Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প802 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.৭ রাজত্বের দায়ভার

    ২৬. রাজত্বের দায়ভার

    গঙ্গার পানি বেশ উষ্ণ এবং বাবর তেত্রিশ স্ট্রোকে বেশ আনন্দেই নদীটা অতিক্রম করে। তার শপথের শেষ অংশ পালন করতে পেরে নিজেকে তার হাল্কা মনে হয়। ছয় বছর আগে বাবুরীকে নিয়ে বরফশীতল সিন্ধু নদে সে ঝাঁপ দিয়েছিলো এবং সেদিনই মনে মনে পণ করেছিলো তার নতুন সাম্রাজ্যের সব প্রধান নদী সে সাঁতরে অতিক্রম করবে। চোখ আর চুল থেকে পানির ফোঁটা ঝেড়ে ফেলে বাবর তীরে উঠে এসে সূর্যের নীচে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। নদীর অপর তীরে একটা ঝাকড়া নিম গাছের নীচে সবুজ ঘাসের বুকে আগ্রা থেকে দেড়শ মাইল দূরে, কনৌজের কাছে অবস্থিত শিবির থেকে তার সাথে আগত দেহরক্ষী আর শিকারীর দল ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করে। আজ রাতে অন্ধকার হলে সে আর তার লোকেরা পানির উপরে মোমবাতি ধরে মাছ মারতে যাবে। কোনো একটা অজানা কারণে ঝকঝকে আলোর মোহ মাছ কোনোমতেই এড়াতে পারে না, তাদের পানির উপরে তুলে আনে, যেখানে সহজেই তখন তাদের হাত দিয়ে ধরা যায়।

    বাবর চোখ বন্ধ করে নদীটার কথা ভাবে। তার আদেশে বিদগ্ধজনেরা হিন্দুস্তানের যে মানচিত্র অংকন করেছে, সেখানে গঙ্গা পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলা মুলুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বিশাল নীল সাগরে পতিত হয়েছে। একদিন বাবর নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে পানির বিশাল ঝকঝকে বিস্তার দেখতে যাবে, সে পুরো ব্যাপারটা ঠিকমতো কল্পনাই করতে পারে না… কেমন দেখতে সেটা, যেখানে পানির বুকে দিগন্ত নেমে এসেছে?

    হিন্দুস্তান এখন তার কাছে বিস্ময়কর, বিভ্রান্তকর একটা স্থানের নাম। তার মাতৃভূমির সাথে তুলনা করলে এটা আসলেও যেনো ভিন্ন একটা জগৎ। এখানের পর্বত, নদী, বনাঞ্চল আর জনহীন প্রান্তর, এখানকার গ্রাম আর পরগনা, এর প্রাণী আর গাছগাছালি, মানুষ আর তাদের ভাষা, এমনকি বৃষ্টি আর বাতাসও একেবারেই আলাদা…কিন্তু সে যখন প্রথমবার সিন্ধু অতিক্রম করেছিলো, তখন সে হিন্দুস্তানকে অপরিচিত এমনকি নিপীড়ক বলে ভেবেছিলো। আর এখন সে এই জায়গাটা আদতেই উপভোগ করতে শুরু করেছে। রানা শঙ্ককে পরাজিত করার পরে থেকে, বেশিরভাগ সময়ই তার ভ্রমণ করে বেটেছে। ছোটখাট একটা শহরের আদলে তৈরি করা বিশাল সব শিবিরে, তার লাল তাবুটা সেইসব শিবিরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত- সমরকন্দ থেকে তৈমূর। যেমন একদা পরিদর্শনে বের হতেন। এইসব ভ্রমণের ফলে বাবর সুযোগ পেয়েছে নিজেকে প্রজাদের সামনে উপস্থাপনের, কিন্তু একই সাথে সে জানবার সুযোগও পেয়েছে।

    রাতের বেলা সে অধিক আগ্রহের সাথে রোজনামচা লিখতে বসে। কৃষকদের মাঠে চাষ করার বিবরণ থেকে দেউতির দল, যারা তাদের লাউয়ের খোলসের পাত্রে ভর্তি তেল আর ধাতব তেপায়ায় সংযুক্ত মোটা সলতে দিয়ে শহর আর গ্রামের রাস্তায় আলো জ্বেলে বেড়ায়, সবকিছুই সে লিখে রাখে। সে যেসব প্রাণী তার কাছে নতুন দেখছে বলে মনে হয়, তার বর্ণনা লিখতে চেষ্টা, যেমন আনন্দোচ্ছল, লাফাতে পছন্দ করা নদীর শুশুক, হিন্দুস্তানের সব নদীতে এদের দেখা যায়। চোয়াল কুমীরের চোয়ালের মতো।

    শীঘ্রই সে আগ্রায় ফিরে যাবে, যেখানের উদ্যানে তার লাগানো গাছগুলো বেড়ে উঠেছে এবং প্রথমবারের মতো কাবুল থেকে আগত মালীর দল আঙুর আর তরমুজ ফলিয়েছে। এছাড়া সাতশ হিন্দুস্তানী পাথরের কারিগর আগ্রায় রানা সঙ্ককে পরাস্ত করার খুশিতে যে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছে, সেটা নির্মাণে ব্যস্ত রয়েছে। মসজিদের উঁচু কুলুঙ্গিযুক্ত খিলান- ইউয়ান- মার্জিত ভঙ্গিতে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে যাওয়া মিনার এবং তার প্রিয় ফুলের উদগত শিল্পকর্ম হিন্দুস্তানী কারিগরের দল এতোটাই নিখুঁতভাবে টিউলিপ আর আইসিস এঁকেছে, যে মনে হবে বাতাসের ঝোকায় পেলব ফুলগুলি বুঝি এখন মাথা নেড়ে উঠবে-একটা সুন্দর ভবন নির্মিত হতে চলেছে। সে আগ্রা আর কাবুলের ভিতরে চিঠি চালাচালির একটা ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রতি আঠার মাইল পরে পরে বিশ্রামের স্থান যুক্ত করা হয়েছে। পূর্বেই ভাড়া করা ঘোড়ার বহর আর তার চালককে সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়। যাতে চিঠিপত্রগুলো হিন্দুস্তানে বাবরের রাজধানী এবং খাইবার গিরিপথের ওপাশে তার ভূখণ্ডে দ্রুত চিঠিপত্র আনা নেয়া করা যায়।

    এতো কিছু অর্জিত হবার কারণে, আজকাল তার রোজনামচার আগের পাতাগুলো পুনরায় পড়ে দেখতে ভালোই লাগে, বিশেষ করে সালতানাহীন, আশাহীন অবস্থা এবং সমরকন্দের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা থেকে লেখা হতাশ বিষণ্ণ বিলাপধ্বনি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। সে তৈমূরের শহর এতোদিন দখল করে রাখতে পারেনি যাতে সেখানে স্থায়ী কিছু তৈরি করতে পারে। হিন্দুস্তানে সে টেকসই ইমারত তৈরিতে হাত দিয়েছে। মৃত্যুর সময়ে, আল্লাহ সহায় থাকলে সে তার সন্তানদের জন্য একটা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যই রেখে যাবে।

    বাবর উঠে বসে পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা সবুজ কাঠঠোকরা ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোঁ দিতে তার ডানায় সূর্যের আলো পড়ে পান্নার রঙ ঝলসে উঠে। তার ছেলেদের ব্যাপারে কি করা যায়? বাবর মাহাম, গুলরুখ, খানজাদা, তাদের চাচী, কামরান, আকসারী আর হিন্দালের জন্য নিরাপদ ভেবে এখন তাদের আনতে লোক পাঠিয়েছে। অচিরেই তারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থেকে আগ্রায় উপস্থিত হবে। তাদের আগমন উপলক্ষে সে বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলো এবং তার বড় দুই ছেলেকে চারকোব, ইয়াকের লেজের স্মারক, জয়ঢ়াক, উৎকৃষ্ট ঘোড়া, দশটা করে হাতি এবং অসংখ্য উট, খচ্চর দান করেছে।

    সে তাদের পিতা হিসাবে গর্বিত। খানজাদা তাকে বলেছে যে, কামরান-এখন তার বিশ বছর বয়স এবং মুখে দাড়ি দেখা দিয়েছে তার আর বাইসানগারের কথামতো কাবুল ভালোই শাসন করেছে। বাইসানগার বহুদিন সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে দায়িত্বরত ছিলো। তেরো বছরের আসকারীও নিজের যোগ্যতা আর উচ্চাশার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। আর কেনো হবে না? বাবর এই বয়সে ফারগানার সুলতান হয়েছিলো। তারা এসে পৌঁছাবার পরে বাবর তাদের উপযোগীতা ভরপুর ব্যবহার করছে। নিয়মিতভাবে এলাকা পরিদর্শনে আর বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ দমন করতে পাঠিয়েছে।

    তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কিন্তু হুমায়ুনের প্রতি তাদের আচরণ- বিশেষ করে কামরানের- দেখে বাবর মাঝে মাঝে মর্মাহত হয়। তাদের ক্ষুব্ধ এমনকি ঈর্ষান্বিত মনে হয়। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক, সে নিজেকে বোঝাতে চায়। হিন্দুস্তান অভিযানে পুরোটা সময় হুমায়ুন বাবরের সাথে ছিলো। হুমায়ুন আর তার মাঝে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখে কামরান, বয়সে যে হুমায়ুনের প্রায় সমবয়সী তার নিজেকে বঞ্চিত মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবর বিষয়টা নিয়ে খানজাদার সাথে আলোচনা করেছে। তার পরামর্শ ছিলো, সে যেনো হুমায়ুনকে বলে নিজের ভাইদের সাথে একটু কুশলী আচরণ করে।

    মাহামের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েছে এবং সে কামরান আর আসকারীর মা গুলরুখকে দোষী করেছে নিজের ছেলেদের হুমায়ুনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার জন্য। হুমায়ুনকে তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার জন্য মাহামের অনুরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু কেবল সে নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে। এবং সে নিজেকে যখন এ ব্যাপারে প্রস্তুত মনে করবে। নিজের ছেলেদের ভেতর থেকে নিজের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী মনোনীত করার ব্যাপারটা রাজার অধিকারভুক্ত বাস্তবিকপক্ষে, প্রাচীনকালে তারা এজন্য পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে আশা করা হতো…কেবল সবচেয়ে শক্তিমানকে মনোনীত করা হতো। কারণ সেই নিজের গোত্রকে রক্ষা করতে পারবে। নিঃসন্দেহে হুমায়ুন ভালো যোদ্ধা, কিন্তু আজকাল একজন রাজাকে আনুগত্য অর্জন আর মিত্র তৈরির মতো গুণাবলীও প্রদর্শন করতে হয় সমরদক্ষতার পাশাপাশি। কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে বাবর নিজের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখতে চায় না।

    একটাই বাঁচোয়া, দশ বছরের হিন্দাল ভাইদের ভিতরের এইসব প্রতিযোগিতার মাঝে নেই। মাহাম এখনও তাকে কাছে কাছেই রাখে। যদিও বাবর শীঘ্রই তার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করবে। হিন্দালের জন্মদাত্রী-মা, দিলবার আগ্রা আসেনি। সে অসুস্থ, আর কাবুলে হিন্দালের বোন গুলবদনের সাথে অবস্থান করছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে বাবর তাকে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠাবে। আর তাহলে তার পুরো পরিবার আবার তার পাশে থাকবে। ঠিক যেমনটা হবার কথা।

    বাবর উঠে দাঁড়ায়। আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গঙ্গার পানির ভিতর দিয়ে শক্তিশালী ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। এবার কেবল ত্রিশটা স্ট্রোক প্রয়োজন হয়- যেখানে তার লোকেরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে।

    *

    “আমি চাই তুমি এটা নাও।” বাবর তার রোজনামচার একটা প্রতিলিপি হাতির দাঁতের নকশা করা মলাট দিয়ে বাঁধানো এগিয়ে দেয়। “আমার জীবনের কথা এখানে লেখা আছে, যা বহু বছর ধরে আমি লিখে আসছি এবং ভবিষ্যতেও লিখে যাবো। আমি আমার অনুলিপিকারীকে আদেশ দিয়েছি প্রতিলিপি তৈরি করার জন্য…”

    হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে রোজনামচাটা নেয়। তার বাদামী চোখ- অবিকল মাহামের মতো- বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে উঠেছে। “আব্বাজান এটা একটা বিশাল সম্মানের বিষয়।”

    “তারচেয়েও বড় কথা, আমি আশা করবো তুমি এটা পড়ে শিক্ষা নেবে। অভিযান আর যুদ্ধটা তুমি ভালোই বোঝে। কিন্তু আমি যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি সেসব সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই… তোমার চেয়ে অর্ধেক যখন আমার বয়স, তখন আমি সুলতানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। আমি আজও বেঁচে আছি আমি আমার গুটিকয় লোকের আনুগত্য, আমার আম্মিজান আর নানীজানের বিচক্ষণতা আর আমার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। একটা সময় ছিলো, যখন আমার কিছুই ছিলো না এবং একপাত্র মাংসের সুরা দেখে আমার চোখে খুশির বান ডাকতো…সেসব ছিলো নিরানন্দ দিন। কিন্তু আমাকে সাম্রাজ্য শাসনের জন্য দক্ষ আর যোগ্য করে তুলেছে আমার প্রতিজ্ঞাকে দৃঢ়তা দিয়েছে যে, আমি একটা সাম্রাজ্য গঠন করবোই… অনেকবেশি নিরাপত্তার মাঝে তুমি বেড়ে উঠেছে। তোমাকে দেখে রাখার জন্য তুমি তোমার পিতাকে পেয়েছো, ভাইদের পেয়েছো কৈশোরের উজ্জ্বলতা ভাগ করে নেবার জন্য…তোমার উচিত এসবের গুরুত্ব দেয়া…”

    “আমি দেই আব্বাজান।” হুমায়ুনকে বিভ্রান্ত দেখায়।

    বাবর চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা কঠিন। সে তার এই লম্বাচওড়া, পেশীবহুল ছেলেটাকে নিয়ে গর্বিত, যে নিজের সাহসিকতা আর দক্ষতার বেশ ভালোই পরিচয় দিয়েছে।

    “ভাইদের প্রতি তোমার আচরণ কেমন উন্নাসিকতাপূর্ণ। কামরান তোমার চেয়ে মাত্র কয়েকমাসের ছোট। হিন্দুস্তান অভিযানে সে অংশ নেয়নি, এতে তার কোনো দোষ নেই। সে কাবুলে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে, বেশ ভালোমত পালন করেছে। কিন্তু তারপরেও তুমি তার উপরে ছড়ি ঘোরাতে চেষ্টা করছে। তুমি আসকারীর সাথে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো আচরণ, যা সে আর নেই এবং সে এটা নিয়ে ক্ষিপ্ত। তোমাদের মাঝে সামান্য প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর, কিন্তু ভাইদের প্রতি তোমার আরও সহনশীল হওয়া উচিত…”

    হুমায়ুন কোনো উত্তর দেয় না।

    “এই নতুন ভূখণ্ডে আমাদের শক্তিই হলো আমাদের একতা। নতুবা আমাদের পতন ঘটবে। ভাইদের সাথে আরও সময় কাটাও, তুমি শিখেছো এমন কিছু তাদের সাথে ভাগ করে নাও…তুমি অনেকদিন একাকী কাটিয়েছে। অনেকদিন সন্ধ্যাবেলা আমি তোমাকে ডেকে পাঠালে জানতে পারতাম তুমি ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হয়েছে…তোমার অনেক সেনাপতিও আমাকে অভিযোগ করেছে তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়ে বা কোনো খবর জানাতে গিয়েও তারা তোমাকে পায়নি। এই একাকীত্বের কি প্রয়োজন?”

    “আমি নির্বিঘ্নে একটু চিন্তা করার সুযোগ চেয়েছিলাম…নিজেকে আর নিজের চারপাশের এই পৃথিবী সম্পর্কে বোঝার জন্য। এসবের কি মানে, কেন আমাদের জন্ম হয়েছে…আমি বিশেষ করে বেহেশতের ধারণা বোঝার চেষ্টা করতাম। আর সেজন্যই আমি সন্ধ্যাবেলা আর রাতে একাকী বের হয়ে যেতাম।”

    “আর তারার দিকে তাকিয়ে তোমার কি বোধোদয় হয়েছে?”

    “আল্লাহতালার ইশারায় তারকারাজি আমাদের নিয়তি নির্ধারণ করে। আপনি আমাকে প্রায়ই তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়ার উপরে ক্যানোপাসকে জ্বলজ্বল করতে দেখার কথা বলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন সেটা একটা আলামত…?”

    “আমি বিশ্বাস করি আল্লাহতালার মর্জি তারার মাঝে ফুটে উঠে। কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, মানুষের নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার সাধ্য রয়েছে। বেহেশতে সম্ভাব্য। পরিণামের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু সিদ্ধান্ত, পছন্দ করার দায়িত্ব আমাদের…” বাবরের কণ্ঠস্বর একটু বেশি কড়া শোনায়। কারণ হুমায়ুনকে দেখে সে বুঝতে পারে বেটার মাথায় তার কথা ঠিকমতো প্রবেশ করছে না।

    “আব্বাজান, আমি আপনাকে কখনও বলিনি, কিন্তু পানিপথে লড়াইয়ের আগের রাতে আমার ব্যাক্তিগত জ্যোতিষ আমাকে বলেছিলো পরের দিন ঠিক দুপুর বেলা আকাশে যদি তিনটা বাজপাখি যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা একটা বিশাল বিজয় অর্জন করবো। ধূলো আর যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই, কামার আর মাস্কেটের ধোঁয়ার উপরে আমি আমাদের মাথার উপরে তিনটা বাজপাখিকে নিশ্চল হয়ে ভেসে থাকতে দেখি। এখানেই শেষ না। আমার সেই জ্যোতিষি হিন্দুস্তানে মোঘলদের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন…এজন্যই আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম পরবর্তীতে কি ঘটতে চলেছে।”

    বাবর মৃদু হাসে। “আমাদের নিয়তির প্রতি তোমার বিশ্বাস দেখে আমি প্রীত হয়েছি। আমি অন্য কিছু আশাও করিনি। কিন্তু বেহেশতে সবকিছু নির্ধারিত হয় না। সে কি বলেছিল যে বুয়া আমাকে বিষপ্রয়োগের চেষ্টা করবে? আর তাছাড়া নতুন ভূখণ্ড দখলে। রাখতে হলে আমাদের নমনীয় আর দক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। নেতৃত্ব আর একাগ্রতা এক্ষেত্রে তারকারাজির চেয়ে বেশি সাহায্য করবে…আমার রোজনামচার এই অনুচ্ছেদটা পড়ে দেখো…” বাবর ছেলের হাত থেকে প্রতিলিপিটা নিয়ে দ্রুত একটা পাতা খুঁজে বের করে: “একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে, তার অমাত্যদের কথা শুনতে হবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা যে কোনো ঘটনা কঠোর হাতে দমন করতে হবে।”

    “মনে রেখো, হুমায়ুন, শাসকের দায়িত্বের চেয়ে বড়ো দাসত্ব আর হতে পারে না। আমার ছেলে হিসাবে- এটা মনে রেখো- সব সময়ে সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একাকী এতো সময় কাটানোটাকে তোমার দুর্বলতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আমরা খোলাখুলি আলোচনা করি। আমি জানি তোমার মনে কি ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, তোমার মুখে আমি সেই ছায়া সবসময়ে দেখতে পাচ্ছি। তুমি জানতে চাও আমি তোমাকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করবো কিনা। আমার উত্তর হলো আমি এখনও সেটা ঠিক করতে পারিনি…এখন পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নেইনি। তোমার সাহসিকতা নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমাকে দেখতে হবে নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, একাগ্রতা আর দক্ষতার মতো মানসিক বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে …আমার রক্তের মতো তোমার রক্তেও তৈমূর আর চেঙ্গিসের রক্তের তেজ আর নিষ্ঠা প্রবাহিত হচ্ছে, আমার কাছে সেটা প্রমাণ করো…”

    *

    “সুলতান, ঘোড়দৌড়ের প্রথম হিট এখন অনুষ্ঠিত হবে।”

    আগ্রা দূর্গের ছাদের প্রাকারে দাঁড়িয়ে নদীর তীর বরাবর হলুদ আর সবুজ নিশান পোতা দেখতে পায়, যেখান থেকে ঘোড়দৌড় শুরু হবে। ছয় সারিতে দশ ফিট পর পর লাঠি পোতা হয়েছে। যা চারশ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত– ঘোড়দৌড়ের সীমানা। প্রতিযোগীদের একেঁবেঁকে এর ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং শেষ প্রান্তে শেষ লাঠির আট ফিট পরে মাটিতে রাখা ভেড়ার কাটা মাথা বর্শার ডগায় গেথে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে ঘুরে আবার একই পথে ফিরে আসতে হবে। বাঁক নেয়াটাই সবচেয়ে কঠিন আর দক্ষতা এবং ঠাণ্ডামাথা দরকার হবে দ্রুত বাঁক নিতে।

    হিন্দুস্তানে বাবরের আগমনে চতুর্থ বার্ষিকী উদযাপনের জন্য তিনদিন ব্যাপী উৎসবের অংশ প্রতিযোগিতাটা। পরে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করা হবে। তারপরে তার তিন ছেলের ভিতরে নিশানভেদের প্রতিযোগিতা হবে: বাবর সম্প্রতি তার দেহরক্ষীর কাছ থেকে একটা উন্নত মাস্কেট ক্রয় করেছে। সেটা দিয়ে যে প্রথমে মাটির ভাণ্ডে গুলি লাগাতে পারবে, সে একটা পান্নার আংটি পাবে। আংটির পাথরে তৈমূরের জন্মের সময়ে তারকারাজির কল্পিত অবস্থান বোঝাতে ব্যবহৃত তিনটা পরস্পর সংযুক্ত বৃত্ত খোদাই করা রয়েছে, যা বাবর তার নতুন সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।

    হুমায়ুন, আসকারী আর কামরান, বাবরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের কেউ ঘোড়দৌড়ে অংশ নিলে অনায়াসে জয়লাভ করতো। কিন্তু আজকের দৌড় কেবল বাবরের সেনাপতিদের জন্য নির্ধারিত। নিজেদের সম্রাটের কাছে আপন আপন যোগ্যতা প্রমাণের এটাই সুযোগ। পুরষ্কার হিসাবে রয়েছে সোনার কারুকাজ করা পর্যানে সজ্জিত একটা বিশাল সাদা স্ট্যালিয়ন এবং লাগামটা খাঁটি সোনার পাত দিয়ে মোড়া।

    বাবা ইয়াসাভাল, সম্প্রতি তাকে বাবরের অশ্বশালার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দৌড় শুরুর স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের ভিড়ে তাকে প্রায় দেখাই যায় না। সবাই ভালো করে দেখার জন্য নিজেদের ভেতরে গুতোগুতি করছে। সে তার হাতে ধরা বর্শা উঁচু করতে ধরতে প্রথম ছয়জন প্রতিযোগী এগিয়ে আসে। বাবরের দিকে তাকালে, সে ইশারায় শুরু করার ইঙ্গিত দিলে, ইয়াসাভাল হাতের বর্শা নামিয়ে নেয়। প্রতিযোগীরা তীব্র বেগে ঘোড়া ছোটায়। ঘোড়ার গলার প্রায় সমান্তরালে শুয়ে তারা কাঠের দণ্ডের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘোড়া দাবড়ায়। বাবরের, কিশোর বয়সে ভেড়ার মাথা নিয়ে পোলো খেলার কথা মনে পড়ে এবং নস্টালজিয়ার একটা রাশ তাকে আপ্লুত করে।

    প্রতিযোগীরা দণ্ডের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং হাতের বর্শা নীচু করেছে। প্রথমে এগিয়ে থাকা অশ্বারোহী- ধূসর দাড়িশোভিত তাজিক, হাসান হিজারী- বর্শার মাথায় নিপূনভাবে ভেড়ার মাথাটা গেঁথে নিয়ে নিখুঁতভাবে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার ঠিক পেছনের অশ্বারোহী তার মতো পারদর্শী না। তার বর্শার ডগা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় এবং মাটিতে বিদ্ধ হয়, এবং দর্শকদের আমোদিত করে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে তুলে নিয়ে বনবন করে পাক খাইয়ে পশ্চাদদেশের উপরে মাটিতে আছড়ে ফেলে। বাকি চারজন নিরাপদে ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়। একজন বাদে সবাই নিশানা ভেদ করতে পেরেছে।

    প্রায় এক ঘণ্টা পরে বাকি পাঁচটা হিট শেষ হয় এবং বিজয়ীরা আবার পরস্পরের সাথে দৌড়াতে একজন বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়। আর সে হাসান হিজারী না। বাবর যেমনটা ভেবেছিলো বরং কাবুলের এক তরুণ যোদ্ধা। সে তার বাদামী রঙের মাদী ঘোড়াটাকে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাবড়েছে। আজ রাতে আয়োজিত ভোজসভায় বাবর তাকে পুরস্কৃত করবে। লাঠিগুলো এবার তুলে ফেলা হয় এবং বাবরের লোকের দৃর্গের দিকে তাড়াতাড়ি রওয়ানা দেয় মল্লযুদ্ধ দেখার জন্য। যেখানে দূর্গের প্রধান আঙ্গিনায় পাথরের মেঝের উপরে কয়েক পরত গালিচা পাতা হয়েছে।

    “বাবা আমি মল্লযুদ্ধে অংশ নিতে চাই।” হুমায়ুন চমৎকার মল্লবিদ এবং সে সেটা জানে। বাবর সায় দিতে সে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বিদায় নেয়। কামরান আর আসকারীকে নিয়ে নীচের প্রাঙ্গনে নেমে এসে বাবর বিশেষভাবে নির্মিত কাঠের মঞ্চের উপর স্থাপিত একটা চেয়ারে আসন গ্রহণ করে।

    শাহজাদা মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এটা জানাজানি হতে হুমায়ুনকে প্রথম পর্বেই যুদ্ধের জন্য মনোনীত করা হয়। সে আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাকী মোহসীন। হিরাতের অধিবাসী চওড়া আর চটপটে এক মল্লযোদ্ধা। যে নাকি প্রায়শই গর্ব করে বলে থাকে। সে একাই চার পাঁচজনের মহড়া নিতে পারে। মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অভিবাদন জ্ঞাপন করে। দুই জনেরই পা খালি, কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত, এবং পরনে ডোরাকাটা আঁটসাট ব্রীচেস, যা হাঁটুর কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। সাকী মোহসীনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতচিহ্নযুক্ত, নিরেট স্বাস্থ্য দারুণ আকর্ষক দেখায়। কিন্তু হুমায়ুনকে দেখতে তার চেয়ে দারুণ লাগে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অন্তত চার ইঞ্চি লম্বা বুক, পিঠ, পেট, কাঁধ আর বাহুর নিখুঁত তেল চকচকে- পেষল দেহ থরোব্রেড ঘোড়ার মতো সুষমা আর সৌন্দর্য মণ্ডিত। তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল পিঠের উপরে লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো।

    বাবরের ইঙ্গিতে যুদ্ধ শুরু হয়। দু’জন বৃত্তাকারে পরস্পরকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, হুমায়ুন পায়ের গোড়ালীর উপরে ফণা তোলা সাপের মতো দুলতে থাকে। তার চোখ প্রতিপক্ষের উপর স্থির। সহসা সাকী মোহসিন তার দিকে ধেয়ে আসে। হুমায়ুন এক লাফে সরে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাটু নিজের পা দিয়ে আকড়ে ধরে তাকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মুহূর্তের ভিতরে হুমায়ুন তার প্রতিপক্ষের পিঠের উপরে চেপে বসে, একহাতে তার গলা পেচিয়ে ধরে মাথা পেছনের দিকে টানতে থাকে। অন্যহাতে সে প্রতিপক্ষের ডান হাত ধরে সেটা মোচড় দিয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত তুলে আনে। সাকী মোহসীনের ঘাম ছুটে যায়, আর তার মুখ ব্যাথায় বিকৃত হয়ে উঠে। “আমি হার মানছি…” সে কোনোমতে দম নিয়ে বলে।

    হুমায়ুন পরবর্তী তিনটা লড়াইও জিতে, যার মানে সে প্রতিযোগিতা থেকে অপরাজিতের খেতাব নিয়ে সরে দাঁড়াতে পারে। বাবর আরো কিছুক্ষণ লড়াই দেখে। কিন্তু চোখের পেছনে একটা তীব্র আর দপদপ করতে থাকা ব্যাথা তাকে বেশ কষ্ট দেয়। সে নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে বলে ঠিক করে। কামরান আর আসকারী তাকে তার কক্ষের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, কথা দেয় তিনঘণ্টা পরে তারা এসে। তাকে হুমায়ুনের সাথে তাদের নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নিয়ে যাবে।

    বাবর তার পরিচারকদের আফিম মেশানো দুধ নিয়ে আসতে বলে। সে ধূসর দেখতে মিষ্টি পানীয়টা পান করে এবং বিছানায় পিঠ ঠেকায়। মাথার ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে সে দেখে হুমায়ুন তার শক্তিশালী মার্জিত দেহের সাহায্যে প্রতিযোগীর পরে প্রতিযোগীদের পরাজিত করছে। দেখে সে নিজে আবার তরুণ হয়ে গিয়েছে এবং সবুজ আর হলুদ দণ্ডের ভিতর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে প্রতিযোগিতা জিতছে। প্রথমবার মাহামকে যেমন দেখেছিলো, অবিকল সে রকম রূপে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আকশির দূর্গে খানজাদাকে মেহেদী রাঙানো খালি পায়ে পোষা বেজীর পেছনে দৌড়াতে দেখে। ওয়াজির খান তাকে ধৈর্যের সাহায্যে শিখাচ্ছে কিভাবে ধনুকে ছিলা পরাতে হয় এবং সবশেষে বাবুরী কাবুলের দূর্গ প্রাসাদের নীচের সমভূমিতে কামান আর ম্যাচলকের কৌশল তাকে দেখাচ্ছে।

    বাবর ঘুম ভাঙতে দেখে সূর্যের আলো তখন কামরার জানালার মার্বেলের জাফরি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। সন্ধ্যার আগে নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে না। তাই তার হাতে এখনও প্রচুর সময় আছে। আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে পড়ে এবং তার পরিচারক দিনে চারবার পানি বদলে দেয়। যে জেড পাথরের বোলের সেটার গোলাপজল দিয়ে মুখ ধোয়। শীতল পানিতে মুখ ধুতে ভালই লাগে এবং সে টের পায় তার মাথাব্যাথা সেরে গেছে।

    সে পাশের অপেক্ষমানের জন্য নির্ধারিত কামরা থেকে মৃদু আলাপের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাবার জন্য চাপা স্বরে কথা বলছে। পর্দার কাছে গিয়ে সে সেটা সরাতে যাবে কিন্তু ওপাশে কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবে কামরানের গলা সে শুনতে পায়। সে যদিও চাপা স্বরে কথা বলছে, কিন্তু তার মন্ত্র, উল্লসিত আওয়াজ কোনোমতেই ভুল হবার নয়।

    “সাকী মোহসীন একটা আহাম্মক। আমি তাকে কতোবার বলেছিলাম হুমায়ুনকে মল্লযুদ্ধে হারাতে হলে বলদের মতো তার দিকে কখনও ধেয়ে যাবে না- হুমায়ুন অনেক বেশি চটপটে। হুমায়ুনের প্রথম আক্রমণের জন্য তার অপেক্ষা করা উচিত ছিলো। তাহলে আমরা একটা দারুণ লড়াই দেখতে পেতাম। হুমায়ুন চিত হয়ে পাছার উপরে ভর দিয়ে পড়ে আছে দেখতে পেলেও শান্তি… কিংবা তারচেয়েও ভালো লাগতো যদি ওর পাঁজরের হাড় ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেতাম…’

    “নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার কি হবে?” ভাইয়ের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে আসকারি এবার কথা বলে এবং তার কণ্ঠস্বর সামান্য উদ্বিগ্ন শোনায়। “সেই কি জিতবে নাকি আমাদের কোনো সুযোগ আছে?”

    “ছোট ভাইটি, সেটার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

    “কি বলতে চাও?”

    “আমার একজন লোকের উপরে দায়িত্ব রয়েছে মাস্কেটে গুলি ভরার। আমি তাকে বলেছি হুমায়ুনের বন্দুকের বারুদে ভেজাল মেশাতে। যাতে সেটা থেকে ঠিকমতো গুলি না হয়। সে যদি আহত নাও হয় লক্ষ্যভেদ তাকে আজ করতে হচ্ছে না। আব্বাজানের পান্নার আংটি হুমায়ুনের ভাগ্যে নেই…”

    বাবর পিছিয়ে আসে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে যা শুনেছে সেটা পুরোপুরি বাস্তব। সে এবার ইচ্ছা করেই জেড পাথরের বোলের গোলাপজল মেঝেতে ফেলে দেয়। শব্দটার ফলে সে যা আশা করেছিলো তাই হয়। কামরান আর আসকারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। “আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি আব্বাজান, তাই আপনার পরিচারকদের পাঠিয়ে দিয়ে আমরাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার সময় হয়ে এসেছে। নিশানা স্থাপন করা হয়েছে এবং মাস্কেটও তৈরি আছে। হুমায়ুন প্রস্তুত হয়ে দূর্গ প্রাঙ্গনে অপেক্ষা করছে।”

    “কামরান আজ নিশানাবাজি হবে না, আমি মত পরিবর্তন করেছি।”

    “কিন্তু আব্বাজান কেন…?”

    “তুমি কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”

    “অবশ্যই না আব্বাজান।”

    “তোমরা দুজনেই এখন বিদায় হও। আর আমার পরিচারকদের পাঠিয়ে দাও। ভোজসভায় তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে।”

    সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠানের জন্য তার পরিচারকরা তাকে প্রস্তুত করতে থাকলে, বাবর খেয়ালই করে না তারা তারা সোনালী প্রান্তযুক্ত গাঢ় নীল রঙের জোব্বা তার ডান কাঁধে ফিরোজা রঙের গিট দিয়ে আটকাচ্ছে বা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বুট জুতার সাথে সোনালী জরির কাজ করা পাজামা পরাচ্ছে। যান্ত্রিক ভঙ্গিতে সে গলার মালা, পাগড়ির অলংকার, পছন্দ করে দেয়। তার হাতের তৈমূরের আংটি যেটা সে কখনও খোলে না- চমকায়। দৃশ্যটা সাধারণত তাকে প্রীত করে কিন্তু সেটা অন্য রাতের কথা।

    সে চার বছর ধরে হিন্দুস্তানে রয়েছে। আজ রাতে সে তার নিজের লোকদের সাথে আহার করবে। পরে যমুনার উপরের আকাশে সুদূর কাশগর থেকে সে যেসব জাদুগরদের নিয়ে এসেছে তারা আতশবাজি নামে একটা বস্তুর সাহায্যে আকাশে কৃত্রিম তারার সৃষ্টি করবে। সে ইতিমধ্যে নিজে একবার দেখেছে এবং চকচক করতে থাকা আলোর ঝর্ণা ধারা রাতের নিকষ আকাশে ছুটে বেড়াচ্ছে দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিলো।

    কিন্তু এখন সবকিছুই তার কাছে কলঙ্কপূর্ণ আর বেকার মনে হয়। তার ছেলেদের অপরিণত, নির্বোধ আর হঠকারী কথায় সে কষ্ট পায়নি তাদের কণ্ঠের বিষ তাকে ব্যথিত করেছে। সে যেটাকে ভাই ভাইয়ের ভিতরে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ভেবেছিলো সেটা আসলে অন্য কিছু এবং সে নিজেই এর জন্য দায়ী। নিজের নতুন সাম্রাজ্যের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবার কারণে সে খেয়ালই করেনি তার চারপাশে কি ঘটছে।

    একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে।

    এই কথাটা কি সে নিজের রোজনামচায় লিখেনি এবং এর কথাই কি সে হুমায়ুনকে বোঝাতে চেষ্টা করেনি। আর সে নিজেই কিনা নিজের উপদেশমতো কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

    বাবরের চোয়াল কঠোর হয়ে উঠে। অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথে, সে কামরান আর আসকারীকে হিন্দুস্তানের কোনো প্রদেশের শাসক নিয়োগ করবে। তাদের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখার মতো প্রচুর কাজ আশেপাশে রয়েছে এবং সে নিজে তাদের এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। আর হুমায়ুনকে সে আগ্রার আশেপাশের এলাকার শাসকের দায়িত্ব দেবে যেখানে সে নিজে তাকে কাছে থেকে দেখতে পাবে। সে এখন থেকে তাকে তার সেইসব ক্লান্তিকর আধ্যাত্মিক আর নিঃসঙ্গতার প্রবণতা পরিহার করতে উৎসাহিত করবে এবং সাম্রাজ্যের কাজের দায়িত্ব নিতে বলবে। হুমায়ুন যদি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তবে সে প্রকাশ্য দরবারে তাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবে। কামরান আর আসকারীকে সেটা মেনে নিতে হবে। আর সেই সাথে ভাইয়ের সাথে খামোখা লড়াই করার প্রবণতাও তাদের পরিহার করতে হবে। হিন্দুস্তান অমিত সম্ভাবনার একটা দেশ। এর অধিকাংশ স্থানই এখনও জয়লাভ করা হয়নি। আর তারা এখানে হুমায়ুনের অনুগত হিসাবেই নিজেদের জন্য উপযুক্ত স্থান সৃষ্টি করতে পারবে। পিতলের বার্নিশ করা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের সাজসজ্জার দিকে তাকিয়ে, বাবর ভাবে, ভাগ্য ভালো তার নিজের বয়স এখনও অল্প। ইনশাল্লা, আল্লাহতালার করুণায়, সে তার সন্তানদের মাঝে বিদ্যমান রেষারেষি দূর করতে পারবে এবং তাদের পরস্পর বিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিতরে একটা সমন্বয় সাধন করতে পারবে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article গথ – অৎসুইশি

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }