Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প802 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১.৪ সমৃদ্ধির শহরে

    বাবরের সৌভাগ্যেই বলতে হবে যে খুনী তাড়নায় সময়ের আগে হাজির হওয়া শীতকাল এবার বসন্তের অকালবোধনে শেষ হয়েছে। বাবর তার কামরায় দাঁড়িয়ে বালকের দলকে জমে থাকা জাক্সারটাসের বুকে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখে, বরফের বুকে সৃষ্টি হওয়া ফাটল দিয়ে পানি উথলে উঠে। কয়েকটা নিশ্চিন্ত ভেড়া জমে থাকা স্রোতের উপর চড়ে বেড়াচ্ছিল, শীতল তোড়ে তারা ভেসে যায়। তাদের মিহি, উচ্চ মাত্রার আর্তস্বর কয়েক সেকেন্ড পরেই মিলিয়ে যায়।

    জাক্সারটাসের পরে এগিয়ে যাওয়া সমভূমিতে, তার গোত্রপতিরা আবার নিজেদের লোকজন নিয়ে এসে ছাউনি ফেলেছে। এবার ডাক পাঠাবার সময়ে সে তার বার্তাবাহকদের আরও দূরে যেতে বলেছে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারদিক থেকে যাযাবর গোত্রগুলিকে প্রাচুর্যপূর্ণ লুণ্ঠিতদ্রব্যের প্রতিশ্রুতি ফুলের কাছে মৌমাছির মত টেনে এনেছে। সাইবানি খান তার উত্তরের শীতকালীন আশ্রয়ে আটকে থাকার কারণে, বাবর ভাবে, আক্রমণের এটাই উত্তম সময়। শীঘ্রই সে তার বাহিনীকে যাত্রার আদেশ দেবে।

    কিন্তু সমরকন্দের অভিমুখে তার অসমাপ্ত অভিযান শুরু করার পূর্বে আম্মিজানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে হবে সে দ্রুতপায়ে তার কামরার দিকে এগিয়ে যায়। এইবার, খুতলাঘ নিগারের পিতলের বার্ণিশ করা আয়নায় সে তার ভিন্ন। চেহারা দেখে যার সাথে আব্বাজানের মারা যাবার রাতের সেই অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ের চেহারার কোনো মিল নেই। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবর তার ত্রয়োদশ জন্মদিন উদযাপন করেছে। তার গালে হাল্কা শত্রু দেখা দিয়েছে আর আগের চেয়ে সে অনেকটাই লম্বা আর চওড়া হয়েছে। কণ্ঠস্বরে ভাঙন এসেছে আর তৈমূরের অঙ্গুরীয় এখন আর আঙ্গুলে মোটেই ঢিলে হয় না।

    “বাছা, তুমি দ্রুত যুবকে পরিণত হচ্ছো।” আম্মিজান তাকে বিদায় চুম্বন দিতে তার কণ্ঠে গর্বের প্রচ্ছন্ন ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। এমন কি সন্তুষ্ট-আর সেই কঠোর বুড়িকে প্রীত করা কোনো মামুলি বিষয় না, কুচকে যাওয়া কিশমিশের মতই যার মুখের ত্বক কিন্তু তার ক্ষুরধার চোখে কিছুই এড়িয়ে যাবার জো নেই।

    “শহরটা আমার দখলে আসবার পরে আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠাব।”

    “তুমি ওয়াদা করছো?” খানজাদা নিমেষে চিবুক উঁচু করে জানতে চায়। “ওয়াদা করছি।” সে নিচু হয় বোনকে চুমো দেয়ার জন্য যে এখন বাবরকে প্রীত করে, লম্বায় তার চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক খাটো।

    হারেমের ভিতর দিয়ে ফিরে আসার সময়ে সে একটা খোলা দরজা অতিক্রম করে। জানালাবিহীন কক্ষটায় তেলের প্রদীপের মৃদু আলোয় এক লম্বা তরুণী কেবল কাচুলী আর গোলাপী ফুলের ছোপ তোলা ঘাঘড়া পরিহিত অবস্থায় সামনে ঝুঁকে বসে চুল আচড়াচ্ছে। বাবর নিচু চৌকাঠ অতিক্রম করে।

    সে তাকে দেখা মাত্র হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায় আর তার মাথার চুল চকচকে পানির মত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। “ফারগানার সুলতান, বাবরকে আমার অভিনন্দন। আল্লাহতালা আপনার উপর প্রসন্ন হোন।” তার কণ্ঠস্বর চাপা কিন্তু পরিষ্কার উত্তরের পাহাড়ী মানুষের টান তাতে স্পষ্ট।

    “আপনি দাঁড়াতে পারেন।”

    মার্জিত ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখ পটলচেরা, দেহবল্লরী তন্বী এবং মধুর রঙের মত ত্বক। বাবর খেয়াল করে তার কামরার এককোণে রাখা পুরান দুটো কাঠের সিন্দুক থেকে কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

    “আমি ভ্রমণ করে ক্লান্ত। আমার পরিচারকদের বলেছি আমাকে একটু একা থাকতে…” সে কথা শেষ না করেই থেমে যায় এবং বাবর তার চেহারায় অনিশ্চয়তা ভর করতে দেখে যেন সে কিছু একটা ভোলা করে দেখছে। সে ঘুরে দাঁড়ায় বেরিয়ে আসার জন্য। সৈন্যবহর যাত্রা শুরু করার আগে আরো অনেক কিছু তদারকি করা বাকি।

    আমাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য “সুলতানকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।” সে তার দিকে একপা এগিয়ে আসলে বাবরের নাকে মৃগনাভীর গন্ধ ভেসে আসে। “আমার বাবার রক্ষিতারা, অবশ্যই, আমার দূর্গে সাদরে আমন্ত্রিত।”

    “আর সেই রক্ষিতার গর্ভে তার ঔরসজাত সন্তান?”

    একটা বিরক্তিবোধ ক্ষণিকের জন্য বাবরকে আপুত করে। “অবশ্যই।” এই রোক্সানার সামান্য গোত্রপতির কন্যার কোনো অধিকার নেই তাকে এই প্রশ্ন করার। তার অস্তিত্বের কথা সে কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে জানতে পেরেছে। কোনো দুর্বোধ্য কারণে তার মরহুম আব্বাজান তাকে দূর্গে নিয়ে না এসে তার নিজের লোকদের মাঝেই তাকে রেখেছিলেন। শিকারে গেলেই কেবল তিনি তার সাথে দেখা করতেন। রোক্সানার কথা তিনি কাউকে বলেননি। একথাও কখনও বলেননি, যে আট বছর আগে যখন তার বয়স চৌদ্দ বছরের বেশি কোনভাবেই না, তখন রোক্সানা তাকে একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে, জাহাঙ্গীর।

    তুষারপাত শেষ হবার ঠিক পরপরই, যখন রোক্সানার বাবা দূর্গে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন কেউই অবিন্যস্ত দাড়িশোভিত মলিন গোত্রপতিকে ভালো করে লক্ষ্যই করেনি। সে তখন ভেড়ার চামড়ার কোটের ভেতরের পকেট থেকে বাবরের বাবার নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি বের করে যেখানে তিনি রোক্সানাকে তার রক্ষিতা আর ছেলেকে নিজের বংশধর বলে স্বীকার করেছেন। সেখানে আরও লেখা আছে তার অকালমৃত্যু ঘটলে রোক্সানাকে যেন শাহী হারেমের নিরাপত্তায় নিয়ে আসা হয়।

    খুতলাঘ নিগার কোনো উচ্চবাচ্য করে ব্যাপারটা মেনে নেন। তার স্বামীর অধিকার আছে যত ইচ্ছা রক্ষিতা রাখার আর বস্তুত তার স্ত্রীর সংখ্যা তিনজন। খুতলাঘ নিগার নিজে তো জানেন তিনিই ছিলেন তার ভালোবাসা, প্রতিদিনের সহচরী, তার উত্তরাধিকারী সন্তানের মাতা। পৃথিবীর আর কোনো দম্পতি তাদের শারীরিক আর মানসিক বন্ধনের জুড়ি হতে পারবে না। তাদের মিলনের আত্মিক অভিরূপ এমনই যে তাদের কেবল দুটি সন্তান বেঁচে আছে। রোক্সানা আর বাবরের সভাইয়ের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব তাকে মোটেই বিচলিত করেনি। আর তাই আম্মিজান যখন বাবরকে অনুরোধ করেন, সে অন্যসব অল্পবয়সী ছেলের মতই নিজের বাবা-মা’র প্রেমের বিষয়ে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করে, আলোচনাটা সংক্ষিপ্ত করতে চায়। তাকে তার সন্তানকে নিয়ে আসতে দাও,” তিনি অবশেষে শীতল কণ্ঠে আলোচনা শেষ করেন। বাবর পরে খেয়াল করে দেখেছে যে খুতলাঘ নিগারের কামরার পাশেই রোক্সানার জন্য কামরা বরাদ্দ করা হয়েছে। অচেনা লোকদের মাঝে এসে উপস্থিত হওয়া নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন? মোটেই না। তিনি তাকে কাছে রেখেছেন যেন তার উপরে লক্ষ্য রাখতে পারেন।

    “সুলতানের মহানুভবতার তুলনা হয় না। রোক্সানা এবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। “আপনার ভাইও আপনাকে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।”

    সভাই, বাবর ভাবে, এবং মোটেই হাসির উত্তর দেয় না। সে তাকে এখনও দেখেনি। ছেলেটা কোনো কারণে জ্বরে আক্রান্ত সন্দেহ নেই মশার বা আটুলির কামড়ের ফল। খুতলাঘ নিগার তাকে এবিষয়ে কিছুই বলেনি। “আপনার সন্তান শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুক, বাবর বলে। সৌজন্যমূলক বাক্য কিন্তু বাবর জানে বাক্যটায় শীতল একটা অনুভূতি রয়েছে। সেটা বাবরের ইচ্ছাকৃত। গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবর দ্রুত বের হয়ে যায়, তার মন ইতিমধ্যেই আসন্ন অভিযানের উত্তেজনায় ব্যপৃত হয়ে পড়েছে।

    ***

    চোখে প্রচ্ছন্ন গর্ব নিয়ে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে পশ্চিমের চারণভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে দেখে, সে ভাবে এবারের অভিযানের জন্য আট হাজার লোক আমার আহবানে সাড়া দিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর ঠিক পেছনেই জমিদারদের বরকন্দাজ আর তাদের লোকেরা। তারপরে আছে গাট্টাগোট্টা চেহারার গোত্রপতির দল, বুনো চকরাখের মত, যারা কাশগড় আর ফারগানার মধ্যবর্তী উঁচু পাহাড়ী এলাকায় বাস করে তাদের ঘোড়া, ভেড়া আর লোমশ ইয়াকের পাল নিয়ে। মালবাহী গরুর গাড়িগুলো যাতে লম্বা তীক্ষ্ণ শিংএর বলদ জোতা হয়েছে মালের ভারে সেগুলোর চাকা তীব্র শব্দে প্রতিবাদ জানায়। এইবার ভাগ্যের উপরে সে কিছুই ছেড়ে দেয়নি। তার যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণাসভায় সে লম্বা অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বারবার পর্যালোচনা করেছে, অবরোধী অনুষঙ্গ থেকে সমরকন্দের দেয়াল টপকাবার সিঁড়ি, এত লোকের খাবারের বন্দোবস্ত, তাদের শান্ত রেখে বিজয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গানবাজনার ব্যবস্থা সবকিছুর দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

    শীতের অলস মাসগুলোতে ওয়াজির খান আর বাবর, তাদের অনুপস্থিতিকালীন সময়ে ফারগানার নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটাও বিবেচনা করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার উজির কাশিম, যার আনুগত্য আর দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাকেই রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে যাওয়া হবে। উজবেক অনুপ্রবেশের কোনো সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি, এবং কোনো ধরণের বিপদ হলে কাশিম সাথে সাথে তাকে সংবাদ পাঠাবে।

    এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমরকন্দের শত্রুর মনোভাব আঁচ করা, সে কি করতে পারে। বাবর জানে যে প্রধান উজির এবারও- এখন প্রকাশ্যে নিজেকে সমরকন্দের সুলতান হিসাবে অভিহিত করেন-তার অভিযানের খবর আগেই পাবে। শহরের শস্যাগারে গত বসন্তের ফসল এখনও মজুদ করা আছে এবং শহরের দেয়াল সুরক্ষিত রাখার জন্য সৈন্যদের বিশ্বস্ততা কেনার মত স্বর্ণখণ্ড কোষাগারে মজুদ রয়েছে।

    নাগাড়ে দশদিন পথ চলার পরে কোলবা টিলা তাদের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে। বাবর ওয়াজির খানের পাঠান রেকীদলের ফেরত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। সে তার ধূসর স্ট্যালিয়নটা পান্নার মত সবুজ ঘাস, যা গত শীতের তুষারপাতের আর্দ্রতায় এখন ও সিক্ত আর মাঝে মাঝে হলুদ, গোলাপী আর সাদা বসন্তের ফুলের নকশায় শোভিত, উপর দিয়ে দাবড়ে নিয়ে যায়। তার ঘোড়ার আগুয়ান গতিতে একটা লম্বা লেজবিশিষ্ট পাখি, শান্তি বিঘ্নিত হতে শূন্যে ডানা ঝাঁপটে ত্রাহি রব তুলে বাতাসের রবাভয়ে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। দিগন্তের বুকে আকাশের প্রেক্ষাপটে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারের দৃশ্যপট সামনে ভেসে উঠলে বাবর টের পায় তার নাড়ীর স্পন্দনে মাদলের বোল উঠছে। পুরো শহরটা ঘিরে আছে একটা শক্তিশালী দেয়ালের ব্যুহ এবং তার ভিতরে বাবরের চোখ খুঁজে নেয় আরেকটা বেষ্টনীর প্রাকার, শহরের ভেতরের নিরাপদতম স্থান তৈমূর যা নিজের সর্বোচ্চ অট্টালিকা কোক সরাই এর চারপাশে নির্মাণ করেছিলো। তার মৃত্যুর পর থেকে জায়গাটার একটা বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বাবর ছোটবেলা থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাহজাদাদের নির্যাতন, হত্যা আর অন্ধ করে দেয়ার গল্প এবং প্রাসাদে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া অমাত্যদের কাহিনী শুনে এসেছে।

    বাবর তার আজদাহাটাকে এক জায়গায় স্থির করে দাঁড় করায়। এত দূর থেকেও বাবর টের পায় একটা অতিকায় দানবের মত শহরটা সতর্ক আর উদগ্রীব হয়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে। অসংখ্য চোখ বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনুমান করতে চেষ্টা করছে কখন আর কোনো দিক থেকে বাবর এসে উপস্থিত হবে এবং তার সাথে লোকবল কত থাকবে। ফারগানা থেকে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল যাত্রাপথের পুরোটাই গুপ্তচরের নজরদারির ভিতরে ছিল।

    এইবার অবশ্য আশেপাশে অন্যকোন অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায় না। নিজের বিরহকাতর ভাই মাহমুদের কথা ভেবে বাবর আনমনেই হেসে উঠে। কোনো সন্দেহ নেই নিজের প্রজ্জ্বলিত নিম্নাঞ্চল নির্বাপিত করতে সে ইতিমধ্যেই আরেকজন রমণীকে খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যদি সে তাকে বেগম করতে চায়, বাবর শপথ নেয় উজিরের কন্যা তারই হবে। ভেট হিসাবে বাবর তাকে পাঠিয়ে দেবে।

    ***

    “সুলতান, আপনাকে ধৈৰ্য্যশীল হতে হবে,” ওয়াজির খান গত পাঁচমাস ধরে যা বলে আসছে সে কথারই পুনরাবৃত্তি করে। অস্থায়ী শিবিরের সদাসতর্ক চোখ কানের ব্যাপ্তি এড়িয়ে, একটা ফলবাগানের ভিতরে তারা বসে আছে। ওয়াজির খান শীতের প্রকোপ কমাবার জন্য এক ঝুড়ি জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে এসেছিল যার দিকে এখন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। এই উষ্ণতাটুকু তাদের প্রয়োজন ছিল। শরৎকাল আসছে। বাতাসে এখনই হাড় কাঁপিয়ে দেয়ার মত কনকনে হিম। “আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমাদের ভেতরেই বিভীষণ আছে। আমরা নিকুচি শের যখনই শহরের কোনো অংশের দেয়াল আক্রমণ করতে যাই বা নিচে সুড়ঙ্গ বানাই সেখানেই তারা আগে এসে বসে থাকে। খবর পায় কি করে।” বাবর জ্বলন্ত কয়লায় ভিতরে খঞ্জরের অগ্রভাগটা দিয়ে একটা গুতো দেয়।

    “সুলতান সব শিবিরেই গুপ্তচর থাকে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আর আমাদেরও কি চর নেই শহরের ভেতরে।”

    “তারা সবাই ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করছে।”

    “আরও অনেক কিছুই করবে, যখন করার সময় হবে। গত পাঁচমাস আমরা শহরটা অবরোধ করে রেখেছি। আমাদের পানি আর রসদের কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু শহরের ভেতরের অবস্থা ঠিক উল্টো। শীঘ্রই তারা বাধ্য হবে খাবারের অন্বেষণে লোক পাঠাতে। আমাদের গুপ্তচরদের এখন কেবল সতর্ক থেকে তাদের গোপনে বের হবার রাস্তাটা চিনে নিতে হবে। শক্তি দিয়ে যা কাবু করা যায় না ছলনায় সেটা সহজেই পরাভূত হয়।”

    হতাশায় বাবর অব্যক্ত স্বরে গুঙিয়ে উঠে। বিজ্ঞ আর ঠাণ্ডা বিচক্ষণ ওয়াজির খান যে লোক যুদ্ধ বিষয়ক কলাকৌশলে অজ্ঞ বাবরকে নিজ হাতে সবকিছু শিখিয়েছেন তিনি তাকে ভালো করে মনে করিয়ে দেন তার আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। বিগত মাসগুলো তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, সে জেনেছে যেখানে ঘাস আশেপাশের থেকে বেশি লম্বা আর সবুজ, বুঝতে হবে সেখানে লুকান পানির ধারা অবশ্যই আছে। সে শিখেছে যুদ্ধের সম্ভাবনা পিছিয়ে গেলে কিভাবে কুচকাওয়াজ আর শরীরচর্চার মাধ্যমে সৈন্যদের প্রস্তুত আর মনোবল চাঙ্গা রাখতে হবে। সে তাদের আদেশ দিয়েছে সমরকন্দের উঁচু দেয়ালের বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে গিয়ে পোলো খেলতে এবং শহরের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজদের হেলায় মোকাবেলা করতে বলে সে ঘোড়ার খুরে মত্ত মাদলের বোল তুলে ছুটে গিয়ে ভেড়ার মাথার বলে তার ম্যালেট দিয়ে আঘাত করেছে যা তারা তাদের খেলা শেষ হলে- ইচ্ছাকৃতভাবে শহর রক্ষাকারী প্রাকারের উপর দিয়ে চরম অবজ্ঞায় ভেতরে ছুঁড়ে দিয়েছে।

    বাবর, অন্ধকারে কিভাবে নিরবে দলবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় এবং কিভাবে লম্বা মই স্থাপন করতে হয় উঁচু দেয়ালের সাথে, যার শীর্ষভাগ ভেড়ার চামড়া মোড়ান রয়েছে কৌতূহল উদ্রেককারী শব্দ রোধ করতে, আয়ত্ব করেছে। মই বেয়ে সে। তাদের সাথে উপরে উঠতে গিয়ে প্রস্তরখন্ড, তীরের ঝাপটা আর বালতি ভর্তি গরম জ্বলন্ত আলকাতরার সামনে পড়েছে এবং পিছিয়ে এসেছে। সে তার লোকদের খোঁড়া অন্ধকার, বালুময় সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দেয়ালের দিকে আশা করেছে নিচে দিয়ে যেতে পারবে কিন্তু ফারগানার পাহাড়ের মত অনড় ভিতের মুখোমুখি হয়েছে।

    বাবর দিনের বেলায় আক্রমণ করেছে, তার লোকেরা ঘামে ভিজে অতিকায় অবরোধ অনুষঙ্গ টেনে এনেছে বিশাল প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু সমরকন্দের লোহা দিয়ে বাধান গেট আর পুরু দেয়াল এসব ঝাপটা আর মাথায় লোহার পাত দেয়া বড় ভারী কাঠের লাঠির আঘাত অনায়াসে সামলে নিয়েছে।

    “আমি বুঝতে পারছি না। আমার চাচা সমরকন্দের সুলতান ছিল। আমি তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধর। আমি আশ্বস্ত করেছি যে শহরে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হবে না। লোকজন নিজের গরজে দরজা খুলে আমাকে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করছে না কেন? সুদখোর উজিরের ভিতরে তারা কি পেল?”

    ওয়াজির খানের হাসি হাসি মুখ দেখে বাবর বুঝতে পারে সে আবার বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। “এমন হতে পারে সে তাদের ভয় দেখিয়ে বশে রেখেছে। একটা কথা মনে রাখবেন সাধারণ মানুষ আপনাকে চেনে না। তৈমূর মারা যাবার পর থেকে অগণিত সুলতান আর গোত্রপতির দল নিজেকে মহান যোদ্ধার আত্মীয় দাবি করে সমরকন্দ অবরোধ করেছে স্বর্ণ আর সৌভাগ্যের প্রত্যাশায়। আপনার আপন। চাচাও বাহুবলে শহরটা অবরোধ করেছিলেন। শহরবাসীরা উপদ্ৰবকারীর প্রতি কেন সদয় হবে? হাম্বলদস্তা উজিরকে অন্তত তারা চেনে।”

    পেঁচার ডাক শুনে তারা আকাশের দিকে তাকায়, সেখানে ইতিমধ্যেই রাতের তারারা বিদায় নিতে শুরু করেছে।

    “সুলতান, এবার আমাদের ফেরা উচিত।” ওয়াজির খান কয়লা ভর্তি ঝুড়িটা লাথি মেরে উল্টে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লাগুলি পা দিয়ে মাটি চাপা দেয়।

    বাবর কেঁপে উঠে, কিন্তু সেটার কারণ কেবল উষ্ণতার সমাপ্তির ভিতরে নিহিত ছিল না। “ওয়াজির খান আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমরা যদি শীঘ্রই শহরটা দখল না করি তবে শীতকাল এসে আবার আমার সৈন্যবাহিনীর দফারফা করে দেবে। আমি বিজয় অর্জন না করেই দ্বিতীয়বারের মত ফারগানায় ফিরে যেতে বাধ্য হব। তখন আমার লোকেরা কি ভাববে আমাকে?”

    ওয়াজির খান তার বাহুতে হাত রাখে। “আমাদের হাতে সময় আছে। সূর্য এখনই ক্রান্তিকালে আসেনি। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সমরকন্দের পতন হবেই।” বাবর ভাবে, তার কথাই ঠিক। তার মরহুম আব্বাজান অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন কিন্তু তাই বলে কখনও হতাশ হননি। তিনি যেন কি একটা কথা বলতেন? “তোমার সৈন্যরা যদি তোমাকে দ্বিধাগ্রস্থ দেখে তবে সব শেষ। তারা তোমার প্রতি নেতৃত্ব আর নিয়মানুবর্তিতার জন্য তাকিয়ে রয়েছে।” হ্যাঁ, সুলতানের কাজ হচ্ছে শক্ত থাকা। তাকে অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে।

    তারা ঘোড়ায় চড়ে ছাউনির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ছাউনির কাছাকাছি পৌঁছালে ঘোড়ার খুরের বোল ছাপিয়ে একটা লোকের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বাবরের কানে ভেসে আসে। দূর্বিনীত বদমাশগুলো কি নিজেদের ভিতরে আবার ঝামেলা বাধিয়েছে, যারা তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ? বাতাসে শোরগোলের আওয়াজ আরও জোরাল হতে এবং শপথ আর প্রতিজ্ঞার ঝড় বইতে থাকলে, সে ক্লান্ত মনে ভাবে।

    হাম্মামখানার তাবুর কাছ থেকে গোলমালের শব্দ আসছে। সে আর ওয়াজির খান আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে, বাবর দেখে তার একজন ভাড়াটে সেনাপতি বনাঞ্চলে বিচরণ করা যাযাবর-নিজের কয়েকজন মার্কামারা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দুটো বস্তার জিনিসপত্র তল্লাশি করছে। আরেকজন লোক, পোশাক-আশাক দেখে মনে হয় আশেপাশের গ্রামের কৃষক, দাঁড়িয়ে দেখছে। “আমার কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নেবার কোনো অধিকার তোমার নেই। তোমরা যদি সবই এভাবে রেখে দাও-আমার শস্য এমনকি আমার ভেড়াগুলোও বাদ দাওনি, তাহলে এই শীতে আমি আমার পরিবারকে কি খেতে দেব।” লোকটা ইশারায় কাছেই জড়োসড়ো হয়ে থাকা আলুথালু বাদামী রঙের ভেড়ার দিকে ইশারা করে। ক্রোধে লোকটার চোখে পানি টলটল করছে।

    এই গোবেচারা, হাল্কা পাতলা, বিপর্যস্ত চেহারার কৃষিজীবি লোকটা ক্রোধে হতাশায় যেসব যোদ্ধাদের সামনে দাপাদাপি করছে তারা হাতের ঝটকায় তাকে জানে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তার স্পর্ধা চোখে পড়ার মত, কিছু একটা আছে লোকটার ভিতরে, বাবর ভাবে।

    “জানে বেঁচে গেলে বলে কপালকে ধন্যবাদ দিতে দিতে তোমার আস্তাকুড়ে ফিরে যাও। আর তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে তাকে আমার তরফ থেকে একটা চুমো দিয়ে বোলো, তার সঙ্গ আমি উপভোগ করেছি, যোদ্ধাদের একজন খিকখিক করে হাসতে হাসতে লোকটার পোদে একটা লাথি বসিয়ে দিলে বেচারা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। লোকটা উঠতে চেষ্টা করলে আরেকটা লাথি কষিয়ে দেয়।

    “এখানে কি হচ্ছে?”

    চমকে উঠে বোকা বোকা চোখে লোকগুলো বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    “মহামান্য সুলতানের প্রশ্নের উত্তর দাও,” ওয়াজির খান বাঘের ঝাপটা নিয়ে বলে। কিন্তু তবুও কেউ উত্তর দেয় না।

    “উঠে দাঁড়াও,” বাবর মাটিতে পড়ে থাকা কৃষককে ইঙ্গিত করতে, সে ধীরে, পেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার বলিরেখা পূর্ণ মুখে আশঙ্কার আঁকাজোকা। সে যদি সৈন্যদের ঘৃণা করে বোঝাই যায় তাদের সুলতানের প্রতিও তার কোনো আস্থা নেই। সে কারুকার্যময় লাগাম সজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট কর্তৃত্বব্যঞ্জক বালকের কাছ থেকে দূরে সরে আসে।

    “যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।” বাবর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে জীবন্ত চিত্রপটের দিকে তাকিয়ে দেখে। তার সামনে দুটো পাটের তৈরি বস্তা অসহায়ের মত উল্টে পড়ে ভেতরের সব মামুলি জিনিসপত্র ছত্রাকারে ছিটিয়ে রয়েছে। বাবর তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে ফেলে, একটা বস্তায় হাত ঢুকায় এবং ভেতর থেকে মলিন কাপড়চোপড়, একটা কাঠের পাত্র এবং কয়েকটা কাপড়ের ব্যাগ বের করে আনে। কাপড়ের ব্যাগগুলো খুলে সে ভেতরে ইঁদুরের কালো বিষ্ঠার সাথে মিশ্রিত ছাতা ধরা শস্যদানা দেখতে পায়। অন্য থলেটা ভারী প্রতিয়মান হয়। ভেতরে ছয়টা হাড্ডিসার মুরগী, যাদের সদ্য মাথা মোচড়ানো হয়েছে, এবং একটা। পনিরের পিণ্ড আর বস্তার আস্তরে মুরগীর পালক আর রক্তে দলা পাকিয়ে রয়েছে। দেখা যায়।

    বাবর বস্তাটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার সময় লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক তার যথাসর্বস্ব ধনের মত সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এগুলো কোথা থেকে এসেছে?” বাবর জানতে চায়। নিরবতা। “আমি জানতে চাইছি এসব কোথা থেকে এসেছে?” দ্বিতীয়বার সে সরাসরি কৃষকের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে। ‘সুলতান, জাফরশান নদীর ওপারে আমার গ্রাম থেকে এসেছে।”

    “আর এসব তোমার কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে?”

    “হ্যাঁ, সুলতান।”

    “জোর করে?”

    “হ্যাঁ, সুলতান। এই দুইজন কেড়ে নিয়েছে।”

    লোকটা লজ্জায় মাথা নিচু করে।

    বাবর তার সেনাপতির দিকে তাকায়। “আমি পরিষ্কার আদেশ দিয়েছিলোম গ্রাম থেকে কোনো কিছু লুঠ করা হবে না, আমরা সব কিছু দাম দিয়ে কিনে নেবো। তৈমূরের উত্তরসূরী গরীব লোকদের নিপীড়ন করতে তাদের রক্তে ধরণী সিক্ত করতে এখানে আসেনি।”

    যাযাবর লোকগুলো তার দিকে গনগনে চোখে তাকায়। “আমরা এখানে কয়েক। সপ্তাহ যাবৎ আছি। আমরা কিছুই জোর করে নেইনি। লুঠ করার মত কোনো মালই নেই। আমার লোকেরা বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের আমোদ দরকার। আর কি এমন নিয়েছে কৃষক নামের এই লার্ভাকীটের কাছ থেকে মামুলি কিছু সামগ্রী।”

    “আর তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে।”

    “তারা তো বললো সেই মহিলা খুব একটা অনিচ্ছুক ছিল না।” দলপতি খিকখিক করে হাসতে তার চওড়া কোদালের মত দাঁতের মধ্যেখানের ফাঁক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

    ক্রোধের একটা ঝাপটা বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার ইচ্ছে হয় তাদের এখনই এখানেই তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে হতভাগাদের দেহবিহীন মুণ্ড গোবরের ঢিপিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। “ওয়াজির খান এই দুই লুটেরাকে এখনই গ্রেফতার করেন। তারা লুঠতরাজ আর ধর্ষণের অভিযোগে দোষী। তারা জানে এর কি শাস্তি। তাদের গোত্রের অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে আমি চাই এই মুহূর্তে তাদের সাজা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হোক।”

    ওয়াজির খান হাত উঁচু করে ইশারা করতেই প্রহরীরা এসে দু’জনকে বন্দি করে যারা কোনো প্রকারের বাধা দেবার পরিবর্তে আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে যেন আশেপাশে যা ঘটছে সেটা তাদের জ্ঞানগম্যির বাইরে।

    “আর তোমাকে বলছি,” বাবর গোত্রপতির দিকে এবার তাকায় যার মুখের আমুদে হাসি অনেক আগেই উবে গেছে। বাবর খেয়াল করে তার আঙ্গুল কোমরে খয়েরী রঙের উলের তেলতেলে মসৃণ কাপড়ে জড়ান খঞ্জরের বাটের আশেপাশে চঞ্চল ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে এবং দেহ টানটান হয়ে আছে, মূর্খটার মাথায় কোনো ধরণের দূর্মতি ভর করলে সেটা মোকাবেলার জন্য সে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। “এই অভিযানে তুমি আমার আইন মেনে চলবে অথবা তার পরিণতি ভোগ করবে এই শপথ নিয়েই তুমি আমার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতেও যদি তুমি তোমার লোকদের সামলে রাখতে ব্যর্থ হও তাহলে জেনো তোমারও একই পরিণতি হবে।” বাবরের কণ্ঠে হুমকির প্রচণ্ডতা। “তুমি সবার সামনে ঘোষণা করবে এটা ন্যায়বিচার-শাহী ন্যায়বিচার। আমি আমার শিবিরে কোনো ধরণের রক্তপাত চাই না। এখনই তোমার সব লোকদের এখানে ডেকে পাঠাও!”

    গোত্রপতির দৃষ্টি বাবর, ওয়াজির খান আর প্রহরীদের হাতে ধৃত দুই লুণ্ঠনকারীর চোখের মরিয়া-দৃষ্টির ভিতরে ঘোরাফেরা করে। বাবর তার চোখে আর অভিপ্রায়ে মৃত্যুর শাণিত সঙ্কেত অনুভব করে। কিন্তু অস্ফুট কসম আউরে গোত্রপতি তরবারির বাট থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং তার পরিষ্কার কামান মাথা আনুগত্য প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে নত করে।

    দশ মিনিট পরে, অভিযুক্ত দুজনের চারপাশে একটা নিরব বৃত্ত তৈরি করে তাদের ক্ষুদ্র গোত্রের সব সদস্য এসে জড়ো হয়। বাবর ইশারায় অনুমতি দিলে সে কেশে গলা পরিষ্কার করে এবং বন্দিদের উদ্দেশ্যে বলে: “আমি যে আইন রক্ষা করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমরা সেটা ভঙ্গ করেছে। আমি, গোত্রপতি হবার কারণে, বিচারের জন্য তোমাদের সোপর্দ করলাম। তোমাদের দেহ টুকরো করে হায়না আর শকুনের খোরাক হিসাবে ফেলে রাখা হবে। এখানে উপস্থিত সবাই আরেকটা কথা শুনে রাখো, আমার আদেশে এটা সংঘটিত হবে। দণ্ড কার্যকর যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিশোধমূলক মনোভাব পোষণ করবে না।”

    ওয়াজির খান তার প্রহরীদলকে সামনে এগোবার ইঙ্গিত দেয়। কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে তারা কাঁপতে থাকা বন্দির দিকে এগিয়ে যায় এবং তাদের হাঁটু ভেঙে দাঁড়াতে বাধ্য করে। ঝকঝকে তরবারির ফলা মৃত্যু মুখে নিয়ে তাদের ঘাড়ের উপরে নেমে আসতে সকালের তাজা শীতল বাতাসে লোকগুলোর শেষ আর্তনাদ পুকুরে ঢিল পড়ার মত ভেসে উঠে ডুবে যায়।

    বাবরের পেটের খাবার মোচড় খেয়ে উঠে আসতে চায় এবং গভীর শ্বাস নিয়ে সে নিজেকে শান্ত রাখে। এটাই আইন। শৃঙ্খলা আর শ্রদ্ধা বজায় রাখতে কোনো নেতা যা করতো সে কেবল সেটাই করেছে। আর্তনাদ প্রশমিত হয়ে শকুনের দল আশু ভোজের সম্ভাবনায় কোলাহল শুরু না করা পর্যন্ত বাবর নিজেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া থেকে বিরত রাখে।

    “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও আর এটা ধরো।” বাবর রৌপ্য মুদ্রা ভর্তি উটের চামড়ায় তৈরি একটা থলে হতভম্ব কৃষকের দিকে বাড়িয়ে ধরতে সে কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপরে সেটা হাতে নেয়। বাবর পিঠ ঘুরিয়ে নিয়ে রওয়ানা দেবে এমন সময় লোকটা গলা পরিষ্কার করে ইতস্তত ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে চায়।

    “আর কিছু বলবে?” চর্মসার আর দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকটা- বাবরের মনে বিরক্ত আর ক্লান্ত একটা অনুভূতির জন্ম দেয়। আজ এখানে যা কিছু ঘটেছে তাতে এই লোকটার কোনো হাত নেই, কিন্তু লুটেরার দল যখন তার গ্রামে হানা দিয়েছিলো তখন সেই সত্যিকারের মানুষের মত তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল…বাবর ভাবনাটা অবান্তর বলে সেখানেই থামিয়ে দেয়। এই লোকটা যোদ্ধা না, সে একজন পরিশ্রমী মানুষ এবং সে সাহস করে তার শিবিরে এসেছিল ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়।

    “সুলতান…একটা ব্যাপার যা আপনার বোধহয় জানা উচিত…তিন দিন আগে পূর্ণিমার সময়ে যা আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

    “কি দেখেছো?…বলো।”

    “আমি দেখেছি কিছু লোক…সম্ভবত, গুপ্তচর– শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি তখন ভেড়া চরাতে গিয়েছিলাম, গাছের আড়ালে লুকিয়ে আমি তাদের বের হতে দেখি, এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদের ফিরেও আসতে দেখেছি। সুইপ্রস্তুতকারকদের ফটকের পাশে দিয়ে একটা গলিপথ সমরকন্দের দিকে চলে গেছে। সুলতান চাইলে আমি সেটা দেখাতে পারি।”

    বাবরের হৃৎস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়। “তুমি যদি সত্যি কথা বলে থাকো তবে ঐ রৌপ্যমুদ্রার কয়েকগুণ বেশি আমি তোমার ওজনের সমান সোনার মোহর তোমাকে দেব।”

    ***

    “সুলতান, এটা স্রেফ পাগলামি।”

    “হয়ত।” বাবর টের পায় তার নিজের ভেতরে উত্তেজনার রাশ আলগা হচ্ছে। আর কয়ের ঘণ্টা পরে সে সমরকন্দের ভেতরে থাকবে।

    “অন্তত আমাকে আপনার সাথে যাবার অনুমতি দেন।”

    “না, ওয়াজির খান। ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত একটা কিশোরকে কে ভাল করে খেয়াল করতে যাবে? কিন্তু সমরকন্দের অনেকেই তোমায় চেনে। আমি একলাই বরং নিরাপদে থাকব।”

    ওয়াজির খানকে অন্তত একবার হলেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখায়। তার অন্ধ চোখের উপরের আড়াআড়ি ক্ষতচিহ্ন স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কুঞ্চিত হয়ে উঠে। “কিন্তু আপনি আমাদের সুলতান,” সে একগুয়ে কণ্ঠে বলে। “ফারগানার কি হবে যদি আপনি আর ফিরে না আসেন?”

    “আমি ফিরে আসছি। এখন আমাকে যেতে দাও।”

    বাবর তার নিজের পছন্দ করা নির্ভরযোগ্য, শক্তপোক্ত দেখতে কালো টাটু ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে রাতের আঁধারে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

    চাঁদের আলোয় পশ্চিমদিকে বয়ে যাওয়া নহরের সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া। এবড়োখেবড়ো পথটা আলোকিত হয়ে আছে, যা আগের রাতে সে নিজে ওয়াজির খান আর সেই কৃষকটার সাথে এসে দেখে গিয়েছিল। তার মস্তিষ্কে পথটার প্রতিটা নুড়িপাথর যেন গাঁথা হয়ে রয়েছে। সে এখন খান উর্তি তৃণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে চলেছে- তার মরহুম আব্বাজান তাকে প্রায়ই এর কথা বলতো- গ্রীষ্মকালে তৈমূর একবার এখানে অবকাশযাপনের উদ্দেশ্যে ছাউনি ফেলেছিল। রেশমের ছাউনির নিচে শুয়ে পানির ধারা বয়ে যাবার শব্দ শুনবে বলে, যা ছিল বেহেশতের উদ্যানে প্রবাহিত জলধারার ন্যায় শীতল আর বিশুদ্ধ। এখন সেই একই জলধারার চঞ্চল শব্দ যেন মহান তৈমূরের কণ্ঠস্বর হয়ে বয়ে চলেছে, তাকে বলছে: “এগিয়ে যাও। সব কিছু তুচ্ছ করে।”

    এক ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পথ চলার পরে স্রোতধারা বিভক্ত হতে বাবর বামদিকের স্রোত অনুসরণ করে সেটা সমরকন্দের বিশাল সবুজাভ-নীল তোরণের আধমাইল দক্ষিণ দিয়ে বয়ে গেছে। তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। দূর্গ প্রকারের পেছন থেকে তাকিয়ে থাকা সতর্ক দৃষ্টি নিঃসঙ্গ অশ্বারোহীকেও সন্দেহের চোখে দেখবে যদি সে খুব কাছে এগিয়ে যায়। সে স্রোতধারার দূরবর্তী পাড় দিয়ে এগিয়ে যায়, যেখানে সে পাড়ে জন্মানো উইলো গাছের ছায়ায় মিশে গিয়ে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে অশরীরির মত এগিয়ে যেতে পারবে।

    ওয়াজির খান অবশ্য ঠিকই বলেছিল। পুরো ব্যাপারটাই পাগলামির চুড়ান্ত। এতগুলো মাস শহর অবরোধ করে রাখার পরে এখন যদি শহরের রক্ষাব্যুহের দুর্বল স্থান আর তার অধিবাসীদের মনোভাব জানবার শখ বাবরের হয়ে থাকে তবে সে নিজে একলা না এসে তার অধীনস্থ কোনো গুপ্তচরকে সুড়ঙ্গ পথে পাঠাতে পারতো। কৃষকটার ইতস্তত ভঙ্গিতে উচ্চারিত সেই কয়েকটা বাক্য শোনবার মুহূর্ত থেকে বাবর জানে নিয়তির অমোঘ হাত তাকে সামনে টেনে নিয়ে চলেছে।

    মাথার উপরে ঝুঁকে থাকা উইলোর শাখার ভেতর দিয়ে রাতের মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। স্রোতস্বিনীর অপর পাড়ে সে শহরের আবছা অবয়ব দেখতে পায়। আর কয়েক মিনিট আর তারপরেই অন্ধকারের ভেতর থেকে দৈত্যের মত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার প্রকটিত হবে। শীঘ্রই একদিন, বাবর নিজেকে কথা দেয়, রাতের আঁধারে চোরের মত নিজের শহরে প্রবেশের বদলে, সে এই তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে নিজের বাহিনী নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে।

    একটা ক্ষুদ্র জন্তু- ইঁদুর, খুব সম্ভবত নদীর তীরে বসবাসকারী ইঁদুর- তার টাটুর খুরের নীচ দিয়ে দৌড়ে গেলে আতঙ্কে হেষাধ্বনি তুলে বেচারা চঞ্চল ভঙ্গিতে পাশে সরে যায়। বাবর নুয়ে পড়ে তার টাটুর নরম, ঝাকড়া গলায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাবর ঘোড়ার সাজ খুলে নেয় এবং পিঠ থেকে ভাঁজ করা কম্বলটা নামায় যার উপরে সে এতক্ষণ বসে ছিল তারপরে ওয়াজির খানের সাথে তার যেমন কথা হয়েছিলো, টাট্ট ঘোড়াটা ছেড়ে দেয় যাতে সেটা পথ খুঁজে ছাউনিতে ফিরে যেতে পারে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে ওয়াজির খান এখানেই আরেকটা নতুন ঘোড়া নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে।

    কোমল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দক্ষিণে আরও আটশ গজ এগিয়ে যাবার পরে সে সুইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের উভয়পার্শ্বে জ্বলন্ত মশালের বিরক্তিকর লালবিন্দু সে দেখতে পায়। লম্বা আর সংকীর্ণ, সমরকন্দের ছয়টা প্রবেশদ্বারের ভিতরে, এটা সবচেয়ে সেটা আর নিরাভরণ। এই তোরণদ্বার সাধারণত কৃষক আর ব্যবসায়ীরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকে। তৈমূর কদাচিত এটা ব্যবহার করেছেন। অতিকায় লোহার তোরণদ্বার আর নীল টাইলে সজ্জিত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার তিনি সাধারণত ব্যবহার করতেন যার প্রবেশ পথের খিলানাকৃতি তোরণের উপরের কামরায় অবস্থানরত নকীবের দল কাড়াকাড়া আর কর্কশ-সুরের তূর্যনাদের মাধ্যমে তার আগমন ঘোষণা করতো।

    সময় হয়েছে এবার স্রোতস্বিনী অতিক্রম করার, যা এখানে অনেক গভীর প্রায় নদীর দ্যোতনায় প্রবাহিত হচ্ছে। বাবর প্রায় তার কাঁধ ছাপিয়ে বয়ে যাওয়া পানিতে ধীরে ধীরে নেমে আসে। প্রায় তীরের কাছে পৌঁছে সে তলদেশের আলগা পাথরে হোঁচট খায় আর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শীতল পানির স্রোত মাথার উপরে বয়ে গিয়ে তার শ্বাসরোধ করে ফেলে সে টের পায় পানির টানে সে ভেসে যাচ্ছে। ডুবন্ত। মানুষের মত অকুলান হয়ে সে কোনমতে একহাত পানির উপরে তুলে আর সেটা গাছের ডালের মত কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেতে সে ব্যাথায় কুচকে যায়। আরেকবারের চেষ্টায় সে একটা ডাল কোনমতে ধরে আর এবার দু’হাত ব্যবহার করে নিজেকে তীরে তুলে নিয়ে আসে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে, সে চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে চারপাশে ভাল করে তাকায়। অন্ততপক্ষে সে নহরের অপর পারে এসে পৌঁছেছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার। তৈমূরের আংটি খোঁজে, যা তার গলায় একটা চামড়ার পাতলা দড়ির সাহায্যে ঝুলে আছে। তার আঙ্গুল ভারী, মোটা ধাতব অস্তিত্ব টের পেতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে নিরবে গুটিসুটি মেরে কাঁপতে কাঁপতে কান খাড়া করে। কিছুই না। না কোনো ফেঁকড়ি ভাঙার আওয়াজ না বাদুরের নরম ডানার ঝাপটানি। সে এবার সামনে সুইপ্রস্তুতকারকদের আবছাভাবে দৃশ্যমান তোরণদ্বারের দিকে তাকায়। গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে সে একটা পুরান বাগানের ধ্বসে পড়া দেয়ালের কাছে। এসে পৌঁছে, যেখানে ডালিম গাছের মাঝে মরা ডালপালার স্তূপের নিচে গোপন সুড়ঙ্গে প্রবেশের মুখটা ঢাকা রয়েছে।

    গতরাতে পাহারা দেবার জন্য কোনো প্রহরী ছিল না। বাবর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে আজও যেন সেরকমই থাকে। আর তাছাড়া সুড়ঙ্গের ভেতরেও সে কারো মুখোমুখি হতে চায় না। তাকে দ্রুত করতে হবে- আর সেই সাথে সতর্কও থাকতে হবে। খোলা স্থানের দিকে দৌড়ে যাবার প্রবণতা গলা টিপে মেরে সে একটা বুড়ো গাছের কোটরে গা-ঢাকা দেবার স্থান খুঁজে বের করে এবং সেখানে চুপ করে বসে কান খাড়া করে চারপাশে লক্ষ্য রাখে। তোমার নামের অর্থ বাঘ, বাবর নিজের মনে বলে, আজ রাতে তাই সেরকমই আচরণ করো। খোলা জায়গা এড়িয়ে গিয়ে তাই আঁধারের আলিঙ্গনে নিজেকে আবৃত করো আর নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করতে শেখো।

    কিছুক্ষণ পরে, একটা বাচ্চা শেয়াল তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। বাবরের গায়ের গন্ধ সে ঠিকই টের পায়, কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যায়। শেয়ালের আচরণ দেখে বাবর নিশ্চিত হয় আশেপাশে কোনো দ্বিপদী প্রাণী নেই। আর সে তার লুকিয়ে থাকার স্থান থেকে এবার তাই বেরিয়ে আসে। তার পরণের মোটা কাপড়ের তৈরি আলখাল্লা আর ভেড়ার চামড়ার আঁটসাট জ্যাকেট- গরীব কৃষকের লেবাস- এখনও ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে আর তার ত্বকে শীতল অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। পানিতে ভেজা কুকুরের মত সে নিজেকে ঝাঁকায়, তারপরে নিজেকে ভাল করে রগড়ে নেয়।

    কম্পিত বুকে, সে সুড়ঙ্গের মুখের দিকে এগিয়ে যায় এবং মুখ থেকে ডালপালা সরিয়ে দেয়। তারপরে বুকে ভর দিয়ে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে এগিয়ে যাবার আগে নিজের পেছনে পুনরায় ডালপালাগুলো আবার জায়গামত রেখে দেয়। হাত বাড়িয়ে সে সুড়ঙ্গের মুখ আটকে রাখা ঝুলদরজার প্রান্ত খুঁজে। এই তো পেয়েছি! দরজাটার হাতল আঁকড়ে ধরতে একটা ছোট পোকা- সম্ভবত পিঁপড়ে বা পেটের নিচে চিমটেওয়ালা ক্ষুদে পোকা- তার আঙ্গুলের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। বাবর সাবধানে দরজাটা খুলে এবং ভেতরে উঁকি দেয়। খনিকূপের মত সরু পথটা ইটের তৈরি আর দু’পাশে কাঠের ডাসা লাগান রয়েছে। সে দু’পাশের ডাসায় পা দিয়ে নামতে শুরু করে আর মাথার উপরে ঝুলদরজাটা টেনে যথারীতি বন্ধ করে দেয়।

    তার চারপাশে এখন সূচীভেদ্য অন্ধকার এবং কেমন একটা অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতাস্যাঁতে, মাটি মাটি গন্ধ তার নাকে ভেসে আসে যেন কোনকিছু- বা কেউ একজন- এখানে মারা গিয়েছে, যা সম্ভবত এখানেই থেকে গিয়েছে। সমরকন্দের একটা গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সত্যি কিন্তু সেই সাথে সেটা সংঘাতময়ও বটে। এই সুড়ঙ্গটা প্ৰথমকে খুঁড়েছিল? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে। তারা কি ভয়ঙ্কর ভবিতব্য এড়াতে নাকি ভেতরে প্রবেশের জন্য এই গর্তটা খুড়েছিল?

    সতর্কতার সাথে, বাবর খনিকূপ সদৃশ সুড়ঙ্গটার তলদেশে নিজেকে নামিয়ে নিয়ে আনে, আগের রাতের অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে সুড়ঙ্গটা মাত্র দশ ফিট গভীর। কিন্তু প্রশ্ন হল সুড়ঙ্গটা এখান থেকে কোথায় গিয়েছে? সে দুহাত দিয়ে দু’পাশে শক্ত করে ধরে পা টিপে টিপে সামনে এগিয়ে যায়। তার পায়ের নিচের মাটিতে প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ সৃষ্টি হয় এবং মনে হয় ক্রমশ ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। পিছলে গিয়ে টলতে টলতে সে সামনে এগিয়ে যায় এবং কয়েক কদম পরে পায়ের নিচে শক্ত পাথরের অস্তিত্ব অনুভব করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

    মাথার উপরের ছাদ নিচু হয়ে আসতে বাবর ঝুঁকে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। এখন কোনো শত্রুর মুখোমুখি হলেই হয়েছে, আর দেখতে হবে না। সোজা হয়ে সে দাঁড়াতেই পারছে না, শত্রুর মোকাবেলা করবে কিভাবে। আর তরবারি চালাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। সে সাথে করে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাটযুক্ত তরবারি নিয়ে আসেনি। কপাল খারাপ হলে সে যদি ধরা পড়ে তখন। তার মত একজন কৃষকের সন্তানের কাছে সেটা কিভাবে এল তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হবে। কিন্তু মুশকিল হল তরবারিটা ছাড়া তার নিজেকে অরক্ষিত মনে হয়।

    স্যাঁতস্যাঁতে, পাতিগন্ধময় বাতাসে সে যেভাবে কুঁজো হয়ে রয়েছে, তাতে শ্বাস নেয়া রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। পায়ের ধাপ গুনতে গুনতে, সে দ্রুত এগিয়ে যায়- দশ, বিশ, ত্রিশ। সে আগে হিসেব করে রেখেছে যে ছয়শো ধাপ তাকে শহরের দেয়ালের কাছে যাবে। কিন্তু তার কোনো ধারণা নেই সুড়ঙ্গটা আসলে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে গোনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নব্বই, একশ। কপালের ঘাম গড়িয়ে মুখে একটা নোনতা স্বাদ ছড়িয়ে যায়। অসহিষ্ণুচিত্তে সে জিহ্বা দিয়ে লবণাক্ত ঘামের ফোঁটা ঘন ঘন টুসকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। একশ পঞ্চাশ…সুড়ঙ্গটা এখন বেশ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে, দু’জন অনায়াসে হেঁটে যেতে পারবে। বাবরের গতিবেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। সে এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। চারশ….

    তারপরে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিসের শব্দ? পুরুষ কণ্ঠের হৈচৈ আর কর্কশ অট্টহাসি সে নিশ্চিতভাবেই শুনতে পায়। সহসা তাকে চমকে দিয়ে সামনে থেকে কমলা আলোর আভা ভেসে আসে। বাবর এবার অস্পষ্ট দেয়াল দেখতে পায় এবং সেটা বাম দিকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বদ্ধস্থানে গলার স্বর গমগম করে প্রতিধ্বনি তুলছে। মুহূর্তের ভিতরেই কণ্ঠস্বর যাদের তারা বাঁক ঘুরবে আর তাকে দেখতে পাবে। বাবর পাগলের মত ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার কোণায় ছুটে যায়। হতাশায় প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে দৌড়াতে থাকে এবং সুড়ঙ্গের একটা ভাজের মাঝে নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে মিলিয়ে দিতে। কিন্তু কণ্ঠস্বরগুলো এখন আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। লোকগুলোকে যদি সুড়ঙ্গটা পাহারা দেবার জন্য পাঠান হয়ে থাকে তবে বলতেই হবে তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। একটা মলিন হাসি তার মুখে ফুটে উঠে। ওয়াজির খানের লোক হলে এতক্ষণে কাজে গাফিলতির জন্য। তাদের চামড়া জীবন্ত খালিয়ে নেয়া হত।

    বাবর অপেক্ষা করে। পুনরায় অন্ধকার আর নিরবতা নেমে এসেছে। বেশ কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সে আবার সামনে এগোতে শুরু করে। বাবর তার পায়ের ধাপের গণনা গুলিয়ে ফেলেছে কিন্তু সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে সে শহরে দেয়ালের কাছে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে গেছে। সে এবার বাম দিকের তীক্ষ্ণ বাঁকটা ঘুরে এবং সামনে এগিয়ে যায়। আরও পাঁচ মিনিট নাগাড়ে হাঁটবার পরে সে তার সামনে আবছা আলোর আভাস বুঝতে পারে যা জ্বলন্ত মশালের কমলা রঙের আভা না বরং চাঁদের আর রাতের তারার একটা শীতল বিকিরণ।

    হাতের উল্টোপিঠ সে তার কপালের ঘাম মোছে এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব অন্ধকারে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করে যেন দূরবর্তী প্রান্তে ধনুকে তীরে জুড়ে তৈরি থাকা সতর্ক প্রহরী তাকে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু সামনে কেবল নিরবতা বিরাজ করছে। পুরো শহর এখন বোধহয় ঘুমে বিভোর। সে তার বিবর্ণ মাটির দাগ লাগা পোষাক আর হাত সুড়ঙ্গের ভিতরের আলোতে কোনমতে দেখতে পায়। তাকে তৈমূরের বংশের রাজপুত্র বলে কেউ চিনতে পারবে সে ভয় এখন আর নেই। শহরের ভিতরে সে অনায়াসে ভীড়ের মাঝে মিশে যেতে পারবে, গতকালের বাসি রুটির সন্ধানে আরেকজন হতভাগ্য কিশোর এসেছে।

    সুড়ঙ্গটা এসে দূষিত পানিতে পূর্ন একটা বৃত্তাকার গর্তে এসে শেষ হয়েছে, বাবর ভাবে, সম্ভবত কোনো অব্যবহৃত ইঁদারার খাড়া ফাঁকা স্থান। উঁকি দিয়ে সে রাতের তারকাখচিত আকাশের চাঁদোয়া দেখতে পায়। নিরবে সন্তর্পনে সে খাঁড়া দেয়ালে গাঁথা ধাতব কীলক বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে। এমন সুড়ঙ্গ এই শহরে আর কতগুলো আছে? কোনো সন্দেহ নেই শত্রুরা তার প্রতিটা পরিকল্পনা সম্পর্কে আগেই অবহিত হয়েছে। তার ছাউনি দূষিত করতে দলে দলে গুপ্তচরের দল ইঁদুরের মত হাজির হয়ে তার গোপন তথ্য জেনে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন, বাবর ভাবে, ইঁদুর হবার পালা এবার আমার।

    দেয়ালের উপরে পাথরের গোলাকার রক্ষামূলক বেষ্টনীর উপর দিয়ে বাবর নিজেকে টেনে তুলে এবং ছায়ার ভিতরে আলতো করে নেমে আসে। চাঁদের আলোতে বাবর দেখে সে একটা আঙ্গিনার মত জায়গায় উপস্থিত হয়েছে যেখানে কেবল দুটো হাড্ডিসার নেড়ী কুত্তা ঘুমিয়ে রয়েছে। বাবর তাদের পাঁজরের হাড় ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে উঠানামা করতে দেখে এবং তাদের মৃদু কেঁউ কেউ স্বরে ফোঁপানি শুনতে পায়। পরাক্রমশালী সমরকন্দে তৈমূরের উত্তরাধিকারীর আগমনের কি অনবদ্য তরীকা কেবল নেড়ী কুকুরের সহচর্যে গায়ের গন্ধে ভূত পালাবে আর করণে ছেঁড়া ফাটা কাপড়।

    এখন প্রশ্ন হল সে ঠিক কোথায় আছে? বাবর জানতে পারলে বর্তে যেত। এখন সে কেবল লোকজন উঠে চলাচল শুরু করা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারে। লোকের আড়াল তার প্রয়োজন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা একটা কাপড়ের স্তূপ খুঁজে পায়। এতেই কাজ চলবে। সে কাপড়ের নিচে আলতো করে ঢুকে আসে এবং সে মাথার উপরে টেনে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। সে ভাবে, সমরকন্দ। সমরকন্দ! তারপরে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ঘুম জোয়ারের মত দুচোখ ছাপিয়ে এসে তার ক্লান্ত শরীরের দখল বুঝে নেয়।

    “এটা আমার জায়গা! তোমার পঁচা গাজর নিয়ে অন্য কোথাও যাও।”

    বাবর ঘুম ভেঙে চমকে উঠে এবং কাপড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। কয়েক ঘণ্টা আগে যে জায়গাটা জনমাবনহীন ছিল এখন লোকজনে গমগম করছে। ভোরের আবছা আলোতে, তার মনে হয় লোকগুলো একটা বাজার বসাতে চাইছে। যার কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙেছে সে তাকিয়ে কালো, ধূলি ধূসরিত আলখাল্লা পরিহিত এক লম্বা, শীর্ণকায় বৃদ্ধলোকের। নিজের পছন্দসই স্থানের দখল বুঝে নিয়ে, সে আসনপিড়ি হয়ে বসে এবং জোব্বার পকেট থেকে কয়েকটা ছাতা-পড়া পেঁয়াজ বের করে।

    সতর্কতার সাথে, বাবর তার লুকানর স্থান থেকে বের হয়ে আসে। রুক্ষ দর্শন, ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত লোকের দল ততোধিক কুঞ্চিত আনাজপাতির সামান্য পরিমাণ কাপড়ের উপরে সাজিয়ে রাখছে- গাজর রঙ বিগড়ে গিয়েছে এবং অঙ্কুরিত হয়েছে আর কুচকে যাওয়া মুলা। আরেক বৃদ্ধা যার কুঞ্চিত মুখ থেকে নেকাব খসে পড়েছে। বেপড়োয়া অনটনে, সমাধিস্থ করার জন্য যেভাবে মৃতদেহ পবিত্র করা হয় ঠিক একই যত্নে একটা মৃত ইঁদুর সাজিয়ে রাখছে। অন্যেরা, বোঝাই যায় যাদের কাছে বিক্রি করার মত কিছু নেই আর কেনার সামর্থ্যের প্রশ্নই উঠে না, তারা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

    বাবর বিস্মিত হয়ে ভাবে, এই লোকগুলো উপবাস করছে। অবরোধ অনেক মাস হল বজায় আছে এবং সে আশা করেনি যে রসদের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, কিন্তু তাই বলে…এক শিশুর কান্নায় তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। এক তরুণী মাতা যার স্তনের দুগ্ধধারা শুকিয়ে গেছে এবং যার চোখের তারা ভর করেছে অসহায়তা। নেকাবের একটা কোণা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সেটাই নিজের সন্তানের বুভুক্ষ ঠোঁটে গুঁজে দেয়।

    “নিজেদের ঘাঁটিতে ব্যাটারা ভালই আছে,” বৃদ্ধলোকটা বলে, তারপরে এমন ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে থুতু ফেলে যে আরেকটু হলে কফের দলা তার নিজের সাতটা পেঁয়াজের স্তূপে গিয়ে পড়ত। “তারা আমাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারা বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারবে, রেশমের আলখাল্লার নিচের ভূড়ি আমাদের খাবার দিয়ে পূর্ণ করবে। ন্যায়বিচার বলে কি কিছু নেই?”

    “বুড়া মিয়া, চুপ করো, মুখে লাগাম দাও, তোমার কারণে আমরা সবাই বিপদে পড়বো। শীতকাল আসলে গতবারের মত এবারও আক্রমণকারীরা দেশে ফিরে যাবে।”

    “আর তারপরে কি ঘোড়ার ডিম হবে? কৃতজ্ঞতায় উজিরকে আরো বেশি করে তখন খাজনা দিতে হবে! বেশ্যার বেটার বড্ড বাড় বেড়েছে! আর সবাই বলছে আমাদের বিবি, বেটীদের সে নাকি ভীষণ পছন্দ করে। মরহুম সুলতান, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন, তার চেয়েও নাকি দ্বিগুণ বড় আমাদের উজিরের হারেম। আমি শুনেছি একরাতে সে তিনজন নারীর সাথে সহবাস করে।”

    “বুড়া মিয়া, শান্ত হও, তোমার বসন্তের দাগঅলা স্ত্রী আর মেয়ের চেয়ে ঐ ছাগলটা অনেক বেশি যৌনাবেদনময়,” আরেক লোক ফোড়ন কাটে।

    নিজের বিবি-বেটীদের আব্রু রক্ষায়, পেঁয়াজ বিক্রেতা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সাফাই দিতে শুরু করতে বাবর আলগোছে সেই চত্বর থেকে সরে আসে এবং একটা গলি ধরে হাঁটতে শুরু করে। সব জায়গাতেই একই দৃশ্য। চোখে মুখে অনাহারের নির্মম ছাপ পড়া, ক্ষুধার্ত মানুষের দল ছায়ামূর্তির মত ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে, যেন তাদের দেহের শেষ বিন্দু জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়া হয়েছে। সে দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে এক বৃদ্ধাকে হাসতে দেখে, যে শিশুর মত মমতায় একটা মৃত বিড়ালের নির্জীব দেহ কোলে করে রেখেছে। ইঁদারার ধারে গতরাতে ঘুমন্ত কুকুরগুলো যে এতদিন বেঁচে রয়েছে সেটা ভেবে সে বেশ অবাক হয়।

    ম্লান কমলা রঙের উদীয়মান সূর্যের কাক্ষিত দৃশ্যপট- যা তাকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করবে। বাবর জানে যে সূর্যের দিকে পিঠ করে হাঁটলে তৈমূরের সুরক্ষিত আস্তানার দেয়ালের কাছে তার পৌঁছে যাওয়া উচিত। আপাতভাবে মনে হয় তার ধারণাই ঠিক। সে দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করে, খেয়াল করে রাস্তাগুলো ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠেছে আর দুপাশের ভবনগুলো এখন অনেক বেশি অভিজাত দর্শন। সে সুদৃশ্য ফুল লতাপাতা আর জ্যামিতিক নকশার প্রাণবন্ত টাইলসে সজ্জিত হাম্মামখানা, গম্বুজযুক্ত মসজিদ আর অপরূপ সুন্দরভাবে তৈরি করা মাদ্রাসা দেখতে পায়, যেখানে বিদ্যার্থীর দল নামাজ আদায় করে আর অধ্যয়ন করে।

    তার পূর্বপুরুষেরা এত সুন্দর একটা শহর তৈরি করেছে এমন বালকসুলভ একটা গর্ববোধ তার ভিতরে জন্ম নেয়। সে যখন সমরকন্দের সুলতান হবে, শহরের আশেপাশের বাগান আর ক্ষেত থেকে সজি এবং ফল এসে আবার বাজার বোঝাই করে ফেলবে। রুটিঘর আর রন্ধনশালা- যা এখন শূন্য আর পরিত্যক্ত থেকে আবারও বাতাসে সুবাস ছড়াবে। সমৃদ্ধশালী আর সুখী নাগরিকের দল, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। এবং, তৈমূরের সময়ের মত, প্রতিভাবান মানুষের দল- কবি, চিত্রকর, পণ্ডিত- সভ্য দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে এখানে এসে মিলিত হবে। পুরো বিষয়টার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরে, বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। “বাছা, আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও।”

    বাবরের পিঠের নাজুক অংশে শক্ত কিছু একটা আঘাত করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, সে কোমরে অস্ত্রের জন্য হাত দিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, সমরকন্দের রাজকীয় পান্না সবুজ রঙের পরিকর পরিহিত দুজন সৈন্য। তাদের যাবার মত পাশে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে কিন্তু তারপরেও তাদের একজন তার হাতের বল্লমের বাঁট দিয়ে বাবরকে আবার আঘাত করে, এবার পাঁজরে খোঁচাটা লাগে এবং সে ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালে গিয়ে আঘাত করে। সেঁতো হাসি দিয়ে, লোক দুটো সদম্ভে সামনে এগিয়ে যায়।

    বাবর, মার্জারের-মত অপলক দৃষ্টিতে পেছন থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু তারা পেছনে ফিরেও তাকায় না। সৈন্য দু’জন বাঁক ঘুরতে সে তাদের পিছু নেয়। তারা যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে সে নিশ্চিত দু’জন কোক সরাইয়ের দিকেই যাচ্ছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, অনুসরণ শুরু করতে সে আরো বেশি সৈন্যের দেখা পেতে থাকে, তাদের কেউ কেউ শহরের সুনসান, আতঙ্কিত নগরের রাস্তায় টহল দিচ্ছে, কেউবা শহর রক্ষাকারী প্রাচীর থেকে ফিরে আসা প্রতিহারী, সেনা। পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে, কেউ এগিয়ে আসছে বুঝতে পারলে সে। জঞ্জালের আড়ালে কিংবা চৌকাঠের পেছনে লুকিয়ে পড়ে চেষ্টা করে তাদের চোখে আড়ালে থাকতে।

    আর তারপরে, একটা সময়ে সে উপরের দিকে তাকালে তৈমূরের দেয়াল পরিবেষ্টিত আস্তানা দেখতে পায় এবং এর ঠিক কেন্দ্রে তৈমূরের সুউচ্চ দূর্গপ্রাসাদ, অতিকায় কোক সরাই। দূর্গের প্রাকার-বেষ্টিত চিহ্নিত স্থান থেকে সবুজ রেশমের নিশান বাতাসে পতপত করে উড়ছে। বাবর ভাবে, ওটা আমার প্রাসাদ। অবচেতন মনে সে তৈমূরের আংটিটা স্পর্শ করে এবং সেটা মুঠোর ভিতরে আঁকড়ে ধরে।

    পাথর দিয়ে বাঁধান পথে সৈন্যদের কুচকাওয়াজের শব্দে তার দিবা স্বপ্নের চটকা ভাঙে। একটা দল আস্তানায় ফিরে আসছে। তাদের অনেক পেছনে থেকে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সৈন্যদলটা আর তাদের অস্ত্রশস্ত্র খুঁটিয়ে দেখে। দীর্ঘকায়, মজবুত শরীরের মানুষ, তাদের অবয়বে অপুষ্টির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। আর প্রত্যেকের হাবেভাবে যোদ্ধার অভিব্যক্তি: এদের পরণেও সমরকন্দের উজ্জ্বল সবুজ পরিকর। জোর করে জুড়ে বসা উজির তাদের আনুগত্যের জন্য কত মোহর দিয়েছেন?

    সহসা পেছন থেকে কেউ একজন তার কাঁধে হাত দেয় এবং আতঙ্কিত বাবর, সব কিছু অগ্রাহ্য করে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু হাতটা ইস্পাতের মত কঠিন। অসহায় বাবর ঘুরে দাঁড়ায় তার আক্রমণকারীর মুখোমুখি হতে।

    “শুভেচ্ছা নেবেন। আমি আশা করিনি এত শীঘ্রই আপনাকে সমরকন্দে দেখবো। অবরোধ এখনও শেষ হয়নি।”

    বাবর ঢোক গিলে। “বাইসিনগার!” তৈমূরের রক্ত রঞ্জিত আংটি ফারগানায় কাছে পৌঁছে দেবার সময়েই তার সাথে বাবরের শেষ দেখা হয়েছিলো।

    “আপনি অনর্থক ঝুঁকি নিয়েছেন। গত ত্রিশ মিনিট ধরে আমি আপনাকে অনুসরণ করছি।”

    বাবরের মুখ এতটাই শুকিয়ে আছে যে সে কথা বলতে পারে না এবং সে নিচের দিকে তাকায়। সে যা দেখে তা দেখে আবার ঢোক গিলে। বাম হাত দিয়ে বাইসিনগার যদিও তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার ডান হাত শক্ত হয়ে তার পাশে কাঠের দণ্ডের মত ঝুলছে।

    বাইসিনগার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। “আপনার চাচার শেষ নির্দেশ পালন করে তৈমূরের আংটি পৌঁছে দেবার শাস্তি। আমি ভাগ্যবান যে এখনও মাথাটা আস্ত আছে, কারণ সমরকন্দের নিরাপত্তার জন্য গ্রান্ড উজিরের আমাকে দরকার আছে।” সে নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি প্রশমিত করে এবং চারপাশে তাকিয়ে পালাবার সম্ভাবনা বিচার করতে গেলে হতাশায় দমে যায় যখন দেখে একদল সৈন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা নিশ্চয় অবাক হচ্ছে তাদের দলপতিকে একটা ময়লা পোশাক পরিহিত কৃষক বালকের সাথে কথা বলতে দেখে। সে এখন যদি পালাতে চেষ্টা করে তবে তারা তাকে এক নিমেষে ধরে ফেলবে। “এখন কি করবে?” সে অবশেষে কথা বলে।

    “ব্যাপারটা খুব সাধারণ। আমি যদি আপনাকে গ্রান্ড উজিরের কাছে ধরিয়ে দেই তবে আমার কপাল ফিরে যাবে। বিলাসবহুল প্রাসাদে, যেখানে ঝর্ণা থেকে গোলাপজল প্রবাহিত হচ্ছে আর সুন্দরী দাসীরা আমার সব ইচ্ছা পালনের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, আমি অনায়াসে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারব।” বাইসিনগারের চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “জীবন অনেক বেশি জটিল। আপনার মরহুম চাচা একজন ভাল শাসক ছিলেন এবং তার শেষ আদেশ যে কোনো মূল্যে পালনের জন্য আমাকে কতৃত্ব দিয়েছিলেন। উজির আমার সম্মান আর অহংকারে আঘাত করেছে। তাকে আমার হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি যদি আপনি আমাকে দেন, তবে আমি আপনার হাতে সমরকন্দ তুলে দেব।”

    বাবরের চোখ ঝলসে উঠে। “আমি তোমাকে কথা দিলাম। তৈমূরের রক্ত ধমনীতে বইছে এমন একজন সুলতান তোমাকে কথা দিচ্ছে।”

    “আমার সুলতান।” তাদের দিকে যারা তাকিয়ে রয়েছে সবার চোখ এড়িয়ে বোঝা যায় কি যায় না এমন ভঙ্গিতে বাইসিনগার বশ্যতা স্বীকার করে মাথা নত করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article গথ – অৎসুইশি

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }