শল্লের নাভি
এই গল্প আমার না। সত্যি বলতে কী, এটা গল্প, নাকি সত্যি ঘটনা, সেটাও ঠিক জানা নেই। বাড়ির একটা ড্রয়ারের চাবি বহুদিন পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবারই পাওয়া যাবে ভেবে কেউ আর ড্রয়ারটা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। অবশেষে বছর দু-এক আগে চাবিওয়ালা ডেকে ড্রয়ারটা খোলা হয়। ভিতরে জরুরি কিছু নেই। শুধু একটা আতশকাচ, কিছু শুকনো ফুল আর একটা টিনের বাক্সের মধ্যে একটা বাঁধানো খাতা ছিল। চামড়ায় বাঁধানো। রয়্যাল সাইজ। আমার পিতামহ স্বর্গীয় বলহরি মজুমদারের খাতা। তাঁর এমন অদ্ভুত নামের কারণ আমি ছোটোবেলায় বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি এড়িয়ে যেতেন। বাবা, জেঠু বা পিসিদের জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পাইনি। তাঁরাও নাকি জানতেন না। খাতার মধ্যে ছোটো ছোটো হিসেবপত্র, রামঠাকুরের বাণী ইত্যাদির পর কয়েক পাতা উনি নিজেকে নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছিলেন। অনেকটা আত্মজীবনীর মতো। সেই সামান্য কটি পাতাতেই তাঁর নামের কারণ হিসেবে এই গল্প রয়েছে। যে কাহিনি এতকাল সযত্নে সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি, সেটাই আপনাদের বলব। তাঁর ভাষা ও বানানে সামান্য কিছু পরিবর্তন করলাম।
“আমার পিতৃদত্ত নাম প্রফুল্লকুমার মজুমদার। আদি বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের টঙ্গি। বাংলাদেশে থাকাকালীন ওখানেই পোস্টাল অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টে করণিকের চাকরি পাই। আমার বিবাহ আর প্রথম দুই সন্তানের জন্ম ওই দেশেই। দেশভাগের আগে ১৯৪৩ সালে আমি কলকাতায় বদলি হই ও সেই থেকে আজ অবধি ভারতবর্ষের নাগরিক হয়েই বসবাস করছি। এখন এই দেশকেই আমি আমার দেশ মেনে নিয়েছি।
ডায়রিতে মিথ্যা লিখতে নেই। এক ভয়ংকর ঘটনায় আমার নাম প্রফুল্ল থেকে পরিবর্তন করে বলহরি রাখা হয়। আমি নিজেও অনেক পরে তা জেনেছি। সে ঘটনা আমার স্মৃতিতে নেই ঠিকই, কিন্তু তার প্রমাণ আমি আজও বহন করে চলেছি। এ কথা আমি কাউকে কোনও দিন বলিনি, বা বলব না। কারণ একটাই। আমি নিজেই ঘটনাটা পুরো বিশ্বাস করতে পারি না।
বিক্রমপুরে আমাদের দেশের বাড়ির ঠিক পাশেই এক শ্মশান ছিল। খুব বড়ো শ্মশান না, আশেপাশের কয়েক ঘর লোকজনের কেউ মারা গেলে ওখানেই পোড়ানো হত। শ্মশানের একপাশ দিয়ে ছোটো একটা সোঁতা ছিল। আমি বড়ো হবার আগেই তা শুকিয়ে যায়। সেই শ্মশানের ডোম ছিল হরিয়া। হরিয়ার পুরো নাম কেউ জানত না। সারাদিন মদ খেয়ে দুই চোখ লাল। টলতে টলতে চলে, কিন্ত্রু মড়া এলেই একেবারে সিধা। তখন তার গায়ে হাতির বল। নিজেই কাঠ কেটে চিতা সাজিয়ে মড়া পোড়াত। যতক্ষণ মড়া পুড়ছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত মড়ার দিকে, যেন কোনও নাটক বা সিনেমা দেখছে।
আমার ছোটোকাকা পরেশচন্দ্র একটু বাউন্ডুলে স্বভাবের ছিলেন। পড়াশুনো মাথায় ঢুকত না। ঠাকুর্দা বহুবার বলেও তাঁকে ইন্টার দেওয়াতে পারেননি। সেই ছোটোকাকা হরিয়ার চ্যালা হয়ে গেলেন। দিনরাত শ্মশানে পড়ে থাকতেন। হরিয়ার ফাইফরমাশ খাটতেন। তার নেশার জিনিস নিয়ে আসতেন। ঠাকুর্দারা কেউই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেননি। কাকাকে ঘরমুখী করার জন্য মাত্র ষোলো বছর বয়সেই কাকার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। কাকিমা ছিলেন ঢাকারই মেয়ে। আমাদের পালটি ঘর। একেবারে শান্ত, চুপচাপ। কাকার পুরো বিপরীত। বিয়ে দেবার পরও কাকার কোনও বদল হল না। বরং শ্মশানে যাওয়া বেড়ে গেল। ঠাকুর্দা হাল ছেড়ে ভাঙা মনে মারাই গেলেন।
ঠাকুর্দা মারা যাবার এক মাসের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। এক রাতে তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর সেরকমই বাজ। পরের দিন ভোরে কাকা হরিয়ার কুঁড়েঘরে গিয়ে চমকে গেলেন। বাজ পড়ে কুঁড়েঘরের একটা অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আর তার ভিতরে আধপোড়া হয়ে মরে পড়ে আছে হরিয়া। মদের নেশায় উঠে পালাতে অবধি পারেনি। এই ঘটনা নিয়ে আমাদের বাড়ির আশেপাশে বেশ একটা সাড়া পড়ে গেল। হরিয়া সবার মড়া পোড়াত। এবার তার মড়ার সৎকার করবে কে? শোনা গেল পাশের গ্রামে নাকি আর-এক চণ্ডাল আছে। কিন্তু দুর্যোগের দিনে তাকে কে ডাকতে যাবে ইত্যাদি নিয়ে প্রায় সারাদিন গেল। সন্ধেবেলা যখন সে এল, তখন প্রায় সারাদিন হরিয়ার আধপোড়া দেহ ওই কুঁড়েতেই অরক্ষিত অবস্থায় আছে। শুনেছি কাকা খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবা একটু খুশি হয়েই বলেছিলেন, “হরিয়া আমাগো পোলাডার মাথা খাইসিল। অ্যাহন যদি ঈশ্বর অরে সুমতি দ্যান..।” মড়া পোড়ানোর সময় আর-এক কাণ্ড। পোড়ানো তখন প্রায় শেষ, আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। সঙ্গে ভয়ানক বাজ। সেই ডোম উপায় না দেখে আমাদেরই এক পড়শি হারাধন কাকার বাড়িতে আশ্রয় নিল। মাঝরাত নাগাদ বৃষ্টি কমলে মশাল জ্বালিয়ে তিন-চারজন গেল দেখতে। মড়া পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল প্রায়। কিন্তু সেই ডোম কী যেন দেখে চমকে উঠল। বারবার করে খুঁজতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা খুঁজেও যখন পেল না, তখন তার চোখেমুখে স্পষ্টই ভয়ের ছাপ।
— বাবু, আফনেরা এট্টু সাবধানে থাইক্যেন।
— ক্যান? কী হইল আবার?
— বাবু, হরিয়ার খুলি আর নাইখান কে য্যান লইয়া গ্যাসে। আমার ভাল্লাগতাসে না বাবু….
— ক্যান নিব? ঠিক কইর্যা দ্যাখ। আসে এদিক ওদিক..
— আমি দেখসি বাবু। কোত্থাও নাই। কেউ লইয়া গেসে।
সেই ডোম হাউমাউ করে এরপর যা বলল তার মানে শনিবার অমাবস্যা তিথিতে হরিয়া অপঘাতে মরেছে। তার দেহ উপযুক্তভাবে দাহ হয়নি। এদিকে তার খুলি আর নাভি পাওয়া যাচ্ছে না। এ এক ভয়ানক অমঙ্গল। চণ্ডাল অপঘাতে মরলে চণ্ডু হয়। আর তার নাভি থেকে হয় শল্ল। একবার চণ্ডু হলে গয়ায় পিণ্ডি দিয়েও নাকি উদ্ধার নেই। যেদিন বজ্রপাতে মারা গেছে সেইদিন থেকে ২০০০ চান্দ্রমাস তাকে চণ্ডু হয়ে থাকতে হবে। গোলামি করতে হবে সেই মানুষটির, যার কাছে তার খুলি আছে। শল্ল আরও খারাপ। কেউ এই শল্ল জোগাড় করে কারও ভিটাতে পুঁতে দিলে এক বছরের মধ্যে তার ভিটামাটি উচ্ছন্নে যাবে। তারা নির্বংশ হবে। তবে… বলে সেই ডোম চুপ করে গেল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে কেউ আর একটা কথাও বলাতে পারেনি। পরের দিন সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে ডোম তার গ্রামে ফিরে গেল। তাকে দস্তুরি দিতে চাইলেও সে এক পয়সা নেয়নি। শুধু বারবার বলেছিল, ‘আপনারা সাবধানে থাকুন বাবু… খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।’
আমি তখন মায়ের পেটে। বাবার কাছে শুনে মা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেলেন। কেউ তাঁকে পরামর্শ দিলেন ওঝা ডেকে বাড়ি বন্ধন করার। ওঝা এসেওছিল। কিন্তু বাড়ি বন্ধন করা যায়নি। যতবার বাড়ির চারদিকে মন্ত্রপড়া জলের ঘট রাখা হচ্ছিল, ততবার সেটা নাকি উলটে যাচ্ছিল, যেন কেউ ইচ্ছে করে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। ওঝা যাবার আগে বলে গেল, ‘মা ঠাইরান, গতিক ঠিক নাই। সাবধানে থাইক্কেন।’
হরিয়া মারা যাবার পর কাকার বাইরে বেরোনোর নেশা কমে গেল অনেকটাই। ছোটোকাকা বাড়ির বাইরে উঠানে একটা ছোটো কুঁড়েঘর মতো বানিয়ে নিলেন। ওখানেই নাকি সাধন ভজন করবেন। ঘরেই থাকতেন। কী সব যেন করতেন। আর কাগজে হিজিবিজি লিখতেন। বাবা আপত্তি করলেও যখন ভাবলেন বেশি মানা করলে হয়তো বাড়ি ছেড়ে আবার শ্মশানে শ্মশানে ঘুরবে, তখন নিমরাজি হলেন। কাকিমা অনেক কেঁদেও সুরাহা করতে পারলেন না। কাকা রাতের পর রাত ওই ঘরেই কাটাতে লাগলেন। স্বপাক রান্না করতেন। সারাদিনে তাঁর মুখ প্রায় দেখা যেত না বললেই চলে। প্রথম ঘটনাটা ঘটল হরিয়া মারা যাবার ঠিক এক মাস পরে। আবার এক অমাবস্যার রাতে। আমাদের পাড়ায় যতীন বাঁড়ুজ্যেরা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিলেন। তিন ছেলে, দুই ছেলের বউ। পাকা বাড়ি, জমিজমা নিয়ে এলাহি কারবার। অনেক আগে একবার ওঁদের খাতাপত্রের হিসেব রাখার জন্য ঠাকুর্দা ছোটোকাকার হয়ে তদবির করেছিলেন। যতীনবাবু কাকার সামনেই ঠাকুর্দাকে বেশ দু কথা শুনিয়ে দেন। সেই যতীনবাবুকেই তাঁর ঘরে মরা অবস্থায় পাওয়া গেল। জিভ বের করা, গলায় লাল দাগ, চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে। অপঘাতে মৃত্যু বলে তিনদিনে শ্রাদ্ধ হল। সেদিনও ঝামেলা। আত্মা নাকি কিছুতেই পিণ্ড গ্রহণ করছে না। পিণ্ড মাখতে গেলেই তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনোহর আচার্যি ছিলেন অগ্রদানী ব্রাহ্মণ। সেই পিণ্ড খেতে গিয়ে গলায় আটকে তাঁর প্রাণ যায় যায় দশা। পাড়ার সবাই বুঝল, কিন্তু কেউ মুখে উচ্চারণ করল না। শল্ল তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ঠিক একমাস পর থেকে।
এর মধ্যে আমার মা একদিন ভয় পেলেন। পোয়াতি মহিলা, রাতে ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম ভাঙল অদ্ভুত অস্বস্তিতে। জেগে জানালা দিয়ে দেখেন বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। কাকার ঘরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে এল। বিরাট কালো শকুনের মতো একটা পাখি কাকার ঘরের চালে বসে আছে। কিন্তু এ কেমন শকুন, যার মুখটা অবিকল মানুষের মতো! কাকার ঘরের দরজা খুলে গেল। কাকা বেরিয়ে এলেন। কাকার দুই হাতে ছটফট করছে দুটো মুরগি। কাকা সে দুটো উঠোনে রাখলেন। পাশে রাখলেন ধামাভরা মুড়ি। মা এত অবাক হয়ে গেছিলেন তাঁর গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। পাখিটা অদ্ভুত সরসর করে নেমে এল। কাকা হাত দিয়ে মুরগির মাথা দুটো ছিঁড়ে পাখির সামনে রাখলেন। পাখিটা চোখ তুলে সোজা তাকাল মায়ের দিকে।
যখন মায়ের মুখে এই গল্প শুনেছি, তখন আমি বছর দশেক হবে। তখনও দেখেছি মা এই জায়গাটা বলতে গিয়ে শিউরে ওঠেন। তাঁর গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। মা স্পষ্ট দেখলেন পাখিটার মুখ শুধু মানুষের মতো না। চেনা একজন মানুষের মতো। হরিয়া…
সেই রাতেই মায়ের প্রচণ্ড রক্তপাত শুরু হয়। বাবা ভোর হতেই দাই মাকে ডেকে আনেন। সব দেখেশুনে তিনি নাকি মাকে বলেছিলেন এই বাড়িতে অপদেবতার ভর আছে। বলেছিলেন সন্ধ্যার পর চুল খোলা না রাখতে, রাতে জানলা বন্ধ রাখতে, বাইরে না বেরোতে। একটা তাগাও যেন বেঁধে দিয়েছিলেন মায়ের হাতে। বলেছিলেন আমার যখন পাঁচ বছর হবে, তার আগে যেন মা ওটা না খোলেন। কিছুটা সেরে উঠে মা শুনতে পান যতীন বাঁড়ুজ্যের বড়ো ছেলে আগের রাতে বাইরে বেরিয়েছিল বাহ্যি করতে। কে যেন তার টুঁটি কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে। মা পরে কাকাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠাকুরপো, কাইল ভোররাত্তিরে ঘরের বাইরে তুমি কী করত্যাসিলা?” কাকা নাকি অম্লানবদনে বলেন যে তিনি সারারাত নিজের ঘরেই ঘুমিয়েছেন। মা যা দেখেছেন সব ভুল।
বছর ঘুরল না, যতীনবাবুর বাড়ির সবাই একে একে মারা গেলেন। সব অপঘাতে। অত বড়ো বাড়ি খাঁ খাঁ করত। এবারে সবাই নিশ্চিত হল কেউ না কেউ তাঁর বাড়ি শল্লের নাভি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখানেই কি শেষ? নাকি শল্লের খিদে এখনও মেটেনি? আমাদের পাড়ায় সর্বদা একটা থমথমে পরিবেশ। এদিকে আমি ততদিনে জন্মে গেছি। আমার ছয় মাস বয়স। অন্নপ্রাশন, নামকরণ সব হয়ে গেছে। কাকাও কুটির ছেড়ে আমাদের মূল বাড়িতে এসে থাকেন। কুঁড়েঘর তিনি নিজের হাতে ভেঙে দেন। শুধু স্মৃতি হিসেবে একটা ছোট্ট ঢিপি আর তাতে একটা বেলগাছ লাগানো ছিল সেই জায়গায়। মায়ের মনে অনেকদিন একটা সন্দেহ দানা বাঁধছিল, বাবাকে বলেওছিলেন, কিন্তু বাবা আমল দেননি। ‘কী যে কও’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আমার কাকিমা মাখনলতার কোনও সন্তানাদি ছিল না। লোকে আড়ালে তাঁকে বাঁজা বলত। তাঁর সব স্নেহ তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন আমার জন্য। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি আমাকে নিয়েই কাটাতেন। সাজাতেন নিজের মতো করে, গান শোনাতেন, ঘুম পাড়াতেন। সবই মায়ের কাছে শোনা। আমার কোনও স্মৃতি নেই।
এখন যেদিনের ঘটনা লিখব, সেদিন নীলপুজো। পুজোর সরঞ্জাম গোছাতে গিয়ে মা খেয়াল করলেন বেলপাতা কম পড়ে গেছে। হালদার বাড়ির বড়ো বেলগাছ ছিল বটে, কিন্তু সে বেশ দূরে আর ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মা পুজোয় বসে গেছেন। জল ঢালা হয়েছে। এখন ওঠাও মুশকিল। মা কাকিমাকে বললেন, ‘ছোড, ঠাকুরপোর অই বেলগাছ থিক্যা কটা বেলপাতা পাইড়্যা আনবি?’ কাকিমা পাতা আনতে গেলেন। মা অপেক্ষা করছেন। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেলেও যখন কাকিমা এলেন না, মা বাধ্য হয়ে পুজো ছেড়ে উঠলেন। বাবা আর কাকা কোনও কাজে ঢাকা টাউনে গেছিলেন। ফিরতে রাত হবে। বেরিয়ে যা দেখলেন তাতে মায়ের চক্ষুস্থির। দেখেন সেই বেলগাছের ঢিপির পাশে অদ্ভুত ভাবে বসে আছেন কাকিমা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর সব অঙ্গ অসাড়। মাকে দেখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কাকিমা শুধু বললেন, ‘উঠতে পারত্যাসি না দিদি, উঠতে পারত্যাসি না।’ মা দৌড়ে এসে কাকিমাকে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাকিমার ওজন যেন এক নিমেষে হাজারগুণ বেড়ে গেছে। মা সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও কাকিমাকে একচুল নাড়াতে পারলেন না।
মায়ের চিৎকারে আশেপাশের বাড়ির লোক ছুটে এল। প্রথমে মহিলারা, তারপর পুরুষরাও হাত লাগাল। কাকিমাকে একচুল নড়ানো গেল না। ততক্ষণে কাকিমা অজ্ঞান হয়ে এলিয়ে পড়েছেন। তবুও তাঁকে নড়ানো যাচ্ছে না দেখে এবার সবাই ভয় পেলেন। ঠিক হল ওঝা ডাকতে হবে। ওঝা পাশের গ্রামে। রাত হয়েছে। বাড়িতে পুরুষমানুষ নেই। কে যাবে এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা করতে করতে রাত প্রায় আটটা বাজল। শেষে পাশের বাড়ির গজানন রায় আর তাঁর দাদা লন্ঠন আর লাঠি নিয়ে চললেন ওঝা আনতে। তাঁরা যাবার খানিক বাদে বাবা আর কাকা ঢুকলেন। কাকাকে ঢুকতে দেখেই কাকিমা নাকি শোয়া অবস্থা থেকে একেবারে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর অদ্ভুত পুরুষালি গলায় কাকাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ছোটোবাবু, এতক্ষণে আইলেন?’ কাকিমাকে ওই ঢিবির কাছে দেখে কাকার চোখ কপালে উঠল। চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি ওহানে ক্যান গেস ছোড বউ? কে তোমারে যাইতে কইসে?’ কাকিমা উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখ হাসি হাসি। সারা শরীর হাসির দমকে দুলছে। কিন্তু মুখ দিয়ে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে তা হাসির নয়। যেন কোনও পিশাচ কারও গলা টিপে ধরেছে, এমন পৈশাচিক গোঁ গোঁ শব্দ। মা কাকাকে জানলেন ঠিক কী হয়েছিল। ‘ও নিশ্চয় ঢিপিতে পাড়া দিসিলো’ বলে কাকিমাকে টেনে সরাতে চাইলেন কাকা। কিন্তু কাকিমার দেহে মত্ত হাতির জোর। তবে হাসি থেমেছে। মুখ থেকে গ্যাঁজা উঠছে।
ওঝা এসে প্রথমেই কাকাকে জিজ্ঞেস করলেন ঢিবিতে কী পোঁতা আছে। এদিকে আমি ঘরের ভিতরে কাঁদছিলাম বলে মা আমাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মা প্রথমে কিছু শুনতে পেলেন না। পরে ওঝা রীতিমতো ধমক দেওয়ায় কাকা প্রায় ফিসফিসে স্বরে বললেন, ‘চণ্ডুর হাড়।’ ওঝাও অবাক।
— এ হাড় আফনে পাইলেন ক্যামনে?
— হরিয়ার হাড়। ও অমাবস্যায় মরসিলো। আমি চিতা থিক্যা উঠাইসিলাম।
— আর কী উঠাইসিলেন?
কাকা জবাব দেন না। ওঝা আবার ধমকে ওঠেন।
— সত্যি কইর্যা কন। আর কী উঠাইসিলেন?
— শল্লর নাভি।
— সে নাভি কোথায় পুঁতসিলেন?
— যতীন বাঁড়ুজ্যেগো বাড়ি।
— ক্যান?
— বাপেরে আকথা কুকথা কইসিল, তাই।
— চণ্ডুর হাড় বশ করা আফনেরে কে শিখাইল?
— হরিয়াই কইসিল আমারে।
— বাঁড়ুজ্যেগো সকলে মরণের পর আফনে শল্লডার সৎকার করসেন?
কাকা পাশাপাশি মাথা নাড়লেন। করেননি। শল্লর নাভি ওই বাড়িতেই পোঁতা আছে। ওঝা বারবার কপালে করাঘাত করলেন। অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। চণ্ডুর হাড় আর শল্লের নাভি একে অপরের পরিপূরক। চণ্ডুর করোটিকে বশ করে শল্লকে দিয়ে কাউকে ধ্বংস করে ফেলা যায়। কিন্তু কাজ শেষের পর সঙ্গে সঙ্গে সেই শল্লের নাভিকে যথাবিহিত সৎকার করতে হবে। চণ্ডুর হাড় কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। শল্লকে ধবংস না করলে সেই করোটির হাড় নিজেই শল্লকে নির্দেশ দিয়ে কাজ করায়। আর সে কাজ বড়ো ভয়ানক। প্রথমেই সে আক্রমণ করে তাকে যে বশ করেছিল তার কোনও প্রিয়জনকে। সেদিন ঢিবিতে কাকিমার পা পড়াতে চণ্ডুর করোটি জাগ্রত হয়েছে। সে-ই শল্লকে দিয়ে এসব করাচ্ছে।
কাকা মাথা নিচু করে বসে আছেন। ঘরভরা লোকের সামনে তাঁর কীর্তি ফাঁস হয়ে গেছে। বাবাই প্রথম কথা বললেন, ‘এহন উপায়?’
ওঝা জানালেন শল্লকে মাটি থেকে উঠিয়ে এনে যজ্ঞের আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু তার আগে কাকাকে এই জায়গা থেকে সরাতে হবে। কারণ শল্লকে ধ্বংস হতে দেখলে চণ্ডু নাকি যাকে ভর করে তার প্রিয়তম মানুষকে শেষ করে তারপর নিজে শেষ হয়। কাকা গিয়ে দেখিয়ে দিলেন কোথায় শল্লের নাভি পুঁতেছেন। ওঝা নিজে সেখান থেকে নিয়ে এলেন। কাকা এলেন না। রয়ে গেলেন পাশের বাড়িতে। কাকিমা তখনও সেই ঢিবির পাশে বসে। যজ্ঞের আগুন জ্বালানো হল। ওঝা তাঁর গেরুয়া রঙের থলির ভিতর থেকে কাপড়ে মোড়া মাথার খুলি বার করলেন। তাতে ঢাললেন কড়া মদ। মদের ওপরে সিদ্ধি পাতা আর মুড়ি ছড়িয়ে দিলেন। তারপর শুরু হল মন্ত্র। কাকিমার চোখ লাল। বনবন করে ঘুরছে। মুখ থেকে এমন অপার্থিব সব শব্দ বেরোচ্ছে যা পৃথিবীর কোনও মরমানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। ওঝা মন্ত্র পড়ছেন, কাকিমার গোঙানি বাড়ছে। ঠিক যেই মুহূর্তে ওঝা শল্লর নাভিকে আগুনে ফেলতে যাবেন, জ্যা-মুক্ত তিরের মত কাকিমা ছুটে চলে এলেন মায়ের কাছে। তারপর সোজা কামড় বসিয়ে দিলেন আমার কাঁধে। সবাই মিলে ধরাধরি করে যখন কাকিমাকে আলাদা করল, তখন আমার কাঁধের বেশ কিছুটা মাংস কাকিমার মুখে। ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে। তিনি হাসিমুখে মহানন্দে সেই মাংস চপচপ শব্দে চিবোচ্ছেন।
কাকিমা আর বাঁচেননি। সেই রাতেই মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে কাকিমা মারা যান। তাঁর প্রিয় মানুষ যে কাকা নন, আমি, সেটা বুঝতে পারেননি বলে মা অনেকদিন অবধি আক্ষেপ করেছিলেন। কাকাও পরদিন থেকে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান, কেউ তাঁর খবর পাননি। অনেকে বলেছিল, “পাপের শাস্তি।” তারপর ওঝা এসে একদিন আমাকে ঝাড়ালেন। তিনমাসেরও বেশি দিন লেগেছিল ঘা পুরো শুকাতে। সেটা অবশ্য ডাক্তারের কৃপা। মা বলতেন যমে মানুষে টানাটানি। বেঁচে যাওয়ার পর আমার প্রফুল্লকুমার নাম বদলে বলহরি রাখা হয়। বলহরি… যমের অরুচি।”
ঠাকুর্দা নব্বই বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর কাঁধের কাছে সেই অদ্ভুত ক্ষত আমিও দেখেছি। বলতেন গাছ থেকে পড়ে গিয়ে। এখন মনে পড়ছে… দেখলে মনে হয় কেউ যেন প্রবল হিংসায়, রাগে একটানে একদলা মাংস খুবলে নিয়েছে।
লেখকের জবানি: ঠাকুর্দার কাছে শীতসন্ধ্যায় যখন গল্প শুনতে চাইতাম, তার বেশিরভাগই ছিল ভূতের গল্প। গল্পের প্রথম দিকের সবকটা কথা সত্যি। বলহরি নাম ছিল তাঁর। উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছিলেন। গল্প শুনতে চাইলে তাই ফেলে আসা দেশের নানা গল্প শোনাতেন। এই গল্পের কিছু কিছু ঘটনা তাঁর মুখে শোনা, তিনিও অন্য কারও মুখে শুনেছেন ছোটোবেলায়। এখানে শল্ল আর চণ্ডুর হাড় নিয়ে যা বলা আছে, তার কিছু পড়েছি যমদত্তের ডায়রিতে আর কিছু ঠাকুর্দার মুখে শোনা। বিভূতিভূষণ বা হেমেন্দ্রকুমার আমাদের যে ঘরানার গল্প শুনিয়ে গেছেন, তা থেকে ইদানীং আমরা অনেকটাই সরে গিয়ে সাইকোলজিক্যাল হররের দিকে ঝুঁকেছি। তাই চেষ্টা করলাম সেই ক্লাসিক স্টাইলে কিছু লেখার। এই গল্পের কিছুটা সত্যি বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা, কিছুটা আমার কল্পনা আর বাকিটা? বাকিটা পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম…