Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আঁধার আখ্যান – কৌশিক মজুমদার

    কৌশিক মজুমদার এক পাতা গল্প186 Mins Read0

    পিপহোল

    ১

    আজ সারাদিন খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। থামতেই চাইছে না। আকাশ থেকে ঘড়া ঘড়া জল যেন কেউ ঢেলে দিচ্ছে, আর তা পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে মোটা ধারায় বয়ে চলেছে লালচে নদী তৈরি করে। বাংলোর সবুজ চালে বৃষ্টিফোঁটার আওয়াজে কান পাতা দায়। দূরে দুরপিনদারা মনাস্ট্রি থেকে ভেসে আসছে আবছা ঘণ্টা আর শিঙার শব্দ।

    জোরে একটা কান ফাটানো বাজ পড়তেই মারিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে অল্প একটু আকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই। নিশ্চয়ই অন্য ঘরগুলোতে চাকররা এতক্ষণে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। তার ঘরে কেউ আলো জ্বালায় না। ফায়ারপ্লেসে রেখে দেয় না জ্বলন্ত কাঠ। ঘরের এককোণে একটা লোহার চারপেয়ে বিছানা। তলায় বেডপ্যান।

    একবার নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল মারিয়া। রক্তাক্ত। ক্ষতবিক্ষত। সারাদিন কাঠের দেওয়ালে নখ ঘষে ঘষে কত কী লেখে মারিয়া। ওর সে ভাষা কেউ বোঝে না। মারিয়ার চুল উশকোখুশকো। গায়ে পুরু ময়লা। কতদিন কেউ ওকে গরম জলে চান করায় না। বন্ধ দরজার সামনে পড়ে আছে আধখাওয়া রুটি আর কাচের গেলাসে জলের তলানি। মারিয়া এগোতে চায়। পায়ে বাঁধা শিকলে ঝনঝন আওয়াজ হয়। কিছুটা এগিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে মারিয়া। তবু কোনওক্রমে শরীর হিঁচড়ে দরজার সামনে যেতে চায়। দরজার বাইরে কারা দাঁড়িয়ে আছে? কথা বলছে। মারিয়া কান পেতে শুনতে থাকে। অচেনা গলা। ওরা বলছে মারিয়াকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে। কোথায়? মারিয়া কোথাও যাবে না। সে এই ঘরেই থাকবে।

    আর-একবার জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই শিকল ছিঁড়ে গেল। মারিয়া কোনওক্রমে দৌড়ে চলে এল দরজার একদম পাশে। কান ঠেকাল দরজায়। ওরা দুষ্টু লোক। ওরা ওর মাকে মেরেছে। এবার ওকে মারতে এসেছে। বাইরের তালা খোলার আওয়াজ পেয়েই এক ঝটকায় ঘরের ভিতরের খিলটা লাগিয়ে দেয় সে। দরজায় ধাক্কার শব্দ। একবার। দুবার। বারবার। মারিয়া কিছুতেই দরজা খুলবে না। মারিয়া নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অপেক্ষা করে ওদের চলে যাওয়ার। তারপর গলা ফাটিয়ে চিলচিৎকার করে ওঠে…

    ২

    ঘরটা দেখেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মৌসুমী। ঠিক এরকমটাই চাইছিল সে মনে মনে। প্রায় হপ্তাখানেক ধরে ঘর খোঁজা চলছে। কোনোটাই ঠিক মনের মতন হচ্ছে না। এদিকে সারাজীবন কলকাতায় কাটিয়ে এখন কালিম্পং-এ প্রথমবার এসে ঘর খোঁজাও ঝকমারি। সবচেয়ে বড়ো হল ভাষার সমস্যা, এখানের স্থানীয় মানুষরা নেপালি ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। হিন্দিও চলে। এদিকে সে বাংলা আর ইংরাজি বাদে কিচ্ছুটি জানে না। ভাগ্যিস সঙ্গে নিধি ছিল। নিধি মহারাষ্ট্রের মেয়ে। দারুণ হিন্দি বলে। বাংলাও। কলকাতাতেই বড়ো হয়েছে। একেবারে ছোটো থেকে দুজন একসঙ্গে লরেটোতে পড়ত। মৌসুমির বেস্ট ফ্রেন্ড। পাকেচক্রে দুজনেই একই স্কুলে চাকরি পেয়েছে। নিধির জন্যেই মৌসুমির বাবা-মা মেয়েকে প্রথমবার এত দূরে আসতে দিয়েছেন। নিধিই আজকাল বাজারহাটে কথাবার্তা চালাচ্ছে।

    মৌসুমীর বাবা আসবেন বলছিলেন। মৌসুমীই না করছিল। এখন দেখছে এলে বরং ভালো হত। এই পাহাড়ি মিশনারি স্কুলে হেডস্যার বড্ড কড়া। ভোর চারটেয় উঠে ঠিক ছটায় মর্নিং প্রেয়ারে উপস্থিত হতে হয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। তখন শরীর ক্লান্ত আর ওই অন্ধকারে বাড়ি খোঁজা প্রায় অসম্ভব। এদিকে সাতদিন হয়ে গেল। হোটেলে আর কাঁহাতক থাকা যায়! এদিকে স্কুলের চেনাজানা কেউ কোনও ভাড়াবাড়ির সন্ধানও দিতে পারছে না।

    শেষে এক রবিবার স্কুলের দারোয়ান বন্ধন থাপাকে রাজি করিয়ে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ল বাড়ি খুঁজতে। তাতেও কি কম হ্যাপা! অনেকে দুজন মেয়েকে ভাড়া দিতে নারাজ, কোথাও ঘর পছন্দ হচ্ছে না, আবার ঘর পছন্দ হয় তো এত অতিরিক্ত বাড়িভাড়া যে তা সাধ্যের বাইরে। দুজনেই প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় বন্ধন বললে, “ম্যাডামজি, এওরা ঘর থিও। পাহারকো মাথি।” প্রথমে না বুঝলেও পরে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বন্ধন বোঝাল পাহাড়ের মাথায় একটা পুরোনো সাহেবি বাংলোবাড়ি আছে। সেই বাড়ির বুড়ি মালকিন তার গ্রাম সম্পর্কের মাসি। একটু যেতে হবে, কিন্তু বাড়িটা ভালো। অগত্যা! সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে দুজন বন্ধনের পিছু নিল।

    পাহাড়ি টিলার ওপরে ছোট্ট একটেরে বাড়ি। সাহেবি কেতায় বানানো। সবুজ চালের রং উঠে এখন কেমন একটা এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। লাল ইটের দেওয়াল ম্যাড়ম্যাড়ে। সামনে পোর্টিকোর পাশে জঙ্গলের মধ্যে ফুটে আছে কিছু হলিহক আর রডোডেনড্রন। এ বাড়ি পুরোনো হলেও নতুন মালিক তেমন যত্ন নিতে পারেন না, বোঝা যায়। কাঠের গেট সরিয়ে ওরা লনে ঢুকতেই কোথা থেকে ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে এল একটা ঝাঁকড়া লোম স্প্যানিয়েল আর তার পিছনে পিছনে “হাচি হাচি” করতে করতে এক নেপালি প্রৌঢ়া। বন্ধনকে দেখেই একগাল হেসে নেপালি ভাষায় কত কী বলে গেলেন তার বিন্দুবিসর্গও মৌসুমীরা বুঝল না। তবে মহিলা হিন্দিটা জানেন আর অল্প ইংরাজিও বলতে পারেন, তাই কথাবার্তায় অসুবিধা হল না। ওদের বসার ঘরে আদর করে বসিয়ে চিনামাটির ছোটো বাটিতে সোনালি চা আর ঘরে বানানো কুকি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন তিনি। চায়ের মৃদু গন্ধে ঘর ভরে গেল। কথায় কথায় জানালেন এই বাড়ি আগে এক সাহেবের বাংলো ছিল। ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে গেলেও সাহেব বহুদিন এই দেশে রয়ে গেছিলেন। তারপর এক রাতে সাহেবের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। মরার আগে এই বাড়ি তাঁর নেপালি খানসামাকে লিখে দিয়েছিলেন সাহেব। সেই থেকে তার পরিবারই এই বাড়ির একতলায় থাকে। দোতলায় কিছু ঘর আছে। সেগুলো বন্ধই থাকে। তার একটা ভাড়া দিতে পারেন তিনি। বাথরুম অ্যাটাচড।

    ক্যাঁচক্যাঁচে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছাতেই মৌসুমীর মন ভালো হয়ে গেল। কাচের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা শীতের যাই যাই রোদ্দুরে যেন সোনার বরন ধারণ করেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁদিকে ঘর। ঘর খুলতেই মন ভরে গেল দুজনের। পুরোনো শালকাঠের চেরা তক্তা দিয়ে তৈরি দেওয়াল। পায়ের কাছে কাচের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তে মিশে যাওয়া সবুজ পাহাড়, খাঁজে খাঁজে বয়ে চলা রঙ্গিত নদী। ঠিক ডানদিকেই উঁকি দিচ্ছে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন ঘর কেউ ছাড়ে নাকি! নিধির দিকে তাকিয়ে দেখল মৌসুমী। সেও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এখন ভয় একটাই। ভাড়া।

    মৌসুমীদের অবাক করে ভদ্রমহিলা বললেন মাসে দশ হাজার দিলেই চলবে। সঙ্গে সকালের ব্রেকফাস্ট ফ্রি। হাতে স্বর্গ পেল ওরা। পরদিনই হোটেলে চেক আউট করে নতুন ঘরে ঢুকে পড়ল দুজনে। আর এত কষ্টে ঘর পাবার আনন্দে পাশের লাগোয়া বন্ধ ঘরটাকে দুজনের কেউই খেয়ালও করল না।

    ৩

    ঘর গোছগাছের জন্য হেডস্যারের কাছে দিন দু-একের ছুটি চেয়েছিল দুজনে। ভাগ্যি ভালো হেডস্যার মঞ্জুরও করেছেন। গুছিয়ে উঠতে প্রায় দেড় দিন লাগল। দ্বিতীয়দিন বিকেলে নিধিরই প্রথম চোখে পড়ল পাশের ঘরটা।

    “হ্যাঁ রে মৌসুমী, এই ঘরটা দেখ! কী অদ্ভুত! বন্ধ!” বাংলাতেও বেশ সড়গড় নিধি।

    “বন্ধ তাতে অদ্ভুতের কী হল? কাজে লাগে না তাই বন্ধ। আমাদের রুমটাও তো বন্ধই ছিল।”

    “আরে ধুর! ভালো করে দেখ। ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরের ছিটকিনি তো খোলাই আছে।”

    “তাহলে অনেকদিন বন্ধ থেকে থেকে দরজা জ্যাম হয়ে গেছে। দাঁড়া ঠেলে দেখি।”

    মৌসুমী বেশ কয়েকবার ঠেলা দিল। প্রথমে আস্তে। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। দরজা একচুল নড়ল না। আরও কয়েকবার ঠেলাঠেলি করে বিরক্ত মৌসুমী বলল, “বাদ দে। চল নিচে লনে ঘুরে আসি।”

    লনে হাচি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মৌসুমী ওর সঙ্গে খেলায় মেতে গেল। নিধি একটু অন্যমনস্ক। কী যেন ভাবছে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, “এখান থেকে একবার দ্যাখ মৌসুমী। ওই যে উপরের পাশাপাশি দুটো ঘর। বাঁদিকেরটা আমাদের। দেওয়ালজোড়া কাচের জানলা। এদিকে ঠিক পাশের ঘরেই কোনও জানলা নেই। শুধু একেবারে উপরে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি। এমন কেন?”

    “তাহলে তো ঠিকই আছে। এটা ভাঁড়ার ঘর বা গুদাম টাইপের কিছু ছিল হয়তো। এখানে লোক থাকত না।”

    “কিন্তু ভাঁড়ার ঘর তো নিচে…”

    “সে তো এখন। সেই সাহেবের আমলে কী ছিল, তার ঠিক আছে?”

    নিধি কোনওমতে মাথা নেড়ে “তাই হবে হয়তো” বলল বটে, কিন্তু মনের খচখচানিটা রয়ে গেল।

    ৪

    শব্দটা প্রথম পেল নিধিই। ভোররাতের দিকে। চাপা কিন্তু স্পষ্ট। কোনও ধাতব বস্তুকে মাটিকে ঘষটানোর আওয়াজ। মাঝে মাঝে ধাতুর ঝনঝনানি। ঘুমের মধ্যে প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে পারেনি। যখন পারল, তখন আওয়াজ আরও বেড়েছে। হাত বাড়িয়ে নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে প্রায় ফিসফিস করে মৌসুমীকে ডাকল নিধি। ওর ঘুম অনেক বেশি গাঢ়। সহজে ভাঙতে চায় না। বেশ কয়েকবার ঠেলাঠেলির পর চোখ মেলল মৌসুমী। জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কী হল রে?”

    “শোন, কীসের যেন একটা শব্দ।”

    কান পেতে শুনল মৌসুমী। শব্দটা বাড়ছে।

    “কোথা থেকে আসছে বল তো?”

    “সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

    মৌসুমী এবার খাটের ওপরে বসে পড়ল। চেষ্টা করল শব্দের উৎস খোঁজার। এদিকে সেই ধাতব শব্দ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আরও অদ্ভুত একটা শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে গোটা ঘরে চারিয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন পাশের ঘরের দেওয়ালে কিছু একটা ঘষে চলেছে। অবিরাম। অক্লান্তভাবে। একটা ঘ্যাসঘ্যাসে শব্দ আর ওয়ালপেপার ছেঁড়ার ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ। এবার সেই আওয়াজটা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে তীব্র এক কিচকিচে অদ্ভুত ধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে। এবার আর কোনও সন্দেহ নেই। সব শব্দের উৎস ওই পাশের বন্ধ ঘর।

    “মনে হয় ইঁদুর”, বলেই তড়াক করে বিছানা থেকে নামল মৌসুমী। দরজা খুলেই পা বাড়াল পাশের ঘরের দিকে। একা এই সময় এই ঘরে থাকবে এত সাহসী মেয়ে নিধি না। সে-ও পিছু নিল। পাশের ঘরের ভারী দরজায় খানিক কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল মৌসুমী। আওয়াজ কমে আসছে। কিন্তু একটা চাপা গোঙানির শব্দ। একটা বাচ্চা মেয়ের গলা। তাহলে কি কাউকে এই ঘরে বন্দি করে রেখেছে এরা? সাহস করে চাবির গর্তে চোখ দিল মৌসুমী। আর দিয়েই চমকে উঠল। কিছু দেখতে পাবে আশা করেনি। কিন্তু দরজার ফুটো দিয়ে দেখল এক অদ্ভুত নীল আভা। স্বচ্ছ কেলাসের মতো। সেটা যেন জ্যান্ত। নড়ছে এদিক ওদিকে। সংবিৎ ফিরল নিধির ডাকে।

    “কি রে? কিছু দেখতে পেলি?”

    “নাহ”, বলে উঠে গেল মৌসুমী।

    সেদিন রাতে দুজনের কারও ঘুম এল না।

    ৫

    দরজায় চোখ লাগিয়ে মৌসুমী যা দেখতে পেয়েছিল, সেটা নিধিকেও পরে বলল সে। নিধিও কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বোঝা গেল ভয়ানক কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে। বাড়ির মালকিন ইয়াংজিকে জিজ্ঞেস করে খুব বেশি লাভ হল না। একে তো তিনি বাড়ির বউ, বাড়ির ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ তাঁর নেই। বাড়ির দোতলায় তিনি কদাচিৎ যান। তিনি পরিষ্কার জানালেন আজ অবধি এই বাড়িতে তিনি কোনও আওয়াজ শোনেননি, বা ওই ঘর বন্ধ কেন তা জানার বদ খেয়ালও কোনও দিন তাঁর হয়নি। মৌসুমীদেরই বা এমন খেয়াল কেন হল তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

    মৌসুমী বুঝল এঁকে জিজ্ঞেস করা বৃথা। এদিকে পাশের ঘরের শব্দ বন্ধ হচ্ছে না। এটা কোনও প্যাটার্ন মেনে চলে না। কোনও রাতে হয়, কোনও রাতে হয় না। এমনকি বেশ কবার সন্ধ্যা আর দুপুরেও এই আওয়াজ শুনেছে ওরা। আওয়াজ শুনলেই দরজার পিপহোলে চোখ লাগায় ওরা। আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। আর সেই স্বচ্ছ নীলাভ আভা। ঘরের ভিতরের কিচ্ছুটি দেখা যায় না।

    দিন সাতেক বাদে, সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ব্রেকফাস্ট করতে গেছিল মৌসুমী। খাবারের টেবিলে এক অতিবৃদ্ধ গোর্খাকে দেখে চমকে গেল। আগে তো কোনও দিন এঁকে দেখেনি সে! চুল ধবধবে সাদা। চামড়া ঝুলে গিয়ে চোখের উপরে এসে চোখ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। খাবার টেবিলে মৌসুমীকে দেখেই চোস্ত ব্রিটিশ উচ্চারণে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “ভেরি গুড মর্নিং ইয়াং লেডি। হোপ এভরিথিং ইজ ফাইন।” গোর্খাদের মধ্যে এইরকম উচ্চারণ আগে শোনেনি মৌসুমী। আলাপ করে জানতে পারল ইনি পেম্বা তামাং। বাড়ির আদত মালিক। এঁকেই বাড়ি দান করে মারা গেছিলেন সাহেব। তাহলে তো এই বাড়ির সব ইতিহাস ইনিই জানবেন! গল্প জুড়ল মৌসুমী।

    জানতে পারল এই ধরনের পাশকপালি “কুইন অ্যান” বাড়ি খুব বেশি নেই কালিম্পং-এ। অনেকদিন আগে এক নীলকর সাহেব ছিল। নাম টমাস ম্যাকগ্রেগর। প্রচণ্ড অত্যাচারী। রায়তরা তাঁকে ডাকত ম্যাকগরগর সাহেব বলে। নীলবিদ্রোহ শুরু হলে রায়তরা তাঁকে পিটিয়ে মারে। তাঁর বউ ছেলে কোনওমতে পালিয়ে বাঁচে। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন ড্যানিয়েল সাহেব। ভালো মানুষ। দার্জিলিং-এর চা বাগানের মালিক। তাঁর কাছেই মানুষ হয় টমাসের ছেলে ডেভিড। ডেভিড বড়ো হলে তাঁকেও চায়ের ব্যবসার অংশীদার করার প্রস্তাব দেন ড্যানিয়েল। শর্ত একটাই। বিয়ে করতে হবে তাঁর মেয়ে এলিজাকে। এলিজা ছিল পাগল। লোভে পড়ে বিয়ে সেরেই ফেলেন ডেভিড। ব্যবসায় লক্ষপতি হলেও সংসারে সুখ ছিল না। দার্জিলিং থাকাকালীনই তাঁদের এক মেয়ে হয়। মারিয়া। মারিয়ার জন্মের পরেই তার মায়ের পাগলামো বাড়তে থাকে। অকারণে ছুরি দিয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইতেন তিনি। একদিন হাত পা বেঁধে ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে চিরে দিতে থাকেন মারিয়ার শরীর। মারিয়া তখন বড়োজোর দশ বছরের হবে। খানসামা পেম্বা না থাকলে হয়তো মারাই যেত বেচারি। ঠিক দুই দিন পরে এলিজার দেহ সিলিং থেকে লটকানো দেখতে পান পেম্বা-ই। স্ত্রী পাগল হলেও তাঁকে ভালোবাসতেন ডেভিড। একেবারে ভেঙে পড়েন এই ঘটনায়। সব ব্যবসাপাতি গুটিয়ে কালিম্পং চলে এলেন। তৈরি করলেন এই বাড়ি।

    “তারপর?” চমকে উঠে মৌসুমী দেখল কোন ফাঁকে নিধি এসে তার পাশে বসে গল্প শুনছে।

    “কিন্তু মারিয়ার রক্তে পাগলামো ছিল”, আবার বলতে শুরু করলেন পেম্বা। “মায়ের গুণ পেতে লাগল ধীরে ধীরে। তার মধ্যেও ধীরে ধীরে নিজেকে শেষ করার এক উদগ্র বাসনা প্রবল হয়ে ওঠে। ব্লেড, ছুরি, যা হাতের কাছে পেত হাত পা কাটত।”

    “ডাক্তার দেখাননি মারিয়াকে?” এবার মৌসুমীর প্রশ্ন।

    পাশাপাশি মাথা নাড়লেন পেম্বা। “নাহ। কাউকে না। ওকেও না, ওর মাকেও না। সাহেবের এই এক অদ্ভুত বাই ছিল। ভাবতেন ডাক্তার দেখালে তাঁর বদনাম হবে। তাই লোকের কাছে বলতেন স্ত্রী অসুস্থ। আর মারিয়ার বেলা যেটা করলেন সেটা আরও পাশবিক।”

    “কী?”

    “কালিম্পং-এ আসার পর থেকেই মারিয়াকে ওপরের ঘরে বন্দি করে রাখা হত। ওকে কেউ দেখতে পেত না। ওর কথা কেউ জানতও না। আমি আর সাহেব ছাড়া। কেউ জিজ্ঞেস করলে সাহেব বলতেন তাঁর মেয়ে বউ দার্জিলিং-এ থাকতেই মারা গেছে। জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে মেরে ফেলে দিলেন সাহেব। এদিকে বেচারা মেয়েটা সারাদিন ঘরে বসে বসে কাঁদত। একটিবার বাইরে যেতে চাইত। দিনরাত দেওয়ালের গায়ে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে কী লিখত কে জানে! আমিই ওকে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতাম দুবেলা। তারপরে একদিন সাহেব খুন হলেন।”

    “খুন হলেন মানে?”

    “সে আর-এক রহস্য। তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়ছে। সাহেব ঠিক করলেন মেয়েকে নিয়ে লন্ডন চলে যাবেন। বাড়ি লিখে দিলেন আমার নামে। একদিন মারিয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছিলেন লন্ডন যাবার ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গেছে। এক মাসের মধ্যেই তিনি চলে যাবেন। আমার এখনও মনে আছে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমরা দুজন উপরে মারিয়ার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এমন সময় খিল লাগানোর শব্দ। আমি, সাহেব বারবার দরজা ধাক্কালাম। চিৎকার করলাম। মারিয়া কিছুতেই দরজা খুলল না। এদিকে সাহেব বেশি লোক জানাজানি হোক চান না। আমি বললাম কার্শিয়াং-এ আমার ভাইয়ের বাড়ি। সে এসব দরজা নিমেষে খুলতে পারে। সাহেব রাজি হলেন। সেই রাতে বৃষ্টির মধ্যেই আমি কার্শিয়াং রওনা হলাম। পরদিন ফিরেই দেখি বাড়ির সামনে পুলিশ। আমি ঢুকতেই আমায় গ্রেপ্তার করল। আগের দিন রাতে সাহেব খুন হয়েছেন। খুব ধারালো কিছু দিয়ে তাঁর সারা শরীর কেউ চিরে দিয়েছে। পুলিশের সন্দেহ আমিই খুন করেছি। মামলা চলল। প্রমাণ হল আমি সেদিন রাতে ছিলামই না। ছাড়া পেয়ে এই বাড়িতেই এলাম।”

    নিধি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আর মারিয়া? ওর কী হল?”

    “সেটা কেউ জানে না। আমি পুলিশকে মারিয়ার কথা বলেছিলাম। পুলিশ বিশ্বাস করেনি। উপরের এই ঘরের দরজা হাট করে খোলা ছিল। ভিতরটা ফাঁকা। ফাঁকা আর পরিষ্কার। একটা ধুলোর কণাও ছিল না গোটা ঘরে। যেন কেউ ঘরের সব কিছু শুষে নিয়ে গেছে। পুলিশের সামনেই দরজাটা আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। আর কোনও দিন অনেক চেষ্টা করেও কেউ খুলতে পারেনি। আমি এই বাড়িতে আসার পরেও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি, পারিনি। সেই রাতে ঠিক কী হয়েছিল তা আজও আমার অজানা।”

    ৬

    ঘর থমথমে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। প্রথম কথা বলল নিধি।

    “আঙ্কেল, আপনার কাছে মারিয়ার কোনও ছবি আছে?”

    “আছে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।” বলে অল্প লেংচে লেংচে পাশের ঘরে চলে গেলেন ভদ্রলোক। ফিরে এলেন একটা মোটা কার্ডবোর্ড বাঁধানো ছবি নিয়ে। হাতে আঁকা না। ফটোগ্রাফ। সাদাকালো ছবিতে রং বুলিয়ে কালার করা। এই ধরনের ছবি এককালে বেশ জনপ্রিয় ছিল ভারতে।

    “আমার কী মনে হয় জানো?” নিধির হাতে ছবিটা ধরিয়ে দিয়ে আপনমনে বলতে থাকেন পেম্বা, “আমার ধারণা মারিয়া আজও ওই ঘরেই আছে। জানি তোমরা আমায় পাগল বলবে। ইয়াংজিও বলে। কিন্তু আমি ওর চলার আওয়াজ পাই। কাঠে নখ ঘষার আওয়াজ পাই। শিকলের ঝনঝন শন্দ শুনতে পাই। যেমন আগে পেতাম। বয়স প্রায় একশো হল। সবাই বলে মনের ভুল…”

    মৌসুমী তখন মারিয়াকে দেখছিল। এ ছবি দার্জিলিং-এ তোলা। দাস স্টুডিওতে। ছোট্ট মারিয়া। মাথাভরা চুল। মুখটা কেমন বিষণ্ণ। মায়াভরা। মৌসুমীর খারাপই লাগছিল মেয়েটার জন্য।

    হঠাৎ নিধিকে দেখে চমকে উঠল সে। নিধির চোখ বড়ো হয়ে গেছে। মুখ হাঁ করে খলা। গোটা দেহ শক্ত। যেন চরম কোনও আতঙ্ক তাকে এক মুহূর্তে স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে।

    “অ্যাই নিধি? কী হল? এরকম করছিস কেন?”

    ফিসফিস করে নিধি শুধু বলতে পারল, “মারিয়ার চোখ… নীল রঙের… মানে… আমরা যখন পিপহোল দিয়ে মারিয়াকে দেখি, মারিয়াও আমাদের দ্যাখে!”

    লেখকের জবানি: এই কাহিনি আমার নিজের কানে শোনা। আমার এক দূর সম্পর্কের বোন মৌসুমী পুনেতে ঘর খুঁজতে গিয়ে শুনেছিল এক সাহেবের বাংলোবাড়িতে নাকি কেউ ঘর নেয় না। কারণ তাতে ভূত আছে। একটা বাচ্চা মেয়ে মারা গেছিল সেই ঘরে। আমি পুনে যাইনি। কিন্তু কালিম্পং-এ কর্মসূত্রে প্রায় দশ বছর ছিলাম। এখানে যে বাড়িটার কথা বলা হয়েছে, ওটা আদতে সেই বাড়ি যেখানে আমি নিজে দশ বছর থেকেছি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার
    Next Article সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    Related Articles

    কৌশিক মজুমদার

    নোলা : খাবারের সরস গপ্পো – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    নীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    অগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার

    August 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.