Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমাদের দুঃখ – কাজী আনোয়ারুল কাদীর

    কাজী আনোয়ারুল কাদীর এক পাতা গল্প78 Mins Read0

    জাতীয় সমস্যা

    চারিদিককার কাড়াকাড়ির ভিতর মন অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলো, ঢেউএর দোল, ফুলের হাসি, মেঘের রঙ, কোকিলের তান, বাতাসের বাঁশী, বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দের যত রকম, সমস্তই মনে হয় যেন অবরুদ্ধ। শেলি, গ্যেটে, কোলরিজ কিছুই ভালো লাগে না। ইতিহাস দর্শন, নাটক নভেল, কাব্য, সব রাজনীতি সমাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে মিলে আনন্দচর্চার বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধঘোষণা করেছে। মনকে বার বার বলি–”ওরে ঐ চোখের জল আর ফেলিস নে।” কিন্তু ঐ যে আবার কোলাহল, কাড়াকাড়ি!

    এরই মধ্যে আবার ক্ষুধার তাড়নায় রোজগারের চেষ্টা করতে হয়; তাতে কত যে হয়রান, ওষ্ঠাগত প্রাণ হতে হয়, তা ভাবতে গেলে মৃত্যু কামনা করতে ইচ্ছা হয়। এত ব্যথা, এত অশ্রু, তবুও সাম্প্রদায়িক বিরোধের অবসান নেই।

    এই সাম্প্রদায়িক বিরোধ মানবপীড়নের এমন জটিল পঙ্কিল এবং নিষ্ঠুর আবেষ্টন রচনা করেছে যে, মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বলে মনে হয়। প্রেম, প্রীতি, দয়া, ক্ষমা এ সব কোথায় যে আশ্রয় নিয়েছে তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কাজ ভালো কি মন্দ তার বিচার করবার জন্য আমাদের মাপকাঠি হয়েছে হিন্দু করেছে না মুসলমান করেছে। হিন্দু নিক্তিতে ওজন ক’রে মুসলমানের চরিত্রের বিচার করছে, অনুবীক্ষণ-যন্ত্রের সাহায্যে মুসলমানের দোষত্রুটির সন্ধান করছে, মুসলমান ‘বিষে বিষক্ষয়’ নীতি অবলম্বন ক’রে আকাশে বাতাসে বিষ মাখিয়ে দিচ্ছে।

    রাজনীতিবিদ্ Joint electon with reservation অথবা without reservation of seats অথবা Seperate Electorate-এর তর্ক তুলেছেন। নানারূপ প্যাক্টের তালি দিয়ে নানা ছিদ্র রীপু করবার চেষ্টা চলেছে। স্যর পি, সি, রায় প্রভৃতি নেতারা নানা দিক দিয়ে চেষ্টা করেছেন দেশের কল্যাণের জন্য। দেশে Revolutionary spirit, কংগ্রেসের Non-violence creed ইত্যাদি এক সঙ্গে কাজ করছে। এই সব মাতামাতির ভিতর কতটুকু কল্যাণ অর্জিত হয়েছে ভেবে দেখবার সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না।

    এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কথা বলেছিলেন কিছু দিন পূর্বে। কবি অনেক কথাই মাঝে মাঝে আমাদিগকে বলে থাকেন কিন্তু ওঁর কথা জাত্যাভিমানী হিন্দু এবং গোঁড়া মুসলমান কেউই বুঝতে চাচ্ছে না। একবার তিনি দুঃখ জানিয়েছিলেন যে, আমাদের দেশের প্রধান পরিচয় হচ্ছে ‘হিন্দু’ ‘মুসলমান’, এবং রাষ্ট্রিক মহাজাতির সৃষ্টির জন্য এই পরিচয় একটি বড় বাধা। দরদী কবির এই হৃদয়-নিড়ান মধু-বাণী অশ্রুবাষ্পময় এই প্রেমের আহ্বান, হৃদয়হীন হিন্দু মুসলমানের প্রাণের কোনো সাড়া আজও জাগায়নি।

    আমাদের দেশে “অন্ন জোটে না কথা জোটে মেলা”। এখানে বহু কথা বলা হয়েছে–এত কথা বলা হয়েছে এবং কাজ এত কম হয়েছে যে, যেন মনে হয়, এদেশটি শুধু কথারই দেশ, কাজের দেশ আদৌ নয়। এর সব চেয়ে বড় প্রমাণ এই যে, নাটক নভেল বাদ দিলে সৃষ্টির দিক দিয়ে আমরা বেশী অগ্রসর হতে পারিনি।

    নাটক নভেলে আমরা Biochemistryর রিসার্চ করি, Chemistry of digestion এর যন্ত্রপাতি তৈরী করি, cellulose হজম করবার সহজ ও সস্তা উপায় বার ক’রে পৃথিবীর অন্নসমস্যা সমাধানের কথা ভাবি। কিন্তু পৃথিবীর অন্নসমস্যা তো দূরের কথা, নিজেদের দেশের অন্নসমস্যাই ক্রমে জটিলতর হয়ে চলেছে।

    এই সব নাটক নভেলে আমরা সমাজের চিত্র আঁকছি নানা দিক দিয়ে, নানাভাবে নরনারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করছি; কিন্তু এতে কতজন নরনারীর জীবন ব্যর্থতার পীড়া থেকে মুক্তি পেয়েছে? এ যেন আমাদের ভাবনার কোনো চেষ্টাই নয়! শত সহস্ৰ দুঃখী ও দুখিনীর নিঃশ্বাসে আকাশ বাতাস আজও তিক্ত! দুঃখের স্তূপ দিয়ে হিমালয় পাহাড় রচনা হয়ে চলেছে, গুণীর গুণের আদর একটুও বাড়েনি। রমেশের ব্যর্থতা, ভগবদ্ভক্ত সমাজপতি গোলক চাটুয্যের কপটতা, জ্ঞানদার বুকফাটা ব্যথা, ভৈরব আচার্যের অকৃতজ্ঞতা, গোবিন্দ গাঙ্গুলীর অনাচার অবিচার ও অত্যাচার, গেনির অসহায়া জননীর দুঃখ ও ক্ষোভ, আশা নিরাশার দোলা, দেবদাসের দুর্ভাগ্য, পার্বতীর বিড়ম্বনা, অভিশপ্ত কিরণময়ীর লাঞ্ছনা, ভারতের লক্ষ লক্ষ নরনারীর কত প্রাণপণ সাধনাকে ব্যর্থতার অতল সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। গোলক চাটুয্যে, গোবিন্দ গাঙ্গুলী এরা সংখ্যায় এত বেশী যে প্রতি গৃহেই এদের আসা যাওয়া। তাই অসহায়া বিধবার দীর্ঘশ্বাস, কুমারীর পিতার দুশ্চিন্তা, শিক্ষিতা নারীর কাতর ম্লান মুখশ্রী, সংস্কার-প্রয়াসী যুবকের ব্যর্থতা, সত্যসন্ধানী প্রৌঢ়ের বেদনা, উদার বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস আজও দেশকে হতশ্রী ও ম্লান ক’রে রেখেছে।

    মুসলমানের গৃহে আজও তেমনি ভ্রাতৃবিরোধ, পরশ্রীকাতরতা, পড়শীর প্রতি বিদ্বেষ, ক্ষুধার জ্বালা, তেমনি শ্রীহীনতা বিদ্যমান। হিন্দুর গৃহে স্বস্তি নাই, মুসলমানের গৃহে শৃঙ্খলা নাই; বাইরে যে সমাজ সেখানে গেলেই দ্বন্দ্ব। আমরা মুখে বলছি, “চঞ্চল গৌরব, দু’ফোঁটা শিশিরে হয় বিগতসৌরভ।” কিন্তু সামান্য গৌরব, সামান্য সুবিধার জন্য আমরা কী না করতে পারি! কত না অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে সব সামান্য সুবিধার জন্য! সামান্য স্কুল কমিটির মেম্বর, ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর, ডিসপেনসারী কমিটীর সভ্য ইত্যাদি পদের জন্য, আমাদের কত ব্যস্ততা, কত গোপন পরামর্শ, বেনামী দরখাস্ত, কত সীমাহীন লজ্জাহীনতা!

    এ সবে হয়তো কিছু লাভ আছে। নানা রকম সমস্যা এমন জটিল চেহারা নিয়েছে যে শুধু বেঁচে থাকবার জন্য, কিছু মান-প্রতিপত্তির জন্য চেষ্টা না করলে চলে না, চারিদিককার আঘাতে প্রাণান্ত হতে হয়। হয়তো চলে না, না হয়তো প্রাণান্ত হতে হয়; কিন্তু তাই বলে এই সব নিয়ে কাড়াকাড়ি, হিংসা, কূটনীতি, নানারূপ লজ্জাহীনতার সমর্থন করা যায় না।

    শুধু যে পল্লীগ্রামে এই সব দীনতা তা তো নয়। সহরে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের সরকারী বেসরকারী সব উচ্চ পদস্থ যাঁরা তাঁদেরও সব লোভ, অহঙ্কার কোনো অংশে কম নয়। এখানেও সততার অভাব এবং দায়িত্বহীনতার প্রভাব এত বেশী যে, ছোট বড় সব একাকার মনে হয়। বেসরকারী বিভাগে উকিল মোক্তার, ডাক্তার, জমিদার, মহাজন, এঁদের নিঃসীম লোভের কথা ভাবতে গেলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। এক একজন উকিলের একদিনকার ফিস্ দিয়ে একশত বস্ত্রহীন নারীর লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা হতে পারতো; এক একজন ডাক্তারের একদিনকার আয়ে সহস্র অন্নাভাবে মলিন-বদন শিশুর মুখে অন্ততঃ একদিনকার জন্য একটু শুভ্র হাসি ফুটে উঠতে পারতো। মহাজনদের হৃদয়-হীনতা, এবং জমিদারদের অসীম দায়িত্ব-হীনতার তুলনা এ জগতে আর কোথায় মেলে? দেখে শুনে মনে বার বার প্রশ্ন ওঠে–এই কি সেই ভারতবর্ষ যার শিক্ষা সম্বন্ধে কবি বলেছিলেন :

    গৃহীরে শিখা’লে গৃহ করিতে বিস্তার
    ভোগেরে বেঁধেছ তুমি সংযমের সাথে
    প্রতিবেশী আত্মবন্ধু অতিথি অনাথে;
    নিৰ্ম্মল বৈরাগ্যে দৈন্য ক’রেছে উজ্জ্বল!…

    সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে পুলিশের দুর্নাম তো আছেই, কিন্তু কোন্ বিভাগে যে সমস্ত বিষয় বিচার ইত্যাদির মর্যাদা রক্ষা হয় তা বিচার করতে গেলে চিত্ত বিকল হয়ে যায়। তোষামোদ সুপারিশ উপঢৌকন এমন কি উৎকোচ চলে না এমন কোনো সরকারী বিভাগ আছে কি না খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। দেশের এই দুর্দিনে সরকারী কর্মচারীদের হৃদয়হীনতা অশান্তি নিবারণ না ক’রে বাড়িয়েই চলেছে। এসব সরকারী কর্মচারীদের প্রতিপত্তি দেখে বিন্তি খেলায় রঙের গোলামের মানের কথা মনে পড়ে।

    সেবক যখন শাসকের স্থান অধিকার করে তখন শাসন শোষণে পরিণত হয়। আমাদের দেশে তাই ঘটেছে। এমন নির্বিঘ্নে শোষণের ব্যবস্থা ও অধিকার অন্য কোথাও নাই। শব্দের অর্থের দিক দিয়ে এক একজন ধর্মাবতার, এক একজন শোষণাবতার। আরও পরিতাপের বিষয়, এ সবের প্রতীকার অসম্ভব এবং নিকট- ভবিষ্যতে যে সম্ভব হবে তার কোনো লক্ষণই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মোটের উপর “প্রবলের উদ্ধত অন্যায়, লোভীর নিষ্ঠুর লোভ, বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ, জাতি অভিমান, মানবতার বহু অসম্মান–দুঃখ পাপ অমঙ্গল–যত অশ্রুজল যত হিংসা হলাহল সমস্ত উঠেছে তরঙ্গিয়া কূল উল্লঙ্ঘিয়া।” দে’খে দেখে চিত্ত বিকল হয়ে যায়। কেবলই মনে হয়, শান্তি ও কল্যাণের দিকে আমাদের দৃষ্টি নাই। হিন্দুর হাতে শাসনভার ন্যস্ত হবে, না মুসলমানের হাতে, তাই নিয়ে আমাদের কাড়াকাড়ি। এদিকে মুসলমানের বিশ্বাস অর্জন করবার চেষ্টা হিন্দুর নেই; মুসলমানও হিন্দুর ভক্তি অর্জন করবার কথা ভাবছে না মোটেই। হিন্দুর ব্যথায় মুসলমানের আনন্দ, মুসলমানের দুঃখে হিন্দুর উল্লাস, দে’খে দে’খে মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আজ লাঞ্ছিত। দয়া, ক্ষমা, প্রেম, প্রীতির পরিবর্তে নিন্দাবাণী, আর আপন সাধুত্ব-অভিমানই হয়েছে আমাদের ধর্ম! তাই দেশের কল্যাণকামীর মনে প্রশ্ন জাগে, কল্যাণ কোথায়?

    যে সমস্ত রাজকর্মচারীদের উপর শাসনভার ন্যস্ত তাঁদের নানারূপ উচ্ছৃঙ্খলতা সম্বন্ধে নিরপেক্ষ সমালোচনা ক’রে যে তাঁদের দোষ সংশোধনের ব্যবস্থা করা হবে, তারও উপায় নেই। চারিদিকে কেবল কাড়াকাড়ি। এই সব কাড়াকাড়ির মধ্যে কোন্ সমালোচনাটি যে সৎ ও নিরপেক্ষ, তা নির্ণয় করা সরকারের পক্ষে কঠিন–আবার যে সব সমালোচনা হয় তার অধিকাংশই হয় নিজ নিজ স্বার্থোদ্ধারের জন্য, না হয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রসূত। সরকারী কর্মচারীদের দৃষ্টি নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিপত্তি ও প্রমোশনের দিকে। তাঁদের মাসিক বেতন বৎসর বৎসর বেড়ে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে গৃহহীন, অর্থহীন, বস্ত্রহীন ও অন্নহীনের সংখ্যাও বেড়েছে। এঁদের প্রমোশন নির্বিঘ্নে হয়ে চলেছে, এ দিকে দেশে জেলের সংখ্যা, কয়েদীর সংখ্যা, অপরাধের মাত্রা, মোকদ্দমার সংখ্যা, ব্যাধির মাত্রা, দুঃখ, শোকতাপ সবই বেড়ে চলেছে। শাসনের উদ্দেশ্য কতটুকু সার্থক হয়েছে ভেবে দেখবার কথা কারও মনে উদয় হয় না।

    দেশের অসংখ্য নরনারী জ্ঞান ও নীতি, ন্যায় ও ধর্ম, সুবিচার, সৎসাহস, সরলতা, উদারতা, প্রীতি কিছুরই মর্যাদা রক্ষা করতে পারছে না। এখানে হিন্দু যেমন অক্ষম মুসলমানও তদ্রূপ। দীনতা ঢাকবার জন্য কেউ বা চাণক্য-নীতির দোহাই দিয়ে বলছে রাজনীতি ক্ষেত্রে কপটতার আশ্রয় নিতে হয়, আবার কেউ বুদ্ধির দীনতা ঢাকতে গিয়ে নৈতিক সৎসাহস বিসর্জন দিয়ে গোপন ভিক্ষা, বেনাম দরখাস্ত, সাম্প্রদায়িক অধিকার, “অতি সূক্ষ্ম ভগ্ন অংশ ভাগ” ইত্যাদির আশ্রয় নিচ্ছে। কেবলই উদ্গীরিত হচ্ছে বিদ্বেষ, কুৎসা, পরশ্রীকাতরতার গরল। ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে সেই গরল। পথশ্রান্ত, পিপাসাকাতর, ওষ্ঠাগত প্রাণ পথিক আমরা–প্রাণের দায়ে পান করছি সেই গরল– এ জ্বালা কি মিটবে? সে কবে!

    হিন্দু মুসলমান শুধু দুটি কথা। এই দুটি কথা আমাদিগকে এতই মোহাচ্ছন্ন করেছে যে আমাদের মনুষ্যত্ব সত্যিই ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। যাঁরা গর্বিত এবং গোঁড়া, তারা হয়তো জানেই না যে, তাঁরা কি পরিমাণে মোহাচ্ছন্ন। মোহাচ্ছন্ন জনের সবচেয়ে বড় শাস্তিই এই যে, তাঁরা তাঁদের পাপ সম্বন্ধে অন্ধ। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাভিমানী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে রকম ভ্রান্ত এবং সাম্প্রদায়িক-মনোভাবগ্রস্ত, তাতে সত্যিই হতাশ হতে হয়। আশৈশব একসঙ্গে খেলাধূলা, একই দেশে বাস, একই স্কুল-কলেজের শিক্ষা, তথাপি হিন্দু মুসলমানে এই যে ব্যবধান, এর কারণ খুঁজে দেখলে বুঝতে পারা যায়, কি পরিমাণে অনিষ্ট সাধিত হয়েছে হিন্দু মুসলমান এই দুটি কথার দ্বারা। সত্য, মঙ্গল ও প্রেম যদি সত্যিই সবারই কাম্য, তবে কেন এত ব্যবধান?

    এই সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য হিন্দু-সম্প্রদায়ভুক্ত যাঁরা তাঁরা দায়ী করছেন মুসলমানকে; আবার মুসলমান-সম্প্রদায়ভুক্ত যাঁরা তাঁরা বলছেন হিন্দু দায়ী। হয়তো এ ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে কম দায়ী নয়। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক বিরোধ মোটেই আধুনিক ব্যাপার নয়। বৌদ্ধ প্রীতির জন্য হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে একবার ৫০০ ব্রাহ্মণকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। রাজার অনুগ্রহ অর্জন করবার জন্য কাড়াকাড়ি সাম্প্রদায়িক বিরোধের অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রধান কারণ এই কাড়াকাড়ি। এই বিরোধের ইন্ধন যোগান হচ্ছে ধর্মের নামে আস্ফালন দ্বারা। ধর্মপালনের পরিবর্তে ধর্মের নামে যে আস্ফালন, তার থেকে উৎপন্ন হয়েছে ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, মুসলমান, খৃষ্টান ইত্যাদি নামের মোহ। দয়া, ক্ষমা, প্রেম, প্রীতি বাদ দিয়ে ধর্মের নামে যে আস্ফালন তার ভিতরে কল্যাণ নেই, এ কথা আমাদিগকে ভাবতে হবে; মোহমুক্ত হয়ে, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে, ঈর্ষা বিদ্বেষকে অতিক্রম ক’রে, সরল মনে, সহজভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা কঠিন হবে না যে, ধর্মের নামে আস্ফালন আর ধর্মপালন এক কথা আদৌ নয়। হিন্দুর মুখে বা কলমে,

    “আর্য্য গরিমা কীর্তি কাহিনী”র কথায় অসহিষ্ণু হয়ে হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ক’রে অসহিষ্ণু মুসলমান কল্যাণকে বর্জন ভিন্ন গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। বিজাতি বলে ভারতের অসংখ্য মুসলমানকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে চেষ্টা করলে হিন্দুও মঙ্গলকে বরণ করতে পারবে না।

    পোষাক এবং কতকগুলি বাহ্যাড়ম্বর বাদ দিলে জ্ঞানে বা গুণে হিন্দু ও মুসলমানকে পৃথক করা যায় না। নিষ্ঠুরতা, কপটতা, সাম্প্রদায়িকতা, পরশ্রীকাতরতা, হিন্দু মুসলমান উভয়ের মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান। যদি কোনো একটি বিশেষ গুণ, যেমন–উদারতা, সরলতা, দানশীলতা, পরোপকারিতা ইত্যাদির কোনো একটিও হিন্দু বা মুসলমান তার কর্মের দ্বারা তার ধর্মের বিশেষত্ব বলে প্রমাণ করতে পারতো তবে তার শ্রেষ্ঠত্ব আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়তো। মুসলমানের টুপী বা হিন্দুর টীকিতে মানবতার বিকাশ সাধিত হয় এমন ধারণা যত শীগগির আমাদের মন থেকে দূর হয় ততই মঙ্গল। টুপী বা টীকিতে পাপ যায় না। শতকরা দেড়শত টাকা সুদে কর্জ দিয়ে খাতকের রক্তশোষণ, স্ত্রীর বুকের উপর চেপে বসে তার চক্ষু উৎপাটন, এসব অহঙ্কার করবার মতো ব্যাপার আদৌ নয়। স্বার্থোদ্ধারের জন্য কুপরামর্শ দিয়ে দাঙ্গার সৃষ্টি যারা করে তারাও যেমন পাপী, নররক্তে যাদের হস্ত রঞ্জিত হয় তারাও তেমনি নিষ্ঠুর। হিন্দু-মুসলমানকে ভাবতে হবে সব কথা নতুন ক’রে। অবজ্ঞার মধ্যে, বিচ্ছেদের মধ্যে, বিদ্বেষের মধ্যে কল্যাণ নেই। মিলন ও প্রীতির মধ্যে শান্তি ও কল্যাণের সন্ধান পাওয়া সহজ হবে। আত্মাভিমান বা জাত্যাভিমানের মধ্যে মিলন ও প্রীতি নাই। যদি কেউ সত্যিই বড় হও, টেনে তোল, যদি না পার বলতে হবে সত্যি বড় নও। যতই হিন্দু মুসলমান বলে চীৎকার করবো আমরা ততই মিলনের পথে অন্তরায় বেড়ে যাবে। উভয় সম্প্রদায়কে মনে রাখতে হবে :

    “মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
    ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে। বিধাতার রুদ্ররোষে
    দুর্ভিক্ষের দ্বারে ব’সে
    ভাগ ক’রে খেতে হবে সকলের সাথে অনুপান
    অপমানে হ’তে হবে আজি তোরে সবার সমান।”
    –রবীন্দ্রনাথ

    আমাদের হয়তো গোড়া থেকেই নতুন ক’রে ভাবতে হবে। God is Almighty ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এই কথাটিই হয়তো re-examine করতে হবে। করুণাময়, প্রেমময়, আনন্দময়, মঙ্গলময় ইত্যাদি রূপকে বাদ দিয়ে সর্বশক্তিমান রূপকে হয়তো আমরা অনাবশ্যক ভাবে বড় ক’রে দেখেছি। God is good, God is joy, God is love–আল্লাহ্ রহমানির রহিম, এইসব রূপকে আমরা মস্তিষ্কের Sub-conscious region-এ নির্বাসিত ক’রে রেখেছি। তাই শক্তির পূজাই আমাদের মূলমন্ত্র হয়েছে এবং শত্রুবেশে ভারতমাতার বুকে তাণ্ডব নৃত্যই আমাদের প্রধান ধর্ম হয়েছে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা, হিন্দু বড় কি মুসলমান বড় তারই প্রমাণাদি নিয়ে আমরা সর্বদা ব্যস্ত। এ দিকে বড় হবার জন্য যে তপস্যার আবশ্যক সে সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন। প্রেম, প্রীতি বাদ দিয়ে শক্তি সঞ্চয় অসম্ভব; তাই কেউই শক্তি সঞ্চয় করতে পারিনি এবং প্রকৃতপক্ষে কেউই অপরকে জয় করতে পারিনি; ফলে দাঁড়িয়েছে কেবলই অশান্তি, ব্যথা ও ক্রন্দন। ব্যথা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মুক্তির জন্য তাকিয়ে আছি আকাশের পানে-Devine help, Miracle এর দিকে। এই মনোভাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিরাট তমসারূপী অপ্রবৃত্তি-মহা-অসুর।

    মানুষের সব চেয়ে বড় অধর্ম-কর্মে অপ্রবৃত্তি। এই অপ্রবৃত্তি হিন্দু মুসলমানের অন্তর থেকে দূর করতে না পারলে আমরা কখনোই নিজেদের সার্থক ক’রে তুলতে পারবো না। আমাদের অপ্রবৃত্তির দুটি বিপুলকায় সন্তান চাকুরী এবং বৈরাগ্য আজ আমাদের কাছে যে সমাদর পেয়েছে তা পাবার যোগ্য তারা নয়। আমাদের শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম অংশে আমরা চাকরীর জন্য তৈরি হই, তারপর চাকরীর মধ্যে মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় যখন একেবারে রিক্ত ও হৃতসর্বস্ব হয়ে পড়ি তখন জপের মালা বা তস্ত্রী ইত্যাদি দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সর্বশক্তিমান রূপকে পূজা ক’রে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ব্যস্ত হই। কবি রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়” আজ পর্যন্ত আমাদের প্রাণে প্রেরণা যোগাতে পারেনি। কয়েক শতাব্দী পূর্বে আরবের মরুভূমিতে একজন মহামানবও এই কথাই “লা রোহবানিয়াতা ফিলইসলাম” ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু মুসলমানে একই দেশের জল বায়ুতে লালিত, পালিত ও বর্ধিত। চাকরী এবং miracle সব মোহকে বাদ দিয়ে জ্ঞানে, প্রেমে এবং কর্মে বড় হবার চেষ্টা না পেলে, ঘৃণা বিদ্বেষ এবং জাত্যভিমান না ছাড়লে, উভয়কে ছোট হয়েই থাকতে হবে।

    “দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে;
    অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহঙ্কারে।
    সবারে না যদি ডাকো
    এখনো সরিয়া থাকো,
    আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান
    মৃত্যুমাঝে হ’তে হবে চিতাভস্মে সবার সমান।”

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)
    Next Article বাংলার জাগরণ – কাজী আবদুল ওদুদ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.