Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আতঙ্ক একাদশ – অনুষ্টুপ শেঠ

    লেখক এক পাতা গল্প153 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মণিদীপ

    চোখ খুলে শুধু সাদা রঙ দেখলাম। দু’পাশে সাদা দেওয়াল, উপরে ফ্যাকাশে সাদা সিলিং। সামনে একটা পর্দা ঝুলছে, সেটা দুধের মত সাদা একদম। মাথার পিছনদিকটা দেখতে পাচ্ছি না, তবে সেও নিশ্চয় এরকম সাদা দেওয়ালই হবে।

    কয়েকবার চোখ খুলে বন্ধ করে কম ঔজ্জ্বল্যের আলোটায় চোখ সইয়ে নিলাম। ঘরটার কোথাও কোনো জানলা, ছবি, ক্যালেন্ডার কিচ্ছু নেই। পুরো ল্যাপাপোঁছা। আমার মাথার মধ্যেটাও তাই হয়ে আছে— ল্যাপাপোঁছা। একটাও শব্দ মনে করতে পারছি না নিজের সম্বন্ধে। নিজের নাম, বয়েস, কোথায় থাকি, কোথায় আছি, কিচ্ছু না।

    হাত পা নেড়েচেড়ে দেখলাম। কোনো ব্যথা-বেদনা নেই। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে, কিন্তু হাত বুলিয়ে বুঝলাম, ওখানেও কোনো চোট-আঘাত লাগেনি।

    তবে কি আমার স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক গোছের কিছু হয়েছিল?

    এতক্ষণে মনে পড়েছে, এটা হাসপাতাল। আর কোথাও এরকম সাদা ঘর থাকতেই পারে না। এক্ষুনি হয়তো পর্দা সরিয়ে সাদা পোশাক পরা কোনো নার্স উঁকি মারবে। তারপর গলায় স্টেথো ঝোলানো, ওইরকমই সাদা কোট পরা কোনো ডাক্তারকে ডেকে আনবে।

    কিন্তু আমি কে? এখানে এলামই বা কী করে?

    খাটটা ধরে ধরে উঠে বসতে গিয়েই মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল। বসে থাকাও শিখতে হবে মনে হচ্ছে নতুন করে। গায়ে জোর জিনিসটা প্রায় নেই বললেই চলে।

    ক’দিন আছি এখানে? একদিনের বেশি সম্ভবত। খাইনি মনে হয় কিছু। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

    তাছাড়া হাসপাতালের ঘর হলে তো কিছু যন্ত্রপাতি থাকবে। নিদেনপক্ষে খাটের পাশে ড্রিপ দেবার স্ট্যান্ড। সেখানে তো এমন চামড়া-মোড়া লাক্সারি সোফার মতো বেড হয় না। কত বড়লোকি হসপিটাল রে বাবা? আমার ইন্সিওরেন্সে কুলোবে তো?

    ঘরে হালকা এসি চলছে, কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মানে সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশনড। হাই ফাই!

    পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম। মাটিতে নেমে দাঁড়াই এবার। একটু নড়বড় করার পর পায়ে ভর দেবার মতো জোর আসে। ঘরটা ছোটো— মেরেকেটে ছ ফুট বাই দশ ফুট হবে। আমার আবার ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে। দম বন্ধ লাগে হঠাৎ। বেরোতে হবে। একটু এলোমেলো হলেও দ্রুত পা ফেলে পর্দাটা সরাই এক ঝটকায়।

    গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা চিৎকারটা সামনের ফাঁকা, অন্ধকার করিডরে ধাক্কা খেতে-খেতে মিলিয়ে যায়।

    ওই করিডরে যাওয়ার উপায় নেই। পর্দাটা একটা ভারী কোলাপ্সিবল গেটকে ঢেকে রেখেছিল। সেই গেটটা টেনে, ভারী তালা দিয়ে বন্ধ করা আছে।

    “নাম সুশান্ত হালদার।” কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বললেন মলয়, “বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি। মাঝারি দোহারা চেহারা, গায়ের রঙ কালো। গত দু’দিন ধরে নিখোঁজ।”

    মুখ তুললেন অসীম গুহ। কাটা-কাটা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “দু’দিন বাদে বলতে এসেছেন?”

    হালকা হলুদ শার্ট, ঘেমো, কালো ট্রাউজার পরা মধ্য-ষাটের ভদ্রলোক এমনিতেই মরমে মরে ছিলেন। তিনি আরো বিব্রত হয়ে উঠলেন এই কথায়।

    “না মানে… জোয়ান ছেলে তো। ভাবলাম বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেছে হুট করে, জানাতে পারেনি। কাল ওর বন্ধুদের, তারপর আত্মীয়দের ফোন করলাম। কেউ কিছু জানে না। তাও ভাবলাম, কোথাও গিয়ে হয়তো আটকে গেছে। কিন্তু কাল রাতেও ও এল না দেখে আর থাকতে পারলাম না। একটু দেখুন না স্যার! বাপ-মা মরা ছেলে। আমরা মামা-মামী বড়ো করেছি কোনোমতে। টানাটানির সংসার, শানুও একটু বারমুখো ছিল। তবু, এমন কিচ্ছুটি না জানিয়ে কখনো চলে যায়নি!”

    “হুম্। নেশা-টেশা ছিল কিছু?”

    “না স্যার। সিগারেট অবধি না। সিনেমা দেখতে ভালোবাসত, সেও তেমন ভয়ানক কিছু না।”

    “মানে, হিরো হবে বলে বম্বে পাড়ি দেয়নি বলছেন?”

    “কেন এত বাজে কথা বলছেন?” এবার তথাগত ফুঁসে ওঠে, “সুশান্ত সে-রকম ছেলে নয়। অ্যাদ্দিন আমার কাছে কাজ করছে। আমি ওকে বিলক্ষণ চিনি।”

    “বেশ। ওর গার্লফ্রেন্ডের নাম ধাম বলুন।”

    “গার্লফ্রেন্ড?” মলয়ের ভাঙা গাল আরও চুপসে যায়, “সেরকম কিছু তো শুনিনি।”

    “এই বয়সের ছেলের গার্লফ্রেন্ড ছিল না? বলেন কী? ড্রাগ-ফাগ নিত নাকি মশাই? নাকি চোরাকারবারে যুক্ত ছিল?”

    “অসীমবাবু, প্লিজ।” তথাগত মুখ না খুলে পারে না। হাসতে-হাসতে বাকি ফর্মালিটিগুলো মিটিয়ে দেন অসীম।

    ফিরে এসে আবার খাটে বসে পড়লাম। দম বন্ধ লাগছে। কী করব এবার? মাথায় কিছু আসছে না। এদিকে খুব তেষ্টা পেয়েছে।

    জল? ওই তো!

    খাটের একপাশে, দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট্ট টেবিল আছে। তার ওপরেই একটা জলের বোতল রাখা আছে দেখছি— আধখাওয়া। কে জানে কার খাওয়া! জল না খেয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করি একবার। এঁটো ব্যাপারটায় আমার খুব ঘেন্না করে।

    আমার? আমিটা কে?

    টের পেলাম, এসি-তে বসেও ঘাম হচ্ছে। সাদা দেওয়ালটা চোখের সামনে একবার ঝাপসা হচ্ছে, একবার স্পষ্ট।

    বোতলটা প্লাস্টিকের। আমি বহুকাল হল প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শুধু কাচের, বা স্টিলের স্পোর্টস বোতল ইউজ করি বাড়িতে।

    বাড়ি… স্পোর্টস বোতল একটা… আর কিছু ভাবার সুযোগ পেলাম না। শরীরটা নিজে থেকেই আবার খাটে ঢলে পড়ল।

    “এইজন্য পুলিশের কাছে আসতে চাইছিলাম না।”

    “আরে মলয়বাবু, এত অল্পে মুষড়ে পড়লে হয়? অ্যাদ্দিন ধরে দেখছি তো এদের! গত ছ’বছরে নাহোক বিশটা মার্ডার কেসে দৌড়েছি, তা জানেন? ও বস্তিতে ক্যাচালের শেষ নেই। কিছু ঝগড়াঝাঁটি মাতলামি চড়লেই হল। লোক গায়েব হয়ে গেল, তারপর এখানে-ওখানে মৃতদেহ আবিষ্কার হ’ল। কার যে কোন স্মাগলিং বা আর কোনো গ্যাং এ কনেকশন আছে তার ঠিক নেই! তখন সব হ্যাপা পোয়াতে হয়েছে এই মণিদীপ-কেই।”

    “সে তো দেখেইছি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মলয়, “মণিদীপ আপনার একার হাতে গড়া। আর পাঁচটা এন.জি.ও-রে সঙ্গে এর পার্থক্যটাও আপনিই গড়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যায় খালপাড়ের বস্তির বাচ্চাগুলোকে পড়ানো, দুপুরে তাদের মায়েদের পড়ানো। মাসে একবার করে হেলথ চেক-আপ। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা। পুজোয় নতুন জামা। তারপর কেউ মেরে অন্যের মাথা ফাটালে, এমনকি কারও জন্ডিস ধরা পড়লেও তো আপনি আর আপনার টিমই সামলেছেন।”

    “তবে! তাছাড়া অসীমবাবু মুখে অমন করেন, কিন্তু নিজের কাজের বেলায় উনি ফাঁক রাখেন না। রিনির বেলায় দেখেননি?”

    “দেখেছি।” মলয়ের কণ্ঠার কাছে হাড় লাফিয়ে ওঠে একবার, “রিনি’র কথা মনে পড়ছে বলেই তো আরো বেশি ভয় করছে।”

    রিনি মণিদীপের টিমে ছিল প্রায় দু’ বছর। বাচ্চাগুলোকে নাচ-গান শেখাত, হাতের কাজ শেখাত। কম বয়স, পাতলার মধ্যে বেশ সুন্দর দেখতে ছিল। ও নিখোঁজ শুনে পুলিশ পাত্তাই দিতে চায়নি শুরুতে। কিন্তু তখনই টের পেয়েছিল তথাগত, আপাত ছ্যাবলা, কথায় কথায় অশ্লীল রসিকতা করে ওঠা, নড়তে চড়তে আলস্য অসীমবাবু আসলে কী সিরিয়াস তদন্তের ব্যাপারে।

    মাসখানেক বাদে রিনির বডিটা ঐ খালপারের উলটো দিকে জঞ্জালের ভ্যাটেই পাওয়া গেছিল। পচা গলা বীভৎস। তথাগত দেখতে যেতে পারেনি, টিমের বাকিরা গেছিল। তারা এসে বলেছিল, চেহারা এতই বিকৃত হয়ে গেছিল যে পরনে চেনা কালো-লাল সালওয়ারটা না থাকলে কেউ রিনি বলে চিনত না।

    তথাগত তখন মণিদীপকে বাঁচাতে ব্যস্ত। লোকে বলছিল, এতে কাজ না করলে মেয়েটা এমন অঘোরে মারা যেত না। সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল, এটা ওই বস্তির কারও কাজ। চেষ্টা করলেও কি আর ওরা মানুষ হতে পারে? অমন সুন্দর মেয়েটার এই পরিণতি নির্ঘাত ওদের জন্যই হয়েছে।

    অন্য যে দুটো মেয়ে কাজ করত, সুরেখা আর কল্পনা, দুজনেই মণিদীপের সংস্রব ছেড়ে দিতে চাইছিল। ওরা ভয় পেয়েছিল। লোকেও যা তা বলতে শুরু করেছিল। অনেক কষ্টে তখন সব সামলেছিল তথাগত। মণিদীপ ওর প্রাণ। একটা অ্যাক্সিডেন্টে সেটা ভেঙে যাবে, এ ও কিছুতেই মানতে পারছিল না। খুব কঠিন সময় গেছে তখন।

    কপালজোরে, তদন্তে বেরিয়ে আসে যে রিনির একটি গোপন প্রেমিক ছিল। তার সঙ্গে নাকি রিনি’র ঝামেলা চলছিল ক’দিন ধরেই। দুশ্চরিত্র বলে ছেলেটির বদনামও ছিল। তার নামেই শেষে কেস দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেসটা দাঁড়ায়নি। প্রেমিকটির অকাট্য অ্যালিবাই ছিল ওই সময়টার জন্য। অসীমবাবু’র মনে এ নিয়ে এখনো খিঁচ আছে— তথাগত জানে। ভদ্রলোকের নিজের একটি ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে আছে, তাই ওঁর কাছে ব্যাপারটা শুধু অফিসিয়াল নয়, অনেকটা পার্সোনাল হয়ে উঠেছিল।

    মার্ডার বাই আননোন পার্সন অর পার্সন্স— এই রায়ের সঙ্গেই থেমে গেছিল ব্যাপারটা।

    তবে সুরেখাকে তথাগত ধরে রাখতে পারেনি। ওর বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছিল, এখানে কাজ করলে ওর আর বিয়ে হবে না। সুরেখা’র জায়গাতেই যোগ দিয়েছিল সুশান্ত। তারও যে কী হল!

    আজ আর চা করতে বা খেতে ইচ্ছে করল না তথাগতর। মনটা ‘কু’ ডাকছে বড্ড। এইভাবে পরপর ঝটকা এলে মণিদীপকে কি আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে?

    পিকলু মণিদীপের জন্মলগ্ন থেকে তথাগত’র সঙ্গে আছে। মণিদীপের অফিস-লাগোয়া ঘরেই বাচ্চাদের ক্লাস নেয় ও। ক্লাসের পরে পরদিনের জন্য একটা মিটিং করছিল তথাগত। তখন পিকলুও এই একই প্রশ্ন তুলল।

    “আমি নিজেও জানি না।” হতাশভাবে বলল তথাগত, “কিন্তু এসব আঘাত অগ্রাহ্য করেই তো আমাদের এগোতে হবে, বল?”

    “জানি না, তথাদা। লোকে কত কিছু বলছে। সেগুলোই শুনতে হচ্ছে এখন।”

    তারক মুখ খোলে এবার, “সুশান্ত’র গোঁয়ার্তুমির ফল কিন্তু এটা। আমাদের সঙ্গে একটা কথা বলল না, জানাল না, পরামর্শ করল না। ফট করে আগুনে হাত দিয়ে দিল!”

    তারকের সঙ্গে অমনি তাল মেলায় কল্পনা, “সত্যি তথাদা, এমন একজনকে কাজে ঢোকালেন আপনি! রোজ-রোজ লোকের সঙ্গে ঝগড়া আর তর্ক করত। আমরা কত বারণ করতাম, শুনতই না। আর সেদিন তো…! ভাগ্যিস আমি সামনে ছিলাম না, নইলে হয়তো আমাকেও ভুগতে হত।”

    বিরক্ত লাগে তথাগত’র। মেয়েটা নিজেকে নিয়ে যে কী ভাবে! এদিকে হাড় বের করা গলা, কালো, ব্রণ ভরা মুখ। কিন্তু নিজেকে নিয়ে কল্পরাজ্য ভ্রমণের আর শেষ নেই। মুখে অবশ্য এ-সব বলা যায় না।

    “আমরা থাকতে তোমার কিছু ক্ষতি হবে না কল্পবনা। এটুকু ভরসা রাখো।”

    “তা রাখি দাদা, কিন্তু একজনের বোকামির মাশুল তো আমাদের সবাইকে দিতে হবে মনে হচ্ছে। কাজ করাই দায় হয়ে উঠল যে!”

    সে কি আর জানে না তথাগত? দুপুরের ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো অলিখিত নিয়মে মেয়ে-বউরা আসতে ভয় পাচ্ছে। বাচ্চাগুলো এখনো আসছে, কিন্তু আগের মতো প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস আর নেই।

    মান্তু এখনো গায়েব, ঠিকই। কিন্তু ফিরে তো আসবে যে কোনোদিন!

    চুলে হাত চালিয়ে সেটাকে আরো এলোমেলো করে ফেলল তথাগত। তারপর খুব ক্লান্ত গলায় বলল, “আরেকবার বল তো পিকলু, কী হয়েছিল সেদিন?”

    “আমার সঙ্গে র‍্যালা নিতে আসবি না! মান্তুকে কারা-কারা চেনে, মনে রাখিস। কোথায় কোন মেয়ে ন্যাকামি মেরে কী বলল, আর তোরা আমার পিছনে লাগতে চলে এলি?”

    পিকলু আর তারক প্রায় আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছিল। মান্তুকে সবাই চেনে। বস্তির নতুন ভাড়াটে থেকে শাসক দলের ছোটো-বড়ো মাপের মন্ত্রীরা অবধি। তাঁদের অনেক অপারেশনে মান্তুর হাত থাকে, এটা এখানকার ওপেন সিক্রেট।

    এতদিন, মণিদীপকে মান্তু ঘাঁটায়নি। মণিদীপের কেউও মান্তুকে ঘাঁটায়নি, তখনও অবধি। কিন্তু সুশান্তকে যে এই নিয়ে আলাদা করে বারণ করা দরকার— এটা তথাগত ভাবেনি। ভেবেছিল, এ-পাড়ার লোক হয়ে সুশান্ত জানবে, কোথায় মুখ বন্ধ রাখতে হয়। যেভাবে তারক, পিকলু, অলোকরা এসব খুঁটিনাটি বুঝে নেয়, সেভাবেই সুশান্তও বুঝে নেবে— এটা ভাবতে দোষ কোথায়? কিন্তু তা হয়নি। সপ্তাহখানেক উধাও থাকার পর মান্তু নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। সুশান্ত তখনই হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ওর কলার চেপে ধরেছিল! তারক বা পিকলু— কেউ কিচ্ছু বলার মতো অবস্থায় ছিল না। ওরা হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কোনো এক শিবানীকে নাকি মান্তু জ্বালিয়েছে বলে উত্তাল গালাগালি দিচ্ছে সুশান্ত।

    ওরা সামনে না থাকলে সুশান্ত’র দফা হয়তো ওখানেই রফা হয়ে যেত। মান্তু’র বুড়ো মাকে নিয়মিত চেক আপ করায় মণিদীপ। দু’বার হাসপাতালে নিয়েও গেছে নিজেদের উদ্যোগে। হয়তো সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই মান্তু শুধু দুটো থাপ্পড় মেরে আর রাশিরাশি জ্বলন্ত খিস্তি দিয়ে সেদিন সুশান্তকে ছেড়ে দিয়েছিল।

    সেদিন, তার পরদিন, এমনকি তার পরেও সুশান্তকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সবাই— একা বা দলবেঁধে। কিন্তু ছোকরা খুব গোঁয়ার ছিল। নির্ঘাত কারও কথা কানে তোলেনি ও। তাই পরদিন সবাই অফিস ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তালা দিয়ে ঘরমুখো হয়নি সুশান্ত। বরং ও আবার বসে গেছিল অফিসে— একটু গোছগাছ করে পরে আসবে বলে।

    সেই শেষ দেখা গেছিল সুশান্তকে।

    কোন ভরসায় ও একা ওখানে ছিল, কে জানে! মান্তুকে সেদিন সারাদিন দেখা যায়নি বলে?

    মান্তুও সেদিন সকাল থেকেই উধাও হয়ে গেছিল। সেই থেকে তাকে আজ অবধি আর কেউ নাকি দেখেনি বস্তিতে।

    কী হয়েছে, বা হয়ে থাকতে পারে— সবাই বোঝে। কিন্তু বলবে কে? কেনই বা বলবে?

    ঘুমটা আবার ভাঙল। এবার রীতিমতো মাথা-ঘাড় ভর্তি ব্যথা নিয়ে উঠে বসলাম। সারা শরীর এখনো ঝিম মেরে আছে, কিন্তু এবার খিদে পাচ্ছে।

    তার মানে, দু’দিন কেটে গেছে। আজ তাহলে রবিবার। মাথা পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে-আস্তে। এত কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ তো, সময় নেবে ঘোরটা কাটতে। প্রতিবারই তাই হয়।

    আধখাওয়া জলের বোতলটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে শেষ করে দিই। আমারই খাওয়া বোতল। এবার মনে পড়েছে, বিশেষ কারণ আছে বলে শুধু এ সময়ে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করি। হা হা! মাসে একদিন প্লাস্টিকের বোতলে জল খেলে নিশ্চয় অত কিছু ক্ষতি হয় না!

    এখনো হাতে পায়ে পুরো জোর আসেনি। আরেকটু অপেক্ষা করাই ভালো। নিজের উপর পুরো কন্ট্রোল না এলে এখান থেকে যাওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে।

    দিনকাল ভালো না। একদম ভালো না। কার মনে যে কী আছে!

    আরো ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আর শোবো না। অনেক কাজ আছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে মনে মনে প্ল্যানগুলো করতে থাকি।

    “আজ ওই মণিদীপ ছোঁড়া এলে বোলো আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়।”

    “মণিদীপ না স্যার, ওটা তো ওর এন.জি.ও-এ নাম।” কনস্টেবল লালন সাঁপুই ভুলটা শুধরে দিতে চাইল, “ওর নাম, তথাগত।”

    “আরে সে যাই হোক। বোলো দেখা করতে। অ্যাদ্দিন ধরে লেগে ছিল। ওকে দেখানোটা আমাদের কর্তব্য তো।” অসীমের গলায় চোরা গর্ব খেলে যাচ্ছিল।

    বিকেলে এসেছিল খবরটা— খালের জলে একটা ধড় ভেসে এসেছে। শুধু ধড়। পচে ফুলে ওঠা জালার মত পেট, মাছে শামুকে ঠোকরানো ক্ষতবক্ষত হাত পা সব আছে, কিন্তু মাথা নেই। শনাক্ত করা খুব কঠিন।

    রিনি’র কেসটা মনে পড়েছিল অসীমের। সেই বডিটা অক্ষত ছিল। এমনকি রেপ-টেপ-ও হয়নি। কিন্তু এই বডির খবর পেয়েই সবার আগে রিনির কেসটা মনে পড়েছিল তাঁর। সেই জঞ্জালের ভ্যাটটা এই স্পট থেকে খুব একটা দূরে নয়। অসীম নিশ্চিত, এটা সুশান্তর শরীর। কিন্তু প্রশ্ন একটাই— সেক্ষেত্রে বডিটা পাক্কা সাতাশ দিন বাদে ভেসে উঠল কেন? তবে কাল খালের জলে জাল ফেলার ব্যবস্থা হয়েছে। ধড় থেকে মাথা আর কত দূরেই বা যাবে!

    তথাগতর কথা ভেবে একটু মায়াই হল। বেচারা। খালধারের বাচ্চাগুলোর জন্য জান লাগিয়ে কাজ করে ছেলেটা। এরকম সেটব্যাক পরপর হলে ওই এন.জি.ও বন্ধ হয়েই যাবে।

    কিন্তু তাঁর তো এসব ভাবলে চলবে না।

    জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে গেছে। কাজটা কে করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। বরং এখন মনে হচ্ছে, রিনির কেসটাও রি-ওপেন করলে হয়। হয়তো সেটাও মান্তুই… কিন্তু না, চিন্তায় লাগাম দেন অসীমবাবু। বউ-মেয়ে নিয়ে সংসারী মানুষ তিনি। মান্তুকে ঘাঁটানো মানেই শাসকদলকে চটানো। সেটা এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এমনি মড়া হলে অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ, কিম্বা মাতাল অবস্থায় জলে পড়ে মৃত্যু— এমন কিছু একটা বলে চালিয়ে দিতেন। মাথাটা হাপিস হয়ে ঝামেলা বাড়িয়ে দিল। তথাগত নিজেও এই জিনিস ধামাচাপা দিতে দেবে না।

    সিগারেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিতে-না-দিতে তথাগত হাজির হল। ছেলেটার মামাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে দেখে অসীমের মুখটা তেতো হয়ে গেল।

    সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল তথাগত। এমনিতে ও নিজেই শনাক্ত করে দিত। কিন্তু মাথা ছাড়া? সেটা বাড়ির লোক ছাড়া কীভাবে সম্ভব?

    কনুইয়ের কাছে জড়ুল, পেটের অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের দাগ— এগুলো বলে যাচ্ছিলেন মলয়। একবারের বেশি তাকাননি টেবিলের ওপর রাখা মাংসপিণ্ডটার দিকে। চোখ বন্ধ করেই বলে যাচ্ছিলেন সব। অসীম আর ডাক্তার মিলিয়ে নিচ্ছিলেন বর্ণনাগুলো। পিছন থেকে তথাগত’র চোখও বডিটায় ঘুরছিল অবাধ্য পোকার মত। সবই মিলে গেল।

    ঘর থেকে বেরিয়েই মলয় হড়হড় করে বমি করে ফেললেন।

    মর্গের গন্ধটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও নাকে লেগে থাকে। তথাগতরও অসহ্য লাগছিল। তবু মনটা বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অসীমবাবুর শেষ কথাটা মনে করে— “মাথাটা থাকলে কেস শেষ হয়ে যেত।”

    কে জানে কী দাঁড়াবে এবার!

    তারক বুঝতে পারছিল, তথাগতদা আজ খুব মুষড়ে আছে। স্বাভাবিক, যেভাবে বুক দিয়ে মণিদীপকে গড়ে তুলেছে লোকটা। সুশান্তটা একটা গাণ্ডু ছিল! যেচে শুধু নিজের পায়ে কুড়ুল মারল না, ওদেরও মেরে রেখে গেল। কী দরকার ছিল তোর, মান্তুর সঙ্গে লাগতে যাবার?

    বড্ড গোঁয়ার ছিল। কারও কথা গ্রাহ্যই করল না।

    নাহ, এ লোকটার এমন থোবড়া দেখতে একটুও ভালো লাগছে না তারকের। সারাদিনের পর এই মণিদীপ ওর নিজের রিলিফের জায়গা। জিজ্ঞেস করেই ফেলল তারক, “ও তথাগতদা, কী বলল পুলিশ অফিসার? বডি পেয়ে গেছে, এবার তো কেস সাজাক।”

    “নাহ্।” তথাগত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পুলিশ কেস ধামাচাপা দিয়ে দিতে চাইছে, যা বুঝলাম।”

    “পুলিশের খেয়ে দেয়ে কাজ আছে।” খরখর করে উঠল অলোক, “খামোকা তারা নিজেদের মাথা কেন হাঁড়িকাঠে ঢোকাবে?”

    তথাগত অন্যমনস্ক ভাবে সায় দিল। বলল, “জানিস, মাথাটা থাকলে বোধহয় আজই কেস ক্লোজ হয়ে যেত!”

    তারকের গলা থেকে অস্বাভাবিক জোরে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে, “মানে?!”

    “মানে বডির মাথা নেই। এটা তো আর অ্যাক্সিডেন্ট বলে চালানো যাবে না।”

    তথাগত থেমে গেল। তারকের চোখ কেমন অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলছে। অস্বস্তি হচ্ছে তাকিয়ে থাকতে। চোখ ফিরিয়ে নিল তথাগত। কল্পনা তার সুরটানা গলায় বলে উঠল, “উহ্ তথাদা, আপনি অমন লাশ দেখে এসেও এত শক্ত আছেন! সত্যি, আপনার নার্ভ খুব স্ট্রং।”

    আদিখ্যেতা! বিরক্তি গোপন করে তথাগত উঠে পড়ল। অন্যরাও উঠল। বাইরে এসে চটি পরতে পরতে তথাগত’র খেয়াল হল, তারক কিন্তু এখনো বসেই আছে ফাঁকা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। চোখে সেই অস্বাভাবিক তীব্র দৃষ্টি।

    অস্বস্তি হয়। বড্ড অস্বস্তি হয়।

    আচমকাই সন্দেহটা ঝলকে ওঠে তথাগতর মনের মধ্যে। সুশান্তর সঙ্গে শেষ সময় কাটিয়েছে তারকই। তারক চলে আসার সময় সুশান্ত একা বসে ছিল এই ঘরে। অন্তত সেটাই তারকের বক্তব্য। পুলিশ মেনেও নিয়েছে সেটা।

    কী কথা হয়েছিল ওদের দুজনের মধ্যে? শেষ কথা?

    ছ বছর আগে এই অসুখটার কথা জানতে পারি প্রথম। তার আগেও ছিল হয়তো। কিন্তু এত তীব্র প্রবণতা টের পাইনি। ওই অবস্থাতেও মাথায় বুদ্ধি গজিয়েছিল। এখানে কোনো ডাক্তার দেখাইনি, সোজা মুম্বই চলে গেছিলাম ছোটোপিসির কাছে।

    মানুষের ব্রেনের অদ্ভুত চলাচল নিয়ে ডক্টর কাশিদকর যথাসম্ভব বুঝিয়েছিলেন আমায়। নার্ভের অজানা সব সংযোগ আর মস্তিষ্কের দুর্জ্ঞেয় রহস্য নিয়ে অনেককিছু জেনেছিলাম তাঁর কাছেই। এই পিরিয়ডটা এভাবে কাটানোও তাঁর পরামর্শ মেনেই।

    এই পিরিয়ডে, মানে মাসে একবার, পূর্ণিমার রাতে আমি আর আমাতে থাকি না। মানুষও থাকি না হয়তো।

    ওয়্যারউলফের গল্প আমিও পড়েছি অনেক। পূর্ণিমার রাতে মানুষ থেকে হিংস্র নেকড়ে হয়ে ওঠার গল্প। না, আমার গায়ে তেমন লোম গজায় না, দাঁতে শ্বাপদাকৃতি আসে না, চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিল্লাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু রক্তে সেই নেশা ধরে। খুনের নেশা। যন্ত্রণা দিয়ে মারার নেশা!

    প্রথম কয়েকবার রাস্তার কুকুর, বেড়াল, একটা টিয়াপাখি— এ-সব দিয়ে কাজ চালিয়েছি। সুখ হত না। তারপর মণিদীপের হয়ে কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পেলাম ওই বস্তি। আহা! খুনির স্বর্গরাজ্য। কেউ হারিয়ে গেলেও তার জন্য খোঁজাখুঁজি হয় না। কেউ মারা গেলে কেউ পাত্তাও দেয় না।

    নিতাইটা পাঁড় মাতাল ছিল। মরেছে, আপদ গেছে। গোবিন্দটা মেয়েবাজ। রিনির গায়েও দুবার হাত দিয়েছিল। পটাইয়ের বউ তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে মালটা মরতে। কী মার মারত বউটাকে রোজ রাত্তিরে! তারপর টার্গেট করেছিলাম আয়েষাকে। রোগাভোগা মেয়ে, কিন্তু রিনির মতোই সুন্দর দেখতে ছিল।

    ইন ফ্যাক্ট, বড্ড বেশি রিনির মতোই দেখতে ছিল মেয়েটা। তাইতেই ভুলটা হয়ে গেল। অন্ধকারে কি আর ফর্সা-কালো বোঝা যায়?

    সেটাই রিস্ক হয়ে গেল। যতই গরীব অসহায় হোক, রিনিরা বস্তির বর্জ্য পদার্থ নয়। এদের ক্ষেত্রে ভালোভাবে তদন্ত হয়। বডিটা খালধারের ভ্যাটে ফেলাটাও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে কেউ দেখে ফেলতে পারত।

    বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা সামলাতে পারছি না। নেট ঘেঁটে, সাইকায়াট্রিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে মুম্বই গেলাম। পিসি-কে বললাম প্রস্টেটে ব্যথা, তাই ডাক্তারের কথামতো যশলোকে চেক করাতে এসেছি। ডক্টর কাশিদকর খুব সহানুভূতি নিয়ে শুনেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “নিজেকে ওই সময় আলাদা করে রাখো। সামলে রাখো। কোনো বন্ধুকে বলো তোমায় ঘরে আটকে রাখতে। নইলে কন্ট্রোল করতে পারবে না।”

    কাকে আর বলব? এ জিনিস কি কাউকে বিশ্বাস করে বলা যায়? নিজেই নিজের ব্যবস্থা করলাম। ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার আমলের বাড়ি ছিল। সে নাকি জমিদার ছিল। মাটির নীচের চোরাকুঠুরিতে অবাধ্য প্রজাদের আটকে রেখে সায়েস্তা করত। সেটাই কাজে লাগালাম।

    প্রতি মাসে, পূর্ণিমার আগের রাতে, ডাক্তারের দেওয়া কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওইখানে নিজেকে আটকে ফেলি। ওষুধের এফেক্ট কাটে ঠিক দু’দিন পরে, মানে পূর্ণিমা পার করে। তখন উঠে আসি আবার।

    তবে গত মাসে এই রুটিন ফলো করিনি। গত মাসে কাজ ছিল।

    গলি পার হয়ে যে যার রাস্তায় ঢুকেছিল। একটু দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল তথাগত। মনটা স্থির থাকছে না। তারকের অমন ভাবে বসে থাকাটা ভাবাচ্ছে।

    রিনি আর সুশান্ত— এই দু’জনেই তারকের খুব ক্লোজ ছিল না? ইঙ্গিতটা কেমন যেন একমুখী হয়ে উঠছে।

    সিগারেটটা ফেলে অতিরিক্ত জোরেই পায়ের তলায় সেটাকে পিষে দিল তথাগত। তখনই ডাকটা ভেসে এল পিছন থেকে, “তথাদা!”

    বুকটা ধড়াস করে ওঠে তথাগতর।

    তারক। ছুটে এসেছে বলে হাঁফাচ্ছে। একটু সময় দেওয়া দরকার ওকে, নিজেকেও।

    “ঘর চাবি দিয়ে এসেছিস তো ঠিকঠাক?”

    “হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি রাখবে চাবি? এই নাও।”

    “না রে, তোর কাছেই থাক। জানিস তো আমি রাত্রে গ্রামে যাচ্ছি আজ।”

    তারকের চোখ কি রাস্তার আলোয় বেশি অন্ধকার দেখায় হঠাৎ?

    “আজ না গেলে হয় না, তথাদা? মানে, আমারও আসলে কাল-পরশু দু’দিন একটু ছুটি চাই। কিছু কাজ আছে ব্রাঞ্চের, অফিস যাব।”

    দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিকারি নেকড়ে জরিপ করে। শিকার কি হাত ফসকাবে?

    “জানিস তো, প্রতি মাসে এই একটাই পুজো বাড়িতে। এত বছরের পুরোনো, আমি না গিয়ে দাঁড়ালে হয় না। তোকে যেতেই হবে?”

    “হ্যাঁ তথাদা। যেতেই হবে। রাতে ফিরবও না, এক কলিগের বাড়িতে থাকব। চাবি তাহলে আর কাউকে দিয়ে যাই?”

    তথাগত’র মাথার মধ্যে অ্যালার্ম বেজে উঠল। গত মাসে, ইনফ্যাক্ট সেদিন সেই সুশান্ত মান্তু কেসের পর পরই, তারক সেম জিনিস বলেছিল না?

    “গত মাসেও তো গেলি।”

    “আর বোলো না। প্রতি মাসে কীসব রিলিজ থাকে কায়েন্টের। চাপের চোটে আমরা মারা যাই! যাক, চাবিটা কী করব তাহলে?”

    “কল্পনার হাতে দিয়ে যা তবে। ও বাড়ি ঢোকার আগে ধরতে পারলে ভালো। আমি এগোই। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।”

    যেতে গিয়েও ঘুরে তাকাল তারক। সরলভাবে প্রশ্ন করল, “তুমি ক’টার ট্রেন ধরবে, তথাদা?”

    আবার সেই নিখাদ নিষ্পলক চাউনি। তথাগত’র গা হিম হয়ে ওঠে। রাতের স্টেশন খুব নির্জন হয়। সেখানে কিছু হলে? এড়িয়ে যাওয়া উত্তর দেয় ও, “দেখি, বাড়ি গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোব। তারপর যা পাব, তাতেই যাব।”

    আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে পা চালিয়ে দিল তথাগত। বুকের মধ্যে হাপরের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ও।

    রিনি। সুশান্ত। কিন্তু শেষে, তারক?

    মোড়ের মাথায় এসে একবার ইতস্তত করল তথাগত। থানার পাশেই অসীমবাবুর কোয়ার্টার। যাবে? যা মনে হচ্ছে কথা বলে দেখে আসবে?

    কিন্তু ওর ধারণাটা যদি ভুল হয়? তাড়াহুড়ো করতে গেলে যদি মণিদীপ শেষ হয়ে যায়!

    একটু ভাবা দরকার। এখন থাক। দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালিয়ে দেয় তথাগত।

    আচ্ছন্ন ভাবটা ক্রমে কেটে আসছে। হাতে পায়ে জোর ফিরে পাচ্ছি এবার। উঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, পা টলছে না।

    গেটের কাছে গিয়ে তালাটা তুলে ধরি। কম্বিনেশন লক। খোলার কম্বিনেশন আমি ছাড়া কেউ জানে না। তালা খুলি। করিডর পেরিয়ে ছোট্ট সিঁড়ি। চাকরদের বাথরুম ছিল এটা আগে। আমি লক পালটে নিয়েছি। চাবি আমার পকেটেই আছে। এই ঘরেই আমি ‘অপারেশন’ করি।

    যেমন করেছিলাম সুশান্ত’র সঙ্গে।

    সুশান্ত’র বড়ো বেশি কৌতূহল ছিল। আমি সেদিন ডায়রিটা ক্যাবলার মতো অফিসে ফেলে চলে এসেছিলাম। আগের দিন মান্তু’র সঙ্গে হওয়া ক্যাচাল নিয়ে সবাই এত ঘেঁটে ছিলাম তখন! ভুলে গেছিলাম, ডায়রিটার পিছনের পাতা ভর্তি করে আয়েষার নাম লিখে রেখেছিলাম লাল পেনে।

    জানি, তুমি কাজের ব্যাপারে সিনসিয়ার। তা বলে ঘর গুছোনোর সময় অন্যের ডায়রিতে কেউ হাত দেয়? বা দেখলেও, এরকম বাড়ি বয়ে এসে অভিযোগ তোলে? মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিলাম। অনেক টাকা। রগচটা গাধা হলে যা হয়। নিল না। বরং বলল, থানায় যাবে। কমপ্লেইন করবে!

    চিরকাল লাক আমার পাশে থেকেছে। রিনি’র বয়ফ্রেণ্ডের গল্পটা ঠিক সময় আবিষ্কার হওয়া লাক ছাড়া কী? সেদিনও তাই হয়েছিল। সুশান্ত আমাকে চ্যালেঞ্জ করল পূর্ণিমার ঠিক আগের রাতে। ও আধঘণ্টা দেরি করলেও আমার ওষুধ খাওয়া হয়ে যেত, কিছুই করতে পারতাম না।

    সুশান্তকে অজ্ঞান করে নীচের চোরকুঠরিতে আটকে রেখেছিলাম। আমার রূপান্তর ঘটে যাবার পর ওকে নিয়ে এসেছিলাম এই বাথরুমে। এই ঘরে জায়গা কম হলেও কাজ হয়ে যাওয়ার পর জল ঢেলে সব রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলা যায়। বস্তা করে চোরকুঠুরিতে ভরে রেখেছিলাম বডিটা। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর, সময়-সুযোগমতো বস্তা খুলে বডিটা খালের জলে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। সিম্পল। ইচ্ছে করেই যথাসম্ভব দেরি করেছিলাম, যাতে বডি পচে ফুলে চেনার অসুবিধে হয়।

    তবে বাজে ভুল করেছিলাম একটা। মাথাটা আলাদা করে কেটে না ফেললে কেসটা সহজেই ক্লোজ হয়ে যেত। কী আর করা? তখন কি আর এ-সব হুঁশ থাকে? ছুরি দিয়ে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে গলাটা কাটতে খুব ভালো লাগছিল— এটুকুই মনে আছে। দেখা যাক, কী হয়। যা লাক তাতে মান্তু’র কথা ভেবেই পুলিশ যাহোক করে কেস ক্লোজ করে দেবে।

    জামা কাপড় বদলাতে বদলাতে নিজের মনেই হাসি। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরশু অকারণেই বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।

    ফ্রিজ থেকে খাবার বার করি। বিয়ারও কিনে রেখেছি মনে করে। নাহ্, আমি সত্যি গুছিয়ে কাজ করি!

    ছায়া-ছায়া মানুষগুলো নিঃশব্দে বাড়িটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

    গত দু’দিন ধরে এক-এক করে সমস্ত পুরোনো কাগজপত্র আর নোট আবার ফিরে এসেছিল অসীম গুহ’র টেবিলে। উল্টোদিকে বসা মানুষটার বক্তব্য ক্রমশ যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠছিল পুলিশের অভিজ্ঞ বুদ্ধিতে।

    তারপর ফোন গেছিল মণিদীপের বাকি সদস্যদের কাছে। তাদের বাড়িতে, বন্ধুমহলে, এমনকি একটা ছোটো সফটওয়্যার কোম্পানির অফিসেও ধেয়ে এসেছিল প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আসল কথা বলা হয়নি, কিন্তু পুলিশি জেরায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া হয়েছিল সব্বার গতিবিধি। তারপর কাগজ-কলম নিয়ে আবার চলেছিল দীর্ঘ হিসাব— কে কখন উধাও হল, কার বডি কখন কোথায় পাওয়া গেল।

    আরও দেখা হল তারিখ, দিনক্ষণ, এমনকি তিথি!

    ছকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অসীমের সামনে। সামনে বসে, ওর অস্বস্তি বাড়ছিল। উত্তেজনাও। তবু সে ভয় পায়নি। ভয় পেয়ে চুপ করে থাকতে সে আর রাজি নয়। সে নিজের জন্যই হোক, বা মণিদীপের জন্যই।

    অবশেষে মুম্বইয়ের টেলিফোন কলটা সেরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন অসীম। পুলিশের হাত সত্যিই লম্বা। তাই ট্রেনজার্নির খবর, ডাক্তার-অ্যাপয়েন্টমেণ্টের হদিশ— সব বেরিয়ে এসেছিল একে-একে।

    তাই আজ রাতে এই অভিযান।

    দু’জন কন্সটেবলকে বাড়ির দু’পাশে, আর একজনকে বাড়ির পিছনে দাঁড় করিয়ে বাড়ির দিকে এগোলেন তাঁরা দুজন। মূল সাক্ষীকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না অসীম। তারকও চায়নি এই মোক্ষম মুহূর্তটা মিস করতে।

    দরজার বেলটা যখন বেজে উঠল, তখন সবে বিয়ারের বোতল হাতে সোফায় বসতে যাচ্ছিল তথাগত।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রতিঘাত – অনীশ দেব
    Next Article বিনুর বই ও নির্বাচিত ছোটোগল্প – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }