পাকড়ো-ছোড়ো
অনেকদিন ধরে মাছ ধরলে জলকে চেনা যায়। চেনা যায় বিশাল দিঘির এক-একটা জায়গাকে… বহু বছর মাছ ধরার অভিজ্ঞতা থেকে সেই সব জায়গায় ফিরে আসতে হয় প্রতি বছর। নির্দিষ্ট ঋতুতে ঋতুতে। জানা যায় ঠিক কেমন পরিবেশ অপেক্ষা করছে সেখানে কিংবা কী চার জলে ফেললে মাছ আসবেই। এই সমস্ত কিছু ঠিকঠাক হবার পরে জলে চার ফেলে চলে অনন্ত প্রতীক্ষা… বাকিটা ভাগ্যের হাতে।
মাছ যদি চার না ঠোকরায়, তবে একসময় সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। নতুন জায়গায়, নতুন মাছের সন্ধানে।
***
ডান দিকের লেনটা ধরে ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে একটা বড়ো এসইউভি চালিয়ে অন্য রাজ্যের দিকে পাড়ি দিচ্ছিল লোকটা। প্রতিটা লেন পেরোবার সময় এক-একবার সে গাড়ির গতি কমিয়ে দিচ্ছিল আপনা থেকেই। খেয়াল রাখছিল পথে কোনও হিচহাইকার গাড়ির লিফটের জন্য বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে কি না। সামনেই চারটে বড়ো বড়ো রাস্তার মোড়। এখানে প্রচুর ছাত্রদের জটলা। ওদের সবসময় কোথাও না কোথাও যাবার দরকার হয়। কেউ ক্যাম্পাস যাচ্ছে, কেউ বাড়ি ফিরছে… এত কোথায় যায় কে জানে! বুড়ো আঙুল দেখিয়েই রয়েছে। লোকটা চারটে রাস্তার মোড় পেরিয়ে গেল। সামনে আরও একটা রাস্তা। সেটা দিয়ে ঢুকে সোজা দক্ষিণমুখো যাত্রা করল সে। তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। এসব কাজে তাড়াহুড়ো চলে না।
প্রতিটি মোড়ে মোড়ে হিচহাইকাররা দাঁড়িয়ে। তাদের অনেকেই জিনস আর ব্রা-বিহীন টিশার্টে বেশ সুন্দরী। কিন্তু লোকটা তার গতি কমাল না। প্রতিটি মেয়েই সঙ্গে একজন পুরুষ নিয়ে অপেক্ষা করছে। একা যারা তারা সবাই পুরুষ। লোকটা পুরুষে আগ্রহী না। ওর চাই মেয়ে। একা, অপেক্ষমাণ, সুন্দরী মেয়ে।
***
লুক- ৫.৫- “আমরা সারারাত মাছ ধরলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না।”
অনেকসময় সারাদিন গাড়ি চালাতে হয়, শুধু পেট্রোল ভরার জন্য থামতে হয় একবার। সত্যিকারের মাছ শিকারি সারারাত মাছ ধরতে গিয়ে কোনও মাছ না পেলেও ভাবে না তার সময়টা নষ্ট হল। তাকে শান্ত থাকতে হবে। মনকে নিয়ে যেতে হবে সেইদিনের ঘটনায়, যেদিন ছিপ ফেলেই সে বিরাট একটা মাছ ধরেছিল। কীভাবে চার ফেলা মাত্র মাছেরা খলবল করে দৌড়ে এসেছিল তার দিকে, কীভাবে সে তাদের খেলিয়ে খেলিয়ে ডাঙায় তুলেছিল।
তারপর তপ্ত কড়াইতে ভেজেছিল।
***
লোকটা মেয়েটার জন্য দাঁড়াল। একলা মেয়ে। তাকে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটা মাটিতে রাখা ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে হেলেদুলে গাড়ির সামনে এল। লোকটা গাড়ির কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবে। মেয়েটি অনেকক্ষণ ধরে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন মনে মনে ঠিক করছে এর সঙ্গে যাওয়া উচিত কি না। তারপর প্রায় পঞ্চাশ- ষাট মাইল দূরের একটা শহরের নাম বলল।
“কোনও সমস্যা নেই,” লোকটা বলল, “সামনের দরজা খুলে ঢুকে পড়ো।”
পিছনের সিটে ব্যাগটা ছুড়ে দিয়ে, সামনের দরজা খুলে মেয়েটা লোকটার পাশে বসে সিটবেল্ট আটকে নিল। ক্লিক আওয়াজ শোনা গেল স্পষ্ট। মেয়েটা বলে চলছিল ও কতটা কৃতজ্ঞ যে ওকে লিফট দেওয়া হল, লোকটিও যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে চলছিল, কিন্তু ওর মন ভাবছিল অন্য কথা। গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে মেয়েটা কী ভাবছিল? কীভাবে মেয়েটা বুঝল যে ওকে বিশ্বাস করা যায়? ও দেখতে একেবারে সাধারণ। অন্য দশটা মানুষের থেকে আলাদা করা যাবে না কোনও মতেই। অনেকদিন আগে ও একবার গোঁফ রেখেছিল। ভেবেছিল, এতে ওর ব্যক্তিত্ব বাড়বে। পরে দেখল এসবে কিছু হয় না। তাই কামিয়ে ফেলেছিল।
আবার ফিরে গেছিল সেই মুখে, যা বৈশিষ্ট্যহীন, সাধারণ… দেখলেও আলাদা করে মনে রাখা যায় না।
***
“আপনিও মাছ ধরেন? আমার বাবা মাছ ধরে, জানেন তো”, মেয়েটা বলছিল, “বছরে এক দুবার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সপ্তাহান্তে বাবা মাছ শিকারে যায়। ফিরে আসে বাক্সভরা বরফে ঠাসা মাছ নিয়ে। মা সেগুলোকে নিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে। প্রায় এক হপ্তা জুড়ে সারা বাড়িতে কেমন একটা মাছ মাছ গন্ধ ছাড়ে।”
“না না, আমি তেমন নই। আমি হলাম সেইরকম মাছ শিকারি, যাকে লোকে পাকড়ো-ছোড়ো মাছুয়া বলে।”
“আপনি বাড়িতে বরফের বাক্স ভরে মাছ নিয়ে আসেন না?”
“আমার বরফের বাক্সই নেই। মানে ছিল এককালে। তারপর আমি দেখলাম শিকারের মজা শিকার করাতেই। আমি মাছ ধরি, মুখের থেকে বঁড়শিটি খুলে নিয়ে আবার তাকে সযত্নে জলে ছেড়ে দিই।”
মেয়েটা খানিক চুপ রইল। যেন এই ব্যাপারটা বেশ আমোদ দিল ওকে।
“কিন্তু মাছের কেমন লাগে? মাছ কি মজা পায়? জানি না”, লোকটা বলে চলে, “এটাও জানি না মাছের ক্ষেত্রে আদৌ মজা পাওয়া ব্যাপারটা প্রযোজ্য কি না। মাছেরা যখন বাঁচার জন্য ছটফট করে, নিঃশ্বাস নেবার জন্য প্রাণপণ লড়াই চালায়, সেটা কি তাদের মজার লাগে? মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, যখন তাদের ছেড়ে দিই আর তারা সাঁতরে চলে যায়, তখন আমার কেন যেন মনে হয় এই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে ওরা খুশি। আমি নিজে কোনও দিন ওদের জায়গায় আসিনি… তাই সঠিক বলা মুশকিল।”
“আমার মনে হয় মজা পায় না।”
“শুধু একটা জিনিস ভাবি, এর পরের বার আবার মুখের সামনে একটা বঁড়শি এলে ওই মাছটা কি পালাবে? না আবার স্বেচ্ছায় বঁড়শি গিলে নেবে, এই ভেবে যে, সেই মাছ শিকারি আবার ওকে ছেড়ে দেবে।”
মেয়েটা অনেক ভেবে বলল, “ওরা তো আর মানুষ না, মাছ। এতটা কি ভাববে?”
“ঠিক বলেছ”, লোকটা বলল, “হক কথা।”
***
মেয়েটা দেখতে দারুণ সুন্দর। বিজনেস ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছে। পড়তে খুব ভালোবাসে আর তাই বেশিরভাগ বিষয় ইংরেজিতেই পড়ে। মাথার চুল বাদামি, সুন্দর ফিগার, পীনোন্নত স্তনযুগল, ভারী নিতম্ব। “সন্তানধারণের জন্য আদর্শ” লোকটা ভাবে। তিনটে চারটে বাচ্চা হবে আর প্রতিবার বাচ্চা হবার সময় ওজন একটু একটু বাড়বে। শেষে ওজনের উপর আর কোনও রাশ থাকবে না। আর মুখটা, এখনই বেশ গোলগাল। তখন তো থ্যাবড়া হয়ে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। চোখের এই উজ্জ্বল ভাবটাও নষ্ট হবে একেবারে। এখনও সময় আছে মেয়েটাকে কুৎসিত হবার থেকে রক্ষা করার…
***
“আপনি প্লিজ ওই মোড়টায় আমাকে ছেড়ে দিন”, মেয়েটা একটা রাস্তা দেখিয়ে বলল।
“ওহহ, আমরা পৌঁছে গেছি?”
“হ্যাঁ, একদম। একটু সাইড করে দাঁড়িয়ে যান। আমি কোনাটায় নেমে যাব…”
কোনায় একটা একটেরে বাড়ির সামনে দাঁড়াল গাড়িটা। মেয়েটা পিছন থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে নিল। লোকটাও কিছুটা এগিয়ে দিল ওকে। বিদায় নেবার সময় আচমকা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, একটা কথা ছিল। আগেই বলতাম। কিন্তু তোমায় আপসেট করতে চাইনি।”
“বলুন।”
“এই যে তুমি অচেনা লোকের গাড়িতে এতটা হিচহাইক করে এলে, তোমার ভয় করল না?”
“ভয়ের কী আছে? সবাই তো করে…”
“তা করে, কিন্তু তুমি একজন সুন্দরী মেয়ে… এভাবে একা একা…”
“আমি একা কোনও দিনও আসি না, দুই বা তিনজন মিলে আসি। এই প্রথমবার একা এলাম।”
“তার মানে তুমি বেশ ঝুঁকি নিয়েছ, বলো…”
“তাতে কী? সব তো ঠিকঠাকই গেল।”
লোকটা খানিক চুপ রইল। তারপর মেয়েটার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, “মাছ ধরার গল্পটা মনে আছে তো? মাছকে জলে ছেড়ে দিলে সেই মাছের কেমন লাগে… মনে রেখো সবাই কিন্তু আমার মতো পাকড়ো-ছোড়ো মেছুয়া হয় না।”
গাড়ি ঘুরিয়ে লোকটা যখন রাস্তায় উঠল, মেয়েটা তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
***
বাড়িতে যখন ফিরল লোকটা, তার মন খুশিতে ভরা। এই বাড়িতেই তার জন্ম। দশ বছর আগে মায়ের মৃত্যুর পর এক রাতও সে এই বাড়ির বাইরে কাটায়নি। ডাকবাক্স খুলে দেখল খান ছয়েক চিঠি। সবকটাই মাছ ধরার কোনও না কোনও সরঞ্জামের অর্ডার। ও জানে এই ব্যবসাটা অনলাইনে করে খদ্দেরদের ক্রেডিট কার্ডে টাকা মেটাতে বললে লাভ অনেক বেশি, কিন্তু ওর খুব বেশি টাকার দরকার নেই। বরং যা চলছে, যেমন চলছে, সেটাই ভালো। সে মাসে মাসে একই ম্যাগাজিনে একই বিজ্ঞাপন দেয়, সেই পুরোনো খদ্দেররাই জিনিসের অর্ডার দিয়ে চলে, মাঝে মাঝে দু-একটা নতুন খদ্দেরও পাওয়া যায় বইকি।
একটু বিশ্রাম নিয়ে বড়ো এক প্লেট পাস্তা বানাল সে, সঙ্গে মাংসের সুরুয়া আর লেটুস দেওয়া স্যালাড। স্যালাডে অল্প অলিভ অয়েল ছড়িয়ে দিল স্বাদের জন্য।
রান্নাঘরের টেবিলে বসে খেয়ে, থালাবাসন ধুয়ে, টিভি-তে খবর দেখতে বসল লোকটা। খবর শেষ হলে আওয়াজটা কমিয়ে আজকের মেয়েটার কথা ভাবতে লাগল। কল্পনায় দেখতে থাকল ফাঁকা রাস্তা, তাতে একলা মেয়েটা, মুখে টেপ দিয়ে আটকানো, দুটো ভাঙা হাত নিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছে। ধীরে ধীরে মেয়েটার গায়ের সমস্ত জামাকাপড় খুলে নিল সে। মেয়েটার শরীরের সবকটা ছিদ্রতে বিঁধিয়ে দিল ধারালো অস্ত্র। যন্ত্রণা আর তার সঙ্গে ভয়… এই না হলে চলে!
মেয়েটার ভবযন্ত্রণা ঘোচাল ধারালো ছুরির এক মোচড়ে। না, না… নিজের হাতে গলা টিপে। ওর ডান হাত মেয়েটার গলায়, চাপ আস্তে আস্তে বাড়ছে… মেয়েটার নিঃশ্বাস জোরে হতে হতে বন্ধ হয় গেল… আঃ কী আনন্দ!! আবেশে লোকটার চোখ মুদে এল। যেন সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটেছে।
কিন্তু আদতে কিচ্ছু ঘটেনি। সে নিজের দরজার বাইরে বেরোয়নি। আর তাই কোনও বরফের বাক্স নেই, কোনও দেহ নেই, এক হপ্তা ধরে পরিষ্কার করার ঝামেলা নেই।
এটাই এই খেলার মজা। পাকড়ো— ছোড়ো। পাকড়ো— ছোড়ো। ব্যস…
***
ভাঁটিখানাটার একটা নাম আছে, টডল ইন। কিন্তু কেউ একে ওই নামে ডাকে না। সবাই একে রয়ের ভাঁটিখানা বলে। লিভারের অসুখে মারা যাবার আগে প্রায় পঞ্চাশ বছর রয় এই দোকানের মালিক ছিল। গত পরশু সেই সুন্দরী হিচহাইকারকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার পর আজ লোকটার একটু ভাঁটিখানায় যেতে ইচ্ছে হল। এটা তার চার নম্বর ভাঁটিখানা। প্রথমটায় সে একটা বিয়ার খেয়েছিল, দ্বিতীয়তে কোনও অর্ডার না দিয়েই বেরিয়ে আসে, তৃতীয়তে শুধু এক গ্লাস কোকাকোলা। এখানেও এক গ্লাস বিয়ারের অর্ডার দিয়ে লোকটি অপেক্ষা করতে লাগল। একটা গান মনে পড়ল আচমকা—
এক পাঁইট বিয়ারে
আধা পাঁইট জল,
ভাঁটিখানা মালিকের
বুদ্ধির ফল।
এই বিয়ারটাও কেমন জলজলে। কিন্তু বিয়ার নিয়ে ওর কোনও আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ ছিল যার জন্য ও এখানে এসেছে… সেটা নিয়ে।
দুটো টুল দূরেই মেয়েটা বসে। আচমকা দেখলে মনে হয় সেই হিচহাইকার মেয়েটা কিংবা ওর বড়দি। কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলে ভুল ভাঙে। এর ব্লাউজটা অনেকটাই ছোটো, সেই অভাব পূরণ করতে উপরের দুটো বোতাম খামোখা খুলে রাখা। হাতে লম্বা ডাঁটিওয়ালা গেলাস, উপরে কমলালেবুর খোসা ভাসছে। ঠোঁটের লিপস্টিক জ্যাবরানো, নখের নেলপলিশ এদিক ওদিক থেকে উঠে গেছে।
মেয়েটা চুমুক দিতে গিয়ে দেখল গ্লাস খালি। বেশ অবাক হয়েই কী করবে ভাবছে, এমন সময় লোকটা হাত দিয়ে বারম্যানকে ইশারা করে মেয়েটার গ্লাস ভরে দিতে বলল। প্রথম চুমুকটা দিয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকাল।
“ধন্যবাদ, আপনি সত্যিকারের ভদ্রলোক।”
“আমি এক মাছ শিকারি”, মেয়েটির কাছে ঘেঁষে বসে বলল লোকটা।
***
কোনও কোনও সময় চারে কী আছে তা ভাবার দরকারই হয় না। অনেকসময় বঁড়শিতে চার দিয়ে জলেও ফেলতে হয় না। নৌকায় বসে থাকলেও মাছ লাফ মেরে নৌকাতে উঠে আসে। দরকার স্রেফ কপালের জোর।
লোকটা কিনে দেবার আগেও মেয়েটা বেশ কয়েকটা ড্রিংক নিয়েছিল। হয়তো আরও দুটো না হলেও চলত, তবু নিল। লোকটারও বসে থাকতে বা পয়সা খরচা করতে কোনও আপত্তি ছিল না।
মেয়েটার নাম মার্নি। বারবার বলছিল। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও কথা, মনে না রাখলে অনর্থ হয়ে যাবে। “আমার নাম জ্যাক”, মিথ্যে বলল লোকটা। মেয়েটা বারবার ক্ষমা চাইল। অনেক চেষ্টা করেও লোকটার নাম ও মনে রাখতে পারছিল না। বরং আবার বলল, “আমার নাম মার্নি। শেষে আই আছে।”
ওর মনে পড়ল বহু বছর আগে ঠিক এমনই এক বারে এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নেশায় আস্তে আস্তে তার চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসছিল, কথা কমে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। লোকটার গাড়ি চেপে নির্দিষ্ট জায়গায় আসার আগে গাড়িতেই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছিল। লোকটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল জ্ঞান আসার। আসেনি দেখে বিরক্ত হয়ে হালকা হাতে মেয়েটার ঘাড় মটকে মেরে ফেলেছিল সেদিন। মেয়েটা বুঝতেই পারেনি। যেন ঘুমিয়েই আছে…
সেটাও মন্দ অভিজ্ঞতা না…
***
“আমার তো নিজের বাড়ি আছে”, মেয়েটা বলে চলছিল, “তবু আমার প্রাক্তন স্বামী আমার বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে। আমি নাকি অযোগ্য মা। আচ্ছা বলুন তো, আমাকে কি আপনার অযোগ্য বলে মনে হয়?” যে বাড়িতে মেয়েটা থাকে সেটা একেবারে নোংরা না হলেও প্রচণ্ড অগোছালো। মেয়েটা তাকে হাত ধরে গোটা সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। এনেই সোজা বেডরুমে। বেডরুমও তথৈবচ। ঢুকেই মেয়েটা সোজা লোকটাকে জড়িয়ে ধরল জাপটে।
লোকটা তাকে একটু ঠেলে সরিয়ে দিল। মেয়েটা অবাক। লোকটা জিজ্ঞেস করল পান করার মতো ঘরে কিছু আছে কি না। মার্নি জানাল ফ্রিজে পুরোনো এক বোতল ভদকা আর বিয়ার থাকতেও পারে। মার্নিকে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিল সে। হাতে বিয়ারের বোতল নিয়ে যখন ঢুকল তখন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মেয়েটা বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে ধীরে ধীরে।
লোকটা ওর খুব কাছে গিয়ে গায়ে কম্বল ঢেকে দিল।
“পাকড়ো— ছোড়ো” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকটা।
***
মাছ ধরা শুধু একটা বাহানা না। দিন দু-এক বাদে এক শীতের শরৎ সকালে লোকটা দরজা খুলেই দেখল আকাশ মেঘে ঢাকা। পশ্চিম দিক থেকে শনশন করে বাতাস বইছে। আজ একেবারে উপযুক্ত দিন। গাড়ি চালিয়ে সে চলে গেল নদীর এক নির্জন খাতে। প্রায় সারাদিন সেখানে বসে থেকে বড়ো ছিপ নিয়ে ধরল তিনটে ট্রাউট মাছ। প্রতিটাই প্রচণ্ড লড়াই চালিয়েছিল। শেষে যখন ও তাদের ছেড়ে দিল, ওদের প্রশান্তি যেন লোকটার মধ্যেও ভর করল।
আচ্ছা মাছেরা কি আর-একটা জীবনের দাবি রাখতে পারে? কিংবা ও কি সত্যিই মাছেদের নতুন জীবন দিল? সে ক্ষমতা কি ওর আছে? কিছু কিছু মাছ তো জল থেকে ওঠালেই মরে যায়। একবার ঘাই মারতেও পারে না। তারা জলের তলায় থাকে। তাদের ইচ্ছে করলেও লোকটা নতুন জীবন দিতে পারবে না। তার মানে কি সেসব মাছ ট্রাউটের থেকে জীবনসংগ্রামে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ল?
এসব ভাবতে ভাবতে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে লোকটা গাড়ি দাঁড় করাল। একটা হ্যামবার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেল সস মাখিয়ে। সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে খেতে সেদিনের পত্রিকাটাও পড়ে নিল।
বাড়ি ফিরে ছিপ, বঁড়শি সব ধুয়ে মুছে সাফ করে রেখে দিল যেখানকার জিনিস ঠিক সেখানে।
***
সেদিন রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হল। চলল টানা তিনদিন। এই তিনদিন লোকটা ঘর থেকে বেরোতে পারল না। সারাদিন সোফায় বসে টিভি দেখে সময় কাটে। রাতে সে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে। কয়েক মাস আগেই ও একবার গুনবার চেষ্টা করেছিল। এই কাজ সে অনেকদিন ধরে করছে। মা মারা যাবার অনেক আগে থেকে। প্রথমদিকে ওর খিদে ছিল দুরন্ত। কিছুতেই বাগ মানত না। মাঝে মাঝে নিজেও অবাক হয়ে ভাবে, কেন ও এতদিন ধরা পড়েনি! প্রথমদিকে তো ডিএনএ থেকে শুরু করে কতরকম প্রমাণ ছড়িয়ে আসত অকুস্থলে তার ঠিক নেই।
তবে হ্যাঁ, ও ঠিক করে নিয়েছিল, কোনও দিন যদি ধরা পড়ে, সব স্বীকার করে নেবে। কোনও ডিএনএ, কোনও প্রমাণ লাগবে না। ওকে জেলে ঢুকিয়ে তালা মেরে চাবি ছুড়ে ফেলে দিলেও ও কিছু বলবে না। ও অন্যদের দেখেছে। কীভাবে অন্যরা একই ধরনের মহিলাদের একইভাবে খুন করে, আর কিছুদিন বাদে ধরা পড়ে যায়। অন্যদের থেকে ও যদি কোথাও আলাদা হয়, তবে তা বৈচিত্র্যে। এমন না যে ধরা পড়ার ভয়ে এটা করে। একই ধরনের মেয়েরা ওকে বোর করে দেয়। বৈচিত্র্যই তো জীবনের অঙ্গ… নাকি মৃত্যুরও? মে ওয়েস্ট একবার বলেছিলেন, “দুটো শয়তানের মধ্যে আমি সেটাকেই বাছব যেটাকে আমি আগে দেখিনি।”
তারপর একদিন ও পাকড়ো-ছোড়ো মেছুয়া বনে গেল। সেদিন থেকে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও শূন্য হল একেবারে। একসময় ও মেয়েদের খুন করত, কারণ ওর মনে হত খুনটা প্রয়োজনীয়। এখন করে না, কারণ ওর মনে হয় সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বরং নেশাগ্রস্তরা যেমন নেশা ছাড়ার পরও কোনওভাবে নেশার দ্রব্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে, ও ঠিক সেই কারণেই পাকড়ো-ছোড়ো খেলা খেলে।
কতজনকে ও খুন করেছে? সত্যি বলতে, ও নিজেও জানে না। ও খুন করে মৃতদের কোনও চিহ্ন নিজের কাছে রাখে না। আর ওর স্মৃতি? এখন বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে এমন হয়েছে যে কোন খুনটা সত্যি আর কোনটা ও কল্পনা করেছে, তা বলা মুশকিল। আর তার দরকারই বা কী?
ওর সেই টেক্সাস সিরিয়াল কিলারের কথা মনে পড়ে। যে-কোনো খুন হলেই সেই খুনি পুলিশের কাছে স্বীকার করত যে সে এটা করেছে। শেষে তো এমন হল যে দেখা গেল এদের মধ্যে কিছু খুন যে সময় হয়েছে, তখন ও পুলিশের গরাদে বন্দি। লোকটা মনে মনে ভাবে ওই খুনির ক্ষেত্রেও কি বাস্তব আর কল্পনা এমনভাবে জট পাকিয়ে গেছিল, যে, একসময় সে নিজেই বুঝতে পারছিল না কোন খুনটা সে করেছে আর কোনটা করেনি?
***
লোকটা বৃষ্টিকে পরোয়া করে না। ওর ছোটোবেলা একলা কেটেছে। বড়োবেলাও। ওর কোনও বন্ধু নেই। দরকারও হয়নি কোনও দিন। মাঝে মাঝে ওর সামাজিক হবার ইচ্ছে জাগে। তখন ও শপিং মলে যায়, সিনেমা হলে যায়, বারে সময় কাটায়… তবে বেশিরভাগ সময় ওর সঙ্গী ও নিজেই। সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ও তাক থেকে একটা বই নামাল। ইসাক ওয়াল্টনের লেখা “দি কমপ্লিট অ্যাংলার।” এ বই মলাট থেকে মলাট কতবার যে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই, তবু প্রতিবার যেন মনে হয় নতুন কিছু খুঁজে পাবে।
“ঈশ্বর মাছধরার মতো এত শান্ত, সমাহিত আর নির্দোষ বিনোদন আর দুটি তৈরি করেননি”, ও জোরে জোরে পড়ল। এ যেন ওর নিজের মনের কথা। তবে অ্যাংলার শব্দটার চেয়ে ফিশারম্যান শব্দটা ওর অনেক বেশি পছন্দের।
বৃষ্টি কমতেই ও একটা লম্বা লিস্ট বানিয়ে সোজা শপিং মলে চলল। চাকাওয়ালা গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে একধার থেকে ডিম, বেকন, পাস্তা, ক্যানের সস নিয়ে ডিটারজেন্ট সাবান কিনতে গিয়েই মেয়েটাকে দেখল সে। ও মেয়ে দেখতে আসেনি। শুধু বাজার করতেই এসেছিল। তার মাথায় ডিটারজেন্ট ছাড়া কিছু ঘুরছিল না, তবু সে মেয়েটাকে দেখেই ফেলল।
মহিলা সত্যিকারের সুন্দরী। সেই হিচহাইকারের মতো অল্পবয়েসি বা মার্নির মতো গায়ে পড়া না। খাঁটি সুন্দরী যাকে বলে। যেমন কোনও অভিনেত্রী বা মডেল হয় আর কি। কিন্তু লোকটা নিশ্চিত জানত এ দুটোর কোনোটাই নয়।
একঢাল লম্বা কালো চুল, দীর্ঘ পা দুটো, টিকালো নাক, দৌড়বিদের মতো সুন্দর ফিগার আর সব মিলিয়ে এমন কিছু একটা ছিল যা নিমেষে লোকটার মনকে তার কেনাকাটার জিনিসপত্র থেকে সরিয়ে পুরোপুরি সেই মহিলার উপরে নিয়ে গেল। মহিলার পরনে স্ল্যাক্স আর টিশার্টের ওপর বোতামহীন শার্ট। পোশাক মোটেই উত্তেজক না, তবু পোশাকে কী আর আসে যায়! মহিলার হাতে লম্বা কেনাকাটার লিস্ট, যার সামান্যই কেনা হয়েছে। লোকটা বুঝল, তার হাতে সময় আছে। আস্তে ধীরে নিজের চাকাওয়ালা কার্ট ঘুরিয়ে দোকানির কাছে গিয়ে নিজের কেনা জিনিসের টাকা মিটিয়ে দিল সে।
বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে সব মালপত্র ভরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শপিং মলের গেটের দিকে। তার এসইউভি-র পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধৈর্য হারালে চলবে না। কোনও না কোনও সময় স্লাইডিং ডোর খুলে মহিলা বেরোবেই। অস্থির হবার কিছু নেই। অস্থির মানুষরা মাছ শিকারি হতে পারে না। যারা খাঁটি মাছ শিকারি, তারা এই বসে থাকা, এই অপেক্ষাতেই চরম উত্তেজনা খুঁজে পায়। প্রতিবার ছিপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই যদি মাছে এসে ঠোকরাত, তাহলে খেলার আনন্দটাই মাটি। তার চেয়ে তো জাল দিয়েই মাছ ধরা যায়। কিংবা জলে একটা গ্রেনেড ফেলে সব মাছ একসঙ্গে মেরে দেওয়া যায়। তাকে কি আর খেলা বলা চলে?
এই তো, বেরিয়েছে…
***
“আমি এক মাছ শিকারি” বলেই হাত বাড়াল লোকটা।
এটা অবশ্য মহিলাকে বলা প্রথম কথা ছিল না। প্রথম কথা ছিল, “অনেক জিনিস আপনার, দাঁড়ান সাহায্য করি।” মহিলা তখন গাড়িতে জিনিস ঢোকাতে ব্যস্ত। লোকটার বাড়িয়ে দেওয়া হাত দেখে হালকা হেসে ধন্যবাদ বলার পর আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। নিপুণ হাতে লোকটা মেয়েটার মাথায় এমন এক আঘাত করল যে তার গোটা শরীর ঢলে পড়ল লোকটার গায়ে, আর সেও মাটিতে পড়ে যাবার আগে সযত্নে মহিলাকে তুলে নিজের গাড়িতে শুইয়ে দিল। মহিলার গা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মারটা কি জোরে হয়ে গেল? লোকটা মহিলার নাড়ি দেখল। নাঃ… বেঁচে আছে। মোটা টেপ দিয়ে সে মহিলার হাত পা মুখ বেঁধে দিল। আটকে দিল সিটবেল্ট। তারপর গাড়ি ছোটাল।
সুপার মার্কেটের সামনে যে অসীম ধৈর্য নিয়ে সে মহিলার বেরোনোর অপেক্ষা করছিল, ঠিক সে ধৈর্য নিয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল মহিলার জ্ঞান ফেরার। “আমি এক মাছ শিকারি”, সে মনে মনে বলতে লাগল। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝেই দেখছিল মহিলার দিকে। কোনও হেলদোল নেই। চোখ বন্ধ, শরীর এলিয়ে পড়া।
একটু বাদে বড়ো রাস্তা ছেড়ে পাশের ছোটো রাস্তায় ঢুকল সে। এবার সে সামান্য একটা পরিবর্তন খেয়াল করল। আপাতদৃষ্টিতে সব আগের মতো। কিন্তু কোথাও একটা প্রাণের সাড়া আছে। লোকটা ঠিক এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। নীরবতা ভেঙে মহিলাকে জানাল সে এক মাছ শিকারি। মহিলা সাড়া দিল না। কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল, মহিলা তার কথা শুনতে পেয়েছে।
“আমি পাকড়ো-ছোড়ো মাছুয়া। অনেকেই এই ধরনের মাছ শিকারির কথা জানেন না। আমি মাছ ধরতে ভালোবাসি। এতে আমি এমন এক আনন্দ পাই, যা আর অন্য কিছুতে পাই না। খেলা বলুন খেলা, সময় কাটানো বলুন সময় কাটানো… কিন্তু এটাই আমি করে থাকি। চিরকাল করে এসেছি।”
বলেই লোকটা ভাবতে থাকল। চিরকাল করে এসেছে? ওর মনে পড়ল একেবারে ছোটোবেলার কথা। হাতে কঞ্চির ছিপ আর দড়িতে বাঁধা বঁড়শি নিয়ে বাড়ির পিছনের ডোবায় মাছ ধরতে যেত সে। আর বড়ো হবার পর অন্য ধরনের মাছ ধরা। এতে যে উৎসাহ সে পেয়েছে, তেমন আর অন্য কিছুতে পায়নি।
“আমি চিরকাল এমন পাকড়ো-ছোড়ো মাছুয়া ছিলাম না, জানেন তো! মানুষ মাছ ধরে কেন? আগে আমিও ভাবতাম এত খাটনি করে মাছ ধরার একটাই মানে, মেরে ফ্যালো। মেরে খেয়ে নাও। একেবারে সোজা হিসেব, কী বলেন?”
“কী বলেন?” মহিলা কোনও উত্তর দিল না। উত্তর দেবার অবস্থায় সে নেই। তার মুখ বাঁধা মোটা টেপ দিয়ে। তার যে চোখ এতক্ষণ বন্ধ ছিল, তা এখন খোলা। চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।
“তারপর কী হল একদিন”, লোকটা বলে চলল, “আমি এই সব কিছুতে উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। এই খুনখারাপি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে লোকে ভাবে জল থেকে ওঠালেই হয়তো মাছ মরে যায়। তা নয়, মাছ খাবি খেতে থাকে। ছটফট করে, কিন্তু আমরা যতটা ভাবি, তার থেকেও বেশি সময় বাঁচে। অনেকসময় মাথায় একটা মুগুরের বাড়িতেও মরে না। লেজ ছটচফটায়। কিন্তু তারপরেই আসল ঝামেলা। সেই মাছকে ধুতে হবে, কাটতে হবে, অন্ত্রগুলোকে ফেলে পরিষ্কার করে হবে…”
গাড়ি এবার কাঁচা রাস্তা ধরেছে। অনেকদিন ও এই রাস্তায় আসেনি। কিন্তু এ রাস্তা ওর বহুদিনের চেনা। রাস্তার শেষে বনের মাঝে এমন একটা নির্জন জায়গা আছে, যেটা ওর খুব প্রিয়।
লোকটা এখন চুপ। একটাও কথা বলছে না। বরং মহিলাকে ভাবার সময় দিচ্ছে। ভাবুক, ও কী বলল সেটা ভেবে দেখুক। গাড়ি চালিয়ে বনের মাঝে এমন এক জায়গায় গাড়ি থামাল যেটা কোনওমতেই বাইরে থেকে দেখা যাবে না।
“আমি আপনাকে সত্যি কথা বলি”, মেয়েটার সিটবেল্ট খুলে ওকে নামাতে নামাতে লোকটা বলতে লাগল, “আমার বরং মাছ মারার চেয়ে এই পাকড়ো-ছোড়ো খেলা অনেক বেশি উত্তেজক লাগে। বিশ্বাস করুন…”
খুব যত্ন করে মহিলাকে মাটিতে শুইয়ে দিল সে। তারপর গাড়ির চাকা খোলার লোহার রডটা দিয়ে দুই হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে ফেলল। ফেলেই পায়ের টেপটা খুলে দিল সে। হাত আর মুখের টেপটা আগের মতোই রইল। একটা ধারালো ছুরি দিয়ে মেয়েটার সব পোশাক একে একে কেটে ফেলল হালকা হাতে। নিজের সমস্ত পোশাক খুলে পাশে গুটিয়ে রাখল যত্ন করে। আদম আর ইভ যেন স্বর্গের উদ্যানে, ভাবল লোকটা। নগ্ন, কিন্তু লজ্জিত না। হে ঈশ্বর, “আমরা সারারাত মাছ ধরলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না।”
এবার সে মহিলার উপরে হামলে পড়ল।
***
বাড়ি ফিরে এসে নিজের সব পোশাক ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিল লোকটা। তারপর স্নান করল অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু তার আগে একেবারে সরাসরি বাথটবে নামল না। ওর সারা গায়ে তখনও সেই মহিলার গন্ধ লেগে আছে। ও চাইছিল না, অতি দ্রুত সে গন্ধ চলে যাক। বরং বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সেই উত্তেজক সময়কে উপভোগ করতে লাগল মনে মনে। একেবারে শুরুতে মেয়েটাকে সুপার মার্কেটে দেখা থেকে শেষে ওর ঘাড়টা মটকে দেওয়া অবধি… গোটা ব্যাপারটাকে বারবার স্মৃতিতে জারিয়ে নিতে চাইল।
ওর মনে পড়ল প্রথম যেবার ও নিজেই এই পাকড়ো-ছোড়ো খেলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেই মেয়েটাও একেবারে নিপুণভাবে গড়া ছিল। তরুণী, ব্লন্ড, চিয়ারলিডারের মতো দেখতে, গালে একটা তিল… যখনই ওর পছন্দের মেয়েদের দেখতে পায়, ও এই খেলা থেকে বেরিয়ে আসে। এই খেলার নিয়ম তো ওরই বানানো, তাই কখন খেলবে আর কখন খেলবে না, সেটাও ও ঠিক করবে, অন্য কেউ না।
একটু খারাপ লাগছিল শুরুতে। আজকের খেলাটা নিয়ম মেনে হল না। তবু পরে সেসব ভুলে অদ্ভুত এক শরীর জোড়া প্রশান্তি তাকে আবিষ্ট করল। সে কিন্তু এখনও পাকড়ো-ছোড়ো মেছুয়াই আছে। সারা জীবনই থাকবে। কিন্তু তা বলে কি ও নিরামিষাশী হয়ে গেল নাকি?
ছিঃ… কক্ষনো না। সবার অধিকার আছে অন্তত দুই-একদিন ভরপেট চর্ব্য চোষ্য খাবার খাওয়ার…
অনুবাদকের জবানি: নিল গাইম্যান আর আল সারান্তোনিও-র সম্পাদনায় Stories: All-New Tales বইটি ২০১০ সালে প্রকাশ পায়। কালিম্পং প্রবাসকালে ওই বছরই বইটি হাতে আসে আমার। বইতে প্রতিটা গল্প নতুন, এই বইয়ের জন্যেই লেখা। এক-একটা গল্প এক-এক ঘরানার। কিন্তু সবকটারই একটা ব্যাপার এক… পড়তে পড়তে প্রায় প্রতি পাতায় মনে হবে “তারপর কী হল?” নিল গাইম্যান তাঁর ভূমিকাতেও লিখেছেন লেখকের নাম বা লেখার গুণ না, একমাত্র এই বৈশিষ্ট্যটা আছে কি না দেখেই গল্পগুলো নির্বাচন করা হয়েছে।
লরেন্স ব্লক প্রবীণ লেখক, এবং বিখ্যাতও। আমেরিকার মিস্ট্রি রাইটার অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে গ্র্যান্ড মাস্টারের খেতাবও দিয়েছেন। ম্যাথু স্ক্রুডার বা এক চোর বার্নি রডেনবার্গকে নিয়ে তাঁর সিরিজ আমেরিকায় বেস্টসেলার। কিন্তু এই গল্পটি, যার আসল নাম ‘Catch and Release’, তাঁর নিজস্ব ঘরানা থেকে একেবারে আলাদা। একে ঠিক ক্রাইমের গল্প বলা যায় না। বরং ভিতরে ভিতরে এক চাপা আতঙ্কের ধারা প্রথম থেকে বয়ে চলে। আর গাইম্যান যেটা বলেছিলেন, তারপর কী হল… সেটা তো আছেই। বাহাত্তর বছর বয়েসে ব্লক নিজেকে ভেঙে দুরন্ত এক গল্প উপহার দিলেন পাঠককে।