Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম

    নীলিমা ইব্রাহিম এক পাতা গল্প272 Mins Read0

    ৭. মিনা

    ০৭.

    এ পাড়ার অনেকেই আমাকে চিনতো, চিনতো বললাম এ জন্যে যে, সে আজ বাইশ বছর আগেকার কথা। ‘৬৮ সালে বিয়ের পর আমি এ পাড়া থেকে চলে যাই। মৌচাক মার্কেট থেকে সোজা রামপুরা টিভি ভবনের দিকে মুখ করে সাত আট মিনিট হাঁটলেই দেখবেন হাতের দু’পাশে পর পর বেশ কয়েকটা গলি। ওরই একটাতে আমরা থাকতাম। তখন মিনা বললে ওকে এলাকার সবাই চিনতো। তখন তো ঢাকায় এমন মানুষের মাথা মানুষ খেতো না। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর। আমাদের পৈত্রিক বাড়ি নোয়াখালি। হাসছেন কিনা জানি না ছোটবেলা থেকেই দেশের নামটা বললে মানুষ নানা রকম মুখভঙ্গী করে। মা ফরিদপুরের মেয়ে। ওরা দুজন কেমন করে যে এতোটা পথ অতিক্রম করে এক সূত্রে বাঁধা পড়লেন তারও ইতিহাস আছে। দাদু আর নানা দুজনেই ঢাকায় কালেকটারিয়েটে চাকুরি করতেন। থাকতেন অল্প ভাড়ায় শহর থেকে দূরে, এখানে ছোট একতলা বাড়িতে। তাদের ঘনিষ্ঠতা অতি সহজে আমার বাবা মাকে এক করেছিল। আমরা দুই বোন এক ভাই। ভাই বড়, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তখন কমার্স নিয়ে পড়ে, আমি মেজো, বিয়ের সময় সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে বিএ পড়ি। বেশ ধুম ধাম করেই সাধ্যাতীত খরচ করে বাবা প্রথম মেয়ের বিয়ে দিলেন। স্বামী হাসনাত তখন অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করতেন। খুব তুচ্ছ চাকুরি নয়। আমাদের সংসার চারজনের মোটামুটি ভালোই চলে যেতো। সত্তর সালে আমার প্রথম মেয়ে ফাল্গুনীর জন্ম হয়। পরিবারের প্রথম সন্তান। আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল সবার জীবনে। বাবা একেক দিন অফিস ফেরত সেই সদরঘাট থেকে ফার্মগেট চলে আসতেন। নাতনিকে আদর সোহাগ করে চলে যেতেন। আমার শাশুড়ি খুব খুশি, রোজ রোজ বেয়াইয়ের দেখা পাচ্ছেন। আমার শ্বশুর মারা গেছেন প্রায় বছর দশেক আগে। বাচচা থাকতো তার দাদির কাছে। আমাদের সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কোনোটারই কমতি ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। গণ-অভ্যুত্থান বিস্ফোরনুখ আগ্নেয়গিরির আকার নিলো। তবুও বেশ একটা আনন্দে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবে।

    কিন্তু ২৫শে মার্চের রাতে সকল মজার সমাপ্তি ঘটলো। ২৬শে সবাই ঘরে বন্ধ। স্বামী ২৫শে মার্চ ঢাকায় আসেন নি। গাজীপুরে রয়ে গেছেন। ২৭শে মার্চ সকাল থেকে লোকের মুখে মুখে এমন সব খবর আসতে লাগলো যে ভয় হলো, ফাল্গুনীর আব্বা বেঁচে আছে তো? শাশুড়ি কেঁদে কেঁদে বিছানা নিলেন। বাবা-মার খবর নেই। কে যোগাযোগ করবে। তরুণ ছেলেকে পথে বের করলে মিলিটারী গুলি করে মারবে। ওঃ সে কি দোজখের যন্ত্রণা! তিনদিনের দিন হাসনাত ফিরে এলো। ফ্যাক্টরী আক্রান্ত। অনেকে মারা গেছে। আল্লাহর মেহেরবান যে ও ফিরে আসতে পেরেছে। আমার ফাল্গনীর কিসমতে ওর আব্বা বেঁচেছে। চারদিন পর আব্বা এলেন। বড় ভাইয়ের খবর পেয়েছেন লোক মারফত, সে এখন বাড়িতে আসবে না। এলেই বিপদ, তাই আব্বা মাকে আর মুন্নীকে নিয়ে দেশে চলে যাচ্ছেন। তিনি এসেছেন আমাদের নিতে। কিন্তু আমার শাশুড়ি ছেলেকে রেখে যেতে কিছুতেই রাজি হলেন না। দশ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। এই ছেলে দুটি নিয়ে তার জীবন। বললেন, বেয়াই সাহেব, আপনি আমিনাকে আর ফারুনীকে নিয়ে যান। বাবা উত্তর দিলেন, ঠিক আছে। আপনি হাসনাতকে বলুন, আমি এখনই ওদের নিয়ে যাবো। কিন্তু আমার স্বামী কিছুতেই আমাদের যেতে দিলেন না। বাবার সঙ্গে অযৌক্তিক তর্ক করলেন। মিলিটারীরা নাকি তিনদিনে সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। শেখ মুজিব বন্দি, তার সঙ্গী-সাথীরা হয় মরেছে

    হয় পালিয়েছে। আপনি আম্মাকে নিয়ে দেশে যান। প্রয়োজন হলে আমরা পরে যাবো। তখন কি যাবার সুযোগ পাবে বাবা? না পেলে যাবো না। বাবা আর কথা বাড়ালেন না। হাতটা তুলে আমার শাশুড়িকে সালাম জানালেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হঠাৎ বাঁ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবার অভিজ্ঞতায় বাবা বুঝেছিলেন সেই আমাদের শেষ দেখা। ওরা শহর রাখবে না। আর বাবা মার খবর পাই নি। মাসখানেক আমরা ওভাবেই রইলাম। আমার দেওর ও স্বামী ঘর থেকে বেরুতো না। ঘরে যা ছিল তার থেকে অল্প অল্প করে দিন চলে যাচ্ছিল।

    দিনটা একভাবে কাটে। কিন্তু রাত হলেই গা ছম ছম করে। এক মাস পার হতেই প্রায় রোজই ফার্মগেটে গোলাগুলি হতো। আমরা থাকতাম ইন্দিরা রোডে, একটু ভেতরে, তাই সুস্পষ্ট কিছু বোঝা যেতো না। তবে মাঝে মাঝে মনে হতো গুলি দু’পক্ষের। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো। সে-বার বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে বৃষ্টিও হয়েছিল অসম্ভব রকম। সারারাত মনে হয় কান খাড়া করে বসে কাটাতাম। আস্তে আস্তে লোকজন চলাচল শুরু হলো। আমার স্বামীর অফিস থেকে তলব এলো। আমরা শাশুড়ি-বৌ অনেক নিষেধ করলাম। কিন্তু ও শুনলো না। পরদিন ফিরে এসে বললো, না অথারিটি ঢাকায় থাকতে দেবে না। এখানেই থাকতে হবে, ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো। শাশুড়ি এবার বেঁকে বসলেন। উনি বিরক্ত হয়ে একাই চলে গেলেন। আমি শাশুড়ির ওপর অসন্তুষ্ট হলাম। মনে মনে ভাবলাম, ভদ্রমহিলা তার ছোট ছেলের নিরাপত্তার কথাই ভাবলেন। অনুদাতা বড় ছেলের দিকটা একটুও চিন্তা করলেন না। উনি মাসের প্রথম দিকে এসে মাইনের টাকা দিয়ে যান এবং একরাত থেকেই পরদিন গাজীপুর ফিরে যান। গোলাগুলির শব্দ এক রকম গা সওয়া হয়ে গেছে। এর ভেতর একদিন কি জানি কি হলো। বাড়ি ঘরের দরজা ভেঙে অল্পবয়সী ছেলেদের ধরে নিয়ে গেল। এবার ভয় পেলাম। এর ভেতর আজ দু’তিন দিন ফাল্গুনীর খুব জ্বর। ডাক্তার ডাকতে পারছি না। বেরুতেই ভয় করে। কিন্তু সেদিন দুপুরের পর সে হঠাৎ ফিট হয়ে গেল। এখনও তার বয়স দু’বছর হয় নি। আমি পাগলের মতো দৌড়ে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে কাছেই বড় রাস্তার উপর একটা ডিসপেনসারিতে ঢুকলাম। কপাল ভালো ডাক্তার ছিলেন। সিস্টার ওকে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো। ঠিক এই সময়ে হঠাৎ রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ হলো। দু’তিনটা জিপ এসে থামলো। ডাক্তার রোগী দেখছে দেখে হঠাৎ আমার হাত ধরে টান দিলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। ডাক্তার কিছু বলবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ততোক্ষণে দু’তিন জনে কিল, লাথি, থাপ্পড় দিয়ে আমার চুল ধরে আমাকে জিপে নিয়ে তুললো। ‘তিন দিন অচৈতন্য পড়ে রইলাম। জ্ঞান এলে ভাবি আমার ফাল্গুনী কি বেঁচে আছে। যদি মার্চ মাসে বাবার সঙ্গে চলে যেতাম তাহলে তো এমন হতো না। শুধু হাসনাতের গোয়ার্তুমির জন্য আমাদের মা মেয়ের প্রাণ গেল।

    শুরু হলো অত্যাচারের পালা। শকুন যেমন করে মৃত পশুকে ঠুকরে ঠুকরে খায় তেমনি, কিবা রাত্রি কিবা দিন আমরা ওই অন্ধকার দোজখে পচতে লাগলাম। মাঝে মাঝে তারা ওপরে ডাকতো আমাদের। আমরা গোসল করতাম, কাপড় বদলাতাম তারপর আবার অন্ধকূপে। কারা আমাদের উপর অত্যাচার করতো, তারা বাঙালি না বিহারি, পাঞ্জাবি না পাঠান কিছুই বলতে পারবো না। ব্যাধিগ্রস্ত হলে তাকে নিয়ে যেতো। ভাবতাম যখন রোগে ধরবে অন্তত সেই সময়ে তো বাইরে যেতে পারবো, হাসপাতালে নেবে। পরে জেনেছি, হাসপাতালে নয় চিরকালের জন্য আলো হাওয়া দেখিয়ে দিতো। অর্থাৎ নির্বিচারে হত্যা করতো। মুক্তির পর অনেক মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে যাদের পেট চেরা, চোখ তোলা ইত্যাদি অবস্থায়। বুঝতে পারছেন কি অত্যাচার গেছে সেখানে। আমি এসেছি আগস্টে অর্থাৎ অনেকের তুলনায় অনেক দেরিতে। ফিস ফিস করে কথা বলতাম, বিভীষিকাময় কাহিনী শুনতাম। একমাত্র বাইরের ব্যক্তি আসতো জমাদারণী। সে কিছু সত্য কিছু কাল্পনিক কাহিনী শুনিয়ে যেতো। নানা রকম উপদেশ দিতে যাতে সহজে বাচ্চা না আসে। কারণ যদি বাচ্চা পেটে আসে আর ওরা যদি জানতে পারে তাহলে তো অমন করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খেলতে খেলতে মেরে ফেলবে। আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখে সয়ে গেল। আবছা আলোতেও অন্যকে দেখতে পেতাম, চিনতে পারতাম। মেরী নামের একটি ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের সঙ্গে এর ভেতরেই আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। ও কলাকোপ বান্দুরার মেয়ে। চন্দ্রঘোনা হাসপাতালে নার্স ছিল। খাবার দেবার সময় হঠাৎ করে একটা জোরালে বাতি জ্বালাতো ফলে সবাই দু’হাতে চোখ ঢাকতাম, অনেকক্ষণ কিছু দেখতে পেতাম না। চোখের সামনে নীল নীল গোল বলের মতো ঘুরে বেড়াতো। বুঝতাম বেশিদিন এভাবে থাকলে অন্ধ হয়ে যাবো। কেনই-বা আমাদের এভাবে রেখেছে? পরে জেনেছিলাম বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের এনে দেখাতে মেয়েদের ওপর অত্যাচার মিথ্যা কথা, কারণ ছাউনিতে কোনো মেয়েই নেই। অথচ আমরা অসংখ্য মেয়ে তখন ভূ-গর্ভের বাংকারে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি।

    হঠাৎ করে গোলাগুলির আওয়াজ বেড়ে গেল। জমাদারণী বললো, সারাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে আর পাকিস্তানিরা হেরে গিয়ে ঢাকায় এসে জমা হচ্ছে। ঢাকা শহরেও মুক্তিবাহিনী ঢুকে গেছে। ততোদিনে মুক্তিবাহিনীর নাম ও তার সংজ্ঞা আমার জানা হয়ে গেছে। বিশ্বাস হতো না, এতো কামান বন্দুকের সঙ্গে বাংলাদেশের খর্বাকার, কৃশ, অনাহারক্লিষ্ট যুবকেরা যুদ্ধ করছে। আর কি হচ্ছে তাতো জানি না। হঠাৎ বোমা পড়তে শুরু করলো। সে কি শব্দ! মাটি কেঁপে কেঁপে উঠলো। ভাবলাম সবাই মিলে মাটি চাপা পড়ে এখানেই মরে থাকবো। কোন দিন কোন সময়ে আমাদের কঙ্কালগুলো আবিষ্কার হবে। পাঁচ দিনের ভেতর সব শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। দিন-রাত শুধু গাড়ির শব্দ আর ওপরে লোকজনের আনাগোনা। আস্তে আস্তে শব্দ, চলাফেরা সবই কেমন যেন স্তিমিত হয়ে উঠলো। আমাদের দিন-রাতের অতিথিরা অনুপস্থিত। মেয়ে মানুষের রুচি অন্তর্হিত হয়েছে। এখন সম্ভবত জান বাঁচাবার চিন্তা। জমাদারণী বললো, পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করবে। কিন্তু আমাদের? আমাদের কি হবে? বেঁচে গেলে আর কি! কেন আমাদের মেরে ফেললো না? আর মারা হবে না। যদি মুক্তি এসে দেখে তোমাদের মেরে ফেলেছে তাহলে তো ওদের কচু কটা করবে। একটু ধৈর্য ধরো। সবাই বেরুতে পারবে।

    সত্যিই একদিন সব চুপচাপ হয়ে গেল। আমাদের বাইরে ডাকা হলো। কোথায় নেবে? সেই জোরালো বাতিটা জ্বলে উঠলো। কে একজন বললো, বাহার আইয়ে মাইজী, মা আপনারা বাইরে আসুন। কি শুনছি আমি, আমাকে ‘মা’ সম্বোধন করছে। আর চারমাস আমি ছিলাম কুত্তী, হারামী, হারামজাদী, বন্যজীবের চেয়েও ইতর। হঠাৎ এভো আপায়ন। মানুষকে বিশ্বাস করতে ভুলে গেছি। ভাববার সময় নেই। হাত ধরে ধরে আমাদের কংকালসার দেহগুলোকে মনে হয় যেন টেনে বের করলো। কেউ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, কেউ বোকার মতো কেউ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হেসেই চলেছে। আমাদের সবাইকে একটা ঘরে নিয়ে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলাতে বলা হলো। আমরা এতোদিনে সেপাইদের মতো হুকুম মানতে বাধ্য হয়ে গেছি। আচরণ করেছি পোষা কুকুরের মতো, এরপর খেতে দেওয়া হলো রুটি মাখন কলা। যন্ত্রের মতো কম বেশি সবাই খেলাম তারপর পাশেই একটা অফিস ঘরের মতো জায়গায় নিয়ে একে একে আমাদের নাম ঠিকানা নিলো। যাদের ঢাকায় ঠিকানা আছে তাদের ঢাকা ও গ্রামের দুটো ঠিকানাই নিলো। কেউ কেউ নিজের দায়িত্বে চলে গেল। আমরা ওখানেই রইলাম তিনচার দিন। যাদের বাবা নিতে এসেছেন তাদের ভেতর কয়েকজন বাবার সঙ্গে চলে গেল। মেরীকে নিয়ে গেলেন তেজগা থেকে আসা একজন সিস্টার। সিস্টার ঠিক মায়ের মতো মেরীকে জড়িয়ে ধরে সান্তুনা দিলেন। মেরীর সঙ্গে আমার আবারও কয়েকবার দেখা হয়েছে। ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ওর নিজের পেশায় নিযুক্ত আছে। বিয়েও করেছে একজন ব্রাদারকে। স্বপ্ন দেখছিলাম, হঠাৎ একজন বাঙালি অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় যেতে চাই। আমি মাস দু’য়েকের অন্তঃসত্ত্বা। বললাম, আমাদের মতো মেয়েদের জন্য আপনারা কি কোনো আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছেন? নিশ্চয়ই, আপনি সেখানে যেতে চান? ঘাড় নাড়লাম। এই দেয়ালের বাইরে যেতে চাই আমি। এতো মূল্য দিয়ে কেনা স্বাধীন বাংলার বাতাস বুক ভরে নিয়ে দেখতে চাই, কেমন লাগে। ধানমন্ডি এলাম, ওখানে ডাক্তার নার্স সবাই আছেন। আমাকে দেখে বললেন, তুমি গর্ভবতী, আমরা গর্ভপাত করাবো। তোমার সম্মতি আছে। উত্তেজিত হয়ে বললাম, ডাক্তার সাহেব এখনই করুন। সস্নেহে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোমাকে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। তুমি খুব দুর্বল, একটু খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নাও। ঠিক হয়ে যাবে। বললাম, ডাক্তার বাড়িতে আমার ফাল্গুনী নামে মেয়ে আছে, আমাকে দয়া করুন। তোমার মেয়ে আছে, আচ্ছা দেখি। তারপর এক সিস্টারকে ডেকে বললেন, সিস্টার মাথার চুল কেটে ভালো করে স্যাম্পু করে দিন। এতো বড় চুল কিন্তু এটা তো জট পাকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। সম্ভবত মাথায় ঘাও হয়ে গেছে। একটু যত্ন করে ওর ব্যবস্থা করে দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলাম। কাটা চুলের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সত্যিই আমার বড় বড় চুল ছিল। একদিন হাসনাত জিদ ধরলো আমাকে খোঁপা বেঁধে দেবে। চিরুনি ব্রাশ আর আমার চুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক গোছা চুল ছিঁড়ে তবে থামলো। ওঃ ভাবতেও মাথাটা টন টন করে উঠলো। এই ববকাটা মেমসাহেবী মাথা দেখে কি ও রাগ করবে, না ঠাট্টা করবে। নিজের মনেই একটু হাসলাম। দশদিন পর আমার গর্ভপাত করানো হলো। তিনমাস হয়েছিল। আল্লাহ্ আর একমাস দেরি হলেই তো ওবা বুঝতে পারতো আর আমাকে বাইরে নিয়ে কি করতো? অস্কুট চিৎকারে মুখ ঢাকলাম। সিস্টার দৌড়ে এলেন কি হয়েছে? চোখের পানি মুছে বললাম, কিছু না। এরপর সাতদিন বিশ্রাম নিয়ে পথে পা দিলাম! টাকা চাইতেই পেলাম। ওরা বলে দিলেন বাসা খুঁজে না পেলে যেন ফিরে আসি, ওরা ব্যবস্থা করে দেবেন। বাসার সামনেই রিকশা থেকে নামলাম। কেউ তাকিয়ে দেখলো না। দরজার কড়া নাড়লাম। আম্মা দরজা খুলে দিয়ে এক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম, ফাল্গুনী? আমি তো জানি না ও বেঁচে আছে কিনা, কার কাছে আছে? মা বললেন, ও ভালো আছে চাচার সঙ্গে বেড়াতে গেছে। মা চা আর মুড়ি খেতে দিলেন। বহুদিন পর তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। বললেন, যাও তোমার ঘরে যাও, গোসল করে কাপড় চোপড় বের করে পরে নাও। মাথার দিকে তাকাতেই বললাম, খুব অসুখ করেছিল আম্মা, হাসপাতালে মাথায় পানি দেওয়ার জন্য চুল কেটে দিয়েছে। আহা, কি হাল হয়েছে আমার মায়ের। আম্মা আমার বাবা-মা তো সবাই ভালো আছে? ওরা তো আর গ্রাম থেকে ফিরে আসেন নি। তোমার মা তো ভাত-পানি ছেড়েছেন তোমার জন্য। ছোট খোকা এলেই ওদের খবর পাঠিয়ে দেবো। ফাল্গুনীকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাপ দিলো না। মিনার মনে হয় একবার ছুটে যায়। তাদের ঐ ছোট বাড়িটায় যেখানে হাসি আনন্দ ছাড়া দুঃখ সে কখনও দেখে নি, আজ তার জন্য মা মরতে বসেছে। মা’তো জানে না তার মেয়ে কতোবার মরেছে আর কেমন লাশ হয়ে ফিরে এসেছে।

    অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলো মিনা। নিজের পছন্দ মতো শাড়ি, ব্লাউজ পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বসেছে এমন সময় ফাল্গুনী এলো চাচার সঙ্গে। প্রথমে সে মাকে চিনতে পারে নি। কোলে যাবে না। কান্না জুড়ে দিলো। তারপর বোধাদয় হলো। ফাল্গনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাবলাম আল্লাহ্ ওর জন্যেই তুমি আমাকে ফিরিয়ে এনেছো। লক্ষ শোকর তোমার কাছে। বহুদিন পর একসঙ্গে ভাত খেলাম সবাই। আম্মা, কাল থেকে আবার আমি রাধবো, কতো কষ্ট গেছে আপনার। মাগো এ কষ্টের জন্য শরীর ভাঙেনি, দিনরাত তোমার কথা ভাবতে ভাবতে একেক সময় মনে হতো আমি কি পাগল হয়ে যাবো। যখন তিনমাস পার হয়ে গেল, তখন বুঝলাম তুমি আর নেই। যে দিন দেশ স্বাধীন হলো সেদিনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়েছিলাম। যদি তোমাকে বন্দি করে রেখে থাকে তাহলে অন্তত ফাল্গুনীর জন্যেও তুমি ছুটে আসবে। বুড়ো আম্মাকে ভুলে থাকলেও ওকে কি ভুলতে পারো? শাশুড়ি বউ দুজনেই গলাগলি হয়ে তিনমাসের জমাট বরফ গলিয়ে বুক হালকা করলাম। তখনও কি ছাই জানি এরপর বুকে বরফ যেন কাঞ্চনজঙ্গার মতো জমে থাকবে।

    হাসনাত এখন বাড়ি থেকেই যাতায়াত করে। সেও গাজীপুর থেকে পালিয়ে একটা গ্রামে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ফিরে এসেছে। এই বিরানপুরীতে আমি আর ছোট খোকা না খেয়ে না ঘুমিয়ে দিন কাটিয়েছি বৌমা। ওঃ! তাহলে বীরপুরুষও পালিয়েছিলেন! শুধু জিদ করে আমার কপালটা পোড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নড়ে উঠলো, ভয়ে আশংকায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আম্মার গলা শুনলাম, বললেন, বড় খোকা দেখো কে এসেছে। দু’পা এগিয়ে আমাকে দেখে হাসনাত ফেটে পড়লো। বললো, তুমি এখানে কেন? মরবার জায়গা পাওনি? ঐ তো ধানমন্ডি লেকে কতো পানি, যাও। কোন সাহসে তুমি আমার বাড়িতে ঢুকেছে। আম্মা ওর মুখে হাত চাপা দিতে গিয়েছিলেন। ও ধাক্কা দিয়ে আম্মাকে ছোট খোকার গায়ের ওপর ফেলে দিলো। ভয় পেয়ে ফাল্গুনী মা, মা চিৎকার করে আমার দিকে হাত বাড্রালো। এক হেচকা টানে হাসনাত মেয়েকে সরিয়ে নিলো। না ও তোর মা নয়, ও এক ডাইনি, আমাদের খেতে এসেছে। এতক্ষণে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলাম। কাপুরুষ, লজ্জা করে না তোমার আমাকে এ কথা বলতে। কেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে? বলো, জবাব দাও? তারপর চাকুরি রক্ষা করতে ছুটলে গাজীপুর। সেখান থেকে শেয়াল কুকুরের গর্তে। ঘরে বুড়ো মা, শিশু কন্যা, স্ত্রী, যুবক ভাই সব ফেলে কেমন নিশ্চিন্তে দশ মাস কাটিয়ে এলে। ওই সময় কি করেছো না করেছো আমরা জানি? রাজাকার হয়েছিলে কিনা তাও তো বলতে পারবো না। যখন বিয়ে করেছিলে, আমার হাত ধরেছিলে, তখন কেন এ দায়িত্ব নিয়েছিলে? তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো, কিন্তু আমি তোমাকে ঘরে থাকতে দেবো না। হঠাৎ ঘুরে ফাল্গুনীকে কোলে নিয়ে আমি বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। হাসনাত আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে মেয়েকে কেড়ে নিলো। ছোট খোকা আমার হাত ধরে রাস্তায় পা দিলো। ওর মুখে কথা নেই, কিন্তু হাতটা শক্ত করে ধরা। রিকশা ডাকতেই আমি চোখ মুছে বললাম, ভাই আমি কিন্তু বাবার কাছে যাবো না। ছোট খোকা মাথা নিচু করে বললো, না ভাবি আমি তোমাকে সেখানে নেবো না। চলো ধানমন্ডি পৌঁছে দিয়ে আসি তোমাকে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করে জানলে আমি ওখানে আছি। বিব্রত ছোট বললো, ওখান থেকে ভাইয়ার নামে চিঠি এসেছিল। আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলাম। ওরা বললো তুমি হাসপাতালে অসুস্থ। তাই আর দেখা করে আসতে পারি নি। ভাবি আমি একটা চাকুরি পেলেই তোমাকে নিয়ে আসবো। যেমন চাকরিই হোক, পাবো নিশ্চয়ই একটি না একটি। ফাল্গুনীর জন্য ভোে না খালাম্মার কাছে ওকে রেখে আসবো। মুন্নী আছে, আমি আছি। মার জন্য বাড়ি থেকে চলে যেতে পারি, না হলে ভাইয়ার সঙ্গে এ বাড়িতে থাকতে আমার রুচি হয় না। বলতে বলতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। ও মাঝে মাঝে আমার খবর নেবে। আর মনে চাইলেই বাসায় যেতে বললো। আজ হঠাৎ ও কিছু বুঝতে পারে নি। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন আর হবে না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো ভাবি। ওর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে মুখ ঢেকে দোতলায় উঠে গেলাম।

    আশ্চর্যজনকভাবে রাতে ভালো ঘুম হলো। আগস্টের পর থেকে এমন নিশ্চিন্ত ঘুম আমি একরাতও ঘুমাই নি। সকালে শরীরটা খুব হাল্কা মনে হলো। মনে হয় সব বন্ধন আমি ছিন্ন করে এসেছি। আমি মুক্ত। আমি আমার নিজের। হয়তো বাবা-মায়ের ওপর অবিচার করলাম। কিন্তু নিজের স্বার্থে আমি মুন্নীর সর্ব সুখ বঞ্চিত করবো কেন? পরে অবশ্য বড়ভাই নিয়মিত এসেছেন, প্রয়োজনে আমাকে সাহায্যও করেছেন অনেক।

    আমি সরাসরি মোসফেকা আপার সঙ্গে দেখা করে সেক্রেটারিয়েল ট্রেনিং ক্লাসে ভর্তি হতে চাইলাম। আমি বিএ পাশ শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বললাম, প্রয়োজনে আমি আপনাকে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে সার্টিফিকেট এনে দেবো। উনি বললেন, শুধু বিএ রোল নাম্বার ও বছরটা দিয়ে দাও আমরাই সার্টিফিকেট নিয়ে নেবো। তুমি গেলে দেরি হবে। ভর্তি হয়ে গেলাম। বেইলী রোডে ক্লাস করতে আসতাম। আরও তিন-চারটি মেয়ে ছিল তারা সবাই মেট্রিক পাশ। দশমাস সময় কেটে গেল। কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আমি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকুরি পেলাম। বেতন মোটামুটি মন্দ নয়। উন্নতির সুযোগ আছে। বেতন পাবার পর আপাকে ধরে আমি বেইলী রোডে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে এলাম। আশ্চর্য! এখানে কোনও মেয়ে কোনও দিন বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখায় নি আমার অতীত নিয়ে। সবাই কর্মরত তবুও এর ভেতর আমরা গল্প গুজব করতাম, পাশের মহিলা সমিতিতে গিয়ে নাটকও দেখতাম। শাড়ি কিনতে যেতাম। ১৯৭৫ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে বত্রিশ নম্বর গিয়েছিলাম। সবার মাথায় হাত দিয়ে তিনি দোয়া করলেন। অবশ্য আমি নিজেই নিচু গলায় বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমরা বীরাঙ্গনা। আরে তাইতো তোরা আমার মা। আজও সেই কণ্ঠস্বর, সেই উন্নত মস্তিষ্ক, প্রশস্ত ললাট আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ যেন আমার অন্তরে চির ভাস্বর। হারিয়ে গেলেন আমার পিতা যিনি আমাকে দেবীর সম্মান দিয়েছিলেন। আজ মনে হয় এ মাটিতে দয়াদ্ৰহৃদয়, উদার চেতা, পরোপকারীর ঠাঁই নেই। স্বার্থান্ধের হাতে তার নিধন অনিবার্য।

    হায়দার অর্থাৎ আমার দেবর, ছোট খোকা, বিকম পাশ করলো বেশ ভালোভাবে? আমার ব্যাংকের কর্তৃপক্ষকে ধরলাম। জানালাম আমার সন্তানের লালন পালনের দায়িত্বভার তারা নিয়েছে। ওনারা সব শুনলেন এবং ছোটখোকাও চাকুরি পেয়ে গেল। আমারই ব্যাংকে। এখন ওর সঙ্গে আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে পরামর্শ করার প্রয়োজন। দুজনে একটা রেস্তোরাঁয় বসলাম। বললো, ভাবি, এবার তো একটা বাসা। ভাড়া নিয়ে আমরা এক সঙ্গে থাকতে পারি। বললাম, পারি, কিন্তু থাকবে না। মাথাটা খুব নিচু করে বললো, ভাইয়া বিয়ে করেছেন, আমাদের বলে নি কিন্তু আমি জানি। জয়দেবপুরেরই একেবারে গ্রামের এক রাজাকারের মেয়ে। ঐ সময় সে ও বাড়িতেই ছিল। তাই আজ মিনার ভাষায় সর্বতোভাবে সে ওদের কর্তা হয়েছে। মিনা মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। সেই হাসনাত কি করে এমন হলো। ওই মায়ের ছেলে? না মিনা আর ভাবতে পারে না। হায়দার বললো, ভাবি, আজ না হয় এসব আলাপ আলোচনা থাক আরেক দিন হবে। ঠিক আছে, বলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো মিনা। বললো, ছোট চলো একবার ফাল্গুনীকে দেখে আসি, আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। তাই চলো অবি। মার অবস্থা ভালো না। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কি হবে ভাবি আমাদের?

    সারাটা পথ রিকশায় মিনা চুপ করে বসে রইলো। সমস্ত অতীত ভীড় করে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সেই বিয়ের দিন, তার পরের আনন্দের দিনগুলো। ফাল্গুনীর জন্মের পর সেই উল্লাস। সবই কি কৃত্রিম ছিল না, মেয়েদের জীবন নিয়ে একটা পুরুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ইচ্ছে মতো তাকে ভোগ করেছে। নতুন খেলনা পেয়ে পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে কোথায় পড়লো, ভেঙে কতো টুকরো হলো তার দিকে ফিরে তাকাবারও অবকাশ নেই। কিন্তু ও কি চিরদিন এমনিই থাকবে? নাঃ এসব কি ভাবছে মিনা? তার কাছে হাসনাত মারা গোছে দু’বছর আগে, নতুন করে এ হারাবার শোক কেন?

    যথারীতি কড়া নাড়তে আম্মা এসে দরজা খুলে দিলেন। এ কি চেহারা হয়েছে আম্মার! রঙটা যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে, মাথার চুল মনে হয় অর্ধেক শাদা হয়ে গেছে। সে কতো দিন আসে না? মাত্র তে মাস ছয়েক হবে। ধীর পদে মিনা এগিয়ে এসে আম্মার হাত ধরলো। হঠাৎ পাঁচ বছরের শির মতো আম্মা ওর বুকে আছড়ে পড়লেন। আর কত শাস্তি তোমরা আমাকে দেবে বৌমা। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো! বুড়ো মায়ের প্রতি কর্তব্য করো। অনেক কষ্টে মিনা ওকে থামালো, জোর করে বসিয়ে দিলো। বললো, আম্মা, ও ওর কাজ করেছে আমরা আমাদের কাজ করবো। কালই বাসা দেখে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবো। তারপর হায়দারের বিয়ে দিয়ে আপনার ঘর সাজিয়ে দেবো। ফাল্গনী থাকবে। আমি আসা যাওয়া করবো। অসহায়ভাবে আম্মা মিনাকে ধরে বললেন, তুমি যেও না বউমা, ও আমাকে মেরে ফেলবে। গতকাল এসেছিল, তোমার কাপড় চোপড় গয়নাগাটি নিয়ে যেতে চায়। গয়না আমি আগেই তোমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, ওসব ফাল্গুনীর প্রাপ্য। আর জামা কাপড় সব তোমার বাবার দেওয়া। ওই পশু আমার গায়ে হাত দিয়েছে বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শাশুড়িকে শান্ত করে মিনা আজ প্রায় তিন বছর পর বাবার বাড়িতে পা দিলো। সেখানে শুধু কান্না। আনন্দ, না দুঃখের মিনা বুঝতে পারছিল না। এই তিনবছরে মুন্নী অনেক বড় হয়েছে, সুন্দরও হয়েছে। ওর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিনা। এ যেন দশ বছর আগেকার সে।

    হায়দার বাইরের ঘরে ফাল্গুনীর সঙ্গে খেলছে, মুন্নী ওকে চা দিয়ে এলো। বাবা মার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করে বললো, বড়ভাই এলে কথা বলো, তারপর আমাকে জানিও। বাবা তুমি এসো আমার হোস্টেলে। কোনও অসুবিধা নেই। দিন সাতেকের ভেতর ফার্মগেটের বাসা ছেড়ে রামপুরায় বাসা নেওয়া হয়েছে। মায়ের কাছাকাছি এসে আম্মাও অনেকটা ভালো আছেন। এদিকে মুন্নীর সঙ্গে হায়দারের বিয়ে হয়ে গেল। হাসনাতকে কেউ জানাবার প্রয়োজনও মনে করলো না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মিনা। যাক-সবাই ঘর পেয়েছে। তাকে বাড়ি এসে থাকবার জন্য অনুরোধ করেছে হায়দার, আম্মা এমন কি বাবা-মাও অনেকবার বলেছেন। কিন্তু না, যে ঘর মিনা ছেড়ে এসেছে সেখানে সে আর ফিরে যাবে না।

    অফিসে শফিক আর সে পাশাপাশি টেবিলে বসে। অনেকটা অন্তরঙ্গ হয়েছে, তারা নিছক বন্ধু, ঐ পর্যন্তই। একবার কতো সাহস যুগিয়েছে শফিক। কিন্তু মিনা জানে যেদিন তিনি তার সব পরিচয় পাবেন বিদ্যুৎ গতিতে সরে যাবেন। সে পুরুষকে যেটুকু চিনেছে তাতে এর থেকে মহৎ কোনও ধারণা পোষণ করবার কারণ সে খুঁজে পায় নি। তবুও সবাই যখন ঘর পেয়েছে তখন মিনার অবসরও একটু বেড়েছে বৈকি। একদিন শফিকের প্রস্তাব অনুসারে সিনেমাও দেখে এলো। কিন্তু বাইরে আসতেই একটা লোক কুৎসিৎ ইঙ্গিত করে সিটি বাজিয়ে উঠলো। শফিক এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মিনা তাকে ধরে ফেললো। ছিঃ ইতরের সঙ্গে ইতরামি করলে নিজের সম্মান থাকে একটু দূরে সে হাসনাতকে সরে যেতে দেখেছে। মরাল কাওয়ার্ডটা সামনে আসেনা কেন? দু’জনে এগিয়ে একটা বেবীতে চড়লো তারপর একেবারে হায়দারের বাসায়। আম্মা, মুন্নী খুব খুশি। ওরা টিভি দেখছিল বন্ধ করে দেওয়ায় ফাল্গনী কেঁদে ফেললো। মিনা একে একে আম্মা, মুন্নী ও হায়দারের সঙ্গে শফিকের পরিচয় করিয়ে দিলো। ফাল্গুনীকে বললো, তোমার আঙ্কেল শফিক চাচা। ফাল্গুনী হেসে এগিয়ে এসে বললো, শফিক চাচা, খুব ভালো, তুমি টিভি দেখো? বলতেই শফিক উঠে গিয়ে টিভিটা খুলে দিল। ফারুনী মহাখুশি কিছুক্ষণ গল্প করে, চা খেয়ে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শফিক চলে গেল। মিনা রয়ে গেল। বহুদিন পর আম্মা ও ফাল্গুনীর সঙ্গে রাতে ঘুমালো। কাল শুক্রবার অতএব তাড়া নেই। শফিক রাতেই হোস্টেলে ফোন করেছে। ফারুনী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মুনী হায়দারের চোখের মণি। বাবা রোজ একবার আসেন ওর টানে। আম্মাও দু’একদিন পর পর ফারুণীকে এসে দেখে যান। বড় ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে। বাবা বলেছেন, এ বিয়েতে মিনা উপস্থিত থাকবে। ইতিমধ্যে হায়দারের কথায় এবং চেষ্টায় মিনা হাসনাতকে তালাক দিয়েছে, তা না হলে ওই পশুটা তার পেছন ছাড়তো না।

    সকালে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জানালার কাছে বসে মিনা ভাবছিল, মাত্র চারটি বছরে তার জীবনের সব জল ছবি হয়ে মুছে গেল। স্বামী, সন্তান, শাশুড়ি, দেবর, জা এরা তো প্রকৃত অর্থে আজ তার কেউ নয়। ফাল্গুনীই-বা তার কতোটুকু? কি দিয়েছে সে ফাল্গনীকে। স্বার্থপরের মতো তাকে দূরে রেখেছে। না, না, জোরে মাথা নাড়লো মিনা, সে স্বার্থপর নয়। একটা সহজ স্বাভাবিক পরিবেশে সে বড় হোক এটাই মিনা চেয়েছিল। আজ মুন্নী, হায়দার ওর বাবা-মা, ও সম্পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু তাকেও তো এক জায়গায় নোঙর ফেলতে হবে। দেবর জায়ের ঘাড়ের ওপর এসে চড়ে বসা আর ওদের দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো ব্যাপারে নাক গলানো কি তার উপযুক্ত কাজ? আম্মা বেশ সেবা পাচ্ছেন। আজকাল সে মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের কাছে যায়। ওখানে গেলে মনেই হয় না ওর জীবনে এতোগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। মুন্নীর ভালো বিয়ে হয়েছে, যখন তখন ফাল্গুনীকে কাছে পাচ্ছেন। তারা এখন সম্পূর্ণ সুখী। কালই মিনা ভেবেছিল আগামী সপ্তাহে ছুটির দিনটা সে বাবা-মার সঙ্গে কাটাবে। মা এখন ছেলের বিয়ের আলোচনায় মত্ত। বাবা মাঝে মাঝে কাছে থেকে বলেন, আরে সবই তো হলো, নিজের কথা কি ভেবেছিস? কেন বাবা, ভালোই তো আছি। আমার তো কোনও অসুবিধা নেই। না, মীনা তুমি এতই যখন বোঝো তখন নিজের ভবিষ্যৎও একটু চিন্তা করো। ফাল্গনী বড় হবে, মানুষ হবে, বিয়ে হবে, পরের ঘরে চলে যাবে। আম্মা একদিন চোখ বুজবেন। হায়দার মুন্নীরও নিজেদের সংসার হয়েছে। আমি ও তোমার মা যখন থাকবো না, তখন? তখনকার কথাটা ভেবে দেখেছো? হাসে মিনা। ভাববে বাবা, ভাববো।

    সত্যিই কাল সারারাত মিনার ভালো ঘুম হয় নি। খুব আজে বাজে স্বপ্ন দেখেছে। শফিক হাবভাবে তাকে ভবিষ্যতের কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু মিনা সাহস করে না। সত্য কথা বলতে কি পুরুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। হাসনাতের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রেম ভালোবাসা বিশ্বাস সব কিছুরই মৃত্যু হয়েছে। তবে ওর বাবার কথাটাও ফেলবার নয়। সবাই তো একদিন নিজের বৃত্তে স্থির হবে সেদিন তার কি হবে? না আজ মন দিয়ে শুনবে শফিক কি বলতে চায়।

    আশ্চর্য! শফিক আজ অফিসে আসে নি। কোনও দরখাস্তও পাঠায় নি। শফিকের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যের কথা অনেকেই জানে। তাই দু’চার জন তাকে প্রশ্ন করলো, শফিক সাহেবের কি হয়েছে? গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো, জানি না। ছুটির আধঘণ্টা খানেক আগে হায়দার এসে দাঁড়ালো। ভাবি একটু আগে বেরুতে পারবে, কিছু কথা আছে। মিনার হাত-পা কাঁপছে। জীবনে আর কোনও নির্মম সত্য সে শুনতে চায় না। তাড়াতাড়ি হাতের কাগজগুলো গুছিয়ে নিয়ে বললো, চলো। দুজনে একটা রেস্তোরাঁ পর্যন্ত হেঁটে এলো। কারও মুখে কোনো কথা নেই! হায়দার চিরকালই কম কথা বলে। বসে চায়ের অর্ডার দেওয়া হলে মিন হায়দারের হাতটা চেপে ধরলো, কি হয়েছে ছোট? আমার ফারুনীর কিছু? আরে না না, তুমি এতো ভাবতে পারো ভাবি। ফাল্গুনীর কিছু না হলে তোমার ছোট্ট অফিসে আসতে পারে না? বেসে চা খাও, সব বলছি। চায়ে চুমুক দিতে একটা স্বস্তির আঃ সূচক শব্দ করলো মিনা। নাও, এখন বলো আমি তৈরি, হেসে বললো মিনা। হায়দার গম্ভীর মুখেই বললো, ভাবি শফিক ভাইকে গুরা ছুরি মেরেছে। মুহূর্তে চোয়াল শক্ত হলো মিনার। কেন? কি করেছিল সে? কিছুই করে নি। যারা মেরেছে তাদের দু’জন ধরা পড়েছে। একজন ভাইয়ার নাম বলেছে। দু’হাতে মাথা চেপে মিনা শুধু উচ্চারণ করলো ছিঃ ছিঃ ছিঃ এতো নিচে নেমে গেছে ওই লোকটা। তারপর? তারপর কি হলো? শফিকের কোথায় লেগেছে? ডান হাতে ভালোমত জখম হয়েছে। বুকে মারতে চেয়েছিল, পারে নি। শফিক ভাই পুলিশকে বলেছে সে কাউকে চেনে না। হয়তো-বা টাকা-পয়সার জন্যে করেছে। কিন্তু আমি জানি কদিন ধরেই ভাইয়া শফিক ভাইয়ের পেছনে লেগেছে। আমি কাল রাতেই জয়দেবপুর গিয়ে তাকে ধরেছি। বলেছি, শফিক ভদ্রলোকের ছেলে তাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে-জানো ভাবি আমার কথা শেষ করতে দিলো না আমার পা দুটো ধরে হাউ মাউ করে কাদলো। বললাম, কাঁদো তুমি যা করেছে তাতে তোমার বাকি জীবনভরই কাঁদতে হবে। তবে আমাদের কাঁদাবার চেষ্টা করো না, তাহলে জেলের ভাত ছাড়া তোমার জন্য আর কোনও পথ থাকবে না। আসলে চাকুরি যাবার ভয়ে অস্থির, আর কোনও দিন এ পথ মাড়াবে না। ওর কথা শেষ হলে মিনা আস্তে আস্তে বললো, কি মানুষ কি হয়েছে-সংসর্গই সব চেয়ে বড় কথা।

    ভাবি চলো এবার শফিক ভাইকে একটু দেখতে যাওয়া দরকার। মিনা সজোরে মাথা নাড়লো, না না, সে আমি পারবো না ছোট। কোন মুখ নিয়ে সেখানে যাবো? তার মা কি ভাববেন? কিছু নয়। চলো আমার সঙ্গে। তুমি যে কিছু জানো তা যেন শফিক ভাই বুঝতে না পারেন। তাহলে আমি খুব ছোট হয়ে যাবো। অগত্যা দু’জনে উঠলে। হায়দারের সঙ্গে একটা বেবীতে উঠলো। শফিক থাকে সিদ্ধেশ্বরী। একটা বহুতল বাড়ির তেতলায়। সুন্দর ফ্ল্যাট! কলিং বেল টিপতেই একজন বৃদ্ধবয়সী মহিলা দরজা খুলে দিলেন। ছোট ওর পূর্ব পরিচিত মনে হলো। কারণ তিনি সাগ্রহে বললেন, এলো বাবা, এসো। ছোটর গলা ভারি, খালাম্মা, মিনা নিচু হয়ে সালাম করতে গেলে উনি হাত দুটো ধরে ওকে মুছে টেনে নিলেন। বললেন, এসো মা, দেখতে কেমন গেরো। এতো বলি সাবধানে থাকিস, তোর মাথার উপর কেউ নেই। কার সঙ্গে কথা বলছো মা? বলতে বলতে বছর কুড়ি একুশের একটি ছেলে এসে ঘরে ঢুকলো। এই যে আয়, হায়দারের ভাবী এসেছে! আসোলামু আলাইকুম ভাবি। আসুন আসুন ভাইয়া ও ঘরে। রফিকের মুখে ভাবি সম্বোধন কেমন যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় মিনা। কারণ সেও বোঝে না। ঘরে ঢুকতেই শফিক শোয়া থেকে উঠে বসলো। মা হা হা করে উঠলেন। রফিক ধরে বসিয়ে দিলো। বিছানার পাশে চেয়ারে বসলো মিনা। কেমন যেন অপরাধের গ্লানিতে চোখ তুলতে পারছেনা সে। শফিক বললো, ও কি? আমার কিছু হয় নি। ভালোভাবে গুলিটা বের করে ফেলেছে। তবে হাসপাতালে থাকতে বলেছিল… ওর কথা শেষ করতে দিলো না রফিক। না উনি থাকলেন না। আশ্চর্য লোক তুমি ভাইয়া!

    এসময় চা দিয়ে গেল কাজের মেয়েটা। চা খেতে খেতে শফিকের মা অনেক কথা বললেন। বললেন, দেখো তো মা, তার ভাঙা মন সে আর বিয়ে করবে না, কি এমন হয়েছে? এমন তো সব ঘরেই হচ্ছে এখন। তোমরা তো একসঙ্গে কাজ করো। একটু বুঝিয়ো তো মা। শফিককে আরোগ্য লাভের শুভেচ্ছা জানিয়ে মিনা বেরিয়ে এলো। হায়দারকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই একা রিকশা নিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলো। কি হয়েছে শফিকের পরিবারে যেজন্য সে বিয়ে করতে চায় না। যাকগে আমি মরছি নিজের জ্বলায়। হোস্টেলে ঢুকতে ঢুকতে ভালো তিনবছর তো হয়ে এলো। এ বছরে তো হোস্টেলও ছাড়তে হবে। একটা এক ঘরের ফ্ল্যাটের চেষ্টা করতে হবে।

    শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ ও মন নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না, কেউ একজন বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেছে। ঘড়িতে তিনটা। উঠে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলে আবার শুয়ে পড়লো সে। ঘুম ভাঙলো সাড়ে সাতটায়। কোনও মতে স্নান সেরে তৈরি হয়ে অফিসে ছুটলো সে। ফোন এলো শফিকের কাছ থেকে, আজ যেতে বলেছে। মিনা বললো, আজ সম্ভব হবে না। অনেক কাজ, কাল যাবে। ইচ্ছে করে সে সময় নিলো। তাছাড়া সত্যিই আজ তার বিশ্রাম প্রয়োজন নইলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আজ তার মনে পড়ছে গত সপ্তাহে শনিবার বিকেলে সে আর শফিক যখন অফিস থেকে বেরুচ্ছিল তখন আরও দু’তিনটা লোকের সঙ্গে সে হাসনাতকে যেন দেখেছিল। ঐদিন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু কাল সে নিশ্চিত যে হাসনাত শফিককে চেনাবার জন্য হয়তো নিজেই এসেছিল, কিন্তু কেন? স্ত্রী-সন্তানকে পথে ফেলে দিয়ে যেমন ইচ্ছে একজনকে ঘরে নিয়ে সুখেই তো আছে সে। তার ওপর আমি সুখী হতে চাইলেই তার আক্রোশ? না, মিনা এবারে বাবার কথাই শুনবে। দেখি শফিকই বা কি বলে। হায়দার বলা সত্ত্বেও মিনা আর শফিকদের বাড়িতে গেলো না। ওর মার এক কথা, ও আর বিয়ে করতে চায় না। তাহলে কি শফিক বিবাহিত? স্ত্রী জীবিত না মৃত? কে জানে দেখি না শফিক তাকে কিছু বলে কিনা। মনে হয় বলবে কারণ কদিন আগেই তাকে দু’একদিন বলেছে, চলো মিনা আমরা কোথাও যাই একটু বসে গল্প করি। তোমাকে যে আমার অনেক কিছু বলার আছে। মিনা গায়ে লাগায় নি। শুধু শুনেছে ওর বাবা ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে জিপ এ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। ওরা দুই ভাই আর মা। মা একটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। পরবর্তীতে বাবার রেখে যাওয়া টাকা পয়সা এক করে ঐ ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। তাকে মানুষ করেছেন। ছোট ভাই এমবিএ পড়ে আগামী বছর পাশ করে বেরুবে, তারপর আর তাদের কোনও সমস্যা থাকবে না। মিনা বোঝে তাকে এসব কথা বলবার অর্থ কি? এও এক রকম চাকুরির দরখাস্তের সাথে বায়োডাটা দেওয়া। মিনা সবই বোঝে কিন্তু আজও পথ খুঁজে পাচ্ছে না।

    দিন দশেক পর শফিক জয়েন করলো। মুখটা বেশ ভার। মিনা বোঝে শফিকের এ সঙ্গত অভিমান। আস্তে আস্তে মেঘ কেটে গেলো। শফিকই তাকে চায়ের দাওয়াত করলো। কিছুটা হেঁটে গিয়ে দূরে একটা রেস্তোরাঁয় বসলো ওরা। চা সামনে নিয়ে শফিকই কথা শুরু করলো, মিনা, আজ তোমাকে একটা কথা বলা আমি খুবই সঙ্গত মনে করছি। কারণ আমি তোমার কাছে একটা আবেদন করবো তার আগে আমি নিজেকে তোমার কাছে পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরতে চাই। মিনা, আমি বিবাহিত। একটু যেন চমকে উঠলো মিনা, দৃষ্টি প্রসারিত করে যেন শফিককে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো। দু’বছর আগে আমি সালেহাকে বিয়ে করি। মন জানাজানি শুরু হয় তারও আগে। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বলে প্রথমটা মায়ের আপত্তি ছিল। পরে অবশ্য ওর ব্যবহারে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর, সালেহা মাকে ঠিক সইতে পারলো না। পদে পদে মাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে লাগলো, আমার মুখের দিকে চেয়ে মা সবই সয়ে গেলেন। শেষে না পেরে একদিন আমাকে বললেন, শফিক তুই আলাদা বাসা নে। আমাদের গরিবী হাল বৌমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আমি চমকে উঠলাম, তা হয় না মা, তুমি যে কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের মানুষ করেছে, আজ তোমাকে ফেলে যাবো আমি? কিন্তু বাবা, আমিও তো আর পারছি না। তোর বাবা আমাকে হীরা জহরৎ না দিতে পারেন, কিন্তু কোনও দিন অসম্মান করেন নি। শফিক নত মস্তকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে ফিরে এসে চা খাবার সময় সালেহাকে বলতেই সে বারুদের মতো ফেটে পড়লো। মায়ের ব্যাপার নিয়ে প্রচন্ড রকম কথা কাটাকাটি হলো। শেষে মা এসে ওদের শান্ত করলেন। বললেন, বউমা, কোনও রাগ বা ক্ষোভ থেকে বলছি না, এ বাড়ি আমার। আমি পথে পা দেবোনা। শফিক উপার্জনক্ষম তাই তাকে বলেছি তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও থাকতে। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছে না। যখন তখন অপমান করছে। আমার আরেকটি ছেলে আছে সে যদি তোমাকে অপমান করে সেটা হবে আমার জন্য আত্মঘাতী। তাই একথা বলছেন, উত্তর দিলো সালেহা, আপনারা অর্থের দিক থেকে দরিদ্র এটা জানতাম, কিন্তু আপনাদের মন এতো ছোট তা আমার জানা ছিলো না। আমি আজই মায়ের বাড়িতে চলে যাবো। মা হাতে ধরে সাধতে গেলে হাত ছেড়ে আনতে গিয়ে মাকে একটা ধাক্কা দিলো। মা পড়ে গেলেন। দু’ভায়ে মাকে ধরে তুলে তার ঘরে নিয়ে গেলাম। আমার ঘরে এসে দেখি সালেহা নেই। পরে একদিন আমি অফিসে থাকা অবস্থায় এসে তার জিনিসপত্র সব নিয়ে গেল। মাসখানেক পর আমি তালাকের চিঠি পেলাম। নিঃশব্দে তাকে মুক্তি দিয়েছি কারণ আমার মায়ের অপমান সহ্য করা আমার জন্য যেমন কঠিন, মাকে ছেড়ে যাওয়া কঠিনতর। প্রায় চার বছর হয়ে গেল আমাদের জীবন এভাবেই চলে যাচ্ছে মিনা। সব শুনেও যদি তুমি আমাকে গ্রহণ করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো। সেদিন ওখানেই শেষ হলো।

    পরদিন শফিককে বললাম, আজ আমি চা খাওয়াবো চলো। শফিক উৎফুল্ল মেজাজেই চললো। চা নাশতা সামনে নিয়ে বললাম, শফিকআগে খেয়ে নাও তারপর আমার কাহিনী শুরু করবো। কারণ আমি তোমার মতো ভালোমানুষ নই। শফিক খাবারে হাত দিলো। মিনা ওর হাতটা চেপে ধরলো, ওকি? অমন করে খাচ্ছ কেন? তুমি হুকুম করলে তাই। মিনা হেসে ফেললো, বেশ খাও। খাওয়া শেষ হলে শফিক একটা সিগারেট ধরালো, তারপর সুখটান দিয়ে বললো, কে আরম্ভ করবে, তুমি না আমি? না না তুমি তো কাল বলছো, আজ আমার পালা। তোমার অনুমতি পেলে আজকের পালাটাও আমি গাইতে পারি-ওপর দিকে চোখ তুলে বললো শফিক। তার মানে? মিনার কণ্ঠে বিস্ময়। তাহলে শোনো, মিনা নামে মালিবাগে এক দুরন্তু মেয়ে ছিল। বিয়ে হলো তার হাসনাত নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যিনি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করেন। তাদের একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হলো নাম তার ফাল্গুনী। মিনা হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশে বর্গী এলো, মিনাকে বৰ্গীরা ধরে নিয়ে গেল, তাদের কয়েদখানায় চারমাস আটকে রাখলো। মিনা শফিকের হাতটা জোরে চেপে ধরলো। শফিক ধীরে ধীরে তার হাতটা আলগা করে বলে চললো, তারপর মেয়েটি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেলো। কিন্তু অপবিত্র আখ্যা দিয়ে স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। স্বামী ততদিনে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটি শাশুড়ি দেওরের কাছে সন্তান রেখে সরকারি সহায়তায় পড়াশুনা করলো, চাকুরি নিলো। এখন বেশ ভালোই আছে তবে একটি সূক্ষ্ম বেদনার কাঁটা, মেয়েটি তার কাছে থাকে না। কিন্তু তার ছোট বোনের সঙ্গে দেওরের বিয়ে হয়েছে। মেয়েটি চাচা চাচীকেই বাবা মা জানে। তাদের সুখের সংসারে আরেকটি মেহমান এসেছে ছেলে। কিন্তু দু’জনে সমান আদরে বড় হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে… স্থান কাল ভুলে গিয়ে মিনা শফিকের মুখ চেপে ধরলো। শফিক থেমে বললো, কোনও রকম ভুল-ভ্রান্তি হয় নি তো? হুবহু বলতে পেরেছি? জ্বী, একেবারে দশে দশ বললে মিনা। কিন্তু তোমাকে এসব কথা কে বলেছে? ছোট? না মিনা, বড়ই এসে বলেছেন অনুগ্রহ করে। তোমার মতো বাজে মেয়ের থেকে যেন দূরে থাকি আমি। দূরে গেলে না কেন? উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করে মিনা। সবার বিচার তো একরকম হয় না। তার কাছে যে খারাপ আমার কাছে সে শুধু ভালো নয়, খুব বেশি ভালোও তো হতে পারে। চলো আজ উঠি। মার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। দরকার হলে ডাক্তার ডাকবে। আমি আসবো তোমার সঙ্গে, জিজ্ঞেস করে মিনা। এলে খুশি হবো। খুশি মনে দু’জনেই একটা রিকশায় বসলো। এক রিকশায় দু’জনেই এই প্রথম।

    এরপর আর দেরি হয় নি। মনী ও হায়দারের বলে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে রেজিস্ট্রি করে একেবারে শফিকের বাড়িতে উঠেছে। ওর মা আগে থেকেই খুব খুশি ছিলেন। এখন আনন্দে আত্মহারা হলেন। বীরাঙ্গনা মিনার সংগ্রাম শেষ হলো। কিছুদিন আগে এক বিয়ে বাড়িতে দেখা। ওর সঙ্গে অবশ্য প্রায়ই আমার দেখা হতো বেইলী রোড় কর্মজীবী হোস্টেলে। আমার ভগ্নীতুল্য বান্ধবী জেরিনা তখন ওখানে কাজ করতো। মাঝে মাঝে ওর ঘরে গিয়ে বসতাম। চোখ নিচু করে মিনা বেরিয়ে যেতো অথবা ঘরে ঢুকতো। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিতো। বলতাম, জেরিনা এই মেয়েগুলোর বুকে আগুন জ্বেলে দিতে পারিস না, ওরা কেন মাথা নিচু করে চলে? নীলিমাদি তোমাদের এ সমাজ ওদের চারিদিকে যে আগুন জ্বেলে রেখেছে তার উত্তাপেই ওরা মুখ তুলতে পারে না। বেশি বেশি বক্তৃতা দিও না। ওদের সম্পর্কে জেরিনা খুব বেশি স্পর্শকাতর ছিল। তবে জেরিনা ওর বিয়ের খবর শুনে গিয়েছিল এবং ওদের একদিন নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছিল। আমার কিন্তু সেটুকু সৎ সাহস বা আগ্রহ হয় নি। মিনা যেনো আগের চেয়েও সুন্দরী হয়েছে। খোঁপায় ফুল, একটা হাল্কা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। রূপে যেন দশদিক আলো হয়ে গেছে। খুব ব্যস্ত। বছর দশেকের একটি মেয়েকে আমার কাছে। এনে বললো, সালাম করো খালামনি। আপা, এ শ্রাবণী আমার মেয়ে। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়লো ওর তো ফাল্গুনী নামে একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। নিজেকে সংযত করলাম। বললাম, কার বিয়েতে এতো ব্যস্ত তুমি? কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, আমার মেয়ের, আর জোরে বললো, আপা আমার দেওর আর বোনের বড় মেয়ে ফাল্গুনীর বিয়ে। আনন্দ বেদনায় মিনার চোখে বান ডেকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ মুছে বললো, দোয়া করবেন মায়ের দুর্ভাগ্য যেন ওকে স্পর্শ না করে। কঠিন গলায় বললাম, দুর্ভাগ্য? কি বলছো তুমি মিনা। ঠিকই আপা, আমি মাফ চাই। আমি বীরাঙ্গনা, মহাপুরুষের বাক্য ব্যর্থ হয় নি। আজ আমি মাতৃগর্বে গর্বিত এক মহিয়সী নারী। আপা আমি খুব খুশি। মিনা পা ছুঁতে গেল। ওকে তুললাম। বহুদিন পর হৃদয়ের একটা বোঝা কমে গেল। তাহলে এ বাংলাদেশে এখনও সৎ মানুষ আছে যারা মিনার মতো মেয়েকে নিয়ে সুখের নীড় রচনা করবার স্পর্ধা ও সাহস রাখে। মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যাস্ট্রোফিজিকস : সহজ পাঠ – নীল ডিগ্র্যাস টাইসন ও গ্রেগরি মোন
    Next Article ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.