Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৮. উইপোকার ঘরবাড়ি

    মা’র কাঠের আলমারির এক তাকে কেবল বই, বাকি তাকগুলোয় কাপড় চোপড়, ভাঁজহীন, ঠাসা। বইয়ের তাকটিতে হাদিসের বই, মকসুদুল মোমেনিন, নেয়ামুল কোরআন, পীর আমিরুল্লাহর লেখা কবিতার বই মিনার, তাজকেরাতুল আওলিয়া, আর হু এম আই বলে একটি ইংরেজি বইও। আমিরুল্লাহ আবার ইংরেজিও জানেন। মা অনেকদিন আমাকে বলেছেন হুজুর খুব জ্ঞানী, ফটফট কইরা ইংরেজি কন। যখন বলেন মা, চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

    তিনি নিশ্চয় দুনিয়াদারির লেখাপড়া করেছেন! এরকম একটি প্রশ্ন আমি করতে চেয়েছি মা’কে। আবার বেয়াদবি হবে বলে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছি আস্ত বাক্য। আল্লাহ রসুল নিয়ে মা আসলে কোনও যুক্তিতে যেতে চান না। পীর আমিরুল্লাহ নিয়েও নয়। যা বলবেন, তা আমি হ্যাঁ হুঁ করে শুনে গেলে মা বেজায় খুশি। মা’র যেহেতু সন্তান আমি, মা’কে খুশি করার দায়িত্ব আমার, এ রকমই জ্ঞান আমাকে দেওয়া হয়েছে। মা’কে খুশি রাখলে চড় চাপড় কিল ঘুসি থেকে বাঁচা যায়, বরং খেতে বসলে মা খাতির করে মাছ মাংসের টুকরো পাতে তুলে দেন। মা’র আদর পাওয়ার লোভের চেয়ে কিল চড় না খাওয়ার ইচ্ছেতেই ঠোঁট সেলাই করে রাখি অদৃশ্য সুতোয়। কোরান হাদিস যারা না মানে, মা স্পষ্ট বলেন, তারা মুসলমান নয়। তারা দোযখের আগুনে পুড়বে। খাতির নেই। ব্যস, সহজ হিশেব। আল্লাহর হিশেব বরাবরই বড় সহজ। নামাজ নেই রোজা নেই, তো দোযখের আগুন। বোরখা পরা নেই, দোযখের আগুন। বেগানা পুরুষের সঙ্গে মেশা, দোযখের আগুন। পেশাব করে পানি না নিলে দোযখের আগুন। জোরে হাসলে দোযখের আগুন। জোরে কাঁদলেও দোযখের আগুন। কেবল আগুন। মা’কে বলতে ইচ্ছে করে আগুনে কেন লোকের এত ভয়! আজকাল আগুন কোনও ব্যাপার হল! শীতের দেশে তো ঘরে ঘরে আগুন জ্বেলে রাখে। আগুন নিয়ে সার্কাসের লোকেরা চমৎকার খেলা খেলে। আগুনে পুড়লে চিকিৎসা আছে, সেরে যায়। আর আল্লাহই বা মানুষকে আগুনের ভয় এত দেখান কেন! আরও কত কত ভয়ংকর পদ্ধতি আছে কষ্ট দেবার, সে পথ আল্লাহ একেবারেই মাড়াননি। বদ লোকেরা শরীরে কষ্ট দিতে ভালবাসে আর চতুর লোকেরা মনে কষ্ট দেয়। শরীরের কষ্টের চেয়ে মনের কষ্টে মানুষ ভোগে বেশি। আল্লাহকে চতুর না মনে হয়ে বরং মনে হয় বড় বদ। গেতুঁর মার স্বামীর মত। সময় সময় বাবার মত, বাবা চান তিনি যা বলেন তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। না পালন করলে শরীরে কষ্ট দেন আচ্ছামত পিটিয়ে। বাবার সঙ্গে আল্লাহর তফাৎ হল বাবা চান দুনিয়াদারির লেখাপড়া করে মানুষ বানাতে, আর আল্লাহর ইচ্ছে হাদিস কোরান পড়ানো। বাবার সঙ্গে আমি যেমন দূরত্ব অনুভব করি, আল্লাহর সঙ্গেও। বাবা এ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকলে আমি খুশি হই, আবার আল্লাহর যেহেতু আকার নেই, বেচারা, আমি অপ্রস্তুত হই তাঁর প্রসঙ্গ এলেও। আসলে দু’জনের অনুপস্থিতিই আমার কাম্য। দু’জনই আমাকে দু’রকম দু’টি দিকে এমন ঠেলে দেন যে আমার নিজের কোনও অস্তিত্ব থাকে না, থাকে কেবল দ্বিখন্ডিত মর্গের লাশ। আমার ওপর খুশি হলে বাবা আমার জন্য খাঁচা ভরে মিষ্টি কিনে আনেন, বড় বড় রুই কাতলা কিনে এনে বড় পেটিগুলো খেতে বলেন। আল্লাহও তো যাকে খাওয়াবেন, তাকে নাকি একেবারে ঠেসে। পাখির মাংস, আঙুর, মদ, কত কিছু। সুন্দরী গোলাপী শরীরের মেয়েরা পুরুষের পাত্রে মদ ঢেলে দেবে। নানা বিষম খুশি যে বেহেসতের খাবার খেয়ে সুগন্ধি ঢেকুর উঠবে। আমার আবার কারও ঢেকুর তোলা দেখতে বিচ্ছিজ্ঞর লাগে। সে সুগন্ধি হোক কি দুর্গন্ধি হোক। এরকম কি হবে যে কোনও ঢেকুর তোলা লোকের সামনে নাক পেতে রইল আরেকজন ঢেকুরের সুগন্ধ নিতে। ধরা যাক সুগন্ধ ঢেকুর শোঁকা চরিত্রে গেঁতুর বাবা আর ঢেকুর ছাড়া চরিত্রে নানা। হাদিসের বইটি ডানে নিয়ে আমি চরিত্রদুটোকে আমার বাঁ পাশে বসাই। তারা ঢেকুর ছাড়ে আর ঢেকুর শোঁকে। আমি উইপোকায়, অক্ষরে, ঢেকুর ছাড়া-শোঁকায়। আমি আছি, অথচ নেই। ঢেকুর ছাড়া-শোঁকা নেই, অথচ আছে। উইপোকা আর অক্ষর থেকে যায় আমার সঙ্গেও, ঢেকুরের সঙ্গেও। তাদের বিলীন করতে মনে মনেও, আমার ইচ্ছে নেই। হাদিসের বইটির ভেতর উইপোকা বাসা বেঁধেছে। বাড়িটি স্যাঁতসেঁতে, কিছুদিন বইয়ের পাতা না ওল্টালেই উই ধরে। উইএর পেট মোটা শরীর দেখে গা রি রি করে আমার। বইটির ওপর বাবার একটি পুরোনো জুতো ঠেসে কিছু উই থেতলে ফেলি। এক চোখ উইএর থেতলে যাওয়া শরীরে, আরেক চোখ বইয়ের অক্ষরে। অক্ষর গুলো থরে থরে সাজানো আছে এরকম– দুনিয়ায় সবকিছু ভোগের সামগ্রী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।

    মেঝেয় আধ শোয়া হয়ে আমার এক হাতে জুতো, আরেক হাতে হাদিসের বই, উইএর পাছার তলে পবিত্র হাদিসের বাণী — যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম, তবে নিশ্চয় সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহাদের স্বামীকে সেজদা করে।

    যখন কোনও স্ত্রী তাহার স্বামীকে বলিবে যে তোমার কোনও কার্যই আমার পছন্দ হইতেছে না, তখনই তাহার সত্তর বছরের এবাদত বরবাদ হইয়া যাইবে। যদিও সে দিবসে রোজা রাখিয়া, ও রাত্রে নামাজ পড়িয়া সত্তর বছরের পুণ্য কামাই করিয়া ছিল। স্বামী স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, স্ত্রীকে সাজসজ্জা করিয়া তাহার নিকট আসিতে বলার পর স্ত্রী তাহা অমান্য করিলে, সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামীর আহবান পাওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করিলে, স্ত্রী ফরজ গোসল ও নামাজ পরিত্যাগ করিলে, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারো বাড়ি বেড়াইতে গেলে।

    যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহ শহীদের তুল্য সওয়াব দান করিবেন।

    পোকাগুলো বই ছেড়ে আমার গায়ের দিকে হাঁটতে থাকে। আমাকেই বুঝি এখন খেতে চায় এরা! বাড়িটি ভরে গেল ঘুণপোকায়! উইপোকায়। রাতে কুট কুট করে ঘুণপোকা কাঠ খায়, আর নিঃশব্দে উই খায় বইয়ের পাতা। মহানবী হযরত মহাম্মদের বাণীগুলোও দিব্যি খেয়ে ফেলতে থাকে। উই কি মুসলমান! উইএর নিশ্চয় ধর্ম থাকে না। এরা শরদিন্দু অমনিবাসও খায়, হাদিস কোরানও খায়।

    দিলরুবা ইস্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর আমার সঙ্গী হয়েছিল বই। লাইব্রেরির বইগুলো দ্রুত শেষ হতে থাকে। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ যা পাই ছাদে বসে, ছাদের সিঁড়িতে, পড়ার টেবিলে, বিছানায় শুয়ে, পড়ি। বাবা বাড়ি এলেই অপাঠ্য লুকিয়ে পাঠ্য বই ধরি, মূলত মেলে বসে থাকি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে, চুপি চুপি বাতি জ্বেলে মশারির নিচে শুয়ে অপাঠ্য পড়ি। পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোয় ইয়াসমিন। মা মাঝে মাঝে বলেন — সারাদিন কি এত ছাইপাশ পড়স! মুবাশ্বেরা মইরা গেল। একটু আল্লাহর নাম ল এহন। সবারই ত মরতে হইব। মা’র কথার আমি কোনও উত্তর করি না। মা’র আদেশ উপদেশ আমার মাথার ওপর জৈষ্ঠ্যের সূর্য হয়ে বসে থাকে যেন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।

    কোরান হাদিসের কথা না মানলে আখেরাতে আর রক্ষে নেই এরকম হুমকি আমাকে অনেক শুনতে হয়েছে। তবে এ যাবৎ হাদিস কাকে বলে আমার ঠিক জানা ছিল না। এখন জানার পর আর ইচ্ছে নেই তলিয়ে জানার। গুয়ের চারিতে জানি গু-ই থাকে, ওতে ঝাঁপ দিয়ে মণি মুক্তা খুঁজে পাওয়ার কোনও কারণ নেই। উইএ খাওয়া বইটিকে দু’হাতে বন্ধ করে রাখি। বইটি থেকে বেরোতে থাকে ঢেকুর, যেন এও গিলেছে বেহেসতের খানা। মা’র পায়ের শব্দে আমি তড়িতে বইটি তুলে তাকে রেখে দিই যেমন ছিল। উইপোকা নিঃশব্দে হাদিসের বই খাচ্ছে, মা জানেন না। মা ব্যস্ত আমান কাকাকে নছিহত করতে। প্রতিরাতে, মা’র অন্ধকার ঘর থেকে ফিসফিস খিলখিল শব্দ শুনি নছিহতের। মা’কে উইপোকার খবর কিছু বলি না। ওদের ক্ষিধে লেগেছে, খাক। আমার কি দায় পড়েছে পোকা মারতে যাওয়ার!

    মুবাশ্বেরা মরে গেছে বলে আমি বুঝি না আমাকে কেন আল্লাহর নাম নিতে হবে। আল্লাহর নাম আমার নিতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয় আল্লাহ ফাল্লাহ সব বানানো জিনিস। কোরান এক অশিক্ষিত লোভী কামুক পুরুষের লেখা, শরাফ মামার মত কোনও লোকের। অথবা ব্রহ্মপুত্রের তীরে যে লোকটি আমার বুক পাছা চেপে ধরেছিল, সে লোকের মত। হাদিস যদি মহাম্মদের বাণী হয়, তবে মহাম্মদ লোকটি নিশ্চয় গেঁতুর মা’র স্বামীর মত, কুৎসিত, কদাকার, নিষ্ঠুর। আল্লাহ আর মহাম্মদে আমি কোনও তফাৎ দেখতে পাই না।

    বইটি তাকে তুলে রাখি ঠিকই, কিন্তু মনে আমার রয়ে যায় লক্ষ উই। ভেতরে নিঃশব্দে আমার অক্ষর শব্দ বাক্য জানি না কী কী সব আরও খেয়ে যায়।

    বিকেলে গেতুঁর মা আসে। গেঁতুর মা’কে দেখে আমি প্রথম চিনতে পারিনি যদিও ভাঙা গলায় আগের মতই কথা বলে যাচ্ছিল। মা বসে ছিলেন বারান্দার চেয়ারে, হাতে তসবিহর গোটা নড়ছিল, গেঁতুর মা’র কথাও মা শুনছিলেন মন দিয়ে। তসবিহ নড়াতে হলে চাই মন দিয়ে দরুদ পড়া। দুটো কি করে একই সঙ্গে পারেন মা! মা’র সম্ভবত দুটো মন। একটি মন আল্লায়, আরেকটি মন জগতে। মা’র জগতটি আবার বেশ ছোট। দিনে দু’বার সে জগতে ভ্রমণ সারা যায়। গেঁতুর মা হঠাৎ কথা থামিয়ে কাপড় সরাতে শুরু করল। মা’র আঙুল তখন নীল তসবিহর গোটা আগের চেয়ে আরও দ্রুত সরাচ্ছে। তসবিহর গোটা সরে, গেঁতুর মা’র কাপড় সরে। তালে তালে। কাপড় সরিয়ে উরু, পা, পায়ের পাতা উন্মুক্ত করল সে, পোড়া। মা আহা আহা করে উঠলেন। গেঁতুর বাবা নয়, এবারের কান্ডটি করেছেন আরেক লোক, সফর আলি। সফর আলির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বছর দুই হল গেঁতুর মার। সে লোকই চেলা কাঠে আগুন লাগিয়ে পুড়েছে তাকে। কেন? যেহেতু স্বামী সে, স্বামী মাত্রই অধিকার রাখে স্ত্রীকে যা ইচ্ছে তাই করার। আমি এরকম একটি উত্তর দাঁড় করাই মনে মনে। কিন্তু মা এবং গেঁতুর মা’র জবাব ছিল সফর আলি লোকটি একটি ইতর, বদমাশ।

    বলতে ইচ্ছে করে মা’কে, সফর আলি কোরান হাদিস মেনে চলে তাই বউ মেরেছে। ঠোঁটের মধ্যে অক্ষরগুলো নাড়াচাড়া করি। শেষ অবদি গিলে ফেলি। অক্ষরগুলো কি সবই উইএ খাচ্ছে! কে জানে!

    গেঁতুর মা এ বাড়িতে ঝি-গিরি করতে এসেছে। পোড়া শরীর নিয়ে তার আর বিয়ে হওয়ারও জো নেই। কোনও পুরুষ তাকে আর ভাত কাপড় দেওয়ার জন্য বসে নেই। মা বলেন, তসবিহর গোটা তখন ধীরে ধীরে পার হয়, আমার তো বান্ধা কামের ছেড়ি একটা আছে। আমার আর লাগব না।

    মা’র পা দুটো নড়ে। কিসের তালে কে জানে। অন্তরে তাঁর কোনও গোপন সঙ্গীত বাজে সম্ভবত। ময়ুর নাচের তাল। মা পেখম গুটিয়ে রাখেন দিনে, রাতে মেলেন। মা’র দু’পায়ের ফাকে চোখ রেখে আমি গেঁতুর মা’র সন্ধে নামা মুখখানা দেখি ঘরের চৌকাঠে বসে। আবছা অন্ধকারে মা’র হাতের তসবিহর নীল গোটাগুলো জ্বলতে থাকে বেড়ালের চোখের মত।

    গেঁতুর মা’কে মা কাজ দিচ্ছেন না, কিন্তু বললেন খালি মুখে যাইও না। ডাইল ভাত কিছু খাইয়া যাইও।

    আমি ফোঁস করে বলি, চৌকাঠে বসেই, পোড়া শরীর থেকে চোখ সরিয়ে — গেঁতুর মারে কামে রাখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইত!

    মা নিরুত্তাপ স্বরে বলেন — মহাভারত ত অশুদ্ধই।

    গেঁতুর মা বসে থাকে বারান্দায় কাটা গাছের গুঁড়ির মত। গাছের গুঁড়ির মাথার ওপর একশ মশা চরকির মত ঘুরছে, হাতে পায়ে কালো হয়ে মশারা লঙ্গরখানার খাবার খেতে বসেছে। পোড়া ত্বক থেকে সম্ভবত অনভূতিটুকুও উবে গেছে। কেবল পেটের ক্ষিধেটুকু রয়ে গেছে পেটেই। গরিবের এই হয়, সব যায়, সংসার সমাজ স্বজন সম্পদ, কেবল ক্ষিধে যায় না। আমি যদি গেঁতুর মা হতাম, নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে দেখি, দুটো ডাল ভাতের জন্য আমি অপেক্ষা না করে উঠে যাচ্ছি, পেছন ফিরছি না। হেঁটে যাচ্ছি বেল গাছের তল দিয়ে কালো ফটকের বাইরে। হাঁটছি, বাতাসের আগে আগে, পাগলা দুলালের মত হাঁটছি, কোথাও কারও দিকে না ফিরে। দুলাল মাউথ অর্গান বাজিয়ে হাঁটে, আমার মাউথ অর্গান নেই, আমার বুকের ভেতর বহুকাল থেকে জমা আর্তনাদ আছে, আর কোনও বাজনার দরকার নেই আমার। ভেতর থেকে হলকা বেরোচ্ছে আগুনের, এ আগুন আমাকে আর পোড়াচ্ছে না, মন পুড়ে সেই কবেই ছাই হয়ে গেছে, শরীরে আর কোনও বাকি ত্বক নেই আমার না পোড়া — এ আগুন আমার পোড়া ত্বক থেকে ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। আমি যখন সফর আলীর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছব, আমাকে দেখে সে চমকাবে, চুলো থেকে খড়ি হাতে নিয়ে তেড়ে আসবে, আমাকে স্পর্শ করার আগেই তার গায়ে আগুন ধরবে, ফুঁসে ওঠা ফুঁড়ে ওঠা আগুন, অন্ধ উদ্বাহু আগুন। আগুন ধেই ধেই নাচবে সফর আলীর শরীরে, তার হাতের জ্বলন্ত খড়িতে। তার খাঁক হওয়া অবদি আমি দাঁড়িয়ে থাকব। আমার ক্ষিধে মিটবে।

    যে আগুন এতকাল ওরা আমার ভেতর পুরেছে, সেই আগুনই চতুর্গুণ ফুঁসে উঠছে আমার ভেতরে। আমি বাতাসের আগে আগে আবার পাগলা দুলালের মত হাঁটছি। আগুনই আমাকে সফর আলীর বাড়ি থেকে আলো হয়ে পথ দেখিয়ে নেবে গেঁতুর বাবার উঠোনে, সে উঠোনের বাতাসে আমি আমার কাতরানোর শব্দ পাব। সেই কাতরানো, এক উঠোন মানুষের সামনে, তালাক হয়ে যাওয়া আমার কাতরানো।

    এটুকু ভেবে, আমি শ্বাস নিই। গেঁতুর মা গাছের গুঁড়ির মত বসে আছে বারান্দায়। মশা চরকির মত ঘুরছে তার মাথার ওপর। তার কুঁকড়ে থাকা শরীরটির দিকে চেয়ে আমি আর তার জায়গায় নিজেকে না বসিয়ে নিজের জায়গায়, চৌকাঠে, নিজেকে এভাবেই বসিয়ে রেখে গেঁতুর বাবার কুতকুত খেলার বয়সী বউ হই নিজে, গেঁতুর বাবার দায়ের কোপ আমাকে ফালি ফালি করে কাটে। রক্তাক্ত আমি উঠোন পড়ে কাতরাচ্ছি আর উঠোনে জড়ো হওয়া মানুষ আমাকে নিঃশব্দে দেখছে হাতে কনুইয়ের ভর রেখে, মাথার পেছনে হাত রেখে, দেখছে বায়োস্কোপের শেষ দৃশ্য। আমি তাবৎ দর্শককে চমকে দিয়ে গেঁতুর বাবার হাত থেকে দা ছিনিয়ে নিয়ে চামড়া কাটছি তার গায়ের, কেটে লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছি। উঠোনের লোকেরা পাড়া কাঁপিয়ে চেঁচাচ্ছে, বলছে আমি পাগল, বদ্ধ পাগল।

    হা পাগল!

    মণির গায়ের চামড়া ছিলে মা লবণ মাখবেন বলেছিলেন ও চিংড়ি মাছের মাথা থেকে গু ফেলেনি বলে। আমান কাকা চিংড়ির মালাইকারি খেতে চেয়েছিলেন, খেতে গিয়ে তাঁর বমি হয়ে যায়। মা ক্ষেপে একেবারে ভূত হয়ে যান মণির ওপর। মণি সত্যি সত্যি ভাবছিল ওর চামড়া ছিলে লবণ মাখা হবে। আমিও। মণিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চামড়া ছিইলা লবণ মাখলে কি হয়রে মণি?

    –যন্ত্রণা হয় খুব। মণি বলেছিল, আতংকে নীল হয়ে ছিল ওর সারা মুখ।

    ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে, ক’টি নিশুত রাতে ওর সঙ্গে শরীর শরীর খেলা খেলেছিলাম, মনে পড়ে। আলগোছে সরিয়ে নিই হাত। মনে মনে বলি, মণি তুই ভুলে যা ওইসব দিনের কথা, এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তোর স্বপ্নের একটা ঘর তোল, তোর মা’কে আর চিনিকে নিয়ে সুখে থাক, কোনও ভরা শস্যের মাঠের কাছে থাক। যদি নদী থাকে ধারে কাছে, জলের মধ্যে কি করে সূর্য ডোবে দেখিস, আকাশে যে কি চমৎকার রং ফোটে তখন মণি! দেখিস তোর মন ভাল হবে।

    মণির গায়ের চামড়া শেষঅবদি তোলেননি মা, লবণও মাখেননি। তবে কাউকে কাউকে এভাবে আমি মনে মনে যন্ত্রণা দিই। শরাফ মামাকে, আমান কাকাকে। আজ ইচ্ছে করছে গেঁতুর বাবাকে। কেবল ইচ্ছেই সার, মাঝে মাঝে ভাবি, কতটা আর পারি আসলে আমি! লিকলিকে এক মেয়ে, ঝড়ো হাওয়ায় হেলে পড়ি, আমার কি সাধ্য আছে রুখে দাঁড়াতে! মাঝে মাঝে এও ভাবি, না থাক, ইচ্ছেটুকু আছে তো!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }