Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চলিত ভাষার এক পাতা গল্প73 Mins Read0
    ⤶ ⤷

     

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    ১

    গ্রীষ্মকাল এল। গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের মাথায় পীরপৈঁতি পাহাড়ের দিক থেকে একদল বক উড়ে এসে বসল। দূর থেকে মনে হল যেন বটগাছের মাথা সাদা ফুলে ভরে গেছে।

    একদিন অর্ধশুষ্ক কাশের বনের ধারে টেবিল-চেয়ার পেতে কাজ করছি। মুনেশ্বর সিং সিপাহী এসে বলল, “হুজুর, নন্দলাল ওঝা গোলাওয়ালা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।”

    একটু পরে প্রায় পঞ্চাশ বছরের এক বৃদ্ধ লোক আমার সামনে এসে সালাম করল। আমার নির্দেশে একটা টুলে বসল। বসেই সে একটা পশমের থলে বের করল। তারপর থলের ভেতর থেকে ছোট একটা জাঁতি আর দুটো সুপারি বের করে সুপারি কাটতে শুরু করল। কাটা সুপারি হাতে রেখে দুই হাত একসঙ্গে করে আমার সামনে ধরে সসম্ভ্রমে বলল, “সুপারি নিন, হুজুর।”

    সুপারি এভাবে খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথা থেকে এসেছেন, কী কাজ?”

    লোকটা বলল, তার নাম নন্দলাল ওঝা, মৈথিল ব্রাহ্মণ। জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারি থেকে প্রায় এগারো মাইল দূরে সুংঠিয়া-দিয়ারায় তার বাড়ি। বাড়িতে চাষবাস আছে, কিছু সুদের কারবারও আছে। সে এসেছে আমাকে আগামী পূর্ণিমার দিন তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে। আমি কি তার বাড়িতে যেতে রাজি আছি? এই সৌভাগ্য কি তার হবে?

    এগারো মাইল দূরে এই রোদে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার লোভ আমার ছিল না। কিন্তু নন্দলাল ওঝা এত পীড়াপীড়ি করল যে, অগত্যা রাজি হলাম। তাছাড়া এদেশের গৃহস্থের সংসার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা জোগাড় করার লোভও সামলাতে পারলাম না।

    পূর্ণিমার দিন দুপুরের পর লম্বা কাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা হাতি আসতে দেখলাম। হাতি কাছারিতে এলে মাহুতের মুখে শুনলাম, হাতিটা নন্দলাল ওঝার। আমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে। হাতি পাঠানোর দরকার ছিল না, কারণ আমার নিজের ঘোড়ায় তুলনায় কম সময়ে পৌঁছতে পারতাম।

    যাই হোক, হাতিতে চড়েই নন্দলালের বাড়ির দিকে রওনা হলাম। সবুজ বনের মাথা আমার পায়ের তলায়, আকাশ যেন আমার মাথায় ঠেকছে। দূরে দিগন্তের নীল পাহাড়ের রেখা বনভূমিকে ঘিরে যেন মায়ার জগৎ তৈরি করেছে। আমি যেন সেই মায়ার জগতের বাসিন্দা, স্বর্গের দেবতা। মেঘের তলায় দিয়ে পৃথিবীর শ্যামল বনভূমির ওপরের নীল আকাশ ভেদ করে যেন আমার অদৃশ্য যাতায়াত।

    পথে চামটার বিল পড়ল। শীতের শেষেও সেখানে সিল্লি আর লাল হাঁসের ঝাঁক ভর্তি। আরেকটু গরম পড়লেই ওরা উড়ে পালাবে। মাঝে মাঝে খুব দরিদ্র পল্লি। ফণীমনসা-ঘেরা তামাকের ক্ষেত আর খোলায় ছাওয়া দীন কুঁড়েঘর।

    সুংঠিয়া গ্রামে হাতি ঢুকতেই দেখলাম, পথের দুই ধারে লোক সারবন্দি দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করতে। গ্রামে ঢুকে অল্প দূরেই নন্দলালের বাড়ি।

    খোলায় ছাওয়া মাটির ঘর আট-দশখানা, সব আলাদা আলাদা। প্রকাণ্ড উঠানের মাঝে ছড়ানো। আমি বাড়িতে ঢুকতেই দুবার হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ হল। চমকে গেলাম। এমন সময় হাসিমুখে নন্দলাল ওঝা এসে আমাকে অভ্যর্থনা করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে একটা বড় ঘরের দাওয়ায় চেয়ারে বসাল। চেয়ারটা এদেশের শিশুকাঠের তৈরি, গ্রামের মিস্ত্রির হাতে গড়া। তারপর দশ-এগারো বছরের একটা ছোট মেয়ে এসে আমার সামনে একটা থালা ধরল। থালায় কয়েকটা পান, সুপারি, একটা ছোট বাটিতে একটু আতর, আর কয়েকটা শুকনো খেজুর। এগুলো নিয়ে কী করতে হয় আমার জানা নেই। আমি আনাড়ির মতো হাসলাম আর বাটি থেকে আঙুলে একটু আতর তুলে নিলাম। মেয়েটিকে দু-একটা ভদ্রতার কথাও বললাম। মেয়েটি থালা রেখে চলে গেল।

    তারপর খাওয়ার ব্যবস্থা। নন্দলাল যে ঘটা করে খাওয়ানোর আয়োজন করেছে, তা আমার ধারণা ছিল না। বড় কাঠের পিঁড়িতে আসন পাতা। সামনে এমন বড় পিতলের থালা এল, যেটা দিয়ে আমাদের দেশে দুর্গাপূজার বড় নৈবেদ্য সাজানো হয়। থালায় হাতির কানের মতো পুরি, বাথুয়া শাক ভাজা, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেঁতুলের ঝোল, মহিষের দুধের দই, পেঁড়া। এমন অদ্ভুত খাবারের সমন্বয় কখনো দেখিনি। আমাকে দেখতে উঠানে লোকের ভিড় জমে গেছে। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন আমি কোনো অদেখা প্রাণী। শুনলাম, এরা সবাই নন্দলালের প্রজা।

    সন্ধ্যার আগে উঠে আসার সময় নন্দলাল একটা ছোট থলি আমার হাতে দিয়ে বলল, “হুজুরের নজর।” অবাক হলাম। থলিতে অনেক টাকা, পঞ্চাশের কম নয়। এত টাকা কেউ কাউকে নজর দেয় না। তাছাড়া নন্দলাল আমার প্রজাও নয়। নজর ফিরিয়ে দেওয়া গৃহস্থের কাছে নাকি অপমানজনক। তাই থলি খুলে একটা টাকা নিয়ে বাকিটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “তোমার ছেলেপুলেদের পেঁড়া খাওয়াও।”

    নন্দলাল কিছুতেই ছাড়বে না। আমি সে কথায় কান না দিয়ে বাইরে এসে হাতির পিঠে চড়লাম।

    পরদিনই নন্দলাল ওঝা আমার কাছারিতে গেল, সঙ্গে তার বড় ছেলে। আমি তাদের সমাদর করলাম। কিন্তু খাওয়ার প্রস্তাবে তারা রাজি হল না। শুনলাম, মৈথিল ব্রাহ্মণ অন্য ব্রাহ্মণের হাতের খাবার খায় না। অনেক বাজে কথার পর নন্দলাল একান্তে আমার কাছে কথা পাড়ল। তার বড় ছেলে ফুলকিয়া বইহারের তহসিলদারির জন্য উমেদার। আমাকে তাকে বহাল করতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিন্তু ফুলকিয়ার তহসিলদার তো আছে। সে পোস্ট তো খালি নেই।” নন্দলাল চোখ ঠেরে ইশারা করে বলল, “হুজুর, মালিক তো আপনি। আপনি চাইলে কী না হয়?”

    আমি আরো অবাক হলাম। এ কেমন কথা! ফুলকিয়ার তহসিলদার ভালোই কাজ করছে। তাকে কোন অপরাধে ছাড়ব?

    নন্দলাল বলল, “কত টাকা হুজুরকে পান খেতে দিতে হবে, বলুন। আমি আজ সন্ধ্যায় পৌঁছে দেব। কিন্তু আমার ছেলেকে তহসিলদারি দিতে হবে, হুজুর। বলুন কত, হুজুর। পাঁচশো?” এতক্ষণে বুঝলাম, নন্দলাল যে আমাকে কাল নেমন্তন্ন করেছিল, তার আসল উদ্দেশ্য কী। এদেশের লোক যে এত ধড়িবাজ, জানলে কি ওখানে যেতাম? আচ্ছা বিপদে পড়লাম তো!

    নন্দলালকে স্পষ্ট কথা বলে বিদায় করলাম। বুঝলাম, নন্দলাল আশা ছাড়েনি।

    আরেকদিন দেখি, ঘন বনের ধারে নন্দলাল আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

    কী কুক্ষণে ওর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম! দুখানা পুরি খাইয়ে সে যে আমার জীবন এমন অতিষ্ঠ করে তুলবে, তা আগে জানলে কি ওর ছায়া মাড়াতাম?

    নন্দলাল আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, “নমস্কার, হুজুর।”

    “হুঁ। তারপর, এখানে কী মনে করে?”

    “হুজুর সবই জানেন। আমি আপনাকে বারোশো টাকা নগদ দেব। আমার ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিন।”

    “তুমি পাগল, নন্দলাল? আমি বহাল করার মালিক নই। যাদের জমিদারি, তাদের কাছে দরখাস্ত করতে পারো। তাছাড়া এখন যে আছে, তাকে কোন অপরাধে ছাড়ব?”

    বলে আর কথা না বাড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম।

    ক্রমে আমার কড়া ব্যবহারে নন্দলালকে আমি আমার আর স্টেটের মহা শত্রু করে তুললাম। তখনো বুঝিনি, নন্দলাল কী রকম ভয়ঙ্কর প্রকৃতির মানুষ। এর ফল আমাকে ভালো করেই ভুগতে হয়েছিল।

    ২

    উনিশ মাইল দূরের ডাকঘর থেকে ডাক আনা এখানকার একটা জরুরি ঘটনা। এত দূরে প্রতিদিন লোক পাঠানো যায় না, তাই সপ্তাহে দুবার ডাকঘরে লোক যায়। মধ্য-এশিয়ার জনহীন, দুর্গম টাকলামাকান মরুভূমির তাঁবুতে বসে বিখ্যাত পর্যটক সোয়েন হেডিনও বোধ হয় এমন আগ্রহে ডাকের অপেক্ষা করতেন। আট-নয় মাস এখানে এসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই জনহীন বন-প্রান্তরে সূর্যাস্ত, নক্ষত্রের রাজি, চাঁদের উদয়, জ্যোৎস্না আর বনের মধ্যে নীলগাইয়ের দৌড় দেখতে দেখতে বাইরের জগতের সঙ্গে সব যোগ হারিয়ে ফেলেছি। ডাকের কয়েকটা চিঠির মধ্যে দিয়ে আবার তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়।

    নির্দিষ্ট দিনে জওয়াহিরলাল সিং ডাক আনতে গেছে। আজ দুপুরে সে আসবে। আমি আর বাঙালি মুহুরীবাবু ঘন ঘন জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছি। কাছারি থেকে মাইল দেড় দূরে একটা উঁচু ঢিবির ওপর দিয়ে পথ। ওখানে এলে জওয়াহিরলাল সিংকে স্পষ্ট দেখা যায়।

    দুপুর হয়ে গেল। জওয়াহিরলালের দেখা নেই। আমি ঘন ঘন ঘর থেকে বাইরে আসছি। এখানকার আপিসের কাজের সংখ্যা কম নয়। আমিনদের রিপোর্ট দেখা, দৈনিক ক্যাশবই সই করা, সদরের চিঠির উত্তর লেখা, পাটোয়ারি আর তহসিলদারের আদায়ের হিসাব পরীক্ষা, নানা দরখাস্তের ডিগ্রি-ডিসমিস করা, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, ভাগলপুরে নানা আদালতে মামলা ঝুলছে—সেসব জায়গার উকিল আর মামলা-তদবিরকারীদের রিপোর্ট পড়া আর উত্তর দেওয়া—আরো নানা বড়-ছোট কাজ প্রতিদিন নিয়ম মতো না করলে দু-তিন দিনে এত জমে যায় যে, কাজ শেষ করতে প্রাণান্ত হয়ে যায়। ডাক এলেই আরেক দঙ্গল কাজ এসে পড়ে। শহরের নানা ধরনের চিঠি, নানা আদেশ—অমুক জায়গায় যাও, অমুকের সঙ্গে অমুক মহলের বন্দোবস্ত করো, ইত্যাদি।

    বেলা তিনটের সময় জওয়াহিরলালের সাদা পাগড়ি রোদে চকচক করতে দেখা গেল। বাঙালি মুহুরীবাবু হাঁকলেন, “ম্যানেজারবাবু, আসুন, ডাকপিয়াদা আসছে—ওই যে—”

    আপিসের বাইরে এলাম। এদিকে জওয়াহিরলাল আবার ঢিবি থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি অপেরা গ্লাস এনে দেখলাম, দূরে জঙ্গলের মধ্যে লম্বা ঘাস আর বনঝাউয়ের মধ্যে সে আসছে। আপিসের কাজে আর মন বসল না। কী আকুল অপেক্ষা! যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য, মানুষের মনে তার মূল্য তত বেশি। এটা খুব সত্যি যে, এই মূল্য মানুষের মনের তৈরি একটা কৃত্রিম মূল্য। জিনিসের আসল উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু জগতের বেশিরভাগ জিনিসের ওপরই তো আমরা একটা কৃত্রিম মূল্য চাপিয়ে তাকে বড় বা ছোট করি।

    জওয়াহিরলালকে কাছারির সামনে একটা ছোট বালুময় জমির ওপারে দেখা গেল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। মুহুরীবাবু এগিয়ে গেলেন। জওয়াহিরলাল এসে সালাম করে দাঁড়াল। পকেট থেকে চিঠির তাড়া বের করে মুহুরীবাবুর হাতে দিল।

    আমারও দু-একটা চিঠি আছে, পরিচিত হাতের লেখা। চিঠি পড়তে পড়তে চারপাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কোথায় আছি? কখনো ভাবিনি আমি এখানে থাকব। কলকাতার আড্ডা ছেড়ে এমন জায়গায় দিনের পর দিন কাটাব। একটা বিলেতি ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়েছি, আজ সেটা এসেছে। মোড়কের ওপর লেখা “উড়োজাহাজের ডাকে”। জনাকীর্ণ কলকাতা শহরে বসে বিংশ শতাব্দীর এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুখ কি বোঝা যাবে? এখানে, এই নির্জন বন-প্রদেশে, সব বিষয়ে ভাবার আর অবাক হওয়ার সময় আছে। এখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সে-অনুভূতি এনে দেয়।

    সত্যি বলতে, জীবনে ভেবে দেখার শিক্ষা এখানে এসেই পেয়েছি। কত কথা মনে জাগে, কত পুরোনো কথা মনে হয়। নিজের মনকে এভাবে কখনো উপভোগ করিনি। এখানে হাজার রকম অসুবিধার মধ্যেও সেই আনন্দ আমাকে যেন একটা নেশার মতো পেয়ে বসছে দিন দিন।

    তবু আমি প্রশান্ত মহাসমুদ্রের কোনো জনহীন দ্বীপে একা পরিত্যক্ত হইনি। বোধ হয় বত্রিশ মাইলের মধ্যে রেলস্টেশন। সেখানে ট্রেনে চড়ে এক ঘণ্টায় পূর্ণিয়া, তিন ঘণ্টায় মুঙ্গের যেতে পারি। কিন্তু প্রথমত, রেলস্টেশনে যাওয়াই কষ্টকর। সে কষ্ট স্বীকার করতে পারি, যদি পূর্ণিয়া বা মুঙ্গেরে গিয়ে কিছু লাভ থাকে। দেখছি, কোনো লাভ নেই। না আমাকে কেউ চেনে, না আমি কাউকে চিনি। গিয়ে কী হবে?

    কলকাতা থেকে এসে বই আর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প ও আলোচনার অভাব এত বেশি টের পাই যে, কতবার ভেবেছি, এ জীবন আমার পক্ষে অসহ্য। কলকাতাতেই আমার সব। পূর্ণিয়া বা মুঙ্গেরে কে আছে যে সেখানে যাব? কিন্তু সদর-আপিসের অনুমতি ছাড়া কলকাতায় যেতে পারি না। তাছাড়া খরচও এত বেশি যে, দু-পাঁচ দিনের জন্য যাওয়া পোষায় না।

    ৩

    কয়েক মাস সুখে-দুঃখে কাটার পর চৈত্র মাসের শেষ থেকে এমন একটা কাণ্ড শুরু হল, যা আমার অভিজ্ঞতায় কখনো ছিল না। পৌষ মাসে কিছু কিছু বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে ঘোর অনাবৃষ্টি। মাঘে বৃষ্টি নেই, ফাল্গুনে নেই, চৈত্রে নেই, বৈশাখে নেই। সঙ্গে সঙ্গে যেমন অসহ্য গ্রীষ্ম, তেমনি ভয়ঙ্কর জলকষ্ট।

    সাদা কথায় গ্রীষ্ম বা জলকষ্ট বললে এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্বরূপ কিছুই বোঝানো যাবে না। উত্তরে আজমাবাদ থেকে দক্ষিণে কিষণপুর, পূর্বে ফুলকিয়া বইহার ও লবটুলিয়া থেকে পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমানা পর্যন্ত সারা জঙ্গল-মহলের মধ্যে যেখানে যত খাল, ডোবা, কুণ্ডী ছিল, সব শুকিয়ে গেছে। কুয়ো খুঁড়লে জল পাওয়া যায় না। যদি বালির নিচে থেকে কিছু জল ওঠে, ছোট এক বালতি জল জমতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। চারপাশে হাহাকার পড়ে গেছে। পূর্বে একমাত্র কুশী নদী ভরসা, সেটা আমাদের মহলের পূর্বতম প্রান্ত থেকে সাত-আট মাইল দূরে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের ওপারে। আমাদের জমিদারি আর মোহনপুরা জঙ্গলের মাঝে একটা ছোট পাহাড়ি নদী নেপালের তরাই থেকে বয়ে আসছে। কিন্তু এখন শুধু শুকনো বালুময় খাতে তার পাথরের চরণচিহ্ন রয়েছে। বালি খুঁড়লে যে জলটুকু পাওয়া যায়, তার লোভে দূরের গ্রাম থেকে মেয়েরা কলসি নিয়ে আসে। সারা দুপুর বালি-কাদা ছেঁচে আধ-কলসি ঘোলা জল নিয়ে বাড়ি ফেরে।

    কিন্তু পাহাড়ি নদী—স্থানীয় নাম মিছি নদী—আমাদের কোনো কাজে আসে না। কারণ আমাদের মহল থেকে অনেক দূরে। কাছারিতেও কোনো বড় ইঁদারা নেই। ছোট যে বালির পাতকুয়ো আছে, তা থেকে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তিন বালতি জল জোগাড় করতে দুপুর ঘুরে যায়।

    দুপুরে বাইরে দাঁড়িয়ে তাম্রাভ অগ্নিবর্ষী আকাশ আর অর্ধশুষ্ক বনঝাউ ও লম্বা ঘাসের বন দেখতে ভয় করে। চারপাশ যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে আগুনের হলকার মতো গরম বাতাস সারা শরীর ঝলসে দিয়ে বয়। সূর্যের এই রূপ, দুপুরের রোদের এই ভয়ঙ্কর রূপ কখনো দেখিনি, কল্পনাও করিনি। এক-এক দিন পশ্চিম দিক থেকে বালির ঝড় বয়। এসব দেশে চৈত্র-বৈশাখে পশ্চিমা বাতাসের সময়। কাছারি থেকে একশো গজ দূরের জিনিস ঘন বালি আর ধুলোর আড়ালে ঢেকে যায়।

    অর্ধেক দিন রামধনিয়া টহলদার এসে জানায়, “কুঁয়ামে পানি নেই ছে, হুজুর।” কোনো কোনো দিন ঘণ্টাখানেক ধরে ছেঁচে বালির ভেতর থেকে আধ বালতি তরল কাদা স্নানের জন্য আমার সামনে এনে ধরে। সেই ভয়ঙ্কর গ্রীষ্মে তাই তখন অমূল্য।

    একদিন দুপুরের পর কাছারির পিছনে একটা হরীতকী গাছের তলায় সামান্য ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চারদিকে তাকিয়ে মনে হল, দুপুরের এমন চেহারা কখনো দেখিনি। এ জায়গা থেকে চলে গেলে আর কোথাও এমন দেখব না। জন্ম থেকে বাংলা দেশের দুপুর দেখেছি, জ্যৈষ্ঠের খররোদ ভরা দুপুর দেখেছি, কিন্তু এই রুদ্রমূর্তি তার নেই। এই ভীম-ভৈরব রূপ আমাকে মুগ্ধ করল। সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা বিশাল অগ্নিকুণ্ড। ক্যালসিয়াম পুড়ছে, হাইড্রোজেন পুড়ছে, লোহা পুড়ছে, নিকেল পুড়ছে, কোবাল্ট পুড়ছে। জানা-অজানা শত শত গ্যাস আর ধাতু কোটি যোজন ব্যাসের দীপ্ত ফার্নেসে একসঙ্গে পুড়ছে। তারই ধু-ধু আগুনের ঢেউ অসীম শূন্যের ইথারের স্তর ভেদ করে ফুলকিয়া বইহার আর লোধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ জঙ্গলে এসে প্রতি ঘাসের পাতার শিরা-উপশিরার সব রস শুকিয়ে ঝামা করে, দিগদিগন্ত ঝলসে পুড়িয়ে শুরু করেছে ধ্বংসের এক তাণ্ডব লীলা। তাকিয়ে দেখলাম, দূরে প্রান্তরে কম্পমান তাপ-তরঙ্গ আর তার ওপারে তাপজনিত একটা অস্পষ্ট কুয়াশা। গ্রীষ্ম-দুপুরে এখানে আকাশ কখনো নীল দেখিনি। তাম্রাভ, কটা শূন্য। একটা চিল-শকুনিও নেই। পাখির দল দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কী অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে এই দুপুরে! খর তাপকে অগ্রাহ্য করে সেই হরীতকীতলায় দাঁড়িয়ে রইলাম কতক্ষণ। সাহারা দেখিনি, সোয়েন হেডিনের বিখ্যাত টাকলামাকান মরুভূমি দেখিনি, গোবি দেখিনি। কিন্তু এখানে মধ্যাহ্নের এই রুদ্রভৈরব রূপের মধ্যে সেসব জায়গার অস্পষ্ট আভাস ফুটে উঠল।

    কাছারি থেকে তিন মাইল দূরে একটা বনে ঘেরা ছোট কুণ্ডীতে সামান্য জল ছিল। শুনেছিলাম, গত বর্ষার জলে সেখানে অনেক মাছ হয়েছিল। খুব গভীর বলে এই অনাবৃষ্টিতেও জল পুরো শুকোয়নি। কিন্তু সে জল কারো কাজে লাগে না। প্রথমত, তার কাছাকাছি অনেক দূরে কোনো মানুষের বসতি নেই। দ্বিতীয়ত, জল আর তীরভূমির মাঝে কাদা এত গভীর যে, কোমর পর্যন্ত বসে যায়। কলসিতে জল ভরে তীরে ওঠার আশা কম। আরেকটা কারণ, জলটা ভালো নয়। স্নান বা পানের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। জলের সঙ্গে কী মিশে আছে জানি না, কিন্তু একটা অপ্রীতিকর ধাতব গন্ধ।

    একদিন সন্ধ্যায় পশ্চিমে বাতাস আর তাপ কমে গেলে ঘোড়ায় বেরিয়ে ওই কুণ্ডীর পাশের উঁচু বালিয়াড়ি আর বনঝাউয়ের জঙ্গলের পথে পৌঁছলাম। পিছনে গ্র্যাণ্ট সাহেবের সেই বড় বটগাছের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। কাছারির খানিকটা জল বাঁচানোর জন্য ভাবলাম, এখানে ঘোড়াকে একবার জল খাওয়াই। যত কাদাই হোক, ঘোড়া ঠিক উঠতে পারবে। জঙ্গল পেরিয়ে কুণ্ডীর ধারে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। কুণ্ডীর চারপাশে কাদার ওপর আট-দশটা ছোট-বড় সাপ। অন্য দিকে তিনটে প্রকাণ্ড মহিষ একসঙ্গে জল খাচ্ছে। সাপগুলো সব বিষাক্ত, করাত আর শঙ্খচিতি জাতের, যা এদেশে সাধারণত দেখা যায়।

    মহিষ দেখে মনে হল, এমন মহিষ আর কখনো দেখিনি। বিশাল একজোড়া শিং, গায়ে লম্বা লোম, বিপুল শরীর। কাছেও কোনো লোকালয় বা মহিষের বাথান নেই। তবে এ মহিষ কোথা থেকে এল, বুঝতে পারলাম না। ভাবলাম, চরির খাজনা ফাঁকি দেওয়ার জন্য কেউ হয়তো জঙ্গলের মধ্যে কোথাও বাথান করে রেখেছে। কাছারির কাছে এসে মুনেশ্বর সিং চাকলাদারের সঙ্গে দেখা। তাকে কথাটা বলতেই সে চমকে উঠল, “আরে সর্বনাশ! কী বলেন, হুজুর! হনুমানজি খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন আজ! ও পোষা মহিষ নয়, ও বুনো মহিষ, হুজুর। মোহনপুরা জঙ্গল থেকে জল খেতে এসেছে। ও অঞ্চলে কোথাও জল নেই তো। জলকষ্টে পড়ে এসেছে।”

    কাছারিতে তখনই কথাটা রটে গেল। সবাই একবাক্যে বলল, “উঃ, হুজুর খুব বেঁচে গেছেন। বাঘের হাতে পড়লে বরং রক্ষা পাওয়া যেত। বুনো মহিষের হাতে পড়লে নিস্তার নেই। এই সন্ধ্যাবেলা নির্জন জায়গায় যদি একবার ওরা আপনাকে তাড়া করত, ঘোড়া ছুটিয়ে বাঁচতে পারতেন না, হুজুর।”

    তারপর থেকে জঙ্গলে ঘেরা ওই ছোট কুণ্ডীটা বন্য জানোয়ারের জলপানের একটা প্রধান আড্ডা হয়ে দাঁড়াল। অনাবৃষ্টি যত বাড়তে লাগল, রোদের তেজ যত বাড়তে লাগল, দিকদিগন্তে দাবদাহ যত প্রচণ্ড হতে লাগল, খবর আসতে লাগল—ওই জঙ্গলের মধ্যে কুণ্ডীতে লোকে বাঘকে জল খেতে দেখেছে, বন-মহিষকে দেখেছে, হরিণের পালকে দেখেছে। নীলগাই আর বুনো শুয়োর তো আছেই, কারণ এই দুই জানোয়ার এই জঙ্গলে বেশি। আমি নিজে আরেকদিন জ্যোৎস্নারাতে ঘোড়ায় করে কুণ্ডীতে গেলাম শিকারের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে তিন-চারজন সিপাহী ছিল, দু-তিনটে বন্দুকও ছিল। সে রাতে যা দেখলাম, জীবনে ভোলার নয়। তা বোঝাতে হলে কল্পনায় ছবি আঁকতে হবে এক জনহীন জ্যোৎস্নাময়ী রাত আর বিস্তীর্ণ বনপ্রান্তরের। আরো কল্পনা করতে হবে সারা বনভূমি জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। অভিজ্ঞতা না থাকলে সে নিস্তব্ধতা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।

    গরম বাতাস অর্ধশুষ্ক কাশ-ডাঁটার গন্ধে ভরে উঠেছে। লোকালয় থেকে অনেক দূরে এসেছি। দিগ্বিদিকের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।

    কুণ্ডীতে প্রায় নিঃশব্দে জল খাচ্ছে একদিকে দুটো নীলগাই, অন্যদিকে দুটো হায়েনা। নীলগাই দুটো একবার হায়েনাদের দিকে তাকাচ্ছে, হায়েনারা একবার নীলগাইদের দিকে তাকাচ্ছে। আর দুই দলের মাঝখানে দু-তিন মাস বয়সের একটা ছোট নীলগাইয়ের বাচ্চা। এমন করুণ দৃশ্য কখনো দেখিনি। দেখে পিপাসার্ত বন্য জানোয়ারদের নিরীহ শরীরে অতর্কিতে গুলি মারার ইচ্ছে হল না।

    এদিকে বৈশাখও কেটে গেল। কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। একটা বিপদ দেখা দিল। এই বিশাল বনপ্রান্তরের মাঝে মাঝে লোকে আগেও দিক হারিয়ে পথ ভুলে যেত। এখন এই পথহারা পথিকদের জলাভাবে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হল। কারণ ফুলকিয়া বইহার থেকে গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছ পর্যন্ত বিশাল তৃণভূমির মধ্যে কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। এক-আধটা শুকনো কুণ্ড যেখানে আছে, অভিজ্ঞতাহীন পথভ্রান্ত পথিকদের পক্ষে সেগুলো খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। একদিনের ঘটনা বলি।

    ৪

    সেদিন বেলা চারটের সময় ভীষণ গরমে কাজে মন বসাতে না পেরে একটা বই পড়ছি। এমন সময় রামবিরিজ সিং এসে খবর দিল, কাছারির পশ্চিমে উঁচু ডাঙার ওপর একজন অদ্ভুত পাগলা লোক দেখা যাচ্ছে। সে হাত-পা নাড়ছে আর দূর থেকে কী যেন বলছে। বাইরে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই দূরের ডাঙায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে। মনে হল মাতালের মতো টলতে টলতে এদিকে আসছে। কাছারির সবাই হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে। আমি দুজন সিপাহী পাঠিয়ে লোকটাকে এখানে আনতে বললাম।

    লোকটাকে যখন আনা হল, দেখলাম তার গায়ে কোনো জামা নেই। শুধু একটা ফরসা ধুতি পরা। চেহারা ভালো, রং গৌর। কিন্তু মুখের আকৃতি ভীষণ। গালের দুই কোণ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল, উন্মাদের মতো দৃষ্টি। আমার ঘরের দাওয়ায় একটা বালতিতে জল ছিল। তা দেখে সে পাগলের মতো ছুটে বালতির দিকে গেল। মুনেশ্বর সিং চাকলাদার ব্যাপারটা বুঝে তাড়াতাড়ি বালতি সরিয়ে নিল। তারপর তাকে বসিয়ে হাঁ করিয়ে দেখা গেল, জিভ ফুলে বীভৎস অবস্থা। অনেক কষ্টে জিভটা মুখের একপাশে সরিয়ে একটু একটু করে তার মুখে জল দিতে দিতে আধ ঘণ্টা পরে লোকটা কিছুটা সুস্থ হল। কাছারিতে লেবু ছিল। লেবুর রস আর গরম জল এক গ্লাস তাকে খাওয়ালাম। ঘণ্টাখানেক পরে সে পুরো সুস্থ হয়ে উঠল। শুনলাম, তার বাড়ি পাটনা। গালার চাষ করার জন্য এ অঞ্চলে কুলের জঙ্গলের খোঁজে পূর্ণিয়া থেকে রওনা হয়েছে দুদিন আগে। তারপর দুপুরে আমাদের মহলে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পরে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমন একঘেয়ে গাছে ভরা জঙ্গলে দিক ভুল করা খুব সহজ, বিশেষ করে বিদেশি লোকের পক্ষে। কালকের ভীষণ গরমে আর পশ্চিমা বাতাসের দমকে সারা বিকেল ঘুরেছে। কোথাও এক ফোঁটা জল পায়নি, একটা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়নি। রাতে ক্লান্ত অবস্থায় একটা গাছের তলায় শুয়ে ছিল। আজ সকাল থেকে আবার ঘোরা শুরু করেছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখলে সূর্য দেখে দিক নির্ণয় করা তার পক্ষে কঠিন হত না। অন্তত পূর্ণিয়ায় ফিরে যেতে পারত। কিন্তু ভয়ে দিশেহারা হয়ে একবার এদিক, একবার ওদিক ছুটেছে সারা দুপুর। তার ওপর খুব চিৎকার করে লোক ডাকার চেষ্টা করেছে। কোথায় লোক? ফুলকিয়া বইহারের কুলের জঙ্গল থেকে লবটুলিয়া পর্যন্ত দশ-বারো বর্গমাইল জঙ্গল সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। তাই তার চিৎকার কেউ শোনেনি। আরো তার আতঙ্কের কারণ, সে ভেবেছিল, তাকে জঙ্গলে জিন-পরী ধরেছে। মেরে না ফেলে ছাড়বে না। তার গায়ে একটা জামা ছিল, কিন্তু আজ অসহ্য পিপাসায় দুপুরের পর এমন গা-জ্বলুনি শুরু হয়েছিল যে, জামাটা খুলে কোথায় ফেলে দিয়েছে। এই অবস্থায় দৈবক্রমে আমাদের কাছারির হনুমানের ধ্বজার লাল নিশানটা দূর থেকে তার চোখে না পড়লে লোকটা আজ বেঘোরে মারা পড়ত।

    একদিন এই ভয়ঙ্কর গরম আর জলকষ্টের দিনে ঠিক দুপুরে খবর পেলাম, নৈঋত কোণে মাইলখানেক দূরে জঙ্গলে ভয়ঙ্কর আগুন লেগেছে। আগুন কাছারির দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, প্রচুর ধোঁয়ার সঙ্গে লাল অগ্নিশিখা লকলক করে আকাশে উঠছে। সেদিন আবার দারুণ পশ্চিমা বাতাস। লম্বা ঘাস আর বনঝাউয়ের জঙ্গল সূর্যতাপে অর্ধশুষ্ক হয়ে বারুদের মতো হয়ে আছে। এক-একটা স্ফুলিঙ্গ পড়তেই গোটা ঝোপ জ্বলে উঠছে। সেদিকে যতদূর চোখ যায়, ঘন নীল ধোঁয়া আর অগ্নিশিখা। চটচট শব্দ। ঝড়ের মুখে পশ্চিম থেকে পূর্বে বাঁকা আগুনের শিখা ডাকগাড়ির বেগে ছুটে আসছে আমাদের কয়েকটা খড়ের বাংলোর দিকে। সবার মুখ শুকিয়ে গেল। এখানে থাকলে আপাতত বেড়া-আগুনে ঝলসে মরতে হয়। দাবানল তো এসে পড়ল!

    ভাবার সময় নেই। কাছারির দরকারি কাগজপত্র, তহবিলের টাকা, সরকারি দলিল, ম্যাপ, সব মজুত। এ ছাড়া আমাদের ব্যক্তিগত জিনিস তো আছেই। এসব তো যায়! সিপাহীরা শুকনো মুখে ভীত কণ্ঠে বলল, “আগ তো আ গৈল, হুজুর!” বললাম, “সব জিনিস বের করো। সরকারি তহবিল আর কাগজপত্র আগে।”

    কিছু লোক লেগে গেল আগুন আর কাছারির মাঝে যে জঙ্গল আছে, তা যতটা পারা যায় কেটে পরিষ্কার করতে। জঙ্গলের মধ্যে বাথান থেকে আগুন দেখে বাথানওয়ালা চরির প্রজা দু-দশ জন ছুটে এল কাছারি বাঁচাতে। কারণ পশ্চিমা বাতাসের বেগ দেখে তারা বুঝেছে, কাছারি ঘোর বিপদে।

    কী অদ্ভুত দৃশ্য! জঙ্গল ভেঙে ছিঁড়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে নীলগাইয়ের দল প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছে, শিয়াল দৌড়চ্ছে, কান উঁচু করে খরগোশ দৌড়চ্ছে। একদল বন্যশূকর ছানাপোনা নিয়ে কাছারির উঠান দিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ছুটে গেল। ওই অঞ্চলের বাথান থেকে পোষা মহিষের দল ছাড়া পেয়ে প্রাণপণে ছুটছে। একঝাঁক বনটিয়া মাথার ওপর দিয়ে সোঁ করে উড়ে পালাল। পিছনে পিছনে একটা বড় ঝাঁক লাল হাঁস। আবার এক ঝাঁক বনটিয়া, কয়েকটা সিল্লি। রামবিরিজ সিং চাকলাদার অবাক হয়ে বলল, “পানি কাঁহা নেই ছে… আরে এ লাল হাঁসকা জেরা কাঁহাসে আয়া, ভাই রামলগন?” গোষ্ঠ মুহুরী বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ বাপু, রাখো। এখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি, লাল হাঁস কোথা থেকে এল, তার হিসেবে কী দরকার?”

    আগুন বিশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়ল। তারপর দশ-পনেরো জন লোক মিলে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগুনের সঙ্গে কী যুদ্ধ! জল কোথাও নেই। আধকাঁচা গাছের ডাল আর বালি এই মাত্র অস্ত্র। সবার মুখচোখ আগুন আর রোদের তাপে দৈত্যের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সারা শরীরে ছাই আর কালি। হাতের শিরা ফুলে উঠেছে। অনেকের গায়ে-হাতে ফোস্কা। এদিকে কাছারির সব জিনিসপত্র—বাক্স, খাট, দেরাজ, আলমারি—তখনো টানাটানি করে বাইরে ফেলা হচ্ছে। কোথাকার জিনিস কোথায় গেল, কে তার ঠিকানা রাখে! মুহুরীবাবুকে বললাম, “ক্যাশ আপনার জিম্মায় রাখুন, আর দলিলের বাক্সটা।”

    কাছারির উঠান আর পরিষ্কৃত জায়গায় বাধা পেয়ে আগুনের স্রোত উত্তর আর দক্ষিণ দিয়ে নিমেষে পূর্বমুখে ছুটল। কাছারিটা কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে গেল এ যাত্রা। জিনিসপত্র আবার ঘরে তোলা হল। কিন্তু অনেক দূরে পূর্বাকাশ লাল করে লোলজিহ্বা প্রলয়ংকরী অগ্নিশিখা সারা রাত ধরে জ্বলতে জ্বলতে সকালের দিকে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের সীমানায় গিয়ে পৌঁছল।

    দু-তিন দিন পরে খবর পাওয়া গেল, কারো আর কুশী নদীর তীরের কর্দমে আট-দশটা বন্য মহিষ, দুটো চিতা বাঘ, কয়েকটা নীলগাই হাবড়ে পড়ে পুঁতে রয়েছে। তারা আগুন দেখে মোহনপুরা জঙ্গল থেকে প্রাণভয়ে নদীর ধার দিয়ে ছুটতে ছুটতে হাবড়ে পড়ে গেছে। অথচ রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কুশী আর কারো নদী প্রায় আট-নয় মাইল দূরে।

     

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleথ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা
    Next Article নৌকাডুবি

    Related Articles

    চলিত ভাষার

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    চলিত ভাষার প্রবন্ধ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

    পালামৌ – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    April 20, 2025
    চলিত ভাষার

    বোঝা (গল্প) – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – চলিত ভাষায়

    April 10, 2025
    চলিত ভাষার

    আপদ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের – চলিত ভাষার

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }