Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৭. প্রত্যাবর্তন ২

    দাদা ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশি এক ওষুধ কোম্পানির চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহে।

    দাদা বলেন, চাকরি নিছি মার লাইগা। মারে এই সংসারে কেউ দেখার নাই। কেউ মারে একটা পয়সা দেয় না। মা যেন আর কষ্ট না করে।

    চাকরির প্রথম বেতন দিয়ে দাদা মা’র জন্য শাড়ি কিনে আনলেন চারটে। মা’র জন্য সোনার বালা গড়তে দিলেন।

    শাড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদলেন মা। শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দাদার আনা শাড়ি তিনি পরলেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কুঁচি কাটলেন শাড়ির। মা’কে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। দাদাকে বুকে জড়িয়ে মা চোখের জলে ভেসে বললেন — আমার লাইগা আর কিছু কিননের দরকার নাই বাবা। আমার কিছু না হইলেই চলব। তুমি টাকা পয়সা জমাও। তুমার ভবিষ্যতে কাজে লাগব।

    ন্যূজ্ব, নত মা এখন শিরদাঁড়া টান টান করে হাঁটেন। তাঁর পেটের ছেলে টাকা পয়সা কামাচ্ছে, তাঁর আর কোনও মাগীখোর লোকের কাছে হাত পাতার দরকার নেই। মা’কে এত উচ্ছ্বল, এত প্রাণবান আর কখনও হতে দেখিনি। কাফেরের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলে পাপ হয়, ফজলিখালা তাই নিজে মা’কে নিয়ে কাচারিতে গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে। মা তালাকনামার কাগজে সই করেছিলেন কাচারিতে বসে। বাবার হাতে কাগজ এলে তিনি ধুত্তুরি বলে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সে কাগজ। কাফেরের সঙ্গে এক ছাদের তলে বাস করতে মা’র গা জ্বলে, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন বলে বলেও মা’র কখনও কোথাও চলে যাওয়া হয়নি এ বাড়ি ছেড়ে। মা কোথাও যান নি কখনও, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে, নাকি থেকে গেছেন বাড়িটির জন্য, নিজে হাতে লাগানো গাছপালাগুলোর জন্য, আর বাড়ির মানুষগুলোর জন্য এক অদ্ভুত মায়ায় — সে আমার বোঝা হয়নি।

    — ইউনিভার্সিটি থেইকা গ্রাজুয়েট হইয়া ফিরছে আমার পুত্রধন। আমার আনন্দ আর ধরে না।

    বাবা দাঁত কটমট করে চলছেন দাদা ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই। গ্রাজুয়েট ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন মাস্টার ডিগ্রি হাতে নিয়ে ফিরতে, আর দাদা বুক পকেটে আনন্দমোহনের বি এসসি পাশের কাগজ নিয়েই বছর দুই পর ফিরলেন। বাবা বলেন এর চেয়ে মইরা যাওয়া ভাল।

    দাদা মাছের মত চোখ করে বসে থেকে বাবার টিপ্পনি শোনেন।

    দাদা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গুছিয়ে বসলেন। ছোটদার খাটটি ঘর থেকে সরিয়ে বাইরে বারান্দায় খাড়া করে রাখলেন।

    খাটটি সরানোয়, আশ্চর্য, বাবা বিষম রাগ করলেন। তিনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন, বললেন — এই খাট যেইখানে ছিল, সেইখানে নিয়া রাখ। যার খাট সে ফিইরা আইলে থাকব কই! যেমন বিছানা পাতা ছিল, তেমন কইরা রাখ।

    মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন — কামাল কি আর ফিইরা আইব! শুনছি, শহর ছাইড়া চইলা গেছে। ইসলামপুর না কই যেন থাকে। কি খায় কেমনে থাকে কেডা জানে! বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন শুনে।

    — কী খায় না খায় তা জাইনা আমার কী! না খাইয়া মইরা যাক। ভুগুক। আমার কী! তুমি হইলা নষ্টের গোড়া। তুমি কথা কইও না। তুমার আসকারা পাইয়া ছেলেমেয়েগুলা নষ্ট হইছে।

    মা শিরদাঁড়া টান টান করে হেঁটে এসে চিবুক উঁচিয়ে বলেন — কথা কইতাম না ক্যা! আমারে আর কতদিন বোবা বানাইয়া রাখবা! আমি কি কারও খাই না পরি! আমার ছেলেই এহন আমারে টাকা পয়সা দেয়, কাপড় চোপড় দেয়, তেল সাবান দেয়। আমার আর ঠেকা নাই কুনো বেডার। ছেড়াডারে কী পাষন্ডের মত মাইরা বাড়ি থেইকা ভাগাইছে। এহন খাট সাজাইয়া রাইখা কি লাভ। লাভ কী!

    লাভ, বাবা বলেন, বাবা বুঝবেন, মা’র বোঝার কোনও প্রয়োজন নেই।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই কিনে এনে ভারি গলায় দাদা নিজে পড়ছেন, আমাকে পড়তে বলছেন। কবিতা পড়তে থাকি একটির পর একটি, দাদা উচ্চারণ শুধরে দেন, কোথায় আবেগ কতখানি দরকার, কোথায় জোর, কোথায় না, কোথায় ধীরে, কোথায় দ্রুত বলে দেন। দাদা বলেন — হৃদয় না ঢাইলা পড়তে পারলে কবিতা পড়বি না।

    দাদা আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজন করেন দু’জনের। আমরা দু’জনই শ্রোতা, দু’জনই আবৃত্তিকার। দাদা বিচারক। আমার এক নতুন জীবন শুরু হয় দাদার চৌহদ্দিতে। ওষুধ কোম্পানীর একটি লাল নোটবুক আমাকে দেন, প্রতিদিন দুটো তিনটে করে কবিতা লিখে দাদাকে দেখাতে থাকি। কোনওটিকে ভাল বলেন, কোনওটিকে খুব ভাল, কোনওটি সম্পর্কে বলেন — এইডা গু হইছে, কবিতা হয় নাই।

    কবিতার খাতাটি ইস্কুলের মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজন বাড়ি নিয়ে যায়। খাতাটি আমার হাতে ফিরতে ফিরতে মাস শেষ হয়ে যায়। কাড়াকাড়ি পড়ে যায় মেয়েদের মধ্যে। দাদা মুক্ত বিহঙ্গ নামে আমার একটি কবিতা পড়ে বলেন — ইস, পাতা পত্রিকাডা থাকলে, তর এই কবিতাডা আমি ছাপাইতাম।

    কেবল কবিতা নয়, গল্পেরও আসর বসান দাদা। দাদা একটি পড়েন, আমি একটি। কোনও কোনও লাইন আহা আহা বলে দু’তিনবার পড়েন, শিখে আমিও তা করি। বাবা বাড়ি ফেরা অবদি আসর রীতিমত গতিময় থাকে।

    কখনও গানের আসরও বসে। আমাকে গাইতে বললে হেঁড়ে গলায় দু’লাইন গেয়ে ছেড়ে দিই। দাদা গাইতে বসে সুরহীন গলায় গরুর মত চেঁচান। গানের আসরে ইয়াসমিনকে নেওয়া হয়, তার গলায় বেশ সুর ওঠে বলে। ইয়াসমিনকে, দাদা বলেন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেবেন।

    গান শোনার একটি যন্ত্র কিনেছেন দাদা। কোনও কোনও বিকেল কেবল গান শুনেই কাটিয়ে দেন। মুছে যাওয়া দিনগুলি আমারে যে পিছু ডাকে, গানটি শুনতে শুনতে, একদিন আবিষ্কার করি দাদা কাঁদছেন, আমাকে লক্ষ করেননি তিনি আমি যে নিঃশব্দে ঢুকেছি ঘরে।

    –দাদা, তুমি কানতেছিলা! জিজ্ঞেস করি।

    দাদা জল মুছে ফেলে বলেন — না, না, কানতাম ক্যান! কান্দি না। এমনি।

    দাদা আসলে কাঁদছিলেন। দাদা কি শীলার জন্য কাঁদছিলেন!

    ঘটনাটি আমি মনে মনে রাখি। মনে মনে রাখি দাদার একটি গোপন কষ্ট আছে। দাদা নিরালায় বসে খুব আপন কারও জন্য, মুছে যাওয়া কোনও দিনের জন্য কাঁদেন।

    দাদার পাশে জানালায় এসে বসি। বাগানে লিলি ফুল ফুটে চমৎকার গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাইরে দুলাল যাচ্ছে মাউথ অর্গান বাজিয়ে। এত দ্রুত হাঁটে সে, দেখে মনে হয় দৌড়োচ্ছে, সকাল, দুপুর, বিকেল, মধ্যরাত, মাউথ অর্গানের শব্দ শুনে যে কেউ বলে দিতে পারে, এ দুলাল। ও কারও সঙ্গে কথা বলে না, কারও জন্য পথে দাঁড়ায় না। ও কেবল দৌড়ে যেতে থাকে, যেন কোথাও ওর খুব জরুরি কোনও কাজ। আসলে ওর কোনও কাজ নেই। লোকে বলে, দুলাল পাগল।

    দুলাল কি আসলেই পাগল? দাদাকে জিজ্ঞেস করি।

    দাদা বলেন — আমার মনে হয় না।

    হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা উঠে দাঁড়ান, মেঘ কেটে সূর্য ওঠার মত হাসি দাদার মুখে, বলেন — যা, দাবার গুটি সাজা। দেখি আইজকা কেডা জিতে।

    আমার মন ভাল হয়ে যায় দেখে যে দাদা হাসছেন। গুটি সাজিয়ে বসে যাই। দাদার কাছ থেকে খেলা শিখে অবদি দাদাকেই হারাচ্ছি খেলায়। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি দেদার গুটি চুরি করেন। খেলতে গিয়ে বলে নিই, চুরি করা চলবে না।

    অথচ চুরি করতে যেয়ে দু’বার ধরা পড়েন দাদা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে তাঁর রাজাকে কিস্তি দিলে ব্যস, দাবার ছক উল্টে ফেলেন ইচ্ছে করে, আমি গলা ছেড়ে চেঁচাতে থাকি, তুমি হারছ, তুমি হারছ।

    দাদা একেবারে যেন কিছুই জানেন না, অবোধ শিশুর মত বলেন, কী আমি হারছি। কই! দেখা কই হারছি! তুই না হারলি!

    মুখখানা দিব্যি নিষ্পাপ বানিয়ে তিনি অস্বীকার করেন তাঁর পরাজয়ের কাহিনী। আমি ভুল চাল দিয়েছিলাম বলে তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই ছক উল্টেছেন এই তাঁর বক্তব্য। আমি জিতেছি, আমি ভাল খেলি, তিনি কোনওদিন মানেন না।

    ইস্কুলে ভাল ছাত্রী হিশেবে আমার নাম হয়। প্রথম তিনজনের মধ্যে আমি আছিই। বাবা তবু স্বীকার করেন না আমি ভাল ছাত্রী। তাঁর বদ্ধ ধারণা, আমি ফাঁকি দিচ্ছি লেখাপড়ায়, তা না হলে আমি প্রথম হই না কেন। মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।

    মা দেখি দাদার মনতুষ্টিতে বিষম ব্যস্ত। দাদা গরুর শুটকির ঝুরঝুরি খেতে চান, মা রাঁধেন। দাদা ঝাল পিঠা খেতে চান, মা আয়োজন করেন। আকাশ মেঘ করলেই বা দুফোঁটা বৃষ্টি ঝরলেই দাদা বলেন — মা ভুনা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজেন।

    মা দিব্যি রেগে যান চাল ডাল মেশাতে।

    মা’র পীরবাড়ি যাওয়া বাদ পড়তে থাকে।

    টাকা পয়সা অলা দাদা হয়ে উঠতে থাকেন বাড়ির গণ্যমান্য একজন। তিনি চিত্ররূপা স্টুডিওতে আমাদের নিয়ে গিয়ে গ্রুপছবি তুলে আনেন। নিজে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে এলবামে সাঁটতে থাকেন। কিছু ছবি বড় করে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাতে বাঁধাতে বলেন — কী, দেখলি কেরম নায়কের মত লাগে আমারে!

    আমি স্বীকার করি দাদাকে দেখতে ছবির নায়কের মত লাগে। দাদা আসলেই খেয়াল করে দেখেছি, সুন্দর।

    আমার আঁকা দুটো ছবিও, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের, বাঁধিয়ে ঝুলেয়ে রাখেন ঘরে, যে ই আসে বাড়িতে, ছবি দুটো দেখিয়ে বলেন — আমার বোনের আঁকা।

    ছবি আঁকার রং তুলি কিনে দিয়ে দাদা আমাকে বলেন আরও ছবি আঁকতে। আঁকতে আঁকতে ভাবি বড় হয়ে আমি ছবি আঁকার ইস্কুলে ভর্তি হব। পিটিআই ইস্কুলে গান গাওয়া মাস্টার বলেছিলেন, আমি খুব বড় শিল্পী হব। যে ছবিই আঁকি না কেন, দেখে মুগ্ধ দাদা বলেন — ছুটোবেলায় তরে ছবি আঁকা শিখাইছিলাম বইলা! নাইলে কি আর এত ভাল আঁকতে পারতি!

    দাদাকে গোপন ইচ্ছের কথা বলি যে একদিন ছবি আঁকার ইস্কুলে লেখাপড়া করে আমি আরও ভাল ছবি আঁকব।

    দাদা ঠোঁট উল্টে বলেন — বাবা শুনলে তরে মাইরাই ফালব। কিছুতেই তরে শিল্পী হইতে দিব না। কইব শিল্পীগোর ভাত নাই।

    দাদা কেবল মা’কেই নয়, আমাদেরও জামা জুতো কিনে দেন, সিনেমা দেখাতে নেন। সিনেমার নেশায় পায় আমাকে। আবদার করে করে অতিষ্ঠ করে ফেলি তাঁকে। মাঝে মাঝে বলেন — ঠিক আছে, দরখাস্ত লেখ আমার কাছে। ভাইবা দেখতে হইব মঞ্জুর করা যায় কি না।

    দরখাস্ত লিখি, ডিয়ার স্যার সম্বোধন করে। ইতিতে লিখি ইয়োর ওবেডিয়েন্ট সারভেন্ট। বই দেখে টুকি আসলে। টাকা চাহিয়া ম্যানেজারের কাছে ইংরেজিতে একটি দরখাস্ত লেখ যে পৃষ্ঠায় আছে, সেটি বার করে, টাকা চাইএর বদলে সিনেমা দেখতে চাই বসিয়ে।

    দরখাস্ত পাওয়ার পরও দাদা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোন না। আমি অস্থির হতে থাকি বিষম। তিনি বলেন — ধৈর্যশক্তি নাই তর। ধৈর্যশক্তি না থাকা আমার একদম পছন্দ না। একবার আমার এক বন্ধুরে লইয়া সিনেমা দেখতে গেছি। ইকবাল নাম। আমরা ডাকতাম শাদা হাত্তি কইয়া। ইয়া শাদা আর ইয়া মুডা আছিল। হলে গিয়া দেখি সিনেমার টিকিট নাই। হে কয় দেখবামই ছবি যেমনেই হোক। ব্ল্যাকে টিকিট কাইটাও দেখবাম। ব্ল্যাকে টিকিট তিন ডবল দাম। কইলাম চল কাইলকা দেখি। সে কয় ওইদিনই দেখব সে। ওই ম্যাটিনি শো। আমি ঘুরাইয়া একখান চড় মারলাম। ওই চড় খাওনের পর আমার সামনে সে আর অস্থিরতা দেহায় না কোনও কিছু লইয়া। তুই হইলি ইকবালের মত, তরও ধৈর্যশক্তি নাই।

    দাদাকে ভালবাসি, ঈর্ষাও করি। দাদা যেখানে খুশি যেতে পারেন, যা ইচ্ছে করতে পারেন। মোটর সাইকেল কিনে ওতে করে সারা শহর ঘুরে বেড়ান। নানান শহরে যান, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোণা। আমার বড় ইচ্ছে করে যেতে। বড় ইচ্ছে করে সীমানার বাইরে পা বাড়াতে। দাদা বলেছেন তরে একদিন জয়রামকুরায় পাহাড় দেখাতে নিয়া যাইয়াম, গারো পাহাড়।

    অপেক্ষায় অস্থির হতে থাকি। দাদা দিন পেছোতে থাকেন, এ মাসে না পরের মাসে করে করে। আমি তবু আশায় আশায় বাঁচি, একদিন খুব ভোরবেলা কারও জাগার আগে, পাহাড় দেখতে যাব, দূরে –অনেক দূরে, নির্জনতার পিঠে মাথা রেখে টিপটিপ টিপটিপ শিশিরের ঝরে পড়া দেখব।

    দাদার ফিরে আসার ক’মাস পর বাবা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে বদলি হন। বদলির খবর এলেই বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। তিনি দাদার ওপর বাড়িঘর দেখাশোনার ভার দিয়ে চলে যান মিটফোর্ডে। দু’দিন পর পর গভীর রাতে ট্রেনে করে ঢাকা থেকে চলে আসেন, রাতটুকু কাটিয়ে আবার খুব ভোরবেলা রওনা হয়ে যান ঢাকায়। মিটফোর্ডে তিনি জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগে অধ্যাপকের পদ পেয়েছেন। ছাত্র পড়ান। মর্গের লাশ কাটেন। বাবার বদলি হওয়ায় বাড়িতে সবচেয়ে বেশি যে খুশি হয়, সে আমি। আমার তখন পাখনা মেলার বয়স।

    এক বিকেলে বড় শখ হয় ব্রহ্মপুত্রের তীরে পা ভিজিয়ে হাঁটতে। বাড়ি থেকে এত কাছে ব্রহ্মপুত্র অথচ এটি দেখতে যাওয়ার অনুমতি জোটে না। যখন ছোট ছিলাম, বলা হত, এত ছোট আমি, আমার একা একা দূরে যাওয়া ঠিক না, ছেলেধরারা বস্তায় ভরে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। ফটিং টিং দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে, পায়ে কথা কয়, হাউমাউখাউ বলে খাবে আমাকে। আর যেই না বড় হয়েছি, শুনতে হচ্ছে, বড় মেয়েদের রাস্তায় বেরোনো ঠিক না। চুপচুপ করে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাইরে, সঙ্গে ইয়াসমিনকে নিই। মা ঘুমোচ্ছেন, দাদা বাইরে, বাবা ঢাকায়, আর আমাদের পায় কে। আমার ফটিং টিঙের ভয় নেই। যাব না কেন? যাব। সেই কত কাল থেকে বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে পুরো এক নদীর সমান দীর্ঘ করেছি স্বপ্ন, আমার মত করে ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটার, তার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার স্বপ্ন।

    ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটছি, আমার চুল উড়ছে, জামার ঝুল উড়ছে, কানে সাঁ সাঁ শব্দ পাচ্ছি বাতাসের। বিকেলের মিঠে রোদে বালু চিকচিক করছে। এমন সময়, এমন সময়ই, আমার প্রচন্ড আনন্দের বুকে বিষের তীর বেঁধাল এক যুবক। উল্টো দিক থেকে আসছিল, আমি দোষ করিনি কিছু, বাড়া ভাতে ছাই দিই নি তার, আমার দু’স্তনে আর পাছায় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে বিষম জোরে টিপে দিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে, যুবকের সঙ্গী আরও কিছু যুবক হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল দূরে দাঁড়িয়ে। আমার শরীর, যেন এ আমার নয়, ওদের মজা করার জিনিস। ব্রহ্মপুত্র সবার নদী, আমারও। আমার অধিকার আছে এ নদীর পাড়ে আসার। কিন্তু কি অধিকারে আমাকে ওরা অপমান করে! দু’হাত আমি মুঠোবন্দি করি। ইচ্ছে হয় সবকটিকে চাবকাই। চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলি। পারি না। এগোতে পারি না দু’কদম।

    ইয়াসমিন কাঁপা গলায় বলে, বুবু চল বাসাত যাইগা। আমার ডর করতাছে।

    ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি মা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসে কথা বলছেন আমান কাকা।

    — কি খবর কেমন আছো মা? আমান কাকা জিজ্ঞেস করেন।

    আমি শ্যেন দৃষ্টি ফেলে লোকটির দিকে, একটি শব্দ উচ্চারণ না করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। প্রাণ খুলে কাঁদি আমি, আমার সকল অক্ষমতার জন্য কাঁদি। কাউকে বুঝতে দিই না যে আমি কাঁদছি। কাউকে বুঝতে দিই না যে যন্ত্রণার গভীর গহন জল আমাকে পাকে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে আরও অতলে।

    মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম — আমান কাকা কেন আইছিল?

    মা মধুর হেসে বলেছেন — ও আল্লাহর পথে আইব। ওরে নছিহত করতাছি।

    আমি বলি — বেশি নছিহত করতে যাইও না। নছিহত করতে গিয়া মুবাশ্বেরা মরল, দেখলা না!

    আমার স্বর এত ক্ষীণ ছিল, মা শুনতে পাননি। অথবা মা বুঁদ ছিলেন কিছুতে যে শোনার চেষ্টা করেননি।

    আমান কাকা প্রতিদিন সন্ধেয় বাড়ি এসে মা’র ঘরে ঢুকে ফিসফিস কথা বলেন। মা দরজা ভেজিয়ে রাখেন সে সময়। একদিন ভেজানো দরজা ঢেলে ঢুকেছি, আমান কাকা লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলেন, মশারির নিচে মা।

    — মা এই অন্ধকারে বইসা কি কর! আমি জিজ্ঞেস করি।

    মা বলেন — না, আমানের ত ওর বউএর সাথে গন্ডগোল হইছে। ওর মনডা খারাপ। তাই আমার কাছে আইসা দুঃখের কথা কইয়া একটু শান্তি পায়। ওরে বুঝাইতাছি, আল্লাহর পথে আইতে।

    — আমার ক্ষিদা লাগছে। ভাত দেও।

    খামোকাই বলি। ক্ষিধে পেলে মণিই আমাকে ভাত দিয়ে যায়।

    মা বলেন, বিরক্ত হয়ে — আমার মাথা বেদনা করতাছে। একটু শুইছি। তগোর জ্বালায় কি একটু শুইয়াও শান্তি পাইতাম না!

    ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। বারান্দার বাতাসে এসে শ্বাস নিই ফুসফুস ভরে। আমার শ্বাস কষ্ট হয়, আমান কাকার সঙ্গে মা’কে গা রেগে বসে থাকতে দেখে। যে লোক সাত বছর বয়সী আমাকে ন্যাংটো করেছিল, সে লোক অন্ধকারে মা’কেও ন্যাংটো করছে বলে আমার আশংকা হয়।

    দাদারও চোখ এড়ায় না আমান কাকার অসময়ে বাড়ি ঢোকা, কেমন কেমন চোখে ইতিউতি তাকানো।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }