Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

    লেখক এক পাতা গল্প183 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ওপরের আকাশ

    ১

    ক্লাস নাইনে উঠতেই আব্বা আমাকে আর মামুনকে পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। জিলা স্কুল শহরের সেরা স্কুল। পরীক্ষার রেজাল্ট, শিক্ষকদের মান, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন—সবদিক থেকে এ সবার ওপরে। স্কুলটার চেহারাও নিরিবিলি ছবির মতো। স্কুলটাতে পড়ার স্বপ্ন অনেকদিন থেকেই ভেতরে ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল। এর একটা কারণ, রাধানগর স্কুলের ব্যাপারে আমার মোহভঙ্গ। ক্লাস সেভেনে উঠতেই নিয়ম হল হিন্দু ছেলেরা আর মুসলমান ছেলেরা পড়বে আলাদা আলাদা সেকশনে। ফলে মুসলমানদের সেকশনে পড়ে যাই। এতে ভেতরে ভেতরে বেশকিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এসব ছেলেদের অধিকাংশের রুচিহীনতা ও অমার্জিত আচার-আচরণের সঙ্গে আমি কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারতাম না। জিলা স্কুল আমাকে এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিল। এখানকার উন্নত শিক্ষা-পরিবেশ আমার জীবন গড়ে তোলার ব্যাপারে খুবই সহায়ক হয়েছিল।

    ২

    যে-কারণে জিলা স্কুলের দিনগুলো আমার মনে এমন স্মৃতিময় হয়ে রয়েছে তার একটা কারণ, শৈশবে বন্ধু বলতে যা বোঝায় এই স্কুলে আমি প্রথম তাদের দেখা পাই। প্রায় একই সঙ্গে তিনজন সহপাঠীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। এরা হল খায়রুল (খায়রুল আনাম সিদ্দিকী), নিজাম (নিজামুল হক), হায়াত (আবুল হায়াত)। আমি সারাজীবনই অসাধারণত্বের পূজারী। মহৎ গুণ তো বটেই, কারও কোনো সাধারণ গুণ দেখলেও আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠি। গর্বে, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে যায়। জীবনে প্রথম যার মধ্যে এই অসাধারণত্বের ছোঁয়া আমি অল্পপরিমাণে দেখেছিলাম সে ছিল রাধানগর স্কুলে আমার এক ক্লাস নিচের এক ছাত্র, মজিদ। নিচের ক্লাসে পড়লেও মজিদ খুব সম্ভব বয়সে আমার সমান বা এক-আধ বছরের বড় ছিল। বলিষ্ঠ ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মজিদের ভেতর একটা সুস্থির ব্যক্তিত্ব ছিল। স্কুলের ফুটবল টিমের ব্যাক হিশেবে ও ছিল দুর্ভেদ্য ও সবার ভরসার স্থল। ওর এই অসাধারণত্ব আমাকে গর্বিত করত। ওর পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হত। ওদের পাড়ার ওর চেয়ে বয়সে বড় একটা মেয়ের সঙ্গে ওর রহস্যজনক সম্পর্কের কথা প্রায়ই টুকরো-টুকরোভাবে কানে আসত। এসব ঘটনা ওর ব্যাপারে আমার বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিত। কিন্তু মেধা বা মননশীলতায় ও ছিল একেবারেই সাধারণ। কাজেই ওর দিকে আমার চাউনির ভেতর অল্পবিস্তর বিস্ময়ের ঘোর লাগলেও তা খুব একটা গভীরে পৌঁছেনি।

    শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথের মতো আমার শৈশবের দিনগুলোয় প্রথম যে কিশোরটি আমার চোখে সবচেয়ে অনন্যসাধারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল সে খায়রুল। খায়রুলদের বাড়ি খুব সম্ভব ছিল বারাসাতে, সেখান থেকে ওরা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল। খায়রুল ছিল জিলা স্কুলে আমাদের ফার্স্ট বয়। ক্লাস ক্যাপ্টেনও ছিল ও। ওর স্নিগ্ধ সপারগ ব্যক্তিত্ব সবার ওপর দিয়ে জ্বলজ্বল করত। ও ছিল প্রিয়দর্শন আর গুণগ্রাহী স্বভাবের। ওর সাথে কথা বলে ক্লান্তি আসত না। জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েই টের পেলাম ক্লাসের এই সেরা ছাত্রটি রহস্যময় সম্মোহনে আমাকে টানছে। স্কুলে সারাদিন খায়রুলের সঙ্গে কথা বলার পরও ওর ব্যাপারে আমার বিস্ময় শেষ হত না। খায়রুলদের পুরোনো আমলের দালানের বাসাটা ছিল স্কুলের পাশেই। সেই বিরাট বাসাটার শেষপ্রান্তে একটা ছোট্ট কুঠুরিতে বসে ও পড়াশোনা করত। আমাদের বাসা ছিল স্কুল থেকে পুরো একমাইল দূরে। প্রতিদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বা না দিয়েই ওর সঙ্গে কথা বলার লোভে হাঁটতে হাঁটতে আবার ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হতাম। ততক্ষণে বিকেলের রোদ পড়ে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। খায়রুল হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ার টেবিলে বসে গেছে। পাবনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও সম্ভবত ওদের বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার পর ওর বাড়ির বাইরে বেরোনোর অনুমতি ছিল না। আমি মধ্যযুগের ইয়োরোপীয় প্রেমিকদের মতো, ওর ঘরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে ওর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম এবং ওর সেই অমিত বিস্ময় শেষ করতে না পারার হতাশা নিয়ে আবার বাসায় ফিরে আসতাম। প্রতিদিন মনের ভেতর জন্ম নেওয়া হাজারো কথা ওকে বলে নিজেকে ভারমুক্ত না করা পর্যন্ত আমার শান্তি হত না। ওকে নিজের চেয়ে অনেক পরিণত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর পরিপূর্ণ মানুষ বলে মনে হত। খুবই রহস্যময় আর দুর্বোধ্য লাগত ওকে। আমি আমার অপরিণত বাচাল অসহায় শৈশব নিয়ে ওর সেই দুয়ে ব্যক্তিত্বের সামনে নিজের যাবতীয় প্রতিভা প্রমাণ করার জন্যে অসহায়ভাবে চেষ্টা করতাম এবং যত ব্যর্থ হতাম তত এ ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠতাম। ওর সঙ্গে গল্প করার মুহূর্তগুলো আমার অফুরন্ত কথায় মুখর হয়ে থাকত। শান্ত সুস্থির খায়রুল ছিল অসম্ভব ভালো শ্রোতা। আমার প্রগলভতায় ও বিরক্ত হত না। আমার বিশৃঙ্খল ও অনুপ্রাণিত কথাগুলোকে ও প্রাণভরে উপভোগ করত। ওকে আমার কথাগুলো উপভোগ করাতে পারছি দেখে গর্ব হত। ব্যক্তিত্ব আর মেধার দিক থেকে খায়রুলকে তখন খুবই উঁচুমাপের মনে হত। স্কুল ছেড়ে আসার পর ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল অনেকদিন পর, ১৯৯০-৯১-এর দিকে, আমাদের বয়স তখন পঞ্চাশের ওপর। ও তখন পাবনা কলেজের অধ্যাপক। ছেলেবেলার ওর সেই সম্পন্ন সমুন্নত ব্যক্তিত্ব তখনও আমার চোখে বিভা ছড়াচ্ছে। শৈশবের সেই চোখভরা বিস্ময় নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ যেন প্রচণ্ড হোঁচট খেলাম। দেখলাম চাকরি, ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন, আর সাধারণ হিশাব-নিকাশের বাইরে কিছুই যেন আর চেনে না ও। ওকে আমার কাছে খুবই সাধারণ মানুষ বলে মনে হল। ওর সাথে বলার মতো কথাই আমি খুঁজে পেলাম না।

    ৩

    আগেই বলেছি শৈশবে ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের বা মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদের যে বন্ধুত্ব হয় তার ভেতর প্রথম প্রেমের আলতো অনুভূতির ছোঁয়া থাকে। আমার শৈশবের প্রতিটি বন্ধুত্বের মধ্যেই প্রাক-প্রেমের এই স্নিগ্ধ ছোঁয়া অনুভব করেছি। এই অনুভূতি যার জন্যে সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিলাম সে নিজাম। নিজামরা ছিল বিত্তশালী, বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুয়ায়, ওখান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ওর ব্যারিস্টার বাবা ১৯৪৭-এর পর পাবনায় এসে হক মোটর কোম্পানি নামে পাবনা- ঈশ্বরদী বাস সার্ভিস খুলেছিলেন। ওর আব্বা প্রায়ই থাকতেন ভারতে, মোটর কোম্পানি চালানোর ভার ছিল ওর মামা আর নিজামের ওপর।

    নিজাম ছিল সুদর্শন আর প্রাণবন্ত। ওর হাস্যোজ্জ্বল বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করেছিল। অরুণ যে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’-এর কথা বলেছিল, নিজামই ছিল আমার কৈশোরের সেই ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। সবদিক থেকে সবার মধ্যে ও-ই ছিল সবার ওপরে। আমার আশংকা ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের মধ্যে একটা আধা-রোমান্টিক ব্যাপার ছিল। ঐ বয়সের বন্ধুত্বের মতো এই আবেগ ছিল সুন্দর, বেদনাময় ও কৈশোরিক। আমাদের এক অসাধারণ উর্দুর শিক্ষক ছিলেন, নাম কসিমউদ্দীন আহমদ। দরাজ কণ্ঠে গভীর দরদ ঢেলে তিনি ক্লাসে আমাদের উর্দু কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। যখন তিনি মোমেনের সেই বিখ্যাত কবিতাটি বলতেন,

    ‘ওহ যো হামামে তুম মে কারার যা তুমহে ইয়াদ হোকে না ইয়দ হো’

    সেই যে তোমার আমার মধ্যে অঙ্গীকার ছিল, তোমার তা মনে আছে কি না জানি না (কিন্তু আমার আছে), তখন স্বপ্ন আর বেদনার ভেতর থেকে মনে হত আমার এই প্রতিজ্ঞা যেন নিজামের সঙ্গেই ছিল, নিজাম সে শপথ ভুলে গেলেও আমি কোনোদিন ভুলব না। কোনো কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে স্যার যখনই ‘বন্ধু’ কথাটা বলতেন, তখনই আমার চোখে নিজামের সুন্দর মুখটা ভেসে উঠত আর আমার সারা অস্তিত্ব বেদনায় ভরে যেত।

    কৈশোর সময়টা ভারী হীনমন্যতার সময়। যৌবন দূর থেকে অজানা হাতছানিতে ডাকছে, অথচ এখনও তার দেখা পাবার নাম নেই। চারপাশের পৃথিবীর তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভেতর এ এক উটকো অপ্রস্তুত দুঃসহ জীবন। বড়দের হাতগুলো কারণে অকারণে কেবলি কানের দিকে এগিয়ে আসার জন্যে উশখুশ করছে, কোনো যোগ্যতা বা সাফল্য দিয়ে কারো কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়া যাচ্ছে না, চেহারাতেও কেমন একটা বেয়াড়া রুক্ষতা—সেখানে না আছে শৈশবের স্নিগ্ধতা, না আছে যৌবনের দীপ্তি—যেন এমনি একটা তুচ্ছ উৎকট কর্কশ অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচার জন্যেই কিশোরেরা পৃথিবীতে আসে। এসব কারণে আমার মনে হয়, কিশোর বয়সের একটা প্রধান ইচ্ছা : বড় হতে চাওয়া। কবে কলেজে উঠব, বড়র মর্যাদা নিয়ে সবার সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াব, সবাই খাতির করে মূল্য দিয়ে কথা বলবে, সেই দুর্লভ দিনগুলোর জন্যে শৈশব কাঙালের মতো প্রতীক্ষা করে। মনে আছে চুল ছাঁটতে সেলুনে ঢুকে ফিরে ফিরে আয়নায় নিজের দিকে কী করুণ চোখেই না তাকাতাম। গোঁফের বা দাড়ির অস্পষ্ট রেখা কোথাও কোনোভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কি না আতিপাতি করে খুঁজতাম। কবে বড়দের মতো গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে সমাজে একজন সম্মানজনক মানুষে পরিণত হব সেই অবিশ্বাস্য দিনের দুরাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। বয়ঃসন্ধির এই সময়টা সত্যি খুব বিমর্ষতায় ভরা। এতটুকু মর্যাদা নেই। উদ্ধত অসুন্দর বেয়াড়া একটা জীবন। অথচ একে পেরিয়ে কোনোমতে একবার যৌবনের দর্পিত সাম্রাজ্যে পা ফেলতে পারলেই রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গে—অসম্পূর্ণ মনুষ্যত্বের অভিশাপ থেকে একলাফে যৌবনের যৌবরাজ্য। আহ্ কী জ্যোতির্ময় মুক্তি! শৈশব আমাদের জীবনের বেলাভূমিতে আনে, যৌবন মনুষ্যত্বের মর্যাদায়

    ৪

    পাবনা জিলা স্কুলের কাছেই বড় রাস্তার ওপর হুবহু একই চেহারার দুটো দৃষ্টিনন্দন দোতলা বাড়ি : দুটোর নামই হেরাজ ম্যানশন। বাড়িদুটোর একটাতে আমাদের এক সহপাঠী থাকত। একদিন আমরা কয়েকজন বন্ধু ওদের বাসায় আড্ডা দিতে গেছি। সুঠাম শরীরের নিজাম ছিল আমাদের চাইতে এমনিতেই কিছুটা লম্বা। সেদিন শাদা ট্রাউজারের সঙ্গে ফুলহাতা শাদা শার্টে আর চকচকে জুতোয় ওকে আরও সুন্দর লাগছিল। আড্ডা শেষ করে আমরা কয়েকজন বাসাটা থেকে বেরিয়ে সামনের মাঠে এসে দাঁড়িয়েছি, নিজাম আর বাকিরা পেছনে পেছনে আসছে। একসময় নিজাম বারান্দা থেকে ঈষৎ দৌড়ানোর ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে মাঠে এসে নামল। বলিষ্ঠ সুন্দর ভঙ্গি। মুহূর্তের জন্যে ওকে আমার যুবকের মতো লাগল। ওর ভেতরের দৃপ্ত যৌবনটাকে আমি দেখতে পেলাম। সেই যৌবনের উষ্ণ রোমশ গন্ধ পর্যন্ত যেন অনুভব করলাম। আমার সমবয়সী কারো মধ্যে সেই প্রথম আমি যৌবন দেখি। এ আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। নিজেকে খানিকটা ছোট লাগল ওর সামনে। দুরাশার মতো মনে হল সেদিন কতদূর, যেদিন দৃপ্ত অবিশ্বাস্য যৌবন এসে আমাকেও অমনি রঙিন আর আকাঙ্ক্ষিত করে তুলবে? ওর ব্যাপারে ওর চাচাত-খালাত বোনদের উৎসাহের কথা ওর মুখে প্রায়ই শুনতাম। সেদিন সেই উৎসাহের জলজ্যান্ত কারণ দেখতে পেলাম।

    আমার মতো আবেগের সর্বগ্রাসিতা খায়রুল বা নিজাম কারো মধ্যেই ছিল না। বন্ধুত্বের বিষণ্ন বেদনায় ওদের চোখ আমার মতো ভিজে উঠত না। তবু সব মিলে নিজামকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। আমার বন্ধুত্বের অনুভূতিগুলো ও খুব একটা বুঝত না, তবু ওকে ভালো লাগত। পৃথিবীতে ভালোবাসার ভার যার বেশি ভালোবাসার দুঃখগুলোও তাকে বেশি বইতে হয়। আমাকেও তাই করতে হয়েছিল। হয়ত সারাজীবনই তা করতে হয়েছে। যাহোক, শৈশবের বন্ধুদের মধ্যে ও-ই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর আমি পাবনা ছেড়ে বাগেরহাটে চলে গেলে এই বন্ধুত্ব একটা বড়ধরনের বিচ্ছেদের সামনে পড়ে। আমি বাগেরহাটের গ্রামের বাড়িতে থাকলেও নিজামের চেহারাটা সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। আকাশে পৃথিবীতে আমি ওকে দেখতে পেতাম। এনভেলাপে ভরে মোটা মোটা চিঠি লিখতাম ওকে। চিঠিগুলো থাকত আমার চোখের পানিতে ভেজা। একদিন একটা পোস্টকার্ডে ছোট্ট করে একটা চিঠি লিখতে বসেছিলাম। পোস্টকার্ড শেষ হল কিন্তু মনের আকুলতা থামল না। অগত্যা আর একটা পোস্টকার্ড নিলাম, তাতেও শেষ হল না। উপায় না দেখে পোস্ট অফিস থেকে একগাদা পোস্টকার্ড এনে একের পর এক চৌদ্দটা পোস্টকার্ড লিখে তবে সে-আবেগ বিশ্রাম নিল। চৌদ্দটা পোস্টকার্ডের লেখা চৌদ্দ পর্বের সে বিশাল চিঠি গ্রামের পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করলাম। একজনের কাছে এত পোস্টকার্ডে লেখা কোনো চিঠি গ্রামের পোস্টমাস্টারও এর আগে দেখেননি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণভাবে মুচকি হাসলেন। নিজামের সঙ্গে সেই বিচ্ছেদ আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছিল।

    বছর কয়েক পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমরা আবার কাছাকাছি হলাম। কিন্তু ততদিনে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। আমরা অপরিচিতও হয়ে গেছি। তখন ওর দিনরাত্রির চিন্তা ইঞ্জিনিয়ারিং, আমার সাহিত্য। দেখলাম আমাদের ভাবনা, ভাষা, অনুভূতি কোনোকিছুই আর আগের মতো মিলছে না। তাছাড়া এরই মধ্যে আমাদের চেহারা থেকেও কৈশোরের সেই নমনীয় মাধুর্য চলে গিয়ে সেখানে যৌবনের রূঢ় বলিষ্ঠ দুটো মুখ জেগে উঠেছে। আমাদের দুজনের কাছেই এই মানুষদুটোকে অচেনা লাগল। আমরা দুজনের কেউই আমাদের ভেতরকার আগের সেই কৈশোরিক বন্ধুকে আর অনুভব করতে পারলাম না। তাছাড়া বন্ধুত্বের আবেগের জায়গায় অন্য একটা আবেগ ততদিনে আমাদের জীবনের দখল নিয়ে নিয়েছে। তার নাম প্রেমের আবেগ। কাজেই বন্ধুত্বের সেই হারানো সুর যেন আর কিছুতেই ফিরে এল না।

    পাবনা জিলা স্কুলে হায়াত ছিল আমার আরেক বন্ধু। ছোটখাটো, গোলগাল মুখের দোহারা গড়নের হায়াতের মনটা ছিল মায়ের মতো মমতায় স্নিগ্ধ। খুবই আন্তরিক আর সরল ছিল হায়াত। দুজন দুজনের হাত ধরে দুই অবোধ শিশুর মতন সবখানে আমরা হেঁটে বেড়াতাম। তখন আমাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকত না। আমাদের ভেতরকার সেই শিশুদুটো আজও একইরকম আছে। এখন ও একজন শাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ, দাড়ি না থাকলেও আমিও তাই, তবু এখনও দেখা হলে আমরা, এই প্রবীণ দুটি মানুষ, ছেলেবেলার সেই অবোধ শিশুদুটোর মতোই আজও হাত ধরে হেঁটে বেড়াতে থাকি।

    নিজাম, খায়রুল দুজনই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। নিজাম মস্তিষ্কের ক্যানসারে, খায়রুল হৃদরোগে আর ডেঙ্গুতে। আমি আর হায়াত এখন বাকি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে অসুস্থ মির্জা গালিবকে তাঁর এক বন্ধু চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন তিনি কেমন আছেন? উত্তরে গালিব লিখেছিলেন, দিন কয়েক পর প্রতিবেশীর কাছ থেকে জেনে নিও। আমাদের ব্যাপারটা জানতে হলেও পাঠককে হয়ত কিছুদিনের মধ্যে তাই করতে হবে।

    পাবনা জিলা স্কুলের গল্প নিয়ে আমি এখনও অসম্ভব স্মৃতিবিধুরতায় ভুগি। পাবনা থেকে চলে আসার প্রায় তিরিশ বছর পর একবার আমি গিয়েছিলাম সেই জিলা স্কুলে। আমি যখন স্কুলে ঢুকছি তখন স্কুল বন্ধ। কেউ নেই। মনে হল স্কুলটা এক আকাশ বিষণ্ণতার নিচে যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে বসে বসে কাঁদছে। সমস্ত শৈশবটাকে আমার চারপাশে হেঁটে বেড়াতে দেখলাম যেন। স্কুলের আনাচে- কানাচে ধরে হেঁটে বেড়ানোর সময়, আমার শৈশবদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে ফিরে ফিরে দেখা হল অনেকবার—গাছের নিচে, মাঠে, ক্লাসরুমে, সব জায়গায়। কী যে কষ্ট আর সুখ একই সঙ্গে!

    অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর একজায়গায় অ্যালিস একবার কেন যেন হঠাৎ, কী একটা ওষুধ খেয়ে বোধহয়, খুব বিশাল আকৃতির হয়ে গিয়েছিল। ওভাবে হঠাৎ অতবড় হওয়ায় দুঃখে সে অনেক কেঁদেছিল। তার চোখের পানির বড় বড় ফোঁটায় ঘরের মেঝে ডুবে গিয়েছিল। এরপর একসময় আবার ভুল করে আরেকটা কী ওষুধ খেয়ে যেন সে খুব ছোট হয়ে গেল। এত ছোট যে তার নিজেরই চোখের পানিতে ডুবে যাওয়া মেঝেতে নিজেই সাঁতরে বেড়াতে লাগল। আমাদের স্কুলটাতে সেদিন বিষণ্ন-মনে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে মনে হয়েছিল ঐ অ্যালিসের মতো। যেন আমার নিজের চোখের পানিতে নিজেই সাঁতরে বেড়াচ্ছি। শৈশবের যে মাধুর্য, যে স্মৃতি—এটা পরবর্তী জীবনের আর কোথাও নেই।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহযরত ওমর – আবদুল মওদুদ
    Next Article শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }