Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    বার্ট্রান্ড রাসেল এক পাতা গল্প222 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. ‘অকেজো’ জ্ঞান

    অধ্যায় ২ – ‘অকেজো’ জ্ঞান

    ফ্রান্সিস বেকন, যিনি তাঁর বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে খ্যাতি অর্জন করেন, জোর দিয়ে বলেছেন, জ্ঞানই হলো শক্তি। তবে সকল জ্ঞান সম্বন্ধেই এটা সত্য নয়। স্যার টমাস ব্রাউন ইচ্ছাপোষণ করতেন সাইরেনরা কী গান করে তা জানা। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে পারলেও এটা তাঁকে হাকিম থেকে হাই শেরিফ (High Sheriff) হতে সমর্থ করত না। যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলি সেই ধরনের জ্ঞানের কথা ছিল বেকনের মনে। বিজ্ঞানের উপর তিনি যে গুরুত্ব আরোপ করলেন তাতে কিন্তু আরব্য এবং মধ্যযুগের প্রথম দিকের ঐতিহ্য দেরিতে বহন করা হলো। ঐ ঐতিহ্য অনুসারে জ্ঞান প্রধানত গঠিত জ্যোতিষবিদ্যা, আলকেমি ও ভেষজবিজ্ঞান নিয়ে; এই সবগুলিই বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে গণ্য হতো। বিদ্বান ব্যক্তি তাকেই মনে করা হতো যিনি এইসব বিজ্ঞানে ব্যুৎপন্ন, এবং ফলে জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বিতীয় সিলভেস্টার পোপকে, অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু অনেক বই পড়েছেন বলে সার্বজনীনভাবে বিশ্বাস করা হতো জাদুকর হিসেবে এবং আরো মনে করা হতো যে, তিনি ভূ-প্রেতের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। প্রসপেরো, যিনি শেক্সপিয়রের সময়ে ছিলেন কাল্পনিক চরিত্র মাত্র, অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্বানব্যক্তি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছে তাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, অন্তত তার জাদুকরী ক্ষমতার জন্য। আমরা এখন যেমন জেনেছি, বেকন সঠিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিতে পারে অধিকতর শক্তিশালী জাদুদণ্ড, যে দণ্ড সম্পর্কে অতীতকালের প্রেসিদ্ধ ব্যক্তিগণ স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতেন না।

    রেনেসাঁস, যা বেকনের সময়ে ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে, জ্ঞানের উপযোগবাদী ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রিকরা হোমারের পরিচিতি অর্জন করে, আমরা যেমন মিউজিক হলের গান সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখি। কারণ হোমারের লেখা উপভোগ তারা করতেন, এবং তাদের মধ্যে কিন্তু এমন বোধ কাজ করত না যে তারা জ্ঞানানুসন্ধান করছেন। কিন্তু ষোড়শ শতকের লোকেরা প্রথমে ব্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক বিদ্যা অর্জনের আগে তাঁকে বুঝতে শুরু করতে পারে নি। তাঁরা গ্রিকদের ভক্তি করতেন, এবং আনন্দ উপভোগে বঞ্চিত হতে ইচ্ছুক ছিলেন না; সুতরাং তারা গ্রিকদের অনুসরণ করতেন; ধ্রুপদী রচনাপাঠ এবং অন্যান্য উপায়ে। যে উপায়গুলো খুব সুস্পষ্ট নয়। রেনেসাঁসের সময়ে বিদ্যার্জন ছিল Joie de vivre-এর অংশ, সুরাপান ও যৌনকর্মের মতোই। এবং এটা শুধু সাহিত্য সম্পর্কেই সত্য নয়। অন্যান্য জটিলতার বিষয় সম্পর্কেও সত্য ছিল। ইউক্লিডের পুস্তকের সঙ্গে হবসের প্রথম পরিচয়ের গল্পটা সবাই জানেন; পুস্তকটি খোলর পর আকস্মিকভাবে তার চোখ পড়ে পিথাগোরাসের একটি উপপাদ্যে, তিনি বিস্ময়সূচক চিৎকার করে ওঠেন, হা ঈশ্বর, এ সম্ভব হতে পারে না এবং পেছন দিক থেকে সংশোধনী পাঠ করতে শুরু করেন যতক্ষণ না স্বতঃসিদ্ধে পৌঁছেন, এবং প্রমাণ দেখতে পান ও সত্যতা অনুভব করেন। কেউ সন্দেহ করতে পারবেন না যে এটা ছিল তাঁর জন্য বড় আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এই মুহূর্তে তিনি ক্ষেত্র জরিপের কাজে জ্যামিতির উপযোগিতার ভাবনা দ্বারা কলুষিত হন নি।

    সত্য যে, রেনেসাঁস ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরাকালীন ভাষাসমূহের ব্যবহারিক প্রয়োজন দেখতে পায়। ধ্রুপদী লাতিন ভাষার প্রতি নতুন প্রীতির প্রাথমিক ফল ছিল পোপের নির্দেশাবলি ও কনস্টান্টাইনের উপহার যে জাল ছিল তা ধরা পড়ল। বাইবেলের প্রাচীন লাতিন তর্জমায় (vulgate) এবং প্রাচীন গ্রিক তর্জমায় (Septuagint) যে ত্রুটিগুলো আবিষ্কৃত হয় তাতে প্রটেস্টান্ট পুরোহিতদের কাছে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা বিতর্কমূলক অস্ত্রের দরকারি অঙ্গে পরিণত হয়। প্রজাতান্ত্রিক গ্রিস ও রোমের নীতিমালার সহায়তা নেয়া হয় পিউরিটানদের ক্ষেত্রে স্টুয়ার্টদের প্রতিরোধ এবং জেসুইটদের ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রীদের প্রতিরোধ ন্যায়ানুগ করে তোলার জন্য। রাজতন্ত্রীরা পোপের প্রতি আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিলেন। তবে এসবই ধ্রুপদীবিদ্যা পুনরুজ্জীবনের প্রতিক্রিয়া, কারণ নয়, এবং লুথারের একশো বছর আগে থেকেই ধ্রুপদী বিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে ইতালিতে। রেনেসাঁসের প্রধান অভিপ্রায় ছিল মানসিক স্ফূর্তি এবং শিল্পকলা চর্চা ও কল্পনা প্রতিভা বৃদ্ধি ও বিকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, এই স্বাধীনতা হারিয়ে গিয়েছিল, স্থান লাভ করেছিল অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার, যা মনশ্চক্ষুতে ঠুলি পরিয়ে দেয়।

    দেখা গেল, গ্রিকরা তাদের মনোযোগর একটি অংশ এমন কিছু বিষয়ে নিবদ্ধ করেছিলেন যা বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ও শৈল্পিক নয়; তারা দর্শন, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয়ও চর্চা করেছেন। এই বিষয়গুলো চর্চা শ্রদ্ধেয় ব্যাপার ছিল। তবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। সত্য যে, হিপ্পোক্রাটিস ও গ্যালেনের নামের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র মর্যাদা লাভ করে; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে আরব দেশের লোক ও ইহুদিরাই শুধু এর চর্চা চালিয়ে যায় এবং জাদুটোনার সঙ্গে কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্যই প্যারাসেলসাস-এর মতো লোকদের খ্যাতি দ্ব্যর্থক। রসায়নশাস্ত্রের সঙ্গে আরো বাজে গন্ধ যুক্ত হয়। এবং এই শাস্ত্র অষ্টাদশ শতকের আগে মর্যাদা লাভ করেনি।

    এইভাবে গ্রিক ও লাতিন ভাষার জ্ঞান, সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান, হয়তো জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানও, ভদ্রলোকদের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। জ্যামিতিক জ্ঞানের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগকে গ্রিকরা অবজ্ঞা করতেন এবং শুধুমাত্র তাদের অবক্ষয়ের সময় জ্যোতিষশাস্ত্রের ছদ্মাবরণে জ্যোতির্বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী হেলেনীয় নিরাসক্তি নিয়ে প্রধানত গণিত শাস্ত্রের চর্চা করে, এবং বিজ্ঞানের যে শাখাগুলো ভেলকিবাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে মর্যাদা হারিয়েছিল সেগুলোর চর্চা এড়িয়ে চলার ঝোঁক দেখা যায়। জ্ঞানের ব্যাপকতর ব্যবহারিক ধারণার দিকে ক্রমিক পরিবর্তন, গোটা অষ্টাদশ শতকে চলেছে। ঐ সময়ের পর ফরাসি বিপ্লব এবং যন্ত্রপাতি বিকাশের দরুন পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হয়। ফরাসি বিপ্লব ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হানে। অপরপক্ষে যন্ত্রপাতি অদ্রলোকসুলভ দক্ষতা ব্যবহারের বিস্ময়কর সুযোগ সৃষ্টি করে। গত দেড়শো বছর জুড়ে মানুষ অকেজো জ্ঞানের মূল্য নিয়ে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর প্রশ্ন তুলেছে। এবং ক্রমান্বয়ে তাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে সেই জ্ঞান অর্জনই মূল্যবান যা সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো না কোনো অংশবিশেষে প্রয়োগ করা যায়।

    ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, জ্ঞান সম্পর্কিত উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মাত্র আংশিকভাবে স্থান লাভ করে। এখনও বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চৈনিক ভাষার অধ্যাপক রয়েছেন যারা চৈনিক ধ্রুপদী রচনা পড়েছেন, কিন্তু সান ইয়াৎ-সেনের রচনাকর্মের সঙ্গে পরিচিত নন, অথচ সান ইয়াৎ সেনের রচনাদি আধুনিক চীন সৃষ্টি করেছে। এখনও এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা প্রাচীন ইতিহাস একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন, যে পর্যায়ের রচয়িতাদের শৈলী বিশুদ্ধ অর্থাৎ তারা গ্রিসের ইতিহাস পড়েছেন আলেকজান্ডার পর্যন্ত, আর রোমের ইতিহাস পড়েছেন নিরো পর্যন্ত, কিন্তু পরবর্তীকালীন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পাঠ করতে অস্বীকার করেন। কারণ ঐ সময়ের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাদের বর্ণনারীতি নিকৃষ্ট। সে যাই হোক এমনকি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও পুরাতন প্রথা এখন মিয়মাণ এবং রুশদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো অধিকতর আধুনিক দেশগুলোতে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উদাহরণত, আমেরিকায় শিক্ষা পর্ষদ উল্লেখ করেছেন যে ব্যবসায়িক পত্রাদি রচনায় অধিকাংশ লোক মাত্র পনেরো শো শব্দ ব্যবহার করেন। সুতরাং তাদের উপদেশ স্কুলের পাঠ্যবিষয় থেকে বাকি শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। ইংরেজদের উদ্ভাবিত মৌলিক ইংরেজি আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এখানে আট শত শব্দ যথেষ্ট মনে করা হয়। নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে বক্তৃতার মূল্য রয়েছে এই ধারণা মারা যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে শব্দাবলির একমাত্র লক্ষ্য হলো ব্যবহারিক তথ্য পরিবেশন। রুশদেশে ব্যবহারিক লক্ষ্য উদ্ধারে আস্থা আমেরিকার চেয়েও আন্তরিক: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা-কিছু শেখানো হয় তা যেন শিক্ষা ও সরকার সম্পর্কে কোনো কাজে লাগে। একমাত্র কিছুটা মুক্তি পাওয়া গেছে ধর্মতত্ত্বের জন্য অতি পবিত্র বলে গণ্য ধর্মগ্রন্থ চর্চা করতে হবে মূল জার্মান ভাষায় এবং কিছু কিছু অধ্যাপককে দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে বুর্জোয়া পরাবিজ্ঞানীদের সমালোচনা থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ রক্ষার জন্য। তবে গোঁড়ামি যতই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ক্ষুদ্র ছিদ্রপথও ততই বন্ধ হয়ে যাবে।

    সর্বত্রই জ্ঞান ধীরে-ধীরে গণ্য হচ্ছে স্বয়ং শুভ হিসেবে নয়, কিংবা সাধারণভাবে জীবন সম্পর্কে প্রশস্ত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ার মাধ্যম হিসেবেও নয়, বরং গণ্য হচ্ছে নিতান্তই প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপাদান হিসেবে। এটি বৃহত্তর সামাজিক অখণ্ডতার অংশ যা সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তার জন্য। আজকের দিনে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরস্পরনির্ভরতা অতীতকালের চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং একজন লোকের উপর বিশেষ জীবন যাপনের চাপ অনেক বেশি। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, ধনীদের জন্য স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং (ইংল্যান্ডে) যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাচীনত্বের দাবিতে অভেদ্য হয়ে গেছে সেগুলি বাদে, তাদের ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করতে দেয়া হয় না, বরং তাদের রাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে তারা প্রয়োজনীয় অভীষ্ট বাস্তবায়ন করছেন ছাত্রদের দক্ষতা প্রদান এবং আনুগত্য শিখিয়ে। এটি সেই আন্দোলনের অনুরূপ যার পরিণতি দাঁড়িয়েছে বাধ্যতামূলক সামরিক চাকুরি, বয় স্কাউট, রাজনৈতিক দল সংগঠন, এবং পত্রিকাদি কর্তৃক রাজনৈতিক ভাববিলাস প্রচার। আমরা আগের চেয়ে স্বীয় স্বদেশবাসীর প্রতি অনেক বেশি সচেতন, এবং পুণ্যবান হয়ে থাকলে আমরা তাদের উপকার করার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকি এবং যা কিছুই ঘটুক না কেন তারা আমাদের উপকার করে। আমরা ভাবতেই পারি না যে একজন লোক অলসভাবে জীবন উপভোগ করবে, তার উপভোগের গুণাগুণ যতই সুরুচিপূর্ণ হোক না কেন। আমরা উপলব্ধি করি যে প্রত্যেক ব্যক্তি একটা মহৎ উদ্দেশ্য (সে যাই হোক) বাস্তবায়নের জন্য কিছু কাজ করবে। আরো এজন্য যে কত বাজে লোক এই মহৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং এটা স্তব্ধ করে দেয়া দরকার। আমাদের মন অবসর পায় না, অতএব আমাদের জ্ঞান অর্জন করে যেতে হবে, তবে এমন জ্ঞান নয় যা দিয়ে আমরা যা-কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তার জন্য লড়াই করতে সাহায্য পাই।

    শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক কথাই বলার আছে। জীবিকা অর্জনের শুরুর আগে সব কিছু শেখার সময় মেলে না এবং নিঃসন্দেহে কেজো জ্ঞান খুবই দরকারি। কেজো জ্ঞানই আধুনিক জগতের নির্মাতা। এই জ্ঞান না থাকলে আমরা যন্ত্রাদি, মোটর গাড়ি কিংবা রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজ পেতাম না; এখানে আরো যোগ করা যায় যে আধুনিক বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা কিংবা প্রচারণা পদ্ধতি আমাদের জুটত না। আধুনিক জ্ঞান মানুষের গড় স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে, আবার একই সময়ে আবিষ্কার করেছে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে কীভাবে বড় বড় শহর পৃথিবী-পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলা যায়। পূর্বেকার তুলনায় আমাদের জগৎ যে যে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট তার উৎস এই কেজো জ্ঞান। কোনো সম্প্রদায়ই এই জ্ঞান এখনও যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করেনি এবং নিঃসন্দেহে শিক্ষার দ্বারা এই জ্ঞানের প্রসার অবশ্যই ঘটাতে থাকবে।

    এটা স্বীকার করতে হবে যে প্রথাগত সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অনেকটাই ছিল বোকামিপূর্ণ। ছেলেরা বছরের পর বছর ব্যয় করে লাতিন ও গ্রিক ব্যাকরণ শেখে। পরিশেষে কিন্তু তারা গ্রিক বা লাতিন লেখকের পুস্তকাদি পাঠে সমর্থও হয় না, তাদের সে ইচ্ছাও থাকে না (নগণ্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে)। যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভাষাসমূহ এবং ইতিহাস, লাতিন ও গ্রিকের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এগুলো শুধু অধিকতর প্রয়োজনীয় নয়। এগুলো স্বল্প সময়ে অনেক বেশি সংস্কৃতি যোগায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন ইতালিবাসীর যা কিছু পড়ার দরকার ছিল তারা সে সব হাতের কাছে মাতৃভাষায় না পেলেও গ্রিক ও লাতিন ভাষায় অবশ্যই পেয়ে যেতেন, তাই এই ভাষাগুলো তাদের কাছে ছিল সংস্কৃতির অপরিহার্য চাবিকাঠি। কিন্তু সেই সময়ের পর মহৎ সাহিত্য বিভিন্ন আধুনিক ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে এবং সভ্যতার বিকাশ এতটা দ্রুত গতিতে সাধিত হয়েছে যে আমাদের সমস্যা বোঝার জন্য পুরাকাল সম্পর্কিত জ্ঞান হয়ে পড়েছে কম দরকারি অন্তত আধুনিক জাতিসমূহ এবং তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞানের তুলনায়। প্রথাগত স্কুল শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ, যা বিদ্যাবত্তার পুনরুজ্জীবনের সময় ছিল খুবই শ্রদ্ধেয়, ক্রমান্বয়ে অযথা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তারা পঞ্চদশ শতাব্দীর পর জগৎ কতটা অর্জন করেছে তা পাত্তা দেয়নি। অথচ শুধু ইতিহাস এবং আধুনিক ভাষা নয়, উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে অবদান রাখে। অতএব এটা ধরে নেয়া যায় যে প্রত্যক্ষ উপযোগী না হয়ে শিক্ষার অন্যবিধ লক্ষ্য থাকা দরকার, এবং প্রথাগত পাঠ্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব দেয়ারও দরকার নেই। উপযোগ ও সংস্কৃতি, যখন দুটিকেই বৃহত্তর পরিসরে ভাবা হয়, দেখা যায় তাদের মধ্যে অসামঞ্জস্য খুবই কম, যে কোনো একটির গোঁড়া প্রবক্তার কাছে অন্যরকম মনে হলেও।

    অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতি এবং প্রত্যক্ষ উপযোগকে সমন্বিত করা যায়, তবু বিভিন্ন ধরনের কিছু পরোক্ষ উপযোগ রয়েছে এমন জ্ঞানের অধিকারে যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে না। আমি মনে করি, আধুনিক জগতের অত্যন্ত বাজে কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধন সম্ভব এই ধরনের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে, এবং সাদামাটা পেশাদারী নৈপুণ্য অর্জনের পিছে একটু কম ছুটে।

    যখন সচেতন তৎপরতা কোনো এক বিশেষ লক্ষ্য হাসিলে নিয়োজিত হয়, তখন অধিংকাশ লোকের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফল দাঁড়ায় ভারসাম্যহীনতা, সঙ্গে যুক্ত হয় এক ধরনের স্নায়বিক বৈকল্য। যারা যুদ্ধকালে জার্মান নীতি পরিচালনা করেছেন তারা অনেক ভুল করেছেন, উদাহরণত, ডুবোজাহাজের ব্যবহার ব্যাপারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষ নেয়, অথচ নতুন কোনো লোক এই কাজটিতে (ডুবোজাহাজ ব্যবহার) বিজ্ঞতা দেখতেন না। কিন্তু তারা মাথা ঠিক রেখে ব্যাপারটা বিচার করতে পারেন নি, কারণ তারা মানসিকভাবে ছিলেন ভারাক্রান্ত, অবকাশ বা ছুটি তাদের মোটে জোটেনি। এই একই জিনিস দেখা যাবে যেখানে কতিপয় লোক এমন কাজে নিয়োজিত হয় যা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী, রুশ কম্যুনিস্ট এবং জার্মান নাৎসি, এদের সবার রয়েছে কঠিন গোঁড়ামি, যা একান্তভাবেই নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের মানসিক জগতে বাস করে। যখন কাজটি গোঁড়াদের অনুমান মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাব্য হয় তখন ফল দাঁড়ায় চমৎকার; কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কোনো বিরুদ্ধ শক্তি থাকলে তা ভুলে থাকা হয়, কিংবা উক্ত শক্তিকে শয়তানের কাজ বলে গণ্য করা হয়, যা মোকাবেলা করতে হবে শাস্তি এবং সন্ত্রাস দিয়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন বয়স্ক মানুষদেরও খেলাধুলা করার দরকার রয়েছে, কিংবা এমন একটা সময় তাদের থাকা দরকার যখন কাজের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে না, উপস্থিত আনন্দ উপভোগ ছাড়া। কিন্তু যদি খেলাধুলাকে উদ্দেশ্য সাধন করতে হয় তাহলে এমন ব্যাপারে সুখ ও উৎসাহ খুঁজে পাওয়া সম্ভব করে তুলতে হবে যার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক নেই।

    দেখা যায় যে আধুনিক শহরের লোকদের আমোদ-প্রমোদের ঝোঁক উত্তরোত্তর নিষ্ক্রিয় ও সমষ্টিগত হচ্ছে। অপরের দক্ষ কার্যকলাপ নিষ্ক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। সন্দেহ নেই, প্রমোদের ব্যবস্থা একেবারে না-থাকার চেয়ে এটা ভালো, কিন্তু সেই জনগোষ্ঠীর চেয়ে উত্তম হবে না শিক্ষার মাধ্যমে যারা বিস্তৃততর পরিসরে চিন্তাশীল উৎসাহে নিমগ্ন, এবং তা কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। উন্নততর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতা দ্বারা মানুষকে উপকৃত করবে, অবকাশ বৃদ্ধি করবে ব্যাপক হারে। আবার অতিরিক্ত অবসর একঘেয়ে হয়; কিন্তু যারা চিন্তাশীল কাজ ও উৎসাহের সঙ্গে জড়িত তাদের বেলায় একঘেয়ে হবে না। অবসরভোগী জনমানুষকে সুখী হতে হলে তাদের অবশ্যই শিক্ষিত হবে হবে। এবং (তাদের শিক্ষিত হতে হবে। একই সঙ্গে মানসিক উপভোগ এবং কারিগরি জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে।

    জ্ঞানোপার্জনে সাংস্কৃতিক উপাদান সফলতার সঙ্গে সমন্বিত হলে মানুষের চিন্তার ও বাসনার রূপ গঠন করে। তাদের সংশ্লিষ্ট করে অন্তত বিরাট নৈর্ব্যক্তিক বিষয়াদির সঙ্গে, তার জন্য যা আসন্ন গুরুত্বের শুধু সে সব ব্যাপারের সঙ্গে নয়। তাড়াহুড়ো করে ধারণা করা হয় যে যখন কোনো ব্যক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজের সামর্থ অর্জন করেছে তখন সে তার জ্ঞান শুধু সামাজিক সুফলের জন্য ব্যবহার করবে। শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগী মতবাদ মানুষের লক্ষ্য নির্ণয়ের সঙ্গে-সঙ্গে তার দক্ষতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে চলে। অপ্রশিক্ষিত মানবিক প্রকৃতিতে বিরাট আকারে নিষ্ঠুরতা থাকে, যা ছোট, বড়, নানা উপায়ে প্রকাশ পায়। ছেলেদের স্কুলে নতুন কোনো ছেলের প্রতি নির্দয় আচরণের ঝোঁক থাকে, কিংবা কারো পোশাক-আশাক যদি প্রচলিত ধাঁচের না হয় তাহলে তার প্রতি নির্দয়তা দেখায়। অনেক মহিলা (পুরুষের সংখ্যাও কম নয়) শুধু খোশগল্প করে দ্বেষ ছড়ায়। স্পেন দেশের লোকেরা ষাঁড়ের লড়াই উপভোগ করে; ব্রিটিশরা উপভোগ করে শিকার ও বন্দুক ব্যবহার। একই নির্দয় আবেগ গুরুতর রূপ নেয় জার্মানিতে ইহুদি এবং রাশিয়ায় কুলাক নির্যাতনে। সকল সাম্রাজ্য এ ধরনের কাজের সুযোগ করে দেয়। আর যুদ্ধের সময় এ ধরনের কাজ সর্বোচ্চ জনহিতকর কর্তব্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

    এখন, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে অত্যন্ত শিক্ষিত ব্যক্তিও অনেক সময় নির্দয় হয়ে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যাদের মন আকর্ষিত তাদের চেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে নির্দয়তার পরিমাণ কম হয়। স্কুলের একটি গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে শিক্ষার্জনে কম ক্ষেত্রেই গড় দক্ষতা দেখায়। হত্যাকাণ্ড হলে, দেখা যায়, হত্যার মূল নায়কেরা প্রায় ক্ষেত্রেই খুবই অজ্ঞ ব্যক্তি হয়ে থাকে। কারণ এই নয় যে মনন চর্চা সদর্থক মানবিক অনুভূতির জন্ম দেয়। তবে তা দিতেও পারে; কারণ হলো মনন চর্চা প্রতিবেশী নির্যাতনে প্রণোদিত না করে অন্য ক্ষেত্রে উৎসাহী করে, তাছাড়া আধিপত্যের মনোভাব তৈরি না করে, আত্ম-সম্মান অর্জনের ভিন্ন উৎসের দিকে চালিত করে। যে দুটি জিনিস সার্বজনীনভাবে কামনা করা হয় তা হলো ক্ষমতা ও শ্রদ্ধা। অজ্ঞ ব্যক্তি বন্য উপায়ে কেবল যে কোনো একটি অর্জন করতে পারে। এতে পরিবেশের উপর প্রভুত্ব অর্জন অন্তর্ভুক্ত হয়। সংস্কৃতি মানুষকে যে ক্ষমতা দেয় তা কম ক্ষতিকর, এবং এটা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সর্বোকৃষ্ট পন্থা। যে কোনো সম্রাটের চেয়ে গ্যালিলিও বেশি কাজ করেছেন পৃথিবী পরিবর্তন করার জন্য এবং তাঁর ক্ষমতা তার নির্যাতনকারীর ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সুতরাং তার নিজের নির্যাতনকারীতে পরিণত হওয়ার দরকার করেনি।

    অকেজো জ্ঞানের সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা এখানে যে এটা মনের চিন্তাশীল অভ্যাসের উন্নয়ন ঘটায়। এই পৃথিবীতে অতি বেশি প্রস্তুতি রয়েছে শুধু কোনো প্রকার পূর্ব চিন্তা ছাড়াই কাজের জন্য, মাঝে মাঝে এমন কাজের জন্যও যে কাজ সম্পর্কে প্রজ্ঞার উপদেশ হবে নিষ্ক্রিয় থাকা। জনগণ এ ব্যাপারে তাদের পক্ষপাত দেখায় নানাভাবে এবং বিশ্রীভাবে। মেফিস্টোফেলিস তার তরুণ ছাত্রদের বলেন যে, তত্ত্ব ধূসর কিন্তু জীবনবৃক্ষ সবুজ এবং সবাই এই উক্তি এমনভাবে উদ্ধৃত করেন যেন এটা গ্যেটের অভিমত, ভেবে দেখা হয় না, গ্যেটের মতে, শয়তান তার প্রাগাতক ছাত্রদের কী বলতে পারে। হ্যামলেটকে দেখানো হয় কাজহীন চিন্তার ভয়ানক সাবধানবাণী হিসেবে, কিন্তু কেউ ওথেলোকে দেখান না চিন্তাহীন কাজের সাবধানবাণী হিসেবে। বার্গসের মতো প্রফেসর, বাস্তববাদী মানুষের প্রতি এক ধরনের স্বপ্নারিবশত দর্শনের নিন্দা করেন এবং বলেন সর্বোৎকৃষ্ট জীবন হবে অগ্রসরমান অশ্বারোহী সৈনিকের অনুরূপ। আমার দিক থেকে বলতে পারি, কাজ সূচিত হবে ব্রহ্মাণ্ড এবং মানবতার অদৃষ্ট সম্পর্কে গভীর বোধ থেকে, বল্গাহীন রোমান্টিক আসক্তি এবং অতিরিক্ত আত্ম-জাহিরের প্রবণতা থেকে নয়। কাজ নয়, চিন্তায় আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অভ্যাস প্রজ্ঞাহীনতা ও অতিরিক্ত ক্ষমতা লিপ্সার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ, দুর্ভাগ্যেও নির্মল স্থৈর্য এবং উদ্বেগের মধ্যে মনের প্রশান্তি রক্ষার উপায়। ব্যক্তিত্বে নিমগ্ন জীবন, আগে হোক পরে হোক, অসহনীয় যন্ত্রণাকর হতে পারে; কেবল বৃহত্তর ও কম বিরক্তিকর বিশ্বের জানলা খোলা রেখে জীবনের হতাশজনক দিক সহনীয় করা যায়।

    মনের চিন্তাশীলতা অভ্যাসের সুবিধা একই সঙ্গে অতি-তুচ্ছ এবং অত্যন্ত গভীর। ডানা-হীন ক্ষুদ্রকীট, ট্রেন ধরতে না-পারা কিংবা বদমেজাজী ব্যবসাসঙ্গীর মতো ছোটখাটো বিরক্তিকর ব্যাপার দিয়ে শুরু করা যায়। এই ধরনের বিরক্তি দূর করার জন্য বীরত্বের চমৎকারিত্ব কিংবা মানবীয় অসুস্থতা বিষয়ে গভীর ভাবনা মূল্যহীন বলেই মনে হয়, তবু এ ধরনের ব্যাপার যে বিরক্তি উৎপাদন করে তা অনেকের শিষ্ট মেজাজ বিনষ্ট করে দেয়, জীবনে আনন্দও থাকে না। এসব ঘটনায় অপ্রচলিত জ্ঞান সান্ত্বনা বয়ে আনতে পারে, যার সঙ্গে ঐ মুহূর্তের অসুবিধার প্রকৃত কিংবা কল্পিত সম্পর্ক রয়েছে; এবং কোনো সম্পর্ক না থাকলে একজনের চিন্তা থেকে বর্তমানকে মুছে দেয়। ক্রোধে শ্বেতবর্ণধারণকারী লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হলে দেকার্তের আসক্তি নামক গ্রন্থের কেন তাদের বেশি ভয় করতে হবে যারা ক্রোধে লাল না হয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় অধ্যায়টি স্মরণ করা সুখকর। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন দুরূহ দেখে যারা অধৈর্য বোধ করেন তাদের অধৈর্য হ্রাস পায় যদি তারা সাধু রাজা ৯ম লুই-র কথা ভাবেন, যিনি ধর্ম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে পার্বত্য বুড়ো লোকটার সঙ্গে নিজের শক্তির হিসেব কষে নিয়েছিলেন। এই বুড়ো লোকটিকে আরব্য রজনীতে পাই জগতের অর্ধেক শয়তানীর উৎস হিসেবে। পুঁজিবাদীদের দুর্নিবার লোভ যখন নিষ্পেষণের রূপ নেয় তখন একজন আকস্মিকভাবে সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন এটা স্মরণ করে যে প্রজাতান্ত্রিক পবিত্রতার প্রতিভূ ব্রুটাস একটি নগরীকে ৪০ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিয়েছিলেন এবং যখন ঐ নগরী সুদ প্রদানে ব্যর্থ হয় তখন তিনি সৈন্য ভাড়া করে নগরীটি অবরোধ করেন।

    কৌতূহলী জ্ঞান কেবল অপ্রীতিকর জিনিসকে কম অপ্রীতিকর করে তোলে না। প্রীতিকর জিনিসকে আরো প্রীতিকর করে তোলে। হ্যাঁন রাজত্বের প্রথম দিকে চিনে সর্বপ্রথম পিচ ও অ্যাপ্রিকট ফলের চাষ সূচিত হয়, এই তথ্য জানার পর ঐ দুটি ফলের স্বাদ আমার কাছে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে; মহান রাজা কনিষ্ক চীনের কিছু লোককে জিম্মি করে রাখে, তারা ভারতে উক্ত দুটি ফল চাষের প্রচলন করে, অতঃপর ছড়ায় পারস্যে, সেখান থেকে রোমক সাম্রাজ্যে আসে খ্রিষ্টিয় সনের প্রথম শতাব্দীতে; অ্যাপ্রিকট (Apricot) এবং প্রিকশাস (Precocious) শব্দ দুটির উৎস অভিন্ন, লাতিন, কারণ অ্যাপ্রিকট ফল খুব তাড়াতাড়ি পাকে, এবং শব্দটির আগে A অক্ষর যোগ করা হয়েছিল ভুলক্রমে, শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার দরুন। এসব তথ্য ঐ ফলটিকে আমার কাছে আরো মিষ্টি করে তুলেছে।

    প্রায় একশো বছর আগে সুখ্যাত কয়েকজন মানব প্রেমিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কেজো জ্ঞান প্রসারের জন্য, ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে জনগণ অকেজো জ্ঞান আস্বাদনের কথা ভুলে গেছে। বিষণ্ণতার দ্বারা আক্রান্ত আমি একদিন বার্টনের Anatomy of Melancholy বইটি খুলে বসি এবং জানতে পারি যে বিষণ্ণতা নামক একটা বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু যেখানে অনেকে মনে করেন যে এটির জন্মদাতা চারটি কৌতুকরস, পক্ষান্তরে গ্যালেন মনে করেন এর জন্মদাতা তিনটি মাত্র, শ্লেষ্ম কিংবা পিটুইটা এর বহির্ভূত। ভ্যালেরিয়াস এবং মেনারডাস আবার এ দুটিকে অন্তর্ভুক্ত করার দারুণ পক্ষপাতী, এবং ফুসসিয়াস, মন্টালটাস, মন্ট্যানাসও অনুরূপ মতের পৃষ্ঠপোষক। তারা বলেন, সাদা কীভাবে কালো হতে পারে? এই লা-জবাব যুক্তি সত্ত্বেও হারকিউলিস দ্য স্যানিয়া এবং কার্ডান, গুইয়ানেরিয়াস এবং লরেনটিয়াস (বার্টন আমাদের এরকমই বলেন) বিপরীত অভিমত পোষণ করতেন। এই ঐতিহাসিক ভাবনা দ্বারা প্রশান্ত হয়ে আমার বিষণ্ণতা বিলীন হয়ে যায়। এখন বিষণ্ণতার কারণ তিনটি কিংবা চারটি করুণ রস হোক না কেন। অতিরিক্ত আগ্রহের নিদান হিসেবে আমি খুব কম বিষয়ই ভাবতে পারি, যা আলোচিত ধরনের প্রাচীন বিতর্কের চেয়ে বেশি কার্যকরী হবে।

    কিন্তু সংস্কৃতির অকিঞ্চিত্বর সুখের যেমন স্থান আছে বাস্তব জীবনের অকিঞ্চিৎকর উদ্বেগ লাঘবের জন্য তেমনি ধ্যানের মূল্য রয়েছে মৃত্যু, ব্যথা, নিষ্ঠুরতা, জাতিসমূহের অন্ধভাবে ছুটে বিপাকে পড়ার মতো জীবনের বৃহত্তর অকল্যাণের ক্ষেত্রে। যারা রীতিবদ্ধ ধর্মে আর কোনো স্বস্তি বোধ করেন না, তাদের জন্য, জীবন যাতে ধূসর, কঠোর এবং তুচ্ছ আত্মজাহিরপূর্ণ না হয়, তার জন্য একটা বিকল্পের দরকার। বর্তমান পৃথিবী কুদ্ধ আত্মকেন্দ্রিক গোষ্ঠীতে পূর্ণ, প্রত্যেক গোষ্ঠী মানব জীবনকে সমগ্রভাবে দেখতে অসমর্থ, কোনো-কোনো গোষ্ঠী সভ্যতার ধ্বংস সাধনে রাজি, তবু এক ইঞ্চি ভূমি ছাড়বে না। এ সংকীর্ণতার মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মহা আয়োজনও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ব্যাপারটা ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের হলে ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতির মধ্যে প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া যাবে। তাছাড়া এমন বিষয়ের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে যেগুলো আত্ম সম্মান খর্ব না-করেও ব্যক্তিকে সমর্থ করে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজকে দেখায়। যা দরকার তা এই তথ্য বা সেই তথ্য নয়, দরকার এমন জ্ঞানের যা গোটা মানব জীবনের লক্ষ্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। দরকার শিল্পকলা ও ইতিহাস, প্রকৃত বীরপুরুষদের জীবনের পরিচয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের অদ্ভুত, আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা। এর সঙ্গে থাকতে হবে যা-কিছু সুস্পষ্টভাবে মানবিক তার প্রতি গর্বের আবেগ, দেখা ও জানার শক্তি, ঔদার্যের সঙ্গে অনুভব এবং বিবেচনার সঙ্গে চিন্তা। ব্যাপক প্রত্যক্ষণ নৈর্ব্যক্তিক আবেগের সঙ্গে যুক্ত হলেই কেবল প্রজ্ঞা দ্রুত উৎসারিত হয়।

    জীবন সকল সময়ই যন্ত্রণাকর ছিল, তবে গত দুশো বছরের চেয়ে এখন আরো বেশি যন্ত্রণাকর হয়েছে। যন্ত্রণা থেকে পলায়নের প্রচেষ্টা মানুষকে অকিঞ্চিৎকরতা, আত্মবঞ্চনা এবং বিরাট সমষ্টিগত উপকথা উদ্ভাবনে পরিচালিত করে। তবে এই সব মৌহর্তিক যন্ত্রণালাঘব আখেরে দুর্ভোগের উৎসের সংখ্যা বাড়ায়। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দুর্ভাগ্যের উপর জয়ী হওয়া সম্ভব কেবল একটি প্রক্রিয়ায়, যাতে ইচ্ছা ও বুদ্ধিবৃত্তি পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। ইচ্ছার কাজ হলো অকল্যাণ পরিহার করতে অস্বীকার করা কিংবা অবাস্তব সমাধান গ্রহণে অসম্মতি, বুদ্ধির কাজ হলো ব্যাপারটা অনুধাবন, চিকিৎস্য হলে চিকিৎসার উপায় অনুসন্ধান, প্রকৃত সম্পর্কে স্থাপন করে সহনশীল করে তোলার চেষ্টা করা কিংবা অবশ্যম্ভাবী বলে গ্রহণ করা; এবং স্মরণ করা। আমাদের পরিমণ্ডলের বাইরে কী রয়েছে, পুরাকালে কী ছিল, আন্তঃনাক্ষত্রিক গহ্বরগুলোতে অনুসন্ধান করলে কী পাওয়া যেতে পারে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল
    Next Article অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    Related Articles

    বার্ট্রান্ড রাসেল

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    প্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    সক্রেটিসের আগে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }