সাজাঘর
ডমিনিক প্যাটাগ্লিয়া প্রাণপণে চেষ্টা করছিল, সাজাঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদকে উপেক্ষা করতে। কিন্তু কপাল মন্দ। সিলিং-এ লাগানো প্রতিটা লাউড স্পিকার একেবারে চরমে বাড়ানো। এই আর্তনাদ প্রায়ই ভেসে আসে… জান্তব পাশবিক চিৎকার। তীক্ষ্ণ, কানে তালা লাগানো। মাঝেমধ্যে কাকুতিমিনতির কিছু শব্দ জড়িয়ে না থাকলে এ চিৎকার যে মানুষের তা বোঝা দুষ্কর।
এখানে দয়ামায়া শব্দটাই অজানা।
ডমিনিক দুই হাত দিয়ে সজোরে নিজের কান চেপে ধরল। কিন্তু সেই আর্তস্বর যেন তার হাতের চামড়া, মাংস ভেদ করে কানের পর্দায় ধাক্কা মারছে। চিৎকারের ফাঁকে ফাঁকে যে কিচকিচে শব্দ আসছিল, তাতে ডমিনিক বুঝতে পারল আজ ওরা স্ক্রু ব্যবহার করছে। দেহের প্রতিটা গাঁটে গাঁটে শক্ত করে এঁটে বসিয়ে দিচ্ছে কাঠের ক্লাম্প, যাতে হাড়মজ্জা সব পিষে যায়।
প্রায়ই হাড়ে চিড় ধরে। কিছুদিন রাজনৈতিক গরমাগরম আলোচনা হয়, বিভিন্ন সহমর্মী দলগুলো প্রতিবাদী চিঠির বন্যা বইয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ সেইসব চিঠিদের জায়গা হয় ফায়ারপ্লেসের আগুনে।
আইনে পরিষ্কার বলা আছে সাজা দিতে গিয়ে যেন শরীরে স্থায়ী কোনও ক্ষতি না হয়। এ ব্যাপারে গভর্নর খুব কড়া। শিক্ষাদান করতে গেলে এসব হ্যাপা খুব অসুবিধে সৃষ্টি করে।
আবার আর্তনাদ। যেন একটা শুয়োরকে খুন করা হচ্ছে। ডমিনিক দুই চোখ জোরে চেপে রইল। সে এই স্ক্রু-র যন্ত্রণা জানে, জানে এর থেকেও ভয়াবহ সব যন্ত্রের অভিজ্ঞতা।
এখানে আসার পর থেকে ডমিনিক তিনবার ওই সাজাঘরের অতিথি হয়েছে। প্রতিবারের অভিজ্ঞতা আগের বারের চেয়ে জঘন্য। প্রথম সে এই ঘরে এসেছিল ভরতি হবার ঠিক পরেই। দুজন ইউনিফর্ম পরা মুশকো জোয়ান মাথায় কাপড় ঢেকে তাকে প্রায় বাস থেকেই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছিল ওয়েটিং রুমে। তালা মেরে রেখেছিল ভীত আর হতবাক ডমিনিককে। সেই ওয়েটিং রুমে কোনও জানালা নেই, আসবাব নেই, মেঝে ধূসর কংক্রিটে বাঁধানো, ঠান্ডা। চারিদিকে তীব্র ঝাঁঝালো অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ। ডমিনিক পরে বুঝেছে, ওটা আসলে আতঙ্কের ঘ্রাণ। ওয়েটিং রুমের একটা দেওয়ালে আগাপাশতলা গাদাগাদি করা ফোটো লাগানো। এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই।
সেইসব মানুষদের ছবি, যাদের এখানে অত্যাচার করা হয়েছে।
হাজার হাজার ফোটো। হাজার হাজার মুখ। প্রতিটা মুখ ভয়ে বিবর্ণ।
ওরা এসে সেই দেওয়ালে ডমিনিকের একটা ছবি সেঁটে দিল। বেশ কয়েকমাস আগে তোলা, কিন্তু এত বেদনার মধ্যেও তাকে কত কমবয়সি লাগছে।
ওকে নিয়ে প্রথমেই একটা কাঠের তাকে বেঁধে ফেলা হল। প্রথম দিনই বুঝিয়ে দেওয়া যে এখানে থাকতে হলে কেমনভাবে চলতে হবে। ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিল, যতক্ষণ না গলা ফেটে ফ্যাসফ্যাসে হয়ে যায়, তারপর গলার আওয়াজ বুজে গেছিল নিজে থেকেই।
ডমিনিকের সহযোগীরও এখন সেই অবস্থা। তীব্র চিৎকার এখন চাপা গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। এমন না যে ব্যথা কমেছে, আসলে এক ঘণ্টা ওই সাজাঘরে থাকলে কারও আর চিৎকারের ক্ষমতা থাকে না। বেচারা…
ডমিনিক চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আচমকা তার চোখ পড়ল নিজের ফোটোতেই। এই ছবিটা সেবার তোলা, যেবার তাকে দ্বিতীয়বার এই সাজাঘরে নিয়ে আসা হয়। ইন্সট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলার কোনও রীতি নেই এখানে, যা বলার তিনিই বলেন। কিন্তু ডমিনিকের মনে নেই তিনি কী বলেছিলেন।
এই ছবিতে ডমিনিকের চোখে জল। মুখটা করুণ।
ওরা সেবার স্ক্রু ব্যবহার করেছিল। ওর হাতের বুড়ো আঙুলে। ওর হাঁটুতে। ওর অণ্ডকোষে।
সেরে উঠতে দশদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ওকে।
তৃতীয়বার সাজাঘরের অভিজ্ঞতা জঘন্যতম। সেবার তিনখানা পোলারয়েড ছবি তোলা হয়েছিল ওর। প্রতিটাতেই ও দেওয়ালে ঝুলছে। টানা দুই ঘণ্টা ধরে ঝুলিয়ে রেখে রাবারের চাবুক দিয়ে ওর দেহের প্রতিটা ইঞ্চিতে সপাসপ চাবকানো হয়েছিল।
তারপর আবার।
আর আবার।
আবার।
সেবার ব্যথা এতটাই তীব্র যে ও ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। রীতিমতো একজন ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল, যিনি অ্যাম্ফিট্যামিন ইঞ্জেকশন দিয়ে ক্রমাগত ওকে সজাগ রাখছিলেন। যে লোকটা অত্যাচার করে, এটাই তার আনন্দ। অত্যাচার ভোগ না করতে পারলে আর কী হল? ডমিনিক শুনেছে একবার এক বেচারি মেয়েকে টানা চোদ্দো ঘণ্টা এই ঘরে রেখে দিয়েছিল। একটাই কারণ। মেয়েটা খানিক বাদে বাদেই জ্ঞান হারাচ্ছিল।
নির্যাতক লোকটি এর ওপরেই বেঁচে আছে। ও এসব ভালোবাসে। ভালোবাসে হাড়গোড় ভেঙে দিতে। যখন কেউ ওর ওপর রাগ বা ঘৃণা দেখায়, ওর মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে। শুধু ওর কাছে নত না হলেই হল। তাহলে দেহের সঙ্গে সঙ্গে ও মানুষটার আত্মাটাকেও ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে দেবার সুযোগ পায়।
ভগবান জানে, এই লোকটাকে এরা কোথা থেকে খুঁজে নিয়ে এসেছে…
আবার একটা ফ্যাসফ্যাসে আর্তনাদ। এক্ষুনি এর পালা শেষ হবে।
এবার ডমিনিকের পালা।
এটা ওর চার নম্বর বার, মানে এবার বিদ্যুৎ। অন্যদের থেকে যা শুনেছে, তাতে বুঝেছে বিদ্যুৎ দিয়ে শাস্তির কাছে অন্য শাস্তিগুলো নেহাতই পানসে। ওর দাঁত, কান, পায়ুছিদ্র দিয়ে কারেন্টের শক দেওয়া হবে। সরকার এখনও এই শাস্তিকে ব্যান করেননি, যদিও এই শাস্তিতে জায়গায় জায়গায় কালো পোড়া দাগ থেকে যায়। পোড়া দাগ নাকি স্থায়ী ক্ষতির মধ্যে পড়ে না।
চিৎকার একেবারে বন্ধ হয়েছে। ওয়েটিং রুমের একেবারে পিন পড়া নিস্তব্ধতায় ডমিনিকের একটা ঝিম ধরা ভাব এল।
আর মাত্র কিছুক্ষণ।
ডমিনিক নিজের হাঁটু দুটো মুড়ে বুকের সামনে নিয়ে এল। এই নিয়ে প্রায় একশো বার সে নিজের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে হাত বুলিয়েছে। নিয়মমতো তাকে পুরো উলঙ্গ করে নিয়ে আসার কথা, কিন্তু কায়দা করে একটা টেপ দিয়ে সে গোড়ালির তলায় একটা ছোটো পেনসিল আটকে এনেছে। পেনসিলের ধারালো ডগাতে টেপ আটকানো। এই অস্ত্রে আদৌ কোনও কাজ হবে কি না, কিংবা ও এটা ব্যবহার করতে পারবে কি না, ওর বেশ সন্দেহ আছে। হয়তো ওই অত্যাচারী লোকটা ওর এই চেষ্টা দেখে মুচকি হাসবে। মজা পাবে।
আর মজার পরেই আসবে রাগ।
যদিও ও আগে থেকে এটা ভেবেই রেখেছিল, তবু ডমিনিকের মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।
এটা কাজ করতেও পারে, যদি ও একটু ক্ষিপ্র হয়। যদি ও ওই অত্যাচারী মানুষটার মুখে আঘাত করতে পারে, অথবা কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে… হয়তো…
দরজা খুলে গেল।
দরজা জুড়ে ওই অত্যাচারী লোকটা দাঁড়িয়ে। সারা দেহে ঘাম আর ভয়ের তীব্র গন্ধ। লম্বায় ডমিনিকের চেয়ে প্রায় ফুট দেড়েক লম্বা। অসুরের মতো চেহারা, চওড়া বুক, শক্ত, মোটা মোটা আঙুল।
“আপনাকে আবার দেখে ভালো লাগল, মি. প্যাটাগ্লিয়া”, খসখসে আওয়াজে বলল লোকটা। কালো আলখাল্লা থেকে শুধু মুখটাই দেখা যাচ্ছে, আর সেই মুখে কালো কালো বিকৃত দাঁতের সারি। লোকটা হাসছে। লোকটার হাতে, বগলে রক্তের ছিটে, কালো প্যান্টের সামনে অনেকটা জায়গা ভিজে রয়েছে এখনও।
যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের অনুমতি সরকার দেয়নি, কিন্তু অত্যাচার করার সময় লোকটা স্বমেহন করতেই পারে, তাতে নিয়মমাফিক কোনও বাধা নেই।
ডমিনিক হাতের তেলোতে পেনসিলটা লুকিয়ে ফেলল আর পায়ুছিদ্র চেপে বন্ধ করে নিল। ওর দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। অত্যাচারী মানুষটা একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিয়ে ইঁদুরের মতো ছোটো ছোটো চোখে কী সব দেখতে লাগল।
“হল মনিটরকে আক্রমণ করেছিলেন, তাই তো ডমিনিক? আপনার দেখি খুব সাহস! বিচি দুটো আস্ত আছে তো? নাকি খুলে নিয়ে জেনারেটরে লাগিয়ে দেখব আলো জ্বালানো যায় কি না”… নিজের বদ রসিকতায় নিজেই বাচ্চা মেয়েদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠল লোকটা।
ডমিনিক প্রায় অসাড় পায়ে ঘরের একদিকের দেওয়ালে সেঁটে যেতে থাকল। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে। অত্যাচারী লোকটা এগিয়ে এল, ঝুঁকে পড়ে ডমিনিকের কবজি ধরল মুঠিতে।
“প্লিজ”, ডমিনিক প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি। তালুর পেনসিলটা সরু, নির্জীব একটা স্প্যাগেটির টুকরোর মতো মনে হল তার।
অত্যাচারী লোকটা নিজের মুখ ডমিনিকের খুব কাছে নিয়ে এল। ডমিনিক ওর মুখের দুর্গন্ধ টের পাচ্ছিল।
“আজকে আপনিই আমার শেষ বরাত। আমাদের হাতে প্রচুর সময়…”
ডমিনিক এক ঝলকে দেওয়ালে নিজের ফটোর দিকে তাকাল।
“না, সময় বেশি নেই।”
ডমিনিকের গলা শুনে লোকটা চমকে গেল। চাপা, ফিসফিসে, কিন্তু ইস্পাতের মতো স্থির, সংকল্পে স্থিত।
অত্যাচারী লোকটা হাসি হাসি মুখে চোখ পাকাল। তবে বোঝা গেল ও অবাক হয়েছে।
“আরে! মি.প্যাটাগ্লিয়া… আপনি আমার মুখে মুখে তর্ক…”
ডমিনিকের হাত বিদ্যুৎগতিতে পেনসিলের ধারালো অংশটা ঢুকিয়ে দিল লোকটার ডান চোখে।
একটা অদ্ভুত সপসপে আওয়াজ করে পেনসিলটা ভিতরে ঢুকে গেল।
লোকটা চিৎকার করে উঠল। ডমিনিকের হাত ছেড়ে দিয়ে এবার সে পিছোতে লাগল এক পা, এক পা করে। তার মাংসল হাত দুটো মুখের ওপর নড়াচড়া করতে লাগল, যেন দুটো পাখি মাটিতে নামতে ভয় পাচ্ছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে নেমে এল রক্ত আর কালচে চটচটে তরল।
ডমিনিক দ্রুত তিন পা এগিয়ে এসে লোকটার ডান চোখে মারল এক ঘুসি, যাতে পেনসিলটা একেবারে গোড়া অবধি ঢুকে গেল চোখের গহ্বরে।
অত্যাচারী লোকটা একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল, আর তারপর একটা মোটা আলুর বস্তার মতো লুটিয়ে পড়ল ঠান্ডা কংক্রিটের মেঝেতে। তার মুখ হাঁ করা, অন্য চোখটা ঠিকরে বেরুচ্ছে, সে চোখের সাদা অংশও এখন টকটকে লাল।
ডমিনিক ওর দেহের পাশে খানিক দাঁড়াল। ও কি সত্যিই পারল? পারল লোকটাকে মেরে ফেলতে?
পালাও! মাথার ভিতরে কে যেন বলে উঠল।
কিন্তু ডমিনিকের পা যেন মেঝেতে শিকড় গেঁথে আটকানো।
ওকে নিশ্চিত হতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে বেজম্মাটা মরেছে।
অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ ধীরে ধীরে কমছিল। ডমিনিক ভয়ে কাঁপতে লাগল। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছাতেই হাঁটু মুড়ে বসে লোকটার পালস খুঁজে বার করবার চেষ্টা করল।
এ যেন জেনেশুনে আগুনে হাত দেওয়া। যেন অসীম সময়কাল ধরে খুব সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে ডমিনিক লোকটার ভিজে, আঠালো ঘাড়টা স্পর্শ করল। ঘাড়ের মাংসল থাকগুলোর মধ্যে ডমিনিক চেষ্টা চালাল ক্যারোটিড ধমনিটা খুঁজে পাবার।
পালস আছে।
যেন কারেন্টের শক খেয়েছে, এমনভাবে ডমিনিক হাতটা সরিয়ে নিল।
“পালা! হতচ্ছাড়া পালা! যদি ও একবার জেগে ওঠে…”
কিন্তু ডমিনিক পালাতে পারছে না। ও যেন অনন্তকাল এই মেঝের সঙ্গে বাঁধা। ও এই মানুষটাকে বাঁচতে দিতে পারে না। শুধু নিজের জন্য না, সবার জন্য।
ডমিনিক নিচের ঠোঁট কামড়াল। আবার হাত বাড়াল পেনসিলটার জন্য।
লোকটা কাতরে উঠল একবার।
ডমিনিক লাফিয়ে উঠল। ওর একটা অস্ত্র দরকার। কিছু একটা হলেই হবে। ও ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে সোজা ছুট লাগাল। বাঁদিকে একটা উঠোন আর ডানদিকে সাজাঘর।
অদ্ভুত একটা দোলাচল শুরু হল ডমিনিকের মধ্যে। ওর আত্মার এক অংশ সাজাঘরে যেতে চাইছিল না, কিন্তু ওখানেই তো অস্ত্রগুলো…
ও ডানদিকে পা বাড়াল।
দরজা খুলেই যেন এক দুঃস্বপ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে সাজাঘর। অন্ধকার, নোংরা, চটচটে, দুটো হলুদ বালব তেলতেলে তারে ঝোলানো। দেওয়ালের রং কালো। গোটা ঘর জুড়ে পেচ্ছাপ আর পায়খানার বোঁটকা গন্ধ যেন স্থির হয়ে আছে। মেঝেতে শিকল আর আংটা বাঁধা। দেওয়ালের র্যাক ভরা সেই অত্যাচারী মানুষটার অত্যাচার করার যন্ত্রপাতি, যেন হাঁ করে রয়েছে তাদের পরের শিকারের জন্য।
ডমিনিক গাছের পাতায় হাওয়া বয়ে যাবার মতো একটা শব্দ শুনতে পেল। পিছন ফিরে দেখল দরজায় সেই অত্যাচারী মানুষটা। সোঁ সোঁ করে নিশ্বাস ফেলছে। তার চোখ থেকে তখনও পেনসিলটা বেরিয়ে রয়েছে আর তা থেকে লালচে চটচটে তরল গলে গলে পড়েছে। সে তার মোটা তর্জনী তুলে ধরল ডমিনিকের দিকে, তারপর থপ করে আরও এক পা এগিয়ে এল।
ডমিনিক লোকটার ক্যাবিনেটের দিকে পা বাড়িয়ে হাতে একটা লাইটার জ্বালানোর অ্যালকোহলের পাত্র নিল। পাত্রের মাথার ঢাকনা খুলে ছিটিয়ে দিল লোকটার মুখ, নাকে চোখে।
চোখের আহত জায়গায় কোহল লেগে জ্বালা বেড়ে উঠল বহু গুণ। লোকটা এক পা পিছনে ফিরতেই জেনারেটারে হোঁচট খেল।
“বেজম্মার বাচ্চা… তোকে একবার হাতে পাই…”
ডমিনিক হাত বাড়িয়ে পরের অস্ত্রটা পেল। একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরা… সেটা হাতে নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপরে। একের পর এক বাড়ি মেরে চলল লোকটার মুখে, যতক্ষণ না ক্যামেরার প্লাস্টিকের দেহ ফেটে গিয়ে চলটা উঠতে থাকে। ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল প্রতিটা বাড়িতে লোকটার হাড়গুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।
লোকটা তাও লাফিয়ে উঠল। ডমিনিক উলটে পড়ে গেল, মাথার পিছন ঠুকে গেল মেঝেতে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। মনে হল তার বাঁ কাঁধে কী যেন ফুটছে।
তার ঠিক পাশেই অত্যাচারী লোকটা উঠে বসল। পেনসিলটা ধরে টেনে বার করে নিল। সঙ্গে সঙ্গে উপড়ে এল ওর চোখটাও, সব নার্ভ সমেত। মনে হল যেন একটা লাল জেলিফিশ তার কর্ষিকাগুলোকে নাড়াচ্ছে। লোকটা তীব্র চিৎকার করে উঠল। পেনসিলটা ফেলে দিল মাটিতে। উপড়ানো চোখটা গালের সামনে ঝুলছে।
ডমিনিক পিছনে হাত দিয়ে বুঝল কী ঠেকছে তার পিছনে। টেনে সামনে নিয়ে এল সেটাকে।
একটা ইস্পাতের ক্লাম্প, প্রায় তার হাতের সমান। সে একদিক চেপে ধরতেই সামনেটা হাঁ হয়ে গেল। সেই হাঁয়ের ভিতর ছোটো ছোটো ইস্পাতের দাঁত। ক্লাম্পের নিচে একটা তার বাঁধা। ডমিনিক দেখতে পেল সেই তারের অন্য প্রান্তের প্লাগ গোঁজা রয়েছে এক ইলেকট্রিক জেনারেটারের সঙ্গে।
লোকটা ততক্ষণে হাতে রবারের চাবুকটা নিয়ে নিয়েছে। চাবুকের এক ঝটকায় সেটা লাগল গিয়ে ডমিনিকের মুখে। তীব্র ব্যথায় কাতরে উঠল ডমিনিক। সে হাতে ক্ল্যাম্প নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। লোকটা সপাসপ করে চাবুকের বাড়ি মেরেই চলেছে।
“তুই জানিস ব্যথা কাকে বলে? দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি”, গর্জে উঠল লোকটা।
ডমিনিক শোয়া অবস্থাতেই ঘুরে গেল। আরও একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল তার মুখে। সে তার মধ্যেই ক্ল্যাম্পটা আটকে দিল অত্যাচারীটার গোড়ালিতে। আর…
কোনওমতে হাত বাড়িয়ে অন করে দিল জেনারেটারের সুইচ।
এক ঝটকায় লোকটা গুটিয়ে গেল, যেন কোনও বইয়ের মলাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমেই দমাস করে মেঝেতে ঠুকে গেল মাথাটা। ওর গোটা দেহের চারদিকে ওজোন গ্যাসের এক সুতীব্র ঝড় যেন বয়ে গেল এক নিমেষে। মুখ থেকে ছিটকে ছিটকে বেরোতে লাগল রক্তের ধারা। দাঁতের মাঝে চেপে ধরা জিভের টুকরো আর চাপ সহ্য করতে না পেয়ে কেটে গড়িয়ে পড়ল চিবুক বেয়ে।
ডমিনিক কাঁকড়ার মতো ধীর পায়ে পিছিয়ে পিছিয়ে দূরত্ব বাড়াল। সে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে দেখল সেই ক্লাম্প থেকে গোড়ালি বরাবর ধোঁয়া উঠছে আর সেই ধোঁয়ার সঙ্গে আগুন, চামড়া পোড়ার গন্ধ। আগুন ছুঁয়ে ফেলল দেহে ছড়ানো দাহ্য অ্যালকোহলকে।
পাটকাঠির মতো দপ করে জ্বলে উঠল গোটা লোকটা।
ডমিনিক অন্যদিকে তাকিয়ে এক ড্রয়ারে তার জামাকাপড় রাখা দেখতে পেল। পিছন থেকে আসা পোড়া মাংস ফাটার ফটাস ফটাস আওয়াজ আর মরতে থাকা লোকটার গোঁ গোঁ ধ্বনিকে উপেক্ষাই করল ডমিনিক। যখন সে জুতোর ফিতে বাঁধছে, ততক্ষণে শয়তানটার সঙ্গে ওর আওয়াজও মরে গেছে।
পাশেই আর-এক টিন কোহল আর একটা তার কাটার প্লায়ার ছিল। সেটাকে ডমিনিক পিছনের পকেটে গুঁজে নিল। তারপর গোটা র্যাকে ছড়িয়ে দিল তরল কোহল। অত্যাচারী লোকটার সাধের অস্ত্রের ক্যাবিনেটেও…
দারুণ পুড়ল জিনিসগুলো।
শেষ অবধি ও গেল ওয়েটিং রুমে। জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবার আগে ও খুব মন দিয়ে নিজের ছবিটাকে দেখে চলল।
ও জানে। ওরা আসবে। ওকে পালাতেই হবে।
উঠোনের দিকের দরজাটা খোলা, আর অবাক কাণ্ড, কোনও প্রহরী নেই। ঠিকই আছে। হল মনিটর জানে ডমিনিক এখন বেশ কয়েক ঘণ্টা সাজাঘরে কাটাবে, তাই এদিক ওদিক গেছে বোধহয়।
ডমিনিক খোলা উঠোনে এসে দাঁড়াল। গাছের পাতার ফাঁকে সূর্যের কিরণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরোনো বন্ধুর মতো। ঠান্ডা উদাসী হাওয়া তার নাকের থেকে পেচ্ছাপের দুর্গন্ধ দূর করে দিল এক নিমেষে।
বাস্কেটবল কোর্টের পরের তারের জাল। তার ওপরে কাঁটাতার। টপকানো অসম্ভব।
কিন্তু ও টপকাবে না।
দুই মিনিটের মধ্যে তার কেটে ও বাইরে বেরিয়ে এল।
স্বাধীনতা মায়ের ভালোবাসার মতো জড়িয়ে ধরল তাকে।
ও বনপথ দিয়ে দৌড়াতে থাকল। ও জানে ওকে একদিন আবার এখানেই ফিরতে হবে।
কিন্তু শিকার হিসেবে না। জীবন্ত বলি হিসেবে না।
ডমিনিক ব্যান হয়ে যাওয়া ইতিহাস বইগুলো পড়েছে। ও জানে কয়েকশো বছর আগে আমেরিকার স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের বিন্দুমাত্র অত্যাচার করা হত না। তখন তার মতো এগারো বছর বয়সের ছোকরারা স্কুলে শুধুই পড়তে যেত। শিক্ষা মানে সরকারের হুকুম তামিল ছিল না। সবচেয়ে বড়ো কথা ছাত্ররা তখন স্বাধীন ছিল।
এই অত্যাচারী লোকটা বড়ো একটা রোগের একটা উপসর্গ মাত্র। ও সিস্টেমেরই অংশ। সিস্টেমেরই ফসল।
ডমিনিক জানে, তার মতো আরও ছাত্র আছে। তারাও যোদ্ধা, তারাও রুখে দাঁড়াচ্ছে। তারাও পরিবর্তন চায়।
ও তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। ও তাদের দলে যোগ দেবে। শক্তিশালী হবে। তারপর আবার যখন এখানে ফিরে আসবে ও, শিকার হিসেবে আসবে না।
আসবে মুক্তিদাতা হিসেবে।
ডমিনিক প্যাটাগ্লিয়া একবারও পিছন ফিরে তাদের প্রাথমিক ক্যাম্পের দিকে না তাকিয়ে বনপথ দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। ও জানে আজ ও কী করেছে আর ও যেন শুনতে পেল হাজার হাজার কচি ছাত্রছাত্রী ওর নামেই জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
অনুবাদকের জবানি: এককালের বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ই.সি কমিকসের হরর স্টোরির ধাঁচে লেখা জোসেফ অ্যান্ড্রু কনরাথের ‘Punishment Room’ ডিসটোপিয়ান সমাজের এক অদ্ভুত গাথা। শুরুতে চলনটা ভয়াল হলেও সেই আক্ষরিক ভয় আমাদের একেবারে কাঁপিয়ে দেয় শেষ কয়েকটা অনুচ্ছেদে। আমরা চমকে উঠি। এ কোন পৃথিবীর কথা! শুধু হরর না হয়ে শেষের এই চরম মানবিক ট্যুইস্ট গল্পকে নতুন এক স্তরে উত্তীর্ণ করেছে।