Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প156 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. আমাদের স্কুলে যেতে হয় না

    অনেকদিন থেকেই আমাদের স্কুলে যেতে হয় না। আমার ধারণা ছিল স্কুলে না। যাওয়ার থেকে আনন্দের বুঝি আর কিছু নেই। কিন্তু কয়দিন থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা সেরকম না।

    স্কুলে যে জন্যে যেতে হচ্ছে না। সে জন্যে অন্য কিছুই করা যাচ্ছে না। আমাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ। খেলাধুলা বন্ধ। মাঝখানে স্কুলের ম্যাপটা নিয়ে কাজ করেছিলাম, সেটাও শেষ হয়েছে। রাশেদ এখন তার মাঝে অন্যান্য জিনিসগুলি লিখছে। দিলীপের সাথে আমি অনেক খেলতাম, সে এখন কোথায় আছে জানি না। আশরাফ আর ফজলুর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। কিন্তু দুজনেই বেশ মনমরা। রাশেদ শুধু মাত্র মুখ শক্ত করে ঘুরে বেড়ায়। তার ধারণা, মুক্তিবাহিনী এল বলে, তারপর মিলিটারী, রাজাকার আর দালালদের অবস্থা একেবারে কেরোসিন হয়ে যাবে।

    আমার বাসার বাইরে বেশিদূর যাওয়া নিষেধ। তবু আমি মাঝে মাঝে একটু ঘুরে আসি। আমার বয়সী বাচ্চাদের বেশি ভয় নেই। রাস্তাঘাটে বেশ কয়েকবার মিলিটারীদের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে। আমার বুক ধুকধুক করেছিল। কিন্তু তারা কিছু করেনি। আস্তে আস্তে আমারও সাহস বেড়েছে, মিলিটারী দেখলে মাঝে মাঝে তাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াই। সব সময় তারা এক সাথে গুলি অনেক থাকে। দোকানপাটে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে দাম না দিয়ে বের হয়ে আসে। একদিন একজন দাম চাইতেই রাইফেলের বট দিয়ে পেটে গদাম করে মেরে বসল। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল লোকটার।

    বাসায় এসে অবিশ্যি আমি সেগুলি বলি না। বললে আর বাসা থেকে বের হতে দেবে না। আব্বার মুখে শুধু একটাই কথা, ঘরে বসে ইংরেজি ট্রনিক্লেশান করতে পারিস না?

    একদিন সকালে রাশেদ এসে বলল, তোর কাছে দশ পয়সা হবে?

    কেন?

    সে গলা নামিয়ে বলল, একটা খাম| কিনতে হবে। দশ পয়সা কম পড়েছে।

    কাকে চিঠি লিখবি?

    রাশেদ আরো গলা নামিয়ে বলল, আজরফ আলীকে।

    কি লিখবি?

    লিখে ফেলেছি। এই দ্যাখ। সে সাবধানে পকেট থেকে রুলটোনা একটা কাগজ বের করল। উপরে এক পাশে লেখা ‘জয় বাংলা’, অন্যপাশে লেখা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, তার নিচে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখাঃ

    শালা আজরফ আলী,
    তুই পাকিস্তানের দালাল মীরজাফর। বিশ্বাসঘাতক। তুই শুধু যে বিশ্বাসঘাতক তাই না, তুই মুখে ইসলামের কথা বলিস। কিন্তু তুই ইসলামের কোন কাজ করিস না। আল্লাহ তোকে সেইজন্যে হাশরের ময়দানে কখনো ক্ষমা করবে না। এই পৃথিবীতে আমরাও তোকে ক্ষমা করব না। তোর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তুই ভাল-মন্দ খেতে চাস তো তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, কারণ আর কয়েকদিনের মাঝেই তোর জায়গা হবে। জাহান্নামে। সেখানে তুই খাবি দোজখের আগুন। হা হা হা হা হা।

    ইতি — আজরাইল

    আমি অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকলাম। রাশেদ মুচকি হেসে বলল, শালার ব্যাটাকে একটু ভয় দেখিয়ে দেই।

    কিন্তু দেখে তো বোঝা যাচ্ছে এটা তোর হাতের লেখা- একটা ছোট ছেলের হাতের লেখা।

    রাশেদ মাথা চুলকে নিচে আরো একটা লাইন লিখে দিল, হাতের লেখা দেখে যেন চিনতে না পারিস সে জন্যে বাম হাতে লিখলাম।

    আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, এবারে ঠিক হয়েছে, মনে করবে। বাম হাতে লিখেছে বলে হাতের লেখা এরকম ক্যাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং।

    রাশেদ মেঘস্বরে বলল, আমার হাতের লেখা কখনোই ক্যাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং না। বেশি কথা না বলে দশ পয়সা থাকলে দে।

    আমি আর তর্ক করলাম না, দশ পয়সা বের করে দিলাম। তারপর দুজনে মিলে পোস্ট অফিসে হেঁটে গিয়ে একটা খাম কিনে উপরে আজরফ আলীর ঠিকানা লিখে, ভিতরে চিঠিটা দিয়ে একটা চিঠির বাক্সে ফেলে দিলাম।

    দুদিন পরে রাশেদ এসে বলল, চিঠিতে কাজ হয়েছে মনে হয়।

    কেন?

    আজরফ আলীর অবস্থা কোরোসিন! আর ঘর থেকে বের হয় না। রাশেদ খুব খুশি হয়ে খিকখিক করে হাসতে থাকে।

    আমি আর রাশেদ মিলে আজরফ আলীর বাসার কাছে দিয়ে হেঁটে এলাম। দেখলাম, দুইজন রাজমিস্ত্রী বাসার সামনের দেওয়ালের উপর ইট গেঁথে সেটাকে আরো উছু করছে। সামনে একজন রাজাকার রাইফেল হাতে পাহারা।

    এর দুইদিন পর রাশেদ এমন একটা কাজ করল যে বলার নয়। আমি সেদিন রাশেদের সাথে বাজারের কােছ দিয়ে আসছি, শাস্তি কমিটির অফিসের সামনে একটু দাঁড়ালাম। আওয়ামী লীগের অফিসটা পুড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাপের অফিসটা পোড়ায়নি, শুধু ভাঙচুর করেছে, সেটাই এখন ঠিকঠাক করে শান্তি কমিটির অফিস। শান্তি কমিটির কাজকর্ম খুবই সহজ, রাজাকার বাহিনী নিয়ে মানুষজনের ঘরবাড়ি লুটপাট করে আনা। যাদের সাথে শত্ৰুতা আছে মিলিটারী নিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে গুলী করে মারা। কেউ মুক্তিবাহিনীতে গেছে। খবর পেলে তাদের ঘরবাড়ি জ্বলিয়ে দেওয়া। মাঝে মাঝে মিলিটারীরা যখন কাউকে ধরে আনে। তখন তাদের আত্মীয়স্বজনরা এসে শান্তি কমিটির লোকজনের পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করে। কেউ তখন খালি হাতে আসে না, টাকা পয়সা নিয়ে আসতে হয়।

    আমরা উঁকি মেরে দেখলাম, অফিসের ভিতর আজরফ আলী একটা চেয়ারে খুব রাগ-রাগ চেহারা করে বসে আছে। তার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে একজন বুড়ো মানুষ হাউমাউ করে কাঁদছে। আহা বেচারা! নিশ্চয়ই তার ছেলেপিলে কাউকে মিলিটারী ধরে নিয়ে এসেছে।

    খানিকক্ষণ সেটা দেখে আমরা রাজাকার বাহিনীর অফিসে গেলাম। আগে সেটা নগেন ডাক্তারের চেম্বার ছিল। নগের ডাক্তার পুরানো আমলের এল. এম. এফ. ডাক্তার, খুব ভাল ডাক্তার। দুই-তিনটা এম. বি. বি. এস. ডাক্তার নাকি পকেটে রেখে দিতে পারেন। নাড়ি ধরে নাকি বলে দিতে পারতেন রোগী দুদিন আগে কি খেয়েছে। নগেন ডাক্তারকে সবাই ইণ্ডিয়া চলে যেতে বলেছিল, কিন্তু তিনি কিছুতেই যেতে রাজি হননি। সারা জীবন এখানে কাটিয়েছেন, এটা তার মাটি, এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। মিলিটারী আসার এক সপ্তাহ পরে রাজাকার বাহিনী তৈরি হল, তারা এসে নগেন ডাক্তারকে গুলী করে মেরে তার চেস্বরটা দখল করে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর অফিস তৈরি করেছে। আমরা সময় পেলে রাজাকার বাহিনীর অফিসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি। কি করে না করে সেটা দেখি। আজকেও দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন দেখি চুয়ু মিয়া দুইজন রাজাকার নিয়ে বের হল। চুন্ন মিয়ার হাতে কিছু নেই। কিন্তু অন্য দুইজন রাজাকারের হাতে একটা করে রাইফেল। চুমু মিয়া আগে ঠ্যালাগাড়ি ঠেলত, মিলিটারী আসার পর এক লাফে রাজাকার কমান্ডার হয়ে গেছে।

    রাজাকার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভাল দেখায় না, আমরা তাই হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম তখন শুনলাম চুম্বু মিয়া বলল, আজরফ আলী চেয়ারম্যানকে চিনিস তো?

    জে।

    এক্ষুনি গিয়ে খবরটা দিবি। দেরি যেন না হয় শুওরের বাচ্চারা।

    জে, দেরি হবে না।

    যা হারামজাদারা, যা।

    আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে রওনা দিলাম, চুন্ন মিয়ার এবং রাজাকার বাহিনীর লোকজনের কথাবার্তা খুব খারাপ, গলাগলি না দিয়ে কথা বলতে পারে না। আমরা হেঁটে যেতে যেতে দেখি, রাজাকার দুইজন পিছনে পিছনে আসছে। তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে কিন্তু দুইজনের কোন তাড়া নেই, একটা পান দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে দুইজন।

    শান্তি কমিটির অফিসের কাছাকাছি আসতেই দেখি আজরফ আলী আসছে। সাথে কেউ নেই, একা। রাশেদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বলল, তুই চলে যা, আমি একটা মজা করি।

    কি মজা?

    দেখবি এক্ষুনি, তুই চলে যা। তোকে যেন না দেখে।

    আমি তাড়াতাড়ি একটা গলিতে ঢুকে গেলাম।

    রাশেদ শার্টের একটা বোতাম খুলে মাথার উপরে তুলে মুখটা ঢেকে ফেলল যেন তার চেহারা চেনা না যায়। তারপর আজরফ আলীর কাছে ছুটে গিয়ে বলল, পাকিস্তানী দালাল দুইজন মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ মিনিটের মাঝে তোকে গুলী করে মারবে।

    কি বললি? কি বললি? কি? কি?

    রাশেদ ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে। আজরফ আলীকে কেমন জানি একটু ভীত দেখাল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রাশেদ যেদিক দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে আবার হেঁটে যেতে থাকে। মনে হয় পুরো ব্যাপারটা সে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে থমকে দাড়ায়, রাস্তার অন্য পাশে রাইফেল হাতে দুজন রাজাকারকে দেখতে পেয়েছে। তারাও আজরফ আলীকে দেখে ছুটে আসছে আজরফ আলীর দিকে।

    আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম রাশেদ কি করেছে। রাজাকার দুজনকে দেখে আজরফ আলী মনে করেছে তারা মুক্তিবাহিনী, তাকে মারতে আসছে। ভয়ে, আতংকে তার চোয়াল ঝুলে পড়ল। চিৎকার করে ঘুরে গেল, তারপর প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। আমার সামনে দিয়ে প্রথমে ছুটে গেল আজরফ আলী, তার পিছনে পিছনে দুজন রাজাকার। আমি গলি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম, বিশাল থলথলে দেহ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে আজরফ আলী। হেঁচট্ট খেয়ে পড়ল একবার, কোনমতে উঠে দাঁড়াল, তারপর আবার চিৎকার করে ছুটতে থাকে। আবার আছড়ে খেয়ে পড়ল, কোন মতে উঠে দাঁড়াল, তারপর সাথে সাথেই পা বেধে আবার হোচট খেয়ে পড়ল। এবারে আর উঠতে পারল না, কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করল, উঠতে না পেরে হামাগুড়ি দিয়েই যেতে থাকে। আর প্রাণপণে চিৎকার করতে থাকে। মােটা, বয়স্ক মানুষ, দৌড়ে অভ্যাস নেই, বেকায়দা পড়ে হাত-পা কিছু ভেঙে গেছে কি না কে জানে।

    রাজাকার দুজন এতক্ষণে দৌড়ে তার কাছে এসে গেছে। আজরফ আলী হঠাৎ দুই হাত জোড় করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি এর আগে কোন মানুষকে এত ভয় পেতে দেখি নাই, এবারে দেখলাম। এটাকে নিশ্চয়ই মৃত্যুভয় বলে। কি ভয়ংকর আতংক তার চোখে-মুখে, মরার আগে মানুষ মনে হয় এভাবে তাকায়।

    হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আজরফ আলী দুই হাত জোড় করে রাজাকার দুইজনের সামনে মাথা নিচু করে বলতে থাকে, বাবারা, আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও। আল্লাহর কসম লাগে বাবার। আমি ইচ্ছা করে করি নাই, জান বাঁচানোর জন্যে করেছি। আমি জয় বাংলার পক্ষে, আমি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। আমি মাপ চাই, মাপ চাই—

    দেখতে দেখতে ভিড় জমে যায় তাকে ঘিরে। রাজাকার দুইজন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু এগিয়ে আসতেই আজরফ আলী একেবারে তাদের পা জড়িয়ে ধরে। একজনের পায়ে মুখ ঘষতে থাকে, তার দাড়িতে জুতার ময়লা লেগে নোংরা হয়ে যায়। তার টুপি খুলে পড়ে টাকমাথা বেরিয়ে যায়। চোখের পানিতে নাকের পানিতে কুৎসিত দেখাতে থাকে তাকে।

    আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি এই মানুষটার দিকে। আবার কেমন জানি গা শির শির করতে থাকে, ঠিক বুঝতে পারি না কেন— কিন্তু আমার কেমন জানি এক ধরণের লজ্জা করতে থাকে। মানুষকে এত ছোট হতে দেখলে নিশ্চয়ই লজ্জা লাগে সবার। কিন্তু আমি চলেও যেতে পারছিলাম না। নিষিদ্ধ জিনিস দেখার একরকম আকর্ষণ থাকে, আমি সেই আকর্ষণের মাঝে আটকা পড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    রাজাকার দুজনের একজন তখন আজরফ আলীকে টেনে তুলে বলল, হুজুর, আমরা মুক্তিবাহিনী না, আমরা রাজাকার বাহিনী।

    হঠাৎ করে আজরফ আলী মনে হল নিজের ভুল বুঝতে পারল। বোকার মত রাজাকার দুইজনের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে অন্য সব মানুষজনের দিকে তাকাল। আমি দেখতে পেলাম প্রচণ্ড রাগে তার মুখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠেছে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। তাকে ঘিরে অনেক বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে, সে তাদের মাঝে রাশেদকে খুঁজছে। হঠাৎ আমি আতংকে একেবারে সিটিয়ে গেলাম— একেবারে আজরফ আলীর ন্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ! যদি চিনে ফেলে? কিন্তু চিনতে পারল না, বৃথাই রাশেদকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে করতে হিংস্র স্বরে বলল, কোথায় সেই শুওরের বাচ্চা? কোথায়?

    একজন জিজ্ঞেস করল, কে?

    শুওরের বাচ্চ বদমাইশ ছোড়া –

    কে? কি করেছে?

    আমি যদি তার চৌদ্দ গুণ্ঠিকে শিক্ষা না দেই! বাপ চাচা সবাইকে যদি এক কবরে মাটি না দেই! ভিটা মাটিতে যদি শকুন না চড়াই তাহলে আমার নাম আজরফ আলী না।

    একজন রাজাকার জিজ্ঞেস করে, কার কথা বলছেন হুজুরী? কার কথা?

    এইটুকু ছেলে, আমাকে এসে বলে –

    কি বলে?

    বলে, বলে— আজরফ আলী কথা বন্ধ করে হিংস্ৰ চোখে এদিকে সেদিকে তাকাতে থাকে।

    আমি রাশেদের সাহস দেখে বোকা বনে যাই। একেবারে আজরফ আলীর নাকের সামনে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, তার আশে পাশে আরো নানা বয়সী ছেলে। এত জনের মাঝে আজরফ আলী কেমন করে রাশেদকে খুঁজে বের করবে? তা ছাড়া শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল, চেহারাও তো দেখেনি আজরফ আলী।

    একজন রাজাকার এবারে হুংকার দিয়ে বলল, সবাই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন নাকি? যান যান, সরেন।

    লোকজন সরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখালো না। মজার গন্ধ পেয়ে বরং আরো বেশি লোক জমে যেতে শুরু করল। আজরফ আলী বেকায়দায় পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই খুব ব্যথা পেয়েছে, দরদরি করে ঘামিছে। দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, এখনো মাছের মত খাবি খাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, আবার ধাপ করে বসে পড়ে কোঁকাতে লাগল।

    রাজাকার দুইজন আবার লোকজনকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোন লাভ হল না। ভিড় বরং আরো বেড়ে যেতে থাকে। শেষে কোন উপায় না দেখে একটা রিকশা থামিয়ে সেখানে আজরফ আলীকে তুলে সরিয়ে নেয়। সে তখনো যন্ত্রণায় কেঁ কেঁ। করে দরদরি করে ঘামিছে।

    লোকজন সরে গেলে আমি রাশেদকে ফিসফিস করে বললাম, তুই তো সাংঘাতিক মানুষ! ডেঞ্জারাস!

    রাশেদ দাঁত বের করে হেসে বলল, এইটা তো খালি মজা করলাম। যখন সত্যিকার টাইট হবে সেদিন বুঝবে মজা।

     

    রাত্রে শুনলাম আব্বা আম্মাকে বলছেন, শুনেছি আজরফ আলীর কি হয়েছে আজ?

    কি হয়েছে তার?

    একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে ধরেছিল রাস্তায়। বলেছে তোমার দিন শেষ। কলমা পড়–

    তাই বলেছে? মুক্তিযোদ্ধা?

    হ্যাঁ। মুক্তিযোদ্ধার কাছে স্টেনগান ছিল, স্টেনগানটা যেই বের করবে। তখন দুইজন রাজাকার এসে হাজির।

    সৰ্ব্বনাশ! তারপর?

    কেউ কেউ বলছে তখন একটা যুদ্ধ হয়েছে, কেউ কেউ বলছে। যুদ্ধ হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাটি বাতাসের মত উবে গিয়েছে।

    সত্যি?

    হ্যাঁ, আব্বা হাসতে হাসতে বললেন, আর আজরফ আলী মনে করেছে রাজাকার দুজন মুক্তিযোদ্ধা। তখন নাকি তাদের পা ধরে ভেউভেউ করে কান্না!

    সত্যি? মুক্তিবাহিনী তাহলে শহরে নামতে শুরু করেছে?

    তাই তো মনে হয়।

    আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না।

     

    পরদিন আমি আর রাশেদ মিলে আজরফ আলীর কাছে দুই নম্বর চিঠিটা পাঠালাম। সেটা শুরু হল। এইভাবে :

    এই বার তুই রাজাকারের পায়ে মুখ ঘষেছিস, মাপ চেয়েছিস— তারা তোকে মাপ করে দিয়েছে। আর কয়েকদিনের মাঝে আমি যখন তোর সামনে দাড়াব আমার পায়ে মুখ ঘষে তোর কোন লাভ হবে না! আমি তোকে মাপ করব না। …

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }