Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরো বারো – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1127 Mins Read0

    লোড শেডিং

    ফণীবাবু তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে থেকেই আঁচ করলেন যে তাঁর পাড়ায় লোড শেডিং হয়ে গেছে। আজ আপিসে ওভারটাইম করে বেরুতে বেরুতে হয়ে গেছে সোয়া আটটা। ডালহৌসি থেকে বাসে তাঁর পাড়ায় পৌছাতে লাগে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কতক্ষণ হল বিজলি গেছে জানার উপায় নেই, তবে একবার গেলে ঘণ্টা চারেকের আগে আসে না।

    ফণীবাবু বাস থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে তাঁর বাড়ির গলি ধরলেন। এ সি, ডি সি, দুটোই গেছে। অথচ এই সেদিনও মনে হয়েছে যে অবস্থাটা যেন একটু ভালর দিকে যাচ্ছে। নবীন চাকর কালই যখন বলল ‘আরো এক ডজন মোমবাতি কিনে রাখব বাবু?’ তখন ফণীবাবু বলেছিলেন, ‘মোমবাতি কিনলেই দেখবি আবার লোড শেডিং শুরু হয়েছে; এখন থাক।’ তার মানে বাড়িতে মোমবাতি নেই। রাস্তার আলো থাকলে তার খানিকটা তাঁর তিনতলার ঘরে ঢুকে চলাফেরার একটু সুবিধে হয়; আজ তাও হবে না। ফণীবাবু বিড়ি সিগারেট খান না, তাই সঙ্গে দেশলাইও থাকে না। অনেকদিন মনে হয়েছে একটা টর্চ রাখলে মন্দ হয় না, কিন্তু সেও করছি করব করে হয়ে ওঠেনি।

    বড় রাস্তা থেকে গলি ধরে মিনিট তিনেক গেলে পরে ফণীবাবুর বাসস্থান। সতেরোর দুই। ফুটপাথের উপর শোয়া গোটা তিনেক নেড়িকুত্তার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে ফণীবাবু তাঁর বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

    মাসখানেক হল কারবালা ট্যাঙ্ক রোডের বাসা ছেড়ে এইখানে এসেছেন ফণীবাবু। তিনি আর চাকর নবীন। বাড়ির প্রত্যেক তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ফণীবাবু লক্ষ করলেন একতলায় ইস্কুল মাষ্টার জ্ঞান দত্তর ঘর থেকে একটা কম্পমান হলদে আলো পড়ছে বারান্দা আর উঠানে। মোমবাতির আলো। অন্য ফ্ল্যাটটা অন্ধকার। কোনও সাড়াশব্দও নেই। আজ পঞ্চমী। রমানাথবাবু যেন বলছিলেন পুজোয় ঘাটশিলা না মধুপুর কোথায় যাবেন। আজই চলে গেলেন নাকি?

    সিঁড়ির তলায় এসে ‘নবীন’ বলে ডাক দিলেন ফণীবাবু। কোনও উত্তর নেই। বেরিয়েছে। ঠিক লোড শেডিং-এর সময় বেরোনো চাই। এটা আগেও কয়েকবার লক্ষ করেছেন ফণীবাবু।

    চাকরের আশা ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ি উঠতে আরম্ভ করলেন ফণীবাবু। মোমবাতির আলোতে প্রথম কয়েকটা ধাপ দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু তার পরেই অন্ধকার। তার জন্য চিন্তার কোনও কারণ নেই; তিন চব্বিশং বাহাত্তর ধাপ তাঁকে উঠতে হবে এটা তাঁর জানা আছে। লোড শেডিং-এর আশঙ্কা করেই ফণীবাবু একদিন সিঁড়ির সংখ্যা গুণে রেখেছিলেন। তাতে অন্ধকারে ওঠার অনেকটা সুবিধা হয়।

    আশ্চর্য! আলো থাকলে সিঁড়ি ওঠাটা সুস্থ লোকের পক্ষে কোনও সমস্যাই নয়; কিন্তু অন্ধকারে পনেরো ধাপ উঠে ষোলোর মাথায় রেলিং-এ কাঠের বদলে হঠাৎ কী একটা হাতে ঠেকতেই ফণীবাবু শিউরে উঠে হাতটা সরিয়ে নিলেন। তারপর মনে সাহস এনে হাতটা রাখতেই বুঝলেন সেটা একটা গামছা।

    দোতলায় কোনও আলো নেই। কোনও শব্দও নেই। তার মানে কোনও লোক নেই। পশ্চিমের দুটো ঘর নিয়ে থাকেন গেস্‌টেটনার অফিসের বিজনবাবু। সঙ্গে থাকেন তাঁর স্ত্রী আর দুই ছেলে। ছোট ছেলেটি মহা দুরন্ত। এক মুহূর্ত মুখ বন্ধ থাকে না তার। অন্য দিকে দুটি ঘর নিয়ে থাকেন কলেজ স্ট্রিটের এক জুতোর দোকানের মালিক মহাদেব মণ্ডল। ইনি সন্ধ্যায় প্রায়ই এক বন্ধুর বাড়িতে তাস খেলতে যান। বিজনবাবুরা মাঝে মাঝে সপরিবারে হিন্দি ছবি দেখতে যান; আজও হয়তো গেছেন।

    ফণীবাবু এ সব নিয়ে আর চিন্তা না করে উঠে চললেন। ষাট ধাপ উঠে ডাইনে মোড় নিতেই একটা টিনের পাত্রের সঙ্গে ঠোক্করের ফলে একটা কানফাটা শব্দ তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বেটাল করে দিয়ে তাঁর হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। বাকি বারোটা ধাপ তাঁকে তাই অতি সাবধানে পা ফেলে উঠতে হল।

    এবার বাঁয়ে ঘুরতে হবে। সামনে দড়িতে ঝোলানো একটা খালি পাখির খাঁচা পড়বে। তাঁর পড়শি নরেশ বিশ্বাসকে তিনি অনেকদিন থেকে বলছেন যে ময়নাটা যখন মরেই গেছে তখন আর খালি খাঁচাটাকে পথের মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখা কেন। ভদ্রলোক এখনও পর্যন্ত কথাটা কানেই তোলেননি।

    ফণীবাবু শরীরটাকে হাঞ্চব্যাকের মতো বেঁকিয়ে খাঁচা বাঁচিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়ালে ভর করে তাঁর ঘরের দিকে এগোলেন। এই ভাবে দেয়াল হাতড়ে তিন চার পা এগোলেই ডাইনে তাঁর ঘরের দরজা।

    একটা গানের শব্দ আসছে। রবীন্দ্রসংগীত। বোধ হয় পাশের বাড়ি থেকে। ট্রানজিস্টারই হবে। লোড শেডিং-এর আদিম ভুতুড়ে পরিবেশে এই জাতীয় শব্দ মনে অনেকটা সাহসের সঞ্চার করে। অবিশ্যি এটাও বলা দরকার যে ফণীবাবুর ভূতের ভয় নেই মোটেই।

    দরজার চৌকাঠ হাতে ঠেকতে ফণীবাবু হাঁটা থামিয়ে পকেট থেকে চাবি বার করলেন। দুটো চাবির একটা থাকে ফণীবাবুর কাছে; আরেকটা রাখে নবীন। তালার জায়গা আন্দাজ করা সহজ ব্যাপার, কিন্তু কড়া হাতড়ে ফণীবাবু তালা পেলেন না। অথচ তাঁর স্পষ্ট মনে আছে যে আপিসে যাবার সময় তিনি তালা লাগিয়ে পকেটে চাবি পুরেছেন। এটাও কি তা হলে নবীনের কীর্তি? সে কি তা হলে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে?

    ফণীবাবু দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে বোকা বনে গেলেন; কারণ দরজা দিব্যি খুলে গেল।

    ‘নবীন!’

    কোনও উত্তর নেই। নবীন ঘুমকাতুরে নয় সেটা ফণীবাবু জানেন।

    ফণীবাবু চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অবিশ্যি ‘ঘরে ঢুকলেন’ কথাটা বোধহয় ঠিক হল না। কারণ দরজার পিছনে কী আছে তা বুঝতে হলে বেড়ালের চোখ দরকার। ফণীবাবু একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে দেখলেন দুটো অবস্থার মধ্যে কোনও তফাত নেই। বাকি কাজ তিনি ইচ্ছে করলে চোখ বন্ধ করেই করতে পারেন। একেই বলে নিরেট অন্ধকার, যাকে দুহাত দিয়ে ঠেলে সামনে এগোতে হয়।

    দরজার বাঁ পাশে এক ফালি দেয়াল, তাতে সুইচবোর্ড। তারপর দেয়াল ঘুরে গিয়ে পাশের ঘরের দরজা, আর দরজা পেরিয়ে ব্র্যাকেট আলনা। ফণীবাবুর হাতে ছাতা, সেটাকে আলনায় টাঙানো দরকার। গরম লাগছে, গায়ের জামাটা খুলে সেটাও আলনায় যাবে। তবে জামা খোলার আগে বুক পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে আলনার পরেই বাঁ দিকে টেবিলের দেরাজে রাখতে হবে।

    ফণীবাবু হাত বাড়ালেন সুইচ আন্দাজ করে। এখন বাতি জ্বলবে না ঠিকই, তবে বিজলি এলেই নিঃশব্দে আলো জ্বলে ওঠার মজাটা থেকে ফণীবাবু বঞ্চিত হতে চান না।

    দুটো সুইচের একটার মাথা খোলা। নবীন একদিন লোড শেডিং-এর মধ্যেই হাতড়াতে গিয়ে শক্‌ খেয়েছিল। ফণীবাবু মোক্ষম আন্দাজে সেটাকে এড়িয়ে দ্বিতীয়টা বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মৃদু চাপে নীচে নামিয়ে দিলেন। খুট্‌ শব্দটা শুনতে ভালই লাগল।

    সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় দরজার ফাঁকটা পেরোতেই আবার দেয়াল ঠেকল হাতে। এর পরেই তাঁর মাথার সমান হাইটে—

    কিন্তু না।

    আলনার বদলে একটা অন্য জিনিস হাতে ঠেকল। শুধু ঠেকল না। আঙুলের একটা বেআন্দাজি খোঁচা লাগায় সেটা স্থানচ্যুত হয়ে মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

    একটা ছবি। না হয় আয়না। ফণীবাবু বুঝলেন তাঁর পায়ের উপর কাচের টুকরো এসে পড়েছে। পায়ে চটি, তাই কাচ ফোটার ভয় নেই, কিন্তু আলনাটা গেল কোথায় সে ভাবনা তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য অনড় করে দিল। তাঁর ঘরে একটা ছবি আছে বটে, পরমহংসদেবের, কিন্তু সেটা থাকবার কথা উল্টোদিকের দেয়ালে। আয়নাটা থাকে টেবিলের উপর। এটা নির্ঘাত নবীনের কীর্তি। ঘরের জিনিস এখান-ওখান করার বাতিক তার আছে বটে! তাঁর চটিজোড়া তিনি রাখেন টেবিলের নীচে, আর বারণ সত্ত্বেও নবীন প্রতিদিন সেটাকে চালান দেয় খাটের তলায়।

    ফণীবাবু হাতের জীর্ণ ছাতাটা মাটিতে নামিয়ে হাতলটা দেয়ালে ঠেকিয়ে সেটাকে সাবধানে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে এগিয়ে গেলেন অদৃশ্য টেবিল লক্ষ্য করে। এগোবার পথে পায়ের চাপে কাচ ভাঙল—চিড়্‌ চিড়্‌ চিড়্‌।

    এবার বাঁ হাতটা টেবিলের কোণে ঠেকলেই দেরাজের হাতল খুঁজে পাওয়া সহজ ব্যাপার।

    কিন্তু বাঁ হাত টেবিলে ঠেকল না। আন্দাজে ভুল হয়েছে। আরো এক পা এগিয়ে গেলেন ফণীবাবু। অন্ধকার এখনও নিরেট। রাস্তার দিকের জানলাটা খুললে হয়তো খানিকটা সুবিধে হত।

    এবার বাঁ হাতটা বাধা পেল।

    একটা আসবাব। কাঠের আসবাব। কিন্তু টেবিল নয়। আলমারি কি?

    হ্যাঁ, এই তো হাতল। খাড়াখাড়ি হাতল। কাচের হাতল। পলকাটা। কাট-গ্লাস। যেমন অনেক পুরোনো আলমারিতে থাকে। ফণীবাবুর একটা পুরোনো আলমারি আছে। বটে, কিন্তু তার হাতল কাচের কিনা সেটা মনে পড়ল না।

    কিন্তু একী—আলমারি যে খোলা!

    ফণীবাবু হাতলটা ছেড়ে দিলেন। অল্প টান দিতেই দরজা খুলে এসেছে।

    সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তাঁর আলমারি স্বভাবতই তিনি কখনও খোলা রেখে যান না। যদিও ধনদৌলত বলতে তাঁর কিছুই নেই, কিন্তু জামাকাপড় আছে, কিছু পুরোনো দলিল আছে, টাকা পয়সা যা কিছু থাকে আলমারির দেরাজে।

    আজ সকালে কি তা হলে চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন ফণীবাবু?

    কিন্তু টেবিলটা গেল কোথায়? তা হলে কি—?

    ঠিক। তাই হবে। কারণটা খুঁজে পেয়েছেন ফণীবাবু।

    গতকাল ছিল রবিবার। দুপুরে এল তুমুল বৃষ্টি। আর তখনই ফণীবাবু দেখলেন যে তাঁর ঘরের সীলিং থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে ঘরের ভিতর। টেবিলের উপরেও জল পড়ছিল, তাই নবীন খবরের কাগজ চাপা দিয়েছিল। আসলে বাড়িটা বেশ পুরোনো। বাড়িওয়ালাকে ছাত সারানোর কথা বলতে হবে এ কথাটা তখনই মনে হয়েছিল ফণীবাবুর। আজও যে এ পাড়ায় দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে সেটা ফণীবাবু রাস্তা ভিজে দেখেই বুঝেছিলেন। নবীন যদি টেবিলটাকে জানলার দিকে সরিয়ে থাকে এবং কাপড় সমেত আলনাটা উল্টো দিকের দেয়ালে টাঙিয়ে থাকে, তা হলে বলতে হবে সে সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে।

    ফণীবাবু মানিব্যাগটা পকেটে পুরে জানলার দিকে এগোলেন।

    তিন পা এগোতেই বাধা পড়ল।

    এটা চেয়ার। নবীন তা হলে চেয়ারটাকে সরিয়েছে।

    নাঃ, এভাবে অন্ধকারে হাতড়ানোর কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে বাকি সময়টা আলোর অপেক্ষায় চেয়ারটাতেই বসে কাটিয়ে দেওয়া ভাল।

    ফণীবাবু বসলেন। হাতলওয়ালা চেয়ার, বসার জায়গাটা বেতের। একবার যেন মনে হল তাঁর নিজের ঘরের চেয়ারে হাতল নেই, কিন্তু পরমুহূর্তেই খটকাটা মন থেকে দূর করে দিলেন। মানুষ নিজের ঘরের আসবাবের খুঁটিনাটি সব সময় মনে রাখে না, এই অভিজ্ঞতা তাঁর আজকে হয়েছে।

    এখন ফণীবাবুর মুখ দরজার দিকে। বাইরে ছোট ছাতটার ওদিকে একটা ফিকে চতুষ্কোণ আভা। ফণীবাবু বুঝলেন সেটা আকাশ। শহরের যে অংশে লোড শেডিং নেই সেখানকার আলো প্রতিফলিত হয়ে আকাশে পড়েছে। যদিও মেঘ থাকায় তারা দেখা যাচ্ছে না। যাক্‌, তবুও তো একটা দেখার জিনিস রয়েছে চোখের সামনে।

    একটা টিক্‌ টিক্‌ শব্দ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যে মুহূর্তে ফণীবাবুর খেয়াল হল যে তাঁর ঘরে কোনও টেবিল ঘড়ি নেই, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কান-ফাটা শব্দ তাঁকে চমকিয়ে প্রায় চেয়ার থেকে ফেলে দিল।

    টেলিফোন।

    তাঁর মাথার ঠিক পিছনে টেবিলের উপর টেলিফোন বেজে উঠেছে।

    নিঃশব্দ অন্ধকারে প্রায় এক মিনিট ধরে একটা তুমুল আলোড়ন তুলে অবশেষে টেলিফোনটা থামল।

    এইবার ফণীবাবু বুঝলেন যে তিনি তাঁর নিজের ঘরে আসেননি, কারণ তাঁর টেলিফোন নেই। আর এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কাছে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

    সতেরোর দুই আর সতেরোর তিন হল পাশাপাশি বাড়ি। একই ধাঁচের দুটো বাড়ি। দুটো বাড়িই তিন তলা, দুটো বাড়িরই একই বাড়িওয়ালা। সতেরোর তিনে ফণীবাবু কোনওদিন ঢোকেননি, কিন্তু আজ বোঝাই যাচ্ছে যে দুটো বাড়ির প্ল্যানই প্রায় হুবহু এক। তিনি এখন বসে আছেন সতেরোর তিনের তিন তলার পশ্চিমের ঘরে। সেই ঘরের আলো এখন নেই, কিন্তু ঘরের দরজা খোলা, আলমারি খোলা।

    তার মানে যাই হোক না কেন, ফণীবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়ার উপক্রম করেই আবার তৎক্ষণাৎ বসে পড়লেন।

    আরেকটা শব্দ। এটা এসেছে তাঁর খুব কাছেই বাঁ দিক থেকে।

    মেঝের উপর একটা টিনের বাক্স জাতীয় কিছু ঘষটানোর শব্দ।

    ফণীবাবু বুঝলেন যে তাঁর গলা শুকিয়ে আসছে আর তাঁর বুকের ভিতরে দুরমুশ পেটা শুরু হয়েছে।

    চোর।

    তাঁর পাশেই বোধহয় খাট, আর খাটের নীচে চোর। বেরোবার চেষ্টায় খাটের নীচে রাখা টিনের বাক্সে ধাক্কা খেয়েছে।

    ঘরের দরজা আর আলমারি কেন খোলা সেটা এখন খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে।

    চোরের কাছে যদি হাতিয়ার থাকে তা হলে ফণীবাবুর অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাঁর নিজের একমাত্র হাতিয়ার ছাতাটি এখন নাগালের বাইরে। তা ছাড়া ছাতার যা দৈন্যদশা, তাতে চোরের চেয়ে ছাতাটি জখম হবে বেশি।

    চোর অবিশ্যি আবার চুপ মেরে গেছে, কারণ টিনের বাক্সের শব্দ তুলে নিজের উপস্থিতিটা জানান দেবার অভিপ্রায় তার নিশ্চয়ই ছিল না, ফলে সে হয়তো কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট।

    ‘ঠিক ঠিক ঠিক?’—একটা টিকটিকি ডেকে উঠল।

    ভুল ভুল ভুল!—ফণীবাবুর মন বলল। একটা বিশ্রী ভুল করে একটা বিশ্রী অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছেন তিনি। ছিঁচকে চোরের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার সম্ভাবনা কম, তবে ছোরা ছুরি থাকা অসম্ভব নয়। অবিশ্যি অনেক চোর নিরস্ত্র অবস্থাতেই বেরোয়। হাতাহাতির প্রশ্ন হলে ফণীবাবু হয়তো লড়ে যাবেন, কারণ এককালে তিনি ফুটবল খেলেছেন পাড়ার টিমে। কিন্তু মুশকিল করেছে এই অন্ধকার। দৃষ্টির অভাবে অতি শক্তিশালী মানুষও অসহায় বোধ করে।

    কিন্তু তা হলে কী করা যায়? যা থাকে কপালে বলে উঠে পড়বেন কি?

    কিন্তু যদি সিঁড়ি নামার মুখে বিজলি এসে যায়? আর ঠিক সেই সময় যদি একদিক দিয়ে চোর পালায়, আর অন্য দিক দিয়ে ঘরের মালিক এসে পড়েন? আর মালিক যদি এসে দেখেন তাঁর ঘরে চুরি হয়েছে, তা হলে তো—

    ফণীবাবুর চিন্তায় ছেদ পড়ল।

    নীচ থেকে একটা পায়ের শব্দ আসছে।

    এই সিঁড়ি ওঠা শুরু হল। ধীরে ধীরে উঠছেন ভদ্রলোক। ওঠার মেজাজ আর পায়ের শব্দ থেকে পুরুষ বলে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

    আটচল্লিশ ধাপ অবধি গুনে ঊনপঞ্চাশের মাথায় ফণীবাবুর ধারণা বদ্ধমূল হল যে, এই ঘরের মালিকই আসছেন সিঁড়ি উঠে, আর সেই সঙ্গে হঠাৎ ভেল্কির মতো মনে পড়ে গেল—

    এই ঘরের মালিককে তো ফণীবাবু চেনেন!

    এতক্ষণ খেয়াল হয়নি কেন? শেয়ারের ট্যাক্সিতে একবার ডালহৌসি অবধি গিয়েছিলেন ভদ্রলোকের সঙ্গে। কোনও কারণে বাস বন্ধ ছিল সেদিন। ভদ্রলোক নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। নাম আদিনাথ সান্যাল। বছর পঞ্চাশেক বয়স, জাঁদরেল চেহারা, টকটকে রং, গায়ে ফিনফিনে আদ্যির পাঞ্জাবি। ঘন ভুরুর নীচে তীক্ষ সবজেটে চোখ।

    বাষট্টি-তেষট্টি-চৌষট্টি…পায়ের শব্দ এখন জোরালো।

    ঘরের ভিতরেও শব্দ। খচ্‌মচ্‌ ধুপ্‌ধাপ্‌—আর তারপরেই একটা যন্ত্রণাসূচক ‘উফ্‌’। পায় কাচ বিঁধেছে। চোরের শাস্তি। বাইরে আকাশের ফিকে আলোটা এক মুহূর্তের জন্য ঢেকে গিয়ে আবার দেখা গেল। চোর ঘুরেছে ডান দিকে। পাইপটা বেয়ে নামা ছাড়া আর গতি নেই তার।

    সিঁড়ির পায়ের শব্দ এবার মেঝেতে। বাইরের বারান্দায়। ফণীবাবুও. উঠে পড়লেন। সাবধানে কাচ বাঁচিয়ে ছাতাটা তুলে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

    দরজার মুখ অবধি এসে পায়ের শব্দ থামল চৌকাঠের বাইরে। কয়েক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। তারপর—

    ‘একী! দরজাটা—?’

    আদিনাথ সান্যালের বাজখাঁই কণ্ঠস্বর। অনেক গল্প করেছিলেন সেদিন ট্যাক্সিতে, তাই ফণীবাবু গলাটা ভোলেননি।

    আরো মনে পড়ছে ফণীবাবুর। তাঁর পাশের ঘরের নরেন বিশ্বাস বলেছিলেন একটা কথা। সান্যাল মশাই নাকি অগাধ টাকার মালিক। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি। সব ভাড়া দিয়ে নিজে এইখানে থাকেন। উপার্জনের রাস্তাগুলো নাকি সিধে নয়। আলমারিতে নাকি অনেক কালো টাকা।

    সান্যাল মশাই এখন ঘরের ভিতর। কাচ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেছেন হাতে হাতে চোর ধরার আশায়। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে ভদ্রলোকের।

    ফণীবাবুর আর ভয় নেই। আদিনাথ সান্যালের পিছন দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে বাহাত্তরটা সিঁড়ি নেমে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সতেরোর দুইয়ের দিকে রওনা দিলেন।

    নিজের বাড়ির তিন তলায় এসে খালি পাখির খাঁচাটা বাঁচিয়ে একবার এগোতেই যখন বিজলি ফিরে এল, তখন ফণীবাবু লক্ষ করলেন যে তাঁর হাতে একটি ঝক্‌ঝকে নতুন হাল ফ্যাশানেব জাপানি ছাতা এসে গেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকেই বলে শুটিং – সত্যজিৎ রায়
    Next Article আরো এক ডজন – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }