Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প207 Mins Read0
    ⤷

    ১. মারদানা ম্যাডাম

    আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু

    উৎসর্গ

    কয়েক বছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হলের ছাত্রীরা কারাটে শিখতে শুরু করেছিল। আমি তখন বলেছিলাম তাদের ভেতর যে প্রথম ব্ল্যাক বেল্ট হতে পারবে তাকে আমি একটা বই উৎসর্গ করব। (বই উৎসর্গ করানোর দ্বিতীয় আরো একটা পদ্ধতি ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে বলা যাবে না!) আমার ঘোষণার কারণেই কি না জানি না, একজন নয় দুইজন নয়-নয় নয়জন ছাত্রী একসাথে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে।

    কাজেই আমি আমার কথা রেখে এই বইটি এই নয়জন ব্ল্যাক বেল্টধারী ছাত্রীদের উৎসর্গ করছি। তারা হচ্ছে :

    ঝুমুর দেব, ফারহানা ফেরদৌস শিউলী, আমিনা সুলতানা, জয়তি দত্ত, লাকী বেগম, শারমিন সুলতানা কণা, উম্মে মরিয়ম মৌসুমী, সাবিহা তাসনিম জেসি, সাথী রানী শর্মা

    .

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু ধারাবাহিকভাবে কিশোর আলোতে প্রকাশিত হচ্ছিল, লেখা শেষ হবার পর সেটি এই নামে একটা বই হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। আমি লেখা শেষ করলেও কিনোর আলোর পাঠকেরা সেটা কিছুতেই মেনে নিতে রাজি হয়নি, বলা যায় তাদের প্রবল চাপের কারণে আমাকে আবার লিখতে শুরু করতে হয়েছিল-সকল চাপকে উপেক্ষা করা যায়, ভালোবাসার চাপ উপেক্ষা করা কঠিন।

    আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু নাম দিয়ে এই বইটি প্রকাশ করার সময় বইয়ের শেষে নতুন একটি অংশ লিখে সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে-যেটুকু লিখেছিলাম সেটা পড়ে কেমন জানি অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল।

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    ১ আগস্ট, ২০১৪

    .

    ০১.

    টুনিদের স্কুলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ম্যাডামের নাম মারদানা ম্যাডাম। মহিলাদের গোঁফ থাকার কথা না কিন্তু টুনিদের স্কুলে বলাবলি করা হয় যে মারদানা ম্যাডামের গোঁফ আছে। কথাটা শুনে অনেকেই ভুরু কুঁচকাতে পারে, একজন মানুষের গোঁফ আছে কি নেই সেটা নিয়ে বলাবলি করার কী আছে? তার মুখের দিকে তাকালেই তো সেটা দেখা যাবে। কিন্তু আসলে তার মুখের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যায় না, তার কারণ মারদানা ম্যাডামের গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং তার গোঁফ যদি আসলেই থেকে থাকে সেটার রংও কুচকুচে কালো, তাই সেটা আলাদা করে দেখা যায় না। খুব কাছে গেলে অবশ্যই সেটা দেখা যাবে, কিন্তু কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে যে মারদানা ম্যাডামের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করবে তার গোঁফ আছে কি নেই! যে সমস্ত ছেলেমেয়েদেরকে মারদানা ম্যাডাম কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছেন (ঠিক আক্ষরিক অর্থে না, ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়ার অর্থে) তারা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে যে মারদানা ম্যাডামের নাকের নিচে ঝাঁটার মতো কালো গোঁফ। তারা আরো বলেছে যে তার চোখের মাঝে মোটা হয়ে থাকা লাল লাল রক্তনালি–সেগুলো নাকি দপদপ করে কাঁপে এবং তার মুখে নাকি মাংসাশি প্রাণীর মতো গন্ধ। যাই হোক এর সবগুলো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব না, কাজেই কেউ কখনো এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করেনি। টুনিদের ক্লাশ মনিটর বলেছে মানুষ যখন বুড়ো হয় তখন নাকি সবার আগে গোঁফ পাকতে শুরু করে, কাজেই যদি সত্যি সত্যি মারদানা ম্যাডামের গোঁফ থেকে থাকে তাহলে আর কয়েক বছরের ভেতর সেগুলো পেকে সাদা হয়ে যাবে, তখন তার কুচকুচে কালো রঙের মাঝে সাদা গোঁফ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। তখন সব বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে।

    এই যে ভয়ঙ্কর মারদানা ম্যাডাম তার থেকেও ভয়ঙ্কর স্যার হচ্ছে মতিউর স্যার। এই স্যার নিয়েও স্কুলে নানা রকম গুজব চালু আছে। যে গুজবটা সবচেয়ে বেশি চালু সেটা হচ্ছে উনিশ শ’ একাত্তর সালে মতিউর স্যার রাজাকার কমান্ডার ছিল, দেশ স্বাধীন হলে গ্রামের মানুষেরা ধরে তার কান কেটে দিয়েছে। মতিউর স্যারের ডান কানটা নাকি রাবারের তৈরি, প্রত্যেক দিন সকালে স্কুলে আসার সময় সুপার গ্লু দিয়ে কানটা নাকি লাগিয়ে নেয়। বিষয়টা পরীক্ষা করা খুব সোজা, ডান কানটা ধরে একটা হঁচকা টান দিলেই সেটা নিশ্চয়ই খুলে আসবে কিন্তু সেটা কে করবে? তবে শোনা যায় পাস করে বের হয়ে গেছে এরকম একজন ছাত্রী নাকি কিরা কেটে বলেছে যে মতিউর স্যার একবার খুব জোরে হাঁচি দিয়েছিল তখন তার ডান কানটা খুলে এসেছিল–সে সেটা নিজের চোখে দেখেছিল। সত্যি সত্যি কথাটা কে বলেছে সেটা অবশ্যি কখনোই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। মতিউর স্যারের অনেকগুলো বেত আছে, একটা শিলং থেকে আনা হয়েছে, একটা বান্দরবানের, আরেকটা নেত্রকোনার। সরকার থেকে বেত মারা নিষেধ করে দেওয়ার পর মতিউর স্যারের মনের দুঃখে প্রায় হার্ট এটাকের মতো অবস্থা হয়েছিল। মতিউর স্যার এখনো মাঝে মাঝে ক্লাশে বেতগুলো নিয়ে আসে, বাতাসে শপাং শপাং করে মারে আর ছাত্রছাত্রীদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেহেতু বেত মারতে পারে না তাই গালিগালাজ করে মনের ঝাল মেটায়। তার গালির মতো বিষাক্ত গালি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যাকে একবার স্যার গালি দেয় কমপক্ষে এক মাস তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে।

    এই যে ভয়ঙ্কর মতিউর স্যার তার থেকেও ভয়ঙ্কর হচ্ছে নার্গিস ম্যাডাম! কথাটা শুনে সবাই মনে করতে পারে নার্গিস ম্যাডাম বুঝি দেখতে মারদানা ম্যাডাম আর মতিউর স্যার থেকেও ভয়ঙ্কর। কিন্তু আসলে সেটা সত্যি নয়, নার্গিস ম্যাডাম দেখতে অসাধারণ। দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হয় সিনেমার নায়িকা, শুকনো পাতলা ছিপছিপে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চুলগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখা, সেখানে বেলী ফুলের মালা, পরনে আকাশী-নীল তাঁতের শাড়ি। কথাবার্তা শুনলে মনে হয় ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়ালের নায়িকা কথা বলছে। কিন্তু যারা তাকে চিনে তারা সবাই জানে নার্গিস ম্যাডাম হচ্ছে ভয়ঙ্কর থেকেও ভয়ঙ্কর। শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে নার্গিস ম্যাডাম যে কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রীর শরীরের সব রক্ত শুষে নিতে পারেন। একবার নাকি ক্লাশ নাইনের একজন ছাত্রীর দিকে নার্গিস ম্যাডাম তিরিশ সেকেন্ড কোনো কথা না বলে তাকিয়ে ছিলেন, সেই ছাত্রী বাসাতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে গিয়ে তাকে দুই ব্যাগ এ পজিটিভ রক্ত দিতে হয়েছিল!

    নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাশে আসেন তখন ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে ভয়ে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায়। শোনা যায়, নার্গিস ম্যাডাম যদি নিচু ক্লাশের কোনো ছেলের কিংবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই ছেলে’ কিংবা ‘এই মেয়ে’ তাহলে নাকি তাদের কাপড়ে বাথরুম হয়ে যায়।

    সেই ভয়ঙ্কর নার্গিস ম্যাডাম একদিন টুনিদের ক্লাশে এসে টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মেয়ে!”

    টুনি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। নার্গিস ম্যাডামের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস কারো নেই, তাই টুনি তার নাকের দিকে তাকিয়ে বলল, “জি ম্যাডাম।”

    সমস্ত ক্লাশ তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “সেই দিন টেলিভিশনে দেখলাম একজন বড় সন্ত্রাসীকে ধরেছে বলে পুলিশ একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভকে পুরস্কার দিচ্ছে।”

    টুনি ঢোক গিলে বলল, “জি ম্যাডাম।” গাবড়া বাবা সেজে থাকা গাল কাটা বকইর্যাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে পুলিশ থেকে ছোটাচ্চুকে একটা চেক দিয়েছিল, কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেলে সেটা দেখানো হয়েছিল, নার্গিস ম্যাডাম মনে হয় সেই অনুষ্ঠানটা দেখেছিলেন।

    নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “তোমাকে দেখলাম সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের পাশে সাজুগুজু করে দাঁড়িয়ে ছিলে।” সাজুগুজু শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটা টিটকারির ভান করলেন আর সেটা শুনে সারা ক্লাশ শিউরে উঠল। টুনি ফ্যাকাসে মুখে বলল, “জি ম্যাডাম।”

    নার্গিস ম্যাডাম তার ভ্রমরের মতো কালো চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন জানতে পারি?”

    টুনি বলল, “প্রাইভেট ডিটেকটিভ হচ্ছেন আমার ছোট চাচা।”

    “সেই জন্যে তুমি টেলিভিশন ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্যে সাজুগুজু করে তোমার ছোট চাচার লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

    সারা ক্লাশ আবার শিউরে উঠল। টুনি ভাবল একবার বলে, আসলে সে মোটেই সাজুগুজু করে ছোটাচ্চুর লেজ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল না। পুলিশের লোকেরা কীভাবে জানি খবর পেয়েছিল যে টুনি গাবড়া বাবার চুল আর দাড়ি টেনে খুলে ফেলে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, তাই তারাই ছোটাচ্চুর পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নার্গিস ম্যাডামের মুখের উপর সেই কথা বলা সম্ভব না, তাই সে কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

    নার্গিস ম্যাডাম তার ফুলের মতো ঠোঁটগুলো সাপের মতো বাঁকা করে বললেন, “শোনো মেয়ে, টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্যে অ জায়গায় কু-জায়গায় নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেবে না। যদি কোনোদিন নিজের যোগ্যতায় টেলিভিশনে তোমার চেহারা দেখাতে পারো তাহলে ক্যামেরার সামনে যাবে। না হলে যাবে না। বুঝেছ?”

    টুনি মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে।

    নার্গিস ম্যাডাম তখন পুরো ক্লাশকে লক্ষ করে বললেন, “তোমাদেরকেও বলে রাখি। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার আত্মসম্মানবোধ। তোমরা কোনোদিন শুধুমাত্র টেলিভিশনের ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্যে এই আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিবে না। যার আত্মসম্মানবোধ নাই তার কিছু নাই।” ‘কিছু নাই’ কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যে মনে হলো ক্লাশ রুমের ভেতর দিয়ে মেশিনগানের গুলি ছুটে গেল। সারা ক্লাশ আতঙ্কে শিউরে উঠল।

    ক্লাশ শেষে নার্গিস ম্যাডাম চলে যাবার পর সবাই টুনির কাছে ছুটে এলো, সবাই জিজ্ঞেস করল সে ঠিক আছে কি না। একজন বলল, “বাসায় গিয়ে লবণ পানি খাবি। তারপর শুয়ে থাকবি।” আরেকজন বলল, “গরম পানি দিয়ে গোসল করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বি।”

    দুষ্টু টাইপের একজন বলল, “টেলিভিশনের ক্যামেরায় আমিও ঢুকে যাই। বই মেলায় গিয়ে আমি সব সময় ক্যামেরাম্যানদের পিছনে পিছনে হাঁটি। যখনই দেখি কারো ইন্টারভিউ নিচ্ছে তখনই পিছনে দাঁড়িয়ে যাই। একদিন আমাকে তিনটা চ্যানেলে দেখিয়েছিল!”

    টুনি কিছু বলল না। সবাই ধরেই নিয়েছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্যে সে বুঝি জোর করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। কী লজ্জা! টুনির একবার মনে হলো সত্য কথাটা বলে দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।

    ক্লাশের ছেলেমেয়েরা চলে যাবার পর টুনির কাছে এলো তাদের ফাস্ট গার্ল মৌটুসী। মৌটুসী লেখাপড়ায় খুব ভালো, তার চেহারাও খুব ভালো, সে খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, নজরুলগীতির কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, মৌটুসী কারাতে ক্লাশে ভর্তি হয়ে রেড বেল্ট পর্যন্ত গিয়েছে, স্কুলের স্পোর্টসে সে লংজাম্পে ফার্স্ট হয়েছে, গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সে মেডেল পেয়েছে। স্কুলের শেষে সে নাচের ক্লাশে যায় নাচ শিখতে, সে সুন্দর ছবি আঁকতে পারে, গল্প লেখার কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর কম্পিটিশনের লোকেরা যে বই লিখেছে সেই বইয়ে তার গল্প ছাপা হয়েছে। এক কথায় একজন মেয়ের যা যা ভালো থাকার কথা মৌটুসীর তার সবকিছু আছে, কিন্তু তার একটা অনেক বড় সমস্যা আছে, সেটা হচ্ছে সে এক সেকেন্ডের জন্যেও ভুলতে পারে না যে সে রূপে-গুণে সবার থেকে ভালো! সে কারণে অহঙ্কারে তার মাটিতে পা পড়ে না আর তাই ক্লাশের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। মৌটুসীর তাই ক্লাশে কোনো বন্ধু নেই, সে একা একা ঘুরে বেড়ায়।

    আজকেও সে একা একা টুনির কাছে এলো। এসে বলল, “আমি যখন নজরুলগীতি কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম তখন আমাকে টেলিভিশনে দেখিয়েছিল।”

    টুনি মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী তখন বলল, “যখন আমার গল্পটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তখন পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল।”

    টুনি এবারেও মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী বলল, “আমি যখন অলিম্পিয়াডে মেডেল পাই তখন আমাদের গ্রুপ ফটো তোলে, সেই গ্রুপ ফটো সব পত্রিকায় ছাপা হয়।”

    টুনি আবার মাথা নাড়ল, এবারেও কোনো কথা বলল না। তখন মৌটুসী মনে হয় একটু রেগে গেল, রেগে গিয়ে বলল, “আমি তোমার মতো টেলিভিশনে নিজের চেহারা দেখাতে মামা-চাচাঁদের পিছনে ঘুরি না। টেলিভিশনের ক্যামেরা আমার কাছে আসে। বুঝেছ?”

    টুনি সাধারণত রাগে না কিন্তু এবারে একটু রেগে গেল, কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে সে একটু হাসার ভঙ্গি করল।

    মৌটুসী রেগে গিয়ে বলল, “তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসছ কেন?”

    টুনি বলল, “তোমাকে দেখলে, তোমার কথা শুনলে আমার আনন্দ হয়, তাই আমি হাসি!”

    মৌটুসী থতমত খেয়ে বলল, “আমাকে দেখলে আনন্দ হয়?”

    টুনি মাথা নাড়ল। মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, “কেন আনন্দ হয়?”

    টুনি বলল, “তোমার চেহারা এত সুন্দর, তোমার এত গুণ সেই জন্যে।”

    মৌটুসী এবারে হকচকিয়ে গেল, টুনি সত্যি বলছে না টিটকারি করছে সেটা সে বুঝতে পারল না, তাই হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

    টুনি একা একা চুপচাপ বসে থাকে, তার মনটা খুব খারাপ। সে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে জোর করে ঢুকে গিয়ে অনেক কিছু করেছে কথাটা সত্যি, কিন্তু সেগুলো সে করেছে তার করতে ভালো লাগে বলে। টেলিভিশনে তার চেহারা দেখাবে সেটা কখনো তার মাথাতেই আসেনি। এখন সবাই ভাবছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য সে হ্যাংলার মতো ছোট চাচার পিছনে পিছনে তার লেজ ধরে ঘুরছে। কী লজ্জা! কী অপমান! কী দুঃখ! টুনির চোখে একেবারে পানি চলে আসছিল কিন্তু সে জোর করে চোখ থেকে পানি বের হতে দিল না। মুখটা শক্ত করে বসে রইল।

    .

    বাসাতে এসেও তার মনটা খারাপ হয়ে থাকল, সে এমনিতেই কথা কম বলে, সব সময় চুপচাপ থাকে, তাই বাসার কেউ সেটা টের পেল না। পরের দিন তার স্কুলে যেতেই ইচ্ছে করছিল না, যদি স্কুলে না যায়, সবাই কিন্তু একটা সন্দেহ করে বসে থাকবে, তাই সে স্কুলে গেল। স্কুলে এসেও সে তার নিজের সিটে চুপচাপ বসে রইল। আজকেও নার্গিস ম্যাডামের ক্লাশ আছে, আজকে ক্লাশে এসে নার্গিস ম্যাডাম কিছু একটা বলে ফেলবেন কি না সেটা নিয়েও তার ভেতরে একটা অশান্তি।

    কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু অন্য রকম হয়ে গেল। ক্লাশ শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে ক্লাশের সবচেয়ে যে দুষ্ট ছেলে সে খুবই উত্তেজিতভাবে ক্লাশে ঢুকে বেঞ্চে নিজের বইয়ের ব্যাগটা রেখেই ছুটে টুনির কাছে এসে হাজির হলো। তার হাতে একটা পত্রিকা, পত্রিকাটা খুলে সে টুনিকে দেখিয়ে বলল, “টুনি! এই দ্যাখ!”

    টুনি দেখল পত্রিকায় তার বিরাট একটা ছবি, চোখে চশমা, মুখে চাপা হাসি, হাতে কয়েকটা বই ধরে রেখেছে। ছবির নিচে বড় বড় করে লেখা ‘ক্ষুদে গোয়েন্দা’। তার নিচে একটু বড় বড় করে লেখা, কেমন করে ধরা হলো গাবড়া বাবা ওরফে গাল কাটা বকইর্যাকে। তার নিচে ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা। যখন সবাই মিলে গাবড়া বাবাকে ধরে ফেলেছিল তখন মনে আছে একজন মানুষ অনেকক্ষণ টুনির সাথে কথা বলেছিল, তার অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। সেই মানুষটা নিশ্চয়ই সাংবাদিক, সেই নিশ্চয় খবরটা পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছে। টুনির খুব ইচ্ছে করছিল পত্রিকায় কী লিখেছে পড়ে দেখে কিন্তু সবার সামনে সেটা করতে তার একটু লজ্জা লাগল। তাই সে পত্রিকাটা এক নজর দেখে চুপচাপ বসে রইল।

    সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা বলল, “টুনি! তুই কোনোদিন আমাদেরকে বলিসনি তুই এত বড় ডিটেকটিভ!”

    টুনি বলল, “আমি মোটেই বড় ডিটেকটিভ না।”

    দুষ্টু ছেলেটা চিৎকার করে বলল, “বড় ডিটেকটিভ না হলে পত্রিকায় কোনোদিন এত বড় করে ছবি ছাপা হয়? মন্ত্রীদের ছবিও এত বড় করে ছাপা হয় না।”

    দুষ্টু ছেলেটার চিৎকার শুনে অন্যেরাও তখন চলে এলো, তারাও পত্রিকার ছবিটা আর নিচের ক্যাপশানটা পড়ে চিৎকার করতে লাগল। আর সেই চিৎকার শুনে অন্যেরা এসে পত্রিকাটা দেখে আরো জোরে চিৎকার করতে লাগল, পত্রিকাটা ধরে কাড়াকাড়ি করতে লাগল। সবাই মিলে টুনিকে ঘিরে লাফাতে লাগল, পত্রিকায় কী লিখেছে সেটা একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে, জোরে জোরে পড়তে লাগল। সবাই এলেও মৌটুসী এলো না, সে দূরে তার সিটে বসে রইল, টুনিকে ঘিরে যে এত হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি সেটা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। টুনির বুঝতে বাকি রইল না যে হিংসায় মৌটুসীর বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। সে যখন কোনো মেডেল পায় তখন সে ক্লাশে এসে সেটা সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করে, কেউ কোনোদিন সেটা ভালো করে দেখারও চেষ্টা করে না। কিন্তু আজ টুনিকে নিয়ে সবার কত আনন্দ, কত উত্তেজনা–তার হিংসা তো হতেই পারে।

    ঠিক তখন ক্লাশের ঘণ্টা পড়ে গেল বলে টুনিকে ঘিরে উত্তেজনাটা আপাতত থেমে যেতে হলো।

    নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাশে ঢুকলেন তখন অন্যান্য প্রত্যেক দিনের মতো ক্লাশ একেবারে কবরের মতো নীরব হয়ে গেল। দেখে বোঝারও উপায় নেই ক্লাশে কোনো জীবিত মানুষ আছে, মনে হয় সবাই বুঝি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।

    নার্গিস ম্যাডাম পড়াতে শুরু করলেন। ম্যাডাম বাংলা কবিতা পড়ান, এত সুন্দর কবিতা কিন্তু ছেলেমেয়েদের সেই কবিতা উপভোগ করার কোনো সুযোগ নেই, তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে কখন কিছু একটা ভুল হয়ে যায় আর চোখের দৃষ্টি দিয়ে ম্যাডাম তাদের রক্ত শুষে নেন।

    নার্গিস ম্যাডাম কবিতাটা পড়ে শোনাতে শোনাতে হঠাৎ একটা কাগজের খচমচ শব্দ শুনে তাকালেন এবং দেখতে পেলেন তৃতীয় বেঞ্চের মাঝামাঝি একটা ছাত্র একটা খবরের কাগজ খুব সাবধানে পিছনের বেঞ্চে পাচার করার চেষ্টা করছে। খবরের কাগজটিতে টুনির ছবি ছাপা হয়েছে এবং যে এখনো দেখেনি তার আর অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না বলে নার্গিস ম্যাডামের ক্লাশেই এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের কাজটি করে ফেলার চেষ্টা করেছিল।

    নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “এই ছেলে তুমি কী করছ?”

    নার্গিস ম্যাডাম মোটেও গলা উঁচিয়ে বলেননি, কিন্তু তবুও মনে হলো ক্লাশে বুঝি একটা বজ্রপাত হয়েছে। যে দুজন অপরাধী তাদেরকে নার্গিস ম্যাডাম দাঁড়াতে বলেননি কিন্তু দুজনই কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে গেল এবং দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তাদের দুই পাশে যারা বসেছিল তারা যে কোনো মুহূর্তে বাথরুম হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে দুই পাশে একটু সরে গেল।

    নার্গিস ম্যাডাম খুবই শান্ত গলায় বললেন, “তোমাদের হাতে ওটা কী?”

    একজন দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, “খ-খ-খ-” কিন্তু সে পুরো খবরের কাগজ বলে শেষ করতে পারল না। নার্গিস ম্যাডাম বরফের মতো শীতল আর চায়নিজ কুড়ালের মতো ধারালো চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং দুইজনকে দেখে মনে হলো তারা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে শুরু করেছে।

    নার্গিস ম্যাডাম বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কী আছে খবরের কাগজে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর যে ক্লাশে বসেই পড়তে হবে?”

    ছেলে দুটির একজন মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। অন্যজন বলল, “টু-টু-টু” কিন্তু সেও কথা শেষ করতে পারল না। ক্লাশের সবাই বুঝে গেল সে টুনির নাম বলার চেষ্টা করছে। টেলিভিশনে টুনিকে দেখেই নার্গিস ম্যাডাম খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, খবরের কাগজে তার ছবি দেখে ম্যাডাম কী করবেন সেটা চিন্তা করে সবাই শিউরে উঠতে লাগল। কেউ লক্ষ করল না বলে দেখতে পেল না শুধুমাত্র মৌটুসীর মুখে একটা আনন্দের ছায়া পড়ল।

    নার্গিস ম্যাডাম হাত বাড়িয়ে বললেন, “খবরের কাগজটা দেখি।”

    তৃতীয় বেঞ্চের ছেলেটা খবরের কাগজটা দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেকে দিল, দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেটা দিল প্রথম বেঞ্চের একজন মেয়েকে, সে সেটা দিল নার্গিস ম্যাডামকে। নার্গিস ম্যাডাম কাগজটা হাতে নিয়ে খুললেন, সাথে সাথে তার চোখ পড়ল টুনির বড় ছবিটাতে। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, মাথাটা একটু কাত করলেন (ভয়ে সারা ক্লাশের সবাই নিজেদের অজান্তে মাথা কাত করে ফেলল) তারপর পুরোটা পড়লেন। পড়ে মাথাটা সোজা করলেন। (সারা ক্লাশ মাথা সোজা করল) তারপর খবরের কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখলেন।

    ক্লাশের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, সবার বুক ভয়ে আতঙ্কে ধুকপুক করছে। যে দু’জন ছেলে দাঁড়িয়েছিল তারা তাদের হাঁটুতে আর জোর পাচ্ছে না, মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে।

    নার্গিস ম্যাডাম ডাকলেন, “টুনি।”

    টুনি উঠে দাঁড়াল।

    নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি গতকালকে বলেছিলাম তোমার চাচার লেজ ধরে তোমার টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে যাওয়া উচিত হয়নি। মনে আছে?”

    টুনি শুকনো গলায় বলল, “মনে আছে ম্যাডাম।”

    “এখন দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার চাচার লেজ ধরে ক্যামেরার সামনে যাওনি, তুমি নিজের যোগ্যতাতেই গিয়েছ।”

    টুনি একটু হকচকিয়ে গিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকাল। আলোচনাটা কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এখন কি সে আগের থেকেও বড় অপরাধ করে ফেলেছে? কাজেই টুনি কিছু না বলে নার্গিস ম্যাডামের নাকের দিকে তাকিয়ে রইল।

    নার্গিস ম্যাডাম শীতল গলায় বললেন, “এই পত্রিকার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার স্টচাই তোমার লেজ ধরে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে গিয়েছেন। কথাটা কি ঠিক?”

    টুনি গলাটা পরিষ্কার করে বলল, “আসলে আমরা কেউ টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে যাই নাই। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট একটা অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে গিয়েছিলাম। অনেক সাংবাদিক ছিল। তার মাঝে টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল।”

    ক্লাশের ছেলেমেয়েরা হতবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে, টুনি সরাসরি নার্গিস ম্যাডামের সাথে কথা বলছে। টুনিকে তখন তাদের মনে হতে থাকে বিশাল সাহসী একটা বাঘের বাচ্চা! কিংবা কে জানে বাচ্চা নয়–আস্ত বাঘ!

    “তুমি গতকাল আমাকে বিষয়টা বলো নাই কেন?” নার্গিস ম্যাডামের গলায় কিছু একটা ছিল যেটা শুনে সারা ক্লাশ কেমন যেন শিউরে উঠল।

    টুনি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করল। নার্গিস ম্যাডাম তার গলাটা আরেকটু উঁচু করে এবারে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন বলো নাই?”

    ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। টুনি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “ভয়ে।”

    নার্গিস ম্যাডামকে দেখে মনে হলো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, “কীসের ভয়ে?”

    টুনি বলল, “আপনার ভয়ে।”

    নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “আমার ভয়ে?”

    টুনি কোনো কথা না বলে এবারে নার্গিস ম্যাডামের স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে রইল। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমাকে তুমি ভয় পাও?”

    টুনি মুখটা একটু ওপরে তুলে বলল, “সবাই ভয় পায়।”

    “সবাই ভয় পায়?” নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে ক্লাশের দিকে তাকালেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল তিনি আশা করছেন সবাই এখন হা হা করে হেসে উঠবে তারপর মাথা নেড়ে বলবে, “না না আমরা ভয় পাই না! কেন ভয় পাব?”

    কিন্তু কেউ সেটা বলল না। সবাই তার সামনের ছেলে কিংবা মেয়ের পিছনে মাথা লুকিয়ে ফেলল। একেবারে সামনের বেঞ্চে যারা আছে তাদের লুকানোর কেউ নাই, তাই তারা যতটুকু সম্ভব মাথা নিচু করে নিজের হাতের নখ কিংবা ডেস্কের উপর রাখা বাংলা বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।

    নার্গিস ম্যাডাম কেমন যেন হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর টুনির দিকে তাকালেন, বললেন, “কী আশ্চর্য! কেন ভয় পায়?”

    টুনি নার্গিস ম্যাডামের চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে তার গলার লকেটের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “টুনি। তুমি ডিটেকটিভ, তুমিই বলো, কেন আমাকে সবাই ভয় পায়?”

    টুনি টোক গিলে বলল, “বলব?”

    “বলো।”

    টুনি আরেকবার সেঁক গিলে বলল, “ভয় করছে ম্যাডাম।”

    “ভয়ের কিছু নাই। বলো।”

    টুনি মনে মনে একবার দোয়া ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিল তারপর বলল, “আপনাকে সবাই ভয় পায় কারণ আপনি কোনোদিন হাসেন না।”

    সারা ক্লাশের মনে হলো যে তাদের উপর দিয়ে একটা টর্নেডো উড়ে গেল, সবার মনে হলো তারা সেই টর্নেডোতে উড়ে যাবে, সবকিছু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না, নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “আমি হাসি না!”

    নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, সরাসরি তাকানোর সাহস নেই বলে সবাই চোখের কোনা দিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা অবাক হয়ে দেখল নার্গিস ম্যাডামের ঠোঁটের কোনায় একটা সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দিচ্ছে। মনে হলো ম্যাডাম হাসিটা চেপে রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু চেপে রাখতে পারছেন না, ধীরে ধীরে তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সপ্তম আশ্চর্যের থেকেও বড় আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে গেল। নার্গিস ম্যাডাম হঠাৎ ফিক করে একটু হেসে ফেললেন।

    সারা ক্লাশ তখন একসাথে ফিক করে হেসে উঠল। ম্যাডাম তখন আরেকটু হাসলেন, ক্লাশের সবাই তখন আরেকটু হাসল। তারপর নার্গিস ম্যাডাম হাসতেই লাগলেন আর ক্লাশের সবাই হাসতে লাগল। টুনি শুধু অবাক হয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল, ম্যাডাম যখন হাসেন তখন হঠাৎ করে তার সেই ভয়ঙ্কর চেহারাটা আর থাকে না, দেখে মনে হয় একেবারে স্বাভাবিক মানুষ।

    নার্গিস ম্যাডাম তার হাসি থামালেন, ছেলে-মেয়েরা সাথে সাথে হাসি থামাল না, তারা আরো কিছুক্ষণ হাসল। ম্যাডাম তখন টেবিল থেকে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন, “তোমরা সবাই টুনির উপর লেখাটা পড়েছ?”

    যে ব্যাপারটা আগে কখনো ছেলেমেয়েরা কল্পনা করেনি সেটাই তারা করে ফেলল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, “পড়েছি!” অন্যেরা আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “পড়ি নাই!”

    “ঠিক আছে, সবাই যেহেতু পড়ো নাই আমি তাহলে পড়ে শোনাই।” তারপর ম্যাডাম নিজে খবরের কাগজের লেখাটা পড়ে শোনালেন। ছেলে-মেয়েরা শুনল, মাঝে মাঝে হাততালি দিল, টেবিলে থাবা দিল, এমনকি কয়েকবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। দশ মিনিট আগে তারা সেটা করতে পারবে কল্পনা পর্যন্ত করেনি।

    শুধু মৌটুসী পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল।

    .

    এর পরে স্কুলে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমে ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা তারপর স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ডিটেকটিভ টুনির কাছে তাদের সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করল। বিচিত্র তাদের সমস্যা! যেমন একজন এসে বলল :

    “আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে, আমার আব্দু-আম্মু আমাকে গল্প বই পড়তে দেয় না। কী করব?”

    টুনি সমাধান দিল, “পাঠ্য বইয়ের নিচে গল্প বই রেখে পড়ে ফেলো।”

    আরেকজন এসে বলল, “রাত্রে ঘুমাতে ভয় লাগে।”

    টুনি জিজ্ঞেস করল, “কীসের ভয়?”

    “ভূতের।”

    টুনি একটা কাগজে লিখল :

    ৬ ১ ৮

    ৭ ৫ ৩

    ২ ৯ ৪

    তারপর সেটা তাকে দিয়ে বলল, “এই কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে ঘুমাবে।”

    “এটা কী?”

    “ম্যাজিক স্কয়ার। ভূত একটা জিনিসকে খুব ভয় পায়। সেটা হচ্ছে অংক। আর অংকের মাঝে সবচেয়ে বেশি ভয় ১৫ সংখ্যাটাকে। এই কাগজে যে সংখ্যা লেখা আছে সেটা যেভাবেই যোগ করবে ১৫ হবে। ভূত এটাকে খুব ভয় পায়। বালিশের নিচে রাখলে ভূতের বাবাও আসবে না!”

    আরেকজন এসে বলল, “লেখাপড়া ভালো লাগে না।”

    টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?” “স্যার কী বলে বুঝি না।”

    “কেন?”

    “স্যার বোর্ডে কী লেখে সেইটাও দেখি না।”

    টুনি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চশমাটা খুলে তাকে দিয়ে বলল, “এটা পরে দেখো তো কেমন লাগে।”

    চশমা পরে সে অবাক হয়ে বলল, “আরে! সবকিছু স্পষ্ট–একেবারে ঝকঝক করছে।”

    টুনি বলল, “তোমার চোখ খারাপ হয়েছে। আব্দু-আম্মুকে বলে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে চশমা নাও।”

    আরেকজন এসে বলল, “সানজিদা আমার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছে ‘পাগল।”

    টুনি বলল, “তুমি তার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখ ছাগল।”

    ছাত্রছাত্রীরা শুধু নিজের সমস্যা নিয়ে আসতে লাগল তা না। নিজেদের বাসার বিভিন্ন মানুষের সমস্যা নিয়েও আসা শুরু করল। একজন এসে বলল, “ভাইয়া জানি কীরকম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়, আর নিজেকে দেখে।”

    টুনি জিজ্ঞেস করল, “চুলে জেল দেয়?”

    “হ্যাঁ।”

    “শরীরে পারফিউম?”

    “হ্যাঁ।”

    “বয়স কত? ষোল-সতেরো?”

    “হ্যাঁ।”

    টুনি বলল, “নরমাল। হরমোন কিক করেছে।”

    যে সমস্যাটা নিয়ে এসেছে সে বলল, “তার মানে কী?”

    “তার মানে এই বয়সের ছেলেরা মেয়েদের সামনে নিজেদের সুন্দর দেখানোর জন্যে সাজুগুজু করে।”

    “কেন?”

    “তুমি এখন বুঝবে না। তোমার বয়স যখন ষোল-সতেরো হবে তখন বুঝবে।“

    “তোমার বয়স কি মোল-সতেরো হয়েছে?”

    “না।”

    “তাহলে তুমি কেমন করে বুঝ?”

    টুনি ইতস্তত করে বলল, “আমি তো ডিটেকটিভ–আমার বুঝতে হয়।”

    আরেকজন এসে বলল, “আব্ব হঠাৎ মোচ কেটে ফেলেছে। এখন আব্বকে চেনা যায় না, দেখে মেয়ে মানুষের মতো লাগে।”

    টুনি জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত? চল্লিশের কাছাকাছি?”

    “হ্যাঁ?”

    “নরমাল। তোমার আব্বর মোচ পাকতে শুরু করেছে। প্রথমে একটা-দুইটা টেনে তুলে ফেলেছে, এখন আর কুলাতে পারছে না, তাই পুরোটা কামিয়ে ফেলেছে।”

    শুধু যে বাসার সমস্যা নিয়ে এলো তা-ই না, এক-দুইজন তাদের মেডিক্যাল সমস্যা নিয়ে এলো। বেশিরভাগ সমস্যা অবশ্যি কাউকে বলার মতো না। একটা-দুইটা হয়তো একটু চিন্তা-ভাবনা করে বলা যেতে পারে। যেমন একটা ছেলে অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলল। “আমি যখন হিসু করি তখন রং হয় হলুদ, ফান্টার মতো।”

    টুনি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “বেশি করে পানি খাও তাহলে রং হবে সেভেনআপের মতো। আর যদি না খাও–”

    ছেলেটা শুকনো মুখে বলল, যদি না খাই?”

    “তাহলে আস্তে আস্তে তোমার হিসুর রং হয়ে যাবে কোকের মতো।”

    ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে তখনই ছুটে বের হয়ে গেল, একটু পরেই দেখা গেল সে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে।

    .

    তবে টুনির কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ সমস্যাটা নিয়ে এলো মৌটুসী। একদিন যখন আশেপাশে কেউ নেই তখন মৌটুসী তার কাছে এসে বলল, “টুনি তুমি তো ডিটেকটিভ।”

    টুনির ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা সবাই সবাইকে তুই করে বলে, মৌটুসী ছাড়া। তার সাথে কারো ভাব নেই তাই সে সবাইকে তুমি তুমি করে বলে। টুনি মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ডিটেকটিভ এখনো হই নাই। হওয়ার চেষ্টা করছি।”

    মৌটুসী বলল, “দেখি তুমি কত বড় ডিটেকটিভ।” তারপর সে ব্যাগ থেকে একটা ভঁজ করা কাগজ বের করে টুনিকে দিয়ে বলল, “এই চিঠিটা কে লিখেছে বের করে দাও।”

    টুনি কাগজটা খুলে দেখে পুরো চিঠিটা উল্টো করে লেখা। টুনি বলল, “যে লিখেছে সে তোমার পরিচিত। তাই এভাবে লিখেছে, যেন হাতের লেখা চিনতে না পারো।”

    মৌটুসী বলল, “এটা কীভাবে পড়তে হবে জানো? একটা আয়নার সামনে ধরলে-”

    টুনি বলল, “আয়না লাগবে না। তারপর কাগজটা জানালার আলোর দিকে উল্টো করে ধরল, মোটামুটি বেশ স্পষ্টভাবে লেখাটা সোজা হয়ে দেখা গেল। চিঠিতে লেখা :

    মৌটুসী
    আমি তোমাকে খুব হিংসা করি। আমরা কেউ কিছু পারি না কিন্তু তুমি গান গাইতে পারো, ছবি আঁকতে পারো, নাচতে পারো। শুধু তাই না, তুমি লেখাপড়াতেও এত ভালো। সবচেয়ে বড় কথা তুমি দেখতে এত সুন্দর। খোদা কেন সবকিছু একজনকে দিল, আমাদের কেন কিছু দিল না?

    ইতি
    একজন হিংসুক

    টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এই চিঠিটা তোমাকে কে লিখেছে বের করার কোনো দরকার নেই।”

    “কেন?”

    “এইটা সিরিয়াস কিছু না। কেউ ঠাট্টা করেছে।”

    “ঠাট্টা?” মৌটুসী মনে হয় বেশ অবাক হলো। “ঠাট্টা কেন হবে?”

    “ঠাট্টা না হলে এগুলো লিখে না। যদি চিঠিতে তোমাকে গালাগালি করত, ভয় দেখাত তাহলে সেটা বের করতে মজা হতো। এটা খুবই পানসে চিঠি।”

    “তোমার কী মনে হয় এটা কি ক্লাশের কোনো ছেলে লিখেছে?”

    “নাহ্। ছেলে লেখে নাই।”

    “তুমি কীভাবে জানো?”

    “আমাদের ক্লাশের কোনো ছেলেরই এখনো হরমোন কিক করে নাই। কোনো মেয়ে দেখতে সুন্দর কি না সেটা তারা জানে পর্যন্ত না! তাদের কাছে ছেলে-মেয়ে সুন্দর-ভ্যাবলা সব এক। এখন তারা ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছু বুঝে না।”

    “তবুও তুমি কি বলতে পারবে এটা কে লিখেছে?”

    “পারব।”

    “কে?”

    টুনি বলল, “সেটা তোমার জানার কোনো দরকার নাই। তারপর সে মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে হাসার ভঙ্গি করল, যার অর্থ গোপন চিঠি নিয়ে আলোচনা শেষ। তাই একটু পরে মৌটুসী মন খারাপ করে চলে গেল।

    পরের দিন সকালবেলাতেই মৌটুসী আবার টুনির কাছে হাজির হলো, তার হাতে আরেকটা কাগজ। টুনিকে বলল, “এই যে আরেকটা চিঠি পেয়েছি, বলতে পারবে এটা কে লিখেছে?”

    “টুনি বলল, দেখি।”

    মৌটুসী বলল, “এই চিঠিতে অনেক গালিগালাজ।”

    “সত্যি?”

    “হ্যাঁ। এই দেখো।”

    টুনি চিঠিটা হাতে নিল, এইটাও উল্টো করে লেখা, টুনি কাগজটা উল্টো করে আলোতে ধরে রেখে পড়ল,

    মৌটুসী
    সাবধান! তোমার কারণে ক্লাশে আমাদের কত কষ্ট। স্যার-ম্যাডামের বকাবকি শুনতে হয়। তাদের গালাগালি শুনতে হয়। তুমি এখনি সাবধান হয়ে যাও তা না হলে তোমার উপরে অনেক বিপদ। আমি তোমাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিব। তুমি কী তাই চাও?

    তোমার আজরাইল

    টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফেরত দিল। মৌটুসী বলল, “কে লিখেছে বলতে পারবে?”

    টুনি জিজ্ঞেস করল, “তার আগে বলো, চিঠিটা পেলে কেমন করে? খামে করে বাসার ঠিকানায় পাঠিয়েছে?”

    “না।”

    “তাহলে?” “আমার ব্যাগের ভিতরে ছিল।”

    “ও” টুনি বলল, “তাহলে এইটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নাই। ক্লাশের কেউ তোমার সাথে মজা করছে।”

    মৌটুসী বলল, “কিন্তু আমি জানতে চাই। তুমি না এত বড় ডিটেকটিভ, পত্রিকায় তোমার ছবি ছাপা হয়, আর এইটা বের করতে পারবে না?”

    “পারব।”

    “তাহলে বের করো।”

    “আমার এই চিঠির একটা কপি দরকার।”

    “ফটোকপি?”

    “না ফটোকপি লাগবে না। আমি চিঠিটা পড়ি তুমি একটা কাগজে লিখে দাও।”

    টুনি তখন চিঠিটা পড়ল আর মৌটুসী সেটা কাগজে লিখে দিল। মৌটুসীর লেখা চিঠিটা হাতে নিয়ে টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো?”

    মৌটুসী মুখ শক্ত করে বলল, “সেটা আমি কেন তোমাকে বলব?”

    “একজন ডিটেকটিভ যখন কেস সলভ করতে যায় তখন তাকে সবকিছু বলতে হয়।”

    “আমি যদি বলে দেই তাহলে তুমি কীসের ডিটেকটিভ?”

    “তুমি যদি জানো তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?”

    “আমি দেখতে চাই তুমি কত বড় ডিটেকটিভ।”

    তাদের কথা শুনে ক্লাশের একটা ছেলে এগিয়ে এলো, জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

    টুনি বলল, “কিছু না।”

    মৌটুসী বলল, “টুনি কত বড় একজন ডিটেকটিভ সেইটা পরীক্ষা করে দেখছিলাম।”

    ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”

    “আমার কাছে কে যেন চিঠি লিখছে। টুনিকে বলছিলাম বের করতে কিন্তু টুনি সেটা বের করতে পারছে না।”

    “কী চিঠি লিখছে?”

    মৌটুসী বেশ উৎসাহ নিয়ে চিঠিটা বের করে ছেলেটাকে দিল। ছেলেটা চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, “এ তো দেখি উল্টা লেখা!”

    টুনি বলল, “কাগজটা উল্টো করে জানালার সামনে ধরো। তাহলে পড়তে পারবে।”

    ছেলেটা জানালার সামনে ধরে চিঠিটা পড়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “কী ভয়ঙ্কর!”

    কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই ক্লাশের সবাই জেনে গেল মৌটুসীর কাছে কে যেন গোপনে ভয়ঙ্কর চিঠি পাঠাচ্ছে! সবাই মৌটুসীর কাছে সেই ভয়ঙ্কর চিঠি দেখতে আসা শুরু করল। মৌটুসী মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করল। যখনই কেউ আসছে তাকেই সে খুব উৎসাহ নিয়ে চিঠিটা দেখাতে লাগল। মৌটুসী সব সময়েই সবার কাছ থেকে গুরুত্ব পেতে চায়।

    পরের দিন মৌটুসী আরেকটা চিঠি নিয়ে এলো, এই চিঠিটা আগের থেকেও লম্বা, আগের থেকেও বড়। এই চিঠিটাও কোনো একজন তার ব্যাগের ভিতরে রেখে দিয়েছে। চিঠিটা আরো ভয়ঙ্কর। এই চিঠিটাতে শুধু যে মৌটুসীকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা নয়, শাস্তিটা কী হতে পারে সেটার বর্ণনা দেওয়া গেছে। (চুলের মাঝে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দেওয়া, ব্যাগের ভেতর বিষ পিঁপড়া রেখে দেওয়া, শরীরের মাঝে মাকড়সা ফেলে দেওয়া, বাসার ভিতরে সাপ ছেড়ে দেওয়া) এরকম ভয়ঙ্কর চিঠি পেয়েও মৌটুসী খুব ঘাবড়ে গেল না! চিঠিটা টুনির হাতে দিয়ে বলল, “এই যে আরেকটা চিঠি!”

    টুনি চিঠিটার মাঝে চোখ বুলিয়ে মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিল। মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, “পড়বে না?”

    “নাহ্। পড়ার দরকার নাই।”

    “কেন?”

    “কী লিখতে পারে আমি জানি।”

    “তাহলে বলো, কে লিখছে এই চিঠিগুলো।”

    টুনি চুপ করে রইল। মৌটুসী ঠোঁট উল্টে বলল, “যদি বলতে না পারো তাহলে স্বীকার করে নাও তুমি বের করতে পারবে না।”

    টুনি এবারেও কথা বলল না। মৌটুসী তখন বলল, “তুমি কচু ডিটেকটিভ।”

    টুনি কোনো কথা না বলে মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

    টুসী বলল, “কী হলো তুমি হাসছ কেন বোকার মতো?”

    টুনি বলল, “তার আগে বলো তুমি কেন প্রত্যেক দিন নিজের কাছে একটা করে চিঠি লিখো? তোমার কোনো কাজ নাই?”

    মৌটুসীর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ আ-আমি?”

    টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তোমার প্রথম চিঠিটা পড়েই আমি বুঝেছিলাম, এরকম চিঠি তুমি নিজে ছাড়া আর কেউ লিখবে না।”

    মৌটুসী গলা উঁচিয়ে বলল, “না–আমি লিখি নাই।”

    টুনি গলা নামিয়ে বলল, “মনে আছে আমি তোমাকে দিয়ে তোমার চিঠি কপি করিয়েছিলাম? কেন করেছিলাম জানো?”

    “কেন?”

    “দেখার জন্যে গোপন চিঠি আর তোমার চিঠির বানান ভুল একরকম হয় কি না!”

    মৌটুসী মুখ শক্ত করে বলল, “আমার কোনো বানান ভুল হয় না।”

    “গোপন চিঠিতেও কোনো বানান ভুল হয় না। একটা ছাড়া—“

    “কোনটা?”

    “কী। ক দীর্ঘ ঈকার আর ক হ্রস্ব ইকার-এর পার্থক্যটা তুমি শিখো নাই, গোপন চিঠি যে লিখেছে সেও, শিখে নাই। লিখেছে তুমি কী তাই চাও? লেখার কথা ছিল তুমি কি তাই চাও?”

    মৌটুসীর মুখটা লাল হয়ে উঠল, “পার্থক্যটা কী?”

    “নার্গিস ম্যাডামকে জিজ্ঞেস কোরো।”

    মৌটুসী বলল, “তোমার সব কথা ভুল।”

    “ঠিক আছে।”

    “তুমি কিছু জানো না।”

    “ঠিক আছে।”

    “তুমি কচু ডিটেকটিভ।”

    টুনি বলল, “ঠিক আছে। শুধু একটা জিনিস।”

    “কী জিনিস?”

    “গোপন চিঠিগুলো তুমি কীভাবে পেতে?”

    “আমার ব্যাগে।”

    “তোমার ব্যাগে আমিও প্রত্যেক দিন একটা করে চিঠি দিয়েছি। আমার চিঠিগুলো তুমি পাও নাই, কেন জানো? তার কারণ তুমি কোনোদিন তোমার ব্যাগে কোনো চিঠি খুঁজে দেখো নাই! তুমি চিঠিগুলো নিজে বসে বসে লিখেছ, কেন ব্যাগে চিঠি খুঁজবে?”

    মৌটুসী কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল, বলল, “তুমি কী লিখেছ চিঠিতে?”

    “বাসায় গিয়ে পড়ে দেখো। তোমাকে বলেছি নিজেকে চিঠি লেখা বন্ধ করতে।”

    ঠিক এরকম সময় কয়েকজন ছেলেমেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। একজন মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করল, “মৌটুসী, আজকে কোনো চিঠি এসেছে?”

    মৌটুসী কিছু বলার আগে টুনি বলল, “না। আসে নাই।”

    “আসে নাই?”

    “না। আর আসবে না।”

    “আসবে না? কেন আসবে না?”

    “তার কারণ যে গোপনে চিঠি লিখত সে ধরা পড়ে গেছে।”

    সবাই চিৎকার করে বলল, “কে? কে চিঠি লিখত?”

    “আমাদের ক্লাশের?” “ছেলে না মেয়ে?”

    ”নাম কী?”

    টুনি বলল, “আমি তাকে বলেছি সে যদি আর গোপন চিঠি না লিখে তাহলে তার নাম আমি কাউকে বলব না। সে রাজি হয়েছে।”

    “প্লিজ প্লিজ আমাদের বলো, আমরা কাউকে বলব না।”

    টুনি বলল, “আমি মৌটুসীকে নামটা বলেছি, তোমরা মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করো। সে যদি বলে আমার কোনো আপত্তি নাই।”

    তারপর টুনি হেঁটে চলে গেল আর সবাই তখন মৌটুসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা ভেবেছিল মৌটুসী গোপন পত্র লেখকের নাম বলবে।

    কিন্তু দেখা গেল মৌটুসীরও নাম বলতে আপত্তি আছে! সে মুখ। শক্ত করে বসে রইল।

    এরপর থেকে মৌটুসীর কাছে আর কোনোদিন কোনো গোপন চিঠি আসেনি।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি তপু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }