Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চলিত ভাষার এক পাতা গল্প73 Mins Read0
    ⤶ ⤷

     

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    ১

    বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ কেটে গিয়ে আষাঢ় এল। আষাঢ় মাসের শুরুতেই কাছারির পুণ্যাহ উৎসব। এখানে মানুষের মুখ বেশি দেখা যায় না বলে আমার একটা শখ ছিল, পুণ্যাহের দিনে অনেক লোক নেমন্তন্ন করে খাওয়াব। কাছে কোনো গ্রাম নেই বলে আমরা গনোরী তেওয়ারীকে পাঠিয়ে দূরের বস্তির লোকদের নেমন্তন্ন করলাম। পুণ্যাহের আগের দিন থেকে আকাশ মেঘলা হয়ে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল, আর পুণ্যাহের দিন আকাশ ভেঙে পড়ল। দুপুর থেকেই দলে দলে লোক নেমন্তন্ন খাওয়ার লোভে মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাছারিতে পৌঁছতে লাগল। এমন মুশকিল যে, তাদের বসার জায়গা দেওয়া যায় না। দলে অনেক মেয়ে ছেলেপুলে নিয়ে এসেছে। তাদের কাছারির দপ্তরখানায় বসার ব্যবস্থা করলাম। পুরুষরা যে যেখানে পারল আশ্রয় নিল।

    এখানে খাওয়ানোর কোনো ঝামেলা নেই। এত গরিব দেশ যে এমনটা থাকতে পারে, আমার জানা ছিল না। বাংলাদেশ যতই গরিব হোক, এদের দেশের সাধারণ লোকের তুলনায় বাংলার গরিবরাও অনেক বেশি অবস্থাপন্ন। এরা এই মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় করে খেতে এসেছে চীনা ঘাসের দানা, টক দই, ভেলি গুড় আর লাড্ডু। কারণ এটাই এখানকার সাধারণ ভোজের খাবার।

    দশ-বারো বছরের একটা অচেনা ছেলে সকাল থেকে খুব খাটছিল। গরিব ঘরের ছেলে, নাম বিশুয়া। দূরের কোনো বস্তি থেকে এসে থাকবে। বেলা দশটার সময় সে কিছু জলখাবার চাইল। ভাঁড়ারের ভার ছিল লবটুলিয়ার পাটোয়ারীর ওপর। সে এক খুঁচি চীনার দানা আর একটু নুন তাকে এনে দিল।

    আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছেলেটা কালো কুচকুচে, সুশ্রী মুখটা যেন পাথরের কৃষ্ণঠাকুর। মলিন মোটা মার্কিনের আটহাতি থান কাপড়ের খুঁট পেতে যখন সে ব্যস্ত হয়ে সেই তুচ্ছ জলখাবার নিল, তখন তার মুখে সে কী খুশির হাসি! আমি বলতে পারি, এমন গরিব অবস্থার কোনো বাঙালি ছেলেও চীনার দানা কখনো খাবে না, খুশি হওয়া তো দূরের কথা। কারণ, একবার শখ করে চীনার দানা খেয়ে যে স্বাদ পেয়েছি, তাতে মুখরোচক সুখাদ্যের হিসেবে তাকে কখনোই উল্লেখ করতে পারব না।

    বৃষ্টির মধ্যে কোনোরকমে ব্রাহ্মণভোজন একরকম শেষ হল। বিকেলের দিকে দেখি, ঘোর অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে তিনটে মেয়ে উঠানে পাতা পেতে বসে ভিজে ঝুপসি হয়ে যাচ্ছে—সঙ্গে দুটো ছোট ছেলেমেয়েও। তাদের পাতে চীনার দানা আছে, কিন্তু দই বা ভেলি গুড় কেউ দিয়ে যায়নি। তারা হাঁ করে কাছারিঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাটোয়ারীকে ডেকে বললাম, “এদের কে দিচ্ছে? এরা বসে আছে কেন? আর এদের এই বৃষ্টির মধ্যে উঠানে বসিয়েছে কে?”

    পাটোয়ারী বলল, “হুজুর, ওরা জাতে দোষাদ। ওদের ঘরের দাওয়ায় তুললে ঘরের সব জিনিসপত্র ফেলা যাবে। কোনো ব্রাহ্মণ, ছত্রী কি গাঙ্গোতা সে জিনিস খাবে না। আর জায়গাই বা কোথায় আছে বলুন?”

    ওই গরিব দোষাদ মেয়ে কয়টির সামনে আমি গিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়াতে লাগলাম। লোকজন ব্যস্ত হয়ে তাদের পরিবেশন করতে শুরু করল। সামান্য চীনার দানা, গুড় আর টক দই এক-একজন যে পরিমাণে খেল, চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। এই ভোজ খাওয়ার জন্য এত আগ্রহ দেখে ঠিক করলাম, দোষাদদের এই মেয়েদের নেমন্তন্ন করে একদিন খুব ভালো করে সত্যিকারের সভ্য খাবার খাওয়াব। সপ্তাহখানেক পরে পাটোয়ারী দিয়ে দোষাদপাড়ার মেয়ে কয়টি আর তাদের ছেলেমেয়েদের নেমন্তন্ন করলাম। সেদিন তারা যা খেল—লুচি, মাছ, মাংস, ক্ষীর, দই, পায়েস, চাটনি—জীবনে কখনো এমন ভোজ খাওয়ার কল্পনাও করেনি। তাদের বিস্মিত আর আনন্দিত চোখ-মুখের হাসি কতদিন আমার মনে ছিল! সেই ভবঘুরে গাঙ্গোতা ছোকরা বিশুয়াও সে দলে ছিল।

    ২

    সার্ভে-ক্যাম্প থেকে একদিন ঘোড়ায় ফিরছি। বনের মধ্যে একটা লোক কাশঘাসের ঝোপের পাশে বসে কলাইয়ের ছাতু মাখছে। পাত্রের অভাবে ময়লা থান কাপড়ের প্রান্তেই ছাতুটা মাখছে—এত বড় একটা তাল যে, একজন লোক, হলই বা হিন্দুস্থানি, মানুষ তো বটে—কী করে অত ছাতু খেতে পারে, এ আমার বুদ্ধির বাইরে। আমাকে দেখে লোকটা সম্ভ্রমে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম করে বলল, “ম্যানেজার সাহেব! থোড়া জলখাই করতে হেঁ হুজুর, মাফ কিজিয়ে।”

    একজন নির্জনে বসে শান্তভাবে জলখাবার খাচ্ছে, এতে মাফ করার কী আছে, খুঁজে পেলাম না। বললাম, “খাও, খাও, তুমাকে উঠতে হবে না। নাম কী তোমার?”

    লোকটা তখনো বসেনি, দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমে বলল, “গরিব কা নাম ধাওতাল সাহু, হুজুর।”

    চেয়ে দেখে মনে হল, লোকটার বয়স ষাটের ওপর হবে। রোগা-লম্বা চেহারা, গায়ের রং কালো, পরনে খুব মলিন থান আর মেরজাই, পা খালি।

    ধাওতাল সাহুর সঙ্গে এই আমার প্রথম আলাপ।

    কাছারিতে এসে রামজোত পাটোয়ারীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ধাওতাল সাহুকে চেনো?”

    রামজোত বলল, “জ্বি হুজুর। ধাওতাল সাহুকে এ অঞ্চলে কে না জানে? সে মস্ত বড় মহাজন, লক্ষপতি লোক, এদিকে সবাই তার খাতক।” পাটোয়ারীর কথা শুনে খুব অবাক হলাম। লক্ষপতি লোক বনের মধ্যে বসে ময়লা উড়ানির প্রান্তে এক তাল নিরুপকরণ কলাইয়ের ছাতু খাচ্ছে—এ দৃশ্য কোনো বাঙালি লক্ষপতির ক্ষেত্রে অন্তত কল্পনা করা খুব কঠিন। ভাবলাম, পাটোয়ারী বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু কাছারিতে যাকে জিজ্ঞেস করি, সে-ই বলে, “ধাওতাল সাহু? তার টাকার লেখাজোখা নেই।”

    এরপর নিজের কাজে ধাওতাল সাহু অনেকবার কাছারিতে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। প্রতিবার একটু একটু করে তার সঙ্গে আলাপ জমে উঠলে বুঝলাম, একটা অদ্ভুত লোকোত্তর চরিত্রের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। বিংশ শতাব্দীতে এমন লোক যে আছে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

    ধাওতালের বয়স যা আন্দাজ করেছিলাম, প্রায় তেষট্টি-চৌষট্টি। কাছারির পূর্ব-দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের প্রান্ত থেকে বারো-তেরো মাইল দূরে নওগছিয়া নামে গ্রামে তার বাড়ি। এ অঞ্চলে প্রজা, জোতদার, জমিদার, ব্যবসাদার প্রায় সবাই ধাওতাল সাহুর খাতক। কিন্তু তার মজা এই যে, টাকা ধার দিয়ে সে জোর করে কখনো তাগাদা করতে পারে না। কত লোক যে তার কত টাকা ফাঁকি দিয়েছে! তার মতো নিরীহ, ভালোমানুষের মহাজন হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু লোকের অনুরোধ সে এড়াতে পারে না। বিশেষ করে সে বলে, যখন সবাই মোটা সুদ লিখে দিয়েছে, তখন ব্যবসা হিসেবেও তো টাকা দেওয়া উচিত। একদিন ধাওতাল আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, উড়ানিতে বাঁধা এক বাণ্ডিল পুরোনো দলিলপত্র। বলল, “হুজুর, মেহেরবানি করে একটু দেখবেন দলিলগুলো?”

    পরীক্ষা করে দেখি, প্রায় আট-দশ হাজার টাকার দলিল ঠিক সময়ে নালিশ না করার দরুন তামাদি হয়ে গেছে।

    উড়ানির আরেক মুড়ো খুলে সে আরো কিছু জরাজীর্ণ কাগজ বের করে বলল, “এগুলো দেখুন দেখি হুজুর। ভাবি একবার জেলায় গিয়ে উকিলদের দেখাই, তা মামলা কখনো করিনি, করা পোষায় না। তাগাদা করি, ‘দিচ্ছি দেব’ করে টাকা দেয় না অনেকে।”

    দেখলাম, সবগুলোই তামাদি দলিল। সব মিলিয়ে সেও চার-পাঁচ হাজার টাকা। ভালোমানুষকে সবাই ঠকায়। বললাম, “সাহুজী, মহাজনী করা তোমার কাজ নয়। এ অঞ্চলে মহাজনী করতে পারবে রাসবিহারী সিং রাজপুতের মতো দুঁদে লোকরা, যাদের সাত-আটটা লাঠিয়াল আছে। তারা খাতকের ক্ষেতে নিজে ঘোড়ায় গিয়ে লাঠিয়াল মোতায়েন করে, ফসল ক্রোক করে টাকা আর সুদ আদায় করে। তোমার মতো ভালোমানুষের টাকা কেউ শোধ করবে না। আর কাউকে দিও না।”

    ধাওতালকে বোঝাতে পারলাম না। সে বলল, “সবাই ফাঁকি দেয় না হুজুর। এখনো চন্দ্র-সূর্য উঠছে, মাথার ওপর দীন-দুনিয়ার মালিক এখনো আছে। টাকা কি বসিয়ে রাখলে চলে? সুদে না বাড়লে আমাদের চলে না হুজুর। এই আমাদের ব্যবসা।”

    তার এ যুক্তি আমি বুঝতে পারলাম না। সুদের লোভে আসল টাকা নষ্ট হতে দেওয়া কেমন ব্যবসা জানি না। ধাওতাল সাহু আমার সামনেই অম্লান মুখে পনের-ষোল হাজার টাকার তামাদি দলিল ছিঁড়ে ফেলল—এমনভাবে ছিঁড়ল যেন সেগুলো বাজে কাগজ। অবশ্য, বাজে কাগজের পর্যায়েই তারা এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাত কাঁপল না, গলার সুর কাঁপল না।

    বলল, “রাঁইচি আর রেড়ির বীজ বিক্রি করে টাকা করেছিলাম হুজুর, নইলে আমার পৈতৃক আমলের একটা ঘষা পয়সাও ছিল না। আমিই করেছি, আবার আমিই লোকসান দিচ্ছি। ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান আছেই হুজুর।”

    তা আছে, স্বীকার করি। কিন্তু কয়জন লোক এত বড় ক্ষতি এমন শান্তমুখে উদাসীনভাবে সহ্য করতে পারে, সেই কথাই ভাবছিলাম। তার বড়মানুষি গর্ব দেখলাম শুধু একটা ব্যাপারে। একটা লাল কাপড়ের বাটুয়া থেকে সে মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা জাঁতি আর সুপারি বের করে কেটে মুখে ফেলে দেয়। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে একবার বলেছিল, “রোজ এক কনোয়া করে সুপারি খাই বাবুজী। সুপারির বড় খরচ আমার।” বিত্তে নিস্পৃহতা আর বড় ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য করার ক্ষমতা যদি দার্শনিকতা হয়, তবে ধাওতাল সাহুর মতো দার্শনিক আমি তো অন্তত দেখিনি।

    ৩

    ফুলকিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আমি প্রতিবারই জয়পাল কুমারের মকাইয়ের পাতা-ছাওয়া ছোট্ট ঘরখানার সামনে দিয়ে যেতাম। কুমার মানে কুম্ভকার নয়, ভুঁইহার বামুন।

    খুব বড় একটা প্রাচীন পাকুড় গাছের নিচেই জয়পালের ঘর। সংসারে সে একেবারে একা, বয়সেও প্রাচীন, লম্বা রোগা চেহারা, মাথায় লম্বা সাদা চুল। যখনই যেতাম, তখনই দেখতাম কুঁড়েঘরের দরজার গোড়ায় সে চুপ করে বসে আছে। জয়পাল তামাক খেত না, কখনো তাকে কোনো কাজ করতে দেখেছি বলেও মনে হয় না, গান গাইতে শুনিনি—একেবারে কর্মশূন্য অবস্থায় মানুষ কীভাবে এমন ঠায় চুপ করে বসে থাকতে পারে, জানি না। জয়পালকে দেখে বড় বিস্ময় আর কৌতূহল হত। প্রতিবারই তার ঘরের সামনে ঘোড়া থামিয়ে তার সঙ্গে দুটো কথা না বলে যেতে পারতাম না।

    জিজ্ঞেস করলাম, “জয়পাল, কী করো বসে?”

    —এই, বসে আছি হুজুর।

    —বয়স কত হল?

    —তা হিসেব রাখিনি, তবে যেবার কুশীনদীর পুল হল, তখন আমি মহিষ চরাতে পারি।

    —বিয়ে করেছিলে? ছেলেপুলে ছিল?

    —পরিবার মরে গেছে আজ বিশ-পঁচিশ বছর। দুটো মেয়ে ছিল, তারাও মারা গেল। সেও তের-চোদ্দ বছর আগে। এখন একাই আছি।

    —আচ্ছা, এই যে একা এখানে থাকো, কারো সঙ্গে কথা বলো না, কোথাও যাও না, কিছু করো না—এ ভালো লাগে? একঘেয়ে লাগে না?

    জয়পাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন খারাপ লাগবে হুজুর? বেশ থাকি। কিছু খারাপ লাগে না।”

    জয়পালের এই কথাটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। আমি কলকাতার কলেজে পড়ে মানুষ হয়েছি। হয় কোনো কাজ, নয়তো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, নয় বই, নয় সিনেমা, নয় বেড়ানো—এ ছাড়া মানুষ কীভাবে থাকে বুঝি না। ভেবে দেখতাম, দুনিয়ার কত কী বদলে গেল, গত বিশ বছর ধরে জয়পাল কুমার তার ঘরের দরজায় ঠায় চুপ করে বসে বসে তার কতটুকু খবর রাখে? আমি যখন ছেলেবেলায় স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়তাম, তখনো জয়পাল এমনি বসে থাকত। বি.এ. পাশ করলাম, তখনো জয়পাল এমনি বসে থাকে। আমার জীবনের নানা ছোট-বড় ঘটনা, যা আমার কাছে পরম বিস্ময়কর, তারই সঙ্গে মিলিয়ে জয়পালের এই বৈচিত্র্যহীন নির্জন জীবনের অতীত দিনগুলোর কথা ভাবতাম।

    জয়পালের ঘরখানা গ্রামের মাঝখানে হলেও কাছে অনেকটা পতিত জমি আর মকাই-ক্ষেত। তাই আশপাশে কোনো বসতি নেই। ফুলকিয়া ছোট্ট গ্রাম, দশ-পনেরো ঘর লোকের বাস। সবাই চারদিকের জঙ্গলমহলে মহিষ চরিয়ে দিন গুজরান করে। সারাদিন ভূতের মতো খাটে আর সন্ধ্যায় কলাইয়ের ভুসির আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে পাড়াসুদ্ধ বসে গল্পগুজব করে, খৈনি খায় কিংবা শালপাতার পিকার ধূমপান করে। হুঁকায় তামাক খাওয়ার চল এখানে খুবই কম। কিন্তু কখনো কাউকে জয়পালের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখিনি।

    প্রাচীন পাকুড় গাছটার মগডালে বকেরা দল বেঁধে বাস করে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, গাছের মাথায় থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটেছে। জায়গাটা ঘন ছায়াভরা, নির্জন। আর সেখানে দাঁড়িয়ে যে দিকেই চোখ পড়ে, সে দিকেই নীল নীল পাহাড় দূরদিগন্তে হাত ধরাধরি করে ছোট ছেলেমেয়েদের মতো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি পাকুড় গাছের ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে যখন জয়পালের সঙ্গে কথা বলতাম, তখন আমার মনে এই বিশাল বৃক্ষতলের নিবিড় শান্তি আর গৃহস্বামীর অনুদ্বিগ্ন, নিস্পৃহ, ধীর জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে কেমন একটা প্রভাব ফেলত। ছুটাছুটি করে বেড়িয়ে লাভ কী? কী সুন্দর ছায়া এই শ্যাম বংশী-বটের, কেমন মন্থর যমুনাজল, অতীতের শত শতাব্দী পায়ে পায়ে পার হয়ে সময়ের উজানে চলে যাওয়া কী আরামের!

    কিছু জয়পালের জীবনযাত্রার প্রভাব আর কিছু চারদিকের বাধাবন্ধনহীন প্রকৃতি আমাকেও ক্রমে ক্রমে যেন জয়পাল কুমারের মতো নির্বিকার, উদাসীন আর নিস্পৃহ করে তুলছিল। শুধু তাই নয়, আমার যে চোখ কখনো এর আগে ফোটেনি, সে চোখ যেন ফুটেছে। যে-সব কথা কখনো ভাবিনি, তাই ভাবাচ্ছে। ফলে এই মুক্ত প্রান্তর আর ঘনশ্যামা অরণ্যপ্রকৃতিকে এত ভালোবেসে ফেলেছি যে, একদিন পূর্ণিয়া কি মুঙ্গের শহরে কাজের জন্য গেলে মন উড়ু উড়ু করে, মন টিকতে চায় না। মনে হয়, কতক্ষণে জঙ্গলের মধ্যে ফিরে যাব, কতক্ষণে আবার সেই ঘন নির্জনতার মধ্যে, অপূর্ব জ্যোৎস্নার মধ্যে, সূর্যাস্তের মধ্যে, দিগন্তব্যাপী কালবৈশাখীর মেঘের মধ্যে, তারাভরা নিদাঘ-নিশীথের মধ্যে ডুব দেব!

    ফেরার সময় সভ্য লোকালয়কে অনেক দূর পিছনে ফেলে, মুকুন্দি চাকলাদারের হাতের বাবলাকাঠের খুঁটির পাশ কেটে যখন নিজের জঙ্গলের সীমানায় ঢুকি, তখন সুদূরবিসর্পী নিবিড়শ্যাম বনানী, প্রান্তর, শিলাস্তূপ, বনটিয়ার ঝাঁক, নীলগাইয়ের জেরা, সূর্যালোক, ধরণীর মুক্ত প্রসার আমাকে একেবারে একমুহূর্তে অভিভূত করে দেয়।

     

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleথ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা
    Next Article নৌকাডুবি

    Related Articles

    চলিত ভাষার

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    চলিত ভাষার প্রবন্ধ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

    পালামৌ – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    April 20, 2025
    চলিত ভাষার

    বোঝা (গল্প) – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – চলিত ভাষায়

    April 10, 2025
    চলিত ভাষার

    আপদ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের – চলিত ভাষার

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }