Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না – প্রবীর ঘোষ

    প্রবীর ঘোষ এক পাতা গল্প296 Mins Read0

    ৫. আপ্লুত বিজ্ঞানী ও মৌলবাদী চক্রান্ত

    অধ্যায়: পাঁচ


    ঈশ্বর বিশ্বাস: আপ্লুত বিজ্ঞানী ও মৌলবাদী চক্রান্ত

    হিন্দু-বিজ্ঞানী ও মৌলবাদী চক্রান্ত

    ‘দেশ’ পাক্ষিক পত্রিকার ২২ এপ্রিল ১৯৯৫ সংখার ৪৬ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলম থেকে একটি অংশ তুলে দিচ্ছিঃ

    “বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণের একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয়ে থাকে, তার নাম মানুষমুখী নীতি (Anthropic Principle)। এতে দেখান হয় যে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির বিভিন্ন সময়ে বহু সম্ভাবনার মধ্যে একটি বিশেষ এবং নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটেছে বারে বারে এভাবে বহু সম্ভাবনার মধ্যে নির্দিষ্ট একটা বাস্তবায়িত হয়েছে, ফলে মানুষ পর্যন্ত এসেছে। যদি একবারও এর ব্যতিক্রম হত, তবে মানুষের উদ্ভব সম্ভব হত না।”···“অর্থাৎ প্রথম থেকেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মানুষমুখী। ক্রিয়ার উদ্দেশ্য থাকে কর্তার মনে, কাজেই এই উদ্দেশ্যটা ভগবানেরই ছিল। এই নীতি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের teleological principle-এর একটা বৈজ্ঞানিক রূপ।”

    প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বিজ্ঞান ও ভগবান’, লেখক: হৃষীকেশ সেন।

    বাস্তবিকই কিছু কিছু বিজ্ঞান পেশার মানুষ বিজ্ঞান মনস্কতাকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজের বিশ্বাস-নির্ভর চিন্তাকে হাজির করতে শুরু করেছেন নতুন ভাবে, নতুন মোড়কে, বিজ্ঞানের শব্দ যুক্ত করে, বিজ্ঞানের এসেন্স মাখিয়ে। তাঁরা ভুলে যান বা ভুলে থাকতে চান—বিজ্ঞানের বেঁচে থাকার ‘অক্সিজেন’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘সন্দেহ’ ও ‘প্রমাণ’। বিজ্ঞানের জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে, কার্যকারণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও প্রকৃতির জগতে, বস্তুজগতে নিয়মের বন্ধন। এ’সবের অনুপস্থিতিতে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান থাকে না। বিজ্ঞানীরা কেন এমন বিজ্ঞানবিরোধী, স্ববিরোধী, কেবলমাত্র বদ্ধমূল ধারণার উপর গড়ে ওঠা, চিন্তা এবং যুক্তিহীন অবিন্যস্ত বিচিত্র সব চিন্তা প্রকাশ করেন? কারণ দু’টি হতে পারে। একঃ পরিবেশগতভাবে ঈশ্বর-বিশ্বাসী হয়ে ওঠার জন্য। দুইঃ অসাম্যের সমাজ কাঠামো বজায় রাখার নিয়ন্ত্রক শক্তির কাছ থেকে আখের গোছাতে। সাধারণভাবে দেখা যায়, এই ধরনের বিজ্ঞান-বিরোধী মত প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি কারণই উপস্থিত থাকে। তবে হতে পারে, সেই উপস্থিতি কখনও কখনও অসচেতনতা থেকে আসে।

    যাই হোক, এই ধরনের বক্তব্যের উত্তরে রমেন্দ্রকুমার পোদ্দার কী বলেন, শুনি আসুন।

    রমেন্দ্রকুমার পোদ্দার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইণ্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োফিজিক্স, মলিকিউলার বায়োলজি অ্যাণ্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক।

    রমেন্দ্রকুমার পোদ্দারের কথায়, “ল অফ প্রোব্যাবিলিটি বলে একটা কথা আছে। প্রোব্যাবিলিটি মানে সম্ভাবনা। গণিতে সম্ভাব্যতা-সম্ভাবনার পরিমাপকে বলে প্রোব্যাবিলিটি। অর্থাৎ সম্ভাবতা ও মোট সম্ভাবনার যে অনুপাত তা-ই প্রোব্যাবিলিটি। তারও একটা নিয়ম আছে। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কোনো ঘটনা ঘটলেও নিয়মের বাইরে ঘটে না, ঐ প্রোব্যাবিলিটি নিয়মের মধ্যে থেকেই ঘটে। এ জিনিস ইতিহাসেও আছে, বিজ্ঞানেও আছে।”

    O

    আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কোনো ঘটনা ঘটলেও নিয়মের বাইরে ঘটে না, ঐ প্রোব্যালিটির নিয়মের মধ্যে থেকেই ঘটে। এ জিনিস ইতিহাসেও আছে, বিজ্ঞানেও আছে।

    O

    বিরাট এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ যদি না-ই আসত, তাতেই বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কী এসে যেত? পৃথিবীতে মানুষ যত বছর ধরে রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বছর ধরে, ডাইনোসররা পৃথিবী কাঁপিয়েছে। ডাইনোসররা এসেছিল, বার বার বহু সম্ভাবনার মধ্যে নির্দিষ্ট একটি সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়েছিল বলেই এসেছিল। একবারও যদি এর ব্যতিক্রম হত, তাহলে ডাইনোসরদের উদ্ভব সম্ভব হত না। অর্থাৎ প্রথম থকেই সৃষ্টির উৎস ছিল ডাইনোসরমুখী। ক্রিয়ার উদ্দেশ্য থাকে কর্তার মনে, কাজেই এই উদ্দেশ্যটা ভগবানের ছিল। কি, এমনটা কি বলা যায় না?

    বিজ্ঞানী অরুণকুমার শর্মাও প্রচারের চেষ্টায় আছেন, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে মানুষের সৃষ্টি—সবের মধ্যেই রয়েছে একটা পরিকল্পিত পরিকল্পনা!

    অরুণকুমার শর্মা আমাদের দেশের বড় মাপের বিজ্ঞানী। এই বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির গোল্ডেন জুবলি প্রফেসর। ফেডারেশন অফ এশিয়ান সায়েণ্টিফিক অ্যাকাদেমিজ অ্যাণ্ড সোসাইটিজের প্রেসিডেণ্ট। ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল সায়েন্স অ্যাকাদেমির প্রাক্তন সভাপতি।

    অরুণবাবুর প্রশ্ন, “এই যে অ্যাকসিডেণ্টাল ফর্মে লাইফ এল, এর পুরোটাই কি অ্যাকসিডেণ্ট?”

    উত্তর অরুণবাবুই দিয়েছেন, “পুরোটা অ্যাকসিডেণ্টে চলছে না, প্রোগ্রাম করে চলছে—একজন প্রোগ্রামার আছেন। তাঁকেই আমি ঈশ্বর বলে মানি। তিনি সাকার নন, নিরাকার, সকলের মধ্যেই তিনি আছেন। আমরা বাইরে যা দেখছি তা তাঁরই অভিব্যক্তি। আমাকে আপনি অদ্বৈতবাদী বলতে পারেন।

    অবশ্য তারপরই একটা বেফাঁস কথা শ্রীশর্মা বলেছেন। তাঁর কথায়, “আমি ধ্যান করি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণের মূর্তি কল্পনা করে কিছুক্ষণ আমি ধ্যান করি, তাঁকে আমি মনের মধ্যে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। অবতাররা তো ঈশ্বর নন, তাঁরা ঈশ্বরোপলব্ধির পথপ্রদর্শক। তাঁরা গুরু। আমার গুরু ঠাকুর রামকৃষ্ণ।

    শিষ্য অরুণবাবু সোচ্চার ঘোষণা রেখেছেন—ঈশ্বর সাকার নন, নিরাকার। গুরু রামকৃষ্ণ সাকার কালীর সঙ্গে কথা বলেছেন, দেখেছেন, মায় খুনসুটি পর্যন্ত করেছেন। অরুণবাবুর কথায়, “ঈশ্বরকে ধরাছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না।” তবু তারপরও অরুণবাবুর গুরু রামকৃষ্ণ! সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে বিজ্ঞানীর মুখ থেকেই গড়গড় করে বেরিয়ে আসে জ্ঞানহীনের মত বিপরীত চিন্তা, বিশৃঙ্খল চিন্তা, যুক্তিহীন চিন্তা, বিজ্ঞান-বিরোধী চিন্তা। এদেশে বুদ্ধিজীবীর সম্মান পান অপুষ্ট বুদ্ধির মানুষ?

    বিজ্ঞানী অরুণকুমার শর্মা যে লাইফ বা প্রাণের আবির্ভাবের মধ্যে ঈশ্বরের প্রোগ্রামকে আবিষ্কার করেছেন, সেই প্রাণের আবির্ভাব প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ রমেন্দ্রকুমার পোদ্দার বলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে প্রাণ, কোনও কিছুই ঈশ্বরের সষ্টি নয়। তাঁর কথায়, “ঈশ্বর এসব কিছুই সৃষ্টি করেননি, এসব সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির নিয়মে—এবং হঠাৎ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এই পৃথিবীতে যা-কিছু দেখছেন—সমস্ত পদার্থ, গাছপালা পশু পাখি কীট পতঙ্গ মানুষ ইত্যাদি সমস্ত কিছু—কতকগুলে পরমাণুর সমষ্টি, a collection of atoms। মানুষের ক্ষেত্রে শুধু collection of atoms বললে হয় না, বলতে হয় a highly organised collection of atoms। কারণ প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ হচ্ছে সর্বোন্নত জীব, মানুষ এসেছে সবার শেষে।”

    “বিজ্ঞান বলে, এই পৃথিবী যেমন একদিনে সৃষ্টি হয়নি তেমনি মানুষও একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি বছর আগে হঠাৎ এক বিরাট বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেই বিস্ফোরণ ‘বিগ ব্যাং’ নামে খ্যাত। বিস্ফোরণের পর প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে যা ঘটেছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোটা ইতিহাসে আর কখনও তা ঘটেনি। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য ঐ তিন মিনিট সময়ের মধ্যেই ধরা আছে। তখনই প্রকৃত অর্থে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল; আজকের বিশ্বে আমরা যা-কিছু দেখি তার বীজ সৃষ্টি হয়েছিল তখন। তখন নিউক্লিয়ন ইত্যাদি বহু কণিকা গঠিত হয়েছিল এবং কণিকাগুলো পরস্পরের উপর ক্রিয়া করতে আরম্ভ করেছিল। এই যে পারস্পরিক ক্রিয়া, বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মিথষ্ক্রিয়া। বহুকাল ধরে বিভিন্নভাবে এই মিথষ্ক্রিয়া হওয়ার ফলে বিভিন্ন পদার্থের সৃষ্টি। এইভাবেই আস্তে আস্তে উদ্ভিদ, পশু, পাখি, মানুষ, প্রভৃতি জীব সৃষ্টি হয়েছে।

    “ঐ যে ‘বিগ ব্যাং’-এর পর নিউক্লিয়ন ইত্যাদি কিছু কণিকা সৃষ্টি হয়েছিল, সে তো শূন্য থেকে হয়নি। নিশ্চয় কিছু ছিল যা থেকে হয়েছিল। কারণ, বিজ্ঞানের গোড়ার কথাই হল—Matter cannot be created nor can it be destroyed। শুধু ম্যাটার নয়, এনার্জির বেলায়ও এই কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ম্যাটার আর এনার্জি বিশ্বসৃষ্টির আগেও ছিল, বিশ্ব যদি কোনোদিন ধ্বংস হয়ে যায় তখনও থাকবে। তবে আজ যেভাবে আছে সেইভাবে হয়তো থাকবে না। হয়তো আবার ‘ব্ল্যাক হোল’-এর মতো একটা কিছু হয়ে ম্যাটার-ট্যাটার সব এক জায়গায় জড়ো হয়ে যাবে, যেমন দেড় হাজার কোটি বছর আগে ‘বিগ ব্যাং’-এর আগে ছিল। তার মানে, ম্যাটার আর এনার্জি আগেও ছিল, পরেও থাকবে—চিরকালই থাকবে। কেবল রূপ বদলাবে হয়তো।

    “ম্যাটার আর এনার্জির আলটিমেট ইউনিট হচ্ছে প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি মৌলিক কণা আর ফোটন। আগেই বলেছি, ম্যাটার হচ্ছে কিছু অ্যাটমের সমষ্টি। অ্যাটমের আবার নিজস্ব জগৎ আছে। তার মধ্যে ইলেকট্রন আছে, নিউক্লিয়ন আছে। নিউক্লিয়নের মধ্যেও আবার অতিক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব কণিকা আছে। ম্যাটার আর এনার্জি ডিফরাণ্ট ইউনিটে, ডিফারেণ্ট লেভেলে এবং ডিফারেণ্ট ফর্মে অর্গানাইজ্ড্ হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে অর্গানাইজ্ড্ হয়ে যখন একটা নতুন অ্যাটম তৈরি হচ্ছে তখন তার নতুন ধর্ম দেখা যাচ্ছে। এইভাবে কতকগুলো অ্যাটম মিলে মলিকিউল তৈরি হল। আবার কতকগুলো-মলিকিউল মিলে ম্যাক্রো-মলিকিউল তৈরি হল। কতকগুলো ম্যাক্রো-মলিকিউল মিলে টিস্যু আর অর্গ্যান তৈরি হল। তারপর বিভিন্ন অর্গ্যান মিলে একটা অর্গানিজম তৈরি হল।

    “অর্গানিজ্‌ম্‌ মানে জীব। তা সে উদ্ভিদও হতে পারে, প্রাণীও হতে পারে। প্রথমে উদ্ভিদের সৃষ্টি। তারপর প্রাণীর। পৃথিবীতে জীবসৃষ্টির পর দুটি ধারায় জীবজগৎ বিভক্ত হয়ে গেল—একটি উদ্ভিদজগৎ আর একটি প্রাণিজগৎ। উদ্ভিদজগৎ আর প্রাণিজগৎ মিলে জীবজগৎ।

    “সৃষ্টির এই যে তত্ত্ব, বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘ইভলুশনিজ্‌ম্‌’ অর্থাৎ ‘বিবর্তনবাদ’। ‘বিগ ব্যাং’-এর পর কোটি কোটি বছর ধরে পরিবর্তন হতে হতে সৃষ্টি আজ এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ঈশ্বর নেই। বিবর্তনের এই ধারায় ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন হয়নি।”

    আরও এক বড় মাপের বিজ্ঞানী, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত তারকমোহন দাসও কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “ঈশ্বর সম্পূর্ণ কাল্পনিক ব্যাপার। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি। জীব জন্তু পশু পাখি কীট মানুষ, কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। এসবই সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টির নিয়মে, ইভলুশনারি প্রসেসে। এই দেখুন না, প্রাণের ইউনিট যে অ্যামিনো অ্যাসিড তা ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, অর্থাৎ প্রাণের উপাদান আমরা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে ফেলেছি। কে জানে, একদিন হয়তো প্রাণও তৈরি করে ফেলব। বিজ্ঞান যেভাবে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, তাতে মনে হয়, ল্যাবরেটরিতে একদিন প্রাণ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, যে জিনিস এখন ল্যাবরেটরিতে হতে চলেছে, সুদূর অতীতে এইভাবেই সে জিনিস প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছিল, এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈশ্বর প্রাণ সৃষ্টি করেননি।”

    O

    প্রাণের ইউনিট যে অ্যামিনো অ্যাসিড তা ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে অর্থাৎ প্রাণের উপাদান আমরা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে ফেলেছি। কে জানে, একদিন হয়তো প্রাণও তৈরি করে ফেলব।

    O

    অজিতকুমার সাহা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার পুত্র ও বিজ্ঞানী হিসেবে বিভিন্ন দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সম্মেলনে এ’দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রধানত কাজ করেছেন নিউক্লিয়র ফিজিক্স ও সলিড স্টেট ফিজিক্স নিয়ে। শ্রীসাহা মনে করেন, জগতে সবই উদ্দেশ্যহীন। এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পেছনে কোনও উদ্দেশ্য বা প্রোগ্রাম ছিল না। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টির নিয়মে, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই।

    শ্রীসাহার কথায়, যতদূর পর্যন্ত জানা যায়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। একটি বিশ্ব হিল, যার মধ্যে ছিল তেজপূর্ণ প্রচণ্ড শক্তি। কেমন তার শক্তি, কি তার বৈশিষ্ট্য—এখনও জানা যায়নি। শুধু জানতে পারা গেছে, ওই তেজঃপূর্ণ, প্রচণ্ড শক্তিতে পূর্ণ বিশ্বে সে ধরনের কোনও পদার্থ ছিল না, যে সব পদার্থের সঙ্গে বর্তমানে আমরা পরিচিত।

    তারপর এক সময় এই তেজঃপুঞ্জ বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণের সময়—এক হাজার থেকে দু’হাজার কোটি বছর আগে। গড় ধরে বলা যেতে পারে, আনুমানিক দেড় হাজার কোটিবছর আগে। সেই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’। এই বিস্ফোরণের পরেই সৃষ্টি হল কোয়ার্ক ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছু কণা। তখনই বিশ্ব সৃষ্টি হল। বিস্ফোরণের পর বিশ্ব যেমন আয়তনে বাড়তে লাগল, তেমনই এক সময় তার উত্তাপ কমতে শুরু করল। বিশ্ব সম্প্রসারিত আর শীতল হতেই থাকল। একটা পর্যায়ে সৃষ্টি হল হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন তারকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। এইভাবে সৃষ্টি হল তারার। সৃষ্টি হল, আবার ধ্বংসও হল। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ভব হল বিভিন্ন ভারী পদার্থের, ইংরেজিতে যাকে বলে হেভি এলিমেণ্ট।

    নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অণু-পরমাণুর সৃষ্টি হতে লাগল এবং তাদের রূপান্তরও ঘটতে লাগল। অণু ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করল। শেষে রেপ্লিকেটিং মলিকিউল এল। রেপ্লিকেটিং মলিকিউল মানে সেই ধরনের মলিকিউল, যা থেকে ঠিক ওই ধরনের মলিকিউল তৈরি হতে পারে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এক সময় এল ইউক্যারিয়োটিক সেল। এই সেল বা কোষের মধ্যে এল জেনেটিক কোষ। এই কোষ থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হল। প্রথমে এল এককোষী প্রাণী, তারপর বহুকোষী।

    মানুষ এসেছে সবার শেষে। মানুষের আগমন মাত্র তিরিশ লক্ষ বছর আগে। মানুষ একবারে পৃথিবীতে আসেনি। এককোষী প্রাণীর থেকে যে রূপান্তর সৃষ্টি হয়েছিল, তারই শেষ পরিণতি মানুষ।

    প্রকৃতির রাজ্যে যে রূপান্তর জন্মলগ্ন থেকে শুরু হয়েছিল, তা সম্পূর্ণই উদ্দেশ্যহীনভাবে আজও ক্রিয়াশীল। কোষের মধ্যেও উদ্দেশাহীনভাবেই মিউটেশন হচ্ছে। এই মিউটেশনই মূল কথা। এই মিউটেশনের জন্যই এককোষী প্রাণী থেকে বিবর্তনের পথ ধরে এসেছে কোটি কোটি কোষের প্রাণী—মানুষ। এই মিউটেশনের জন্যেই বিবর্তন সম্ভব হয়েছে।

    বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘God created man in His own image’। বাইবেলের কথাটা বদলে বলা যায়, Mancreated God in his own image। প্রায় সব ধর্মেই তাই। তাইতো আমরা দেখি দেব-দেবীদের সবাই মানুষেরই মত। তারা দুঃখে কাতর হন, আনন্দে উল্লাসিত, ক্রোধে উন্মাদ।

    O

    বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘God created man in His own image। বাইবেলের কথাটা বদলে বলা যায়, Man created God in his own image। প্রায় সব ধর্মেই তাই। তাইতো আমরা দেখি দেব-দেবীদের সবাই মানুষেরই মত। তারা দুঃখে কাতর হন, আনন্দে উল্লাসিত, ক্রোধে উন্মাদ।

    O

    আর এক বিজ্ঞানী অশোক বড়ুয়া ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে বাইবেলে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক থিওরি। তশোক বড়ুয়া ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স-এর ডিরেক্টর। শ্রীবড়ুয়া পদার্থ বিজ্ঞানী। তিনি বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানের আধুনিক ‘বিগ ব্যাং’ থিওরির কথা হাজার হাজার বছর আগেই লেখা হয়েছে বাইবেলে। তাঁর কথায়, “বাইবেলে আছে, In the begining God created the heaven and the earth। আরও আছে And God said, let there be light: and there was light। ‘বিগ ব্যাং’ থিওরিও বলছে, হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটল, তারপরই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হল। সুতরাং ‘বিগ ব্যাং’ থিওরিও যা, কনভেনশনাল গডও তা। কোনো পার্থক্য নেই।”

    বিকাশ সিংহ। সল্টলেকের ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের ভেরিয়েবল্ এনার্জি সাইক্লোট্রন সেণ্টারের ডিরেক্টর। একই সঙ্গে নিউক্লিয়র ফিজিসিস্ট এবং বিভিন্ন ধর্ম পুস্তকে খুঁজে পান আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে।

    ‘বিগ ব্যাং’ থিওরির প্রসঙ্গে বিকাশবাবুর অভিমত, “মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের চিন্তাধারার অনেক মিল আছে। বিশ্ব সৃষ্টির আগে যে মহাতেজ ছিল, সেই মহাতেজ কোথা থেকে এসেছিল, বিজ্ঞানী হিসেবে তার উত্তর আমার জানা নেই। (যাকে ‘বিগ ব্যাং’বলি—তার আগে কী ছিল, বিজ্ঞান সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না।) দার্শনিক হিসেবে আমি স্বীকার করতে রাজি আছি, ঈশ্বরই সেই তেজ সৃষ্টি করেছিলেন—এবং তারপর মহাভারতে বিশ্বরূপদর্শনের যে বর্ণনা পাই, সেই বর্ণনার সঙ্গে পনের শ কোটি বছর আগেকার ঐ বিস্ফোরণের দৃশ্যের অনেকখানি মিল খুঁজে পাওয়া যায়।”

    ইণ্ডিয়ান ন্যাশান্যাল সায়েন্স আকাদেমির সিনিয়র সায়েণ্টিস্ট মৃণালকুমার দাশগুপ্তও মনে করেন, এই মহাবিশ্ব বিষয়ে আজকের বিজ্ঞান যে সব সিদ্ধান্তে পোঁচেছে, সে সব কথা হাজার হাজার বছর আগেই বলে গেছে বেদ ও উপনিষদ। তাঁর কথায় “এই বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে আমাদের বেদ ও উপনিষদে যে কথা আছে, আজকের বিজ্ঞানের সঙ্গে তা অনেকখানি মিলে যায়। বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে আজকের বিজ্ঞান যে কথা বলছে, আমাদের উপনিষদ বহুকাল আগে প্রায় সেই কথাই বলে গেছে।”

    মৃণালবাবু খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ওপেনহাইমার তো গীতার বিশ্বরূপ দর্শনে একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের তেজ দেখে তিনি গীতা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন—

    দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা।
    যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস মহাত্মনঃ।”

    মৃণালবাবু বোঝাতে চেয়েছেন—হিন্দু ধর্মচিন্তার মধ্যে নিহিত রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের নানা সিদ্ধান্ত।

    ২২ এপ্রিল ’৯৫-এর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হৃষীকেশ সেন-এর ‘বিজ্ঞান ও ভগবান’ লেখাটির প্রসঙ্গে আবার আমরা ফিরছি। ৪৫ পৃষ্ঠার ১ম কলমে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ-এর দ্বৈত বিশ্বের (Duplex world} যে ধারণা দিয়েছেন, তা সাংখ্য দর্শনের অব্যক্ত-ব্যস্ত তত্ত্বের মত। ৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’-এর সেই মহাবিস্ফোরণের কথা তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ, ‘কঠক সংহিতা ইত্যাদি প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে।

    রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন-এর চৈত্র ১৪০০ সংখ্যার ১৪৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্বন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞানীমহলে জনপ্রিয় তত্ত্ব ‘বিগ ব্যাং’ (Big Bang)-এর বর্ণনা বিজ্ঞানীদের লেখায় যা পাই, প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থের সৃষ্টি বর্ণনার সঙ্গে রয়েছে তার আশ্চর্য-রকম মিল। বিজ্ঞানের এই ধারণার সঙ্গে তুলনা করা যায় শ্রীমদ্ভাগবতে কথিত সৃষ্টি বর্ণনাঃ “সকল পদার্থ ভিত হইয়া পরস্পর মিলিত হইল। তাহার পর সেই সকল হইতে একটি অচেতন অঙ উৎপন্ন হইল।…ঐ অঙ বহির্ভাগে ক্রমশ দশগুণ বর্ধিত প্রধানাদি জলাদি দ্বারা পরিবৃত। সেই অঙেই ভগবান হরির মূর্তিস্বরূপ লোকসমূহ বিস্তৃত আছে। আবার তিনি দশাঙ্গুলি পরিমিত হইলেও এই বিশ্ব আবৃত করিয়া আছেন। মায়ার অধীশ্বর সেই ভগবান বিবিধ রূপ ধারণ কবিতে ইচ্ছা করিয়া আত্মমায়া দ্বারা যদৃচ্ছাক্রমে প্রাপ্তকাল, অদৃষ্ট ও প্রকৃতি আশ্রয় করিয়াছিলেন।”

    যে প্রবন্ধ থেকে এই অংশটি তুলে দিলাম, তার নাম, বিজ্ঞানমনস্কতা, ভগবদ্ধিশ্বাস ও কুসংস্কার’। লেখক—বিশ্বরঞ্জন নাগ।

    শ্রীমদ্ভাগবত থেকে আমরা পেলাম, তেজঃপূর্ণ, শক্তিপূর্ণ যে বিশ্ব বিস্ফোরিত হয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, সেই বিশ্ব আবার সষ্টি হয়েছিল সকল পদার্থের আলোড়িত হয়ে মিলনের মধ্য দিয়ে।

    আধুনিক ‘বিগ ব্যাং তত্ত্বের সঙ্গে আশ্চর্যরকম মিলের পরিবর্তে বড় রকম গরমিলই তো চোখে পড়ছে। এরপরও বিশ্বরঞ্জনবাবু আশ্চর্য রকম মিল খুঁজে পেলে, সেটা বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথার সত্যতা বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করে।

    বিজ্ঞান যখন বলছে, ‘বিগ ব্যাং থিওরি যখন বলছে, শক্তিপূর্ণ ওই বিশ্বে সে ধরণের কোনও পদার্থ ছিল না, যে সব পদার্থের সঙ্গে আমরা পরিচিত, জল বায় প্রাণী ইত্যাদি তো দূরের কথা। শ্রীমদ্ভাগবতে বিস্ফোরিত হওয়ার আগের তেজঃপূর্ণ বিশ্ব জলাদি দ্বারা পরিবৃত থাকার বর্ণনা পড়েও যাঁরা আশ্চর্য হন, তাঁরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই যে আশ্চয হওয়ার ভান করেন, এটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না।

    হিন্দু মৌলবাদী, রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন-এর ওই সংখ্যার ১৪৫ পৃষ্ঠাতেই বলা হয়েছে, “ব্ল্যাক হোল’-এর কথা বিজ্ঞানে নতুন হলেও হিন্দু ধর্মে তা আদৌ নতুন নয়। হিন্দু ধর্মে ব্লাক হোলের কথা কীভাবে আছে? তাও উদাহরণ হিসেবে

    তুলে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণটা এই-‘ব্ল্যাক হোল’ (কৃষ্ণ গহ্বর)-জাতীয় মহাশূন্যের তথাকথিত ‘সিঙ্গুলারিটি’তে (গাণিতিক উৎসবিন্দু}, যেখানে নতুন পদার্থ জন্ম নিচ্ছে, আধুনিক বিজ্ঞানে ভাবা হয় যে, সময় সেখানে স্তব্ধ হয়ে থাকে। সাধারণের মধ্যে বহুল-প্রচলিত কথা ‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছর এরই প্রতিধ্বনি।”

    ‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছর’, কথাটা নাকি ‘ব্ল্যাক হোল’- এর সমার্থক শব্দ? ‘ব্ল্যাক হোল’-এর অস্তিত্বেরই ঘোষণা! অস্তিত্বেরই প্রতিধ্বনি!! এটা আপনার আমার মনে না হোক, রামকৃষ্ণ মিশনের মনে হয়েছে, হিন্দু ধর্মের প্রচারক বৃহত্তম সংস্থাটির মনে হয়েছে। এরকম অনেক কিছুই ওদের মনে হয়। ওদের মনে হয়—নলজাতক শিশু (Test-tube baby), বিকল্প মা (surrogate imother), এইসব আধুনিক বিজ্ঞানের দান বলে আমরা মনে করলেও তা আসলে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার কাছে নতুন কিছু নয়। দ্রোণ ও দ্রোণীর জন্মকথা, সত্যবতীর জন্মকথা, এসব পুরাণের ঘটনা তারই প্রমাণ। যে ‘পেট্রিয়ট মিসাইল’ (Patriot missile) নামের বিধ্বংসী অস্ত্র (উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল) আবিষ্কারের পর প্রমাণিত হয়ে গেছে বরুণ-বাণ’ ও ‘অগ্নি-বাণ আদৌ কোনও কল্পনা ছিল না।

    এই সবই লেখা রয়েছে উল্লেখ করা ‘উদ্বোধন’-এর ১৪৫ পৃষ্ঠায়। এই পৃষ্ঠাতে এ’কথাও বলা হয়েছে – হিন্দু পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে, মহাকাব্যে বর্ণিত অধিকাংশই রূপক। রূপকগুলোর ব্যাখ্যা করলেই দেখতে পাব, বিজ্ঞানের নবতম কোনও আবিষ্কারই নতুন নয়। ওই আবিষ্কার আসলে নতুন করে ফিরে দেখা। “আসলে আমরা এক আত্মবিস্মৃত জাতি। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞানরাশিকে অবহেলা করে পাশ্চাত্যের অসম্পূর্ণ জ্ঞানকেই সম্পূর্ণ বলে মনে করি।… বিদেশের বিজ্ঞানী প্রশংসা না করলে ভারতীয় বিজ্ঞানী স্বীকৃতি পান না। বিদেশী পত্রিকায় ছাপা না হলে ভারতীয় বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র গণ্য হয় না। দেশের কবিরাজী ঔষধকে হেয় প্রতিপন্ন করাই আমাদের ডাক্তারদের ‘উন্নত’ শিক্ষার পরিচয়।

    এই পত্রিকায় ১৪৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা সত্যকে জেনেছিলেন। সেই সত্যকে তাঁর ‘পরমব্রহ্ম’ বলতেন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সেই পরমব্রহ্মের স্বরূপ-তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই বিজ্ঞানবিরোধী নয়। কাজেই ভগবদ্বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানমনস্কতায় কোন বিরোধ নেই।”

    রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এই অমূল্য বাণী বিশ্লেষণ করলে আমরা পাচ্ছিঃ

    একঃ বিজ্ঞানের সব নবতম আবিষ্কারই বাস্তবে নতুন কোনও আবিষ্কারই নয়। এ’সবই প্রাচীন যুগে হিন্দুরা আবিষ্কার করেছিল। প্রাচীন হিন্দু পুরাণে, মহাকাব্যে এইসব আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোর উল্লেখ আমরা পাই।  দুই: প্রাচীন হিন্দু পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, মহাকাব্যে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোর উল্লেখ রয়েছে রূপক আকারে। প্রয়োজন—রূপকগুলোর ব্যাখ্যার। প্রয়োজন—আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে রূপকগুলোর পুনর্ব্যাখ্যার।

    তিন: ভারতের বৃহত্তম হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন আহ্বান জানাচ্ছে, আমাদের ঋষিদের অধ্যাত্মবাদী জ্ঞান ও ঈশ্বরবাদী জ্ঞান যা আসলে বিজ্ঞান, সেই বিজ্ঞান দ্বারা পাশ্চাত্যের অসম্পূর্ণ বিজ্ঞানকে অপসারণ করতে হবে। এবং এ’ভাবেই আত্মবিস্মৃত জাতিকে উঠে দাঁড়াতে হবে।

    চার: ঈশ্বরে বিশ্বাস ও যুক্তিমনস্কতা বা বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।

    পাঁচ: হিন্দু দর্শন অবশ্যই বিজ্ঞান এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক বড় বিজ্ঞান।

    যদিও অবশ্য সেটা প্রমাণ করতে গেলে আবার হিন্দু দর্শনের মধ্যে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের তত্ত্বই খুঁজে বার করতে হয়।

    এই কথাগুলো শুধুমাত্র রামকৃষ্ণ মিশন প্রচার করছে না, এই একই ধরনের বক্তব্য প্রচারে বিপুলভাবে আসরে নেমেছে বিশ্বহিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পাটি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দল। সঙ্গে গলা মেলাতে পেয়েছেন কিছু হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীকে।

    ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন, বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও মৌলবাদী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জনতা পার্টির (অবশ্য ভারতের নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক প্রতিটি দলই ব্যাপক অর্থে মৌলবাদকে জিইয়ে রাখতে চায় ভোট-বাক্সকে স্ফীত করার লোভে। আর এই লোভেই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের অলীক ঈশ্বর বিশ্বাস, অমানবিক ধর্মীয় বিশ্বাস, ভ্রান্ত নিয়তিবাদকে জনগণের মন থেকে সরাবার চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ভোট হারাবার ঝুঁকি নিতে নারাজ) সুরে সুর মেলাতে হাজির হয়েছে বাঙলাভাষী ইণ্টেলেকচুয়ালদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তথাকথিত সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’। ‘দেশ’ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে লাগাতারভাবে ঈশ্বর বিশ্বাস ও ধর্ম বিশ্বাসের পক্ষে বস্তাপচা যুক্তি উগরেই চলেছে।

    ২২ এপ্রিল, ১৯৯৫ সংখ্যার ‘দেশ’ থেকে ইতিমধ্যেই কিছু কিছু কুযুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। ওই সংখ্যার ৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মডেল হিসেবে ‘ঊর্ণনাভ’ বা মাকড়সার উল্লেখ আছে, বেদান্তে। বাস্তবের বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মাকড়সার আশ্চর্যরকম মিলও খুঁজে পেয়েছে মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ‘আঁতেল’ হবার সুখ দেওয়া ‘দেশ’ পত্রিকা। মিল কোথায়? বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড শূন্য থেকে প্রসারিত হতে শুরু করেছে, আবার সঙ্কুচিত হয়ে একদিন শূন্যে পরিণত হবে। মাকড়সা না হোক, মাকড়সার জালও প্রসারিত হয়, আবার জাল গুটিয়েও নেওয়া যায়। অতএব বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বেদান্ত বর্ণিত মাকড়সার দারুণ মিল খুঁজে পাওয়া গেল!  ‘দেশ’ পত্রিকায় এমন বালখিল্যবৎ উদাহরণ হাজির করা দেখে আমার সাথী দেবকুমার হালদার হেসে গড়াগড়ি দিয়ে বলেছিলেন, “ব্যাখ্যা খুঁজে বের করবই ভাবলে যে কোনও কিছু থেকেই টেনে-টুনে একটা যা হোক ব্যাখ্যা হাজির করা যায়-ই।

    “ধরো, একজন মাতালকে জিজ্ঞেস করলে-‘বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মডেল বিষয়ে তোমার কোনও ধারণা আছে?

    “মাতাল তোমার কথার জবাব না দিয়ে বোতল বের করল। তারপর ঢক-ঢক করে গলায় ঢালল গোটা বোতলের গলিত আগুন। ফাঁকা বোতলটা নামিয়ে রেখে এলো-মেলো পায়ে বেরিয়ে গেল।

    “মাতালের এই ঘটনার মধ্যে থেকেও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের বাস্তব মডেলের সঙ্গে মিল খুঁজে বের করা যায়, বের করার তাগিদ থাকলে।

    “বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড শূন্য থেকে সৃষ্টি, সেটা বোঝাতেই মাতাল শূন্য হাত বোতলে পূর্ণ করেছিল। ব্রহ্মাণ্ড সঙ্কুচিত হতে হতে শূন্যে পরিণত হবে বোঝাতেই মাতাল তার গলায় শেষ মদ-বিন্দু ঢেলে বোতল শূন্য করেছিল। এবং নামিয়ে রেখেছিল বোতল।”

    মুসলিম-বিজ্ঞানী ও মৌলবাদী চক্রান্ত

    ফতেহ মোহাম্মদ পেশায় বিজ্ঞানী। নিবাস, পাকিস্তানে। কোয়াণ্টাম মেকানিকস-এর থেকে শুরু করে জিন, সবই পবিত্র মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কোরআনের আলোকে অনুধাবন করা যায়—এই প্রসঙ্গে একটি ঢাউস বই লিখেছেন মোহাম্মদ সাহেব। প্রকাশক, পাকিস্তানের সামরিক পুস্তক ক্লাব। সরকার বইটির দারুণ প্রশংসা করেছে। বইটিতে ব্যাখ্যা সহকারে দেখানো হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারই নানা রূপকের আকারে রয়েছে কোরআনে। লেখক নানা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন (অনেক মুসলিম ধর্ম-বিশ্বাসীদের মতে প্রমাণ করে ছেড়েছেন), ‘ব্ল্যাক হোল’ বা ‘কৃষ্ণ গহ্বর’ হল কেনআন বর্ণিত ‘দোজখ’ বা নরক।

    পারভেজ আমিরালী হুদোভয় পাকিস্তানের বিশিষ্ট পরমাণু পদার্থবিদ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড-এর এম. আই. টি. থেকে পি-এইচ. ডি.। ইতালির ট্রায়েস্টে আই. সি. পি. টি.-তে সম্মানীয় অতিথি বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৮৪ সালে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের বিষয়—পাকিস্তানে ইসলামি মৌলবাদের উত্থান ও বিজ্ঞানের আদর্শগত সংকট। প্রবন্ধে লেখক এক জায়গায় বলেছেন, “পাকিস্তানে একটি ক্রমবর্ধমান নতুন আন্দোলন হাজির হয়েছে, ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসকে বিজ্ঞান বলে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা আধুনিক বিজ্ঞানকে পশ্চিমা উপদ্রব হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে হটিয়ে ইসলামি বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানকে হটিয়ে হিন্দু বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠার আহ্বানের সঙ্গে কী অসাধারণ মিল! দু’ দেশের মৌলবাদী চিন্তানায়কদের চিন্তার আশ্চর্য রকম মিল পাঠক- পাঠিকারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হচ্ছে, বিজ্ঞান একটি আদর্শগত বিষয় এবং ইসলামি বিজ্ঞান খ্রিস্টিয় বিজ্ঞান বা কমিউনিস্টদের বিজ্ঞান থেকে ভিন্নতর ও উৎকৃষ্ট। ইসলামি বিজ্ঞানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা এবং পবিত্র কোরআন ইসলামি বিজ্ঞানের অনুপ্রেরণা। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ব্যয়বহুল ইসলামিক বিজ্ঞান সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলো থেকে আগত শত শত বিজ্ঞান প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে এই মতটাই উঠে এসেছিল।

    “ইসলামিক দর্শনকে বিজ্ঞান বলে যারা চালাতে চাইছে, তাদের মধ্যে প্রধান নেতৃত্বে রয়েছে জামাত-ই-ইসলাম’ নামের একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একটু লক্ষ্য করলেই খুঁজে পাবেন, এক্ষেত্রেও দু’ দেশে অসাধারণ মিল। এদেশে হিন্দু দর্শনকে বিজ্ঞান বলে চালাতে চাইছে বিশ্বহিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি, রামকৃষ্ণ মিশন, ইত্যাদি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দল। যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন যোগাড় করেছে। জামায়তি প্রচারের বৈশিষ্ট্য হল পশ্চিমা বিজ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিষোদগার। জামাত-ই-ইসলামের সবচেয়ে বাকপটু নেতাদের মধ্যে একজন মরিয়ম জামিলাহ।…মরিয়ম জামিলাহর মতে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সমপর্যায়ে ওঠার কোনও প্রয়োজন নেই মুসলিম বিজ্ঞানের। এটা অভিপ্রেতও নয়। কারিগরি শিক্ষার সংকীর্ণতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে জামিলাহ সুপারিশ করেছেন আধুনিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে অধ্যাত্মবাদী ইসলামি সাধকদের ফিরিয়ে আনতে।” আমাদের দেশে মৌলবাদী ও প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে মৌলবাদী প্রতিটি শক্তিই আধুনিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে ফিরিয়ে আনতে চাইছে অধ্যাত্মবাদী হিন্দু সাধকদের, ঋষিদের। দু’দেশের মৌলবাদী চিন্তায় কী আশ্চর্য রকমের মিল!

    ডঃ পারভেজ তাঁর প্রবন্ধে আরও লিখেছেন, “গত কয়েক বছরে ‘ইসলামি বিজ্ঞান’-এর প্রবক্তারা একটি নতুন ব্যাখ্যা হাজির করতে শুরু করেছে—এই ‘ইসলামি বিজ্ঞান’ শুধুমাত্র সেকেলে মুসলমানদের বিজ্ঞান নয়। বরং এটা এমনই এক বিজ্ঞান যা সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে কোরআনের আলোতে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। এইজাতীয় বক্তব্যের সমর্থনে ইসলামি বিজ্ঞানের প্রবক্তরা যুক্তি হাজির করেন যে-কোরআন একটি সম্পূর্ণ জীবন-বিধান। কোরআনে রয়েছে সব বিজ্ঞান।” হিন্দু মৌলবাদীরা যেমন বলেন—আমাদের বেদে, পুরাণে, গীতায় সব আছে।  ডঃ পারভেজ জানাচ্ছেন, কিছু কিছু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী পেশার বড় মাপের মানুষ ইসলামি অধ্যাত্মবাদের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক বিজ্ঞানের লুকনো নানা তত্ত্ব।

    ডঃ পারভেজ উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন এমনই কিছু বিজ্ঞান-বিরোধী ‘ইসলামি বিজ্ঞানীকে’। “প্রথম উদাহরণ একজন পাকিস্তানী অধ্যাপক। লণ্ডনের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ, ডি, করেছেন। পাকিস্তানের জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি উন্নয়ন সংস্থার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং একটি বৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান শিক্ষাবিদ। এই বিজ্ঞানী বর্তমানে জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও কারিগরি কমিশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি। ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামিক বিজ্ঞান সম্মেলন’-এ একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন। তাতে তিনি জানিয়েছেন—একঃ প্রতি সেকেণ্ডে আলোর যা গতি, তার চেয়ে কম গতিবেগ হওয়ার কারণে ‘বেহেশত’ বা ‘স্বর্গ’ আক্ষরিক অর্থেই বর্তমান অবস্থান থেকে সরে গেছে। দুইঃ শবেবরাতের পুণ্য রজনীর এক উপাসনা, সাধারণ রাতের সহস্র উপাসনার চেয়ে শ্রেয়। তাঁর এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদকে টেনে এনেছেন। তিন: কোরআনে বর্ণিত ‘সাত আসমান’ তত্ত্ব বিষয়ে প্রফেসর সাহেব বলেন, এগুলো পরমাণুর কোয়াণ্টাম স্তরের মত। যেভাবে শক্তি শোষণ বা বর্জন করে পরমাণু স্তর পরিবর্তন করে, সেভাবে পাপ বা পুণ্য করেও এক আসমান থেকে অন্য আসমানে যাওয়া যায়।

    “আরেকজন ইসলামি বিজ্ঞানী যাঁকে আমরা সোজাসুজি ডঃ বি. এম. বলে উল্লেখ করব, তিনি পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি কমিশনের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত। শুধু গভীরভাবে ধার্মিক নন, সামাজিক ব্যাধিগুলোর সর্বরোগহর ওষুধ হিসেবে ইসলামি বিজ্ঞান প্রয়োগের ব্যাপারে কৃতসংকল্প। তিনি একটি প্রবন্ধে বলেছেন, কোরআনে বর্ণিত অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন অগ্নিময় জীব আসলে জিনের অস্তিত্বের রূপকাকার। এই ধার্মিক বিজ্ঞানী আর একটি প্রবন্ধে জানিয়েছেন কৃষ্ণ গহ্বর (Black Hole)-এর অস্তিত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন হলেও হাজার হাজার বছর আগে রচিত কোরআনে এর উল্লেখ আছে। কোরানে যে বেহেশত- এর অর্থাৎ স্বর্গের উল্লেখ আছে, তা আসলে কৃষ্ণ গহ্বর।” (হিন্দু ধর্ম প্রচারক রামকৃষ্ণ মিশন বলছে, ‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছর’, বাক্যটি কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি) বিশিষ্ট ইসলামি বিজ্ঞানী ফতেহ মোহাম্মদ প্রমাণ করতে সচেষ্ট-দোজখ বা নরকই হল কৃষ্ণ গহ্বর। পারমাণবিক শক্তি কমিশনের বড় মাপের বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, কৃষ্ণ গহ্বর আসলে ‘বেহেশত বা স্বর্গ। ঈশ্বর, আল্লাহে বিশ্বাসী মানুষগুলোও যে মৌলবাদী বিজ্ঞানীদের এমন উল্টো-পাল্টা কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পরবেন! আরও বেশি বেশি করে ধর্মাত্মা বিজ্ঞানীদের মতামত নিলে, আরও বেশি বেশি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনাই প্রবল।  পাকিস্তানের একটি উল্লেখযোগ্য নতুন বই ‘গড ইউনিভার্স অ্যাণ্ড লাইফ’। লেখক, মোহাম্মদ মুনির। যাঁরা ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটাতে চাইছেন, তাঁদের কাছে বইটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বইটির ২৫ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন, “আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, পারমাণবিক অবদানগুলো অধ্যাত্মিক। বস্তুবাদীরা আমাদের যে ভাবে প্রোটন ও নিউট্রনে আকর্ষণের ক্ষেত্রে তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তিকে বিশ্বাস করতে বলেন, আসলে তা কিন্তু সত্যি নয়। ভাবতে অবাক লাগে, যখন নর ও নারী একে অপরের পিছু ছুটছে, প্রেমে লিপ্ত হচ্ছে, তখন সেই নর-নারীরাই এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি, যে প্রোটন ও নিউট্রন দুই লিঙ্গে বিভক্ত।”

    বুঝুন ব্যাপারটা! পরমাণুর মধ্যে আত্মার আবিষ্কার এবং প্রোটন ও নিউট্রনে দুই বিপরীত লিঙ্গের আবিষ্কার! মুনির সাহেব তাঁর এমন যুগান্তকারী আবিষ্কারকে বিজ্ঞানের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে অবহেলে নোবেল জিতে নিতে পারেন।

    মিশরের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ রাশাদ খলিফা অত্যাধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে কোরআন বিশ্লেষণ করে, বিশ্লেষিত তথ্যের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, কোরআন নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর রচনা এবং কোরআনই অলৌকিকের অস্তিত্বের প্রমাণ। ডঃ খলিফা এ বিষয়ে একটি বইও লিখে ফেলেছেন, ‘দি কম্পিউটার স্পিকন্ গডস্‌ মেসেজ টু দি ওয়ার্ল্ড’। খলিফা সাহেবের আবিস্কৃত তথ্যের ভিত্তিতে মোঃ আবদুর রজ্জাক লিখেছেন, ‘আল-কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযা এবং উনিশ। ‘মোজেযা’ কথার অর্থ ‘অলৌকিক ব্যাপার’। মোজেযা এবং উনিশ’ শব্দ দুটি নামকরণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সার্থকতা এই যে, আল্লাহে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী খলিফা সাহেব কম্পিউটারের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন— উনিশ সংখ্যাটি পরম বিস্ময়কর ও চরম অলৌকিকত্বের চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিস্তারিত নির্ভুল বর্ণনা!

    কোরআন যে আল্লাহেরই রচনা, তাই চূড়ান্ত বিজ্ঞান, এবং অলৌকিক অস্তিত্বের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ—একথা জানিয়ে ‘জনাব প্রবীর ঘোষ-কে প্রীতি ও শুভেচ্ছার উপহার হিসেবে’ একটি চিঠিসহ বইটি পাঠিয়েছিলেন লেখক।

    সে সময় উত্তর দিইনি। মনে হয়েছিল এসব পাগলামীর যোগ্য জবাব হতে পারে—উপেক্ষা। কিন্তু আজ পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের ও ঈশ্বরের মেলবন্ধন ঘটাবার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, তাতে এইসব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের পাগলামী কতটা নির্ভেজাল, কতটা নির্ভেজাল তাঁদের অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস—এই নিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ দেখা দিয়েছে। প্রচারমাধ্যমগুলো, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলো প্রচার শুরু করেছে – বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের ও ঈশ্বরের কোনও বিরোধ তো নেই-ই, বরং মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলার সময় হয়েছে। এঁরা নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞানের ভারী ভারী কথা আমদানি করে যেমন এক রহস্যময় কুয়াশা সৃষ্টি করে গোটা বিষয়টাকেই গুলিয়ে দিচ্ছেন, তেমনই কখনও বা হাজির করছেন বিজ্ঞানীদের ভাঁড় ভাঁড় কথা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শোষক ও রাষ্ট্রশক্তির মগজ ধোলাইয়ের এই পরিকল্পিত প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের এ জাতীয় পাগলামী বা উদ্দেশ্যমূলক কুযুক্তির বিরুদ্ধে বর্তমানে কলম ধরতে হচ্ছে, বক্তব্য রাখতে হচ্ছে।

    খলিফা সাহেব বাস্তবিকই কি মনে করেন হজরত মোহাম্মদ আল্লাহের পাঠানো ‘বোরাক’ নামের এক আশ্চর্য মা-প-পা (মানুষ + পশু + পাখি)-র পিঠে চেপে কোটি কোটি বছরের পথ পার হয়ে আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন? আল্লাহের সঙ্গে মোহাম্মদের কথা-বার্তা হয়েছিল? আল্লাহ মোহাম্মদকে দুটি মহারত্ন উপহার দিয়েছিলেন—’নামাজ’ ও ‘রোজা’! তারপর আবার কোটি কোটি বছরের পথ ফেরা। যাতায়াত, আল্লাহের সঙ্গে কথা-বার্তা, সব মিলিয়ে মোহাম্মদের সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক মিনিট। বিজ্ঞানী খলিফা সাহেব, আপনি কি বাস্তবিকই মনে করেন এমনটা ঘটা সম্ভব? বিজ্ঞান মেনেই সম্ভব?

    ‘বোরাক’-এর দেহ ঘোড়ার, মাথা সুন্দরী যুবতীর, পিঠে পাখির ডানা। বোরাকের পাখা ছিল। বোরাক উড়তে পারত। এ’ সব ধরে নেবার পরও প্রশ্ন থেকে যায়—ডানায় নির্ভর করে শূন্যে উড়তে বায়ুর প্রয়োজন হয়। যেখানে বায়ু নেই, সেখানে ডানার সাহায্যে ওড়া বিজ্ঞানের নিয়মেই অসম্ভব। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করার পর এক ফুট ওড়াও যেখানে অসম্ভব, সেখানে কোটি কোটি মাইল উড়ল কী করে? কল্পনায় ভর করে ছাড়া ওড়ার আর কোনও ব্যাখ্যা তো পাই না!

    এখন যেভাবে সব ধর্মীয় কল্পনার গায়ে ‘রূপক’ ছাপ মেরে গোঁজামিল ব্যাখ্যা হাজির করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তাতে ‘বোরাক’কে আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন যান অথবা ‘টাইম-মেশিন বলে কোনও ধার্মিক বিজ্ঞানী ভবিষাতে ব্যাখ্যা হাজির করলে বিন্দুমাত্র অবাক হব না।

    সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যখন সর্বত্র বিরাজ করছেন, তখন মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতে কোটি কোটি মাইলের পথ উড়িয়ে নিয়ে গেলেন কেন? মাথায় ঢোকে না।

    O

    সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যখন সর্বত্র বিরাজ করছেন, তখন মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতে কোটি কোটি মাইলের পথ উড়িয়ে নিয়ে গেলেন কেন? মাথায় ঢোকে না।

    O

    বিজ্ঞানী খলিফা সাহেব উত্তরে হয়তো বলবেন—মোহাম্মদকে আরশ, বেহেস্ত ও দোজখ দেখাতেই আল্লাহ এই ভ্রমণ বা ‘মোয়ারাজ’-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। যিনি যুক্তির ধার ধারেন না, তাঁর এমন কথা বলতে কোনও অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয়। এমন ভাবার পক্ষেও খলিফা সাহেবের কোনও অসুবিধে নেই যে, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৩ অক্টোবর, রবিবার, সকাল ৯টায়। আবার এমন উদ্ভট বিজ্ঞান-বিরোধী তথ্যকে বিজ্ঞানের ছাপ মেরে দিতে উন্মাদ বা ধান্ধাবাজ কোনও বিজ্ঞানী রামকৃষ্ণ মিশনের দেওয়া উদাহরণের অনুকরণে বলতেই পারেন – ‘বিশ্বশ্রষ্টা ঈশ্বরের এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছর’ জাতীয় কথা। সঙ্গে এটুকুও বলে দেবেন সালের হিসেবটা ঈশ্বরের করা, ওটা মানুষর বছরে পরিবর্তিত করতে…. ইত্যাদি ইত্যাদি।

    কোরআনের বেহস্ত বা স্বর্গের সাতটা ভাগ ও দোজখ বা নরকের সাতটা ভাগকে কিছু মুসলিম বিজ্ঞানীরা যেভাবে পরমাণুর কোয়াণ্টাম স্তরেরই রূপক বলে প্রচারে নেমেছেন, তাতে বেহেস্তে মদ ও মেয়েছেলের ঢালাও ব্যবস্থাকে ‘রূপক’ ছাপ মেরে একটা অকিঞ্চিতকর ব্যাখ্যা হাজির করতে কতক্ষণ?

    ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত সৈয়দ আহমেদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন—আল্লাহের বাণীর বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে বাস্তব সত্যের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সেখানে আল্লাহের বাণীকে ‘রূপক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

    সৈয়দ সাহেবের এই নীতিটা বিভিন্ন প্রধান ধর্ম দারুণভাবে গ্রহণ করেছে এবং কিছু কিছু বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানের মুক্ত হাওয়া থেকে এনে ‘হিন্দু-বিজ্ঞানী’, ‘মুসলিম-বিজ্ঞানী’, ‘খ্রিস্টান-বিজ্ঞানী’ ইত্যাদি খাঁচায় পুরে সুন্দরভাবে কাজে লাগাচ্ছে।

    খ্রিস্টান-বিজ্ঞানী ও মৌলবাদী চক্রান্ত

    স্বর্গের কথায় আর একজনের কথা মনে পড়ে গেল। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী ফ্র্যাংক জে টিপলার-এর কথা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টিউলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। বিষয়: আপেক্ষিকতা। ডক্টরেট হওয়ার পরও জ্যোতিঃপদার্থ নিয়ে গবেষণা করেছেন বার্কলে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিখেছেন একটি বই, ‘দি ফিজিক্স অব ইম্‌মর্টালিটি’। তাতে টিপলার লিখছেন-কুড়ি বছর আগে যখন আমার কেরিয়ার জ্যোতিঃপদার্থবিদ হিসেবে শুরু করেছিলাম, তখন ছিলাম কট্টর নাস্তিক। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, একদিন আমিই লিখব এমন কোনও বই, যার উপজীব্য হবে ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের মূল দাবিগুলোর সত্যতা প্রমাণ।

    টিপলার ওই ঘোষণা করেছেন, “কচিৎ-কখনও আমরা পদার্থবিদরা দেখি, আমাদের বহু আগে বাতিল তত্ত্বকেই পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীদের এখন বাতিল ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে। আমার আশা, এই গ্রন্থে বিজ্ঞানীদের সে কাজে অনুপ্রাণিত করতে পারব। এখন সময় এসেছে ধর্মতত্ত্বকে পদার্থবিদ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার। স্বর্গকে একটা ইলেকট্রনের মতই বাস্তবে পরিণত করার।”

    টিপলার তাঁর ‘ওমেগা পয়েণ্ট’ তত্ত্বে বলেছেন, স্বর্গ আছে, আছেন ঈশ্বর, আছে পুনর্জন্মের ব্যবস্থা।

    এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর কথা মনে পড়ে গেল। পুনর্জন্মে বেজায় বিশ্বাসী। তার প্রবলতর বিশ্বাস থেকে ধ্বনিত হয়েছে, “ঈশ্বর আছেন, প্রতিটি মানুষকে এই সত্যে একদিন-না-একদিন আসতেই হবে। এ জন্মে না হলে পরের জন্মে, না হলে তার পরের জন্মে। একজন্মে-না-একজন্মে তার ঈশ্বরে বিশ্বাস আসবেই।”

    বহুজন্ম ধরে ঈশ্বরে বিশ্বাসের উপর পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ না চালিয়েই কী প্রত্যয়ী সিদ্ধান্ত বলুন তো! বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এমন ডাকাবুকো অন্ধ বিশ্বাসী বিরল।

    এই বিরল প্রজাতির বিজ্ঞানীর নাম-বিধানরঞ্জন রায়। ডঃ রায় একজন খাদ্য বিজ্ঞানী; কলকাতার সেণ্ট্রাল ফুড ল্যাবরেটরির প্রাক্তন ডিরেকটর। ইণ্ডিয়ান অ্যাকাদেমি অব ফরেনসিক সায়েন্স-এর সভাপতি।

    ডঃ টিপলার সাহেবের পুনর্জন্ম ব্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা। তাঁর থিওরি মত এমন কম্‌প্যুটর ভবিষ্যতে তৈরি হবে, যে কম্‌প্যুটরকে একটি প্রাণীর তাবৎ উপাদানের ডিটেল ইনফরমেশন জানালে কম্‌প্যুটর প্রাণীটিকে ফের বানিয়ে দেবে। একটি প্রাণীর উপাদানের খুঁটিনাটি তথ্যসমূহ কে জানাবে? জানাবে ভবিষ্যতের একটি অত্যাধুনিক কম্‌প্যুটর? এভাবেই ‘ওমেগা পয়েণ্ট’-এ মৃত্যুর পর একদিন আবার আপনি আমি জন্ম নেব আধুনিক কম্‌প্যুটরের দয়ায়।

    ডঃ টিপলারের এজাতীয় তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের মাথায় গ্রহণযোগ্য করে ঢুকিয়ে দিতে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়েছে। দেশ পত্রিকা ‘৯৫-এর কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় ‘ভাললাগা বই’ হিসেবে টিপলারের বইটি দশ দশটি পাতা জুড়ে প্রবল বিক্রমে বিরাজ করছে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য, “ধর্ম ও বিজ্ঞানের যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল গ্যালিলিওর সময়ে তা বোধহয় শেষ হচ্ছে এত দিনে। শেষ হচ্ছে জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী ফ্র্যাংক জে টিপলার-এর প্রচেষ্টায়।”

    একটি ঘটনার দিকে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ম্যুনিখ-এর ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিট্যুটের তরফ থেকে একটি সেমিনারে জ্যোতিঃপদার্থের উপর বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ডঃ টিপলারকে। আমন্ত্রণ জানানো ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হওয়ার মাঝখানেই প্রকাশিত হয় “দি ফিজিক্স অব ইমমর্টালিটি’ বইটি। বইয়ে বিজ্ঞান বিরোধী বক্তব্য রাখার জন্য বাতিল করা হয় টিপলারকে জানানো বক্তৃতার আমন্ত্রণ। ফ্যাক্স পাঠিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়, কল্পনায় তিনি এতটাই দূরে চলে গিয়ে এমন সব উদ্ভট বক্তব্য রেখেছেন, যাতে বস্তুত বিজ্ঞানের সুনামই নষ্ট হতে পারে।  ঈশ্বর-পরলোক-নিয়তি চর্চায় মগ্ন আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে দেশীয় বিজ্ঞান সংস্থাগুলো কবে এমন দৃঢ় ঋজু পদক্ষেপ নেবে? কবে এইসব বিজ্ঞান-পেশার বিজ্ঞান-বিরোধী মানুষগুলো বয়কটের সম্মুখীন হবেন? গা শোঁকাশুঁকি বন্ধ করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসার মত সৎ বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ কি আমরা অদূর ভবিষ্যতে পাব না?

    আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, ওয়েনবার্গ তাঁর “দি ফাস্ট থ্রি মিনিটস্’-এ লিখেছেন, “মানুষ এ বিশ্বাসকে কিছুতেই ঠেলে দিতে পারে না, এই বিশ্বের সঙ্গে তার একটা বিশেষ যোগাযোগ আছে। মানতে চায় না, তার অস্তিত্ব মোটামুটি কতগুলো আকস্মিক ঘটনার পরিণতি। এই আকস্মিক ঘটনাগুলোর সূত্রপাত হয়েছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্মের তিন মিনিটের মধ্যে। ….. এই পৃথিবী বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের নগণ্য একটা ক্ষুদ্রাংশ, এটা মানা মানুষের পক্ষে সত্যিই কষ্টকর। এই বিশ্ব একদিন বিলীন হবে অসহনীয় তাপে কিংবা সীমাহীন শীতলতায়—এটা মেনে নেওয়া মানুষের পক্ষে আরও কষ্টকর। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যতই বোধগম্য হয়, ততই উদ্দেশ্যহীন মনে হয় তাকে।”

    ওয়েনবার্গ যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাবকে উদ্দেশ্যহীন বলছেন তখন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক জন ব্যারো টিপলারের মতই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাবের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। মানুষের আবির্ভাবের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। মানুষের আবির্ভাবের জন্যই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। এই প্রস্তুতি-পর্ব ছিল সৃষ্টিকর্তার মর্জিমাফিক। তাঁর মতে—ধর্মতত্ত্ব ও ঈশ্বরতত্ত্বকে বাদ দিয়ে বিশ্বতত্ত্বকে কখনই জানা সম্ভব নয়!

    স্টিফেন হকিং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হলেও মাঝে-মধ্যে বিজ্ঞানকে সরিয়ে রেখে ঈশ্বরকে কাছে টেনে নেন। দ্বিতীয় বিয়েটাও সেরেছেন চার্চে গিয়ে ঈশ্বর ও ঈশ্বর পুত্রকে সাক্ষী রেখে। তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থণা করে। বাঁচোয়া, হকিংকে বিজ্ঞানীরা ও শিক্ষিত সমাজ শ্রদ্ধা করেন তাঁর বিজ্ঞান চর্চার জন্য, ঈশ্বর ও ধর্ম চর্চার জনা নয়!

    হকিং তাঁর ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ভগবান আমাদের মত প্রাণী সৃষ্টি করবেন বলেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি এভাবে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।”

    না, হকিং বা ঈশ্বর বিশ্বাসী কোনও বিজ্ঞানীর অন্ধ বিশ্বাসই প্রমাণ করে না—ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব আছে। শুধু এটুকুই প্রমাণ করে, তাঁরা বিজ্ঞানী হলেও মাঝে-মধ্যে অন্ধবিশ্বাসে নতজানু।

    আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় মাপের বিজ্ঞানী পল ডেভিস মাঝে-মধ্যে যুক্তি ও বিজ্ঞানকে সাময়িক ছুটি দিয়ে ভাবনার পাল তুলে ভেসে যান অধ্যাত্মিক জগতের কাছাকাছি। তিনি ‘গড অ্যাণ্ড দি নিউ ফিজিক্স’ গ্রন্থে লিখছেন, “বিশ্ব একটি মনঃ যে নিজেকে দেখছে ও একই সঙ্গে নিজেকে তৈরি করছে। আমাদের ব্যক্তিগত ‘মন’ বা ‘চেতনা’কে বিশ্ববাপী মনের সমুদ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপ বলে ভাবা যেতে পারে। (প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা এখানে ‘ভাবা যেতে পারে’ কথাটির প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ‘ভাবা যেতে পারে’ কথাটি আরও একটি ইঙ্গিত বহন করে—’না-ও ভাবা যেতে পারে’।) এই ভাবনা স্মরণ করিয়ে দেয় অতীন্দ্রিয়বাদের সেই ধারণাকে—ঈশ্বর বিভিন্ন খণ্ডিত ব্যক্তি-মনের সমষ্টিস্বরূপ। অধ্যাত্মিক প্রগতির উপযুক্ত স্তরে উন্নীত হলে মানুষের মন তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে সেই অখণ্ড-মনে লীন হয়ে যায়।”

    অধ্যাত্মবাদীদের ‘আত্মা-পরমাত্মা’ চিন্তার সঙ্গে পল ডেভিসের চিন্তার সাদৃশ্য থাকায় অধ্যাত্মবাদীরা আনন্দে উদ্বেল, যেন এই সাদৃশ্য অধ্যাত্মবাদকে বিজ্ঞান-এর শিলমোহর দেবে। পরিবর্তে পল ডেভিসের এ-জাতীয় কল্পনা নির্ভর চিন্তা তাঁকে ‘ধার্মিক-বিজ্ঞানী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে মাত্র।

    আর এক ঈশ্বর ভক্ত বিজ্ঞানী ক্যাফাটস পদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী হলেও ঈশ্বর চিন্তায় পল ডেভিসের কাছাকাছি তাঁর অবস্থান। ক্যাফাটস তাঁর ‘দি কনসাস ইউনিভার্স’ গ্রন্থে লিখছেন, “যদিও আমরা আমাদের বোধের গভীরে ‘সমগ্র’-এর অন্তর্নিহিত ঐক্যকে বুঝতে পারি, বা অনুভব করতে পারি [অর্থাৎ, লেখক ও তাঁর সমমানসিকতার মানুষরা অনুভব করতে পারেন, তাঁদের আত্মা পরমাত্মারই অংশ। এই ‘আত্মা-পরমাত্মা’ ব্যাপারটা তাঁদের কাছে শুধুমাত্র মানসিকভাবে অনুভবের বিষয়। এমনই অনুভবের মধ্য দিয়েই মানসিক কারণে কত যে শারীরিক অসুখ হয়, অলীক-দর্শন, অলীক-শ্রবণ ইত্যাদি সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, শুধু এই নিয়েই একটা বড় বই লিখে ফেলা যায়। এবং লেখার ইচ্ছেও অবশ্য রয়েছে।] কিন্তু বিজ্ঞানে শুধুমাত্র বিভিন্ন ‘অংশ’-এর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েই আলোচনা করা সম্ভব। অবিভাজ্য-পূর্ণ যা থেকে অংশের জন্ম, সেই পূর্ণ সম্পর্কে বিজ্ঞান কিছুই বলতে পারে না [পূর্ণ = পরমাত্মা সম্পর্কে অনুভব ছাড়া কোনও প্রমাণই যখন নেই, তখন বিজ্ঞান ‘পূর্ণ’ সম্পর্কে কিছু বলবে—প্রত্যাশা রাখাটাই পাগলামী।]

    ক্যাফাটস-এর এই উক্তিকে টপ্ করে লুফে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন তাঁদের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এর ৯৬তম বর্ষের ৩য় সংখ্যায় ক্যাফাটস-এর উল্লিখিত অংশটি তুলে দিয়ে ব্যাখ্যা হিসেবে লিখছে, “যাঁরা বেদান্ত পড়েছেন বা ‘কথামৃত’ পড়েছেন তাঁরাই লক্ষ্য করবেন যে, বেদান্তের ব্রহ্ম বর্ণনা (“সর্বং খন্বিদং ব্রহ্ম”) বা শ্রীরামকৃষ্ণ সাধারণ লোককে বোঝাবার জন্য যেভাবে ব্রহ্মের কথা বলেছেন (“ব্রহ্ম বাক্য মনের অতীত, ব্রহ্ম যে কি, তা মুখে বলা যায় না।”), তার সঙ্গে আধুনিক পদার্থবিদদের ‘পূর্ণ’-এর বর্ণনার বিশেষ সাদৃশ্য আছে।”

    আর এক পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রিটজফ কাপরা ‘দি টাও অফ ফিজিক্স’ গ্রন্থে পরমাণুর নড়া-চড়া বা কম্পনের মধ্যে নটরাজের নৃত্যকে অনুভব করার কথা জানালেন (এ সেই মেঘের মধ্যে বাঘ, নৌকো, মানুষের মুখ ইত্যাদিকে অনুভব করার মত ব্যাপার।)।

    বিজ্ঞান পেশার সঙ্গে যুক্ত যে সব বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের থেকে অনেক বেশি দূরে সরে গিয়ে ঈশ্বর অস্তিত্বের পক্ষে উল্টো-পাল্টা বক্তব্য রাখেন, তাঁদের সম্পর্কে আমরা ম্যুনিখ-এর মাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের সেই কথার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারি-কল্পনায় আপনারা বিজ্ঞানের থেকে এতটাই দূরে সরে গিয়ে এমন সব উদ্ভট বক্তব্য রেখেছেন, যাতে শুধুমাত্র আপনাদের সুনাম নয়, বিজ্ঞানের সুনামও নষ্ট হচ্ছে।

    ধর্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা বেজায় রকম সংখ্যালঘু, তবু প্রচারে বিশাল

    এখানে অবশ্য মূল প্রসঙ্গ বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের সুনামের নয়। মূল প্রসঙ্গ বা সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা একটু ভাবুন তো, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সাধারণ শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির জন্য যখন শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি মানুষ যখন প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করে না (এনসাইক্লোপিডিয়ার ৯০ দশকের যে কোনও সংস্করণে চোখ বোলালেই এই বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পারবেন), ধর্মে ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা যখন প্রচণ্ড রকম সংখ্যালঘু, তখন আঙুলে গোনা কিছু পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর-বিশ্বাসের পক্ষে করা মন্তব্য বা বক্তব্যকে বিশাল করে প্রচার করা হচ্ছে কেন? পাশ্চাত্যে ঈশ্বর বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা কেমন, এবিষয়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে হাতের কাছে না থাকলেও আছে আধুনিক পদার্থবিদ্যার আইনস্টাইনোত্তর যুগের অন্যতম সবচেয়ে খ্যাতিমান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের একটি মন্তব্যঃ

    “খুব কম বিজ্ঞানীই ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতি মনোযোগ দেন। আমি দু’জন জেনারেল রিলেটিভিস্টকে জানি, যাঁরা ধর্মপ্রাণ রোমান ক্যাথলিক; জনাকয়েক তত্ত্বীয় পদার্থবিদ যাঁরা ইহুদি ধর্মে বিশ্বাস-টিশ্বাস করেন; একজন পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ যিনি খ্রিস্টধর্মে নতুনভাবে দীক্ষিত হয়েছেন; একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ যিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান; এবং একজন গাণিতিক পদার্থবিদ যিনি ইংলণ্ডের চার্চ থেকে পবিত্র আদেশ নিয়েছেন। সন্দেহ নেই, এমন ধার্মিক বিজ্ঞানী নিশ্চয়ই আছেন, যাঁদের আমি চিনি না বা যাঁরা নিজের মত নিজের কাছেই রাখেন। তবু নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে আমি যতদূর বলতে পারি, আজকালকার বেশিরভাগ পদার্থবিদই একজন বলিয়ে-কইয়ে নাস্তিক হিসেবে নাম কেনার খাতিরেও ধর্ম নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান না।” [ড্রিমস অফ এ ফাইনাল থিয়োরি, ভিণ্টেজ, ১৯৯৩; পৃষ্ঠা ২০৫]

    বলাই বাহুল্য, স্টিফেন ভাইনবার্গের পরিচিত বিজ্ঞানীদের বৃত্তটা স্বাভাবিকভাবেই সাংঘাতিক রকমের বড় এবং পৃথিবী জুড়ে। প্রসঙ্গত এটুকুও জানিয়ে রাখা ভাল, তাঁর পরিচিত বিজ্ঞানীদের ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন। জানার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি কাজে লাগাতেন সাধারণভাবে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে লাঞ্চ টেবিলের আড্ডা বা চায়ের আড্ডা। স্টিফেন ভাইনবার্গের নিজের কথায়, “এইসব নিয়ে (অর্থাৎ ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে) মাথা ঘামানোর ব্যাপারে আমি বোধহয় আজকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটু ব্যতিক্রমী” (ঐ বইয়ের ঐ পৃষ্ঠাতেই)।

    প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একবার ভাবুন তো, অতি সাম্প্রতিককালে কী এমন ঘটল যে প্রচার-মাধ্যম ও তাঁদের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের বক্তব্যগুলোকে বার বার বিশাল করে প্রচারের আলোকে আনতে লাগল? এমন কী ঘটল যে এদেশের ঈশ্বরে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করে ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষে তাঁদের যুক্তিকে লাগাতারভাবে হাজির করতে শুরু করেছে প্রচার মাধ্যমগুলো? এ’দেশের নাক উঁচু পাক্ষিক পত্রিকা, সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক এ জাতীয় প্রচারকে এমনই তুঙ্গে নিয়ে গেছে যে তার প্রভাবে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধরা লেখকরা সাধারণভাবে গ্রহরত্নধারী, ঈশ্বরের নামে কপালে হাত ঠেকানো ডাক্তার বা বিজ্ঞানীদের প্রবল উপস্থিতির কথা তাঁদের লেখায় প্রায়ই নিয়ে আসছেন। বাস্তব চিত্রটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম। এ দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। আমার কাছে নির্ভরযোগ্য কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে আছে অভিজ্ঞতা। আন্দোলনের সূত্রে বিজ্ঞানীমহলে পরিচিতির যে বৃত্ত, সেখানে দেখেছি, ঈশ্বর বিশ্বাসী বিজ্ঞান পেশার মানুষরা স্পষ্টতই সংখ্যালঘু। কী এমন হল যে, ঈশ্বর বিশ্বাসের পিঠে বিজ্ঞানের পাখা জুড়ে দিতে অতিসাম্প্রতিককালে প্রবলভাবে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার মধ্যম ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা? রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ সরাসরি ধর্মের জিগির তুলছে, কেউবা ধর্মস্থান ও ধর্মগুরুদের আপ্লুত শ্রদ্ধা নিবেদন করে জনমানসে ধর্মের সুড়সুড়ি দিচ্ছে, আবার কেউবা একই সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাস, ঈশ্বর বিশ্বাস, নিয়তি বিশ্বাসকে শোষণের অহিংস কিন্তু প্রবল কার্যকর হাতিয়ার মনে করার পাশাপাশি মানুষের এইসব অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ‘রা’ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ‘বিচ্ছিন্নতা’ নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে। নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এই ধরনের আচরণের মধ্য দিয়ে এ কথাই প্রমাণ করে— তারা শেষ পর্যন্ত ধনকুবের শোষকদেরই সহযোগী।

    গত কয়েক বছর ধরে ভারতের তথা পৃথিবীর সমাজ সাংস্কৃতিক পরিবেশে একটি বিশাল ঘটনা নিঃশব্দে ঘটে চলেছে—আধুনিক যুক্তিবাদের অগ্রগমন। কোনও সন্দেহ নেই, আধুনিক যুক্তিবাদের আগ্রাসন ঠেকাতে যে বহুতর পরিকল্পনা দ্রুত গড়ে উঠছে, এ’জাতীয় কর্মকাণ্ড সেই বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশ।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ
    Next Article অলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ

    Related Articles

    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.