Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১২. প্রত্যাবর্তন ১

    চার মাস পর আমাকে হোস্টেল থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন মা। সে এক কান্ড বটে। যে মা’র সঙ্গে আমার দেখা করাই মানা ছিল, সেই মা’র হাতে সঁপে দেওয়া হল নিষিদ্ধ গন্দম। মা প্রায়ই হোস্টেল সুপারের সঙ্গে দেখা করে কাঁদতেন, বলতেন ওর বাবা একটা বিয়ে করবে, তাই মেয়েকে হোস্টেলে পাঠায়ে দিছে। সবই হচ্ছে ষড়যন্ত্র। বাড়ি বিক্রি কইরা দিয়া নতুন বউ নিয়া সে আলাদা বাড়িতে থাকবে। এখন মেয়েকে আমার কাছে দিয়া দেন, দুই ছেলের কেউই কাছে নাই, মেয়ে বাড়িতে থাকবে, দেখি কী কইরা তার বাপ বাড়ি বিক্রি করে, কী কইরা বিয়ে করে আরেকটা।

    সুপারের মন মা’র কান্নায় গলল। মেয়ে দিয়ে দিলেন মায়ের কাছে।

    চার মাস পর বাড়ি ফেরে মেয়ে।

    ইয়াসমিনকেও ফেরত আনা হয়েছে মির্জাপুর থেকে।

    দু’মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে বসে থাকেন মা। সন্ত্রস্ত।

    বাবা বাড়ি ঢুকে আমাদের দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। বাবার চোখ লাল হতে থাকে। চোয়াল শক্ত হতে থাকে। দাঁতে লাগতে থাকে দাঁত। ভয়ে মিইয়ে থাকি আমি, ইয়াসমিন মা’র পিঠের পেছনে লুকোতে চেষ্টা করে মুখ।

    মেয়েদেরে ত, মা মিনমিন করে বলেন, জন্ম আমি দিছি। এদের উপর আমার অধিকার নাই নাকি!

    কথাটি মা ছুঁড়ে দেন বাতাসে, যার গায়ে লাগে লাগুক।

    বাবা টুঁ শব্দ করলেন না। বাড়িতে খাবার পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। নানার দোকান থেকে ঠোঙা করে খাবার এনে আমাদের খেতে দেন আর শব্দ ছুঁড়তে থাকেন প্রতিদিন বাতাসে–বিয়া করার খায়েশ হইছে। মেয়েদুইটারে দূর কইরা বিয়া করব। এই শয়তানি আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিব না। বেডা পুইল্যা খেতা লইয়া শহরে আইছিল, আমার বাপে বেডারে টেকা পইসা দিয়া বাচাইছে।

    মা হাঁটতে হাঁটতে শব্দ ছোঁড়েন বাতাসে। বাতাসে, দেখে তাই মনে হয়, আসলে ছোঁড়েন বাবার উদ্দেশে। সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে নয়, বাবা যে ঘরে বসে আছেন, তার পাশের ঘর আর বারান্দা থেকে উঁচুস্বরে, এমন উঁচুস্বরে যেন কান খাড়া না করেই বাবা শুনতে পান।

    ইস্কুলে যাওয়ার রিক্সা ভাড়া দেওয়াও বন্ধ করে দিলেন বাবা। বন্ধ রইল ইস্কুলে যাওয়া। মা বলেন দেখি কয়দিন লেখাপড়ার খরচ না দিয়া পারে!

    মা’র বিশ্বাস এ ব্যাপারে অভিমান বা রাগ দেখিয়ে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয় বাবার। তিনদিন ইস্কুলে না যাওয়া লক্ষ করে বাবা শেষ পর্যন্ত নিজেই তাঁর নীরবতা ভাঙেন। ভোরবেলা ঠান্ডা পানিতে গোসল করে কাপড় চোপড় পরে তৈরি হয়ে আমাকে ডেকে গলা কেশে, যেন গলার তলে কফ জমে আছে, বলেন–কি লেখাপড়া করার আর দরকার নাই!

    আমি চুপ।

    লেখাপড়া করার আমার দরকার আছে কি নেই, তা বাবাই সিদ্ধান্ত নেন। আমার সিদ্ধান্তের কোনও প্রায়োজন হয় না।

    যদি দরকার না থাকে, বাবা বলেন চোখ কড়িকাঠে রেখে, তাইলে সোজাসুজি বইলা দেও। আমারও আর চিন্তা করার দরকার নাই। তুমার ভাইয়েরা ত বইলা দিছে আমারে। বইলা দিছে তারা লেখাপড়া করবে না। মাস মাস টাকা পাঠাই নোমানরে, ও কয় এইবার নাকি পরীক্ষা দিব না, দিব পরের বার। আর তুমার আরেক ভাই, তার জীবন ত শেষই। তুমরাও ওই পথে যাইতে চাইলে কও, তাইলে আর টাকা পয়সা খরচা কইরা তুমাদেরে ইস্কুলে পড়ানির কুনো মানে নাই।

    আমি উদাস দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই উঠোনের বড় হয়ে যাওয়া ঘাসে, শ্যাওলা পড়া কলতলায়, পেয়ারা গাছের ডালে বসে থাকা একটি পাতিকাকের লেজে। বাবার সামনে মুখ খুলে আমার অভ্যেস নেই। যত নির্বাক হই, তত মঙ্গল। যত নিশ্চল হই, তত বাবা নিশ্চিন্ত হন। এরকমই নিয়ম যে, বাবা যা খুশি বলে যাবেন, মাথা নিচু করে, চোখ নামিয়ে তা নিঃশব্দে শুনে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করবেন অথবা চড় কষাবেন গালে, মাথা পেতে সবই গ্রহণ করতে হবে আমাকে। বাবা এই যে বললেন ছোটদার পথে যেতে চাইলে আমি যেন তাকে বলি, তিনি আমাকে যেতে দেবেন। আসলে এ নেহাতই কথার কথা। যদি সত্যিই বলি আমি ছোটদার মত হতে চাই, ইস্কুলে টিস্কুলে আর যাব না, তিনি কিছুতেই তা হতে দেবেন না, বরং পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলবেন আমার।

    — ইস্কুলে যাস না ক্যান! বাবা ড্রাম পেটানো স্বরে বলেন। হঠাৎ এমন বিকট আওয়াজে আমার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। চোখ নামিয়ে আনি পাতিকাকের লেজ থেকে। প্রশ্নটির উত্তর আসলেই বাবা জানতে চাইছেন, গর্জে উঠে বোঝান। উত্তরটি তিনি জানেন, তবু তাঁর জানা উত্তরটিই তাঁকে আবার নতুন করে জানাতে হবে আমাকে। আমি যে জানি আমার অন্যায়ের জন্য দায়ি তিনি, আমি নই, তা জানাবার জন্য তাঁকে বলি, যতটা স্বর তাঁর সামনে ওঠানো সম্ভব–রিক্সাভাড়া নাই।

    — রিক্সাভাড়া নাই ক্যান? মায়ের অস্টকাডি হইছস! তর মায়ে মুখে তুইলা খাওয়াইতাছে। রিক্সাভাড়া যোগাড় করতে পারে না!

    দুটো টাকা বাবা ছুঁড়ে দেন আমার মুখের ওপর, টাকা দুটো মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে। পড়ুক, আমি ভাবি, এ ভাবেই পড়ে থাক। ভাবিই কেবল, আমার ভাবনা থেতো করে দিয়ে বাবা ফুঁসতে থাকেন আমার নির্লিপ্তির দিকে চেয়ে, ঠিকই উবু হয়ে টাকা দুটো তুলি। বাবাকে ছোটদার কাছেই কেবল একবার হেরে যেতে দেখেছি। তিনি এবার হেরেছেন কি না জানি না, তবে নিঃশব্দে নতি স্বীকার করলেন, মেনে নিলেন আমাদের প্রত্যাবর্তন, অবশ্য বুঝতে দিলেন না যে তিনি মেনে নিয়েছেন। তিনি আর চ্যাংদোলা করে আমাদের হোস্টেলে ফেরত পাঠান না। পাঠান না ঠিকই কিন্তু বাড়িটিকে অন্ধকার কারাগার বানিয়ে ফেলেন। রাস্তা দেখা যায় যে জানালাগুলোয় দাঁড়ালে, সেগুলো পাকাপাকি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। গরুগাড়ি ভরে ইট বালু সিমেন্ট কিনে রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়ির চারদিক ঘিরে যে দেয়াল, তা দ্বিগুণ উঁচু করে তুলে দেন জেলের দেয়ালের মত, বাইরের সঙ্গে ভেতরের কোনও যোগাযোগ রইল না। ছাদে ওঠা নিষেধ। ছাদে উঠলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামান ছাদ থেকে। ফের কখনও উঠলে পায়ের টেংরি ভেঙে ফেলবেন বলেন। যে ছাদ আমাদের বৃষ্টিতে ভিজে গান গেয়ে নাচার, মিছিমিছির রান্নাবাড়ির, রেলিংএ হেলান দিয়ে আউট বই পড়ার, দাঁড়িয়ে পাড়ার মানুষদের নাড়ি নক্ষত্র দেখার, চমৎকার জায়গা ছিল, সে ছাদ হয়ে উঠল নিষিদ্ধ। আমার চলাচলের সীমানা আকস্মিক হৃাস পাচ্ছে, বুঝি, কেন, ঠিক বুঝি না। ছাদ থেকে বাইরের জগতখানা আমার অল্প অল্প করে চেনা হয়ে উঠছিল। মিঠে হাওয়ায় ছাদে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ এসে ভিড় করত মাথায়, গুঁড়ি গুঁড়ি ঝিরি ঝিরি শব্দ। বৃষ্টির মত। আমি সেই শব্দ দিয়ে মনে মনে মালা গাঁথতাম।

    ছাদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ছাদের নেশা আমাকে আরও পেয়ে বসে। বাবা বাড়ি থেকে বেরোলেই দৌড়ে ছাদে উঠি। কালো ফটকে বাবা আসার শব্দ হলে ঝড়ো বাতাসের মত নিচে নেমে নিষ্পাপ শিশুর মত মুখ করে বসে থাকি পড়ার টেবিলে। সীমানা যত ক্ষুদ্র হয় আমার, বাঁধ ভাঙার প্রবল স্পৃহা তত আমাকে উন্মত্ত করে। ভেতরে এবং বাইরে দুটো আদল আমি টের পেতে থাকি আমার। একটি উৎসুক, আরেকটি নিস্পৃহ।

    বাবা কেন ওসব করতেন, মাস কয় গেলে বুঝেছি যে বাবার ভয় ছিল আমার না আবার কারও সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় আর লেখাপড়া ছেড়ে কোনও বখাটের হাত ধরে আমিও বাড়ি থেকে পালাই। ইস্কুল এবং বাড়ির বাঁধা গন্ডির ভেতরে আমার জীবন আটকা পড়ে রইল। ওই আটকা পড়া জীবনে রতন এসে খুশির স্রোতে আমাকে ভাসিয়েছিল ক’দিন। রতন আসত টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা গ্রাম থেকে, দাদার ঘরে ঘুমোত, বিকেলে বসত চোর পুলিশ খেলতে আমাদের নিয়ে। চোর পুলিশ খেলাটি কাগজের খেলা। ছোট ছোট কাগজে চোর, পুলিশ, ডাকাত লিখে ভাঁজ করে ছুঁড়ে দিত, যে কোনও একটি তুলতে হত। পুলিশ লেখা কাগজ তুললে আমাকে অনুমান করে বলতে হত বাকি দুজনের কে চোর অথবা কে ডাকাত। ভুল হলে ঘর ফাটিয়ে বলত ডাব্বা। রতন ডাব্বাই বলত গোল্লা পাওয়াকে। রতন বাবার এক ডাক্তার বন্ধুর ছেলে, তার জন্য বাড়িটির দ্বার বরাবরই অবারিত ছিল, থাকারই কথা, বাবা যখন অর্থকষ্টে ছিলেন, ছিলেন একসময়, আমার জন্মের আগে কখনও, ডাক্তার বন্ধুটি তাঁকে দু’হাত খুলে টাকা দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে রতন। মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি নিয়ে চুল উড়িয়ে শার্ট উড়িয়ে সে দৌড়োত সারা বাড়ি, সে ছিল ঘরের লোকের মত অথবা না হলেও অন্তত ভাব করত। বাড়ি এসেই গামছা হাতে নিয়ে চলে যেত গোসলখানায়, গোসল সেরে ফর্সা চেহারাকে দ্বিগুণ ফর্সা বানিয়ে কায়দা করে চুল আঁচড়ে কী খালা কি রানছেন, খেতে দেন বলে রান্নাঘরে ঢুকে যেত। মা আবার রতনের মা বুলবুলকে বড় ভালবাসতেন, রতনকে খেতে বসিয়ে বুলবুল কি এখনও আগের মত দেখতে! জিজ্ঞেস করেন মা, প্রতিবারই করেন, রতন যখনই আসে। বুলবুল দেখতে অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন, মা বলেন। মা’কে কারও সৌন্দর্য নিয়ে এত উচ্ছঅজ্ঞসত হতে আর দেখিনি। সেই রতন আমাদের নিয়ে চোর পুলিশ খেলে, লুডু খেলে, তাসের যাদু দেখিয়ে দেখিয়ে আমার ছাদে না উঠতে পারার কষ্টকে খানিকটা কমিয়েছিল। কিন্তু সেবার যাওয়ার দিন একটি ভাঁজ করা কাগজ টেবিলে রেখে মাথায় বরাবরের মত চাটি মেরে বলল–ভাল থাকিস। গেলাম।

    রতন তো আর হাঁটে না, তার দুর্বার গতি তাকে উড়িয়ে নেয়। রতন হাওয়া হয়ে গেলে ভাঁজ করা কাগজটি খুলে দেখি চিঠি। লিখেছে, সে আমাকে ভীষণ ভালবাসে। লিখেছে আমি যদি তাকে না ভালবাসি তবে তার জীবন একেবারেই বৃথা। এবার ৮০, আদায় লিখে চিঠি শেষ করেছে। পড়ে আমার বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল। জিভ গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে। ভাঁজ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে, হাতের ঘামে ভিজে যাওয়া কাগজ গোসলখানায় গিয়ে আবার খুলি। ভালবাসি শব্দটির দিকে হাভাতের মত তাকিয়ে থাকি। চিঠিটি আমাকে লেখা, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। চিঠিটি যখন রতন দিয়েছে, কেউ কি দেখেছে আড়াল থেকে! কেউ দেখলে সব্বনাশ। চিঠিটি কারও হাতে কখনও পড়লে সব্বনাশ। আমার পায়ে পায়ে সব্বনাশ হাঁটে। আমার শ্বাসে শ্বাসে সব্বনাশ। চিঠিটি ছিঁড়ে ফেললে দুর্ভাবনা দূর হবে, কিন্তু ছিঁড়তে আমার ইচ্ছে করে না। থাকুক এটি। থাকুক ইতিহাস বইয়ের ভেতর, বালিশের তলায়, খুব গোপন জায়গায় চিঠিটি বেঁচে থাকুক। দোমড়ানো কাগজটিকে আগলে রাখি ঠিকই কিন্তু রতনের জন্য আমার কোনও ভালবাসা জন্মায় না, জন্মায় কেবল চিঠিটির জন্য।

    চিঠিটি বাবা আবিষ্কার করেন অল্প কিছুদিন পরই। তিনি, আমি যখন ইস্কুলে, বাড়িতে আমার বইপত্র ঘেঁটে দেখেছেন লেখাপড়া কি রকম করছি আমি, বইয়ের কত পৃষ্ঠা অবদি পড়ার দাগ আছে, খাতায় কতদূর কি লেখা হয়েছে, অঙ্ক কষার নমুনাই বা কেমন, এসব। ঘাঁটতে গিয়ে চিঠিটি হাতে পড়ে তাঁর। আমাকে তিনি ভাল মন্দ কিছু বলেননি। কেবল টাঙ্গাইলে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ডাক্তার বন্ধুকে, রতন যেন কোনওদিন তাঁর বাড়ির ধারেকাছে না আসে।

    রতন না এলে আমার বয়েই গেল। মনে মনে বলি।

    বাবার বন্ধুটি অপমানিত হয়েছেন বলে বন্ধুটির জন্য, যাঁকে কোনওদিন চোখে দেখিনি, মায়া হতে লাগল। নিজেকেও দেখলাম কুণ্ঠিত হতে, যেন সকল অপরাধ আমার। যেন রতন যে আমাকে চিঠি লিখেছে এর সব দায়ভার আমার। সব পাপ আমার।

    আমাকে আগলে রাখার নানা গভীর গোপন ষড়যন্ত্রে বাবা যখন ব্যস্ত, তখনই একদিন বাবা চোখে মুখে বিষম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেন–জিনিসপত্রের দাম বাইড়া গেছে, এখন থেইকা একবেলা ভাত, রাত্রে রুটি খাইতে হবে সবার।

    রুটি? ভাতের বদলে? বাবা এ আবার নতুন কি তামাশা শুরু করলেন! মা গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলেন–বিয়া করছে বুধয়, বউ খাওয়ানি লাগতাছে। এইদিকে শাতাইয়া ওই দিকে খাওয়াইব।

    মা মনে হয় ভুল বোঝেন। রাস্তায় শয়ে শয়ে ভিখিরিদের হাঁটতে দেখে রিক্সাঅলাদের বলতে শুনি শহরে বানের পানির লাহান মানুষ আসতাছে গেরাম উজাড় কইরা, ফসল নাই, খাওন নাই। রিক্সার ভেতরে বসে অবাক তাকিয়ে থাকি উন্মূল উদ্বাস্তুদের দিকে। হাতে বাসন ওদের। শুকনো বাসন। দৌড়োচ্ছে গাঙিনার পাড় থেকে নতুন বাজারের দিকে। ভিখিরিদের চোখ বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, বুকের হাড়গুলো যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরোবে, পেট মিশে যাচ্ছে পিঠে, যেন কঙ্কালের কাফেলা যাচ্ছে, কাফেলা থেকে পিছিয়ে পড়ে কেউ ধুঁকছে নর্দমার সামনে, কেউ ভাত ভাত বলে চেঁচাচ্ছে বড় বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের কালো ফটকের সামনে দাঁড়িয়েও ওরা একমুঠো ভাত চায়। পান্তা হোক, পচা হোক, একমুঠো ভাত।

    দেখে, ইস্কুল ফেরা ভরপেট আমি দৌড়ে যাই ভিক্ষে আনতে, দু’মুঠ করে চালই তো। দেখি চালের ড্রামে তালা ঝুলছে। বাবর তালা। বড় শক্ত তালা।

    মা ভাত দেও, ভিক্ষা চাইতাছে মানুষ, ওরা মনে হয় অনেকদিন খায় না। প্রচন্ড উৎকণ্ঠায় আমি নামাজে ডুবে থাকা মা’কে বলি।

    মা মোনাজাত শেষ করে সালাম ফিরিয়ে হাতে চুমু খেয়ে জায়নামাজ গুটিয়ে শুকনো মুখে বলেন, ভাত নাই।

    ভিখিরিদের মা কখনও ফেরাননি আগে। দু’মুঠো করে চাল দেওয়ার নিয়ম বরাবরই এ বাড়িতে ছিল। বাড়তি ভাত ফেলে দেওয়া হয় পাতিল পাতিল, গরমে ভাত পচে যায় বলে এক রাতেই। মাঝে মাঝে ভিখিরিদের পান্তা খাওয়ানো হত। এখন পান্তাও নেই। দুপুরে থালার ভাত শেষ করে আঙুল চুষতে চুষতে বলেছিলাম–মা আরেকটু ভাত দেও।

    যে আমাকে জোর করে ভাত খাওয়ানো হত, খেতে অরুচি হত, গল্প বলে বলে, থালের কিনারে মাছ মাখা ভাত নলা বানিয়ে মালার মত রেখে মা বলতেন, এইটা হইল বাঘ, এইটা সিংহ, এইটা হাতি, এইটা ভালুক–এইতো ভালুক টারে গিলে ফেল দেখি মা আমার, ওয়াও। ভালুক ভয় পাচ্ছে তোমাকে দেকে। এইবার হাতিটাকে খাও। গল্পের মজায় খেতাম। মা’র কত রকম কায়দা ছিল আমাকে খাওয়ানোর। মন দিয়ে পড়ছি হঠাৎ হা কর ত হা কর খুব মজার জিনিস বলে মুখে ঢকিয়ে দিতেন খাবার। পড়তে পড়তে হঠাৎ খেয়াল হলে যে আমাকে খাওয়াচ্ছেন অমনি আর না, সর সর, বলে মা’কে সরিয়ে দিয়েছি। মা আমাকে খাওয়াবেনই। আম, আনারস, তরমুজ কেটে থালে কাটা চামচ দিয়ে রেখে যান টেবিলে, যেন পড়তে পড়তে খাই। ভাত পাতে রেখে উঠে যাওয়া ছিল আমার চিরকালের স্বভাব। সেই আমি আঙুল চেটে ভাত খেয়ে বসে থাকি ১৯৭৪এ, মা বলেন– ভাত নাই আর।

    আমরা কি গরিব হয়ে গেলাম হঠাৎ?

    ভাত চাইলে ভাত দেওয়া হয় না, এ এক আজব ঘটনা, অন্তত এ বাড়িতে। ভিখিরিদের ভিক্ষে দেওয়া হয় না, এ ই বা কেন!

    বাবা রুটি খান দু’বেলা। মাও। কাজের লোকের জন্যও রুটি। ভাত ফোটে কেবল দু’মেয়ের জন্য। ড্রামের চাল ফুরোচ্ছে।

    বাবা কপালের দু’পাশের শিরা চেপে বলেন–দেশে দুর্ভিক্ষ।

    রাস্তায় ভিক্ষুক বাড়তেই থাকে। ঘরে ঘরে গিয়ে ভাতের বদলে ফ্যান চায়।

    একদিন আস্ত একটি জীবন্ত কঙ্কাল এসে দাঁড়াল দরজায়। বয়স বড়জোর সাত কী আট হবে ছেলেটির, দেখে আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। ছেলেটি কিছু চাইতে পারল না, ফ্যান কিংবা কিছু। গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছিল না ওর। আমি মা’কে ডেকে শিগরি কিছু খাবার দিতে বলি, যা হোক কিছু, আমার ভাগেরটুকু, আমি না হয় না খাব। মা ছেলেটিকে ভাত খেতে দিলেন। হাড়ের হাতখানা তুলে ছেলেটি মুখে পুরছিল ভাত। আমরা, না খেতে পেয়ে প্রায় মরতে বসা ছেলেটির গিলতে কষ্ট হচ্ছিল ভাত, দেখছিলাম। অভাব দেখেছি মানুষের, কিন্তু ভাতের অভাবে কাউকে কঙ্কাল হতে দেখিনি। মনে হচ্ছিল কিছু না খেতে খেতে ওর গলার ছিদ্র বুঝি বুজে এসেছে। এত ভাত তরকারি ফেলে দেওয়া হয়, বেড়াল কুকুর খায়, কাকের দল খায়। আর মানুষ মরছে না খেতে পেয়ে!

    মা রাতে রুটি চিবোতে চিবোতে বললেন–আমি ছুটু থাকতে একবার দুর্ভিক্ষ হইছিল, উড়োজাহাজ থেইকা ছাতু ফেলত, দৌড়াইয়া গিয়া ছাতু টুকাইয়া আইনা খাইতাম। ভাত পাই নাই।

    বাবাও তাঁর খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বলেন–ভাত খাইবা কি কইরা। চাল ছিল না ত। মানষের হাতে টাকা ছিল, কিন্তু বাজারে চাল নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে না খাইতে পাইয়া। কলিকাতার রাস্তায় শুনছি লাশের উপর লাশ। কলাগাছের ভিতরে যে শাদা অংশটা থাকে, ওইটা খাইয়া বাইচা থাকছি। আমাদের গেরামের কত লোক নিজের মেয়েরে বেইচা দিছে, জামাই বউরে বেইচা দিছে, কেবল দুইটা ভাতের জন্য।

    — কি জানি, এই দুর্ভিক্ষও পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরের মত হয় কি না। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

    ঘরের চাল শেষ হয়ে গেলে কী হবে! আর কি আমরা ভাত পাব না! না খেয়ে খেয়ে ইসরাইলের মত কঙ্কাল হতে হবে আমাদের! ভেবে পেটের ভেতর হাত পা সেঁধিয়ে যায় আমার। এরকম হয়েছিল আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য দজ্জাল পাঠাচ্ছেন বলে যখন খবর ছড়াল পীর বাড়ির লোকেরা। ভয়ংকর দেখতে দজ্জাল বিশাল রামদা দিয়ে তাদের, যাদের বিশ্বাস নেই আল্লাহর ওপর, গলা কাটবে। চোখ বুজলেই তখন চোখের সামনে ভাসত দজ্জাল তার কুৎসিত দাঁত মেলে পাহাড়ের মত উলঙ্গ শরীরখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে রামদায়ের পোচ দিচ্ছে গলায়, গা কেটে পাঁচ টুকরো করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন, আমি চিৎকার করছি বাবা গো মা গো বলে। আমি মরে যাচ্ছি আর হো হো করে হাসছে দজ্জাল। আমি তখন চোখ বুজে সমস্ত শক্তি খাটিয়ে শরীর খিঁচিয়ে ঈমান আনতে চাইতাম। ঈমান, মা বলেছেন, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, মুহম্মদ আল্লাহর রসুল, এ কথাটি কেবল বিশ্বাস করা। আমি ঈমান আনতে বাক্যটি বার বার আওড়াতাম। বিশ্বাস ব্যাপারটি তখন আমার কাছে খানিকটা রহস্যময়। মা যা বলেন তাই আমাকে বিশ্বাস করতে হয়। না দেখেও। না বুঝেও। জিন ভূত বিশ্বাস করার মত। অথবা ফটিং টিং, পায়ে কথা বলছে, তিনটে মাথা কাটা, যা আমি কখনও দেখিনি, কেবল শুনেছি, বিশ্বাস করা। ফটিং টিংএর ওপর ঈমান আনতে বললে আমাকে জপতে হত ফটিং টিং ফটিং টিং ফটিং টিং, যদি ফটিং টিংএর দজ্জাল পাঠিয়ে মানুষের গলা কাটার ক্ষমতা থাকত। মা বলেছিলেন যা তর নানির ঘরে শুইতে যা। তর মামারা তরে কত আদর করে। শরাফ মামা জোর করে আমাকে ন্যাংটো করেছিল, ব্যাপারটিকে আদর বলে আমার বিশ্বাস হয় নি। মা যা বলেন তা আমাকে বিশ্বাস করতে হয় বলেই সম্ভবত করা, আল্লাহ রসুল, জিন ভূত। আমাকে যদি অধিকার দেওয়া হত বিশ্বাসের, আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না যা আমাকে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে তা করতাম। ইস্কুলে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে বাতাসে গ্যাস আছে। আমাকে করতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় চোখে না দেখা জিনিসগুলো আসলে আমি চাপে পড়ে বিশ্বাস করছি। কেউ যদি ধমকে বলে একখানা ঘোড়া দেখ উড়ছে আকাশে। আমি সম্ভবত তাই দেখব। দুর্ভিক্ষের কঙ্কাল দেখছি নিজের আসন্ন শরীরে।

    মা বলেন–এই যে তগোরে কত কই ভাত ফালাইছ না। ভাতের একটা দানা মাটিত ফেললে আল্লাহ বেজার হন। ভাতের দাম কি এহন দেখলিা! ভাত না পাইয়া মানুষ মরতাছে।

    সোফার হাতলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন মা ড্ডনা জানি আমার ছেলে দুইটা উপাস করতাছে।

    — নোমানরে নিয়মিত টাকা পাঠাইতাছি, চিন্তা কইর না। বাবা সান্ত্বনা দেন। মা আসলে ভাবেন ছোটদার কথা। ছোটদাকে তো কেউ টাকা পাঠায় না। ছোটদা কোথায় আছেন, কেমন আছেন কেউ আমরা জানি না। মা তাঁর হারানো ছেলের জন্য ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বাবা অনেক রাত হইছে, যাও যাও ঘুমাইতে যাও বাক্যটি ছুঁড়ে দিয়ে নিজে শোবার ঘরে চলে যান।

    রাত পোহালেই ভিড় কালো ফটকে। মা ভাতের ফ্যান জমিয়ে রেখে ওদের বিলোন। বিকেলে ইসরাইল এসে দাঁড়ায় দরজায়, তাকে ভাত দেওয়া হয় খেতে।

    মিছিল যায় অন্ন চাই বস্ত্র চাই বাঁচার মত বাঁচার মত বাঁচতে চাই বলে।

    কমুনিস্ট পার্টির মিছিল গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে লাল কাপড় মেলে ধরছে — চাল দেন, গরিবরা মরছে। ওদের বাঁচান।

    মিছিল আমাদের বাড়িতেও ঢোকে। মিছিলের লোকের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা। আমাকে মিছিলের একজন বলে–যাও বাড়ির বড় কাউকে ডাক দাও। চাল দিতে বল। রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় আমার। আমি দৌড়ে গিয়ে মা’কে বলি–মা চাল দেও। লোক আইছে। চাল দিতেই হইব।

    মা রুখে ওঠেন।– চাল চাইলেই চাল দিতে হইব নাকি! তরা খাইবি কি!

    — অনেক লোকে চাল দিছে, কাপড়ের মধ্যে অনেক চাল, দেইখা যাও। তুমারে ডাকতাছে। হাত ধরে টানি মা’র।

    মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের বলেন–কি চান?

    যুবকের দল থেকে একজন এগিয়ে এসে বলে–চাল চাই মা চাল চাই। মানুষ মারা যাচ্ছে না খাইতে পাইয়া। তাই আমরা ছাত্ররা, চাল নিতাছি বাড়ি বাড়ি ঘুইরা, এইসব গরিবদের দেওয়া হবে খাইতে। চাল দেন। যেটুকু পারেন, সেটুকুই দেন।

    বাকি যুবকেরা সমস্বরে বলে ওঠে–কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না।

    উত্তেজনায় আমি কাঁপছি তখন। মা’কে খোঁচা দিয়ে বলি–চাল দেও মা, তালা ভাইঙা চাল বার কর।

    — তর বাবা মাইরা ফেলবে। মা গলা চেপে বলেন।

    — মারুক মা, মারুক। তবু চাল দেও। চল তালা ভাঙি। আমি বেপরোয়া।

    এত লোক মাঠে জমা হয়েছে দেখে মা খানিকটা ঘাবড়ে যান। বলেন–তর বাবারে একটা খবর দেওয়া গেলে ভাল অইত। এদেরে এহন আমি সামলাই কেমনে।

    কালো ফটক হাঁ করে খোলা। পাড়ার ছেলেরা ভিড় করেছে দেখতে ফটকের বাইরে। মা ইতস্তত করেন কোনও কিছুর উদ্যোগ নিতে। উত্তেজিত আমি উঠোন থেকে আধখানা ইট এনে ড্রামে লাগানো তালার ওপর ধরাম করে মারি। তিন ধরাম, চার ধরাম। তালা ভাঙে। বাবর তালা। বড় শক্ত তালা।

    অর্ধেক ড্রাম অবদি চাল। গামছা ভরে চাল তুলে দৌড়ে যাই মাঠে। মা হতবাক দাঁড়িয়ে আমার কান্ড দেখেন।

    চাল নিয়ে গান গাইতে গাইতে ছেলের দল চলে যায়। মুগ্ধ চোখে মিছিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অনুভব করি অসম্ভব এক অমল আনন্দ। ভেতর থেকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এক উদ্ধত আমি, অনড় অটল আমি। বিষম সাহসী আমি। স্বপ্নবান আমি। এই আমাকে, আমি নিজেই আপাদমস্তক দেখি আর বিস্মিত হই। এ কি সত্যিকার আমি, নাকি হঠাৎ বিকেলে যুবকের দল দেখে বিহ্বল হওয়া উঠতি উৎসুক কিশোরী মাত্র!

    মা ফ্যাকাসে মুখে খোলা ফটকের সিটকিনি বন্ধ করে আসেন ভেতর থেকে ।

    তর বাবা, মা বলেন, তরে আইজকা আর আস্ত রাখত না।

    আমি হেসে বলি–বাবার মাইর ত প্রত্যেকদিনই প্রায় খাইতে হয়। এইটা কি নতুন কিছু!

    মা বলেছিলেন কমুনিস্টরা খারাপ। ওরা খারাপ হলে গরিবদের জন্য ওরা চাল যোগাড় করছে কেন! এ তো অন্যায় নয় গরিবকে মরণ থেকে বাঁচানো। ওরা আল্লাহ মানে না, কিন্তু ওরা তো কোনও পাপ করছে না বরং পীড়িত মানুষের ওরা শুশ্রুষা করছে। ইসরাইলের মত কত মানুষ যারা রাস্তায় ধুঁকছে ক্ষিধেয়, তাদের মুখে খাবার দিতে চাইছে। আমার ইচ্ছে করে ওদের দলে ভিড়ে আমিও গান গেয়ে চাল যোগাড় করি। আমার ইচ্ছে করে নিজে না খেয়ে থাকি, যতদিন না দূর্ভিক্ষ দূর হচ্ছে। কিন্তু আমার ইচ্ছেয় কিছু হবার নয়। চাইলেই সীমানা ডিঙোতে পারি না। আমাকে আপাতত অপেক্ষা করতে হয় বাবার চাবুক খাবার। ছোটদার জন্য কেনা চাবুকটি বাবার বিছানার তোষকের তলে এখনও রাখা।

    বাবা বাড়ি ফিরে চালের ড্রামে চোখ ফেলেন, যা ফেলবেনই বলে আমার অনুমান ছিল। ভাঙা তালাটি ঝুলে থাকে ড্রামের গায়ে, বাবা যা হাতে নেবেন বলে অনুমান ছিল আমার। অনুমান ছিল ক্রুদ্ধ বাঘের মত বাবা সারা বাড়ি গর্জাবেন। বাবা তাই করেন। আমি শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি ঘরে। আশংকা করি বাবা তোষকের তল থেকে চাবুক খানা নিচ্ছেন হাতে, যেটি এক্ষুণি আমাকে রক্তাক্ত করবে। পিঠে অনুভব করতে থাকি যন্ত্রণা। ধনুকের মত বাঁকতে থাকে পিঠ। শিড়দাঁড়ায় তীব্র বাথা, যে ব্যথা আমার অচিরে হবে, তা আমি আগেই অনুভব করতে থাকি। বাবার হুংকারে বাড়ি কাঁপে। হিম হয়ে থাকে শরীর। কোটরে কোনও চোখ নয়, দুটো পাথর কেবল, সামনে এক ঘর অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। পালকের মত উড়ে যাচ্ছি কোথাও আমি, কোথায়, জানি না। রাজবাড়ি ইস্কুলের আঙিনায় মীরাবাঈএর শাদা মূর্তির মত নগ্ন হয়ে যাচ্ছি। আমি নিজেই নিজেকে নগ্ন করছি। আমার কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, একা আমি। এই জগত সংসার আমার জন্য নয়। আমি নির্বাণ লাভ করছি।

    মুহূর্তে নিথর হয়ে যায় সারা বাড়ি, যেন এ বাড়িতে কখনও কেউ ছিল না, থাকে না। যে যার গুহায় গিয়ে সম্ভবত লুকিয়েছে হুংকার শুনে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি আমার ডাক পড়ার পুলসেরাতের পুল পার হতে, কতখানি পাপ আমি করেছি তা প্রমাণ হবে আজ। আমার বিশ্বাস হতে থাকে আমি পাপ করিনি। এই প্রথম একটি বিশ্বাস আমি নিজে নির্মাণ করি। নিজের ওপর ঈমান আনতে থাকি ধনুকের মত বাঁকানো শরীরকে সিধে শক্ত করতে করতে। আওড়াতে থাকি যা বলব, বইয়ে লেখা ক্ষুধার্তদের খাবার দাও। তাই যখন লোকেরা আইসা চাল চাইল, আমি দিলাম।

    মা, আমি স্পষ্ট শুনি, বলছেন–চিল্লাও কেন, আস্তে কথা কইলেই ত হয়। ড্রামের তালা আমি ভাঙছি। মেয়েরা ক্ষিদায় কানতেছিল, তাই।

    — ক্ষিদায় কানব ক্যান। দুপুরে ভাত রান্ধো নাই! খায় নাই! বাবা বলেন।

    মা রান্নাঘরের বারান্দা থেকে সরু গলায় বলেন–ওই ভাতে ওদের হয় নাই। মাইপা চাল দিয়া গেছ দুই মেয়ের লাইগা খালি, আমার ভাত খাইতে ইচ্ছা হইছিল, খালি রুটি খাইয়া মানুষ পারে! তাই আমি খাইয়া নিছিলাম ওদের ভাগের থেইকা।

    — কত বড় সাহস তুমার তালা ভাঙছ। আমারে খবর দিলা না ক্যা! বাবার গলার স্বর তখনও নামেনি।

    –কেমনে দিয়াম! বাড়িত কেউ আছে যে খবর পাঠানি যাইব! মা কণ্ঠে খানিকটা রাগ মিশিয়ে বলেন।

    বাবার গর্জন থামে। আচমকা থামে।

    নিথর বাড়িখানা যেন আড়মোড়া ভেঙে জাগে এখন। বেরিয়ে আসতে থাকে গুহাবাসিরা, আলোয়। থাল বাসনের শব্দ হয় রান্নাঘরে। মা’র পায়ের শব্দ বারান্দায়। থপথপ। থপথপ।

    বাবা চলে গেলে বাইরে, মা বেল গাছের তল ধরে হেঁটে কালো ফটকের দিকে হাঁটেন। বোরখার তলে মা’র ফুলে ওঠা পেট।

    এরকম প্রায়ই হচ্ছে। বোরখার নিচে ফুলে ওঠা পেট আর বেল গাছের তলে মা’র হাওয়া হয়ে যাওয়া। মা’র পেছনে ছায়ার মত হেঁটে দেখি মা কালো ফটক নিঃশব্দে খুলে রিক্সা চড়ে মোড় নিচ্ছেন বাঁয়ে। পীর বাড়ির রাস্তা ডানে, নানিবাড়িও ডানে। তবে বাঁয়ে আবার কোন বাড়ি!

    –মা কই যাও তুমি! রিক্সা তুমারে নিয়া বাম দিকে যায়। বাম দিকে আবার কার বাড়ি! মা বাড়ি ফিরলে চোখ সরু করে বলি।

    মা ঠোঁটে বিরক্তির কাঁপন তুলে বলেন–নিজের কাম কর। এত কথা কইস না। মা’র এই স্বভাব, প্রশ্ন পছন্দ না হলে রাগ করেন, সে যেমন তেমন রাগ নয়। একবার আমার গালে এমন ওজনদার চড় মেরেছিলেন পীরের বাড়িত সেইদিন পুটলা ভইরা কি দিয়া আইছ? জিজ্ঞেস করেছিলাম বলে, যে, মাথা ঘুরে আমি থুবড়ে পড়েছি জানালার লোহায়।

    বাড়ির বাঁ রাস্তা ধরে কোন বাড়িতে যান মা তা সেদিন আমাকে বলেননি। ক’টা দিন গেলেই কিন্তু জিজ্ঞেস করেন, যাইবি দেখতে আমি কই যাই!

    আমি লাফিয়ে উঠে বলি– হ।

    মা আমাকে নিয়ে হেঁটে রওনা হন দেখাতে। হাঁটতে হাঁটতে গোলপুকুর পার পেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ইস্কুলের সামনে এক গলি, সেই গলিতে এক বস্তি, সেই বস্তির এক ছ’ফুট বাই ছ’ফুট বেড়ার ঘর, ঢুকি দেখি বসে আছে ছোটদা আর গীতা মিত্র। মা বোরখার তল থেকে ক’টি কৌটো বার করলেন। বড় কৌটোটিতে চাল।

    আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি দৃশ্য দেখে।

    –খবরদার এই কথা কুনো কাক পক্ষীও যেন না জানে। মা চোখ রাঙিয়ে বলেন। ঢোঁক গিলে বলি– আমি কাউরে কইতাম না।

    –আফরোজা, রান্ধো। ঘরে ডাইল আছে ত, না! মা কৌটোগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলেন।

    –আফরোজা কার নাম! জিজ্ঞেস করি।

    –ও মুসলমান হইছে ত। নাম আফরোজা। মা বেশ উচ্ছসিত গলায় বলেন।

    ছোট্ট চৌকিতে আফরোজা বসে ছিল মাথায় ঘোমটা পরে। ছোটদা শুকনো মুখে তার পাশে। ঘরে ওই চৌকিটি ছাড়া আছে মাটির মেঝেতে একটি মাটির চুলো আর দু’তিনটে বাসন কোসন।

    কোথায় সেই টেরি কাটা, শিস বাজানো বেলবটম যুবক! মুখ-শুকনো ছোটদাকে দেখে বিষম মায়া হয় আমার! এক জীর্ণ কুড়েঘরে দিন কাটাচ্ছেন! নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়, যে, তাঁকে যখন নির্যাতন সইতে হয়েছিল, হাত পা গুটিয়ে কেঁচোর মত বসেছিলাম। মুখখানাও সেলাই করে। আজকাল শেকলে বেঁধে মানুষ মানুষকে মারে! এক বাবাই পারেন এসব। ছোটদার জন্য কেউই কিছু করতে পারিনি কেবল আড়ালে চোখের জল ফেলা ছাড়া!

    –ছোটদা, তুমার অনেকগুলা চিঠি আইছে।

    চুলোয় আগুন ধরাতে ধরাতে ছোটদা বলেন–হুম।

    — কটন দা দেখি সেইদিন বাসার সামনে দিয়া যাইতাছে। জিগাস করল কামাল কই। আমি কিছু কই নাই। গলার স্বর খানিকটা বাড়িয়ে এবার।

    কোনও কথা না বলে ছোটদা চুলোয় পাতিল বসান। পাতিলে পানি ফোটে। অনভ্যস্ত হাতে চুলোয় খড়ি ঠেলেন তিনি। এরকম দৃশ্য সম্পূর্ণ নতুন আমার কাছে। ছোটদার, লক্ষ করি, কোনও আগ্রহ নেই গিটারের মাস্টার কটনদা বা তাঁর কাছে আসা চিঠিপত্তরের জন্য। তিনি, আমার ধারণা হয়, বদলে গেছেন এ ক’মাসে অনেক। মা’র কৌটোগুলো খুলে খুলে ঝুঁকে দেখছেন কী ওতে, চাল তেল, মশলা, রান্না করা মুরগির মাংস, দেখে দু’ঠোঁট চেপে আনন্দ আড়াল করে চুলোয় খড়ি ঠেলেন যেন খড়ি ঠেলার চেয়ে জরুরি কোনও কাজ জগতে আপাতত নেই। সম্ভবত খুব ক্ষিধে পেয়েছে ছোটদার। আগেও তো তাঁর ক্ষিধে পেত, তবু খাওয়ায় বড় অনিয়ম করতেন। সারা শহরে গুলতানি মেরে এসে বাড়া ভাত টেবিলে ফেলে আড্ডা পেটাতেন।

    আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ছোটদার লাজুক চোখের দিকে। কতদিন পর ছোটদাকে দেখছি। ভালবাসার জন্য অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়েছিলেন, ছোটদা অনেকটা তাই, পুরু গদি য়েচ্ছায় ছেড়ে ধুলোয় বিছানা পেতেছেন। ওদের ভালবাসার কুটিরখানাও, আমার বিশ্বাস জন্মে, ঐশ্বর্য্য ঠাসা। জাগতিক কোনও বিষয়াদিতে না হোক, অন্য কিছুতে। সে অন্য কিছুর ঠিক ব্যাখ্যা হয় না, অনুভব করতে হয় কেবল। বিষয় বাসনা বিসর্জন দিতে যে কেউ পারে না। খুব কম লোকের পক্ষে সম্ভব বৈরাগ্য বরণ করা। ছোটদা ডলি পালকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি নাকি ওকে নিয়ে গাছের তলে জীবন কাটাতে পারবেন। একই কথা গীতা মিত্রকেও লিখেছিলেন বত্রিশ পৃষ্ঠার এক চিঠিতে। কুড়েঘরে জীবন কাটানো অনেকটা গাছের তলায় জীবন কাটানোর মতই। ছোটদা পারেনও ঝুঁকি নিতে! বিত্ত বৈভব তোয়াক্কা করেন না। সব বাঁধন ছুটে এখন মুক্ত এক মানুষ তিনি, কেউ তাঁকে এখন শাসন বা শোষণ কিছুই করছে না, বলে দিচ্ছে না কখন ঘরে ফিরতে হবে, কখন পড়তে বসতে হবে, কিছু। আমারও মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে শেকল ভেঙে। অদৃশ্য এক শেকল অনুভব করি আমার সারা গায়ে। ছোটদাকে বাঁধা শেকলটির মত শেকল।

    মা’র সঙ্গে গোপন যোগাযোগটি হওয়ার পর ছোটদা, দুপুরে বাবা যখন হাসপাতালে থাকেন, চুপচুপ করে বাড়িতে আসেন, পেছনে গীতা মিত্র ঘোমটা মাথায় পা টিপে টিপে। মা তাঁদের ঘরে ঢুকিয়ে, দরজার খিল এঁটে যেন কাক পক্ষি না দেখে, খেতে দেন, যাওয়ার সময় থলে ভরে চাল ডাল তেল নুন দিয়ে দেন সঙ্গে। আমরা দু’বোন কান খোলা রাখি বাবার আসার কোনও শব্দ হয় কিনা, হঠাৎ আসার। ছোটদা ঘরে ঘরে বেড়ালের মত হাঁটেন আর রেডিও, ঘড়ি, গান শোনার যন্ত্র নেড়ে চেড়ে বলেন এইটা আমার দরকার আর কি যেন খোঁজেন সারা ঘরে। তোষকের তলে, আলমারির ড্রয়ারে, বই রাখার তাকে। ছোটদাকে এমন দেখায় যেন তিনি নতুন এসেছেন এ বাড়িতে। অপার বিস্ময় চোখে জিনিসপত্র হাতড়ান। ছোটদাকে বাড়িতে হাঁটাচলা করতে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়, ইচ্ছে হয় তিনি আগের মত এখানে থাকুন, আগের মত টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমোন, লালায় ভরে যাক বইয়ের পাতা, উঠোনের রোদে কাঠের পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ধুন্দলের ছুবলায় গা মেজে গোসল করুন। আবার সেই আগের মত হাওয়ায় উড়িয়ে চুল, কাঁধে গিটার, শিস বাজাতে বাজাতে দরজার কড়া নাড়ুন রাতে, প্রতি রাতে।

    ছোটদা তাঁর গিটার, জামা কাপড়, টিনের ট্রাংক ধীরে ধীরে সব সরাতে লাগলেন। দেখি একদিন রেডিও নেই ঘরে, আরেকদিন দেয়ালের ঘড়িটি নেই। লক্ষ করিনি, এমন ভাব করি। রেডিও যে টেবিলে ছিল, সেখানে খামোকা পুরোনো বই খাতা পত্রিকার স্তূপ করে রাখি, যেন কারও নজরে না পড়ে খালি টেবিল। দেয়ালে টাঙিয়ে রাখি রঙিন ক্যালেন্ডার। ইয়াসমিন ভাব করে তারও চোখে পড়ছে না বাড়ি থেকে কিছু কিছু জিনিস নেই হয়ে যাচ্ছে। মা সময় জিজ্ঞেস করেন এভাবে–দেখ ত তর হাতঘড়িতে কয়টা বাজে! ইচ্ছে করেই দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখার অভ্যেসটি তিনি তুলে রাখেন কোথাও। তিনটে প্রাণী আমরা বাড়িতে অন্ধের অভিনয় করে যাই, কেউ কাউকে প্রশ্ন করি না কোনও আর মনে মনে আশা করি বাবা যেন খবর শুনতে রেডিও না খোঁজেন, আর সময় দেখতে চোখ না ফেলেন দেয়ালে। বাড়িতে ছিঁচকে চোর এসে এটা সেটা নিয়ে যেতে পারে, এরকম একটি আশংকা আমি প্রকাশ করব যে কোনও খোঁজাখুঁজির বেলায়, ভেবে রাখি। আমার ধারণা হয় মা এবং ইয়াসমিনের মনও এরকম কোনও উত্তর সাজাচ্ছে। ইস্কুল থেকে বিকেলে ফিরে যেদিন দেখি সোফার ঢাকনা দিয়ে ছোটদা বড় রেকর্ড প্লেয়ারটি জড়াচ্ছেন, আমি যেন দেখিনি তিনি কি করছেন, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গুন গুন করে অন্যমন যেন, ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখতে থাকি। মা চকিতে ঘরে ঢুকে চাপা গলায় বলেন ছোটদাকে –এইটা নিস না, তর বাবা রাইগা আগুন হইয়া যাইব।

    –এইটা ঠিকমত বাজে না। সারাই করতে হইব। মেকানিকের কাছে নিয়া যাই। ছোটদা পাথর ভাঙা গলায় বলেন।

    অনুতাপ এবং মায়া দুটোই যদি গ্রাস করে থাকে তোমাকে, তবে তুমি অভিমান করতে পারো, ক্রুদ্ধ হতে পারো না, আমার এরকমই ধারণা হয়। আমি মা কিংবা ইয়াসমিন শেষ অবদি বাধা দিতে পারি না, ছোটদা রেকর্ড প্লেয়ারটি মেইড ইন জার্মানি, উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন, নুয়ে, ঝুঁকে।

    দিন যায়, সারাই কিছুরই হয় না। জিনিসপত্র কিছু আর ফেরত আসে না বাড়িতে। না আসুক, এখন শখের জিনিস সরিয়ে যদি তাঁর তৃপ্তি হয়, না হয় হোক। আমাদেরও খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হোক।

    একদিন অসময়ে বাবা বাড়ি আসেন, যে আশংকাটি আমি অনেকদিন করছিলাম। আমার সারা শরীর হিমে জমে থাকে। বাবার পায়ের শব্দ শুনে ওঁরা সেঁধিয়ে যায় হাতের কাছে একটি ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজটি কানে বোম ফাটার মত লাগে। এই বুঝি বাবার কানে গেল কোনও অচেনা শব্দ। বাবা সেই শব্দের সুতো ধরে কতদূর যাবেন কে জানে। আমার জমে থাকা শরীরটি অবশ হতে থাকে। মা বন্ধ দরজার পাশে এমন ভঙিতে দাঁড়িয়ে কথা বলেন যে তিনিই নিতান্ত প্রয়োজনে দরজাটি ভেজিয়ে রেখেছেন, কেউ নেই ঘরে, কারও থাকার কথা নয়। মা’র কথাগুলো নিরর্থক, যেমন হাত মুখ ধইয়া খাইতে বইলি না এহনও! যদিও আমি ইস্কুল থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে অনেক আগেই বসে আছি। আমার মাগরেবের নামাজের সময় গেল গা। যদিও তখনও বিকেল ফুরোয়নি। বাবা অসময়ে বাড়ি এসে অন্যদিন কে কি করছে তাই দেখেন , আমরা পড়াশুনা করছি কি না, ছাদে কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কি না, জানলাদরজা সব সাঁটা আছে কি না, সব ঠিকঠাক দেখলে আমার পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে নানা মনীষীর বাণী আওড়ে চলে যান রোগি দেখতে। সেদিন যেন তিনি অযথাই লম্বা সময় কাটাচ্ছেন বাড়িতে। যেন খামোকা হাঁটছেন ঘরগুলোয়। এক একটি মুহূর্তকেও মনে হতে থাকে দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ। ঘরগুলোয় জুতোর মচমচ শব্দ তুলে হেঁটে বন্ধ দরজাটির পাশে দাঁড়াতেই মা বলেন কিছু খাইবা, খাবার দিব? মা’র এ প্রশ্নটিরও কোনও মানে হয় না। এ সময় না দুপুরের খাবার সময়, না রাতের। বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে দরজাটি ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে বন্ধ, অথচ বাড়ির মানুষগুলো কেউ অনুপস্থিত নয়, তবে ভেতরে কে! প্রশ্নটি অবান্তর নয়। তবু প্রশ্নটি আমার মনে হতে থাকে নিতান্ত অনুচিত। যার ইচ্ছে সে ভেতরে, তা দিয়ে বাবার কি প্রয়োজন। ধরা যাক আমিই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে যাদুমন্ত্রে বাইরে এসেছি। যাদু তো এমন আছেই। পিসি সরকার তাই করতেন। হুডিনিও তাই। বন্ধ বাক্সে নিজেকে বন্দি করে রেখেই বাক্সটি যেমন ছিল তেমনই থাকে, তিনি আচমকা বাক্সের বাইরে।

    বাবা দরজায় আবারও ধাক্কা দিয়ে হাঁক ছাড়েন, ভেতরে কেডা? মা নিঃশব্দে সরে যান বাবার সামনে থেকে। কিছু আর তাঁর হাতে নেই পাহারা দেওয়ার। আমার ঠান্ডা শরীরটির হঠাৎ পেশাব পায়খানা চাপে। তরকারি পোড়া গন্ধ বেরোয় রান্নাঘর থেকে। ইয়াসমিন এমন ঝুঁকে থাকে বইয়ের ওপর, যেন পাথরের মূর্তি কোনও, নড়ন চড়ন নেই। বন্ধ দরজা থেকে বাবার অদম্য উৎসাহের আগুন এক ফুৎকারে নিবিয়ে দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা আমরা কেউ দেখি না। বাবা এমনই, কোনও কিছুর শেষ না দেখে তাঁর শান্তি হয় না। সন্দোহ যদি একবার উঁকি দেয়, তিনি এসপার ওসপার করে ছাড়েন সবকিছুর। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে তিনি রহস্যের জট ছাড়ান। ভেতরে কে, বাবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ তৈরি নেই। ভেতরে কে প্রশ্নটি এর ওর দিকে, আবার বাতাসেও ছুঁড়তে থাকেন তিনি।

    কী দরকার ছিল এত নিরীক্ষণের, কুকুর বেড়াল আর দুটো মেয়ে যে যার জায়গামত আছে, মেয়েরা পড়ার টেবিলে আর জন্তুদুটো বারান্দায়, ছাদে কেউ হাঁটছে না, দরজা জানালা সাঁটা আছে। মাও আছেন বাড়িতে, এমন নয় যে সংসার মাচায় তুলে চলে গেছেন পীরবাড়ি। যেমন চলে সংসার তেমনই, কোনও সুতো পড়ে নেই কোথাও সংশয়ের। তবু, অকারণেই বাবা হুংকার ছোড়েন ভেতরে কে?

    আমি ঝুঁকে আছি একটি জ্যামিতির বইয়ে, যেন এক কঠিন জ্যামিতি বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছে খুব, আর কে কোথায় কিসের ভেতর এসব আমার জানার কথা নয়, আর আমার সময়ও নেই ওসবে ফিরে তাকানো, যেন হুংকারটি মোটেও আমার কানে যায়নি। জ্যামিতির সমস্যা মিমাংসায় আমি এতই ব্যস্ত যে কারও দিকে কোনও চোখ না ফেলে, কারও কোনও হুংকার কানে পৌঁছেনি এভাবে দ্রুত হেঁটে যাই গোসলখানার দিকে। যেন গোসলখানাটি এ মুহূর্তূ আমার বিষম প্রয়োজন, মাথায় যেহেতু জ্যামিতির জটিলতা, চাঁদিতে জল ঢেলে তার জট খুলতে হবে। দরজা এঁটে আমি বড় একটি শ্বাস ফেলি। বাড়িতে কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা কল্পনা করার সাহস বা শক্তি আমি অনুভব করি, নেই আমার। যা কিছু ঘটে, চোখের আড়ালে ঘটুক। কিন্তু পালিয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কেন! আমার দরজায়ও শাবলের কোপ পড়ে। দরজা খোল, দরজা খোল! বেরিয়ে এলেই চিতার মত চেপে ধরেন বাবা, ওই ঘরের ভেতরে কেডা?

    বাবার রুদ্রমূর্তি দেখে শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি দাগি আসামির মত। যেন অপরাধ আমার। যেন বন্ধ ঘরটির সব দায়িত্ব একা আমার। বাবা আমাকে মুঠোর ভেতর নিয়ে দাপান সারা বারান্দা, জবাব তাঁর চাই। তা নইলে ভয়ংকর কোনও কান্ড ঘটাবেন এক্ষুণি। শেষ পর্যন্ত কালো মুখের, ফিনফিনে চুলের, ভোঁতা নাকের মা ত্রাতার ভূমিকায় নামেন। বাবার ছোবল থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হিমে ডুবে থাকা গলায় বলেন–কামাল আইছে বউ নিয়া। বউ মুসলমান হইছে।

    –কি? কি কইলা? কে আইছে? বাবা প্রশ্ন করেন খনখনে গলায়।

    –কামাল। কামাল আইছে। মা আবার বলেন।

    –কামাল কেডা? কোনও কামালরে আমি চিনি না। বলতে বলতে বাবা ছুটে আসেন বন্ধ দরজার সামনে। সারা বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জন তোলেন–এক্ষুণি ওদেরে বাইর কর আমার বাসা থেইকা। এক্ষুণি। এক্ষুণি।

    আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখনও। হাত পা আবার অবশ হতে শুরু করেছে।

    বাবার তর্জনি তখনও কালো ফটকের দিকে উঁচু করে ধরা।

    পেছনের দরজা খুলে ছোটদা বউএর হাত ধরে দৌড়োতে থাকেন কালো ফটকের দিকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }