Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶

    ১৯. যুদ্ধের পর

    ক.

    পাড়ার খালি পড়ে থাকা বাড়িগুলোয় হিন্দুরা ফিরে আসছে। কলকাতার শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসছে নিজের দেশে, ফেলে যাওয়া ঘরে। জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে সব। খাঁ খাঁ করা উঠোনে রাস্তার নেড়িকুকুরগুলো শুয়ে ছিল। এখন মানুষে কলকল করছে। ছাদের রেলিংএ থুতনি রেখে ওদের ফিরে আসা দেখি। শুকনো ব্রহ্মপুত্রে যেন জোয়ার এসেছে। মরা বাগান ফুলে রঙিন হয়ে আছে। হারানো জিনিসের জন্য ওদের কাউকে শোক করতে দেখি না। নিজের ভিটেটুকু পেয়েই ওরা খুশি। এর মধ্যেই কীর্তন গাইতে শুরু করেছে কোনও কোনও বাড়ি। মেয়েরা সন্ধের বাতি নিয়ে উলু দিচ্ছে ঘরে ঘরে। আস্ত একটি শ্মশান আজ গা ঝেড়ে জাগল।

    ওরা চলে আসার দিন সাতেক পর আমাদের কালো ফটক খুলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা আসে, পেছনে পনোরো ষোলজন মুখ চেনা পাড়ার লোক। অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাই বাড়ির ভেতর হেসে, ওদের কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই যেন জন্মের শত্তুরের বাড়ি ওরা বেড়াতে এসেছে। ওরা এ ঘরে ও ঘরে হাঁটে, আর বলে কই লুটের মাল কই! যার যা মাল উঠাইয়া লও।

    পাড়ার মুখ চেনা লোকেরা এক এক করে আমাদের কাঁসার বাসন, পেতলের কলসি, চেয়ার টেবিল উঠিয়ে নিয়ে যায়। মা সেলাই মেশিনের ছিদ্রে তেল ঢালছিলেন, তেলের কৌটো হাতেই ধরা থাকে, মেশিনটি আলগোছে একজন কাঁধে উঠিয়ে নেয়। হতবাক দাঁড়িয়ে থাকি আমি, মাও।

    বাড়ি লুট করে ওরা চলে যাওয়ার পর মা বলেন যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিকই আছে। কথাটি বাবার উদ্দেশ্যে বলেন মা, আমি বুঝি। গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর বাড়িতে নতুন কিছু জিনিস দেখে মা বলেছিলেন এইগুলা কি কিনলা নাকি? কিনলা কিনলা পুরান জিনিস কিনলা ক্যান? পচা গলা গুড়ের ড্রাম দিয়া করবাটা কি!

    বাবা মোজা খুলে জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিলেন, কথা বলছিলেন না।

    — নাকি, হিন্দু বাড়ি থেইকা লইয়া আইলা! মা নাক সিঁটকে বলেছিলেন।

    বাবা তারও উত্তর দেননি।

    গুড়ের ড্রামগুলো দেখে আমিও অবাক বনেছিলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল বাবা অন্যের বাড়ি থেকে জিনিসগুলো না বলে নিয়ে এসেছেন। যে বাবা প্রদীপ নামের এক হিন্দু ছেলেকে যুদ্ধের সময় বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আলম নাম নিয়ে ছেলেটি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দিব্যি থেকে গেছে বাড়িতে, বাবা তাকে ওষুধের দোকানে রীতিমত ক্যাশে বসার কাজও দিয়েছেন আর সেই বাবা কি না হিন্দুদের ফেলে যাওয়া জিনিসে লোভ করেছিলেন! একাত্তরে এ বাড়িতে বড়দাদা, রিয়াজউদ্দিন আর ঈমান আলী ছিলেন। এরকমও হতে পারে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন ওঁরাই।

    বাবাকে যেহেতু প্রশ্ন করার বুকের পাটা নেই, বড়াদাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হিন্দুদের জিনিস তুমরা লুট করছিলা নাকি!

    বড়দাদা বারান্দায় লোহার চেয়ারে বসে উঠোনের হাঁসমুরগির হাঁটাচলা দেখছিলেন। যেন হাঁসমুরগিই জগতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রাণী, যেন হাঁসমুরগির বাইরে মানুষ এবং তাদের যে কোনও জিজ্ঞাসা নিতান্তই ছেঁদো। প্রশ্নটি তাঁর গা ঠেলে ঘোর ভাঙিয়ে আবার করলে তিনি উত্তর দেন — বিহারিরা রাস্তায় ফালাইয়া জিনিসপত্র পুড়াইয়া দিতাছিল, রাস্তা থেইকা টুকাইয়া কিছু জিনিস বাড়িতে আইনা রাখছিলাম।

    — কেডা আনছিল? বাবা ? বাবা আনছিল কি না কও? আমি চেপে ধরি বড়দাদাকে।

    বড়দাদা হাঁস মুরগির দিকে গম ছুঁড়ে দিতে দিতে বলেন — ওই আমরাই।

    ওই আমরাই। এরকম ওই হোথা উত্তর আমাকে স্বস্তি দেয় না।

    বাড়ি লুট হওয়ার খবর পেয়ে বাবা বাড়ি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কনুই ভেঙে দু’বাহুতে দুটো হাত রেখে। আমার ভাবতে ভাল লাগে বাবা অনুতাপ করছেন।

    আমার দেখতে ইচ্ছে করে অনুতাপ করা বাবার মুখখানা। কেবল বাবার গর্জন শুনেছি, অহংকার দেখেছি। এত অহংকার, মানুষকে, আমার মনে হয় অমানুষ করে ফেলে সময় সময়।

    দাদা ফিরে এলে খবর দিই — লুটের মাল ফেরত নিছে মানুষেরা।

    ছোটদা ফিরে এলেও বলি।

    বাড়ি থমথম করে। বাবা দাঁড়িয়েই থাকেন বারান্দায় হাতদুটো হাতে বেঁধে। স্তব্ধতা ভেঙে কাচ-ভাঙা গলায় মা বলেন, বাবা যেন শুনতে পান এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে, — কী দরকার আছিল পচা গুড়ের ড্রাম লুট করার! পাপের শাস্তি আল্লায়ই দেন। মাঝখান থেইকা আমার জিনিস গেল। আমার সেলাই মেশিনডা। নিজে টাকা জমাইয়া কিনছিলাম।

    দুঃসময় আসে যখন, ঝাঁক বেধেঁই আসে। বাড়িটি লুট হওয়ার পর ঠিক পরের দিনই দাদাকে রক্ষীবাহিনীরা রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রক্ষীবাহিনী নামে একটি বাহিনী বানিয়ে তাদের হাতে সন্ত্রাস কমানোর দায়িত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিব। তারা নানা জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে, ব্যস, রাস্তাঘাটে যাকেই সন্দোহ হচ্ছে, ধরে নিয়ে হাত পা বেঁধে পেটাচ্ছে। ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা শাদাসিধে দাদাকেও। দাদাকে ছুটিয়ে আনতে গিয়ে ফেরত এলেন বাবা একা। পনেরোদিন একটানা পিটিয়ে সন্ত্রাসের কোনও হদিশ না পেয়ে ওরা ছেড়ে দিল দাদাকে। ঘাঁটি থেকে ফেরত এসে দাদা ভীষণ বিরোধী হয়ে উঠলেন শেখ মুজিবের। বলে বেড়ালেন — পাকিস্তান আমলই ভাল ছিল। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা ছিল।

    যারা শেখ মুজিবকে পছন্দ করত, তারাও বলতে শুরু করেছে, এ কেমন সরকার, রক্ষীবাহিনী দিয়া দেশের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করতাছে!

    খ.

    এরকম কথা বছর কয়েক ধরে চলে। অসন্তোষ বাড়ে মানুষের। শেখ মুজিব বাকশাল নামে রাজনৈতিক দল তৈরি করে বাকি সব দল নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

    — এ কেমন সরকার যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়, মানুষ মরে না খাইয়া। বাবা বলেন।

    টুপি দাড়ি অলা লোকেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে চেঁচাতে লাগল — এইরম স্বাধীনতার কোনও মূল্য নাই। দেশটারে আবার পাকিস্তান বানাইতে হইব।

    বড় মামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন — দেশের যে কী হবে বুঝতে পারতাছি না। পাকিস্তান আমলেও যা হয় নাই এই দেশে তাই করতাছে এই সরকার। শবে বরাত পালন করছে ঘটা কইরা বঙ্গবভনে। পাকিস্তান আমলেও শবে বরাত পালন করা হইত না। ইসলামি সম্মেলনে গেছে মুজিব। রাশিয়া কত সাহায্য করল যুদ্ধের সময়, এহন মুজিব সরকার ইসলামি বিশ্বের খাতায় বাংলাদেশের নাম লেখাইছে। ভারতের বিরুদ্ধেও কথা কয় সরকার। ভারতের আর্মি না আসলে দেশ স্বাধীন হইত নাকি!

    আমি রাজনীতির বেশি কিছু বুঝি না। যখন শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ বাজে রেডিও তে, এটুকুই বুঝি আমার ভাল লাগে। রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় উত্তেজনায়। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম যেন নিছক স্লোগান নয়, রক্তে তুফান তোলা কবিতা। ইস্কুলে গানের ক্লাসে গাই জয় বাংলা বাংলার জয়। এ তো নিছক গান নয়, অন্য কিছু। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠার কিছু। পাড়ায় ক’দিন পর পরই প্যান্ডেল খাটিয়ে নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়, ছুটে যাই মাইকে গানের আওয়াজ পেলেই। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছেলে মেয়েরা গান করে, নাচে। কী যে সুন্দর দেখায় ওদের! গানগুলো বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়। ক্ষুদিরামের গান শুনলেও এমন হত। ক্ষুদিরামের গল্প বলতেন কানা মামু, দেশ স্বাধীন করার জন্য এক ছেলে ইংরেজ বড়লাটকে বোমা মেরে ফাঁসিতে ঝুলেছিল। আমারও ক্ষুদিরামের মত হতে ইচ্ছে করে। অমন সাহসী, অমন বেপরোয়া।

    হঠাৎ একদিন, সে সময় হঠাৎই, পুরো শহর থম থম করে। পাড়ার লোকেরা রাস্তায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। যেন পৃথিবী ধ্বসে পড়ছে আর দু’মিনিট পর এ পাড়ার মাথায়। কারও কারও কানে রেডিও। মুখ শুকনো। চোখ গোল। কি হল কি হল। আবার কী! কান পেতে রেডিও শোনার দিন তো শেষ একাত্তরে, চারটে বছর কেবল পার হল, এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ গেল, ভাঙা সেতু ভাঙা রাস্তা ঘাট সারাই হচ্ছে, কী হল তবে আবার! দেশ থমথম করলে লোকের অভ্যেস রেডিওতে বিবিসি শোনা। দেশের খবরে এ সময় কারও আস্থা থাকে না। লোকে যা করে, বাবাও তা করেন। আমাকে রেডিওর নব ঘোরাতে বলেন বিবিসির খবর ধরতে, বড় একটি দায়িত্ব পেয়ে খানিকটা গৌরব হয় আমার। আমাকে কখনও পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু করার আদেশ বাবা দেন না। জগত সংসারের অন্য কিছুতে আমাকে ডাকা হয় না। নব ঘোরানোর কাজ সব দাদার কিংবা ছোটদার। আমার কেবল দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। দাদা নেই বাড়িতে, চাকরির কারণে শেরপুর গেছেন দু’দিনের জন্য। ছোটদা তো নেইই। নেই বলে আমি আজ নতুন রেডিওর নব ঘোরানোর দায়িত্ব পেয়েছি। বিবিসির কাছাকাছি এলে বাবা বলেন থাম থাম। শব্দ ভেসে আসে ঈথারে, ভাঙা শব্দ, অর্ধেক উড়ে যাওয়া শব্দ।

    শেখ মুজিব নিহত।

    কেবল তাই নয়, পরিবারের প্রায় সবাইকে কারা যেন গুলি করে মেরে রেখেছে তাঁর বষিনশ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। এ কি হল! এ ও কি সম্ভব! কপালের শিরা চেপে বসে থাকেন বাবা। ছোটদা বাড়ি থাকলে ঠোঁট ছোট করে বসে থাকতেন বারান্দায়। দাদা হয়ত বলতেন — শেখ কামাল আর শেখ জামাল, মুজিবের দুই ছেলে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মানুষেরে জ্বালাইয়া খাইছে। পকেটে পিস্তল নিয়া ঘুরত। বড় বাড় বাড়ছিল, মানুষ কত আর সহ্য করব।

    মা ঘর ময় হাঁটেন অস্থির, আর থেকে থেকে বলেন — এই টা কি অমানুষের মত কাজ। ছেলে ছেলের বউ এতটুকু বাচ্চা ছেলে রাসেল সবাইরে মাইরা ফেলল! তারা কি দোষ করছিল? কী পাষন্ড গো বাবা। কী পাষন্ড!

    — এখন কি দেশটা আবার পাকিস্তান হইয়া যাইব?

    প্রশ্নটি বাবার দিকে ছুঁড়ে দিই। কোনও উত্তর ফেরত আসে না। তিনি কপালের শিরা চেপে তখনও।

    — মা, কও না কেন, দেশটা কি পাকিস্তান হইয়া যাইব নাকি!

    যেন বাবা মা সব উত্তর হাতে বসে আছেন। তাই কি হয় কখনও! মা বলেন — বংশ নির্বংশ কইরা ফেলাইছে রাইত দুপুরে। আল্লায় এদের বিচার করবেন।

    বাবা তখনও শিরা চেপে। এরমধ্যে সাত সকালে বাবার কাছে পাড়ার দু’জন লোক আসেন। মাখন লাল লাহিড়ী আর এম এ কাহহার, মুন্নির বাবা। বৈঠক ঘরে বসে সকালের চা খেতে খেতে তাঁরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কঠিন কঠিন কথা বলেন। দরজার আড়াল থেকে শুনে আমি তার কতক বুঝি, কতক বুঝি না। বড়রা আমাকে তাঁদের আলোচনায় টানেন না আমি যথেষ্ট বড় হইনি বলে অথবা আমি মেয়ে বলে, কে জানে!

    ঘরে টানানো তর্জনি তোলা শেখ মুজিবের ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমার বড় মায়া হতে থাকে। মানুষটি কাল ছিল, আজ নেই–বিশ্বাস হতে চায় না। রেডিওতে আর জয় বাংলা গান বাজে না। আমার ভয় হতে থাকে। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি। এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল, এই বুঝি আমাদের মোষের গাড়ি করে আবার পালাতে হবে কোথাও! এই বুঝি শহরের রাস্তায় কামান চলবে, এই বুঝি গুলি করে যাকে ইচ্ছে তাকে মেরে ফেলা হবে। এই বুঝি আমার শরীরে টর্চ ফেলে দেখবে কেউ, ঠান্ডা একটি সাপ ঢুকে যাবে আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।

    সময় এক রাতেই পাল্টে গেছে, শেখ মুজিবের নাম নেওয়া বারণ। জয় বাংলা বলা বারণ। আমার শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। বৈঠক ঘর থেকে বাবার থেকে থেকে কী যে হইব ভবিষ্যত! হামাগুড়ি দিয়ে আসতে থাকে ভেতর ঘরে।

    কী যে হইব ভবিষ্যত, বাবা পরদিনও বলেন, আবু আলী, দোকানের কর্মচারি, বাবার ডান হাত, দু’লাখ টাকা চুরি করে পালাল যেদিন ফার্মেসি থেকে।

    মা বলেন কৃপণের ধন পিঁপড়ায় খায়, বউ পুলাপানরে শাতাইয়া টাকা জমাইলে ওই টাকা আল্লাহ রাহে না। কুনো না কুনো ভাবে যায়ই। কত কইছি আমার মার বেবাক সহায় সম্পদ সব লুট হইয়া গেছে, লুট ত এই বাড়ি থেইকাই হইল। তুমি কিছু সাহায্য কর মারে। ফিইরা চাও নাই। এহন দেহ টাকা কেমনে যায়! আল্লার বিচার।

    দেশ থমথম করে, তবু মাদারিনগর থেকে রিয়াজুদ্দিন আর ঈমান আলী আসতে থাকেন, ওঁরা টাকা নিয়ে যান খতি ভরে, জমি কিনবেন। মা ওঁদের পাকঘরে বসিয়ে গামলা ভরে ভাত দিতে থাকেন, থালের কিনারে অল্প ডাল, আর পোড়া শুকনো মরিচ। ওঁরা শুকেনো মরিচ ডলে ভাত খেতে থাকেন। মা ওঁদের ঘুমোতে দেন মেঝেয়, মশারি ছাড়া। মশার কামড়ে ফোলা মুখ ফুলে ওঠে ওঁদের।

    বাবা রাতে ফিরে জিজ্ঞেস করেন — ওদেরে খাওয়া দিছ?

    মা গলায় রসুন তেলের ঝাঁজ মিশিয়ে বলেন — দিছি না? ঠাইস্যা খাইছে।

    আমি লেখাপড়া করতে থাকি। পাঠ্যের নিচে অপাঠ্য। বাবা স্বপ্ন দেখতে থাকেন। মেয়ে পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আমি ছাদে উঠতে থাকি লুকিয়ে। পাড়ার কারও কারও চুলের ঢেউ, গালের টোল, চোখের হাসি, ঠোঁটের অভিমান দেখতে আমার ভাল লাগতে থাকে। সন্ধে হলে ছেলে দেখার পাট চুকিয়ে ছাদ থেকে নামি। ঘরে বসে কখন অমাবস্যা, কখন পূর্ণিমা আকাশ কালো বা আলো করে তার খবর রাখা সম্ভব হয় না। চাঁদের সঙ্গে বহুকাল আমার হাঁটা হয় না।

    মা পীরবাড়িতে যেতে থাকেন। অন্ধকারে গা ঢেকে আমান কাকা আসতে থাকেন বাড়িতে। মা শরীর-মন ঢেলে নছিহত করে যেতে থাকেন। কাপড় চোপড় সুটকেসে গুছিয়ে খাটের তলায় রেখে দিয়েছেন মা। খুব শীঘ্র তিনি চলে যাবেন আল্লাহতায়ালার পাঠানো বোররাখে চড়ে, মক্কায়। প্রথম ব্যাচে নিজের নাম তোলার জন্য মা পীরের কাছে তদবীর করতে থাকেন। আমার আর মনে হতে থাকে না যে মা মরে গেলে আমিও মরে যাব।

    বাবা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে আবার বদলি হয়ে চলে এসেছেন ময়মনসিংহে। মেডিকেল কলেজে ছাত্র পড়ানোর চাকরি করতে থাকেন। গাধা পিটিয়ে মানুষ করার অধ্যাপক তিনি। বিকেলবেলা আরোগ্য বিতানের ডাক্তার লেখা ঘরটিতে বসে রোগী দেখতে থাকেন। রোগীদের ভিড় বাড়তে থাকে।

    চাকলাদারের সঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়ার পর রাজিয়া বেগম ঘন ঘন লোক পাঠাতে থাকেন বাবার কাছে।

    ছোটদা কোথায় আছেন, মরে আছেন না বেঁচে, কেউ আমরা জানি না। বাবা ছোটদার বিছানা পেতেই রাখেন, হঠাৎ একদিন তিনি ফিরে আসবেন আশায়।

    দাদা ঘরের আসবাবপত্র বানাতে থাকেন আর শহর ঘুরে পান পাতার মত মুখ এমন একটি সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে থাকেন বিয়ে করবেন বলে।

    আমি বড় হতে থাকি।

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }