Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চলিত ভাষার এক পাতা গল্প73 Mins Read0
    ⤷

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    পনেরো-ষোলো বছর আগেকার কথা। বি.এ. পাশ করে কলকাতায় বসে আছি। অনেক জায়গায় ঘুরেও চাকরি জোটেনি।

    সরস্বতী পূজার দিন। মেসে অনেক দিন ধরে আছি, তাই জোর করে তাড়িয়ে দেয়নি, কিন্তু মেসের ম্যানেজার তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুলেছে। মেসে প্রতিমা গড়ে পূজা হচ্ছে—ধুমধামও কম নয়। সকালে উঠে ভাবছি, আজ সব বন্ধ, দু-এক জায়গায় একটু আশা ছিল, কিন্তু আজ আর কোথাও যাওয়া কাজের হবে না। বরং ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়াই।

    মেসের চাকর জগন্নাথ তখন এক টুকরো কাগজ হাতে দিয়ে গেল। পড়ে দেখলাম, ম্যানেজারের লেখা তাগাদার চিঠি। আজ মেসে পূজার জন্য ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, আমার কাছে দু-মাসের টাকা বাকি, আমি যেন চাকরের হাতে অন্তত দশ টাকা দিই। নইলে কাল থেকে খাওয়ার জন্য অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

    কথাটা ঠিকই, কিন্তু আমার কাছে মোটে দুটো টাকা আর কয়েক আনা পয়সা। কোনো জবাব না দিয়ে মেস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পাড়ায় নানা জায়গায় পূজার বাজনা বাজছে, ছেলেমেয়েরা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে। অভয় ময়রার দোকানে নানা রকম নতুন খাবার থালায় সাজানো। বড় রাস্তার ওপারে কলেজ হোস্টেলের ফটকে নহবৎ বসেছে। বাজার থেকে লোক দলে দলে ফুলের মালা আর পূজার জিনিস কিনে ফিরছে।

    ভাবলাম, কোথায় যাওয়া যায়। এক বছরের বেশি হলো জোড়াসাঁকো স্কুলের চাকরি ছেড়ে বসে আছি—বা বসে ঠিক নয়, চাকরির খোঁজে এমন কোনো মার্চেন্ট অফিস, স্কুল, খবরের কাগজের অফিস, বা বড়লোকের বাড়ি নেই, যেখানে অন্তত দশবার ঘুরে আসিনি। কিন্তু সবার এক কথা—চাকরি খালি নেই।

    হঠাৎ পথে সতীশের সঙ্গে দেখা। সতীশের সঙ্গে হিন্দু হোস্টেলে একসঙ্গে থাকতাম। এখন সে আলিপুরে উকিল, তেমন কিছু হয়নি মনে হয়। বালিগঞ্জের দিকে কোথাও একটা টিউশনি আছে, সেটাই এখন তার সংসারের ভেলার কাজ করছে। আমার তো ভেলা দূরের কথা, মাস্তুল-ভাঙা কাঠও নেই। যতদূর হাবুডুবু খাওয়ার, তাই খাচ্ছি। সতীশকে দেখে সে কথা মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম। আরেকটা কারণে ভুললাম, সতীশ বলল, “এই যে, কোথায় চলেছ, সত্যচরণ? চল, হিন্দু হোস্টেলের ঠাকুর দেখে আসি—আমাদের পুরোনো জায়গা। আর বিকেলে বড় জলসা হবে, এসো। ওয়ার্ড সিক্সের সেই অবিনাশকে মনে আছে? ময়মনসিংহের কোন জমিদারের ছেলে। সে এখন বড় গায়ক। সে গান গাইবে। আমায় একটা কার্ড দিয়েছে, তাদের এস্টেটের দু-একটা কাজ মাঝে মাঝে করি তো। এসো, তুমি গেলে সে খুশি হবে।”

    কলেজে পড়ার সময়, পাঁচ-ছয় বছর আগে, আমোদ পেলে আর কিছু চাইতাম না। এখনো সে মনের ভাব কাটেনি দেখলাম। হিন্দু হোস্টেলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে সেখানে দুপুরের খাওয়ার নেমন্তন্ন পেলাম। আমাদের দেশের অনেক পরিচিত ছেলে সেখানে থাকে, তারা কিছুতেই যেতে দিতে চাইল না। বললাম, “বিকেলে জলসা হবে, এখন কী! মেস থেকে খেয়ে আসব।” তারা সে কথায় কান দিল না।

    কান দিলে সরস্বতী পূজার দিনটা আমাকে না খেয়ে কাটাতে হতো। ম্যানেজারের ওরকম কড়া চিঠির পর মেসের লুচি-পায়েসের ভোজ খেতে পারতাম না, যখন একটা টাকাও দিইনি। এ বেশ হলো—পেট ভরে নেমন্তন্ন খেয়ে বিকেলে জলসার আসরে গিয়ে বসলাম। তিন বছর আগের ছাত্রজীবনের উল্লাস যেন ফিরে এল। কে মনে রাখে চাকরি পেলাম কি না, মেসের ম্যানেজার মুখ হাঁড়ি করে বসে আছে কি না! ঠুংরি আর কীর্তনের সমুদ্রে ডুবে গিয়ে ভুলে গেলাম, দেনা মেটাতে না পারলে কাল সকাল থেকে বায়ুভক্ষণের ব্যবস্থা হবে। জলসা ভাঙল রাত এগারোটায়। অবিনাশের সঙ্গে আলাপ হলো। হিন্দু হোস্টেলে থাকার সময় আমরা দুজনে ডিবেটিং ক্লাবের চাঁই ছিলাম। একবার স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভাপতি করেছিলাম। বিষয় ছিল, স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা চালু করা উচিত। অবিনাশ প্রস্তাবক, আমি প্রতিবাদী পক্ষের নায়ক। দুপক্ষে তুমুল তর্কের পর সভাপতি আমাদের পক্ষে মত দিলেন। সেই থেকে অবিনাশের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কলেজ ছাড়ার পর এই প্রথম তার সঙ্গে দেখা।

    অবিনাশ বলল, “চল, আমার গাড়ি আছে, তোমায় পৌঁছে দিই। কোথায় থাকো?”

    মেসের দরজায় নামিয়ে দিয়ে বলল, “শোন, কাল হ্যারিংটন স্ট্রিটে আমার বাড়িতে বিকেল চারটায় চা খাবে। ভুলো না। তেত্রিশের দুই। নোটবুকে লিখে রাখ।”

    পরদিন হ্যারিংটন স্ট্রিট খুঁজে বের করলাম, বন্ধুর বাড়িও পেলাম। বাড়ি খুব বড় নয়, তবে সামনে-পিছনে বাগান। গেটে উইস্টারিয়া লতা, নেপালি দারোয়ান, আর পিতলের প্লেট। লাল সুরকির বাঁকা রাস্তা—এক ধারে সবুজ ঘাসের বন, অন্য ধারে বড় বড় মুচকুন্দ, চাঁপা আর আমগাছ। গাড়িবারান্দায় বড় একটা মোটর গাড়ি। বড়লোকের বাড়ি নয় ভাবার কোনো উপায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বসার ঘরে গেলাম। অবিনাশ এসে আদর করে বসালো, আর সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো দিনের কথায় আমরা দুজনেই মশগুল হয়ে গেলাম। অবিনাশের বাবা ময়মনসিংহের বড় জমিদার, কিন্তু এখন কলকাতার বাড়িতে তারা কেউ নেই। গত অগ্রহায়ণে অবিনাশের এক বোনের বিয়ের জন্য দেশে গিয়েছিলেন, এখনো কেউ ফেরেনি।

    একটা-দুটো কথার পর অবিনাশ বলল, “এখন কী করছ, সত্য?”

    বললাম, “জোড়াসাঁকো স্কুলে মাস্টারি করতাম, এখন একরকম বসেই আছি। ভাবছি, আর মাস্টারি করব না। অন্য কোনো দিকে দেখছি, দু-এক জায়গায় আশাও পেয়েছি।”

    আশা পাওয়ার কথাটা সত্যি নয়। কিন্তু অবিনাশ বড়লোকের ছেলে, ওদের মস্তবড় এস্টেট। তার কাছে চাকরির উমেদারি করছি, এটা না দেখানোর জন্যই কথাটা বললাম।

    অবিনাশ একটু ভেবে বলল, “তোমার মতো উপযুক্ত লোকের চাকরি পেতে দেরি হবে না। আমার একটা কথা আছে। তুমি তো আইনও পড়েছিলে, না?”

    বললাম, “পাশও করেছি, কিন্তু ওকালতি করার মতিগতি নেই।”

    অবিনাশ বলল, “আমাদের পূর্ণিয়া জেলায় একটা জঙ্গল-মহাল আছে। প্রায় বিশ-ত্রিশ হাজার বিঘে জমি। সেখানে আমাদের নায়েব আছে, কিন্তু তার ওপর ভরসা করে এত জমির বন্দোবস্তের ভার দেওয়া যায় না। আমরা একজন উপযুক্ত লোক খুঁজছি। তুমি যাবে?”

    কান অনেক সময় মানুষকে ঠকায়, জানতাম। অবিনাশ কী বলছে! যে চাকরির জন্য এক বছর ধরে কলকাতার রাস্তাঘাট চষে বেড়াচ্ছি, চায়ের নেমন্তন্নে একেবারে অযাচিতভাবে সেই চাকরির প্রস্তাব এসে হাজির হলো?

    তবু মান রাখতে হবে। খুব সংযমে মনের ভাব চেপে উদাসীনের মতো বললাম, “ও! আচ্ছা, ভেবে বলব। কাল আছো তো?”

    অবিনাশ খুব খোলামেলা আর দিলদরিয়া মেজাজের মানুষ। বলল, “ভাবাভাবি রাখো। আমি আজই বাবাকে চিঠি লিখছি। আমরা একজন বিশ্বাসী লোক খুঁজছি। জমিদারির ঘুণ কর্মচারী চাই না—কারণ তারা বেশিরভাগ চোর। তোমার মতো শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান লোক দরকার। জঙ্গল-মহাল নতুন প্রজার সঙ্গে বন্দোবস্ত করব। ত্রিশ হাজার বিঘের জঙ্গল। এত দায়িত্বের কাজ কি যার-তার হাতে ছাড়া যায়? তোমার সঙ্গে আজকের আলাপ নয়, তোমার নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। তুমি রাজি হয়ে যাও—আমি এখনই বাবাকে লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আনিয়ে দিচ্ছি।”

    ২

    কীভাবে চাকরি পেলাম, সেটা বেশি বলার দরকার নেই। কারণ এ গল্পের উদ্দেশ্য অন্য। সংক্ষেপে বলি—অবিনাশের বাড়ির চায়ের নেমন্তন্নের দুই সপ্তাহ পর একদিন নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বি.এন.ডব্লিউ. রেলওয়ের একটা ছোট স্টেশনে নামলাম।

    শীতের বিকেল। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ঘন ছায়া নেমেছে, দূরে বনশ্রেণীর মাথায় অল্প অল্প কুয়াশা জমেছে। রেললাইনের দু-ধারে মটরক্ষেত, শীতল সন্ধ্যার হাওয়ায় তাজা মটরশাকের স্নিগ্ধ গন্ধে মনে হলো, যে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, সেটা বড় নির্জন হবে। এই শীতের সন্ধ্যার মতো নির্জন, এই উদাস প্রান্তর আর দূরের নীল বনশ্রেণীর মতো।

    গোরুর গাড়িতে প্রায় পনেরো-ষোলো ক্রোশ চললাম সারারাত ধরে। ছইয়ের মধ্যে কলকাতা থেকে আনা কম্বল-র‍্যাগ শীতে জল হয়ে গেল। কে জানত, এই অঞ্চলে এত ভয়ানক শীত! সকালে রোদ উঠলেও তখনো পথ চলছি। দেখলাম, জমির প্রকৃতি বদলে গেছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যও অন্য রূপ নিয়েছে। ক্ষেতখামার নেই, বস্তি-লোকালয়ও তেমন দেখা যায় না। শুধু ছোট-বড় বন, কোথাও ঘন, কোথাও পাতলা, মাঝে মাঝে মুক্ত প্রান্তর, কিন্তু তাতে ফসলের আবাদ নেই।

    কাছারিতে পৌঁছলাম বেলা দশটায়। জঙ্গলের মধ্যে প্রায় দশ-পনেরো বিঘে জমি পরিষ্কার করে কিছু খড়ের ঘর, জঙ্গলের কাঠ, বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরি। ঘরে শুকনো ঘাস আর বন-ঝাউয়ের সরু গুঁড়ির বেড়া, তার ওপর মাটি লেপা।

    ঘরগুলো নতুন তৈরি। ঘরে ঢুকতেই টাটকা কাটা খড়, আধকাঁচা ঘাস আর বাঁশের গন্ধ পেলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম, আগে জঙ্গলের ওদিকে কোথাও কাছারি ছিল, কিন্তু শীতে সেখানে জলের অভাব হওয়ায় এই ঘর নতুন বাঁধা হয়েছে। পাশেই একটা ঝরনা থাকায় এখানে জলের কষ্ট নেই।

    ৩

    জীবনের বেশিরভাগ সময় কলকাতায় কাটিয়েছি। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ, লাইব্রেরি, থিয়েটার, সিনেমা, গানের আড্ডা—এগুলো ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারি না। এই অবস্থায় চাকরির কয়েকটা টাকার জন্য যেখানে এসে পড়লাম, এত নির্জন জায়গার কথা কখনো ভাবিনি। দিনের পর দিন যায়, পূর্বাকাশে সূর্য ওঠে দূরের পাহাড় আর জঙ্গলের মাথায়, আবার সন্ধ্যায় বনঝাউ আর লম্বা ঘাসের শীর্ষ সিঁদুরের রঙে রাঙিয়ে সূর্য ডুবে যায়। এর মধ্যে শীতকালের এগারো ঘণ্টার দিনটা যেন খাঁ-খাঁ করে শূন্য। কীভাবে সেটা ভরাব, প্রথম প্রথম সেটাই আমার কাছে মস্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

    কাজকর্ম করলে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু আমি নতুন এসেছি। এখনো এখানকার লোকের ভাষা ভালো করে বুঝি না, কাজের কোনো বিলিব্যবস্থাও করতে পারি না। নিজের ঘরে বসে, যে কয়েকটা বই সঙ্গে এনেছিলাম, সেগুলো পড়েই কোনোরকমে দিন কাটাই। কাছারিতে যে লোকজন আছে, তারা একেবারে বর্বর। তারা আমার কথা বোঝে না, আমিও তাদের কথা ভালো বুঝি না। প্রথম দশ দিন কী কষ্টে কাটল! কতবার মনে হলো, চাকরির দরকার নেই। এখানে হাঁপিয়ে মরার চেয়ে আধপেটা খেয়ে কলকাতায় থাকা ভালো। অবিনাশের অনুরোধে এই জনহীন জঙ্গলে এসে কী ভুলই করলাম! এ জীবন আমার জন্য নয়।

    রাতে নিজের ঘরে বসে এসব ভাবছি, এমন সময় দরজা ঠেলে কাছারির বুড়ো মুহুরী গোষ্ঠ চক্রবর্তী ঢুকলেন। এই একমাত্র লোক, যার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে হাঁপ ছাড়ি। গোষ্ঠবাবু এখানে অন্তত সতেরো-আঠারো বছর আছেন। বর্ধমান জেলার বনপাশ স্টেশনের কাছে কোন গ্রামে বাড়ি। বললাম, “বসুন, গোষ্ঠবাবু।”

    গোষ্ঠবাবু অন্য চেয়ারে বসলেন। বললেন, “তোমায় একটা কথা বলতে এলাম নিরিবিলি। এখানকার কোনো মানুষকে ভরসা করবে না। এ বাংলা দেশ নয়। লোকজন সব বড় খারাপ।”

    বললাম, “বাংলা দেশের মানুষও যে সবাই খুব ভালো, তা নয়, গোষ্ঠবাবু।”

    “সে আর আমার জানতে বাকি নেই, ম্যানেজার বাবু। সেই দুঃখ আর ম্যালেরিয়ার তাড়নায় প্রথম এখানে এসেছিলাম। প্রথম এসে বড় কষ্ট হতো। এই জঙ্গলে মন হাঁপিয়ে উঠত। এখন এমন হয়েছে, দেশ তো দূরের কথা, পূর্ণিয়া বা পাটনায় কাজে গিয়ে দু-দিনের বেশি তিন দিন থাকতে পারি না।”

    গোষ্ঠবাবুর মুখের দিকে কৌতুক নিয়ে তাকালাম। বললেন কী! জিজ্ঞেস করলাম, “থাকতে পারেন না কেন? জঙ্গলের জন্য মন হাঁপায় নাকি?”

    গোষ্ঠবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বললেন, “ঠিক তাই, ম্যানেজার বাবু। তুমিও বুঝবে। নতুন এসেছ কলকাতা থেকে, কলকাতার জন্য মন উড়ু উড়ু করছে। বয়সও তোমার কম। কিছুদিন এখানে থাকো। তারপর দেখবে।”

    “কী দেখব?”

    “জঙ্গল তোমায় পেয়ে বসবে। কোনো গোলমাল বা লোকের ভিড় ক্রমশ ভালো লাগবে না। আমার তাই হয়েছে। গত মাসে মুঙ্গের গিয়েছিলাম মকদ্দমার কাজে। শুধু মনে হয়, কবে এখান থেকে বেরোব।”

    মনে মনে ভাবলাম, ভগবান আমায় সে দুরবস্থা থেকে বাঁচান। তার আগে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছি।

    গোষ্ঠবাবু বললেন, “বন্দুকটা রাতে শিয়রে রেখে শোবে। জায়গা ভালো নয়। আগে একবার কাছারিতে ডাকাতি হয়ে গেছে। তবে এখন এখানে টাকাকড়ি থাকে না, এই যা।”

    কৌতূহল নিয়ে বললাম, “বলেন কী! কতকাল আগে ডাকাতি হয়েছিল?”

    “বেশি না। আট-নয় বছর আগে। কিছুদিন থাকো, তখন সব জানতে পারবে। এ অঞ্চল বড় খারাপ। তাছাড়া, এই ভয়ানক জঙ্গলে ডাকাতি করে মেরে ফেললে দেখবে বা কে?”

    গোষ্ঠবাবু চলে গেলে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরে জঙ্গলের মাথায় চাঁদ উঠছে। উদীয়মান চন্দ্রের পটভূমিকায় একটা বনঝাউয়ের বাঁকা ডাল, ঠিক যেন জাপানি চিত্রকর হকুসাইয়ের আঁকা ছবি।

    চাকরি করার আর জায়গা পেলাম না! এসব বিপজ্জনক জায়গা। আগে জানলে অবিনাশকে কখনো কথা দিতাম না।

    দুর্ভাবনা থাকলেও উদীয়মান চাঁদের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করল।

    ৪

    কাছারির কাছে একটা ছোট পাথরের টিলা, তার ওপর একটা প্রাচীন আর বিরাট বটগাছ। এই বটগাছের নাম গ্র্যান্ট সাহেবের বটগাছ। কেন এই নাম, তখন খোঁজ করেও কিছু জানতে পারিনি। একদিন নিস্তব্ধ বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের শোভা দেখতে টিলার ওপর উঠলাম।

    টিলার ওপর বটতলায় আসন্ন সন্ধ্যার ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে কত দূর পর্যন্ত এক চমকে দেখতে পেলাম—কলুটোলার মেস, কপালীটোলার সেই ব্রিজের আড্ডা, গোলদিঘিতে আমার প্রিয় বেঞ্চ। প্রতিদিন এই সময়ে সেখানে গিয়ে বসে কলেজ স্ট্রিটের জনস্রোত আর বাস-মোটরের ভিড় দেখতাম। হঠাৎ মনে হলো, তারা কত দূরে পড়ে রয়েছে। মন হু-হু করে উঠল। কোথায় আছি! কোথাকার জনহীন অরণ্যে-প্রান্তরে খড়ের চালায় বাস করছি চাকরির জন্য! মানুষ এখানে থাকে? লোক নেই, জন নেই, একেবারে নিঃসঙ্গ। একটা কথা বলার মানুষ পর্যন্ত নেই। এদেশের এই মূর্খ, বর্বর মানুষেরা একটা ভালো কথা বললে বোঝে না। এদেরই সঙ্গে দিনের পর দিন কাটাতে হবে? সেই দূরবিসর্পী জনহীন সন্ধ্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে মন উদাস হয়ে গেল, একটু ভয়ও হলো। তখন ঠিক করলাম, এ মাসের আর সামান্য দিন বাকি, পরের মাসটা কোনোরকমে চোখ বুজে কাটাব। তারপর অবিনাশকে একটা লম্বা চিঠি লিখে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে যাব। সভ্য বন্ধুবান্ধবদের অভ্যর্থনা পেয়ে, সভ্য খাবার খেয়ে, সভ্য সুরের সঙ্গীত শুনে, মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে, বহু মানুষের আনন্দ-উল্লাসভরা কণ্ঠস্বর শুনে বাঁচব।

    আগে কি জানতাম, মানুষের মধ্যে থাকতে এত ভালোবাসি! মানুষকে এত ভালোবাসি! তাদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব, হয়তো সব সময় তা পালন করতে পারি না। কিন্তু ভালোবাসি তাদের নিশ্চয়ই। নইলে তাদের ছেড়ে এসে এত কষ্ট পেতাম কেন?

    প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিঙে বই বেচত সেই বুড়ো মুসলমান, কতদিন তার দোকানে দাঁড়িয়ে পুরোনো বই আর মাসিক পত্রিকার পাতা উল্টেছি। কেনা উচিত ছিল হয়তো, কিন্তু কেনা হয়নি। সেও যেন পরম আত্মীয় মনে হলো। তাকে কতদিন দেখিনি!

    কাছারিতে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে টেবিলে আলো জ্বেলে একটা বই নিয়ে বসেছি। সিপাহি মুনেশ্বর সিং এসে সেলাম করে দাঁড়াল। বললাম, “কী, মুনেশ্বর?”

    ইতিমধ্যে দেহাতি হিন্দি কিছু কিছু বলতে শিখেছিলাম।

    মুনেশ্বর বলল, “হুজুর, আমায় একটা লোহার কড়া কিনে দেওয়ার হুকুম দিন মুহুরী বাবুকে।”

    “কী হবে লোহার কড়া?”

    মুনেশ্বরের মুখ প্রাপ্তির আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বিনীত সুরে বলল, “একটা লোহার কড়া থাকলে কত সুবিধে, হুজুর। যেখানে সেখানে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, ভাত রাঁধা যায়, জিনিসপত্র রাখা যায়, তাতে ভাত খাওয়া যায়, ভাঙবে না। আমার একটাও কড়া নেই। কতদিন ধরে একটা কড়ার কথা ভাবছি। কিন্তু হুজুর, বড় গরিব। একটা কড়ার দাম ছ-আনা। অত দাম দিয়ে কড়া কিনি কীভাবে? তাই হুজুরের কাছে এলাম। অনেক দিনের সাধ, একটা কড়া আমার হয়। হুজুর যদি মঞ্জুর করেন, হুজুর মালিক।”

    একটা লোহার কড়াই যে এত গুণের, যে এখানে লোক রাতে এর স্বপ্ন দেখে, এমন কথা এই প্রথম শুনলাম। এত গরিব লোক পৃথিবীতে আছে যে ছ-আনার একটা লোহার কড়াই জুটলে স্বর্গ হাতে পায়? শুনেছিলাম, এদেশের লোক বড় গরিব। এত গরিব জানতাম না। বড় মায়া হলো।

    পরদিন আমার সই করা চিরকুটের জোরে মুনেশ্বর সিং নউগচ্ছিয়ার বাজার থেকে একটা পাঁচ নম্বরের কড়া কিনে এনে আমার ঘরের মেঝেতে নামিয়ে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।

    “হো গেল, হুজুরকি কৃপা—সে কড়াই হো গেল!” তার আনন্দমুখর মুখের দিকে তাকিয়ে এই এক মাসের মধ্যে প্রথমবার মনে হলো—বেশ লোকগুলো। বড় কষ্ট তো এদের!


    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleথ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা
    Next Article নৌকাডুবি

    Related Articles

    চলিত ভাষার

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    চলিত ভাষার প্রবন্ধ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

    পালামৌ – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    April 20, 2025
    চলিত ভাষার

    বোঝা (গল্প) – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – চলিত ভাষায়

    April 10, 2025
    চলিত ভাষার

    আপদ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের – চলিত ভাষার

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }