Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরো এক ডজন – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প273 Mins Read0

    সদানন্দের খুদে জগৎ

    আজ আমার মনটা বেশ খুশি-খুশি, তাই ভাবছি এইবেলা তোমাদের সব ব্যাপারটা বলে ফেলি। আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে। তোমরা তো আর এদের মতো নও। এরা বিশ্বাস করে না। এরা ভাবে আমার সব কথাই বুঝি মিথ্যে আর বানানো। আমি তাই আর এদের সঙ্গে কথাই বলি না।

    এখন দুপুর, তাই এরা কেউ আমার ঘরে নেই। বিকেল হলেই আসবে। এখন আছি কেবল আমি আর আমার বন্ধু লালবাহাদুর। লালবাহাদুর সিং! উঃ—কাল কী ভাবনাটাই ভাবিয়েছিল ও আমাকে। ও যে আবার ফিরে আসবে তা ভাবতেই পারিনি। ওর ভীষণ বুদ্ধি, তাই ও পালিয়ে বেঁচেছে। আর কেউ হলে এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেত।

    এই দেখো, বন্ধুর নামটা বলে দিলাম, আর আমার নিজের নামটাই বলা হল না!

    আমার নাম শ্রীসদানন্দ চক্রবর্তী। শুনলেই দাড়িওয়ালা বুড়ো বলে মনে হয় না? আসলে আমার বয়স কিন্তু তেরো। নাম যদি বুড়োটে হয় তা সে আমি কী করব? আমি তো আর নিজের নাম নিজে দিইনি, দিয়েছিলেন আমার ঠাকুমা।

    অবিশ্যি উনি যদি আগে থেকে টের পেতেন যে নামটার জন্য আমার খুব মুশকিল হবে, তা হলে নিশ্চয়ই অন্য নাম দিতেন। উনি তো আর জানতেন না যে, সবাই খালি আমার পিছনে লাগবে আর বলবে, ‘তোর নাম না সদানন্দ? তবে তুই অমন গোমড়া ভূত কেন রে? মুখে হাসি বুঝি তোর কুষ্ঠীতে নেই?’

    সত্যি, এদের যদি একটুও বুদ্ধি থাকে। খালি খ্যাঁক খ্যাঁক করে খ্যাঁকশেয়ালের মতো হাসলেই বুঝি আনন্দ বোঝায়? সবরকম আনন্দে কি আর হাসা যায়, না হাসা উচিত?

    যেমন ধরো, তুমি হয়তো কিছু না-ভেবে মাটিতে একটা কাঠি পুঁতেছ, আর হঠাৎ দেখলে একটা ফড়িং খালি খালি উড়ে উড়ে এসেই কাঠির ডগায় বসছে—এটা তো ভীষণ মজার ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে তুমি সেটা দেখে যদি হো হো করে হাসো, তা হলে তো লোকে পাগল বলবে! যেমন আমার এক পাগলা দাদু ছিলেন। আমি অবিশ্যি তাঁকে দেখিনি, কিন্তু বাবার কাছে শুনেছি তিনি নাকি কারণ-টারণ না থাকলেও হো হো করে হাসতেন। এমনকী শেষে যখন পাগলামি খুব বাড়ার দরুন বাবা, ছোটকাকা, অবিনাশকাকা, এরা সব মিলে তাঁকে শেকল দিয়ে বাঁধছিল, তখনও নাকি তাঁর হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড়।

    আসল কথা কী জানো? আমি যেসব জিনিসে মজা পাই, সেসব জিনিস হয়তো বেশির ভাগ লোকের চোখেই পড়ে না। আমার বিছানায় শুয়ে শুয়েই তো কত মজার জিনিস দেখি আমি। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে শিমুলের বিচি ঘরে উড়ে আসে। তাতে লম্বা রোঁয়া থাকে, আর সেটা এদিক-ওদিক শূন্যে ভেসে বেড়ায়। সে ভারী মজা। একবার হয়তো তোমার মুখের কাছে নেমে এল, আর তুমি ফুঁ দিতেই হুশ করে চলে গেল কড়িকাঠের কাছে।

    আর জানলার মাথায় যদি একটা কাক এসে বসে, তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তো ঠিক যেন মনে হয় সার্কাসের সং। আমি তো কাক এসে বসলেই নড়াচড়া বন্ধ করে কাঠ হয়ে পড়ে থাকি, আর আড়চোখ দিয়ে কাক বাবাজির তামাশা দেখি।

    অবিশ্যি আমায় যদি জিজ্ঞেস করো যে সবচেয়ে বেশি মজা কীসে পাই তা হলে আমি বলব—পিঁপড়ে। এখন অবিশ্যি শুধু মজা বললে ভুল হবে, কারণ এখন—না, থাক। আগেই যদি আশ্চর্য ব্যাপারগুলো বলে দিই তা হলে সব মাটি হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং শুরু থেকেই বলি।

    আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে আমার একবার খুব জ্বর হয়েছিল। সেটা যে কিছু নতুন জিনিস, তা নয়। জ্বর আমার প্রায়ই হত। সর্দি-জ্বর। মা বলতেন সকাল-সন্ধে মাঠে ঘাটে ভিজে মাটি আর ভিজে ঘাসে বসে থাকার ফল।

    অন্যবারের মতো এবারও জ্বরের প্রথম দিকটা বেশ ভাল লাগছিল। কেমন একটা শীত-শীত, গা মড়ামড়ি, কুঁড়েমির ভাব। তা ছাড়া ইস্কুল কামাইয়ের মজা তো আছেই। বিছানায় শুয়ে জানলার বাইরে মাদার গাছটায় একটা কাঠবিড়ালির খেলা দেখছিলাম, এমন সময় মা এসে একটা খুব তেতো ওষুধ খেতে দিলেন। আমি লক্ষ্মী ছেলের মতো ওষুধটা খেয়ে, ঢকঢক করে গেলাস থেকে খানিকটা জল খেয়ে বাকি জলটা কুলকুচি করে জানলা দিয়ে ফেলে দিলাম। মা খুশি হয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন।

    তারপর চাদরটা ভাল করে টেনে মুড়ি দিয়ে পাশবালিশটা জড়িয়ে আরাম করে শুতে যাব, এমন সময় একটা জিনিস চোখে পড়ল।

    দেখলাম কুলকুচির খানিকটা জল জানলার উপর পড়েছে, আর সেই জলে একটা ছোট্ট কালো পিঁপড়ে ভীষণ হাবুডুবু খাচ্ছে।

    ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত লাগল যে, আমি আরো ভাল করে দেখবার জন্য আমার চোখ দুটো পিঁপড়ের একদম কাছে নিয়ে গেলাম।

    দেখতে দেখতে হঠাৎ কীরকম জানি মনে হল যে, পিঁপড়েটা আর পিঁপড়ে নয়, সেটা মানুষ। না, শুধু মানুষ নয়, সেটা যেন ঝন্টুর জামাইবাবু, মাছ ধরতে গিয়ে কাদায় পিছলে পুকুরে পড়ে গেছেন, আর ভাল সাঁতার জানেন না বলে খাবি খাচ্ছেন আর হাত-পা ছুড়ছেন। মনে পড়ল ঝন্টুর জামাইবাবুকে বাঁচিয়েছিল ঝন্টুর বড়দা আর ওদের চাকর নরহরি।

    যেই মনে পড়া, অমনই ইচ্ছে হল আমিও পিঁপড়েটাকে বাঁচাই।

    জ্বর নিয়ে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের ঘরে ছুটলাম। সেখানে বাবার রাইটিং প্যাড থেকে খানিকটা ব্লটিং পেপার ছিঁড়ে নিয়ে একদৌড়ে ঘরে ফিরে এসে একলাফে খাটে উঠে ব্লটিং পেপারের টুকরোটা জলে ঠেকিয়ে দিলাম। ঠেকাতেই চোঁ করে সব জলটুকু কাগজে উঠে এল।

    আর পিঁপড়েটা হঠাৎ বেঁচে গিয়ে কেমন জানি থতমত খেয়ে দু’-একবার এদিক-ওদিক ঘুরে সোজা নর্দমার ভিতর চলে গেল।

    সেদিন আর পিঁপড়ে আসেনি।

    পরের দিন জ্বরটা বাড়ল। দুপুরের দিকে মা কাজটাজ সেরে ঘরে এসে বললেন, ‘ড্যাবড্যাব করে জানলার দিকে চেয়ে আছিস কেন? এত জ্বর—ঘুম আসুক বা না আসুক, একটু চোখ বুজে চুপ করে পড়ে থাক না।’

    মাকে খুশি করার জন্য চোখ বুজলাম, কিন্তু মা বেরিয়ে যেতেই আবার চোখ খুলে নর্দমার দিকে দেখতে লাগলাম।

    বিকেলের দিকে সূর্যি যখন প্রায় মাদার গাছটার পিছনে চলে এসেছে, তখন দেখি একটা পিঁপড়ে নর্দমার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে।

    হঠাৎ সেটা সুড়ুত করে বাইরে এসে জানলায় পায়চারি আরম্ভ করে দিল। এটা সেই কালকের নাকানি-চোবানি খাওয়া পিঁপড়েটা। আমি বন্ধুর কাজ করেছিলাম, সেটা মনে রেখে সাহস করে আবার আমার কাছে এসেছে।

    আমার আগে থেকেই ফন্দি আঁটা ছিল। ভাঁড়ারঘর থেকে লুকিয়ে এক চিমটে চিনি এনে কাগজে মুড়ে আমার বালিশের পাশে রেখে দিয়েছিলাম। তার থেকে একটা বেশ বড় দানা বার করে জানলার উপরে রাখলাম।

    পিঁপড়েটা হঠাৎ থমকে থেমে গেল। তারপর আস্তে আস্তে দানাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে সেটাকে বার কয়েক এদিক থেকে ওদিক গুঁতিয়ে দেখল। তারপর হঠাৎ কী জানি ভেবে বোঁ করে ঘুরে নর্দমার ভিতর চলে গেল।

    আমি ভাবলাম, বা রে বা, এমন সুন্দর খাবার জিনিসটা দিলাম, আর পিঁপড়েভায়া সেটা ফেলেটেলে উধাও? তা হলে আসবারই কী দরকার ছিল?

    কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তারবাবু এলেন। এসে আমার নাড়ি দেখলেন, জিভ দেখলেন, আর বুকে পিঠে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে দেখলেন। দেখেটেখে বললেন যে তেতো, ওষুধটা আরো দু’বার খেতে হবে, আর খেলে নাকি দু’দিনের মধ্যেই জ্বর ছেড়ে যাবে।

    আমার তো শুনে মনই খারাপ হয়ে গেল। জ্বর-ছাড়া মানেই ইস্কুল, আর ইস্কুল মানেই দুপুরটা মাটি। দুপুরবেলাই যে যত পিঁপড়ে আসে আমার জানলা দিয়ে।

    যাই হোক, ডাক্তারবাবু ঘর থেকে বেরোনোমাত্র আবার জানলার দিকে চাইতেই আমার মন আবার ভাল হয়ে গেল।

    এবার একটা নয়, একেবারে সারবাঁধা পিঁপড়ের দল বেরিয়ে আসছে নর্দমা দিয়ে। নিশ্চয়ই সামনের পিঁপড়েটা আমার চেনা পিঁপড়ে, আর নিশ্চয়ই ও-ই গিয়ে চিনির খবরটা দিয়ে অন্য পিঁপড়েগুলোকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

    একটুক্ষণ চেয়ে থাকতেই পিঁপড়ের বুদ্ধির নমুনাটা নিজের চোখেই দেখলাম। পিঁপড়েগুলো সবাই একজোটে চিনির দানাটাকে ঠেলতে ঠেলতে নর্দমার দিকে নিয়ে চলল। সে যে কী মজার ব্যাপার তা না দেখলে বোঝা যায় না। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আমি যদি পিঁপড়ে হতাম তা হলে নিশ্চয়ই শুনতাম ওরা বলছে—‘মারো জোয়ান, হেঁইও! আউর ভি থোড়া, হেঁইও! চলে ইঞ্জিন, হেঁইও!’

    জ্বর ছাড়ার পর প্রথম কয়েক দিন ইস্কুলে খুব খারাপ লাগত। ক্লাসে বসে খালি খালি আমার জানলার কথা মনে হত। না-জানি কত রকম পিঁপড়ে সেখানে আসছে আর যাচ্ছে। অবিশ্যি আমি আসার আগে রোজই দু’-তিনটে চিনির দানা জানলায় রেখে আসতাম, আর বিকেলে ফিরে গিয়ে দেখতাম সেগুলো আর নেই।

    ক্লাসে আমি বেশিরভাগ দিন বসতাম মাঝখানের একটি বেঞ্চিতে। আমার পাশে বসত শীতল। একদিন পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছে, আর গিয়ে দেখি শীতলের পাশে ফণী বসে আছে। আমি আর কী করি, পিছনের দিকে দেয়ালের সামনে একটা খালি জায়গা ছিল, সেখানেই বসলাম।

    টিফিনের আগের ক্লাসটা ছিল ইতিহাসের। হারাধনবাবু তাঁর সরু গলায় হ্যানিবলের বীরত্বের কথা বলছিলেন। হ্যানিবল নাকি কার্থেজ থেকে সৈন্য নিয়ে পুরো আল্পস পাহাড়টা ডিঙিয়ে ইতালি আক্রমণ করেছিলেন।

    শুনতে শুনতে হঠাৎ কীরকম জানি মনে হল যে, হ্যানিবলের সৈন্য এই ঘরের মধ্যেই রয়েছে আর আমার খুব কাছ দিয়েই চলেছে।

    এদিক-ওদিক চাইতেই আমার পিছনের দেয়ালে চোখ পড়ল। দেখলাম একটা বিরাট লম্বা পিঁপড়ের লাইন দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে। ঠিক সৈন্যের মতো সারি সারি অসংখ্য কালো কালো খুদে খুদে পিঁপড়ে, একটানা একভাবে চলেছে তো চলেইছে।

    নীচের দিকে চেয়ে দেখি মেঝের কাছে দেয়ালে একটা ফাটল, আর সেই ফাটল দিয়ে পিঁপড়েগুলো বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।

    টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই দৌড়ে চলে গেলাম বাইরে, আমাদের ক্লাসের পিছন দিকটায়। গিয়ে সেই ফাটলটা খুঁজে বার করলাম। দেখলাম পিঁপড়েগুলো ফাটল দিয়ে বেরিয়ে ঘাসের ফাঁক দিয়ে সোজা চলেছে পেয়ারা গাছটার দিকে।

    পিঁপড়ের লাইন ধরে গিয়ে পেয়ারা গাছের গুঁড়ির কাছেই যে জিনিসটা বেরোল, সেটাকে দুর্গ ছাড়া আর কী বলব?

    স্পষ্ট দেখলাম একটা দুর্গের মতো উঁচু মাটির ঢিবি, তার তলার দিকে একটা গেট, আর সেই গেট দিয়ে সার বেঁধে ভিতরে ঢুকছে পিঁপড়ের সৈন্যদল।

    আমার ভীষণ ইচ্ছে হল দুর্গের ভিতরটা একটু দেখি।

    পকেটে আমার পেনসিলটা ছিল, তার ডগাটা দিয়ে ঢিবির উপরের মাটিটা আস্তে আস্তে একটু একটু করে সরাতে লাগলাম।

    প্রথমে কিছুই বেরোল না, কিন্তু তারপর যা দেখলাম তাতে সত্যিই আমি অবাক! দুর্গের ভিতর অসংখ্য ছোট ছোট খুপরি আর সেই খুপরির একটা থেকে আরেকটায় যাবার জন্য অসংখ্য কিলবিলে সুড়ঙ্গ। কী আশ্চর্য, কী অদ্ভুত। এই খুদে খুদে হাত-পা দিয়ে এরকম ঘর বানাল কী করে এরা? এত বৃদ্ধি হল কী করে এদের? এদেরও কি ইস্কুল আছে, মাস্টার আছে? এরাও কি লেখাপড়া শেখে, অঙ্ক কষে, ছবি আঁকে, কারিগরি শেখে? তা হলে কি মানুষের সঙ্গে এদের কোনওই তফাত নেই, খালি চেহারা ছাড়া? কই, বাঘ ভাল্লুক হাতি ঘোড়া এরা তো নিজের বাড়ি নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এমনকী ভুলোর মতো পোষা কুকুরও পারে না।

    অবিশ্যি পাখিরা বাসা করে। কিন্তু তাদের একটা বাসাতে আর ক’টা পাখি থাকতে পারে? এদের মতো দুর্গ বানাতে পারে পাখি, যাতে হাজার হাজার পাখি একসঙ্গে থাকবে?

    দুর্গের খানিকটা ভেঙে যাওয়াতে পিঁপড়েদের মধ্যে খুব গোলমাল পড়ে গিয়েছিল। আমার খুব কষ্ট হল। মনে মনে ভাবলাম, এদের যখন ক্ষতি করেছি, তখন এবার উলটে কোনও উপকার করতে হবে। তা না হলে আমাকে ওরা শত্রু বলে ভাববে, আর আমি সেটা মোটেই চাই না। আসলে তো আমি ওদের বন্ধু!

    তাই পরদিন ইস্কুল যাবার সময় মা আমাকে যে সন্দেশটা খেতে দিয়েছিলেন তার অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা একটা শালপাতায় মুড়ে প্যান্টের পকেটে নিয়ে নিলাম।

    ইস্কুলে পৌঁছে ক্লাসের ঘণ্টা পড়ার আগেই সেটা পিঁপড়ের ঢিবির পাশে রেখে এলাম। বেচারাদের নিশ্চয়ই খাবার খুঁজতে অনেকদূর যেতে হয়। আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখবে খাবারের পাহাড়। এটা কি কম উপকার হল?

    এর কিছুদিন পরেই আমাদের গরমের ছুটি হয়ে গেল, আর আমারও পিঁপড়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা বেশ ভাল জমে উঠল।

    পিঁপড়েদের দেখে দেখে তাদের বিষয় যেসব আশ্চর্য জিনিস জানতে পারছিলাম সেগুলো মাঝে মাঝে বড়দের বলতাম। কিন্তু ওরা কোনও গা-ই করত না। সবচেয়ে রাগ হত যখন ওরা আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিত। তাই একদিন ঠিক করলাম যে এবার থেকে আর কাউকে কিছু বলব না। যা করব নিজেই করব, আর যা জানব নিজেই জানব।

    একদিন একটা ব্যাপার হল।

    তখন দুপুরবেলা। আমি ঝন্টুদের বাড়ির পাঁচিলের গায়ে একটা লাল পিঁপড়ের ঢিবির পাশে বসে পিঁপড়েদের খেলা দেখছি। অনেকে বলবে লাল পিঁপড়ের ঢিবির পাশে তো বেশিক্ষণ বসা যায় না, কারণ পিঁপড়ে কামড়াবে যে। এটা ঠিকই যে, আগে লাল পিঁপড়ের কামড় আমি খেয়েছি, কিন্তু কিছুদিন থেকে দেখছি ওরা আর আমাকে কামড়ায় না। তাই বেশ নিশ্চিন্ত মনে বসে পিঁপড়ে দেখছিলাম, এমন সময় হঠাৎ দেখি ছিকু আসছে।

    ছিকুর কথা আগে বলিনি। ওর ভাল নাম শ্রীকুমার। আমাদের ক্লাসেই পড়ে, কিন্তু আমাদের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক বড়, কারণ ওর গোঁফদাড়ি বেরিয়ে গেছে। ছিকু খালি সর্দারি করে, তাই ওকে কেউ ভালবাসে না। আমিও না। কিন্তু তাই বলে আমি কখনও ওর সঙ্গে লাগতে যাই না, কারণ জানি যে ওর গায়ে খুব জোর।

    ছিকু আমায় দেখতে পেয়ে বলল, ‘এই ক্যাবলা, ওখানে ওত পেতে বসে কী হচ্ছে?’

    আমি ছিকুর কথায় কান দিইনি, কিন্তু ও দেখলাম আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

    আমি পিঁপড়েগুলোর দিকে দেখতে লাগলাম। ছিকু আমার কাছে এসে আবার বলল, ‘কী, হচ্ছে কী? হাবভাব দেখে সুবিধের লাগছে না তো?’

    আমি আর লুকোবার চেষ্টা না করে সত্যি কথাটাই বলে দিলাম।

    ছিকু শুনে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘পিঁপড়ে দেখছিস মানে? ওর মধ্যে আবার দেখবার কী আছে? আর পিঁপড়ে কি তোর নিজের বাড়িতে নেই যে, এখানে আসতে হবে?’

    আমার ভারী রাগ হল। আমি যাই করি না কেন, তোর তাতে কীরে বাপু? সবটাতে নাক গলানো আর সর্দারি!

    আমি বললাম, ‘আমার দেখতে ভাল লাগে তাই দেখছি। পিঁপড়ের ব্যাপার তুমি বুঝবে না। তোমার নিজের যা ভাল লাগে তাই করো না গিয়ে। এখানে জ্বালাতে এলে কেন?’

    ছিকু আমার কথা শুনে বেড়ালের মতো ফ্যাঁশ করে উঠে বলল, ‘ও, দেখতে ভাল লাগে? পিঁপড়ে দেখতে ভাল লাগে? তবে দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ!’—এই বলতে বলতে আমি কিছু করবার আগেই ছিকু তিন লাথিতে পিঁপড়ের ঢিবিটা একেবারে থ্যাবড়া করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। আর সেইসঙ্গে বোধহয় কম করে পাঁচশো পিঁপড়ে থেঁতলে-ভেঁতলে মরে-টরে একাকার হয়ে গেল।

    লাথি মেরেই ছিকু হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় আমার মাথার মধ্যে হঠাৎ কী জানি একটা হয়ে গেল।

    আমি একলাফে ছিকুর পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি ধরে তার মাথাটা দুমদুম করে চার-পাঁচবার ঝন্টুদের পাঁচিলে ঠুকে দিলাম।

    তারপর ছিকুকে ছেড়ে দিতে সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে চলে গেল।

    আমি নিজে যখন বাড়ি ফিরলাম, তার আগেই ছিকু এসে নালিশ করে গেছে।

    কিন্তু আশ্চর্য, মা আমাকে প্রথমটা মারেনওনি, বকেনওনি। আসলে বোধহয় মা বিশ্বাসই করেননি, কারণ আমি তো এর আগে কারুর গায়ে কখনও হাত তুলিনি। তা ছাড়া মা জানতেন যে আমি ছিকুকে ভয় পাই।

    কিন্তু মা যখন আমায় ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলেন তখন আমি মিথ্যে কথা বলতে পারলাম না।

    মা তো শুনে অবাক! বললেন, ‘বলিস কী! তুই সত্যিই ছিকুর মাথা ফাটিয়ে দিইচিস?’

    আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দিয়েছি। শুধু ছিকু কেন? যে পিঁপড়ের বাসা ভাঙবে, তারই মাথা ফাটিয়ে দেব।’

    এটা শুনে মা সত্যিই ভীষণ রেগে আমায় অনেকগুলো কিলচড় মেরে ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখে দিলেন।

    সেদিন শনিবার ছিল। বাবা তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে ফিরলেন। ফিরে মা-র কাছে সব শুনেটুনে আমার ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা-চাবি দিয়ে দিলেন।

    আমার কিন্তু মার-টার খাওয়ার জন্য পিঠে একটু ব্যথা করলেও, মনে কোনও দুঃখ ছিল না। আমার কেবল দুঃখ হচ্ছিল ওই পিঁপড়েগুলোর জন্য। সেবার পরিমলদিদের সাহেবগঞ্জের কাছে দুটো রেলগাড়িতে ভীষণ কলিশন লেগে শুনেছিলাম প্রায় তিনশো লোক মরে গিয়েছিল। আর আজ ছিকুর তিন লাথিতেই এত পিঁপড়ে মরে গেল?

    কী অন্যায়, কী অন্যায়, কী অন্যায়!…

    বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম, আর গাটা শীত-শীত করতে লাগত। আমি চাদরটা টেনে মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

    তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

    হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

    খুব সরু, মিহি একটা শব্দ—ভারী সুন্দর, কতকটা গানের মতো, তালে তালে উঠছে আর নামছে।

    আমি এদিক-ওদিক কান পেতেও বুঝতে পারলাম না শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে। খুব দূরে কোথাও গান-টান হচ্ছে বোধহয়। কিন্তু এরকম গান তো এর আগে কখনও শুনিনি!

    এই দেখো, গান শুনতে শুনতে কখন যে এর মধ্যে নর্দমা দিয়ে ইনি এসে হাজির হয়েছেন তা তো টেরই পাইনি!

    এবার ঠিক চিনলাম এ আমার সেই চেনা পিঁপড়ে—যাকে জল থেকে বাঁচিয়েছিলাম। আমার দিকে চেয়ে সামনের দুটো পা মাথায় ঠেকিয়ে নমস্কার করছে! কী নাম দেওয়া যায় এর? কালী? কেষ্ট? কালাচাঁদ? ভেবে দেখতে হবে। বন্ধু অথচ নাম নেই, সে কী করে হয়!

    আমি আমার হাতের তেলোটা চিত করে জানলার উপর রাখলাম। পিঁপড়েটা সামনের পা দুটো মাথা থেকে নামিয়ে আস্তে আস্তে আমার হাতের দিকে এগিয়ে এল। তারপর আমার কড়ে আঙুল বেয়ে হাতের উপর উঠে আমার তেলোর হিজিবিজি মাপের নদীর মতো লাইনগুলোর উপর চলেফিরে বেড়াতে লাগল।

    এমন সময় দজায় হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হওয়াতে আমি চমকে উঠলাম, আর পিঁপড়েটাও হুড়মুড়িয়ে হাত থেকে নেমে নর্দমার ভিতর চলে গেল।

    তারপর মা দরজার চাবি খুলে ঘরে এসে আমায় একবাটি দুধ খেতে দিলেন, আর আমার চোখ দেখে আর কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন যে জ্বর এসেছে।

    পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু এলেন। মা বললেন, ‘সদু সারারাত ছটফট করেছে আর “কালী” “কালী” বলেছে।’ মা বোধহয় ভাবলেন যে আমি ঠাকুরের নাম করছিলাম! মা তো আর আসল ব্যাপারটা জানতেন না।

    ডাক্তারবাবু যখন আমার পিঠে স্টেথোস্কোপ লাগিয়েছেন তখন আমি আবার কালকের মতো মিহি গলায় গান শুনতে পেলাম। এবার কালকের চেয়ে জোরে, আর সুরটা বোধহয় একটু অন্যরকম। আর ঠিক মনে হল যেন জানলার দিক থেকেই গানটা আসছে। কিন্তু ডাক্তারবাবু চুপ করে থাকতে বলেছিলেন, তাই ঘুরে দেখতে পারলাম না।

    পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তারবাবু উঠে পড়লেন, আর আমিও আড়চোখে জানলার দিকে চেয়ে দেখি—ও বাবা, আজ আবার নতুন বন্ধু—ডেঁয়ো পিঁপড়ে! আর এ-ও দেখি নমস্কার করছে! সব পিঁপড়েই কি তা হলে আমার বন্ধু?

    আর গানটা কি তা হলে ওই পিঁপড়েটাই করছে নাকি?

    কিন্তু মা তো গানের কথা কিছুই বলছেন না! তা হলে কি উনি শুনতে পাচ্ছেন না?

    আমি জিজ্ঞেস করব ভেবে মা-র দিকে ফিরতেই দেখি উনি চোখ বড় বড় করে জানলার দিকে চেয়ে আছেন। তারপর হঠাৎ টেবিল থেকে আমার অঙ্কের খাতাটা টেনে নিয়ে আমার উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে খাতাটা দিয়ে এক চাপড় মেরে পিঁপড়েটাকে মেরে ফেললেন।

    সঙ্গে সঙ্গে গানটাও থেমে গেল।

    মা মুখে বললেন, ‘বাব্বাঃ—কী উপদ্রবই হয়েছে পিঁপড়ের। বালিশ বেয়ে উঠে কানের মধ্যে ঢুকে কামড় দিলেই হবে চিত্তির।’

    ডাক্তারবাবু একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে যাবার পর আমি খুন-হওয়া পিঁপড়েটার দিকে চাইলাম। আর এমন সুন্দর গানটা গাইতে গাইতে সে মরে গেল? এ যেন ঠিক আমার সেই ইন্দ্রনাথ দাদুর মতো। উনিও খুব ভাল গান গাইতেন। অবিশ্যি আমরা বেশি বুঝতাম না, তবে বড়রা বলত যে খুব ভাল ওস্তাদি গান। উনিও ঠিক এইভাবেই একদিন তানপুরা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ মরে গেলেন। তাঁকে যখন শ্মশানঘাটে নিয়ে যায় তখন শহর থেকে আনা কীর্তনের দল হরিনাম গাইতে গাইতে তাঁর সঙ্গে গিয়েছিল। আমি দেখেছিলাম, আর আমার এখনও মনে আছে, যদিও আমি তখন খুব ছোট।

    আর আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। ইঞ্জেকশন নিয়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম যে একটা বিরাট পিঁপড়ের দল মরা পিঁপড়েটাকে ঠিক ইন্দ্ৰনাথ দাদুর মতো করে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে। দশ-বারোটা পিঁপড়ে তাকে কাঁধে নিয়েছে আর বাকি পিঁপড়েগুলো পিছনে সারিবেঁধে ঠিক কীর্তনের মতো গান গাইতে গাইতে চলেছে।

    বিকেলে মা কপালে হাত দিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল।

    জানলার দিকে চেয়ে দেখলাম যে, মরা পিঁপড়েটা আর সেখানে নেই।

    সেবার জ্বরটা সহজে ছাড়ছিল না। ছাড়বে কী করে, দোষ তো এদেরই। বাড়ির সব লোক যে পিঁপড়ে মারতে আরম্ভ করেছিল। সারাদিন যদি ওরকম পিঁপড়ের চিৎকার শুনতে হয় তা হলে তো মনখারাপ হয়ে জ্বর বাড়বেই।

    আবার আরেকটা মুশকিল। এরা যখন ওদিকে ভাঁড়ারঘরে কিংবা উঠোনে পিঁপড়ে মারত, আমার জানলায় তখন অন্য পিঁপড়ের দল এসে ভীষণ কান্নাকাটি করত। বেশ বুঝতাম যে এরা চাইছে তাদের হয়ে আমি একটু কিছু করি—হয় পিঁপড়ে মারা বন্ধ করি, না-হয় যারা মারছে তাদের শাসন করি—কিন্তু আমার যে অসুখ, তাই আমার গায়ে তেমন জোর ছিল না। আর থাকলেও বড়দের কি আর ছোটরা শাসন করতে পারে?

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন একটা ব্যবস্থা করতেই হল।

    সেটা ঠিক কোনদিন তা আমার মনে নেই, খালি মনে আছে যে সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, আর ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেলাম ফটিকের মা চেঁচিয়ে বলছে যে তার কানের ভিতর নাকি রাত্রিবেলা একটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে ঢুকে কামড়ে দিয়েছে।

    এটা শুনে অবিশ্যি আমার খুব হাসি পেয়েছিল, কিন্তু তার পরেই ঝাঁটাপেটার আওয়াজ আর চিৎকার শুনে বুঝলাম যে পিঁপড়ে মারা আরম্ভ হয়ে গেছে।

    তারপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। হঠাৎ মিহি গলায় শুনতে পেলাম কারা যেন বলছে—‘বাঁচাও! বাঁচাও! আমাদের বাঁচাও!’ জানলার দিকে চেয়ে দেখি পিঁপড়ের দল এসে গেছে আর ভীষণ ব্যস্তভাবে জানলার উপর ঘোরাফেরা করছে।

    পিঁপড়ের মুখে এই কথা শুনতে পেয়ে আমি আর থাকতে পারলাম না। অসুখবিসুখ ভুলে গিয়ে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বারান্দায় বেরিয়ে গেলাম। প্রথমটা বুঝতে পারলাম না কী করব, তারপর হাতের কাছে একটা কলসি দেখে সেটাকে আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাম।

    তারপর আর যা-কিছু ভাঙবার মতন ছিল সব ভাঙতে আরম্ভ করলাম।

    ফন্দিটা ভালই এঁটেছিলাম, কারণ আমার কাণ্ড দেখে পিঁপড়ে মারা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মা, বাবা, ছোটপিসিমা, সাবিদি যে যে-ঘরে ছিল সব হাঁ হাঁ করে বেরিয়ে এসে আমায় জাপটে ধরে কোলপাঁজা করে তুলে এনে খাটের উপর ফেলে ঘরের দরজা আবার তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিল।

    আমি মনে মনে খুব হাসলাম, আর আমার জানলার পিঁপড়েগুলো আনন্দে নাচতে নাচতে আর ‘শাবাশ’ ‘শাবাশ’ বলতে বলতে বাড়ি ফিরে গেল।

    এর পরে আমি আর খুব বেশিদিন বাড়িতে ছিলাম না, কারণ একদিন ডাক্তারবাবু এসে দেখে-টেখে বললেন যে বাড়িতে আমার চিকিৎসার সুবিধা হবে না, তাই আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।

    আমি এখন যেখানে আছি সেটা একটা হাসপাতালের ঘর। চারদিন হল আমি এখানে এসেছি।

    প্রথমদিন আমার ঘরটা খুবই খারাপ লেগেছিল, কারণ এত পরিষ্কার ঘর যে দেখলেই মনে হয় এখানে পিঁপড়ে থাকতেই পারে না। নতুন ঘর কি না, তা ফাটল-টাটল কিছু নেই। একটা বড় আলমারিও নেই যার তলায় বা পিছনে পিঁপড়ে থাকবে। নর্দমা একটা আছে বটে, কিন্তু সেটাও ভীষণ পরিষ্কার। তবে হ্যাঁ, ঘরে একটা জানলা আছে আর জানলার ঠিক বাইরেই একটা আমগাছের মাথা, আর তার একটা ডাল জানলার বেশ কাছে এসে পড়েছে।

    বুঝলাম, পিঁপড়ে যদি থাকে তো ওই ডালেই থাকবে।

    কিন্তু প্রথমদিন জানলার কাছে যাওয়াই হল না। কী করে যাব? সারাদিন ধরেই হয় ডাক্তার, না-হয় নার্স, না-হয় বাড়ির কোনও লোক আমার ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করছে।

    দ্বিতীয়দিনেও একই ব্যাপার।

    মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একটা ওষুধের বোতল তো ছুড়ে ভেঙেই ফেললাম, আর তাতে নতুন ডাক্তারবাবু বেশ চটে গেলেন। এ ডাক্তারবাবু যে বেশি ভাল লোক না, সে তাঁর গোঁফ আর চশমাটা দেখেই বুঝতে পারা যায়।

    তিনদিনের দিন একটা ব্যাপার হল।

    তখন ঘরে আর কেউ ছিল না, খালি একজন নার্স কোনার চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। আমি চুপচাপ শুয়ে কী যে করব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না। এমন সময় একটা ধমকের আওয়াজ পেয়ে নার্সের দিকে চেয়ে দেখি ওর হাত থেকে বইটা কোলে পড়ে গেছে, আর ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

    আমি তাই না দেখে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে জানলার দিকে গেলাম।

    তারপর জানলার নীচের দিকের খড়খড়িতে পা দিয়ে উঠে খানিকটা উঁচু হয়ে শরীরটা যতখানি পারি জানলা দিয়ে বার করে হাত বাড়িয়ে আমগাছের ডালটা ধরে টানতে লাগলাম। এমন সময় আমার ডান পা-টা খড়খড়ি থেকে হড়কে গিয়ে একটা খট করে আওয়াজ হল, আর সেই আওয়াজ শুনেই নার্সটার ঘুম ভেঙে গেল।

    আর যায় কোথা!

    একটা বিকট চিৎকার দিয়ে নার্সটা ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে বিছানায় নিয়ে ফেলল। আর সেইসঙ্গে আরো অন্য লোকও এসে পড়ল, তাই আমিও আর কিচ্ছু করতে পারলাম না।

    ডাক্তারবাবু চটপট আমাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন।

    আমি ওদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম যে ওরা ভেবেছিল আমি বুঝি জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম। কী বোকা ওরা! অত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়লে তো মানুষ হাত-পা ভেঙে মরেই যাবে।

    ডাক্তারবাবু চলে গেলে পর আমার ঘুম পেতে লাগল, আর বাড়ির জানলাটার কথা মনে করে ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। কবে যে আবার বাড়ি ফিরে যাব কে জানে!

    ভাবতে ভাবতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি এমন সময় মিহি গলায় শুনলাম, ‘সিপাহি হাজির হুজুর! সিপাহি হাজির!’

    চোখ খুলে দেখি আমার খাটের পাশের টেবিলের সাদা চাদরে, ওষুধের বোতলটার ঠিক পাশে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো লাল কাঠপিঁপড়ে!

    নিশ্চয়ই গাছ থেকেই আমার হাতে উঠে এসেছিল ওরা—আর আমি টেরই পাইনি!

    আমি বললাম, ‘সেপাই?’

    জবাব এল, ‘হাঁ, হুজুর।’

    বললাম, ‘কী নাম তোমাদের?’

    একজন বলল, লালবাহাদুর সিং। আর একজন বলল, লালচাঁদ পাঁড়ে।

    আমি তো মহা খুশি। কিন্তু তাও ওদের দু’জনকে সাবধান করে দিলাম যে ওরা যেন বাইরের লোক এলে একটু লুকিয়ে-টুকিয়ে থাকে, তা না হলে মারা পড়তে পারে। লালচাঁদ আর লালবাহাদুর মস্ত সেলাম ঠুকে বলল, ‘বহুত আচ্ছা, হুজুর!’

    তারপর ওরা দু’জনে মিলে একটা চমৎকার গান আরম্ভ করে দিল। আর আমিও সেই গানটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    এবার তাড়াতাড়ি কালকের ঘটনাটা বলে নিই, কারণ ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল; ডাক্তারবাবুর আসার সময় হয়ে গেছে।

    কাল হয়েছে কী, বিকেলের দিকে শুয়ে শুয়ে লালবাহাদুর আর লালচাঁদের কুস্তি দেখছি—আমি বিছানায়, আর ওরা টেবিলে। দুপুরবেলা আমার ঘুমোবার কথা, কিন্তু কাল ওষুধ খেয়ে আর ইঞ্জেকশন নিয়েও ঘুম আসেনি। কিংবা এও বলতে পারি যে, ঘুম আমিই ইচ্ছে করেই আনিনি। দুপুরবেলা ঘুমোলে আর আমার পিঁপড়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করব কখন!

    কুস্তি খুব জোর চলছিল, কে যে জিতবে তা বোঝা যাচ্ছিল না, এমন সময় হঠাৎ খটখট করে জুতোর আওয়াজ পেলাম। এই রে, ডাক্তারবাবু আসছেন!

    আমি বন্ধুদের দিকে ইশারা করতেই লালবাহাদুর চট করে টেবিলের নীচে চলে গেল।

    কিন্তু লালচাঁদ বেচারা কুস্তি করতে করতে চিৎ হয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়ছিল। তাই সে অত তাড়াতাড়ি পালাতে পারল না। আর তার জন্য একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল।

    ডাক্তারবাবু এসে টেবিলের উপর লালচাঁদকে দেখে ইংরেজিতে কী একটা রাগি কথা বলেই হাত দিয়ে এক ঝাপটা দিয়ে ওকে টেবিল থেকে মাটিতে ফেলে দিলেন।

    লালচাঁদ যে ভীষণ জখম হল সে আমি ওর চিৎকার শুনেই বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি আর কী করব? ডাক্তারবাবু ততক্ষণে নাড়ি দেখবেন বলে আমার হাত ধরে নিয়েছেন। একবার হাত ঠেলে উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাই দেখে আবার নার্স অন্যদিক থেকে এসে আমায় চেপে ধরল।

    পরীক্ষা শেষ হলে ডাক্তারবাবু রোজকার মতো আজও গোমড়া মুখ করে গোঁফের পাশটা চুলকোতে চুলকোতে দরজার দিকে ফিরেছেন, এমন সময় হঠাৎ কী কারণে যেন তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে মুখ দিয়ে তিন-চার রকম বাংলা-ইংরেজি মেশানো বিশ্রী শব্দ করলেন—ঈঃ! উ! আউচ!’

    তারপর সে এক কাণ্ড! স্টেথোস্কোপ ছিটকে গেল, চশমা পড়ে ভেঙে গেল, কোট খুলতে গিয়ে বোতাম ছিঁড়ল, টাই খুলতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে বিষম লাগল, শেষকালে শার্ট খোলায় গেঞ্জির ফুটো অবধি বেরিয়ে পড়ল—তবু ডাক্তারবাবুর লাফানি আর চেঁচানি থামল না। আমি অবাক!

    নার্স বলল, ‘কী হয়েছে, স্যার?’

    ডাক্তার লাফাতে লাফাতে বললেন, ‘অ্যান্ট! রেড অ্যান্ট! আস্তিন বেয়ে—উঃ! উঃ!’

    হুঁ হুঁ বাবা। আমি কি আর বুঝতে পারিনি? এখন বোঝো ঠেলা! আস্তিন বেয়ে উঠছে লালবাহাদুর সিং—বন্ধুর হয়ে প্রতিশোধ নিতে!

    তখন যদি এরা আমায় দেখত, তা হলে আর বলত না যে, সদানন্দ হাসতে জানে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরো বারো – সত্যজিৎ রায়
    Next Article জয় বাবা ফেলুনাথ – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }