Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. মা

    পাড়ার ছেলেরা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে যায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বীর মুজাহিদ নও জোয়ান, কবুল মোদের জান পরান, আনতে হবে পাকিস্তান, আনতে হবে পাক কোরান। মা এক্কা দোক্কা খেলা ফেলে দৌড়ে যান মিছিল দেখতে। মিছিল চলে গেলে মাও লাফিয়ে বলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কিছু না বুঝেই বলেন। হঠাৎ এক সকালে উঠে তিনি শোনেন, ভারত থেকে ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তান নামের একটি দেশ মিলেছে মুসলমানের। পাড়ার ছেলেরা নেচে নেচে মিছিলে গায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ইস্কুলে পাকিস্তানের জয়গান শেখানো হয়।

    জীবন যেমন ছিল, পাকিস্তান হবার পর তেমনই থেকে যায় মা’র। নাসিরাবাদ মাদ্রাসায় মিয়াভাই আগেও যেমন যেতেন, এখনও যান; বাড়িতে মা’কে কোরান শরিফ পড়াতে সুলতান ওস্তাদজি আগেও যেমন আসতেন, এখনও আসেন; তফাৎটা কি হল তিনি দেখতে পান না। বাজান মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন পাঁচবেলা, এখনও যান। কেউ তো এসবে বাধা দেয়নি, তবে আল কোরান নতুন করে আনার জন্য লোক ক্ষেপেছিল কেন! মাঝখান থেকে কী হল, অমলারা কাঁদতে কাঁদতে হিন্দুস্তান চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার দিন মা কড়ইগাছ তলায় হতবাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ি ঘর জমিজমা জলের দরে বিক্রি করে চলে গেল অমলারা। মা অমলার সঙ্গে সই পেতেছিলেন। সই চলে গেলে কার না বুক খাঁ খাঁ করে! মা’রও করেছে। মা ফেরাতে পারেননি কিছু, কারও চলে যাওয়া। ইস্কুল খালি হয়ে গেল দেখতে দেখতে, কোনও হিন্দু মেয়ে আর ইস্কুলে আসে না। খালি ক্লাসঘরে দু’চারটে মুসলমান মেয়ে তখন ইতিহাস বইএর নতুন অধ্যায়ে পাকিস্তান আমাদের দেশ, কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির জনক মুখস্ত করে। ছড়া কবিতার নতুন নতুন বই আসে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার বদলে আসে গোলাম মোস্তফা, বন্দো আলী মিয়ার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের বদলে কাজী নজরুল ইসলাম। মা কিন্তু থেকে থেকেই আওড়ান আগের পড়া কবিতা। অমলার দিদির কাছে শেখা একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি মাগো দেখবে জগতবাসী অমলারা চলে যাওয়ার পরও, গান মা। যেমন জীবন, তেমনই চলে, ছোটছোট দুঃখ সুখে। পুকুরের কচুরিপানা সরিয়ে আগেও সাঁতার কাটতেন, এখনও। আগেও পিঁড়ি পেতে বসে মাছের ঝোল মেখে ভাত খেতেন, এখনও। দেশ বদলে যায়, মানুষ বদলায় কই! ইংরেজের বদলে কাবুলিঅলা হাঁটে রাস্তায়, পরদেশি বলেই ওদের ডাকেন মা। মা’র নিভৃত জগতে পুতুলগুলো আগের মত শুয়ে থাকে। কেবল মা’র পুতুলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া অমলার পুতুলটিকে বড় দুঃখী দুঃখী লাগে। মা’র বুকের জলে এক মিহি কষ্ট গোপনে সাঁতরায়।

    পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় মা’কে। বাবার কাছে আবদার করতেন রথের মেলায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার, পুতুল কিনে দেবার। অবশ্য পুতুলের শখ মিটে যায়, যখন রক্তমাংসের একটি ছেলে জন্মায় মা’র। যে বছর ছেলে জন্মায়, সে বছরই,বায়ান্ন সন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার করার দাবি নিয়ে যারা মিছিল করছিল, তাদের গুলি ছোঁড়ে উর্দুভাষীরা। মুসলমানরে যদি মুসলমানই মারে, তাইলে আর কি দরকার আছিল মুসলমানের আলদা একটা দেশ বানানির! মা ভাবেন।

    ছেলেরা ছয় দফার দাবি নিয়ে রাস্তায় মিছিল করে। যে রাস্তা ধরে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের মিছিল যেত, সে রাস্তায় রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুভাষী নিপাত যাক বলে মিছিল যায়। কি আশ্চর্য, মা ভাবেন, এঁদো গলির ভেতর, খলসে মাছে ভরা পুকর পাড়ে তাঁর বসে থাকতে থাকতেই মিছিলের চরিত্র পাল্টে গেল।

    বাড়ি থেকে মনুমিয়ার দোকানে সদাই কিনতে যেতে আসতে আমাদের গলিতে লিকলিকে একটি লম্বা ছেলেকে দেখতাম প্রায়ই। পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বড়ই গাছটির তলে ছিল তার ছোট এক টিনের ঘর। পেছনে অবশ্য বড় বাড়ি। ওখানে ওর মা আর বাকি ভাই বোনেরা থাকে। তখন বাড়ির বড় হয়ে যাওয়া ছেলের জন্য বারবাড়ির ঘরটি ছেড়ে দেওয়াই নিয়ম। দাদা আর ছোটদার জন্যও তাই হয়েছিল। ছোটদা একদিন বললেন লিকলিকে ছেলেটি খোকনের বড় ভাই, মিন্টু। খোকন ছিল ছোটদার বিষম বন্ধু। এমনই, যে, প্রেমেও পড়তেন ওঁরা একসঙ্গে, এক মেয়ের। মিন্টুকে আমার বড় একা মনে হত। তাকে দেখতাম ফিনফিনে শার্ট আর নীল লুঙ্গি পরে একা একা গলিতে হাঁটতে, ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আনমনে শিস বাজাতে। এত পাকা পাকা বড়ই ঝুলে থাকত যে আমি জিভে জল নিয়ে বড়ই গাছের তলে যেতে আসতে কিছুক্ষণ দাঁড়াতাম। বড় ইচ্ছে হত পড়ে থাকা কিছু বরই কুড়িয়ে নিই। মিন্টু যদি দেখে আবার আমার কান মলে দেয়, সেই ভয়ে আমি জিভের জল জিভে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। পাড়ার ছেলেপিলেরা আমাকে দেখলে কী কই যাও? গাড়িঘোড়া দেইখ্যা হাইট্যো এরকম শাদামাটা কিছু হলেও বলত। মিন্টু আমাকে দেখত কেবল, কিছু বলত না। ও সম্ভবত খুব লাজুক ছিল। পাড়ায় থাকে, অথচ পাড়ার ছেলেদের মত ওকে দেখতে লাগে না, যেন অন্য কোনও দেশের, অন্য কোনও শহরের, অন্য কোনও পাড়ার ছেলে মিন্টু। এ পাড়ার কারও সঙ্গে তার মেলে না। সে একা নিজের সঙ্গে কথা বলে নিঝুম দুপুরে। চাঁদনি রাতে খালি গায়ে কামিনী গাছের নিচে শুয়ে থাকে একা।

    উনসত্তরে রাজবাড়ি ইস্কুল ছাড়িয়ে আমাকে বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। বিদ্যাময়ী ইস্কুলটি শহরের মধ্যিখানে, ইস্কুলের ডানে গাঙ্গিনার পাড়, বাঁয়ে নতুন বাজার। এ ইস্কুলে আগের ইস্কুলের চেয়ে দূর। রিক্সা করে ইস্কুলে যেতে চার আনা, আসতে চার আনা, বাবা গুনে আটআনা পয়সা দিয়ে যান মা’র হাতে। মা সে পয়সা সকাল দশটা অবদি বেঁধে রাখেন আঁচলের খুঁটে। সাড়ে দশটায় আমার ইস্কুল বসে। যেতে আসতে দেখি শহর যেন উল্টে পড়ে আছে রাস্তায়। কিল ঘুসি খেয়ে শহরের চেহারা এবড়ো থেবড়ো। রাস্তায় ইটপাটকেল, গাছের গুঁড়ি। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের গাড়ি। ছোটদা প্রায়ই ইস্কুল কামাই করে মিছিলে চলে যান। আমারও ইচ্ছে করে ছোটদার মত মিছিলে যেতে। ছোটদা রাত করে বাড়ি ফেরেন, তাঁর বাড়ি না ফেরা অবদি বাবা পায়চারি করেন উঠোনে। মা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন বৈঠকঘরের দরজায়। ছোটদাকে বলা হয়েছে মিছিলে না যেতে। তিনি বাবা মা’র মোটে বাধ্য ছেলে নন, দাদা যেমন। দাদাকে ধমকে বসিয়ে রাখা যায় ঘরে, কিন্তু ছোটদাকে বাগে আনা মুশকিল, ফাঁক পেলেই তিনি পালান।

    সেদিন চব্বিশে জানুয়ারি। সকাল থেকেই মিছিলের শব্দ শুনছি। কাকেরা পাড়ার আকাশ কালো করে চেঁচাচ্ছে। এত কাক ওড়ে কেন, মানুষই বা ছোটে কেন এত মিছিলের দিকে! মা যেমন ছিলেন রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসা খালি পায়ে, এলো চুলে, আলুথালু শাড়িতে, নখে পিঁয়াজের গন্ধ, হাতে মশলার দাগ, তেমনই দৌড়ে গেলেন গলি পেরিয়ে ঘুমটিঘরের উল্টোদিকে বড় রাস্তার ওপর মুকুলদের বাড়ি। বাড়ির খোলা বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখেন জিলা ইস্কুলের বোর্ডিং এর পাশ দিয়ে, ঠান্ডার বাপের জিলিপির দোকান পার হয়ে রেললাইনের দিকে দৌড়োচ্ছে মানুষ। মা, মুকুলের মা, শাহজাহানের মা, শফিকের মা ছুটতে থাকা পাড়ার ছেলেদের থামালেন। বারান্দায় জড়ো হতে লাগল পায়ে হাতে কাঁধে গুলি লাগা ষোল সতেরো বছর বয়সী ফারুক, রফিক, চন্দন। বাড়ির ভেতর থেকে আসতে লাগল বালতি ভরা পানি, ডেটলের শিশি, তুলো। মা’রা ছেলেদের ক্ষত মুছে দিয়ে পরনের শাড়ি ছিঁড়ে বেঁধে দিচ্ছিলেন ব্যান্ডেজ। কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দিলেন রিক্সা করে সোজা হাসপাতাল।

    দুপুরের দিকে বাবা ফিরে এলেন। কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে তিনি ঢুকলেন মিন্টুদের বাড়িতে। বাবার পেছন পেছন মা, মা’র পেছন পেছন আমি। আমাদের পেছনে পাড়ার আরও লোক। মিন্টুর মা’র মুখের দিকে বাবা করুণ চোখে তাকিয়েছিলেন, মিন্টুর একলা পড়ে থাকা টিনের ঘরখানার দিকেও।

    কী হইছে, মিন্টুর কিছু হইছে? মিন্টুর মা বাবার হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি খবর পেয়েছেন আগেই যে মিছিলে মিন্টু ছিল সবার সামনে, গায়ে পুলিশের গুলি লেগেছে বলে লোকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে ওকে। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন খানিক পর পর, কিছু বলছিলেন না। আমরা ছিলামই ও বাড়িতে দাঁড়িয়ে। মিন্টুর বোন, মনু, পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদছিল। মাথার ওপর ছিলই কাকের কা কা কা। পাড়ার মায়েরা মুকুলদের বারান্দা থেকে ফিরে এসে পানি ঢালছিলেন কেঁদে বেঁহুশ হয়ে পড়া মিন্টুর মা’র মাথায়। মনু থেকে থেকে মা’কে বলছিল ও ঈদুন আপা, আমার ভাইরে যারা মারছে, তাগোরে আমি খুন করুম। মনু বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিল বাড়ির বাইরে। মা তাকে ফেরাচ্ছিলেন দু’হাতে। মনু কি করে খুন করবে খুনীদের। খুনীদের হাতে বন্দুক, কেউ কি পারে খালি হাতে সশস্ত্র কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে!

    পাড়ার লোকেরা মিন্টুর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছিল কী করে মিছিল এগোচ্ছিল পশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে, তখন বলা নেই কওয়া নেই, কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রিম দ্রিম, ছেলেরা উল্টো দিকে দৌড়োল, কেবল মিন্টু পারেনি। মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভিড় আরও বাড়ছে। খোকন, বাμচু, হুমায়ুন মিন্টুর ভাইগুলো ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকল। মিন্টুকেও আনা হল, খাটিয়ায় শাদা কাপড়ে ঢেকে।

    আমি বরই গাছের তলে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মিন্টুর গা মাথা ঢাকা। চুপচাপ লাজুক ছেলেটি, যে ছেলে সকালেও দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেছে উদাসীন, নাস্তা খেতে বাড়ির ভেতর ডাক পড়লে মা’কে বলেছে যে সে বাইরে বেরোচ্ছে খানিকক্ষণের জন্য, এই ফিরছে। রান্নাঘরে ঢেকে রেখেছিলেন মা তাঁর ছেলের নাস্তা। মিন্টু যখন ফিরে এল, তখনও তার নাস্তা ঢাকা।

    বরই পড়ে তলাটি ভরে ছিল, পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বরই। একটি বরইও আমার কুড়োতে ইচ্ছে করেনি সেদিন। সেদিন কেউ কান মলে দেবে বলে ভয় ছিল না, তবু ইচ্ছে করেনি। মা’কে দেখেছি মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলছেন কাইন্দোন না। মিন্টুর রক্ত ছুঁইয়া কত ছেলেরা কইতাছে এর শোধ তারা নিবই নিব। দিন পাল্টাইব, দিন ঠিকই পাল্টাইব। মিন্টু লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর পাড়ার মানুষও, কেবল মিন্টুর আত্মীয়রা নয়, কেঁদেছে। লিকলিকে ছেলেটিকে মানুষ এত ভালবাসত আমার জানা ছিল না।

    ছোটদাও গুম হয়ে বসে থাকলেন। তিনি ছিলেন মিছিলে মিন্টুর ঠিক ডানে দাঁড়ানো। গুলি তাঁর ডান বাহু ঘেঁসে উড়ে গেছে মিন্টুর বুকে। গুলি ছোটদার বুকেও লাগতে পারত। সেদিন ছোটদাও মরতে পারতেন।

    মিন্টুকে আকুয়ার কবরখানায় কবর দেওয়া হল সেদিন। পাড়ায় এত বিষাদ এর আগে আমি কখনও দেখিনি। বিকেলে বাচ্চারা খেলতে গেল না মাঠে। বড়রা গলির রাস্তার কিনারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু গলায় কথা বলল। যেন পুরো পাড়া সেদিন আর খাবে না, দাবে না, হাসবে না, খেলবে না, ঘুমোবে না।

    ক’দিন পর শেখ মুজিব এলেন মিন্টুদের বাড়িতে। সে কী ভিড় শেখ মুজিবকে দেখতে। ছোটদা বলেছিলেন আহা সেদিন আমি মরলে আমগোর বাড়িতে ভিড় হইত, দেখতে শেখ মুজিব আসত। পুলিশের গুলিতে সেদিন মিন্টুর বদলে নিজের মরণ হলেই তিনি খুশি হতেন। মৃত্যু হল না বলে কাউকে এমন হা পিত্যেশ করতে আমি আর দেখিনি। আমিও দেখতে গিয়েছিলাম শেখ মুজিবকে। হাজার লোকের ভিড়ে শেখ মুজিবকে দেখা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে, এরপর ইটের ওপর ইট রেখে তার ওপর, এরপর দেয়ালে, প্রথম নিচু দেয়াল পরে পড়ে মরার ভয় তুচ্ছ করে উঁচু দেয়ালে দাঁড়িয়ে শেষ অবদি দেখেছিলাম শেখ মুজিবকে। গায়ে কালো কোট, চশমা পরা লম্বা একটি লোক। দেখতে আমাদের পাড়ার সাহাবউদ্দিনের মত। সাহাবউদ্দিনকে দেখতে তো এত লোকের ভিড় হয় না! শেখ মুজিব নামের মানুষটি যেন সাত আসমান থেকে নেমে এসেছেন এ পাড়ায়, যেন তিনি ঠিক আর সবার মত মানুষ নন। শেখ মুজিব মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বরই তলায় সেদিনও পড়ে ছিল মিষ্টি মিষ্টি বরই। বরই কুড়োনোর কোনও ইচ্ছে আমার হয়নি সেদিনও।

    মানুষের নিয়মই এই, মানুষ বেশিদিন শোক বইতে পারে না। মাস পার হয়নি, আবার যে যার জীবনে ফিরে গেল। মাঠে খেলতে শুরু করল বাচ্চারা, পুরুষেরা থলে ভরে বাজার করতে লাগল, উনুনে ফুঁকনি ফুঁকতে লাগল বাড়ির মেয়েরা। আমিও সন্ধে নামলে উঠোনে পাটি পেতে হারিকেনের আলোয় দুলে দুলে পড়তে থাকলাম আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।

    কেবল কবরখানার পাশ দিয়ে যেতে, ওটিই ছিল আমার ইস্কুলে যাওয়ার, মনু মিয়ার কিম্বা ঠান্ডার বাপের দোকানে যাওয়ার পথ, মা যেমন বলেছিলেন, দু’হাত মুঠো করে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হেঁটেছি। মা বলেননি, কিন্তু কোথাও ফুল ফোটা কোনও গাছ দেখলে, সে যার বাড়ির ফুলই হোক, ছিঁড়ে দৌড়ে দিয়ে এসেছি মিন্টুর বাঁধানো কবরে। আমার মনে হত মিন্টু ঘ্রাণ পাচ্ছে সে ফুলের।

    এই ঠুনকো পাকিস্তানও ভাঙবে বলে মা’র মনে হয়, লোকের কথাবার্তার ধরনও মা দেখেন পাল্টে গেছে, আয়ুব খানের গুষ্ঠি তুলে লোকে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাল দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দাবি তুলে ছেলেরা রাস্তায় নামছেই। পাকিস্তান সরকার ক’দিন পর পরই সারা দেশে কারফিউ দিচ্ছে, বাইরে বেরোনো মানা, ব্ল্যাকআউট ঘোষণা করছে, বাড়িঘর অন্ধকার করে বসে থাকতে হয়। সব শাসকের এক চরিত্র, মা ভাবেন। ইংরেজের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কম অনাচার করছে না! পূবের ধন পশ্চিমে পাচার হয়ে যাচ্ছে, এ ঠিক ভারতের ধন ইংরেজ যেমন জাহাজ ভরে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। পাকিস্তান দিয়ে মা’র হবে কি! দেশ ভেঙে আরও টুকরো হোক, দেশ কাকে খাক, চিলে নিক, কিছু তাঁর যায় আসে না, তিনি তাঁর ছেলেদের মিছিলে মরতে দিতে চান না। ছেলে মেয়ে ছাড়া তাঁর আর আছে কি! এদের নিয়ে দাঁড়াবার মাটি যদি তিনি পান, তাই যথেষ্ট। লেখাপড়া জানলে তিনি কোনও চাকরি পেতে পারতেন, যে কোনও একটি চাকরি, তাহলেই নিরুত্তাপ বাবাকে তিনি মুক্তি দিতেন, অথবা নিজে মুক্তি পেতেন। ছোটদাকে নিয়ে একবার রেলে চড়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন চাকরি খুঁজতে, ঢাকা শহরের বাতাসে নাকি ভূরি ভূরি চাকরি ওড়ে, হাত বাড়ালেই ধরা যায়। ঢাকার এক হাসপাতালে নার্সের চাকরি চাইলে কর্তৃপক্ষ বললেন হুট করে তো আর নার্সের চাকরি জোটে না, আরও লেখাপড়া জানতে হবে, নার্সিং ইস্কুলের সার্টিফিকেট লাগবে। মা ফিরে এলে বাবা ফোঁড়ন কেটেছিলেন–কয় না, সুখে থাকলে ভুতে কিলায়!

    ছোটদাকে চোখের আড়াল করতে ভয় হয় মা’র। মিন্টুর মত ছোটদাও যদি গুলি খেয়ে মরেন একদিন! নিমপাতার তেতোয় দুধ ছাড়ানো ছেলের জন্য মাজ্ঞর বুকের ভেতর টনটন করে মা’র। পাঁচ ছ’ বছর বয়সেও ছোটদার বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যেস যায়নি। নানি বলেছিলেন বুনিত নিমপাতা বাইটা দে, তাইলেই ছেড়া বুনি খাওয়া ছাড়ব। তাই করেছেন মা, নিমপাতার রস মেখে রেখেছেন বোঁটায়, যেন জিভে তেতো স্বাদ পেতে পেতে দুধ খাওয়ার শখ যায় ছেলের। ছোটদা কথা বলেছেনও দেরি করে, দু’বছর পার করেও বা আ বা আ করতেন বাবা বলতে গিয়ে। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে গেলে ইস্কুলের হেডমাস্টার একটি প্রশ্নই করেছিলেন বানান কর তো পুরস্কার, ছোটদা পুস পাস পাস, পাস পাস পুস, স্পু স্পা পুস বলে হাঁপিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেডমাস্টারের সঙ্গে বাবার খাতির ছিল বলে ছোটদাকে ভর্তি করে নেন ইস্কুলে। ছোটদাকে হাতঘড়ি আর জ্যামিতি বক্স কিনে দিয়ে বাবা বলেছিলেন লেখাপড়ায় ভাল করলে একটা সাইকেল পাইবা। ছোটদা হাতঘড়ি হারিয়ে ফেললেন তিনদিনের দিন, আর কাঁটাকম্পাস ব্যবহার করতে লাগলেন বাড়ির সবার দাঁতে আটকা মাংস তোলার কাজে। দাদাকে দেখে তাঁরও একদিন শখ হয়েছিল আমার মাস্টার সাজার। বই খুলে আমাকে বললেন–

    পড়, পিঁড়া পিঁড়া কয়টা ডিম
    একটা দুইটা তিনটা ডিম।

    দাদা শুনে হাঁ হয়ে থাকেন। কপালে ভুরু তুলে বলেন এই এই কি পড়াস, পিঁড়া পিঁড়া কস ক্যান, এইডা ত পিঁপড়া পিঁপড়া কয়টা ডিম।

    ছোটদা লকলক করে বড় হয়ে যাওয়ার পরও মা তাঁকে কোলের ছেলেই মনে করতেন। ছোটদাই, মা আশংকা করতেন, হবেন গবেট গোছের কিছু। কিন্তু দাদাই হলেন শান্ত শিষ্ট, সাত চড়ে রা নেই। ছোটদা উল্টো। ইস্কুল থেকে নালিশ আসে, ছেলে ডিসিপ্লিন মানে না।

    –কি রে ডিসিপ্লিন মানস না শুনলাম!

    ছোটদার কানের লতি ধরে টেনে ঘরে এনে চোখের তারার ওপর তারা রেখে জিজ্ঞেস করেন বাবা।

    –মানি মানি। ছোটদা রাগে সশব্দে শ্বাস ছেড়ে বলেন।

    –তর স্যারেরা তাইলে মিছা কথা কয়! বাবা বলেন।

    ছোটদা দিব্যি বলে দিলেন–হ।

    গালে কষে থাপ্পড় মেরে বাবা বলেন–ইস্কুলের রেডিও ভাঙছস ক্যান?

    ছোটদা ফুঁসে উঠে বলেন–আমি রে রেডিও শুনতাছি, এক ছেড়া আইয়া রেডিও কাকাইড়া লইতে চাইছিল। তাই ভাঙছি।

    –বা বা, সুন্দর যুক্তি দিছ! এত সুন্দর যুক্তি আমার ছেলের, ছেলেরে এহন মাথায় তুইলা নাচতে হয়। আমি রাইতদিন পরিশ্রম করি, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জ্‌ইন্য। ছেলেমেয়েরা যেন লেখাপড়া কইরা মানুষের মত মানুষ হয়। আর এরা যদি অমানুষই হয়, কিসের এত খাটাখাটনি! ছোটদার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পড়ার টেবিলে পাঠিয়ে বাবা বলেন– মায়ের আশকারা পাইয়া ছেলেডা নষ্ট হইয়া যাইতাছে।

    এ বাড়িতে কেউ একবার মার খেলে তার জন্য চমৎকার উপঢৌকন অপেক্ষা করে থাকে। ছোটদা বাবার হাতের মার খাওয়ার পরদিনই বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মা ক্রিকেটের ব্যাট বল কিনে দিলেন ছোটদাকে। সেই ব্যাট অবশ্য তিনি বলে মারার চেয়ে ঘরের চেয়ার টেবিলে মেরে আনন্দ পেতেন বেশি। ছোটদার মিছিলে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই মা’র নতুন আবদার ছেলেকে গিটার কিনে দিতে হবে, গান বাজনা নিয়ে পড়লে মিছিল মিটিং থেকে ছোটদার মন উঠবে, এই আশা। বাবা একখানা হাওয়াইন গিটার কেনার টাকা দেন, গিটার কিনে গিটারের হলুদ একখানা জামাও নিজের হাতে বানিয়ে দেন মা। ছোটদার প্রতি মা’র আদর দাদার চোখে পড়ে, তিনি মা’কে বলেন আমারে একটা বেহালা কিইনা দিতে কন।

    –তুই ক। তর কি মুহে রাও নাই? মা’র স্বরে বিরক্তি।

    দাদা চুপসে যান। বাবার কাছে বেহালা চাওয়ার সাহস দাদার নেই। তিনি হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে আঙুলে টেবিল ঠুকে তাল দেন নিজেই নিজের গানে। গান দাদার একটিই, চার বছর বয়সে যেটি শিখেছিলেন মা’র কাছেএকবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি। ছোটদা গিটারে সা রে গা মা শিখে চলতি সিনেমার গান বাজাতে শুরু করেন। প্রতিমাসে ছোটদার গিটারের মাস্টারের বেতনের টাকার জন্য হাত পাতেন মা। প্রতিমাসেই টাকা দেওয়ার আগে বাবা বলেন–লেহাপড়া কতদূর করতাছে খবর নিছ? নাকি গান বাজনা নিয়া থাকলে ওর জীবন চলব? তিনটা প্রাইভেট মাস্টার রাইখা দিছি– অঙ্কের, ইংলিশের, সাইন্সের। ঠিকমত মাস্টারের কাছে যায় কি না জানো? রাইত কয়টা পর্যন্ত পড়ে? সুলেখার মা’র ছেলেগুলা রাইত দশটা পর্যন্ত পড়ে।

    গিটারের মাস্টারের টাকা প্রতিমাসেই বাবা ছুঁড়ে দেন টেবিলে, বিছানায়, মেঝেয়। আর তিন মাস্টারের টাকা মাস্টারদের বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসেন।

    বাবাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না মা। এত জটিল চরিত্র আর কোনও সংসারে আছে বলে মা’র মনে হয় না। এই মনে হয়, সংসারের জন্যই তাঁর খাটাখাটনি, সন্তানের মঙ্গলের জন্য সব উজাড় করে দিচ্ছেন আবার মনে হয় সংসারের কারও জন্য তাঁর কোনও মায়াই নেই, লোকে মন্দ বলবে বলে তিনি সংসার নামের একটি লোক দেখানো জিনিস হাতে রেখেছেন, আসলে রাজিয়া বেগমকে জীবন সঁপেছেন বাবা। আবার, বাবা যেদিন আমানউদ্দৌলাকে মাদারিনগর থেকে এনে আমাদের বাড়িতে ওঠালেন, চটের থলে করে এক সেরের জায়গায় দু’সের খাসির মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, চেম্বার থেকে সকাল সকাল ফিরে মা’কে বললেন–গোসতটা বেশি কইরা পিঁয়াজ দিয়া ভুনা কর, আর লাউশাক রান্ধো সিম দিয়া, পাইন্যা ডালের বদলে ডাইল চচ্চড়ি কর–মা’র মনে হল যেন সকল খাটাখাটনি আসলে মাদারিনগরের মানুষদের জন্য।

    সে রাতে দাদাদের কাছে ডেকে বাবা বলেছিলেন–তোমাদের লেখাপড়ার খবর কি? মাস্টারের কাছে পড়তে যাও ঠিকমত?

    দাদার মাথা ঝুলে থাকে ঘাড়ে, মেঝেয় বুড়ো আঙুল ঘসতে ঘসতে বলেন–হ যাই।

    –খেলা বেশি না পড়া বেশি, কুনটা কর? বাবা জিজ্ঞেস করেন।

    যে উত্তরটি তিনি শুনতে চান, দাদা তাই শোনান–পড়া।

    লেখাপড়া করে যে, সে কি করে?

    –গাড়িঘোড়া চড়ে। দাদা উত্তর দেন, চোখ মেঝেয়।

    –আর তুমি? ছোটদার দিকে চোখ ফেরান।

    ছোটদা বলেন–গা গাড়িঘোড়া চড়ে।

    শুনে আমি বলতে চেয়েছিলাম–বাবা ত লেখাপড়া করছে। বাবা তো ঘোড়াতেও চড়ে না। মটর গাড়িতেও না। চড়ে রিক্সায়।

    বলা হয় না। শব্দ গিলে ফেলার স্বভাব আমার, গিলে ফেলি।

    — হুম। আমাদের বাড়িতে একটা নতুন লোক আইছে, আমানুদ্দৌলা নাম। সে তোমাদের কি হয়? কাকা হয়। তোমাদের কি হয় সে?

    ছোটদা ঘরের থামে হেলান দিয়ে বললেন–কাকা হয়।

    –কাকা হয়, ঠিক। বাবা ছোটদাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন–এইভাবে দাঁড়াইতে হয়, সোজা হইয়া।

    –আর এই যে, তুমি এইদিকে আসো বলে আমাকে ডাকেন।

    –তুমি তোমার কাকারে দেখছ? আমার ভাইরে?

    মাথা নাড়ি আমি। হ্যাঁ দেখেছি।

    –ঠিক আছে, সবাই পড়তে বও গিয়া। ভাত রান্ধা হইলে খাইবা। কাকারে লইয়া খাইবা। কাকা আপন লোক। বুঝছ কি কইছি?

    দাদা ভাল ছাত্রের মত মাথা নেড়ে বলেন–বুঝছি।

    আমান কাকার জন্য খড়ির ঘরের খড়ি সরিয়ে চৌকি আর টেবিল চেয়ার পেতে দিলেন বাবা। তাঁকে শহরের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বাবা বাড়িতে জানিয়ে দিলেন এখন থেকে কাকা এ বাড়িতে থাকবেন। তাঁর খরচপাতি সব বাবাই দেবেন।

    –নিজের ছেলে মেয়ে আছে। এত খরচ পুষাইবা কেমনে তুমি? বাবার আয়োজন দেখে বলেছিলেন মা।

    বাবা বলেছেন–পুষাইতে হইব। নিজের মায়ের পেটের ভাই যখন। আমি ত আর ভাইরে ফেলাইয়া দিতে পারি না। আর ও থাকলে তুমারও লাভ হইল। বাজার সদাইটা ওরে দিয়াই করাইতে পারবা।

    –বাজার সদাই তো নোমান কামালই, বড় হইছে, করতে পারে। মা ঠান্ডা গলায় বলেন।

    পরদিন মা’র জন্য একটি ছাপা সুতি শাড়ি কিনে আনেন বাবা। মা খয়ের ঘসে একটি পান খান সেদিন। ঠোঁট লাল টুকটুক করে, নতুন শাড়িটি পরে বাবার গা ঘেঁসে বিছানায় বসে বলেন–কাপড়ের বাইনটা খুব ভালা।

    শাড়িটি মা’কে কেমন মানাচ্ছে এসব কথায় না গিয়ে বাবার ব্যাকুল প্রশ্ন।–আমানরে খাওন দিছ?

    মুহূর্তে মা’র বুকে একটি কাঁটা এসে বেঁধে। আসলে কি বাবার এই আদর, সোহাগ সবই আমান কাকার যেন ভাল দেখাশোনা করেন মা, সে কারণে! লোকে চাকর বাকরকে মাঝে মাঝে এটা ওটা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে যেন চাকর ভাল রাঁধে বাড়ে, যেন বিশ্বস্ত থাকে মনিবের! নিজেকে এ সংসারে এক দাসী ছাড়া মা’র আর কিছু মনে হয় না। মা’র সুখ কিসে, কিসে অসুখ বাবা তার খবর রাখেন না। আমান কাকা বাড়িতে আসার দিন সাতেক পর মা একবার বলেছিলেন–সুলেখার মা’র বাড়িতে তোমারে আর আমারে দাওয়াত দিছে, সুলেখার বিয়া। চল যাই।

    বাবা সাফ বললেন–না।

    মা পীড়াপিড়ি করলে বিরক্ত স্বরে বললেন–টেকা রাখো, যা উপহার কিনার, কিইনা তুমি একলা যাও।

    এরকম এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে জীবন যাপন করেন মা। লোকে জানে তিনি ডাক্তারের বউ, লোকে জানে সুখে টইটম্বুর তাঁর জীবনের চৌবাচ্চা। কেবল তিনি জানেন বাবার শরীর থেকে ভেসে আসা অন্য এক নারীর গন্ধ তাঁর সব সুখ স্বপ্ন ধুলোয় উড়িয়ে দিয়েছে, তিনিই জানেন শরম লজ্জা থুয়ে শরীর মেলে দেওয়ার পরও বাবা বিছানায় পাশ ফিরে ঘুমোন, তাঁর নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হয় কেবল দীর্ঘশ্বাস।

    ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে সুলেখার বিয়ে খেয়ে আসেন মা। মা সারা বাড়ির ভিড়ের মধ্যে বড় একা বোধ করেন। বাবা রাতে ফেরেন গুনগুন গান গাইতে গাইতে, জিভ লাল পানের রসে। টেবিলের বাড়া ভাত সে রাতে ছোঁন না বাবা। কুন বেডির বাড়িত থেইকা খাইয়া আইছ যে ভাত খাইতে বও না? মা কথার তীর ছোঁড়েন বাবার দিকে।

    বাবা হেসে বলেন–দাওয়াত আছিল এক রুগির বাড়িত।

    –পুরুষ রুগি নাকি মেয়ে রুগি? বিছানায় দ হয়ে শুয়ে মা বলেন।

    — রুগি রুগিই। পুরুষ আর মেয়ে কী! বাবা ধমকে বলেন।

    — অইতা চালাকি আমি বুঝি। রাজিয়া বেগম তুমার রুগিই আছিল। আছিল না? হের বিছনা থেইকা তুমারে আমি তুইলা আনি নাই? আনছি। আমারে সরল সহজ পাইয়া তুমি যা ইচ্ছা তাই কইরা যাইতাছ। বলে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

    মা’র পাশে সটান শুয়ে বাবা বলেন–যা ইচ্ছা করতে পারলে ত ভালই ছিল। করতে পারি কই!

    সকালে ছোটদার গিটারে তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়! দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়, গানের সুর শুনে বাবা লাফিয়ে বিছানা ছাড়েন। ভেসে আসা সূরের সঙ্গে তিনি গাইতে থাকেন–প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।

    মা থালায় করে হাতগড়া রুটি আর ডিম-পোচ নিয়ে ঘরে ঢুকে বাবাকে গান গাইতে দেখে চমকান। ওহ, মাকে আরও চমকে দিয়ে বাবা বলেন, কামাল ত ভালই বাজায়। গানটাতে একেবারে আমার মনের কথা কইছে। শুনছ!

    সেই সকালে হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাবা ছোটদাকে ডেকে বললেন–কুন মাস্টারের কাছে গিটার শিখ তুমি! মাস ত শেষ, টাকা লাগব না মাস্টারের! কত টাকা!

    বলে মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিলেন ছোটদার হাতে। ছোটদার সারা মুখে উপচে পড়ে খুশি। বাবা বললেন–ভাল কইরা লেখাপড়া না করলে, খালি গান বাজনা লইয়া থাকলে চলব! গান বাজনা কি তোমারে খাওন দিব! সকালে ব্রেনডা পরিষ্কার থাকে। সকালে পড়তে বসবা। একটা রুটিন কইরা লও। খাওয়ার সময় খাওয়া। পড়ার সময় পড়া। গান বাজনার সময় গান বাজনা।

    কোথায় এক অজপাড়াগাঁয়ের রাখাল ছেলে শহরের বড় হাসপাতালের সরকারি ডাক্তার হয়ে গেল! জীবনে এত সফল হয়েও পরাজয়ের, দুঃখের এই গানটি বাবার ভাল লাগল, মা বুঝে পান না, কেন। মা’র হিশেবে মেলে না কিছুই। মানুষটি পাথরে গড়া, আবার মনে হয়, কাদায়।

    সেরাতে বাবা বাড়ি ফিরলে মা কুঁচি কেটে শাড়ি পড়েন, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে বাবাকে হাতপাখায় বাতাস করতে করতে, বাবা যখন রাতের খাবার খান, আমাকে বললেন যা তর নানির ঘরে ঘুমা গিয়া।

    নানির ঘরে যাওয়ার কথায় লাফিয়ে ওঠা মেয়ে আমি, মা তাই জানেন। কিন্তু অবাক হন শুনে যখন বলার পরও আমি ও ঘরের দিকে ছুটি না।

    মা আবার বলেন—যা তর নানির ঘরে ঘুমাইতে যা।

    আমি মাথা নেড়ে বলি–না।

    মা চকিতে ঘাড় ফেরান আমার দিকে–কি রে, যাইবি না তুই!

    আমি স্পষ্ট স্বরে না বলি।

    –কি হইছে তর? কেউ মারছে? টুটু, শরাফ, ফেলু কেউ?

    খাটের রেলিংএর কাঠ থেকে পুডিং তুলতে তুলতে নখে, বলি–না।

    –না, তাইলে যাস না ক্যা?

    মা আমাকে দরজার দিকে ঠেলেন।

    আমি দরজার পাল্লা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনে অন্ধকার উঠোন।

    মা বলেন–ছেড়িডারে লইয়া আর পারা গেল না। ও মুটেই কথা শুনে না। কই, ঘরো বইসা থাক। না বাইরে খেলবো। সারাদিন খেলা খেলা। খেলার মধ্যে মাইর খাইয়া প্যানপ্যান কইরা কান্দো। শইলে মাংস নাই, পাখির দানা মুহে দেয়। ছুটবেলায় তিনজনে হাত পা ঠাইসা ধইরা দুধ খাওয়াইতে হইছে। দুধ খাইব না, ডিম খাইব না। দিন দিন বেয়াদ্দব হইতাছে। কইতাছি তর নানির ঘরে গিয়া ঘুমা। যায় না। অইন্যদিন তো খুশিতে লাফ দিয়া দৌড় লাগাস।

    ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি দরজায়, এক পাও নড়ে না আমার।

    মা কাছে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে নরম কণ্ঠে বলেন–যাও, মামারা কিচ্ছা শুনাইব, যাও। ফিতা লইয়া যাও, ঝুনু তুমার চুল বাইন্ধা দিব।

    আমি নড়ি না। বাবা বলেন–থাক, যাইতে যহন চাইতাছে না।

    –বড় বেয়াদ্দপ। মা বলেন।

    আমি, মা ভাবেন, হয়েছি অদ্ভুত। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মা’র পেছনে। এত ভয়, এত লজ্জা, এত দ্বিধা আমার কোত্থেকে এল মা বোঝেন না। আমার মুখ দিয়ে রা শব্দ বেরোয় না, গল্প বলতে বললেও শব্দ হাতড়াই, কিন্তু শুনতে বেলায় কান খাড়া। নানা জনের নানা গল্প শুনি, কিন্তু নিজে গুছিয়ে গল্প বলতে পারি না। পড়তে বেলায়ও। এর মধ্যেই ব্যঙ রাজকুমার, ঠাকুরমার ঝুলি, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি নানারকম রূপকথার বই পড়ে সারা। আমি পড়ি না তো, গিলি, গোগ্রাসে। আমি মুখচোরা গোছের, মনের কথা খুলে বলি না খুব, এই যে নানির ঘরে আমি ঘুমোতে গেলাম না, মামাদের সঙ্গে শুয়ে কিচ্ছা শোনার মত লোভনীয় ব্যাপারটিকে দিব্যি বাতিল করে দিলাম, কেন, কি কারণ, তা মুখ ফুটে বলি না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ধমকালে। কানমলা, গুঁতো, চড় চাপড় সারাদিনই খাচ্ছি, তারপরও মুখে শব্দ নেই। কাঁদিও না প্রাণ খুলে। রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখে জন্ম। শর্মিলার বাড়িতে কোনও খাবার খাইনি শর্মিলা হিন্দু বলে, কপালে হিন্দু মেয়েদের মত টিপও পরতে চাই না, হয়ত আমার খুব অন্যরকম হবার কথা ছিল, ঈমানদার। কিন্তু আরবি পড়তে গেলে আমি খুব খুশি হই না, কায়দা সিফারা ফেলে কখন রূপকথার একটি বই হাতে নেব, ছবি আঁকব, দৌড়ে রেললাইনে যাব, মাঠে খেলব, সেই তালে থাকি। কত বলা হয়েছে মানুষের ছবি আঁকিস না, মানুষের ছবি আঁকলে গুনাহ হয়, মানুষের যদি প্রাণ দিতে পারস, তাইলেই সে ছবি আঁক, তবু মানুষের ছবি আঁকার প্রচন্ড উৎসাহ আমার মরে না।

    ফজলিখালার শ্বশুরবাড়ি থেকে মা লাল রঙে আঁকা হযরত মহাম্মদের জুতোর ছবির ওপর আল্লাহর আয়াত লেখা একটি কাগজ, মা বলেন নাল শরিফ, তাবিজের খোলে পুরে অকারণ ভয় দূর করতে আমার গলায় পরিয়ে দেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }