Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আরো বারো – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1127 Mins Read0

    দুই ম্যাজিশিয়ান

    ‘পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো।’

    সুরপতি ট্রাকগুলো গুনে নিয়ে অ্যাসিস্‌ট্যান্ট অনিলের দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে। দাও, গাড়ি পাঠিয়ে দাও সব ব্রেকভ্যানে। আর মাত্র পঁচিশ মিনিট।’

    অনিল বলল, ‘আপনার গাড়িও ঠিক আছে স্যার। কুপে। দুটো বার্থই আপনার নামে নেওয়া আছে। কোনো অসুবিধে হবে না।’ তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘গার্ডসাহেবও আপনার একজন ভক্ত। নিউ এম্পায়ারে দেখেছেন আপনার শো। এই যে স্যার—আসুন এদিকে।’

    গার্ড বীরেন বকশি মশাই একগাল হেসে এগিয়ে এসে তাঁর ডান হাতখানা সুরপতির দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

    ‘আসুন স্যার, যে-হাতের সাফাই দেখে এত আনন্দ পেইচি, সে-হাত একবারটি শেক করে নিজেকে কেতাত্থ করি।’

    সুরপতি মণ্ডলের এগারোটি ট্রাঙ্কের যে-কোন একটির দিকে চাইলেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘Mondol’s Miracles’ কথাটা পরিষ্কার বড় বড় অক্ষরে লেখা প্রতিটি ট্রাঙ্কের পাশে এবং ঢাকনার উপর। এর বেশি আর পরিচয়ের দরকার নেই—কারণ ঠিক দু’মাস আগেই কলকাতার নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে মণ্ডলের জাদুবিদ্যার প্রমাণ পেয়ে দর্শক বার বার করধ্বনি করে তাদের বাহবা জানিয়েছে। খবরের কাগজেও প্রশংসা হয়েছে প্রচুর। এক সপ্তাহের প্রোগ্রাম ভিড়ের ঠেলায় চলেছে চার সপ্তাহ। তাও যেন লোকের আশ মেটে নি। থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের অনুরোধেই মণ্ডলকে কথা দিতে হয়েছে যে বড়দিনের ছুটিতে আবার শো করবে সে।

    ‘কোনো অসুবিধে-টসুবিধে হলে বলবেন স্যার।’

    গার্ডসাহেব সুরপতিকে তাঁর কামরায় তুলে দিলেন। সুরপতি এদিকে ওদিকে দেখে নিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বেশ কামরা।

    ‘আচ্ছা স্যার, তাহলে…’

    ‘অনেক ধন্যবাদ!’

    গার্ড চলে যাবার পর সুরপতি তার বেঞ্চের কোণে জানালার পাশটায় ঠেস দিয়ে বসে পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বার করল। এই বোধহয় তার বিজয় অভিযানের শুরু। উত্তর প্রদেশ: দিল্লী, আগ্রা, এলাহাবাদ, কাশী, লক্ষ্ণৌ। এ যাত্রা এই ক’টিই—তারপর আরো কত প্রদেশ পড়ে আছে, কত নগর কত উপনগর। আর শুধু কি ভারতবর্ষই? তার বাইরেও যে জগৎ রয়েছে একটা—বিরাট বিস্তীর্ণ জগৎ। বাঙালী বলে কি আর অ্যাম্বিশন নেই? সুরপতি দেখিয়ে দেবে। এককালে যে-দেশের জাদুকর হুডিনির কথা পড়ে তার গায়ে কাঁটা দিত, সেই আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে তার খ্যাতি। বাংলার ছেলের দৌড় কতখানি, তা সে প্রমাণ করবে বিশ্বের লোকের কাছে। যাক না ক’টা বছর। এ তো সবে শুরু।

    অনিল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ‘সব ঠিক আছে স্যার। এভরিথিং।’

    ‘তালাগুলো চেক করে নিয়েছ তো?’

    ‘হ্যাঁ স্যার।’

    ‘গুড।’

    ‘আমি দুটো বোগি পরেই আছি।’

    ‘লাইন ক্লিয়ার দিয়েছে?’

    ‘এই দিল বলে। আমি চলি।…বর্ধমানে চা খাবেন কি?’

    ‘হলে মন্দ হয় না।’

    ‘আমি নিয়ে আসব’খন।’

    অনিল চলে গেল। সুরপতি সিগারেটটা ধরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে কুলি যাত্রী ফেরিওয়ালার দু-মুখো কলমুখর স্রোত বয়ে চলেছে। সুরপতি সেদিকে দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। স্টেশনের কোলাহল মিলিয়ে এল। মনটা তার চলে গেল অনেক দূরে, অনেক পিছনে। এখন তার বয়স তেত্রিশ, তখন সাত কি আট। দিনাজপুর জেলার ছোট একটি গ্রাম—পাঁচপুকুর। শরতের এক শান্ত দুপুর। এক বুড়ী চটের থলি নিয়ে বসেছে বটতলায় মতি মুদির দোকানের ঠিক সামনে। তাকে ঘিরে ছেলেবুড়োর ভিড়। কত বয়স বুড়ীর? ষাটও হতে পারে, নব্বুইও হতে পারে। তোবড়ানো গালে অজস্র হিজিবিজি বলিরেখা, হাসলেই সংখ্যায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আর ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে কথার খই ফুটছে।

    ভানুমতীর খেল!

    ভানুমতীর খেল দেখিয়েছিল বুড়ী। সেই প্রথম আর সেই শেষ। কিন্তু যা দেখেছিল তা সুরপতি কোনদিন ভোলেও নি, ভুলবেও না। তার নিজের ঠাকুরমার বয়সও তো পঁয়ষট্টি; ছুঁচে সুতো পরাতে গেলে সর্বাঙ্গ ঠকঠক করে কাঁপে। আর ওই বুড়ীর কুঁকড়ানো হাতে এত জাদু! চোখের সামনে নাকের সামনে হাত-দুহাতের মধ্যে জিনিসপত্তর সব ফুসমন্তরে উধাও করে দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই ফুসমন্তরে বার করে দিচ্ছে—টাকা, মার্বেল, লাট্টু, সুপুরি, পেয়ারা! কালুকাকার কাছ থেকে একটা টাকা নিয়ে বুড়ী ভ্যানিশ করে দিলে, তাতে কাকার কী রাগ আর তম্বি! তারপর খিলখিল হাসি হেসে বুড়ী যখন আবার সেটি বার করে ফেরত দিল, তখন কাকার চোখ ছানাবড়া।

    সুরপতির বেশ কিছুদিন ভালো করে ঘুম হয় নি এই ম্যাজিক দেখে। আর তারপর যখন ঘুমিয়েছে তখনও নাকি মাস কয়েক ধরে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ম্যাজিক-ম্যাজিক বলে চেঁচিয়ে উঠেছে।

    এর পরে গাঁয়ে যখনই মেলা-টেলা বসেছে, সুরপতি ম্যাজিক দেখার আশায় ধাওয়া করেছে সেখানে। কিন্তু তেমন অবাক করা কিছুই আর চোখে পড়ে নি।

    ষোলো বছর বয়সে সুরপতি চলে আসে কলকাতার বিপ্রদাস স্ট্রীটে কাকার বাড়িতে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পড়বে বলে। কলেজের বইয়ের সঙ্গে পড়া চলেছিল ম্যাজিকের বই। কলকাতায় আসার দু-এক মাসের মধ্যেই সুরপতি সেসব বই কিনে নিয়েছিল, আর কেনার কিছুদিনের মধ্যেই বইয়ের সব ম্যাজিকই তার শেখা হয়ে গিয়েছিল। তাসের প্যাকেট কিনতে হয়েছিল অনেকগুলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাস হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক অভ্যাস করতে হয়েছিল তাকে। কলেজের সরস্বতী পুজোয়, বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন-টন্মদিনে সুরপতি এসব ম্যাজিক মাঝে মাঝে দেখাত।

    সে যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, তখন তার বন্ধু গৌতমের বোনের বিয়েতে তার নেমন্তন্ন হয়। সুরপতির ম্যাজিক শেখার ইতিহাসে এটা একটা স্মরণীয় দিন, কারণ এই বিয়েবাড়িতেই তার প্রথম দেখা হয় ত্রিপুরাবাবুর সঙ্গে। সুইনহো স্ট্রীটের বিরাট বাড়ির পিছনের মাঠে শামিয়ানা পড়েছে; তারই এক কোণে একটি ফরাসে অতিথি-অভ্যাগত-পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন ত্রিপুরাচরণ মল্লিক। হঠাৎ দেখলে নেহাত নগণ্য লোক বলেই মনে হয়। বছর আটচল্লিশ বয়স, কোঁকড়ানো টেরিকাটা চুল, হাসি-হাসি মুখ, ঠোঁটের দু’কোণে পানের দাগ। রাস্তায় ঘাটে এরকম কত লোক দেখা যায় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তার ঠিক সামনেই ফরাসের উপর যে কাণ্ডটা ঘটছে সেটা দেখলে লোকটির সম্বন্ধে মত পালটাতে হয়। সুরপতি প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারে নি। একটা রুপোর আধুলি গড়িয়ে গড়িয়ে তিন হাত দূরে রাখা একটি সোনার আংটির কাছে গেল, তারপর আংটিটাকে সঙ্গে নিয়ে আবার গড়গড়িয়ে ত্রিপুরাবাবুর কাছেই ফিরে এল। সুরপতি এতই হতভম্ব যে তার হাততালি দেবার সামর্থ্য নেই। এদিকে পর মুহূর্তেই আবার আরেক তাজ্জব জাদু। গৌতমের জ্যাঠামশাই ম্যাজিক দেখতে দেখতে চুরুট ধরাতে গিয়ে তাঁর দেশলাইয়ের কাঠি সব বাক্স থেকে মাটিতে ফেলে বসলেন। তাঁকে উপুড় হতে দেখে এিপুরাবাবু বললেন, ‘আপনি আর কষ্ট করে ওগুলো তুলছেন কেন স্যার? আমাকে দিন। আমি তুলে দিচ্ছি।’

    তারপর কাঠিগুলো ফরাসের এক কোণে স্তূপ করে রেখে নিজের বাঁ হাতে বাক্সটা নিয়ে ত্রিপুরাবাবু ডাকতে লাগলেন—‘আঃ তুতুতু আঃ আঃ আঃ…’ আর কঠিগুলো ঠিক পোষা বেড়াল কুকুরের মতোই একে একে গুটি গুটি এসে বাক্সের ভিতর ঢুকে যেতে লাগল।

    সেই রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর সুরপতি ভদ্রলোককে একটু একা পেয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে। সুরপতির ম্যাজিকে আগ্রহ দেখে ভদ্রলোক খুবই অবাক হন। বলেন, ‘বাঙালীরা ম্যাজিক দেখেই খালাস, দেখাবার লোক তো কই বড় একটা দেখি না। তোমার এদিকে ইন্টারেস্ট দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি।’

    এর দু’দিন পরেই সুরপতি ত্রিপুরাবাবুর বাড়ি যায়। বাড়ি বললে ভুল হবে। মির্জাপুর স্ত্রীটের একটি মেস-বাড়ির একটি জীর্ণ ছোট্ট ঘর। অভাব-অনটনের এমন স্পষ্ট চেহারা সুরপতি আর দেখে নি। ভদ্রলোক সুরপতিকে তাঁর জীবিকার কথা বলেছিলেন। পঞ্চাশ টাকা করে ম্যাজিক দেখানোর ‘ফী’ তাঁর। মাসে দুটো করে বায়না জোটে কিনা সন্দেহ। চেষ্টায় হয়তো আরো কিছুটা হতে পারত, কিন্তু সুরপতি বুঝেছিল ভদ্রলোকের সে চেষ্টাই নেই। এত গুণী লোকের এমন অ্যাম্বিশনের অভাব হতে পারে সুরপতি তা ভাবতে পারে নি। এর উল্লেখ করাতে ভদ্রলোক বললেন, কী হবে? ভালো জিনিসের কদর করবে কেউ এ পোড়া দেশে? ক’টা লোক সত্যিকারের আর্ট বোঝে? খাঁটি আর মেকির তফাত ক’টা লোকে ধরতে পারে? সেদিন যে বিয়ের আসরের ম্যাজিক তুমি এত তারিফ করলে, কই, আর তো কেউ করল না! যেই খবর এল পাত পড়েছে, সব সুড়সুড় করে চলে গেল ম্যাজিক ছেড়ে পেটপুজো করতে।’

    সুরপতি কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে অনুষ্ঠানে ত্রিপুরাবাবুর ম্যাজিকের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। কিছুটা কৃতজ্ঞতা এবং বেশিটাই একটা স্বাভাবিক স্নেহবশত ত্রিপুরাবাবু সুরপতিকে তাঁর ম্যাজিক শেখাতে রাজী হয়েছিলেন। সুরপতি টাকার কথা তোলাতে তিনি তীব্র আপত্তি করেন। বলেন, ‘তুমি ও কথা তুলো না। আমার একজন উত্তরাধিকারী হল, এইটেই বড় কথা। তোমার যখন এত শখ, এত উৎসাহ, তখন আমি শেখাব। তবে তাড়াহুড়ো কোরো না। এটা একটা সাধনা। তাড়াহুড়োয় কিচ্ছু হবে না। ভালো করে শিখে নিলে একটা সৃষ্টির আনন্দ পাবে। খুব বেশি টাকা বা খ্যাতির আশা কোরো না। অবিশ্যি আমার দুর্দশা তোমার কোনদিনই হবে না, কারণ তোমার মধ্যে অ্যাম্বিশন আছে, আমার নেই…’

    সুরপতি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, সব ম্যাজিক শেখাবেন তো? ওই আধুলি আর আংটির ম্যাজিকটাও শেখাবেন তো?

    ত্রিপুরাবাবু হেসে বলেছিলেন, ধাপে ধাপে উঠতে হবে। ব্যস্ত হোয়ো না। লেগে থাকো। সাধনা চাই। এসব পুরাকালের জিনিস। মানুষের মনে যখন সত্যিকারের জোর ছিল, একাগ্রতা ছিল, তখন উদ্ভব হয় এসব ম্যাজিকের। আজকের মানুষের পক্ষে মনকে সে-স্তরে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। আমার কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জান?’

    ত্রিপুরাবাবুর কাছে যখন প্রায় ছ’ মাস তালিম নেওয়া হয়ে গেছে সেই সময় একটা ব্যাপার ঘটে।

    একদিন কলেজ যাবার পথে সুরপতি চৌরঙ্গীর দিকে লক্ষ করল, চারিদিকে দেয়ালে, ল্যাম্পপোস্টে আর বাড়ির গায়ে রঙীন বিজ্ঞাপন পড়েছে—‘শেফাল্লো দি গ্রেট।’ কাছে গিয়ে বিজ্ঞাপন পড়ে সুরপতি বুঝল শেফাল্লো একজন বিখ্যাত ইতালীয় জাদুকর—কলকাতায় আসছেন তাঁর খেলা দেখাতে। সঙ্গে আসছেন সহজাদুকরী মাদাম প্যালার্মো।

    নিউ এম্পায়ারেই এক টাকার গ্যালারিতে বসে শেফাল্লোর ম্যাজিক দেখেছিল সুরপতি। আশ্চর্য চোখ-ধাঁধানো মন-ধাঁধানো ম্যাজিক সব। এতদিন এসব ম্যাজিকের কথা সুরপতি কেবল বইয়েই পড়েছে। চোখের সামনে গোটা গোটা মানুষ ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার আলাদিনের প্রদীপের ভেল্কির মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে। একটি মেয়েকে কাঠের বাক্সের মধ্যে পুরে বাক্সটাকে করাত দিয়ে কেটে আধখানা করে দিলেন শেফাল্লো, আবার পাঁচ মিনিট পরেই মেয়েটি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল অন্য আরেকটা বাক্সের ভিতর থেকে তার গায়ে একটি আঁচড়ও নেই। সুরপতির হাতের তেলো সেদিন লাল হয়ে গিয়েছিল হাততালির চোটে।

    আর শেফাল্লোকে লক্ষ করে বার বার অবাক হচ্ছিল সেদিন সুরপতি। লোকটা যেমন জাদুকর, তেমনি অভিনেতা। পরনে কালো চকচকে স্যুট, হাতে ম্যাজিক-ওয়ান্ড, মাথায় টপ-হ্যাট। সেই হ্যাটের ভিতর থেকে জাদুবলে কীই না বার করলেন শেফাল্লো। একবার খালি হ্যাটে হাত ঢুকিয়ে কান ধরে একটা খরগোশ টেনে বার করলেন। বেচারা সবে কানঝাড়া শেষ করেছে এমন সময় বেরোল পায়রা—এক, দুই, তিন, চার। ফরফর করে স্টেজের চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল ম্যাজিক পায়রা। ওদিকে শেফাল্লো ততক্ষণে সেই একই হ্যাটের ভিতর থেকে চকোলেট বের করে দর্শকদের মধ্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন।

    আর এর সবকিছুর সঙ্গে চলেছে শেফাল্লোর কথা। যাকে বলে কথার তুবড়ি। সুরপতি বইয়ে পড়েছিল যে একে বলে ‘প্যাটর’। এই ‘প্যাটর’ হল ম্যাজিশিয়ানদের একটা প্রধান অবলম্বন। দর্শক যখন এই প্যাটরের স্রোতে নাকানি-চোবানি খাচ্ছেন, ম্যাজিশিয়ান সেই ফাঁকে হাতসাফাইয়ের আসল কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন।

    কিন্তু এর আশ্চর্য ব্যতিক্রম হলেন মাদাম প্যালার্মো। তাঁর মুখে একটি কথা নেই। নির্বাক কলের পুতুলের মতো খেলা দেখিয়ে গেলেন তিনি। তাহলে তাঁর হাতসাফাইগুলো হয় কোন্ ফাঁকে? এর উত্তরও সুরপতি পরে জেনেছিল। স্টেজে এমন ম্যাজিক দেখানো সম্ভব যাতে হাত সাফাইয়ের কোন প্রয়োজন হয় না। সেসব ম্যাজিক নির্ভর করে কেবল যন্ত্রের কারসাজির উপর এবং সেসব যন্ত্র চালানোর জন্য স্টেজের কালো পর্দার পিছনে লোক থাকে। মানুষকে দুভাগে ভাগ করে কেটে আবার জুড়ে দেওয়া, বা ধোঁয়ার ভিতর অদৃশ্য করে দেওয়া—এসবই কলকব্জার ব্যাপার। তোমার যদি পয়সা থাকে, তুমিও সেই সব কলকব্জা কিনে বা তৈরি করিয়ে সেই সব ম্যাজিক দেখাতে পার। অবিশ্যি ম্যাজিকগুলো জমিয়ে, রসিয়ে সাজপোশাকের বাহারে চিত্তাকর্ষক করে দেখানোর মধ্যেও একটা বাহাদুরি আছে, আর্ট আছে। সবাইয়ের সে আর্ট জানা নেই, কাজেই পয়সা থাকলেই বড় ম্যাজিশিয়ান হওয়া যায় না। সবাই কি আর—

    সুরপতির স্মৃতিজাল হঠাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

    ট্রেনটা একটা প্রকাণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে দরজা খুলে কামরার মধ্যে ঢুকেছে—এ কী! সুরপতি হাঁ-হাঁ করে উঠে বাধা দিতে গিয়ে থমকে থেমে গেল।

    এ যে সেই ত্রিপুরাবাবু! ত্রিপুরাচরণ মল্লিক!

    এরকম অভিজ্ঞতা সুরপতির আরো কয়েকবার হয়েছে। একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে হয়তো অনেককাল দেখা নেই। হঠাৎ একদিন তাঁর কথা মনে পড়ল বা তাঁর বিষয়ে আলোচনা হল, আর পরমুহূর্তেই সশরীরে সেই লোক এসে হাজির।

    কিন্তু তাও সুরপতির মনে হল যে ত্রিপুরাবাবুর আজকের এই আবির্ভাবটা যেন আগের সব ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে।

    সুরপতি কয়েক মুহূর্ত কোন কথাই বলতে পারল না। ত্রিপুরাবাবু ধুতির খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাতের একটা পোঁটলা মেঝেতে রেখে সুরপতির বেঞ্চের বিপরীত কোণটাতে বসলেন। তারপর সুরপতির দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, ‘অবাক লাগছে, না?’

    সুরপতি কোনমতে ঢোক গিলে বলল, ‘অবাক মানে—প্রথমত, আপনি যে বেঁচে আছেন তাই আমার ধারণা ছিল না।’

    ‘কী রকম?’

    ‘আমি আমার বি.এ. পরীক্ষার কিছুদিন পরেই আপনার মেসে যাই। গিয়ে দেখি তালা বন্ধ। ম্যানেজারবাবু—নাম ভুলে গেছি—বললেন যে আপনি নাকি গাড়ি চাপা পড়ে…’

    ত্রিপুরাবাবু হোহো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘সেরকম হলে তো বেঁচেই যেতাম! অনেক ভাবনাচিন্তা থেকে রেহাই পেতাম।’

    সুরপতি বলল, ‘আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে—আমি এই কিছুদিন আগেই আপনার কথা ভাবছিলাম।’

    ‘বল কী? ত্রিপুরাবাবুর চোখেমুখে যেন একটা বিষাদের ছায়া পড়ল। আমার কথা ভাবছিলে? এখনো ভাবো আমার কথা? শুনে আশ্চর্য হলাম।’

    সুরপতি জিভ কাটল। ‘এটা আপনি কী বলছেন ত্রিপুরাবাবু! আমি কি অত সহজে ভুলি? আমার হাতেখড়ি যে আপনার হাতেই। আজ বিশেষ করে পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল। আজ বাইরে যাচ্ছি ‘শো’ দিতে। এই প্রথম বাংলার বাইরে।—আমি যে এখন পেশাদারী ম্যাজিশিয়ান তা আপনি জানেন কি?’

    ত্রিপুরাবাবু মাথা নাড়লেন।

    ‘জানি। সব জানি। সব জেনেশুনেই, তোমার সঙ্গে দেখা করব বলেই আজ এসেছি। এই বারো বছর তুমি কী করেছ না করেছ, কী ভাবে তুমি বড় হয়েছ, এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছ—এর কোনোটাই আমার অজানা নেই। সেদিন নিউ এম্পায়ারে ছিলাম আমি, প্রথম দিন। একেবারে পিছনের বেঞ্চিতে। সবাই তোমার কলাকৌশল কেমন অ্যাপ্রিসিয়েট করল তা দেখলাম। কিছুটা গর্ব হচ্ছিল বটেই। কিন্তু—’

    ত্রিপুরাবাবু থেমে গেলেন। সুরপতিও কিছু বলার খুঁজে পেল না। কীই বা বলবে সে? ত্রিপুরাবাবু যদি কিছুটা ক্ষুণ্ণ বোধ করেন তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। সত্যিই উনি গোড়াপত্তনটা না করিয়ে দিলে সুরপতির আজ এতটা উন্নতি হত না। আর তার প্রতিদানে সুরপতি কীই বা করেছে? বরং উলটা এই বারো বছরে ক্রমশ তার মন থেকে ত্রিপুরাবাবুর স্মৃতি মুছে এসেছে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাবটাও যেন কমে এসেছে।

    ত্রিপুরাবাবু আবার শুরু করলেন, ‘গর্ব আমার হয়েছিল তোমার সেদিনের সাক্সেস দেখে। কিন্তু তার সঙ্গে আপসোসও ছিল। কেন জান? তুমি যে রাস্তা বেছে নিয়েছ, সেটা খাঁটি ম্যাজিকের রাস্তা নয়। তোমার ব্যাপারটা অনেকখানি লোকভুলানো রং-তামাশা, অনেকখানি যন্ত্রের কৌশল। তোমার নিজের কৌশল নয়। অথচ আমার ম্যাজিক মনে আছে তোমার?’

    সুরপতি ভোলে নি। কিন্তু সেই সঙ্গে এও মনে ছিল তার যে ত্রিপুরাবাবু যেন তাঁর সেরা ম্যাজিকগুলো তাকে শেখাতে দ্বিধা বোধ করতেন। তিনি বলতেন, ‘এখনো সময় লাগবে।’ সেই সময় আর কোনদিন আসে নি। তার আগেই এসে পড়লো শেফাল্লো, আর তার দু’মাসের মধ্যেই ত্রিপুরাবাবু উধাও।

    কিছুটা বিস্ময় ও কিছুটা আপসোস সুরপতির হয়েছিল সেদিন—মেসে গিয়ে ত্রিপুরাবাবুকে না পেয়ে। কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। কারণ তখনও তার মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে শেফাল্লো। শেফাল্লোর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সে অনেক স্বপ্নজাল বোনে। দেশে দেশে ম্যাজিক দেখিয়ে রোজগার করবে, নাম করবে, লোককে আনন্দ দেবে, লোকের হাততালি পাবে, বাহবা পাবে।

    ত্রিপুরাবাবু অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছেন। সুরপতি তাঁকে একবার ভালো করে দেখল। ভদ্রলোককে সত্যিই দুঃস্থ বলে মনে হচ্ছে। মাথার চুল প্রায় সমস্ত পেকে গেছে, গালের চামড়া আলগা হয়ে এসেছে, চোখ ঢুকে গেছে কোটরের ভিতরে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি কি ম্লান হয়েছে কিছু? মনে তো হয় না। আশ্চর্য তীক্ষ্ণ চাহনি ভদ্রলোকের।

    ত্রিপুরাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অবিশ্যি তুমি কেন এ পথ বেছে নিয়েছ জানি। আমি জানি তুমি বিশ্বাস কর—হয়তো আমিই তার জন্য কিছুটা দায়ী—যে খাঁটি জিনিসের কদর নেই। স্টেজে ম্যাজিক চালাতে গেলে একটু চটক চাই, চাকচিক্য চাই। তাই নয় কি?’

    সুরপতি অস্বীকার করল না। শেফাল্লো দেখার পর থেকেই তার এ ধারণা হয়েছিল। কিন্তু জাঁকজমক মানেই কি খারাপ? আজকাল দিনকাল বদলেছে। বিয়ের আসরে ফরাসের উপর বসে ম্যাজিক দেখিয়ে কীই বা রোজগার করবে তুমি, আর কেই বা জানবে তোমার নাম? ত্রিপুরাবাবুর অবস্থাটা তো সে নিজের চোখেই দেখেছে। খাঁটি ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যদি মানুষের পেট না চলে তো সে ম্যাজিকের সার্থকতা কোথায়?

    সুরপতি ত্রিপুরাবাবুকে শেফাল্লোর কথা বলল। যে-জিনিস হাজার হাজার দর্শক দেখে আনন্দ পাচ্ছে, তারিফ করছে, তার কি কোনই সার্থকতা নেই? খাঁটি ম্যাজিক তো সুরপতি অশ্রদ্ধা করছে না। কিন্তু সে পথে কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই সুরপতি এই পথ বেছে নিয়েছে।

    ত্রিপুরাবাবু হঠাৎ যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বেঞ্চির উপর পা তুলে দিয়ে তিনি সুরপতির দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

    ‘শোনো সুরপতি, তুমি যদি সত্যিই বুঝতে পারতে আসল ম্যাজিক কী জিনিস তাহলে তুমি নকলের পিছনে ধাওয়া করতে না। হাতসাফাই তো ওর শুধু একটা মাত্র অঙ্গ। অবিশ্যি তারও যে কত শ্রেণীবিভাগ আছে তার শেষ নেই। যৌগিক ক্রিয়ার মতো সে-সব সাফাই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অভ্যাস করতে হয়। কিন্তু এ ছাড়াও তো আরো কত কী আছে। হিপ্‌নটিজ্‌ম! কেবল চোখের চাহনির জোরে মানুষকে সম্পূর্ণ তোমার বশে এনে ফেলতে পারবে। এমন বশ করবে যে সে তোমার হাতে কাদা হয়ে যাবে। তারপর ক্লেয়ারভয়েন্স, বা টেলিপ্যাথি, বা থটরীডিং। অপরের চিন্তার জগতে তুমি অবাধ চলাফেরা করতে পারবে। একজনের নাড়ী টিপে বলে দেবে সে কী ভাবছে। তেমন তেমন শেখা হয়ে গেলে পরে তাকে স্পর্শও করতে হবে না। কেবল মিনিট খানেক তার চোখের দিকে চেয়ে থাকলেই তার মনের কথা, পেটের কথা সব জেনে ফেলবে। এসব কি কম ম্যাজিক? জগতের সব সেরা ম্যাজিকের মূল হচ্ছে এইসব জিনিস। এতে কলকব্জার কোন ব্যাপারই নেই। আছে শুধু সাধনা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা।’

    ত্রিপুরাবাবু দম নেবার জন্য থামলেন। ট্রেনের শব্দের জন্য তাঁকে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছিল। তাতে বোধ হয় তিনি আরো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এবারে তিনি সুরপতির দিকে আরো এগিয়ে এসে বললেন, আমি তোমাকে এর সব কিছুই শেখাতে চেয়েছিলুম, কিন্তু তুমি গ্রাহ্য করলে না। তোমার তর সইল না। একজন বিদেশী বুজরুকের বাইরের জাঁকজমক তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিল। আসল পথ ছেড়ে যে পথে চট করে অর্থ হয়, খ্যাতি হয়, সেই পথে চলে গেলে তুমি।’

    সুরপতি নির্বাক। সত্যি করে এর কোন অভিযোগেরই প্রতিবাদ সে করতে পারে না।

    ত্রিপুরাবাবু এবার সুরপতির কাঁধে একটা হাত রেখে গলার স্বর একটু নরম করে বললেন: ‘আমি তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি সুরপতি। আমায় দেখে বুঝেছ কিনা জানি না—আমার অবস্থা খুবই খারাপ। এত জাদু জানি, কিন্তু টাকা করার জাদুটা এখনও অজানা রয়ে গেছে। অ্যাম্বিশনের অভাবই আমার কাল হয়েছে, নাহলে কি আর আমার অন্নচিন্তা করতে হয়? আমি এখন মরিয়া হয়েই এসেছি তোমার কাছে সুরপতি। আমি নিজে যে নিজের পায়ে দাঁড়াব সে শক্তি আর নেই, বয়সও নেই। কিন্তু আমার এটুকু বিশ্বাস আছে যে আমার এ দুর্দিনে তুমি আমাকে—কিছুটা স্যাক্রিফাইস করেও—সাহায্য করবে। ব্যস্‌—তারপর আর আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।’

    সুরপতির মনটা ধাঁধিয়ে উঠল। কী সাহায্য চাইছেন ভদ্রলোক? ত্রিপুরাবাবু বলে চললেন, ‘তোমার কাছে হয়তো প্ল্যানটা একটু রূঢ় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। মুশকিল হচ্ছে কি, আমার যে শুধু টাকারই প্রয়োজন তা নয়। বুড়ো বয়সে একটা নতুন শখ হয়েছে, জান। একসঙ্গে অনেকগুলো লোকের সামনে আমার সেরা খেলাগুলো একবার দেখাতে ইচ্ছে করছে। হয়তো এই প্রথম এবং এই শেষবার, কিন্তু তাও এ শখটাকে কিছুতেই দমন করতে পারছি না সুরপতি!’

    একটা অজানা আশঙ্কা সুরপতির বুকটাকে কাঁপিয়ে দিল।

    ত্রিপুরাবাবু এবার তাঁর আসল প্রস্তাবটা পাড়লেন।

    ‘লক্ষৌতে তোমার ম্যাজিক দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি সেখানেই যাচ্ছ। ধরো যদি শেষ মুহূর্তে তোমার অসুখ করে! দর্শককে একেবারে হতাশ করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেয়ে ধরো যদি তোমার জায়গায় আর কেউ…।’

    সুরপতি হকচকিয়ে গেল। ত্রিপুরাবাবু বলেন কী! সত্যিই মরিয়া হয়েছেন ভদ্রলোক, নাহলে এমন অদ্ভুত প্রস্তাব করেন কী করে?

    সুরপতি চুপ করে আছে দেখে ত্রিপুরাবাবু বললেন, ‘অনিবার্য কারণ হেতু তোমার বদলে তোমার গুরু ম্যাজিক দেখাবেন—এইভাবেই খবরটা দিয়ে দেবে তুমি। এতে কি লোক খুব হতাশ হবে বলে মনে হয়? আমার তো তা মনে হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমার ম্যাজিক লোকের ভালোই লাগবে। কিন্তু তাও আমি প্রস্তাব করি যে প্রথম দিনের হিসেবে তোমার যা টাকা পাওনা হত, তার অর্ধেক তুমিই পাবে। তাতে আমার ভাগে যা থাকবে তাতেই আমার চলে যাবে। তারপর তুমি যেমন চলছ চলো। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না। কেবল এই একদিনের সুযোগটুকু তোমাকে করে দিতেই হবে সুরপতি!

    সুরপতির মাথা গরম হয়ে উঠেছে।

    ‘অসম্ভব! আপনি কী বলছেন আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না ত্রিপুরাবাবু। বাংলার বাইরে এই আমার প্রথম প্রদর্শনী। লক্ষৌয়ের ‘শো’-এর উপর কত কিছু নির্ভর করছে তা আপনি বুঝতে পারছেন না? আমার কেরিয়ারের গোড়াতেই আমি একটা মিথ্যের আশ্রয় নেব? কি করে ভাবছেন আপনি এমন কথা?’

    ত্রিপুরাবাবু স্থির দৃষ্টিতে সুরপতির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ট্রেনের শব্দের উপর দিয়ে তাঁর ধীর, সংযত কণ্ঠস্বর সুরপতির কানে ভেসে এল।

    ‘সেই আধুলি আর আংটির ম্যাজিকের উপর তোমার এখনো লোভ আছে কি?’

    সুরপতি চমকে উঠল। কিন্তু ত্রিপুরাবাবুর চাহনিতে কোন পরিবর্তন নেই।

    ‘কেন?’

    ত্রিপুরাবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজী হও তাহলে আমি তোমায় ম্যাজিকটা শিখিয়ে দেব। যদি এখনই কথা দাও তো এখনই। আর যদি না দাও—’

    হুইশল্‌-এর বিকট শব্দ করে একটা হাওড়াগামী ট্রেন সুরপতিদের ট্রেনের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার কামরার আলোয় ত্রিপুরাবাবুর চোখ বার বার ধকধক করে জ্বলে উঠল। আলো আর শব্দ মিলিয়ে গেলে পর সুরপতি জিজ্ঞাসা করল, ‘আর যদি রাজী না হই?’

    ‘তাহলে ফল ভালো হবে না সুরপতি। তোমার একটা কথা জানা দরকার। আমি যদি দর্শকের মধ্যে উপস্থিত থাকি তাহলে ইচ্ছা করলে আমি যে-কোন জাদুকরকে অপদস্থ, নাকাল এমন কি একেবারে অকেজো করে দিতে পারি।’

    ত্রিপুরাবাবু তাঁর কোটের পকেট থেকে একজোড়া তাস সুরপতির দিকে এগিয়ে দিলেন।

    ‘দেখাও তো দেখি তোমার হাতসাফাই! কঠিন কিছু না। একেবারে প্রাথমিক সাফাই। পিছনের এই গোলামটা সামনের এই তিরির উপর নিয়ে এসো দেখি হাতের ঝাঁকানিতে।’

    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ষোলো বছর বয়সে সুরপতির এই সাফাইটা আয়ত্ত করতে লেগেছিল মাত্র সাতদিন।

    আর আজ?

    সুরপতি তাস হাতে নিয়ে দেখল তার আঙুল অবশ হয়ে আসছে। শুধু আঙুল নয়, আঙুল, কব্জি, কনুই একেবারে—পুরো হাতটাই অবশ। ঝাপসা চোখে সুরপতি দেখল ত্রিপুরাবাবুর ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি; এক অমানুষিক তীক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন তিনি সুরপতির চোখের দিকে। সুরপতির কপাল ঘেমে গেল, সর্বাঙ্গে একটা কাঁপুনির লক্ষণ অনুভব করল সে।

    ‘এবার বুঝেছ আমার ক্ষমতা?’

    সুরপতির হাত থেকে তাসের প্যাকেটটা আপনা থেকেই পড়ে গেল বেঞ্চির উপরে। ত্রিপুরাবাবু তাসগুলো গোছ করে তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘রাজী আছ?’

    সুরপতির অসুস্থ অবশ ভাবটা কেটে গেছে।

    সে ক্লান্ত ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাজিকটা শেখাবেন তো?’

    ত্রিপুরাবাবু তাঁর ডান হাতের তর্জনী সুরপতির নাকের সামনে তুলে ধরে বললেন, ‘লক্ষৌ’য়ের প্রথম শোতে তোমার অসুস্থতাহেতু তোমার পরিবর্তে তোমার গুরু ত্রিপুরাচরণ মল্লিক তাঁর জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করবে। তাই তো?’

    ‘হ্যাঁ, তাই।’

    ‘তুমি তোমার প্রাপ্য টাকার অর্ধেক আমাকে দেবে। ঠিক তো?’

    ‘ঠিক।’

    ‘তবে এসো।’

    সুরপতি পকেট হাতড়ে একটা আধুলি, আর নিজের আঙুল থেকে পলাবসানো আংটিটা খুলে ত্রিপুরাবাবুকে দিল।…

    * *

    বর্ধমানে গাড়ি থামতে চা নিয়ে তার ‘বস’-এর কামরার সামনে এসে অনিল দেখে সুরপতি ঘুমে অচেতন। অনিল একটু ইতস্তত করে একবার ‘স্যার’ বলে মৃদু শব্দ করতেই সুরপতি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

    ‘কী…কী ব্যাপার?’

    ‘আপনার চা এনেচি স্যার। ডিসটার্ব করলুম, কিছু মনে করবেন না।’

    ‘কিন্তু…?’ সুরপতি উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টিতে কামরার এদিক-ওদিক দেখতে লাগল।

    ‘কী হল স্যার?’

    ‘ত্রিপুরাবাবু…?’

    ‘ত্রিপুরাবাবু?’ অনিল হতভম্ব।

    ‘না, না…উনি তো সেই ফিফ্‌টি-ওয়ানে…বাস চাপা পড়ে…কিন্তু আমার আংটি?’

    ‘কোন্ আংটি স্যার? আপনার পলাটা তো হাতেই রয়েছে।

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর…’

    সুরপতি পকেটে হাত দিয়ে একটা আধুলি বার করল। অনিল লক্ষ করল সুরপতির হাত থরথর করে কাঁপছে।

    ‘অনিল, ভেতরে এসো তো একবার। চট করে এসো। ওই জানালাগুলো বন্ধ করো তো। হ্যাঁ, এইবার দেখো।’

    সুরপতি বেঞ্চির এক মাথায় আংটি আর অন্য মাথায় আধুলিটা রাখল। তারপর ইষ্টনাম জপ করে যা-থাকে-কপালে করে স্বপ্নে-পাওয়া কৌশল প্রয়োগ করল আধুলির দিকে তীব্র সংহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

    আধুলিটা বাধ্য ছেলের মতো গড়িয়ে আংটির কাছে গিয়ে সেটাকে সঙ্গে নিয়ে সুরপতির কাছে গড়িয়ে ফিরে এল।

    অনিলের হাত থেকে চায়ের পেয়ালাটা পড়ে যেত যদি না সুরপতি অদ্ভুত হাতসাফাইয়ের বলে সেটাকে পড়ার পূর্বমুহূর্তেই নিজের হাতে নিয়ে নিত।

    লক্ষৌয়ে জাদুপ্রদর্শনীর প্রথম দিন পর্দা উঠলে পর সুরপতি মণ্ডল সমবেত দর্শকমণ্ডলীর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর স্বৰ্গত জাদুবিদ্যাশিক্ষক ত্রিপুরাচরণ মল্লিকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করল।

    আজ প্রদর্শনীর শেষ খেলা—যেটাকে সুরপতি খাঁটি দেশী ম্যাজিক বলে আখ্যা দিল—হল আংটি ও আধুলির খেলা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকেই বলে শুটিং – সত্যজিৎ রায়
    Next Article আরো এক ডজন – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }