Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না – প্রবীর ঘোষ

    প্রবীর ঘোষ এক পাতা গল্প296 Mins Read0

    ৬. আপ্লুত বিজ্ঞানী ও ভুরু কোঁচকানো বিজ্ঞানী

    অধ্যায়: ছয়

    ঈশ্বর বিশ্বাস: আপ্লুত বিজ্ঞানী ও ভুরু কোঁচকানো বিজ্ঞানী

    O

    কিছু বাঙালি বিজ্ঞানী ঈশ্বর মানেন। ঈশ্বর মানার পক্ষে তাঁদের যুক্তিগুলো এই অধ্যায়ে হাজির করব। বিজ্ঞানীদের এইসব যুক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটাবার দায়িত্ব নিয়েছিল বাংলা দৈনিক পত্রিকা ‘যুগান্তর’। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এই যে, প্রথম কিস্তির লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালের ‘আন্তর্জাতিক যুক্তিবাদী দিবস’-এ অর্থাৎ ১ মার্চ।

    আমরা অবশ্য এখানে ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের যুক্তিগুলোকে হাজির করেই ক্ষান্ত হব না, বিশ্লেষণ করে দেখব—যুক্তিগুলো বাস্তবিকই কতটা যুক্তি।

    O

    এক: মণীন্দ্রমোহন চক্রবর্তী, প্রাক্তন উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কল্যাণী বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ইংলণ্ডের রয়্যাল ইন্সটিটিউট অফ কেমিস্ট্রির ফেলো। ভারতে নামী-দামি রসায়নবিজ্ঞানী যাঁরা আছেন, তাঁদেরই একজন।

    মার্কস-এঙ্গেলস নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছেন এককালে। বর্তমানে মার্কসবাদের চেয়েও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজিমের প্রবক্তা) মানবতা বিকাশের পথনির্দেশকে বেশি গ্রহণযোগ মনে করেন, এবং সে কথা সোচ্চারে প্রচারও করেন। ১৯৮৯ -এ পোঁছে মণীন্দ্রমোহন জানালেন, “বস্তুবাদে বা জড়বাদে মানুষের মুক্তি নেই! নাস্তিকতা মানুষকে শান্তি দিতে পারে না।”

    তাহলে শোষণ থেকে মুক্তি পেতে, অসাম্যের সমাজ কাঠামোর অনিবার্য ফল যে ‘অশান্তি’, তাকে বিদায় দিয়ে ‘শান্তি’কে ফিরিয়ে আনতে কী করতে হবে? সে পথনির্দেশও দিয়েছেন মনীন্দ্রমোহন, “আধ্যাত্মিক পথেই মানুষের মুক্তি, ঈশ্বর বিশ্বাসই মানুষের মনের শান্তি।”

    মণীন্দ্রমোহন চক্রবর্তী অধ্যাপক মানুষ। তাঁর পক্ষে শোভা পায় না, রাজনৈতিক নেতাদের মত, কিচ্ছুটি না জেনেও সে বিষয়ে জনগণকে প্রচুর জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা। অতএব, আশা করছি তিনি ভালমত জেনে বুঝেই বলছেন-অধ্যাত্মবাদ নিয়ে চর্চা করলে মানুষের মুক্তি আসবে। তিনি নিশ্চয়ই ‘অধ্যাত্মবাদ’ কথাটির অর্থ বিষয়েও ওয়াকিবহাল। অর্থাৎ তিনি জানেন, ‘অধ্যাত্মবাদ’ মানে ‘আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ’, যার হাত ধরাধরি করে উঠে আসে পরমাত্মা-ঈশ্বর-আল্লা ইত্যাদিরা। উঠে আসে পরলোক, ভূত, জীন, পরলোকের বিচার ইত্যাদি আরও কত কী! অবিনশ্বর আত্মার সুতো ধরে টান মারলেই এ’সবই এক এক করে সারি-সারি উঠে আসে। আত্মার অমরত্বকে প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছে ‘অধ্যাত্মবাদ’। আত্মার অমরত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্নেরই অবকাশ নেই অধ্যাত্মবাদে। কারণ, আত্মা অমরত্ব হারালে অধ্যাত্মবাদের গোটা তত্ত্বটাই মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।

    ‘আত্মা’ কাকে বলে? অর্থাৎ, ‘আত্মা’র সংজ্ঞা কী? আত্মার সংজ্ঞা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বহু মতের নির্যাস থেকে বেরিয়ে আসে প্রধান দু’টি মত।

    একঃ ‘চিন্তা’, ‘চেতনা’, ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’ই আত্মা। দুইঃ ‘চিন্তা’, ‘চেতনা’, ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’ আত্মারই কাজ-কর্মের ফল।

    বিজ্ঞান পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে—মন, চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য বলে আমরা যাকে চিহ্নিত করি, তা হল মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরই ক্রিয়া-বিক্রিয়া বা কাজ-কর্মের ফল।

    মানুষের মৃত্যুর পর এক সময় মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বাস্তব অস্তিত্বই বিলীন হতে বাধ্য। কারণ, মৃত্যুর পর সাধারণভাবে দেহও বিলীন হয় পুড়ে ছাই হয়ে কবরের মাটিতে মিশে গিয়ে, অথবা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পচে-গলে-জন্তুর পেটে গিয়ে। দেহ বিলীনের সঙ্গে সঙ্গে দেহাংশ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষও বিলীন হয়। এরপর মস্তিস্ক স্নায়ুকোষ নেই, কিন্তু তার কাজ-কর্ম আছে এবং কাজ-কর্মের ফল হিসেবে মনও আছে—এমনটা শুধু কল্পনাতেই সম্ভব।

    অধ্যাত্মবাদীদের আত্মার সংজ্ঞা নিয়ে যে দ্বিতীয় মতটি রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, চিন্তা, চেতনা, চৈতনা বা মন হল আত্মারই কাজ-কর্মের ফল। এই সংজ্ঞাটিকে মেনে নিলে বলতে হয়—আত্মা হল মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ।

    মানুষ মরণশীল। গোটা মানুষটাই যখন মরণশীল, তখন তার দেহাংশও যুক্তিগতভাবে মরণশীল হতে বাধ্য। অতএব, আমরা এরপর এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারি—মানুষের দেহাংশ মস্তিষ্কস্নায়ুকোষও মরণশীল। মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ মরণশীল হলে ‘আত্মা’ও মরণশীল হতে বাধ্য।  ‘আত্মা’ না বাঁচলে ‘অধ্যাত্মবাদ’ও যে বাঁচে না। যে অধ্যাত্মবাদ দাঁড়িয়ে আছে ‘আত্মা অমর’ এই অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিতের উপর। সেই মিথ্যের এক ‘বাদ’ বা ‘ism’-এর পথ ধরে কখনই মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। আসতে পারে শুধু সর্বনাশ (আত্মা ও অধ্যাত্মবাদ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা পড়তে পারেন, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’-এর ৪র্থ-খণ্ড)।

    মণীন্দ্রবাবু, বাস্তবিকই আপনি কি মনে করেন, যে মায়ের চোখের সামনে ছেলের দু’চোখ উপড়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক দলের পোষা খুনেরা, সেই মায়ের মনের শান্তি ফেরাতে হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির চেয়ে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ অনেক বেশি ফলপ্রসূ দাওয়াই?

    মণীন্দ্রবাবু, আপনি কি সত্যিই মনে করেন, যে সন্তানের চোখের সামনে মাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে প্রকাশ্য রাজপথে পেটাই করেছে মহল্লার রাজনৈতিক মস্তানরা, সেই সন্তানের দাউ দাউ অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারে ঈশ্বরের কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ? মস্তানদের কঠোর শাস্তি ও রাজনৈতিক সততার জন্য দাবি তোলা, দাবি আদায়ে শেষতক যাওয়ার চেষ্টায় কি শান্তি নেই? অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থার মধ্যে কি অশান্ত মনে শান্তি আসে না?

    যে ডাক্তারের অবহেলায় শিশু পাপড়ির মৃত্যু হয়েছিল, সেই ডাক্তারদের অকর্মণ্যতা, অবহেলা ও হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে পাপড়ির বাবা-মা দরবার করেছেন মেডিকেল কাউন্সিলের কাছে। আইনের লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ডাক্তারটির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পেরেছেন। পেরেছেন তাঁকে জেলে ঢোকাতে। পাপড়ির বাবা-মা ডাক্তারটির অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে জয়ী হয়ে যতটুকু শান্তি পেয়েছিলেন, লড়াই না চালিয়ে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করে ততটুকু কি পেতেন? তাঁদের এই লড়াই এক দিকে যেমন ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারী অবহেলাকে কিছুটা হলেও সংযত করেছে, তেমনই অবহেলিত রোগীদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতনাবোধ জাগিয়ে তুলেছে। ফলে ভবিষ্যতে চিকিৎসকের অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু ও তার দরুন অশান্তির কিছু কারণ নিশ্চয়ই দূর করা গেছে। চিকিৎসকদের দুর্নীতিকে তাড়াতে এবং সেই দুর্নীতির কারণে চেপে বসা অশান্তিকে বাড়াতে সামাজিকভাবেই লড়াই চালাতে হবে, ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে অশান্তির সঙ্গে সহাবস্থানকেও মেনে নিতে হবে।

    মণীন্দ্রবাবু, সত্যিই কি আপনি মনে করেন, যে বাবা-মার চোখের সামনে কিশোরী কন্যা দলবদ্ধ পুরুষদের কামনার শিকার হয়, সে বাবা-মা ধর্ষণকারী দলবদ্ধ পশুদের বুক ফুলিয়ে শিস দিয়ে মহল্লায় টহল দিতে দেখার পরও প্রতিরোধের পথে না গিয়ে, ঠাকুর ঘরে দরজা বন্ধ করে চোখের জলে ভাসে, সে-ই পায় পরম শান্তি, যার কোনও বিকল্প নেই?

    মণীন্দ্রবাবু, বন্ধ কারখানার শ্রমিক দেখেছেন? মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চিমনি থেকে ধোঁয়া না ওঠা কারখানার শ্রমিক দেখেছেন? ওদের ঘরে কোনও দিন পা রেখেছেন? দেখেছেন অসংখ্য জঞ্জালের মাঝে জীবন্ত কঙ্কালের মিছিল, খুকখুক কাশি? এরাই তো সপরিবারে শেষ ডিনার খেতে বসে ফলিড়ল কি বেগন স্প্রে সাজিয়ে। এরাই পরম অবহেলায় নদীর স্রোতে একে একে ছুঁড়ে দেয় রক্তের সম্পর্কগুলো। রেল লাইনে সারি-সারি গলা পেতে অপেক্ষা করে মৃত্যুর। ঈশ্বর কখনই এদের থিদেয় ভাত-রুটির বিকল্প হয়ে ওঠে না; তাই চিরশান্তি পেতে বার বার এরা ঈশ্বরের চেয়ে মৃত্যুকেই কাম্য জ্ঞান করেছে।

    মণীন্দ্রবাবু, আপনি কি বাস্তবিকই মনে করেন, এই দুনীতিতে ভরা অসামোর সমাজ কাঠামোকে বজায় রেখেও মানুষের মনে শান্তি আনা সম্ভব? স্রেফ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে দুঃখ ভোলার মধ্য দিয়েই সম্ভব?

    O

    এই দুনীতিতে ভরা অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে বজায় রেখেও মানুষের মনে শান্তি আনা সম্ভব? স্রেফ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে দুঃখ ভোলার মধ্য দিয়েই সম্ভব?

    O

    তাত্ত্বিকভাবেই তা সম্ভব নয়। কারণ, অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনা থাকলে বঞ্চিত মানুষদের দুঃখ থাকবেই। মণীন্দ্রবাবু, এই সহজ-সরল সত্যকে আপনি কেন ভুলে থাকতে চাইছেন? আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনার এই ভুলের পরিণতি কী মারাত্মক হতে পারে? এর ফলে দারিদ্র্যের নগ্ন লাঞ্ছনায় নুয়ে পড়া বহু মানুষ তাদের উপর নেমে আসা প্রতিটি বঞ্চনাকে ‘ভাগের লিখন’ ধরে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকবে।

    মণীন্দ্রমোহন চক্রবর্তীর ঈশ্বরের সংজ্ঞা কী? তাঁরই কথায়, “ঈশ্বর আছেন সেই উপলব্ধি আমার হয়েছে। আপনি জিজ্ঞেস করবেন, কী করে? তার উত্তরে আমি বলব, এই যে জগৎ চলছে, এ তো শুধু শুধু নয়-কতকগুলো নিয়ম মেনে চলছে। কিন্তু কে সেই নিয়মগুলো তৈরি করেছেন? এই মহাবিশ্বে, প্রত্যেকেই আপন পথে আপন আপন নিয়ম মেনে ঘুরে চলেছে। নিয়ম না মানলে কী দারুণ সঙ্কট সৃষ্টি হত ভাবতেও পারি না।…তাহলে একটা শক্তি নিশ্চয় আছে যে শক্তি এই জিনিস ঘটাচ্ছে। বিশ্বজগতের সমস্ত নিয়ম তার সৃষ্টি, সে-ই সবকিছু চালাচ্ছে। মানুষের সাধ্য নেই তাকে অতিক্রম করে।”

    অর্থাৎ, মণীন্দ্রবাবুর বিশ্বাস মত, ঈশ্বর একটা শক্তি; যে প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ন্তা শক্তি। ঘুরিয়ে আমরা বলতে পারি, প্রকৃতিই তাঁর ঈশ্বর।

    অধ্যাপক চক্রবর্তীর জীবনে কখনও কি এমন কিছু ঘটেছে, যাতে তাঁর মনে হয়েছে—ঈশ্বর আছেন, এবং এ তারই প্রমাণ?

    এমন প্রশ্নের উত্তরে শ্রীচক্রবর্তীর বক্তব্য, “হ্যাঁ….আমার মনে খুব ইচ্ছা ছিল, ইংল্যাণ্ডের লিভারপুলে গিয়ে প্রফেসর টি. পি, হিলডিচের কাছে পি-এইচ. ডি. করব। প্রফেসর হিলডিচ ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রিতে এক দিকপাল। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রিতে, বিশেষ করে গ্লিসারাইড কেমিস্ট্রি অর্থাৎ তৈল রসায়নে এত বড়ো অথরিটি এখনও পর্যন্ত আর একজনও হননি। আমি চিঠি লিখলাম প্রফেসার হিলডিচকে। পত্রপাঠ তিনি আমাকে জানালেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত, আমার কাছে এখন অনেক ছাত্র, বেশ কয়েক বছর আমার কাছে জায়গা হবে না।’ তখন মাস্টারমশাই প্রফেসর বীরেশ গুহ চিঠি লিখলেন প্রফেসর হিলডিচকে। পরের ডাকেই আমার কাছে চিঠি এল, ‘চলে এস যত তাড়াতাড়ি পার।’ বলুন, এটা ঈশ্বরের দান ছাড়া আর কী!”

    ভাল! অধ্যাপক চক্রবর্তীর কথায় আমরা জানতে পারলাম, প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ন্তা শক্তি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজের বাইরে কাউকে কাউকে দিয়ে চিঠি-টিঠিও লিখিয়ে থাকে, কারও বা পি-এইচ. ডি. করার ব্যবস্থা করে দেয়।

    অধ্যাপক চক্রবর্তী হিলডিচের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করে তাঁর মাস্টারমশাই বীরেশ গুহর কাছে অনুরোধ করেছিলেন কেন, হিলডিচকে চিঠি লেখার জন্য? এ তো রোগীকে একই সঙ্গে ঠাকুরের চরণামৃত ও ওষুধ খাওয়াবার মতই এক ঘটনা, অসুখ সারলে চরণামৃতের গুণ!

    ঈশ্বর আছেন, প্রমাণ করতে অধ্যাপক চক্রবর্তীর হাজির করা পি-এইচ. ডি.-কাহিনী বলেছিলাম আমার বান্ধবী মিস্টুনকে। শুনে মিস্টুন বলেছিলেন, “উনি তো ঈশ্বর আছেন-এর পক্ষে একটা প্রমাণ হাজির করেছেন, নেই-এর পক্ষে অমন লক্ষ-কোটি প্রমাণ আমি হাজির করতে পারি। একবার ভাবতো, ভারতের কয়েক লক্ষ বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের প্রার্থনা পূরণ করতে কারখানার তালা কেন খুলছেন না ঈশ্বর? কেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়ে প্রার্থনা পূরণ করতে পারছে না ঈশ্বর? কেন সমস্ত প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে রোগীরা মরছে? ঈশ্বর কি কোনও এইডস রোগীর প্রার্থনা পূরণ করে তাকে রোগ মুক্ত করতে পারবেন? পারবেন না। যতদিন পর্যন্ত না এইডসের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন পারবেন না।”

    O

    ঈশ্বর কি কোনও এইডস রোগীর প্রার্থনা পূরণ করে তাকে রোগ মুক্ত করতে পারবেন? পারবেন না; যতদিন পর্যন্ত না এইডসের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন পারবেন না।”

    O

    মিস্টুনের সওয়ালটা অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন চক্রবর্তীর জবাব প্রত্যাশায় এখানে তুলে দিলাম।  অধ্যাপক চক্রবর্তীকে একটা ঘটনা শোনাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ভারতের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ডঃ শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের জবানীতেই বলি:

    “যদি প্রশ্ন করো, ভগবান মানেন কি না, এককথায় তার উত্তর-না। যদি জিজ্ঞেস করো, কেন না—তাহলে একটা ঘটনার কথা বলি শোনো। আমার বয়স তখন বার-তের। মোহনবাগানের সঙ্গে একটা ইংরেজ টিমের খেলা। মনপ্রাণ দিয়ে ভগবানকে ডেকে বলেছিলাম, মোহানবাগান যেন অন্তত একটা গোল করতে পারে। কিন্তু সেদিন আমাকে চোখের জলে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল মোহনবাগান একটা গোলও করতে পারেনি, বরং তিনটে গোল খেয়েছিল। সেইদিনই বুঝেছিলাম, ভগবান-টগবান সব বাজে, গোল দিতে হলে নিজেদেরই দিতে হবে। বলতে পার, সেটা আমার জীবনের একটা turning point.”

    দুই: জগৎজীবন ঘোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবরসায়ন বিভাগের শতবার্ষিকী অধ্যাপক। জীবরসায়নের ক্ষেত্রে যে সব বিজ্ঞানী ভারতে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে নামী বললে বোধহয় ভুল হবে না।

    জগৎবাবু ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তাঁর কাছে ঈশ্বরের সংজ্ঞা কী? ঈশ্বর কি প্রকৃতি চালনাকারী একটা শক্তি? নিরাকার শক্তি? না কি, তাঁর আকার আছে?

    এবিষয়ে জগৎবাবুর উত্তর ভারি কৌতূহল-উদ্দীপক।

    “সাকার ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না, ঈশ্বরকে আমি একটা ইন্দ্রিয়াতীত সত্তা হিসেবে মনি” [বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর, প্রথম প্রকাশ ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৩৭

    ওই বইয়েরই ৪০ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে:

    “জগৎবাবু কালীভক্ত। তাঁর মনে হয়, কালীর কালো রঙে মহাকাল এসে সংহত হয়েছে। কালীমূর্তি সামনে রেখে মনটাকে নিবদ্ধ করে তিনি শান্তি পান। প্রতি শনিবার বউবাজার ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি গিয়ে ধ্যানে বসেন।”

    জগৎবাবু যখন কালী ওরফে আদ্যাশক্তির ধ্যান করেন, তখন তাঁর অনুভূতি প্রসঙ্গে জানাচ্ছেনঃ

    “আমি তখন সেই আদিশক্তিকে স্মরণ করি; আমার তখন মনে হয়, একটা সুপার পাওয়ার আমাকে চালনা করছে।”

    কোনওরকম ভাব-আবেশ হয় কি?

    “না। আমি তো সাধুসন্তদের মতো মাটি ছাড়িয়ে উপরে উঠতে পারিনি। এই মাটিতে বসেই আমি তখন মনে একটা শক্তি অনুভব করি।”

    জগৎবাবুর এই উত্তরগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম –

    এক: তিনি সাকার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। দুই: ঈশ্বর তাঁর কাছে নিরাকার এক ইন্দ্রিয়াতীত সত্তা। তিন: তিনি কালীভক্ত। কালীতে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ সাকার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। চার: ধ্যানে সাধুসন্তরা মাটি ছাড়িয়ে উপরে উঠতে পারেন।

    জগৎবাবুর কর্মকাণ্ডের ভিতরই যেহেতু মস্তিষ্কের রসায়ন পড়ে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তাঁর মস্তিস্ক স্নায়ুকোষে আজন্ম-লালিত বিশ্বাস স্থান পেলে পেতে পারে, কিন্তু স্ববিরোধী বিশ্বাস কখনই স্থান পাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন অদ্ভুত ঘটনাই ঘটল! মস্তিস্ক স্নায়ুকোষের গোলমালেই কি এমনটা ঘটল? আর, সাধুদের ধ্যানে শূন্যে ভেসে থাকার ব্যাপারটা? অমনটা কি অনেকবারই ঘটতে দেখেছেন? না কি, না দেখে স্রেফ শোনা কথায় বিশ্বাস করে বসে আছেন?

    (জগৎবাবুই সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। জগৎবাবুর কাছে একটি বিনীত অনুরোধ, ধ্যানে শূন্যে ভাসে এমন সাধুর সাক্ষাৎ পেলে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির যে কোনও শাখায় যোগাযোগ করবেন। গ্যারাণ্টি দিচ্ছি, সেই তথাকথিত সাধুর বুজরুকি ফাঁস করে তাকে আবার মাটিতে নামিয়ে আনব।)

    নাকি না দেখে অন্ধ বিশ্বাসে আত্মসমর্পণ? আপনার জন্য দুঃখিত, জগৎবাবু। একই মস্তিস্কে বিজ্ঞান-চিন্তা ও বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তার সহাবস্থানে দুঃখিত, এবং সেই সঙ্গে শঙ্কিত। আপনার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে যতটা শঙ্কিত, তারচেয়েও বেশি শঙ্কিত, আপনি পেশায় বিজ্ঞানী হওয়ায় আপনার চিন্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপূল বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে ভেবে।

    তিন: অসীমা চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ রসায়ন বিভাগের খয়রা প্রফেসর ছিলেন কুড়ি বছর। ১৯৮২ তে নিয়মতান্ত্রিক অবসর গ্রহণ। তবু নিয়মিত ক্লাশ নেন। ১৯৭৩-এ কলকাতা সাইন্স কলেজেই গড়ে তোলেন ‘সেণ্টার অফ অ্যাডভান্সড স্ট্রাডিজ ইন দি কেমিস্ট্রি অফ নাচারাল প্রোডাক্টস’। প্রতিষ্ঠানটির কাজ—গাছগাছড়ার ভেষজমূল নিয়ে উন্নত পর্যায়ে গবেষণা চালানো। ১৯৭৫-এ ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেণ্ট হন। ওই বছরই পান ‘পদ্মভূষণ’। রাষ্ট্রপতি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য হন ১৯৮২ সালে।

    শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ঈশ্বর আসলে কী? তাঁরই কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, “এই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়মে চলছে, গ্রহ-উপগ্রহ-তারকারা ঠিকমতো ঘুরছে—দিন হচ্ছে, রাত্রি হচ্ছে; ভোর হতেই পাখিরা ডেকে উঠছে, আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মানুষ জন্মাচ্ছে এবং যে জন্মাচ্ছে সে মারা যাচ্ছে—গোটা জগৎ যে একটা নিয়মবন্ধনে চলছে, এর নিশ্চয় একজন কর্তা আছেন। কর্তা ছাড়া তো কর্ম হয় না। বিশ্বনিয়ন্ত্রণের এই যে মহাকর্তা, তিনিই ঈশ্বর।”

    শুধু অসীমা চট্টোপাধ্যায় নন, অনেক বিজ্ঞান-পেশার ব্যক্তিই বলেন—এই যে বিশ্বের সৃষ্টি, এই যে নিয়মবন্ধনে চলা, এসবের নিশ্চয় একজন কর্তা আছেন, একজন স্রষ্টা আছেন।

    এ জাতীয় বক্তব্যের বিরুদ্ধে ‘ইন্সটিটিউশন অফ ইলেকট্রনিক্স অ্যাণ্ড টেলিকমিউনিকেশন্স (ইণ্ডিয়া)-র ফেলো, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ডঃ জয়ন্ত বসু’র স্পষ্ট বক্তব্য, “তাই যদি বলেন, আমিও পালটা প্রশ্ন করতে পারি, তাহলে সেই স্রষ্টার স্রষ্টা কে? তাঁরও তো একজন স্রষ্টা থাকা উচিত, কারণ তিনিও তো সৃষ্টি হযেছেন।”

    এর উত্তরে কোনও কোনও বিজ্ঞানী ‘রা’ কাটেন না। কেউ বা বলেন, “ঈশ্বর স্বয়ম্ভু, অর্থাৎ স্বয়ং উৎপন্ন হয়েছেন।”

    জয়ন্তবাবুর পাল্টা বক্তবা, “বেশ, ধরে নিলাম ঈশ্বর স্বয়ম্ভু, আপনা থেকে জন্মেছেন, তাহলে এই কথাটা প্রকৃতির বেলায় বলি না কেন—যার মধ্যে এই জগৎ আছে? প্রকৃতিকে স্বয়ম্ভু বলতে আপত্তি কোথায়? আমাকে যদি সেইখানেই যেতে হয়, শেষ উত্তর যদি আমি দিতে না পারি তাহলে প্রকৃতিকে স্বয়ম্ভু বলতে দোয কী?”

    অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ঈশ্বর, অর্থাৎ মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তি কিছু কিছু মানুষকে মেসেজ পাঠান। অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, “আমি মনে করি, টেলিগ্রাফ বা টেলিফোনের মতো একটা মেসেজ আসে। রিসিভার ভালো হলে সেই মেসেজ ধরা যায়। আমি যদি ভালো রিসিভার হই তাহলে সেই মেসেজ আমি ধরতে পারি। তবে তার জন্য সাধনা দরকার।

    যাক, শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়ের সাধনায় একটা দারুণ তথ্য জানা গেল, একটা শক্তি, যা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই শক্তি আবার বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষদের সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় কথাও বলে। অর্থাৎ, শক্তির স্বরযন্ত্র আছে! দেহ নেই, কিন্তু স্বরযন্ত্র আছে—ভবিষ্যৎ গবেষকদের কাছে দারুণ গবেষণার বিষয়।

    এবার দেখা যাক, কী ধরনের সাধনার প্রয়োজন হয় প্রকৃতির নিয়ন্তক শক্তির মেসেজ ধরতে?

    উত্তরে শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমি আমার বাবা ভাই বোন স্বামী সন্তান ছাত্রছাত্রী পাড়াপ্রতিবেশী সকলের প্রতি কর্তব্য করেছি; আমি জ্ঞানত সৎপথে চলেছি, সরলভাবে জীবন যাপন করেছি, কখনও কারও ক্ষতি চিন্তা করিনি, কারও প্রতি হিংসা করিনি, কারও ভাল হলে আনন্দ হয়েছে, যথাসাধ্য মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি। পুজো পাঠ স্তব সবই করি। দুবেলাই করি। বার বছর সত্যনারায়ণের পুজো করেছি। এছাড়া বাঙালীর ষষ্ঠী অষ্টমী এসব তো আছেই।”

    শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তি, অর্থাৎ কিনা ঈশ্বরের কাছ থেকে নানা উপদেশ, পথ নির্দেশ ইত্যাদি পাওয়া যায়। তবে তা পেতে গেলে আচরণগত কিছু বিধি পালন, পুজো, স্তব, মন্ত্র-টন্ত্র পাঠ ইতাদি করতে হয়। মন্ত্রশক্তির সাহায্যে ঈশ্বর নামক পরমশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব।

    শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বর দর্শন প্রসঙ্গে আরও জানিয়েছেন, “আপনার মনে যদি পবিত্রতা আসে-নির্জনে শুদ্ধচিত্তে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আপনি যদি তাঁর প্রতি মনঃসংযোগ করতে পারেন তাহলে তাঁকে আপনি দেখতেও পারেন।”

    শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন, “শুধু তা-ই নয়, যেসব প্রিয়জন অনেকদিন চলে গেছেন, এই পৃথিবীতেই নেই খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে পারলে, খুব মনঃসংযোগ করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারলে তাঁদেরও দেখা যায়। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”

    শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় যদি আরও একটি স্টাডি সেণ্টার খোলেন, সেই কেন্দ্রের গবেষণার বিষয়বস্তু হবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তির পথ-নির্দেশ ও উপদেশ গ্রহণের উপযুক্ত রিসিভার হয়ে ওঠার উপায়; দেহ বা দেহাংশ স্বরযন্ত্রের অনুপস্থিতি সত্বেও পৃথিবীর যে কোনও ভাষায় কথা বলার বিজ্ঞান; বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ পদ্ধতি; বিশ্বনিয়ন্তক শক্তির উপর মন্ত্রের প্রভাব; বিশুদ্ধ সত্যনারায়ণ ব্রতপালন পদ্ধতি; বিভিন্ন ব্রতপালন ও পুজোআচ্চার দ্বারা বিশ্বনিয়ম্ভক শক্তিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করার উপায়; ঈশ্বর দর্শন ও মৃত প্রিয়জন ও বিখ্যাতজনদের দর্শনলাভের পদ্ধতি ইত্যাদি।

    না, না; শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়কে একটুও ঠাট্টা করছি না। বরং আন্তরিকভাবেই চাইছি, গাছগাছড়ার ভেষজমূল্য নিয়ে গবেষণা মূলতুবি রেখে এই নব-অধ্যাত্মিক গবেষণাকেন্দ্রের কর্ণধার হয়ে বসুন। তাতে আমাদের সমাজের বিশাল লাভ হবে। ক্যানসার থেকে এইডস যে কোনও রোগ সারাবার ওষুধ তৈরির ফর্মুলা ঈশ্বরের কাছ থেকে জেনে নিলেই যখন চলবে, তখন কোনও ওষুধ নিয়ে গবেষণা চালাবার নামে পৃথিবী জুড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ নেহাতই অর্থ ও শ্রমের অপচয় নয় কি?

    যাঁরা আমার এতদূর কথা শুনে ঠোঁটের ফাঁকে হাসছেন, তাঁদের হাসি বন্ধ করে দেওয়ার মত কথা শোনাই। শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানেই আছে, তিনি এভাবেই নির্দেশ পেয়ে সুষনিশাক আর জটামাংসী দিয়ে মৃগীরোগের একটা দারুণ ওষুধ তৈরি করেছিলেন।

    দুষ্টেরা বলতে পারেন, কোনও কিছু নিয়ে গভীরভাবে চর্চা বা গবেষণা চালাবার সময় সেই সংক্রান্ত বহু চিন্তা উঠে আসাটাই স্বাভাবিক। এমনই উঠে আসা চিন্তাকেই শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় বার বার মেসেজ বলে ভুল করেছেন।

    দুষ্টদের এমন কথায় নব-অধ্যাত্মিক গবেষণা কেন্দ্রের কাজ বন্ধ করা যায় না। বরং, এমন গবেষণা সাকসেসফুলি চালাতে পারলে আর কোনও বিষয়ে কোনও গবেষণা চালাবারই প্রয়োজন থাকবে না। মা ভৈ! পৃথিবীতে অধ্যাত্মবাদ নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণার ভবিষ্যৎ চিত্রের কথা চিন্তা করে এখনি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

    চার: দিলীপকুমার সিংহ গণিতজ্ঞ। ফলিত গণিত তাঁর অধ্যাপনা ও গবেষণার বিষয়। ফিজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, সোশ্যাল, এনভায়রনমেণ্টাল ইত্যাদি বহু বিজ্ঞান শাখার গাণিতিক মডেল তিনি তৈরি করেছেন। দেশ-বিদেশের বহু সোসাইটি ও আকাদেমির তিনি ফেলো। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

    সিংহমশাই ঈশ্বর প্রসঙ্গে সিংহবিক্রমে প্রশ্ন তুলেছেন, “কোন্ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে কোন বিজ্ঞানী বলতে পারেন, তিনি ভগবান মানেন না? বিজ্ঞান তো কোনোকিছু অবিশ্বাস করতে বলে না।”

    ভালো, ভালো, খুব ভালো। আশা করি সিংহমশাই কথায় ও কাজে এক।এবং তিনি কুমড়োপটাশ, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, টিয়ামুখো গিরগিটি, রামগরুড়ের ছানা, শাকচুন্নি থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়া পর্যন্ত সব কিছুই মানেন। কারণ, সত্যিই তো কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তিনি বলবেন, “আমি ওসব মানি না। বিজ্ঞান তো কোনও কিছুকেই অবিশ্বাস করতে বলে না।

    গণিতবিজ্ঞানী দিলীপবাবুর কথায়, “যাঁরা অনুসন্ধান না করেই বলেন, ভগবান মানেন না, তাঁরা অবৈজ্ঞানিকভাবে বলেন, হাততালি পাবার জন্য গায়ের জোরে বলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো রাজনৈতিক নেতা নন, তাঁদের হাততালি পাবার দরকার কী? বিজ্ঞানীদের হাততালি পাবার কোনো দরকারই নেই।”

    দিলীপবাবু বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে বলেছেন। অনুসন্ধান না চালিয়ে ‘ঈশ্বর নেই’ বলার ব্যাপারটাকে দারুণ রকম নিন্দা-মন্দ করেছেন। দিলীপবাবুর এ’জাতীয় মতামতকে গুরুত্ব দিলে কুমড়োপটাশ থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়া পর্যন্ত সব্বার ক্ষেত্রেই গভীর অনুসন্ধান চালাবার আগে ‘নেই’ বলার অধিকার বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হয়।

    দিলীপবাবুর বক্তব্যের পিঠে দারুণ চপেটাঘাতের মতই এসে পড়েছে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তারকমোহন দাসের চাঁচাছোলা কথাবার্তা। তারমোহনবাবুর পরিচয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যাণ্ট ফিজিওলজি বিভাগের প্রফেসর, অ্যাগ্রিকালচার অ্যাণ্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডীন, এনভায়রনমেণ্টাল সায়েন্স বিভাগের কো-অর্ডিনেটর। ভারত সরকারের গঙ্গাদূষণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন, চালাচ্ছেন বায়ুদূষণে উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা।

    তারমোহনবাবু ঈশ্বর মানেন না। কেন মানেন না? তাঁর কথায়, থাকলে এতদিনে বেরিয়ে যেতেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁকে আবিষ্কার করা যেত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা যায়নি। যাবেও না কোনোদিন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হল—প্রথমে একটা প্রশ্ন থাকবে, তারপর সেটা নিয়ে এক্সপেরিমেণ্টেশন হবে, তারপর ইনফারেন্স হবে এবং শেষে সেই ইনফারেন্স অনুসারে ব্যাখ্যা হবে। কিন্তু ঈশ্বর সম্বন্ধে এসব কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই, আমি কোথাও কোনো রেফারেন্স পাইনি। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না বিজ্ঞানে প্রমাণ পাচ্ছি ঈশ্বর আছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ঈশ্বর আছেন মানতে রাজি নই।”

    দিলীপকুমার সিংহ স্বীকার করেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কখনই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। তাঁর কথায়, “আসলে এটা অনুভূতির প্রশ্ন—এবং অনুভূতি অনেকটা সংস্কারের উপর নির্ভর করে। আমরা লেখাপড়া শিখেছি বলেই পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত, একথা কখনই বলা যায় না। আমাদের সকলেরই কিছু-না-কিছু সংস্কার আছে, সেই সংস্কারই গোড়ায় ঠিক করে দেয় ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কী হবে। সংস্কার তো ছেলেবেলা থেকেই গড়ে ওঠে, তাই আপনি যদি ঈশ্বর আছেন এই সংস্কারের মধ্যে বড়ো হন তাহলে ঈশ্বর আছেন, আপনার মানতে ইচ্ছা হবে।” ঝুলি থেকে বিড়াল বেরুল! তাহলে ঈশ্বর কি শুধুই সংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও অনুভূতির ব্যাপার মাত্র? নাকি বিজ্ঞানী দিলীপকুমার সিংহের ‘ঈশ্বর’ অন্ধবিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে ‘প্রত্যয়’ হয়ে প্রতিষ্ঠিত?

    দিলীপবাবুর কথায়, “আমার স্বীকার করতে সঙ্কোচ নেই, আমার মধ্যে একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব আছে, আমি প্রচণ্ড একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে আছি—ঈশ্বর আছেন একথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছি না, আবার জোর দিয়ে বলতেও পারছি না—হ্যাঁ, ঈশ্বর আছেন।”

    (‘সাতকাণ্ড রামায়ণ, সীতা কার বাবা?’ ব্যাপারটা এমনই দাঁড়াল না কি? আশা করছি, দিলীপবাবু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ ‘অবৈজ্ঞানিকভাবে’ করেননি। হাততালি পাবার লোভে এমনটা বলেননি। কিন্তু তাহলে কেন ঈশ্বর-অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশের জন্য বিজ্ঞানীদের গাল-পারা! ধুৎ-তারি-ছাই! এত উল্টো-পাল্টা কথা-বার্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাবে দেখছি।)

    কিন্তু এসব কথার পরেও সিংহমশাই ঈশ্বর প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা সত্যিই চমকপ্রদ! তাঁর কথায়, “অবিশ্বাস কী করে করি বলুন তো। আমি নিজে একেবারেই কিছু টের পাইনি, তা তো নয়।”

    কীভাবে টের পেয়েছেন, বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “আমার বোনেদের ভালো বিয়ে হয়েছে, ভাইয়েরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমিও নেহাত খারাপ নেই। নিশ্চয়ই কেউ অদৃশ্য হাতে আমাকে সাহায্য করেছে। সে ঈশ্বরও হতে পারে, একটা শক্তিও হতে পারে।…তাকে ঈশ্বর বলুন না, দোষ কী।”

    দিলীপকুমার সিংহের বোনেদের ভালো বিয়ে ও ভাইদের প্রতিষ্ঠা যদি ঈশ্বর আস্তির একটা প্রমাণ হয়, তবে বহু মানুষের বোনেদের খারাপ বিয়ে ও তাদের ভাইদের অপ্রতিষ্ঠা কি ঈশ্বরের অনস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় না? দিলীপবাবু কী বলেন?  পাঁচ: সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রাক্তন অধিকর্তা, ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সাইন্স’-এর সভাপতি। ভারতসরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত কমিটির প্রাক্তন সদস্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সারা ভারত বিজ্ঞান জাঠার (১৯৮৭) অন্যতম নেতা (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য—বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলতে যে সব বিষয় জাঠা বেছে নিয়েছিল, তার মধ্যে বিষয় হিসেবে স্থান পায়নি ‘কুসংস্কার’, স্থান পায়নি যুক্তিমনস্ক মানুষ গড়ার প্রয়াস)। মৃত্তিকাবিজ্ঞান ও কৃষিরসায়ন নিয়ে কাজের জন্য ভারতে যাঁরা অগ্রগণ্য, সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁদের একজন।

    সুশীলবাবু কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? এবিষয়ে তাঁর সাফ জবাব, “দেখুন, ঈশ্বর নিয়ে আমি কখনও চর্চা করিনি। বিজ্ঞানী কেন, যে কোনো যুক্তিবাদী লোকই বলবে, ‘যা নিয়ে তুমি কখনও চর্চা করোনি, তা নিয়ে তোমার পক্ষে কিছু বলা ঠিক নয়। কেননা, সে সম্বন্ধে তোমার ধারণা ভ্রান্ত হতে পারে। অনুভূতির সাহায্যে হয়তো কিছু বলতে পার, কিন্তু অনুভূতিও অনেক সময় তোমাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই আমি মনে করি, আমার পক্ষে এ বিষয়ে কিছু না বলাই শ্রেয়।”

    ভাল কথা! সুশীলবাবু যেহেতু ঈশ্বর নিয়ে চর্চা করেননি, তাই ঈশ্বর আছে, কি নেই, এ বিষয়ে কোনও রকম মত প্রকাশে নারাজ। তিনি আর এক প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্টতই জানিয়েছেন, “ঈশ্বর আছেন কি না আমি জানি না। এই বিষয়ে তাঁর চর্চা নেই তো, তাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। আশা করি, রামগরুড় ইত্যাদির অস্তিত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও সুশীলবাবু বলতেন—রামগরুড় ইত্যাদির অস্তিত্ব আছে কি না, আমি জানি না। থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।

    তবে সুশীলবাবু একথা সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন, “ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা একটা বিজ্ঞান।”

    এই জাতীয় কথা আর কোনও বিজ্ঞানীর লেখায় বা কথায় আজ পর্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সুশীলবাবুর কথায়, “পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে এই বিজ্ঞানের মিল নেই।”

    “পাশ্চাত্য বিজ্ঞান মানেই বাইরের জিনিস অর্থাৎ আমরা যে জিনিস দেখতে পাচ্ছি, স্পর্শ করতে পারছি সেই জিনিস। সবই ফিজিক্যাল ব্যাপার। এ দিয়ে ঈশ্বরের পরিমাপ হয় না, এ দিয়ে ঈশ্বর আছে কি নেই বলা যায় না।”

    “ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ভিতরের জিনিস নিয়ে নিজের ভিতরটা দেখা ও বোঝার চেষ্টা করাই এই বিজ্ঞানের লক্ষ্য।”

    ডক্টর সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় নিশ্চয়ই অধ্যাত্মবাদ নিয়ে চর্চা করেই এ’সব কথা বলেছেন। চর্চা করে দেখেছেন, আত্মা অমর। ভূত-প্রেত-পরমাত্মা-ঈশ্বরআল্লা-পরলোক, ইত্যাদি সবেরই বাস্তব অস্তিত্ব আছে! ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের মৃত্তিকা গবেষণাপত্র শ’র উপর প্রকাশিত হয়েছে। নামী বিদেশি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থেও কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যা প্রকাশিত হয়েছে, সবই তো পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের জিনিস। প্রাচ্য বিজ্ঞান অর্থাৎ ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ নিয়ে তাঁর চর্চা ও গবেষণাপত্র অপ্রকাশিত রেখে তিনি কি প্রাচ্য-বিজ্ঞান, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ও তামাম বিশ্ববাসীকে বিশালভাবে বঞ্চিত করছেন না? আমজনতার পক্ষ থেকে, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট মৃত্তিকাবিজ্ঞানী ও অধ্যাত্মবিজ্ঞানী ডক্টর সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রতি বিনীত নিবেদন, তিনি অধ্যাত্মবিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর চর্চা ও গবেষণার সঙ্গে জনগণের পরিচয় ঘটাবার সুযোগ করে দিন। তাঁর প্রাচ্য বিজ্ঞানচর্চার অসাধারণ দিকটি জনগণের কাছে, জনণের স্বার্থে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

    যে সুশীলবাবু সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন, “ঈশ্বর আছেন কি না আমি জানি না, সেই সুশীলবাবুই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা রেখেছেন, “ভারতীয় অধ্যাত্মিকতাও একটা বিজ্ঞান”, অর্থাৎ “ভারতীয় আত্মা পরমাত্মা ও পরলোক তত্ত্ব বিজ্ঞান”। যাঁরা সুশীলবাবুর এমন চূড়ান্ত স্ববিরোধিতায় হতবুদ্ধি ও হতবাক, তাঁদের অবগতির জন্য সুশীলবাবুর আরও কিছু কৌতুহল উদ্দীপক বা ‘মজার ছত্রিশ ভাজা’ মার্কা উক্তি তুলে দিচ্ছি:

    (এক) “রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ঈশ্বর লাভ করেছিলেন এবং নরেনের মতো ঐরকম ঘোর নাস্তিককেও ঈশ্বর দেখিয়েছিলেন, সুতরাং নিশ্চয় তাঁর মধ্যে একটা প্রতীতি (প্রত্যয়) জন্মেছিল| এই প্রতীতিই আসল কথা। বিজ্ঞানীদেরও এইরকম প্রতীতি জন্মায, তবেই তাঁরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।”

    (দুই) “দেখুন, বিজ্ঞানে সকলের ভাষা সকলে বোঝেন না। স্পেশালাইজেশনের দরুন বিজ্ঞানের ভাষায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এক বিজ্ঞানের লোক আর-এক বিজ্ঞানের ভাষা খুব বেশি বুঝতে পারেন না। যেমন ধরুন, আমি সয়েল কেমিস্ট্রির লোক, অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ভাষা আমি ঠিক বুঝি না—অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে এমনসব টার্মিনোলজি ব্যবহার করা হয় যা আমার বোধগম্য হয় না। কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে ভাবে-ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলে কিছু বুঝি। আধ্যাত্মিক জগতেও এইরকম আছে।”

    (তিন) “রামকৃষ্ণদেবের কথা দিয়েই বলি। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণদেবের কাছে দূরদূরান্ত থেকে অনেক সাধুসন্ত আসতেন। গঙ্গাতীরে এক পরম সাধক আছেন শুনেই তাঁরা আসতেন। তাঁরা তাঁর ভাষা জানতেন না। রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তাঁদের হয়তো দু-চারটে কথা হত-এছাড়া বেশিরভাগই আকার-ইঙ্গিত, চোখের ভঙ্গি, হাতের মুদ্রা। এইভাবেই তাঁদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান হত, এক ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীর আর-এক ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীর মধ্যে যেমন হয়। কাজেই এ-ও একটা বিজ্ঞান।”  (তখন খড়গপুরের ট্রাফিক সেটেলমেণ্টে থাকি। সীতানাথ মাথায় কয়লার ঝুড়ি নিয়ে কয়লা বেচতে আসত। বিয়ে করল দক্ষিণ ভারতীয় একটি মেয়েকে। মেয়েটিও কয়লা বেচতে আসত। কিন্তু তেলুগু ছাড়া আর সব ভাষাই তার কাছে ছিল পরম-রহস্যময়। আকার-ইঙ্গিত-চোখের ভঙ্গি-হাতের মুদ্রায় ভাববিনিময় করত। সীতানাথ ছিল ওড়িয়াভাষী।

    সীতানাথ ও তার পরিবারের সকলের সঙ্গেই সীতানাথের জীবনসঙ্গিনীর ভাববিনিময়ের ভাষা ছিল আকার-ইঙ্গিত। এখন মনে হচ্ছে, আসল মানেটা বুঝতে পারছি। ওদের যেভাবে আকার-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় হত, সেভাবেই এক ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীর সঙ্গে আর-এক ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীর ভাব বিনিময় হয়। কাজেই সীতানাথ ও তার জীবনসঙ্গিনীর ব্যাপার-স্যাপারও আসলে বিজ্ঞান। ওরা ছিল খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী।

    (চার) “জগৎ চলছে প্রকৃতির নিয়মে। জগৎ চালাবার জন্য আর-একজনের দরকার আছে বলে মনে করার প্রয়োজন নেই। আবার যদি জিজ্ঞাসা করেন, জগৎ সৃষ্টি হল কী করে, উত্তরে বলব, সে-ও প্রকৃতির নিয়মে। কেউ একজন জগৎ সৃষ্টি করেছে ভাবলে সমস্যা বাড়ে। তখন প্রশ্ন ওঠে, তাঁকে সৃষ্টি করেছেন কে? এ প্রশ্নের উত্তর পাব না। তখন যেতে যেতে সেই ইনফিনিটিতে গিয়ে পোঁছতে হবে। অত গোলমালের মধ্যে না যাওয়াই ভালো। প্রকৃতির নিয়মে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে ও প্রকৃতির নিয়মে জগৎ চলছে মেনে নিলে কোনো গোল থাকে না।”

    (পাঁচ) “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, সেইটেই আমার ধর্ম।” সুশীলবাবুর এই পাঁচমিশেলি বক্তব্য বিষয়ে মন্তব্য নিঃষ্প্রয়োজন।

    ছয়: গোরাচাঁদ চট্টোপাধ্যায় গত তিরিশ বছর ধরে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের কর্ণধার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। জীবরসায়নের নানা শাখায় তাঁর প্রায় পৌনে দু’শোর মত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে দেশ বিদেশে। এক সময় তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

    গোরাচাঁদবাবুর কথায়, “আমাদের সৌরমণ্ডলের কথা ধরুন, সূর্যের চারপাশে গ্রহরা তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে অবিরাম ঘুরছে। এই যে তাদের মুভমেণ্ট, এর একটা আশ্চর্য সিংক্রোনাইজেশন আছে। ধরুন, আজ থেকে দশ বছর পরে একটা চন্দ্রগ্রহণ কি সূর্যগ্রহণ হবে। আমাদের ম্যাথম্যাটিক্যাল সায়েন্স এত উন্নতি করে গেছে যে, আমরা অঙ্ক কষে বলে দিতে পারি, অমুক দিন অমুক সময় এই গ্রহণ হবে। এ একটা ফ্যাণ্টাস্টিক ব্যাপার। আমার মনে হয়, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই যে গতিশীলত, কোনো এক অতিপ্রাকৃত শক্তি একে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই যে একটা সুপারন্যাচারাল ফোর্স বা গাইডিং ফোর্স—এটা কিন্তু সামথিং মিরাকিউলাস।”  গোরাচাঁদবাবুর এমন বক্তব্যকে কাঁধ থেকে পোকা ঝাড়ার মতই ঝেড়ে ফেলেছেন বি. ডি. নাগচৌধুরী, পাল্টা যুক্তির টোকায়। বি. ভি.’র পুরোটা বাসন্তীদুলাল, তবে বি. ডি. নামেই বেশি পরিচিত। ডঃ নাগচৌধুরী সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়র ফিজিক্সের ডিরেক্টর ছিলেন। ছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ছিলেন দেশের প্রক্রিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। ভারতের পরমাণু বোমা তৈরির ক্ষেত্রে ডঃ নাগচৌধুরীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির চূড়োয় উঠেছেন। বিদেশের বিজ্ঞানীদের কাছেও অতিপরিচিত একটি নাম।

    ডঃ নাগচৌধুরীর যুক্তি, “সুপারন্যাচারাল ফোর্সেরও তো প্রমাণ চাই। প্রমাণ না পেলে বিজ্ঞানী হিসেবে আমি মানি কী করে? বিজ্ঞানে অনেক রকম এনার্জির কথা বলা হয়েছে। একটা এনার্জি আর একটা এনার্জিতে ট্রান্সফার করা যায়, তাকে বলে ট্রান্সফর্মেশন অব এনার্জি। আমি যদি সুপারন্যাচারাল ফোর্স বা এনার্জির কথা ধরি, তাহলে কোন এনার্জিকে সুপারন্যাচারাল এনার্জিতে ট্রান্সফর্ম করব? আবার সুপারন্যাচারাল এনার্জিকেই বা কোন্ এনার্জিতে ট্রান্সফর্ম করা সম্ভব হবে? সুতরাং ঈশ্বরকে সুপারন্যাচারাল ফোর্স হিসাবেও ভাবতে পারি।”

    O

    যদি সুপারন্যাচারাল ফোর্স বা এনার্জির কথা ধরি, তাহলে কোন্ এনার্জিকে সুপারন্যাচারাল এনার্জিতে ট্রান্সফর্ম করব? আবার সুপারন্যাচারাল এনার্জিকেই বা কোন্ এনার্জিতে ট্রান্সফর্ম করা সম্ভব হবে? সুতরাং ঈশ্বরকে সুপারন্যাচারাল ফোর্স হিসাবেও ভাবতে পারি না।”

    O

    গোরাচাঁদবাবুর জবানীতে, “রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ সুপারম্যান ছিলেন জানি, অতি সাম্প্রতিক কালে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথজীর কথাও শুনেছি। শুনেছি তাঁদের বহু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। থাকতেই পারে, কারও ক্ষমতা থাকতেই পারে—নইলে এত লোক তাঁদের কাছে ছোটে কেন?”

    তাঁর এই তিনটি বাক্যের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাচ্ছি এক: গোরাচাঁদবাবু জানতেন, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। কীভাবে জানতে পেরেছিলেন? কীভাবে ওঁদের অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন? দুই: “নইলে এত লোক তাঁদের কাছে ছোটে কেন?”—কী সহজ-সরল উত্তর! যুক্তির পরিবর্তে সংখ্যাগুরুদের মতামতে কী গভীর বিশ্বাস! আঃ হাঃ এমন সংখ্যাতত্বে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের কৃপাতেই সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা আটকে ছিল শত-সহস্র বছর।

    বিশাস যদি ‘ডগমা’ হয়, অর্থাৎ যুক্তিনির্ভর না হয়ে বদ্ধমূল ধারণার উপর গড়ে ওঠে, তখন তা অন্ধ হয়ে যায়। গোরাচাঁদবাবু পেশায় বিজ্ঞানী হলেও বাস্তব জীবনে অন্ধ বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত একটি পিছিয়ে পড়া মানুষ-বই কিছু নন।

    গোরাচাঁদবাবু আরও বলেছেন, “ধরুন, রামকৃষ্ণ পরমহংস যদি আজ জন্মাতেন, আমরা কি তাঁর মেটাবলিক ইভেণ্ট দিয়ে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারতাম? কখনই না। বায়োকেমিস্ট্রি যে এখন অ্যাটামিক লেভেল ছাড়িয়ে আরেও অনেক ফাইনার লেভেলে চলে গেছে, তবু রামকৃষ্ণদেবের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য আমরা ভেদ করতে পারতাম না।”

    কী মুশকিল বলুন তো! অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণিত হলে তবে তো তার কারণ খুঁজে বের করার ও ব্যাখ্যার প্রশ্ন আসবে! গোরাচাঁদবাবু আগেই ঘোষণা করে বসে রইলেন, রামকৃষ্ণ প্রমুখদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য ভেদ করতে তিনি পারতেন না। তিনি অবশ্য আমরা কথাটা ব্যবহার করেছেন। জানিয়েছেন, “আমরা ভেদ করতে পারতাম না”। এই “আমরা” বলতে বোধহয় তাঁর মত অন্ধবিশ্বাসের কাছে নতজানু বিজ্ঞানীদের কথা বলেছেন। বিশ্বাস যেখানে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়, যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, শুধুমাত্র বদ্ধমূল ধারণার উপর গড়ে ওঠা, সেই বিশ্বাস কখনই সত্যানুসন্ধান করতে পারে না। রহস্য ভেদ করতে পারে না। অতএব, গোরাচাঁদবাবুরা বিজ্ঞানী হয়েও যে পারবেন না, এটা তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। তবে অলৌকিক রহস্য ভেদের ব্যাপারে গোরাচাঁদবাবু বাস্তবিকই আন্তরিক হলে একটি কাজ করতে পারেন। অলৌকিক ক্ষমতাবান কারও খবর পেলে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতিকে খবর দিতে পারেন। গ্যারাণ্টি দিচ্ছি, রহস্য ভেদ করে দেব-ই।

    সাত: বীরেন্দ্রবিজয় বিশ্বাস কলিকাতা বসুবিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা। মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে তাঁর কাজ। দুটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার তিনি পেয়েছেন, ভাটনগর পুরস্কার ও শ্রীনিবাসাইয়া পুরস্কার। আমেরিকার বিখ্যাত মলিকিউলার বায়োলজিস্ট আলেকজাণ্ডার হলেণ্ডা মনে করেন ডঃ বিশ্বাস একদিন নোবেল পুরস্কার পাবেন, তার কর্মকাণ্ডের জন্য।

    বীরেন্দ্রবাবু তাঁর এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছেন। তিনি সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন, আমরা যাঁদের মহাপুরুষ বলি, অনেকের বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। আছে কি নেই, বিজ্ঞান এখনও প্রমাণ করতে পারেনি।”

    কী মজার ব্যাপার বলুন তো! দাবিদার একবার দাবি করলেই কেল্লা ফতে। এবার বিজ্ঞানকেই আদা-জল খেয়ে প্রমাণ করতে হবে—তার দাবির অসারতা। নতুবা! বীরেন্দ্রবাবুব মত ডাকসাইটে নামী-বিজ্ঞানীরাও শোরগোল তুলবেন—দাবি অসার কি না বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি।

    দাবি প্রমাণের দায়িত্বটা দাবিদারের নয়—বীবেন্দ্রবাবুর এমন বালখিল্যের মত কথায় আমার বন্ধু মিস্টুন বলেছিলেন, “আমাদের পাড়ার ফুচকাওয়ালা ঝুন্নু বলে, ও নাকি এক রকম পাতার রস খাইয়ে বেশ কয়েকজন এইডস রোগীকে একদম সারিয়ে দিয়েছে! কোন গাছের পাতার রস খাওয়ায়? না, ঝুন্নু এ’বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। বলে, ‘এতবড় আবিস্কারটা আমি বলি, আর তোমরা ফোকটাই নাম কেন। নোবেল প্রাইজ দিলে তবে নাম বলব।’ ভাল হয়ে যাওয়া রোগীদের নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেই হাসে আর বলে, ‘আমি কি পাগল যে রোগীদের নাম বলব? ওদের নাম বলি, আর পাবলিক ওদের পিছনে লেগে পড়ুক?’ এতদিন ঝুন্নুকে আধা-পাগলা ভাবতাম। এখন তোমার মুখে বীরেন্দ্রবিজয়বাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, এভাবে ঝুন্নুর দাবিকে উড়িয়ে দেওয়াটা আদৌ ঠিক নয়। কারণ, ঝুন্নুর এইডস সারাবার ক্ষমতা আছে কি নেই, বিজ্ঞান এখনও প্রমাণ করতে পারেনি। এই যুক্তিতে ঝুন্নুকে এইডসের ওষুধের আবিস্কারক হিসেবে সত্যিই নোবেল প্রাইজ দেওয়া যেতেই পারে। বীরেন্দ্রবাবুর বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক নাম আছে। উনি এ ব্যাপারে ঝুন্নুকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন। বীরেন্দ্রবাবু তাঁর অকাট্য যুক্তিতে নিশ্চয়ই নোবেল পুরস্কার কমিটিকে প্রভাবিত করতে পারবেন। আর তারপর যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার আনবে ঝুন্নু ফুচকাওয়ালা। ঝুন্নু ও নোবেল পুরস্কার—এই দুয়ের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটা ঘোচাতে এখন শুধু দরকার, বীরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে ঝুন্নুর আলাপ করিয়ে দেওয়া।”

    ‘ঐশ্বরিক ক্ষমতা’ বলে কিছু আছে কি নেই, বিজ্ঞান যদি প্রমাণ করতে পারত, তা হলে কী হত? বীরেন্দ্রবাবুর কথায়, “তাহলে প্রমাণ হয়ে যেত ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বর থেকেই তো ঐশ্বরিক! ঈশ্বর না থাকলে ঐশ্বরিক হয় কী করে?”

    ভাল! ভাল! কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বীরেন্দ্রবাবু প্রকারান্তরে এ’কথাও স্বীকার করলেন—অবতার নামে চিহ্নিতদের কেউই আজ পর্যন্ত তাঁদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেননি। তেমনটা পারলে তো ঈশ্বরের অস্তিত্বও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়ে যেত।

    ঐশ্বরিক ক্ষমতার অস্তিত্ব বিষয়ে বীরেন্দ্রবাবুর দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তিভূমি প্রমাণইীন, যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বস–এ কথা রূঢ় শোনালেও সত্যি।

    বীরেন্দ্রবিজয়ের কথায়, “হয়তো মহাপুরুষরা সাধনার দ্বারা তাঁদের মস্তিষ্ককে অনেক বেশি কাজে লাগাতে পারেন। তাতে তাঁদের ক্ষমতা বেড়ে যায়, তখন তাঁরা অনেক অসাধারণ কাজ করতে পারেন। এমন কি ভবিষ্যৎও দেখতে পারেন। বিজ্ঞানের দিক দিয়ে তা অসম্ভব কিছু নয়।”

    শুরুই ‘হয়তো’ দিয়ে কেন? তাহলে একথাও তো বলা যায়—“হয়তো সাধনার দ্বারা অসাধারণ কাজ বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ আদৌ সম্ভব নয়”।

    ‘হয়তো’, ‘যদি’, ‘তবে’ দিয়ে বীরেন্দ্রবাবুর এই ঐশ্বরিক ক্ষমতার পক্ষে ওকালতির ভিতটা বড় বেশি ঠুনকো। আরও মারাত্মক ব্যাপার হল এই যে, বীরেন্দ্রবাবু মনে করেন বিজ্ঞান মেনেই মানুষের ভবিষ্যৎও দেখা সম্ভব! ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত না হলে তাত্ত্বিকভাবেই ভবিষ্যৎ দেখা সম্ভব নয় (এই প্রসঙ্গে বিস্তৃত জানতে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ৩য় খণ্ড পড়তে পারেন)। পূর্বনির্ধারিত কথার অর্থ যা আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে, কোনওভাবেই যার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত না হলে ভবিষ্যৎ দেখার পর তা পাল্টে যেতেই পারে। আর তেমনটা ঘটলে ভবিষ্যৎ দেখা ভুল হতে বাধ্য। অতএব, তাকে আর ‘বিজ্ঞানের দিক থেকেই সম্ভব’, এমনটা বলা যাবে না। ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত হওয়াটা যদি সম্ভবই হয়, তবে সমস্ত রকম প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য।

    বীরেন্দ্রবাবু, আপনি অসুস্থ হলে কি ডাক্তার দেখান? ওষুধ খান? যদি দেখান, যদি খান, তবে বলতেই হয়, আপনি স্ববিরোধী চিন্তার শিকার। কারণ রোগ-ভোগ, সুস্থতা, মৃত্যু সবই যখন পূর্বনির্ধারিত, তখন ডাক্তার ও ওষুধের ভূমিকা শূন্য হতে বাধ্য নয় কি?

    বীরেন্দ্রবাবু, এক সময় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, টাইফয়েড সহ অনেক রোগেরই কোনও চিকিৎসা ছিল না। এইসব রোগীর ভাগ্যে তখন নির্ধারিত হত মৃত্যু। ওষুধ আবিষ্কার হতেই নির্ধারিত মৃত্যু পিছু হটেছে। নির্ধারিত ভবিষ্যৎ এভাবেই প্রচেষ্টার কাছে, বিজ্ঞানের কাছে বার বার পরাজিত হয়েছে, হচ্ছে, হবে।

    বীরেন্দ্রবাবু, ঐশ্বরিক শক্তি, ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, বিজ্ঞানের দিক দিয়ে একান্তভাবেই অসম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে বা বাস্তবে কোনওভাবেই এই অসম্ভবকে আপনি সম্ভব করতে পারবেন না। কখনই পারবেন না।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ
    Next Article অলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ

    Related Articles

    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.