Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার ছেলেবেলা – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প123 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. স্বপ্নলোকের চাবি

    স্বপ্নলোকের চাবি

    পারুল আপা নেই, কাজেই স্কুলের দুঃসহ দুঘণ্টা কোনোক্রমে পার করে দেবার পরের সময়টা মহানন্দের। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। সাজানো-গোছানো সুন্দর বাড়ি দেখলেই হট করে ঢুকে পড়ি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৎক্ষণাৎ বের করে দেয়া হয়। এর মধ্যে একটি বাড়িতে ভিন্ন ব্যাপার হল। এই বাড়িটিও মীরাবাজারেই। আমাদের বাসার কাছে। বিশাল কম্পাউন্ড, গাছগাছালিতে ছাওয়া ধবধবে সাদা রঙের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। এই বাড়িতে কে থাকেন তাও আমরা জানি, সিলেট এম. সি. কলেজের অধ্যাপক। আমাদের কাছে তার পরিচয় হচ্ছে প্রফেসর সাব, অতি অতি অতি জ্ঞানী লোক-যাঁকে দূর থেকে দেখলেই পুণ্য হয়। তবে এই প্রফেসর সাহেব নাকি পাকিস্তানে থাকবেন না, দেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যাবেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নাকি চাকরিও হয়েছে। তিনি চেষ্টা করছেন বাড়ি বিক্রির।

    এক দুপুরে গেট খোলা পেয়ে হুট করে সেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। গাছপালার কী শান্ত-শান্ত ভাব। মনে হয় ভুল করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এক বাড়ি, বাগানে ঢুকে পড়েছি। আনন্দে মন ভরে গেল। একা একা অনেকক্ষণ হাঁটলাম। হঠাৎ দেখি কোনার দিকের একটি গাছের নিচে পাটি পেতে একটি মেয়ে উপড় হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতে একটা বই। সে বই পড়ছে না—তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আমার জীবনে এত সুন্দর মেয়ে আর দেখিনি। মনে হল তার শরীর সাদা মোমের তৈরি। পিঠভরতি ঘন কালো চুল। যোলো-সতেরো বছর বয়স। দৈত্যের হাতে বন্দিনী রাজকন্যারাও এত সুন্দর হয় না। মেয়েটি হাত-ইশারায় ডাকল। প্রথমে ভাবলাম দৌড়ে পালিয়ে যাই। পরমুহূর্তেই সেই ভাবনা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেলাম।

    কী নাম তোমার খোকা?

    কাজল।

    কী সুন্দর নাম! কাজল। তোমাকে মাখতে হয় চোখে। তা-ই না?

    কিছু না-বুঝেই আমি মাথা নাড়লাম।

    অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি, তুমি একা একা হাঁটছ। কী ব্যাপার?

    আমি চুপ করে রইলাম।

    কীজন্যে এসেছ এ-বাড়িতে?

    বেড়াতে।

    ও আচ্ছা-বেড়াতে? তুমি তা হলে অতিথি। অতিথি নারায়ণ। তা-ই না?

    আবারও না-বুঝে আমি মাথা নাড়লাম। সে বলল, তুমি এখানে চুপচাপ দাড়াও। নড়বে না। আমি আসছি।

    মেয়েটি চলে গেল। ভেবে পেলাম না সে অনধিকার প্রবেশের জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা করতে গেল কি না। দাঁড়িয়ে থাকাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে? পালিয়ে যাওয়াই উচিত। অথচ পালাতে পারছি না।

    মেয়েটি ফিরে এসে বলল, চোখ বন্ধ করে হাত পাতো।

    আমি তা-ই করলাম। কী যেন দেয়া হল আমার হাতে। তাকিয়ে দেখি কদমফুলের মতো দেখতে একটা মিষ্টি।

    খাও, মিষ্টি খাও। মিষ্টি খেয়ে চলে যাও। আমি এখন পড়াশোনা করছি। পড়াশোনার সময় কেউ হাঁটাহাঁটি করলে বড় বিরক্তি লাগে। মন বসাতে পারি না। আমি চলে এলাম এবং দ্বিতীয় দিনে আবার উপস্থিত হলাম।

    আবার মেয়েটি মিষ্টি এনে দিল। কোনো সৌভাগ্যই একা একা ভোগ করা যায় না। আমি তৃতীয় দিনে আমার ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত। মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, এ কে?

    আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, এ আমার ছোট বোন। এ-ও মিষ্টি খুব পছন্দ করে।

    মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। সে হাসতে হাসতে বলল, খুকি, তোমার নাম কী?

    আমার বোন উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকাল। নাম বলাটা ঠিক হবে কি নাসে বুঝতে পারছে না। আমি ইশারায় তাকে অভয় দিতেই সে বলল, আমার নাম শেফু।

    শেফু? অর্থাৎ শেফালি। কী সুন্দর নাম! তোমরা দুজন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকো।

    আমরা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। একসময় চোখ মেললাম। মেয়েটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ বিষণ্ণ। সে দুঃখিত গলায় বলল, আজ ঘরে কোনো মিষ্টি নেই। তোমাদের জন্যে একটা বই নিয়ে এসেছি। খুব ভালো বই। বইটা নিয়ে যাও। দাঁড়াও, আমার নাম লিখে দিই।

    সে মুক্তার মতো হরফে লিখল, দুজন দেবশিশুকে ভালোবাসা ও আদরে শুক্লাদি।

    বই নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বইটার নাম ক্ষীরের পুতুল। লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাতায় পাতায় ছবি।

    ক্ষীরের পুতুল হচ্ছে আমার প্রথম-পড়া সাহিত্য। সাহিত্যের প্রথম পাঠ আমি আমার বাবা-মার কাছ থেকে পাইনি। বাবার বিশাল লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরির পুস্তকসংখ্যা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো। সমস্ত বই তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন। বাবার লাইব্রেরির বই আমাদের অর্থাৎ বাচ্চাদের নাগালের বাইরে ছিল। বাবা হয়তো ভেবেছিলেন, এইসব বই পড়ার সময় এখনও হয়নি।

    শুক্লাদি তা ভাবেননি। তিনি অসাধারণ একটি বই একটি বাচ্চা-ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার স্বপ্নজগতের দরজা খুলে দিলেন। স্বপ্নজগতের দরজা সবাই খুলতে পারে না। দরজা খুলতে সোনার চাবির দরকার। ঈশ্বর যার-তার হাতে সেই চাবি দেন না। সে-চাবি থাকে অল্পকিছু মানুষের কাছে। শুক্লাদি সেই অল্পকিছু মানুষদের একজন।

    শুক্লাদির সঙ্গে আমার ঐ বই পাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনা করতেন। ছুটি শেষ হবার পর কলকাতা চলে গেলেন। তার কিছুদিন পর প্রফেসর সাহেব বাড়ি বিক্রি করে ইন্ডিয়া গেলেন। যিনি বাড়ি কিনলেন তিনি প্রথমে গাছগুলি সব কাটিয়ে ফেলে, বাড়িটিকে ঘিরে যে-স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন।

    কত-না নিঝুম দুপুরে এই শ্রীহীন বাড়ির গেটের কাছে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি। গভীর দুঃখে আমার চোখ ভেঙে জল এসেছে।

    বাসায় এসেই বসেছি ক্ষীরের পুতুল নিয়ে। এই বই নিয়ে বসলেই ভেঙে-যাওয়া স্বপ্ন ফিরে আসত। মুহূর্তে চলে যেতাম অন্য কোনো পৃথিবীতে। কী অদ্ভুত পৃথিবীই-না ছিল সেটি!

    শুক্লাদির দেয়া ক্ষীরের পুতুল বইটি উনিশশো একাত্তর পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল। একাত্তরের অনেক প্রিয় জিনিসের সঙ্গে বইটিও হারিয়েছি। কিন্তু সত্যি কি হারিয়েছি? হৃদয়ের নরম ঘরে যাদের স্থান দেয়া হয় তারা কি কখনো হারায়? কখনো হারায় না। শুক্লাদির কথা যখনই মনে হয় তখনই বলতে ইচ্ছা করে, জনম জনম তব তরে কাঁদিব।

    ক্ষীরের পুতুল বইটি আমার জীবনধারা অনেকখানি পালটে দিল। এখন আর দুপুরে ঘুরতে ভালো লাগে না। শুধু গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করে। কুয়োতলার লাগোয়া একটা ঘর, দুপুরের দিকে একেবারে নিরিবিলি হয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে জানালায় হেলান দিয়ে গল্পের বই নিয়ে বসি। জানালার ওপাশে কাঁঠালগাছের গুচ্ছ। সেই কাঁঠালগাছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে কাক ডাকে। এ ছাড়া চারদিকে কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত নৈঃশব্দের জগৎ। এটা যেন চেনা-জানা পৃথিবী নয়, অন্য কোনো ভুবন।

    বই-এ পাতার পর পাতা অতি দ্রুত উলটে যাচ্ছি। এইসব বই বাবার আলমিরা থেকে চুরি করা। মা জেগে ওঠার আগে রেখে দিতে হবে। ধরা পড়লে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। একদিন ধরা পড়লাম। বাবার হাতেই ধরা পড়লাম। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বই পড়ছিস? দেখি, দেখি বইটা।

    তিনি বই হাতে নিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বইয়ের নাম-প্রেমের গল্প। তিনি থমথমে গলায় বললেন, পড়েছিস এই বই।

    আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, হুঁ।

    বুঝেছিস কিছু?

    হুঁ।

    কী বুঝেছিস?

    কী বুঝেছি ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। বাবা বই নিয়ে আলমিরায় তালাবন্ধ করে রাখলেন। আমি ভয়ে অস্থির। নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা হবে। সন্ধ্যাবেলা তিনি বললেন, কাপড় পরে আমার সঙ্গে চল।

    আমি কোনো কথা না বলে কাপড় পরলাম। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তিনি রিকশা করে আমাকে নিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বই এর এক বিশাল সংগ্রহ। যেদিকে চোখ যায় শুধু বই, বই আর বই। আমাকে লাইব্রেরির মেম্বার করে দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, এখানে অনেক ছোটদের বই আছে, আগে এইগুলি পড়ে শেষ কর। তারপর বড়দের বই পড়বি।

    প্রথমদিনের দুটি বই নিজে পছন্দ করে দিলেন। দুটি বইয়ের একটির নাম মনে আছে—টম কাকার কুটির। কী অপূর্ব বই! এই বইটি পড়বার আনন্দময় স্মৃতি এখনও চোখে ভাসে। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। সিলেটের বৃষ্টি—ঢালাও বর্ষণ। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে বই নিয়ে বসেছি। টম কাকার গল্প পড়তে পড়তে চোখে নেমেছে অশ্রুর বন্যা। সমস্ত হৃদয় জুড়ে একধরনের শূন্যতা অনুভব করছি। হঠাৎ করে মহৎ সাহিত্যকর্মের মুখোমুখি হলে যা হয়, তা-ই হচ্ছে-প্রবল আবেগে চেতনা আলোড়িত হচ্ছে।

    আমার বই পড়ার অভ্যাস মা খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। প্রায়ই বিরক্ত হয়ে বলেন, এই ছেলে দিনরাত আউট বই পড়ে। যখন সবাই খেলাধুলা করছে সে অন্ধকারে বই নিয়ে বসেছে। চোখ নষ্ট হবে তো!

    চোখ আমার সত্যি সত্যি খারাপ হল। যদিও তা বুঝতে পারলাম না। বাইরের পৃথিবী আবছা দেখি। আমার ধারণা, অন্য সবাইও তা-ই দেখে। ক্লাস ফাইভে উঠে প্রথম চশমা নিই। চোখের ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, এই ছেলে তো অন্ধের কাছাকাছি! এতদিন সে চালিয়েছে কীভাবে? প্রথম চশমা পরে আমিও হতভম্ব হয়ে ভাবি-চারদিকের জগৎ এত স্পষ্ট! কী আশ্চর্য! দূরের জিনিসও তা হলে দেখা যায়!

    আগের কথায় ফিরে আসি।

    কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সদস্য হওয়ায় সবচে কষ্টে পড়ল আমার ছোট দুই ভাইবোন-শেফু এবং ইকবাল। মীরাবাজার থেকে একা এতদূরে হেঁটে যেতে ভালো লাগে না। আমি এদের সঙ্গে নিয়ে যাই। পথ আর ফুরাতে চায় না। পথে দুতিন জায়গায় ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করতে বসি। আমার সব ক্লান্তি সব কষ্ট দূর হয়ে যায় যখন দুটি বই হাতে পাই। আনন্দে ঝলমল করতে থাকি। শেফু এবং ইকবাল আমার এই আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে না। শুধুমাত্র আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে তাদের দিনের পর দিন কষ্ট করতে হয়।

    আমাকে রোজ দুটি করে বই দিতে গিয়ে একদিন লাইব্রেরিয়ানেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এখন থেকে একটি করে বই নেবে, দুটো না। আর এইসব আজেবাজে গল্পের বই পড়ে কোনো লাভ নেই। এখন থেকে পড়বে জ্ঞানের কথা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল এইসব শিখতে হবে। নাও, আজকে এই বইটা নিয়ে যাও।

    আমি খুব মন খারাপ করে বইটা হাতে নিলাম। বইয়ের নাম জানবার কথা। বাসায় এনে দুতিন পাতা পড়লাম। এতটুকুও আকর্ষণ করল না। পরদিন ফেরত দিতে গেছি। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক বললেন, পড়েছ?

    আমি বললাম, হুঁ।

    তিনি হাত থেকে বই নিয়ে কয়েকটা পাতা উলটে বললেন, আচ্ছা বলো, গ্লেসিয়ার কী?

    আমি বলতে পারলাম না। তিনি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, বদর ছেলে-যাও, এই বই ভালোমতো পড়ে তারপর আসো।

    কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আমি আর কখনো যাইনি। জানবার কথা বইটিও ফেরত দেয়া হয়নি। বাসায় ফিরে জানবার কথা কুটিকুটি করলাম, কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আমি প্রচণ্ড অভিমানী হয়ে জন্মেছি। অভিমান নামক ব্যাপারটি কম নিয়ে জন্মানো ভালো। এই জিনিসটি আমাদের বড়ই কষ্ট দেয়।

    বই পড়ার আগ্রহে সাময়িক ভাটা দেখা দিল। আগের জগতে ফিরে গেলাম-ঘুরে বেড়ানো। ইতিমধ্যে চুরিবিদ্যা খানিকটা রপ্ত হয়েছে। লক্ষ্য করেছি, মা ভাংতি পয়সা রাখেন তোশকের নিচে। সিকি, আধুলি, আনি দুআনি-ঠিক কত আছে, সেই হিসেব তার নেই। ভাংতি পয়সার মধ্যে সবচে ছোট হচ্ছে-সিকি। একবার একটা সিকি সরিয়ে সমস্ত দিন আতঙ্কে নীল হয়ে রইলাম। সারাক্ষণ মনে হল, এই বোধহয় মা বলবেন, সিকি কে নিয়েছে? মা তেমন কিছু করলেন না। পরদিন সেই সিকি নিয়ে এবং সঙ্গে ছোট বোনকে নিয়ে চায়ের স্টলে চা খেতে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বড়রা যেমন দোকানে চা খায়, আমরাও তেমনি খাব। দোকানদার নিশ্চয়ই দুই ক্ষুদে কাস্টমার পেয়ে বিস্মিত হয়েছিল। সে যত্ন করে আমাদের দুজনকে গ্লাসে করে দুকাপ চা দিল। একটা পরোটা ছিড়ে দুভাগ করে দুজনের হাতে দিল এবং কোনো পয়সা রাখল না। হাতের সিকি হাতেই রয়ে গেল। অতঃপর দুজনে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। কোনো গন্তব্য নেই-যতদূর রিকশা যায়। তখন রিকশাভাড়া ছিল বাধা। শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা যাওয়া যেত এক সিকিতে। রিকশাওয়ালা আমাদের জল্লারপাড়ের কাছে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে মহানন্দে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। মনে হল, চুরিবিদ্যা খুব খারাপ কিছু নয়।

    মার তোশকের নিচ থেকে প্রায়ই পয়সা উধাও হতে লাগল। একদিন কাজের ছেলে রফিক চুরির জন্যে প্রচণ্ড বকা খেল। তোশকের নিচে পয়সা রাখাও বন্ধ হয়ে গেল। বড় কষ্টে পড়লাম। এখন একমাত্র ভরসা দেশের বাড়ি থেকে বেড়াতে-আসা মেহমানরা।

    আমাদের বাসায় মেহমান লেগেই থাকত। দাদার বাড়ির দিকের মেহমান, মার বাড়ির দিকের মেহমান। কেউ আসত শহর দেখতে, কেউ শাহজালাল সাহেবের মাজার দেখতে, কেউবা চিকিৎসা করাতে। মেহমানরা দয়াপরবশ হয়ে এক আনা বা দুপয়সা বাড়িয়ে দিতেন—পৃথিবীটাকে বড়ই সুন্দর মনে হত। ছুটে যেতাম দোকানে। কত অপূর্ব সব খাবার-হজমি! দুপয়সায় অনেকখানি পাওয়া যেত, টক টক ঝাঁঝালো স্বাদ। খানিকটা মুখে দিলেই জিভ কালো কুচকুচে হয়ে যেত। এক আনায় পাওয়া যেত দুগোল্লা সরষে তেল মাখানো বিচি-ছাড়ানো তেঁতুল। বাদামভাজা আছে, বুটভাজা আছে। যদুমিয়ার দোকানে পাওয়া যেত দুধ-চকলেট। এক আনায় চারটা, তবে আমার জন্যে একটা ফাউ। পাঁচটা।

    মিষ্টি পানের একটা দোকান ছিল, তার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই দোকানি ছোট একটা পান বানিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলত, ভাগ। কী সুস্বাদু ছিল সেই মিষ্টি পান!

    গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম দেশের বাড়ির মেহমানদের জন্যে। মেহমান আসা মানেই আনন্দ। শহর দেখানোর জন্যে আমি চমৎকার গাইড। একদিন-না-একদিন তারা রঙমহল সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবেন। আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে। আমাকে নেয়ার ব্যাপারে তারা তেমন আপত্তিও করবেন না। কারণ আমার জন্যে আলাদা করে টিকিট করতে হবে না। আমি ছবি দেখব কোলে বসে, কিংবা পঁড়িয়ে। বাড়িতে মেহমান থাকার আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে সেই সময় মার শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যেত। বড় ধরনের অপরাধেও মা কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার শাস্তি ছাড়া অন্য শাস্তি দিতেন না।

    মেহমানদের মধ্যে একজনের কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি মায়ের দিকের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। ভাটিঅঞ্চলের মানুষ। খুনের দায়ে হাজতে আছেন। জামিনে ছাড়া পেয়ে কয়েকদিন থাকতে এলেন আমাদের এখানে। অসম্ভব রকমের রুগ্‌ণ একজন মানুষ। যক্ষ্মা নামের কালরাত, সারাক্ষণ কাশছেন। কাশির সঙ্গে টাটকা রক্ত পড়ছে।

    তিনি বাসায় এসেই মাকে ডেকে বললেন, রাজরোগে ধরেছে গো মা। এই ব্যাধি ছোঁয়াচে। তোমার ছেলেপুলের সংসার। ভেবেচিন্তে বলো আমাকে রাখবে? তিন-চার দিন থাকতে হবে। হোটেলে থাকতে পারি, কিন্ত হোটে থাকতে ইচ্ছা করছে না। তুমি ভেবেচিন্তে বলো।

    মা বললেন, আপনি অবশ্যই আমার এখানে থাকবেন।

    খুব ভালো কথা। তা-ই থাকব। বেশিদিন বাঁচব না। যে-কয়টা দিন আছি পরিচিত মানুষদের মধ্যে থাকতে চাই। তবে মা আমি যে থাকব, আমার কিছু শর্ত আছে।

    কী শর্ত?

    নিজের মতো বাজার-সদাই করব। এর জন্যে মনে কষ্ট নিও না। আমার অনেক জিনিসের অভাব আছে, টাকাপয়সার অভাব নাই। কী মা, রাজি?

    মাকে রাজি হতে হল। আমরা পরম বিস্ময়ে দেখলাম—মাত্র চারদিন যে লোকটি থাকবে তার জন্যে বস্তাভরতি পোলায়ের চা আসছে, টিনভরতি ঘি, চিনি। দুপুরে প্রকাণ্ড একটা চিতলমাছ চলে এল, আঁকাভরতি মুরগি।

    তিনি নিজে এতসব খাবারদাবারের কিছুই খেলেন না। মাকে বললেন, আমাকে তিন চামুচ আলোচালের ভাত আর এক চামুচ ঘি দিও। এর বেশি আমি কিছু খেতে পারি না। আল্লাহ আমার রিজিক তুলে নিয়েছেন।

    শৈশবে যে অল্পকিছু মানুষ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল উনি ছিলেন তাদের একজন। ভাটিঅঞ্চলের জমিদারবংশের মানুষ। এঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় মানুষ একযোগে এঁদের বসতবাড়ি আক্রমণ করে। এঁরা তখন আত্মরক্ষার জন্যে কিংবা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে বন্দুক নিয়ে দোতলা থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। পঞ্চাশের মতো মানুষ আহত হয়, মারা যায় ছজন। জমিদারবাড়ির সকল পুরুষের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ আসামি হিসেবে সবাইকেই বেঁধে নিয়ে আসে। যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত যে-মানুষটির কথা বলছি তিনিও আসামিদেরই একজন। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন-বাড়ি যখন আক্রান্ত হয় তখন আমিই বন্দুক নিয়ে বের হই। আমি একাই গুলি করি-হত্যাকাণ্ডের সমস্ত দায়দায়িত্ব আমার। শাস্তি হলে আমার শাস্তি হবে। অন্য কারও নয়।

    মজার ব্যাপার হল, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনোই যোগ ছিল না। এই ধরনের স্বীকারোক্তি তিনি করেছেন অন্যদের বাঁচাবার জন্যে। তাঁর যুক্তি হল—আমার যক্ষ্মা হয়েছে, আমি তো দুদিন পর এম্নিতেই মারা যাচ্ছি। ফাঁসিতেই নাহয় মরলাম। অন্যরা রক্ষা পাক। তা ছাড়া বাকি সবারই বৌ-ছেলেমেয়ে আছে। আমি চিরকুমার মানুষ, আমি বেঁচে থাকলেই কী, মরলেই কী?

    যক্ষ্ম রুগির চোখ এম্নিতে উজ্জ্বল হয়। ওঁর চোখ আমার কাছে মনে হল ঝিকমিক করে জ্বলে। সারাক্ষণ ধবধবে সাদা বিছানায়, সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে মর্তির মতো বসে থাকেন। আমি বড়ই বিস্ময় অনুভব করি। একদিন হাত-ইশারা করে আমাকে ডাকলেন, আমি এগিয়ে যেতেই তীব্র গলায় বললেন, তুই সবসময় আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করিস কেন? খবরদার, আর আসবি না। ছোট পুলাপান আমি পছন্দ করি না।

    আহত ও অপমানিত হয়ে তার ঘর থেকে আমি বের হয়ে আসি, কিন্তু তাঁর প্রতি যে-গভীর ভালোবাসা লালন করি তার হেরফের হয়নি। মামলা চলাকালে জেল-হাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। আমার মনে আছে, তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি বালিশে মুখ গুঁজে দীর্ঘ সময় কাঁদি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএলেবেলে – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article সূর্যের দিন – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }