অভিশাপ
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সম্পাদিত বিখ্যাত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার একটা সংকলন ইদানীং হাতে এসেছে। সেটাই উলটেপালটে দেখছিলাম। বিভিন্ন বিষয়ে দারুণ সব লেখার সঙ্গে একটা লেখায় চোখ আটকে গেল। একটা সম্পাদকীয় নিবন্ধ। নাম ‘পানিহাটির অপদেবতা’। সম্পাদকীয় লেখাটা অদ্ভুত। তাতে লেখা ১৩১২ সন, মানে ১৯০৫ নাগাদ কোজাগরী পূর্ণিমার তিন দিন পর ‘পানিহাটিতে এক অপদেবতার ভয়ানক উপদ্রব হয়’। কোন এক হীরেন্দ্রনাথ বসাকের উপরে এই অপদেবতার ভরে এমন কিছু একটা হয় ‘যাহা কহিতে গেলে শোনিত শুখাইয়া আসে।’ সম্পাদক ধরেই নিয়েছেন ঘটনাটি মুখে মুখে প্রচলিত হওয়ায় এর কাহিনি বিস্তারিত সবাই জানেন। তাই তিনি বিশেষ বর্ণনা দেননি। তাতেও ভয়াবহ এক আতঙ্কের ছাপ রয়েছে গোটা লেখা জুড়ে। ঠিক কী হয়েছিল না জানতে পারলে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ আকাশের কথা মাথায় এল। আকাশ আমার বন্ধু। কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। ওদের আদি বাড়ি পানিহাটি। এখন অবশ্য সপরিবারে কল্যাণীতে থাকে। ওঁর বাবা ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। এখনও প্রচুর পড়াশোনা করেন। উনি কিছু জানলেও জানতে পারেন।
আকাশকে ফোন করায় কিছু সময় গেল ওর রাগ ভাঙাতে, কেন এতদিন ফোন করিনি। একথা সেকথা বলার পর সরাসরি কাজের কথায় এলাম।
— আচ্ছা আকাশ, কাকুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারবি?
— কী কথা?
— অনেকদিন আগে, মানে ধর তোর ঠাকুর্দার জন্মেরও আগে, পানিহাটিতে একবার এক অপদেবতার উপদ্রব হয়। সে ঘটনা এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তা নিয়ে একটা সম্পাদকীয় লিখে ফেলেছিলেন। কাকুকে একটু জিজ্ঞেস কর তো, কাকুর কোনও আইডিয়া আছে কি না এই ব্যাপারে..
— দাঁড়া বাবাকে দিচ্ছি… বলেই আকাশ খানিকক্ষণের মধ্যে কাকুকে ডেকে দিল। কাকুকে গোটা ব্যাপারটা বলায় কাকু খানিক চুপ। তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি একবার আমাদের বাড়ি আসতে পারবে? সব কথা ফোনে হয় না। তুমি এসো, আমি তোমায় সব বলব।”
পরের সপ্তাহেই এক রবিবার করে আকাশ দের সেন্ট্রাল পার্কের পাশের দোতলা বাড়িতে আমি উপস্থিত। গিয়েই দেখি জলখাবার তৈরি। লুচি, ছোলার ডাল, মিষ্টি। কাকিমা মারা গেছেন বছরখানেক হল। বাড়িতে এখন কাকু, আকাশ , আকাশের বউ রিনি আর ছোট্ট ছেলে ঋক। খেতে খেতেই প্রশ্ন করলাম, “কাকু, সেই ঘটনাটা বললেন না তো?”
কাকুর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। কী যেন ভেবে তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এতদিন আমি এই ঘটনাটা কাউকে বলিনি। বাবুকেও না (বাবু আকাশের ডাকনাম)। বাবুর মা জানত। ভেবেছিলাম কাহিনিটা সঙ্গে নিয়েই চিতায় উঠব। ভুলেই গেছিলাম প্রায়। সেদিন তুমি ফোন করায় চমকে উঠলাম। আমার বাবা বলেছিলেন যেন তেন প্রকারেণ এই কাহিনি নাকি পরিবারের সাত পুরুষ অবধি বিস্তার পাবেই। আমি বিশ্বাস করিনি। এখন বুঝছি, আমি বন্ধ করতে চাইলেও এই কাহিনিকে আটকানো মুশকিল। গত কয়েকদিন অনেক ভেবেছি। তারপর ঠিক করলাম নিয়তিতে আমার হাত নেই। নইলে তুমিই বা ওই লেখা পড়বে কেন, আর পড়ে আমাকেই বা ফোন করবে কেন?”
আমি বেশ অবাক। আকাশ আর রিনির মুখ দেখে বুঝলাম ওরাও হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। কেউ একটা কথাও বলছে না। পাশের ঘরে ঋক একা একা মায়ের ওড়না নিয়ে খেলছে আর বকবক করছে। ঘরে আওয়াজ বলতে ওইটুকুই।
“পানিহাটির অপদেবতার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক এক অভিশাপ জড়িয়ে আছে। সেই কাহিনিই বলব তোমাদের। আমার ঠাকুরদার বাবা কিশোরীমোহন মুখুজ্জে ছিলেন ভয়ানক ডাকাবুকো মানুষ।”
“কিশোরীমোহন মানে রোনাল্ড রসের সেই সহযোগী, যাঁকে ব্রিটেনে সোনার মেডেল দিয়েছিল?”
“উনি বাঁড়ুজ্জে। হাংরি আন্দোলনের মলয় রায়চৌধুরীর দাদু। পানিহাটির নিলামবাটি ছিল ওঁদের বাড়ি। আমার ঠাকুরদার বাবার বন্ধু। আমাদের ছিল মশলা আর তামাকের ব্যবসা। নদীপথে যশোরের সঙ্গে বাণিজ্য চলত। পানিহাটি তো ব্যবসারই জায়গা। সংস্কৃত পণ্যহট্ট বদলে এই নাম হয়েছে।”
বুঝলাম কাকু এবার ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছেন, তাই আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বললাম, “কাকু যেটা বলছিলেন…”
উনি আবার সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ঠাকুর্দার বাবা ব্যবসা দেখতেন বটে, তবে ব্যবসায় তাঁর মন ছিল না। বরং কোথায় কীর্তন হচ্ছে, কোথায় যাত্রাপালা হবে, কাকে শ্মশানে নিতে হবে এই নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল দেখার মতো। কাজ দেখতেন হিরু বসাক নামে এক নায়েব। তাঁর আসল নাম আমি জানি না। হিরুই শুনেছি। ছোটোখাটো বেঁটে মানুষ, লিকলিকে রোগা, গালে লম্বা দাড়ি। সবাই ঠাট্টা করতেন, হিরুবাবুর দাড়ির ওজন ওঁর থেকে বেশি। তবে মানুষটা ছিলেন ধুরন্ধর। ব্যবসার গলিঘুঁজি তাঁর নখদর্পণে। তখন ইংরেজ আমল। আর সে আমলে ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ হত না। কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট, কোন সাহেবকে টাকা দিতে হবে, আর কোন সাহেবকে মেয়ের জোগান দিলে খুশি হবেন, তা হিরুবাবুর মতো কেউ জানত না। কিশোরী নিজের মতো থাকতেন আর বকলমে হিরুবাবুই ব্যবসার মালিক ছিলেন। হিরুবাবুর নিজের চরিত্রদোষ ছিল না। কিন্তু আশেপাশের গাঁয়ের বিবাহিত মহিলাদের ফুসলে সাহেবদের ভোগ হিসেবে পাঠানোর জন্য তাঁকে কেউ দুচোখে দেখতে পারত না। ব্যতিক্রম কিশোরীমোহন। সব জেনেশুনেও তিনি হিরুকে প্রশ্রয় দিতেন। তার একটাই কারণ, সেরেস্তা থেকে যখন খুশি টাকা নিয়ে তিনি দুহাতে খরচা আর আমোদআহ্লাদ করতে পারতেন। এ সুযোগ নিজে দায়িত্ব নিলে সম্ভব না। এদিকে তলে তলে হিরুর শত্রু বাড়ছিল। তিনি সঙ্গে দুজন লেঠেল নিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করলেন। বাড়াবাড়ি হল ১৯০৫ সালের পুজোর ঠিক আগে আগে। পুজোতে ম্যাকগ্রেগর সাহেবকে ভেট পাঠাতে হয়। তা না হলে ব্যবসার দাদন পেতে মুশকিল হবে। এবারের ভেট হিরু অনেকদিন ধরেই ঠিক করে রেখেছিলেন। গোয়ালাপাড়ায় রাধু নতুন বিয়ে করেছে। তার বউ কমলা যেন বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। বয়স এখনও পনেরো পেরোয়নি। ডাঁসা যৌবন। এক রাতের জন্য একে পেলে সাহেব গোটা এক বছরের দাদন লিখে দেবে। মুশকিল হল একটাই। কমলা রাধুকে ভয়ানক ভালোবাসে। আর রাধুও কমলাকে। রাধুর শরীরে হাতির বল। সা-জোয়ান চেহারা। শুধু একটাই দোষ। সন্ধে হলেই ধেনো মদের বোতল খুলে বসে। হিরুবাবু জানতেন মদ খেলে লোকের তাল ঠিক থাকে না। একদিন রাধুকে ডেকে আদর করে গলা অবধি মদ খাওয়ালেন। রাধু অতটা তলিয়ে ভাবেনি। এদিকে হিরুর লেঠেলরা কমলাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল আগরপাড়ায় সাহেবের ডেরায়। কমলা আর ফেরেনি। কেউ বলে সাহেবের রক্ষিতা হয়ে গেছে। কেউ বলে হিরু তাকে সোনাগাজির গলিতে নিয়ে বেচে দিয়েছে। আবার কেউ বলে আগরপাড়ারই এক গাছের ডালে ঝুলে পড়েছে। রাধু আর তার বাবা হরি কিশোরীর কাছে নালিশ জানাল। তিনি সব বুঝলেন, কিন্তু হিরুকে চটাতে পারলেন না। হিরুকে ডাকায় সে সমস্ত অস্বীকার করল। রাধু বাবার সঙ্গে ফিরে গেল। তার চোখে অদ্ভুত এক আগুন। কিশোরী ভাবলেন সব মিটে গেছে।
তিনদিন বাদে গোটা পানিহাটি আবার নড়েচড়ে বসল। সেদিন সপ্তমী। আমাদের বাড়ি দুর্গাপুজো হত। সব সেরে হিরু বসাক বাড়ি ফিরছেন, সঙ্গে মশাল হাতে দুই লেঠেল। আচমকা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল রাধু। কিছু বোঝার আগেই হিরুর কাঁধে দিল টাঙ্গির এক কোপ। হাতের খানিকটা খুলে ঝুলতে লাগল। লেঠেল দুজন চোস্ত। সঙ্গে সঙ্গে মশাল মাটিতে ফেলেই রাধুর মাথা বরাবর দুই লাঠির বাড়ি। রাধুর মাথা ফেটে দুফালা হয়ে গেল। পরদিন সকালে গিয়ে সবাই দেখল রাধুর মাথা মাঝবরাবর ফাটা। ফুলকপির মতো সাদা সাদা ঘিলু এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। পুলিশ এল। কিন্তু কিশোরীর পয়সার জোর ছিল। কোনও সাক্ষী না থাকায় পুলিশ এজাহারই নিল না।
তবে হিরুর অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। কলকাতা থেকে সাহেব ডাক্তার এসেও সুবিধে করতে পারলেন না। কাটা জায়গা পচে ঘা হল। সেই ঘা বেড়ে সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ল। কোজাগরী পূর্ণিমার তিনদিন পর সন্ধ্যাবেলায় হিরু বসাক মারা গেলেন। তিন কুলে হিরু বসাকের কেউ ছিল না। ফলে কিশোরী ঠিক করলেন তিনি আর তাঁর বন্ধুরাই কাঁধ দিয়ে হিরুকে শ্মশানে নিয়ে যাবেন। মারা যাবার পরে দেখা গেল হিরুর গোটা শরীর ফুলে জয়ঢাক হয়ে গেছে। বেঁটে মানুষ, তাই একেবারে ফুটবলের মতো লাগছে। খাটে শুইয়ে দুইদিকে বাঁশ বেঁধে আটজন পথবাহক ‘হরি হরি’ বোল তুলে তাঁকে নিয়ে চলল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই একটা আশশ্যাওড়া গাছ ছিল। তার নিচ দিয়ে যেতে না যেতেই হিরুবাবু দড়ি ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এ কেমন অলক্ষণ? কিশোরী ছিলেন মড়া পোড়ানোর এক্সপার্ট। বললেন, ‘দড়ি পচা। পাটের দড়িতে হবে না। নারকেলের মজবুত দড়ি আনতে হবে।’ আনা হল। হিরুবাবুকে ওঠাতে গিয়ে আর-এক মুশকিল। এই সামান্য সময়ে হিরুবাবুর ওজন প্রায় চারগুণ বেড়ে গেছে। আটজন চেষ্টা করেও তাঁকে মাটি থেকে খাটে ওঠাতে পারল না। যেন কোনও অশরীরী শক্তি প্রবল বলে হিরুকে মাটিতে ঠেসে ধরে আছে। তাঁর পায়ের পাতা অবধি মাটির সঙ্গে আঠার মতো লেগে। চোখের তুলসীপাতা সরে গেছে। দুই চোখ খোলা। মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে হিরু বসাক সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। শেষে গলদঘর্ম হয়ে কিশোরী ঠিক করলেন বাঁশের চালি দেহের তলায় ঢুকিয়ে শক্ত দড়িতে বেঁধে শ্মশানে নিয়ে যাবেন। তাই হল। এদিকে এসব করতে করতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেছে। মৃদু কণ্ঠে হরিবোল হরিবোল বলতে বলতে আটজন চলেছে। পিঠের মড়া যেন ক্রমশ আরও ভারী হচ্ছে। পা আর চলতে চাইছে না। এদিকে পথও ফুরোচ্ছে না। কিশোরীর বন্ধু ভোলানাথের বাবা ছিলেন তান্ত্রিক। সে ফিসফিস করে বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, হিরু বসাককে দানোয় পায়নি তো!’
এই কথায় সবাই একসঙ্গে শিউরে উঠল। সবারই মনে হয়েছিল। এতক্ষণ মুখ ফুটে কেউ বলতে পারেনি। দানো কোনও ভূত নন। ইনি অপদেবতা। অ-শরীরী। দানোকে কেউ কোনও দিন দেখেনি। কোনও মৃত ব্যক্তি মহাপাপ করে মরলে দানো তার দেহ আশ্রয় করে। দানোয় পেলে দেহ দশগুণ অবধি ভারী হয়, যমদূতরা তার দেহ হেঁচড়ে হেঁচড়ে যমালয়ে নিয়ে যায়। আর তাতে কেউ বাধা দিলে মহাপাপ। সেই পাপ যে কী কেউই ঠিক জানে না।
কিশোরী এই সবই শুনেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করতেন না। এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেলেও তিনি সবাইকে ধমক দিলেন, ‘থাম দিকি। লজ্জা করে না তোদের? বুড়োদের মতো কতা কইছিস? এসব দানো-ফানো কিচ্চু নেই। এসব তোদের ভ্রেম। হিরু বসাকের শরীল পচে গেচে, তাই ওজন বেড়েচে।’
পথ একসময় শেষ হল। সাধারণত তিন মন কাঠে লোকজনকে দাহ করা হয়। হিরুর জন্য আরও দুই মন নেওয়া হল। চিতা সাজানো হচ্ছে। শববাহকরা হুঁকায় কড়া দা-কাটা তামাক টানছে, দুইজন পাশেই মামার দোকানে ধেনো মদ খেতে গেছে, এমন সময় কিশোরীই খেয়াল করলেন মড়ার দেহটা ধীরে ধীরে বেঁকে যাচ্ছে। ধনুকের মতো। ভোলানাথ একদৃষ্টে ভয়ে ভয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। গোটা দেহ চালিতে বাঁধা। শুধু মাথা আর পা মাটি থেকে খুব আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। কিশোরী ডোমকে বকাবকি শুরু করলেন তাড়াতাড়ি মড়া পোড়ানো শুরু করার জন্য। ডোম চিতা সাজিয়ে দিল। অতি কষ্টে হিরুকে চিতায় তোলা হল। কিশোরীই মুখাগ্নি করবেন। তার আগে মড়ুইপোড়া বামুন মন্ত্র বলতে বলতে পিণ্ড রাঁধছেন, এমন সময় হঠাৎ হিরুবাবু চিতার উপরে খাড়া হয়ে বসলেন। এই দৃশ্য দেখে যে যেদিকে পারে ছুট দিল। শুধু বামুন পিণ্ড ফেলে জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। হিরুবাবুর ঘাড় গেল ঘুরে। তিনি সোজা তাকালেন কিশোরীর দিকে। তারপর জিভ বার করে কী একটা শব্দ করলেন। আর তারপরেই মনে হল প্রবল বেগে কারা যেন হিরুর পা ধরে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলেছে। চিতা ভেঙে গেল। হিরুর মৃতদেহ প্রবল বেগে শ্মশানের পাশের জঙ্গলের দিকে ধেয়ে চলল। কিশোরী খানিক থ হয়ে গেছিলেন। তারপর তিনিও পিছন পিছন ছুট লাগালেন। বামুনঠাকুর যতটা দেখলেন, কিশোরী প্রাণপণে হিরুর চুলের মুঠি ধরে তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করছেন। তারপর দুজনেই জঙ্গলের ভিতরে মিলিয়ে গেল।
আধঘণ্টা বাদে সবাই ধীরে ধীরে ফিরে এসেছে। ভাঙা চিতার সামনে সেই বামুন বসে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করছেন। ভোলানাথ সহ বন্ধুরা জিজ্ঞেস করায় বামুন সব খুলে বললেন। কিন্তু কিশোরী গেলেন কোথায়? তাঁকে তো খুঁজতে হবে। প্রথমে কেউ জঙ্গলে এত রাতে যেতে রাজি হল না। শেষে ভোলাই সবাইকে বোঝাল। লন্ঠন, মশাল নিয়ে সবাই কিশোরীকে খুঁজতে জঙ্গলে ঢুকল। আকাশে মেঘ করেছিল অনেকক্ষণ। এখন টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হল। মশাল গেল নিভে। শুধু ঢাকা লন্ঠনের আবছা আলো। জঙ্গলে খানিক যাবার পর একটা জায়গায় ঝোপঝাড় দুমড়ে মুচড়ে আছে। যেন কেউ ভারী কিছু টেনে নিয়ে গেছে। দলের সবাই সেই পথেই রওনা হল। খানিক যাবার পর জঙ্গল কিছুটা হালকা। গাছপালা কম। আর সেখানেই ঢাকা লন্ঠনের অল্প আলোয় তারা যা দেখতে পেল, তাতে তাদের রক্ত হিম হয়ে গেল। জঙ্গলের মাঝে চিত হয়ে শুয়ে আছেন কিশোরী আর ঠিক তাঁর উপরে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো উবু হয়ে তাঁর পেটের থেকে মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে একটা প্রাণী। এ প্রাণী অনেকটা মানুষের মতো। অনেকটা হিরু বসাকের মতো। কিন্তু মানুষ না। মানুষের অমন ধারালো দাঁত থাকে না। মানুষের চোখ আলো পড়লে ওরকম জ্বলজ্বল করে না। কিশোরী দানোকে বাধা দিয়েছিল। কিশোরীকে দানো তাই চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
এই ঘটনার দুইদিন পরেই কিশোরীর বড়ো ছেলে পুকুরে ডুবে মারা যায়। আমার বাবা তখন সবে এক বছর। ঠাকুমা পানিহাটি ছেড়ে কলকাতায় বাপের বাড়ি চলে আসেন। বাবা কলকাতাতেই বড়ো হন। বিয়ে করেন। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ছেলে হয়। দুই বছর হতে না হতে ছাদের রেলিং ভেঙে পড়ে সে ছেলে মারা যায়। স্পট ডেড…। বাবা আমাকে এই গল্পটা বলেছিলেন। আমিও বড়ো হই। বিয়ে করি। কাজল জন্মায়। একদিন বোতলে করে দুধ খেতে খেতে আচমকা ওর দমবন্ধ হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই সব শেষ। আকাশ জন্মাল তার বছর দু-এক বাদে। ওকে আজ অবধি কিছু বলিনি… বলতামও না… যদি না তুমি সবটা আবার খুঁচিয়ে তুলতে…”
সবাই চুপ। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে রিনি “ঋকের কোনও আওয়াজ পাচ্ছি না কেন?” বলেই দৌড়ে পাশের ঘরে গেল, আর গিয়েই চিৎকার করে বলল, “এদিকে এসো শিগগির।”
আর্তনাদেই মনে হল ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম। খাটের উপরে ফ্যান। ফ্যান থেকে ঝুলছে রিনির ওড়না, আর ওড়না থেকে ঝুলছে ছোট্ট ঋক। তার চোখ খোলা। পলক পড়ছে না…
লেখকের জবানি: ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সম্পাদিত বিখ্যাত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার একটা সংকলন সত্যি আমার হাতে এসেছিল। সেখানে খবরটাও সত্যি। অপদেবতাদের নিয়ে লেখার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে। দানোকে নিয়ে তথ্য পেয়েছি যমদত্তের ডায়রি থেকে। বাকিটা কল্পনা।