Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরো বারো – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1127 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ক্লাস ফ্রেণ্ড

    সকাল সোয়া নটা।
    মোহিত সরকার সবেমাত্র টাইয়ে ফাঁসটা পরিয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী অরুণা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘তোমার ফোন।’
    ‘এই সময় আবার কে?’
    কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটায় অফিসে পৌঁছানোর অভ্যাস মোহিত সরকারের; ঠিক বেরোনোর মুখে ফোন এসেছে শুনে স্বভাবতই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল।
    অরুণাদেবী বললেন, ‘বলছে তোমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত।’
    ‘ইস্কুলে? বোঝ!—নাম বলেছে?’
    ‘বলল, জয় বললেই বুঝবে!’
    ত্রিশ বছর আগে ইস্কুল ছেড়েছেন মোহিত সরকার। ক্লাসে ছিল জনাচল্লিশেক ছেলে। খুব মন দিয়ে ভাবলে হয়তো তাদের মধ্যে জনাবিশেকের নাম মনে পড়বে, আর সেই সঙ্গে চেহারাও। জয় বা জয়দেবের নাম ও চেহারা দুটোই ভাগ্যক্রমে মনে আছে। কারণ সে ছিল ক্লাসে সেরা ছেলেদের মধ্যে একজন। পরিষ্কার ফুটফুটে চেহারা, পড়াশোনায় ভালো, ভালো হাইজাম্প দিত, ভালো তাসের ম্যাজিক দেখাত, ক্যাসাবিয়াঙ্কা আবৃত্তি করে একবার মেডেল পেয়েছিল। স্কুল ছাড়ার পর তার আর কোনো খবর রাখেননি মোহিত সরকার। তিনি এখন বুঝতে পারলেন যে এককালে বন্ধুত্ব থাকলেও এতকাল ছাড়াছাড়ির পর তিনি আর কোনো টান অনুভব করছেন না তাঁর ইস্কুলের সহপাঠীর প্রতি।
    মোহিত অগত্যা টেলিফোনটা ধরলেন।
    ‘হ্যালো!’
    ‘কে, মোহিত? চিনতে পারছ ভাই? আমি সেই জয়—জয়দেবস বোস। বালিগঞ্জ স্কুল।’
    ‘গলা চেনা যায় না, তবে চেহারাটা মনে পড়ছে। কী ব্যাপার?’
    ‘তুমি তো এখন বড় অফিসার ভাই; নামটা যে মনে রেখেছ এটাই খুব!’
    ‘ওসব থাক—এখন কী ব্যাপার বল।’
    ‘ইয়ে, একটু দরকার ছিল। একবার দেখা হয়?’
    ‘কবে?’
    ‘তুমি যখন বলবে। তবে যদি তাড়াতাড়ি হয় তাহলে…’
    ‘তাহলে আজই করো। আমার ফিরতে ফিরতে ছয়টা হয়। সাতটা নাগাদ আসতে পারবে?’
    ‘নিশ্চয়ই পারব। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। তখন কথা হবে।’
    হালে কেনা হালকা নীল স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে আপিস যাবার পথে মোহিত সরকার ইস্কুলের ঘটনা কিছু মনে আনার চেষ্টা করলেন। হেডমাস্টার গিরীন সুরের ঘোলাটে চাহনি আর গুরুগম্ভীর মেজাজ সত্ত্বেও স্কুলের দিনগুলি ভারি আনন্দের ছিল। মোহিত নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন। শঙ্কর, মোহিত আর জয়দেব—এই তিনজনের মধ্যেই রেষারেষি ছিল। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড তিনজনে যেন পালা করে হতো। ক্লাস সিঙ্ থেকে মোহিত সরকার আর জয়দেব বোস একসঙ্গে পড়েছেন। অনেক সময় এক বেঞ্চিতেই পাশাপাশি বসতেন দুজন। ফুটবলেও পাশাপাশি স্থান ছিল দুজনের; মোহিত খেলতেন রাইট-ইন, জয়দেব রাইট-আউট; তখন মোহিতের মনে হতো এই বন্ধুত্ব বুঝি চিরকালের। কিন্তু ইস্কুল ছাড়ার পরেই দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। মোহিতের বাবা ছিলেন অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার। ইস্কুল শেষ করে মোহিত ভালো কলেজে ঢুকে ভালো পাস করে দু’বছরের মধ্যেই ভালো সদাগরী আপিসে চাকরি পেয়ে যায়। জয়দেব চলে যায় অন্য শহরের অন্য কলেজে, কারণ তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। তারপর আশ্চর্য ব্যাপার, মোহিত দেখেন যে তিনি আর জয়দেবের অভাব বোধ করছেন না; তার জায়গায় নতুন বন্ধু জুটেছে কলেজে। তারপর সেই বন্ধু বদলে গেল যখন ছাত্রজীবন শেষ করে মোহিত চাকরির জীবনে প্রবেশ করলেন। এখন তিনি তাঁর আপিসের চারজন মাথার মধ্যে একজন; এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো তাঁরই একজন সহকর্মী। স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে একমাত্র প্রজ্ঞান সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্লাবে দেখা হয়; সেও ভালো আপিসে বড় কাজ করে। আশ্চর্য, ইস্কুলের স্মৃতির মধ্যে কিন্তু প্রজ্ঞানের কোনো স্থান নেই। অথচ জয়দেব—যার সঙ্গে ত্রিশ বছর দেখাই হয়নি—স্মৃতির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। এই সত্যটা মোহিত পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বেশ ভালো করে বুঝতে পারলেন।
    মোহিতের অফিসটা সেন্ট্রাল এভিনিউতে। চৌরঙ্গী আর সুরেন ব্যানার্জির সংযোগস্থলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ির ভিড়, মোটরের হর্ন আর বাসের ধোঁয়া মোহিত সরকারকে স্মৃতির জগৎ থেকে হুড়মুড়িয়ে বাস্তব জগতে এনে ফেলল। হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়াতে মোহিত বুঝলেন যে তিনি আজ মিনিট তিনেক লেট হবেন।
    অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যায় তাঁর লি রোডের বাড়িতে যখন ফিরলেন মোহিত, তখন তাঁর মনে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের স্মৃতির কণামাত্র অবশিষ্ট নেই। সত্যি বলতে কী, তিনি সকালের টেলিফোনের কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন; সেটা মনে পড়ল যখন বেয়ারা বিপিন বৈঠকখানায় এসে তাঁর হাতে রুলটানা খাতার পাতা ভাঁজ করে ছেঁড়া একটা চিরকুট দিল। তাতে ইংরেজিতে লেখা—’জয়দেব বোস, অ্যাজ পার অ্যাপয়েন্টমেন্ট’।
    রেডিওতে বিবিসির খবরটা বন্ধ করে মোহিত বিপিনকে বললেন, ‘ভেতরে আসতে বল’—আর বলেই মনে হলো, জয় এতকাল পরে আসছে, তার জন্য কিছু খাবার আনিয়ে রাখা উচিত ছিল। আপিস-ফেরতা পার্ক স্ট্রিট থেকে কেক-পেস্ট্রিজাতীয় কিছু কিনে আনা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ ছিল, কিন্তু খেয়াল হয়নি। তাঁর স্ত্রী কি আর নিজে খেয়াল করে এ কাজটা করেছেন?
    ‘চিনতে পারছ?’
    গলার স্বর শুনে, আর সেই সঙ্গে কণ্ঠস্বরের অধিকারীর দিকে চেয়ে মোহিত সরকারের যে প্রতিক্রিয়াটা হলো সেটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে শেষ ধাপ পেরোনোর পরেও আরেক ধাপ আছে মনে করে পা ফেললে হয়।
    চৌকাঠ পেরিয়ে যিনি ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পরনে ছাই রঙের বেখাপ্পা ঢলঢলে সুতির প্যান্টের ওপর হাতকাটা সস্তা ছিটের শার্ট দুটির কোনোটিও কস্মিনকালে ইস্তিরির সংস্পর্শে এসেছে বলে মনে হয় না। শার্টের কলারের ভিতর দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে আছে তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও মোহিত তাঁর স্মৃতির জয়দেবের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন না। আগন্তুকের চোখ কোটরে বসা, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে ঝামা, গাল তোবড়ানো, থুতনিতে অন্তত তিন দিনের কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার উপরাংশ মসৃণ, কানের পাশে কয়েক গাছা অবিন্যস্ত পাকা চুল। প্রশ্নটা হাসিমুখে করায় ভদ্রলোকের দাঁতের পাটিও দেখতে পেরেছেন মোহিত সরকার, এবং মনে হয়েছে পান-খাওয়া ক্ষয়ে-যাওয়া অমন দাঁত নিয়ে হাসতে হলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসা উচিত।
    ‘অনেক বদলে গেছি, না?’
    ‘বোসো।’
    মোহিত এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সামনের সোফায় আগন্তুক বসার পর মোহিতও তাঁর নিজের জায়গায় বসলেন। মোহিতের নিজের ছাত্রজীবনের কয়েকটা ছবি তাঁর অ্যালবামে আছে; সেই ছবিতে চোদ্দ বছর বয়সের মোহিতের সঙ্গে আজকের মোহিতের আদল বার করতে অসুবিধা হয় না। তাহলে এঁকে চেনা এত কঠিন হচ্ছে কেন? ত্রিশ বছরে একজনের চেহারায় এত পরিবর্তন হয় কি?
    ‘তোমাকে কিন্তু বেশ চেনা যায়। রাস্তায় দেখলেও চিনতে পারতাম’—ভদ্রলোক কথা বলে চলেছেন—’আসলে আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কলেজে পড়তে পড়তে বাবা মারা গেলেন, আমি পড়া ছেড়ে চাকরির ধান্দায় ঘুরতে শুরু করি। তারপর, ব্যাপার তো বোঝই। কপাল আর ব্যাকিং এ দুটোই যদি না থাকে, তাহলে আজকের দিনে একজন ইয়ের পক্ষে…’
    ‘চা খাবে?’
    ‘চা? হ্যাঁ, তা….
    মোহিত বিপিনকে ডেকে চা আনতে বললেন, আর সেই সঙ্গে এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে কেক মিষ্টি যদি নাও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই; এনার পক্ষে বিস্কুটই যথেষ্ট।
    ‘ওঃ।’ —ভদ্রলোক বলে চলেছেন, ‘আজ সারা দিন ধরে কত পুরনো কথাই না ভেবেছি, জান মোহিত!’
    মোহিত নিজেরও যে কিছুটা সময় তাই করেছেন সেটা আর বললেন না।
    ‘এল সি এম, জি সি এম-কে মনে আছে?’
    মোহিতের মনে ছিল না, কিন্তু বলতেই মনে পড়ল। এল সি এম হলেন পি-টির মাস্টার লালচাঁদ মুখুজ্যে। আর জি সি এম হলেন অঙ্কের স্যার গোপেন মিত্তির।
    ‘আমাদের খাবার জলের ট্যাঙ্কের পেছনটায় দুজনকে জোর করে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে কে বঙ্ ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল মনে আছে?’
    ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাসি এনে মোহিত বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর মনে আছে। আশ্চর্য, এগুলো তো সবই সত্যি কথা। ইনি যদি জয়দেব না হন, তাহলে এত কথা জানলেন কী করে?’
    ‘স্কুল লাইফের পাঁচটা বছরই আমার জীবনের বেস্ট টাইম, জান ভাই,’ বললেন আগন্তুক, ‘তেমন দিন আর আসবে না।’
    মোহিত একটা কথা না বলে পারলেন না।
    ‘তোমার তো মোটামুটি আমারই বয়স ছিল বলে মনে পড়ে’—
    ‘তোমার চেয়ে তিন মাসের ছোট।’
    ‘—তাহলে এমন বুড়োলে কী করে? চুলের দশা এমন হলো কী করে?’
    ‘স্ট্রাগ্ল, ভাই স্ট্রাগল,’ বললেন আগন্তুক। ‘অবিশ্যি টাকটা আমাদের ফ্যামিলির অনেকেরই আছে। বাপ-ঠাকুরদা দুজনেরই টাক পড়ে যায় পঁয়ত্রিশের মধ্যে! গাল ভেঙেছে হাড়ভাড়া খাটুনির জন্য, আর প্রপার ডায়েটের অভাবে। তোমাদের মতো তো টেবিল-চেয়ারে বসে কাজ নয় ভাই। কারখানায় কাজ করেছি সাত বছর, তারপর মেডিক্যাল সেলসম্যান, ইনশিওরেন্সের দালালি, এ দালালি, সে দালালি! এক কাজে টিকে থাকব সে তো আর কপালে লেখা নেই। তাঁতের মাকুর মতো একবার এদিক একবার ওদিক। কথায় বলে—শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়—অথচ তাতে শেষ অবধি শরীরটা গিয়ে কী দাঁড়ায় তা তো আর বলে না। সেটা আমায় দেখে বুঝতে হবে।’
    বিপিন চা এনে দিল। সঙ্গে প্লেটে সন্দেশ আর শিঙাড়া। গিন্নির খেয়াল আছে বলতে হবে। ক্লাস ফ্রেন্ডের এই ছিরি দেখলে কী ভাবতেন সেটা মোহিত আন্দাজ করতে পারলেন না।
    ‘তুমি খাবে না?’ আগন্তুক প্রশ্ন করলেন। মোহিত মাথা নাড়লেন।—’আমি এইমাত্র খেয়েছি।’
    ‘একটা সন্দেশ?’
    ‘নাঃ, আপ—তুমিই খাও।’
    ভদ্রলোক শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতেই বললেন, ‘ছেলেটার পরীক্ষা সামনে। অথচ এমন দশা, জানো মোহিত ভাই, ফির টাকাটা যে কোত্থেকে আসবে, তা তো বুঝতে পারছি না।’
    আর বলতে হবে না। মোহিত বুঝে নিয়েছেন। আগেই বোঝা উচিত ছিল এঁর আসার কারণটা। সাহায্য প্রার্থনা। আর্থিক সাহায্য। কত চাইবেন? বিশ-পঁচিশ হলে দিয়ে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ না দিলেই যে উৎপাতের শেষ হবে এমন কোনো ভরসা নেই।
    ‘আমার ছেলেটা খুব ব্রাইট, জানো ভাই। পয়সার অভাবে তার পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এ কথাটা ভেবে আমার রাতে ঘুম হয় না।’
    দ্বিতীয় শিঙাড়াটাও উঠে গেল প্লেট থেকে। মোহিত সুযোগ পেলেই জয়দেবের সেই ছেলে বয়সের চেহারাটার সঙ্গে আগন্তুকের চেহারা মিলিয়ে দেখছেন, আর ক্রমেই তাঁর বিশ্বাস বদ্ধমূল হচ্ছে যে সেই বালকের সঙ্গে এই প্রৌঢ়ের কোনো সাদৃশ্য নেই।
    ‘তাই বলছিলাম, ভাই’, চায়ে সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন আগন্তুক, ‘অন্তত শ’খানেক কি শ’ দেড়েক যদি এই পুরনো বন্ধুর হাত তুলে দিতে পারো, তাহলে—’
    ‘ভেরি স্যরি।’
    ‘অ্যাঁ?’
    টাকার কথাটা উঠলেই সরাসরি না করে দেবেন এটা মোহিত মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হলো ব্যাপারটা এতটা রূঢ়ভাবে না করলেও চলত। তাই নিজেকে খানিকটা শুধরে নিয়ে গলাটাকে আরেকটু নরম করে বললেন, ‘স্যরি ভাই। আমার কাছে জাস্ট নাউ ক্যাশের একটু অভাব।’
    ‘আমি কাল আসতে পারি। এনি টাইম। তুমি যখনই বলবে।’
    ‘কাল আমি একটু কলকাতার বাইরে যাব। ফিরব দিন তিনেক পরে। তুমি রোববার এসো।’
    ‘রবিবার…’
    আগন্তুক যেন খানিকটা চুপসে গেলেন। মোহিত মনস্থির করে ফেলেছেন। ইনিই যে জয়, চেহারায় তার কোনো প্রমাণ নেই। কলকাতার মানুষ ধাপ্পা দিয়ে টাকা রোজগারের হাজার ফিকির জানে। ইনি যদি জালিয়াত হন? হয়তো আসল জয়দেবকে চেনেন। তার কাছ থেকে ত্রিশ বছর আগের বালিগঞ্জ স্কুলের কয়েকটা ঘটনা জেনে নেওয়া আর এমন কী কঠিন কাজ?
    ‘রবিবার কখন আসব?’ আগন্তুক প্রশ্ন করলেন।
    ‘সকালের দিকেই ভালো। এই নটা সাড়ে নটা।’
    শুক্রবার ঈদের ছুটি। মোহিতের আগে থেকেই ঠিক আছে বারুইপুরে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে সস্ত্রীক গিয়ে উইক-এন্ড কাটিয়ে আসবেন। দুদিন থেকে রবিবার রাতে ফেরা; সুতরাং ভদ্রলোক সকালে এলে তাঁকে পাবেন না। এই প্রতারণাটুকুরও প্রয়োজন হতো না যদি মোহিত সোজাসুজি মুখের ওপর না করে দিতেন। কিন্তু কিছু লোক আছে যাদের দ্বারা এ জিনিসটা হয় না। মোহিত এই দলেই পড়েন। রবিবার তাঁকে না পেয়ে যদি আবার আসেন ভদ্রলোক, তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা না করার কোনো অজুহাত বার করবেন মোহিত সরকার। তারপর হয়তো আর বিরক্ত হতে হবে না।
    আগন্তুক চায়ের কাপে শেষ চুকুম দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখতেই ঘরে আরেকজন পুরুষ এসে ঢুকলেন। ইনি মোহিতের অন্তরঙ্গ বন্ধু বাণীকান্ত সেন। আরো দুজন আসার কথা আছে, তারপর তাসের আড্ডা বসবে। এটা রোজকার ঘটনা। বাণীকান্ত ঘরে ঢুকেই যে আগন্তুকের দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিলেন সেটা মোহিতের দৃষ্টি এড়াল না। আগন্তুকের সঙ্গে বন্ধুর পরিচয়ের ব্যাপারটা মোহিত অম্লান বদনে এড়িয়ে গেলেন।
    ‘আচ্ছা, তাহলে আসি…’ আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়েছেন। ‘তুই এই উপকারটা করলে সত্যিই গ্রেটফুল থাকব ভাই, সত্যিই।’
    ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্তেই বাণীকান্ত বন্ধুর দিকে ফিরে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, ‘এই লোক তোমাকে তুই করে বলছে— ব্যাপারটা কী?’
    ‘এতক্ষণ তুমি বলছিল, শেষে তোমাকে শুনিয়ে হঠাৎ তুই বলল।’
    ‘লোকটা কে?’
    মোহিত উত্তর না দিয়ে বুকশেল্ফ থেকে একটা পুরনো ফোটো অ্যালবাম বার করে তার একটা পাতা খুলে বাণীকান্তর দিকে এগিয়ে দিল।
    ‘একি তোমার ইস্কুলের গ্রুপ নাকি?’
    ‘বোট্যানিক্সে পিকনিকে গিয়েছিলাম,’ বললেন মোহিত সরকার।
    ‘কারা এই পাঁচজন?’
    ‘আমাকে চিনতে পারছ না?’
    ‘দাঁড়াও, দেখি।’
    অ্যালবামের পাতাটাকে চোখের কাছে নিয়ে বাণীকান্ত সহজেই তাঁর বন্ধুকে চিনে ফেললেন।
    ‘এবার আমার ডানপাশের ছেলেটিকে দেখ তো ভালো করে।’
    ছবিটাকে আরো চোখের কাছে এনে বাণীকান্ত বললেন, ‘দেখলাম।’
    মোহিত বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন যিনি এইমাত্র উঠে গেলেন।’
    ‘ইস্কুল থেকেই কি জুয়া ধরেছিলেন নাকি?’—অ্যালবামটা সশব্দে বন্ধ করে পাশের সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন বাণীকান্ত। —’ভদ্রলোককে অন্তত বত্রিশবার দেখেছি রেসের মাঠে।’
    ‘সেটাই স্বাভাবিক’, বললেন মোহিত সরকার। তারপর আগন্তুকের সঙ্গে কী কথা হলো সেটা সংক্ষেপে বললেন।
    ‘পুলিশে খবর দে’, বললেন বাণীকান্ত, ‘চোর জোচ্চোর জালিয়াতের ডিপো হয়েছে কলকাতা শহর। এই ছবির ছেলে আর ওই জুয়াড়ি এক লোক হওয়া ইম্পসিবল।’
    মোহিত হালকা হাসি হেসে বললেন, ‘রোববার এসে আমাকে না পেলেই ব্যাপারটা বুঝবে। তারপর আর উৎপাত করবে বলে মনে হয় না।’
    বারুইপুরে বন্ধুর পুকুরের মাছ, পোলট্রির মুরগির ডিম, আর গাছের আম জাম ডাব পেয়ারা খেয়ে, বুকল গাছের ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বুকে বালিশ নিয়ে তাস খেলে শরীর ও মনের অবসাদ দূর করে রবিবার রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে মোহিত সরকার বিপিন বেয়ারার কাছে শুনছেন যে সেদিন যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।—’যাবার সময় কিছু বলে গেছেন কি?’
    ‘আজ্ঞে না,’ বলল বিপিন।
    যাক্, নিশ্চিন্ত! একটা সামান্য কৌশল, কিন্তু তাতে কাজ দিয়েছে অনেক। আর আসবে না। আপদ গেছে।
    কিন্তু না। আপদ সেদিনের জন্য গেলেও পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ মোহিত যখন বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তখন বিপিন আবার একটি ভাঁজ করা চিরকুট এনে দিল তাঁকে। মোহিত খুলে দেখলেন তিন লাইনের একটি চিঠি।
    ভাই মোহিত,
    আমার ডান পা-টা মচকেছে, তাই ছেলেকে পাঠাচ্ছি। সাহায্যস্বরূপ সামান্য কিছুও এর হাতে দিলে অশেষ উপকার হবে। আশা করি হতাশ করবে না।—
    ইতি জয়
    মোহিত বুঝলেন এবার আর রেহাই নেই। তবে সামান্য মানে সামান্যই, এই স্থির করে তিনি বেয়ারাকে বললেন, ‘ডাক ছেলেটিকে।’
    মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে দরজা দিয়ে ঢুকে মোহিতের দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে আবার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
    মোহিত তার দিকে মিনিট খানেক চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘বোস।’
    ছেলেটি একটু ইতস্তত ভাব করে একটি সোফার এক কোণে হাত দুটোকে কোলের ওপর জড়ো করে বসল।
    ‘আমি আসছি এক্ষুনি।’
    মোহিত দোতলায় গিয়ে স্ত্রীর আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে নিয়ে আলমারি খুলে দেরাজ থেকে চারটে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে একটা খামে পুরে আলমারি বন্ধ করে আবার নিচের বৈঠকখানায় ফিরে এলেন।
    ‘কী নাম তোমার?’
    ‘শ্রী সঞ্জয়কুমার বোস।’
    ‘এতে টাকা আছে। সাবধানে নিতে পারবে?’
    ছেলেটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
    ‘কোথায় নেবে?’
    ‘বুক পকেটে।’
    ‘ট্রামে ফিরবে, না বাসে?’
    ‘হেঁটে।’
    ‘হেঁটে? কোথায় বাড়ি তোমার?’
    ‘মির্জাপুর স্ট্রিট।’
    ‘এত দূর হাঁটবে?’
    ‘বাবা বলেছেন হেঁটে ফিরতে।’
    ‘তার চেয়ে এক কাজ করো। ঘণ্টাখানেক বোস, চা-মিষ্টি খাও, অনেক বইটই আছে, দেখো—আমি নটায় অফিসে যাব, আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার গাড়ি তোমার বাড়ি পৌঁছে দেবে। তুমি বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারবে তো?’
    ছেলেটি আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
    মোহিত বিপিনকে ডেকে ছেলেটির জন্য চা দিতে বলে আপিসে যাবার জন্য তৈরি হতে দোতলায় রওনা হলেন।
    ভারি হালকা বোধ করছেন তিনি, ভারি প্রসন্ন।
    জয়কে দেখে না চিনলেও তিনি তার ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে পেয়েছেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকেই বলে শুটিং – সত্যজিৎ রায়
    Next Article আরো এক ডজন – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }