বারো মিনিট
আজ ২৬ জুন। দুপুর দুটো বারো। তিরিশ তলা অফিসের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর অরবিন্দ মুস্তাফি। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই তিনি ঝাঁপ দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবেন। আর যে অনিবার্য ঘটনাবলির কারণে তিনি এই চরম সিদ্ধান্ত নিলেন, তার শুরু হয়েছিল ঠিক বারো মিনিট আগে।
দুপুর দুটো, ড. মুস্তাফির চেম্বার
খুব ধীরে চেম্বারের দরজা খুলে গেল। উঁকি দিল সেক্রেটারি লরার মুখ। অন্যদিন ওঁর গালভরা হাসি দেখলেই ড. মুস্তাফির দিন ভালো হয়ে যায়। আজ লরার সারা মুখ ছাইবরন। মুখে ভয়ের ছাপ। বোধহয় একটু আগে কেঁদেছে, চোখদুটো ফোলা ফোলা। এরকম কিছু একটা হতে পারে সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলেন ড. মুস্তাফি। ভিতরের উত্তেজনা না দেখিয়ে শান্ত গলাতেই বললেন, “ভিতরে এসো।” লরা প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসেই হাঁউমাউ করে উঠল।
“আপনি পালান, এক্ষুনি পালান ডক্টর। যেভাবে হোক আপনি পালান। ওঁরা আপনাকে খুন করবে। ভোট হয়েছিল, দুজন বাদে সবাই আপনার বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছে। মাধবন তো আপনাকে মারার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ও-ই সবাইকে আপনার বিরুদ্ধে উসকাচ্ছে।”
“ওহহ, সেন্ট্রাল কমিটির মিটিং শেষ হল বুঝি…”
দুপুর দুটো চার, এ.সি.এ.-র মিটিং রুম
এ.সি.এ. অর্থাৎ এলিয়েন কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের ঝাঁ চকচকে মিটিং রুমে একটু আগেই বেশ গরম গরম মিটিং শেষ হয়েছে। সিদ্ধান্ত পাশ হতে ভোট করতেই হল, কারণ ডক্টর ক্রোল আর ডক্টর গুহ প্রথম থেকেই মুস্তাফির পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছিলেন। তবু কর্তব্য আগে। নিয়ম, অনুশাসন আগে। সেখানে ব্যক্তিগত সেন্টিমেন্টের কোনও মানে নেই। পৃথিবী আর সংস্থার জন্য যে ক্ষতিকর, তাকে চলে যেতেই হবে।
তিনি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা হলেও।
এই নিয়মাবলি ড. মুস্তাফির নিজের খসড়া করা। ভাগ্যের পরিহাসে নিজের নিয়মের ফাঁদে তিনি নিজেই ধরা পড়েছেন। অন্য কেউ হলে এই মিটিং-এর দরকারই পড়ত না। সরাসরি হত্যার আদেশ দিত সেন্ট্রাল কমিটি। আগেও দিয়েছে। এতক্ষণে মুস্তাফির দেহ শোভা পেত মাটির গভীরে রাখা ক্রায়োচেম্বারে। কিন্তু হাজার হোক ড. মুস্তাফি প্রায় একা হাতে এই সংস্থা গড়ে তুলেছেন। ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবী দখল করতে আসা প্রাণীদের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তাই এই মিটিং।
“কী ভাবছেন ড. ক্রোল? চিন্তা করবেন না। ঠান্ডা ঘরে খুব আরামেই থাকবেন ড. মুস্তাফি”, হাসি হাসি মুখে বললেন ড. মাধবন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই মৃত্যুদণ্ডটা এত তাড়াতাড়ি হল।
“কিন্তু তাতে কি কোনও সুরাহা হবে মাধবন? বিশেষ করে মুস্তাফির মতো একজন ইউএফও এক্সপার্টকে হারালে…”
ক্রোলের কথা শেষ হতে দিলেন না মাধবন। হাত তুলে থামিয়ে বেশ রূঢ় গলাতেই বললেন, “সেটা আমিও অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেই ড. মুস্তাফি আর আজকের মুস্তাফিতে আকাশপাতাল ফারাক। কুড়িটা বছর পেরিয়ে গেছে মাঝখানে। চেহারায় বোঝা না গেলেও আসলে ওঁর ভীমরতি ধরেছে। ওঁর ভুলেই আজ আমাদের বাহান্ন জন এজেন্ট মারা গেছে। পৃথিবীর সুরক্ষা বিপন্ন। কী জবাব দেবেন তাদের পরিবারকে? সবচেয়ে বড়ো কথা, কিছুদিন বাদে আমরা আদৌ বাঁচব কি না সেটা নিয়ে ভেবেছেন?” উত্তেজনায় মাধবনের মুখ লাল হয়ে গেল।
“মুস্তাফিকে মরতেই হবে।”
দুপুর দুটো ছয়, ড. মুস্তাফির চেম্বার
মাথার দুপাশের দুটো রগ চেপে ধরে বসে আছেন ড. অরবিন্দ মুস্তাফি। এ.সি.এ.-র বর্তমান প্রধান। চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফুটে উঠছে গত কুড়ি বছরের নানা দৃশ্য। কে ভেবেছিল এক অনামী, অখ্যাত জায়গা থেকে উঠে আসা অরবিন্দ মুস্তাফি একদিন পৃথিবীর অন্যতম সেরা সংগঠনের প্রধান হবে! কুড়ি বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম সমস্যাটা শুরু হয়। পৃথিবীর আশেপাশের গ্রহ, বিশেষ করে মঙ্গলের পরিবেশ বদলাতে থাকে দ্রুত। খুব স্বাভাবিকভাবেই মঙ্গলবাসীরা প্রতিবেশী গ্রহ পৃথিবীতে অনুপ্রবেশ শুরু করে। গোপনে। একের পর এক ইউএফও নামতে থাকে পৃথিবীর জনমানবহীন প্রান্তরে। নেভাদায়, থরে, আন্টার্কটিকায়। সেখান থেকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্বের নানা স্থানে। এর আগেও একবার এরা এসেছিল। সেবার দুটো ভুল করেছিল ওরা। এক, বড্ড তাড়াহুড়ো করে একবারে পৃথিবী দখলের চেষ্টা করেছিল, আর দুই, পৃথিবীর জীবাণুদের বিরুদ্ধে কোনওরকম সুরক্ষা নেবার কথা ভাবেনি।
কিন্তু এবার তাদের প্ল্যান অনেক বেশি স্থির, নির্ভুল। যাকে ইংরাজিতে অ্যাডাপ্টেশান বলে, সেই ক্ষমতা এদের অসীম। নতুন পরিবেশে মানুষের মতো চেহারা ধারণ বা ভাষা শিখতে মাত্র কয়েকদিন লাগত তাদের। তারপরেই পৃথিবীর মানুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে এরা বংশবিস্তারের চেষ্টা চালাত। ঠিক এখানেই প্রকৃতি তাদের সহায় হত না। এই সংকর প্রাণীরা দেখতে কদাকার, বিকৃত। চেহারা দেখেই তাদের আলাদা করা যায়। ক্রমাগত এদের সংক্রমণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর যিনি উদ্যোগ নেন, তিনি ড. মুস্তাফি। তিনিই প্রথম সরকারকে এসিএ স্থাপনের পরামর্শ দেন। সংকর প্রাণীদের দেখামাত্র হত্যার প্রস্তাবও তিনিই দিয়েছিলেন। এই সংস্থার সব নিয়ম তাঁর নিজের গড়া।
আজ তিনি জানেন কী পরিণতি অপেক্ষা করছে তাঁর সামনে। হয়তো পৃথিবীর সামনেও।
দুপুর দুটো আট, ড. মাধবনের চেম্বার
“আপনারা এত সেন্টিমেন্টাল কেন হচ্ছেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। মানলাম ইউএফও এক্সপার্ট, মানলাম সংস্থার প্রধান, কিন্তু আজ অবধি কাজের কাজটা তেমন কী করেছেন বলতে পারেন?” উত্তেজিত গলায় বলছিলেন মাধবন।
“সে তো আপনি বলবেনই”, গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বললেন মুস্তাফির অ্যাসিস্ট্যান্ট ড. শিশির গুহ। “আপনার প্রেসিডেন্ট হবার পথের কাঁটা তো একজনই ছিলেন। মুস্তাফি। এ কথা কে না জানে!”
“একদম বাজে কথা বলবেন না। আর মুস্তাফি নিজে কটা মঙ্গলবাসীকে ধরেছেন বলুন তো? একটাও না। সবসময় আমরা খবর পেয়ে গেছি আর গিয়ে দেখেছি ভাঙা ইউএফও-র টুকরোটাকরা পড়ে আছে। আমি নিজের হাতে দুটোকে ধরেছিলাম একবার। মানুষের মতোই দেখতে, মনে আছে আপনার?”
“হ্যাঁ, আর এটাও মনে আছে ইনভেস্টিগেশনের নামে আপনি অত্যাচার করে তাদের মেরে ফেলেছিলেন। আপনার যে কোনও বিভাগীয় তদন্ত হয়নি, সেটা কিন্তু মুস্তাফি স্যারের জন্যেই।”
“আমি তখনও বলেছি, এখনও বলছি, ওরা কীভাবে মারা গেল আমি জানি না। আগের দিন রাত অবধি একেবারে ঠিক ছিল। পরদিন এসে দেখি মরে পড়ে আছে। গোটা দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, কিচ্ছু নেই…”
“তারপরেও আপনি এই চেয়ারেই আছেন, ক্রায়োচেম্বারে ঢোকেননি, সেটা কার জন্য জানেন তো? ড. মুস্তাফির জন্য।”
“আর যে ক্ষতিটা করে গেলেন? সেটা তো বলছেন না… বহুদিন ধরে মঙ্গলবাসীরা চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে ওদের জিনের মিউটেশান ঘটানো যায়। তাহলে আর সংকর সন্তান বিকৃত হবে না। ওরা ইচ্ছেমতো চারিয়ে বসবে গোটা পৃথিবীতে। আর সেই কাজে ওরা প্রায় সফল। শুধু তাই না, আমাদের ইন্টেলিজেন্সের কাছে এটাও খবর ছিল যে ওরা এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, যাতে মঙ্গল থেকে পৃথিবী যাতায়াত করতে আর ইউএফও লাগবে না। কী ভয়ানক হবে বুঝতে পারছেন? এখন তাও আমাদের রাডার ওদের গতিবিধি ধরতে পারে, তখন তাও পারবে না।”
“এই নতুন পদ্ধতিটা কী?”
“সেটাই তো কেউ জানে না। তদন্তের প্রায় শেষ দশায় চলে এসেছিলাম। শুধু আপনাদের মুস্তাফির একটা ভুলে…”
দুপুর দুটো দশ, ড. ক্রোলের চেম্বার
গম্ভীর মুখে এসিএ-র গোপন রিপোর্টটা ওলটাচ্ছিলেন ড. ক্রোল। মোটা লাল ফাইলে দুশো পাতার রিপোর্ট। শেষে লেখা, “এসিএ-র গোপন কমিটি বাহান্ন জন সবচেয়ে দক্ষ কর্মীদের নিয়ে একটা সার্চ কমিটি তৈরি করে। এর প্রধান ছিলেন ড. মাধবন। এঁদের কাজ ছিল যে ল্যাবরেটরিতে মঙ্গলবাসীরা গোপনে মিউটেশান চালাচ্ছে, সেটা খুঁজে বার করা, আর জানা কীভাবে ইউএফও ছাড়া ওরা পৃথিবীতে আসার কথা ভাবছে। এই দলের নেতা ছিল জেরেমি সন্ডার্স নামে বছর তিরিশের এক ছোকরা। সব ঠিকঠাক চলছিল, শেষ খবরে সন্ডার্স জানায় সে খবর পেয়েছে কোথায় চলছে এই এক্সপেরিমেন্ট। তবে কাউকে জানায়নি। মাধবনকেও না। একদিন দলের বাহান্ন জনকে নিয়ে অতর্কিতে হানা দিয়েছিল সেই ল্যাবে। খুব সম্ভব যোগাযোগ করতে গেছিল হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু পারেনি। কারণ হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগের তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি সেদিনই বদলে দিয়েছিলেন ড. মুস্তাফি। সুরক্ষার জন্য এটা প্রায়ই করা হয়। কিন্তু করার আগে দেখে নিতে হয় কেউ কোনও মিশনে আছে কি না। একটা সামিট মিটিং করতে হয়। মুস্তাফি এসব কিচ্ছু না করে আচমকা ফ্রিকোয়েন্সি বদলে দেন। ফলে সন্ডার্সের দল আর যোগাযোগ করতে পারেনি।
পরের দিন তাদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো পাওয়া যায় এসিএ-র সদর দপ্তরের সামনে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ড. মুস্তাফি জানিয়েছেন, নিয়ম থাকলেও এই সামান্য কারণে মিটিং ডাকার প্রয়োজন হবে তিনি ভাবেননি। এর আগেও তিনি এই কাজ করেছেন। এবার যে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে তা বুঝতে পারেননি। তিনি প্রধান হলেও মাধবন তাঁকে এই মিশনের ব্যাপারে অন্ধকারে রেখেছিলেন। আগে জানা থাকলে তিনি এই কাজ কখনোই করতেন না।
মাথা নাড়লেন ক্রোল। আর কিচ্ছু করার নেই। নিয়ম নিয়মই। মুস্তাফিকে মরতেই হবে।
দুপুর দুটো বারো, ড. মুস্তাফির চেম্বার
ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালেন ড. মুস্তাফি। দুটো বারো। তিনি বুঝে গেছেন তাঁর জন্য ভবিষ্যৎ কী নিয়ে অপেক্ষায় আছে। নিজের হাতে গড়া এসিএ-র ক্রায়োচেম্বারে বরফের চাঁই হয়ে শুয়ে থাকতে পারবেন না তিনি। এই অপমানের মৃত্যু তাঁর জন্য নয়। চিরটাকাল যা করেছেন, আজও তাই করবেন। নিজের ভাগ্য গড়ে নেবেন নিজের হাতে। পৃথিবী থেকে বিদায় তাঁর নিজের ইচ্ছেমতোই হবে। কোনও মাধবন সেটা ঠিক করে দেবে না।
শেষটা বড্ড অপমানের হল। এমনটা হবে কখনও ভাবেননি মুস্তাফি। কী আর করা! সবকিছু তো আর নিজের হাতে থাকে না! চেম্বার খুলে ল্যাবে ঢুকলেন তিনি। অন্ধকার ল্যাব। জানলা খুলে দিতেই এক ঝলক রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিতরে। তিরিশ তলার ওপর থেকে গোটা শহরকে পিঁপড়ের মতো খুদে লাগছে। গুটিগুটি পায়ে জানলার কাছে দাঁড়ালেন মুস্তাফি। জোর হাওয়া বইছে। একটা চেয়ার নিয়ে কার্নিশে উঠে দাঁড়ালেন। আর কোনও ভয় নেই, কোনও খেদ নেই। অনেক হয়েছে। আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? তিনি জানেন তাঁর মধ্যে বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। কার্নিশে দাঁড়িয়ে দুহাত পাখির মতো মেলে দিলেন তিনি। ঝাঁপ দিলেন। নিচে নামতে থাকলেন…
…আর তারপরেই সোঁ করে উড়ে চললেন তাঁর নিজের গ্রহ মঙ্গলের উদ্দেশে।
লেখকের জবানি: কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখা খুব একটা হয়নি। এই গল্পের আইডিয়া মূলত একটা ছবি দেখে। উইল আইজনারের আঁকা সেই ছবিতে কোটপ্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক উড়ে উড়ে ভিনগ্রহে যাচ্ছেন। ভিনগ্রহী মানেই যে বিকট কিছু, সেই ধারণা দূর হয়েছিল সেদিনই। গল্প লেখার সময় সেটাই মাথায় ছিল আর কি…