Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আইরিন – পিয়ের লেমেইত

    লেখক এক পাতা গল্প257 Mins Read0
    ⤷

    ০১. নাম ধরে ডাকলো

    আইরিন – পিয়ের লেমেইত / অনুবাদ : আফনান নিবিড়
    প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯

    .

    সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলো কমান্ড্যান্ট কামিল ভেরোভেন। এরইমাঝে জোড়া খুনের নৃশংসতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পুরো ক্রিমিনাল ব্রিগেড। সবচেয়ে সাহসি অফিসারকেও নির্বাক করে দেয় খুনির পৈশাচিকতা। কিছুদিনের মধ্যেই কামিল আবিষ্কার করে, বিখ্যাত কিছু ক্রাইম-ফিকশনের অনুকরণে হচ্ছে এসব খুন। সঙ্গে সঙ্গে পত্রপত্রিকাগুলো খুনিকে “নভেলিস্ট’ নামে ডাকতে শুরু করে দেয়। নভেলিস্টের হত্যাযজ্ঞ কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ জানে না। উৎকণ্ঠার মাঝে প্রতিটি দিন পার করতে থাকে সবাই। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের সবচেয়ে দুধধর্ষ অফিসাররা কী পারবে। নভেলিস্টকে থামাতে? সবার চোখ এবার শিকার এবং শিকারির উপরে নিবদ্ধ। অবশেষে কেসটা হয়ে ওঠে দু-জন মানুষের মধ্যেকার এক দ্বৈরথে। একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য মরিয়া তারা কিন্তু যার ক্ষতি যতো কম হবে কেবল সে-ই জয়ি হবে এ লড়াইয়ে। স্ক্যান্ডিনিভিয়ান, স্প্যানিশ, জাপানিজ এবং লাতিনের পর এবার বাংলাভাষাভাষি পাঠক। পরিচিত হবে ফরাসি ক্রাইম-গ্লারের সবচেয়ে অগ্রগণ্য লেখক পিয়ের লেমেইতের। অসাধারণ একটি ক্রাইম ট্রিলজির প্রথম উপাখ্যান, ভয়ঙ্কর সুন্দর একটি গল্প আইরিন-এর সাথে।

    .

    নিঃসন্দেহে আইরিন পিয়ের লেমেইতকে ফ্রান্সের থৃলার সাহিত্যের চুঁড়ায় নিয়ে গেছে।

    -নিউ ইয়র্ক টাইমস।

    একটি মর্মান্তিক সত্যি ঘটনা…আইরিন-এর শেষ টুইস্টটি পাঠকের মাথা রীতিমতো ঝিমঝিম করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

    -দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল

    ভেরোভেন একজন অনন্যসাধারণ ডিটেক্টিভ…চেলসি কেইন এবং ফ্রেইড ভারগাসের ভক্তরা লুফে নেবে তাকে। প্যারিসের পটভূমিতে অসাধারণ একটি গল্পের সাথে পরিচিত হবে তারা

    -কিরকুস রিভিউস

    আইরিন-এর শুরুটা হয়েছে দুর্দান্ত গতিতে আর এর সমাপ্তি পাঠকের চোয়াল ঝুলিয়ে দেয়ার। ক্ষমতা রাখে…উপন্যাসটি শেষ হবার পর ভেরোভেনের দরকার হবে নতুন একটি টাইটেলের : মেটা-মেটা ডিটেক্টিভ।

    -নিউ ইয়র্ক টাইমস

    .

    পিয়ের লেমেইতের জন্ম ফ্রান্সের প্যারিসে। সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করলেও এখন মনোনিবেশ করেছেন লেখালেখিতে। এছাড়াও বর্তমানে চিত্রনাট্য লিখছেন পুরোদমে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ হলো ‘কামিল ভেরোভেন’ সিরিজটি। এখন পর্যন্ত তিনটি বই বেরিয়েছে এই সিরিজের। এটাই তাকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দিয়েছে পশ্চিমাবিশ্বে। সিরিজের প্রথম বই আইরিন ইংরেজিতে অনুদিত হবার পরই ফ্রান্সের বাইরে অন্যান্য দেশের সাহিত্য-সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়েন তিনি। তার অ্যালেক উপন্যাসটি ২০১৩ সালে প্রভাবশালী ক্রাইম রাইটার অ্যাসোসিয়েশন। ইন্টারন্যাশনাল ড্যাগার অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত হয়। এছাড়াও লেমেইত ফ্রান্সের খ্যাতনামা এবং সর্বোচ্চ সাহিত্যিক পুরস্কার প্রি দু। প্রিমিয়ার রোমান দে কগন্যাক, প্রি দু মেলেয়ার পোলার ফ্রাঙ্কোফোনি এবং ২০১০ সালে প্রি দু পোলার ইউরোপিয়ান দু পয়েন্ত অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হোন।

    .

    প্রথম খণ্ড

    অধ্যায় ১

    সোমবার, ৭ই এপ্রিল, ২০০৩

    “অ্যালিস…” নাম ধরে ডাকলো সে। যে কেউ ওকে দেখে যুবতি ভাববে।

    একটু ব্যঙ্গাত্মকভাবে ডাকলেও অ্যালিসের মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারলো না সে। আরম্যান্ডের নেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারের নোটে চোখ বুলালো অ্যালিস ভ্যান্ডারবচ, বয়স চব্বিশ। চব্বিশ বছর বয়সি সাধারণ একটা মেয়ে কেমন হয় তা সে কল্পনা করার চেষ্টা করলো। এই বয়সি মেয়েরা চিকন-চাকন মুখ, হলদে-বাদামি চুল আর দ্যুতিময় চোখের অধিকারিণী হয়। কিন্তু চোখ তুলে সে যা দেখলো তা তার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। মেয়েটা মোটেও তেমন নয় : চুলগুলো যেন খুলির সাথে লেপ্টে আছে, বাদামি হলেও গোড়ার দিকটা কালো; চেহারায় মলিন একটা ভাব, ডান গালে রক্তবর্ণের কালশিটে পড়ে গেছে, মুখের এক কোণায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ…দেখে মনে হচ্ছে মানুষের মাঝে কোন একটা জন্তু বাস করছে, চোখেমুখে তীব্র ভয়, ভয়ের তীব্রতায় এখনো কাঁপছে সে, যেন শীতের রাতে কোট ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছে। সামনে থাকা প্লাস্টিকের কফি কাপটা এমনভাবে চেপে ধরলো যেন এটা তার জীবনের শেষ ভরসা।

    সাধারণত, ক্যামিল ভেরহোভেন রুমে ঢুকলে সবচেয়ে সাহসি মানুষটাও কেঁপে ওঠে। কিন্তু অ্যালিস যেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তার কোন ভ্রূক্ষেপই নেই এ ব্যাপারে।

    সকাল সাড়ে আটটা বাজে। কিছুক্ষণ আগেই ক্রিমিনাল ব্রিগেডে পৌঁছানো ক্যামিল বেশ ক্লান্ত বোধ করছে। গতকাল ডিনার শেষ করতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিলো। আইরিন আর তার কিছু বন্ধু ছিলো যাদেরকে সে চেনে না। তারা টেলিভিশনের ব্যাপারে গল্প করেছে, কিছু গল্প বলেছে যা তার সচরাচর ভালো লাগে। কিন্তু তার মনোযোগ আটকে ছিলো বিপরীতে বসা মেয়েটার দিকে, যাকে দেখে বারবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। খাবার সামনে নিয়ে মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নিঃ একই চাহনি, একই মুখ, একই ব্র্যান্ডের সিগারেট একের পর এক টেনে যাচ্ছিলো। নিজেকে সে দশ বছর পেছনে আবিষ্কার করলো; সেই মধুর সময়টাতে যখন তার মায়ের গায়ে থাকতো রঙ্গিন ঢিলেঢালা পোশাক, ঠোঁটে থাকতো জ্বলন্ত সিগারেট আর চুলগুলো এলোমেলো। সেই সময়টাতে মায়ের কাজ দেখতে ছুটে যেতো। রঙতুলি হাতে পেলে দুনিয়ার কোন খেয়াল থাকতো না তার। মাঝে মাঝে কাজে এতোটাই মগ্ন থাকতো যে নিজের ছেলের উপস্থিতিই টের পেতো না। মায়ের প্রতিটি পেইন্টিং তার অসম্ভব পছন্দের ছিলো। প্রতিটি পদক্ষেপ খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল করতো যেন এতে কোন রহস্যের সমাধান মিলবে। এসব অবশ্য অনেক আগের কথা। মায়ের লাগামহীন ধূমপানের কারণেই ফিটাল হাইপোট্রপির শিকার হয় সে। যার কারণে তার উচ্চতা চার ফুট এগারো ইঞ্চিতেই আটকে গেছে। সে নিজেও জানে না কাকে বেশি ঘৃণা করে, তার মাকে-ার বদ অভ্যাসের কারণে তুলুজ-লট্রেকের চেয়ে একটু কম বিকটাকৃতি লাভ করেছে-নাকি তার বিনয়ী, ক্ষমতাহীন বাবাকে, যে তার স্ত্রীর দিকে করুণামাখা দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তবে আকৃতিতে না হলেও ষোল বছর বয়সেই সে সামথ্যবান পুরুষ হয়ে ওঠে। মা নিজের স্টুডিওতে ব্যস্ত, বাবা ব্যস্ত ফার্মেসিতে, এই সময়টাতে খাটো হওয়ার কষ্ট সে বুঝতে শিখেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাস্তবতা বুঝতে পারে, নিচু থেকেই মানুষকে দেখার অভ্যাস করে নেয়, টুল ছাড়া শেলফ থেকে বই নামানোর চেষ্টাও ছেড়ে দেয়। দরকারি জিনিসপত্র এমনভাবে রাখে, দেখে মনে হয় কোন পুতুলের ঘর।

    বিপরীতে বসে থাকা মহিলার দিকে তাকাতেই এসব স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ালো। জীবনের শেষ দিকে বিছানায় বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে তার মা। অসুস্থতার কারণে একদম বিছানায় পড়ে যায়। সদা ব্যস্ত একজন মানুষ নিঃসঙ্গ অবস্থায় দিন কাটায়। তবে অসুস্থতার সুবাদে মায়ের খুব কাছাকাছি থাকতে পারত সে। সেই সময়টাতে মায়ের স্টুডিওতে বসে প্রচুর স্কেচ করেছে। মায়ের রুমে গেলে দেখা হতো তার বাবার সাথে যে সারাটা জীবন মাথা নিচু করেই কাটিয়ে দিয়েছে, স্ত্রীর কপালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে দেখা যায়নি তাকে। ক্যামিলকে সঙ্গ দেয়ার মত কেউ ছিলো না। সারাটা দিন স্কেচ করেই সময় পার করতো।

    যতদিনে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়তে শুরু করেছে, ততদিনে তার মায়ের স্বাস্থ্য আরো খারাপের দিকে যায়। বাসায় ফিরেই দেখা হতো হতাশায় নিমজ্জিত বাবার সাথে। এভাবেই কাটতে থাকে তার দিন। সবকিছু পেছনে ফেলে সমস্ত মনোযোগ সে ঢেলে দেয়নিজের পড়ালেখায়।

    ক্লাসে থাকাকালীন সময়ে হুট করে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে ফোন আসায় তার বুকটা কেঁপে ওঠে। “তুমি এখনই বাসায় চলে আসো, তার বাবা নিচু স্বরে বলেছিলো। এরপর আর বোঝার বাকি থাকেনি, তার উপর থেকে বটবৃক্ষের ছায়া চিরতরের জন্য দূরে সরে গেছে। পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ আর নেই।

    চল্লিশে পা দেয়া বেটে আর টেকো এই লোকটা এখন জানে তার সেই ধারণা ভুল ছিলো, তার জীবনে আইরিনের আগমন ঘটেছে। পুরনো দিনের দুঃসহ সব স্মৃতি পুরো সন্ধ্যাটাই মলিন করে দিলো।

    আইরিনের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে যাবার সময় তার কাছে ফোন আসে যে, অ্যালিসকে বোন-নভেলের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

    “আমি দশ মিনিটের মরধ্যই আসছি,” বলল ক্যামিল। “আমি আসার পর যেন শুনতে পাই তুমি মাকোকে খুঁজে পেয়েছে।”

    “মার্কোকে খুঁজে বের করবো…?” আরম্যান্ড ধাঁধায় পড়ে গেলো, “কোথায় খুঁজবো?”

    “এইসব বালছাল আমি কী জানি, যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো।”

    ছোট ছোট পদক্ষেপে দৌড়ে নিজের অফিসে ঢুকলো ক্যামিল।

    “তাহলে, শুরু থেকেই শুরু করা যাক,” অ্যালিসের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

    অ্যালিসের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ক্যামিলকে দেখে যেন সম্বিত ফিরে পেলো সে। এমনভাবে তাকালো যেন জীবনে প্রথমবার দেখছে, তবে একইসাথে কিছুটা স্বস্তিও বোধ করলো, কেননা দুই ঘন্টা আগেও সে বেদম মার খেয়েছে। এখন বসে আছে ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে চার ফুট এগারো ইঞ্চির এক অফিসার যে সবকিছু শুরু থেকে শুনতে চাইছে যেন এই দুঃস্বপ্নের শুরুও আছে।

    “কতদিন ধরে স্যান্টেনির হয়ে কাজ করছো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। এরইমাঝে অ্যালিসের স্কেচিং শুরু করে দিয়েছে।

    “আমি ওর হয়ে কাজ করি না!”

    “আচ্ছা, ধরে নেই দু-বছর ধরে কাজ করছে। তুমি ওর হয়ে কাজ করো আর ও তোমাকে সাপ্লাই দেয়, এটাই তো তোমাদের চুক্তি, তাই না?”

    “না।”

    “তুমি এখনও ভাবো ও তোমাকে ভালোবাসে?” বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। ক্যামিল নিজের স্কেচিংয়ে মনোযোগ দিলো। চারপাশে নেমে এলো সুনসান নীরবতা। মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেলো তার : মডেলের শরীরে শিল্পীর হৃদয় স্পন্দিত হয়।

    আস্তে আস্তে স্কেচপ্যাডে ভিন্ন এক অ্যালিসের ছবি ভেসে উঠতে থাকলো। সামনে বসে থাকা মেয়েটার চেহারার অবস্থা খুব বাজে হলেও একদম ফেলে দেয়ার মত না। ক্যামিলের তাকানোর ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় তার মাথায় বুদ্ধি খেলা করছে।

    “একটা সিগারেট খাওয়া যাবে?”

    “স্যান্টেনি ভয়াবহ বিপদে আছে। পুরো পৃথিবী আর তার ভাইয়েরা তার পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছে। আর এটা তোমার চেয়ে ভালো কে জানে?” অ্যালিসের গালে লেগে থাকা রক্তের দিকে আঙুল তাক করে আরো বলল, “ওরা খুব একটা বন্ধুবৎসলও তো নয়, তাই না? আমরা ওকে আগে খুঁজে বের করতে পারলে সেটা তোমার জন্যই মঙ্গলজনক। তোমার কী মনে হয়?”

    মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে পেন্ডুলামের মত দোল খাওয়া ক্যামিলের জুতোর দিকে তাকিয়ে অ্যালিস যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লো।

    “স্যান্টেনিকে সাহায্য করার মত কেউ নেই। এখান থেকে তোমার মুক্তিরও কোন পথ খোলা নেই। সর্বোচ্চ আর কয়েকটা দিন টিকতে পারবে। আর তোমাকেও যে সাহায্য করবে এমন কেউ বেঁচে নেই, নাকি আছে? ওরা তোমাকেও খুঁজে বের করবে…এখন বলল, স্যান্টেনি কোথায়?”

    ছোট বাচ্চারা যেমন ঠোঁট ফুলিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকে তেমনি বসে আছে অ্যালিস। ভুল করছে জেনেও সেখান থেকে ফিরে আসবে না।

    “আচ্ছা, যাই হোক, কিছু মনে করো না…তুমি এখন যেতে পারো। আশা করি আমাদের পরবর্তি সাক্ষাৎ আরো মধুময় হবে।”

    ঠিক এই সময়েই অফিসে পা রাখে আরম্যান্ড।

    “আমরা কেবলই মার্কোর খোঁজ পেয়েছি। যেমনটা আপনি বলেছিলেন, ওর অবস্থা ভয়াবহ।”

    “কোথায় পেলে?”

    “ওর আস্তানাতেই।”

    “যাই হোক, মেয়েটাকে যেতে দাও,” বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো ক্যামিল।

    ভয় আর আতঙ্ক মিশ্রিত এক অনুভূতির ছাপ দেখা গেলো অ্যালিসের চেহারায়।

    “ও রামুইলারে আছে,” নিচুস্বরে বলল সে।

    “ওহ্,” অসন্তুষ্টি ভরা কণ্ঠে জবাব দিলো ক্যামিল।

    “১৮, বুলেভার্ড দেলাগ্রাঞ্জ।”

    কোন অনুমতির তোয়াক্কা না করে প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালো অ্যালিস।

    “এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়,” বলল ক্যামিল।

    অধ্যায় ২

    আরম্যান্ডকে ইশারা করে দ্রুত একটা টিম পাঠাতে নির্দেশ নিলো ক্যামিল। ওদিকে লুইস দুঃসংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

    “ক্যুবেভুয়াতে আরেক কাণ্ড ঘটে গেছে,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল সে।

    “কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করতে করতে হাতে কলম তুলে নিলো ক্যামিল।

    “সকালে আমরা অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন পাই। আমি এখন ওখানেই আছি। এটা…আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না”।

    “এতো ভণিতা না করে বলে ফেলল। পরেরটা পরে দেখা যাবে, অনেকটা আদেশের সুরে বলল ক্যামিল।

    “ওখানে হত্যালীলা চলেছে। রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছে। কিন্তু সচরাচর আমরা যেমনটা দেখি তেমন না, মানে আমি বলতে চাইছি…”

    “আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না, লুইস।”

    “মানে, আমার জীবনে দেখা হত্যাকাণ্ডের সাথে এর কোন মিল নেই…”

    অধ্যায় ৩

    ফোনে না পেয়ে সরাসরি লা গুয়েনের অফিসে চলে গেলো ক্যামিল। দরজায় নক করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না।

    দশাসই গড়নের মানুষ লা শুয়েন গত বিশটা বছর ধরে একের পর এক ডায়েট রুটিন ফলো করেও এক কেজি ওজন কমাতে পারেনি। তার মুখসহ সারা শরীরে বাড়তি মেদ জমার লক্ষণ সুস্পষ্ট। সারাটা জীবন সিংহাসন ছাড়া রাজার মত করে কাটিয়ে দিয়েছে। জীবনকে দেখে নির্লোভ দৃষ্টিভঙ্গিতে। ক্যামিলের হাতে ডোশিয়ে দেখে আর কোন কথা না বাড়িয়ে তার সাথে বেরিয়ে পড়লো।

    অধ্যায় ৪

    টেলিফোনে লুইসের বলা শেষ কথাটা বারবার ক্যামিলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টা তাকে চিন্তিত করে তুললো। তার সহকারী আর যাই হোক ঘটনা কখনো রঙ মাখিয়ে বলে না। তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত কল থেকে ভালো কিছু আশা করছে না। লুইসের মুখভঙ্গির কথা ভেবে হাসি থামাতে পারলো না সে।

    সুইসের চেহারায় সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের ছাপ স্পষ্ট। কোঁকড়ানো চুলগুলো একপাশে সিঁথি করে রাখা। তার মুডের সাথে চুলের সিথিও পরিবর্তিত হয়। অনেকদিন ধরে খেয়াল করে এই জিনিসটা আবিষ্কার করেছে ক্যামিল। চুল যেদিন ডানদিকে সিঁথি করা থাকে সেদিন যেন বলতে চায় কাজ শুরু করা যাক অথবা এভাবে হচ্ছে না। বামদিকে সিঁথি করে রাখা মানেই কোন কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত অথবা বিব্রত। তাকে দেখলেই অনিন্দ্য সুন্দর গ্রিক দেবতাদের কথা মাথায় আসে ক্যামিলের। চেহারায় এখনো তারুণ্য, উজ্জ্বলতার ছাপ সুস্পষ্ট।

    তার জীবনে অভাব বলে কিছু নেই। ধনী হওয়ার জন্য যা যা দরকার সবই তার আছে। কথাবার্তার ধরণ, শব্দ বাছাই করা, অন্যের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষমতা, কোন দিকেই কমতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অনেক আগেই অতিক্রম করেছে যেখানে ল, ইকোনমিকস, হিস্টোরি, সাইকোলজি নিয়ে পড়েছে। নিজের খেয়ালখুশি মত যখন যেটা নিয়ে পড়তে মন চেয়েছে তাই পড়েছে। অথচ এতোগুলো অর্জন তার কাছে বিশেষ কোন অর্থ বহন করে না। ছয় রুমের এক বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট তার। বুকশেলফ ভরা বই আর কেবিনেট ভরা ক্রোকারিজ জিনিসপত্র। বিলাসিতা করার হেন কোন জিনিস নেই যা তার বাসায় নেই। ছুটির দিনগুলোতে মায়ের সাথে সময় কাটায়। বেশ সুখেই দিন কাটছিলো তার। হুট করেই একদিন অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে শুরু করে নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি এখানে কী বালটা ছিঁড়ছি?

    এই জীবন তার কাছে একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। জীবনে কোন অনিশ্চয়তা নেই। বিলাসিতাপূর্ণ এই জীবনের প্রতিটি দিন যেন নরকে কাটে। এই জীবনে থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে শুরু করে। একসময় সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশে যোগ দেবে। ক্রিমিনালে ব্রিগেডে সুযোগ পাওয়ার   ব্যাপারে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ছিলো তার। নিজের জীবনে আবারো শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে। গোয়েন্দা হিসেবে যোগদানের পর তার কল্পনার জগতের সাথে কোন মিলই খুঁজে পায় না আগাথা ক্রিস্টির জটিল রহস্যের জট কিংবা কোনান ডয়েলের বুদ্ধির খেলা, কিছুই চোখে পড়ে না। এর পরিবর্তে স্বামীর হাতে ক্ষতবিক্ষত স্ত্রী, মাদকদ্রব্য চোরাচালানকারি, নেশাখোরদের মধ্যে মারামারি, বেশ্যাদের টাকা পাওয়া নিয়ে অভিযোগ-এসব নিয়েই সময় কাটে। তবে তাকে দেখে বেশ মজা পায় ক্যামিল। চোখেমুখে সবসময় একটা অজানা আতঙ্ক থাকলেও মনটা বেশ শক্ত তার। শত কোলাহলের মাঝেও নির্বিকারভাবে সাক্ষির ভাষ্য নেয়া, নির্দয়ভাবে খুনের শিকার হওয়া তেরো বছর বয়সি মেয়ের মাকে সান্ত্বনা দেয়ার কাজটাও খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করে।

    ক্রিমিনাল ব্রিগেডে প্রথম পা রাখার পর কেউই তাকে স্বাগত জানায়নি। কম্যাড্যান্ট ক্যামিল ভেরোভেন অভিজাত বংশের এই তরুণকে নিয়ে শুরুর দিকে খুব একটা আশাবাদী ছিলো না। অন্যান্য অফিসাররা বেশ নির্মম ব্যবহার করেছে তার সাথে। দুই মাসের মাঝেই যাবতীয় নিষ্ঠুর তামাশা আর চূড়ান্ত অপমানের শিকার হতে হয়েছে তাকে। সবকিছুই মাথা নিচু করে সহ্য করেছে। নিজের পরিণতিকে বরণ করে নিয়েছে।

    অন্যান্য সব সহকর্মীদের তুলনায় বেশ আগে একজন ভাল অফিসার হওয়ার যাবতীয় গুণাবলি লুইসের মাঝে লক্ষ্য করে ক্যামিল। দক্ষতা যাচাই করার জন্য তাকে ডারউইনিয়ান উইংয়ে নিযুক্ত করে। এজন্য ক্যামিলের প্রতি সে কৃতজ্ঞতা পোষণ করে। এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে লুইসকে একটা বারে ঢুকে মদ পান করতে দেখে ক্যামিল। তখন তার মনে পড়ে ‘কুল হ্যাণ্ড লুক” মুভির মারামারির দৃশ্যের কথা যেখানে পল নিউম্যানের মার খেতে খেতে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে প্রতিপক্ষও তার প্রতি করুণা বোধ করে একসময় মারামারিই শেষ করে দেয়। ঠিক এভাবেই কাজ হাসিল না হওয়া অবধি তার পেছনে লেগে থাকে লুইস। এভাবেই সময় যেতে থাকে আর দুইজনের মাঝে সম্পর্কের গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। লুইসকে নাম ধরে ডাকা শুরু করে ক্যামিল আর লুইসও তাই। তবে সে ছাড়া বাকি সবাই তাকে কম্যাড্যান্ট বলেই ডাকে। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মত না হলেও একে অপরকে বেশ শ্রদ্ধা করে। দুজনে এটাও জানে কাজের পরিবেশে এই সম্পর্কটা খুব জরুরি।

    অধ্যায় ৫

    লা গুয়েনকে পেছনে রেখে ক্যামিল আর আরম্যান্ড সবার আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলো। জায়গাটা পরিত্যক্ত শিল্প এলাকা।

    কিছু ওয়ার্কশপের সংস্কার কাজ চলছে, এরই মাঝখানে পরিত্যক্ত একটা ফ্যাক্টরি। দেয়ালের রঙ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে চারটি ইউনিটের কাজ সদ্য শেষ হয়েছে। পুরো জায়গাটা শুকনো মরুভূমির মত দেখাচ্ছে। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ির দেখা মিলবে না এখানে।

    সিঁড়ি বেয়ে উঠে অ্যাপার্টমেন্ট প্রবেশ করলো সবাই। ক্যামিল পেছনে তাকিয়ে দেখলো লুইস দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা প্লস্টিক ব্যাগ নিয়ে ক্রমাগত থুতু ফেলে যাচ্ছে। লা গুয়েন, ক্যামিল আর দুইজন অফিসার মিলে স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত রুমে ঢুকলো। সাধারণত নতুন অফিসাররা অপরাধস্থলে মুতের ছাপ খোঁজে। কিন্তু দক্ষ অফিসাররা খোঁজে জীবনের চিহ্ন। কিন্তু ঘরের প্রতিটি কোণা মৃত্যুর দখলে। এমন পরিবেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার আগেই ক্যামিলের চোখ আটকে গেলো দেয়ালে ঝুলে থাকা এক নারীর মাথার দিকে।

    কিছুদুর সামনে এগুতেই যা চোখে পড়লো তা নিজের সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি কয়েকটা আঙুল, ছোপ ছোপ জমে থাকা রক্ত, মলমূত্রের দুর্গন্ধ, নাড়িভুঁড়ির ছিন্ন ভিন্ন অংশ। সাথে সাথে তার মনে পড়লো গয়ার আঁকা ছবির কথা, ‘স্যাটার্ন ডিভোরিং হিজ সন’, এক ঝলকের জন্য যেন দেখতে পেলো সেই ভয়ার্ত মুখ, কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখ আর ভয়ংকর উন্মাদনা। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অন্যতম সিনিয়র অফিসার হওয়া সত্ত্বেও এখান থেকে দূরে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলো কম্যাড্যান্ট, যেখানে লুইস হাতে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    “এসব কী…?” স্বগতোক্তি করলো লা গুয়েন, তার কথাগুলোকে গিলে নিলো অসীম শূন্যতা। শুধু লুইসের কানে গেলো কথার কিছু অংশ, চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো।

    “আমি জানি না। আমি সোজা ঢুকেছি আর সাথে সাথে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি…এর বেশি কিছু আমি জানি না।”

    রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা আরম্যান্ডও কিছুটা বিমর্ষ। ভেজা হাত ট্রাউজারে মুছে নিলো, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

    ফরেনসিক টিমের প্রধান অফিসার লা গুয়েনের দিকে এগিয়ে গেলো।

    “আমার দুটো টিম লাগবে। এর জন্য বেশ কিছু সময়েরও প্রয়োজন। এটা আর দশটা সাধারণ ক্রাইম সিনের মত নয়।”

    “আচ্ছা, বাকিটা তোমার উপর ছেড়ে দিলাম, ম্যালেভালকে বলল লা গুয়েন, কেবলি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।

    ঘটনার পুর্বে অ্যাপার্টমেন্টের অবস্থা কেমন ছিলো তা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। কেননা চারিদিকে পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে তারা কোন দিকে থেকে শুরু করবে তাই বুঝতে পারছে না। ক্যামিলের ডানদিকে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শরীরের ছিন্নভিন্ন কিছু অংশ, পাকস্থলী থেকে উঁকি দিচ্ছে ভাঙ্গা হাড়, একপাশে পড়ে আছে কাটা স্তন, অন্যান্য অংশ দেয়ালে ঝুলানো। কয়েকটা অংশ চোখে না পড়লে নিশ্চিত করে বলাই যেতো না লাশটা কি কোন মহিলার নাকি পুরুষের। বামদিকে পড়ে আছে একটা মাখা, চোখগুলো প্রাণহীন। হা হয়ে থাকা মুখের ভেতরের দিকে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। বিপরীত দিকে পড়ে থাকা শরীরের একটা অংশ থেকে খুব যত্নসহকারে চামড়া তুলে নেয়া হয়েছে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে মাংস, অনেকগুলো আগুনে পোড়া ক্ষত চিহ্নও সুস্পষ্ট, পেট আর যোনিতে গভীর ক্ষত, সম্ভবত এসিড ঢেলে করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভিক্টিমের মাথা আর গালে পেরেক ঠুকে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পকেট থেকে নোটবুক বের করেও তা সাথে সাথে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো ক্যামিল, কেননা এই হত্যাকাণ্ডে ভয়াবহতার মাত্রা এতোটাই বেশি যে প্রথাগত উপায়ে এগিয়ে কোন লাভ নেই। নশংশতার ক্ষেত্রে কোন কৌশলই কাজে দেয় না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে আজকে সে এখানে উপস্থিত, নাম না জানা এই পাশবিকতার সামনে।

    এরইমাঝে দেয়ালের একদিকে একটা লেখায় চোখ আটকে গেল সবার। ভিক্টিমের রক্ত দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা আই অ্যাম ব্যাক। মেঝেতে পড়ে থাকা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখে বোঝা যাচ্ছে লেখার জন্য প্রচুর রক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো এক আঙুল, আবার কখনো কয়েকটা আঙুল দিয়ে লেখার কারণে বেশ কয়েকটা জায়গায় কিছুটা ঘোলা হয়ে আছে। লাশ ডিঙিয়ে দেয়ালের আরো কাছে চলে গেলো ক্যামিল। বাক্যের শেষে অত্যন্ত যত্নসহকারে একটা ফুলস্টপ দেয়া।

    রক্ত ছিটে দেয়াল থেকে একদম সিলিং অবধি চলে গিয়েছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো ক্যামিল। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করাটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

    অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় এক ডজনের মত লোক একত্রে কাজ করছে। সাধারণত; ক্রাইম সিনে বাইরের কেউ ঢুকলে মনে হবে সবাই বেশ খোশমেজাজে আছে, অনেকটা অপারেশন থিয়েটারের মত। একজন আরেকজনের সাথে দুষ্টামি করছে, হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই ব্যাপারটা ক্যামিল প্রচণ্ড ঘৃণা করে। এস.ও.সি.এস এর লোকজনের কথাবার্তা নিষ্ঠুর রসিকতা, ব্যঙ্গাত্মক উপমায় ভরপুর যেন তারা সব সাধু। পুরুষ প্রধান সবগুলো পেশাতেই এমনটা বেশি দেখা যায়। একজন ফরেনসিক অফিসার যে কিনা লাশ নিয়ে কাজ করে অভ্যস্ত তার কাছেও নারীর মৃতদেহ আলাদা গুরুত্ব বহন করে। বীভৎস ভাবে সারা শরীর আর মুখ থেতলে থাকলেও তা ‘সুন্দরী নারীর দেহ’ বলতে তাদের বাঁধে না। কিন্তু ক্যুবেভুয়ার এই অ্যাপার্টমেন্টের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। সবচেয়ে অভিজ্ঞ আর পোড় খাওয়া অফিসারটাও আজ নির্বাক, এমন বীভৎস দৃশ্যে কেউ অভ্যস্ত নয়। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এরই মাঝে ফরেনসিক অফিসাররা নীরবে নমুনা সংগ্রহ, ছবি তোলা, মাপ নেয়া সহ নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। আরম্যান্ড এক কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে যেন তার পায়ে শিকড় গজিয়েছে। অন্যদিকে ম্যালেভাল ক্রমাগত বমি করে যাচ্ছে, বেশ কয়েকবার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সে।

    অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বড়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ যত্ন করে একে সাজানো হয়েছে। মূল দরজা খুলেই সরাসরি লিভিং রুমে ঢোকা যায়, কংক্রিটের দেয়াল সাদা চুনকাম করা। ডানপাশের দেয়ালে বেশ বড় সাইজের একটা পেইন্টিং ঝুলছে। পেইন্টিং দেখে ক্যামিলের পরিচিত মনে হচ্ছে। দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় দেখেছে এমন পেইন্টিং।

    “দ্য হিউম্যান জিনোম,” বলল লুইস।

    সাথে সাথে ক্যামিলের মনে পড়লো, ‘দ্য হিউম্যান জিনোম’ কালি আর কাঠকয়লা দিয়ে করেছিলো এক চিত্রশিল্পী।

    বেডরুমে ঢুকে চোখে পড়লো সোফার পাশে পড়ে আছে জিকিউ ম্যাগাজিনের একটা কপি। ডানদিকে সুসজ্জিত মিনি-বার, বামদিকে একটা কফি টেবিল যার উপরে কর্ডলেস ফোন আর একটা অ্যানসারিং মেশিন। দেয়ালের মাঝ বরাবর বড় সাইজের ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টেলিভিশন।

    সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা খুঁজছিলো আরম্যান্ড। তার কাঁধে হাত রেখে ভি.সি.আরের দিকে ইঙ্গিত করে ক্যামিল বলল, “চলো দেখি ওটাতে কী আছে?”

    ক্যাসেট চালু করতেই দেখা গেলো একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর যার মাথায় বেসবল ক্যাপ, দুপায়ের মাঝে কমলা রেখে খোসা ছাড়াচ্ছে। ভিডিওটা বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত বাসায় তৈরি করা হাস্যরসাত্মক ভিডিওর মত মনে হলো তার কাছে।

    “থামালে কেন? চলতে দাও। হয়তো কোন মূল্যবান সূত্রও পেয়ে যেতে পারি এখান থেকে,” বলল সে।

    অ্যানস্যারিং মেশিনের দিকে ঝুঁকলো। “হ্যালো!”-ভরাট গলার পুরুষ কণ্ঠ—”আমি দুঃখিত, আপাতত লন্ডনে আছি, বিপ শোনার পর আপনার মেসেজ দিয়ে রাখুন,..যত দ্রুত সম্ভব আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।”

    “লোকটা নিঃসন্দেহে ভোকোডার ব্যবহার করছে,” বলল ক্যামিল।

    এই বলে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।

    বেডরুমের দেয়ালের এক পাশের বড় অংশ জুড়ে একটা ওয়্যারড্রোব। বিছানা রক্ত আর মলমূত্রে ভরা। রক্তে মাখা চাদর গোল করে পাকানো। বিছানার এক কোণে একটা খালি করোনার বোতল পড়ে আছে। আরেকপাশে বড় একটা সি.ডি প্লেয়ার আর ফুলের পাপড়ির মত কয়েকটা কাটা আঙুল। ফরেনসিক অফিসারদের খুলে রেখে যাওয়া একটা ড্রয়ারে উঁকি দিলো ক্যামিল, একটা সুটকেস ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে।

    “এখানে কেউ খুঁজে দেখেছেন?” জিজ্ঞেস করলো সে।

    “এখনো না,” একটু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব এলো ফরেনসিক অফিসারদের মাঝ থেকে।

    বিছানার পাশে একটু ঝুঁকে মাটিতে পড়ে থাকা নোটবুক হাতে নিলো সে। ইটালিক অক্ষরে লেখা : প্যালিওসি।

    “কেউ চেনেন নাকি জায়গাটা?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

    “না, নামই শুনিনি।”

    ম্যালেভালকে ডাকলো সে। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে বমি করা ম্যালেভালের চেহারা দেখে করুণা হলো তার। ইশারা করে থামিয়ে দিলো তাকে।

    বাথরুমের দেয়াল পুরোটা সাদা, শুধু একপাশে বিশাল একটা ওয়ালপেপার। আর বাথটাবে যেন কেউ রক্ত লেপ্টে দিয়েছে। কোন একজন ভিক্টিমের বেহাল দশা করা হয়েছে এখানে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বেসিনটা এখনো ভেজা, হয়তো খুনি হাত ধোঁয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলো।

    অ্যাপার্টমেন্টের মালিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হলো ম্যালেভালকে। ফরেনসিক অফিসারদের রেখে ক্যামিল, লুইস আর আরম্যান্ড বেরিয়ে পড়লো।

    “আরম্যান্ড তুমি প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নাও। কাজ শেষ করে ম্যালেভালও তোমার সাথে যোগ দিবে। আর খেয়াল রাখবে ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে। এমনিতেই ঝামেলার শেষ নেই,” এই বলে থামলো ক্যামিল।

    মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো আরম্যান্ড, কিন্তু তার চোখ লুইসের হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। সেই সকালে প্রথম সিগারেট ধরিয়েছিলো, এরপর আর সময় করে উঠতে পারেনি।

    “বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে এর জন্য।”

    “জেন!” পেছন থেকে ডাকলো ক্যামিল।

    ডাক শুনে ঘুরলো বার্গেরেট।

    “সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজটা করবে। দু-দিন সময় দিলাম।”

    “আচ্ছা, ঠিক আছে…” মুখ গোমড়া করে জবাব দিলো বার্গেরেট। লুইসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ক্যামিল।

    “মাঝে মাঝে বেশ কাজে দেয় এই পদ্ধতি।”

    অধ্যায় ৬

    অ্যাপার্টমেন্টটার সংস্কার কাজ করেছে বিখ্যাত রিয়েল স্টেট কোম্পানি এস.ও.জি.ই.এফ.আই।

    সকাল ১১:৩০, কু দে ভালমি। গুহার মত একটা অফিসে কোটেট নামে একজনের সাথে দেখা হলো।

    কিছুক্ষণ পার হওয়ার বুঝা গেলো এই লোকটাই সর্বেসর্বা। কোটেট সেই ধরনের লোক যারা খুব সহজেই ঘাবড়ে যায়, বেখাপ্পা ধরনের লম্বা। পোশাক দেখেই বোঝা যায় স্ত্রীর কিনে দেয়া, যে নিজের স্বামীকে কোন বড় কোম্পানির ম্যানেজার পদে কল্পনা করতে ভালোবাসে, যদিওবা সে জানে তার স্বামী তেমন কিছুই না। ক্যামিলকে অফিসে ঢুকতে দেখেও না দেখার ভান করলো কোটেট। যতটা সম্ভব বাজে অভিনয় করলো যা খুব সহজেই ক্যামিলের চোখে ধরা পড়েছে।

    এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত লুইসই এগিয়ে আসে। আজকে তাকে বেশ স্থির দেখা যাচ্ছে।

    “কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে অ্যাপার্টমেন্টটা লিজ দেয়া হয়েছিলো আমরা তা জানতে চাই। আশা করি বুঝতে পারছেন আমাদের হাতে সময় খুব কম।”

    “অবশ্যই। আপনারা কোন অ্যাপার্টমেন্টের কথা বলছেন?”

    “১৭, রুই ফেলিক্স ফ্যরে, ক্যুবেভুয়া।”

    কোটেটের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

    “ওহ…”

    নিজের ডেস্কের দিকে ভয়ার্ত মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে কোটেট, মুখটা মাছের মত নড়ছে।

    “মঁসিয়ে কোটেট, আমার মনে হয় সবকিছু খুলে বললেই আপনার এবং আপনার কোম্পানির জন্য ভাল হবে…সময় লাগলে আপনি সময় নিন,” একদম শান্ত কণ্ঠে বলল লুইস।

    “হ্যাঁ…হ্যাঁ, অবশ্যই।” ডুবে যাওয়া মানুষের মত অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো সে।

    “ওই চুক্তিটা আসলে…কীভাবে যে বলবো? চুক্তিটা আসলে পুরোপুরি নিয়ম মেনে করা হয়নি, বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি।”

    “না তো, একদমই না।” বলল লুইস।

    “গত এপ্রিলে আমরা চুক্তি করি। আর চুক্তিটা হয়…”

    “নাম কী?”

    ক্যামিলের দিকে তাকালো সে।

    “হেইনাল। আমার যতদূর পড়ে লোকটার নাম হেইনাল।”

    “আপনি নিশ্চিত?”

    “হ্যাঁ, জ্য হেইনাল। ক্যুবেভুয়ার অ্যাপার্টমেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছিলো। এমনিতেই ওই প্রজেক্টে আমরা অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। চারটা ইউনিট শেষ হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা লাভ করতে পারিনি। ক্ষতির সম্মুখীন কে হতে চায়…”

    মাত্রাতিরিক্ত কথাবার্তায় কিছুটা বিরক্তবোধ করলো ক্যামিল। “কয়টা ইউনিট বিক্রি করেছেন?”

    “একটাও না।”

    কোটেট ‘একটাও না’ শব্দটা এমনভাবে বলল যেন তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছে।

    “দয়া করে থামবেন না…বলতে থাকুন…” উৎসাহ নিয়ে বলল লুইস।

    “ওই লোকটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য আসেনি, বরং ভাড়া নিতে চাইছিলো। নিজেকে ফিলা ইন্ডাস্ট্রির একজন বলে দাবি করে সে। আমি সাথে সাথেই মানা করে দিয়েছিলাম, কেননা এই একটা ইন্ডাস্ট্রির সাথে আমরা মিশতে চাই না। সবসময় লোকজনের আনাগোনা, রাতদুপুরে মানুষের আগমন, বুঝতেই পারছেন কী বলতে চাইছি? তাছাড়া, আমাদের কাজ অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা, এস্টেট এজেন্টের কাজ করি না।”

    “বুঝতে পারছি,” বলল লুইস।

    “কিন্তু আমাদের সবারই একটা দুর্বল জায়গা থাকে। আর ওই লোকটা…”

    “নগদ টাকা দিতে চাইছিলো?”

    জিজ্ঞেস করলো লুইস। “হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন এবং…”

    “কিছু বেশি পেয়েছেন নাকি?” যোগ করলো ক্যামিল।

    “হ্যাঁ, মূল দামের প্রায় তিনগুণ বেশি।”

    “লোকটা দেখতে কেমন ছিলো?”

    “আমি আসলে ভালোমতো খেয়াল করিনি। বেশিরভাগ সময় ফোনেই কথা হয়েছে আমাদের।”

    “তার কথাবার্তা?”

    “বেশ মার্জিত।”

    “তো…?”

    “অ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে পারবে কিনা তা জানতে চাইছিলো। আমরা তার জন্য ব্যবস্থাও করি। একে পর এক ছবি তুলে যাচ্ছিলো, আসলে ওই মুহূর্তেই আমাদের একটু সতর্ক হওয়া দরকার ছিলো…”

    “কী নিয়ে?”

    “ফটোগ্রাফারকে নিয়ে…তাকে দেখে মোটেও পেশাদার মনে হচ্ছিলো না। পোলারয়েড ক্যামেরার মত কিছু একটা নিয়ে এসেছিলো। ছবি তোলার সাথে সাথেই এমনভাবে লাইন করে সাজিয়ে রাখছিলো যেন মিশে গেলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মোট কথা, আমি তার চেয়ে কোন অংশেই খারাপ না।”

    “কোন এস্টেট এজেন্ট?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

    “অনেকটা তেমনই।”

    “চেহারার কোন বর্ণনা দিতে পারবেন?”

    “অস্পষ্টভাবে। আমরা বেশিক্ষণ ছিলাম না সেখানে। আমার কিছুই করার ছিলো না ওখানে, তাছাড়া এমন একজন ফটোগ্রাফারের পিছনে মুল্যবান সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। কাজ শেষে মেইলবক্সে চাবি রেখে চলে যায় সে।”

    “সে দেখতে কেমন ছিলো?”

    “গড়পড়তা ধরনের…।”

    “গড়পড়তা দ্বারা কী বুঝাচ্ছেন?” জোর দিয়ে বলল লুইস।

    “গড়পড়তা মানে গড়পড়তা। আপনারা কী জানতে চাইছেন? উচ্চতা মাঝারি ধরনের, বয়সও তেমন-তার সবকিছুই এমন?”

    ক্যামিলই প্রথম উঠে দাঁড়ালো। কোটেট সবাইকে লিফট অবধি এগিয়ে দিলো।

    “আপনাকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হবে। দরকার পড়লে আদালতেও হাজির হতে…” একটু হুমকির সুরে বলল লুইস।

    “কোন কিছুই স্পর্শ করবেন না। কোন কাগজপত্রও লুকানোর চেষ্টা করবেন না। আপনাদের অ্যাপার্টমেন্টে দুই দুইটা মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে তাও আবার ঝুলন্ত অবস্থায়। এটা মাথায় রাখবেন।”

    শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোটেট, যেন পরিস্থিত বোঝার চেষ্টা করছে।

    “কোন ছবি, ব্লু প্রিন্ট কিছু আছে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

    “আমাদের কাছে একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করা আছে।”

    “যাবতীয় জিনিস আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।”

    এই বলে কোটেটের দিকে নিজের আইডি কার্ড বাড়িয়ে দিলো সে। কোটেট এমনভাবে হাতে নিলো যেন তার আঙুল জ্বলে যাচ্ছে।

    অধ্যায় ৭

    দুই টিম একসাথে কাজ করা সত্ত্বেও সবাইকে অফিস টাইম শেষ হওয়ার পরও কাজ করতে হচ্ছে। স্কোয়াডের গাড়ি, মোটরসাইকেলের আনাগোনা সকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এরইমাঝে মিডিয়ার লোকজন বাইরে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। লা গুয়েনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালো ক্যামিল।

    “এখানেও প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে,” বলল লা গুয়েন।

    ক্যুবেভুয়ার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটা সংকল্প নিয়ে বের হলো ক্যামিল; যত কম সময় থাকা যায়।

    প্রত্যাশার চেয়ে কম লোকই দেখতে পেলো বাইরে; বিশজনের মত অতি উৎসাহী লোকজন, এক ডজনের মত রিপোর্টার, নামকরা পত্রিকা থেকে কেউ আসেনি আর কয়েকজন ফ্রিল্যান্সার যারা গরম খবরের আশায় ছুটে এসেছে।

    দুটো কারণে ক্যামিল একইসাথে জনপ্রিয় এবং প্রচারবিমুখ হিসেবে পরিচিত। কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা তাকে দিয়েছে আকাশছোঁয়া খ্যাতি। তার ছবি ভোলা ক্যামেরাম্যানদের জন্য কষ্টসাধ্য কাজ হলেও, কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষুদ্র গড়নের এই মানুষটার দিকে ছুটে এলো। একটু চাঁচাছোলা ধরণের হলেও সে সত্য বলে অকপটে।

    শারীরিক আকৃতির কারণে কিছুটা সুবিধাও পেতো সে। একবার কেউ দেখলে আর ভুলতে পারতো না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছে, কেননা সে জানে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে এমন একজন হিসেবে যে কিনা শারীরিক অক্ষমতা দূর করে অসাধারণ এক অফিসারে পরিণত হয়েছে। অনেকেই তাকে প্রধান অতিথি বানিয়ে অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে। তার গাড়িটাও বিশেষভাবে তৈরি করা যেখানে নিয়ন্ত্রণ করার সব কিছু রাখা আছে স্টেয়ারিং হুইলের কাছাকাছি।

    একবার কাজ সেরে স্টুডিওতে পৌঁছানোর পর সে লিফটে চড়ে বসেছিলো। তখন হাতভর্তি ফাইল নিয়ে এক অপরিচিত নারী তাকে জিজ্ঞেস করলো কোন ফ্লোরে যাবে। কাঁচুমাচু দৃষ্টিতে পনেরো তলার বাটনের দিকে ইংগিত করলো সে। মুচকি হাসি দিলো সেই অপরিচিত নারী, বাটন চাপতে গিয়ে হাতের সব ফাইল দিলো ফেলে। লিফট গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও দেখা গেলো তারা ফাইল গোছাচ্ছে। ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বিদায় জানালো ক্যামিল।

    “ওয়ালপেপার ঝুলানোর সময় আমার একই সমস্যা হয়, তাকে আশ্বস্ত করলো ক্যামিল।

    মেয়েটি আবারও হাসলো। তার হাসিটা বেশ সুন্দর।

    ছয়মাস পর আইরিনকে বিয়ে করলো ক্যামিল।

     অধ্যায় ৮

    রিপোর্টারদের মাঝে বেশ তাড়াহুড়ো দেখা গেলো।

    “ভিক্টিম দুইজন,” ক্যামিল বলতে শুরু করলো।

    “তারা কারা?”

    “আমরা এখনো জানি না। দুইজনই তরুণী।”

    “বয়স কেমন?”

    “পঁচিশের কাছাকাছি। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।”

    “লাশ কখন নিয়ে যাওয়া হবে?” একজন ফটোগ্রাফার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।

    “খুব শিগগিরই। আমাদের একটু তাড়া আছে।” কিছুক্ষণের জন্য প্রশ্নবাণ থেমে গেলো, এখান থেকে পালানোর আদর্শ মুহূর্ত।

    “তদন্তের স্বার্থে এখন বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে সত্যি বলতে এটা আর দশটা সাধারণ কেসের মত নয়। আমাদের হাতে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন সূত্রও নেই। আগামিকাল এই কেস নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করবো। ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য রাখার অনুরোধ করছি, ফরেনসিক অফিসারদের কাজ করতে দিন,..”

    “তাহলে আমরা কী লিখবো?” লালচুলো এক তরুণ প্রশ্ন করলো।

    “দুইজন নারী খুন হয়েছেন যাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে খুন হলেও কে বা কারা করেছে তা অজ্ঞাত।”

    “কিন্তু এতো অল্প তথ্য!”

    “এই কথাটাই আমি তখন থেকে বলার চেষ্টা করছি।”

    ঠিক এমন সময়ে ক্যামিল মনেপ্রাণে যে ঘটনা এড়িয়ে যেতে চাইছিলো তাই ঘটলো। ফরেনসিক টিমের ভ্যান এসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো কিন্তু বিল্ডিংয়ের প্রবেশমুখের কাছে ভিড়তে পারলো না, কেননা সামনের রাস্তায় বেশ বড় কংক্রিটের পিলার পড়ে আছে। ভ্যানের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে দিতেই দুইজন ফরেনসিক অফিসার লাফ দিয়ে নামলো। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা মৌমাছির মত অ্যাপার্টমেন্টের দরজার দিকে ছুটলো। ভিতরের দৃশ্য দেখে তারা যেন সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো, সারা দেয়ালে রক্ত এমনভাবে লেগে আছে যেন কিছুক্ষণ আগে এখানে রক্ত দিয়ে হোলি খেলা হয়েছে। এরইমাঝে ফরেনসিক অফিসাররা লাশসহ অন্যান্য এভিডেন্স ব্যাগ ভ্যানে উঠানো শুরু করলো।

    ফটোগ্রাফাররা একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে।

    “শিট!” মনে মনে বলল ক্যামিল।

    একদম লেজেগোবরে অবস্থা সেখানে। পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো, যে কল তার অবস্থার বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট।

     অধ্যায় ৯

    ইদতিঁতে জুডিশিয়েঁ’র ছেলে দু’জন বেশ ভাল কাজ করেছে। দুটি জানালা খুলে দেয়া হয়েছে। এতে করে সকালের ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকছে আর পঁচা দুর্গন্ধটাও নেই।

    লাশ সরানোর পরে ঘটনাস্থলের দশা আরো অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। কেমন একটা গুমোট ভাব যেন সবকিছুতেই মত্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

    ক্যুবেভুয়ার অবস্থা আরো ভয়াবহ। ক্যামেরা, রেঞ্জফাইন্ডার, চিমটা, শিশি, এভিডেন্স ব্যাগ নিয়ে ল্যাব সহকারীরা তাদের কাজ করছে। ফরেনসিক টিমের সদস্যরা কয়েকটা আঙুল, মাথা, বমির নমুনা নিয়ে গেছে। এখন শুধু রক্তের দাগ আর মলমূত্র ছাড়া কিছুই নেই। অ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে একদম অন্যরকম লাগছে। ক্যামিলকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে যেন কোন ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করছে।

    রুমে পা রেখেই টিভি আর টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল লুইস। কামিল পা বাড়ালো বেডরুমের দিকে। তারা দুজন এমনভাবে ঘুরতে লাগলো যেন নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় কোন আর্ট গ্যালারিতে এসেছে। কিছুক্ষণ পর লুইস চলে গেলো বেডরুমে আর ক্যামিল জানালা দিয়ে কিছু একটা গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো।

    ক্যামিলকে লিভিং রুমে খুঁজে পাওয়া গেল। ফ্লোরে একটা সুটকেস পড়ে ছিলো যা এখনো নিয়ে যাওয়া হয়নি। এর ভিতরে একটা স্যুট, একজোড়া জুতা, ইলেকট্রিক রেজার, ওয়ালেট, স্পোর্টস ওয়াচ পাওয়া গেলো।

    একজন টেকনিশিয়ান এসে বলল, “আজকের দিনটা তোমার জন্য কুফা, ক্যামিল…টি.ভি রিপোের্টর নিচে চলে এসেছে।”

    সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়ে ক্যামিল বলল, “আজকের রাত নয়টার সংবাদ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত এই খবরই চলতে থাকবে।”

    অধ্যায় ১০

    “পুরোটাই পূর্বপরিকল্পিত, যথেষ্ট সময় নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করা হয়েছে,” বলল লুইস।

    “আমার মনে হয় ব্যাপারটা আরো জটিল। আদতে এই কেসে এমন কিছু একটা আছে যা মোটেও খাপ খাচ্ছে না।”

    “খাপ খাচ্ছে না?”

    “না। এখানের প্রায় সব জিনিসই একদম নতুন-বিছানা, কার্পেট, সুবকিছুই। শুধুমাত্র একটা পর্ণ মুভির শুটিংয়ের জন্য কেউ এতো টাকা খরচ করবে না। একদম গোছানো অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া যায়। আসলে তারা ভাড়াও করে না বরং বিনামূল্যে কোন জায়গা জোগাড় করে নেয়।”

    “স্নাফ মুভি?”

    “এমনটা আমিও ভেবেছি। হতে পারে…” বলল ক্যামিল।

    দুজনেই জানে এই ধরনের ছবির কদর আরো আগেই কমে গেছে। তাছাড়া, এতো দামি জিনিসপত্র, সাজানোগোছানো ঘর, সবকিছু মিলিয়ে তাদের অনুমানের সাথে খাপ খাচ্ছে না।

    “দেয়ালে আঙুলের ছাপগুলোও অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না।”

    “বাইরে থেকে কারো পক্ষেই কিছু দেখা সম্ভব ছিলো না। দরজা, জানালা সবই বন্ধ ছিলো। সম্ভবত খুনি আমাদের কোন বার্তা দিতে চাইছিলো। পুরো কাজটাই একদম তার পরিকল্পনা মত করেছে। কিন্তু, আমি এটাই বুঝতে পারছি না এমন বীভৎস হত্যাকাণ্ড এতো গুছিয়ে একজন মানুষ কিভাবে করলো…” লুইসের মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

    “সেটা দেখা যাবে। আমার কাছে সবচেয়ে অবাক লেগেছে অ্যানসারিং মেশিনের ব্যাপারটা,” বলল ক্যামিল।

    “কেন?” চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো লুইস।

    “আমার খটকা লাগছে এটা ভেবে যে ফোন, অ্যানসারিং মেশিন সব থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই এখানে নেই–ফোনের লাইন…”

    “কী!” সাথে সাথে ফোনের দিকে ছুটে গেলো লুইস। টেবিল সরাতেই দেখতে পেলো ইলেকট্রিকাল সকেট, কিন্তু ফোনের তার সেখানে লাগানো নেই।

    “এটা যে পূর্বপরিকল্পিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। লুকানোর কোন চেষ্টাও করা হয়নি। একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে…”

    পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুমের চারপাশে হাঁটা শুরু করলো ক্যামিল।

    অধ্যায় ১১

    সবার প্রথমে এলো লুইস, এরপর আরম্যান্ড। কিছুক্ষণ পর ম্যালেভাল যোগ দিলো, যাকে এখন ফোনে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। এরই সাথে ক্যামিলের টিম পূর্ণ হলো যারা পরিচিত ‘ভেরহোভেন ব্রিগেড’ নামে। নিজের নোট দ্রুত পড়ে শোনালো ক্যামিল।

    “কোন আইডিয়া?”

    তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকালো।

    “প্রথমেই আমাদের এটা জানতে হবে যে মোট কয়জন এর সাথে জড়িত। মানুষ যত বেশি হবে, তাদের খুঁজে বের করাটা আরো সহজ হবে,” মতামত জানালো আরম্যান্ড।

    “একা একজন মানুষ এই কাজ করতে পারবে না। এটা অসম্ভব,” বলল ম্যালেভাল।

    “ফরেনসিক বিভাগ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার আগে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাবে না।”

    দুপাশে বসে থাকা দুইজন একদম দুই মেরুর মানুষ; একজন অপব্যয়ী, আরেকজন কিপটে। ছাব্বিশ বছয় বয়সি জ্য-ক্লদ ম্যালেভলের চেহারায় একসময় কমনীয়তা ছিলো যা নিজেই নষ্ট করেছে-গভীর রাত, সুন্দরী মেয়ে এসব নিয়ে সময় কাটে তার। এমন একজন মানুষ যে মিতব্যয়ীতা কী জিনিস তা জানেই না। আবহাওয়া পরিবর্তন হলেও, তার চেহারা থেকে ক্লান্তির ছাপ কখনো দূর হয় না। ম্যালেভালের ব্যাপারে একটু বেশিই চিন্তা হয় ক্যামিলের। গত কয়েক মাসে দুইবার ম্যালেভালকে লুইসের সাথে কথা বলতে দেখেছে। প্রতিবারই তাদেরকে বেশ বিব্রত মনে হয়েছে যেন এমন কিছু করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে যা তাদের করা উচিত নয়। সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে ম্যালেভাল লুইসের কাছে টাকা ধার চাইতো। এরমাঝে নিজেকে জড়াতে চায়নি বলে দেখেও না দেখার ভান করে রইলো।

    একের পর এক আমেরিকার সিগারেট টেনে যেতো ম্যালেভাল। নারীর প্রতি তার আকর্ষণের কথা বললেই নয়, দেখতেও বেশ সুদর্শন। লম্বা, কালো চুল আর শরীর এমন ফিট যে এখনো ফ্রান্সের অলিম্পিক জুডো দলে সুযোগ পাবে।

    মুদ্রার উল্টোপিঠ নিয়েও একটু ভাবলো ক্যামিল–আরম্যান্ড, বেচারা আরম্যান্ড। বিশ বছরের কর্মজীবনের উনিশ বছরই সে পার করেছে সবচেয়ে নির্লিপ্ত আর কিপটে পুলিশ অফিসার হিসেবে। লম্বা, লিকলিকে, রোগা শরীর তার। কিপটেমির ছাপ তার চেহারাতে সুস্পষ্ট। তবে এসব নিয়ে ক্যামিল কখনোই তাকে ছোট করে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। এক সেন্ট কিংবা এক কাপ কফির পয়সা বাঁচানোর জন্য আরম্যান্ড কতটা নিচে নামতে পারে তা দেখে কিছুটা অবাক হয় সে। নিজের এই অবস্থান ঠিকই টের পেতো সে। একারণেই একসময় বিষণ্ণতাগ্রস্থ, একাকী হয়ে পড়ে। নীরবেই নিজেই কাজ করে যেতো। কাজের পেছনে লেগে থাকার অসীম ক্ষমতা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো অন্য উচ্চতায়। দিনের পর দিন টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে কাউকে খুঁজে বের করা কিংবা ঘণ্টার পর ঘন্টা কাজ করে লাইসেন্সবিহীন কোন গাড়ির খোঁজ, প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা-মোটকথা খড়ের গাদা থেকে সুই খুঁজে বের করার কাজ একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব। কয়েক লক্ষ টুকরার কোন জিগস পাজল দিয়ে গেলেও তা না মিলানো অবধি থামবে না সে। বিষয় নিয়ে তার কখনোই বাছাবাছি করার অভ্যাস ছিলো না। তার বেশ কিছু কাজই অনেকের কাছে এখনো অকল্পনীয় মনে হয়। একটা সময় সবাই বুঝতে পারে এই লিকলিকে শরীরের লোকটার মাঝে এমন কিছু আছে যা তাদের কারোরই নেই। তার কিপটেমি নিয়ে যত ধরনের রসিকতা করা সম্ভব তার সবই করেছে সহকর্মীরা, কিন্তু কখনোই এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে। বরং একসময় তারাই থেমে যায়। কেউ আর মজা পেতো না পুরনো কথাতে।

    “ওকে। যতক্ষণ না আমরা প্রাথমিক রিপোর্ট পাই ততক্ষণ এভাবেই চলতে থাকুক। আরম্যান্ড, ম্যালেভাল, আমি চাই তোমরা দুজন ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত এভিডেন্স নিয়ে কাজ শুরু করো, ওগুলো কোথা থেকে এলো–আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, বিছানার চাদর…আর লুইস, তুমি ভিডিওগুলো দেখো, কিছু পেলে আমাকে জানাবে। কারো কোন প্রশ্ন আছে?”

    কেউ কোন প্রশ্ন করলো না। হয় কোন প্রশ্নই নেই অথবা প্রশ্নের অন্ত ছিলো না।

    অধ্যায় ১২

    অজ্ঞাতনামা এক স্থানীয় লোক পুলিশকে ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ফোন করেছিল। ওই রেকর্ডিং আবার শুনতে চাইলো ক্যামিল।

    “১৭, রুই ফেলিক্স ফরে, ক্যুবেভুয়ার। এখানে কেউ খুন হয়েছে।”

    কণ্ঠস্বর অবিকল ওই অ্যানসারিং মেশিনের লোকের মত, একই রকম কাঁপুনি, সম্ভবত একই ডিভাইস দিয়ে করা হয়েছে।

    পরবর্তি কয়েকঘণ্টা নানান জিনিস নিয়ে মাথা ঘামালো ক্যামিল কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

    যখন বিরক্তিকর প্রশাসনিক কাজ করতে বাধ্য হয়, তখন তাকে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কেননা অফিসের কাগজপত্র, নানা ধরনের পরিসংখ্যান কিংবা অফিসিয়াল রিপোর্ট লেখা ইত্যাদি কাজ করতে হলেও তার মন পড়ে থাকে ফ্লোরে থাকা লাশের উপর, রক্তের শুকিয়ে যাওয়া কালচে দাগ তাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ে না।

    অধ্যায় ১৩

    ‘ইদতিঁতে জুডিশিয়েঁ’র প্রধান বার্গেরেট, আপদমস্তক একজন সৈনিক, ধীরস্থিরভাবে কাজ করা যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, কারো দ্বারাই প্রভাবিত হয় না। কিন্তু লা গুয়েনের সাথে তার সম্পর্ক স্লো মোশনে চলা দু’জন সুমো কুস্তিগিরের মারামারির মতো। লা গুয়েনের হস্তক্ষেপের কারণে বিকালের মাঝেই প্রাথমিক মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেলো ক্যামিল।

    খুন হওয়া দু-জনেরই বয়স বিশ থেকে ত্রিশের মাঝে। এদের মাঝে প্রথমজনের উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, ওজন প্রায় পঞ্চাশ কেজি, বাম পায়ের হাঁটুতে একটা কাটা দাগ; আর দ্বিতীয়জনের উচ্চতা আর ওজন প্রায় সমান, তবে শরীরের কোথাও কোন কাটা দাগ নেই।

    দু-জনেই খুনের তিন চার ঘণ্টা আগে ক্ৰডাইটস, বিফ স্টেক, রেড ওয়াইন খেয়েছিলো আর ডেজার্টে একজন খেয়েছে স্ট্রবেরি, অন্যজন লেবুর শরবত। দেয়ালের লেখাগুলো কয়েকটা আঙুল ব্যবহার করে লেখা হয়েছে। ল্যাটিন না জানা কারো জন্য লেখাটা পড়া বেশ কষ্টসাধ্য। কাকে আগে খুন করা হয়েছে কিংবা কীভাবে করা হয়েছে? হত্যাকারী একজন নাকি আরো বেশি? হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিলো কিনা আর হলেও কীভাবে? এমন আরো হাজারো প্রশ্ন আছে যা সমাধান করতে ক্যামিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

    তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, দেয়ালে পাওয়া আঙুলের ছাপের মাঝে মধ্যমার ছাপটা আসল নয়, রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে করা হয়েছে।

    কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্যামিল কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথে কম্পিউটারে তথ্য বিশ্লেষণ শুরু করা হয়ে গছে। একইসাথে ভাল এবং খারাপ খবর এসেছে তার কাছে। ভাল খবরটা হচ্ছে একজন ভিক্টিমের আঙুলের ছাপ ডাটাবেজে থাকা তথ্যের সাথে মিলে গেছে; এভলিন রুভ্রে, বয়স তেইশ, ববিগ্নিতে থাকে, পুলিশের কাছে বেশ পরিচিত মুখ।

    আর খারাপ লাগার কারণ হচ্ছে, আবারও এক বিকৃতমস্তিষ্কের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে দূর করার চেষ্টা করলো সে। নকল আঙুলের ছাপেরও খোঁজ পাওয়া গেলো; সেটা ২০০১ সালের ২১শে নভেম্বরের এক কেসের সাথে জড়িত। সাথে সাথে ওই কেসের ফাইল চেয়ে পাঠালো সে।

    অধ্যায় ১৪

    ডেস্কে পড়ে থাকা কেস ফাইলটা যেন একটা অভিশাপ। এই বিষয়ে সবাই একমত। বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলা কোন অফিসারই এই কেসে হাত দিতে চাইবে, কেননা ঘটনার সময়ে পুরো মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো কেসটা। ভিক্টিমের পায়ে কালো কালির নকল আঙুলের ছাপ নিয়ে সেই সময় সাংবাদিকরা নানা ধরনের কাহিনী রটিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ যাবত এই জিনিস নিয়ে নানা ধরনের শিরোনামে করা হয়েছে; কেউ লিখেছে ‘ট্রেম্বলের কসাই’ অথবা ‘শহরে নতুন রহস্যময় হত্যাকারীর আগমন’। এমন রস মিশিয়ে আরো অনেক শিরোনাম হয়েছে, তবে পুরস্কারটা যথারীতি গেছে লা মাটিনের দখলে, যাদের খবরের শিরোনাম ছিলো ‘কুমারীর প্রাণ’ কেড়ে নিলো করুণ মৃত্যু।

    এই কেস নিয়ে ক্যামিলের জানাশোনা অন্য কারো চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মনে করতেই নিজেকে একটা ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে দেখতে পেলো। ট্রেম্বলে কেস নতুন করে শুরু করা মানেই বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা। যতক্ষণ না খুনিকে গ্রেফতার করা হবে ততক্ষণই প্যারিসের উপশহরে একের পর এক মহিলার খণ্ডিত লাশ পাওয়া যাবে। লা গুয়েনকে ফোন করে সব জানালো।

    “শিট,” স্বাভাবিকভাবে বলল লা গুয়েন।

    “খারাপ বলেননি।”

    “মিডিয়া তো এর পিছনে উঠে পড়ে লাগবে।”

    “আমার ধারণা তারা এতক্ষণে খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।”

    “ঠিক বুঝলাম না। তুমি এতোক্ষণে দ্বারা কি বুঝাচ্ছো?”

    “আপনি কী আশা করেন? ‘ক্রিমিনাল ব্রিগেড’ তো একটা ঝাঁঝরির মত। আমরা ক্যুবেভুয়া পৌঁছানোর এক ঘণ্টার মাঝেই সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হয়েছে…”

    “আর,..” একটু চিন্তিত মনে হলো লা গুয়েনকে।

    “ওখানে টি.ভি’র লোকজনও ছিলো…”

    কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললো লা গুয়েন, এই নীরবতাকেই নিজের সুযোগে পরিণত করলো ক্যামিল।

    “আমি এদের সাইকোলজিকাল প্রোফাইল চাই,” বলল ক্যামিল।

    এদের দ্বারা কী বুঝাচ্ছো? তার মানে তোমার কাছে প্রমাণ আছে যে খুনি একজনের বেশি?”

    “একজন নাকি আরো বেশি, এই বালছাল আমি কীভাবে জানবো?”

    “আচ্ছা। এই কেসের ইনিভেস্টিগেটিং ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জাজ দেশমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমি তাকে ফোন করে তোমার চাহিদার ব্যাপারে বলে দিবো।”

    ক্যামিল এর আগে কখনো দেশমের সাথে কাজ করেনি। তবে দুই একবার দেখা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর বয়সি মহিলা, দেখতে খুবই কুৎসিত এতোটুকুই তার মনে পড়ে।

    “কালকে অটোপসি করা হবে। যদি কোন বিশেষজ্ঞ পাওয়া যায় খুব দ্রুত, তাহলে আমি কালকের মাঝেই কিছু জানাতে পারবো।

    ট্রেম্বলে কেসের ফাইল বন্ধ করে বর্তমান কেসে মনোযোগ ঢেলে দিলো ক্যামিল। বাকিটা বাসায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

    অধ্যায় ১৫

    এভলিন রুভ্রের পুলিশ রেকর্ড :

    জন্ম ১৯৮০ সালের ১৬ই মার্চ। মা ফ্রাঁসোয়া রুভ্রে। বাবার পরিচয় জানা যায়নি। স্কুলের পার্ট খুব দ্রুতই চুকিয়ে যায়। চাকরির ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোন তথ্য নেই। বেশ্যাবৃত্তির দায়ে প্রথম গ্রেফতার হয় ১৯৯৬ সালে। বয়স বিবেচনায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনমাস পর আবারো মাদক সেবনের দায়ে ধরা পড়ে। কিন্তু এবার তাকে আদালত অবধি যেতে হলো। অপরাধীর সাথে যে আবারো দেখা হবে এই ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত ছিলো বিচাকমণ্ডলী, তাই উপহারস্বরূপ তাকে আটদিনের কারাদণ্ড দিলো। এরপরে আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। সাধারণত, গ্রেফতার হওয়া অপরাধীদের অপরাধের তালিকা দিন দিন বাড়তেই থাকে। কিন্তু রুভ্রের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। আটদিন কারাদণ্ড ভোগের পর যেন বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। সর্বশেষ তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ক্যৰেভুয়ার অ্যাপার্টমেন্টে ঝুলন্ত অবস্থায়।

    অধ্যায় ১৬

    সত্তরের দশকের এক জরাজীর্ণ বাড়ি, দরজা জানালার বেশিরভাগই ভাঙ্গা, দেয়ালে গ্রাফিটি করা। তৃতীয় তলায় স্পাইহোল সমৃদ্ধ দরজা। “আমরা পুলিশের লোক, দরজা খুলুন!” শোনামাত্রই এভলিনের মা দরজা খুলে দিলো। তার বয়স অনুমান করা অসম্ভব।

    “ম্যাডাম রুভ্রে?”

    “আমরা আপনার মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

    “ও এখানে থাকে না।”

    “কোথায়… কোথায় থাকে সে?”

    “আমি জানি না। আমি তো আর পুলিশের লোক না।”

    “হ্যাঁ, আমরা পুলিশের লোক, তাই আমাদের সাহায্য করাটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক…এভলিন ভয়াবহ বিপদের মাঝে আছে, ভয়াবহ বিপদ…”

    “কিসের বিপদ?”

    “ওর ঠিকানা আমাদের দরকার।”

    একটু দ্বিধান্বিত বোধ করলো সে। ক্যামিল আর লুইস এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকেই বেশ সাবধানী মনে হচ্ছে।

    “খুব জরুরি দরকার।”

    “ও জোসে’র বাসায়।”

    “জোসে কে?”

    “আমি জানি না। নামটাই জানি শুধু।”

    এই বলে দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্ধত হলো সে। ঠিক তখনি ক্যামিল পা বাড়িয়ে দিলো দরজার মাঝে। ম্যাডাম রুভ্রে নিজের মেয়ের ব্যাপারে বেশি কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তার আরো জরুরি কাজ পড়ে আছে।

    “এভলিন মারা গেছে, ম্যাডাম রুভ্রে।”

    মুহূর্তের মাঝেই চেহারায় এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেলো তার। মুখটা হা হয়ে ইংরেজি ও অক্ষরের মত হয়ে গেলো, চোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো, কিন্তু কোচিংকার-কিহকাবিলাপ নেই সেখানে। তার চেহারার এই পরিবর্তন বেশ ভাল লাগলো ক্যামিলের। তার চেহারায় কিছু একটা আছে যা আজ সকালে অ্যালিসের মাঝেও দেখেছে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাডাম রুভ্রে, চোখে এক গভীর শূন্যতা। কোন শব্দ নেই, শুধু অসীম শূন্যতা আর নীরবতা যেন তার পৃথিবীটা দখল করে নিয়েছে।

    “লাশ শনাক্ত করার জন্য আপনার একটু আসতে হবে।”

    এখন সে কিছুই শুনছে না। ক্যামিলের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সব বুঝতে পেরেছে। আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলো ক্যামিল। দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেলো। ক্যামিল কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো এই ভেবে যে তাকে ভেতরে যেতে বলা হয়নি।

    অধ্যায় ১৭

    ডাটাবেজের তথ্য অনুসারে জোসের পুরো নাম জোসে রিভেইরো। বয়স চব্বিশ। অল্প বয়স থেকেই অপরাধে জড়িয়ে যায়, চুরি আর সহিংতার জন্য তিনবার গ্রেফতার হয়েছে। প্যান্টিনে জুয়েলারির দোকানে ডাকাতির অপরাধে সর্বশেষ জেলে যেতে হয়। ছয়মাস আগে ছাড়া পায়, কিন্তু এরপর থেকে আর কোন খবর নেই। ভাগ্য সহায় থাকলে তাকে বাসায়ই পাওয়া যাবে, নইলে এতোক্ষণে দৌড়ের উপর থাকবে, এখানে আসতে সময় লাগবে না। কিন্তু এর কোনোটাতেই খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না লুইস আর ক্যামিল। পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী জোসে রিভেইরো মস্তিষ্কবিকৃত কোন খুনি নয়। এরইমাঝে জিনস আর স্লিপার পড়ে উপস্থিত হলো সে। চেহারায় চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট।

    “হাই, জোসে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তোমার সাথে দেখা হলো।”

    ক্যামিল আর জোসের মাঝে এক অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ক্যামিলের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন সে রাস্তায় পড়ে থাকা কোন আবর্জনা।

    ক্যামিল আর লুইস ঘরের ভেতরে ঢুকলো। জোসে বাধা দিলো না, তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছে পুলিশের লোক অসময়ে তার বাসায় কেন হাজির হলো। এই তথ্যটাই জানা দরকার। ছোট লিভিং রুমে একটা টেলিভিশন আর সোফা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। কফি টেবিলে বিয়ারের খালি বোতল পড়ে আছে। বেডরুমে ঢুকলো ক্যামিল। ঘরটা যেন শুকরের খোঁয়াড়, পুরুষ আর মহিলার কাপড় এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

    দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জোসে, বেশ চিন্তিত, কথা না বলার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এর শেষ দেখে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

    “এখানে একাই থাকো?”

    “তা দিয়ে আপনার কী দরকার?”

    “আমরা প্রশ্ন করবো, জোসে। তুমি কি একা থাকো?”

    “না। আমার সাথে এভলিনও থাকে। কিন্তু ও এখন নেই।”

    “আর এভলিন কী করে?”

    “ও চাকরি খুঁজছে।”

    “ওহ…কিন্তু এখনো পায়নি, তাই না?”

    “না। এখনো না।”

    লুইস কিছু না বলে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু হুট করেই ক্যামিলকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো, কেননা উত্তর যে এমন হবে তা সে আগে থেকেই জানতো। তাই দেরি না করে নিজের পরবর্তি পদক্ষেপ নিলো।

    “শেষ কবে ওর সাথে দেখা হয়েছে তোমার?”

    “শনিবারে ও চলে গেছে।”

    “ও কি এমন প্রায়ই করে? মানে আমি বলতে চাইছি এতোদিন তোমাকে ছাড়া থাকে?”

    “উমম…না, ঠিক তা না,” বলল জোসে।

    এমন সময়ে জোসে বুঝতে পারলে তারা এমন কিছু জানে যা সে জানে না। খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য, আর তা শিগগিরই জানতে পারবে।

    “আপনি জানেন ও কোথায় আছে, তাই না?”

    “ও খুন হয়েছে, জোসে। আজ সকালে ক্যুবেভুয়ার একটা অ্যাপার্টমেন্টে আমরা লাশ খুঁজে পেয়েছি।”

    জোসে যে সত্যি সত্যিই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে তা আর বোঝার বাকি রইলো না। বেশ্যা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভালোবেসেছে, একসাথে রাত কাটিয়েছে। তার চোখেমুখে প্রিয়জন হারানোর বেদনা সুস্পষ্ট।

    “কে করেছে এই কাজ?” জিজ্ঞেস করলো জোসে।

    “আমরা এখনো জানি না। এজন্যেই এখানে আসা। ওখানে এভলিন কী করছিলো তা আমাদের জানতে হবে?”

    জোসে মাথা নাড়লো, তার কোন ধারণা নেই। এক ঘন্টার মাঝেই এভলিন আর জোসের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পেলো ক্যামিল।

    অধ্যায় ১৮

    এভলিন রুভ্রের জীবনে সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে গেছে। একবার গ্রেফতার হওয়ার পর সে বুঝতে পারে স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা সম্ভব নয়। বিশেষ করে নিজের মা যখন তাকে তাড়িয়ে দেয় তখন থেকে বাস্তবতা। বুঝতে শিখে। ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, একসময় সরবরাহ করাও শুরু করে দেয়। হুট করেই এক ক্লায়েন্ট তাকে সেক্স করার অফার দেয়, আর কনডম ছাড়া করার জন্য দ্বিগুণ টাকা দিতে চায়। সাথে সাথে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় সে। কিছুদিন পর তার জীবনে প্রবেশ করে জোসে। দুজনে মিলে নতুন একটা ফ্ল্যাটে উঠে। এরপর শুরু হয় তাদের যৌথ উদ্যোগ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে কাটিয়ে ক্লায়েন্ট খোঁজে এভলিন আর সেখানে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে জোসে। এভাবেই দুজনের ব্যবসা বেশ ভালই চলতে থাকে। একেকবার একেক হোটেলে নিয়ে যাওয়া আর সেখানে অপেক্ষা করার মাধ্যমই জোসের দায়িত্ব সম্পন্ন হয়। গত সপ্তাহেও এমন কিছু ঘটেছিলো। জন নামে এক ক্লায়েন্টের সাথে একটা হোটেলে দেখা করে এভলিন। ফেরার পর তার সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলেনি সে, আর দশটা কামুক পুরুষের মতই ছিলো। কিন্তু কয়েকদিন পর আবারো দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে জন। তবে এবার সে থ্রিসাম করতে চাইলে আর মেয়ে খোঁজার দায়িত্ব এভলিনকেই দিলো। তার একমাত্র শর্ত, বয়স আর উচ্চতা যেন এভলিনের মতই হয়। সবকিছু ভেবে জোসাইন ডেবেফকে ফোন করলো এভলিন, যার সাথে দেখা হয়েছিল একটা রেলস্টেশনের পাশে। সারারাত থাকতে হবে, এরজন্য বেশ ভাল পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে-দুইদিন কাজের সমান টাকা। জন তাদেরকে ক্যুবেভুয়ার ঠিকানা দিয়ে দেয়। জোসে দুইজনকে নিয়ে ঠিকানা মত পৌঁছে দেয়, কিন্তু মরুভূমির মত জায়গা দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তাই চুক্তি হয় জোসে ততক্ষণ বসে থাকবে যতক্ষণ না এভলিন হাত নেড়ে ইশারা দেয় যে সবকিছু ঠিক আছে। বিশ মিটার দূরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করে জোসে। কিছুক্ষণ পর জন বাইরে বেরিয়ে আসে, তার সাথে সাথেই আসে এভলিন। সে হাত নেড়ে জানায় সব ঠিক আছে। এদিকে জোসের আবার প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন এর খেলা দেখার কথা, তাই আর দেরি না করে ওখান থেকে চলে আসে।

    জোসে রিভেইররার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দ্বিতীয় ভিক্টিমের ব্যাপারে লুইসকে একটা ফাইল তৈরি করতে বলল ক্যামিল। নাম জোসাইন ডেবেফ, বয়স বিশের কাছাকাছি। তবে এই কাজে জড়িত মেয়েদের খুঁজে বের করতে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না।

    অধ্যায় ১৯

    সোফায় শুয়ে আছে স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ আইরিন, পেটের উপর হাতদুটো রাখা, ঠোঁট জুড়ে বিস্তৃত হাসি, কিন্তু এসব কিছুই খেয়াল করছে না ক্যামিল, তার মাথায় এখনো ক্ষতবিক্ষত লাশের ছবি ঘুরছে।

    “তুমি ঠিক আছো?” ক্যামিলের হাতে বিশাল ফাইল দেখে প্রশ্ন করলো সে।

    “হ্যাঁ…আমি ঠিক আছি।”

    পরিবেশ হালকা করার জন্য আইরিনের পেটে হাত রেখে প্রশ্ন করলো, “তো, আমার বাবুটা কি ফুটবলে লাথি মারছে এখন?”

    কথাটা বলতে না বলতেই রাত নয়টার খবর শুরু হয়ে গেল। দেখানোর মত খুব অল্প জিনিসই ছিলো তাদের কাছে, তাই অ্যাপার্টমেন্টে ঢাকার গেটটাকেই বিভিন্ন কোণা থেকে দেখানো শুরু করলো, বন্ধ দরজা, ফরেনসিক অফিসাররা ঘটনাস্থল ছেড়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য। মিডিয়ার লোকজন যে এই কেস নিয়ে মাতামাতি করবে এব্যাপারে নিশ্চিত ক্যামিল। মুহূর্তের জন্য সরকারের এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার চিন্তা মাথায় এলো।

    আইরিন চুপ করে রইলো। নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে, যাকে এখন টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে। দিন শেষে ক্যামিল সেই কথাগুলোই বলেছে, যা এখন টিভিতে শোনা যাচ্ছে।

    “ওরা মনে হয় সম্পাদনা করার কোন সময় পায় না, একটু পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলল আইরিন।

    ক্যামিলকে বেশ ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। কিছুসময় তার কথাও ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না।

    “দুইজন নারীর লাশ পেয়েছি আমরা, যাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তবে আমরা খুব নিষ্ঠুর এক খুনির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।” এই কথা আমি কী ভেবে বললাম বলার মতো একটা কাজ করে ফেলেছি! মনে মনে ভাবলো ক্যামিল। “তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জাজ দেশমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আপাতত এরচেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। এখন সরে গিয়ে আমাদের কাজ করতে দিন…”

    রাতের খাবার খাওয়ার পর ক্যামিলকে একটু চিন্তিত মনে হলো আইরিনের। একবার পত্রিকা পড়ছে, আবার একটু পরেই ম্যাগাজিন হাতে নিচ্ছে।

    “তুমি বরং কিছু কাজ করে নাও। আশা করি খুব বেশি সময় লাগবে না আর তুমি স্থিরও হতে পারবে,” হেসে হেসে বলল আইরিন।

    “একদমই লাগবে না। আমি শুধু ফাইলে একবার চোখ বুলিয়েই তোমার কাছে চলে আসবো।”

    ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যালেক্স – পিয়ের লেমেইত
    Next Article হযরত ওমর – আবদুল মওদুদ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }