সে এক অদ্ভুত পার্টি
“চল না”, ভিক বলল, “দারুণ মজা হবে!”
“না হবে না”, আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম; যদিও জানতাম আমার আপত্তি বেশিক্ষণ ধোপে টিকবে না।
“আরে সিরিয়াসলি বলছি, চ। অসাধারণ হবে”, ভিক ঘ্যানঘ্যান করে এক কথা প্রায় একশোবার বলে চলল, “কত সুন্দরী মেয়ে আসবে জানিস?” বলতে বলতে তার সাদা সাদা দাঁতগুলো যেন মুখের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।
আমরা দুজনেই লন্ডনের দক্ষিণে একটা বয়েজ স্কুলে পড়ি। ভিকের নানা সময় দু-একটা বান্ধবী থাকলেও আমার ভাগ্যে ঢুঁ ঢুঁ। মূলত ছেলেদের সঙ্গেই আমরা মিশি। ভিকের এক বন্ধু তাকে একটা পার্টিতে নেমন্তন্ন করেছে। সে যাবেই, আর আমি যেতে নারাজ। মুশকিল হল এই সপ্তাহে আমার মা বাবা কী একটা কনফারেন্সে বিদেশে গেছেন, আর গোটা হপ্তা আমি ভিকের বাড়ির অতিথি। না চাইলেও আমাকে ভিকের পিছু নিতে হয়েছে। কথা বলতে বলতে আমরা ইস্ট ক্রাইডন স্ট্রিটের একটা সরু গলি বেয়ে হাঁটছিলাম।
“এবারেও সেই গতবারের মতো হবে দেখিস। তুই দারুণ সুন্দরী একটা মেয়ে পটিয়ে তার সঙ্গে গপ্পে মজে যাবি, আর আমি রান্নাঘরে বসে তার মায়ের রাজনীতি কিংবা কবিতা নিয়ে বকরবকর শুনব”, আমি গজগজ করে বললাম।
“আরে! তোকে তো আগে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, নাকি? ওসব আমি তোকে শিখিয়ে দেব। মনে হয় এই রাস্তাটাই হবে”, ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বলল ভিক।
“সে কী! তুই বাড়ি চিনিস না?”
“অ্যালিসন একটা কাগজে রাস্তার নির্দেশ লিখে দিয়েছিল। সে কাগজ আমি ভুলে হলের টেবিলে ফেলে এসেছি। কোই বাত নেহি। বাড়ি আমি ঠিক খুঁজে নেব।”
“কী করে?”
“কিচ্ছু না। এই রাস্তা ধরে সো-ও-জা এগিয়ে যাব আর দেখব কোন বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। ব্যস।”
গোটা রাস্তাটা শুনশান। একটা বাড়ি দেখেও মনে হচ্ছে না যে সেই বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। চারিদিকে সরু সরু সব বাড়ি। সামনে জং ধরা গাড়ি, বাইক আর আবর্জনাভরা বাগানের টুকরো। রাস্তা জুড়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ। অজানা কোনও মশলার গন্ধের মতো। সেই রাস্তার শেষে আরও সরু, স্যাঁতসেঁতে একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। তেড়াসোয়ালা বাড়ি সব। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। সব কেমন অদ্ভুতভাবে চুপচাপ। নিস্তব্ধ।
“তোর তো মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার দরকারই নেই। তুই একবার হেসে তাকালেই কাজ হয়ে যায়। সবই তোর ব্যক্তিত্বের কামাল”, আমি বলেই ফেললাম।
“ধুসস, ওভাবে হয় নাকি? তোকে সাহস করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বুঝলি বুদ্ধুরাম!”
আমি জ্ঞানত কোনও দিন কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলিনি। জানি না কেমন করে বলতে হয়। সেটা এবার ভিককে বলেই ফেললাম।
“সত্যি! তুই এমন করছিস, যেন মেয়েরা কোনও অন্য গ্রহের জীব।”
রাস্তাটা ততক্ষণে একটা বাঁক নিয়েছে। আমিও বুঝে গেছি আমরা ভুল পথে এসেছি। এখানে কোত্থাও কোনও পার্টি হচ্ছে না। হঠাৎ খুব দূর থেকে বিকেলের সেই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা ভেঙে আমাদের কানে একটা চাপা বাজনার আওয়াজ এল। যেন বন্ধ দরজা জানলায় সেই আওয়াজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সেই শব্দের দিকেই হেঁটে গেলাম দুজনে। মোরাম বিছানো বিষণ্ণ রাস্তা, এলোমেলো কিছু গোলাপের ঝাড় আর ছোট্ট একটা অগোছালো বাগান পেরিয়ে দরজার সামনে এসে ভিক ডোরবেল টিপল। দরজা খুলল একটা মেয়ে। তার বয়স কত বলা মুশকিল। আসলে পাঁচ, সাত এমনকি দশ বছর অবধি ছেলে আর মেয়েরা প্রায় একভাবে বেড়ে ওঠে, তারপরই কেমন দুম করে মেয়েরা বড়ো হয়ে যায়। তবে দেখে মনে হল মেয়েটা আমাদেরই বয়সি।
“হ্যালো”, বলল মেয়েটা।
ভিক তড়বড় করে বলে চলল, “আমরা দুজন অ্যালিসনের বন্ধু। ওই যে কমলা রঙের চুল, হাসি হাসি মুখ, হামবুর্গে বাড়ি… ওর।”
“ও তো এখানে নেই। নাহহ”, দরজায় দাঁড়িয়েই মেয়েটা জবাব দিল।
“সে কোনও ব্যাপার না। আমি হলুম ভিক আর এই হল আমার বন্ধু এন”, বলেই ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া উপহারটা বার করে ভিক বলল, “এটা তবে কোথায় রাখব?”
এবার মেয়েটা দরজা ছেড়ে দাঁড়াল।
“ওই টেবিলে রেখে দাও।”
মেয়েটার চুল সোনালি, ঢেউখেলানো। সত্যি বলতে কী, এত সুন্দর মেয়ে আমি জন্মে দেখিনি। নাম বলল স্টেলা। শুনেই ভিক একগাল হেসে জানাল এত সুন্দর নাম সে আগে শোনেনি। ব্যাটা শয়তান! সব্বাইকে এই এক কথা বলে। মেয়েটা আমাদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা মিউজিক সিস্টেমে জোরে জোরে গান বাজছে। কয়েকটা মেয়ে আগে থেকেই নাচছিল। তখন পার্টির গান মানেই আমরা বুঝতাম স্ট্র্যাংলার, এলো ব্যান্ড কিংবা নিল ইয়ং-এর হারভেস্ট। কিন্তু এই ঘরে যে গান বাজছিল তা আমার চেনা কোনও গানের মতো না। এই অদ্ভুত ধাতব সুর পৃথিবীর কোনও যন্ত্র সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার জানা নেই। গোটা ছয়েক আমাদের বয়সি মেয়ে ধীর লয়ে সেই সুরেই নাচছিল। সঙ্গে স্টেলাও।
ভিক যথারীতি স্টেলার সঙ্গে আলাপ জমাল। ওরা কী বলছে, তা এই আওয়াজে শুনতে পাচ্ছিলাম না। বিরক্ত হয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম। কিচেন টেবিলে বেশ বড়ো বোতলে কোকোকোলা রাখা। একটা প্লাস্টিকের কাপে তারই কিছুটা ঢেলে আমি মেয়ে দুটোকে খেয়াল করলাম। মাটিতে থেবড়ে বসে তারা গুজগুজ করে গল্প করছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো। তাতে আলো পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে এমন চকচকে। পোশাক সিনেমা আর্টিস্টদের মতো। মাথা নেড়ে নেড়ে অদ্ভুত বিজাতীয় এক ভাষায় তারা গল্প চালিয়ে যাচ্ছে।
হাতে কোকের গেলাসটা নিয়ে ভিতর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরটা এত বড়ো আর এতগুলো ঘর। কিন্তু সব ঘরেই কেমন আবছা আবছা অন্ধকার, যেন চল্লিশ ওয়াটের নিভু নিভু বালব জ্বালা। সবকটা ঘরেই দু-তিনজন করে মেয়ে বসে আছে। সবাই বিদেশি বলেই মনে হল। এমন মেয়েদের আমি আগে দেখিনি। এক কোণে কাচের গোল টেবিলে ধবধবে সাদা চুলের একটা মেয়ে উদাস চোখে বাইরের সন্ধে নামা দেখছিল। তার চুল কোমর ছুঁয়েছে।
“আমি একটু তোমার পাশে বসতে পারি?” সাহসে ভর করে বলেই ফেললাম।
মেয়েটা উত্তর দিল না। শুধু বিষণ্ণ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। আমি ওর পাশের চেয়ারে বসলাম। তাকিয়ে দেখি ভিক আর স্টেলা হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে। আমি দোতলায় উঠিনি। জানি না ওখানে কী আছে। ভিক আমার দিকে চেয়ে একবার শুধু ঠোঁট নেড়ে বলল, “কথা বল।”
“তুমি কি এখানেই থাকো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আবার মেয়েটা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
“আমি এন। তোমার নাম কী?”
“আমি ওয়েইনের ওয়েন। আমি দ্বিতীয়।”
“ওহহ… বাঃ, বেশ অন্যরকম নাম তো তোমার”, এ ছাড়া আর কী বলব বুঝলাম না।
মেয়েটা তার ছলছলে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এর মানে আমার স্রষ্টার নাম ওয়েইন। আমাকে ফিরে গিয়ে ওঁর কাছেই রিপোর্ট করতে হবে। আমি এই পৃথিবীতে বংশবিস্তার করতে পারব না।”
“মানে?”
মেয়েটা নিজের আঙুলগুলো টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে দিল। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা অদ্ভুত। ডগাটা সমান দুই ভাগে বিভক্ত। গাছের ডালের মতো।
“আমাকে যখন তৈরি করেছিল, তখন থেকেই এই গণ্ডগোলটা রয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিল আমায় ধ্বংস করে দেবে। ভাগ্য ভালো করেনি। কিন্তু এখন আমায় ফিরে যেতে হবে। আমার জায়গায় আমার নিখুঁত বোনেরা আসবে। বংশবিস্তার করবে। ওরা প্রথম। আমি দ্বিতীয়। আমাকে শিগগির ওয়েইনে ফিরে গিয়ে জানাতে হবে তোমাদের এখানে আমি কী কী দেখলাম।”
“আমিও আসলে এখানকার না। আমিও ক্রাইডনে থাকি না।” আমি বোকার মতো বললাম। মেয়েটা কি তবে আমেরিকান? আমি ওর কথার কোনও মানেই বুঝতে পারছিলাম না।
“হ্যাঁ, সে তো বটেই”, মেয়েটা বলে চলল এক নিঃসঙ্গ স্বরে, “আমরা কেউই তো এখানকার না, তাই না? আমি আসার আগে ভেবেছিলাম এই জায়গা কত বড়োই না হবে। যাক, তবু জায়গাটা দারুণ”, বলতে বলতে সে চট করে নিজের বাঁ হাতটা ডান হাতের তলায় লুকিয়ে ফেলল। তারপর অগোছালো একটা হাই তুলে বলল, “ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত। সেদিন ব্রাজিলে রিওর কার্নিভালে ওদের দেখলাম। সোনালি রং। লম্বা। আর চোখ দুটো পোকাদের মতো। আমি তো দেখেই ছুটে হ্যালো বলতে গেছি। গিয়ে দেখি ওমা! এ তো কতগুলো মানুষ কস্টিউম পরে সেজেছে। আমি হোলা কোল্টকে বললুম, ‘হ্যাঁ রে ওরা আমাদের মতো সেজেছে কেন?’ হোলা বললে, ওরা নাকি আসলে নিজেরাই নিজেদের চেহারা পছন্দ করে না। সবার রং হয় গোলাপি, নয় বাদামি। আর কী বেঁটে। ম্যাগো! কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। এই যে আমি, এখনও পুরো বাড়িনি, আমারই ওদের কেমন বামনবীর বলে মনে হয়, তো হোলার কী দোষ?”
তারপর এই প্রথম একগাল হেসে মেয়েটা বলল, “ভাগ্যিস মানুষগুলো হোলার আসল রূপ দেখেনি!”
“হুমম, তুমি নাচবে আমার সঙ্গে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে মেয়েটা আপত্তি জানাল। “নিয়ম নেই। আমি ওয়েইনের সম্পত্তি। আমি এমন কিছু করতে পারব না যাতে সেই সম্পত্তির ক্ষতি হয়।”
“তোমায় কিছু এনে দেব?”
“শুধু জল।”
আমি কিচেন থেকে নিজের জন্য কোক আর মেয়েটার জন্য জল এনে দেখলাম চেয়ার ফাঁকা। বেশ অবাক হয়ে সামনের ঘরে উঁকি মারলাম। দেখলাম প্রচুর মেয়ে আর কিছু ছেলেও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ভিকও নাচছে, স্টেলার সঙ্গে। খুব সম্ভব মেয়েটা দোতলায় গেছে, কারণ নিচে কোথাও ওকে দেখতে পেলাম না। হেঁটে লিভিং রুমের সোফায় বসলাম। একটা মেয়ে আগে থেকেই সোফার অন্য কোণে বসে ছিল। ছোটো ছোটো কালো চুল। স্পাইক করা। ভিকের উপদেশ মনে পড়ল। কথা বলতে হবে।
“উমম, এই মগের জলটা তুমি নিতে পারো, লাগবে?” খুব সন্তর্পণে, যেন কোনও দিনও কেউ তাকে কিছু দেয়নি, এমনভাবে আলগোছে মেয়েটা জলের মগটা ধরল। তারপর অল্প হেসে বলল, “আমার ঘুরতে খুব ভালো লাগে।” যেন দামি কোনও শরবত খাচ্ছে এভাবে জলের মগে হালকা চুমুক দিতে দিতে জানাল, “শেষবার সূর্যে গেছিলাম। সেখানের তাপপ্রবাহের সমুদ্রে তিমিদের সঙ্গে খেলেছি আমি। আসলে মহাশূন্যে ঠান্ডায় প্রায় জমে গেছিলাম। ভাগ্যিস সূর্যটা বেশ উষ্ণ! আমি চলে যাব ভাবছিলাম। কিন্তু কত কিছু দেখাই বাকি বলো! তার বদলে এখানে চলে এলাম। তোমার এই জায়গাটা ভালো লাগে?”
“মানে?”
কোচের একপাশে হেলান দিয়ে সে বলল, “আমার ওই একরকম লাগে। অনেকবার মা বাবাকে বলেছি পৃথিবীতে আসব না। শুনল না। এখানে নাকি অনেক কিছু শেখার আছে। সে তো সূর্যতেও শেখা যায়। জেসা তো আজ এই গ্যালাক্সি কাল ওই গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়ায়। আমিও তেমন করতে চাই। আমার এই জায়গাটা একদম ভালো লাগে না। আমাকে নিয়ে একটা ক্যালসিয়ামের ফ্রেমে বাঁধানো গদগদে মাংসপিণ্ডের মধ্যে পুরে দিয়েছে। অসহ্য! শুধু মনে হয় কবে মুক্তি পাব। সবচেয়ে বড়ো কথা মুখ দিয়ে হাওয়া নিয়ে স্বরযন্ত্র নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলাটাও কী বিরক্তিকর! আমি বলে দিয়েছি, একদিন আমি নিশ্চিত মারা যাব। এই জগৎ থেকে মুক্তি পাবার নাকি সেটাই একমাত্র উপায়।”
আমি ধীরে ধীরে ওর দিকে এগোলাম। ওর চোখে জলের বিন্দু চকচক করছে, “আচ্ছা, এই যে তরল পদার্থটা চোখে এলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, কেন বলো তো? কেউ আমায় আজ অবধি বলেনি। আমি আজও বুঝে উঠতে পারি না!”
মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।
হঠাৎ দেখি দরজার সামনে ভিক আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাশেই স্টেলা। আমি যেতেই ভিক লজ্জিতভাবে বলল, “এই শোন না, আমরা ভুল পার্টিতে চলে এসেছি। এইমাত্র স্টেলার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম।”
“সে কী? আমাদের তাহলে চলে যেতে হবে?”
“সেরকম কিছু না। আসলে এরা সব ট্যুরিস্ট। ফরেন এক্সচেঞ্জে যেমন হয়, তেমনই। অনেকে জার্মানি থেকে আসে, যেমন অ্যালিসন এসেছে। তুই কথা বলছিস তো সবার সঙ্গে? আমি আর স্টেলা একটিবার দোতলা থেকে ঘুরে আসি, কেমন?”
স্টেলাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। গোটা পার্টিতে সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু যথারীতি ভিকের মিষ্টি কথায় মজে ও আমায় পাত্তাও দিচ্ছে না। ঘরে কেউ গল্প করছে, কেউ মজাদার চুটকি বলে সবাইকে হাসাচ্ছে, কিন্তু অনেক খুঁজেও আমি সেই কালো স্পাইক চুলের মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না। হয়তো দোতলায় গেছে। ঘুরতে ঘুরতে আবার কিচেনেই ঢুকলাম। প্রচুর খাবার আর পানীয় রাখা। আমি একটা প্লাস্টিকের কাপে কোক আর বরফ নিলাম।
“কী খাচ্ছ তুমি?” একটা মেয়েলি গলা ভেসে এল।
“বরফ দিয়ে কোক।”
“আমায় দেবে?”
আমি একটা গ্লাসে ঢেলে দিতে গিয়ে মেয়েটার মাথাজোড়া ঝাঁকড়া টকটকে তামাটে চুল দেখে বেশ অবাক হলাম। চুলগুলো সব আংটির মতো প্যাঁচালো।
“কী নাম তোমার?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“ট্রায়োলেট।”
“সুন্দর নাম”, বলেই আমার ভিকের কথা মনে পড়ল।
“আসলে এটা একটা কবিতা। আমার মতো।”
“তুমি একটা কবিতা?”
মেয়েটা হাসল। তার টিকালো নাক গ্রিক অ্যান্টিগোনের কথা মনে পড়ায়, কিংবা ব্যারি স্মিথের আঁকা কোনান কমিকসের মহিলাদের কথা।
“হ্যাঁ, কখনও আমি কবিতা, কিংবা একটা প্যাটার্ন, অথবা একটা জাতিও বলতে পারো।”
“তা কী করে হয়? একজন মানুষ একসঙ্গে তিনটে জিনিস হবে কীভাবে?”
“আচ্ছা তুমি বলো তোমার নাম কী?”
“এন।”
“দ্যাখো এন, তুমি একজন মানুষ। একজন পুরুষ। আবার একজন দ্বিপদ।”
“সে তো একটা জিনিসকেই তিনভাবে বলা, আলাদা কিছু না।”
মেয়েটা তার ডাগর দুটো চোখ বড়ো করে তাকাল। চোখের রং হালকা সবুজ। যেন কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেছে। ফিসফিস করে বলল, “সব বিভেদ দূর করে দেব আমরা। সবকিছু মিলেমিশে একটা কবিতা হয়ে যাবে। এই মহাবিশ্ব। এই পৃথিবী। আমরা যেখান থেকে এসেছি, যেখানে চলেছি, আমাদের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা এক কাব্যের রূপ নেবে। তারপর দূরতর নক্ষত্রে আমরা সেই কাব্যের তরঙ্গকে পাঠাব। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে সে কবিতা ভাঙবে, জুড়বে, আবার নতুন এক কবিতার রূপ নেবে।”
“আর তারপর?”
“তারপর তুমি বদলে যাবে। যেভাবে প্রতিটা কবিতাপাঠ তোমায় একটু একটু করে বদলে দেয়। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ এক নিরবচ্ছিন্ন কবিতা হয়ে যাবে, যার অংশ তুমি, আমি, আমরা সবাই।”
একটু থামল মেয়েটা। কী যেন ভাবল। তারপর আবার বলল, “এই মহাবিশ্বে কেউ আমাদের স্বাগত জানিয়েছে, আবার কেউ এমন আচরণ করেছে যেন আমরা কোনও নোংরা আগাছা। অথবা কোনও ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু এই ঘৃণা, এই দ্বেষের শেষ কোথায়?” আমার কানের খুব কাছাকাছি ঠোঁট নিয়ে সে তার অদ্ভুত সুরে কী যেন বলে চলল। আমি সে ভাষার একটা বর্ণও বুঝলাম না। শুধু এতটুকু বুঝলাম যা শুনছি, তা আমার জীবনে শোনা মধুরতম কবিতা। আমি আগে কোনও দিন তা শুনিনি। ভবিষ্যতেও শুনব না। একটা বর্ণ না বুঝেও প্রতিটা শব্দ যেন আমার বহুকালের চেনা বোধ হচ্ছিল। মনে হল শব্দের এক অনন্ত মহাসাগরে আমি যেন নিঃসীম ভেসে চলেছি।
চমক ভাঙল ভিকের এক ধাক্কায়।
“শিগগির চল এখান থেকে। পালা এক্ষুনি।”
যেন শতসহস্র মাইল পেরিয়ে এক ধাক্কায় সেই ঘরে ফিরলাম। আমি চাইছিলাম সে কবিতার শেষটা শুনতে।
“পরে হবে। এখন ভাগ!” বলে আমার হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে ভিক আমায় হলঘরে নিয়ে এল। আমি পিছন ফিরে কিচেনে তাকিয়ে ট্রায়োলেটকে খুঁজলাম। কিচেন ফাঁকা। কেউ নেই। শুধু সিঁড়ির মাথায় স্টেলা একলা দাঁড়িয়ে। গত তিরিশ বছরে সেই দৃশ্য আমি ভুলিনি। মৃত্যুর আগেও ভুলব না। স্টেলার চোখ… দেখে মনে হল গোটা বিশ্বের ক্রোধ যেন জ্বলন্ত অগ্নির মতো ঠিকরে বেরোচ্ছে সেই চোখ থেকে। অমন টকটকে লাল জ্বলন্ত চোখ পৃথিবীর কোনও প্রাণীর হয় বলে আমার জানা নেই।
আমরা পালালাম।
পার্টি, ট্যুরিস্ট, বাজনা সব ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমরা পালালাম। যেন তীব্র বজ্রপাতে দিশাহারা দুটি জীব। কীভাবে সেই গলির ভুলভুলাইয়া পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় এলাম মনে নেই। দেওয়ালে ভর দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ভিক শুধু বলল, “আরে এ তো আসলে…” বলেই দুদিকে জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকল।
“কিছু জায়গা আছে, যেখানে কোনও দিন যেতে নেই।”
দেখলাম ভিকের দুই চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ছোট্ট বাচ্চার মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ভিক। উপরের দোতলার ঘরে কী ঘটেছে আমি জানি না, কিন্তু যাই ঘটুক, তা তার অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে চিরকালের মতো। সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে। ভিক সামনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। আর আমি পিছনে পিছনে সেই কবিতার সন্ধানে, যা আর কোনও দিন আমি শুনতে পাব না।
অনুবাদকের জবানি: নিল গাইম্যানের কাহিনি অনুবাদ যে-কোনো অনুবাদকের স্বপ্ন। এই গল্পটা How to talk to girls at parties প্রথমবার পড়েছিলাম কমিকস আকারে। গ্যাব্রিয়াল বা আর ফাবিও মুনের অসামান্য সেই রূপদান যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানেন। বাঙালি পাঠকের কাছে গাইম্যান এখনও তত পরিচিত নাম নন। তাই কিশোর ভারতীর অনুবাদ সংখ্যায় এই গল্পটাই অনুবাদ করি আমি। এপার বাংলায় গাইম্যানের অনুবাদ সেই প্রথম।