Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প802 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১.৫ কোক সরাই

    সন্ধ্যা নেমে আসতে, ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর, তার সেনাবাহিনীর তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনায় শিহরিত হতে থাকা একটা দলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে, ভরপেট খেয়ে তরবারিতে শান দিয়ে আর পিঠে চামড়ার তৈরি ঢাল বেঁধে যারা পায়ে হেঁটে প্রধান ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। প্রথমে তারা তিন রাত আগে নহরের কিনারা ধরে বাবরের অনুসৃত পথ অনুসরণ করবে, কিন্তু তারপরে চাহাররাহা তোরণদ্বার দিয়ে সমরকন্দে প্রবেশের জন্য সংকেতের অপেক্ষায় লুকিয়ে অপেক্ষা করবে, শহরে প্রবেশের এই তোরণদ্বারের পাহারায় নিয়োজিত আছে বাইসিনগার, আর সে বাবরকে সেটা খুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

    “আমার সাথী-যোদ্ধারা, আজ রাতে আমরা আমাদের নিয়তির মুখোমুখি হব। এসো আমরা যোদ্ধার আত্মায় বলীয়ান হয়ে হৃদয়ের সবটুকু সাহস জড়ো করি- লড়াই করার শারীরিক সাহস কেবল না, আমি জানি সেটা তোমাদের ভালই আছে, বরং নহর ধরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য আক্রমণের সংকেত না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈৰ্য্য যেন তোমাদের থাকে। আমরা প্রত্যেকেই তার সহযোদ্ধার বাঁচা-মরার দায়িত্ব বহন করছি। নিজের অবস্থান থেকে আমাদের ভিতরে একজনও যদি পিছিয়ে আসে- অনিচ্ছাসত্ত্বেও বা অসহিষ্ণুতার জন্য- জেনে রেখো, সে আমাদের সবার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার বয়স কম হতে পারে, আমি জানি আমি আমার ভূমিকা ঠিকমতই পালন করবো। তোমরা কি আমাকে। প্রতিশ্রুতি দেবে যে তোমাদের দায়িত্বও তোমরা ঠিকমত পালন করবে?”

    সমস্বরে সবাই একসাথে চিৎকার করে বলে উঠে “হাঁ, সুলতান।”

    সময় আর নষ্ট না করে বাবর অগ্রবর্তী দলটাকে যাত্রা করবার আদেশ দেয়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুটো সারি তৈরি করে নহরের পাশ দিয়ে তারা কুয়াশার ভিতরে হারিয়ে যায়। পানির যতটা কাছে সম্ভব থেকে, তীরের উইলো গাছে ডালপালা আর ঝোপঝাড়ের সামান্য আড়ালের পুরোটা সদ্ব্যবহার করে তারা এগিয়ে যায়। নিরবে এভাবে পনের মিনিট এগিয়ে যাবার পরে সহসা, সামনের কাতারের সৈন্যদের ভেতরে কেউ সামান্য কেশে উঠে। বাবরের কানে প্রহরী কুকুরের হুঙ্কারের মত জোরাল শোনায় হচিটা। অবশ্য সমরকন্দের দিক থেকে কোনো ধরণের নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় না। বাবর আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপরেই সৈন্যটা আবার কেশে উঠে, এবার মনে হয় আগের চেয়েও জোরে এবং মনে হয় অনন্তকাল ধরে কাশতে থাকতে যা আদতে এক মিনিটেরও অনেক কম। এখনও মশার ভনভন আওয়াজ ছাড়া আর কিছুর শব্দ পাওয়া যায় না, অন্ধকারে প্রতিটা মানুষের উন্মুক্ত ত্বকে তারা মহানন্দে কামড়াতে শুরু করেছে।

    “সুলতান, আমি তাকে ফেরত পাঠাব,” ওয়াজির খান ফিসফিস করে তাকে বলে। “বাঁচলাম।”

    মূল ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার দুই ঘণ্টা পরে, বাবর সঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের কাছের সেই স্থানটা চিনতে পারে, যেখান থেকে সমরকন্দে রেকী করার অভিপ্রায়ে গোপন সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে সে উঠে গিয়েছিল। আজ রাতে অবশ্য সে তার লোকদের নিয়ে নহরের কিনারা ধরে সামনে এগিয়ে যায়। জ্যোৎস্নার আলোয় প্রসন্ন চিত্তে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী আরও একবার তার বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যখন উত্তরদিকে বাঁক নিয়ে সেটা চারহাররাহা তোরণদ্বারের মাত্র দুইশ গজ দূর দিয়ে বয়ে গিয়েছে দেখা যায়।

    বাবর আর তার লোকেরা, নহরের কিনারের আগাছা আর উইলোর আড়ালের পুরো সদ্ব্যবহার করে কোনো ধরণের অবাঞ্ছিত শব্দের জন্ম না দিয়ে তোরণদ্বারের খুব কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে যায়। ওয়াজির খানের সাথে সংক্ষিপ্ত পরামর্শ করে নিয়ে, বাবর চাঁদ মাথার উপরে উঠে না আসা পর্যন্ত তার লোকদের ঝোপঝাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকার আদেশ দেয়- তোরণদ্বার খুলে দেবার ব্যাপারে বাইসানগারের সাথে তার সেরকমই কথা হয়েছে।

    ***

    অস্বস্তি দূর করতে বাবর একটু নড়ে উঠে। কিন্তু ব্যাপারটা কঠিন। মশার ঝাঁক তাকে এখনও ছেকে ধরে আছে। আর না চুলকে কামড়ের জায়গা থাকতে পারছে না। আসনপিড়ি হয়ে বসে থাকায় তার কাপড়ে কাদা লেগেছে এবং নড়লেই নিচে থেকে প্যাঁচপেচে শব্দ ভেসে আসে, কিন্তু ঘন আগাছার কারণে জায়গাটা বেশ ভাল আড়াল তৈরি করেছে। সে যদি, ঠিক তার মাথার উপরের চারকোণা আকাশের তারা আর চাঁদের আবর্তন দেখে, ঠিকমত সময় আন্দাজ করে থাকে, তাহলে এখানে থানা নেয়ার পরে নব্বই মিনিট অতিবাহিত হয়েছে।

    সে যেখানে গুঁড়ি দিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে, সেখান থেকে অবশ্য আশেপাশের এলাকা আর আকাশের এমন বেশি কিছু অংশ দেখা যায় না, যার ফলে সে চাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। তাকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে আরও কতক্ষণ তাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে। ওয়াজির খানের পিতৃব্যসুলভ উপদেশ অমান্য করে, যে অন্য আর সবার মত তারও মাথা নিচু করে রেখে, সময়ের হিসাবের ভার তার নিজস্ব আরও অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপরে ছেড়ে দেয়া উচিত, বাবর মাথা উঁচু করে। আগাছার আড়াল থেকে ভাল করে দেখার জন্য উঁকি দিতে, ওয়াজির খানের পরামর্শে পরিধান করা ইস্পাতের জালিকা দেয়া জ্যাকেট, যেটা তার দেহের মাপের চেয়ে অনেক বড়, কুঁচকে গিয়ে তার বাহুর নিচে বোগলের কাছে খোঁচা দেয়। অসহিষ্ণুভাবে বাবর টানাহেঁচড়া শুরু করে, আলখাল্লার নিচে হাত দেয় এবং চেষ্টা করে কুঁচকে যাওয়া ইস্পাতের জ্যাকেট সোজা করতে। কিন্তু সে বিষয়টা আরও জটিল করে তোলে।

    তার ঠিক মুখের সামনে, আগাছার আড়াল থেকে একজোড়া বুনো হাঁস আর্তস্বরে ডানা ঝাঁপটে উঠে। বর্ম ঠিক করতে গিয়ে তার মাত্রাতিরিক্ত নড়াচড়ায় বোধহয় বেচারারা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বিব্রতভঙ্গিতে সে আবার মাথা নিচু করে, কিন্তু আগাছার আড়ালে মাথা নিচু করতে সে তার কয়েক ফিট দূরে পায়ের আওয়াজ শোনে যা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। যদিও যুক্তি তাকে বলে যে সেটা তারই কোনো লোকের পায়ের আওয়াজ, কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাঁটযুক্ত আলমগীর আঁকড়ে ধরে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে লড়তে প্রস্তুত। শব্দটা আরও বাড়তে এবার ওয়াজির খানের কাদামাখা মুখ আগাছার আড়াল থেকে উঁকি দেয়, পেটের উপরে ভর দিয়ে কনুইয়ের সাহায্যে অনেকটা বাইম মাছের মত এঁকেবেঁকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং সেই সাথে কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার মনে হয় যে পিঠে ঢাল আটকানো এবং প্রায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার কারণে ওয়াজির খানকে বেঢপ আকৃতির কচ্ছপের মত দেখাচ্ছে।

    “সুলতান, সময় হয়েছে। আমি কি সংকেত দিতে আদেশ দেব।”

    কোনমতে হাসি চেপে বাবর মাথা নাড়ে।

    ওয়াজির খান যেভাবে এসেছিল সেভাবেই মাথা নিচু করে পিছলে পেছনে সরে যায়। মুহূর্ত পরে, তার আদেশে, রাতের নির্মেঘ আকাশে একটা জ্বলন্ত তীর বিশাল বৃত্তচাপ তৈরি করে আকাশে উঠে আসে, ধূমকেতুর মত জ্বলছে তার জ্বলন্ত পুচ্ছ। আগাছার ভিতরে এবার বাবর উঠে দাঁড়ালে তার পেট গুলিয়ে উঠে এবং উত্তেজনা আর আশঙ্কায় তার পা কাঁপছে টের পায়। তার লোকেরা তার চারপাশে, আড়াল ছেড়ে একে একে উঠে দাঁড়াতে থাকে।

    ওয়াজির খানও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। “আমরা শীঘ্রই জানতে পারব বাইসিনগার এক কথার মানুষ কিনা।”

    “সে তার কথা রাখবে।” বাবর সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিন্তু পোড় খাওয়া ওয়াজির খানের মনের সংশয় দূর হয় না, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন যে তরুণ অনভিজ্ঞ বাবর হয়ত প্রতারিত হয়েছেন।

    বাবর আর ওয়াজির খানকে সামনে রেখে, তাদের যোদ্ধারা আগাছার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং আক্রমণাত্মক বিন্যাসে সজ্জিত হয় আর জলাভূমির উপর দিয়ে দ্রুত চারহাররাহা তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়, তাদের পায়ের চামড়ার নাগরা মাঝেমধ্যেই কাদায় আটকে যায় এবং সবাই শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস নেয়। তারা আরও এগিয়ে যেতে বাবর দেখে সুউচ্চ সবুজাভ-নীল তোরণ বা পুঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণের তুলনায় সেটা অনেক ছোট। তোরণদ্বারের দু’পাশে শক্তপোক্ত পাথরের যেনতেনভাবে তৈরি করা বুরুজ নির্মানের সময় দর্শনীয়তার চেয়ে উদ্দেশ্যের বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এবং বাবর এখান থেকেই তোরণদ্বারের ভারী লোহার গ্রিল দেখতে পায়, যা শহরে প্রবেশের সংকীর্ণ গলিপথটা সুরক্ষিত করে রেখেছে। তার মনে হয় ফোকলা দাঁতের কেউ তার দিকে মুখব্যাদান করে হাসছে।

    সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখতে বাবর চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকালে বুঝতে পারে কোথাও কিছু নড়ছে না- এমন কি তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ যেখান থেকে বাইসানগার কপিকল দিয়ে গ্রিল তোলার আদেশ দেবে সেখানেও কোনো আলো জ্বলছে না। কোনো কিছু না ঘটলে সে কি করবে? হয়ত পুরোটাই একটা নির্মম ছলনা। বা এটাও হতে পারে পুরো পরিকল্পনাই ফাঁস হয়ে গিয়েছে আর বাইসানগার এখন কোনো অন্ধকার কুঠরিতে নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তাদের পায়তারা যন্ত্রণাক্লিষ্ট কণ্ঠে বয়ান করছে।

    বাবর নিজেকে শান্ত করে চিন্তা করতে থাকে। তার সামনে এখন কি পথ খোলা রয়েছে? কিন্তু মনে মনে সে জানে তার সামনে এই একটাই পথ রয়েছে। তাদের এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন কি এখন, জ্বলন্ত তীরের বাঁকান গতিপথের মাধ্যমে যা সূচীত হয়েছে, বাছাই করা চার’শ যোদ্ধার দল ইতিমধ্যে তার তিন রাত আগের যাত্রাপথ পুনরায় অনুসরণ করে স্যাঁতস্যাঁতে সংকীর্ণ সুড়ঙ্গে নেমেছে, যা তাদের শহরের ভেতরে নিয়ে যাবে। সে তাদের পরিত্যাগ করবে না। যাই ঘটুক না কেন, সে তার লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে তোরণ আক্রমণ করবেই।

    তার মন যখন এসব বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোলাচালে আচ্ছন্ন, বাবর তোরণদ্বারের ডান পাশের দেয়ালের উপরে হাতে মশাল ধরা একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে সে এপাশওপাশ দোলাতে থাকে। একই সাথে বাবর আশেপাশে কোথাও বিশাল একটা পুলির ঘুরতে শুরু করার কর্কশ খরখর আওয়াজ শুনতে পায়। লোহার গ্রীলটা প্রথমে কেঁপে উঠে, তারপরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন উপরে উঠতে শুরু করে। ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে সে বিজয়ীর একটা হাসি দেয়, তারপরে আক্রমণের জন্য পূর্ব নির্ধারিত সংকেত চাপা স্বরে বলে উঠে। তার লোকেরা সংকেতটা পুনরাবৃত্তি করতে সে একটা চাপা গমগমে আওয়াজ শুনতে পায়। সংকেতটার কোমল আবেদন, থিতিয়ে আসতে নিজের ভেতরে সে একটা উদ্দীপনা টের পায় যা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে।

    ডান হাতে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি, বাম হাতে খঞ্জর নিয়ে বাবর তোরণদ্বারের বাকি পথটুকু দৌড়ে অতিক্রম করে। লোহার গ্রীল ইতিমধ্যে এক তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে। তার লোকেরা তাকে ঘিরে ধরতে গ্রীলের নিচের তীক্ষ্ণ শলাকার খোঁচা থেকে বাঁচতে সে নিজেকে গুটিয়ে একটা বলের মত করে এবং নীচ দিয়ে গড়িয়ে আসে। কুণ্ডলাকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সে লাফিয়ে পায়ের উপরে উঠে দাঁড়ায় এবং অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাতাস কেটে মৃত্যু মুখে নিয়ে ছুটে আসা তীরের অমোঘ শব্দ বা অন্ধাকারে হুল্লোড় তুলে ডিগবাজি দিয়ে ধেয়ে আসা কুঠারের সামান্যতম আভাসের জন্য তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় টানটান হয়ে রয়েছে। কিন্তু তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ থেকে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে আসা পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। বাইসানগার এগিয়ে আসে, মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। “স্বাগতম। আমি আমার কথা রেখেছি।” সে বাবরের সামনে এসে নতজানু হয়। “আমাদের দ্রুত যা করার করতে হবে। গুপ্তচরের দল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে- এমন কি এখনও হয়ত কেউ আমাদের দেখছে এবং যেকোন মুহূর্তে পাগলাঘন্টি বেজে উঠতে পারে। আমার বিশজন লোক এই তোরণের পাহারায় রয়েছে আর বাকিরা কোক সরাইয়ের নিকটে অপেক্ষা করছে।” শহরের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা অন্ধকার গলির দিকে ইশারা করে সে দেখায়। “আমার সঙ্গে আসুন।”

    বাইসানগারের কথা শেষ হতে, সামনে, নগর প্রাকারের অভ্যন্তরে কোক সরাইয়ের ছাদে অন্ধকার বিদীর্ণ করে সহসা কমলা রঙের আলোর আভা দেখা যায়- মশাল। তাদের উপস্থিতির খবর সেনাছাউনিতে পৌঁছে গেছে। শিঙার গগনবিদারী আর্তনাদ এবং কর্কশ স্বরে সেনাপতিদের নিজ নিজ লোককে ডাকার শব্দ ভেসে আসতে বোঝা যায় যে বিপক্ষকে চমকে দেবার সুযোগ তারা হারিয়েছে। বাবর ইতস্তত করে না। তরবারি উপরে তুলে গায়ের পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সে তার লোকদের রণহুঙ্কার দেয়- “ফারগানা।” তার কানের পর্দা দপদপ করে, সে সামনের দিকে। ধেয়ে যায়।

    গলিটার দুপাশে লম্বা, উঁচু, মাটির ইটের সারিবদ্ধ বাসা যার দরজা নিশ্চিতভাবেই ভেতর থেকে বন্ধ। বাবর এক মুহূর্তের জন্য দরজাগুলোর পেছনে জড়সড় হয়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোর কথা ভাবে, যারা দোয়া করছে যেন এই ঝড় শীঘ্রই শেষ হয়। তাদের জানবার কথা না যে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা বা লুট করার উপরে সে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তার শত্রুদের অবশ্যই উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে, নিরীহ লোকদের রক্তে স্নান করে সে সমরকন্দে তার শাসনকাল শুরু করতে চায় না।

    “সুলতান, এই পথে।” বাইসানগার বাবরের বাহু আঁকড়ে ধরে এবং হেঁচকা টানে বামদিকে বাঁক নেয়া একটা সরু গলিতে তাকে নিয়ে আসে। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বাবর টলে উঠে এবং আরেকটু হলেই সে আছাড় খেতো। মুহূর্তের জন্য সে তার পেছনে ওয়াজির খানের দিকে তাকায়। গলিটার দুপাশে উঁচু দেয়াল আর ভীষণ সংকীর্ণ। পাশাপাশি একজন বড়জোর দুজন লোক এগিয়ে যেতে পারবে- অতর্কিত আক্রমণের জন্য আদর্শ স্থান। গাঢ় অন্ধকারের ওপাশে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?

    “দূর্গে পৌঁছাবার এটা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ।” বাইসানগারের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ আর তাতে আর্তি ঝরে পড়ে।

    বাবর চোখ সরু করে তার দিকে তাকায়। সে জানে যে তার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তার লোকেরা এখন তার মাঝে একজন নেতাকে দেখতে চাইছে। এখন ইতস্তত করার কোনো অবকাশ নেই, যখন শত্রুর কণ্ঠস্বর প্রতি মুহূর্তে তাদের দিকে। এগিয়ে আসছে। সে বাইসানগারকে বিশ্বাস করে, যা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে সে তার লোকদের বলে অনুসরণ করতে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইসানগারের পেছন পেছন গলিতে প্রবেশ করে। বাবর বিস্মিত হয় যে শহর দখলের লড়াই শুরু হতে তার ভিতরের ভয় কোথায় যেন উবে গেছে এখন সেখানে কেবল উত্তেজিত উল্লাস বিরাজ করছে। সব যুদ্ধেই কি একই অনুভূতি হয়? সহসা, পূর্বদিকে খানিকটা দূর থেকে, সে একটা জোরাল হুঙ্কার ভেসে আসতে। তার লোকেরা নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে এসেছে এবং এখন শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তারা গ্রান্ড উজিরের অনুগত সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখবে।

    গলিটা এবার ডান দিকে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে, এবং তারপরে সহসাই শেষ হয়েছে। চারপাশে আধো-অন্ধকারে তাকিয়ে বাবর দেখে সে একটা প্রাঙ্গনের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার একদিকে, ঠিক তার উল্টোপাশে, তৈমূরের দূর্গপ্রাসাদের উঁচু দেয়াল। গতবারের অভিযানের স্মৃতি আর তার পর্যবেক্ষণ করা পরিকল্পনার কথা স্মরণ করে, সে বুঝতে পারে তারা নিশ্চয়ই দক্ষিণ দিকে এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ, কয়েক’শ গজ সামনে দেয়ালের ভিতরে, পূর্বদিকে বিস্তৃত কোক সরাইয়ের তীক্ষ্ণ দাঁতের মত প্রাচীরের বেষ্টনী দেয়া দূর্গপ্রাসাদ সে দেখতে পায়। বাইসানগার তাদের ভালই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। আরও খুশির কথা বাবর ঠিক তার মাথার উপরের দেয়ালে কোনো প্রহরী দেখতে পায় না। সম্ভবত তারা কল্পনাও করেনি শত্রু এখান দিয়ে বেয়ে উপরে উঠতে পারে।

    যাই হোক, বাইসানগার আর ওয়াজির খানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাবর দ্রুত আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে এবং দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালে গায়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। গলিপথে তার লোকেরা এসে উপস্থিত হলে সে ইশারায় তাদেরও একইভাবে দাঁড়াতে বলে। কোনো ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে তারা তার আদেশ পালন করে। বাইসানগার নিচু স্বরে কিছু একটা বলতে, কালো আলখাল্লা পরিহিত, গম্বুজাকৃতি শিরোস্ত্রাণ মাথায় দেয়া ছায়ামূর্তির দল আঙ্গিনার পশ্চিমদিকের কোণায় অবস্থিত ভাপ উঠতে থাকা আবর্জনার স্তূপের আড়াল ছেড়ে বের হয়ে আসে। বাইসানগারের সৈন্যদল। তারা এসে নিরবে তাদের সেনাপতিকে ঘিরে দাঁড়ায়।

    “সুলতান, সামনের বাঁকের মুখে একটা বন্ধ করে দেয়া তোরণদ্বারের কাছে দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের উচ্চতা সবচেয়ে কম,” বাইসানগার ফিসফিস করে বলে। “আর আমরা সেখান দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করবো। আমার লোকেরা মই নিয়ে এসেছে এবং আমি আমার তীরন্দাজদের বলবো নিরাপত্তার আড়াল দিতে।” বাবর আর ওয়াজির খান সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে। দেয়ালের গায়ের সাথে প্রায় মিশে গিয়ে এবং বাইসানগারের নেতৃত্বে আক্রমণকারী দলটা দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের কোণার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। সতর্কতার সাথে বাইসানগার একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখে এবং তারপরে পেছনে সরে এসে বাবর আর ওয়াজির খানকে ইঙ্গিত করে দেখতে।

    দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারা সবাই নিশ্চিত হয় যে সবকিছু ঠিক আছে। তোরণদ্বারটা এখান থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। সহসা এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা বাবরের কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে। ওয়াজির খানের আগলে রাখা বাহুর বেষ্টনী থেকে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সে চিৎকার করে তার লোকদের অনুসরণ করতে বলে, তোরণদ্বার লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করে। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকার কথা সে বেমালুম ভুলে যায় এবং সাথে সাথে সে তীরের বাতাস কেটে এগিয়ে যাবার হুশ শব্দ শুনতে পায় তারপরেই আরেকটা, কোনো। সন্দেহ নেই তার মাতালের মত চিৎকার শুনে তীরন্দাজের দল দূর্গের ছাদের। বেষ্টনীর পিছনে এসে হাজির হয়েছে। একটা লম্বা শরযষ্টি বিশিষ্ট তীর তার গালে আঁচড় কেটে যায় পেছনের ভূমিতে গেঁথে যাবার পূর্বে। তীব্র জ্বালার প্রতি সে ভ্রূক্ষেপ করে না। মুহূর্তের উল্লাস ছাড়া আর কিছুই সে অনুভব করে না। সে তোরণদ্বারের দিকে দৌড়ে যায়। কোনমতে অক্ষত দেহে সে সেখানে পৌঁছে, যে পাথর দিয়ে তোরণদ্বার আটকানো সেটার সাথে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয়, আশা করে মাথার উপরে ঝুলন্ত সরদল তাকে কিছুটা হলেও আড়াল দেবে। চারপাশে তাকিয়ে সে তার পাশের পাথরের চৌকাঠে একটা গুটিসুটি মেরে থাকা বাঘ খোদাই করা দেখতে পায়, সমরকন্দের শাহী প্রতীক, কান দুটো মাথার সাথে লাগানো আর মুখটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বাঁকানো রয়েছে।

    বাইসানগারের তীরন্দাজের দল এখন অবস্থান নিয়ে, দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীদের সমুচিত জবাব দিয়ে চলেছে। বাবর টের পায় কপালের উপর থেকে উষ্ণ তরলের একটা ধারা গড়িয়ে চোখে এসে পড়ছে। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে সে টের পায় জিনিসটা রক্ত কিন্তু তার নিজের না। উপরের দিকে তাকিয়ে সে দেখে গলায় শরবিদ্ধ এক সৈন্য দেয়ালের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হাত উঁচু করে সে লোকটার শরবিদ্ধ জায়গাটা স্পর্শ করতে, সে তাল হারিয়ে ফেলে। মুহূর্ত পরে, বাবরের পায়ের কাছে একটা ভোতা শব্দ করে লোকটার দেহ আছড়ে পড়ে। রক্ত আর শ্লেষ্ম ছিটকে, হতভাগ্য লোকটা কুঁকড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে এবং তারপরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া কালো রক্তের মাঝে তার দেহটা নিথর হয়ে যায়।

    বাইসানগারের লোকের এখন দেয়ালের গায়ে লম্বা লম্বা কাঠের মই স্থাপন করছে। কাঠের ধাপের দু’পাশে চামড়ার ফালি আটকে মইগুলো তৈরি করা হয়েছে বটে কিন্তু দারুণ কার্যকর মইগুলো। তাদের লোকেরা ইতিমধ্যে মই বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, তারা একহাতে কাঠের ডাসা ধরে অন্য হাতে মাথার উপরে ঢাল ধরে রেখেছে উপর থেকে ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে।

    বাবরের হৃৎপিণ্ড এখনও দুরন্ত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে এবং সে দ্রুত কিছু একটা করতে মরিয়া হয়ে উঠে। সে চারপাশে তাকায় উপরে উঠার অন্য কোনো পথ খোঁজে। তোরণদ্বার ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম দৃষ্টিতে, পাথরের দেয়াল। মসৃণ দেখায়, প্রতিটা পাথর নিখুঁতভাবে জোড়া দেয়া। ফারগানার বুনো পাহাড় আর দরীতে সে খামোখাই বেড়ে উঠেনি, বাবর নিজেই নিজেকে বলে। ভাল করে তাকাতে সে পাথরের দেয়ালে অনেক ফাটল আর চিড় দেখতে পায় যেখানে হাত। আর পা দিয়ে তার মত হাল্কা পাতলা একজন বেয়ে উঠতে পারবে। তার মরহুম। আব্বাজানের মূল্যবান তরবারি পিঠে ঝুলিয়ে, বাবর গভীর একটা শ্বাস নেয়। শেষবারের মত চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে রীতিমত উদ্বিগ্ন দেখায়। বাবর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং দেয়ালের পাদদেশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময়ে তাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীর ফাঁকি দিয়ে মইয়ের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।

    সে দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করে, তার হাত দেয়ালের উপরে হাতড়াতে থাকে, সামান্য বের হয়ে থাকা পাথরের কোণা, এবং চুনের আস্তর খসে পড়ার কারণে দুই পাথরের মাঝে উন্মুক্ত হয়ে উঠা ফাঁক কিংবা রাজমিস্ত্রীদের বাটালির ঘাইয়ের ফলে সৃষ্ট দাগ খুঁজে- যেখানে সে বুড়ো আঙ্গুল কিংবা হাত বা পায়ের কিনারা রাখতে পারে। সে তার ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত রাখে নতুবা সে পড়ে যাবে, এবং প্রতিমুহূর্তে তার হাত নতুন অবলম্বন খুঁজতে থাকে। তৈমূরের রাজমিস্ত্রীরা অসাধারণ কাজ করেছে- হাতের কাজের দক্ষতার কারণেই কি তিনি তাদের সমরকন্দে নিয়ে আসেননি? বড্ড বেশি দক্ষ সম্ভবত, বাবরের ভাবনা সহসা মাটি থেকে বিশ ফিট উপরে একটা ঝকি খায়, যখন তার পা কোনো অবলম্বন ছাড়া শূন্যে ঝুলতে থাকে এবং সে টের পায় কেবল হাতের উপরে ঝুলে থাকার কারণে তার নখ উপরে আসতে চাইছে।

    পাথরের মত শুষ্ক আর ধূলোময় মুখে, বাবর কোনো মতে ঝুলে থাকতে চেষ্টা করে, পাগলের মত পা দিয়ে ডানে বামে খুঁজতে থাকে কোনো অবলম্বন পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু কেবল মসৃণ পাথরের দেয়ালে তার পা ঘষা খায়। দেহের পুরো ওজন নেবার কারণে তার বাহুদ্বয় প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তারপরে, যখন তার মনে হতে শুরু করে যে হাত ছেড়ে দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়াই শ্রেয়, ঠিক তখনই তার ডান পা নরম কিছু একটায় গিয়ে পড়ে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঘাসের একটা গোছা, পাথরের ফাটলের গভীরে যার বীজ প্রোথিত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বাবর এবার তার ডান পা গোছাটার উপরে রেখে দেখে সেটা ভার নিতে পারে কিনা এবং সেটা তার দেহের ভর কিছুটা সামাল দিলে তার হাতের অসহ্য ব্যাথা কমে আসে।

    এক নিমেষের জন্য সে তার চোখ বন্ধ করে। নিজেকে তার ক্ষুদ্র, অরক্ষিত, অসহায়, একটা কীটের মত মনে হয়। কিন্তু সে অন্তত এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। পুনরায় চোখ খুলে, মাথার অবিন্যস্ত চুলের মাঝ দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে দেয়ালের শীর্ষদেশ বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে সম্ভবত মাথার সাত কি আট ফিট উপরে। সতর্কতার সাথে, অনুসন্ধানী ভঙ্গিতে সে ডান হাত উপরে বাড়িয়ে দেয় এবং মাথার দুই ফিট উপরে বের হয়ে থাকা একটা পাথরের খাঁজ খুঁজে পেতে সে স্বস্তিতে আরেকটু হলে জোরে হেসে উঠত। তারপরে, ডান পা ঘাসের গোছর উপরে রেখে যা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, সে বাম পা ভাঁজ করে এবং উপরের দিকে সেটা রাখার জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখে। পুনরায় সে আরেকটা খাজ খুঁজে পায়- খুব বড় কোনো ফাটল না- সংকীর্ণ একটা খাঁজ, পাথরের গায়ে একটা আড়াআড়ি ফাটল, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। শেষ একটা হেঁচকা টানে, দেয়ালের শীর্ষভাগে সে নিজেকে উপরে টেনে তোলে এবং কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে থাকে যেন তরবারির ফলা তার আঙ্গুলের উপরে নেমে না আসে।

    ছাদের কিনারের প্যারাপেটের উপর দিয়ে টপকে সে নিজেকে দেয়ালের উপরের চওড়া অংশে নিয়ে আসে যেখানের পাথর প্রহরীদের পায়ের ঘষায় মসৃণ হয়ে গিয়েছে। বাবর চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে প্রথম যারা উপরে উঠে এসেছে সে তাদের অন্যতম। সে ভেবেছিল তার অনেক সময় লেগেছে কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে ওয়াজির খানের নেতৃত্বে তার আরও লোক এসে হাজির হয় এবং দড়ির মই বেয়ে উঠে আসবার কারণে সবাই হাঁসফাঁস করছে।

    দেয়ালের নিরাপত্তা রক্ষায় যারা নিয়োজিত ছিল, বোধহয় পালিয়েছে। একপা পিছিয়ে এসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাবর পালিয়ে যাওয়া কোনো সৈন্যের একপাশে ফেলে যাওয়া একটা রূপা দিয়ে বাধান ঢালের সাথে হোঁচট খায়। সে ঝুঁকে ঢালটা তুলতে যাবে। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা একটা শব্দ শুনে সে ঘুরে তাকায়। দেয়ালের ভিতরের দিকে অবস্থিত একটা আঙ্গিনা থেকে উপরে উঠে আসা একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে সমরকন্দের অপেক্ষাকৃত সাহসী সৈনিকের একটা দল হুড়মুড় করে উপরে উঠে আসছে। বাবর, তাদের উজ্জ্বল সবুজ রঙের পরিকর আর বর্শার মাথায় উড়তে থাকা সবুজ নিশান দেখে ধারণা করে, গ্রান্ড উজিরের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল। একটা হুঙ্কার দিয়ে, বাবর তাদের দিকে ধেয়ে যায়, জানে যে ওয়াজির খান আর তার লোকেরা তাকে অনুসরণ করবে এবং শপথ, হুঙ্কার, আর এলোপাথাড়ি তরবারি ধারালো যোতের ভিতরে নিজেকে আবিষ্কার করে। দেয়ালের উপরের অংশটা যদিও বেশ চওড়া- সম্ভবত দশ ফিট প্রশস্ত- দু’পাশ থেকে শীঘ্রই টপাটপ মানুষ নিচে আছড়ে পড়তে থাকে। কেউ আহত হয়ে নিচে পড়ে, কাউকে আবার অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ঠেলেই ফেলে দেয়। ঘামের উষ্ণ, নোতা গন্ধ তার নাক প্রায় বন্ধ করে দেয়। সে এরপরে যতদিন বেঁচে থাকবে তার স্মৃতিতে এটা যুদ্ধের ঘ্রাণ হিসাবে বিরাজ করবে।

    কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ির এক দীর্ঘকায় যোদ্ধা ভীড়ের ভিতরে বাবরকে আলাদা করে, তার হাল্কা দেহকাঠামো আর অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়স লক্ষ্য করে লোকটার মাংসল চোখেমুখে ক্রুদ্ধ বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়। ইঁদুর শিকারের আগে বাবর বিড়ালের চোখে মুখে এমন ভাব দেখেছে এবং লোকটার অবজ্ঞা বাবরকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ওয়াজির খান অনুরোধ করেছিলে যে বাবর যেন এমন কিছু পরিধান না করে যাতে তাকে ফারগানার সুলতান হিসাবে সনাক্ত করা না যায় কিন্তু এই হোঁকা উদ্ধত শুয়োরটাকে সে আজ তার জাত চিনিয়ে দেবে।

    “বুড়ো খোকা তোমার বাসায় থাকা উচিত ছিল, আগুনের পাশে বসে থেকে তোমার ভেজা পাজামা বদলে দেয়ার জন্য পরিচারককে ডাকতে।”

    এক মুহূর্তের জন্য উদ্ধত যোদ্ধাটা হতবাক হয়ে যায় কিন্তু তারপরে বাবর কি বলছে সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে তার অভিব্যক্তি ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে তার চর্মসদৃশ শক্ত হাতে বর্শাটা ধরে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে। “পুঁচকে ইঁদুরের ছানা, আমি যদি তোমাকে পিষে না দিয়েছি।”এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যে বাবর কোনো প্রতিরোধই করতে পারে না, সে বর্শার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ভোঁতা দিকটা বাবরের পেটে বেমক্কা একটা গুতো দেয়।

    বাবর টের পায় ধাক্কার চোটে তার পা ভারসাম্য হারিয়েছে আর সে পিছনে ছিটকে পড়েছে। ডুবন্ত মানুষের মত সে হাত নাড়ে, ভয় পায় যে আঘাতের প্রাবল্য তাকে দেয়ালের নিচে ছিটকে ফেলবে। কিন্তু সে টের পায় তার মাথা পেছন দিকে হেচকা টানে নিচু প্যারাপেটের গায়ে বুকে যায়। ক্ষণিকের জন্য তার চারপাশের জগত আলোর ফুলঝুরিতে ভরে উঠে, খানিক আগে নহরের ধারে আগাছার আড়াল থেকে যে বিশুদ্ধ রূপালি নক্ষত্রের দীপ্তির দিকে তাকিয়ে ছিল, সে রকম না অনেকটা উজ্জ্বল এবড়োথেবড়ো আকৃতির একটা জটলা মত যা পিচ্ছিল রক্তের মত লালে জারিত। তার মুখ লবণাক্ত পানিতে ভরে উঠতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে সেটা উগরে দেয়। তারপরেও সে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারে না- আঘাতটা তার বুকের সব বাতাস বের করে দিয়েছে।

    দাড়িঅলা লোকটা তার দিকে আবার ধেয়ে আসে। “খোকা ওটা কেবল শুরু ছিল। ঐ বিদ্রুপের কারণে মারা যাবার আগে তোমার কপালে আরো ভোগান্তি আছে, সে থুতু ফেলে এবং একই সাথে বর্শাটা দিয়ে বাবরের নিতম্বে খোঁচা দিতে চায়। একেবারে সময়মত বাবর গড়িয়ে পাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় এবং বর্শার ফলা পাথরের মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আগুনের ফুলকি ছোটায়। তার প্রতিপক্ষ গালবকে। দশাসই ওজন হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে লোকটার চলাফেরা অনেক দ্রুত। বিশাল ভালুকের মত সে বাবরের দিকে স্থির প্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে ধেয়ে আসে, সে অর্ধেক ঝুঁকে এক হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা করতে থাকা পেট আঁকড়ে ধরে দম ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য হাতে ঠিকই তরবারিটা ধরা রয়েছে। তার নিঃশ্বাস সবে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং সে মাত্র সুস্থির বোধ করতে শুরু করেছে।

    “তা ইঁদুরের ছানা- শীঘ্রই তুমি তোমার দলের বাকি ধাড়ি ইঁদুরগুলোর সাথে নিচের গোবরের গাদায় গড়াগড়ি খাবে,” লোকটা কথা বলার ফাঁকে বর্শার ফলার তীক্ষ্ণ দিকটা সরাসরি বাবরের মুখের দিকে নিশানা করে। বাবর হীরক দ্যুতিময় শীতল আভাযুক্ত ফলার দিকে সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্তের জন্য তার নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মনে হয় কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাতে অক্ষম, কিন্তু দানবটা তার দিকে বর্শার ফলা দিয়ে আঘাত করেছে, সহজাত প্রবৃত্তির বলে সে ঠিকই বুঝতে পারে তার কি করতে হবে। নিজের সবটুকু ক্ষিপ্রতা আর গতি জড়ো করে সে মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং তার আততায়ীর নাগালের কাছ থেকে সরে গিয়ে আগুয়ান বর্শার নিচে দিয়ে তার দিকে গড়িয়ে আসে। তার দেহ দানবটার পায়ে এসে ধাক্কা খেতে সে তার লম্বা ফলাযুক্ত খঞ্জর দিয়ে বদমায়েশটার একটা পায়ের হাঁটুর পেছনের মাংসপেশী দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। একটা বিকট আর্তনাদ করে, তার প্রতিপক্ষ একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং পায়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়। বাবর টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার আঘাত করে। এবার সে লোকটার বাম বোগলের নিচে পাজর লক্ষ্য করে আঘাত করে যা তার বর্ম আবৃত করে রাখেনি। সে অনুভব করে তার খঞ্জরের ফলা মাংসপেশী আর মোটা কার্টিলেজ ভেদ ভেতরে প্রবেশ করে, লোকটার পাঁজরের ভিতরে পিছলে যায়। দানবটা নিচু কণ্ঠে একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ করে এবং সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। বাবর তার খঞ্জরের ফলা বের করে আনলে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে হাতাহাতি লড়াইয়ে প্রথম হত্যা করা লোকটার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    “সুলতান! সাবধান!” ওয়াজির খান একেবারে ঠিক সময়ে হুঁশিয়ার করে দেয়। এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে, বাবর তার ঘাড় লক্ষ্য করে রণকুঠার নামিয়ে আনা অন্য আরেক আক্রমণকারীকে ভীষণভাবে আঘাত করে। সহসা বাবর আবার জানতে পারে ভয় কাকে বলে। কি আহাম্মক সে এভাবে পেছন থেকে তাকে আক্রমণের সুযোগ দিয়েছিলো। মওকা পেয়ে ওয়াজির খান তার নতুন আক্রমণকারীকে লাথি মেরে ভূপাতিত করে এবং বাঁকা তরবারির মোক্ষম কোপ বসিয়ে দিতে, ছাদের উপরে তার ছিন্ন মাথা গড়াতে থাকে।

    দ্বিতীয় সুযোগ লাভ করে কৃতজ্ঞ, বাবর, জানে অনেক অনভিজ্ঞ যোদ্ধাই এই সুযোগ লাভে বঞ্চিত হয়, ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, দু হাতে খঞ্জর আর তরবারি প্রস্তুত, কিন্তু চারপাশে তাকাতে দেখে গ্রান্ড উজিরের রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যে হয় খুন হয়েছে নয়তো প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সবাই তারা একজন দু’জনের দল করে একে অন্যের উপরে পড়ে রয়েছে বা পাথরের উপরে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তাদের একদা উজ্জ্বল পরিকর এখন রক্তে ভেজা। ছিন্নভিন্ন নাড়িভূড়ি আর গড়িয়ে পড়া মলের গন্ধ নাকে বাবর ঝাপটা দেয়।

    “আসুন।” বাইসানগার তার পাশে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধের একটা গভীর ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে আর মুখটা ব্যাথায় শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে সে কয়েকশ ফিট দূরে কোক সরাইয়ের আবছা অবয়বের দিকে বারবার ইঙ্গিত করে। “গ্রান্ড উজির ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে- আমি যদি তাকে ঠিক চিনে থাকি তাহলে ব্যাটা গিয়ে জেনানা মহলে আশ্রয় নেবে।”

    নিজের লোকদের অনুসরণ করতে বলে, বাবর হোঁচট খেতে খেতে বাইসানগারে পিছু নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়, যা দেয়াল থেকে নিচের আঙ্গিনায় নেমে গিয়েছে। পড়ে থাকা লাশ আর আধা পিচ্ছিল জমাট রক্তের উপর দিয়ে কোনমতে টপকে যাবার সময়ে একটা মুখের উপরে তার দৃষ্টি আটকে যায়। মুখটা সম্ভবত তারই বয়সী আরেক কিশোর যোদ্ধার। রক্তশূন্য, মৃত্যুযন্ত্রণার নিরব চিৎকারে তার ঠোঁট পেছনে বেঁকে গিয়ে মাড়ি বের হয়ে আছে এবং তার চোখের লম্বা পাপড়ির নিচে বিশাল কালো চোখে দৃষ্টির মায়া মিলিয়ে গিয়ে ফুটে আছে মৃত্যুর বিভীষিকা। বাবর কেঁপে উঠে এবং দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। ওয়াজির খান তাকে হুঁশিয়ার করে চিৎকার করে না উঠলে তারও একই ভাগ্য বরণ করতে হতো।

    বাবর আর ওয়াজির খান এবং তাদের লোকেরা বাইসানগারকে প্রাঙ্গনের উপর দিয়ে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে দূর্গ আস্তানাকে নিরব আর শান্ত দেখায়। দেয়ালের উপরে একচোট লড়াইয়ের পরে তাদের আর নিরবে এগিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না- দূর্গ আস্তানায় তাদের উপস্থিতি এখন আর গোপন নেই। কিন্তু বাবরের লোকদের অনেকেই গরু আর ভেড়া-চোর হবার কারণে তারা নিরবে আর গোপনে এগিয়ে যায়। গ্রান্ড উজিরের বাকী দেহরক্ষী এবং সৈন্যরা সব কোথায়? বাবর আশঙ্কা করে যে কোনো সময়ে তীরের একটা ঝাপটা ধেয়ে আসতে পারে, কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটে না।

    চার-তলা কোক সরাইয়ের কাছে গোপনে পৌঁছালে তারা সেটাকে রহস্যজনকভাবে নিরব দেখতে পায়, ড্রাগনের হাতল যুক্ত পিতলের চকচকে দরজাগুলো খোলা এবং অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তৈমূরের কিংবদন্তির দূর্গ। এমন চমৎকার একটা কিছু নির্মাণের জন্য না জানি আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। দূর্গের প্রতিটা পাথর থেকে শক্তি আর ক্ষমতা যেন ঠিকরে পড়ছে। বাবরের তার মরহুম আব্বাজানের বলা অশুভ গল্পগুলো মনে পড়ে। “তৈমূরের সব সন্তান যারা বিদ্রোহ করেছে এবং সিংহাসনে বসেছে সবাই সেখানেই বসেছে। সিংহাসনের মোহে পড়ে যারা নিজের প্রাণ হারিয়েছে সবাই সেখানেই প্রাণ দিয়েছে। বলা হয় তারা তাদের শাহজাদাকে কোক সরাইয়ে নিয়ে গিয়েছে’ কথাটার মানে সেই শাহজাদা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে।”

    ওয়াজির খান আর বাইসানগার নিজেদের ভিতরে আলাপ করে। ভিতরে প্রবেশের জন্য অধীর বাবর তাদের সাথে এসে যোগ দেয়। “সুলতান, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,” বাবরের ভিতরের অস্থিরতা লক্ষ্য করে ওয়াজির খান দ্রুত কথাটা বলে। “পুরো ব্যাপারটা একটা ফাঁদও হতে পারে।” বাবর মাথা নাড়ে। সে ঠিকই বলেছে। কেবল অসতর্ক আহাম্মকই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশের মত ভুল করবে। বন্ধ তোরণদ্বারের কাছে তাড়াহুড়োর কারণে প্রায় মরতে বসার ঘটনা স্মরণ করে বাবর অনেক কষ্টে নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করে। তারপরেও ওয়াজির খান যখন তার ছয়জন লোককে দেয়ালে প্রজ্জ্বলিত মশাল খুলে নিয়ে সতর্কতার সাথে তাদের ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে বলে যে কোনো ধরণের ফাঁদ পাতা আছে কিনা, বাবরকে তখনও অস্থিরভাবে উসখুশ করতে দেখা যায়।

    বাবরের কাছে যা কয়েক যুগের মত মনে হয়, বস্তুত পক্ষে, কয়েক মিনিট পরে, লোকগুলো বাইরে এসে জানায় যে আপাত দৃষ্টিতে সবই ঠিক আছে। বাবরের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে, তার লোকেরা জোটবদ্ধ ভঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করে। পিতলের দরজা অতিক্রম করে তারা একটা উঁচু খিলানাকৃতি ছাদের প্রবেশ কক্ষ দেখতে পায় এবং তারপরেই ঠিক সামনে রয়েছে চওড়া নিচু সিঁড়ির ধাপ। ধীরে, সতর্কতার সাথে দপদপ করতে থাকা মশালের আলোয় তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে, সামনের অন্ধকারের দিকে সবাই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ত্রিশ ধাপ ওঠার পরে তারা দ্বিতীয় তলায় এসে পৌঁছে। সামনে সিঁড়ির আরেকটা ধাপ দেখা যায়। বাবর প্রথম ধাপে ইতিমধ্যে পা রেখেছে এমন সময় সে একটা চিৎকার শুনতে পায়।

    “সুলতান, নেমে আসুন, শীঘ্রই নেমে আসুন!” বাবর ঝুঁকে পড়তে সামনের অন্ধকার। থেকে ছুঁড়ে মারা একটা বর্শা তার মাথার উপর দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চলে যায়, এতটাই কাছ দিয়ে যে তার ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে পড়ে। নিমেষ পরেই, গ্রান্ড উজিরের দুই ডজন দেহরক্ষীর আরেকটা দল সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসে। পরের মুহূর্তে বাবর পাগলের মত ডানে বামে মোচড় খেয়ে তরবারি চালাতে শুরু করে। বিভ্রান্তির মাঝে তার তরবারির চেয়ে এখন খঞ্জরই বেশি কাজে আসে। সে শত্রুর ঢালের নিচে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার খঞ্জরের ফলাটা উপরের দিকে করে কোপ বসিয়ে দেয়, সে জায়গামত আঘাত করতে পারলে হাতে আর কব্জিতে উষ্ণ রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে টের পায়। তার লোকেরা তাকে চারপাশে থেকে ঘিরে রেখেছে, হুঙ্কার দিয়ে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করতে করতে পুরো দলটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

    গ্রান্ড উজিরের লোকেরা সিঁড়ির নিচে থেকে উঠে আসা আক্রমণের চাপ সামলাতে না। পেরে পিছু হটতে শুরু করে। শীঘ্রই তাদের আরও পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। সহসা তাদের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং হেরে যাওয়া যুদ্ধে প্রাণ না দেয়া আর পালাবার প্রবণতা জোরালো হতে তারা সিঁড়ি ভেঙে পালাতে আরম্ভ করে। বাবরের লোকেরা এবার দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে পলায়মান অবয়বগুলোকে কোপাতে কোপাতে এগিয়ে। যায় এবং তৃতীয় তলার কিছুটা পর্যন্ত দাবড়ে দেয়।

    তাড়াহুড়োয়, বাবর একটা অসমান ধাপে পিছলে যায় এবং কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ে। তার আগুয়ান লোকদের একজন ঠিক পিছনেই ছিল, যে নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবরের গায়ে হোঁচট খায় এবং তার পেলব পিঠের উপর পা দিয়ে মাড়িয়ে গেলে আরও একবার বাবরের বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়। লড়াই তৃতীয় তলায় স্থানান্তরিত হতে বাবর চোখমুখ কুঁচকে কোনো মতে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের জন্য তার বমি বমি পায় এবং চোখে ঝাপসা দেখে। দেয়ালে হাত দিয়ে সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে এবং জোরে শ্বাস নিতে গেলে কালশিটে পরা পাঁজর আর পেটের টান খাওয়া মাংসপেশী ব্যাথায় প্রতিবাদ জানায়।

    “সুলতান।” ওয়াজির খান সিঁড়ি ভেঙে তার দিকে ছুটে আসে। “আপনি কি জখম হয়েছেন?”

    বাবর মাথা নাড়ে। “না, আমি ঠিক আছি।”

    “গ্রান্ড উজিরের অবশিষ্ট সৈন্যরা যারা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে- এই ভবনের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা প্রায় জয় লাভ করেছি।” ওয়াজির খানের মুখে দুর্লভ একটা হাসি ফুটে উঠে এবং সে বাবরের কাঁধ স্পর্শ করে। “আসুন।”

    ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে থেকে একটা গোলমালের শব্দ ভেসে আসে এবং পাথরের সিঁড়িতে দুদ্দাড় শব্দে অনেকগুলো পা তাদের দিকে ছুটে আসে। বাবর ঝটিতে ঘুরে দাঁড়ায় নতুন দুর্দৈব মোকাবেলা করতে। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসা ছায়াগুলোকে সে চিনতে পারে, তারই লোক, একেবারে সামনে রয়েছে আলি মজিদ বেগ ফারগানার পশ্চিম থেকে আগত পেশল দেহের গোত্রপতি, যাকে সে আর ওয়াজির খান সুড়ঙ্গ পথে আগত লোকদের নেতা হিসাবে মনোনীত করেছে।

    “সুলতান, দূর্গ আর নগর প্রাসাদ আমাদের দখলে- সেই সাথে পুরো শহর।” আলি মজিদ বেগকে বিধ্বস্ত দেখায়, কিন্তু ঘাম আর রক্তের নিচে তার পটল-চেরা চোখে বিজয়োল্লাস চিকচিক করে।

    “তোমরা দারুণ যুদ্ধ করেছে।”

    “সুলতান।” আলি মজিদ বেগ যদিও এখনও হাঁপাচ্ছে, নিজের আর অধীনস্থ লোকদের সাফল্যে তার কণ্ঠে গর্ব উথলে উঠে।

    “তোমরা কি গ্রান্ড উজিরকে কোথাও দেখেছো?”

    আক্ষেপের সাথে আলি মজিদ বেগ মাথা নাড়ে।

    “তাহলে বাইসানগার যা ভেবেছে সেটাই ঠিক। এখানেই কোক সরাইয়ে রক্ষিতাদের আঁচলের তলায় গিয়ে ব্যাটা লুকিয়েছে, যদি না কোনক্রমে শহর ছেড়ে পালিয়ে না যায়।”

    “সুলতান, সে পালিয়ে যাবে কোথায়? কে তাকে আশ্রয় দেবে?” ওয়াজির খান প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলে।

    ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো অতিক্রম করে কোক সরাইয়ের উপরের তলায় উঠে আসে। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার উল্টো দিকে, তার উৎফুল্ল যোদ্ধাদের মাঝ দিয়ে সে রূপার উপরে সবুজাভ-নীল মিনে আর পাথরের কারুকাজ করা একজোড়া দরজা দেখতে পায়।

    “জেনানা মহল?” বাবর জানতে চায়।

    বাইসানগার সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে।

    মানস চোখে, বাবর সহসা নিজের বোন খানজাদার ভয়ার্ত চোখ দেখতে পায়। সে কেমন অনুভব করতো, যদি তার বোন এমন একটা দরজার পেছনে, বিজয়োল্লাসে উন্মাদ যোদ্ধাদের হাত থেকে। অসহায় ভাবে লুকিয়ে থাকতো? সে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে ঘুরে তাকায়। “মেয়েদের যেন কেউ অপমান না করে। আমি সমরকন্দ এসেছি এর নতুন সুলতান হিসাবে, রাতের আঁধারে আসা কোনো হন্তারক আমি নই।”

    সে তার লোকদের অনেকের ভেতরে তাদের আবেগতাড়িত মুখে আশাহতের বেদনা দেখতে পায়। তারা সম্ভবত বিশ্বাস করে যে, সে এমন কথা বলতে পেরেছে কারণ সে একজন লোকের চাহিদা আর হতাশা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণাযুক্ত এক কিশোর। যাকগে তাদের যা ইচ্ছা তারা ভাবতে পারে। আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকালে সে তার সেনাপতির মুখে প্রসন্নতা দেখে বুঝতে আরও একটা পরীক্ষায় সে উতরে গিয়েছে।

    নিচের আঙ্গিনা থেকে নিয়ে আসা মাথায় লোহার পাতযুক্ত দেয়াল চূর্ণকারী দুরমুশের আঘাতে রূপার দরজা কেঁপে উঠে এবং সবুজাভ-নীল পাথরের উজ্জ্বল টুকরো খোলামকুচির মত ছিটকে মাটিতে পড়ে। কিন্তু দরজাটা তারপরেও অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। চকচকে রূপার পাতের নিচের কাঠ নিশ্চয়ই সেরকম মজবুত আর হুড়কাও দৃঢ়। তার লোকেরা চতুর্থবারের মত দুরমুশটা দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেবার সময় বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজার রূপার আস্তরণ ফেটে বেঁকে যায় এবং নিচের কাঠ গুঁড়িয়ে যায়। দু’জন যোদ্ধা তাদের রণকুঠার দিয়ে একজন মানুষ প্রবেশের মত একটা বড় ফোকড় তৈরি করে।

    বাবর আর তার লোকেরা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করে। সে নিশ্চিত যে কোনো মুহূর্তে হারেম রক্ষা করতে এগিয়ে আসা যোদ্ধার হুঙ্কার তারা শুনতে পাবে কিংবা ভেতর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের কারণে বাধ্য হবে ফাঁকা স্থানটা থেকে সরে দাঁড়াতে। তার বদলে কেবল নিরবতাই বিরাজ করে। আর চন্দনকাঠের ভারী মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে যা তাকে শেষবার মায়ের কাছে বসে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গন্ধটা তাদের চারপাশে ঘুরপাক খায়, ঘামের সাথে মিশে একটা আলাদা গন্ধের জন্ম দেয়।

    তার লোকদের চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে, বাবর দরজার ফোকরের দিকে এগিয়ে যায়, সে আবার পণ করেছে প্রথমে সেই ভিতরে প্রবেশ করবে। “না। সুলতান।” নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করা ওয়াজির খানের হাত তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “প্রথমে আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেন।”

    বাবর ভাবে, আমি তার কাছে ঋণী। হতাশা লুকিয়ে রেখে সে ওয়াজির খান আর তার দু’জন যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে সতর্কতার সাথে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। কিছুক্ষণ পরেই সে শুনতে পায় ওয়াজির খান বলছে, “সুলতান, আপনি এবার ভিতরে আসতে পারেন।”

    বাবর দরজার ফোকড় গলে ভেতরে প্রবেশ করে নরম রেশমের গালিচায় পা রাখে। এমন কোমলতা সে জীবনেও অনুভব করেনি। তাদের ফারগানা গালিচাগুলোকে এর তুলনায় জীর্ণ কম্বল মনে হয়।

    ওয়াজির খান ইশারায় তাকে সতর্ক থাকতে বলে। তার বাকি লোকেরা পেছন থেকে চাপ প্রয়োগ করতে, বাবর সামনে এগিয়ে যায়, বিশাল কক্ষের প্রতিটা আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেকোন আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত। কাঁচ লাগান কুলুঙ্গিতে প্রজ্জ্বলিত শত শত মোমবাতির আলোতে কক্ষটা আলোকিত। স্বচ্ছ হলুদাভ আলো দেয়ালে ঝোলান হাতে বোনা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা টিউলিপ, সোলোমী আর সমরকন্দের অন্যান্য ফুল, এবং চকচকে স্যাটিন বা মখমলের পুরু তাকিয়ার উপরে খেলা করছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ছয়টা রূপার দরজা একেকপাশে। তিনটা করে, বাবর অনুমান করে সেগুলোর পেছনে মেয়েদের ব্যক্তিগত কামরা রয়েছে। ঠিক নাক বরাবর সামনে আরেকটা দরজা, এটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ান। আর তার উপরে সমরকন্দের বাঘের প্রতিরূপ খোদাই করা রয়েছে।

    তার লোকেরা আবারও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে টের পেয়ে, বাবর কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে। “উজির!” সোনায় মোড়ান দরজার দিকে লক্ষ্য করে সে বলে, তার কণ্ঠস্বর হতে পারে এখনও পুরুষালী হয়নি কিন্তু পরিষ্কার এবং দৃঢ়। “আপনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না, কিন্তু নিজের মৃত্যু দ্রুত আর সম্মানজনক করতে পারেন।” দরজার পেছনে একটা মৃদু নড়াচড়ার শব্দ মনে হয় সে শুনতে পায় কিন্তু তারপরেই আবার সব আগের মত নিরব হয়ে যায়। “উজির, আপনার কি লজ্জা বা সম্মানবোধ বলে কিছু নেই?” বাবর অনড় ভঙ্গিতে বলে।

    এইবার নিশ্চিতভাবেই একটা ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়। সহসা সোনালী দরজাটা খুলে যেতে সেখানে গ্রান্ড উজিরের দু’জন দেহরক্ষীকে দেখা যায়, একজনের গালে আড়াআড়ি একটা তরবারির আঘাতের চিহ্ন। তাদের প্রতিবাদ করতে থাকা প্রভুর হাত ধরে টেনে আনছে, তার উজ্জ্বল সবুজ রঙের জরির কাজ করা আলখাল্লা পেছনে ঢেউয়ের মত দুলছে। কোনো রকমের ভণিতা না করে তারা গ্রান্ড উজিরকে বাবরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়, তারপরে নিজেরা তার সামনে বশ্যতা স্বীকারের ভঙ্গিতে নতজানু হয়। অন্য দেহরক্ষীরা, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে নিজেদের প্রণত করে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বাবর পুরো নাটকটা দেখে। “বাইসানগার সবাইকে নিরস্ত্র কর।”

    বাইসানগারের লোকেরা দ্রুত আদেশ পালন শুরু করতে, মলিন নীল রঙের রেশমের পোশাক পরিহিত এক কিশোরী সোনালী দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে এসে, বাইসানগারের লোকদের নাগাল এড়িয়ে সোজা গ্রান্ড উজিরের দিকে ছুটে যায়। তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে বেচারী তাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে তার তন্বী দেহটা এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেয়। মেয়েটা সুস্থির হয়ে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। সে দেখে একটা ডিম্বাকৃতি মুখ এবং চোখ যা কান্নায় ভরাক্রান্ত হলেও সুন্দর। “আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ।” ভয়হীন কণ্ঠে মেয়েটা কথাগুলো বলে, যদিও রণ ক্লান্ত একদল যোদ্ধার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যাদের কাছ থেকে সে নিশ্চয়ই জানে যে সে সামান্যই সহানুভূতি বা করুণা প্রত্যাশা করতে পারে।

    “তার বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার যোগ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে।” বাবর কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়। “অন্য মেয়েরা কোথায়?”

    মেয়েটা প্রথমে ইতস্তত করে তারপরে বলে, “সবাই নিজ নিজ কামরায় রয়েছে।” সে ছয়টা ছোট দরজা ইশারায় দেখায়। বাবর ওয়াজির খানের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। “সবগুলো তল্লাশি করেন। কোনো সৈন্য যেন সেখানে লুকিয়ে না থাকতে পারে। তারপরে মেয়েদের সেখানেই আটকে রাখেন আমরা যতক্ষণ তাদের দিকে মনোযোগ দেবার সময় না পাই।” ওয়াজির খান দ্রুত তার লোকদের দরজা ভাঙার নির্দেশ দেয়। প্রায় সাথে সাথে বাবর হারেমের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আর বিলাপের সুর ভেসে আসতে শুনে। কিন্তু সে জানে তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। মেয়েদের ভয় পাওয়া থেকে সে তাদের বিরত রাখতে পারবে না, কিন্তু তাদের কেউ অপমানও করবে না।

    উজিরের কন্যা এখন তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে, তার বাদামী চোখে গর্বিত অভিব্যক্তি। সে তার অভিযুক্ত চাহনী থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। “তাকে ব্যক্তিগত কামরায় নিয়ে যাও এবং তালাবন্ধ করে রাখো।” উজিরকে ছেড়ে দেবার কোনো অভিপ্রায় তার নেই। কিন্তু বুঝতে মেয়েটাকে তার বাবার মৃত্যুদণ্ড দেখা থেকে সে বিরত রাখতে চাইতে। মেয়েটাকে কেউ ধরার আগেই, সে নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ায় এবং পেলব গলার উপরে গর্বিত মাথা উঁচু করে রেখে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতরে হারিয়ে যায়, যাবার সময়ে কোনো অনুরোধ বা ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও ফিরে তাকায় না। বাবর পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কল্পনা করে এমন সম্মান প্রদর্শন করতে তাকে কি মূল্য দিতে হয়েছে।

    “বেশ, উজির দেখা যাচ্ছে আপনার মেয়ে আপনার দেহরক্ষীদের চেয়ে সাহসী আর অনেক বেশি বিশ্বস্ত। এমন সম্মান পাবার যোগ্য আপনি নন।” বাবর বুঝতে পারে সবার সামনে মেয়েটাকে তার বাবা এভাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অপমান করায় সে নিজেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

    “সমরকন্দের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার কোনো অধিকার তোমার নেই।” গ্রান্ড উজির নিজেকে টেনে তুলে বসার আসনে নিয়ে আসেন এবং বাবরের দিকে গুটিবসন্তে ক্ষতবিক্ষত, চওড়া-চোয়াল বিশিষ্ট মুখে অশুভ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকেন, আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনা সম্পর্কে তাকে আপাতদৃষ্টিতে নিরুদ্বিগ্ন দেখায়। “আমার ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, শেষ সুলতানের আমি ভাস্তে। আমার চেয়ে আর কার দাবি জোরাল?”

    গ্রান্ড উজির তার রক্তজবার মত চোখ কুচকে তাকায়। “তুমি হয়ত ভাবছে সমরকন্দ দখল করেছে, কিন্তু জেনে রাখো তুমি কখনও এটা নিজের অধিকারে রাখতে পারবে না, সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে। “পাহাড়ী জঞ্জাল, কথাটা চিন্তা করে দেখো। ফারগানায় নিজেদের নোংরা ভেড়ার পালের কাছে ফিরে যাও। সম্ভবত তাদের ভিতরেই তুমি নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পাবে- আমি শুনেছি তোমরা বিশেষ কোন…”।

    “অনেক হয়েছে!” বাবর কাঁপতে থাকে যা সে বুঝতে পারে বয়ঃসন্ধিক্ষণের উত্তেজনা, কিন্তু আশা করে তার লোকেরা যেন সেটাকে রাজকীয় ক্রোধ বলে মনে করে। “বাইসানগার,” সে নাটকীয় ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে।

    সেনা অধিপতি তার দিকে এগিয়ে আসে। “সুলতান?”

    “অন্যায়ভাবে সিংহাসন অধিকার করা ছাড়াও শেষ সুলতানের শেষ আদেশ পালন করার জন্য এই লোকটা তোমার সাথে নির্মম জুলুম করেছে।” বাবর লক্ষ্য করে বাইসানগার তার ডান হাত যেখানে থাকবার কথা ছিল সেদিকে চকিতে তাকায়। “পরবর্তী জীবনের পাওনা বুঝে নেবার জন্য এই পাপীকে সেখানে পাঠাবার ভার তোমাকে দেয়া হল। নিচের প্রাঙ্গণে তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে এবং তার কন্যার সাহসিকতার জন্য খেয়াল রাখবে পুরো ব্যাপারটা যেন দ্রুত নিষ্পন্ন হয়। তারপরে তার দেহটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার থেকে শিকল দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে, যেন লোকেরা দেখতে পায় যে লোকটার উচ্চাশা আর ধনলিপ্সা তাদের অভাব আর কষ্টে ফেলেছিল তাকে আমি কিভাবে সাজা দিয়েছি। তার দেহরক্ষীর দল যদি আমাকে তাদের সুলতান হিসাবে মেনে নিয়ে আনুগত্যের শপথ নেয় তবে তারা প্রাণে বেঁচে যাবে।”

    বাইসানগারের লোকেরা উজিরকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে, সহসা ক্লান্তি এসে বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য সে চোখ বন্ধ করে এবং রেশমী কোমল গালিচাটা স্পর্শ করার জন্য ঝুঁকে যা আগামীকাল গুটিয়ে নিয়ে তার মায়ের কাছে উপহার হিসাবে পাঠাবার আদেশ দেবে বলে ঠিক করেছে। “সমরকন্দ,” সে নিজেকে ফিসফিস করে শোনায়। “এখন আমার।”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article গথ – অৎসুইশি

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }