Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম

    নীলিমা ইব্রাহিম এক পাতা গল্প272 Mins Read0

    ৩. রীনা

    ০৩.

    আমি রীনা বলছি। আশাকরি আমার পরিচয় আপনাদের কাছে সবিস্তারে দেবার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে আপনারা এতো হৈ চৈ করেছিলেন যে ত্রিশ হাজার পাকিস্তানি বন্দি হঠাৎ ভাবলো বাংলাদেশ থেকে কোনো হেলেনকে তারা হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য খুব বেশি বিস্মিত হন নি কারণ আমার মতো আরও দু’চারজন এ সৌভাগ্যের অধিকারিণী হয়েছিলেন। অবশ্য পাকিস্তানিরা কিন্তু আমাদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল না, আমরা স্বেচ্ছায় ওদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম। কারণ বাংকার থেকে আমাকে যখন ভারতীয় বাহিনীর এক সদস্য অর্ধ উলঙ্গ এবং অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে তোলে তখন আশেপাশের দেশবাসীর চোখে মুখে যে ঘৃণা ও বঞ্চনা আমি দেখেছিলাম তাতে দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলতে পারি নি। জঘন্য ভাষায় যেসব মন্তব্য আমার দিকে তারা ছুঁড়ে দিচ্ছিল… ভাগ্যিস বিদেশীরা আমাদের সহজ বুলি বুঝতে পারে নি।

    ওরা খুব সহানুভূতির সঙ্গে আমাকে টেনে তুলে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে নিয়ে গেল। গোসল করে কাপড় বদলাবার সুযোগ দিলো। জিজ্ঞেস করলো, কিছু খাবো কিনা? মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালাম। তারপর ওদের সহায়তায় জিপে উঠলাম। আমি ভালো করে পা ফেলতে পারছিলাম না, পা টলছিল, মাথাও ঘুরছিল। ওরা দ্রুত আমাকে আরও তিনজনের সঙ্গে গাড়িতে তুলে নিলো। ওদের কথায় বুঝলাম আমরা ঢাকা যাচ্ছি। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি জীবিত না মৃত? এমন পরিণাম কখনও তো ভাবি নি। ভেবেছিলাম একদিন বাংকারে মরে পড়ে থাকবো আর প্রয়োজনে না লাগলে ওরাই মেরে ফেলে দেবে। লোকসমাজে বেরুবো, এতো ঘৃণা ধিক্কার দেশের লোকের কাছ থেকে পাবো তাতো কল্পনাও করি নি।

    ভেবেছিলাম যদি মুক্তিবাহিনী আমাদের কখনও পায়, মা-বোনের আদরে মাথায় তুলে নেবে। কারণ আমরা তো স্বেচ্ছায় এ পথে আসি নি। ওরা আমাদের বাড়িতে একা ফেলে রেখে দেশের কাজে গিয়েছিল এ কথা সত্যি। কিন্তু আমাদের রক্ষা করবার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল কার ওপর? একবারও কি আমাদের পরিণামের কথা ভাবেনি? আমরা কেমন করে নিজেকে বাঁচাবো, যুদ্ধের উন্মাদনায় আমাদের কথা তো কেউ মনে রাখে নি। পেছনে পড়েছিল গর্ভবতী স্ত্রী, বিধবা মা, যুবতী ভগ্নী কারও কথাই সেদিন মনে হয় নি। অথচ তাদের আত্মরক্ষার তো কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। বৃদ্ধ পিতা-মাতা মরে বেঁচেছেন, গর্ভবতী পত্নীর সন্তান গর্ভেই নিহত হয়েছে। যুবতী স্ত্রী, তরুণী ভগ্নী পাকদস্যুদের শয্যাশায়িনী হয়েছে। অথচ আজ যখন বিজয়ের লগ্ন এসেছে, মুক্তির মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে তখনও একবুক ঘৃণা নিয়ে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে সামাজিক জীবেরা। একটা পৃথই এসব মেয়েদের জন্যে খোলা ছিল-তা হলো মৃত্যু। নিজেকে যখন রক্ষা করতে পারে নি, তখন মরে নি কেন? সে পথ তো কেউ আটকে রাখেনি। কিন্তু কেন মরবো? সে প্রশ্ন তো আমার আজও। মরি নি বলে আজও. আর পাঁচজনের মতো আছি, ভালোই আছি, জাগতিক কোনও সুখেরই অভাব নেই। নেই শুধু বীরাঙ্গনার সম্মান। উপরন্তু গোপনে পাই ঘৃণা, অবজ্ঞা আর ভ্রুকুঞ্চিত অবমাননা।

    সে কবে, কতোদিন আগে? আমার একটা অতীত ছিল, ছিল বাবা-মা বড়ভাই আসাদ আর ছোটভাই আশফাক। বাবা পাকিস্তান সরকারের বড় চাকুরে। কাকাও লাহোর রাওয়ালপিন্ডি কখনও ঢাকা। বড়ভাই বিএ পরীক্ষা দিয়ে আর্মিতে ঢুকলেন। বাঙালির প্রতি অবজ্ঞা তিনি ঘোচাবেন। আব্বার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু তিনি বাধাও দিলেন না। ট্রেনিং শেষ করে কিছুদিন রইলো শিয়ালকোটে, তারপর একেবারে কুমিল্লায়। ততোদিনে আব্বা রিটায়ার করেছেন। আশফাক ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বিতীয় বর্ষ আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী। বড় সুখে আনন্দে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো। আতাউরের সঙ্গে কিছুটা মন দেওয়া নেওয়া যে হয় নি তা নয়, তবে ফাইনাল পরীক্ষার আগে কিছু প্রকাশ করবার সাহস আমার ছিল না। আতাউর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পিএইচডি করবার জন্যে আমেরিকা যাচ্ছে। নিজেরা ঠিক করলাম ও চলে যাক, পরীক্ষা হলে আমারও যাবার ব্যবস্থায় বাধা থাকবে না।

    বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আমরা বেশ দূরেই থাকতাম। কখনও বাড়ির গাড়ি, কখনও-বা বাসে আসা যাওয়া করতাম। তখনও পথঘাট এমন শ্বাপদ সঙ্কুল হয় নি। সন্ধ্যা হলে বাবা ক্লাবে যেতেন। আমি আর মা পড়াশুনা করতাম, টিভি দেখতাম অথবা মেহমান এলে আপ্যায়ন করতাম।

    আমি নাকি অসাধারণ সুন্দরী ছিলাম। ঘরে বাইরে সবাই তাই বলত। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি-না, খুঁত নেই আমার কোথাও, দীর্ঘ মেদশূন্য দেহ, গৌরবর্ণ, উন্নত নাসিকা, পদ্মপলাশ না হলেও যাকে বলে পটল চেরা চোখ, পাতলা রক্তিম ওষ্ঠ। একেবারে কালিদাসের নায়িকা! নিজের রূপ সম্পর্কে নিজে খুবই সচেতন ছিলাম। একা এক ঘর লোকচক্ষুর সামনে কেমন করে নিজেকে আকর্ষণীয় করে রাখতে হয় তাও জেনে ফেলেছিলাম যখন যা প্রয়োজন কিনবার জন্যে অর্থের অভাব হতো না। নিজে স্কলারশীপ পেতাম, বড়ভাইও টাকা দিতো আর মা জননী তো আছেনই।

    এমনিই নিস্তরঙ্গ সুখের জীবনে বিক্ষুদ্ধি বাতাস বইতে শুরু করলো, ছ’দফা আন্দোলনকে উপলক্ষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মতৎপর হয়ে উঠলো। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। কিন্তু দু’দফায় আমাদের মতভেদ ছিল না। রাজনৈতিক আন্দোলন ছাত্রশক্তির সহায়তায় তীব্রতর হলো। শুরু হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাবা বড়ভাইয়ের জন্য চিন্তিত হতেন কারণ আগরতলা মামলায় কিছু নৌ-বাহিনীর সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বড় ভাইয়ের জাতীয় চেতনা আব্বার অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু ছাত্র, জনতা, রাজনীতিবিদ সকলের মিলিত আন্দোলনে আইয়ুবের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেল। শেখ মুজিব পেলেন জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন।

    এবার পট পরিবর্তন। আইয়ুব গেল, ইয়াহিয়া এলো, হলো নির্বাচন। নির্বাচন পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিরোধী সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমরা ভাবলাম এবার শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ভুট্টোর মাথায় তখন ষড়যন্ত্রের কুটিল চক্র কাজ করছিল। মদ্যপ দুর্বল ইয়াহিয়াকে হাত করে ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তান ধ্বংসের সুযোগ খুঁজতে লাগলো দুরাত্মার চুলের অভাব হয় না। সুতরাং সংসদ বসলো না। সময় কাটিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলো পাকিস্তান। একমাস বাংলায় চললো অসহযোগ আন্দোলন। সে কি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। তারপর? তারপর ২৫শে মার্চ, জাতীয় ইতিহাসের সর্বাধিক কৃষ্ণরাত্রি। ঢাকার খবর পেলাম। কিন্তু আমরা ঠিক এতোটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আশফাক আব্বাকে আমাদের নিয়ে গ্রামে চলে যেতে বললো। ও ঢাকা থেকেই ফোনে কথা বলছিল। জানালো, ও এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাবে পরে যোগাযোগ করবে। বড় ভাই ভালো আছে। মা আর আমি যতো বিচলিত হলাম আব্বা ততোটা নন। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছিলেন। সবাই তাকে মান্য করে, তার কিসের ভয়? তিনি ভরসা দিলেন কিন্তু মা মেয়ে ভরসা পেলাম না। পরিচিতরা একে একে চলে যাচ্ছে।

    রাহেলার মা অর্থাৎ কাজের মহিলাও চলে গেল। মাফ চেয়ে গেল, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। মা কেন জানি না কিছু বেশি করে কাপড়-জামা ওকে দিয়ে দিলেন। দিনটা তবুও নানা কাজে যায় কিন্তু সন্ধ্যা হলেই যেন অন্ধকার গলা টিপে ধরে। আব্বার ক্লাব নেই, ঘরে টিভি খোলা যায় না, শব্দ যেন আমাদের আরও ভীত সন্ত্রস্ত করে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। হঠাৎ সত্যিই একদিন কৃষ্ণদাসের গরুর পালে বাঘ পড়লো, কিন্তু সে ভর দুপুরে। বেলা ১টা মতো হবে মা আমাদের খাবার ব্যবস্থা করছেন। এমন সময় একটা আর্মি জিপ এসে থামলো। আমার হৃদপিণ্ডের উত্থান পতন যেন আমি নিজে শুনতে পাচ্ছি।

    বাবা দরজার কাছে এলেন, একজন অফিসার তমিজের সঙ্গে আব্বার সঙ্গে করমর্দন করলো। আব্বা তাদের বসতে বললো, কিন্তু তারা বসলো না। বললো, তোমার ছেলে কোথায়? বাবা বললেন, ও তো তোমাদের মতো আর্মির ক্যাপ্টেন, কুমিল্লায় আছে। বাবাকে কথা শেষ করতে দিলো না, হঠাৎ বাবার গালে একটা প্রচণ্ড চড় কষে দিলো। আব্বা হতভম্ব হয়ে বললেন, তোমরা জানো না আমি কে? আমি… কথা শেষ হলো না কুত্তার বাচ্চা’ সম্বোধনের সঙ্গে লাথি খেয়ে বাবা বারান্দায় পড়ে গেলেন! ছুটে গেলেন মা, মাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, হট যাও বুড্ডী। খানসামা আলী এসেছিল, তাকেও টেনে দাঁড় করালো। তারপর স্টেনের আওয়াজ ঠা ঠা ঠ্যা। বাবা, মা, আলীর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে। হতভম্ব আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম, ক্রুদ্ধ মুখগুলো খুশিতে ভরে গেল। আইয়ে আইয়ে করে আমার হাত ধরে ঐ জিপে টেনে তুলে নিয়ে গেল। আমি তখন চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি সজ্ঞানে ছিলাম কি না বলতে পারি না। কিছুক্ষণ পরই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিপটা থেমে গেল। একজন হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে নামালো। আমি কেঁদে উঠলাম। কারণ ও হাত একটু আগেই আমার বাবা মাকে হত্যা করে এসেছে। সোহাগ মিশিয়ে খুনী বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে যত্ন করেই রাখবো। বুঝলাম আমি নিকটস্থ সেনানিবাসে এসেছি সুতরাং ইতরামি হয়তো অপেক্ষাকৃত কম হবে। অফিস ঘরে একদিকে একটা সোফাসেট ছিল, আমাকে সেখানে বসিয়ে দিল। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ঠাণ্ডা কিছু খাবো নাকি? কে জানে, এই মাত্রই তো বাবা মাকে খেয়ে এসেছি তবু সমস্ত গলা বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কে যেন আদর করে সামনে এক পেয়ালা চা দিলো। কোনোমতে কাপ তুলে এক চুমুক চা খেতেই আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো, হড় হড় করে ওদের সুন্দর কার্পেটের ওপর বমি করে দিলাম। এতোক্ষণে সমস্ত শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করলাম ‘সরি’। আমার খেদমতকারীরা কর্তার হুকুমে আমাকে কাছেই একটা ঘরে নিয়ে গেল। একটা ঘরে সম্ভবত একজনকে থাকতে দেওয়া হয়, সঙ্গে বাথরুম। একটু পরে জমাদারণী শ্রেণীর একজন মধ্যবয়সী এলো একসেট কাপড়-জামা অর্থাৎ সালোয়ার কামিজ নিয়ে। কারণ বমি করে সব নষ্ট করে ফেলেছি। আমি গোসলখানায় ঢুকলাম। জমাদারণী বার বার বললো আমি যেন দরজা বন্ধ না করি। তখনও আমার মুখে কথা নেই, শুধু বোব দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললো দরজা বন্ধ করে অনেক মেয়ে মরবার চেষ্টা করেছে তাদের কঠিন সাজা দেওয়া হয়েছে। ভাবলাম দরজা খোলাই বা কি আর বন্ধই-বা কি! উলঙ্গকে নাকি স্বয়ং খোদাও ভয় পান। সুতরাং কে আমাকে ভয় দেখাবে, আমি পারবো কতজনকে ভয় দেখাতে। মাথায় প্রচুর পানি ঢেলে নিজেকে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করলাম। না, আমি মরবো না, মেরে ফেললে কিছু করার নেই কিন্তু আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করবো না। আমি গোসল সেরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বসলাম। মাথা দিয়ে পানি ঝরছে, চিরুনি নেই, হেয়ার ড্রায়ার নেই, একটা শুকনা তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো জড়িয়ে রাখলাম। একটু পরে চিরুনি ও আনুষঙ্গিক প্রসাধন সামগ্রীও এলো। বা! অভ্যর্থনা তা ভালোই হলো।

    রাতে আবার ডাক এলো, বুঝলাম এটা অফিসারস মেস। একই টেবিলে আমাকে খেতে দিল দেখে অবাক হলাম। ধীরে ধীরে কথাবার্তা শুরু হলো। প্রকৃতপক্ষে জীবন কাটিয়েছি আব্বার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে, তাই উর্দু আর ইংরেজি দুটোই আমার আয়ত্বে ছিল। আব্বার পরিচয় নিলো, কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত বলে মনে হলো না। বড়ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলো। সম্ভবত ছোটর সংবাদ এরা জানে না। জানতে চাইলো, ইউনিভার্সিটির কোন শিক্ষক কোন দল করে, কোন হলে কোন দলের ছাত্র থাকে ইত্যাদি। কি উত্তর দিয়েছিলাম তা আর আজ এতোদিন পর মনে পড়ে না। তবে সবই যে উল্টা পাল্টা বলেছিলাম এটুকু মনে আছে। কাঁধের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম এদের দলপতি একজন লেঃ কর্ণেল, বয়স ৪৫ বছরের মতো হবে। সুঠাম দেহ তবে উচ্চারণ শুনে বুঝলাম পাঞ্জাবী। আরেকবার বুকটা কেঁপে উঠলো কারণ এই শ্রেণীকে আব্বা একেবারেই দেখতে পারতেন না। বলতেন অশিক্ষিত, বর্বর, গোঁয়ার। যাই হোক খাবার নিয়ে নাড়াচাড়াই করতে লাগলাম। কি ভাবছিলাম তাও আজ মনে করতে পারি না। কর্ণেল সাহেব আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না, এখানে আমি তোমার দেখৃ ভালো করবো। তবে পালাবার চেষ্টা করলে জানে মেরে ফেলা হবে এটা মনে রেখো। দরজা কখনও বন্ধ করবে না। জমাদারণী রাতে তোমার ঘরে শোবে।

    আমি কোনো কথারই জবাব দিলাম না বা দিতে পারলাম না। জমাদারণীর সঙ্গে। ঘরে ফিরে এলাম। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ আমার বলতে লজ্জা নেই সেদিন আমি মরার মতো ঘুমিয়েছিলাম। একবারও ভাবতে চেষ্টা করি নি বাবা নেই, মা নেই, আমি নিজে অনন্ত দোজখের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। কেন এমন হয়েছিল? মনে হয় আমার বোধশক্তি লোপ পেয়েছিল। আর না হয় সেদিন থেকে নিজেকে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। গায়ে রোদ লাগায় উঠে বসলাম। জমাদারণী একেবারে অনুগত আয়ার মতো নতুন পেস্ট ব্রাশ এগিয়ে দিলো। হাসলাম, এ ধরনের কাজ করবার অভ্যাস তার আছে। মুখ ধুয়ে আসতেই ধুমায়িত চা এলো। বললো, সায়েরা ব্রেকফাস্টে ডাকছে। বললাম, আমার ব্রেকফাস্ট এখানেই নিয়ে এসো। উত্তরে হাসিমুখে সখি বলে, যেমন আপনার মর্জি। কর্ণেল সাহেবের নেকনজরে আছেন আপনি, রানীর আরামে থাকবেন। ভাবলাম পরিণাম যখন এক, তখন রাণীই-বা কি আর জমাদারণীই-বা কি! তবুও সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। কলম পেন্সিল খুঁজলাম। এক টুকরা কাগজ ঘরে নেই। সব প্রকার সতর্কতাই গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া আমিই তো একমাত্র রাজকীয় মেহমান নই। এর আগেও কতো এসেছে কতো গেছে। আল্লাহ্ এই ছিল আমার কপালে! জীবন নিয়ে কতো রঙিন স্বপ্ন দেখেছিলাম ক’মাস পরে আমেরিকা ষাৰাে স্বামীর ঘরে। কতো বড় বড় দেশ দেখবো, জীবন উপভোগ করবো, সন্তানের মা হবো। হাসলাম নিজের মনে, এ যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। এরা যতো শক্তিমানই হোক জয়ী আমরা হবোই। তখন আমি কোথায় থাকবো? তার অনেক আগেই তো আমি ব্যাধিগ্রস্ত শরীর নিয়ে শেষ হয়ে যাবো। এমন কতো যুদ্ধবন্দির কাহিনী পড়েছি, সিনেমা দেখেছি, কিন্তু এমন রানীর আদর, আরাম আয়েস পেয়েছে ক’জন। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবতী।

    আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জমাদারণী জয়গুণ। তাকে বললাম, কর্ণেল সাহেব বদলি হয়ে গেলে আমার কি হবে? যে সাহেব আসবে তুমি তার রাণী হয়ে থাকবে। কেন? আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেনা? ওরে বাপ! সাহেবের বেগমসাহেবাকে আমি একবার দেখেছি। সে মারাত্মক। টের পেলে তুমি, তত তুমি, সাহেবকে গলা টিপে মারবে। বললাম, বেগমসাহেব থাকে কোথায়? জয়গুণ বললো কখনও ঢাকায়, কখনও তার বাপের কাছে ইসলামাবাদে। নিজের অজ্ঞাতে দু’হাত গলায় উঠে থামলো, মনে হলো যেন বেগমসাহেবার চাপে ব্যথা পাচ্ছি। একদিন সন্ধ্যায় কর্ণেল আমাকে নিয়ে খোলা জিপে বেড়াতে বেরুলেন। মনে হচ্ছিল পাশে আতাউর, আমি আমেরিকার কোনও শহরে। খুব ভালো লাগছিল, গুন গুন করে গান গাইছিলাম হয়তো। গাড়ি একটা ছোট দোকানের সামনে থামলো, ছোট ছোট কটা ছেলে যাদের আমরা ঢাকায় টোকাই বলতাম দাঁড়ানো ছিল, হয়তো-বা খেলছিল, মিলিটারী দেখে থেমে গেছে।

    গলা বাড়িয়ে বললাম, কি করছো? ছোট ছেলেটা বললো, বাঙালি, কথা কইস না, হালায় বেবুশ্যে মাগী। কর্ণেল তখন বিস্তৃত দন্তপাটি মেলে হাসছে। ছেলেগুলো দৌড় দিলো কিন্তু আমার সর্বদেহে মনে যে কালি ছিটিয়ে গেল তার থেকে আমি আজিও মুক্ত হতে পারি নি। লেডি ম্যাকবেথের মতো আরবের সমস্ত সুগন্ধি ঢেলেও তো আজ তার অন্তর সৌরভ মণ্ডিত হলো না। সেই ক্ষুদ্র শিশুর চোখে মুখে প্রতিফলিত ঘৃণা আমার রানীত্বকে মুহূর্তে পদদলিত করেছিল। কিছুক্ষণ পর কর্ণেল সাহেব বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। ছেলেগুলো কিছু একটা বলে দৌড়ে পালিয়েছে। তাদের গমন পথের দিকে তিনি জিপ ঘোরালেন। আমি তার হাত চেপে ধরে গাড়ির মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আতাউরকে নিয়ে মুক্তি পাবো এটা ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখি নি। ওই শিশুটি আমাকে বলে গেল, সেটা স্বপ্নই-আমার জীবনে তা অলীক। কারণ ওই স্বপ্ন দেখার অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি।

    ওটা কতো তারিখ কোন মাস মনে নেই। সম্ভবত জুনমাস হবে। দিনটা সত্যিই আমার জন্য অশুভ ছিল। শিষ দিতে দিতে কর্ণেল সাহেব গাড়ি থেকে নামতেই তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হলো। জিএইচকিউ এর গাড়ি দাঁড়িয়ে। অতএব হোমড়া চোমড়া কেউ এসেছেন। আমাকে ইশারায় পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে যাবার নির্দেশ দিলেন। সেই আমার প্রেমিক কর্নেলের সঙ্গে শেষ দেখা এবং প্রেমলীলাও শেষ। হেড কোয়ার্টার থেকে ব্রিগেডিয়ার খান এসেছে। জমাদারণীর সংবাদ। তারপর আমার এ সযত্নে লালিত দেহটাকে নিয়ে সেই উন্মত্ত পশুর তাণ্ডবলীলা ভাবলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমাকে কামড়ে খামচে বন্যপশুর মতো শেষ করেছিল। মনে হয় আমি জ্ঞান হারাবার পর সে আমাকে ছেড়ে গেছে। লোকটাকে এক ঝলক হয়তো ঘরে ঢুকতে দেখেছিলাম তারপর সব অন্ধকার। সকালে মুখ ধুতে গিয়ে দেখলাম আমার সমস্ত শরীরে দাঁতের কামড় ও নখের আঁচড়। কামগ্রস্ত মানুষ যে সত্যিই পশু হয়ে যায় তা আমার জানা ছিল না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ মনে হলো এই টোকাইয়ের কথা বেবুশ্যে মাগী। হ্যাঁ সত্যিই আমি তা, আমার মুখে চোখে সর্বাঙ্গে তার ছাপ। হ্যাঁ শুরু হলো আমার পূর্ণ পতন। এখন সত্যিই আমি এক বীরাঙ্গনা।

    ভোরেই ব্রিগেডিয়ার সাহেব চলে গেছেন কর্ণেলকে বগলদাবা করে। তার প্রেমলীলার সংবাদ পেয়েই ব্রিগেডিয়ার পরিদর্শনে এসেছিলেন। শ্রমের মূল্য উশুল করেই গেলেন। এরপর থেকে শুরু হলো পালা করে অন্যদের অত্যাচার। কর্নেলের ভয়ে যারা আমাকে রাণীর মর্যাদা দিয়েছিল তারা দু’বেলা দু’পায়ে মাড়াতে লাগলো। আমার শরীরে আর সহ্য হচ্ছিল না। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি কুমিল্লা মিলিটারী হাসপাতালে গেলাম। তখন প্রায় বেশির ভাগই মেল নার্স। শুধু রুগিনীদের জন্য কয়েকজন মহিলাকে রাখা হয়েছে বা থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। আমাকে দেখে তারা কষ্ট পেলেন কিন্তু সহানুভূতি দেখাতে সাহস পেলেন না। অথচ তাদের কথাবার্তায় বোঝা যেতো তারা এদের সর্বনাশ প্রতিমুহূর্তে কামনা করছেন। কিন্তু আমার মতো তাদেরও হাত পা বাধা। যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে।

    তবে বাঙালি মহিলাদের দেখলাম এমন কি ডাক্তারও। নাম জানবার চেষ্টা করি নি, পাছে নিজের নাম প্রচার হয়ে যায়। তবে ডাক্তার ও নার্স সহানুভূতি সম্পন্ন হয়ে আমাকে বেশ কিছুদিন রাখলেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আমাকে ঢাকার কাছাকাছি কোনও একটি ক্যাম্পে নিয়ে এলো। বেঁচে গেলাম যে পুরোনো জায়গায় ফেরত পাঠালো না। কিন্তু যেখানে এলাম সেখানে প্রায় কুড়িজন মেয়ে এক সঙ্গে থাকে। এই বোধহয় সত্যিকার অর্থে দোযখ। হঠাৎ একটি মেয়ে মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করলো, রীনা আপা, ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম আমি। কৃশ মলিন মুখ, বড় বড় চোখের মেয়েটিকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরুলো বাঁশি। মেয়েটি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর বাবা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মালী। বাঁশি প্রায়ই আমাদের ফুল দিতো। আমার বুকের ভেতর মুখ রেখে সে কি কান্না। ছ’মাস পর এই প্রথম আমার চোখেও জল এলো। ওকে রাস্তা থেকে জিপে টেনে তুলে এনেছে। ওদের বাড়ির কেউ জানে না। ভেবেছে বোধহয় মরে গেছে। মরে কেন গেলাম না আপা? চাইলেই কি আর মরা যায় পাগলী। আমিই কি মরতে পেরেছি? অন্যেরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। বাঁশি বললো এখানে কথা বলাও মানা। জমাদারণীও খুব বজ্জাত, যখন তখন গায়ে হাত তোলে। শত অত্যাচারের ভেতরও একটা পৃথক ঘরে থাকতে পেরেছিলাম কিন্তু এ কোন জায়গায় এলাম।

    নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চারিদিক থেকে কেবল গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। বাঁশি ফিস ফিস করে বলে, আপা, কম জোরেরগুলো মুক্তিবাহিনীর বুঝলেন? অবাক হয়ে বললাম মুক্তিবাহিনী? হ্যাঁ, আপা, এখন খুব লাগছে। কোনদিন যেন আমাদের এইখানে থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আমার আরও ঘৃণ্য দৃশ্য দেখার বাকি ছিল। দু’দিন পর দেখলাম ওই ঘরেরই একপাশে চার-পাঁচজন উন্মত্ত পশু একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে সবার সামনেই ধর্ষণ করলো। ভয়ে কয়েকজন মুখ লুকিয়ে রইলো, কেউবা হাসছে। মনে হলো এদের বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। যুদ্ধের ন’মাসে আমি যতো অত্যাচার দেখেছি এবং সয়েছি এটিই সর্বাধিক বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক। পশুত্বের এমন তাণ্ডবলীলা আমি আর দেখি নি।

    এখন চারিদিকে কেমন একটা ব্যস্ততার ও সন্ত্রস্ত ভাব। কারণ বুঝি না। এ দিক। থেকে গোলাগুলির শব্দ যেন কমে এসেছে। তারপর একদিন হঠাৎ আমাদের সবাইকে ট্রাকে করে নিয়ে চললো ঢাকা। জিজ্ঞেস করলো, কেউ ছুটি পেতে চায় কিনা। কেউ রাজি না। এতোদিনে এরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে গেছে সবকিছু। বাঁশি বললো, জানো আপা ফালানী নামে একটা মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিরা ওকে চোর মনে করে গুলি করে মেরে ফেলেছে। কি সাংঘাতিক। বশির অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। সবাই মিলে ট্রাকে উঠলাম। বুঝলাম কুর্মিটোলায় এলাম। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কতো এসেছি। আজ তার নাম উচ্চারণ করলে আমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। অফিসারদের কেমন মুখ শুকনো আর জওয়ানরা রীতিমতো ভীত। প্রতিদিন বাইরে থেকে লোক এসে এখানে ভীড় জমাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ ভোর রাতে প্রচণ্ড এয়ারক্রাফট-এর শব্দ। কি ব্যাপার একটু পরেই দ্রুম দ্রাম কোথায় যেন বোমা পড়ছে! সমস্ত শরীর কাঁপছে, সবাই কম্বল জড়িয়ে পরস্পরের গা ঘেঁষে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর এ্যান্টি এয়ার ক্রাফট-এর দ্রিম ভ্রাম শব্দ থামলো। অল ক্লিয়ার সাইরেন বাজালো। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন শুরু হলো আমাদের জল্পনা কল্পনা। এরা তো পালাবে কিন্তু আমাদের মেরে ফেলবে নিশ্চয়ই, না তা করবে না। আমাদের লাশ দেখলে মুক্তিবাহিনী কি ওদের ছেড়ে দেবে। আমাদের আহার নিদ্রা ঘুচে গেল। তাহলে কি সত্যিই মুক্তি আসন্ন। আবার বাইরে বেরুবো, বাড়ি যাবো কিন্তু কোথায় বাড়ি, কোথায় কবর হয়েছিল বাবা, মা ও আলীর। বড় ভাই কি বেঁচে আছে? থাকলে নিশ্চয়ই আমার খোঁজ করবে। আর এই অবস্থা দেখলে পাগল হয়ে যাবে সে। রীনা যে তার কলিজার টুকরা ছিল। ছোটভাই বা কোথায়? বেঁচে আছে কিনা তাই-বা কে জানে। মুক্তির সময় যতো কাছে আসতে লাগলো আমাদের উত্তেজনা ও উদ্বেগও ততো বাড়তে লাগলো। আল্লাহ ওই শুভদিন আর কতোদূরে।

    পরপর কদিন বোমা পড়লো। প্রথম প্রথম পাকিস্তানি বিমান উড়লো, তারপর সব চুপচাপ। মনে হলো এদের আর বিমান নেই। যুদ্ধ শেষ। শুনলাম লে. জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল নিয়াজী ও রাও ফরমান আলীকে নির্দেশ দিচ্ছে। রেডিও থেকে একই কথা ভেসে আসছে। দূরে কামানের শব্দ। ১৬ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলো ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বের কাছে আমাদের বলা হলো নিজ দায়িত্বে বাড়ি চলে যেতে পারো। বেশ কয়েকজন মেয়ে ওই লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আমরা প্রায় জনা ত্রিশেক রয়ে গেলাম সেনানিবাসে। কোথায় যাবো? দেখি বড়ভাই থাকলে আমার খোঁজ নিশ্চয়ই করবে। আর যদি না থাকে তাহলে ঘরে ফিরে আমার লাভ কি! বাবা নেই, মা নেই, ভাইয়া নেই, এ মুখ নিয়ে আমি যাবো কোথায়? আত্মসমর্পণের পরও অস্ত্রত্যাগ করতে সময় লাগলো। কারণ ভারতীয় বাহিনী তখনও এসে পৌঁছায়নি। সামান্য হাজার পাঁচেক সৈন্য কয়েকজন অফিসার টাঙ্গাইলের দিক থেকে এসেছেন। মূলধারা এখনও নরসিংদীতে নদীর ওপারে।

    ধীরে সুস্থে ব্যবস্থা হতে লাগলো। আমাদের অনেকের কাছ থেকেই ঠিকানা চেয়ে নিয়ে বাড়িতে খবর দেওয়া হলো। কারও কারও আত্মীয় স্বজন বাপ ভাই খবর পেয়ে ছুটে এলো। কিন্তু বেশির ভাগই সঙ্গে নিলো না মেয়েদের। বলে গেল পরে এসে নিয়ে যাবে। বাঁশির বাবা এলো, আদর করে বুকে জড়িয়ে বাঁশিকে নিয়ে গেল। যাবার সময় বাঁশি আমাকে সালাম করে বলে গেল ও গিয়েই আমাদের বাড়িতে খবর দেবে, নিশ্চয়ই তারা খবর পায় নি। ভাবলাম কেউ থাকলে তো খবর পাবে। কেন জানি না আমি নিঃসন্দেহ হলাম আমার ভাইয়েরা কেউ বেঁচে নেই, সুতরাং পাকিস্তানিদের সঙ্গে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ মনে হলো সেই পথের পাশের টোকাইয়ের মুখখানা মাগীবেবুশ্যে যেখানেই যাবো ওই সম্বোধনই শুনতে হবে। তার চেয়ে চলে যাই বিদেশে একটা কিছু করে খাবো ওখানে। আর সহজ পথ তো চিনেই ফেলেছি।

    হঠাৎ দুপুরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন শিক্ষিকা এলেন আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে। অর্থাৎ যারা পাকিস্তানে যাচ্ছে ওঁরা তাদের আটকাতে চান। আমাকে অনেক বোঝালেন, আমার কাজের অভাব হবে না, ভাইয়েরা না নিলেও নিজের উপার্জনে নিজে চলতে পারবো। চাকরির দায়িত্ব তাঁরা নেবেন, থাকবার ব্যবস্থাও করবেন। কিন্তু কেমন যেন একটা বিজাতীয় ক্রোধ আমাকে অস্থির করে তুললো। এরা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন সুতরাং বড় বড় কথা বলা এঁদের শোভা পায়। পরে অবশ্য ওঁদের সম্পর্কে শুনেছি। ওঁরা অনেক কষ্ট করেছেন, সগ্রাম করেছেন। এবং সফল হয়েছেন। কিন্তু আমি? আমি তো কোনো কিছু করবার সুযোগ পাই নি। এমন কি আত্মহত্যা করবার সুযোগও আমার ছিল না। আমাকে যারা রক্ষা করতে পারে নি অজি কেন তার আদর দেখাতে আসে। পরে স্থিরভাবে চিন্তা করলাম, না আমার একটা পরিচয় আছে। বাবা-মা না থাকলেও, ভাইয়েরা না থাকলেও আমি তো পথের ভিখিরি না। এখন ফিরে পরিত্যক্ত বাড়িতে উঠলে কেমন হবে। উঠতে পারবো কি, যদি অন্য কেউ দখল করে নিয়ে থাকে তাহলে আমার হয়ে লড়বে কে? না না দেহ-মনের এ অবস্থা নিয়ে আমি ওসব লড়াই ফ্যাসাদে যেতে পারবো না। তবে নীলিমা আপা আমার নাম ঠিকানা সব লিখে নিয়েছিলেন। কেন, তা আমি জানি না। অবশ্য সেদিন যদি ওটুকু লিখে না নিতেন তাহলে আমি চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতাম। না, আমি ওদের কারও কষ্যাতেই রাজি হলাম না। নওশেবা আপার মধুর ব্যবহার আমি এখনও স্মরণ করি। পরে অনেকবার ভেবেছি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবো। কিন্তু কিসের লজ্জা আমাকে বাধা দিয়েছে, দূর থেকে অনেক অনুষ্ঠানে কলিম শরাফীর সঙ্গে ওঁকে দেখেছি কিন্তু আমার বর্তমান চেহারায় আমাকে চিনতে পারা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক ওঁরা দুঃখ নিয়ে ফিরে গেলেন। আমি অপরিচিত অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়াবার প্রস্তুতি নিলাম। তারপর একদিন শেষ বারের মতো চোখের জলে বুক ভিজিয়ে সোনার বাংলার সীমান্ত, এই রক্তখচিত পতাকা সব ফেলে চলে এলাম। ওই পতাকা অর্জনে কি আমার বা আমার মতো যেসব মেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের কোনও অবদান নেই? আজ পথে পথে কতো শহীদ মিনার। কতো পথ-ঘাট-কালভার্ট-সেতু আজ উৎসর্গিত হচ্ছে শহীদদের নামে। শহীদের পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তানেরা কতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা সহানুভূতিই শুধু নয়, সম্মান পাচ্ছে কিন্তু আমরা কোথায়? একজন বীরাঙ্গনার নামে কি একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে? তারা মরে কি শহীদ হয়নি? তাহলে এ অবিচার কেন? বিদেশে তো কতো যুদ্ধবন্দি মহিলাকে দেখেছি। অনায়াসে তারা তাদের জীবনের কাহিনী বলে গেছেন হাসি অশ্রুর মিশ্রণে। তাহলে আমরা কেন অসম্মানের রজ্জুতে বাঁধা থাকবো? এ কোন মানবাধিকারের মানদণ্ড? যেদিন আমার নারীত্ব লুষ্ঠিত হয়েছিল সেদিনও এমন আঘাত পাই নি, যে আঘাত পেলাম বাংলাদেশের পতাকাকে পেছনে ফেলে ভারতে ঢুকতে। ঐ মুহূর্তে আমার চেতনা হলো এ আমি কি করলাম? আজ থেকে আমি পাকিস্তানি নাগরিক! ধিক্কার আমাকে। তিলে তিলে নঈমাস যে নির্যাতন সহ্য করেছি তা সব ধুলোয় লুটিয়ে গেল। না ভারত থেকেই আমাকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমি জানি আজ যদি আমি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বলি এরা আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে তা হলেই তো মুক্তি পাবে। কিন্তু তারপর? সেটা তখন দেখা যাবে।

    মহাসমারোহে বন্দি শিবিরে ঢুকলাম। পাকিস্তানিদের সে কি আনন্দ উল্লাস। বুঝলাম এ ওদের প্রাণে বেঁচে যাবার ফুর্তি। কই আমাকে তো কেউ বাঁচাতে এগিয়ে এলো না। কুমিল্লা হাসপাতালে বাঙালি অফিসার দেখেছি, তারাও তো কখনও আমাকে জিজ্ঞেস করে নি আমি মুক্তি চাই কিনা। যাক অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজের ভাগ্য ও অক্ষমতাকেই ধিক্কার দিই। সাতদিন কেটে গেল কেমন একটা আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে। হঠাৎ একজন লোক এসে বললো, আপনার ভিজিটর এসেছে? আপনাকে ভিজিটরদের রুমে যেতে বলেছে। আমার ভিজিটর? কে হতে পারে? না, না, ভুল আছে কোথাও। লোকটি তাগাদা দিলো, কই চলুন। মাথায় গায়ে ভালো করে দোপাট্টা জড়িয়ে অনিচ্ছুক মনে ক্লান্তু পা দুটোকে টেনে নিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা হেঁটে একটা করিডোরের শেষ মাথায় এসে পর্দা তুলে দাঁড়ালো লোকটি। বললো, যান। পা দুটো আমার মনে হয় মাটির সঙ্গে সিমেন্ট দিয়ে গাখা হয়ে গেছে। সামনে এগুবার বা পেছনে ছুটে পালাবার শক্তি আমার নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ভাইয়া, আমার হাত দুটো ধরতেই ওর বুকে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ভাইয়া, আমি মরে গেছি, আমি মরে গেছি। ভাইয়া শুধু আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো এবং আমাকে প্রাণভরে কাঁদতে দিলো। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে পাশে বসলো। বললো, রিনী, তোকে আমি এখন নিয়ে যাবো। তুই তৈরি হয়ে আয়। বলেই অপ্রস্তুত হয়ে বললো, না থাক যাবার পথে নিউ মার্কেট থেকে তোর জন্যে কাপড় জামা কিনে নিয়ে যাবো। আমাকে কিছু কাগজপত্র এখনই সই করতে হবে তুই চুপটি করে বোস। ভাইয়া টেবিলে বসে থাকা অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বললো এবং কি কি সব কাগজে সই করলো। আমার দুতিনটে কাগজে সই করতে হলো। আমি শুধু ঐ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আমি বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাবো কি? নিশ্চয়ই! উইশ ইউ গুড লাক এ্যান্ড হ্যাপি লাইফ।

    বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিলো ভাইয়া। বললো নিউমার্কেট। আমি শুধু রাস্তা দেখছি, আর দেখছি অগণিত লোকের হেঁটে যাওয়া। ওরা স্বাধীন। ওদের কেউ ধরে নেবে না। হঠাৎ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে বললো, ভয় কিরে? আমি তো এসে গেছি। খোকা (অর্থাৎ ছোট ভাই তোর জন্যে বাড়ি সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। আলী ভাইকে দেখলে চিনতে পারবি না। চমকে উঠলাম, আলী ভাই বেঁচে আছে? আছে, তবে বা পাটা কেটে ফেলেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় হলো। মার্কেটে নেমে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো শাড়ি কিনবি না সালোয়ার কামিজ। স্থির দৃষ্টিতে ভাইয়ার মুখ জরিপ করে বললাম শাড়ি। শাড়ি, জুতো, স্যান্ডেল, প্রসাধনী, চিরুনি, ব্রাশ সব কেনা হলো ভারপর গিয়ে উঠলাম নিউ মার্কেটের কাছে একটা হোটেলে। আমরা পরদিন সকালের ফ্লাইটে ঢাকা যাবো। সারাটা দিন ভাইয়ার সঙ্গে ছোটবেলার মতো ঘুরলাম।

    সিনেমা দেখলাম, প্রচুর গল্প করলাম। ভাইয়া তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলো, থোকা কেমন করে বেঁচে গেছে অল্পের জন্য তাও বললো। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম আমি যে এখানে আছি তুমি কি করে জানলে? ভাইয়ার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বললেন ঢাকায় ভারতীয় মিলিটারীর ব্রিগেডিয়ার ভার্মার কাছে গিয়েছিলাম যদি তোর কোনও খবর পাওয়া যায়। ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক, ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। পরে বললেন, যেসব বাঙালি মহিলা পাকিস্তানি বন্দিদের সঙ্গে গেছে তাদের কিছু হিসাব আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিমের কাছে। আপনি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। গুড় লাক।

    অনেক কষ্টে নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনি তোর নাম শুনে খুবই উত্তেজিত হলেন। বললেন, অনেক চেষ্টা করেছিলাম বাবা, কিন্তু কিছুতেই ওকে আটকাতে পারলাম না। সমস্ত দেশের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে ও চলে গেল। তুমি অশোকের কাছে যাও আমি ওকে বলে দিচ্ছি। ও তোমার বোনকে খুঁজে দেবে। ব্রিগেডিয়ার ভার্মার নাম অশোক। সত্যিই অশোক তার দিদির নির্দেশে আমার জন্য যা করেছে তা বলে শেষ করতে পারবো না রিনী। উনি না থাকলে আমি হয়তো আর তোকে খুঁজে পেতাম না।

    ঢাকাতেও আমরা কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম না। একরাত হোটেলে রইলাম। ভাইয়ার অফিসে যেতে হলো ছুটির ব্যবস্থা করতে। তাছাড়া আমার সম্পর্কেও বাংলাদেশ সরকারকে কি কি কাগজ পত্রদিতে হলো। রাতের ট্রেনে রওয়ানা হলাম। পরদিন নিজেদের বাড়ি।

    সব কিছুই তেমনি আছে তবে সব মানুষ জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছে। আলী ভাই ক্রাচ নিয়ে এসে দাঁড়ালো। গামছা দিয়ে চোখ ঢেকে বললো। এ তোমার কি চেহারা হয়েছে আপামণি। কেন? ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমি তো ভলো আছি। কিন্তু তুমি তো আমার জন্য পা হারালে আমাকে কথা শেষ করতে দিলো না আলী ভাই, মুখ চেপে ধরলো। সবাই মিলে চেষ্টা করে বাড়িটাকে জীবন্ত করে তোলা হলো।

    আব্বা আম্মার জন্য মিলাদ পড়ানো হলো। অনেকেই এলেন, কেউ কথা বললেন না। সবাই বলতে গেলে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেন, আব্বা-আম্মার জন্য দুঃখ করলেন। মহিলারা কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন, আমি সুযোগ দিলাম না। প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখী যে হতে হবে তা বুঝতে পারলাম।

    বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। ভাইয়া আমাকে যাবার জন্য জিদ করলো ‘ বললো তুই স্বাভাবিক না হলে কেউ তোকে স্বাভাবিক হতে দেবে না। আরও যন্ত্রণা বাড়াবে, শেষ পর্যন্ত গেলাম। পুরোনো ক্লাসফ্রেন্ড কয়েক জনের সঙ্গে দেখা হলো। ওরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প করলো। আমাকে বললো, এবার তোর কথা বল? বললাম, আমার কথা? শুনালাম আর সবাই গিললো। সবার অনাবিল হাসি থমকে আবহাওয়া ঠাণ্ডা শীতল। হয়ে গেল। স্যারদের সঙ্গে দেখা করলাম। জুনিয়র স্যার একেবারেই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেন। কিন্তু সিনিয়রদের ভেতর দু’একজন বেশ তীর্যক ভঙ্গিতে চাইলেন এবং বাঁকা প্রশ্ন করলেন। চুপ করে গেলাম। ভাবলাম পায়ের নিচের মাটি শক্ত হোক। তারপর দেখে নেবো। কিন্তু মাটি কি আজও শক্ত হয়েছে।

    গতানুগতিক জীবন কেটে যায়। বাসায় আমি একা, সেই পুরোনো মায়ের আমলের বুয়া আর আলী ভাই। আলী ভাই আমাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখে। ও কেন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেছে। ভাইয়া প্রায়ই আসে। কয়েক ঘণ্টার জন্যে হলেও আমাদের দেখে যায়। একদিন সংকোচ ত্যাগ করে বললাম, ভাইয়া তুই বিয়ে কর। ভাবি এলে আমার এতো একা একা লাগবে না। ভাইয়া হেসে বললো, আমি বিয়ে করলে তোর ভাবি এখানে থাকবে? ও আমার সঙ্গে যেতে চাইবে না? চাইলেও… কথাটা শেষ করতে পারলাম না। ভাইয়া বললো, আগে তোর ব্যবস্থা করি তারপর নিজের। আতোয়ারের সঙ্গে কথা হয়েছে। ও সামারে আসবে তখন সব কথা হবে।

    আপন অলক্ষ্যে আমার ওষ্ঠে ম্লান হাসি দেখে ভাইয়া বললো, না, না, তুই ওকে ভুল বুঝিস না। জবাব দিলাম না। আজ প্রায় পাঁচমাস হলো আমি এখানে এসেছি, ভাইয়ার সঙ্গে তার কথাও হয়েছে অথচ আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করে নি। আমি কিন্তু ওকে চেষ্টা করে ভুলতে বসেছি। কারণ ওকে আমি চিনিঃ ও ভালোমানুষ কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ নয়। ও আমাকে নিয়ে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে না। তবুও ভাইয়ার স্বপ্নটা ভাঙতে ইচ্ছে হলো না।

    সামনে পরীক্ষা, প্রস্তুতি নিলাম। লাইব্রেরিতে এখন আর খুব বেশি যাই না, ঘরেই পড়াশোনা করি। সহপাঠীদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে আসে। তবে আগের মতো কারও সঙ্গেই খোলা মেলা মিশি না, একটু দূরত্ব রেখেই চলি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য কোনও মেয়ে আমাদের বাসায় আসে না। ক্লাশে গেলেও ওরা প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েছি কিন্তু গায়ে পড়ে কথা বলে নি। কিন্তু কেন? আমি ওদেরই মতো একজন, আমার মতো দুর্ভাগ্য তো ওদেরও হতে পারতো। কেউ কেউ ফাঁক পেলে প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে আমার বন্দিজীবনের কথা জানতে চেয়েছে। নিঃসন্দেহে আমি তাদের উপেক্ষা করেছি। এখন আমিও ওদের এড়িয়ে চলি। আমি এমন কোনও কাজ স্বেচ্ছায় করি নি যে ওদের কাছে নতি স্বীকার করে থাকতে হবে। কি আশ্চর্য মানসিকতা। সত্যি লেখাপড়া শিখে বড় চাকুরি করা যায় কিন্তু মনের প্রসারতা বাড়াতে গেলে যে মুক্ত উদার পরিবেশ প্রয়োজন ও তা থেকে বঞ্চিত। তাই ওদের করুণা করলাম মনে মনে, আর সরে এলাম দূরে।

    এরপর এল কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। আতোয়ার এলো। ওর আসবার খবর পেয়েছি। ভেবেছিলাম এসেই ছুটে আসবে আমাদের বাড়ি। কিন্তু না। আমার মনের অস্থিরতা আলী ভাই বুঝলো। বললো, আপামণি, আতোয়ার ভাই আসছে। অতোদূর থিকা আসছে তা একটু ঠাণ্ডা হইলেই আমাগো বাড়ি আসবো। হয়তো তাই, আলী ভাইয়ের কথা সত্যি হোক। তৃতীয় দিন সকালে আতোয়ার এল। আগের থেকে অনেক সুন্দর ও স্মার্ট হয়েছে, সরাসরি ওর সামনে এলাম। আমার জড়তা অনেক কেটে গেছে ওকে বসতে বললাম। কেমন আছ জিজ্ঞেস করলে ও হ্যাঁ অতি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো। বললাম, কাল আসোনি কেন? বললো, তুমি একা থাকো তাই হুট করে আসাটা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম। আমি ওর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর দেয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এলো ও। বললো, কই চা খাওয়াবে না? সঙ্গে সঙ্গে পর্দা ঠেলে আলী ভাই ঢুকলো চায়ের সরঞ্জাম ও কিছু নাশতা নিয়ে। অবশ্য ও দু’হাত ব্যবহার করতে পারে না, তাই সঙ্গে বুয়া।

    আতোয়ার চমকে উঠলো, এ কি? এ তোমার কি হয়েছে আলী ভাই? এই তো কতো মানুষ দ্যাশের জন্য জান দিচ্ছে, আমি একখান মাত্র পা দিলাম। বেদনায় আতোয়ারের মুখ ম্লান হয়ে উঠলো। আমি দুঃখিত আলী ভাই, তোমাকে আঘাত দিলাম। আতোয়ারের রপ্ত করা বিলাতী ভদ্রতা। আলী ভাই কথা বাড়ালো না। তোমরা খাও বলে ভেতরে চলে গেল। আলী ভাইয়ের পায়ের কথা বললে ওর আব্বা আম্মার কথা মনে হয় আর ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আলী ভাই নিজে ওই বাগানের বেড়ার কাছে কবর দিয়েছে তাদের। এক পা টেনে টেনে গোসল করিয়েছে। কবর খুঁড়বার সময় একজন রিকশাওয়ালা ওকে সাহায্য করেছিল। সেই পরে আলী ভাইকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা করেছে। তার নাম সালাম। এখনও আসে। ভাইয়া ওকে জামা কাপড় টাকা পয়সা যখন যা পারে দেয়। ওকি, চা নাও। দেখো আলী ভাই তোমার প্রিয় পাঁপড় ভাজা দিতেও ভোলে নি। সন্ধেবেলা আতোয়ার উঠে গেল। বললো রিনা নদীর ধারে যাবে? মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালাম। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সেই সৌভাগ্য কি আমার সইবে?

    না, বীরাঙ্গনার ভাগ্যে বাংলাদেশের কোনো সুখই সয় নি। অন্তত আমার জানামতে না। দিন সাতেক পর ভাইয়া এলো। সরাসরি আতোয়ারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। আতোয়ার কিছুদিন সময় চাইতেই ভাই স্পষ্ট জিজ্ঞেস করলো, দেখো আতোয়ার আমি স্পষ্ট জবাব চাই তুমি এ বিয়ে করবে কিনা। কারণ যেভাবেই হোক আমি জেনেছি আমার বোনের উপর তোমার দুর্বলতা আছে। তুমি ওকে পছন্দ করতে সেটাও আমি জানতাম তাই তোমাকে কষ্ট দেওয়া। না, না, এ আপনি কি বলছেন। আমি আব্বা-আম্মার সঙ্গে আলাপ করে আপনাকে জানাবো। আব্বা আম্মার সঙ্গে আলাপ-ভাইয়া যেন তিক্তভাবে হেসে উঠলেন। বেশ, করো কিন্তু আমি চারদিনের বেশি থাকতে পারবো না। যাবার আগে তোমার মতামত জেনে যেতে চাই।

    ভাইয়া বেরিয়ে গেল। আতোয়ার হঠাৎ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো ভাইয়ার এমনভাবে আমাকে কথা বলাটা কি ঠিক হলো? বিয়ে করলে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করবো না? ওঁরা যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপত্তি করেন, তাহলে কি করবে তুমি সেটাও ভেবে রেখো। অফকোর্স নিশ্চয়ই ভাববো। তবে আজ তোমাকে একটা কথা বলছি আতোয়ার। স্বাধীনতা তোমাদের অনেক দিয়েছে আর ভাইয়া হারিয়েছে অনেক। সেজন্য ওর মেজাজটা সব সময় স্বাভাবিক থাকে না। সেটা ঠিক, কিন্তু তোমাদের পরিবারে এ দুঃখ দুর্দিনের জন্য তো তোমরা আমাকে দায়ী করতে পারো না? তুমি কি বলছো আতোয়ার, তোমাকে দায়ী করবো কেন, কোনও সৌভাগ্যবানকেই আমরা দায়ী করি না। আমরা সচেতন মন-মানসিকতা নিয়েই এ দুর্যোগে ঝাঁপ দিয়েছি এবং কাটিয়ে উঠবার দায়ও আমাদের। তবে… না ঠিক আছে। আজ এ পর্যন্ত রইল। তুমি যাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাও, যাঁদের অনুমতি নিতে চাও স্বচ্ছন্দে নিতে পারো। তবে আমি তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আমি তোমার কোনও দায় বা বোঝা নই। আমার ব্যাপারে তোমার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই তুমি ভেবে চিন্তেই পা ফেলো।

    শেষ পর্যন্ত আতোয়ার বিয়েতে মত দিলো। ভাইয়া প্রচণ্ড খুশি হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বার বার অভিনন্দন জানাতে থাকলো। আমার খুব লজ্জা হলো। আমি কি এমনই গলগ্রহ? এ কি বোনের বিয়ে, না দায়মুক্তি? না না মনটা আমার খুব ছোট হয়ে গেছে। এসব কি ভাবছি আমি আমার ফেরেশতার মতো ভাইয়া সম্পর্কে। কিন্তু জীবনে যে জটিলতার গ্রন্থি আমি গলায় পরেছি তার থেকে কি সহজে মুক্তি পাবো? আতোয়ার বলতে গেলে গোপনে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। সামান্য ঘরোয়াভাবেই আমাদের বাড়িতে বিয়ে হবে। আমি এখানেই থাকবো। ও গিয়ে কাগজপত্র ঠিক করতে ৬ মাস ৯ মাস যা লাগে তারপর আমি যেতে পারবো ওর কাছে। অবশ্য এ ব্যাপারে আমিও একমত ছিলাম। হৈ চৈ লোক জানাজানি আমারও ভালো লাগছিল না। তবুও ভাবলাম এ গোপনীয়তা ওদের দিক থেকে কেন? এমন কি ওর আব্বা আম্মা তখন ঢাকায় যাবেন ওর বোনের বাড়িতে। তাহলে কি সত্যিই এটা দায়সারা। কেমন যেন দোলায়মান হলো মনটা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো ভাইয়াকে যখন এ কথাটা আতোয়ার বললো। চিৎকার করে উঠলেন ভাইয়া, কেন? গোপন কেন? এ আবার কেমন কথা? একদিন তো সেক্রেটারীর মেয়েকে বিয়ে করবার জন্য তোমার সমস্ত পরিবারের আগ্রহের সীমা ছিল না। আজ বুঝি তিনি নেই তাই? কি ভেবেছো আমাদের? আমাদের দু’ভাইয়ের পরিচয় নেই? আমি কর্ণেল, ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার। তোমাদের থেকে আমরা কম কিসে? তবে যদি মনে করে থাকো আমার বোন উচ্ছিষ্ট তাহলে তোমাকে আমিই নিষেধ করবো এ বিয়ে তুমি করো না। মন পরিচ্ছন্ন করতে পারলে এসো, না হয় এখানেই শেষ। ভাইয়া দু’হাতে মাথা চেপে সোফায় বসে পড়লো। মনে হচ্ছিল আমি চিৎকার করে কাঁদি। কোন অশুভ লগ্নে আমার জন্ম হয়েছিল। পিতা-মাতাকে শেষ করলাম, এখন তো ভাইকেও পাগল বানাতে বসেছি। খোকা নিশ্চল পাথরের মতো ঘরের পর্দা ধরে দাঁড়ালো।

    আমিই শক্তি সঞ্চয় করলাম। সুষ্ঠু বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললাম, আতোয়ার আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। যে পরিবারে আমি জন্মেছি সেখানে অনুদারতা, কাপুরুষতা ঘৃণার বস্তু। আমি তোমায় ঘৃণা করি। হ্যাঁ সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি। তুমি যেতে পারো, ভুলেও কখনো আর এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়াবে না ভালো করে শুনে যাও আমি বীরাঙ্গনা, কখনো ভীরুর কণ্ঠলগ্না হবে না। যেতে পারো তুমি! পর্দা তুলে পাশের ঘরে গিয়ে বাবার বিছানায় শুয়ে ভেঙে পড়লাম। বাবা, বাবাগো। ভাইয়া এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললো, এ তুই কি করলি রীনি? আমিই-বা কেন অমন চালের মতো রেগে উঠলাম বলতো? তোকে দেশে ফিরিয়ে এনে শেষ পর্যন্ত কি তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম? ভাইয়া তুমি থামবে, আমি কি কচি খুকি? নিজের দায়িত্ব নেবার মতো বয়স আমার হয়নি? শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কি আমি অর্জন করিনি? তুমি আমাকে একটু একা ছেড়ে দাও। নিজের কাঁধের বোঝা একটু হালকা করো তো। আমার বিয়ের প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে জানাবো, ফকিরের মতো আমার বর খোঁজার জন্য দরজায় দরজায় হাত পেতো না। ঠিক আছে তাই হবে। বিয়ে প্রসঙ্গ বাদ। এ বাড়িতে স্বইচ্ছায় তুই বিয়ে করবি তারপরই ছেলেদের বিয়ে হবে, রাজি? হাত বাড়িয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম রাজি, রাজি, রাজি। মুখে চোখে পানি দিয়ে খুশি মনে ও খোশ মেজাজে তিন ভাইবোন চা খেতে বসলাম। মনে হলো আলী ভাইও একটু স্বস্তি বোধ করছে।

    দিন যায়, থেমে থাকে না। আমাদের দিনও চললো তবে পথটা আর সরল সহজ রইল না। আমার পরীক্ষার পর এখানে একা বাসায় থাকাটা আর সমীচীন মনে হলো না। এক সময় আতোয়ারের জন্য একটা টান ছিল আমার, এখন তাও ছিন্ন। অবশ্য আরও দু’চার বার সে এসেছিল কিন্তু মেরুদণ্ডহীন পুরুষের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়া কষ্টকর। অবশ্য পরে আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয় নি। হয়েছে বহু বছর পর বিদেশের মাটিতে শ্বেতাঙ্গিনী অর্ধাঙ্গিনীসহ। বাড়ি ভাড়া দিয়ে আলী ভাইসহ ঢাকায় ভাইয়ার বাসায় সেনানিবাসে চলে এলাম। বুয়া চোখের জলে বিদায় নিলো। একটা ঘরে বাবা-মার অনেক জিনিসপত্র বন্ধ করে রেখে দেওয়া হলো। মায়ের সাধের সংসার আর পুত্রবধূর হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারলেন না। পরীক্ষার ফল বেরুলো, মোটামুটি অবস্থান, সেনানিবাসের কাছাকাছি একটা স্কুলে কাজ নিলাম। সকালে ভাইয়া পৌঁছে দেয়, ছুটির পর এক সহকর্মীর সঙ্গে ফিরি। ওরা আমাদের কাছেই থাকে। মিতুও আমারই মতো ভাইয়ার কাছে থাকে। তবে ওর মা আছেন তাই সুখের বন্ধন আছে। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যায়। ওর মাকে খুব ভালো লাগে। খুব স্নেহ করেন আমাকে। মাকে মনে করে চোখে পানি আসে। খোকা চলে যাচ্ছে জার্মানি, হায়ার স্টাডিজের জন্য অথচ ভাইয়া কতো ব্রিলিয়ান্ট ছিল, আমার জন্য কিছু করতে পারলো না।

    মিতুর মেজভাই ডাক্তার। সেও আর্মিতে আছে। পোস্টিং যশোরে। মাঝে মাঝে আসে হৈ চৈ করে চলে যায়। বিয়ের জন্য ওরা মেয়ে খুঁজছে। ওর মা আভাসে আমাকে বোঝাতে চান। কিন্তু ওরা তো জানে না আমি বীরাঙ্গনা নামক এক অস্পৃশ্য চণ্ডালিনী। আমার সব আছে, নেই শুধু সমাজ আর সংসারের বন্ধন।

    হঠাৎ একদিন মিতু ওর ভাই নাসিরকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলো। আমি অপ্রস্তুত। বললাম, একটু খবর দিয়ে এলে কি হতো? মিতু বললো, কেন, পোলাও রান্না করতি? সেটা এখনও করতে পারিস মেজভাইয়ার হাতে অফুরন্ত সময়।

    সেকি? ছুটি নিয়েছে নাকি? নাসির হেসে বললো, হ্যাঁ, মায়ের আদেশে আরও দু’দিন ঢাকায় থাকতে হবে। কার নাকি রংপুর থেকে আমাকে দেখতে আসবে। আমি হাসি চাপতে না পেরে মুখে কাপড় চাপা দিলাম।

    একি হাসছেন যে! বিশ্বাস না হয় মিতুকেই জিজ্ঞেস করুন। মিতু গম্ভীর হয়ে বললো, ঘটনাটা সত্য, কনেপক্ষ জামাই দেখতে আসবে, কানা, খোঁড়া, লুলা, লেংড়া কিনা দেখে তবে ফাইনাল কথা।

    তাহলে মেয়ে আপনার পছন্দ হয়েছে? প্রশ্ন করলাম লজ্জা ত্যাগ করে।

    কেমন করে শুধু তো বাঁশি শুনেছি। রূপগুণের বর্ণনা, বাপের বিষয় সম্পত্তির হিসাব ইত্যাদি ইত্যাদি। বলার ভঙ্গীতে তিনজনেই হেসে উঠলাম। চায়ের জন্য ভেতরে যেতেই মিতু বললো, তোকে ভাইয়ার খুব পছন্দ, তুই সম্মতি দিলে আম্মা তোর ভাইয়ার কাছে কথা পাড়বেন।

    পাগল হয়েছিস? আমি ওসব ভাবিই না। বললাম আমি দ্রুত। তোর কি মাথা খারাপ, বিয়ে তো করতেই হবে। আমিও শিগগিরই চলে যাবো। তাই আম্মা মেজভাইয়ার এখন বিয়ে দিতে চান। মিতু বাগদত্তা। জামাই আবুধাবীতে আছে। তিনমাস পরে এসে রুসমত সেরে ওকে নিয়ে যাবে। বললাম, ব্যস্ত কি? আমায় একটু ভাবতে সময় দে। মিতু গম্ভীর হলো। এর চেয়ে ভালো স্বভাবের ছেলে তুই পাবি না, দেখে নিস। বেশ তো না পেলে তো হাতের পাঁচ রইলই।

    চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বাইরের ঘরে এলাম। নাসির ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। বাবা মার ফটো দেখে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো। বললাম আব্বা, আম্মা একাত্তরে শহীদ, নিজের ঘরের ভেতরেই। চমকে উঠলো ভাই-বোন। এতো বড় খবরটা ওরা জানতো না। পরিবেশটা কেমন যেন বেদনাতুর হয়ে উঠলো। আমি প্রসঙ্গ যত চাপা দিতে চেষ্টা করি নাসির ততোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করে। বললাম, আজ নয় নাসির সাহেব আরেক দিন সময় করে আসুন সব গল্প বলবো আপনাকে। অবশ্য গল্প নয়, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস। মিতুরা ভাইবোন চলে গেল। আমি ভাবনার রাজ্যে ডুবে গেলাম। না, পালানো নয়, লুকানো নয়। আমি খোলাখুলি সব বলবো, তারপর? তারপর আর কি? নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত তো নিয়েই বসেছি। স্বামী, সংসার সন্তান সুখের দাম্পত্য জীবন সেতো আতোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে আমার চৌহদ্দি ছেড়ে পালিয়েছে। দেখাই যাক না নাসির সাহেবের প্রতিক্রিয়া। এখন কিন্তু কষ্ট হয় না, লজ্জা হয় না, অপমানবোধ করি না। উপরন্তু ওই চিকেন হার্টেড় আধা অন্ধ মানুষগুলোর উপর অনুকম্পা জাগে ৷ পরদিন আমাদের ছুটি কি একটা ধর্মীয় পার্বন উপলক্ষে, ভাইয়া অফিসে। রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে বারান্দায় বসে কাগজের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম। খুন, জখম, ধর্ষণ, কুপিয়ে স্ত্রী হত্যা, পুড়িয়ে পত্নী হত্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই ভয় করে, কার ভেতরে কোন পশু জেগে ওঠে বলা যায় না! এর ভেতর রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন হয়ে গেছে। যিনি আমাদের বীরাঙ্গনার সম্মানে ভূষিত করেছিলেন তিনি বীরশ্রেষ্ঠ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিন-চার মাসের ভেতর নানা রকম পট পরিবর্তন হলো। মানুষের লোভ লালসা শুধু অর্থের প্রতি নয়, ক্ষমতার প্রতিও। সব দেখছি আর ভাবছি এই বানরের পিঠা ভাগের জন্য কি ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছিল এ বাংলার মাটিতে। আমার বাবা ও মা কি এদের এই বিশ্বাসঘাতকতার উগ্র প্রকাশের জন্য অমন সুন্দর জীবন উৎসর্গ করে গেছেন? এতো অবক্ষয় এতো তাড়াতাড়ি। অর্থের লোভের চেয়েও ক্ষমতার লোভ আরও বেশি এবং ঘৃণ্য বলে মনে হয়। অনেক সময় আহার্য বা আরামের জন্য মানুষ অর্থলিন্দু হয় কিন্তু ক্ষমতালিপ্স তো শুধু দানবশক্তি লাভের জন্য। ছিঃ! হঠাৎ পেছনে মোটর সাইকেলের শব্দ পেলাম। মুখ ঘুরিয়ে দেখি নাসির। একমুখ হাসি ছড়িয়ে বললো, এসে গেলাম, কাহিনী শুনতে। কাল যে দাওয়াত দিয়েছিলেন মনে আছে? হেসে বললাম, আসুন, দাওয়াত দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু যতদূর মনে পড়ে আজ এবং সকালেই তাতে মনে পড়ে না। নাসির হেসে বললো, সাধে বলে যে মেয়েদের বারো হাত শাড়িতে ঘোমটা আঁটে না, সময় তারিখ না থাকলে আমরা ধরে নিই, এনি ডে, এনি টাইম। কি বসতে বলবেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চলে যাবো?

    আরে না না বসুন। রীনা বিব্রতবোধ করে। অতোদূর থেকে হোন্ডা চালিয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে? চায়ের কথা বলে আসি? বলবেন তবে শুধু চায়ে তো খিদে নষ্ট হবে, সঙ্গে আর কিছু হবে না, নাসির হাসে। সত্যিই আপনি শুধু বেহায়া না পেটুকও।

    রীনা ভেতরে চলে গেল। নাসির গুন গুন করে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভাজতে শুরু করলো। রীনা এলো, নিঃশব্দে বসে পড়লো। নাসিরও স্থির হয়ে বসলো। কই, বলুন সে-সব কথা।

    নিশ্চয় বলবো। তবে আগে চাটা খেয়ে নিন, নইলে হয়তো খাওয়াই হবে না। রীনা চুপ করে রইলো। নাসির বললো, দেখুন আমি গোমড়া মুখ দেখতে ভালোবাসি না। প্লিজ একটু হাসুন। রীনা গম্ভীর মুখে বললো, আপনার ভালোবাসা বা ভালোলাগার ওপর নির্ভর করে আমাকে চলতে হবে নাকি? হতেও তো পারে, কিছু কি বলা যায়? এবার রীনা হেসে ফেললো।

    বুয়া চা নিয়ে এলো। না, না ভেতরেই দাও, আসুন নাসির সাহেব চা খেয়ে তারপর এখানে এসে বসবো। হাসি-গল্পে-ঠাট্টা-তামাশায় চা-পর্ব শেষ হলো। মনে হলো জীবনের দুঃখকে নাসির ঠাই দিতে রাজি না। রীনাও তো একদিন অমনিই ছিল। তারপর কি দিয়ে কি হয়ে গেল। বাইরে এসে বসলো দু’জনে। রীনা শুরু কলো… সব শেষে বললো নাসির, আমি বীরাঙ্গনা, সেটা আমার লজ্জা না, গর্ব। অন্তত নিজের সম্পর্কে এই আমার অভিমত, বিশ্বাস করুন। ভালো কথা, আগ্রহের সঙ্গে বললো নাসির, আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা আর সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাহলে তোমারই-বা অহংকার থাকবে না কেন? লজ্জা? কিসের লজ্জা? লজ্জা তাদের যারা দেশের বোনকে রক্ষা করতে পারেনি? শক্রর হাতে তুলে দিয়েছে। আমাদের এ অপরাধের জন্য আমি সবার পক্ষ থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কি আরও কিছু করতে হবে? নতজানু হয়ে জোড়হাতে দাঁড়ালো নাসির। রীনার দু’চোখের জল গাল বেয়ে নামছে তখন। নাসির তখন গিয়ে ওকে সযত্নে কাছে টেনে নিলো, চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো, তাহলে মাকে বলি আমাদের প্রস্তাব মঞ্জুর? রীনা ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। কিছুক্ষণ পর নাসির চলে গেল। রীনা ওখানে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এ কি সত্যি? তার জীবন এমনভাবে ভরে উঠবে, পূর্ণতা পাবে। এও কি সম্ভব! এর পেছনে আব্বা-আম্মার দোয়া আছে, আর আছে আমার ভাইয়ার সাধনা। আকাশটা যেন আজ বড় বেশি উজ্জ্বল, গাছগুলো সবুজের গর্বে বিস্ফোরিত, বাগানের প্রতিটি ফুল হাসছে, রীনা কি করবে এখন? ফোন এলো, মিতু হেসে গড়িয়ে পড়ছে। বললো, ভাবি কনগ্রাচুলেশন। ফোন ছাড়তে চায় না, ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে ওরা কাল আসবে।

    বিয়ের পর বাসরঘরে ঢুকে নাসির আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে অভিনন্দন বীরাঙ্গনা! লজ্জায় মুখ তুলতে পারি নি। ভাইয়ার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে তার সাধ্যের অতিরিক্ত ব্যয় করে সে বোনের বিয়ে দিয়েছে।

    সহজভাবে জীবন চলেছে। আমি নিঃসন্দেহে সুখী। আমাদের তিনটি সন্তান দুটি ছেলে একটি মেয়ে। মাঝে নাসির দু’বছরের জন্য ট্রেনিং নিতে আমেরিকা গিয়েছিল। আমিও সঙ্গে ছিলাম। আমাকে চাকুরিটা ছাড়তে হয়েছিল কারণ ওর ছিল বদলির চাকুরি। এক সময় কুমিল্লাতেও ছিলাম। হাসপাতালটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। নিজে যে ঘরে যে বেডে ছিলাম, হাত বুলিয়ে দেখলাম। সেদিন ছিলাম বন্দি আর আজ স্বাধীন।

    একটি মেয়ে তার জীবনের যা কামনা করে তার আমি সব পেয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে কিসের অভাব আমার, আমি কি চাই? হ্যাঁ একটা জিনিস, একটি মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ। পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কণ্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যাস্ট্রোফিজিকস : সহজ পাঠ – নীল ডিগ্র্যাস টাইসন ও গ্রেগরি মোন
    Next Article ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.