মরণের পরে
১
কনকনে ঠান্ডায় আচমকা শিউরে উঠল প্রাণকৃষ্ণ। খুব ছোটোবেলায় মাঘের শীতে যখন লেপ গায়ের থেকে সরে যেত, তখন অনেকটা এইরকম মনে হত। প্রথমেই চিনচিন করে উঠল পায়ের আঙুলগুলো। তারপর শিরদাঁড়া বেয়ে কনকনে একটা ঠান্ডা মাথার খুলি অবধি কাঁপিয়ে দিল একেবারে।
চারিদিক অন্ধকার। প্রাণকৃষ্ণ খানিকক্ষণ বুঝতেই পারল না ও কোথায়। ভেবলে-টেবলে শুয়ে রইল খানিক। ও শুয়েই আছে। কোনও একটা বাক্স ধরনের লম্বাটে জিনিসে। লোহার তৈরি। কিন্তু ও এখানে এল কী করে? কিচ্ছু মনে নেই। ওকে কি কেউ ধরে আনল? শেষ মনে থাকা অবধি ও হাবুলের ঠেকে বসে দেদার বাংলা খাচ্ছিল। সঙ্গে ঝাল ঝাল চানাচুর আর আলুর চপ। হাবুল বলছিল, “সকাল সকাল আর বেশি টেনো না, পানুদা… শরীলে সইবে না।” ও শোনেনি। শেষটায় পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠল আর বমি শুরু। কী বমি… কী বমি। দুজন মুশকোমতো লোক অনেক চেষ্টা করেও ওকে ধরে রাখতে পারছিল না। পেটের নাড়িভুঁড়ি যেন ঠেলে বেরুতে চাইছে। তারপর ওর শরীর ছেড়ে দিল। ওরা ধরাধরি করে ওকে একটা বাঁশের খুঁটিতে ভর দিয়ে বসাল। ওর আর কিচ্ছু মনে নেই…
প্রাণকৃষ্ণর গায়ে পাতলা একটা চাদর। কিন্তু যা ঠান্ডা এতে কিস্যু লাভ হচ্ছে না। এবার হাতের আঙুলগুলো কুঁকড়ে আসছে। শালারা ফ্রিজের মধ্যে বন্ধ করে রেখে দিল নাকি? এটা মনে হতেই প্রাণকৃষ্ণ আবার কেঁপে উঠল। তবে এবার শীতে না। ভয়ে। ও কি তাহলে মারা গেছে? যমদূতরা ওকে ধরাধরি করে নরকে নিয়ে এসেছে? সারা জীবনে যা পাপ করেছে, তাতে সে স্বর্গে যাবে না এই বিষয়ে প্রাণকৃষ্ণ একরকম নিশ্চিন্তই ছিল। অন্যের টাকা মারা, পাশের বাড়ির মিনতির বর বাড়ি না থাকলে চুপিচুপি ঘরে ঢুকে সারা দুপুর ফুর্তি করা, মদ, মাংস, মেয়েছেলে, বাকিটা কী রেখেছে? কিন্তু তা বলে নরক যে এমন হয়, সেটাও ওর ধারণা ছিল না। সেখানে নাকি গরম কড়াইতে ফেলে তেলে ভাজে। এখন যা ঠান্ডা লাগছে, তাতে সেটা বরং ভালো বোধ হচ্ছে। প্রাণকৃষ্ণ একটু দুঃখ পেল। যতদিন বেঁচে ছিল নরক নিয়ে ভুল একটা ধারণা ছিল তার। পৃথিবীর মানুষের এখনও তাই আছে। এই যে বলাইয়ের বাবা, এত কিছু জানে, সেও তো এটা জানে না। কিন্তু ফিরে গিয়ে যে শুধরে দেবে সে উপায়ও নেই।
ভাবতে ভাবতে আশেপাশে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল যেন। ওই বুঝি যমদূতরা এল…
২
রজত আর সুমন দুজনেই বেশ উত্তেজিত। কাউকে না জানিয়ে রাত দুটোয় ওরা কাঁটাপুকুর মর্গে এসেছে। দুজনেই সার্জারির ছাত্র। কিন্তু বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া এখন এত ঝকমারি হয়েছে যে নিজেদের মতো করে শেখা মুশকিল। পঞ্চাশ জন একটা মড়াকে ঘিরে থাকে, আর স্যার যে কী দেখান, ভালো করে দেখাই যায় না। এসব দিকে রজত বেশ চৌকশ। ইউনিয়ন করে। চেনাজানা ভালোই। ও-ই একদিন সুমনকে বলল, “কি রে, নিজের জন্য স্পেশাল মড়া চাই?”
“ধুস। কী যে বলিস! হবে নাকি?”
“হবে গুরু। তবে কিছু মাল্লু ছাড়তে হবে। কাঁটাপুকুর মর্গের ডোম হরিয়াদার সঙ্গে কথা বলেছি। বেওয়ারিশ লাশ এলেই জানাবে। আর পোস্টমর্টেমের নামে কী হয় তা তো জানিস। তার আগে আমরা নিজেদের মতো দেখেশুনে নেব। কি, চলবে?”
“চলবে তো… কিন্তু কত দিতে হবে?”
দুজনে দুহাজার টাকায় রফা হয়েছে। সকালেই খবর পাঠিয়েছে হরিয়া। একটা লাশ এসেছে। তিন কুলে কেউ নেই। বিষ মদে মারা গেছে। রাতে বডি খুলবে। রজতের বুক ঢিপ ঢিপ। সুমন সাহস দেখালেও খুব যে একটা সাহস পাচ্ছে, তা না। এত রাতে এসব জায়গায় যেন ভূতে ভর করে।
৩
মর্গে ঢুকেই হরিয়াকে দেখতে পেল তারা। লাশকাটা ঘর থেকে বেরুল। ঘরে উঁকি দিল রজত। টেবিল খালি। হরিয়ার দুই চোখ লাল। হাড়িয়া খেয়ে প্রায় মত্ত। জড়ানো গলায় বলল, “টাকাটা?” দুটো চকচকে দুহাজারের নোট পকেটে গুঁজে হরিয়া ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। হরিয়ার হাতে অনেকটা কুঠারের মতো দেখতে একটা অস্ত্র। “ওটা কী কাজে লাগে?” রজত বলল।
“বডি খুলতে।” উত্তর দিল হরিয়া।
৪
প্রাণকৃষ্ণ বেশ কয়েকবার দুর্গানাম করে নিল। যমদূতরা হাজির। এবার যা থাকে কপালে। ড্রয়ারের মতো ওর বাক্সটা কে যেন খুলে দিল। আহহ… ঠান্ডা অনেকটা কম। বাইরে জোরালো আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তবু মিটমিট করে তাকিয়ে পানু সোজা উঠে বসে পড়ল। আর তা দেখেই প্রথমেই এক জান্তব চিৎকার করে উঠল রজত। তার দেখাদেখি সুমনও। দুজনেই দৌড়ে পালাল একজিট গেটের দিকে। যাবার আগে শুধু দেখতে পেল হরিয়ার নেশা কেটে গেছে। এত বছরের চাকরিজীবনে সে এমন দৃশ্য দেখেনি। তার দুই চোখ বিস্ফারিত।
৫
পরের দিন সকালে উঠে আগের গোটা রাতটাই কেমন যেন দুঃস্বপ্ন মনে হল দুজনের। কিন্তু একসঙ্গে দুজনে কীভাবে এক জিনিস দ্যাখে। হরিয়ারই বা কী হল। রজতের অনিচ্ছাতেও সেদিন দুপুরে কাঁটাপুকুরে আবার গেল ওরা। হরিয়া নেই। কে জানে কোথায় গেছে। তাহলে কি ওর কিছু হল? সুমন ভাবল। ঠিক সেই সময় চাপা গলায় রজত ওর টিশার্ট টেনে বলল, “ওই দেখ।”
সুমন দেখল লাশকাটা ঘরের খালি টেবিলটা এখন আর খালি নেই। কালকের সেই মড়াটা সেখানে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। শুধু তার করোটি বরাবর মাথাটা দুইভাগ করে দিয়েছে হরিয়ার ওই কুঠারের মতো অস্ত্রটা।
লেখকের জবানি: অহর্নিশের জন্য অ্যামব্রোস বিয়ার্সের ডেভিলস ডিকশনারি অনুবাদ করেছিলাম। তখনই তাঁর অন্য গল্পগুলো পড়ার সৌভাগ্য হয়। এই গল্পের বীজ তেমনই একটা গল্পের মধ্যে ছিল।