Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরব কন্যার আর্তনাদ – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ

    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস এক পাতা গল্প693 Mins Read0

    ০৯. অগ্নিদগ্ধ দুই প্রমোদবালা

    অগ্নিদগ্ধ দুই প্রমোদবালাকে দাহির হাতির হাওদা থেকে ফেলে দিল

    ৯৩ হিজরী সনের সেই ভয়াল রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। রণাঙ্গনের চারদিকে অসংখ্য জ্বলন্ত মশাল ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে রক্তের গন্ধ। আহতদের আর্তনাদ ও আহাজারী রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জন্ম দিয়েছে এক ভয়ার্ত পরিবেশ। বিন কাসিমের যোদ্ধারা দাহির বাহিনীর নিহত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র একত্রিত করছিল। কয়েকটি দল শাহাদাত বরণকারী সহযোদ্ধাদের লাশগুলো জমা করছিল। কয়েকটি দল আহত সৈন্যদের তুলে এনে শিবিরের পিছন দিকে সেবাদানকারীদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। যেসব মহিলা বিন কাসিমের যোদ্ধাদের সাথে এসেছিল তারা এসব আহত যোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে ওষুধ দিচ্ছিল। সেবিকা মহিলারা ছিল বিন কাসিমের সৈন্যদেরই কারো স্ত্রী বোন বা কন্যা। প্রতিটি যুদ্ধের পর আহতদের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষার দায়িত্ব তারাই পালন করছিল। তারা রাত জেগে বিরামহীন ভাবে আহতযোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে ওষুধ দিত, আর পানাহার করাতো। অশ্বারোহী একটি ইউনিট দাহির বাহিনীর মৃত ও আহত সৈন্যদের লাওয়ারিশ ঘোড়াগুলোকে ধরে ধরে মুসলিম শিবিরে পাঠাচ্ছিল। বিন কাসিম গণীমতের সম্পদ সংগ্রহের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সৈন্যদের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করলেন। কারণ তিনি জানতেন, আজ যে সৈন্যদের সাথে তার মোকাবেলা হয়েছে, তা রাজা দাহিরের বিপুল সৈন্যের একটি অংশ মাত্র। রাজার আরো অসংখ্য সৈন্য আরূঢ় প্রান্তরে সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় মোকাবেলার জন্য অপেক্ষা করছে। তখন রাতের বেলায় যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়া হতো, কিন্তু রাতের অন্ধকারে গেরিলা আক্রমণের আশঙ্কা থাকতো। বিন কাসিম দু’জন সেনাপতিকে তাদের ইউনিট নিয়ে রণাঙ্গণ

    থেকে দূরে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য পথে টহল দেয়ার নির্দেশ দিলেন। যে পথে শত্রুসৈন্যদের রাতের বেলায় গেরিলা আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। সৈন্যরা রণক্লান্ত হলেও এতটুকু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না করার উপায় ছিল না। শত্রু পক্ষ ছিল খুবই প্রবল ও অভিজ্ঞ। কারণ রাজা দাহির অল্প কিছু সৈন্য মোকাবেলায় পাঠিয়ে বেশিসংখ্যক সৈন্য তার কাছে রেখে দিয়েছিল। রণকৌশলের দিক থেকে তা ছিল খুবই উঁচুমানের সমরবিদের পরিচায়ক।

    বিন কাসিম নিজে এই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন না। রাতের বেলায় তিনি ময়দানে ঘোড়া হাঁকিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিন কাসিমের সাথে ছিল তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী। তারা ময়দান থেকে কিছুটা দূরে রাতের গেরিলা আক্রমণ প্রতিহতকরণে টহলদানরত সৈন্যদের কাছে চলে এলেন। টহলদলের দুই সেনাপতির উদ্দেশ্যে বিন কাসিম বললেন, বন্ধুদ্বয়! আজকের লড়াইটা সূচনামাত্র। এটাকেই শত্রু বাহিনীর পরিণতি মনে করো না। শুধু একটি মোকাবেলায় বিজয়ী হয়ে এমন আত্মশ্লাঘায় ডুবে যেয়োনা যে, সামনের প্রতিটি মোকাবেলায় শত্রুবাহিনী এভাবেই পরাস্ত হবে। রাজা দাহির তার ছেলে জয়সেনাকে কিছু সৈন্য দিয়ে মোকাবেলায় লিপ্ত করে আমাদের যুদ্ধ কৌশল দেখে নিয়েছে। সে আমাদেরকে কিভাবে পরাজিত করতে হবে তা বুঝার চেষ্টা করছে। সামনের প্রতিটি মোকাবেলায় আমাদেরকে আরো সতর্ক হয়ে লড়াই করতে হবে, অবশ্য আল্লাহ তাআলা বিজয় আমাদেরকেই দান করবেন।

    ‘চিন্তা করবেন না বিন কাসিম। আমরা সেইদিন নিজেদেরকে বিজয়ী মনে করবো যে দিন রাজা দাহিরের খণ্ডিত মস্তক আপনার পায়ের কাছে গড়াগড়ি করবে’ বললেন সেনাপতি যুরায়েম বিন আমর মাদানী। ইসলামের পথে বাধাসৃষ্টিকারী এই দেয়ালকে আমরা গুড়িয়ে দিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলবো, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, আমরা সেই কর্তব্য পালন করেছি।

    বিন কাসিম। নিঃসন্দেহে আমাদের এ বিজয় চূড়ান্ত বিজয় নয়; তবে এই বিজয়ই আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ খুলে দিয়েছে” বললেন অপর সেনাপতি দারাস বিন আইউব। আমাদের যোদ্ধারা হাতিকে ভয় পেতো। আর এখন দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, দাহির বাহিনীর হাতিগুলোই আমাদের সৈন্যদের ভয় করতে শুরু করেছে।

    নিঃসন্দেহে তা ঠিক, বললেন বিন কাসিম। আমি আমার যোদ্ধাদেরকে হাতির শুঁড় কেটে দিতে নিজ চোখে দেখেছি।

    এরপর বিন কাসিম তাঁর আহত সৈন্যদের দেখতে চলে গেলেন। ঘাসের ওপর কাপড় বিছিয়ে আহত সৈন্যদের শুইয়ে রাখা হয়েছিল। আহত সেনা শিবিরের কাছে গিয়ে বিন কাসিম ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তিনি একেকটি তাঁবুতে ঢুকে সৈন্যদের সাথে কথা বলে আবার অন্য শিবিরে প্রবেশ

    ছিলেন। এ ভাবে একটির পর একটি তাঁবুতে ঢুকে সৈন্যদের চিকিৎসার। খোঁজ-খবর ও আহতদের সাথে কথা বলে নতুন একটি তাবুতে প্রবেশ করছিলেন। তাবুতে মশাল জ্বলছে। তিনি দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধা আহত সৈন্যকে পানি পান করাচ্ছে। অবশ্য এর আগেই ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। বৃদ্ধার চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট হলেও তার গড়ন বেশ শক্ত। এরই মধ্যে সেবিকা বৃদ্ধার সাথে আহত সৈনিকের কথাবার্তা হয়েছে।

    : তুমি কার মা? : আহত সৈনিক বয়স্কা সেবিকাকে জিজ্ঞেস করল।

    এ মুহূর্তে আমি সকল সৈন্যের মা, যারা আরবদের মান অক্ষুন্ন রাখার জন্য রক্ত ঝরিয়েছে। তোমার মনে এ প্রশ্নের উদ্রেক হলো কেন, যে আমি কার মা? পাল্টা প্রশ্ন করল বৃদ্ধা।

    : হ্যাঁ, তুমি আমারও মা-ই বটে। আমার মা হলেও এমন মমতায় পট্টি বেঁধে দিতো এবং পরম আদরে পানি মুখে তুলে দিত। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। কারণ তুমি এখন এমন বয়সে উপনীত হয়েছে যে, আমাদের উচিত ছিল তোমার সেবা করা, কিন্তু উল্টো আমাদেরকে তোমার সেবা করতে হচ্ছে।

    : তুমি কোন কবিলার লোক আহতকে জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধা।

    : আমি বনী উমাইয়ার লোক। আচ্ছা, তুমি কোন গোত্রের?

    : আমি আলাফী গোত্রের লোক। জবাব দিল মহিলা।

    : আলাফী? আঁতকে উঠল আহত সৈনিক। আমাদের সেনা শিবিরে কি কোন আলাফী গোত্রের সৈন্যও আছে। যার মা তুমি?

    : না, বনী উমাইয়ার শাসনাধীন সেনাবাহিনীতে কোন আলাফী গোত্রের সৈন্য থাকতে পারে না। এখানেও নেই। কারণ এই দুই গোত্রের মধ্যে শত্রুতা বিদ্যমান।

    : তাহলে তুমি এখানে এলে কি করে? আলাফীরা তো সবাই বিদ্রোহী। ওরা খলিফার সাথে বিদ্রোহ করে হিন্দুস্তানে এসে রাজা দাহিরের আশ্রয়ে বসতি গেড়েছে।

    : আমি একা নই। আমার সাথে আলাফী গোত্রের আরো চার মহিলা এসেছে। আমরা তোমাদের সৈন্যদলের সাথে আরব থেকে আসিনি, মাকরান থেকে এসেছি।

    : ও নদী কিভাবে পার হয়েছে তোমরা?

    : কেন, নদীতে নৌকার পুল ছিলনা? আমরা সেই পুল পেরিয়ে এসেছি। আমাদের কেউ বাধা দেয়নি।

    আমি তোমার হাতে পানি পান করবো না। বৃদ্ধার হাতের পানি পান করতে অস্বীকৃতি জানালো সৈনিক। বৃদ্ধা সেবিকা ও আহত সৈন্যের মধ্যে যখন এই কথা হচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন সেনাপতি বিন কাসিম।

    বিন কাসিমকে প্রবেশ করতে দেখে আহত সৈনিক বৃদ্ধাকে বলল, তুমি এখান থেকে উঠে যাও, প্রধান সেনাপতি বিন কাসিম এসেছেন। তিনি যেন তোমার কথা জানতে না পারেন। বৃদ্ধা উঠে দু’হাতে বিন কাসিমের মাথা ধরে তার কপালে চুমু দিলো এবং তার উদ্দেশ্যে বলল বিন কাসিম। তুমি কি ভুলে গেছে, তোমার বাপ দাদা বনী সাকীফের লোক ছিলেন? বনী উমাইয়ার নূন রুটি কি তোমার শরীরে এতোটাই প্রভাব সৃষ্টি করেছে যে, তুমি তোমার সৈন্যদের মধ্যে আলাফীদের প্রতি এমন বিদ্বেষ তৈরি করে রেখেছে যে, এই আহত সৈনিক আমার হাতের পানি পান করতে পর্যন্ত ইচ্ছুক নয়।

    : কেন, কি হয়েছে? জানতে চাইলেন বিন কাসিম?

    : বিন কাসিমের জিজ্ঞাসার জবাবে বৃদ্ধা জানালো, সে একজন আলাফী গোত্রের মহিলা এবং মাকরান থেকে আরো চার মহিলাকে নিয়ে বিন কাসিমের আহত সৈন্যদের সেবাদানের জন্য কিভাবে এপর্যন্ত এসেছে।

    : তুমি জানো না বিন কাসিম, তুমি জানো না। প্রতিটি আলাফী নারী শিশু তোমার বিজয়ের জন্য কতভাবে যে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছে। এটাই ভেবে দেখো, এই বয়সেও আমি এতোদূর পর্যন্ত আসতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে নিজ চোখে দেখার খুব সাধ ছিল আমার। আজ

    দেখেছি। আমি তোমার চেহারায় খালিদ বিন ওয়ালিদ, সাদ বিন ওয়াক্কাস, আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ ও তাঁর সাথীদের নমুনা দেখতে পাচ্ছি…। দয়া করে তুমি এই সৈনিককে বলল, সে যেন আমার হাতের পানি পান করে, আমি পানিতে কোন বিষ মেশাইনি।

    মাফ করো মা। আমি আলাফীদের শত্রু নয় বন্ধু মনে করি। এই বেচারা জানে না, আলাফীরা আমাদের কতভাবে সহযোগিতা করছে।

    : বিন কাসিম ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে আহত সৈন্যের দিকে তাকালেন। সৈনিক তার চাহুনীর ভাষা বুঝতে পারল। আর বৃদ্ধা মহিলা পরম মমতায় আহত সৈন্যের দিকে পুনরায় পানির পাত্র তুলে ধরলে সৈনিক পানি পানের জন্য তার দিকে দু হাত প্রসারিত করে দিল। শোন বাবা! দুটি গোত্রের মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে কিন্তু এই মতবিরোধ আর শত্রুতা ইসলামের সম্পর্ককে ছিন্ন করতে পারে না। যে দিন গোত্রে গোত্রে ইসলামের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে, সেদিন ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, মুসলমানরা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে।

    সকাল বেলায় সূর্যোদয়ের পর দেখা গেল বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দাহিরের সৈন্যদের মৃতদেহ। এদের মধ্যে তখনও যেসব সৈন্যের দেহে প্রাণ ছিল তাদের কেউ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। মুসলিম বাহিনীর শাহাদত বরণকারী সৈন্যদের লাশগুলো এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছিল, আর সৈন্যরা সেগুলো দাফন করার জন্য কবর খুড়ছিল। অবশেষে একসাথে জানাযা পড়ে সবাইকে কবর দেয়া হলো। সিন্ধুতীরে আরব মুজাহিদদের মৃতদেহগুলো ইতিহাসের পাতায় ঠাই পেল আর তাদের দেহগুলো চিরদিনের জন্য মাটির সাথে মিশে গেল। সৈন্যদের দাফন শেষে বিন কাসিম রাজা দাহিরের সাথে প্রথম মুখোমুখি লড়াইয়ের খবর জানিয়ে হাজ্জাজের কাছে চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিতে যুদ্ধের গোটা পরিস্থিতি, সাফল্যও ক্ষয়ক্ষতির কথা সবিস্তারে উল্লেখ করলেন। চিঠি লেখা শেষ হলে বিন কাসিম পত্র বাহকের হাতে তা দিয়ে বললেন, যথাসম্ভব দ্রুত এই পয়গাম হাজ্জাজের কাছে পৌছাবে। হাজ্জাজের পরিকল্পনা মোতাবেক সপ্তম দিন বিন কাসিমের পত্রের জবাব নিয়ে পত্রবাহক ফিরে এলো। মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রাথমিক বিজয়ের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিন

    কাসিম ও সৈন্যদেরকে মোবারকবাদ জানালেন। সেই সাথে হাজ্জাজ কিছু দিক নির্দেশনা শেষে বিন কাসিমকে লিখলেন,

    এখন তুমি রাজা দাহির যেখানে সৈন্য জমায়েত করে অবস্থান করছে সে দিকে অগ্রসর হও…। তবে ভুলে যেয়োনা, আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানী ছাড়া শক্তি ও কৌশলের জোরে কখনো সাফল্য ধরা দেয় না। সব শেষে হাজ্জাজ লিখলেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখো, সব সময় আল্লাহর দরবারে সাফল্য ও মদদের জন্য মোনাজাত করতে থাকো, তাহলে প্রতিটি লড়াইয়ে আল্লাহর মদদে বিজয় তোমাদেরই হবে।’

    নিজেদের গুছিয়ে বিশাল ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দাহিরের সৈন্যদের মৃত দেহ, মৃত ঘোড়া ও হাতির দেহগুলোকে টেনে হেঁচড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে বিন কাসিমের সৈন্যদের টানা কয়েক দিন পরিশ্রম করতে হল। তাতে ময়দান পরিষ্কার হয়ে গেল, এক পাশে রয়ে গেল শুধু বিন কাসিমের আহত সৈন্যদের তাবু আর শহীদদের কবর, এবার বিন কাসিমের সৈন্যরা আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। প্রস্ততি চলাকালীন সময়ে একদিন সন্ধ্যাবেলায় বিন কাসিমের সেনা শিবিরে সকলের দৃষ্টি পশ্চিম আকাশের দিকে কি যেন তালাশ করছিল।

    হঠাৎ এক সৈনিক চিকার দিয়ে বলল, “আমি দেখে ফেলেছি! রমযানের চাঁদ উঠেগেছে। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর সারা শিবিরে যেন আনন্দের বন্যা বইয়ে দিল। অপরদিকে রাজা দাহিরও রমযানের চাঁদ দেখে খুশি হল। কারণ চূড়ান্ত আক্রমণের জন্যে রমযানের অপেক্ষা করছিল দাহির। রাজা দাহির তার সেনাপতিপুত্র জয়সেনাকে বলেছিল, রমযানের দিনের বেলায় যখন বিন কাসিমের বাহিনী ক্ষুধা পিপাসায় কাতর থাকবে, তখন সে চূড়ান্ত আঘাত হানবে। সেই রাতের দ্বিপ্রহরে একজন স্থানীয় লোক মুসলিম শিবিরে প্রবেশ করে সরাসরি শাবান ছাকাফীর তাবুতে চলে গেল। সে ছিল মুসলিম সেনাবাহিনীর একজন গোয়েন্দা। গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে সে জানাল, আরুঢ়ের পার্শবর্তী একটি ময়দানে রাজা দাহিরের সৈন্যরা রণপ্রস্তুতিতে সজ্জিত। তবে গোয়েন্দার পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়নি এই বাহিনী কোন দিকে যাত্রা করবে।

    তারা কি বিন কাসিমের বাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করবে, না নিজেরা এগিয়ে এসে বিন কাসিমকে হুমকি দেবে।

    শাবান ছাকাফী তখনি গোয়েন্দাকে সাথে নিয়ে বিন কাসিমের তাঁবুতে চলে এলেন। বিন কাসিমকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়া হলো। তিনি নিজে গোয়েন্দার কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিস্থিতির খবর নিলেন।

    এ খবর পেয়ে বিন কাসিম আর ঘুমাতে পারলেন না। তিনি গোয়েন্দা প্রধানকে নির্দেশ দিলেন, আপনি অগ্রসর হয়ে রাজার সৈন্যদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে আসুন। শাবান ছাকাফীকে বলার প্রয়োজন ছিল না, কি জিনিস তাকে প্রত্যক্ষ করতে বলা হয়েছে। এদিকে বিন কাসিম সকল সেনাপতি ও কমান্ডারদের ডেকে বললেন, বন্ধুরা! এখন সেই সময় এসে গেছে যে সময়ের জন্যে তোমরা অপেক্ষা করছে। শুধু তোমরা না, শত্রু বাহিনীও এই চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাজা দাহিরের রণপ্রস্তুতি ছিল রাজকীয়। রাজা দাহিরের হাতিটিও ছিল রাজকীয় সাজে সজ্জিত। অন্যান্য হাতির তুলনায় সেটি ছিল অনেক বড় এবং দেখতে ধূসর বর্ণের। এই নর হাতিটিকে কখনো কোন মাদী হাতির ধারে কাছে যেতে দেয়া হতো না। ফলে এটি সর্বক্ষণ মাতালের মতো উগ্র থাকত। হিন্দুরা হাতিকে রণাঙ্গণে নিয়ে আসার আগে এগুলোকে প্রচুর চোলাই মদ পান করাত। ফলে রণাঙ্গণে হাতিগুলো থাকতো উত্তেজিত উন্মত্ত। নির্দিষ্ট মাহুত ছাড়া আর কারো পক্ষে এসব জঙ্গী হাতিকে কাবুতে রাখা সম্ভব হতো না। মাহুত তাদের ইঙ্গিতেই হাতিগুলোকে ইচ্ছামতো চালাতে পারতো।

    রাজা দাহিরের হাতির ওপর ছিল রাজকীয় হাওদা। সোনালী রঙের ঝালর দেয়া দামী কালো কাপড়ে আবৃত ছিল হাতির উর্ধাঙ্গ। হাওদার ওপরে রাখা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ বর্শা ও তীর। যুদ্ধাবস্থায় রাজাকে তীর ও বর্শা এগিয়ে দেয়ার জন্য হাওদায় দু’জন অভিজ্ঞ সহযোগীকে রাখা হতো। রাজা দাহির যে তীর ব্যবহার করতো তা ছিল বিশেষ ভাবে তৈরি অনন্য বৈশিষ্ট সম্পন্ন। নতুন চাঁদের মতো বাঁকা উভয় প্রান্ত ধারালো এই তীর ধনুকের সাহায্যে নিক্ষেপ করার পর ঘুরে ঘুরে গিয়ে শত্রু সৈন্যের গলায় পড়লে মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।

    রাজা দাহিরের হাওদাতে অন্তত দু’জন রূপসী তরুণীকে রাখা হতো। প্রয়োজনের সময় এরা রাজাকে সুস্বাদু শরাব পান করাতো।

    রাজা দাহির হাতির ওপর আরোহণ করতে যাবে ঠিক এ মুহূর্তে মায়ারাণী এসে নিজ হাতে রাজার মাথায় তিলক এঁকে দিল এবং তার গালে চুমু খেল। আগেই বলা হয়েছে, মায়ারাণী দাহিরের আপন বোন হলেও তাকেই দাহির বিয়ে করে ছিল। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এসে রাজা দাহিরের গলায় লাল সাদা সূতার তৈরি পৈতা পরিয়ে দিলো। সে সময় পুরোহিতদের একটি দল ভজন গাইতে ছিল। রাজা দাহির যখন হাওদায় পা রাখলো তখন আগে থেকে হাওদায় অবস্থানরত দুই রূপসী তরুণী তাদের কাধ রাজার দিকে এগিয়ে

    দিল। রাজা দুই তরুণির কাধে ভর দিয়ে হাওদায় অবতরণ করল। মোট কথা, রাজা দাহিরের রণাঙ্গনে যাত্রা ছিল রীতিমতো একটি জমকালো অনুষ্ঠান। দাহির হাতির ওপর বসার সাথে সাথেই মাহুত হাতিকে চালিয়ে দিল। মাতাল হাতি শুড় ওপরে তুলে বিকট চিৎকার করে দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করলে চতুর্দিক থেকে শুরু হলো জয়ধ্বনী মহারাজের জয় হোক। তিনবার উপস্থিত সকল মানুষ এই জয়ধ্বনী উচ্চারণ করল। রাজার হাতি কয়েকবার গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কিছুটা সামনে অগ্রসর হয়ে আবার পিছিয়ে এলো, যেন হাতি রনাঙ্গণে যেতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। মাহুতের কথা ও শাসন সে মানতে নারাজ।

    একপর্যায়ে টানা কয়েকটি চিৎকার দিয়ে দ্রুতবেগে রাজার হাতি সারিবেঁধে অপেক্ষমান সৈন্যদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সৈন্যদের অগ্রভাগে একশ জঙ্গী হাতি সারিবেঁধে দাঁড়ানো ছিল। প্রতিটি হাতির পিঠের হাওদায় তিনজন করে তীরন্দাজ ও চারজন করে বর্শা নিক্ষেপকারী সৈন্য সদাপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল।

    হস্তিবাহিনীর পেছনে ছিল দশ হাজার অশ্বারোহী, যাদের প্রত্যেকের মাথায় শিরস্ত্রাণ এবং দেহে লোহার বর্ম। পনের হাজার পদাতিক সৈন্য তাদের ডানে ও পনের হাজার পদাতিক সৈন্য বামে সুসজ্জিত অবস্থায় দাঁড়ানো। রাজা দাহিরের নির্দেশে এভাবে সকল সৈন্যকে দাঁড় করানো হলো, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে রাজা সকল সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।

    ‘পবিত্র ভারতমাতার যোগ্য সন্তানেরা! এই ধরিত্রী আজ তোমাদের কাছ থেকে রক্ত দাবী করছে। ভারত মাতা আজ তোমাদের কাছে জীবন বলিদানের আহবান জানাচ্ছে। নিজের মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ভারতমাতার জন্যে নজরানা দিয়ে দাও। আমি তোমাদের সাথেই আছি থাকবো। তোমাদের সাথে আমিও আমার জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার আগে অন্তত একশ শত্রু নিধন করতে হবে…। আমি দেবদেবীদের ইঙ্গিত পেয়েছি, আমার মাথা আমার শরীরেই থাকবে এবং আরব পর্যন্ত যাবে। আরব ভূমি বহু দিন ধরে তোমাদের অপেক্ষা করছে। তোমরা বিজয়ী বেশে সেই দেশে প্রবেশ করবে যে দেশ থেকে সনাতন ধর্মের শত্রুরা ভারতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। ইসলামের নবোথ্থিত মাথা গুড়িয়ে দিতে হবে, মক্কার পবিত্র ঘরে আবার দেবদেবীর মূর্তি প্রতিস্থাপন করতে

    হবে। চিরদিনের জন্য সেখানকার আযান বন্ধ করে দিতে হবে। সেখানে আযানের পরিবর্তে ঘণ্টা বাজবে, ভজনকীর্তন হবে, আরতি হবে।

    “ভারতমাতার জয় হোক” “রাজা দাহিরের জয় হোক”

    বিশাল বাহিনীর জয়ধ্বনীতে রাজা দাহিরের আওয়াজ হারিয়ে গেল। বক্তৃতায় বিরতি দিয়ে ক্ষান্ত হলো দাহির। অতঃপর শ্লোগান থামলে দুহাত ওপরে তুলে আবার বলতে শুরু করল

    ভারতমাতার সন্তানেরা! তোমাদের মন থেকে এই ভয় তাড়িয়ে দাও যে, মুসলমানরা খুব সাহসী বীর, ওরা রাজ কুমার জয়সেনার সৈন্যদের হারিয়ে দিয়েছে এটা নিয়ে চিন্তা করো না। ওরা আমাদের বহু দুর্গ জয় করে নিয়েছে, এটাকেও বড় মনে করো না। বৌদ্ধদের সহযোগিতার কারণে ওরা আমাদের দূরবর্তী দুর্গগুলো কব্জা করতে পেরেছে। এটা ওদের বাহাদুরী নয়। বৌদ্ধদের গাদ্দারী। এই সাফল্যেকে পুঁজি করেই মুসলমানরা নদী পার হয়ে এপারে আসার দুঃসাহস দেখিয়েছে। ওরা ভাবছে, আমাদেরকে আরো পিছু হটিয়ে দিতে পারবে। আর আমরা ওদের ভয়ে দুরে পালিয়ে যাবো। তোমরা মনে রেখো, আমি ইচ্ছা করেই ওদেরকে এ পর্যন্ত আসতে দিয়েছি। এখন আর কখনো ওরা নদীর পাড়ে যেতে পারবে না। এখন আমরা নদীর পাড়ে যাবো। ওদের নৌকাগুলোকে জ্বালিয়ে দেবো, নদীতে ভাসিয়ে দেবো। এখন নদী পার হওয়ার পালা আমাদের। একথা মনে রেখো, যদি ওদের ভয়ে জড়সড়ো হয়ে থাকো, বুক টান করে ওদের মোকাবেলায় জীবনবাজী রাখতে না পারো, তাহলে তোমাদের যুবতী স্ত্রী, বোন, কন্যারা ওদের দাসীতে পরিণত হবে। তোমাদের ধন-সম্পদ অলংকারাদি ওরা লুটে নেবে। তোমাদের পালিত গোমাতাকে ওরা জবাই করে খাবে। তোমরা কি গোমাতার অসম্মান সহ্য করবে?

    না, না, আমরা জীবন থাকতে গোমাতার অসম্মান হতে দেবো না, সমস্বরে রব উঠল হাজারো কণ্ঠে।

    ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, অনলবর্ষী বক্তৃতায় রাজা দাহির হিন্দুদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, তার সৈন্যদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল যুদ্ধ উন্মাদনা। সৈন্যদেরকে দাহির দেবদেবীদের অভিশাপের ভয় দেখাল এবং দেবদেবীর মর্যাদা রক্ষায় জীবনপাত করনে স্বর্গের অফুরন্ত সুখ লাভের লোভ দেখাল।

    রণাঙ্গণে যাওয়ার আগের রাতে রাজা দাহির তার সামরিক উপদেষ্টাদের ডেকে তাদের সাথে পরামর্শ করল। সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ও কমান্ডারদের সাথে যুদ্ধ নিয়ে সলাপরামর্শ করলো। পরামর্শদাতাদের মধ্যে মুসলিম সরদার হারেস আলাফীও ছিলেন। হারেস আলাফীকে দাহির নির্ভরযোগ্য সুহৃদ ও বুদ্ধিমান পরামর্শদাতা ভাবতো। অথচ আলাফী সরদারের সব আনুগত্য শুভাকাঙ্ক্ষা ছিল বিন কাসিম ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি। সে সময় যদি বনী উমাইয়ার শাসন না হতো, তাহলে এসব আরব যোদ্ধাকে মাকরানে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হতো না।

    রাজা দাহির তার কমান্ডারদের নির্দেশ দিলো, সেনাদেরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে একেকটি দলকে পরস্পর থেকে দূরে রাখবে। রাজা মনে করেছিল, মুসলিম সৈন্যরাও তার সৈন্যদের সাথে মোকাবেলার জন্য বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় দাহিরের রিজার্ভ সৈন্যরা অন্য প্রান্ত থেকে অথবা পিছন দিক থেকে মুসলিম সৈন্যদের ওপর হামলা চালাবে।

    ‘ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করে মারতে হবে’ বলেছিল রাজা দাহির। মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু করা হবে তখন, যখন ওরা বিচ্ছিন্নভাবে মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাবে। এদের অধিকাংশ সৈন্য নিহত ও আহত হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। নতুন চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই রাওয়ার দিকে অভিযান শুরু হবে কিন্তু মাত্র দুটি ইউনিট আরব বাহিনীকে মোকাবেলা করবে। এক ইউনিট আক্রমণ করে পিছনে চলে আসবে আরেক ইউনিট আক্রমণ করবে। বিগত রাতেই এসব রণকৌশল রাজা তার কমান্ডারদেরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সেনাবাহিনী রওয়ানা হবার আগে উত্তেজনা ও আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে সে সবার মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করে দুটি অশ্বারোহী ও একটি পদাতিক ইউনিটকে জয়সেনার সাথে মুসলিম বাহিনীর অবস্থান রাওয়া-এর দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিল। কারণ রাজার সংবাদবাহকরা তাকে খবর দিয়েছিল, মুসলিম সৈন্যরা এখনও রণাঙ্গনেই অবস্থান করছে তাদের অগ্রাভিযানের কোন আলামত দেখা যায়নি।

    ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা দাহির এই বলে বক্তৃতা শেষ করেছিল‘আমার জীবন থাকতে ইসলাম সিন্ধুতে প্রবেশ করতে দেবো না। আমরা যদি এখানেই ইসলামের আগমন রুখে দিতে না পারি, তা হলে তা সারা হিন্দুস্তানে

    ছড়িয়ে পড়বে। আর আমাদের সন্তানেরাও এই অভিশাপ থেকে রেহাই পাবে না।

    মৃত্যুর পর ইদুর কুকুরের বেশে আমাদের পুনর্জন্ম হবে।’ বক্তৃতা শেষে আগের রাতের পরিকল্পনা মতো সৈন্যদেরকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলো রাজা।

    সেনাবাহিনী চলতে শুরু করলেই এক উষ্ট্রারোহী দ্রুতবেগে রাজার হাতির কাছে এসে জানালো, আরব বাহিনী রণাঙ্গন ছেড়ে আরো সামনে চলে এসেছে। এবং আমাদের থেকে সামান্য দূরে অবস্থান নিয়েছে।

    বিন কাসিমকে আগেই তার এক গোয়েন্দা খবর দিয়েছিল, দাহিরের সৈন্যরা অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে রাজার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। যুদ্ধ কৌশলে পারদশী বিন কাসিম এ খবর পাওয়া মাত্রই প্রস্তুতি অবস্থায় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য রাতারাতি তার সৈন্যদের অভিযানের জন্য প্রস্তুত করলেন এবং সকাল হতেই সেনাদের রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বিন কাসিমের সৈন্যদের চলার গতি ছিল তীব্র ফলে দিনের শেষে তারা রাওয়া থেকে আরো চার পাঁচ মাইল সামনে পৌছে গেল।

    এর ফলে রাজা দাহিরের পূর্ব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। রাজা দাহির জানতো না এখন আর তার সৈন্যদের গতিবিধি বিন কাসিমের অজানা নয়। রাজা দাহির তার সৈন্যদেরকে বিভিন্নভাগে বিভক্ত করে যে দিকে পাঠিয়েছিল বিন কাসিমের গোয়েন্দারা সব তথ্য সংগ্রহ করে তাকে যথাসময়ে অবহিত করেছিল। রাজা দাহিরকে বিদায় জানানোর জন্য যেসব লোক সমবেত হয়েছিল তারা সবাই যার যার মতো করে ফিরে গেল। এদের মধ্যে ছিল পুরোহিত দল, সামরিক উপদেষ্টা এবং দরবারের শীর্ষ আমলা শ্রেণি। তাছাড়া রাজা দাহিরের রক্ষিতা ও স্ত্রীরাও তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। বিদায় জানাতে আসা লোকদের মধ্যে মায়ারাণী এবং সরদার আলাফীও ছিলেন।

    মায়ারাণী তাকে নিয়ে আসা পালকীতে চড়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে একটি ঘোড়া আনিয়ে তাতে আরোহণ করল। এদিকে হারেস আলাফী সবার থেকে ভিন্ন হয়ে একাকী ফিরে যাচ্ছিলেন। মায়ারাণী তার ঘোড়াকে সরদার আলাফীর ঘোড়ার পাশে নিয়ে গেল।

    পাশাপাশি গিয়ে মায়ারাণী সরদার আলাফীর উদ্দেশ্যে বলল

    সরদার আলাফী! মহারাজ তোমার পরামর্শ খুব তাড়াতাড়ি মেনে নেন। আচ্ছা তুমি কি এসব পরামর্শ মহারাজের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে করো না তোমার শুভাকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বস্ততা আরো কারোর প্রতি?

    ‘হঠাৎ তুমি একথা জিজ্ঞেস করছো কেন রাণী? মায়ারাণীকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন আলাফী। আমার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে কি তোমার কোন সন্দেহ আছে? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে আমার মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। কারণ তুমি মূলত একজন মুসলমান এবং আরব। তাছাড়া তুমিতো বলেই দিয়েছ, কিছুতেই তুমি আরব ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পারবে না। এতে আমার সন্দেহ হয় তুমি আড়ালে আবডালে আরবদেরই সহযোগিতা করছে আর মহারাজকে এমন পরামর্শ দিচ্ছো, যাতে আরব বাহিনীরই সুবিধা হয়। ‘ তুমি কি এমন একটি পরামর্শের কথা বলতে পারবে? তুমি মহারাজকে পরামর্শ দিয়েছে, নির্বিঘ্নে মুসলিম বাহিনীকে নদী পার হয়ে এপারে আসতে দিতে। মহারাজ তোমার এই পরামর্শ এজন্য মেনে নিয়েছেন যে, তিনি যদি আরব বাহিনীকে পরাজিত করেন তাহলে নদীর কারণে ওরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। একথা না বলে তুমি যদি এমন পরামর্শ দিতে আর বাহিনীকে নদীপার হওয়ার সুযোগ দিয়ে যখন ওরা নদী পার হতে থাকবে তখন ওদের ওপর তীর ও বর্শার তুফান চালিয়ে দেবেন। তা কি ভালো হতো না?

    রাণী! মহারাজকোন বালক শিশু নন। তিনি নির্বোধ অবুঝ অদক্ষ নন। তিনি বিন কাসিমের চেয়ে অনেক বেশী দক্ষ। তিনি ভালো মন্দ সুবিধা অসুবিধা ভালো জানেন। এসব কথা থাক, আসলে তুমি কি বলতে চাও; সেকথা বলো। – তুমি তো বলতে চাচ্ছ, আমি প্রকৃতপক্ষে বিন কাসিমের শুভাকাঙ্ক্ষী, তোমাদের সাথে থেকে মহারাজকে ধোকা দিচ্ছি।

    হ্যাঁ, আমি তোমাকে একথাই বলতে চাই। আমি তোমাকে একথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মহারাজ’ অনুগ্রহ করে তোমাদেরকে মাকরানে আশ্রয় দিয়েছেন। না হয় এদেশে কোন মুসলমানের পক্ষে আশ্রয় গ্রহণ সম্ভব ছিল না। আচ্ছা, তোমার সাথে দু’জন লোককে দেখেছিলাম, তন্মধ্যে একজনকে দেখছি, অপরজন কোথায় গেছে? মায়া, মহারাজকে যে ধোকা তুমি দিয়েছ, সে কথা আমি জানি। তুমি একই সাথে মহারাজের বোন ও স্ত্রী। কিন্তু হৃদয়ের তাপ ও জ্বালা নিরসনের

    জন্যে তুমি এক আরব নওজোয়ানকে বন্ধু বানিয়ে রেখেছে। তুমি জানতে চাইলে আমি তার নামও বলে দিতে পারি। তুমি আমার যে লোকের অনুপস্থিতির কথা জানতে চাচ্ছো দিনের বেলা কেন, অনেক সময় রাতের বেলায়ও সে আমার সাথে থাকে না।

    আমি জানি সে তখন কোথায় থাকে’ বলল মায়ারাণী। তাহলে সে কথা বলো, সে এ মুহূর্তে কোথায়? উম্মামাখা কণ্ঠে জানতে চাইলেন আলাফী। আলাফী ঘোড়া থামিয়ে মায়ার চোখে চোখ রেখে বললেন, মায়া! আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা দূর করে দাও, তোমার সবচেয়ে গোপন কথা আমার অন্তরে সংরক্ষিত রয়েছে।

    আলাফীর ইঙ্গিতপূর্ণ এই হুমকিতে চুপ হয়ে গেল রাণী। আলাফী বললেন, আজ আমি তোমাকে আরেকটি রহস্য বলে দিচ্ছি, মহারাজ বিন কাসিমকে পরাজিত করতে পারবে না।

    তুমিতো এটাই চাও!

    এটা আমার চাওয়া নয়। এটা আমার ভবিষ্যদ্বাণী। আর সার্বিক পরিস্থিতিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, মহারাজের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

    আলাফীর যে সঙ্গীর কথা মায়ারাণী জানতে চেয়েছিল, সে কিছু দূরে এক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অপর লোকটি ছিল বিন কাসিমের একজন গোয়েন্দা। আলাফীর সঙ্গী গোয়েন্দাকে বলছিল, রাজা দাহির যুদ্ধের কি পরিকল্পনা করেছে।

    অবশ্য একথা ঠিক যে, আলাফীর পক্ষ থেকে যদি বিন কাসিমকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না করা হতো তাহলেও বিন কাসিম দাহিরের জালে আটকা পড়ার মতো লোক ছিলেন না। দাহিরের অবস্থান থেকে চার মাইল দূরেই তিনি তার সৈন্যদের অভিযান রুখে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি সবকিছু বুঝে শুনে ধীর ও বিচক্ষণতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি নতুন এই এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত হতে চাচ্ছিলেন। তাঁর ছড়িয়ে দেয়া গোয়েন্দারাও রাজার ঘরের খবর সংগ্রহ করে তাকে যথাসময়ে অবহিত করছিল। সেসময় বিন কাসিমের সেনাদলে ছিল

    বারো হাজার অশ্বারোহী। রাজা দাহিরের ছেলে জয়সেনাকে পরাজিত করে ওর সৈন্যদের বহু ঘোড়া বিন কাসিমের যোদ্ধারা কব্জা করে নিয়েছিল। ফলে তার বহু পদাতিক সৈন্যও তখন অশ্বারোহী সেনায় রূপান্তরিত হয়েছিল। আরবদের সাথে যেসব পদাতিক সৈন্য ছিল এদের অধিকাংশই ছিল স্থানীয়। বিজিত এলাকার লোকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে পদাতিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।

    মুসলমানদের সদাচার ও তাদের বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে এসব স্থানীয় লোক বিন কাসিমের বাহিনীতে ভর্তি হয়েছিল। স্থানীয় সৈন্যদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার। সম্মিলিত মুসলিম সৈন্যের মোকাবেলায় রাজা দাহিরের সেনাবাহিনীতে পদাতিক সৈন্য সংখ্যাই ছিল ত্রিশ হাজার। বিন কাসিমের সেনাবাহিনীতে তীরন্দাজের সংখ্যা ছিল এক হাজার। তাদের মধ্যে একটি ইউনিট ছিল অগ্নিবাহী তীরন্দাজ।

    বিন কাসিম তার সৈন্যদের মধ্যভাগে অবস্থান নিয়ে বাকীদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছিলেন। তার সাথে রাখলেন সেনাপতি মিহরাব বিন সাবিতকে। ডান বাহুর দায়িত্ব দিলেন সেনাপতি জাহাস বিন জাফীর কাঁধে আর বাম বাহুর দায়িত্ব সেনাপতি যাকওয়ান বিন বকরের ওপর ন্যস্ত করলেন। রিজার্ভ বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন সেনাপতি আনাতা বিন হানযালা আর অগ্রগামী ইউনিটের দায়িত্ব ছিল আতা বিন মালেকের ওপর। বিন কাসিম সবাইকে সর্বশেষ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার পর ঘোষণা করলেন, আরব ভাইয়েরা! আমি যদি মারা যাই তাহলে আমার স্থলাভিষিক্ত হবে মিহরাব বিন সাবিত। মিহরাবের মৃত্যু হলে সাঈদ হবে তোমাদের প্রধান সেনাপতি।

    বিন কাসিম লক্ষ্য করলেন, রাজা দাহিরের সৈন্যরা ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত হয়ে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা দৃষ্টে তিনি তার সৈন্যদের বেশি জায়গা জুড়ে না ছড়ানোর নির্দেশ দিলেন।

    কেন্দ্রীয় ও রক্ষণভাগের কমান্ড নিজের হাতে রেখে তিনি জানতে চেষ্টা করলেন রাজা দাহিরের বেশির ভাগ সৈন্য কোন অংশে। রাজা দাহিরের পরিকল্পনা ছিল তার রিজার্ভ সৈন্য দিয়ে সে মূল আঘাত হানবে আর বিক্ষিপ্ত সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদেরকে মোকাবেলায় ব্যস্ত রাখবে। সেই সাথে রাজা দাহির ভেবেছিল আরব বাহিনীকে হয়তো তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যাবে কিন্তু রাজার সৈন্যদের অনেক আগেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আরব বাহিনী এগিয়ে আসায় রাজার যুদ্ধ পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল।

    বিন কাসিম আতা বিন হানযালার রিজার্ভ সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা শত্রুবাহিনীর প্রধান ইউনিটের ওপর আক্রমণ চালাও।

    সেনাপতি হানযালার সহযোদ্ধাদের আঘাত ছিল খুবই তীব্র। হিন্দু সৈন্যরা এই আত্মতুষ্টিতে ছিল তারা আরব সৈন্যদেরকে তাদের মর্জি মতো সুবিধাজনক স্থানে ফেলে আঘাত করবে। আর আরব সৈন্যদেরকে তাদের ইচ্ছামতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হয়রানী করে নাস্তানাবুদ করবে। রণাঙ্গনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে। কিন্তু যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ হিন্দুদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে চলে গেল। সেনাপতি আতা বিন হানযালার আক্রমণ হিন্দু সৈন্যরা দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলার চেষ্টা করল। তাদের বিশ্বাস ছিল রাজার অন্য বাহিনী তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে কিন্তু বিন কাসিম এমন নিপূণ কৌশল অবলম্বন করলেন যে, রাজার কোন ইউনিটই এদের সহযোগিতায় আসার সুযোগ পেল না।

    পিছনে ফিরে আসা ছাড়া রাজার এই সৈন্যদের জন্যে আর কোন পথ খোলা ছিল না। তারা পিছিয়ে আসতে শুরু করেছিল। বিন কাসিম যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। রাজার সৈন্যদেরকে পিছনে চলে যেতে দেখে তিনি সেনাপতিকে নির্দেশ পাঠালেন, তোমার সহযোদ্ধাদেরকে ওদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত রাখো।

    রাজার এই ইউনিটের সাথে প্রশিক্ষিত হাতিও ছিল। কিন্তু হাতিকে আরব সৈন্যরা আর মোটেও ভয় পাচ্ছিল না। কারণ হাতির বিরুদ্ধে আরব তীরন্দাজরা অগ্নিবাহী তীর ব্যবহার করছিল। তীরন্দাজরা হাতির চোখ লক্ষ্য করে অগ্নিবাহী তীর ছুড়তে শুরু করল। যেহেতু প্রশিক্ষিত হাতিগুলো ছিল প্রদক্ষিণরত এজন্য ওদের চোখে আঘাত করা সহজসাধ্য ছিল না। তবুও অগ্নিবাহী তীর হাতির গায়ের যে স্থানেই আঘাত করতো, হাতিগুলো ভড়কে গিয়ে তীব্র চিৎকার দিয়ে রণাঙ্গন থেকে পালাতে শুরু করল।

    রণাঙ্গনের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেও বিক্ষিপ্ত সৈন্যদেরকে একত্রিত করার কোন চেষ্টাই করলো না রাজা দাহির। সে নিজে রণাঙ্গনের মূল ভূমিতেও প্রবেশ করল না। এ দিকে বিন কাসিমও রণক্ষেত্র থেকে নিজেকে দূরে রাখলেন। তিনি আড়ালে থেকে তার সৈন্যদেরকে আগে পিছনে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। ফলে যুদ্ধ অনেকটাই ছোট ছোট সংঘর্ষে ছড়িয়ে পড়ল। বেলা যতোই পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছিল উভয় পক্ষের যোদ্ধারা

    সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের পরিবর্তে নিজেদেরকে পিছনে নিয়ে আসছিল। এভাবে প্রথম দিনের বেলা শেষে রাত নেমে এলো। উভয় বাহিনীর সৈন্যরা নিজ নিজ তাঁবুতে আশ্রয় নিল। রাতের বেলায় উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে পাহারা দেয়া ছাড়া কোন ধরনের আক্রমণ প্রতি আক্রমণের ঘটনা ঘটলো না।

    রাজা দাহির মনে করেছিল, সে যেমন তার সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়েছে, বিন কাসিমও সৈন্যদের এভাবে ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু বিন কাসিম তাঁর সৈন্যদের এভাবে ছড়িয়ে দিলেন না। ইতিহাসের কনিষ্ঠতম এই ক্ষণজন্ম সেনাপতি ছড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে তার সৈন্যদেরকে পরস্পর কাছাকাছি থেকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। প্রথমত প্রখর সামরিক দূরদর্শিতা দ্বিতীয়ত সরদার আলাফীর গোয়েন্দা তথ্যে তিনি রাজা দাহিরের পরিকল্পনা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। না, আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না। টানা সাত আট দিন এভাবে অনিষ্পন্ন যুদ্ধ চলার পর অধৈৰ্য্য হয়ে তার সামরিক কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বলল দাহির।

    শত্রুরা সতর্ক হয়ে গেছে। এদিকে আমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে। সেই সাথে ক্ষতি হচ্ছে আমার সৈন্য সংখ্যা। এখন আর বসে থাকা নয়, এখন আমি শত্রুদের হুমকি দেবো। হ্যাঁ! মহারাজ! এখন সময় এসেছে ওদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে হুমকি ও উস্কানী দেয়ার। মুসলিম বাহিনী টানা যুদ্ধে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাজার কথায় সায় দিয়ে বলল এক সেনাপতি। না, তোমার কথা ঠিক নয়। তোমাদের বড় ত্রুটি হলো, কোন জিনিসকে তোমরা গভীর ভাবে তলিয়ে দেখো না। চোখ মেলে কোন জিনিসের ভিতরটা দেখতে চাও না। তোমাদের প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়নি। ক্লান্তও হয়নি। ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। কিছুতেই ওরা আমাদের ফাঁদে পা দেবে না। উম্মমাখা কণ্ঠে সেনাপতির উদ্দেশ্যে বলল রাজা। সেই দিন রাতের ঘটনা। রাজা দাহির তার রাজকীয় তাবুতে দুই সুন্দরী রক্ষিতার সাথে ফুর্তি আর মদপান করছিল। এর আগে যুদ্ধ সম্পর্কে তার কমান্ডার ও সেনাপতিদের সে নির্দেশ দিল আগামীকাল মুখোমুখি লড়াই শুরু হবে। হঠাৎ ছুটন্ত ঘোড়ার আওয়াজ ভেসে এলো রাজার কানে। দেখতে দেখতে আওয়াজ আরো নিকটবর্তী হতে লাগল। রাজা প্রহরীকে ডেকে

    বলল, কোথা থেকে অশ্বখুরের আওয়াজ আসছে? ইত্যবসরে একটি ঘোড়া এসে রাজার তাঁবুর সামনে থামল। প্রহরী রাজার নির্দেশ শুনে তাঁবু থেকে বের হচ্ছিল ঠিক সে সময় তাকে ঠেলে মায়ারাণী ভিতরে প্রবেশ করল। তার চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ। দ্রুতগতিতে তার তাঁবুতে প্রবেশ করা থেকেই বুঝা যাচ্ছিল কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। কি হয়েছে রাণী? এ অসময়ে তুমি এখানে এলে? আসন ছেড়ে রাণীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল রাজা।

    তাবুর মাঝামাঝি এসেই থেমে গেল রাণী। সে চোখের ইশারায় নর্তকীদের ইঙ্গিত করল। রাণীর ইঙ্গিতে নর্তকীদ্বয় তাঁবুর বাইরে চলে গেল। প্রহরী তো আগেই বাইরে চলে গিয়েছিল। রাণী রাজার কাছে গিয়ে তার দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে চেপে ধরল। তার শরীর কাঁপছে। কাপাকাপা কণ্ঠে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কিত কণ্ঠে রাণী বলল, মহারাজ! শুনেছি আগামীকাল থেকে মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হবে। দুহাই লাগে, আপনি রণক্ষেত্রে যাবেন না। মহারাজ! আপনি পিছনে থেকে সৈন্যদের নির্দেশ দেবেন।

    কি সব বলছো রাণী। কি হয়েছে তোমার? উম্মামাখা কণ্ঠে বলল রাজা।

    আমি যদি শুধু আপনার বিবি হতাম তা হলে হয়তো একথা অমন করে বলতাম না। আমি আপনার বোন। বোন হয়ে ভাইয়ের এমন না, না, এমনটি কখনো হতে পারে না। ধরা গলায় বাক্য শেষ করতে পারল না রাণী। ওহ! রাণী, বুঝেছি! তুমি হয়তো কোন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে আতঙ্কিত হয়েছে। রাণীকে বুকের সাথে মিশিয়ে পিঠে হাত রেখে আদর করে বলল রাজা, এসো এটা পান করে নাও। মনটা ঠিক হয়ে যাবে। রাণীকে টেনে এনে তার দিকে শরাবের পেয়ালা উঠিয়ে দিতে দিতে বলল রাজা। শরাবের পানপাত্রে ধাক্কা মারলো রাণী। ধাক্কায় রাজার হাত থেকে পানপাত্র ছিটকে গিয়ে পড়ল বিছানায়। এসব মদ আমাকে খুশি করতে পারবে না মহারাজ! বলুন, আপনি রণাঙ্গনে যাবেন না…। আমি খুবই খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখেছি, আপনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন, আমি আপনাকে উঠাতে যাচ্ছি, জীবিত উদ্ধার করতে চাচ্ছি ঠিক এমন সময় আমাদের লোকেরাই তরবারী দিয়ে আপনার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। একথা বলে মায়ারাণী নীরব হয়ে গেল এবং ওপরের দিকে এভাবে চোখ বড় বড় করে তাকালো যেন কোন

    ভয়ংকর ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করছে সে। দ্রুত বেগে বিছানার ওপর বসা দাহিরের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে রাজার দু’পা জড়িয়ে ধরে মায়ারাণী বলল, যাবেন না মহারাজা কথা দিন, আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবেন না।

    “আরে বোকা! আমি রণাঙ্গনে না গেলে আমার সৈন্যরা হতোদ্যম হয়ে পড়বে। মুসলিমরা যদি জানতে পারে, সিন্ধুরাজা রণাঙ্গনে আসেনি তাহলে ওরা আমাকে কাপুরুষ মনে করবে।” বলল রাজা দাহির। তুমি কি দেখনি রাণী, আরব বাহিনী কিভাবে আমার রাজ্য দখল করে এগিয়ে আসছে। পণ্ডিতেরা বলেছে, মুসলমানদের যে করেই হোক এখানে ধ্বংস করে দিতে হবে। এদের ধ্বংস করার দায়িত্ব দেবতারা আমার ওপর দিয়েছে। এই পণ্ডিতেরাই তো আমার স্বপ্নের কথা শুনে বলেছে, যে করেই হোক মহারাজকে রণাঙ্গনে যাওয়া থেকে বিরত রাখো। তারা বলেছে, কাউকে পানিতে ডুবতে দেখা ভালো নয়, বলল রাণী।

    রাজা দাহির মায়ারাণীকে সাথে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। নানা কথায় রাজা মায়াকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল কিন্তু তাতে রাণী আরো উদ্বেলিত হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে রাজা দাহির রাণীকে দুহাতে ধরে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিয়ে দুই সৈনিককে নির্দেশ দিলো, তোমরা মায়াকে রাওয়া দুর্গের ভিতরে পৌছে দিয়ে আসো।

    ৯৩ হিজরী সনের ৯ রমযান। রাজা দাহিরের সৈন্যরা ময়দানে রণপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সৈন্যদের সম্মুখ সারিতে জঙ্গী হাতি। সারিবদ্ধ হাতির পিছনে রাজা দাহিরের বিশেষ হাতি দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রাজা দাহির রাজকীয় ভাবমূর্তি নিয়ে তার হাতির হাওদার ওপরে দাঁড়ানো। দাহিরের কাছেই তার ছেলে জয়সেনা একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। জঙ্গি হাতিগুলো মাতাল। প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করছে। হাতিগুলো অস্থিরভাবে দু’চার কদম এগুচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। হাতিগুলোর অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছিল ওরাও যেন টের পেয়ে গেছে, তাদের সামনে অজেয় শত্রু। সব হাতির ওপরে রাজার তীরন্দাজ সৈন্য তীর ধনুক বর্শা বল্লম নিয়ে রণসাজে প্রস্তুত। বিন কাসিম তার সৈন্যদেরকে রাজার সৈন্যদের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করালেন। তিনি সেনাপতি আবু মাহের হামদানীর ইউনিটকে সর্বাগ্রে হাতির

    মুখোমুখি দাঁড় করালেন। হামদানীর ইউনিটের সব যোদ্ধা ছিল আরব সৈন্যদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ লড়াকু ও নির্ভিক। তারেক বিন কাব, মাসউদ কালবী, সালমান আবদী, যিয়াদ বিন জালিদীকে বিন কাসিম তার সাথে রাখলেন।

    তার সৈন্যদের ডান বাহুর কমান্ডার নিযুক্ত করলেন যাকওয়ান বিন বকরীকে। আর রিজার্ভ সৈন্যদেরকে নাবাতা বিন হানযালার অধীনে ন্যস্ত করলেন। যুদ্ধ শুরুর আগে বাশার বিন আতিয়া, মুহাম্মদ বিন যিয়াদ মুসআব বিন আব্দুর রহমান এবং খোরম বিন উরওয়া এই চারজনকে ডেকে পাঠালেন। এই চারজন ছিল অস্বাভাবিক পারদর্শিতা ও বীরত্বের অধিকারী। তাদের উদ্দেশ্যে বিন কাসিম বললেন

    “বন্ধুগণ! তোমাদের ওপর আমি এমন দায়িত্ব দিচ্ছি, যার প্রতিদান দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তোমাদেরকে একাজের যোগ্য প্রতিদান দেবেন। কেননা তোমরা আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বেরিয়েছ।”

    আমাদের কি করতে হবে আল্লাহর ওয়াস্তে তাই বলুন, সম্মানীত সেনাপতি! বলল এদের একজন! আল্লাহর কসম! আমরা কোন ধরনের প্রতিদান অভিবাদনের তোয়াক্কা না করে আপনার নির্দেশ পালনে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ।

    রাজা দাহির হবে তোমাদের শিকার তোমরা তার হাতিকে ঘিরে ফেলবে। হাতিকে এমন আঘাত করবে যে ওটি পড়ে যেতে বাধ্য হয়। দাহিরকে জীবিত পাকড়াও করতে চেষ্টা করবে। জীবিত পাকড়াও করা সম্ভব না হলে ওর অঙ্গ কেটে নিয়ে আসবে। সে বহু নিরপরাধ নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আরবকে ধুকে ধুকে মরতে বাধ্য করেছে, ওকে আমি ক্ষমা করতে পারি না।

    ঠিক আছে, আপনার নির্দেশ পালন করা হবে সেনাপতি! ইনশাআল্লাহ আমরা আপনার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করব।

    বিন কাসিম আবার তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, হে আরব বন্ধুরা! আমি যদি শহীদ হয়ে যাই তাহলে আমার স্থলে মিহরাব বিন সাবিত প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে, সেও যদি শাহাদতবরণ করে তাহলে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে সাঈদ।

    যুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে বিন কাসিমের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি কিছুটা হতাশা সৃষ্টি করল। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, রাজা দাহিরের হাতি সম্মুখ থেকে পিছনে সরে যাচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল জায়গা বদল করছে রাজা, কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল শুধু জায়গা বদল নয় একেবারে সকল সৈন্যের পিছনে অবস্থান নিল রাজার হাতি। সেই সাথে হিন্দু বাহিনীর সম্মুখ ভাগের হাতির সারিকেও পিছনে সরিয়ে নিল দাহির।

    বিন কাসিম কিছুটা আশা দূরাশার মধ্যেই সেনাপতি মেহরাব বিন সাবিতকে নির্দেশ দিলেন, বিন সাবিত এগিয়ে যাও! আল্লাহর নাম নিয়ে হামলা কর।

    নির্দেশ পাওয়া মাত্র মিহরাবের অশ্বারোহী ইউনিটের যোদ্ধারা উর্ধশ্বাসে ঘোড়া ছুটালো। অপর দিকে দাহিরের সৈন্যদল থেকে একটি অশ্বারোহী অংশ এগিয়ে এসে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হলো। শুরু হলো প্রচণ্ড লড়াই। অবস্থা এই হলো যে, লড়াইয়ের শুরুতেই সেনাপতি মেহরাব শাহাদাত বরণ করলেন। বিন কাসিম অগ্নিবাহী তীরন্দাজদেরকে অগ্রসর হয়ে হাতিগুলোকে অগ্নিবাহী তীরের শিকারে পরিণত করার নির্দেশ দিলেন কিন্তু ততোক্ষণে রাজা দাহির হস্তিবাহিনীকে আরো পিছনে সরিয়ে নিয়েছে। রাজা দাহির হয়তো চূড়ান্ত আঘাতের জন্যে হস্তিবাহিনীকে সংরক্ষিত রাখার জন্য পিছিয়ে নিয়েগেছে। মেহরাবের শাহাদাতের পর তার ইউনিটকে পিছনে নিয়ে এসে সেনাপতি সাঈদের ইউনিটকে আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হলো। আবারো শুরু হলো প্রচণ্ড লড়াই। রাজা দাহির খুবই সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করছিল। রাজা আবারো একটি অশ্বারোহী ইউনিটকে এগিয়ে দিয়ে মোকাবেলার নির্দেশ দিল। এমতাবস্থায় বিন কাসিম সেনাপতি আতা বিন মালিকের ইউনিটকে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। আতার ইউনিট ছিল সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পলকের মধ্যে ওরা এগিয়ে গেল। ফলে রাজার সৈন্যরা মালিকের ইউনিটকে কাবু করতে পারল না।

    রণাঙ্গনের পরিস্থিতি বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য তারিখে মাসুমীতে লেখা হয়েছে, রাজা দাহির প্রত্যক্ষ করছিল তার বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় নগন্যসংখ্যক মুসলিম সৈন্যের মধ্যে কোন ধরনের ক্লান্তির ছাপ নেই। বিশাল হস্তিবাহিনী চোখের সামনে থাকার পরও ওদের মধ্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা যায় না।

    ওরা যখন হামলা করে তখন তাদের তকবীর ধ্বনীতে আকাশ কেঁপে ওঠে, অস্বাভাবিক প্রাণবন্ত ও উচ্ছাস মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণে।

    রাজা দাহির প্রচণ্ড মোকাবেলায় তার সৈন্যদেরকে পিছনে সরে আসার নির্দেশ দিল, আরব সৈন্যরাও ওদের পিছনে তাড়িয়ে নিতে শুরু করল। বিন কাসিম লক্ষ করলেন, হঠাৎ করে সৈন্যদের পিছিয়ে নেয়ার মধ্যে রাজা দাহিরের কূটচাল রয়েছে। আবেগ তাড়িত হয়ে মুসলিম যোদ্ধারা যখন

    য়ে অনেক দূর চলে যাবে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে অগ্রসরমান ইউনিট মূল বাহিনী থেকে, তখন রাজার বাহিনী এদের ঘেরাও করে নিঃশেষ করে ফেলবে। অবস্থা আঁচ করে বিন কাসিম তার অগ্রসরমান ইউনিটকে শত্রুদের তাড়া না করে পিছনে সরে আসার নির্দেশ দিলেন।

    এপর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে কোন লড়াই ছিল না, তবে রণাঙ্গন হিন্দু সৈন্যদের মরদেহে ভরে গিয়েছিল। আহত সৈন্যরা আর্তচিৎকার করছিল। আহতদের কেউ কেউ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার পড়ে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় উভয় দলের দু’তিনজন করে সৈনিক দৌড়ে রণাঙ্গনে গিয়ে আহত সৈন্যদের তুলে নিয়ে আসছিল। আহত সৈন্যদের তদারকি ও তাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিন কাসিম একটি ভিন্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের হাতে থাকতো পানির পাত্র এবং জরুরী ঔষুধপত্র। এই ইউনিট গঠন করা হয়েছিল যারা কোন না কোন কারণে যুদ্ধের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছিল অথবা স্বভাবতই যারা ছিল সেবা মানসিকতা সম্পন্ন এবং চিকিৎসা বিষয়ে পারদর্শী। বিন কাসিমের চিকিৎসা ও সেবা ইউনিটের সদস্যরা পানির পাত্র নিয়ে রণাঙ্গনে আহতদের চেহারায় পানির ঝাপটা দিয়ে তাদের চেতনা ফিরিয়ে আনতে এবং আহতদের পানি পান করাতো।

    হঠাৎ স্বেচ্ছাসেবকদের একজনের প্রতি বিন কাসিমের দৃষ্টি পড়ল। লোকটি তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বিন কাসিমের মনে হলো পুরুষের পোশাক পরিহিত হলেও লোকটি মনে হয় পুরুষ নয় নারী। নারী না হলেও একেবারে নাদুস নুদুস কিশোর। বিন কাসিম লোকটিকে কাছে ডাকলেন এবং ঘোড়ার পিঠে বসেই গভীর ভাবে লোকটির প্রতি তাকালেন।

    আমার দৃষ্টি যদি আমাকে বিভ্রান্ত না করে থাকে তবে আমার মনে হয় তুমি পুরুষ না-নারী, বললেন বিন কাসিম।

    হ্যাঁ, সাকিফ গোত্রের কোন চোখ কখনো প্রতারণার শিকার হয় না বিন কাসিম! আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমি নারী। শুধু আমি একা নই, আমার মতো আরো কয়েকজন নারী এখানে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসাবে কাজ করছে।

    তুমি কি স্বামীর সাথে এসেছ? তোমার ভাইও হয়তো তোমার সাথেই যুদ্ধে এসেছে? পুরুষের বেশধারী সেবিকাকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। বিন কাসিম! বলল মহিলা। মুসলিম বাহিনীতে যুদ্ধরত সবাই আমার ভাই। আমি স্বামীর সাথে এসেছি। আর কোন কথা না বলেই মহিলা তার কাজে চলে গেল। সেই দিনের যুদ্ধে আহতরা ছাড়া আর কোন যোদ্ধা পানি পান করত না। কারণ রোযার মাস হওয়ায় যুদ্ধরত হলেও তাদের কেউই রোযা ত্যাগ করত না।

    অবস্থা এমনই জটিল হয়ে গেল যে, বিন কাসিমের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ হলো না, নারীদেরকে রণাঙ্গনে থাকার অনুমতি দেবেন কি-না। কারণ ইত্যবসরে রাজা দাহির তার হস্তিবাহিনীকে আক্রমনের নির্দেশ দিয়ে দিছে। জঙ্গি হাতিগুলো মাতাল অবস্থায় বিকট চিৎকার দিয়ে এগিয়ে আসছিল। হাতির পিঠে শত্রুসেনারা তীর বর্শা ও বল্লম নিয়ে আঘাতের জন্য উদ্যত।

    এমতাবস্থায় বিন কাসিমের ইঙ্গিতে সেনাপতি সাঈদ ও আতার ইউনিটের যোদ্ধারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হওয়াটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। কয়েকটি ছোট দল মিলে একেকটি হাতিকে ঘেরাও করা ছিল তাদের দায়িত্ব। অশ্বারোহীরা হস্তিবাহিনীর মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার সাথে সাথে তাদের পিছন থেকে অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপকারীরা হাতিকে উদ্দেশ্য করে অগ্নিবাহী তীর ছুড়তে শুরু করল। শত্রুদের জঙ্গি হাতিগুলোকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে অগ্নিবাহী তীর ছিল কার্যকর হাতিয়ার। হামলা শুরুর সাথে সাথে একটি অগ্নিবাহী তীর এক হাতির পিঠে দাঁড়ানো বল্পমধারী শত্রুসেনার গায়ে আঘাত হানল। সাথে সাথে শত্রুসেনার গায়ে আগুন ধরে গেল। জ্বলন্ত আগুনে সৈন্যটি হাতির হাওদাতে চিল্কার ও লাফালাফি শুরু করলে ওর এক সাথীর গায়েও আগুন ধরে গেল। আগুনের হাত থেকে বাচার জন্যে উভয় সৈনিক হাতির হাওদা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ল। নীচে পড়ে নিজেদের সামলে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করার আগেই মুসলিম যোদ্ধাদের ধাবমান ঘোড়র পায়ে পিষ্ট হয়ে গেল।

    যুদ্ধের এক পর্যায়ে দিবাকর দিন শেষে তলিয়ে গেল। মাহুতরা তাদের হাতিগুলোকে তখন পিছিয়ে নিতে শুরু করল। তখনকার দিনে দিন শেষে যুদ্ধ।

    নিষ্পন্ন থাকলেও লড়াই বন্ধ করে দেয়া হতো। রীতি অনুযায়ী হস্তিবাহিনী হিন্দু শিবিরে ফিরে গেল আর অশ্বারোহী বাহিনী মুসলিম শিবিরে প্রত্যাবর্তন করল। সেদিন তিন চারটি হাতি মারাত্মক আহত হলো। আহত হাতিগুলো নিজ বাহিনীর সৈন্যদের জন্যেই মৃত্যুদূতে পরিণত হলো। বহু সৈন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেল। অবশেষে রাতের অন্ধকার রণাঙ্গনকে কালো পর্দায় ঢেকে দিল। বন্ধ হয়ে গেল মোকাবেলা।

    পর দিন ছিল ৯৩ হিজরী সনের ১০ রমযান। বৃহস্পতিবার। মহাভারতের ইতিহাসে সেই দিনটি সোনালী হরফে লিখে রাখার মতো দিন। সেদিন শুরু হয়েছিল ভারতের মাটিতে শিরক ও তৌহিদের মধ্যে চূড়ান্ত লড়াই। রাতে মুসলিম শিবিরে কোন যোদ্ধার পক্ষে সামান্য আরাম করাও সম্ভব হয়নি। সবাইকে বলে দেয়া হলো আগামীকাল হবে চূড়ান্ত লড়াই। কাজেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। তোমরা কি দেখনি, দাহির দূরে হাতির ওপরে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের তামাশা দেখছিল?

    সেনা-কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম। দাহির পর্যবেক্ষণ করছিল, সম্মুখ সমরে আমরা কিভাবে যুদ্ধ করি, লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের কতটুকু আছে। শেষ মুহূর্তে দাহির হস্তিবাহিনী দিয়ে আঘাত হেনেছিল, সে দেখে নিতে চেয়েছিল, কি ভাবে আমরা হাতির মোকাবেলা করি। চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সে রমযান মাস পর্যন্ত এজন্য অপেক্ষা করেছে। কারণ রমযান মাসে আমরা দিনের বেলায় রোযা রাখি, পানাহার করি না। ফলে লড়াই করার মতো শক্তি আমাদের থাকবে না…। দেখবে আগামীকালের রণাঙ্গনের পরিস্থিতি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেহরীর সময়ই বিন কাসিমের সব যোদ্ধারা পানাহার পর্ব সেরে নিল। আহত কোন যোদ্ধাকে তারা রণাঙ্গনের ত্রিসীমায় যেতে দিলো না। সবাইকে রণাঙ্গন থেকে তুলে এনে শিবিরের চিকিৎসা ইউনিটে রেখে দিল। সেখানে যুদ্ধে আসা মহিলারা তাদের সেবাশুশ্রুষা করছিল।

    এদিকে বিন কাসিমের কাছে একের পর এক খবর পাঠাচ্ছিল তার গোয়েন্দারা, কখন শত্রুসেনারা কি করছে। রাজা দাহির তার কমান্ডারদের সন্ধ্যাবেলায়ই বলে দিলো আগামীকালই হবে শেষ লড়াই। আগামী কালই হবে বিন কাসিমের জীবনের শেষ দিন। বিন কাসিম বাহিনীর যে সৈনিক বেঁচে থাকবে তার বাকী জীবন দাহিরের গোলামী করেই কাটাতে হবে। তবে সেই গোলামী হবে খুবই ভয়ঙ্কর, কষ্টদায়ক।

    আমার সৈন্যদের মধ্যে যে বিন কাসিমের খণ্ডিত মাথা এনে আমার হাতে দেবে সে হবে সৌভাগ্যবান। তাকে আমার রাজ দরবারে বসার জায়গা দেবো এবং চারটি গ্রামের জমিদারী দেবো। সে সেখানে দুর্গ তৈরি করে নিজের মতো করে শাসন কাজ চালাতে পারবে। রাতের দ্বি-প্রহরে মায়ারাণী আবার রাজা দাহিরের তাবুতে চলে এলো। রাণীর চেহারা ছিল অনেকটাই প্রসন্ন কারণ আজকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে দূরে থেকেছিল। রাণী আজও এসে বলছিল, আগামীকালও আপনি যুদ্ধে যাবেন না। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে সৈন্যদের দিয়ে যুদ্ধ করাবেন। রাজা দাহির মায়াকে আশ্বস্ত করার জন্যে বলল, ঠিক আছে, আমি তাই করব।

    পরদিন সকাল বেলায় সিন্ধুতীরের পললভূমি নতুন দৃশ্য নিয়ে হাজির হলো। রাজা দাহিরের গোটা সেনাবাহিনী রণপ্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। রাজা দাহির সকল সৈন্যের মাঝখানে তার রাজকীয় হাতির ওপর সওয়ার। পাশে ছিল দাহিরের পুত্র জয়সেনা। সেদিন রাজা দাহির পূর্ণ রাজকীয় জাকজমক নিয়ে রণাঙ্গনে আভির্ভূত হলো। দাহিরের ডানে-বামে অগ্রপশ্চাতে দশ হাজার বর্মপরিহিত অশ্বারাহী। এই দশ হাজার অশ্বারোহীই আরব বাহিনীর সাথে মোকাবেলার জন্যে যথেষ্ট, তাছাড়াও রাজা দাহিরের বাহিনীতে ছিল ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য। রণাঙ্গনে খোদ রাজাকে পেয়ে দাহিরের সৈন্যরা ছিল খুবই উজ্জীবিত।

    রাজা দাহিরের সাথে তার হাওদায় দুই সুন্দরী তরুণীও ছিল। তাছাড়া ছিল কয়েকজন বল্লম ও বর্শাধারী সৈন্য এবং বাঁকানো তীর নিক্ষেপকারী তীরন্দাজ। দাহিরের হাতির হাওদাতে আরো ছিল পানপাত্র ভর্তি শরাব। রাজার হাতির দু’পাশে ছিল কয়েকজন অশ্বোরোহী পুরোহিত। বিন কাসিম রাজা দাহিরের সৈন্যদের অবস্থান ও রণপ্রস্তুতি দেখে তার সৈন্যদের কর্মপরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করলেন। আল্লাহ প্রদত্ত দূরদর্শিতায় বিন কাসিম শত্রুপক্ষের অভিসন্ধি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর তীরন্দাজ সৈন্যদেরকে তিন ভাগে ভাগ করেনিলেন। সম্ভবত তিনি এটা করেছিলেন শত্রু বাহিনীর বিস্তৃতি তার বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি ছিল বলে। প্রতিটি সৈনিককে তিনি পূর্ণ প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। প্রত্যেক তীরন্দাজ নিজ নিজ ধনুকে তীর প্রবেশ করিয়ে নিল। বিন কাসিম তার বাহিনীকে পাঁচটি গোত্রীয় সারিতে ভাগ করলেন। এক সারিতে রাখলেন আলাফী গোত্রের যোদ্ধাদের। আরেক সারিতে দাঁড়

    করালেন আমীন গোত্রের লোকদেরকে। তৃতীয় সারিতে দাঁড় করালেন বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের যোদ্ধাদের, চতুর্থ সারিতে রাখলেন আবুল কায়েসের . নেতৃত্বাধীন তার গোত্রীয় মুজাহিদদেরকে আর পঞ্চম সারিতে দাঁড় করালেন ইবাদী গোত্রের লোকদেরকে।

    সারিবদ্ধভাবে সবাইকে দাঁড় করানোর পর বিন কাসিম তার ঘোড়াকে সৈন্যদের সামনে দিয়ে এপ্রান্ত ওপ্রান্ত দৌড়ালেন। গোটা সৈন্যদের চতুর্দিকে একবার প্রদক্ষিণ করে এসে তিনি সকল সৈন্যদের সামনে মাঝখানে তাঁর ঘোড়া থামালেন।

    চূড়ান্ত যুদ্ধের পূর্বমুহুর্তে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে সর্বকালের সর্বকনিষ্ট এই মহানায়ক যে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছিলেন তা হুবহু অক্ষরে অক্ষরে আজো ইতিহাসের পাতায় অম্লান। বিন কাসিম বললেন

    “হে আরব মায়ের সন্তানেরা। মাটির তৈরি মূর্তি পূজারী সৈন্যদেরকে তোমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছো। এরা শুধু তোমাদের অগ্রাভিযান রোধ করতে আসেনি, এরা আজ আমাদের অস্তিত্ব বিলীন করার সংকল্প নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। এই মুশরিক বেঈমানেরা শুধু তাদের ধর্মরক্ষার জন্যেই যুদ্ধ করতে আসেনি, এরা এসেছে আমাদের আক্রমণ থেকে তাদের সহায়সম্পদ পরিবার পরিজনকে রক্ষা করতে। এরা তাদের দেবালয়, সম্পদের খানা রক্ষার জন্যে জীবন-মরণ প্রতিজ্ঞা করে এসেছে।

    এদের হৃদয়ে এসব দেবালয় ও সম্পদের খানার প্রতি ভালোবাসা এতো প্রকট যে এগুলো রক্ষার জন্যে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে তারা প্রস্তুত। এরা আজ ভয়ংকর যুদ্ধের সূচনা করবে। এদের আক্রমণ হবে খুবই ভয়াবহ। তোমাদেরকে প্রচণ্ড মনোবল ও দৃঢ়তা নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। তোমরা আল্লাহর পথে শাহাদাতের আশা। নিয়ে আপন মাতৃভূমি ছেড়ে হিন্দুস্তানে এসেছো। বাতিলের সাথে আজ হক এর সংঘাত। মহান আল্লাহ সত্যের পক্ষে, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই আমাদের মদদ করবেন। সবসময় আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা করতে থাকো। ভয়, শঙ্কা, দ্বিধা সংকোচ মন থেকে ঝেড়ে ফেলো। মনে রেখো, আমাদের তরবারীগুলো কাফেরদের রক্তপানের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে রয়েছে। ওরা আজ আমাদের হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। তোমার যদি পার্থিব স্বার্থ, যশখ্যাতি ও সম্পদের দিকে তাকাও, তাহলে এগুলোও এই বেঈমানদের কাছ থেকে তোমরা ছিনিয়ে নিতে পারবে। বিজয়ী হলে এই জগতেও তোমরা ঢের সম্পদের অধিকারী হবে আর আখেরাতে আল্লাহ

    তাআলা তোমাদেরকে অকল্পনীয় প্রাচুর্য সম্মানে ভূষিত করবেন। মনে রাখবে, যাকে যেখানে দাঁড় করানো হয়েছে এবং তৎপরতা চালানোর যে জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে একচুলও এদিক সেদিক হবে না। এমন যেন না

    হয় বিশৃঙ্খল হয়ে ডান প্রান্তের লোকেরা বাম বাহুতে আর বাম প্রান্তের লোকেরা ডান প্রান্তে চলে এসেছে এবং মাঝের লোকেরা সামনে সামনের লোকেরা মাঝে চলে গেছে। কারো সাহায্যের প্রয়োজন ছাড়া কেউ আপন জায়গা বদল করবে না।

    খুব মনে রাখবে, সৎ ও নেক মানুষেরই বিজয় হয়ে থাকে। যাদের উদ্দেশ্য সৎ আল্লাহর কাছে তারা প্রিয়। লড়াই চলাকালেও মুখে কুরআনের আয়াতের তেলাওয়াত করতে থাকবে এবং সবসময় ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’র যিকির চালু রাখবে।

    বিন কাসিমের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর বনীবকর গোত্র ও বনী তামীম গোত্রের দু’জন করে লোক এসে তার সামনে দাঁড়াল। আল্লাহর কসম! তোমরা এ মুহূর্তে কোন অভিযোগ নিয়ে আসোনি তো? এ সময় অভিযোগ শোনার মুহূর্ত নয়, বললেন বিন কাসিম। “সম্মানিত সেনাপতি। আল্লাহ আপনাকে বিজয় ও মদদ দিন।” বলল আগন্তুকদের একজন। আমরা সবার আগে আমাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্যে আপনার কাছে নিজেদের পেশ করছি। কাফের বাহিনীকে দেখুন, ভয়ানক আতঙ্ক হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ানো। আপনি তাকিয়ে দেখুন, ওদের হাতিয়ার কতো উন্নত। আপনি তাকিয়ে দেখুন, পাহাড়ের মতো বিশালদেহী জঙ্গি হাতি নিয়ে ওরা আমাদের মুখোমুখি। ওদের চেহারা দেখুন! নিজেদের উন্নত সমরায়োজন অস্ত্রশস্ত্র জঙ্গি হাতি এবং বর্ম বল্পমে সজ্জিত হয়ে ওরা বেশ আত্মবিশ্বাসী উৎফুল্ল। আপনি কি আমার গোত্রের লোকদেরকে সর্বাগ্রে আক্রমণ করার অনুমতি দেবেন?

    আল্লাহর কসম! হে বনী তামীম ও বনী বকরের যোদ্ধারা। আমি তোমাদের শ্রদ্ধা করি। আমি বিশ্বাস করি তোমরা প্রত্যেকেই জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করবে। তিনি আবার সব সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আরব যোদ্ধারা। বনি তামীম ও বনি বকর সবার আগে আক্রমনের জন্যে উদ্বেলিত। আমি বিশ্বাস করি তোমরা প্রত্যেকেই শত্রুদের জন্যে মৃত্যুদূতের মতো ঝাপিয়ে পড়তে উদগ্রীব।

    এ সময় বনী তামীম ও বনী বকর গোত্রের যোদ্ধারা একযোগে এমন জোরে তকবীর ধ্বনী করল যে, আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল। তাদের তকবীর শেষ হতে না হতেই গোটা মুসলিম সৈন্যরা এমন উচ্চ আওয়াজে তকবীর ধ্বনি দিতে শুরু করল যে, আরব সৈন্যদের মধ্যে যাদের মনে কিছুটা দুর্বলতা ছিল তাদের দুর্বলতা প্রচণ্ড উত্তাপে দূর হয়ে গেল। আরব সৈন্যদের ঘোড়াগুলো হ্রেষারব এবং পা দিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করল যেন ওগুলোও লড়াইয়ের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। বিন কাসিম উদ্দীপ্ত সৈন্যদেরকে দু’হাত প্রসারিত করে থামালেন।

    তিনি সৈন্যদের উদ্দেশে আবারো বললেন, হে আরব যোদ্ধারা! আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আল্লাহ মুসলমানদের দুটি নেয়ামত দিয়েছেন। প্রথম নেয়ামত আল্লাহর রসূল আর দ্বিতীয় নেয়ামত বান্দাদের ইস্তেগফার কবুল করা। দৃঢ় থেকো, মনের শক্তি অটুট রাখো, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকেই দুশমনদের ওপর বিজয়ী করবেন।

    বিন কাসিম ঘোড়া হাঁকিয়ে দুই সৈন্যদলের মাঝামাঝি গিয়ে থামলেন এবং উচ্চ আওয়াজে বললেন, সেনাপতি সুলায়মান ও সেনাপতি আবু ফিদা! তোমরা চল্লিশজন করে যোদ্ধা নিয়ে শত্রু সেনাদের মোকাবেলার আহবান করো।

    এটা ছিল তখনকার দিনের যুদ্ধের রীতি। মূলযুদ্ধ শুরুর আগে উভয় পক্ষের কিছুসংখ্যক যোদ্ধার মোকাবেলা হতো। আবু ফিদা ছিলেন সদ্য আযাদকৃত গোলাম। তিনি সেনাপতি সুলায়মানের নেতৃত্বে চল্লিশ জন সৈন্য নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে অগ্রসর হয়ে শত্রুসেনাদের অবস্থান থেকে কিছু দূরত্বে দাঁড়িয়ে শত্রু সেনাদেরকে মোকাবেলার জন্যে আহবান জানালেন।

    সেনাপতি সুলায়মানের আহবানে রাজা দাহির কয়েকজন ঠাকুরকে কিছুসংখ্যক সৈন্য দিয়ে মোকাবেলার নির্দেশ দিল। রাজা দাহিরের সৈন্যরা মূল সৈন্যদল থেকে কিছুটা এগিয়ে এলেই আবু ফিদা তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং প্রচণ্ড আওয়াজে তকবীর ধ্বনী দিয়ে রণাঙ্গন কাঁপিয়ে দিল। আবু ফিদা শত্রুসেনাদের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে ঘুরে ওদের পিছনে চলে গেল। একদিকে সুলায়মান আর অপর দিকে আবু ফিদা এমন তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়ল যে, শত্রুবাহিনীর যে সৈন্যই তাদের ধারে

    কাছে আসছিল ধরাশায়ী হয়ে তড়পাতে শুরু করল এবং দ্বিখণ্ডিত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল।

    মুসলিম মুজাহিদরা এতোটাই প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করল যে, হিন্দু সৈন্যরা পর্যস্ত হয়ে গেল। আর বাকীরা পালিয়ে তাদের বাহিনীর দিকে চলে গেল।

    এদিকে আবু ফিদা উন্মুক্ত ময়দানে এপাশে ওপাশে ঘোড়া হাঁকিয়ে শত্রুদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল। এবার আরো কয়েকজন ঠাকুরের নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদলকে রাজা দাহির মোকাবেলা করার জন্যে পাঠালো। আবু ফিদা তখন আক্ষরিক অর্থেই এক আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে। সে দাহিরের যোদ্ধাদেরকে রণাঙ্গনের ঠিক জায়গায় পৌছার অবকাশই দেয়নি। আবু ফিদার এই দুঃসাহসী মোকাবেলা তার সহযোদ্ধাদেরকেও অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত করল। সেই সাথে নাবাতা ও তার সহযোদ্ধারাও আবু ফিদার সাহসীকতায় উজ্জীবিত হলো। ফলে রাজা দাহিরের এই সেনাদলেরও পূর্বের সেনাদলের পরিণতি বরণ করতে হলো।

    এবার রাজা তৃতীয় সেনাদল পাঠাল। এ দলে আগের তুলনায় সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশি। মুসলিম যোদ্ধারা তৃতীয় শত্রু দলকেও পূর্ববর্তী দুই দলের মতো প্রচণ্ড আক্রমণে পর্যদস্ত করল। এই দলের অধিকাংশ শত্রুসেনা আহত বা নিহত হল এবং যারা অক্ষত ছিল তারা পালিয়ে মূল সৈন্যদের কাছে আশ্রয় নিল। নাবাতা ও আবু ফিদার ছোট্ট দুটি ইউনিটের মরণপণ আক্রমণ এবং শত্রু বাহিনীর বিপর্যয়ে মুসলিম শিবির হর্ষধ্বনী ও তকবীরে মুখরিত হয়ে উঠল। মুসলিম সৈন্যদের গণনবিদারী তকবীর ধ্বনীতে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল। পরপর তিনটি সেনাদলের বিপর্যয় হিন্দু সৈন্যদের প্রভাবিত করল। যুদ্ধের ব্যাপারে রাজার কপালে ভাঁজ পড়ল, কারণ আবুফিদা শত্রুসেনাদের বিতারিত ও কচুকাটা করে শত্রু শিবিরের কাছাকাছি পর্যন্ত ঘোড়া হাঁকিয়ে শত্রুদেরকে মোকাবেলার জন্যে বেরিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছিল। আবু ফিদা বলছিল, “সাহস থাকে তো সামনে এসো না ভূতপূজারীরা! এসো না তোমাদের এই মৃত ভাইদের মরদেহগুলো তুলে নিতে? এস না, এসো, সাহস করো। অন্তত এদের ঘোড়াগুলো এসে নিয়ে যাও…।” রাজা দাহিরের, আহত ও নিহত সৈন্যদের ঘোড়াগুলো রণাঙ্গন জুড়ে দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। ছুটন্ত ঘোড়াগুলোকে পাকড়াও করার

    জন্যে বিন কাসিম কয়েকজনকে নির্দেশ দিলেন। শত্রুবাহিনীর বেশকিছু ঘোড়া মুসলমানরা পাকড়াও করে পিছনে পাঠিয়ে দিল।

    সিন্ধু মাতার সন্তানেরা! এই দুশমনদেরকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে কেটে ফেল। এতোক্ষণ আমি ওদের নিয়ে খেলা করছিলাম ওদের একটু ছাড় দিয়েছিলাম, তোমরা ওদের বাহাদুরী ধূলায় মিশিয়ে দাও। হিন্দু সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করল দাহির। রাজা দাহিরের কাছে এতো বেশি সৈন্য ছিল যে, ইচ্ছা করলে দু’প্রান্তের সৈন্যদেরকে আরো ছড়িয়ে দিয়ে সে মুসলিম বাহিনীকে ঘেরাও করে নিতে পারতো। রাজার নির্দেশের সাথে সাথে তার দু’প্রান্তের সৈন্য আরো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল এবং অগ্রভাগের সৈন্যরা বিন কাসিমের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করল। বিন কাসিম তার দু’প্রান্তের সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা তোমাদের দুই বাহুকে এতটুকু ছড়িয়ে দাও যাতে শত্রু সৈন্যরা তোমাদের নাগাল না পায়। রাজা দাহিরের সৈন্যদের আক্রমণ ছিল প্রচণ্ড। বহু জায়গা নিয়ে রাজা দাহিরের সৈন্যরা যুদ্ধের সূচনা করল। দাহির তার বিপুল সৈন্যসংখ্যা ও জঙ্গি হাতির শক্তির ওপর আস্থাবান ছিল। রাজা মনে করেছিল এতো বিপুল সৈন্যের পক্ষে ক্ষুদ্র এই বাহিনীকে ধূলায় মিশিয়ে দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

    ফলে সে কোন রণকৌশলের আশ্রয় না নিয়ে সোজা আক্রমণের নির্দেশ দিল। কিন্তু বিপুল শক্তির প্রতিপক্ষ থাকার পরও বিন কাসিম সব সময় তার মেজাজকে স্থির রাখলেন। তিনি সর্বোত্তম রণকৌশল অবলম্বন করে এই বিশাল বাহিনীর মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হলেন। তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে আরব যোদ্ধারা! বেঈমান সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। ওদের মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। তোমরা ওদের ধরে ধরে হত্যা করো।” সেনাপতির চিঙ্কার শুনে মুসলিম যোদ্ধারা আরো উজ্জীবিত হলো, তারা নিজেদের শৃঙ্খলা বজায় রেখে মোকাবেলা করতে শুরু করল। মুসলিম সেনাপতিরা সৈন্যদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতি কড়া নজর রাখলেন। দু’প্রান্তের দুই বাহুর সেনাপতিরা তাদের বাহুকে এতোটাই বিস্তৃত করে দিলেন যে, হিন্দু সৈন্যরা তাদের নাগাল পেল না। দু’প্রান্তের বিস্তৃতির পর উভয়প্রান্তের যোদ্ধারা শত্রুদের ওপর হামলে পড়ল। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিয়ে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা দাহির অনেকটা বেপরোয়া ভাবেই আক্রমণের নির্দেশ দিল। ফলে দাহিরের পদাতিক

    ও অশ্বারোহী উভয় সৈন্য মুসলমানদের আঘাতে ধরাশায়ী হতে লাগল। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রাজা দাহির জঙ্গি হাতিগুলোর সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছিল না, কারণ বিশৃঙ্খলার কারণে তার হাতির সামনে তার অশ্বারোহী সৈন্যরা এসে বার বার বাধা সৃষ্টি করছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে, সুশৃঙ্খল মুসলিম যোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে দাহিরের বিশৃঙ্খল সৈন্যরা পিছিয়ে আসতে শুরু করল। এই দৃশ্য ছিল দাহিরের জন্য অসহ্যকর। রাজা দাহির ছিল তার বাহিনীর পিছনে রিজার্ভ বাহিনী পরিবেষ্টিত। চার হাজার সৈন্যের দুটি অশ্বারোহী ইউনিটকে রিজার্ভ রেখেছিল দাহির। রিজার্ভ বাহিনী থেকে আটশ নির্বাচিত সৈন্য নিয়ে রাজা দাহির মূল রণক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হল। দাহিরের রিজার্ভ বাহিনীর প্রতিটি যোদ্ধাই ছিল বর্মধারী। এরা আধুনিক বর্শা ও তরবারী দিয়ে সজ্জিত। সেই সাথে আক্রমণ প্রতিহত করার মতো মজবুত ঢাল ছিল প্রত্যেকের সাথে। রাজা দাহির তার বিশেষ সাদা হাতির ওপর সওয়ার। হাতে অস্বাভাবিক ধরনের ধনুক। যা থেকে দুপাশ ধারালো ঘূর্ণিয়মান তীর নিক্ষেপ করছিল রাজা। এই বিস্ময়কর তীরের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হতে শুরু করল মুসলিম সৈন্যরা।

    জঙ্গি হাতি মোকাবেলার জন্যে বিন কাসিম আলাদা ইউনিট তৈরি করেছিলেন। তাদেরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। রাজা দাহিরের হাতিকে ঘেরাও করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট চারজনকে। কিন্তু এই চারজন রণাঙ্গনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে অন্য কোথাও আটকে গিয়েছিল। রাজা দাহিরের হাতিকে তার বিশেষ সৈন্যরা ঘেরাও করে রেখেছিল। এরা ছিল দাহিরের বিশেষ নিরাপত্তারক্ষী। রাজার একান্ত যোদ্ধারা রাজাকে সাথে পাওয়ার কারণে স্বভাবত উজ্জীবিত ছিল। এরা পরম বিক্রমে মুসলমানদের আক্রমণ করছিল ফলে মুসলিম সৈন্যদের জীবনহানীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

    এমন সময় শত্রু শিবিরের এক কমান্ডার সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, “সিন্ধু মাতার সন্তানেরা! মহারাজ রণাঙ্গণে এসে গেছেন। তিনি নিজে শত্রুদের কচুকাটা করছেন। চিৎকার শুনে অন্যান্য হিন্দু সৈন্যরাও রাজা দাহিরকে যুদ্ধ করতে দেখে বিপুল উৎসাহে মুসলিম যোদ্ধাদের ওপর হামলে পড়ল। আরব সৈন্যরা এ মুহূর্তে প্রবল আক্রমণের সম্মুখীন হলো।

    ঠিক এই মুহূর্তে আরব শিবিরের এক যোদ্ধা সুজা হাবশী ঘোড়া হাঁকিয়ে বিন কাসিমের কাছে এসে বলল, সম্মানিত সেনাপতি! দাহির ও তার হাতিকে জখম করার আগে আমার খাওয়া-পরা সব হারাম। আমি হয় দাহিরের মাথা কেটে নিয়ে আসবে নয়তো শহীদ হয়ে যাব।

    বিন কাসিম কিছু বলার আগেই সুজা বিদগতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে দাহিরের একান্ত সৈন্যদের ভীড়ে ঢুকে পড়ল। তখন বিন কাসিমের যোদ্ধারা বীরদর্পে দাহিরের একান্ত বাহিনীর মোকাবেলা করছিল। সুজা হাবশী দাহিরের একান্ত বাহিনীকে এড়িয়ে রাজার হাতির কাছাকাছি পৌছে গেল কিন্তু রাজার হাতির কাছাকাছি হলে তার ঘোড়া ভড়কে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে ছুটল। সুজা আবার ঘোরপথে ঘোড়াকে রাজার হাতির কাছে নিয়ে এলে ঘোড়া হাতির কাছাকাছি যেতেই আবার ঘুরে দৌড় দিল।

    এসময় দাহিরের বিশেষ বাহিনীকে মুসলিম যোদ্ধারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে আর রাজার হাতির প্রতি বিশেষ নজর দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সুজা হাবশীর মাথায় পাগড়ী ছিল। ছুটন্ত অবস্থায়ই সে অগ্রসর হয়ে মাথার পাগড়ী খুলে তার ঘোড়ার চোখ দুটো বেঁধে ফেলল। এবার আর ঘোড়ার পক্ষে কিছু দেখা সম্ভব ছিল না। ফলে সুজা ইচ্ছামতো ঘোড়াকে ডানে-বামে সামনে পিছনে তাড়িয়ে নিতে পারছিল। এবার সুজা হাবশী পিছন দিক থেকে তার ঘোড়াকে রাজার হাতির কাছে নিয়ে গেল এবং তরবারীর প্রচণ্ড আঘাতে হাতির শুঁড় কেটে ফেলল। হাতির সূঁড় সম্পূর্ণ কাটা সম্ভব না হলেও মারাত্মক জখম হলো। আঘাত করেই সুজা হাবশী হাতির কাছ থেকে দূরে সরে গেল এবং পুনর্বার আঘাত করার জন্য ঘোড়াকে ঘুরাতে লাগল। এমন সময় দাহির ঘুর্ণিয়মান দুধারী তীর সোজা হাবশীর দিকে ছুড়ে মারল। তীরটি গিয়ে পড়ল সুজাহাবশীর গলায়, ধারালো তীরে সুজার গলা কেটে গিয়ে মাথা একদিকে হেলে পড়তেই সে ঘোড়া থেকে লুটিয়ে পড়ল। সেই সাথে তেজস্বী এই আরব যোদ্ধা তার সংকল্প পূর্ণ করে শাহাদাত বরণ করল।

    হঠাৎ রণাঙ্গনের পরিস্থিতি বদলে গেল। রাজা দাহিরের চিল্কারে তার সৈন্যরা মুসলিম সেনাদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানল। রাজা দাহির এপর্যন্তই তার দুটি ইউনিটকে রিজার্ভ রেখেছিল। এবার রিজার্ভ সৈন্যদেরও আঘাতের

    নির্দেশ দিলো। বস্তুত মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের পরিবেশ বদলে গেল। বিশাল বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে আরব সৈন্যদের মধ্যে বিপর্যয় দেখা দিল। চতুর্মুখী আক্রমণ সামাল দিতে গিয়ে মুসলিম সৈন্যদের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ল। আরব সৈন্যদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদ ডেকে আনল জঙ্গি হাতিগুলো। তাছাড়া দাহিরের দুধারী তীরও মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করল। বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলিম সৈন্যরা তাদের কমান্ডার ও সেনাপতিদের কথাও অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলো।

    এমতাবস্থায় প্রধান সেনাপতি বিন কাসিম উচ্চ আওয়াজে চিৎকার দিয়ে বললেন, ইসলামের সৈনিকরা। তোমাদের প্রধান সেনাপতি বিন কাসিম এখনো জীবিত। আমি তোমাদের সাথেই আছি, তোমাদের সাথেই যুদ্ধ করছি। খবরদার! কেউ বেঈমানদের পিঠ প্রদর্শন করো না। বেঈমানরা। বাঁচার জন্য লড়াই করে। ওরা মৃত্যুকে ভয় পায়, তোমরা ভয়কে মন থেকে তাড়িয়ে দাও। ঐতিহাসিক মাসুমী লিখেছেন, রাজা দেশাইয়ের ছেলে মুকু এততক্ষণ রণাঙ্গনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। সে পাঁচ শতাধিক সহযোদ্ধাকে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের যখন এই অবস্থা তখন মুকু চোখের সামনে নিজের পরিণতি ভেবে সিদ্ধান্ত নিল। এই যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় হলে রাজা দাহিরের হাতে অপমানজনক মৃত্যু বরণ করতে হবে। অতএব দাহিরের অত্যাচার ও মৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে মুসলমানদের বিজয়ের কোন বিকল্প নেই। কাল বিলম্ব না করে মুকু তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে দাহিরের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল।

    মুকুকে পড়তে দেখে বিন কাসিমের মনে সাহস সঞ্চারিত হলো। কারণ তার সামনে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুসলিম কমান্ডারদের নাম ধরে ধরে ডাকতে শুরু করলেন। হে আরব যোদ্ধারা! তোমরা পুনর্বার জেগে ওঠো, কোথায় আছে আমার মাদানী, মুহাম্মদ বিন মুসআব? নাবাতা বিন হানযালা? কোথায় গেলে ওয়ারিস বিন আইউব, মুহাম্মদ বিন যিয়াদ, তামীম বিন যায়েদ? তোমরা কোথায়? কোথায় গেলে বন্ধুরা? তোমরা তো ইসলামের রক্ষক! হারমানা তোমাদের জন্যে বেমানান। বুকে সাহস সঞ্চার করো? দলবেধে শত্রুদের আঘাত করো, আল্লাহ তোমাদের মদদ করবেন। সবাই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনো, চূড়ান্ত আঘাত হানো। আল্লাহর কসম তোমাদের পালানোর জায়গা নেই।

    বিন কাসিমের এই চিৎকারে মুসলিম সৈন্যরা সম্বিত ফিরে পেল। কমান্ডার ও সেনাপতিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সৈন্যদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে একসাথে জড়ো করল এবং কিছুটা পিছিয়ে এলো। মুসলমানদের কোথাও থেকে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বিন কাসিমের সহযোদ্ধারা যখন পিছিয়ে এসে পুনর্বার আঘাত করল তাতে মুকু তার পাঁচ’শ যোদ্ধা নিয়ে তাদের সাথে শরীক হলো। এবার প্রচণ্ড ও চূড়ান্ত আঘাত হানল আরব বাহিনী।

    চূড়ান্ত লড়াইয়ে জেতার জন্য বিন কাসিম দুটি হাতিয়ার ব্যবহার করলেন। সাধারণত মুখোমুখি সংঘর্ষে এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হতো না। বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন, ছোট ছোট মিনজানিক থেকে শত্রুদের হাতিগুলোর ওপর পাথর নিক্ষেপ করে। এদের হাওদাগুলো গুড়িয়ে দাও।

    পিছন থেকে একদল সৈন্য ছোট মিনজানিকগুলো এগিয়ে এনে পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরাই চিৎকার করতে শুরু করল পাথর নিক্ষেপ বন্ধ কর। কারণ নিক্ষিপ্ত পাথরে মুসলিম সৈন্যরাও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। যেহেতু লড়াই ছিল প্রচণ্ড এজন্য হাতিগুলো ছিল ধাবমানও অস্থির। এমতাবস্থায় লক্ষ্যভেদ করা ছিল মুশকিল। বিন কাসিম সাথে সাথেই তার এই ভুল বুঝতে পেরে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করে দিলেন।

    কিন্তু এই পাথর নিক্ষেপের ইতিবাচক ফল হলো, পাথর নিক্ষিপ্ত হতে দেখেই হিন্দু সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করল। কারণ তারা জানত এই পাথর তাদের শত শত বছর ধরে অজেয় দুর্গ ও পূজণীয় মন্দির ডাভেল ধ্বংস করে দিয়েছে। যেখানেই মুসলমানরা পাথর ছুড়েছে সেখানে হিন্দুরা টিকতে পারেনি।

    আরবদের মরণপণ আক্রমণে বেশকিছু হাতি মারাত্মকভাবে জখমী হয়ে বিকটু আওয়াজে চিৎকার করে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করল। এসব হাতির পক্ষে তখন আপনপর পার্থক্য করার ক্ষমতা ছিলনা। এমতাবস্থায় সবগুলো হাতিকে বেকার করে দেয়ার জন্য বিন কাসিম এগুলোর ওপর অগ্নিতীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। আরব তীরন্দাজরা বিপুল উৎসাহে শত্রুপক্ষের হাতিকে লক্ষ্য করে অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। কয়েকটি তীর ছুড়ার পর একটি হাতির হাওদায় আগুন ধরে গেল। আগুন থেকে বাঁচার জন্য ওপরে দাঁড়ানো তীরন্দাজ বর্শাধারী ও মাহুতরা হাতির ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ল। আরব সৈন্যরা আহত হাতিগুলোকে তরবারী ও

    বর্শা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল। তারা কোন হাতিকে বাগে আনার কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ আরবদের দৃষ্টিতে লড়াইয়ে হাতি কোন কার্যকর বাহন বলে মনে হতো না।

    এ পর্যায়ে হিন্দু বাহিনী জীবন নিয়ে পালানোর জন্যে আত্মরক্ষামূলক লড়াই করছিল। তারা চেষ্টা করছিল কোন মতে পশ্চাদ্ধাবন করে যুদ্ধের ইতি টানতে। কিন্তু হিন্দুদের পশ্চাদাবন আত্মহুতিতে পরিণত হলো। পরিস্থিতি পরিণতির দিকে যেতে দেখে রাজা দাহির তার মাহুতকে বলল, আমার হাতিটিকে মূল রণাঙ্গনের ভিতরে নিয়ে যাও। এপর্যায়ে রাজা দাহির নিজে জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ে লিপ্ত হলো। বিদ্যুৎগতিতে সে ডানে-বামে তার বিশেষ তীর বর্ষণ করত শুরু করল, সেই সাথে যেখানে বর্শা বল্লমের প্রয়োজন বোধ করছিল তাই ব্যবহার করছিল। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা দাহির তখন বেপরোয়া। মেশিনের মতো কাজ করছিল তার দেহ। চাকার মতো চতুর্দিকে ঘুরছিল সে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো তীর বর্শা নিক্ষেপে লিপ্ত ছিল রাজার দু’হাত। তার হাওদায় দাঁড়ানো দুই সুন্দরী তরুণী পানপাত্রে রাজাকে শরাব দিচ্ছিল কিন্তু অতি সন্তরণশীল হাতির ঝাকুনী সামলাতে না পেরে তরুণী দু’জন পানপাত্র নিয়েই একে অন্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পরছিল। রাজা দাহিরের তখন এদের অবস্থা তাকিয়ে দেখার ফুরসত ছিল না।

    একপর্যায়ে বিন কাসিমের তীরন্দাজরা রাজার হাতি লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। কারণ তখন দৃশ্যত রাজা একাই আক্রমণাত্মক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক অগ্নিতীর দাহিরের হাওদায় আগুন ধরিয়ে দিল। রাজার হাতির হাওদা ছিল দামী রেশমী কাপড়ে আবৃত। তার হাতির দেহ ছিল হাটু পর্যন্ত রেশমী কাপড়ে ঢাকা। মুহূর্তের মধ্যে হাতির সারা গায়ের রেশমী কাপড়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আগুন থেকে বাঁচার জন্য মাহুত লাফিয়ে মাটিতে পড়ল। আর তরুণী দু’টি আর্তচিৎকার শুরু করে দিল। কারণ ওদের কাপড়েও আগুন ধরে গেছে। নির্বাক দাহির যেন নিজেকে জ্বালিয়ে দিতেই প্রস্তুত। সে কাল বিলম্ব না করে দুই তরুণীকে ধরে মাটিতে ছুড়ে মারল। দুই মুসলিম যোদ্ধা দুই তরুণীকে ধরে মুসলিম শিবিরের নিরাপত্তা জোনে পৌছে দিল। ওখানকার সেবিকা মহিলা ওদের ধরে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল।

    রাজার হাতির হাওদা তখন পুরোমাত্রায় জ্বলে উঠেছে। আগুন থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য হাতি অস্থির হয়ে উঠল। পাশেই ছিল একটা ঝিলের মতো জলাশয়। জ্বলন্ত হাতি রাজাকে পিঠে নিয়েই দৌড়ে নেমে গেল ঝিলে। অগ্নিদগ্ধ হাতি পা ভাঁজ করে পানিতে শরীর ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করল আর কাঁটা শুঁড় দিয়ে সারা গায়ে পানি ছিটিয়ে দিতে লাগল।

    পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন ডুবে গেছে। রাজা দাহির অবস্থা বেগতিক দেখে হাতির ওপর থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাতরে ঝিলের তীরে পৌছাল। রাজার হাতিকে অনুসরণ করে কয়েক আরব যোদ্ধা ঝিলের তীরে পৌছে গেল। রাজা তীরে উঠতেই তাকে ঘিরে ফেলল আরব যোদ্ধারা। দাহির তরবারী বের করে একাই কয়েক জনের সাথে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হলো। মরণ ত্যাগী রাজা নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয় প্রতিশোধ স্পৃহায় একজনকে ধরাশায়ী করেই নিজের জীবন দিতে চেষ্টা করল কিন্তু আরবযোদ্ধারা তাকে আর সেই সুযোগ দিলো না। কিছুক্ষণ রাজাকে খেলিয়ে এক পর্যায়ে এক যোদ্ধা পিছন দিক থেকে সজোরে রাজার ঘাড়ে আঘাত হানল, কেটে গেল দাহিরের গর্দান। অমিত তেজস্বী এই আরবযোদ্ধার নাম ছিল কাসিম বিন ছালাবা। বনী তাঈ’ গোত্রর লোক ছিল ছালাবা।

    দশমীর আলোকিত চাঁদনী রাত। কিন্তু গোটা রণাঙ্গন ছিল ধুলায় অন্ধকার। সারা দিনের তুমুল যুদ্ধের কারণে গোটা এলাকা ধূলায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। একশ হাত দূরের মানুষকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। শেষপর্যায়ে মারাত্মকভাবে আরব বাহিনীর কাছে পর্যদস্ত হয়ে পড়েছিল রাজার বাহিনী। আর কাটা পড়েছিল কলাগাছের মতো। যেসব হিন্দু সৈন্য প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিল এরা রাওয়া দুর্গে আশ্রয় নেয়ার জন্যে ওদিকে পালাতে শুরু করল। অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে বিন কাসিম তার কয়েকজন কমান্ডার ও সিপাহীদের নির্দেশ দিলেন, নিজ নিজ ইউনিট নিয়ে তোমরাও রাওয়া দুর্গে ঢুকে পড়। নয়তো পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা দুর্গবন্দি হয়ে শক্তি সঞ্চয় করলে আমাদেরকে আরেকটি লড়াই করতে হবে।

    নির্দেশ পেয়ে বিন কাসিমের সৈন্যদের কয়েকটি ইউনিট উর্ধশ্বাসে ঘোড়া হাঁকিয়ে রাওয়া দুর্গে ঢুকে পড়ল। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের প্রবেশের সুবিধার

    জন্য দুর্গের প্রধান ফটক খোলা ছিল। তাতে আরব যোদ্ধাদের আর প্রবেশে বেগ পেতে হলো না। তাছাড়া রাজার পরাজয়ের কারণে কে আরব আর কে সিন্ধি এ খবর নেয়ার মতো কোন কর্তৃপক্ষ দুর্গফটকে ছিল না। আরব যোদ্ধারা দুর্গে প্রবেশ করেই দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল।

    সকাল হতেই বিন কাসিম একদল সৈন্য নিয়ে রাওয়া দুর্গে প্রবেশ করলেন। তখনও তিনি রাজার মৃত্যুর খবর জানতেন না। তিনি দুর্গে প্রবেশ করেই নির্দেশ দিলেন, রাজা দাহির কোথায় আছে? তার কি পরিণতি হয়েছে? এ খবর দ্রুত সংগ্রহ কর। গোয়েন্দা প্রধান হিসাবে স্বাভাবিক ভাবেই এ তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব শা’বান ছাকাফীর কাঁধে বর্তায়। বিন কাসিমের নির্দেশের আগেই তিনি জেনে নিয়েছিলেন রাতেই ঝিলের পাড়ে আরবদের হাতে নিহত হয়েছে দাহির।

    সকালবেলায় যখন সৈন্যরা রাজার খোঁজে ঝিলের পাড়ে উপস্থিত হলো, তখন কোথাও রাজার মরদেহ খুঁজে পেল না। ব্যাপক খোজ খবর নেয়ার পর কেবল একজন জানালো, রাতের বেলায় প্রধান পুরোহিতকে এদিকে আসতে দেখা গেছে।

    সাথে সাথে শা’বান ছাকাফী প্রধান পুরোহিতকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন, রাতের অন্ধকারে যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় তুমি ঝিলের পাড়ে কেন গিয়েছিলে?

    আপনাদের মহানুভবতার বহু কাহিনী আমি শুনেছি। আমি আপনাদের কাছে সত্য প্রকাশ করে দেবো কিন্তু বিনিময়ে আমার স্ত্রী সন্তানও জীবনের নিরাপত্তা চাই আমি।

    ‘তোমার আবেদন মঞ্জুর করা হলো’ বললেন ছাকাফী। কিন্তু বলো, কি ছিল সেখানে? মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছিল, মহারাজা ঝিলের পাড়ে নিহত হয়েছেন, বলল পুরোহিত। হিন্দু সৈন্যরা আমার কাছে জানতে চাইলে রাজার মরদেহ কি ভাবে সৎকার করা হবে? আপনি হয়তো জানেন, আমরা মৃত্যুর পর মরদেহ জ্বালিয়ে দেই।

    তিনি তো আর সাধারণ কোন লোক ছিলেন না। সাধারণ কোন প্রজার মতো তো আর তার মরদেহ সতকার করা যায় না। কিন্তু তখনো আশেপাশে আপনার সৈন্যরা বিদ্যমান ছিল। এমতাবস্থায় আমি তাদের বললাম, রাজার

    মরদেহ কাদায় পুঁতে ফেলো। মুসলমানরা এখান থেকে চলে গেলে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদায় মহারাজের মরদেহ সতকার করতে হবে।…. এখন আসুন, দেখতে চাইলে আপনাদেরকে মহারাজের মরদেহ দেখিয়ে দিই। পুরোহিতের লাশ গুম করে ফেলা এবং তথ্য উদঘাটনের ব্যাপারটি বিন কাসিমকে অবহিত করলেন শাবান ছাকাফী। বিন কাসিম নিজেই চিহ্নিত শত্রুর মরদেহ দেখার জন্য অকুস্থলে হাজির হলেন এবং সৈনিকদেরকে কাদা থেকে রাজার মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দিলেন।

    রাজা দাহিরের চেহারা আঘাতে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া মাথাও কেটে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে সহজে রাজাকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। রাজার একান্ত দুই সেবিকা তরুণীকে অকুস্থলে হাজির করলে তারা রাজার মরদেহ শনাক্ত ও নিশ্চিত করল।

    ‘রাজার গলা কেটে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ওর ছিন্ন মাথা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠানো হবে।

    বিন কাসিমের নির্দেশে দেহ থেকে রাজা দাহিরের মস্তক ছিন্ন করে ফেলা হলো। দাহিরের পুত্র জয়সেনা কোথায়? পুরোহিতেকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। মুসলমানদের প্রবল আক্রমণ শুরু হতেই রণাঙ্গন ত্যাগ করেছিল সে, বলল পুরোহিত। সে হয়তো এখন ব্রাহ্মণাবাদ পৌছে গেছে। পরাজিত পিতার ছিন্ন মস্তক বিজয়ী বিন কাসিম যখন হাজ্জাজের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থা করলেন, নিহত রাজার পুত্র জয়সেনা তখন ব্রাহ্মণবাদ পৌছে বিন কাসিমের অগ্রাভিযান প্রতিরোধের চেষ্টায় লিপ্ত হলো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous ArticleThe Book of Dragons – Edith Nesbit
    Next Article সিংহশাবক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    Related Articles

    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    পীর ও পুলিশ – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    প্রেম যুদ্ধ – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    প্রেম যুদ্ধ – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    কাল নাগিনী – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    সিংহশাবক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

    July 16, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.