে প্রবেশ করার জন্য। হাজার হোক মৃত মানুষের শবাধার। মুহূর্তর জন্য একটু অস্বস্তিবোধ হওয়ায় থমকে দাঁড়াল দীপাঞ্জন । আর ঠিক সেই সময় একটা খস খস শব্দ শুরু হলো ভিতরে। শবাধারে শুয়ে কেউ যেন হাত পা নাড়ছে। দুজনেই চমকে উঠল শব্দটা শুনে। পর মুহূর্তেই একটা বেশ বড়ো ইঁদুর শবাধারের ভিতর থেকে লাফিয়ে নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এত উত্তেজনার মধ্যেও হেসে ফেলল দুজন। মুহূর্তর জন্য হলেও তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল প্রাণীটা । এরপর আর সময় নষ্ট না করে তারা আত্মগোপন করল শবাধারের ভিতর। তাদের চারপাশেও শুধু প্রাচীন শবাধার। এদের মধ্যে অনেকেরই নাকি মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে অথবা ডুয়েল কোর্টে। অপঘাতে মৃত মানুষদের আত্মার নাকি মুক্তি ঘটে না! দীপাঞ্জন যেন কোনো একটা বইতে পড়েছিল একথা। প্রাচীন দুর্গপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্রের অন্ধকারে সময় এগিয়ে চলল।

    মিনিট কুড়ি সময় কেটে যাবার পর হঠাৎই একটা ছায়ামূর্তি নেমে এসে দাঁড়াল সিঁড়ির মুখে। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে গেল দীপাঞ্জনরা। কে ও? সেই স্কন্ধকাটা ? ” ছায়ামূর্তিটা একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল, তারপর যেন বেশ নিশ্চিন্ত ভাবেই সমাধিবাক্সগুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল দীপাঞ্জনরা যেখানে লুকিয়ে আছে সেদিকে। কাছাকাছি আসতেই চেনা গেল লোকটাকে। সে রিচমন্ড। তার হাতে ধরা আছে ছোট একটা বাক্স । সেই গয়নার বাক্সটা। দীপাঞ্জনদের কয়েক হাত তফাতে গিয়ে সে থামল। দেয়ালের গায়ে লাগানো একটা কফিন বাক্সর ওপর উঠে দাঁড়াল সে। একটা শব্দ করল ‘উঃ’ করে। হয়তো বা তার কাঁধের ব্যথার জন্যই। বাক্স সমেত হাত উঁচু করল সে। হাত পৌঁছে গেল দেয়ালের গায়ে রিচার্ডের বাসায়। বাক্সটা সে ফেলল সেই ছোট শবাধারে। এরপর লাফিয়ে নীচে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাধিক্ষেত্র ছেড়ে ওপরে উঠে গেল। জুয়ান বললেন, আমার অনুমানই তবে ঠিক। দাঁড়কাকের বাসাতেই দামি জিনিসগুলো রাখা হয়। আমাদের দেখাবার জন্যই সম্ভবত ওই স্কন্ধকাটা সেজে কাকের বাসা থেকে জিনিসগুলো নিতে এসেছিল সে। কিন্তু তার দুর্ঘটনার পর হয়তো তার আমাদের সৎ লোক বলে মনে হয়েছে। সে জন্য সে আজ আর ও পোশাকের ধার ধারেনি।’

    দীপাঞ্জন বলল, ‘তাহলে এবার ফেরা যাক? সে বাইরে বেরোতে যাচ্ছিল জায়গাটা ছেড়ে। কিন্তু জুয়ান বলল, ‘না, আরও মিনিট দশেক থাকি এখানে। কোনো কারণে সে যদি আবার এখনই ফিরে আসে তবে আমাদের এখানে দেখলে তার মনে ভুল ধারণা হতে পারে। তাছাড়া সে ঘরে ফিরে গেলেও তার জন্য তাকে সময় দেওয়া দরকার। আর একটু অপেক্ষা করে বেরোনোই ভালো।’

    মিনিট দশেক সময় কবরের বাক্সর মধ্যেই কেটে গেল। এক সময় জুয়ান বললেন এখানে রাত কাটাতে বেশ ভালোই লাগল। মানুষ মিথ্যা ভয় পায় এসব জায়গা নিয়ে। এটা এত প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র। এখানে কোনো প্রেতাত্মা থাকলে সে কি দেখা দিত না? এই শবাধারগুলোতে যাঁরা ছিলেন বা আছেন তাদের অনেকেরই তো অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। আসলে এসবই মানুষের মনের ভুল। চলো এবার ফেরা যাক।’ এই বলে তিনি কফিন ছেড়ে নামতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় দীপাঞ্জনের চোখে পড়ল সিঁড়ির মুখটাতে। নিজের অজান্তেই তার একটা হাত যেন টেনে ধরল জুয়ানকে। তিনিও সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। সিঁড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে আরও একজন। গবাক্ষের অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে তার গায়ে। সেই আলোতে বোঝা যাচ্ছে সে রিচমন্ড নয়, দীর্ঘকায় অন্য এক ছায়া মূর্তি। তার পরনে লম্বা ঝুলের পোশাক, কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ার ঝুলছে। ভালো করে তাকে দেখার পর চমকে উঠল তারা। লোকটার কোনো মুণ্ডু নেই, সে এক কবন্ধ মূর্তি, ঘাড়ের ওপর শুধু জেগে আছে তার গলাটা! দীপাঞ্জনতো ওপর থেকে নীচের চত্বরে একেই দেখেছিল। জর্জের মুণ্ডুহীন প্রেতাত্মা !

    সে কখন এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক খেয়াল করেনি দীপাঞ্জনরা। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছে পাথরের মূর্তির মতো। কোনো দিকে সে ঘুরছে না। তার দিকে বিস্মিতভাবে চেয়ে রইল তারা। এক একটা মুহূর্ত যেন মনে হচ্ছে এক এক ঘণ্টা। কিছুক্ষণ পরই মুহূর্তর জন্য যেন ঢেকে গেল গবাক্ষটা। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল সব। তারপরই অবশ্য আবার অস্পষ্ট আলোকিত হয়ে উঠল জায়গাটা। গবাক্ষ দিয়ে রিচার্ড প্রবেশ করেছে ঘরে। সারা ঘরে একবার পাক খেয়ে সে গিয়ে বসল নিজের জায়গাতে। তার নিরাপদ আশ্রয়ে সেই দেয়ালের তাকের শবাধারটার মধ্যে। সেখানে বসে বড়ো কাকটা ঠোঁটগুঁজে ঘাড়ের মধ্যে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়ল সে। এবার নড়ে উঠল কবন্ধ ছায়ামূর্তিটা। সে এগোতে শুরু করল দীপাঞ্জনরা যেদিকে আছে সেদিকে। একটা রক্তস্রোত যেন প্রবাহিত হতে লাগল দীপাঞ্জনের ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত। একটা শিরশির অনুভূতি।

    রিচমন্ডের মতোই সে এসে দাঁড়াল একই জায়গাতে দীপাঞ্জনদের কাছাকাছি। এবার তারা স্পষ্ট দেখতে পেল তাকে। তার পোশাকই বলে দিচ্ছে সে রাজকীয় ব্যক্তি। তার পরনে মধ্যযুগের সম্ভ্রান্ত লোকেদের মতো সার্টিনের পোশাক, ঝলমলে কোমরবন্ধ তলোয়ারের খাপটাও ঝিলিক দিচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে। তার ছিন্ন গলাতে ঝুলছে বেশ কিছু মালা। তবে তার বুক যে রক্তে ভেজা তা অস্পষ্ট আলোতেও বোঝা যাচ্ছে। বীভৎস দেখাচ্ছে তার ধড়ের ওপর মুণ্ডুহীন গলাটা!

    মূর্তিটা এরপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল রিচমন্ড যে শবাধারে উঠে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। মাথার ওপর দিকে দেওয়ালের গায়ে রিচার্ডের বাক্সর দিকে সে হাত বাড়াল। সে কী লুঠ করতে চায় আর্লদের সম্পদ? নাকি ওখানে তারও কাটা মুণ্ডু রাখা আছে? কাকটা মাথা তুলল এবার। তাকাল কবন্ধ মূর্তির দিকে। কিন্তু তার মধ্যে তেমন কোনো উত্তেজনা দেখা গেল না। বহু যুগ ধরে এটা তার নিরাপদ বাসস্থান। কিন্তু এর পর মুহূর্তই একটা কাণ্ড ঘটল। সাপ যেমন তার শিকার ধরে তেমনই সেই মূর্তির ডান হাতটা সাপের ছোবলের মতো উঠে গিয়ে চেপে ধরল দাঁড়কাকের গলা। এমন কোনো ঘটনা ঘটতে পারে হয়তো ভাবতেই পারেনি কাকটা । দীর্ঘ দিন ধরে এ প্রাসাদে সবাই তাকে আদর যত্নই করে এসেছে, কেউ আক্রমণ করেনি। কবন্ধ মূর্তির বজ্রকঠিন মুঠির মধ্যে আটকা পড়ে গেল সে। এমনভাবে আটকা পড়ল যে তার ডাক দেবার ক্ষমতা রইল না। দু-একবার পাখা ঝাপটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে থেমে গেল। আঙুলগুলো এঁটে বসেছে তার গলায়। কাকটাকে নিয়ে কবন্ধ মূর্তি লাফিয়ে নীচে নামল, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে যেদিক থেকে সে এসেছিল সেদিকে এগোল।

    জর্জের প্রেতাত্মা সিঁড়ির মুখে অদৃশ্য হতেই জুয়ানের ধাক্কায় সংবিৎ ফিরল দীপাঞ্জনের। জুয়ান বললেন, ‘চলো ওকে অনুসরণ করতে হবে। ও যদি কোনো রক্তমাংসের মানুষ হয় তবে এত নির্লোভ চোর আমি দেখিনি। ধনরত্নর বদলে দাঁড়কাক চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে! ওই কাক নিয়ে ও কী করবে?’

    কবরের বাক্স থেকে বেরিয়ে দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগোল তারা। দীপাঞ্জনরা যখন বাইরে এল তখন কাক হাতে সেই কবন্ধ মূর্তি সেই ডুয়েল কোর্ট পার হয়ে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দীপাঞ্জনরাও নিঃশব্দে এগোল তার পিছনে। কবন্ধ মূর্তির আবার দেখা মিলল ভিতরের চত্বরটাতে। স্তম্ভগুলোর আড়াল থেকে সে নীচে নেমেছে চত্বর পেরিয়ে অন্য দিকে যাবার জন্য। যেখানে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা আছে। স্তম্ভের আড়াল থেকে তারা দেখতে লাগল তাকে।

    জর্জের প্রেতাত্মা এখন চত্বরের মাঝখানে পৌঁছেছে, ঠিক তখনই ওপাশের স্তম্ভের আড়াল থেকে চত্বরে নামল একজন। তার পরনে যুদ্ধের পোশাক। হাঁটু পর্যন্ত চামড়ার ফিতে বাঁধা জুতো। কোমরবন্ধে ঝুলছে লম্বা তলোয়ার। দেহের ঊর্ধ্বাংশ ঢাকা আছে লোহার ঝালর দেওয়া বর্মে, মাথায় শিরস্ত্রাণ।

    লোকটাকে দেখেই চত্বরের মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল জর্জের প্রেতাত্মা। সেই বর্মধারী যোদ্ধা এগিয়ে এল তার দিকে। এবার তাকে চিনতে পারল দীপাঞ্জনরা। নতুন আগন্তুকের হাতে একটা শিঙা ধরা আছে। তিনি আর্ল সেভার্ন।

    আর্ল ও সেই কবন্ধ মূর্তি কিছুটা তফাতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অদ্ভুত মূর্তি দুটো পরস্পর পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল।

    আর্ল তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে? রিচমন্ড নাকি?”

    কবন্ধ জবাব দিল, ‘আমি রিচমন্ড নই। আমি জর্জের প্রেতাত্মা।’

    আর্ল বললেন, “তা হতে পারে না। তাহলে তুমি নিশ্চই নরাফাক্সের রাজদ্রোহী ডিউক?’

    তার কথা শুনে কবন্ধমূর্তি যেন একটু হাসল বলে মনে হলো। তারপর সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সে কথা অবশ্য তুমি বলতে পারো।’

    আর্ল বললেন, ‘আমি তাহলে ঠিকই ধরেছি। রাজদ্রোহী তুমি দুর্গে প্রবেশ করেছ কেন?

    আমি রাজার অনুগত সেবক আর্ল সেভার্ন তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি। চলো, ডুয়েল কোর্টে চলো।’ এই বলে তলোয়ারের হাতলে হাত রাখলেন বৃদ্ধ আর্ল স্তম্ভের আড়ালে অন্ধকারে আত্মগোপন করে দীপাঞ্জন আর জুয়ান শুনতে লাগলেন তাদের কথোপকথন ।

    কবন্ধ মূর্তি স্পষ্টই হাসল দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা শুনে। সে বলল, ‘সে না হয় যাওয়া যাবে ডুয়েল কোর্টে। কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলাম। তুমি নীচে নেমে আসায় আমার কাজে সুবিধা হলো। ডুয়েল কোর্টে যাবার আগে এটা দেখো—’ এই বলে সে চাঁদের আলোতে উঁচু করে তুলে ধরল গলা চেপা দাঁড় কাকটাকে।

    বৃদ্ধ আর্ল সম্ভবত এতক্ষণ ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। প্রেতাত্মা সেটা ওপরে তুলে ধরতেই আর্ল আর্তনাদ করে উঠলেন—‘রিচার্ড’ বলে।

    তারপর তিনি বলে উঠলেন, ‘ওকে নিয়ে তুমি কী করবে? ছেড়ে দাও, ওকে ছেড়ে দাও বলছি।’

    ছায়ামূর্তি বলল, ‘হ্যাঁ ওকে ছেড়ে দেব ঠিকই, কিন্তু তার আগে একটা একটা করে ডানা ছিঁড়ব, তারপর গলাটা মুচড়ে ভাঙব।’ এই বলে সে কাকটার ডানা থেকে কটা পালক ছিঁড়ে অন্ধকারে উড়িয়ে দিল।

    . ব্যাপারটা দেখেই আর্তনাদ করে উঠলেন আর্ল। তিনি কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘দোহাই তোমার, অমন কোরো না। নরফাক্সের ডিউক তুমি কী চাও বলো? আমি আত্মসমর্পণ করছি। এ প্রাসাদ তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি, শুধু ওকে তুমি ছেড়ে দাও।’

    জর্জের প্রেতাত্মা বলে উঠল, ‘এ ভাঙা প্রাসাদ নিয়ে কী করব? আমি অন্য জিনিস চাই। তার আগে তলোয়ারটা নামিয়ে রাখো।’ ইতস্তত করতে লাগলেন আর্ল। তাই দেখে স্কন্ধকাটা আরও দুটো পালক ছিঁড়ে বাতাসে ওড়ালেন। আবার আর্তনাদ করে উঠলেন আর্ল। তারপর তলোয়ারটা কোষমুক্ত করে ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। ধাতব শব্দ করে সেটা আছড়ে পড়ল দীপাঞ্জনরা যে থামের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার কাছেই। আর্ল এরপর কাতরকণ্ঠে বলল, “আর কী করতে হবে বলো? কি নিতে এসেছ তুমি ধন সম্পদ? ও সব রিচার্ডের বাক্সে আছে। সব নিয়ে যাও, শুধু ওকে ছেড়ে দাও…

    এ পর্যন্ত শোনার পর জুয়ান বললেন, ‘লোকটা লুটেরা ওকে থামাতে হবে।’ এই বলে থামের আড়াল থেকে লাফিয়ে নেমে আর্লের তলোয়ারটা নিয়ে জুয়ান ছুটলেন কবন্ধ মূর্তির দিকে। তাঁকে অনুসরণ করল দীপাঞ্জন। সেই স্কন্ধকাটা শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরল। জুয়ানকে ছুটে যেতে দেখে সেও কোষমুক্ত করে ফেলল তলোয়ার।

    প্রথম আঘাত হানলেন জুয়ানই। তলোয়ার উঁচিয়ে সেটা প্রতিহত করল ছায়া মূর্তি। দুই তলোয়ারের সংঘর্ষে প্রচণ্ড ধাতব শব্দ আর আগুনের ফুলকি উঠল। শুরু হলো এক অদ্ভুত লড়াই। চত্বর জুড়ে তখন এগিয়ে কখনও পিছিয়ে লড়াই চালাতে থাকল দুই যোদ্ধা। ঠিক যেমন ডুয়েল লড়াই হত একসময়। দুই তলোয়ারের ধাতব সংঘর্ষের শব্দ অনুরণিত হতে লাগল চত্বর জুড়ে। সে লড়াইয়ের হতবাক দর্শক দীপাঞ্জন আর আর্ল।

    এক হাতে কাকটা ধরে অন্য হাতে তলোয়ার ধরে লড়াই চালাচ্ছে কবন্ধ মূর্তি। তবে জুয়ানও যে এত ভালো তলোয়ার চালাতে পারেন তা জানা ছিল না দীপাঞ্জনের। সেই কবন্ধমূর্তি যেন পিছু হটতে শুরু করেছে আত্মরক্ষা করতে করতে। জুয়ানের তলোয়ার একবার ছুঁয়ে গেল ছায়ামূর্তির বাহু। মুহূর্তের মধ্যেই একটা লাল দাগ সৃষ্টি হলো সেখানে। ছায়ামূর্তি সঙ্গে সঙ্গে হাতে ধরা দাঁড়কাকটাকে উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল, ‘এই বুড়ো কাকটা আর বাঁচবে না। এখনই এর প্রাণ বার করে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটল। আর্ল সেভার্ন হঠাৎ ছুটে এসে জুয়ানকে জাপ্টে ধরে বলতে থাকলেন, লড়াই থামাও, লড়াই থামাও, নইলে ও রিচার্ডকে মেরে ফেলবে।

    এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না জুয়ান হতচকিত হয়ে পড়লেন তিনি। কবন্ধ মূর্তি মনে হয় এই রকম কোনো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তলোয়ারের উলটো দিক দিয়ে সে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল জুয়ানের মাথায়। হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ল জুয়ানের, আর্লের বাহুবন্ধন থেকে তিনি ঢলে পড়লেন মাটিতে। দীপাঞ্জন ছুটে আসতে যাচ্ছিল। কিন্তু কবন্ধ মূর্তি চিৎকার করে উঠল—’কাছে এলেই এখনই এর মুণ্ডু কেটে দেব।’ সেই বীভৎস মূর্তির উদ্যত তলোয়ারের নীচে পড়ে যাচ্ছেন অচৈতন্য জুয়ান। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপাঞ্জন ।

    আর্লও কিছুটা পিছু হটে দাঁড়িয়েছেন। তাকিয়ে আছেন কবন্ধমূর্তির পায়ের নীচে পড়ে থাকা জুয়ানের দিকে। হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি তার জন্য এমন একটা ঘটনা ঘটবে। তিনি অস্পষ্ট ভাবে ছায়ামুর্তির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ওকে তুমি মারলে?’

    সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ মারলাম। এবার কাকটার মুণ্ডু কাটাব। কবর ঘরের বাক্সে যা আছে তা আমি নিতে আসিনি। নিতে এসেছি তোমার কাছে যে জিনিসটা রাখা আছে সেটা।’

    কথাটা শুনে যেন থমকে গেলেন আর্ল। তাঁর মুখ স্পষ্ট বিস্ময় ফুটে উঠল। কবন্ধ মূর্তি আবার ধমকে উঠল, ‘দিয়ে দাও বলছি, দিয়ে দাও।’

    আর্ল হতভম্বর মতো আরও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর শিঙার মাথার দিকটা অন্য হাতের চেটোয় ওপর উপুড় করে কয়েকবার ঝাঁকি দিলেন। একটা ছোট্ট কাপড়ের পুঁটলি শিঙার ভিতর থেকে খসে পড়ল তাঁর হাতে। সেটা নিয়ে তিনি ছুড়ে দিলেন কবন্ধ মূর্তির দিকে। কবন্ধর এক হাতে ধরা তলোয়ার, অন্য হাতে দাঁড়কাকটা। আর্ল যে জিনিসটা ওভাবে তার দিকে দেবেন তা মনে হয় ধারণা করতে পারেনি সে। ছোট্ট বলের মতো আকারের কাপড়ের পুঁটলিটা কবন্ধর গায়ে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে ফেটে গেল। তার থেকে বিন্দ বিন্দু আলোক বিন্দু যেন ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। জহরত!

    কবন্ধ মূর্তি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে তলোয়ারটা পাশে নামিয়ে আর্ল আর দীপাঞ্জনদের দিকে তাকাতে তাকাতে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা জহরতগুলো আর পুঁটুলিটা তার পোশাকের মধ্যে পুরে ফেলল। কিন্তু সে তলোয়ারটা তুলে নিয়ে যখন উঠতে যাচ্ছে তখনই সে কীসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল একবার। আর তখনই যেন কীভাবে তার হাত ফসকে মুক্ত হয়ে গেল রিচার্ড। একটা কর্কশ ডাক ছেড়ে আতঙ্কিত পাখিটা উড়ে গেল আকাশের দিকে। আর তারপরই এক খসখস অদ্ভুত শব্দ হতে লাগল দুর্গ প্রাকারের খাঁজ আর মাথার ওপরের তাকগুলো থেকে। এক অদ্ভুত খসখস শব্দ!

    কবন্ধ মূর্তিটা মাটিতে পড়ে গেলেও দাঁড়কাকটা হাত ছাড়া হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং-এর মতো লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। তারপর তলোয়ারটা দিয়ে অচৈতন্য জুয়ানকে দেখিয়ে বলল, “কাকটা গেল যাক। এ লোকটা তো আছে, এর জীবন তোমার ওপরই নির্ভর করছে আল। দাঁড়কাক নয়, একটা মানুষের জীবন।’

    আর্ল বলে উঠলেন, ‘যা ছিল তোমাকে দিয়েছি। এবার তুমি দুর্গ ছেড়ে চলে যাও।’ কবন্ধমূর্তি বলে উঠল, ‘যাব, তার আগে তোমার হাতের শিঙাটাও চাই আমার চাই। ওটা নিতেই তো এসেছি আমি।’

    বৃদ্দ আর্ল সেভার্ন কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। শিঙাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। যেন বৃদ্ধ আর্ল কী করবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাকের গায়ে খসখস শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা পড়ছে চাঁদ। মুহূর্তর জন্য অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চত্বরটা। মাটিতে পড়ে আছেন জুয়ান। মাথার কাছে মাটি রক্তে ভেজা। কবন্ধ মূর্তির তলোয়ারের নীচে তার দেহ। বেশ কিছুটা তফাতে দীপাঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে। সে বুঝতে পারছে না সামান্য শিঙাটা দিতে তিনি এত দেরি করছেন কেন? ওই জহরতগুলোর থেকেও কী শিঙার মূল্য বেশি? নাকি শিঙার চেয়ে জুয়ানের জীবনের মূল্য কম আর্লের কাছে? আর্লের সিদ্ধান্তের ওপর হয়তো সত্যিই নির্ভর করছে জুয়ানের জীবন ।

    দীপাঞ্জন তাঁকে বলতে যাচ্ছিল শিঙাটা কবন্ধমূর্তিকে দিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু তার আগেই সেই মূর্তি বলল, ‘দাও শিঙাটা দিয়ে দাও।’

    আর্লের মুখে যেন একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। হয়তো বা সেটা পাগলের পাগলামো । তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, দিচ্ছি, তবে দেবার আগে জিনিসটা একবার বাজিয়ে নেই।’ ছায়ামূর্তি শুনে অট্টহাস্য করে বলে উঠল, ‘ওটা বাজিয়ে আর্ল. তোমার সৈন্যসামন্ত ডাকবে নাকি? ছিল তো শুধু রিচমন্ড। সে এখন তলোয়ারের ঘায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বন্ধ ঘরে। আর কে আসবে শিঙার ডাকে? ঠিক আছে কয়েকবার বাজিয়ে নাও তোমার শিঙা।’

    কয়েক মুহূর্ত সেই কবন্ধ মূর্তির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বৃদ্ধ আর্ল । তারপর শিঙাটা আকাশের দিকে তুলে ধরে ফুঁ দিলেন তাতে। অদ্ভুত এক পোঁ পোঁ শব্দ হলো। আর তার পরই যেন দাঁড়কাকগুলোর সম্মিলিত বীভৎস চিৎকারে কেঁপে উঠল দুর্গপ্রাসাদ। কয়েক মুহূর্তর জন্য অন্ধকার নেমে এল চত্বরে। মেঘ সরে যেতেই দীপাঞ্জন দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে দাঁড়কাক ঘিরে ধরেছে কবন্ধ মূর্তিকে। তারা ঠোকোর দিচ্ছে তাকে। সেই মূর্তি পাগলের মতো তলোয়ার চালাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু একটা দাঁড়কাক কাটা পড়লেই তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে পাঁচটা দাঁড়কাক। তাদের লম্বা ধারালো ঠোঁটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রেতাত্মার পোশাক। আর্ল সেভার্ন বাজিয়ে চলেছেন তাঁর শিঙা। আর সেই শব্দে কবন্ধ মূর্তির দিকে মাথারা ওপরের বুরুজ থেকে দুর্গর প্রাচীন খাঁজ থেকে মাথার ওপরের তাক থেকে ধেয়ে আসছে শয়ে শয়ে দাঁড়কাকের দল। বৃদ্ধ আর্লের অদৃশ্য প্রহরীরা। এতদিন আর্ল তাদের রক্ষা করেছেন এবার তারা তাঁর জন্য আত্মাহুতি দিতে তৈরি। তাদের বীভৎস চিৎকার আর আর্লের শিঙা ফোকার শব্দে কাঁপছে দুর্গ প্রাসাদ। কবন্ধ মূর্তির গলাটা খসে পড়ল তার ঘাড় থেকে। সেটা গড়াতে গড়াতে এসে পড়ল দীপাঞ্জনের পায়ে কাছে। লাল রঙ করা একটা ফাঁপা টিনের কৌটো। কিন্তু সেটা খুলে যেতেই উন্মোচিত হলো তার ভিতরে থাকা লোকটার মাথা। কিন্তু কাকগুলো মৌমাছির মতো লোকটাকে ঘিরে ধরে লোকটার মাথায় মুখে ঠেকোর দেবার চেষ্টা করছে যে তার মুখটা ঠিক বুঝতে পারছে না দীপাঞ্জন। কাকের পালকও উড়ছে চারপাশে।

    একসময় লোকটা আর লড়াই চালাতে পারল না। কাকেদের চক্রব্যূহে আটকা পড়ে গেছে সে। প্রতি মুহূর্তে ধারালো ঠোঁটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। ছিন্নভিন্ন পোশাক থেকে উন্মুক্ত হয়ে গেছে তার দেহ। প্রতি মুহূর্তে কাকগুলো ঠোকোর বসাচ্ছে সে সব জায়গাতে। তলোয়ারও এক সময় পড়ে গেল হাত থেকে। দু-হাত দিয়ে কাকের ঠোঁট থেকে মাথা বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে লোকটা বাঁচার জন্য ছুটল চত্বর ছেড়ে দুর্গর ভিতর অন্ধকার অংশে। কিন্তু কাকগুলোও তার পিছু ছাড়ল না। লোকটার পিছন পিছন কাকের ঝাঁকও হারিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। দুর্গের ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগল লোকটার আর্ত চিৎকার আর কাকেদের ডাক। অন্ধকারের মধ্যে সে শব্দ পাক খাচ্ছে দুর্গর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। অর্থাৎ কাকের দল লোকটার পিছু ছাড়েনি। দীপাঞ্জন দেখল জুয়ান উঠে বসেছেন। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। যদিও তার কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে তবু তিনি বললেন, আমার তেমন কিছু হয়নি। প্রাথমিক অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম ঠিকই, কিন্তু উঠতে পারছিলাম না চোখের সামনে লোকটার তলোয়ার নাচছিল বলে। তাই অজ্ঞানের ভান করে পড়ে ছিলাম। শেষের দিকের সব কথোপকথন আমি শুনেছি।’

    ও কথা বলার পর দীপাঞ্জনের হাত ধরে উঠে ভিয়ে জুয়ান বললেন, ‘চলো রিচমন্ডকে খুঁজে বার করতে হবে। সে কী অবস্থায় আছে কে জানে। আর রুমাল দিয়ে আমার কপালে একটা ফেট্টি বেঁধে দাও।’

    দীপাঞ্জন দ্রুত করে ফেলল সে কাজটা। তারপর মাটি থেকে তলোয়ার দুটো কুড়িয়ে নিয়ে তারা এগোল দুর্গর ভিতর কোন্ ঘরে রিচমন্ড আছে তাকে খোঁজার জন্য। আর্ল পাগলের মতো বিভিন্ন খাদে শিঙা বাজিয়েই চলেছেন। তাঁর কোনো দিকে হুঁশ নেই। কিন্তু যখন দীপাঞ্জনরা এগিয়ে গিয়ে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছে তখন তারা আবার দেখতে পেল সেই লোকটাকে। কাকের তাড়া খেয়ে কী ভাবে যেন সে পৌঁছে গেছে দুর্গপ্রাকারে। প্রাকারের গায়ে সৈন্য চলাচলের যে পথ আছে চাঁদের আলোতে সে পথ ধরে ছুটছে লোকটা, যার তার পিছু ধাওয়া করছে কাকের দল! সেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপাঞ্জনরা।

    চিৎকার করতে করতে দুর্গ প্রাকারে সংকীর্ণ পথ দিয়ে ক্রমশ ওপরে উঠছে লোকটা। এক সময় যে পৌঁছে গেল সবচেয়ে উঁচু জায়গাতে। ঠিক সেই সময় হঠাৎই শিঙা ফোঁকা থামিয়ে দিলেন আর্ল। আর শব্দ বন্ধ হওয়াতে কাকের দল হঠাৎ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে উড়তে শুরু করল আকাশে। তাদের চিৎকারও থেমে গেল। আক্রমণ মুক্ত হয়ে লোকটাও দাঁড়িয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। মাথা উঁচু করে সে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল কাকগুলো আর ধেয়ে আসছে কিনা? কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর সে যেন নিশ্চিত হলো যে কাকগুলো আর আসছে না। সে এরপর দুর্গ প্রাকারে গায়ের তাক থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে সম্ভবত দুর্গ থেকে পালাবার অন্য কোনো পথ আছে কিনা তা দেখতে লাগল ।

    আর তারপরই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। চাঁদটাকে ডানার আড়ালে ঢেকে দিয়ে আকাশ থেকে নেমে এল একটা বিশাল কাক । লোকটার পিছনে ঠোকোর দিল সে। রিচার্ড! হঠাৎ ঠোকোর আর ডানার ঝাপটায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল লোকটা। প্রাকারের ওপর থেকে একটা বীভৎস আর্তনাদ করে লোকটা সশব্দে এখানে ওখানে ধাক্কা খেতে খেতে আছড়ে পড়ল চত্বরের এক কোণে। দীপাঞ্জন আর জুয়ান ছুটে গেলেন তার কাছে। তার নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে চমকে উঠল তারা। চাঁদের আলোতে তাদের সামনের পড়ে আছে ডিউক শ্যাননের দেহ!

    পরিশিষ্ট : সকালবেলা রিচমন্ডের ঘরে বসে কথা বলছিল দীপাঞ্জন আর জুয়ান। রিচমন্ডকে তারা উদ্ধার করেছিল একতলারই একটা ঘর থেকে তার গোঙানি শুনে। আলো ফোটার পরই রিচমন্ড পুলিশ ডাকে। তারা এসে তুলে নিয়ে গেছে লর্ড ওরফে রবার্টের দেহ। পুলিশ তাকে শনাক্ত করতে পেরেছে। তার নাম রবার্ট। প্রত্নসামগ্রীর চোরা কারবারি । এর আগে সে একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় ।

    দীপাঞ্জন বলল, ‘লোকটা আচ্ছা ধোঁকাবাজ। সেমিনারে আসা ডিউক শ্যাননকে কিডন্যাপড করে নিজে শ্যানন সেজে এখানে এসেছিল! ভাবুন কী বুদ্ধি! তবে প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বেশ খোঁজখবর রাখতো লোকটা। কী সুন্দর আমাদের ইতিহাসের গল্প শোনাচ্ছিল!

    জুয়ান বললেন, ‘যারা এ সব প্রাচীন প্রত্নসামগ্রীর চোরাকারবারি তাদের ও সব খোঁজ রাখতে হয়, ইতিহাসও জানতে হয়। কুড়িয়ে পাওয়া খবরের কাগজটা যদি আগে খুলে দেখতাম তবে সব স্পষ্ট হয়ে যেত। প্রথম কাগজটায় ইতিহাসবিদ শ্যাননের ছবিসহ তার নিখোঁজ হবার সংবাদ ছাপা হয়েছিল, যার দ্বিতীয় দিনের কাগজে লন্ডনের পল্লি অঞ্চল থেকে পুলিশ কর্তৃক তাঁর উদ্ধার হওয়ার কাহিনি। তাই কাগজদুটো হাতিয়ে নিয়ে সেগুলো ফেলে দিয়েছিল রবার্ট।

    রিচমন্ড বলল, ‘পরশু রাতে আমি যখন কবন্ধর পোশাক পরে পরদিন আপনাদের দেখাবার জন্য প্রাচীন গহনাগুলো আনতে যাই তখন সম্ভবত সেও দেখে ফেলে আমাকে । তারপর কাল রাতে পোশাক ঘর থেকে হাতিয়ে নেয় আমার পোশাকটা। আমি কাল রাতে অবাক হয়ে গেছিলাম পোশাকটা না পেয়ে। আর্ল মাঝে মাঝে ঢোকেন সেই পোশাক ঘরে। আমি ভাবলাম মনের খেয়ালে পোশাকটা তিনি কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন !

    জুয়ান আবার বললেন, ‘আমার এবার মনে হচ্ছে বারবার ‘নরফক্সের লর্ড, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে’ ইত্যাদি বলে আর্ল সেভার্ন মনে হয় ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমাদের কোনো ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছিলেন। প্রথমদিনের কাগজে লর্ডের নিখোঁজ হবার খবর তিনি পড়েছিলেন। হয়তো তিনি ধরতে পেরেছিলেন ধাপ্পাবাজির ব্যাপারটা। আমরা তাঁর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ না বুঝে কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ ভেবেছিলাম ।

    রিচমন্ড বলল, হ্যাঁ। তা হতে পারে। এবার বেরোতে হবে। আশা করছি নটিংহ্যাম থেকে লন্ডনে ফেরার দুপুরের ট্রেনটা আপনাদের ধরিয়ে দিতে পারব। আমার জন্য আপনাদের বিপদের মুখে পড়তে হলো সে জন্য দুঃখিত।’

    জুয়ান বললেন, ‘আমরা দুঃখিত নই….আপনার মতো নির্লোভ মানুষের দেখা পেয়ে ৷ এভাবে আপনি কোটি কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি আগলে রাখছেন ! অসুস্থ, মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষের সেবা করছেন। এমন মানুষের চট করে দেখে মেলে না। তবে আপনাদের কাছে একটা শেষ প্রশ্ন যাচ্ছে। চত্বরে যা ঘটেছিল তা আমরা আপনাকে আগেই বলেছি। রবার্ট নামের জালিয়াত জহরতগুলো হস্তগত করার পর শিঙাটা চাইছিল কেন? ওটাইতো তার বিপদ ডেকে আনে !

    রিচমন্ড মুহূর্ত খানেক চুপ করে থেকে বলল, ‘তাহলে ব্যাপারটা আপনাদের বলি। এর পিছনে ঐতিহাসিক সত্যতা কতটা আমার জানা নেই। এই আর্ল বংশধরদের মধ্যে বংশানুক্রমে এক গোপন কাহিনি প্রচলিত আছে। রবার্ট নামের লোকটা কীভাবে যে গল্প জানল তা আমি বলতে পারব না। আপনাদের সম্ভবত আগে বলেছিলাম যে নর্মান হলেও স্যাক্সনদের সঙ্গে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল আর্লদের। তারা কখনও আক্রমণ করেনি এই দুর্গ। এর পিছনে গোপন কাহিনি হলো, শেরউড বনে রবিনহুড মণিকারের কাছ থেকে রাজা জনের জহরতের মালা ডাকাতি করার কিছুদিনের মধ্যেই রাজার সেনারা এসে ঘিরে ফেলল বন। রবিন পালিয়ে এসে আশ্রয় নিল এই নর্মান দুর্গে। আর্ল সেভার্নের শিকারি পূর্বপুরুষ কী কারণে তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা গল্পে বলা নেই। যাই হোক রবিন এ দুর্গ ছেড়ে বেরোবার সময় কৃষকের ছদ্মবেশে বেরোল। তার আগে গচ্ছিত রেখে গেল দুটো জিনিস। ওই জহরতের মালা, যারা . . . রিচমন্ড কথা শেষ করার আগেই দীপাঞ্জন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তার মানে ওটা রবিনহুডের শিঙা!”

    রিচমন্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, গল্পটা তেমনই বলে। যুগ যুগ ধরে শিঙা আর তার ভিতর রাখা জহরত রক্ষা করে আসছে এই আর্ল পরিবার। ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তবে? জহরতের থেকে অনেক বেশি দাম হবে শিঙার । কোটি পাউন্ডে বিক্রি হবে রবিনহুডের শিঙা। সে জন্যই ওটা নিতে চাচ্ছিল রবার্ট।

    রিচমন্ডের ঘর ছেড়ে তার সঙ্গে অলিন্দে বেরিয়ে এল দীপাঞ্জন আর জুয়ান। মালপত্র নিয়ে রিচমণ্ডের সঙ্গে চত্বরে নেমে এল দীপাঞ্জন। চত্বর পেরিয়ে তারা প্রধান তোরণের দিকে এগোতে যাচ্ছে, ঠিক এমন সময় থামের আড়াল ছেড়ে কবর ঘরের দিক থেকে বেরিয়ে এলেন আর্ল সেভার্ন। তার পরনে ঝলমলে পোশাক। কোমরবন্ধে তলোয়ার ঝুলছে। যেন ছবির বই থেকে উঠে আসা ডিউক তিনি। তার বাঁহাতের ওপর বসে আছে রিচার্ড, আর ডান হাতে ধরা আছে সেই শিঙাটা। তিনি তাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই দীপাঞ্জনরা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল তাঁকে।

    খুশি হলেন বৃদ্ধ আর্ল। তিনি দীপাঞ্জনদের বললেন, ‘তোমরা কি শেরউড বনে ফিরে যাচ্ছ? রবিনকে বলো তার জিনিস নিরাপদেই আছে। তোমরা যখন ফিরে যাচ্ছ তখনতো তোমাদের অভিবাদন জানাতে হয়।’ এই বলে তিনি শিঙাটা উচিয়ে ধরে ফুঁ দিলেন তাতে। অন্য রকম এক গম্ভীর শব্দ হলো শিঙা থেকে। সে শব্দ শুনে কাকগুলো কিন্তু ধেয়ে এল না। শুধু রিচার্ড একটা মৃদু শব্দ করল ‘ক-ক’ করে। যেন সে বলল—‘গুড বাই!’

    ***

    ⤶
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত
    Next Article অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    Related Articles

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    আঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার ভয়ংকর – হিমাদ্রিকিশোর দাসগুপ্ত

    December 9, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }