Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৩. ঋতুস্রাব

    ইস্কুল থেকে ফিরে জামা কাপড় বদল করতে গিয়ে দেখি শাদা পাজামা রক্তে লাল। কেন! কাটল কিছুতে! কোথায় কেটেছে! কাটার তো কথা নয়! ব্যথা তো লাগছে না! কী হল! ভয়ে বুক কাঁপছে তখন আমার। এত রক্ত বেরোচ্ছে, আমি আবার মরে যাচ্ছি না তো!

    দৌড়ে, মা ফুলকপি তুলছিলেন সবজির বাগান থেকে, তাঁর কোলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদি।

    –ও মাগো, আমার শরীর কাইটা গেছে। সমানে রক্ত বার হইতাছে।

    –কই কাটছে! কই! মা কোল থেকে আলতো হাতে আমাকে তোলেন।

    আমি তলপেটের নিচে আঙুল নামাতে থাকি।

    মা বলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে– কাইন্দ না।

    আমি গালে নামা চোখের জল মুছে বলি, ডেটল তুলা নিয়া আসো তাড়াতাড়ি।

    মা হেসে বলেন–কান্দার কিছু নাই। ঠিক হইয়া যাইব।

    রক্ত বেরোচ্ছে আমার গা থেকে, আর মা’র মুখে দুশ্চিন্তার লেশ নেই। তিনি দুটো ফুলকপি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমার ক্ষত খুঁজে তুলোয় ডেটল মেখে, যা সচরাচর করেন, ব্যান্ডেজ করলেন না। বরং ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ঝুলিয়ে, ফুলকপির বালু ঝেড়ে বললে–তুমি এখন বড় হইছ। বড় মেয়েদের এইগুলা হয়।

    –এইগুলা হয় মানে? কোনগুলা? মা’র চাপা হাসির দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে বলি।

    –এই রক্ত যাওয়া। এরে স্রাব কয়। হায়েজ কয়। প্রত্যেক মাসেই এইরকম হয় মেয়েদের। আমারও হয়। মা হেসে বলেন।

    –ইয়াসমিনেরও হয়! উদ্বিগ্ন আমি, জিজ্ঞেস করি।

    –ওর এখনও হয় না। তুমার মত বড় হইলে ওরও হইব।

    হঠাৎ এক বিকেলে আমি, এভাবে, বড় হয়ে গেলাম। মা আমাকে বলেন–তুমি এখন আর ছোট না। তুমি এখন ছোটদের মত খেলাধুলা করা, বাইরে যাওয়া এইসব করতে পারবা না। বড় মেয়েদের মত ঘরে থাকবা। দৌড়াইবা না, শান্ত হইয়া থাকবা। পুরুষলোকের সামনে যাইবা না।

    মা তাঁর পুরোনো একটি শাড়ি ছিঁড়ে টুকরো করে, টুকরোগুলো ভাঁজ করে আমার হাতে দিলেন, পাজামার একটি ফিতেও দিলেন। বললেন, গম্ভীর মুখে, চাপা হাসিটি নেমে গেছে ঠোঁট বেয়ে, পেটে ফিতাটা শক্ত কইরা বাইন্ধা তারপরে এই ভাঁজ করা কাপড়টা ফিতার দুইদিকে গুইঞ্জা রাখবা। রক্ত ঝরব তিন দিন, চাইর পাঁচ দিনও ঝরতে পারে। ডরের কিচ্ছু নাই। সবারই হয় মা। এইটা খুব স্বাভাবিক। এই কাপড় রক্তে ভিইজা গেলে এইটা ধইয়া লাইড়া দিবা, আরেকটা পরবা। খুব গোপনে সব করবা, কেউ যেন না দেখে। এইগুলা শরমের জিনিস। কাউরে কইতে হয় না।

    আমার ভয় হতে থাকে। এ কেমন অদ্ভুত কান্ড যে রক্ত ঝরবে শরীর থেকে, তাও প্রতি মাসে! কেন ছেলেদের ঘটবে না ব্যপারটি। কেন মেয়েদের কেবল! কেনই বা আমার! আল্লাহতায়ালার মত প্রকৃতিও কি একচোখা! নিজেকে হঠাৎ মনে হয় আমি যেন এখন মা খালাদের মত বড় হয়ে গেছি, আমার আর পুতুল খেলার বয়স নেই। আমার আর খুনসুটি করার বয়স নেই, আমাকে এখন শাড়ি পরে রাঁধাবাড়া করতে হবে, মন্থরগতিতে চলতে হবে, নিচুগলায় কথা বলতে হবে। আমি এখন বড়। গোল্লাছুটের মাঠ থেকে, এক্কাদোক্কার ঘর থেকে কেউ যেন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আমি আর আগের সেই আমি নই। আমি অন্য আমি, ভীষণ বিভৎস আমি। যেটুকু স্বাধীনতা অবিশিষ্ট ছিল, তাও উড়ে গেল নিমেষে তুলোর মত হাওয়ায়। আমি কি কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি! নাকি যা ঘটছে, মা যা বলছেন, সব সত্যি! যদি সবই দুঃস্বপ্ন হত, যদি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতাম যেমন ছিলাম, তেমনই আছি! আহা, তেমন হয় না কেন! মনে মনে প্রবল ইচ্ছে করি যেন এই রক্তপাত মিথ্যে হয়! যেন এ স্রেফ দুর্ঘটনা হয়, শরীরের ভেতরে কোনও গোপন ক্ষত থেকে রক্তপাত হয়, এটিই প্রথম আর এটিই যেন শেষ হয়। যেন শাড়ির টুকেরোগুলো মা’কে ফিরিয়ে দিয়ে বলতে পারি, সেরে গেছে।

    গোসলখানার দেয়ালে মাথা ঠুকে কোনও যন্ত্রণার বোধ হয় না। শরীর একটি বাহন মাত্র, রক্তাক্ত একটি হৃদয় বহন করে চলেছি এতে। বুকের ভেতর কষ্টের নুড়িপাথর জমে জমে পাহাড় হতে থাকে। হাতে ধরা মা’র দেওয়া শাড়ির টুকরো। আমার নিয়তি ধরে আছি আমি হাতে। একচোখা কুৎসিত নিয়তি।

    মা গোসলখানার দরজায় টোকা দিয়ে চাপা স্বরে বলেন কী হইছে, দেরি কর ক্যান! যেমনে কইছি অমনে কইরা তাড়াতাড়ি বার হও।

    মা’কি আমাকে কাঁদতে দিতেও চান না সাধ মিটিয়ে! লজ্জায় মুখ ঢেকে কাঁদতে, অপমনে বিবর্ণ হতে! যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে আশংকায়! মা’র ওপর রাগ হয় আমার। বাড়ির সবার ওপরই, যেন সবার এক গোপন ষড়যন্ত্রের শিকার আমি। আমাকেই বেছে নেওয়া হয় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে। গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোয় আমারই। গায়ে পায়ে সর্বনাশ যদি কারও জড়িয়ে থাকে, সে আমারই। এই ছেঁড়াখোঁড়া আমার। কী করে এই গা রি রি করা ঘটনাটি আমি লুকিয়ে রাখব! কী করে আমি হাঁটব, দৌড়োব, যদি কেউ জেনে ফেলে আমার পাজামার তলে ত্যানা লুকিয়ে আছে, আর সেই ত্যানা চুপসে আছে রক্তে। নিজেকে বড় ঘেন্না লাগে। ঘেন্নায় থুথু ছুঁড়ি নিজের গায়ে। আমি এখন সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া কিছু নই। আমি এখন আর আর সবার মত নই। অন্যরকম। বিশ্রিরকম। আমার ভেতর গোপন এক অসুখ আছে। যে অসুখ কখনও সারে না।

    এ কে কি বড় হওয়া বলে! আমি লক্ষ করি আমি যেমন ছিলাম, তেমনই রয়ে গেছি। আমার তখনও দৌড়ে গোল্লাছুট খেলতে ভাল লাগে কিন্তু মা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন–লাফ দিবি না, দৌড়াবি না, তুই এখন আর ছোট না। মাঠে দাঁড়ালে মা খেঁকিয়ে ওঠেন, ঘরের ভিতরে আয়, অন্য বাড়ির ছাদ থেইকা বেডারা তাকাইয়া রইছে।

    –তাতে কি মা! কেউ তাকাইলে দোষ কি! ম্লান স্বরে বলি।

    –তুই বড় হইয়া গেছস। অসুবিধা আছে।

    কি অসুবিধা? তা কখনও মা’র কাছে জানতে পারিনি। বাইরের পুরুষ ক্রমশ আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আড়াল করার, আবৃত করার খেলায় মা বিষম মেতে ওঠেন। মামারা বন্ধু নিয়ে বেড়াতে এলে মা আমাকে ঠেলে পাঠান ভেতরের ঘরে। আমি যেন মামার বন্ধুদের চোখের সামনে না পড়ি। ক্রমশ অস্পৃশ্য হয়ে উঠতে থাকি।

    মা’র আলমারিতে চাবি খুঁজতে গিয়ে হাত লেগেছিল কোরান শরিফের ওপর, মা ছুটে এলেন–নাপাক শইলে কোরান শরিফ ধরবি না।

    –নাপাক শরীর মানে? তেতো গলায় বলি।

    –হায়েজ হইলে শইল নাপাক থাকে। তখন আল্লাহর কালাম ছোঁয়া নিষেধ। নামাজ রোজা করা নিষেধ।

    মা কুকুরকে বলেন নাপাক। তাহলে মেয়েরাও সময় সময় নাপাক হয়! অযু করলে সবাই পাক হতে পারে, ঋতুস্রাবের মেয়েরা ছাড়া। দুর্গন্ধ এক ডোবায় পড়েছি আমি, আমার চুলের ডগা থেকে পায়ের আঙুল অবদি নোংরা। ঘেন্নায় আমার বমি আসে। নিজের ওপর ঘেন্না। রক্তের ত্যানা ধুতে গিয়ে উগলে আসে পেটের নাড়ি। এর চেয়ে জ্বিনের বাতাস লাগলে বোধহয় ভাল ছিল, ভাবি। এই নোংরা, নষ্ট, নাপাক ব্যাপারটিকে পুষে রাখতে হয় মনের একটি কৌটোয়, কৌটাটিকে পুরে রাখতে হয় মাটির তলে, যে মাটিতে কারও পা পড়ে না।

    আমার হাঁটতে ভয় হয়, দাঁড়াতে ভয় হয়। সারাক্ষণ আশংকা করি, এই বুঝি ত্যানা বেরিয়ে এল বাইরে। টুপ করে আলগোছে পড়ে গেল ঘরভর্তি মানুষের সামনে। এই বুঝি জেনে গেল সবাই। এই বুঝি মেঝে ভেসে গেল পচা রক্তে। এই বুঝি ঠা ঠা শব্দে হেসে উঠল মানুষ। এ আমার শরীর, এ শরীর আমাকেই অপমান করছে। আমাকেই দিনের আলোয় নর্দমায় চুবোচ্ছে।

    দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও পারি না জামা খুলে ফেলতে। বুকের মধ্যে বড় হচ্ছে কাজুবাদামের মত স্তন। শরীর থেকে কুলকুল করে স্রোত বইছে রক্তের। আমি বিমর্ষ শুয়ে থাকি বিছানায়।

    তিনদিনের রক্তপাতে আমি যখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিছানায় মৃতের মত শোয়া, বাবা দেখে, চোখ কপালে তুলে বুনো ষাঁড়ের মত তেড়ে আসেন, –কি ব্যাপার অবেলায় শুইয়া রইছস কেন! উঠলি এখনও! শিগরি পড়তে বস।

    শরীর টেনে তুলে পড়ার টেবিলে বসি। বাবা ধমকে বলেন–এত আস্তে চলস ক্যান! শইলে জোর নাই। ভাত খাস না!

    মা আবারও সেই ত্রাতার ভূমিকায়। বাবাকে ডেকে নিয়ে যান অন্য ঘরে, অন্য ঘরটি ঠিক আমার ঘরের বাঁপাশের ঘরটি। ঘরটি থেকে দেয়াল ফুঁড়ে হিস হিস ফিস ফিস শব্দ আসে, শব্দের আগায় বাঁধা অদৃশ্য আগুন। আমার কান পুড়ে যেতে থাকে সে আগুনে। মেলে রাখা বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে। আগুনে পুড়তে থাকে আমার বই খাতা, পেনসিল সব। সারা মুখে হলকা লাগে আগুনের।

    বাবা অন্য ঘর থেকে এসে নিঃশব্দে আমার কাঁধে হাত নাকি চাবুক জানি না, রেখে বলেন, বিশ্রাম নিতে চাইলে নেও। শুইয়া থাকো কিছুক্ষণ। পরে পড়তে বও। যাও, বিছানায় যাও। বিশ্রামেরও দরকার আছে শরীরের। নিশ্চয়ই আছে। এইজন্য কুম্ভকর্ণের মত সারাদিন ঘুমাইলে আর আইলসার মত শুইয়া থাকলে ত চলবে না। তুমার একটা আইলসা ভাই আছে না! নোমান। ওর আইলসামির জন্য ও লেখাপড়া করতে পারল না। দেখ না ছাইকলুজি পড়ে। কী ছাতা পড়ে আমার! পইড়া একেবারে রাজ্য শাসন করব! আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেন বাবা। শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে–জান ত, বাবা বলেন, আমার এখন সন্তান বলতে দুইটা মেয়েই। তোমরাই আমার বুকের ধন। তোমরাই আমার ভরসা, আমার বাঁচার আশা। তোমাদেরে মানুষ কইরা যাইতে পারলেই আমার জীবনে শান্তি হইব। তুমরা যদি আমারে কষ্ট দেও, আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। শরীরটা ক্লান্ত লাগলে একটু বিশ্রাম নিবা। আবার ভাল বোধ করলে উইঠা পড়তে বসবা। কয় না, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবা, তাই সয়! তুমাদের খাওয়া পরা কোনকিছুরই অভাব আমি রাখি নাই। কেন! যেন ঠাইস্যা লেখাপড়া কইরা মানুষ হইতে পার। ছাত্রজীবনে অধ্যয়নই একমাত্র তপস্যা। তারপরে ধর কর্মজীবন, তহন কর্ম করবা। আর কর্মজীবনের পরে আসে হইল অবসর জীবন, তহন অবসর নিবা, কর্ম থেইকা অবসর। সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। আছে না!

    বাবা তাঁর খসখসে আঙুলে আমার চুল আঁচড়ে ঘাড়ের পেছনে জড়ো করেন। ব্যাকব্রাশের বাবা চুল কপালে আসা সইতে পারেন না, নিজের যেমন নয়, অন্যেরও নয়। আগেও দেখেছি, তাঁর আদর মানে চুল পেছনে সরিয়ে দেওয়া। আহ! এত রুক্ষ কারও হাত হতে পারে! খসখসে আঙুলগুলো আমার পিঠে দৌড়োয়। আদর নয় তো এ যেন ঝামা ঘসে আমার চামড়া তুলছেন গায়ের।

    ঋতুস্রাব হল আর ধুলোখেলা ছেড়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকব ঘরে, এ আমার মনে ধরে না। বড় শখ ছিল বড় হতে, তত বড় হতে যে দরজার সিটকিনির নাগাল পাব। এখন একাই আমি পায়ের আঙুলে ভর রেখে সিটকিনি খুলতে পারি। কিন্তু এই রক্তপাত আমাকে এত বড় করে দেয়, এত আড়াল করে দেয় সবার, যে, আমার ভয় হতে থাকে। মা আমাকে এগারো বছর বয়সে জন্মের মত হাফপ্যান্ট ছাড়িয়ে দিয়ে নিজে হাতে পাজামা বানিয়ে দিয়েছেন পরার। বারো বছরে এলে বলেছেন ওড়না পড়তে, আমার ঠ্যাং বড় হচ্ছে, বুক বড় হচ্ছে সুতরাং বড় হওয়া জিনিসগুলো আড়াল করে রাখতে হবে। আমি যদি এসব না পরি, লোকে আমাকে বেশরম বেলাজ বলবে। সমাজে কেউ বেশরম মেয়েদের পছন্দ করে না। যাদের লাজ লজ্জা আছে, তাদের ভাল বিয়ে হয়। আমারও, মা’র আশা, ভাল বিয়ে হবে। বইয়ের পোকা মমতার বিয়ে হয়ে গেছে ক’দিন আগে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি চেন, যার সাথে তুমার বিয়ে হইতাছে?

    মমতা না বলেছে, চেনে না।

    হাতি চড়ে সে লোক মমতার বিয়েতে এসেছিল। সারা শহর দেখেছে হাতিতে বসে বর যাচ্ছে বিয়ে করতে। যৌতুক নিয়েছে অঢেল, সাত ভরি সোনা, তিরিশ হাজার টাকা, রেডিও, হাতঘড়ি। হাতির পিঠে চড়িয়ে মমতাকে সে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।

    মমতা এখন থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকদের দেখাশুনা করবে। লেখাপড়ার পাট চুকেছে ওর। ওর বই পড়ার শখকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে হাতি চড়া লোকটি।

    ঋতুস্রাবের ধকল না পোহাতেই গ্রামের এক হাবিলদার লোক বড় এক রুই মাছ নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে বললেন তিনি তাঁর ছেলের সঙ্গে বাবার বড় কন্যার বিয়ে দিতে চান। শুনে, লোকটির হাতে মাছটি ফেরত দিয়ে কালো ফটক দেখিয়ে দিয়েছেন বাবা, আর একটি শব্দ উচ্চারণ না করে যেন লোকটি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।

    মা অসন্তোষ স্বরে ঢেলে বাবাকে বলেছেন, এমন করলে চলব! মেয়েরে কি বিয়া দিবা না! মেয়ে ত বড় হইছে। এই বয়সেই বিয়া হইয়া যাওয়া ভালা।

    মা’কে আর অগ্রসর হতে না দিয়ে বাবা বলেন–আমার মেয়েরে কহন বিয়া দিতে হইব, সেইডা আমি বুঝাম। তুমার মাতব্বরি করতে হইব না। মেয়ে আমার লেখাপড়া করতাছে। ডাক্তার হইব। আমার মত এম বি বি এস ডাক্তার না। এফ আর সি এস ডাক্তার। ওর বিয়া নিয়া আর কুনো কথা যেন আমি শুনি না।

    কান পেতে বাবার কথাগুলো শুনে, বাবার ওপর আমার সব রাগ জল হয়ে যায়। বাবাকে ইচ্ছে করে নিজের হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দিই, বাবার নিশ্চয় তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু বাবা না ডাকলে তাঁর কাছে ভেড়ার, না চাইলে কিছু দেওয়ার অভ্যেস আমার নেই। আমি অভ্যেসের খোলস ফুঁড়ে বেরোতে পারি না।

    মা, আমি লক্ষ করি, আমার বড় হওয়া বিষয়ে বিষম উচ্ছ্বসিত। বাজার থেকে একটি কালো বোরখা কিনে এনে আমাকে বললেন–দেখ তো মা, এই বোরখাটা কিইনা আনলাম তুমার জন্য। পইরা দেখ তো লাগে কি না।

    অপমানে আমি লাল হয়ে উঠি। বলি–কি কও! আমারে বোরখা পরতে কও!

    –তাই তো। বড় হইছস না। বড় হইলে মেয়েদেরে বোরখা পরতে হয়।

    মা বোরখাটি হাতে নিয়ে তার দৈর্ঘপ্রস্থ মাপতে মাপতে বলেন।

    –না আমি বোরখা পরব না। শক্ত গলায় বলি।

    –তুই মুসলমান না! মুসলমান মেয়েদেরে পর্দা করার কথা আল্লাহ তায়ালা নিজে বলছেন। মা মোলায়েম কণ্ঠে বলেন।

    –তা বলুক গিয়া। আমি বোরখা কিছুতেই পরব না। বলি।

    –ফজলির সবগুলা মেয়ে কী সুন্দর বোরখা পরে। কত ভাল মেয়ে ওরা। তুমিও ত ভাল মেয়ে। বোরখা পরলে মানষে কইব মেয়েটা কত লক্ষ্মী।

    পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন মা। পিঠে উষ্ণ স্পর্শ পড়লে আমি মোমের মত গলে যাই। কিন্তু আজ আমাাকে গললে চলবে না। আমাকে না বলা শিখতে হবে। মনে মনে আওড়াই শব্দটি–না।

    –না।

    –কি পরবি না? মা ক্ষেপে ওঠেন।

    –না ত কইলাম। মা’র নাগাল থেকে ছিটকে সরে বলি।

    মা যে হাতটি পিঠে বুলোচ্ছিলেন, সেটি দিয়েই থাপ্পড় কষে পিঠে বলেন–তুই জাহান্নামে যাইবি। আমি তরে কইয়া দিলাম তুই জাহান্নামে যাইবি। তর মতি গতি আমার ভালা ঠেকতাছে না। নওমহলে এত নিয়া গেলাম, তারপরও তর চোখ খুলল না। দেখলি না চোখের সামনে, তর বয়সী, এমন কি তর ছোটরাও বোরখা পরে। কী সুন্দর লাগে ওদেরে। নামাজ রোজা করে। তুই যত বড় হইতাছস, নামাজ রোযা সব ছাড়তাছস। তর কপালে জাহান্নাম লেখা আছে।

    মা থাপড়ে আমার পিঠ লাল করে দিন, বোরখা আমি পড়ব না। ঘাড় গুঁজে বসি এসে পড়ার টেবিলে। বই সামনে নিয়ে বসে থাকা কেবল, অক্ষরগুলো শকুনির ডানার তলে ঢাকা।

    মা থপথপ করে হাঁটেন বারান্দায়। আমার ঘরটি ভেতর-বারান্দার লাগোয়া। যেন শুনতে পাই, মা বলেন–আসলে ও হইছে একটা মিড়মিড়া শয়তান। দেখলে মনে হয় কিচ্ছু বুঝে না, মা বাপে যা কয়, তাই শোনে। আসলে না। এ আমার মুখে মুখে তর্ক করে। আর কেউ ত এমন করে না। এ এত সাহস পায় কোত্থেকা। বাপের মত মাইরা চামড়া তুলতাম যদি পিঠের, তাইলে সবই শুনত। সুজা আঙুলে ঘি উঠে না।

    বাঁকা আঙুলে ঘি ওঠানোর সময় মা আর মা থাকেন না, ডাইনি হয়ে যান। এত বিচ্ছিজ্ঞর লাগে মা’কে দেখতে তখন। মনেই হয় না এই মা আমাকে মুখে তুলে আদর করে খাওয়াতেন, ছড়াগান শেখাতেন, এই মা রাত জেগে বসে থাকেন গায়ে জ্বর হলে। ধুলোর মত মিশে যেতে থাকি মাটিতে, আমার হাড়ে রক্তে মাংসে ক্রোধ জমা হতে থাকে হীরের কণার মত।

    ইচ্ছে হয় বিষ খেয়ে মরে যাই। একেবারে মরে যাই। জগত বড় নিষ্ঠুর, এই জগতে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল। পত্রিকায় পড়েছি এক মেয়ে হঠাৎ সেদিন ছেলে হয়ে গেছে। বড় ইচ্ছে করে আমার, হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে ছেলে হয়ে গেছি। কোনও বেঢপ মাংস পিন্ড নেই বুকে। ফিনফিনে শার্ট পরে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়াব। টৈ টৈ করে শহর ঘুরে, সিনেমা দেখে, বিড়ি ফুঁকে বাড়ি ফিরব রাতে। মাছের সবচেয়ে বড় টুকরোটি মা তুলে দেবেন পাতে, আমি ছেলে বলে, বংশের বাতি বলে। ছেলেদের সাত খুন মাপ মা’র কাছে। কেউ আমাকে বুকের ওপর ওড়না ঝুলোতে বলবে না, বোরখা পরতে বলবে না, আমার ছাদে ওঠা, জানালায় দাঁড়ানো, বাড়িতে বন্ধু নিয়ে আড্ডা দেওয়া, যখন খুশি বেরিয়ে যাওয়ায় কারও কিছু বলার থাকবে না।

    কিন্তু কে আমাকে ছেলে করে দেবে! আমার নিজের সাধ্য নেই নিজেকে ছেলে করার। কার কাছে প্রার্থনা করব, এক আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করে মানুষ! আল্লাহ ছাড়া আরও কেউ যদি থাকত প্রার্থনা করার! হিন্দুদের তিনকোটি দেবতার কাছে করব! দেবতারা আমার কথা শুনবেন কেন, আমি তো হিন্দু নই। আর আল্লাহর কাছে অনেক চেয়ে দেখেছি, আল্লাহ মোটেও তা দিতে জানেন না। আল্লাহ ব্যাপারটি নেহাত ফালতু। কারও কাছে প্রার্থনা না করে আমার ইচ্ছের কথাটি নিজেকে বলি। হয় মর না হয় ছেলে হয়ে যাও হঠাৎ, বারবার বলি। বাবা বলেন, ইচ্ছে করলেই নাকি সব হয়। আমি তাই হৃদয়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ইচ্ছে করি। আমার ভেতর বাহির, আমার পাপ পুণ্য, সব ঢেলে ইচ্ছে করি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }