পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১
খুব জ্যোৎস্না, তেমনি হাড়কাঁপানো শীত। পৌষ মাসের শেষ। সদর কাছারি থেকে লবটুলিয়ার ডিহি কাছারিতে তদারক করতে গেছি। লবটুলিয়ার কাছারিতে রাতে রান্না শেষ হয়ে সবার খাওয়াদাওয়া হতে রাত এগারোটা বেজে যায়। একদিন খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর থেকে বাইরে এসে দেখি, এত রাতে আর সেই কনকনে ঠান্ডা আকাশের তলায় একটা মেয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় কাছারির কম্পাউন্ডের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। পাটোয়ারীকে জিজ্ঞেস করলাম—ওখানে কে দাঁড়িয়ে?
পাটোয়ারী বলল—ও কুন্তা। তুমি আসবে শুনে আমায় কাল বলছিল—ম্যানেজারবাবু আসবেন, তাঁর পাতের ভাত আমি গিয়ে নিয়ে আসব। আমার ছেলেপুলের বড় কষ্ট। তাই বলেছিলাম—যা।
কথা বলছি, এমন সময় কাছারির টহলদার বলোয়া আমার পাতের ডালমাখা ভাত, ভাঙা মাছের টুকরো, পাতের গোড়ায় ফেলা তরকারি আর ভাত, দুধের বাটির বাকি দুধভাত—সব নিয়ে গিয়ে মেয়েটির আনা একটা পেতলের কানাউঁচু থালায় ঢেলে দিল। মেয়েটি চলে গেল।
আট-দশ দিন সেবার লবটুলিয়ার কাছারিতে ছিলাম, প্রতি রাতে দেখতাম ইঁদারার পাড়ে সেই মেয়েটি আমার পাতের ভাতের জন্য গভীর রাতে আর সেই ভয়ঙ্কর শীতে বাইরে শুধু আঁচল গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দেখতে দেখতে একদিন কৌতূহলবশে পাটোয়ারীকে জিজ্ঞেস করলাম—কুন্তা, যে রোজ ভাত নিয়ে যায়, ও কে, আর এই জঙ্গলে থাকে কোথায়? দিনে তো কখনো দেখি না ওকে?
পাটোয়ারী বলল—বলছি হুজুর।
ঘরে সন্ধ্যা থেকে কাঠের গুঁড়ি জ্বালিয়ে গনগনে আগুন করা হয়েছে—তার ধারে চেয়ার পেতে অনেকক্ষণ ধরে কিস্তির আদায়ের হিসেব মেলাচ্ছিলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ করে এসে মনে হল একদিনের জন্য কাজ যথেষ্ট করেছি। কাগজপত্র গুটিয়ে পাটোয়ারীর গল্প শুনতে তৈরি হলাম।
—শোন হুজুর। বছর দশেক আগে এ অঞ্চলে দেবী সিং রাজপুতের বড় রবরবা ছিল। তার ভয়ে যত গাঙ্গোতা আর চাষী ও চরির প্রজা জুজু হয়ে থাকত। দেবী সিংয়ের ব্যবসা ছিল খুব চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া এসব লোককে—আর তারপর লাঠিবাজি করে সুদ-আসল টাকা আদায় করা। তার তাঁবে আট-ন’জন লাঠিয়াল পাইকই ছিল। এখন যেমন রাসবিহারী সিং রাজপুত এ অঞ্চলের মহাজন, তখন ছিল দেবী সিং।
দেবী সিং জৌনপুর জেলা থেকে এসে পূর্ণিয়ায় বাস করে। তারপর টাকা ধার দিয়ে জোরজবরদস্তি করে এ দেশের যত ভীতু গাঙ্গোতা প্রজাদের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলল। এখানে আসার কয়েক বছর পরে সে কাশী যায় আর সেখানে এক বাইজীর বাড়ি গান শুনতে গিয়ে তার চৌদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে দেবী সিংয়ের খুব ভাব হয়। তারপর তাকে নিয়ে দেবী সিং পালিয়ে এখানে আসে। দেবী সিংয়ের বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। এখানে এসে দেবী সিং তাকে বিয়ে করে। কিন্তু বাইজীর মেয়ে বলে সবাই যখন জেনে ফেলল, তখন দেবী সিংয়ের নিজের জাতভাই রাজপুতরা তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে তাকে একঘরে করল। পয়সার জোরে দেবী সিং সে সব গ্রাহ্য করত না। তারপর বাবুগিরি আর অযথা খরচ করে আর এই রাসবিহারী সিংয়ের সঙ্গে মকদ্দমা করতে গিয়ে দেবী সিং সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। আজ বছর চারেক হল সে মারা গেছে।
ওই কুন্তাই দেবী সিং রাজপুতের সেই বিধবা বউ। একসময় ও লবটুলিয়া থেকে কিংখাবের ঝালর-দেওয়া পালকি চেপে কুশী আর কলবলিয়ার সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীর মিছরি খেয়ে জল খেত—আজ ওর ওই দুর্দশা! আরও মুশকিল এই যে বাইজীর মেয়ে সবাই জানে বলে ওর এখানে জাত নেই, তা ওর স্বামীর আত্মীয়-বন্ধু রাজপুতদের মধ্যে হোক, কি দেশওয়ালী গাঙ্গোতাদের মধ্যে। ক্ষেত থেকে গম কাটা হয়ে গেলে যে গমের গুঁড়ো শীষ পড়ে থাকে, তাই টুকরি করে ক্ষেতে ক্ষেতে বেড়িয়ে কুড়িয়ে এনে বছরে দু-এক মাস ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আধপেটা খাইয়ে রাখে। কিন্তু কখনো হাত পেতে ভিক্ষে করতে ওকে দেখি নি হুজুর। তুমি এসেছ জমিদারের ম্যানেজার, রাজার সমান, তোমার এখানে প্রসাদ পেলে ওর তাতে অপমান নেই।
বললাম—ওর মা, সেই বাইজী, ওর খোঁজ করেনি তারপর কখনো?
পাটোয়ারী বলল—দেখি নি তো কখনো হুজুর। কুন্তাও কখনো মায়ের খোঁজ করেনি। ওই দুঃখ-ধান্দা করে ছেলেপুলেদের খাওয়াচ্ছে। এখন ওকে যা দেখছেন, ওর একসময় যা রূপ ছিল, এ অঞ্চলে সে রকম কখনো কেউ দেখেনি। এখন বয়সও হয়েছে, আর বিধবা হওয়ার পরে দুঃখে-কষ্টে সে চেহারার কিছু নেই। বড় ভালো আর শান্ত মেয়ে কুন্তা। কিন্তু এদেশে ওকে কেউ দেখতে পারে না, সবাই নাক সিঁটকে থাকে, নিচু চোখে দেখে, বোধ হয় বাইজীর মেয়ে বলে।
বললাম—তা বুঝলাম, কিন্তু এই রাত বারোটার সময় এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ও একা লবটুলিয়া বস্তিতে যাবে—সে তো এখান থেকে প্রায় তিন পোয়া পথ!
—ওর কি ভয় করলে চলে হুজুর? এই জঙ্গলে সবসময় ওকে একা ফিরতে হয়। নইলে কে আছে ওর, যে চালাবে?
তখন পৌষ মাস ছিল, পৌষ-কিস্তির তাগাদা শেষ করে চলে এলাম। মাঘ মাসের মাঝামাঝি আর একবার একটা ছোট চরি মহাল ইজারা দেওয়ার জন্য লবটুলিয়া যাওয়ার দরকার হল।
তখনো শীত একটুও কমেনি, তার ওপর সারাদিন পশ্চিমা বাতাস বইবার ফলে প্রতি সন্ধ্যার পর শীত দ্বিগুণ বেড়ে যেত। কয়েকদিন মহালের উত্তর সীমানায় বেড়াতে বেড়াতে কাছারি থেকে অনেক দূরে গিয়ে পড়েছি—সেদিকে বহুদূর পর্যন্ত শুধু কুলগাছের জঙ্গল। এইসব জঙ্গল জমা নিয়ে ছাপরা আর মজফরপুর জেলার কালোয়ার-জাতীয় লোকে লাক্ষার চাষ করে বিস্তর পয়সা কামায়। কুলের জঙ্গলের মধ্যে প্রায় পথ ভুলে ফেলার মতো অবস্থা, এমন সময় হঠাৎ একটা মেয়ের আর্তনাদ, বাচ্চাদের গলার চিৎকার আর কান্না আর কর্কশ পুরুষকণ্ঠে গালিগালাজ শুনতে পেলাম। কিছুদূর এগিয়ে দেখি, একটা মেয়েকে লাক্ষার ইজারাদারের চাকরেরা চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে আসছে। মেয়েটির পরনে ছেঁড়া ময়লা কাপড়, সঙ্গে দু-তিনটে ছোট ছোট কাঁদতে থাকা বাচ্চা, দুজন ছত্রি চাকরের মধ্যে একজনের হাতে একটা ছোট ঝুড়িতে আধঝুড়ি পাকা কুল। আমাকে দেখে ছত্রি দুজন উৎসাহ পেয়ে যা বলল, তার মানে এই যে, তাদের ইজারাকরা জঙ্গলে এই গাঙ্গোতিন চুরি করে কুল পাড়ছিল বলে তাকে কাছারিতে পাটোয়ারীর বিচারের জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হুজুর এসে পড়েছেন, ভালোই হয়েছে।
প্রথমেই ধমক দিয়ে মেয়েটিকে তাদের হাত থেকে ছাড়ালাম। মেয়েটি তখন ভয়ে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে একটা কুলঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। তার দুর্দশা দেখে এত কষ্ট হল!
ইজারাদারের লোকেরা কি এত সহজে ছাড়তে চায়! তাদের বোঝালাম—বাপু, গরিব মেয়েমানুষ যদি তার ছেলেপুলেদের খাওয়ানোর জন্য আধঝুড়ি টক কুল পেড়ে থাকে, তাতে তোমাদের লাক্ষাচাষের বিশেষ কী ক্ষতি হয়েছে। ওকে বাড়ি যেতে দাও।
একজন বলল—জানেন না হুজুর, ওর নাম কুন্তা, এই লবটুলিয়াতে ওর বাড়ি, ওর অভ্যেস চুরি করে কুল পাড়া। আরও একবার গত বছর হাতে হাতে ধরেছিলাম—ওকে এবার শিক্ষা না দিয়ে দিলে—
প্রায় চমকে উঠলাম। কুন্তা! তাকে তো চিনলাম না? তার একটা কারণ, দিনের আলোয় কুন্তাকে তো দেখিনি, যা দেখেছি রাতে। ইজারাদারের লোকজনকে তৎক্ষণাৎ শাসিয়ে কুন্তাকে মুক্ত করলাম। সে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে ছেলেপুলেদের নিয়ে বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার সময় কুলের ধামাটা আর আঁকশিগাছটা সেখানেই ফেলে গেল। বোধ হয় ভয়ে আর সঙ্কোচে। আমি উপস্থিত লোকগুলোর মধ্যে একজনকে সেগুলো কাছারিতে নিয়ে যেতে বলাতে তারা খুব খুশি হয়ে ভাবল ধামা আর আঁকশি সরকারে নিশ্চয়ই বাজেয়াপ্ত হবে। কাছারিতে এসে পাটোয়ারীকে বললাম—তোমাদের দেশের লোক এত নিষ্ঠুর কেন বনোয়ারীলাল? বনোয়ারী পাটোয়ারী খুব দুঃখিত হল। বনোয়ারী লোকটা ভালো, এদেশের তুলনায় সত্যিই তার হৃদয়ে দয়ামায়া আছে। কুন্তার ধামা আর আঁকশি সে তখনই পাইক দিয়ে লবটুলিয়াতে কুন্তার বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
সেই রাত থেকে কুন্তা বোধ হয় লজ্জায় আর কাছারিতেও ভাত নিতে আসেনি।
২
শীত শেষ হয়ে বসন্ত পড়েছে।
আমাদের এই জঙ্গল-মহালের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানা থেকে সাত-আট ক্রোশ দূরে, অর্থাৎ সদর কাছারি থেকে প্রায় চৌদ্দ-পনেরো ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে হোলির সময় একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম্য মেলা বসে, এবার সেখানে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। অনেকদিন বহু লোকের সমাগম দেখিনি, এদেশের মেলা কেমন তা জানার একটা কৌতূহলও ছিল। কিন্তু কাছারির লোকে বারবার নিষেধ করল, পথ দুর্গম আর পাহাড়-জঙ্গলে ভর্তি, তাছাড়া গোটা পথটার প্রায় সর্বত্রই বাঘ আর বন্যমহিষের ভয়, মাঝে মাঝে বস্তি আছে বটে, কিন্তু সে বড় দূরে দূরে, বিপদে পড়লে তারা বিশেষ কোনো উপকারে আসবে না।
জীবনে কখনো এতটুকু সাহসের কাজ করার অবকাশ পাইনি, এই সময়ে এইসব জায়গায় যতদিন আছি যা করে নিতে পারি, বাংলা দেশে আর কলকাতায় ফিরে গেলে কোথায় পাব পাহাড় জঙ্গল, কোথায় পাব বাঘ আর বন্যমহিষ? ভবিষ্যতের দিনে আমার মুখে গল্প শোনার জন্য উৎসুক পৌত্র-পৌত্রীদের মুখ আর তরুণ দৃষ্টি কল্পনা করে মুনেশ্বর মাহাতো, পাটোয়ারী আর নবীনবাবু মুহুরীর সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে মেলার দিন খুব সকালে ঘোড়া করে রওনা হলাম। আমাদের মহালের সীমানা ছাড়াতেই ঘণ্টা-দুই লেগে গেল, কারণ পূর্ব-দক্ষিণ সীমানাতেই আমাদের মহালের জঙ্গল বেশি, পথ নেই বললেও চলে, ঘোড়া ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন সে পথে চলা অসম্ভব, যেখানে-সেখানে ছোট-বড় শিলাখণ্ড ছড়ানো, শাল-জঙ্গল, লম্বা কাশ আর বনঝাউয়ের বন, সমস্ত পথটা উঁচু-নিচু, মাঝে মাঝে উঁচু বালিয়াড়ি রাঙা মাটির ডাঙা, ছোট পাহাড়, পাহাড়ের ওপর ঘন কাঁটাগাছের জঙ্গল। আমি যখন তখন কখনো দ্রুত, কখনো ধীরে ঘোড়া চালাচ্ছি, ঘোড়াকে কদম চালে ঠিক চালানো সম্ভব হচ্ছে না—খারাপ রাস্তা আর ছড়ানো শিলাখণ্ডের জন্য কিছুদূর পরপর ঘোড়ার চাল ভেঙে যাচ্ছে, কখনো গ্যালপ, কখনো দুলকি, কখনো বা পায়চারি করার মতো মৃদু গতিতে শুধু হেঁটে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি কাছারি ছাড়ার পর থেকেই আনন্দে মগ্ন হয়ে আছি, এখানে চাকরি নিয়ে আসার দিন থেকে এদেশের এই ধু-ধু মুক্ত প্রান্তর আর বনভূমি আমাকে ক্রমশ দেশ ভুলিয়ে দিচ্ছে, সভ্য জগতের শতরকম আরামের উপকরণ আর অভ্যাসকে ভুলিয়ে দিচ্ছে, বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত ভুলে যাওয়ার জোগাড় করে তুলেছে। যাক না ঘোড়া আস্তে বা জোরে, শৈলশৃঙ্গে যতক্ষণ প্রথম বসন্তে ফোটা রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসেছে, পাহাড়ের নিচে, ওপরে মাঠের সর্বত্র ঝুপসি গাছের ডাল ঝাড়ঝাড় ধাতুপফুলের ভারে নত, গোলগোলি ফুলের নিষ্পত্র দুগ্ধশুভ্র কাণ্ডে হলুদ রঙের বড় বড় সূর্যমুখী ফুলের মতো ফুল মধ্যাহ্নের রোদকে মৃদু সুগন্ধে অলস করে তুলেছে—তখন কতটা পথ গেল, কে রাখে তার হিসেব?
কিন্তু হিসেব খানিকটা যে রাখতেই হবে, নইলে দিগভ্রান্ত আর পথভ্রান্ত হওয়ার পুরো সম্ভাবনা, আমাদের জঙ্গলের সীমানা পেরোনোর আগেই এ সত্যটা ভালো করে বুঝলাম। কিছুদূর তখন অন্যমনস্কভাবে গেছি, হঠাৎ দেখি সামনে অনেক দূরে একটা বিরাট অরণ্যের ধূম্রনীল শীর্ষদেশ রেখার মতো দিগন্তের সে অংশে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কোথা থেকে এল এত বড় বন এখানে? কাছারিতে কেউ তো বলেনি যে, মৈষণ্ডির মেলার কাছাকাছি কোথাও এমন বিশাল অরণ্য আছে? পরক্ষণেই ঠাহর করে বুঝলাম, পথ হারিয়েছি, সামনের বনরেখা মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট না হয়ে যায় না—যা আমাদের কাছারি থেকে খাড়া উত্তর-পূর্ব কোণে। এসব দিকে চলতি বাঁধাপথ বলে কিছু নেই, লোকজনও বড় একটা হাঁটে না। তাছাড়া চারদিকে দেখতে ঠিক একই রকম, সেই এক ধরনের ডাঙা, এক ধরনের গোলগোলি আর ধাতুপফুলের বন, সঙ্গে সঙ্গে আছে চড়া রোদের কম্পমান তাপ-তরঙ্গ। দিক ভুল হতে বেশিক্ষণ লাগে না আনাড়ি লোকের।
ঘোড়ার মুখ আবার ফেরালাম। হুঁশিয়ার হয়ে গন্তব্যস্থানের অবস্থান নির্ণয় করে একটা দিকচিহ্ন দূর থেকে আন্দাজ করে বেছে নিলাম। অকূল সমুদ্রে জাহাজ ঠিক পথে চালানো, অনন্ত আকাশে এরোপ্লেনের পাইলটের কাজ করা আর এই অজানা সুবিশাল পথহীন বনপ্রান্তরে ঘোড়া চালিয়ে তাকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া প্রায় একই শ্রেণির ব্যাপার। অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তাদের এ কথার সত্যতা বুঝতে দেরি হবে না।
আবার রোদে পোড়া নিষ্পত্র গুল্মরাজি, আবার বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ, আবার অনাবৃত শিলাস্তূপের মতো দেখতে গণ্ডশৈলমালা, আবার রক্তপলাশের শোভা। বেলা বেশ চড়ল; জল খেতে পেলে ভালো হত, এর মধ্যেই মনে হল; কারো নদী ছাড়া এ পথে কোথাও জল নেই, জানি; এখনো আমাদের জঙ্গলেরই সীমানা কতক্ষণে ছাড়াব ঠিক নেই, কারো নদী তো অনেক দূর—এ চিন্তার সঙ্গে তৃষ্ণা যেন হঠাৎ বেড়ে উঠল।
মুকুন্দি চাকলাদারকে বলে দিয়েছিলাম আমাদের মহালের সীমানায় সীমানাজ্ঞাপক বাবলা কাঠের খুঁটি বা মহাবীরের ধ্বজার মতো কিছু পুঁতে রাখে। এ সীমানায় কখনো আসিনি, দেখে বুঝলাম চাকলাদার সে আদেশ পালন করেনি। ভেবেছে, এই জঙ্গল ঠেলে কলকাতার ম্যানেজারবাবু আর সীমানা পরিদর্শনে এসেছেন, তুমিও যেমন! কে খেটে মরে? যেমন আছে তেমনই থাকুক।
পথের কিছুদূরে আমাদের সীমানা ছাড়িয়ে এক জায়গায় ধোঁয়া উঠছে দেখে সেখানে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে একদল লোক কাঠ পুড়িয়ে কয়লা করছে—এই কয়লা তারা গ্রামে গ্রামে শীতকালে বেচবে। এদেশের শীতে গরিব লোকে মালসায় কয়লার আগুন করে শীত নিবারণ করে; কাঠকয়লা চার সের পয়সায় বিক্রি হয়, তাও কিনতে পয়সা অনেকের জোটে না, আর এত পরিশ্রম করে কাঠকয়লা পুড়িয়ে পয়সায় চার সের দরে বেচে কয়লাওয়ালাদের মজুরি কীভাবে পোষায়, তাও বুঝি না। এদেশে পয়সা জিনিসটা বাংলা দেশের মতো সস্তা নয়, এখানে এসে থেকে তা দেখছি। শুকনো কাশ আর সাবাই ঘাসের ছোট্ট একটা ছাউনি কেঁদ আর আমলকীর বনে, সেখানে বড় একটা মাটির হাঁড়িতে মকাই সিদ্ধ করে কাঁচা শালপাতায় সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে, আমি যখন গেলাম। লবণ ছাড়া অন্য কোনো উপকরণই নেই। কাছে বড় বড় গর্তের মধ্যে ডালপালা পুড়ছে, একটা ছোকরা সেখানে বসে কাঁচা শালের লম্বা ডাল দিয়ে আগুনে ডালপালা উলটে দিচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলাম—কী ও গর্তের মধ্যে, কী পুড়ছে?
তারা খাওয়া ছেড়ে সবাই একযোগে দাঁড়িয়ে উঠে ভীত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে বলল—কাঠকয়লা হুজুর।
আমার ঘোড়ায় চড়া মূর্তি দেখে লোকগুলো ভয় পেয়েছে, বুঝলাম আমাকে বনবিভাগের লোক ভেবেছে। এসব অঞ্চলের বন গভর্নমেন্টের খাসমহলের অন্তর্ভুক্ত, বিনা অনুমতিতে বন কাটা বা কয়লা পোড়ানো বেআইনি।
তাদের আশ্বস্ত করলাম। আমি বনবিভাগের কর্মচারী নই, কোনো ভয় নেই তাদের, যত ইচ্ছে কয়লা করুক। একটু জল পাওয়া যায় এখানে? খাওয়া ফেলে একজন ছুটে গিয়ে মাজা ঝকঝকে জামবাটিতে পরিষ্কার জল এনে দিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, কাছে বনের মধ্যে ঝরনা আছে, তার জল।
ঝরনা?—আমার কৌতূহল হল। ঝরনা কোথায়? শুনিনি তো এখানে ঝরনা আছে!
তারা বলল—ঝরনা নেই হুজুর, উনুই! পাথরের গর্তে একটু একটু করে জল জমে, এক ঘণ্টায় আধ সের জল হয়, খুব সাফ পানি, ঠান্ডাও খুব।
জায়গাটা দেখতে গেলাম। কী সুন্দর ঠান্ডা বনবীথি! পাখিরা বোধ হয় এই নির্জন অরণ্যে শিলাতলে শরৎ-বসন্তের দিনে, বা গভীর নিশীথে জলকেলি করতে নামে। বনের খুব ঘন অংশে বড় বড় পিয়াল আর কেঁদের ডালপালা দিয়ে ঘেরা একটা নাবাল জায়গা, তলাটা কালো পাথরের, একখানা বড় প্রস্তরবেদী যেন কালে ক্ষয় পেয়ে ঢেঁকির গড়ের মতো হয়ে গেছে। যেন খুব বড় প্রাকৃতিক পাথরের খোরা। তার ওপর সপুষ্প পিয়াল শাখা ঝুপসি হয়ে পড়ে ঘন ছায়া তৈরি করেছে। পিয়াল আর শাল মঞ্জরীর সুগন্ধ বনের ছায়ায় ভুরভুর করছে। পাথরের খোলে বিন্দু বিন্দু জল জমছে, এইমাত্র জল তুলে নিয়ে গেছে, এখনো আধ ছটাক জলও জমেনি।
তারা বলল—এ ঝরনার কথা অনেকে জানে না হুজুর, আমরা বনে জঙ্গলে সবসময় ঘুরি, আমরা জানি।
আরো পাঁচ মাইল গিয়ে কারো নদী পড়ল, খুব উঁচু বালির পাড় দু-ধারে, অনেকটা খাড়া নিচে নেমে তবে নদীর খাত, এখন খুব সামান্য জল আছে, দু-পারে অনেক দূর পর্যন্ত বালুকাময় তীর ধু-ধু করছে। যেন পাহাড় থেকে নামছে মনে হল; ঘোড়ায় জল পার হতে যেতে এক জায়গায় ঘোড়ার জিন পর্যন্ত এসে ঠেকল, রেকাবদলসহ পা মুড়ে খুব সাবধানে পার হলাম। ওপারে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, উঁচু-নিচু রাঙা-রাঙা শিলাখণ্ড, আর শুধুই পলাশ আর পলাশ, সর্বত্র পলাশফুলের মেলা। একবার দূরে একটা বুনো মহিষকে ধাতুপফুলের বন থেকে বের হতে দেখলাম—সেটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে পায়ের ক্ষুর দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। ঘোড়ার মুখের লাগাম কষে থমকে দাঁড়ালাম; ত্রিসীমানায় কোথাও জনমানব নেই, যদি শিং পেতে তাড়া করে আসে? কিন্তু ভাগ্য ভালো, সেটা আবার পথের পাশের বনের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নদী ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে পথের দৃশ্য কী চমৎকার! তবুও তো দুপুর ঝাঁ-ঝাঁ করছে, অপরাহ্নের ছায়া নেই, রাতের জ্যোৎস্না নেই—কিন্তু সেই নিস্তব্ধ খররৌদ্র-মধ্যাহ্নে বাঁ-দিকে বনাবৃত দীর্ঘ শৈলমালা, দক্ষিণে লৌহপ্রস্তর আর পাইয়োরাইট ছড়ানো উঁচু-নিচু জমিতে শুধুই শুভ্রকাণ্ড গোলগোলি ফুলের গাছ আর রাঙা ধাতুপফুলের জঙ্গল। সেই জায়গাটা সত্যিই অদ্ভুত; এমন রুক্ষ অথচ সুন্দর, পুষ্কাকীর্ণ অথচ উদ্দাম আর অতিমাত্রায় বন্য ভূমিশ্রী জীবনে কখনো দেখিনি। আর তার ওপর ঠিক-দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদ। মাথার ওপর আকাশ কী ঘন নীল! আকাশে কোথাও একটা পাখি নেই, শূন্য মাটিতে বন্য-প্রকৃতির বুকে কোথাও একটা মানুষ বা জীবজন্তু নেই—নিঃশব্দ, ভয়ঙ্কর নিরালা। চারদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির এই বিজন রূপলীলার মধ্যে ডুবে গেলাম—ভারতবর্ষে এমন জায়গা আছে জানতাম না তো! এ যেন ফিল্মে দেখা দক্ষিণ-আমেরিকার আরিজোনা বা নাভাজো মরুভূমি কিংবা হডসনের বইয়ে বর্ণিত গিলা নদীর অববাহিকা-অঞ্চল।
মেলায় পৌঁছতে বেলা একটা বেজে গেল। প্রকাণ্ড মেলা, যে দীর্ঘ শৈলশ্রেণী পথের বাঁ-ধারে আমার সঙ্গে সঙ্গে ক্রোশ-তিনেক ধরে চলে এসেছিল, তারই সবচেয়ে দক্ষিণ প্রান্তে ছোট্ট একটা গ্রামের মাঠে, পাহাড়ের ঢালে চারদিকে শাল-পলাশের বনের মধ্যে এই মেলা বসেছে। মহিষারড়ি, কড়ারী, তিনটাঙা, লছমনিয়াটোলা, ভীমদাসটোলা, মহালিখারূপ ইত্যাদি দূরের কাছের নানা জায়গা থেকে লোকজন, মূলত মেয়েরা এসেছে। তরুণী বন্য মেয়েরা এসেছে চুলে পিয়ালফুল বা রাঙা ধাতুপফুল গুঁজে; কারো কারো মাথায় বাঁকা খোঁপায় কাঠের চিরুনি আটকানো, বেশ সুঠাম, সুললিত, লাবণ্যভরা দেহের গঠন প্রায় অনেক মেয়েরই—তারা আমোদ করে পুঁতির দানার মালা, সস্তা জাপানি বা জার্মানির সাবানের বাক্স, বাঁশি, আয়না, অতি বাজে এসেন্স কিনছে, পুরুষরা এক পয়সায় দশটা কালী সিগারেট কিনছে, ছেলেমেয়েরা তিলুয়া, রেউড়ি, রামদানার লাড্ডু আর তেলেভাজা খাজা কিনে খাচ্ছে।
হঠাৎ মেয়েমানুষের গলায় আর্তকান্নার শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। একটা উঁচু পাহাড়ি ডাঙায় যুবক-যুবতীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে হাসিখুশি গল্পগুজব আর আদর-আপ্যায়নে মত্ত ছিল—কান্নাটা উঠল সেখান থেকেই। ব্যাপার কী? কেউ কি হঠাৎ মারা গেল? একজন লোককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তা নয়, কোনো একটা বধূর সঙ্গে তার বাপের বাড়ির গ্রামের কোনো মেয়ের দেখা হয়েছে—এদেশের রীতিই নাকি এমন, গ্রামের মেয়ে বা কোনো প্রবাসিনী সখী, কুটুম্বিনী বা আত্মীয়ার সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হলে দুজনে দুজনের গলা জড়িয়ে মড়াকান্না জুড়ে দেবে। অনভিজ্ঞ লোকে ভাবতে পারে তাদের কেউ মারা গেছে, আসলে এটা আদর-আপ্যায়নের একটা অঙ্গ। না কাঁদলে নিন্দা হবে। মেয়েরা বাপের বাড়ির মানুষ দেখে কাঁদল না—অর্থাৎ তাহলে প্রমাণ হয় যে, স্বামীগৃহে বড় সুখেই আছে—মেয়েমানুষের পক্ষে এটা নাকি বড়ই লজ্জার কথা।
এক জায়গায় বইয়ের দোকানে চটের থলের ওপর বই সাজিয়ে বসেছে—হিন্দি গোলেবকাউলী, লয়লা-মজনু, বেতাল পঁচিশী, প্রেমসাগর ইত্যাদি। বয়স্ক লোকে কেউ কেউ বই উলটে-পালটে দেখছে—বুঝলাম বুকস্টলে দাঁড়িয়ে পড়া পাঠকের অবস্থা আনাতোল ফ্রান্সের প্যারিসেও যেমন, এই বন্য দেশে কড়ারী তিনটাঙার হোলির মেলাতেও তাই। বিনা পয়সায় দাঁড়িয়ে পড়ে নিতে পারলে কেউ বড় একটা বই কেনে না। দোকানীর ব্যবসাবুদ্ধি কিন্তু বেশ প্রখর, সে একজন তন্ময় পাঠককে জিজ্ঞেস করল—বই কিনবি? না হলে রেখে দিয়ে অন্য কাজ দেখ। মেলার জায়গা থেকে কিছুদূরে একটা শালবনের ছায়ায় অনেক লোক রাঁধছে খাচ্ছে—এদের জন্য মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসেছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি আর লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রি হচ্ছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটা প্রিয় সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা আর বুনো শিম।
হঠাৎ কারো ডাক কানে গেল—ম্যানেজারবাবু—
তাকিয়ে দেখি ভিড় ঠেলে লবটুলিয়ার পাটোয়ারীর ভাই ব্রহ্মা মাহাতো এগিয়ে আসছে।—হুজুর, তুমি কখন এলে? সঙ্গে কে? বললাম—ব্রহ্মা এখানে কী, মেলা দেখতে?
—না হুজুর, আমি মেলার ইজারাদার। এসো, এসো, আমার তাঁবুতে চলো একটু পায়ের ধুলো দেবে।
মেলার একপাশে ইজারাদারের তাঁবু, সেখানে ব্রহ্মা খুব খাতির করে আমায় নিয়ে গিয়ে একটা পুরোনো বেণ্টউড চেয়ারে বসাল। সেখানে একজন লোক দেখলাম, এমন লোক বোধ হয় পৃথিবীতে আর দেখব না। লোকটা কে জানি না, ব্রহ্মা মাহাতোর কোনো কর্মচারী হবে। বয়স পঞ্চাশ-ষাট, গা খালি, রং কালো, মাথার চুল কাঁচা-পাকায় মেশানো। তার হাতে একটা বড় থলিতে এক থলি পয়সা, বগলে একটা খাতা, সম্ভবত মেলার খাজনা আদায় করে বেড়াচ্ছে, ব্রহ্মা মাহাতোকে হিসেব বুঝিয়ে দেবে। মুগ্ধ হলাম তার চোখের দৃষ্টির আর মুখের অসাধারণ দীন-নম্র ভাব দেখে। যেন কিছু ভয়ের ভাবও মেশানো ছিল সে দৃষ্টিতে। ব্রহ্মা মাহাতো রাজা নয়, ম্যাজিস্ট্রেট নয়, কারো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়, গভর্নমেন্টের খাসমহলের একজন বর্ধিষ্ণু প্রজা মাত্র—নিয়েছে না হয় মেলার ইজারা—এত দীন ভাব কেন ওই লোকটার তার কাছে? তারও পরে আমি যখন তাঁবুতে গেলাম, ব্রহ্মা মাহাতো আমাকে এত খাতির করছে দেখে লোকটা আমার দিকে অতিরিক্ত সম্ভ্রম আর দীনতার দৃষ্টিতে ভয়ে ভয়ে এক-আধ বারের বেশি তাকাতে ভরসা পেল না। ভাবলাম লোকটার এত দীনহীন দৃষ্টি কেন? খুব কি গরিব? লোকটার মুখে কী যেন ছিল, বারবার তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, এমন সত্যিকার দীন-বিনম্র মুখ কখনো দেখিনি।
ব্রহ্মা মাহাতোকে লোকটার কথা জিজ্ঞেস করে জানলাম তার বাড়ি কড়ারী তিনটাঙা, যে গ্রামে ব্রহ্মা মাহাতোর বাড়ি; নাম গিরিধারীলাল, জাতি গাঙ্গোতা। তার এক ছোট ছেলে ছাড়া আর সংসারে কেউ নেই। অবস্থা যা অনুমান করেছিলাম—অতি গরিব। সম্প্রতি ব্রহ্মা তাকে মেলায় দোকানের আদায়কারী কর্মচারী বহাল করেছে—দৈনিক চার আনা বেতন আর খেতে দেবে।
গিরিধারীলালের সঙ্গে আমার আরো দেখা হয়েছিল, কিন্তু তার সঙ্গে শেষবারের সাক্ষাতের সময়কার অবস্থা বড় করুণ, পরে সে-সব কথা বলব। অনেক ধরনের মানুষ দেখেছি, কিন্তু গিরিধারীলালের মতো সাচ্চা মানুষ কখনো দেখিনি। কত কাল হয়ে গেল, কত লোককে ভুলে গেছি, কিন্তু যাদের কথা চিরকাল মনে আঁকা আছে আর থাকবে, সেই অতি অল্প কয়েকজন লোকের মধ্যে গিরিধারীলাল একজন।
৩
বেলা পড়ে আসছে, এখনই রওনা হওয়া দরকার, ব্রহ্মা মাহাতোকে সে কথা বলে বিদায় চাইলাম। ব্রহ্মা মাহাতো একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, তাঁবুতে যারা উপস্থিত ছিল তারা হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকাল। অসম্ভব! এই ত্রিশ মাইল রাস্তা অবেলায় ফেরা! হুজুর কলকাতার মানুষ, এ অঞ্চলের পথের খবর জানা নেই তাই এ কথা বলছেন। দশ মাইল যেতে সূর্য ডুবে যাবে, না হয় জ্যোৎস্নারাত্রিই হল, ঘন পাহাড়-জঙ্গলের পথ, মানুষজন কোথাও নেই, বাঘ বের হতে পারে, বুনো মহিষ আছে, বিশেষত পাকা কুলের সময়, এখন ভাল্লুক তো নিশ্চয়ই বের হবে, কারো নদীর ওপারে মহালিখারূপের জঙ্গলে এই তো সেদিনও এক গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে বাঘে নিয়েছে, বেচারা জঙ্গলের পথে একা আসছিল। অসম্ভব, হুজুর। রাতে এখানে থাক, খাওয়াদাওয়া কর, যখন দয়া করে এসেছ গরিবের ডেরায়। কাল সকালে তখন ধীরে-সুস্থে গেলেই হবে।
এই বাসন্তী পূর্ণিমায় পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নারাত্রে জনহীন পাহাড়-জঙ্গলের পথ একা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার প্রলোভন আমার কাছে দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। জীবনে আর কখনো হবে না, এই হয়তো শেষ, আর যে অপূর্ব বন-পাহাড়ের দৃশ্য দেখে এসেছি পথে! জ্যোৎস্নারাত্রে—বিশেষত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় তাদের রূপ একবার দেখব না যদি, তবে এতটা কষ্ট করে আসার কী অর্থ হয়?
সবার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়িয়ে রওনা হলাম। ব্রহ্মা মাহাতো ঠিকই বলেছিল, কারো নদীতে পৌঁছানোর কিছু আগেই টকটকে লাল সুবৃহৎ সূর্যটা পশ্চিম দিকচক্রবালে একটা অনুচ্চ শৈলমালার পিছনে অস্ত গেল। কারো নদীর তীরের বালিয়াড়ির ওপর যখন ঘোড়াসুদ্ধ উঠেছি, এইবার এখান থেকে ঢালু বালির পথে নদীগর্ভে নামব—হঠাৎ সেই সূর্যাস্তের দৃশ্য আর ঠিক পূর্বে বহু দূরে কৃষ্ণ রেখার মতো দেখা মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের মাথায় নবোদিত পূর্ণচন্দ্রের দৃশ্য—যুগপৎ এই অস্ত আর উদয়ের দৃশ্যে থমকে ঘোড়াকে লাগাম কষে দাঁড় করালাম। সেই নির্জন অপরিচিত নদীতীরে সমস্তই যেন একটা অবাস্তব ব্যাপারের মতো দেখাচ্ছে—
পথে সর্বত্র পাহাড়ের ঢালে আর ডাঙায় ছাড়া-ছাড়া জঙ্গল, মাঝে মাঝে সরু পথটাকে যেন দুদিক থেকে চেপে ধরছে, আবার কোথাও কিছুদূরে সরে যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর নির্জন চারদিক, দিনমানে যা-হয় একরকম ছিল, জ্যোৎস্না ওঠার পর মনে হচ্ছে যেন অজানা আর অদ্ভুত সৌন্দর্যময় পরীরাজ্যের মধ্য দিয়ে চলেছি। সঙ্গে সঙ্গে বাঘের ভয়ও হল, মনে পড়ল মেলায় ব্রহ্মা মাহাতো আর কাছারিতে প্রায় সবাই রাতে এ পথে একা আসতে বারবার নিষেধ করেছিল, মনে পড়ল নন্দকিশোর গোসাঁই নামে আমাদের একজন বাথানদার প্রজা আজ মাস দুই-তিন আগে কাছারিতে বসে গল্প করেছিল এই মহালিখারূপের জঙ্গলে সেই সময় কাউকে বাঘে খাওয়ার ব্যাপার। জঙ্গলের এখানে-ওখানে বড় বড় কুলগাছে কুল পেকে ডাল নত হয়ে আছে—তলায় বিস্তর শুকনো আর পাকা কুল ছড়ানো—তাই ভাল্লুক বের হওয়ারও সম্ভাবনা খুবই। বুনো মহিষ এ বনে না থাকলেও মোহনপুরা জঙ্গল থেকে এবেলার মতো এক-আধটা ছিটকে আসতে কতক্ষণ! সামনে এখনো পনেরো মাইল নির্জন বনপ্রান্তরের ওপর দিয়ে পথ।
ভয়ের অনুভূতি চারপাশের সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে তুলল। এক-এক জায়গায় পথ দক্ষিণ থেকে খাড়া উত্তরে আর উত্তর থেকে পূর্বে ঘুরে গেছে, পথের খুব কাছে বাম দিকে সর্বত্রই একটানা অনুচ্চ শৈলমালা, তাদের ঢালে গোলগোলি আর পলাশের জঙ্গল, ওপরের দিকে শাল আর বড় বড় ঘাস। জ্যোৎস্না এবার ফুটফুট করছে, গাছের ছায়া হ্রস্বতম হয়ে উঠেছে, কী একটা বন্যফুলের সুবাসে জ্যোৎস্নাশুভ্র প্রান্তর ভরপুর, অনেক দূরে পাহাড়ে সাঁওতালেরা জুম চাষের জন্য আগুন দিয়েছে, সে কী অভিনব দৃশ্য, মনে হচ্ছে পাহাড়ে আলোর মালা কে যেন সাজিয়ে রেখেছে।
কখনো যদি এসব দিকে না আসতাম, কেউ বললেও বিশ্বাস করতাম না যে, বাংলা দেশের এত কাছে এমন সম্পূর্ণ জনহীন অরণ্যপ্রান্তর আর শৈলমালা আছে, যা সৌন্দর্যে আরিজোনার পাথুরে মরুদেশ বা রোডেসিয়ার বুশভেল্ডের থেকে কোনো অংশে কম নয়—বিপদের দিক দিয়ে দেখতে গেলেও এসব অঞ্চল নিতান্ত পুঁচকে বলা চলে না, সন্ধ্যার পরেই যেখানে বাঘ-ভাল্লুকের ভয়ে লোকে পথ হাঁটে না।
এই মুক্ত জ্যোৎস্নাশুভ্র বনপ্রান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম, এ এক আলাদা জীবন, যারা ঘরের দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকতে ভালোবাসে না, সংসার করা যাদের রক্তে নেই, সেইসব বারমুখো, খাপছাড়া প্রকৃতির মানুষের জন্য এমন জীবনই তো কাম্য। লিকাতা থেকে প্রথম প্রথম এসে এখানকার এই ভীষণ নির্জনতা আর সম্পূর্ণ বন্য জীবনযাত্রা কী অসহ্য হয়েছিল, কিন্তু এখন আমার মনে হয় এই ভালো, এই বর্বর রুক্ষ বন্য প্রকৃতি আমাকে তার স্বাধীনতা আর মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে, শহরের খাঁচার মধ্যে আর দাঁড়ে বসে থাকতে পারব কি? এই পথহীন প্রান্তরের শিলাখণ্ড আর শাল-পলাশের বনের মধ্য দিয়ে এই রকম মুক্ত আকাশতলে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় হু-হু ঘোড়া ছুটিয়ে চলার আনন্দের সঙ্গে আমি দুনিয়ার কোনো সম্পদ বিনিময় করতে চাই না।
জ্যোৎস্না আরো ফুটেছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারধারে তাকিয়ে মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় যাকে এতদিন জানতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাতে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা আর স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগবলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে না, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালে।
মহালিখারূপের জঙ্গল শেষ হতেই মাইল চার গিয়ে আমাদের সীমানা শুরু হল। রাত প্রায় নটার সময় কাছারি পৌঁছলাম।
৪
কাছারিতে ঢোলের শব্দ শুনে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি একদল লোক কাছারির কম্পাউন্ডে কোথা থেকে এসে ঢোল বাজাচ্ছে। ঢোলের শব্দে কাছারির সিপাহী কর্মচারীরা এসে তাদের ঘিরে দাঁড়াল। কাউকে ডেকে ব্যাপারটা কী জিজ্ঞেস করব ভাবছি, এমন সময় জমাদার মুক্তিনাথ সিং দরজার কাছে এসে সেলাম করে বলল—একবার বাইরে আসবেন মেহেরবানি করে?
—কী জমাদার, কী ব্যাপার?
—হুজুর, দক্ষিণ দেশে এবার ধান মরে যাওয়ায় অজন্মা হয়েছে, লোকে চলতে না পেরে দেশে দেশে নাচের দল নিয়ে বেরিয়েছে। ওরা কাছারিতে হুজুরের সামনে নাচবে বলে এসেছে, যদি হুকুম হয় তবে নাচ দেখায়।
নাচের দল আমার আপিসঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
মুক্তিনাথ সিং জিজ্ঞেস করল, কোন নাচ তারা দেখাতে পারে। দলের মধ্যে একজন ষাট-বাষট্টি বছরের বুড়ো সেলাম করে বিনীতভাবে বলল—হুজুর, হো হো নাচ আর ছক্কর-বাজি নাচ।
দলটি দেখে মনে হল নাচের কিছু জানুক না-জানুক পেটে দুটো খাওয়ার আশায় সব ধরনের, সব বয়সের লোক এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তারা নাচল আর গান গাইল। বেলা পড়ার সময় তারা এসেছিল, ক্রমে আকাশে জ্যোৎস্না ফুটল, তখনো তারা ঘুরে ঘুরে হাত ধরে নাচছে আর গান গাইছে। অদ্ভুত ধরনের নাচ আর সম্পূর্ণ অপরিচিত সুরের গান। এই মুক্ত প্রকৃতির বিশাল প্রসার আর এই সভ্য জগৎ থেকে অনেক দূরে নিভৃত বন্য আবেষ্টনীর মধ্যে এই দিগন্তপরিপ্লাবী ছায়াবিহীন জ্যোৎস্নালোকে এই নাচগানই চমৎকার খাপ খায়। একটা গানের অর্থ এরকমঃ
‘শিশুকালে বেশ ছিলাম। আমাদের গ্রামের পিছনে যে পাহাড়, তার মাথায় কেঁদ বন, সেই বনে কুড়িয়ে বেড়াতাম পাকা ফল, গাঁথতাম পিয়াল ফুলের মালা। দিন খুব সুখে কাটত, ভালোবাসা কাকে বলে, তা তখন জানতাম না। পাঁচ-নহরী ঝরনার ধারে সেদিন কররা পাখি মারতে গেছি। হাতে আমার বাঁশের নল আর আঠা-কাঠি। তুমি কুসুম-রঙে ছাপানো শাড়ি পরে এসেছিলে জল ভরতে। দেখে বললে—ছিঃ, পুরুষমানুষে কি সাত-নলি দিয়ে বনের পাখি মারে! আমি লজ্জায় ফেলে দিলাম বাঁশের নল, ফেলে দিলাম আঠা-কাঠির তাড়া। বনের পাখি গেল উড়ে, কিন্তু আমার মন-পাখি তোমার প্রেমের ফাঁদে চিরদিনের মতো যে ধরা পড়ে গেল! আমায় সাত-নলি চেলে পাখি মারতে বারণ করে এ কী করলে তুমি আমার! কাজটা কি ভালো হল সখি?’
ওদের ভাষা কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। গানগুলো তাই বোধ হয় আমার কাছে আরো অদ্ভুত লাগল। এই পাহাড় আর পিয়ালবনের সুরে বাঁধা ওদের গান, এখানেই ভালো লাগবে।
ওদের দক্ষিণা মাত্র চার আনা পয়সা। কাছারির আমলারা একবাক্যে বলল—হুজুর, তাই অনেক জায়গায় পায় না, বেশি দিয়ে ওদের লোভ বাড়াবেন না, তাছাড়া বাজার নষ্ট হবে। যা রেট তার বেশি দিলে গরিব গেরস্তরা নিজেদের বাড়িতে নাচ করাতে পারবে না হুজুর। অবাক হলাম—দু-তিন ঘণ্টা প্রাণপণে খেটেছে, কমপক্ষে সতেরো-আঠারোজন লোক—চার আনায় ওদের জনপিছু একটা করে পয়সাও তো পড়বে না। আমাদের কাছারিতে নাচ দেখাতে এই জনহীন প্রান্তর আর বন পার হয়ে এতদূর এসেছে। সমস্ত দিনের মধ্যে এটাই রোজগার। কাছে আর কোনো গ্রাম নেই যেখানে আজ রাতে নাচ দেখাবে।
রাতে কাছারিতে ওদের খাওয়া আর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। সকালে ওদের দলের সর্দারকে ডেকে দুটো টাকা দিতে লোকটা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নাচ দেখিয়ে খেতে কেউ দেয় না, তার ওপর আবার দু-টাকা দক্ষিণা!
তাদের দলে বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে আছে, ছেলেটার চেহারা যাত্রাদলের কৃষ্ণঠাকুরের মতো। একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, খুব শান্ত, সুন্দর চোখমুখ, কুচকুচে কালো গায়ের রং। দলের সামনে দাঁড়িয়ে সে-ই প্রথমে সুর ধরে আর পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচে, তখন ঠোঁটের কোণে হাসি মিলিয়ে থাকে। সুন্দর ভঙ্গিতে হাত দুলিয়ে মিষ্টি সুরে গায়—
রাজা লিজিয়ে সেলাম ম্যায় পরদেশিয়া।
শুধু দুটো খাবার জন্য ছেলেটা দলের সঙ্গে ঘুরছে। পয়সার ভাগ সে বড়ো একটা পায় না। তাও সে খাওয়া কী! চীনা ঘাসের দানা আর নুন। বড়োজোর তার সঙ্গে একটু তরকারি—আলুপটল নয়, জঙ্গলি গুড়মি ফল ভাজা, নয়তো বাথুয়া শাক সেদ্ধ, কিংবা ধুঁধুল ভাজা। এই খেয়েই মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। দিব্যি স্বাস্থ্য, সারা শরীরে অপূর্ব লাবণ্য।
দলের মাথাকে বললাম, ধাতুরিয়াকে রেখে যাও এখানে। কাছারিতে কাজ করবে, আর থাকবে খাবে।
মাথাটা সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক, সে-ও এক অদ্ভুত ধরনের মানুষ। এই বাষট্টি বছরেও একেবারে বালকের মতো। বলল—ও থাকতে পারবে না হুজুর। গাঁয়ের সব লোকের সঙ্গে একসঙ্গে আছে, তাই ও আছে ভালো। একা থাকলে মন কেমন করবে, ছেলেমানুষ কি থাকতে পারে? আবার তোমার সামনে ওকে নিয়ে আসব হুজুর।