Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আঁধার আখ্যান – কৌশিক মজুমদার

    কৌশিক মজুমদার এক পাতা গল্প186 Mins Read0

    প্রেতিনী

    আমি শুভদীপ। শুভদীপ সরকার। বাবার নাম শুভাশিস সরকার। মা জয়ন্তী সরকার। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার এক বোন ছিল। জয়িতা সরকার। তিন বছর আগে বোন মারা গেছে। আমি বাবা মায়ের সঙ্গে থাকি না। হোস্টেলে থাকি। একা। বাবা কথা দিয়েছিল আমার চোদ্দো বছরের জন্মদিনের দিন আমাকে নিতে আসবে। আমাকে হোস্টেল থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে। আজ আমার জন্মদিন। বাবা আর মা দুজনেই আমাকে নিতে এসেছে। আমি ঘরে নিজের জিনিস গুছাচ্ছি। মা আমাকে হেল্প করছে। বাবা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে কথা বলছে।

    “আপনি শিওর? ওকে নিয়েই যাবেন?” ওয়ার্ডেন বললেন।

    “দেখুন, হাজার হোক একমাত্র ছেলে। ওকে ছেড়ে থাকতেও তো পারি না। আমি তো তবু অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। ওর মায়ের কথা ভাবুন… সারাদিন একা একা…”

    “তা বটে। কিন্তু আর কিছুদিন… যাই হোক, যা ভালো বোঝেন।” বলে ওয়ার্ডেন চলে গেলেন।

    মা আমার বইগুলো গুছাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি আমার ডায়রি নিয়ে পড়তে শুরু করেছে। আর দু-এক পাতা উলটেই চিৎকার করে বাবাকে ডাকল মা।

    “এই যে, কি গো! দেখে যাও তোমার ছেলের কাণ্ড!”

    আমি ভাবলাম দৌড়ে গিয়ে ডায়রিটা কেড়ে নিই। তারপর দেখলাম যা দেখার মা দেখে ফেলেছে। এখন কাড়তে গেলে হিতে বিপরীত হবে।

    বাবা প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকল, “কেন কী হয়েছে?”

    “এই দ্যাখো! তোমার ছেলে… দিনরাত ডায়রিতে এসব করছে।”

    লাল কাপড়ে বাঁধানো ডায়রিটা আমাকে বাবা কিনে দিয়েছিল। গতবার জন্মদিনে। এখানের প্রতিদিনের রোজনামচা লেখার জন্য। কিন্তু তা বলে কি আমি নিজের রিসার্চের কাজ এতে লিখতে পারব না! কী জানি বাবা।

    বাবা খুব গম্ভীরভাবে ডায়রির পাতা ওলটাতে লাগল। একটা করে পাতা ওলটাচ্ছে, আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। গোটা দশ পাতা উলটে খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “এসব কী বাবুন?”

    “আমার রিসার্চের কাজ”, গম্ভীর মুখে জবাব দিলাম।

    “রিসার্চ! তুমি আজকাল এইসব নিয়ে রিসার্চ করছ? এসব কী? ব্রহ্মরাক্ষস। জটেবুড়ি। কন্ধকাটা। ঘর দেবত্তি। প্রেতিনী। কারা এরা?”

    “তুমি জানো বাবা। খুব ভালো জানো। এঁরা অপদেবতা। তোমাকে আগেও বলেছি।”

    “এসব গাঁজাখুরি বিশ্বাস করো তুমি? যত্তসব আষাঢ়ে গপ্পো!”

    “গপ্পো না বাবা। এঁরা আছেন। আমাদের মধ্যেই। যেমন তুমি-আমি…”

    “এসব কে শেখাচ্ছে তোমায় বলো তো?” বাবা এবার প্রায় চিৎকার করে বলল, “কোথা থেকে জানছ এই সব?”

    “বই পড়ে। আমাদের তো দিনে এক ঘণ্টা লাইব্রেরি অ্যালাউড।”

    “আর সেখানে বসে তুমি এইসব পড়ো!!” রাগে বাবার গলা এবার প্রায় ধরে এল। মা বাবাকে থামাল।

    “তুমি আর উত্তেজিত হোয়ো না। এবার তো বাড়িতেই থাকবে। আমি দেখছি কী করা যায়।”

    “দেখো”, ডায়রিটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে বাবা বলল, “তোমার কথায় এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার দায়িত্ব।” বলে বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করল দমাস করে।

    আমি কিছু বললাম না। শুধু মাটি থেকে ডায়রিটা কুড়িয়ে পিঠের ব্যাকপ্যাকে রেখে দিলাম।

    বেরোতে বেরোতে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আজকে নিজে ড্রাইভ করছে। পাশে মা। আমি পিছনের সিটে একা বসে আছি। মা হাতব্যাগ থেকে একটা কেক বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “খেয়ে নে। বাড়ি যেতে যেতে দেরি হবে।”

    “কেন?”

    “একটু লাল্টু কাকুর বাড়ি যাব। বাড়ি মানে নতুন বাড়ি। ওরা বিরাটিতে একটা নতুন বাড়ি কিনেছে। এখন আর হাবড়ায় থাকে না। অনেকদিন ধরে আমাদের বলছে যেতে। যাওয়া হচ্ছে না। তোর বাবা বলল আজ যখন পাশ দিয়েই যাব, তো ঘুরেই আসি। বেশিক্ষণ না। ঘণ্টাখানেক থাকব। ফেরার পথে বারাসাত, মধ্যমগ্রামে প্রচুর ভালো দোকান আছে। ডিনার করে নেওয়া যাবে।”

    আমি কিছু বললাম না। গাড়ি এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি অনেকদিন পরে এভাবে সন্ধ্যা নামা দেখছি। হোস্টেলে সন্ধ্যার আগেই নিজের নিজের রুমে ঢুকে যেতে হয়। আমার ঘরের জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যেত না। আকাশ প্রথমে কমলা, তারপর গোলাপি হয়ে অদ্ভুত ছাই ছাই রং নিল। সব গাড়ি ধীরে ধীরে হেডলাইট জ্বালাচ্ছে।

    বিরাটি ব্রিজের পাশ থেকে বাবা গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা নিল। এদিকে রাস্তা বেশ ভাঙা। এবড়োখেবড়ো। খানিক যাবার পর আবার ডান দিক, বাঁ দিক ঘুরে গাড়ি একটা সরু গলিতে গিয়ে ঢুকল।

    “তুমি ওদের বাড়ি চেনো?” মা জিজ্ঞাসা করল।

    “হ্যাঁ, আগে একবার এসেছিলাম লাল্টুর সঙ্গে। বাড়ি দেখতে। তখনও কেনেনি। তিন চার বছর বাড়িটা পড়ে ছিল। কেউ কিনছিল না। ও প্রায় জলের দরে পেয়ে গেছে। নইলে এই পজিশানে, এত সস্তায়, সম্ভব?”

    “কিনছিল না কেন?”

    “আরে লোকজনের কুসংস্কার বোঝো না? কে যেন এই বাড়িতে মারা গেছিল, সেই থেকে এই বাড়িতে নাকি…” বাবা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি পিছনে আছি বুঝে একেবারে চুপ মেরে গেল। মা আর ঘাঁটাল না।

    গাড়ি এসে থামল বেশ পুরোনো একটা বাড়ির সামনে। দোতলা বাড়ি। নতুন করে রং করাবে বলে দেওয়াল ঘষা হয়েছে। বাড়ির সামনে ছোটো বারান্দা। কিছু জংলা গাছ ইতিউতি গজিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে বুঝলাম ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এতক্ষণ ভিতরে এসির জন্য বুঝতে পারিনি। লাল্টুকাকু বাড়ির সামনেই মিস্তিরিদের সঙ্গে কথা বলছিল। আমাদের দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এল।

    “কী ব্যাপার মাস্টার শুভদীপ! কতদিন পরে দেখলাম তোমাকে! এখন তো আর মাস্টার না, মিস্টার বলতে হবে। এসো এসো ভিতরে এসো। তোমার কাকিমা অনেকক্ষণ ওয়েট করছে।”

    বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিতেই কেমন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমায়। মনে হচ্ছিল আড়াল থেকে কে যেন আমায় দেখছে। এটা আরও বাড়ল বাড়িতে ঢোকার পর। বাইরে অমন গরম, ভিতরে কিন্তু বেশ ঠান্ডা। চিনচিনে। বাবা তো বলেই ফেলল, “তোদের বাড়ির ভিতরে তো খুব ঠান্ডা! এসি লাগে না বোধহয়।”

    “আসলে অনেক পুরোনো বাড়ি তো। মোটা মোটা দেওয়াল। ছাদে কড়ি বরগা দেখছিস না… আর এসি কী বলছিস, শেষরাতে রীতিমতো চাদর গায়ে দিতে হয়।”

    হাসিমুখে দোতলা থেকে নেমে এল লাল্টুকাকুর বউ। আমাদের হাতে ধরে নিয়ে গেল উপরে। “তুমিই শুভদীপ! তোমার কথা অনেক শুনেছি। আজ দেখা হল।”

    কাকু বিয়ে করেছে বছর দু-এক হল। বিয়েতে আমি আসতে পারিনি। কাকিমার সঙ্গে আমার এই প্রথম দেখা।

    দোতলায় ঠান্ডাটা অদ্ভুতভাবে আরও বেশি। এমন হবার কথা না। নিচতলাই সাধারণত বেশি ঠান্ডা হয়। আর একটা অদ্ভুত গন্ধ। গোটা দোতলা জুড়ে। আঁশটে। দমবন্ধ করা।

    দোতলাতেই বসার ঘর। বাবা মা সোফায় বসল। আমি একটা মোড়া টেনে বসলাম। কাকিমার মুখটা হাসি হাসি। মনে হচ্ছে জোর করে হাসবার চেষ্টা করছে। আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করল। কী ভালোবাসি, হবি কী, বন্ধু আছে কি না। আমি হুঁ হাঁ করে জবাব দিলাম। কাজের লোক জলখাবার নিয়ে এল। মাছের প্যাটিস, আর কেক। প্যাটিসটা অদ্ভুত ঠান্ডা। আর আঁশটে গন্ধ। দুই কামড় খেয়ে সরিয়ে রাখলাম। বাবারা দিব্যি খাচ্ছে। আমায় জিজ্ঞাসা করতে বললাম খিদে নেই।

    এবার বাড়ি দেখানোর পালা। কাকুদের বেডরুমের পাশের রুমটা তালাবন্ধ। মা জিজ্ঞাসা করতেই কাকিমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। শুনলাম ওই ঘরেই নাকি আগের মালিকের বউ থাকতেন। একবার দীপাবলির দিন রাতে তাঁর প্রসবযন্ত্রণা ওঠে। ওই সময় ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। সব ব্যবস্থা করার আগে এই ঘরেই বউটি মারা যায়। নাম ছিল নেহা গুপ্তা। বিহারি। বেনিয়া। আমি এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠলাম। দীপাবলির রাতে সব প্রেতেরা নরক থেকে মর্তে উঠে আসে। আমি পড়েছি। সেই রাতে কোনও সধবা মহিলা প্রথম সন্তান হবার সময় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মারা গেলে তার কোনও গতি কেউ করতে পারে না। গয়ায় পিণ্ড দিলেও না। সে প্রেতিনী হয়ে সেই ঘরে এঁটে বসে থাকে। অবশ্য বেশিদিন না। মাঝে মাঝেই তাঁর খিদে পায়। তখন ঘরে জ্যান্ত কেউ ঢুকলে প্রেতিনী তাকে বাহন করে ঘুরে বেড়ায়। তার আত্মার অংশ চুষে চুষে খায়, যতক্ষণ না সেই লোক শুকিয়ে মরে যাবে। আমি এই সমস্ত জানি।

    বাবা আমার দিকে তাকিয়েই বুঝেছিল গোলমাল। জানি না আমার ভয় কাটানোর জন্য কি না, বাবা বলে উঠল, “আমি ওই ঘরটা দেখব।” কাকিমা ইতস্তত করে কাকুর দিকে তাকাল। কাকু বাবাকে বারবার করে বলল, “ছাড় না! এই ঘরটাই দেখতে হবে? কী দরকার?”

    বাবা জোর করতে লাগল। শেষে কাকু বলল, “ঠিক আছে। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। কিন্তু আমরা কেউ যাব না। তুই একা ঢোক।”

    বাবা বলল, “আমিও ঢুকব, বাবুনও ঢুকবে। ওর মাথার থেকে এসব পাগলামো দূর করতে হবে।”

    মা অনেকবার মানা করল। বাবা শুনল না। কাকু দরজা খুলে দিলে আমাকে কলার ধরে প্রায় টেনেহিঁচড়ে ঘরে ঢোকাল বাবা। আমি ঢুকতে চাইনি। ঘরের ভিতর এত ঠান্ডা, যেন এসি চালানো। আঁশটে গন্ধটা দম বন্ধ করে দিচ্ছে। বাবা এদিক ওদিক হাতড়ে বালবের সুইচ জ্বালাল। ফাঁকা ঘর। কিচ্ছু নেই। শুধু একদিকের দেওয়ালে রোগা ফ্যাকাশে মুখের এক মহিলার ছবি টাঙানো। তাতে পুরু ধুলো।

    “দিব্যি ঘর। এটা ইউজ করিস না কেন? এই ঘরে একটা খাট পেতে রাখবি। সামনের বার এলে এই ঘরে আমি শোব। বাবুনকে নিয়ে। কি রে বাবুন, তাই তো?”

    আমি উত্তর দিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। বাবা হেসে হেসে কথা বলে যাচ্ছিল। একটা কথাও আমার কানে ঢুকছিল না। আরও ঘণ্টাখানেক থেকে আমরা বাড়ির দিকে রওনা হলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম লাল্টুকাকু বাবাকে বলছে, “এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই পারতি। ছেলেটা একেবারে চুপ মেরে গেছে।”

    বাবা মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে “ছাড় তো” বলে উড়িয়ে দিল।

    রাস্তায় জ্যাম। বারাসাত পৌঁছাতেই রাত নটা বেজে গেল। বাবা বলল এখানেই কোথাও খাবে। মৌচাকের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। আমার খিদে পাচ্ছিল না। বাবা জোর করছিল তাই এক পিস চিকেন দিয়ে অল্প ভাত খেলাম। সবকিছুতেই সেই অসহ্য আঁশটে গন্ধ। মাকে বললাম। মা বলল সব ঠিক আছে। দশটায় যখন খেয়েদেয়ে বেরোলাম, দেখি আকাশ মেঘে ঢাকা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কাজিপাড়া অবধি তাও রাস্তায় কিছু লরি, প্রাইভেট কার ছিল। রেলগেট পেরোনোর পরে আর কিচ্ছু নেই। বাবাও অবাক। এই সময় যশোর রোডে আর কিছু না হোক প্রচুর লরি থাকে। সেসব গেল কোথায়? আমি জানলায় মুখ ঠেকিয়ে বসে ছিলাম। দুইদিকে মাঠ। ধানখেত। দু-একটা বাড়িতে টিমটিমে আলো জ্বলছে। কোনও কারণে এদিকে লোডশেডিং। রাস্তার একটাও ল্যাম্পপোস্টে আলো নেই। বাইরের অন্ধকারে চোখ সয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

    আচমকা মনে হল অন্ধকার যেন জমাট বাঁধছে গাড়ির পাশেই। একটা স্থির জমা ধোঁয়ার মতো চাপা অন্ধকার গাড়ির পাশে পাশে চলছে। আমি কাচ থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। প্রথমে মনে হচ্ছিল দুটো লম্বা বাঁশ। ভালো করে খেয়াল করতে দেখলাম তা না। একটু দূরে দুটো রোমশ পা। তার কোমর আমাদের গাড়ির ছাদ ছুঁয়েছে। উপরে কী আছে দেখতে পাচ্ছি না। আমি দেখতে চাইও না। গাড়ির ভাঙা ভাঙা হলুদ আলোতে শুধু এটুকু বুঝলাম সেই দুই দৈত্যাকার পায়ের মালিক আমাদের গাড়ির সঙ্গে সমান বেগে হেঁটে হেঁটে চলেছে— তার পায়ের গোড়ালি দুটো পুরো উলটো।

    আমি এত জোরে চেঁচিয়ে উঠেছি যে বাবা সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাতে গিয়ে মা সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

    “কী হয়েছে বাবুন? এরকম অদ্ভুত চিৎকার করে উঠলি কেন?” বাবা বলল।

    মা তখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদের কিছু বলা বৃথা। বিশ্বাস করবে না। মিথ্যা বললাম, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেছি।”

    বাবা কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলল না। ঠিক তখনই আমাদের গাড়ির কাচে একটা টোকা পড়ল। বাবা কাচ নামাতেই গোটা গাড়ি সেই আঁশটে গন্ধে ভরে গেল। ঠিক এই গন্ধটাই আমি লাল্টুকাকুর বাড়িতে পেয়েছিলাম। এক মহিলা। বিহারি। ভাঙা বাংলায় বলল হাবড়া যাবে। কোনও বাস পাচ্ছে না। যদি একটু পৌঁছে দেওয়া হয়।

    আমি বারবার মাথা নেড়ে বাবাকে মানা করলাম। কিন্তু বাবা শুনলে তো! বাবা কোনও দিন কারও কথা শোনে না। নিজের মতে চলে। বাইরে তখন বৃষ্টি বাড়ছে। বাবা হাসিমুখে পিছনের গেট খুলে দিয়ে বলল, “চলে আইয়ে।”

    আমার পাশে এসে বসেছে মহিলা। গাড়ি চলছে। হালকা একটা নীল আলো গোটা গাড়ি জুড়ে। মহিলার মাথায় ঘোমটা। পরনে শাড়ি। মুখ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। আমি আড়চোখে ওকে দেখছিলাম। বারবার চেষ্টা করেও ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল না। একবার ঘোমটা একটু সরতেই মুখটা দেখে চমকে গেলাম। কোনও মানুষের মুখ এমন হয়! এই মুখ যেন আসলে কোনও মুখ না। একটা মাংসপিণ্ড। তাতে চোখ, নাক, কান, ঠোঁট কিচ্ছুটি নেই। নজর পড়ল শাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা হাতে। কালো সরু কাঠের মতো হাত। কোঁচকানো। যেন সব রস কেউ চুষে নিয়েছে। হাতের আঙুলগুলো বাঁকা আর তার ডগায় শক্ত বাঁকানো নখ। মায়ের মাথা একদিকে ঢলে পড়েছে। গাড়ি চললেই মায়ের ঘুম পায়। বাবা আপনমনে গাড়ি চালাচ্ছে আর গান গাইছে। সেই মহিলার আঙুলগুলো এবার নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ খুলে কী যেন বার করতে চাইছে। গাড়ির আবছা আলোয় আমি দেখতে পেলাম মহিলা ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বাচ্চার কাটা হাত বের করল। তারপর বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। হাতের কাটা অংশ থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। প্রেতিনী আমাদের পিছু ধাওয়া করেছে।

    এক ঝলকে আমি দেখে নিলাম ওদিকের গাড়ির লকটা বন্ধ করতে বাবা ভুলে গেছে। মাথা ঠান্ডা করে আমার দিকের দরজায় পিঠ রেখে শরীরের সমস্ত শক্তি দিকে উলটো দিকের দরজায় মারলাম এক লাথি। সেই প্রেতিনী কিছু বোঝার আগেই ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ঠিক তখনই উলটো দিক থেকে একটা বড়ো দশ চাকার লরি এসে ওর শরীরের ওপর দিয়ে চলে গেল।

    বাবা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাল। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বাবা আর লরির ড্রাইভার দুজনেই গাড়ি থামিয়ে অনেকক্ষণ দেখল পিণ্ড হয়ে যাওয়া দেহটাকে। তারপর বাবা ফিরে এসে খুব শান্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কেন এমন করলাম। আমি সব বললাম। লাল্টুকাকুর বাড়ি, প্রেতিনীর কাহিনি, সেই বিরাটাকার ওলটানো পা… সব। বাবা আমাকে বকল না। কিচ্ছু বলল না। শুধু গাড়ি ঘুরিয়ে আবার হোস্টেলের দিকে চলল।

    আমি এখন হোস্টেলে নিজের ঘরে বসে আছি। বাইরে মায়ের কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা আর ওয়ার্ডেন কথা বলছেন। সঙ্গে আমার ডাক্তার। ডাক্তার সেন। সেনই কথা বলছিলেন, “আমার ভুল হয়েছে। স্কিজোফ্রেনিয়ার রুগি যে আসলে কোনও দিন সুস্থ হয় না তা বুঝিনি। হ্যালুসিনেশানটা তার মানে এখনও চলছে। ভেবেছিলাম এই তিন বছরে… আর ভালো ইম্প্রুভ করছিল তো! এদিকে আপনিও তাড়া দিচ্ছিলেন অ্যাসাইলাম থেকে নিয়ে যাবার জন্য। সব ভেবে…”

    আমার ঘুম পাচ্ছিল। একটু আগে আমাকে ডাক্তার ইঞ্জেকশান দিয়েছেন। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুনতে পেলাম ওয়ার্ডেন বলছেন, “আমি স্যার আপনাকে শুরুতেই বলেছিলাম। যে ছেলে এগারো বছর বয়েসে নিজের বোনকে গলা টিপে মারতে পারে…”

    লেখকের জবানি: এই কাহিনিরও অর্ধেকের বেশি আমার নিজের কানে শোনা। আমার বাল্যবন্ধু অনির্বাণ চক্রবর্তী (যার ডাকনাম লাল্টু) দুই বছর আগে এক রাতে সস্ত্রীক যশোর রোড দিয়ে আসার সময় এক অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়। প্রায় হুবহু সেই অভিজ্ঞতাই এখানে লিখেছি, যদিও কথককে বদলে। শেষের হরোউইৎস সম ক্লাইম্যাক্স একেবারেই আমার প্ল্যান।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার
    Next Article সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    Related Articles

    কৌশিক মজুমদার

    নোলা : খাবারের সরস গপ্পো – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    নীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    অগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার

    August 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.