Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

    লেখক এক পাতা গল্প183 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    নানা পথের হাতছানি

    ১

    ১৯৪৭ সালে আব্বা পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে যান। ফলে জামালপুরের গাছপালা প্রকৃতি-ঘেরা মাঠে পথে আমার যে-স্বপ্নগুলো পাতা মেলতে শুরু করেছিল সেগুলোকে অসমাপ্ত রেখেই আমাকে সেখান থেকে বিদায় নিতে হয়।

    পাবনা যাওয়ার পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে আমি এমন এক অঘটন ঘটিয়ে বসি যা কয়েক ঘণ্টার জন্যে বাসার সবার সুখশান্তিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। জামালপুর থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে আমরা ঈশ্বরদী স্টেশনে এসে পৌঁছোই রাত দুটোর দিকে। আমি চিরদিনই বেঘোরে ঘুমাই, সে-রাতে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমটা হয়ত আরও একটু জেঁকে বসেছিল। ঈশ্বরদী স্টেশনে আসতেই টের পেলাম কে একজন যেন আমাকে সেই ঘুম থেকে জোর করে তুলে কিছুটা হাঁটিয়ে ট্রেনের দরোজা পার করে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিল। আমার দুচোখে তখনও ভারী গাঢ় ঘুম চেপে বসে আছে। কী করে আমি বুঝব এতটুকু ঘুমের মধ্যে আমরা জামালপুর থেকে অনেক দূরে সম্পূর্ণ অজানা একটা দেশে চলে এসেছি; যেখানে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা জামালপুরের কোনো চেনা জায়গা নয়, সুদূর ঈশ্বরদী স্টেশনের সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা প্ল্যাটফর্ম। ঘুমের ভেতর শুধু টের পেলাম কারো হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি ট্রেনের দরোজা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে নামলাম। জায়গাটা কোথায়, আমাকে কী করতে হবে, কিছুই বুঝলাম না। ঘুমের ভেতর যেমন হাঁটছিলাম, তেমনি হাঁটতে লাগলাম।

    হাঁটতে হাঁটতে একসময় টের পেলাম, প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে আমি একটা ট্রেন- লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছি। আগেই বলেছি মনে মনে আমি কিন্তু তখনও জামালপুরে। ঘুমের ঘোরের মধ্যে সেই রেললাইনটাকে আমার কাছে জামালপুরের সেই পরিচিত রেললাইনের মতো মনে হল। সেই লাইনের ওপর দিয়ে যেভাবে নেশার ঘোরে হেঁটে হেঁটে অনেক দূরের ঝাপসা সুদূর গ্রামগুলোকেও ছাড়িয়ে চলে যেতাম, সেভাবেই একা একা হেঁটে চললাম।

    অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল আমার পাশ দিয়ে কে যেন হেঁটে চলেছে। ঘুমজড়ানো গলায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘আর কতদূরে?’ ভেবেছিলাম আমি হয়ত আমাদের লোকদের সঙ্গেই হেঁটে চলেছি এবং তিনি হয়ত আমাদেরই কেউ হবেন। স্টেশন থেকে এতদূরে আচ্ছন্নের মতো আমাকে হাঁটতে দেখে তাঁরও ইতিমধ্যেই কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘এ লাড়কা, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ তাঁর কথায় আমার ঘুমের জড়তা কিছুটা হোঁচট খেল। চোখ মুছে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। লোকটার পোশাক- পরিচ্ছদ দেখে আমার ধারণা হল তিনি রেলের কর্মচারী—গার্ড, চেকার বা এ- ধরনের কেউ। আমি-যে কোন্ স্টেশনে আছি তা-ও তো আমার জানা নেই। তাই তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম না। বললাম : ‘ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। সবাই বোধহয় ওখানেই আছে।’

    হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। মনের ওপর একটা ভয় চেপে বসল। ভাবলাম প্ল্যাটফর্মে ফিরে যাই। কিন্তু কোথায় প্ল্যাটফর্ম? পেছনে তাকিয়ে দেখি অ-নে-ক দূরে প্ল্যাটফর্মের আলোগুলো মিটমিট করছে। কখন-যে আমি প্রায় আধামাইলের বেশি পথ চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। তবু ফিরে যাবার জন্যে মন আকুলিবিকুলি করতে লাগল। কিন্তু যে-রাস্তাটার ওপর দিয়ে এতক্ষণ হেঁটে এসেছি সে-রাস্তাটাকে যেন বেশিরকম অন্ধকার মনে হতে লাগল। ফিরে যেতে আমার ভয় করতে লাগল।

    ভদ্রলোক নানা প্রশ্ন করে আব্বার পরিচয় জেনে নিলেন। বললেন : ‘রাতটা আমার বাসাতেই থাক, সকালে তোমাকে দিয়ে আসব।’ হয়ত লম্বা সময় ট্রেনে ডিউটি করে তিনি তখন ক্লান্ত ছিলেন, তাই কষ্ট করে তখনি আবার ফিরে যেতে চাইলেন না।

    সেকালে ঈশ্বরদী স্টেশনের খুব আভিজাত্য ছিল। কলকাতা আর খুলনা থেকে উত্তরবঙ্গ আর পূর্ববঙ্গে যাবার জংশন ছিল এটি। নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে ছেড়ে চারঘণ্টায় সোজা চলে আসত ঈশ্বরদীতে, তারপর একধাক্কায় সান্তাহার। ট্রেনে, যাত্রীতে, ব্যস্ততায়, বৈভবে, বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা কর্মচারীদের কোয়ার্টারে, ওভারব্রিজে ঈশ্বরদী ছিল রমরমা।

    ভদ্রলোক আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসাটা রেলওয়ে কোয়ার্টারের ভেতর। তাঁর পরিবারটি উর্দুভাষী। সন্তান দুজন—এক ছেলে, এক মেয়ে। দুজনেই আমার বয়সী। ভদ্রলোকের স্ত্রী হাসিখুশি মহিলা, সেদিন শখ করে ফিরনি রান্না করেছিলেন, আমাকে দিতে দিতে বললেন : ‘লাড়কাকো নসিব বহৎ আচ্ছা হ্যায়। লো, খা লো। ভদ্রলোকের স্ত্রীর মতো ছেলেমেয়ে দুটিও দুপুর-রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। জানি না বাবার প্রতীক্ষায় মার সঙ্গে তারা প্রায়ই এমনি রাত জাগত কী-না। তাদেরই বয়সের একজন হারিয়ে-যাওয়া অচেনা ছেলেকে পেয়ে তারা উৎসাহী হয়ে উঠল। আমার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল ওদের। মেয়েটি ফুটফুটে, চুল সোনালি, চোখদুটো আশ্চর্য সুন্দর। আমার চোখ নিজের অজান্তে ফিরে ফিরে মেয়েটিকে দেখতে লাগল। ঘটনাটির পর অনেকদিন পর্যন্ত মেয়েটিকে আমার মনে পড়েছে।

    ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে আমরা তিনজন অনেকক্ষণ ধরে খেলে কাটালাম। ওদের উর্দু-মেশানো অদ্ভুত ভাঙা-বাংলা এখনও আমার কানে বাজে। এই নতুন ভিনদেশী পরিবেশ আমাকে কিছুটা খুশি করে তুলেছিল। বিশেষ করে মেয়েটির সোনালি চুল আর চোখ আমি কিছুতেই যেন ভুলতে পারছিলাম না। নতুন পরিবেশে এসে আমি বাসার সবার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। আমি- যে একটি হারিয়ে-যাওয়া ছেলে, আমার-যে ভাই-বোন আব্বা-আম্মা আছেন, তাঁরা-যে আমাকে না-দেখে এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় যন্ত্রণায় পাগলের মতো হয়ে রয়েছেন তা আমার মনেও এল না। মনেই হচ্ছিল না আমি হারিয়ে গেছি। ঘণ্টাকয়েক ঘুমিয়ে ভদ্রলোক উঠে পড়লেন, বললেন : ‘চ্যলো, তুমকো ওয়াপস দেনা।’

    ঐ বাসা থেকে চলে আসতে আমার মন সরছিল না। আমি কিছু একটা হারিয়ে ফেলার বেদনা অনুভব করছিলাম।

    ভদ্রলোক আমাকে স্টেশনমাস্টারের রুমে নিয়ে চাপাস্বরে তাঁকে কী যেন বললেন। স্টেশনমাস্টার হাত ধরে আমাকে তাঁর সামনে টেনে এনে দুষ্টু হেসে বললেন : “তাহলে তুমিই সেই ছেলে!’

    কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমার হারিয়ে যাবার ঘটনাটায় আমাদের গোটা পরিবারের ওপর দিয়ে কী প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। দেখলাম প্ল্যাটফর্মের ওপর আগোছালোভাবে জিনিশপত্রের মাঝখানে সবাই ঘুমহীন লাল চোখে অবসন্নভাবে বসে আছেন। আমার ব্যাপারে থানায় তো ডায়রি করা হয়েছেই, কলকাতা পাবনা সবদিকে লোকও পাঠানো হয়েছে।

    আমি ফিরে আসায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টাব্যাপী দুশ্চিন্তাপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান হল। সবাই হাঁফ ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

    সেদিনের কথা ভাবলে আজও আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কীভাবে ঘুমের ঘোরে অতদূর হেঁটে গিয়েছিলাম? কীভাবে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে অতটা রাস্তা পেরিয়েছিলাম? নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে দু-একবার আমি আশেপাশে তাকিয়েছিলামও, না হলে নিশ্চয়ই উল্টোপাল্টা পথ ধরে চলে যেতাম! যেসব মানসিক রোগী ঘুমের ভেতর হেঁটে বেড়ায় আমি তো তাদের কেউ নই। তাহলে সেদিন কী করে ঘটল এমনটা? আমার ধারণা আমি হেঁটে গিয়েছিলাম গভীর ঘোরের ভেতর দিয়ে। এ ঘোর ঘুমের না, মানসিক ঘোর। এ আমার রক্তের জিনিশ। প্রায় সারাক্ষণই আমি বেঁচে থাকি এমনি এক ঘোরের ভেতর। ঘোরের ভেতর হাঁটার নেশা আমাকে সেদিন গ্রাস করেছিল।

    ২

    ঘটনাটা এর বছরতিনেক আগের। বেড়াতে গেছি কলকাতায়। দিনকয় ধরে আছি। ইচ্ছামতো ফূর্তি করছি। একদিন হঠাৎ দেখি নানা আমাদের ওপর ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত। নানীকে বলছেন : ‘এমন অসভ্য ছেলেপেলেকে এখানে রাখা যাবে না। কালই এদের বিদায় কর।’

    পরের দিন সত্যিসত্যি আমাদের খেদানো হল। জন্তু-জানোয়ারের মতো আমাদের তাড়ানো হচ্ছে দেখে আমার খুব আত্মসম্মানে লাগল। আমি ও একটা কাগজ জোগাড় করে তাতে লিখলাম : ‘আমিও আর কোনোদিন এ- বাড়িতে আসব না।’ ইচ্ছা, কাগজটা সরাসরি নানার কাছে পৌঁছাই। কিন্তু লেখার পরেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কাগজটা রাখি কোথায়? যদিও নানার স্পর্ধাকে একহাত দেখিয়ে দেওয়ার জন্যেই এটা লেখা তবু সরাসরি নানার হাতে এটা পড়ে যাওয়াও তো খুবই বিপদের। চিরদিনের জন্যে কলকাতায় আসাটাই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। কলকাতার মতো এমন রমণীয় স্বর্গকে গায়ে পড়ে কী করে হাতছাড়া করা যায়? চিড়িয়াখানা, গড়ের মাঠ, গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, আইসক্রিম, কুলফি বরফ—এসব পাব কী করে? বাড়ির একতলায় সিঁড়ির নিচে রান্নাঘরে একগাদা কাঠের চলা সবসময় ফেলে রাখা হত। অনেক ভেবেচিন্তে সেই চলাগুলোর অনেক নিচে চিঠিটাকে আস্তে করে রেখে দিলাম। এমনভাবে রাখলাম যাতে কেউ কোনোদিন সেটা খুঁজে না পায়। এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। নানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাও হল, আবার নানার হাতে ওটা যেন পড়তে না পারে তার পাকা ব্যবস্থাও হল।

    ঘটনাটার বছর পঁচিশেক পর আমি একবারই ঐ বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ছাদে উঠে হাঁটছি, হঠাৎ ছাদের রেলিং ধরে নিচের কার্নিশ আর ফুটপাথের দিকে তাকাতেই বুকটা ধড়াশ করে উঠল। মনে পড়ল এই তিনতলার কার্নিশের ওপর দিয়ে ছেলেবেলায় আমি তো দৌড়ে বেড়াতাম। দৌড়ানোও অসম্ভব নয়। গ্রামের খোলা মাঠে দাবড়ে বেড়াতে আমরা অভ্যস্ত। শহরে তিনতলা বাড়ির কার্নিশ পেয়ে হয়ত ওটাকেও অমনি একটা খোলা মাঠই ধরে নিয়েছিলাম। মনে হতেই হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কী চাপা কার্নিশ? কী করে দৌড়াতাম এর ওপর দিয়ে? এতটুকু পা হড়কালেই তো তিনতলা থেকে নিচের ফুটপাথের ওপর পড়ে থেঁতলে যেতাম। সেদিন বুঝলাম কেন সেবার নানা আমাদের একদিনের নোটিশে অমন অসম্মানজনকভাবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

    এই আমার প্রকৃতি। কোনোকিছু নিয়ে মেতে গেলে জীবনের অপ্রশস্ত কার্নিশের ওপর দিয়ে আজও অমনি আত্মঘাতীভাবে ছুটে যাই। সামনের খানা-খন্দ, পাহাড়- পর্বত কিছুই দেখতে পাই না।

    ৩

    পাবনা কলেজ ছিল প্রকৃতি আর সভ্যতার ঠিক মাঝামাঝি রেখায়। তবু তার সারা অবয়বে যেন ছিল প্রকৃতিরই ছোঁয়া। আমাদের বাসার সামনে মাঠ, কলেজভবন পেরোলে আবার মাঠ, তারপর কলেজের বিশাল মাঠ আর তার গা ঘেঁষে ইছামতী পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের স্কুলের বিস্তীর্ণ মাঠ—সব মিলে আমাকে যেন আদিঅন্তহীন এক অবার জগতের অধিবাসী করে তুলত। এই মাঠের পর মাঠ আমাকে খেলার নেশায় মাতিয়ে তুলেছিল। গোটা স্কুলজীবনটাই আমার কেটেছে খেলাধুলা নিয়ে। ওটাই ছিল তখন আমার আসল পরিচয়। ভালো ছাত্রত্বে বা পড়াশোনার আগ্রহে আমি ছিলাম অনেক পেছনের সারিতে।

    ফুটবল হয়ে উঠেছিল আমার রক্তের খেলা। সারাটা স্কুলজীবন এই খেলা নিয়ে মাতালের মতো আমার কেটেছে। ক্রিকেট

    আমার কেটেছে। ক্রিকেট নিয়ে মেতে থেকেছি শীতকালগুলোতে। ক্রিকেটের মাদকতার সঙ্গে শীতের হাওয়ার মিষ্টি আমেজ এখনও আমার স্মৃতির ভেতর ঝিরঝির করে। ক্রিকেটে আমি ছিলাম মাঝারি মাপের বোলার, উইকেট পেতাম থেকে থেকেই, কিন্তু ব্যাট হাতে নিলেই কেন যেন চোখে অন্ধকার দেখতাম। বোলারের হাত থেকে বল কখন কীভাবে যে শাঁ করে ছুটে এসে আমার উইকেট উড়িয়ে নিত বুঝে উঠতে পারতাম না। যে-আমি সারাজীবন সমাজ-সংসারের এত জাতের আলাদা ক্রিজে দাঁড়িয়ে এত সুস্থিরভাবে ব্যাট করেছি সেই আমি-যে ক্রিকেট-মাঠে কেন ব্যাট হাতে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আউট হয়ে যেতাম, আজও ভেবে পাই না।

    তবে ক্রিকেট বা ফুটবলে যাই হোক, সবচেয়ে ভালো ছিলাম আমি ব্যাডমিন্টনে। বাসার সামনে কলেজভবনের পাশে কোর্ট কেটে খেলে যেতাম বিকেল থেকে রাত অব্দি। প্রতিদিন দশ-বারো গেমের নিচে নয়। শিশুবয়সে দিনে আঠারো বোতল দুধ খেয়ে বেড়ে-ওঠা কিশোর আমি; দশ-বারো গেম কেন, ষোলো-আঠারো গেমেও আমার কিছু হওয়ার কথা নয়। সত্যিসত্যি ভালো ছিলাম আমি খেলাটায়। সে-যুগে আজকের মতো জেলা, বিভাগ বা জাতীয় পর্যায়ের খেলা ছিল না। থাকলে আমি নির্ঘাত ভালো করতাম।

    পাবনা আসার পর থেকেই আব্বা বাসায় গরু পুষতে শুরু করেন। পাঁচ-সাত সের দুধ-দেওয়া ভালো জাতের গরু। প্রতি সন্ধ্যায় খেলার পর বাসায় ফিরে সেই দুধের অন্তত সের দেড়েক ভাগে জুটত। অবসাদটা পুষিয়ে যেত। গরুগুলোকে নিয়েও আব্বার একধরনের গভীর মমতা ছিল। এদের আব্বা সন্তানের মতো দেখতেন। কোনো কারণে ওরা ডাকাডাকি করলে কী করে কলেজে বসে আব্বা যেন তা টের পেয়ে যেতেন। ওদের কী হয়েছে জানার জন্যে বাসায় এসে গরুগুলোকে আদর করতে থাকতেন। বারে বারে ওদের অবোধ ভাষায় জিজ্ঞেস করতেন কী হয়েছে। ওদের ডাকগুলো আব্বার কাছে ওদের অব্যক্ত কান্নার মতো মনে হত। নিজের এত ছেলেমেয়ে থাকার পরও আব্বার মধ্যে গরুর জন্যে এমন বাৎসল্যরস যে কোথা থেকে আসত বুঝতাম না।

    ৪

    আগেই বলেছি, বাসার সামনে কলেজের পুকুরটা ছিল বেশ বড়সড়। এর পাড় ধরে লম্বালম্বিভাবে হাঁটতে শুরু করলে পুকুরটা যেন শেষ হতে চাইত না। পুকুরটাকে আমার কাছে অন্তহীন মনে হত। কিন্তু পুকুরটা আসলে অতবড় ছিল না। বছর-চল্লিশ বয়সের সময় একবার পাবনা গিয়ে পুকুরটা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সেটাকে অতবড় মনে হয়নি। ছেলেবেলায় পাবনায় থাকতে আমি নেহাতই ছোট ছিলাম। আমার পাগুলোও ছিল ছোট ছোট। সেই ছোট পা দিয়ে পুকুরের পাড়টাকে হেঁটে পার হতে গিয়ে সেটাকে অমন অন্তহীন মনে হত।

    তবু পুকুরটা ছিল মোটামুটি বড়। এই পুকুরটা ছিল আমার দিনের বেলার দ্বিতীয় বাড়ি। গ্রীষ্ম-শরতের ছুটি আর সাধারণ বন্ধের সময় পুরো দিনের বেলাটা মোটামুটি ওর পানিতেই কাটাতাম। সকাল ন-টায় সেই-যে নামতাম, উঠতাম তিনটা-চারটার দিকে। মা ছিল না, তাই আমি ছিলাম পুরোপুরি স্বাধীন। প্রায় কোনোকিছুতেই আমাকে কিছু বলার কেউ ছিল না। সারাদিন গোসল-করা লাল টকটকে চোখদুটো আব্বার চোখে পড়লেই ছিল কেবল বিপদ। যে-ধরনের আদর-আপ্যায়ন জুটত তা জনে জনে বলে বেড়াবার মতো নয়।

    ৫

    আমাদের বাসার পেছনেই ছিল জটু রায়ের বিশাল বাগানবাড়ি। তারপর একটা ঘনকালো বিরাট জঙ্গল। এই জঙ্গল ক্রমাগত নিবিড় আর বিস্তৃত হয়ে ইছামতীর ধার ধরে উত্তর দিকে চলে গেছে। পুকুরটার মতো এই জঙ্গলটাও ছিল আমার কৈশোরের দুর্বার স্বেচ্ছাচারিতার আর-এক অফুরন্ত লীলাভূমি। আমাদের বাসার পেছনেই জটু রায়ের বাগানের দৈত্যের মতো বড় বড় আমগাছের একটানা দীর্ঘ সারি। টারজানের কিছু ফিল্ম ততদিনে দেখে ফেলেছি। ছবিতে গাছের মজবুত শক্ত লতা ধরে ঝুলে একগাছ থেকে আরেক গাছে টারজানের যাবার দৃশ্যে আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত। জটু রায়ের বিশাল আমগাছগুলো আমার সে-স্বপ্নপূরণের সুযোগ দিল। গাছগুলোয় লম্বা লম্বা দড়ি টানিয়ে সেসব ধরে ঝুলে গাছ থেকে গাছে যাওয়া আর নিজেকে টারজান ভেবে আত্মপ্রসাদ পাওয়ার আনন্দে বুঁদ হয়ে থেকে আমার জান্তব উত্তেজনায়-ভরা দুপুরগুলো কাটতে লাগল।

    গোটা বাগানটার মধ্যে আমাকে যা সবচেয়ে প্রলুব্ধ করত তা হল বাগানের দক্ষিণ দিকের মাঝারি আকারের একটা ফলশা গাছ। বর্ষা এলে ছোট ছোট অসংখ্য সবুজ ফলে ভরে যেত পুরো গাছটা, তারপর বেগুনি-খয়েরি রঙ ধরে এক-দুই করে পাকতে শুরু করত। পাকা ফলশার রূপ আর স্বাদ দুটোই আমার শৈশবের চোখে ছিল বিস্ময়। ফলগুলোকে আমার কাছে রূপকথার ফল বলে মনে হত।

    জটু রায় সম্ভবত ছিলেন কুষ্টিয়ার জমিদারের কর্মকর্তা। আমাদের পাবনা যাওয়ার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের লোকদের অবস্থা ততদিনে পড়ে এসেছে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একতলা বাড়িটার অবস্থাও জরাজীর্ণ। তবু এই বিশাল বাগানওয়ালা বাড়িটা নানা কারণে আমার মনে গেঁথে আছে।

    বাড়িটার একটা গাছের কথা খুব মনে পড়ে। লোকে বলত সেটা শতাব্দী- ফুলের গাছ। গাছটার চারপাশে থরে থরে লম্বা চোখা অজস্র তীক্ষ্ণ পাতা ছড়ানো। গাছটা পাঁচ-সাত ফুট উঁচু। শুনতাম বহুবছর পরে পরে গাছটাতে ফুল আসে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমরা পাবনায় থাকতেই একদিন সত্যিসত্যি গাছটাতে ফুল এল। খবর পেয়ে গিয়ে দেখি রাজার মতো এক আশ্চর্য বিরাট ফুল দাঁড়িয়ে আছে গাছটার মাথায়। ফুট দু-তিন উঁচু, ধবধবে শাদা, গোল গোল অজস্র পাপড়িওয়ালা ফুলটা সবুজ পাতার বিশাল পটভূমিকে আলো করে ফুটে আছে। ফুলটাকে আজও আমার বুকের ভেতর অমনি রাজকীয় ভঙ্গিতে দেখতে পাই।

    ৬

    পাবনা কলেজে লাইব্রেরিটি ছিল বেশ বড়সড়। তবু কলেজের পেছনেই কালীমন্দিরের সামনের মাঠের বাঁ-ধারের শেষপ্রান্তে ছিল একটা টিনের তৈরি মাঝারি আকারের লাইব্রেরি। আমার তখন বয়স অল্প, লাইব্রেরিটার নামের চেয়ে ওর রঙিন সুন্দর বইগুলোর দিকেই আমার লোভ ছিল বেশি, সেই অতি-উৎসাহের ফাঁক দিয়ে এর নামটা পুরোপুরি স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। লাইব্রেরির মেঝে ছিল পাকা, বারান্দাটা বড়সড়। ঐ বারান্দায় নিয়মিত নাটক, সাহিত্য প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবের আয়োজন হত। গোটা পাড়াটার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল স্নায়ুকেন্দ্র ছিল লাইব্রেরিটা। লাইব্রেরিতে শেলফ ছিল, বই ছিল, ঘর-দোর আসবাবপত্র ছিল; কিন্তু তার চেয়েও বড় যে-সম্পদটি ছিল তা হল বেশকিছু উজ্জীবিত মানুষ। এঁরাই ছিলেন লাইব্রেরির মূল প্রাণশক্তি। বইয়ের চেয়ে তাদের আকর্ষণেই আমরা বেশি করে ঐ লাইব্রেরিতে ভিড় জমাতাম।

    আমাদের রাধানগর পাড়ার ঐ লাইব্রেরিতে ছিল এমনি কয়েকজন মানুষ, বিকাশের দিকে যাঁরা আমাদের জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকটির লেখাপড়া ছিল বিস্তর। আমার ধারণা ছোট্ট ঐ লাইব্রেরিটির প্রায় সবগুলো বই ছিল তাঁর পড়া। কোনো শাদামাঠা বই নিতে গেলে বলতেন : ‘ওটা নিও না খোকা, এই বইটা নাও। ভালো লাগবে।’ তাঁরই উৎসাহে এক-এক করে দেবসাহিত্য কুটিরের বইয়ের পাশাপাশি আরও অনেক বই পড়ে ফেলেছিলাম লাইব্রেরিটি থেকে।

    লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক ছিলেন অবৈতনিক, শুনতাম জজকোর্টে কোনো- একটা চাকরি করতেন। তাঁর সমমনা কিছু বন্ধু ছিল, বিকেলে তাঁরাই লাইব্রেরিতে এসে গল্পে আড্ডায় পরিবেশটাকে সরগরম রাখতেন। তাঁদের মধ্যে একজন সুদর্শন ভদ্রলোক ছিলেন, আমরা তাকে বাদলদা বলে ডাকতাম। স্বাস্থ্যবান, ফরসা মানুষ ছিলেন তিনি, বয়স তিরিশের মতো, চুলগুলো মাথার মাঝবরাবর উঁচিয়ে সুবিন্যস্তভাবে অন্যপাশে এলিয়ে পড়ছে। একদিন বাদলদা আমাকে অদ্ভুতভাবে প্রজ্বলিত করে তুললেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন : “ভিকটর হুগোর লা মিজারেবল পড়েছিস?’

    বললাম : ‘না তো!’

    বাদলদা অসহিষ্ণুভাবে বললেন : ‘শিগগির পড়! ও তো আগুন!’

    ‘আগুন’ শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যেন সেই জ্বলন্ত আগুনকে তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।

    তাঁর ‘আগুন’ শব্দটা আমার সারা অস্তিত্বে যেন আগুন ধরিয়ে দিল। আমাদের লাইব্রেরিতে বইটি না-থাকায় পাগলের মতো সেটাকে সারা শহরে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। একসময় দিলালপাড়ার একটা ছোট লাইব্রেরিতে বইটির খোঁজ পেলাম। গোগ্রাসে পড়লাম। সত্যিই ‘আগুন’ বইটা। মানবতাবোধের স্নিগ্ধ আগুনে জ্বলন্ত আর মহিমাময়। বইটা পড়ে আমি কেঁদেছিলাম।

    এমনিভাবে জীবনকে জ্বালিয়ে দেবার মতো আরও অনেকেই ছিলেন লাইব্রেরিটিতে। একজনের কথা দিয়ে শেষ করব। তিনি শহরের কোনো-একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেই সুবাদে আমরা তাঁকে ‘স্যার’ বলতাম। ভদ্রলোক প্রায়ই লাইব্রেরিতে আসতেন। তাঁকে দেখলেই আমাদের ভালো লাগত। একহারা শরীর, চোখে চশমা, ধবধবে ধুতি-চাদর পরা, মুখে প্রশান্ত হাসি। কিন্তু এত সুন্দর চেহারার মধ্যে-যে এমন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা লুকানো আছে কে তা ভাবতে পারে? রাস্তাঘাটে যতবার যেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হত তিনি গ্রামোফোনের কাটা রেকর্ডের মতো কেবল একটি প্রশ্নই করতেন : ‘এ সপ্তাহে কী বই পড়লে?’ মনে মনে চটে উঠতাম! মানুষ কি প্রতি সপ্তাহে একটা করে বই পড়ে নাকি? তবু তিনি কথাটা বলতেন। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতাম। কাঁচুমাচু হয়ে বলতাম : ‘এ সপ্তাহে কিছু পড়িনি স্যার।’ আমার কথা শুনে তাঁর মুখ যেন আরও প্রসন্ন হয়ে উঠত। বলতেন : ‘পড়নি তাতে কী? আগামী সপ্তাহে পড়ে নিলেই হবে।’ পরের সপ্তাহে দেখা হলে সেই একই স্নিগ্ধ উজ্জ্বল হাসিতে সেই একই প্রাণঘাতী প্রশ্ন। তাঁর ভয়ে শেষপর্যন্ত বই পড়াই শুরু করতে হল। কিন্তু এতেও রেহাই নেই। যখনই বলতাম অমুক বইটা পড়েছি, তিনি খুশিতে গদগদ হয়ে উঠতেন : ‘চমৎকার, অভিনন্দন। এভাবে প্রতি সপ্তাহে একটা করে বই পড়লে দেখবে জীবনটাই বদলে গেছে।’ বলেই তিনি আবার বইয়ের ব্যাপারে ফিরে যেতেন। ‘হ্যাঁ, কী নাম যেন বললে বইটার!’ আমি নাম বললেই বলতেন : “নিশ্চয়ই খুব চমৎকার বই। তাই না? কিন্তু জানো, বইটা আমি এখনও পড়িনি। বলো না, বইটার মধ্যে কী আছে, তোমার সঙ্গে আমিও ওটা সম্বন্ধে জেনে নিই।’

    অসাধারণ কেউ ছিলেন না এই মানুষটি। কোনো কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বা অমিত প্রতিভাধর, কিছুই না। নেহাতই একজন সাধারণ শাদামাঠা স্কুলশিক্ষক। কিন্তু কিশোর তরুণদের জীবনকে উচ্চতর স্বপ্নের দিকে এগিয়ে দেবার এই-যে কৌশল আর নিদ্রাহীন চেষ্টা, এ কি এতই সাধারণ!

    ৭

    আগেই বলেছি, লাইব্রেরির লম্বা বারান্দাটায় মঞ্চ বানিয়ে সারাবছর যেসব নাটক আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত সেগুলোই ছিল রাধানগর গ্রামের সাংবাৎসরিক জীবনের সবচেয়ে সরগরম বিষয়। আমি তখন সবে এইট থেকে নাইনে উঠেছি। হঠাৎ, স্কুলপর্যায়ের নাটকে সরাসরি নায়কের চরিত্র পেয়ে গেলাম। নাটকের নাম ‘জইনশাহীর পাহাড়চূড়ায়’, লেখক মোফাখখরুল ইসলাম, পাবনা কলেজের বাংলার তরুণ অধ্যাপক। আমরা যখন করটিয়ায়, মোফাখখরুল ইসলাম তখন সেখানে ছিলেন ছাত্র, সেই সুবাদে আমরা তাঁকে মোফাখখর ভাই বলতাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই যে-একঝাঁক ইসলামী কবি ফররুখ আহমদের আদর্শে বাংলার সঙ্গে আরবি ফারসি শব্দের মিশেল দিয়ে পাকিস্তানি কবিতার নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন, করটিয়া কলেজের ছাত্র তালিম হোসেনের মতো মোফাখখর ভাইও ছিলেন তাঁদের একজন।

    একটা ঘটনার কারণে মোফাখখর ভাইয়ের কথা আমার স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছিল। কলেজের ছাত্র-সংসদের নির্বাচনে তিনি সেবার প্রার্থী। তখনও মাইক্রোফোনের যুগ আসেনি। কাজেই কী জাতীয় নির্বাচনে, কী কলেজ নির্বাচনে শ্রোতার কাছে কথা পৌঁছানোর একমাত্র উপায় তখন চোঙ্গা। চোঙ্গা হাতে নিয়ে তার একদিকে মুখ লাগিয়ে বক্তাকে কথা বলতে হত। সে-দৃশ্যের কথা মনে হলেও এখন হাসি পায়। টিনের তৈরি চোঙ্গার যেদিক দিয়ে বক্তা কথা বলত সেদিকটা সরু, যেদিক দিয়ে কথা বেরোত সেদিকটা প্রশস্ত। এর ফলে বক্তার কথা কিছুটা বড় আর ভারী হয়ে শ্রোতাদের কানে যেত।

    তো, নির্বাচনে মোফাখখর ভাই-এর পক্ষে চোঙ্গা দিয়ে জোর প্রচারণা চলছে। মোফাখখর ভাই কবি, ছাত্রমহলেও এ-ব্যাপারে তাঁর বেশ নাম-ডাক। তাই তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাও চলছে কবিতার মতো ছন্দে ছন্দে, তালে মিলে। এপাশ থেকে একজন বলছে : ‘ভোট ফর’। চোঙ্গার ভেতর দিয়ে বড় হয়ে বের হওয়ায় কথাটা হাস্যকর রকমে ভরাট আর বিকট হয়ে শোনা যাচ্ছে : ‘ভো-ও-ট ফ-অ-র’। কথাটা শেষ না-হতেই ওদিক থেকে আর-একজন আরও উদ্ভট ভঙ্গিতে মিল দিয়ে বলে উঠছে : ‘মো-ফা-খ-খ-র’। এভাবে ‘ভোট ফর মোফাখখর’ কথাটা কখনও ধীরলয়ে, কখনও দ্রুত, কখনও ছন্দে ছন্দে, তালে তালে আনন্দে-হিল্লোলে ভোটারদের গোটা পরিবেশটাকেই মুখর করে রাখছে।

    এমন-যে মোফাখখর ভাই, আমি হয়েছি তাঁর ‘জইনশাহীর পাহাড়চূড়ায়’ নাটকের তরুণ নায়ক। নাটকের কাহিনী পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নিয়ে। ছেলে, রাজপুত্র ও দেশপ্রেমিক আর বাবা, রাজা ও দেশদ্রোহী। নাটকের শেষদৃশ্যে ছেলের গুলিতে বাবার মৃত্যু হবে, এই ছিল মোদ্দাকাহিনী। আমি সেই নাটকে অভিনয় করেছিলাম পুত্রের ভূমিকায়। যে-বন্দুক আমাকে দেওয়া হয়েছিল বাবাকে গুলি করার জন্যে, সেটা নেহাতই ছিপি-লাগানো খেলনা বন্দুক। বন্দুকের ট্রিগার ধরে টান দিলে ছিপিটা ধা করে বের হয়ে যেত, কিন্তু বন্দুকের শব্দ হত না। তাই শব্দের জন্যে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। আমি ট্রিগার ধরে টান দিতেই আরেকজন স্টেজের পাশে পটকা ফোটাবে, এই ছিল নির্দেশ। সবই চলছিল ঠিকমতো। কিন্তু বিপদ ঘটল মোক্ষম সময়ে। আমি ট্রিগারে টান দিলাম, যার হাতে পটকা ছিল, সে-ও সময়মতোই ফোটাল, কিন্তু পটকা ফুটল না। কিন্তু না-ফুটলে কী হবে, আমার পিতা সেই বিশ্বাসঘাতক বাদশা এমন বিকট মৃত্যুশব্দ করে ভয়ংকরভাবে কাত্রাতে লাগল যে বন্দুকের আওয়াজ-যে হয়নি, দর্শকদের তা মনেই রইল না। যা হোক, ভালো অভিনয়ের জন্যে মেডেল পেয়েছিলাম সে-রাত্রে। রুপোর মেডেল।

    নাটকের দর্শক ছিল প্রায় শ-পাঁচেক, প্রায় সবই রবাহূত অনাহূত খেটে-খাওয়া সাধারণ লোকজন। নাটকের সময় দর্শকের জায়গায় এত মাথা দেখে মনে হয়েছিল সারা পাবনা শহরের মানুষ বুঝি নাটকটি দেখছে। সবাই জেনে যাচ্ছে আমার দুর্লভ অভিনয় কৃতিত্বের ঘটনা। পরের দিন সকাল হতেই বেশ পা ভারী করে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম রাজার মতো এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে। মনে আশা, রাস্তার লোকেরা কাজ ফেলে আমার দিকে হয়ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। বলবে : ‘ঐ যায় কালকের নাটকের পাগড়িশোভিত সেই অসামান্য রাজপুত্র, যে দেশপ্রেমের জন্যে বাবাকে গুলি করে মারতেও দ্বিধা করেনি। আর কী ভালো অভিনয়টাই না করেছে! রুপোর মেডেল তো আর এমনি দেয়নি!’ কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে তাদের কারো মধ্যে কোনো ভাবান্তর হচ্ছে বলে মনে হল না। কেউ যেন আমাকে চিনলও না। ফিরে তাকালও না। দেখলাম যে-যার জীবন-জীবিকার কাজ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। কেউ অফিসে যাচ্ছে, কেউ স্কুলে, কেউ দোকান খুলে বেচাকেনা করছে। হয়ত এটাই জীবনের আসল বাস্তবতা। আমরা-যে জগতের তুলনায় কত ছোট এটা অনেক সময় আমরা মনে রাখি না। পৃথিবীর বিশাল কর্মযজ্ঞের তুলনায় কত সামান্য একটা ব্যাপারকে বড় ভেবে কী লজ্জাজনকভাবেই না আশান্বিত হয়েছিলাম।

    ৮

    সারা শহরজুড়ে নাটকের একটা মত্ততা ছিল সে-সময়। তার ঢেউ এসে লেগেছিল আমাদের পাড়াতেও। আমি গোটা-দুই নাটক পরিচালনা করেছিলাম স্কুলে থাকতেই। প্রথমটার নাম ‘বন্দী বীর’। নাটকটি ছিল আলেকজান্ডার আর পুরুকে নিয়ে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বাঁশের ফ্রেমের ওপর পুরনো শাড়ি পেঁচিয়ে উইংস বানানো হয়েছে, সেগুলোকে বাসার বাইরের বারান্দার দুধারে দাঁড় করিয়ে তৈরি হয়েছে মঞ্চ, দর্শকরা বসেছে সামনের মাঠে। বৈঠকখানার চেয়ারগুলোকে মঞ্চে এনে কোনোটাকে সিংহাসন, কোনোটাকে পাত্রমিত্রদের চেয়ার হিশেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

    সময়মতো নাটক শুরু হল। একই চেয়ারে কখনও আলেকজান্ডার বসলেন, কখনও পুরু, অন্যগুলোয় সভাসদেরা।

    শুরু হল নাটক। সবকিছু চলছে ভালোই। কিন্তু একজায়গায় একটা ছোট্ট গণ্ডগোলে সব প্রায় ভণ্ডুল হবার যো। নাটকের একটা জায়গা ছিল যেখানে পুরু একজন বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিকে ধমকে বলবে : ‘এতবড় আস্পর্ধা তোমার?” কিন্তু নাটকের সময় ব্যাপারটা উল্টে গেল। খানিকটা নার্ভাস হয়ে, খানিকটা প্রম্পট শুনতে ভুল করে মন্ত্রী নিজেই পুরুকে ঐ বলে ধমকে উঠল। রাজা সেনাপতির এই ঔদ্ধত্যের জন্যে তৈরি ছিল না। হঠাৎ ভড়কে গিয়ে বলে উঠল : ‘এ্যাই রে, এ ডায়ালগ তো আমার।’ সঙ্গে সঙ্গে হাসির প্রচণ্ড রোল পড়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। যাহোক হাসাহাসি চললেও পুরো নাটকটা আমরা কোনোমতে শেষ করে সম্মান বাঁচাতে পেরেছিলাম।

    কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আমরা আরেকটা নাটক শুরু করলাম। নাটকের নাম ‘ইন্দ্রজাল’। এখানেও হল সেই প্রম্পটের বিভ্রাট। সে যে কী বিভ্রাট না-বলে বোঝানো যাবে না। তো, নাটকটার জন্যে তখন আমরা নায়ক খুঁজছি। কিন্তু মনমতো নায়ক পাওয়া যাচ্ছে না। কথাবার্তায়, ব্যক্তিত্বে, চেহারায় সবদিক দিয়ে নায়কের মতো নায়ক হতে হবে তো তাকে!

    আমাদের দলে একটি ছেলে ছিল দেখতে বেশ সুন্দর। বাঙালি নায়ক বলতে যা বোঝায় : সুন্দর, পৌরুষহীন, নাদুসনুদুস, ফরসা। একেবারে লালমুলো গোছের। তার অসীম সাধ নাটকের নায়ক হবে। নায়ক খুঁজছি শুনেই আমাদের আশপাশে সে ঘুরঘুর শুরু করল। থেকে-থেকেই আমাদের দিকে করুণদৃষ্টিতে একটানা তাকিয়ে থাকে। আশা, আমরা তাকে ডেকে বলি : ‘এই, নায়ক হবি?’ আমরা নাটক নিয়ে কথা শুরু করলেই গলা বাড়িয়ে চেহারা করুণ করে একটানা শুনে যায়। ‘আমাকে দিয়ে কি হতে পারে না’—এমনি একটা অসহায় ভাব সে-চেহারায়। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের পুরো দলটার মধ্যে ওর চেয়ে নির্বোধ আর নেই। একে কী করে নায়ক করা যায়! দর্শকের কাছে মার খেতে হবে তো! যাহোক, শেষপর্যন্ত নায়িকার চাচার রোল দিয়ে ওকে শান্ত করলাম। রোলটা ছোট। একটাই মাত্র ডায়ালগ : ‘মা স্বপ্না, তোমার বাবা তোমাকে ডাকছেন।’ আশাহত হলেও আপাতত তাই মেনে নিয়ে সে আমাদের ফুটফরমাশ খাটতে শুরু করে দিল।

    এদিকে আমরা একজন ভালো নায়ক পেয়ে গেলাম। রীতিমতো প্রিয়দর্শন। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি অভিনয়। আমাদেরই একটা ছেলে নায়িকা হল মেয়ে সেজে। ভালোই চলছিল প্রস্তুতি। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। নাটক নামার ঠিক দুদিন আগে নায়ক হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ল। জ্বর সত্যি মারাত্মক। ১০৫ ডিগ্রির কম নয়। প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। এখন কী করা! নায়ক কোথায় পাই! হাতে সময়ও নেই। সংকট বুঝে সেই ‘রাঙামুলো’ আবার আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর শুরু করল। আগের মতো থেকে-থেকেই করুণচোখে আমাদের দিকে তাকায়। দূর থেকে তাকিয়ে মৃদুমৃদু হাসে। যেন বলতে চায়, ‘লাগবে কি না বলো, বললে এখনও রাজি হতে পারি।’ শেষপর্যন্ত উপায় না-দেখে তাকেই ধরতে হল। অন্তত বাঙালি নায়কের গোল টমেটোমার্কা চেহারা তো আছে। আপাতত ওটুকুই ভরসা। আমাদের প্রস্তাব শুনে সে লাফিয়ে উঠল। বললাম : ‘পারবি দুদিনের মধ্যে সব সংলাপ মুখস্থ করতে?’ সে জোর দিয়ে বলল : ‘অবশ্যই।’ প্রাণপণে সে সংলাপ মুখস্থ করতে লাগল। কিন্তু পরের দিন পরীক্ষা নিতেই ধরা পড়ল কিছুই সে মুখস্থ করতে পারেনি। আর কোনোদিন পারবেও যে না তাও স্পষ্ট হল। স্মৃতিশক্তি বলতে কিছুই নেই ওর। কিন্তু করাটা কী? নাটক চলবে কী করে? উপায়হীন হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, মঞ্চের পাশ থেকে প্রম্পটার প্রম্পট করবে জোরে জোরে। তা শুনে শুনে ও সংলাপ বলে যাবে। তাতে যদ্দুর যা হয়।

    নাটকের দিন বেশ লোকসমাগম হল। শুরু হল নাটক। কিন্তু প্ৰথমেই বিপদ ঘটাল প্রম্পটার। সে এত জোরে প্রম্পট শুরু করল যে, নায়কের গলা ছাপিয়ে ওর কথা দর্শকের সারি পর্যন্ত পৌঁছোতে লাগল। নায়কের গলা প্রায় শোনাই যায় না। দর্শকদের ভেতর থেকে কে একজন নায়ককে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠল : ‘আপনি আর অযথা কষ্ট করতিছেন কেন ভাই? আমরা তো এমনিই সব শুনতিছি।’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আরেকজন বলে উঠল : ‘আপনি বরং আমাগরে মধ্যেই আইসে বসেন। আমাগরে সঙ্গে নাটক শোনেন।’ আরেক দফা হাসির রোল উঠল। নাটক তবুও চলছে। প্রম্পটার একটা সংলাপ বললে নায়ক প্ৰথমে সেটা শান্তভাবে কান পেতে শুনে নেয়, তারপর পাশের অভিনেতা-অভিনেত্রীকে তা বলে। প্রম্পটার প্রম্পট করতে দেরি করলে তার অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। অসহায়ের মতো সে উইংসের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

    এমনিভাবে দর্শকদের হাসাহাসি আর কথাবার্তার ভেতর দিয়ে একসময় সেই দৃশ্যটা এসে পড়ল, যে-দৃশ্যে নায়িকাকে সেই ঈপ্সিত আর অসম্ভব কথাটা তাকে জানাতেই হবে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে হবে : ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ এখানে এসে ঘটল এক বেদনাদায়ক ব্যাপার। প্রম্পটার ঐ কথাটা প্রম্পট করতে গিয়ে গলায় আবেগ ঢেলে বলেছে, ‘আমি তোমাকে…।’ নায়কও নায়িকাকে বলে ফেলেছে, ‘আমি তোমাকে…।’ কিন্তু এর পরেই দুর্ঘটনা। প্রম্পটার চুপ। কে একজন দৌড়ে যাওয়ার সময় প্রম্পটারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ায় প্রম্পটারের হাতের বইটা ছিটকে পড়ে গেছে। এদিকে প্রম্পটারের কাছ থেকে সাপ্লাই না- পেয়ে নায়ক প্রবরও নির্বাক। বেশকিছুক্ষণ কোনো নড়াচড়া নেই। কেবল নায়ক একদৃষ্টে উইংসের দিকে করুণ-চোখে তাকিয়ে।

    অবস্থা দেখে দর্শকদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। কে একজন বলে উঠল ‘কী নায়ক ভাই, জবান বন্ধ হয়ে গেল নাকি?’ শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। নায়ক তখনও ঘর্মাক্ত-মুখে উইংসের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে পাণ্ডুলিপি গোছগাছ করে নিজেকে সামলে উঠেছে প্রম্পটার। জায়গাটা খুঁজে পেয়ে প্রায় মিনিট-দেড়েক পরে চালু করে দিয়েছে বাক্যটার বাকি অংশ : ‘ভালোবাসি’। আর যায় কোথায়! ক্ষুধার্ত বাঘের মতো নায়ক ছিনিয়ে নিল শব্দটা। তারপর— এতক্ষণ চুপ থাকার ক্ষতিপূরণ হিশেবেই হয়ত নায়িকার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কামানের মতো গর্জে উঠল : ‘ভালোবাসি’। পুরো দর্শকসারি তুমুল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সে-হাসি এমন অফুরন্ত যে কিছুতেই আর নাটক শেষ করা যায় না।

    ৯

    সাঁতার, খেলাধুলা, ব্যায়াম—সবকিছু আমাকে শক্তসমর্থ আর মজবুত কিশোরে পরিণত করল।

    আমার জাঁকালো স্বাস্থ্যটা দিয়ে ভালো কী করা যেতে পারে কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছি না, অথচ খারাপ কী করা যেতে পারে তার বহুরকম প্রলোভন সারাক্ষণ আমার চারপাশে মৌ মৌ করে। আমাদের পাশের গ্রাম পৈলানপুরে একজন নামকরা গুণ্ডা ছিল, তার যেমন স্বাস্থ্য তেমনি দাপট। রাস্তায় লোকেরা তাকে দেখলে সমীহ করে সরে দাঁড়াত। রাস্তা দিয়ে সে রাজার মতো হাঁটত। সবার মুখে তার গৌরবগাথা। খারাপ টাকা ভালো টাকাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। আমারও তাই হল। ভালো কিছু চোখের সামনে না-পাওয়ায় সেই গুণ্ডাই আমার আদর্শ হয়ে উঠল। তার মতো একজন উঁচুমাপের গুণ্ডা হবার স্বপ্ন মনকে গ্রাস করে নিল। তার মতো আমার দাপটেও একদিন শহরের মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে, মনের চোখে সে-দৃশ্য দেখে শিহরণ বোধ করতে লাগলাম।

    প্রথমে একটা ছোটখাটো দল বানিয়ে ফেললাম পাড়ার ছেলেপেলেদের নিয়ে। পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা-গল্পগুলো পড়া চলছিল তখন। তাছাড়া নীহাররঞ্জনের অসাধারণ গোয়েন্দা গল্পগুলো রসিয়ে পড়ছিলাম। পড়ে পড়ে রোমহর্ষক আর দুর্ধর্ষ অভিযানের ইচ্ছা জেগে উঠেছিল ভেতরে ভেতরে।

    আমি তখন পড়ি ক্লাস এইটে। প্রথমদিকে দলটা ছোট থাকলেও পরের দিকে বেশ বড় হয়ে উঠল। বহু ছেলেপেলে যোগ দিল তাতে। শঙ্কু, উমু, বৈদা এরকম অদ্ভুত নামের একদঙ্গল ছেলে। বিরাট এক বাহিনী গড়ে উঠল দেখতে দেখতে।

    সে-সময় আমাদের স্কুলে এক-কোম্পানি বালুচ আর্মি এসে ক্যাম্প করেছিল। সৈন্যদের ক্যাপ্টেন সাহেবের কথা আজও মনে পড়ে। অসম্ভব সুদর্শন আর দীর্ঘদেহী ছিলেন তিনি। বাড়ি ছিল পেশোয়ারে। তার হাঁটার ভঙ্গি ছিল অভিজাত। দুই চোখ মাথায় ভরা। সৈন্যরা প্রতিদিন সকালে মার্চ-পিটি করত। এরই সঙ্গে একটা অদ্ভুত ট্রেনিং ছিল তাদের। কী করে বেয়নেট চার্জ করতে হয় তার ট্রেনিং। তাদের সামনে ঝোলানো থাকত একটা বড়সড় বালুর বস্তা। অনেক দূর থেকে এক-এক করে সৈনিক রাইফেলের সঙ্গীন উঁচিয়ে প্রথমে তেড়ে আসত বস্তাটার দিকে তারপর হঠাৎ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আবার ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত বস্তাটার ওপর, তারপর পূর্ণশক্তিতে বেয়নেটটাকে আমূল ঢুকিয়ে দিত ঝুলন্ত বস্তাটার ভেতর। তারপর এক ঝটকায় সেটাকে খুলে নিয়ে ছুটে যেত সামনের দিকে। সঙ্গীন ঢোকানোর আগে ভয়-ধরানো গলায় চিৎকার করে বলত : পয়েন্ট। বেয়নেট বের করার সময় বলত : উইথড্র, তারপর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বলে উঠত : ম্যানগার্ড।

    সৈন্যদের দেখে দেখে আমার মনেও ঐ ধরনের দল গড়ে তোলার উৎসাহ জেঁকে বসল। ঐ কোম্পানির আদলেই গড়ে তুললাম দলটা। আমি হলাম দলের ক্যাপ্টেন। দলে তখন প্রায় ২৬-২৭ জন ছেলে। আমার ছোটভাই মামুন আর শিবনারায়ণ হল আমার সহকারী। দলের ছেলেদের ওরাই কুচকাওয়াজ করাত, স্কুলের সামনে মিলিটারিরা যেভাবে করায়, সেভাবে। কাগজ দিয়ে মিলিটারিদের মতো আমি একটা সামরিক ক্যাপও বানিয়েছিলাম নিজের জন্যে, খানিকটা নিম্নমানের সুবেদার-মার্কা টুপি বানিয়ে দিয়েছিলাম মামুন আর শিবনারায়ণকে। ক্যাপ্টেন সাহেবের মতো আমার হাতেও সবসময় থাকত একটা লম্বা ছড়ি। মাঝে মাঝেই আর্মির ক্যাপ্টেনের মতো নিজের সৈন্যদল পরিদর্শন করতাম। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের কাউকে পা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ছড়ি দিয়ে খোঁচা মেরে তা সোজা করে দিতাম। সামনে দিয়ে ওরা কুচকাওয়াজ করে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন সাহেবের মতো অভিবাদন গ্রহণ করতাম।

    আগেই বলেছি, আমাদের বাসার পেছনেই জটু রায়ের বাড়ি। বাড়ির পেছনদিকে একটা বড় জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা। সবাই মিলে একটা গর্ত খুঁড়লাম সেই জঙ্গলে। পাঁচ- ছ-ফুট গভীর গর্তটা নিচে নেমে চারপাশে বেশকিছুটা ছড়ানো। গর্তের মুখ একটা ড্রামের ঢাকনি দিয়ে ঢাকা থাকত, যাতে বৃষ্টির পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। ঐ জায়গাটার নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘আড্ডা’। গোয়েন্দা-কাহিনী পড়েই মাথায় এসেছিল নামটা। গর্তের দিকে যাওয়ার রাস্তা ছিল দুটো। সে-রাস্তাগুলোও ছিল বিশেষ ধরনে তৈরি। আমরা-যে ঐ আড্ডায় যাচ্ছি বা বেরোচ্ছি তার শব্দ যেন শত্রুরা শুনতে না পারে সেজন্যে প্রথমে মাটিতে পুরু করে খড় বিছিয়ে তার ওপর মাটি ফেলে রাস্তাগুলো বানিয়েছিলাম। আমরা ওখানে বসে ডিটেকটিভ বইয়ের ডাকাতদের মতো সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে শলাপরামর্শ করতাম।

    একেকদিন আমরা একেক অভিযানে বেরোতাম। একবার গিয়েছিলাম কাছের একটা বাগানের লিচুগাছ লুট করতে। বাগানের মালিক আমাদের হুকুমমতো ভেট পাঠায়নি, এই তার অপরাধ। আমরা বিশ-পঁচিশজন ছেলে মিলে বাগানটার একটা গাছে গিয়ে উঠেছি। গাছের লিচু লুট করা প্রায় শেষ। হঠাৎ বাগানের মালিক বল্লম- সড়কিওয়ালা দশ-বারোজন লোক নিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলল। গুলতি লাঠি এসব ছিল আমাদের অস্ত্র, তাই ওদের সঙ্গে এঁটে ওঠার শক্তি আমাদের ছিল না। আমরা পালাতে চেষ্টা করলাম। সেদিন গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে আমার ডান পা খুব খারাপভাবে মচকে গিয়েছিল। মচকানো পায়ের জন্যে আজও আমি আসন করে বসতে পারি না। এসব আম-লিচু যে আমরা খাবার জন্যে লুট করতাম তা নয়, অধিকাংশই রবিনহুডি কায়দায় সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতাম। এতে মনে বিরাট গর্ব জাগত। সবার কাছে কেউকেটা হয়ে ওঠার তৃপ্তি পেতাম। রবিনহুড ততদিনে পড়ে ফেলেছিলাম, হয়ত ঐ বইয়ের প্রভাবও এসবের পেছনে কাজ করেছিল।

    আড্ডার ব্যাপারে একমাত্র সমস্যা হত আব্বাকে নিয়ে। আড্ডায় দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে বাসায় ফিরলে আব্বা যখন জিগ্যেস করতেন : ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি।’ আর আমি সরল বিশ্বাসে জবাব দিতাম : ‘আড্ডায়’। তখন আব্বা খপ করে আমার কানটা চেপে ধরে এমনভাবে আদর-আপ্যায়ন শুরু করতেন যে মিনিট- পাঁচেকের আগে তা শেষ হত না। বুঝে উঠতে পারতাম না আমার ব্যাপারে আব্বার এই অযাচিত অনুগ্রহ কেন! ডিটেকটিভ বইয়ে আব্বার বয়সী বড় বড় মানুষেরাই আড্ডায় বসে যদি দুঃসাহসিক অভিযানের প্ল্যান করতে পারে তবে আমাদের মতো ছোট ছোট ছেলেরা তা করলে অপরাধ কেন হবে?

    আমি আমার দল নিয়ে এপাড়া-ওপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে প্রায়ই মারামারি করতাম। নামের সঙ্গে ‘গুণ্ডা’ উপাধিটা অর্জন তখন আমার দিনরাত্রির একমাত্র নেশা। একবার পাশের এক পাড়ার ১৫-২০টা ছেলে এসে হামলা চালাল আমাদের ওপর। ওরা এসেছিল আগের মার-খাওয়ার প্রতিশোধ নিতে। খুব মারামারি হয়েছিল সেদিন, বিশ্রীরকম মারামারি, একালের মারামারি হলে নির্ঘাত দু-একটা লাশ পড়ে যেত।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহযরত ওমর – আবদুল মওদুদ
    Next Article শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }