Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যানিমেল ফার্ম – জর্জ অরওয়েল

    জর্জ অরওয়েল এক পাতা গল্প95 Mins Read0

    অ্যানিমেল ফার্ম – ১০

    দশ

    বছর গড়িয়ে যায়, ঋতু বদল হয়, স্বল্পায়ু জন্তুরা পৃথিবী থেকে বিদেয় নেয়। এমন একটা সময় এল, যখন বিদ্রোহের কথা মনে রাখার মত কেউ রইল না। কেবল রইল ক্লোভার, বেনজামিন, মোজেস আর কয়েকটা শুয়োর। মুরিয়েল নেই, ব্লুবেল, জেসি আর পিনশারও মারা গেছে। মি. জোনস মারা গেছেন অতিরিক্ত মদ পানে লিভার পচিয়ে। স্নোবল বিস্মৃত, বক্সারের কথাও কারও মনে নেই। কেবল জীবিতদের মধ্যে তাকে যারা চিনত তারা ছাড়া। ক্লোভার এখন বুড়ো পেট মোটা ঘোড়া, শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা আর চোখের কোণে পিঁচুটি জমেছে।

    দু’বছর আগে তার অবসর গ্রহণের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু জন্তুরা আসলে কখনোই অবসর নেয় না। অবসর নেবার পর মনের সুখে মাঠে চরে বেড়াবার নিয়মের কথা কেউ মনে রাখেনি। নেপোলিয়ন এখন চব্বিশ স্টোন ওজনের পরিণত শুয়োর। স্কুয়েলারের শরীরে এত চর্বি জমেছে যে, চোখ মেলে তাকাতেও তার কষ্ট হয়। বুড়ো গাধা বেনজামিন আছে সেই আগের মত, শুধু তার নাক হয়েছে আগের চেয়ে ধূসর। বক্সারের মৃত্যুর পর দিনে দিনে বিষণ্ণ আর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে।

    খামারে জন্তুসংখ্যা যে হারে বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছিল, সে হারে বাড়েনি। তবুও সব মিলিয়ে সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। পরে জন্মানো জন্তুদের কাছে ‘বিদ্রোহ’ কেবল মাত্র ইতিহাস। তারা শুধু এর গল্প শুনেছে বুড়োদের মুখে। যে সব জন্তু বাইরে থেকে আনা হয়েছে, তারা এসব কথা আগে কখনও শোনেনি। ক্লোভার ছাড়া আরও তিনটে ঘোড়া হয়েছে খামারে। টগবগে, পরিশ্রমী কিন্তু ভীষণ বোকা। এদের কেউই এ বি ছাড়া অন্য কোন বর্ণ চিনতে শেখেনি।

    বিদ্রোহ বা জন্তুমতবাদ সম্পর্কে যা বলা হত, সব তারা নির্দ্বিধায় মেনে নিত। বিশেষ করে ক্লোভারের কথা। ক্লোভারকে তারা মায়ের মত শ্রদ্ধা করত, কিন্তু তার কথার মানে কতখানি বুঝত, তা বলা মুশকিল।

    খামারের অনেক উন্নতি হয়েছে। মি. পিলকিংটনের কাছ থেকে দুটো জমি কেনা হয়েছে, উইণ্ডমিলের কাজ শেষ হয়েছে। এর সাহায্যে ফসল কাটার যন্ত্র ও কপিকল চালানো হয়। অনেক নতুন বিল্ডিং হয়েছে। মি. হুয়িম্পার নিজের জন্য ঘোড়ার গাড়ি কিনেছেন। উইণ্ডমিলের উৎপাদিত শক্তি শস্য ভাঙার কাজে ব্যবহার করা হয় এবং এর মাধ্যমে প্রচুর টাকা আয় হয়। জন্তুরা আরেকটা উইণ্ডমিল বানানোর কাজে হাত দিয়েছে, এটার কাজ শেষ হলে তা দিয়ে ডায়নামো চলবে।

    স্নোবলের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো, গো-শালায় বৈদ্যুতিক বাতি, গরম পানি, সপ্তাহে তিনদিন কাজ—এসব কথা আর শোনা যায় না। নেপোলিয়ন বলেছে, এসব কথা জন্তু মতবাদ বিরোধী। তার মতে কঠোর পরিশ্রম আর মিতব্যয়ীতার মধ্যেই আসল সুখ নিহিত। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, দিনে দিনে খামারের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু জন্তুদের জীবনযাপনের মান সেই আগের মতই রয়ে গেছে—শুধু শুয়োর-কুকুরদের ছাড়া। কারণটা সম্ভবত ওরাই খামারের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাতি। তারা খামারের কাজকর্ম করত না। তবে কাজ যে একেবারেই করত না, তা নয়।

    তারা খাটত ‘ফ্যাশনের’ পেছনে। স্কুয়েলার অবশ্য জন্তুদের কাজকর্ম দেখাশোনা করত। শুয়োরদের কাজ সম্বন্ধে তার ব্যাখ্যা কখনোই থামত না। সে বলত, শুয়োররা সারাদিন রিপোর্ট, ফাইল এসব অদ্ভুত জিনিস নিয়ে কাজ করে। এগুলো হলো বড় বড় কাগজ, খুদে অক্ষরে ঢাকা। সাদা কাগজগুলো যখন খুদে অক্ষরে ভরে যায় তখন সে সব আগুনে ফেলে দেয়া হয়। এরই মাধ্যমে নাকি খামারের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। শুয়োর-কুকুরেরা খাদ্য উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল অনেক এবং খেতও প্রচুর।

    জন্তুরা ভাবত, জীবন মানেই কষ্ট। তাদের সব সময় খিদে লেগেই থাকত। তারা খড়ের গাদায় ঘুমাত, পুকুরের পানি খেত, জমিতে কাজ করত, শীতে কাঁপত আর গ্রীষ্মে মাছির উৎপাত সইত। বুড়োরা আগের দিনের গল্প শোনাত। বিদ্রোহের আগের সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করত। অবশ্য তুলনা করার মত তেমন কিছু তারা খুঁজে পেত না। কারণ, সেসব দিনের কথা তাদের প্রায় মনেই পড়ে না। স্কুয়েলারের লম্বা-চওড়া কথার ওপর আর কথা বলত না কেউ। তারা কেবল বুঝত, আগের চেয়ে জীবন এখন অনেক সুখের।

    বর্তমানে যে সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এসব সমস্যার আসলে কোন সমাধান নেই। অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর বেশি সময়ও তারা পেত না। শুধু বুড়ো বেনজামিনের সব মনে আছে। আগের জীবন কেমন ছিল—এখন কেমন চলছে, সব মনে আছে তার। সে জানে, জীবনটা সব সময়ই এমন কষ্টের। খিদে, পরিশ্রম, হতাশা-এরচেয়ে বড় বাস্তব আর কিছু নেই।

    কিন্তু জন্তুরা কখনও ভোলেনি তারা স্বাধীন। ‘জন্তু খামারই’ পুরো ইংল্যাণ্ডের একমাত্র স্বাধীন খামার। প্রতিটি শাবক, অন্য খামার থেকে কেনা জন্তু—সবাই একথা ভেবে উল্লাসিত হত, পত্পত্ করে উড়তে থাকা সবুজ পতাকার দিকে তাকিয়ে গর্বে তাদের বুক ভরে উঠত। বুড়োরা ফিফিস্ করে বলত সেই বীরত্বের কথা, জোনসের বিতাড়ন, সাতটি নীতি, সেই মহান যুদ্ধের কথা—যে যুদ্ধে মানুষেরা পরাজিত হয়েছিল। কোন স্বপ্নই বিফলে যায়নি। জন্তুতন্ত্র, মেজরের সেই স্বপ্ন—‘এমন দিন আসবে যে দিন ইংল্যাণ্ডের সবুজ খেতে কোন মানুষের পা পড়বে না, পুরো রাজ্যই হবে জন্তুদের’-এ স্বপ্ন তারা আজও মনের গহীনে লালন করে। হয়তো শিগগির নয়, বহু বহু বছর পরে হলেও এমন দিন আসবে।

    ‘বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ড’ গোপনে গোপনে জন্তুদের মনে গুঞ্জন তোলে। যদিও প্রকাশ্যে গাইতে কেউ সাহস পায় না। হয়তো তাদের জীবনটা তেমন সুখের নয়। সব আশা পূরণ হয়নি; তবুও তাদের কোন দুঃখ নেই। তারা জানে, অন্য জন্তুদের চেয়ে তারা কত আলাদা। খিদেয় কষ্ট পেলেও শস্য ফলায় কেবল নিজেদের জন্য—মানুষের জন্য নয়। তাদের কেউ দু’পায়ে হাঁটে না। কাউকে ‘প্রভু’ বলে ডাকে না। সবাই সমান এই জন্তুরাজ্যে।

    গ্রীষ্মকালে একদিন সকালে স্কুয়েলার ভেড়াদের ডেকে নিয়ে গেল একটা পতিত জমিতে। সেখানে কোন ফসল জন্মে না, কেবল আগাছা। ভেড়াগুলো স্কুয়েলারের তত্ত্বাবধানে সারাদিন আগাছা পরিষ্কার করল। বেলা শেষে ফার্ম হাউসে ফিরল স্কুয়েলার একা, ভেড়াদের রাতে সেখানেই থাকতে বলল। পুরো সপ্তাহ ধরে তারা সেখানে রইল, স্কুয়েলারের অধিকাংশ সময় কাটতে লাগল তাদের পিছনে। অন্যদের সে জানাল, ভেড়াদের একটা নতুন গান শেখানো হচ্ছে।

    ভেড়ারা সেদিন বিকেলে ফিরছে, অন্য জন্তুরাও কাজ শেষে ফেরার পথ ধরেছে। হঠাৎ, উঠানের দিক থেকে তীব্র হ্রেষারব ভেসে এল। থমকে দাঁড়িয়ে গেল সবাই পথের ধারে। আবার শোনা গেল হ্রেষারব, গলাটা ক্লোভারের। জন্তুরা লাফিয়ে জড়ো হলো উঠানে, তারপর দেখল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

    একটা শুয়োর দু’পায়ে দাঁড়িয়ে আছে!

    হ্যাঁ, শুয়োরটা হচ্ছে স্কুয়েলার। দু’পায়ে প্রায় স্বাভাবিকভাবেই উঠানের চারধারে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর, সার বেঁধে ফার্ম হাউস থেকে বেরিয়ে এল সব শুয়োর—দু’পায়ে হাঁটছে সবাই। কেউ টলমল পায়ে, কেউ প্রায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠান ঘিরে চক্কর দিল। এরপর স্কুয়েলারের চিৎকারে আর মোরগের ডাকে নেপোলিয়নের আগমন বার্তা ঘোষিত হলো। চারদিকে কুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, রাজকীয় ভঙ্গিতে দু’পায়ে হেঁটে এল নেপোলিয়ন। তাকে ঘিরে রেখেছে ভয়াল দর্শন কুকুরগুলো। তার খুরে একটা চাবুক ঝুলছে।

    চারদিকে অটুট নীরবতা। ভীত, বিস্মিত জন্তুরা উঠানে শুয়োরদের চক্কর দেয়া দেখল। তাদের চিরচেনা পৃথিবীতে বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। মূর্ত হয়ে উঠল নিস্তব্ধতা। কুকুরের ভয়, দীর্ঘ দিনের নীরব থাকার অভ্যেস, সব যেন ভেসে গেল এক মুহূর্তে। প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে চাইল সবাই। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেড়াগুলো চিৎকার করে উঠল—‘চার পেয়েরা ভাল, দু’পেয়েরা আরও ভাল।’

    পাঁচ মিনিট ধরে চিৎকার করার পর তারা থামল, ততক্ষণে জন্তুরা প্রতিবাদের ভাষা ভুলে গেছে। শুয়োরেরা আবার মার্চ করে ফার্ম হাউসে ফিরে গেল। বেনজামিন কাঠে নাক ঘষে শব্দ করল। ক্লোভারের চোখ দুটো ভীষণ ম্লান দেখাচ্ছে। কিছু না বলে কেশর নেড়ে ধীরে ধীরে চলল সে বার্নে, যেখানে লেখা আছে জন্তু মতবাদের সাতটি নীতি। কয়েক মুহূর্ত লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল সে। অপারগ হয়ে বলল, ‘আমার দৃষ্টিশক্তি আগের চেয়ে কমে গেছে। আগে এই লেখাগুলো অনায়াসে পড়তে পারতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লেখাগুলো বদলে গেছে। বেনজামিন, নীতিগুলো কি আগের মতই আছে?’

    দীর্ঘদিনের মৌনতা ভাঙল বেনজামিন। এগিয়ে এসে লেখাগুলো পড়ল সে। সেখানে এখন সাতটার বদলে কেবল একটা নীতি লেখা। ‘সব জন্তুই সমান, কিন্তু তাদের মধ্যেও শ্রেণীভেদ আছে।’

    পরদিন চাবুক হাতে শুয়োরদের কাজের তদারক করতে দেখে অবাক হলো না কেউ। সবাই আরও জানল, শুয়োরেরা এখন প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে, অয়্যারলেস যন্ত্র ব্যবহার করে, তাদের ঘরে টেলিফোন সংযোগ দেয়া হয়েছে। আরও জানা গেল, নেপোলিয়ন পাইপ টানে। আর শুয়োরেরা মানুষের মত কাপড়—চোপড় পরে। নেপোলিয়ন নিজে পরে কালো কোট, পাজামা আর পায়ে চামড়ার পট্টি। তার প্রিয় মাদি শুয়োরটি পরে মিসেস জোনসের দামী সিল্কের জামা। এসবের কোন কিছুতেই জন্তুরা অবাক হয় না। মনে হলো, অবাক হবার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে।

    সপ্তাহ খানেক পর, বিকেল বেলা খামারে অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি এল। আশেপাশের খামারের মালিকদের ‘জন্তু খামার’ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শুয়োরেরা তাদের পুরো খামার ঘুরিয়ে দেখাল। পরিচালনার সুষ্ঠু ব্যবস্থা, বিশেষ করে উইণ্ডমিল দেখে মানুষেরা চমৎকৃত হলো। জন্তুরা তখন শালগম খেতের আগাছা পরিষ্কার করছিল, কেউ মাথা তুলল না–নতমুখে কাজ করে গেল। বোঝা গেল না, কি দেখে তারা বেশি ভয় পাচ্ছে, মানুষ, নাকি চাবুক হাতে শুয়োর?

    বিকেল বেলা ফার্ম হাউস থেকে চিৎকার আর উচ্চস্বরের হাসির শব্দ শোনা গেল। সেই সাথে মানুষের কথাবার্তা। কৌতূহলী হয়ে উঠল জন্তুরা, কি হচ্ছে ওখানে? এই প্রথমবারের মত জন্তু আর মানুষ কি এক হয়ে গেল? চুপি চুপি ফার্ম হাউসের দিকে এগোল সবাই।

    কেউ কেউ এগোতে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু ক্লোভার তাদের সাহস জোগাল। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ফার্ম হাউসের কাছাকাছি গেল সবাই, লম্বা জন্তুরা জানালা দিয়ে উঁকি দিল। দেখল, বিশাল টেবিলের চারধারে বসেছে দু’জন মানুষ আর ছ’টি শুয়োর। নেপোলিয়ন বসেছে টেবিলের একমাথায়। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই টেবিলে বসেছে শুয়োরেরা, সবাই মনোযোগ দিয়ে তাস খেলছে। মদ পানের জন্য মাঝখানে একবার বিরতি দেয়া হলো খেলায়। জগ থেকে সবার গ্লাস ভরে দেয়া হলো পানীয়। খোলা জানালায় উঁকি দেয়া জন্তুদের বিস্মিত মুখ কারও নজরে পড়ল না।

    ফক্সউডের মালিক মি. পিলকিংটন গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। পান করার আগে সবার উদ্দেশে ছোট্ট একটা বক্তব্য রাখলেন তিনি। বললেন, খুব আনন্দের সঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন যে, দীর্ঘ দিনের অবিশ্বাস ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলো আজ। এর আগে তিনি বা অন্য কোন মানুষ জন্তু খামারকে নিজেদের প্রতিবেশী বলে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বদলে শুয়োরেরা খামার চালাচ্ছে, এই অস্বাভাবিকতায় মানুষ অস্বস্তি বোধ করত।

    অন্য খামারের মালিকেরা ভাবত, এ ব্যাপারটা তাদের নিজ খামারের জন্তু ও মানুষের ভারসাম্য নষ্ট করবে। কিন্তু সেই সন্দেহের অবসান হয়েছে আজ। মানুষেরা স্বচক্ষে এই খামারের প্রতিটি ইঞ্চি পরিদর্শন করেছে। কি দেখল তারা? শুধু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতিই নয়, সেই সঙ্গে শৃংখলা ও অধ্যবসায়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা অন্য খামারের জন্য উদাহরণ হতে পারে। তার বিশ্বাস, এই খামারের জন্তুরা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে এবং সবচেয়ে কম খাবার পায়। আজ তারা যে সব পদ্ধতি দেখেছে, তার কিছু কিছু তাদের নিজেদের খামারেও চালু করা যেতে পারে।

    তিনি তার বক্তব্য প্রায় শেষ করে এনেছেন। শেষ করার আগে জন্তু খামারের প্রতি তার বন্ধুত্ব ও সহানুভূতির কথা পুনরায় ব্যক্ত করলেন। জন্তু খামারের সাথে তার আর কোন গণ্ডগোল নেই। আসলে সব খামারের সমস্যা তো একই, শ্রমিক সমস্যা কম বেশি সবারই আছে। জন্তুদের নিয়ে খানিকটা রসিকতা করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু জন্তুদের তরফ থেকে কোন সাড়া মিলল না। তিনি কোন মতে তার বক্তব্য শেষ করলেন এই বলে, ‘আপনাদের সাথে যেমন নিচু শ্রেণীর জন্তুদের বিবাদ আছে, তেমনি আমাদের সাথে আছে শ্রমিকদের।’

    টেবিলের চারপাশের সবাই তার বক্তব্যে মৃদু উল্লাস প্রকাশ করল। মি. পিলকিংটন শুয়োরদের আবারও অভিনন্দন জানালেন, খামারের কড়া রেশন ব্যবস্থা, জন্তুদের কাছ থেকে অতিরিক্ত শ্রম আদায় ও বিশৃঙ্খলাহীন একটা সুন্দর খামার গড়ে তোলার জন্য।

    এরপর গ্লাস তুলে টোস্ট করলেন তিনি। ‘জন্তু’খামার দীর্ঘজীবী হোক। উল্লাসধ্বনি ও খুরের শব্দ শোনা গেল। নেপোলিয়ন গর্বিত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে এসে মি. পিলকিংটনের সাথে গ্লাস ঠুকল। উল্লাসধ্বনি স্তিমিত হয়ে এলে নেপোলিয়ন দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াল কিছু বলার জন্য।

    নেপোলিয়নের বক্তব্য বরাবরই সংক্ষিপ্ত হয়। সে বলল, ‘সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়ায় সে নিজেও আনন্দিত। বহুদিন ধরে জন্তু বিদ্বেষী মানুষের, গুজব রটিয়েছে এখানে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলছে। তারা ভাবত, অন্য খামারের জন্তুদের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু এভাবে আসল সত্য চাপা দেয়া যায় না। এখন আমাদের সদিচ্ছা ও সহযোগিতার মনোভাব বুঝতে পেরে সবাই আমাদের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। খামার এত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার একমাত্র কৃতিত্ব শুয়োরদের। শুয়োরেরা সম্মিলিতভাবে খামারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।’

    তার বিশ্বাস, এখন আর পারস্পরিক সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এ পর্যায়ে সে খামারের কিছু নিয়মের পরিবর্তন করতে চায়। জন্তুদের মধ্যে আগে এক অদ্ভুত প্রথা ছিল, তারা একে অপরকে ‘কমরেড’ বলে সম্বোধন করত। এই প্রথা আর এখন থেকে চলবে না। আরও একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল, কার যেন মাথার খুলি খুঁটির মাথায় বেঁধে তাকে ঘিরে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হত।

    এই নিয়মও আজ থেকে বাতিল ঘোষণা করা হলো। সেই খুলিটা ইতিমধ্যেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অতিথিরা দেখছেন সবুজ পতাকা উড়ছে। নেপোলিয়ন বলল, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছে যে আগে পতাকায় সাদা শিং ও খুর আঁকা ছিল—তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন থেকে পতাকা থাকবে পুরোপুরি সবুজ।

    মি. পিলকিংটন তার বক্তব্যের একজায়গায় একটু ভুল করেছেন, ধরিয়ে দিল নেপোলিয়ন। মি. পিলকিংটন এই খামারকে সম্বোধন করেছেন ‘জন্তু খামার’ বলে। অবশ্য তার জানার কথা নয়,’ বলল নেপোলিয়ন। ‘আজ থেকে এই নাম বদলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে এই খামার আবার “ম্যানর ফার্ম” নামে পরিচিত হবে। হাজার হলেও, এটাই তার আদি নাম।

    ‘ভদ্র মহোদয়গণ। আমরা এখন “ম্যানর ফার্মের” নামে পান করব। ম্যানর ফার্ম দীর্ঘজীবী হোক,’ বক্তব্য শেষ করল নেপোলিয়ন।

    আগের মতই উল্লাসধ্বনি শোনা গেল। এক চুমুকে গ্লাস খালি করল সবাই। এই দৃশ্য দেখে জন্তুরা গুঙিয়ে উঠল, যেন ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক কোন দৃশ্য দেখছে সবাই। শুয়োরদের চোখে-মুখে এ কিসের ছায়া? ক্লোভারের ম্লান দৃষ্টি সবার মুখ ছুঁয়ে গেল। জন্তুদের মন কেমন করে উঠল। কি যেন বদলে যাচ্ছে? উল্লাসধ্বনি স্তিমিত হয়ে এল, শুয়োরেরা হাতের তাসের দিকে মনোযোগ দিল। খেলা চলতে লাগল আগের মত। এক সময় নিঃশব্দে পিছিয়ে এল জন্তুরা।

    কিন্তু বিশগজ না যেতেই থামতে হলো তাদের। ফার্ম হাউসে চিৎকার আর গোলমাল শোনা যাচ্ছে। আবার জানালায় ভিড় করল জন্তুরা। হ্যাঁ, ভীষণ রকম গোলমাল বেধেছে। চিৎকার, হৈ চৈ, কুটিল চাউনি আর তীব্র প্রতিবাদ চলছে ভেতরে। গোলমাল বেধেছে নেপোলিয়ন ও মি. পিলকিংটনের মধ্যে খেলা নিয়ে।

    তারা দু’জন রাগে চিৎকার করছে, দুটো গলার স্বর প্রায় একই রকম। এখন বোঝা যাচ্ছে শুয়োরদের চোখে কিসের ছায়া, কিসের আভাস! জন্তুরা শুয়োর থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের দিকে তাকাল। মানুষ থেকে আবার শুয়োর, শুয়োর থেকে মানুষ। তাদের চোখের সামনে চেহারাগুলো একাকার হয়ে গেল। কোনটা শুয়োর আর কোনটা মানুষ, বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।

    ***

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Next Article শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – জর্জ বার্নাড শ

    Related Articles

    জর্জ অরওয়েল

    ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }