Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আপিম

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প13 Mins Read0

    আজ সকালে বাজারে যাওয়ার লোকের অভাব ঘটিয়াছে। বাজার প্রতিদিন একরকম নরেন নিজেই করে, আজ সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া সে একগাদা আপিসের কাগজপত্র লইয়া বসিয়াছে। অথচ বাজারে একজনকে পাঠাইতে হইবে। আপিস আছে, স্কুল-কলেজ আছে, কিছু মাছ-তরকারি না আনাইলে চলিবে কেন? ব্যস্ত ও ব্ৰিত স্বামীর মুখ দেখিয়া মায়ার বড়ই মমতাবোধ হইল, বাজারের কথাটা না তুলিয়াই সে সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গেল ছাতে।

    ছাতের ঘুপচি-ঘরখানায় থাকে বিমল, সংসারের সমস্ত গণ্ডগোলের উর্ধ্বে থাকিয়া সে কলেজের পড়া করে। বিমল তখনো ঘুমাইতেছিল। বেলা আটটার আগে কোনোদিনই তার ঘুম ভাঙে না। ছোট কেরোসিন-কাঠের টেবিলটিতে গাদা করা বই-খাতা আর ইংরেজি-বাংলা মাসিকপত্র; বিছানাতেও কয়েকটা বই পড়িয়া আছে। মাথার কাছে একটা বার্লির কৌটা, দেশলাইয়ের কাঠি, পোড়া সিগারেটের টুকরা আর ছাইয়ে প্রায় ভর্তি হইয়া গিয়াছে, বিছানা পাতিয়া মেঝের যেটুকু ফাঁকা আছে সেখানেও এইসব আবর্জনাই বেশি।

    এসব মায়ার নজরে পড়িল না, এতবড় ছেলে সিগারেট খাইবে সেটা আর এমন কী দোষের ব্যাপার? মায়ার শুধু চোখে পড়িল ঘুমন্ত ছেলের ক্লিষ্ট মুখোনি। আহা, কত রাত জাগিয়া না জানি ছেলে তার পড়িয়াছে! আজ যেমন করিয়াই হোক ওকে একটু বেশি দুধ খাওয়াইতেই হইবে। ভাশুরের দুধ যদি একটু কমাইয়া দেওয়া যায়–আপিম খায় বলিয়াই একজন রোজ একবাটি দুধ খাইবে আর এত খাঁটিয়া তার ছেলের যথেষ্ট দুধ জুটিবে না? যে ছেলে একদিন….

    সেইখানে দাঁড়াইয়া মায়া হয়তো ছেলের ভবিষ্যতের এবং সেই সঙ্গে জড়ানো নিজের ও নিজের এই সংসারের ভবিষ্যতের স্বপ্নে কিছুক্ষণের জন্য বিভোর হইয়া থাকিত, গোঙানির মতো আওয়াজ করিয়া বিমল পাশ ফেরায় স্বপ্ন-দেখা তখনকার মতো স্থগিত রাখিতে হইল।

    কাল যে ইংরেজি নভেলখানা পড়িতে পড়িতে বিমল ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক পিঠের নিচে সেই বইখানাই অনেকক্ষণ তার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করিতেছিল। মায়া ডাকিতেই সে জাগিয়া গেল।

    বাজার? চা-টা খাইয়া একবার বাজার যাইতে হইবে? মস্ত একটা হাই তুলিয়া মাথা নাড়িয়া বিমল বলিল, আমি পারব না।

    মায়া তা জানে। বিমল কোনোদিন বাজারে যায় না, বাজারে গেলে তার বিশ্রী লাগে, কেমন যেন লাগে, বড় খারাপ লাগে। তবু মায়া আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখিল, কাকে পাঠাব তবে? আজকের মতো একবারটি যা লক্ষ্মী, উনি আপিসের কাজ নিয়ে বসেছেন, নইলে–

    বিমল আবার মাথা নাড়িল, উঁহু, বাজার-টাজার আমার দ্বারা হবে না মা, বল তো দশবার গিয়ে দোকান থেকে জিনিস এনে দিচ্ছি; বাজারে ঢুকে মাছ, তরকারি কিনতে পারব না।

    মায়া ফিরিয়া গেল। তাই হোক, কোনোদিন যেন ছেলেকে তার নিজে বাজার করিতে যাইতে না হয়, শুধু বাজার করার জন্যই যেন মাহিনা দিয়া লোক রাখিবার ক্ষমতা তার হয়।

    আচ্ছা, তার ভাশুর কেন বাজারে যায় না? অন্তত আজকের মতো কেন যাইবে না? আপিম খায় বলিয়া? এ তো উচিত নয়! আগে যখন বড় চাকরি করিত, তখনকার কথা আলাদা। তখন কিছু বলিবার ছিল না, কিন্তু এখন যখন সপরিবারে ধরিতে গেলে একরকম ভাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়া আছে, এখন একদিনের জন্য দরকার হইলে কেন সে যাইবে না?

    কথাটা বুঝাইয়া বলিতে নরেনও সায় দিল, তারপর সন্দিগ্ধভাবে বলিল, দাদা কি যাবে? কাল কতটা গিলে ঘুমোচ্ছে কে জানে, ডেকে তুলতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। দাদার কথা বাদ দাও।

    বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন আজকাল।

    নরেন একথাতেও সায় দিল। বলিল, কী জান, শোকে তাপে এরকম হয়েছেন। বৌদি মারা যাবার পর থেকে–

    তার আগে বুঝি খেতেন না?

    তা খেতেন, তবে সে নামমাত্র, এতটা বাড়েনি।

    আপিমের নেশা বাড়ালেই বাড়ে।

    মায়া উঠিয়া গেল, বাজারে পাঠাইয়া দিল ঠিকা-ঝি কালিদাসীকে। বাড়তি একটা কাজও কালিদাসী করে না, এক গ্লাস জল গড়াইয়া দিতে বলিলেও গজর গজর করে, কিন্তু বাজারে পাঠাইলেই যায়। পয়সা তো চুরি করেই, মাছ-তরকারিও কিছু কিছু সরায়, ভিন্ন একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া আনিয়া নির্ভয়ে মায়াকে দেখায়, অন্তরঙ্গভাবে একগাল হাসিয়া বলে, ঘরের বাজারটাও এইসাথে সেরে এলাম মা। গরিবের বাজার দেখেছ মা, দুটি আলু, দুটি ঝিঙে–

    মায়া বিশ্বাস করে না যে, তাদের বাজার হইতে সরানো এই সামান্য জিনিসেই কালিদাসীর বাড়ির সকলের পেট ভরে। তবে সে আরো যে তিনটি বাড়িতে কাজ করে তাদের প্রত্যেকের বাজারে এরকম ভাগ বসাইলে চলিয়া যাইতে পারে বটে। মাঝবয়সী এই স্ত্রীলোকটির আঁটসাঁট গড়ন আর চালচলন সমস্তই মায়ার চক্ষুশূল, ঝি পাওয়া এত কঠিন না হইলে সে কবে কালিদাসীকে দূর করিয়া দিত। তবু মেয়ে মানুষ মেয়েমানুষের ঘরের খবর না জানিয়া পারে না, তাই খুঁটিয়া খুঁটিয়া কালিদাসীর সংসারের সব বিবরণই মায়া প্রায় জানিয়া ফেলিয়াছে। খাওয়ার লোক এ বাড়ির চেয়ে দু-একজন বেশিই হইবে, তাছাড়া কালিদাসীর স্বামী মদন আপিম খায়।

    প্রথম দিন খবরটা শুনিয়া মায়া গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বলিয়াছিল, আপিম খায়! তাই বুঝি রোজগারপাতি কিছুই করে না?

    কালিদাসী আশ্চর্য হইয়া বলিয়াছিল, রোজগার করবে না কেনে গা? ওর মতো খাটতে পারে কটা লোক? তবে গরিবের রোজগার তো, কুলোয় না।

    মায়াও আশ্চর্য হইয়া বলিয়াছিল, আপিম খায়, তবু নিয়মিত কাজকম্ম করে?

    কালিদাসী বলিয়াছিল, আপিম খায় তো কাজকম্ম করবে না কেনে মা?

    .

    প্রায় দশটার সময় কালিদাসীর বাজার-করা মাছ-তরকারি মুখে গুঁজিয়া নরেন আপিস যাইতেছিল, আপিমশোর দাদা ডাকিতেছে শুনিয়া তার ঘরে গেল। তিনটি মাথার বালিশের উপর একটা পাশবালিশ চাপাইয়া আরামে ঠেস দিয়া হরেন আধশোয়া অবস্থায় পড়িয়া আছে। মুখে কিন্তু তার একটুও আরামের ছাপ নাই, আছে চটচটে ঘামের মতো ভোতা একটা অবসাদ আর নির্বিকার উদাসভাবের আবরণ। তোশকটা একটু ঘেঁড়া, বিছানার চাদরটা অত্যন্ত ময়লা, দুটি বালিশ আর পাশবালিশটিতে ওয়াড়ের অভাব, ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রে পীড়াদায়ক বিশৃঙ্খলা। কিন্তু উপায় কী? শোকে তাপে মানুষ যখন কাতর হইয়া পড়ে, তখন আর তার কাছে কী প্রত্যাশা করা যায়?

    হরেন বলিল, আপিস যাচ্ছ?

    নরেন বলিল, হ্যাঁ।

    একটা টাকা দাও দিকি আমাকে।

    নরেন একটু ভাবিল। টাকার বড় টানাটানি, মাস শেষ হইয়া আসিয়াছে। অনেক দিন হইতে দাদাকে সে টাকা দিয়া আসিতেছে, কখনো একটা, কখনো দশটা। আজ ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করিয়া দেখা দরকার। আর কি কোনোদিন হরেনের পক্ষে গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বড় চাকরি-বাকরি করা সম্ভব হইবে? আগের মতো অত বড় না হোক, মাঝারি রকমের বড়? দুবছরের মধ্যে যদি এত আপিম বাড়াইয়াও শোকতাপটা সামলাইয়া উঠিতে না পারিয়া থাকে, আর কি কোনোদিন পারিবে? আপিমটা হয়তো দিন দিন পরিমাণে বাড়িয়াই চলিবে। মায়া ঠিক বলিয়াছে, আপিমের নেশা বাড়াইলেই বাড়ে।

    টাকা তো নেই দাদা। মাস কাবার হয়ে এল, আমি সামান্য মাইনে পাই–

    একেবারে নেই? আনা চারেক হবে না?

    নরেন মাথা নাড়িয়া বলিল, না, একটি পয়সা নেই। আপিমের জন্যে তো? আপিমটা এবার তুমি ছেড়ে দাও দাদা।

    হরেন তৎক্ষণাৎ রাজি হইয়া গেল, আচ্ছা, ছেড়ে দেব। কিন্তু হঠাৎ তো ছাড়া যায় না, এ্যাদ্দিনের নেশা! কারো কাছে ধারধোর করে অল্প একটু এনো আজ কিনে, কমিয়ে কমিয়ে কদিন বাদেই একেবারে ছেড়ে দেব। সত্যি, এ নেশাটা এবার ছেড়ে দেওয়াই উচিত। এনো কিন্তু, কেমন?

    দেখি-বলিয়া নরেন চলিয়া গেল।

    জবাবটা হরেনের তেমন পছন্দ হইল না। অন্তত আজকের দিনটা চলিয়া যায় এ রকম সামান্য পরিমাণে আপিম নরেন কিনিয়া আনিবে এটুকু ভরসাও কি করা চলে, এ রকম জবাবের পর? যদি না আনে? অসময়ে সে ফিরিয়া আসিবে, তারপর হয়তো হাজার চেষ্টা করিয়াও এক রতি আপিমও সংগ্রহ করা চলিবে না। কী সর্বনাশ! সন্ধ্যার সময় একটু আপিম না হইলে তার চলিবে কেন? কথাটা ভাবিতে গিয়াই তার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

    .

    বিমল কলেজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইলে বিমলকে সে ডাকে, গলা যথাসম্ভব মিহি করিয়া বলে, কলেজ যাচ্ছ, তোমার কাছে টাকা আছে, একটা দিতে পার আমায়?

    বিমল বলে, আছে, তোমায় দেব না।

    কেন?

    আপিম খেয়ে খেয়ে তুমি গোল্লায় যাবে আর আমি–

    হরেনের আধবোজা চোখ দুটি যেন এমন শ্রান্ত যে আড়চোখে ভাইপোর মুখের দিকে তাকানোর পরিশ্রমটুকু করিবার ক্ষমতাও চোখের নাই। চোখ দুটি একেবারে বুজিয়া ফেলিয়া বলে, আচ্ছা, থাক থাক। দরকার নেই।

    স্নানাহারের পর হরেন আধ-ময়লা একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া নিজেই বাহির হইয়া যায়। আপিম ছাড়া তো চলিবে না, যেভাবেই হোক জোগাড় করিতেই হইবে।

    .

    এদিকে আপিসে কাজ করিতে করিতে নরেনের মনটা খুঁতখুঁত করে। প্রথমটা হরেনের মঙ্গলের জন্য নিজের দৃঢ়তা প্রদর্শনের কথা ভাবিয়া বেশ গর্ববোধ হইতেছিল, আপিসে পৌঁছিতে পৌঁছিতেই প্রায় সে ভাবটা শেষ হইয়া গিয়াছে। এখন মনে হইতেছে, মোটে চারগণ্ডা পয়সা চাহিয়াছিল, না দেওয়া কি উচিত হইয়াছে? একদিনে আপিম ছাড়া আপিমখোরের পক্ষে সম্ভব নয়, এ কথাও সত্য। মনে কর, হরেন যদি সত্য সত্যই কমাইয়া ধীরে ধীরে আপিম ছাড়িয়া দেয়, আবার উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া ভালো একটা কাজ সংগ্রহ করিয়া ফেলে এবং আজকের ব্যাপারের জন্য তাকে কোনোদিন ক্ষমা না করে? কোনোদিন যদি তাকে আর টাকা-পয়সা কিছু না দেয়? কাজে নরেনের ভুল হইয়া যাইতে থাকে। হরেন যখন বড় চাকরি করিতেছিল তখনকার সেই সুখের দিনগুলির কথা মনে ভাসিয়া আসিতে থাকে। কী আরামেই তখন সে ছিল! কোনো ভাবনা ছিল না, কোনো অভাব ছিল না, নিজের বেতনের প্রায় সব টাকাই নিজের সুখের জন্য খরচ করিলেও কিছু আসিয়া যাইত না। আজ চারিদিকে টানাটানি, কেবল অভাব আর অভিযোগ, দিনে পাঁচটির বেশি সিগারেট খাওয়ার পর্যন্ত তার উপায় নাই, বিড়ি টানিতে হয়! আপিমের নেশাটা ছাড়িয়া হরেন যদি আবার…

    টিফিনের সময় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল লইয়াই মাঝবয়সী এক লোক আসিয়া বলিল, এ মাসে নেবেন তো? আপনার জন্যে বাছা বাছা নম্বর রেখেছি–সব কটা জোড় সংখ্যা, একটা বিজোড় নেই। এই দেখুন, চার, আট, ছয়–

    ছটি লটারির টিকিট বাহির করিয়া সে নরেনের হাতে দেয়। নরেন নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কিনছি তো প্রত্যেক মাসে, লাগছে কই!

    প্রথমে তিনখানা, তারপর জোড়া সংখ্যার টিকিট কেনা ভালো মনে করিয়া চারখানা টিকিট রাখিয়া নরেন একটি টাকা বাহির করিয়া দিল। টাকাটা পকেটে ভরিয়া লোকটি বলিল, এক টাকা দামের একখানা টিকিট আছে, নেবেন? ফার্স্ট প্রাইজ চল্লিশ পার্সেন্ট, গতবার সাতান্ন হাজার হয়েছিল, এবার আরো বেশি হবে। মস্ত ব্যাপার!

    টিকিটখানা হাতে করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নানাভাবে দেখিয়া নরেন বলিল, নেব কী, টাকাই যে নেই। একেবারে মাসকাবারে এলেন, কদিন আগে যদি আসতেন! তেসরা আসবেন, নেবখন।

    লোকটি ঝাঁকড়া চুলে ঝাঁকি দিয়া বলিল, তেসরা আসব কী মশায়, আজকে লাস্ট ডেট। সব টিকিট সেল হয়ে গেছে, ওই একখানা রেখেছিলাম আপনার জন্য–কী জানেন, এতে আপনার চান্স বেশি, টিকিট লিমিটেড কিনা। থার্ড প্রাইজও যদি পান, বিশ হাজার টাকা তো বটেই, বেশিও পেতে পারেন।

    আর একটি টাকা মানিব্যাগে ছিল, টাকাটি নরেন বাহির করিয়া দিল।

    এদিকে কলেজে বিমলের মনটাও খুঁতখুঁত করে। হরেন যখন তাকে ডাকিয়াছিল, তার খানিক আগেই কাগজে দেশনেতার মস্ত একটা বিবৃতি সে পড়িয়া ফেলিয়াছিল। বিবৃতিটি অবশ্য আপিম সম্পর্কে নয়, তবু সেটি পড়িয়া দেশসুদ্ধ লোকের উপর যে তীব্র আক্রোশ আর যে অনির্দিষ্ট আত্মগ্লানি তাকে পীড়ন করিতেছিল, অর্ধশায়িত জেঠাকে দেখিয়া তার প্রতিক্রিয়া একটা নির্দিষ্ট উপলক্ষ পাইয়া প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, হঠাৎ-জাগা বেপরোয়া উদ্ধতভাবের আর সীমা ছিল না। কলেজে পৌঁছিতে পৌঁছিতেই সে ভাবটা প্রায় উবিয়া গিয়াছে। এখন মনে হইতেছে, ওরকম বাহাদুরি না করিলেই বোধ হয় ভালো হইত। কেবল সবিতাদের বাড়িতে নয়, আরো যে কয়েকটি উঁচুস্তরের পরিবারে সে মেলামেশার সুযোগ পাইয়াছে, একটু খাতিরও পাইতেছে, তা তো কেবল সে হরেন মিত্রের ভাইপো বলিয়াই! তার জেঠামশায়ের সুদিন যদি কোনোদিন ফিরিয়া আসে আর জেঠামশায় যদি তাকে উঁচুস্তরে উঠিবার বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া দেয়, তবেই তো কেবল সবিতার সম্বন্ধে আশাভরসা পোষণ করা তার পক্ষে সম্ভব হইতে পারে। অবশ্য সবিতা যদি তার জন্য পাগল হইয়া ওঠে, যদি বুঝিতে পারে যে তাকে ছাড়া বাঁচিয়া থাকিয়া কোনো সুখ নাই, তবে হয়তো জেঠামশায় পিছনে নাই জানিয়াও এবং সে যে একদিন বড় হইবেই হইবে তার কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ সে এখন দেখাইতে না পারিলেও, তাকেই সবিতা বরণ করিবে। তবুও, জেঠামশায়কে চটানো বোধ হয় উচিত হয় নাই।

    তিনটার সময় বিমল গেটের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। তার ক্লাস এক ঘণ্টা আগেই শেষ হইয়াছে, এবার শেষ হইল সবিতার।

    প্রায় আধঘণ্টা পরে সবিতা আসিল, বিনা ভূমিকাতেই বলিল, আজ তো আপনাকে মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারব না। আমি অন্যদিকে যাব।

    বিমল বলিল, কোন দিকে?

    সবিতা বলিল, এই–অন্যদিকে। মানে, আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব।

    বিমল বলিল, কতক্ষণ থাকবেন?

    সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিল, তার কি ঠিক আছে কিছু!

    সবিতার গাড়ি চলিয়া গেলে বিমল ভাবিতে লাগিল, এখন কী করা যায়? একবার সে বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা দামি ঘড়িটার দিকে চাহিয়া দেখিল। হরেন তাকে একদিন ঘড়িটি কিনিয়া দিয়াছিল। এত শিগগির বাড়ি ফিরিয়া কোনো লাভ নাই। মাধুরীদের বাড়িতে যদি যায়, কেমন হয়? মাধুরী হয়তো দু-একখানা গান শোনাইতে পারে, তারপর হয়তো তার সঙ্গে বেড়াইতে যাইতেও রাজি হইতে পারে। কিন্তু বড় ক্ষুধা পাইয়াছে, কিছু খাইয়া যাওয়া দরকার, মাধুরী তো শুধু এক কাপ চা খাইতে দিবে।

    .

    সেদিন রাত্রি নটার সময়ও হরেন বাড়ি ফিরিল না। নরেন আর বিমলকে ভাত দিয়া। মায়া দুটি দুধও দুজনের থালার সামনে আগাইয়া দিল।

    বিমল আশ্চর্য হইয়া বলিল, দুধ কেন?

    নরেন বলিল, দাদার দুধ আছে তো?

    মায়া বলিল, ওঁর দুধ লাগবে না।

    খাইয়া উঠিয়া নরেন ঘরে গেল, আপিসে একজন একপয়সা দামের একটি চুরুট উপহার দিয়াছিল, বিছানায় আরাম করিয়া বসিয়া সবে চুরুটটি ধরাইয়াছে, হরেনের ছোট মেয়ে অমলা আসিয়া খবর দিল, বাবা তোমায় ডাকছে কাকু।

    নরেন অন্য কথা ভাবিতেছিল, ইতিমধ্যে দাদা কখন বাড়ি ফিরিয়াছে টেরও পায় নাই। জানালার সিমেন্টের উপর চুরুটটি নামাইয়া রাখিয়া একটু অস্বস্তির সঙ্গেই সে হরেনের কথা শুনিতে গেল। এমন সময় বাড়ি ফিরিয়া তাকে ডাকিয়া হরেনের কী বলিবার থাকিতে পারে?

    হরেন তাকে পাঁচটি টাকা দিয়া বলিল, একেবারেই টাকা নেই বলছিলে, এই টাকা কটা রাখো। আর শোনো, বসাকদের কোম্পানিতে একটা কাজ ঠিক করে এলাম। বুড়ো কদিন থেকে আমায় বলছিল–তুমি তো চেন বুড়োকে, চেন না? শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কিন্তু কী আর করা যায়, সংসার তো চালানো চাই। মেয়েটারও বিয়ে দিতে হবে দুদিন পরে।

    এইসব ভেবে–

    হরেনের ভাব দেখিয়া মনে হয়, একটা চাকরি ঠিক করিয়া আসিয়া সে যেন অপরাধ করিয়াছে এবং নিজেকে সমর্থন করার জন্য নরেনের কাছে কৈফিয়ত দিতেছে। হঠাৎ থামিয়া গিয়া সে ডাকিল, অলি!

    অমলা আসিলে বলিল তোর কাকিমাকে বল তো গিয়ে, আমি ভাত খাব না, শুধু দুধ খাব।

    নরেন নিজেই মায়াকে খবরটা জানাইয়া আসিল। হরেনের চাকরির খবরের চেয়ে সে শুধু দুধ খাইবে এই খবরটাই যেন মায়াকে বিচলিত করিয়া দিল বেশি। গৃহিণীর কর্তব্য পালনের জন্যই সে যে আজ একফোঁটা দুধও রাখে নাই, দুধের কড়াইটা পর্যন্ত মাজিবার জন্য কলতলায় বাহির করিয়া দিয়াছে! কী হইবে এখন?

    বিমলকে ডাকো শিগগির–আর, কআনা পয়সা দাও।

    বিমল মোড়ের ময়রার দোকান হইতে দুধ আনিতে গেল, নরেন ঘরে গিয়া আবার বিছানায় আরাম করিয়া বসিল। চুরুটটা নিভিয়া গিয়াছে। রাত্রে সহজে ঘুম না আসিলে দরকার হইতে পারে ভাবিয়া দুটি সিগারেট নরেন সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল–ঘুম না আসিলে গভীর রাত্রে ক্রমাগত সিগারেট টানিবার ইচ্ছাটা কেন যে প্রচণ্ড হইয়া ওঠে কে জানে! বিমলকে পাঁচটা সিগারেটও আনিতে দেওয়া হইয়াছে, সুতরাং নিশ্চিন্ত মনেই সঞ্চিত সিগারেটের একটি ধরাইয়া সে টানিতে লাগিল। যার যা টানা অভ্যাস সেটা না হইলে কি তার আরাম হয়!

    হরেন আবার চাকরি করিবে, সংসারের অভাব অনটন দূর হইবে, এ চিন্তার চেয়ে অন্য একটা অতি তুচ্ছ কথা নরেনের বেশি মনে হইতে থাকে। কাল বাজার করার পয়সা কোথায় পাইবে সে ভাবিয়া পাইতেছিল না, হরেন পাঁচটা টাকা দেওয়ায় এই দুশ্চিন্তার হাত হইতে সে রেহাই পাইয়াছে। বাজারের পয়সা পর্যন্ত না রাখিয়া দুটাকা দিয়া লটারির টিকিট কিনিয়াছে, এই চিন্তাটাও মনের মধ্যে বড় বেশি বিধিতেছিল। হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাইয়া গেলে যে কী মজাটাই হইবে; এ কল্পনায় যেন তেমন সুখ হইতেছিল না। এবার চোখ বুজিয়া নিশ্চিন্ত মনে কল্পনাকে আমল দেওয়া সম্ভব হইয়াছে।

    পড়ার টেবিলের সামনে বসিয়া বিমল ভাবিতে থাকে, এতরাত্রে সে যে কষ্ট করিয়া তার খাওয়ার জন্য দুধ কিনিয়া আনিয়াছে, পাকে-প্রকারে জেঠামহাশয়কে এ খবরটা জানাইয়া দিতে পারিলে বোধ হয় ভালো হইত। সকালের ব্যাপারেও জেঠামশায় যদি চটিয়া থাকে, কথাটা শুনিয়া খুশি হইতে পারে। খুশি হইলে হয়তো–

    রাত্রির মতো মায়ার সংসারের হাঙ্গামা চুকিতে এগারটা বাজিয়া গেল। হরেন তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অন্যদিন সন্ধ্যার পরেই নেশা জমিয়া আসে, এগারটা-বারটা পর্যন্ত ঝিমানোর আরাম ভোগ করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়ে। আজ সে সুখটা ফসকাইয়া গিয়াছে। রাত নটা পর্যন্ত বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া এমন শ্রান্তই সে হইয়া পড়িয়াছিল যে ভালো করিয়া নেশা জমিবার আগেই ঘুম আসিয়া গিয়াছে। নরেন চিৎ হইয়া শুইয়া তৃতীয়বার লটারির টিকিটের লেখাগুলি খুঁটিয়া খুঁটিয়া পড়িতেছে। বিমলও পড়ার টেবিল ছাড়িয়া কয়েকখানা বই আর খাতা-পেন্সিল লইয়া বিছানায় আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মুখে তার গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ হইতে সে মনে মনে একটা গল্প গড়িয়া তুলিতেছিল।কলেজ হইতে সবিতার গাড়িতে মোড় পর্যন্ত আসিবার সময় একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়া গিয়াছে, হাসপাতালে সে আর সবিতা একটা ঘরে পাশাপাশি দুটি বেডে পড়িয়া আছে। সবিতার বিশেষ কিছু হয় নাই, সবিতাকে বাঁচাইতে গিয়া তার আঘাত লাগিয়াছে গুরুতর। ডাক্তারের বারণ না মানিয়া সবিতা বেড ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া তার কপালে হাত বুলাইয়া দিতেছে। গল্পটি যখন জমিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তখন বিমলের মনে পড়িয়া গিয়াছে, আহত হইয়া এক হাসপাতালে গেলেও তাদের তো এক ওয়ার্ডে রাখিবে না!

    টেবিলের ওপর এক গ্লাস জল ঢাকা দিয়া রাখিয়া মায়া খানিকক্ষণ ছেলের দিকে চাহিয়া রহিল। একবার ভাবিল, আর বেশি রাত জাগিতে ছেলেকে বারণ করে। তারপর ভাবিল, বড় হইতে হইলে রাত জাগিয়া না পড়িলে চলিবে কেন! এ পর্যন্ত ছেলের পরীক্ষাগুলি ভালো হয় নাই, এবার একটু রাত জাগিয়া যদি মেডেল পায়, বৃত্তি পায়–

    শরীরে শ্রান্তি আসিয়াছে কিন্তু চোখে ঘুম আসে নাই। একটি পান মুখে দিয়া দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া মায়া দ্রুতবেগে ছেলের মেডেল আর বৃত্তি পাওয়ার দিনগুলি অতিক্রম করিয়া যায়। গিয়া পৌঁছায় সেইসব দিনে, বিমল যখন মস্ত চাকরি করিতেছে, ঘরে একটি টুকটুকে বৌ আসিয়াছে–

    বাড়িতে আপিম খায় একজন, কিন্তু জাগিয়া স্বপ্ন দেখে সকলেই। হরেনের পনের বছরের মেয়ে অমলা পর্যন্ত কাকিমার চোখ এড়াইয়া এতরাত্রে খোলা ছাতে একটু বেড়াইতে যায়–ছাতে গিয়া নানা কথা ভাবিতে তার বড় ভালো লাগে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিবেক
    Next Article যাকে ঘুষ দিতে হয়

    Related Articles

    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    প্রৌঢ়ের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    উদারচরিতানামের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    রাজার বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }