Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প74 Mins Read0

    আলোর ময়ুর – ২

    ০৫.

    খাওয়া-দাওয়ার পর সোমা আর তপতী তাদের নির্দিষ্ট ঘরটায় চলে এল। বোতাম টিপে মাথার ওপরকার ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে তপতী বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?

    সোমা শুধাল, কী রে?

    মৃন্ময়দার ওপর খুব চটে গেছিস, না?

    সোমা উত্তর দিল না, তার মুখ কঠিন হয়ে উঠল।

    বিছানায় এসে টান-টান শুয়ে পড়ল তপতী। বলল, রাগ করিস না ভাই; মৃন্ময়দাটা কোনরকম ফর্মালিটি জানে না, মুখে যা আসে দুমদাম বলে ফেলে। একেক সময় খুব খারাপ লাগে। কিন্তু মানুষটা ভারি সরল রে। দু-চারদিন মিশলে বুঝতে পারবি, কোনও রকম ঘোরপ্যাঁচ নেই।

    সোমা আবছা জড়ানো গলায় কিছু বলল; বোঝা গেল না।

    পাশ ফিরতে ফিরতে তপতী বলল, মৃন্ময়দাটা অদ্ভুত লোক। দারুণ দুঃখী, জীবনে ভীষণ ডিপ্রাইভড় হয়েছে, অথচ বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। সব সময় হই-হুঁল্লোড় করছে, তার গলা দ্রুত ঘুমে বুজে আসতে লাগল।

    কোনও ব্যাপারেই সোমার বিশেষ আগ্রহ নেই। সে উদাসীন কৌতূহল শূন্য।

    তবু নিজের অজান্তেই ফস করে বলে বলল, ডিপ্রাইভড হয়েছে মানে?

    সে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, পরে শুনিস

    কী ভেবে সোমা বলল, ঊনি তো দিল্লি থাকেন; তখন তাই বললি না?

    হ্যাঁ, ঘুমন্ত গলায় উত্তর দিল তপতী।

    একলাই থাকেন?

    কী অস্পষ্টভাবে বলল তপতী, তারপরেই তার গলা ডুবে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাক ডাকতে লাগল। ভারি বিশ্রী অভ্যাস তপতীর।

    সোমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন সে দেখেছে স্রেফ নাক ডাকার জন্য একটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। পরক্ষণেই সে জানালার বাইরে গোলাপ বাগানের দিকে তাকাল। ওখানে ঝক ঝক প্রজাপতি উড়ছিল, আর ফড়িং। ফাল্গুনের উল্টোপাল্টা এলোমেলো হওয়ার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।

    তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ জুড়ে আসতে লাগল সোমার। তপতীর পাশে শোয়ামাত্র সে ঘুমিয়ে পড়ল।

    .

    ০৬.

    ঘুম যখন ভাঙল বিকেলের আলো মলিন হয়ে এসেছে। রোদের রঙ এখন বাসি হলুদের মতন। রাস্তার লম্বা লম্বা গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে তপতীদের বাগানে এসে পড়েছে। বাইরে অনেক পাখি ডাকছিল, অজস্র গোলাপের গন্ধে ফাল্গুনের চটুল বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।

    বিছানায় শুয়েই বড় বড় জানালার মধ্য দিয়ে আকাশ দেখা যায়। শীতের পর আকাশ এখন ঝকঝকে নীলপালিশ-করা আয়নার মতন।

    পাশ ফিরে তপতীকে ডাকতে গিয়ে সোমা দেখল, সে জায়গাটা ফাঁকা। ঘুম ভাঙবার পর কখন সে উঠে গেছে, কে জানে। সোমা শুয়েই থাকল। আকাশ দেখতে লাগল, গাছের ছায়া দেখতে লাগল, পাখিদের চেঁচামেচি শুনতে লাগল। মোটামুটি এসব ভালোই লাগছিল তার, তবু কী রকম এক অন্যমনস্কতা আর বিষাদ যেন তাকে ঘিরে থাকল। একলা হলেই এই বিষাদটা সোমাকে পেয়ে বসে। আর তখনই বিতৃষ্ণার অতল থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়ায় বিকাশ।

    হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল তপতী। এক মুখ হেসে বলল, ঘুম ভেঙেছে তা হলে? আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর উঠবি না।

    সোমাও হাসল, কিছু বলল না।

    তপতী আবার বলল, আর শুয়ে থাকতে হবে না, চটপট উঠে পড়—

    মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে রেডি হয়ে নিবি

    কী ব্যাপার? হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল সোমা।

    কী আবার ব্যাপার, এই বিকেলবেলা ঘরে বসে থাকবি নাকি? আমাদের শহরটা কেমন, একটু ঘুরে ফিরে দেখবি না? মৃন্ময়দা টাঙ্গা ডাকতে গেছে। এসেই কী রকম তাড়া লাগায় দেখিস–

    মৃন্ময়ের কথায় সোমার মুখে ছায়া পড়ল। বলল, আজই বেরুবি?

    তপতী বলল, আজ বেরুলে ক্ষতিটা কী?

    না, ক্ষতি কিছু না। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছি, খুব টায়ার্ড লাগছে। এখন আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। মুখটা করুণ করে সোমা তাকাল। প্লিজ, মনে কিছু করিস না ভাই

    আচমকা দরজার কাছ থেকে দুম করে কেউ বলল, আপনি একটা ল্যাক্টাভ্যাগাস–

    চমকে সেদিকে তাকাল সোমা; দরজার ঠিক ওপরেই মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। সে কখন এসেছে, কে জানে। কতক্ষণ তাদের কথা শুনছে, তাই বা কে বলবে। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল সোমার।

    তপতী বলল, ল্যাক্টাভ্যাগাস–তার মানে কী?

    মৃন্ময় বলল, কে জানে কী মানে। বলতে বেশ লাগল তাই বলে ফেললাম।

    তপতী বালিকার মতন সারা গা দুলিয়ে হেসে উঠল, তুমি একটা রাবিশ।

    মৃন্ময় বলল, ঠিক আছে রাবিশই। এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তোরা। টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

    জাস্ট টেন মিনিট সময় নিচ্ছি।

    নো, ফাইভ মিনিট। কাপড়-চোপড় বদলাতে এর চাইতে বেশি সময় লাগে নাকি?

    বা রে, চা খাব না?

    চা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। মৃন্ময় আর দাঁড়াল না, বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।

    এই অসভ্য লোকটার সঙ্গ অসহ্য। সোমা বলল, আমি কিন্তু যাব না।

    সোমা যে ভেতরে ভেতরে খুবই রেগে গেছে, তপতী লক্ষ্য করেনি। অসহিষ্ণু গলায় সে বলল, দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছিস, কী যে স্বভাব হচ্ছে তোর। কলকাতায় হোস্টেলের ঘর থেকে বেরুস না; এখানে এসেও যদি ঘরেই বসে থাকবি তবে আসার মানে কী? হাত ধরে এক টানে সোমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনল তপতী; তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল, চল, আজ তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাব। যেভাবে সরলা কিশোরীকে চতুর পুরুষ ফুসলায় তপতীর গলায় স্বর অনেকটা সেই রকম।

    সোমা বলল, কী দেখাবি?

    সেটা এখন বলব না : ক্রমশ প্রকাশ্য।

    সোমা শেষ চেষ্টা করল, কাল দেখলে হত না?

    উঁহু আজই–প্রায় টানতে টানতে সোমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল তপতী।

    এক কলেজে বছর তিনেক কাজ করছে ওরা। প্রথম দিন থেকেই সোমা দেখছে, মেয়েটা যেন সব সময় টগবগ করে ফুটছে। একটুতেই সে উচ্ছ্বসিত একটুতেই তার মধ্যে ঢেউ ওঠে। আর যখন যেটা মাথায় চাপে সেটা না করে ছাড়ে না। কাজেই তার ইচ্ছায় নিজেকে না সঁপে দিয়ে রেহাই পাওয়া গেল না।

    .

    শাড়ি বদলাতে বেশিক্ষণ লাগল না। তারপর তপতীরা বেরিয়ে পড়ল। তপতীর মা চা খাবার কথা বলেছিলেন, মৃন্ময় সে সময় দিল না। দোলন ঝুলন যেতে চেয়েছিল; তাদের কী একটা পরীক্ষা সামনে, তাই নেওয়া হল না।

    বাড়ি থেকে বেরুলেই দুর্গাবাড়ি। তার গায়েই একটা টাঙ্গা দাঁড়িয়ে ছিল। সোমা আর তপতী পিছনের সিটে বসল। মৃন্ময় বসল সামনের সিটে, কোচোয়ানের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গা চলতে শুরু করল।

    একটু পর খোয়ার রাস্তা পেরিয়ে জমজমাট বাজারের কাছে এসে পড়ল টাঙ্গাটা। কলকাতার অনুকরণে এখানে কিছু দোকানপাট-ঘড়ির দোকান, রেডিওর দোকান, রেডিমেড পোশাকের দোকান। কাঁচের শো-উইন্ডোতে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা রয়েছে। দু-একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁও চোখে পড়ল।

    মৃন্ময় সোমাকে বলল, বুঝলেন ম্যাডাম, এটা আমাদের পূর্ণিয়ার চৌরঙ্গী।

    সোমা অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকল।

    মৃন্ময়ের হয়তো দুকান কাটা, সে বলতে লাগল, কলকাতার তুলনায় অবশ্য কিছুই না; তবু নিজেগুণে ক্ষমা করে নেবেন।

    সোমা চুপ। মৃন্ময় এবার তপতীকে বলল, কি রে তপী, কোনদিকে যাবি?

    তপতী বলল, যেদিকে খুশি

    মৃন্ময় চট করে কী ভেবে নিল। আড়ে আড়ে একবার তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, যদি খাদাঞ্চির দিকে যাই?

    ঠোঁট কামড়ে আঁচলে আঙুল জড়াতে জড়াতে তপতী বলল, আহা, খাদাঞ্চি ছাড়া যেন পূর্ণিয়ায় আর কোনও জায়গা নেই–

    নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেন বাপু পেটে খিদে মুখে লাজ

    লাজুক হাসল তপতী। আরক্ত মুখে বলল, তোমাকে আমি বলেছি!

    মৃন্ময় বলল, মুখ ফুটে না বললে কী আর বোঝা যায় না? ওখানে যাবার জন্যে তো মুখিয়েই আছিস।

    আমি কিন্তু কিছুতেই খাদাঞ্চি যাব না।

    যাবি যাবি, হাজারবার যাবি। নাকের ডগায় বঁড়শি আটকানো আছে, না গিয়ে কি পারবি? এখন না গেলেও লুকিয়ে চুরিয়ে তো যাবিই–

    মৃন্ময় কোচোয়ানকে বলল, খাদাঞ্চি চালাও

    সোমা তপতীকে লক্ষ্য করছিল। তিন বছর ধরে সে দেখছে, তপতীটা দারুণ হুল্লোড়বাজ। লজ্জা-টা বলে কিছু নেই। কিন্তু খাদাঞ্চি যাবার কথায় তার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যাচ্ছে। অবাক সোমা খুব নীচু গলায় বলল, খাদাঞ্চি যাবার কথায় একেবারে লজ্জাবতী লতাটি হয়ে গেলি, কী ব্যাপার রে?

    চকিতে মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে গলার স্বর অতলে নামাল তপতী, একটা দারুণ জিনিস দেখাব বলেছিলাম না? সে জিনিসটা ওই খাদাঞ্চিতেই আছে।

    জিনিসটা কী রে?

    গেলেই দেখতে পাবি। একখানা বা সারপ্রাইজ দেব না।

    একটু ভেবে সোমা বলল, টাঙ্গা খাদাঞ্চিতে আসবে তা হলে তুই জানতিস?

    নিশ্চয়ই জানতাম। মৃন্ময়দার সঙ্গে যখন বেরিয়েছি তখন সে কি আর ওখানে না গিয়ে ছাড়বে। যা ফাজিল।

    এদিকে রাস্তায় যারা যাচ্ছিল তারা প্রায় সবাই মৃন্ময়র্কে ডেকে ডেকে কথা বলছিল। কেমন আছেন মৃন্ময়বাবু? কবে এলেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। মৃন্ময়ও কারোকে কারোকে ডাকছিল, এ বিষুণ, ক্যায়সা হায় রে?

    আচ্ছা, বিষুণ নামধারী লোকটা বলে, আপ ক্যায়সা?

    বহুত খু— বালবাচ্চা আচ্ছা তো?

    জী—

    কিংবা এ রামলগন সিং

    রামগলন নামধারী লোকটা বলে, আরে বাপ, মিরিনমায়বাবু। (মৃন্ময়বাবু) আপ কব পূর্ণিয়া আয়া?

    মৃন্ময় বলে, পরশু রোজ

    আরে বাপ পরশু রোজ আয়া, হাম নহী জানে—

    জানবি কী করে? দেখা তো হয়নি। এখনও তাড়ি খাস, বউকে পেটাস?

    এক হাত জিভ কেটে রামলগন প্রায় আঁতকেই ওঠে, আরে বাপ, দারু-ঊরু কব ছোড় দিয়া

    ব্যাটা ধম্মপুত্তুর হয়ে উঠেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তপতী সোমাকে বলল, মৃন্ময়দা এখানে দারুণ পপুলার। পূর্ণিয়ার এমন কেউ নেই যে তাকে চেনে না। সবার সঙ্গে ওর খাতির।

    সোমা কোনওরকম উৎসাহ দেখাল না।

    এক সময় বাজার এলাকাটা পিছনে ফেলে টাঙ্গাটা খানিক এগিয়ে বাঁ-ধারে ঘুরল; শিরদাঁড়ার মতো সোজা একটা রাস্তা এখান থেকে পুবে গেছে। দুধারে বাড়িঘর বেশির ভাগই টিনের চালের, মাঝে-মধ্যে পুরোনো আমলের কিছু একতলা। আচমকা বিশাল কম্পাউন্ডওলা একটা তিনতলাও চোখে পড়ল।

    রাস্তায় ভিড়-টিড় বিশেষ নেই, দু-চারটে সাইকেল-রিকশা হুস হুস বেরিয়ে যাচ্ছে, কদাচিৎ এক-আধটা টাঙ্গা। কলকাতার হইচই, ট্রাফিক আর জনস্রোতের কথা মনে পড়ল সোমার। সর্বক্ষণ ফুটন্ত টগবগে সেই শহরটির তুলনায় এ শহর কত নির্জন, কত স্তিমিত আর নিরুত্তেজ। সোমার স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল।

    রাস্তার লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে মৃন্ময় সোমাকে বলল, এই রাস্তাটা সোজা খাদাঞ্চি আর লাইন বাজার হয়ে হাইওয়েতে মিশেছে।

    লোকটাকে কে যে গাইডের ভূমিকা নিতে বলেছে, সে-ই জানে। সোমা উত্তর না দিয়ে উদাসীন গম্ভীর মুখে বসে থাকল।

    যাই হোক রাস্তাটা চেনা-চেনা লাগছিল। সোমা তপতীকে আস্তে করে বলল, এই পথটা দিয়ে আজ দুপুরে আমরা তোদের বাড়ি গেছি না?

    তপতী উত্তর দেবার আগেই টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ধরেছেন। আপনার মেমারি তো দারুণ শার্প দেখছি; একবার গিয়েই রাস্তাটাকে ঠিক ঠিক মনে করে রেখেছেন। আমার আবার বুঝলেন নিজের মাথাটা দেখিয়ে মৃন্ময় বলল, এটার ভেতর গোবর পোরা। একবারে তো পারবই না সাতবার দেখলেও মনে থাকবে কিনা সন্দেহ।

    দাঁতে দাঁত চেপে রইল সোমা। এই গায়ে-পড়া বাজে টাইপের বাঁচাল লোকটাকে অনেক আগেই ঠান্ডা করে দিতে পারত; নেহাত তপতীর দাদা তাই চুপ করে আছে। আরেকটু বাড়াবাড়ি দেখলে নির্ঘাৎ চড় কষিয়ে দেবে।

    কিছুক্ষণ যাবার পর ধবধবে সাদা বিরাট একখানা মসজিদ পড়ল, তার কারুকাজ করা গম্বুজে শেষ বেলার আলো এসে পড়েছে। মৃন্ময় বলল, এই মসজিদটার বয়স অনেক। কেউ কেউ বলে সেই নবাবি আমলে তৈরি হয়েছিল।

    সোমা উত্তর দিল না।

    মসজিদ পেরিয়ে আরো কিছুটা গিয়ে একটা তেরাস্তার মুখে এলে মৃন্ময় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এ বগেড়িলাল রুখো–রুখো{ টাঙ্গাওলার নাম বগেছিলাল। টাঙ্গা থেমে গেল।

    মৃন্ময় তপতীর দিকে ফিরে ঠোঁট টিপে কৌতুকের গলায় বলল, যা, সোমেশের বাবা-মার সঙ্গে একটু দেখা করে আয়।

    মুখ নামিয়ে নখ খুটতে খুটতে তপতী বলল, আজ থাক, পরে একদিন যাব।

    না-না, আজই যাব। বুড়োবুড়ি একলা পড়ে থাকে; তুই গেলে খুব খুশি হবে।

    তপতী নখ খুঁটতেই থাকল।

    এবার আর কৌতুক-টৌতুক না, সস্নেহ কোমল স্বরে মৃন্ময় বলল, যা–যা-তোর বন্ধুকেও নিয়ে যা।

    তুমি যাবে না?

    না, আমার ওপর বুড়োবুড়ি কেমন চটা জানিস তো; দেখলেই খেপে উঠবে।

    তপতী হাসল, খেপবার কাজ করলে খেপবে না?

    মৃন্ময় বলল, আচ্ছা তোরা তাড়াতাড়ি ঘুরে-টুরে আয়, আবার জমে যাস না। আমি ততক্ষণ বগেড়িলালের সঙ্গে গল্প করছি।

    সোমাকে নিয়ে তপতী নেমে পড়ল। তারপর সে রাস্তাটা সোজা ডানদিকে চলে গেছে সেটা ধরে হাঁটতে লাগল।

    একটু আগে মৃন্ময় আর তপতী যা বলছিল তার কিছুই বুঝতে পারছিল না সোমা। মৃন্ময়ের সামনে কিছু জিগ্যেস করতেও তার ইচ্ছা হয়নি, কোন কথায় কী ইতর রসিকতা করে বসবে, লোকটাকে বিশ্বাস নেই।

    বন্ধুকে একলা পেয়ে সোমা যখন কিছু বলতে যাবে সেই সময় ওরা একটা বড় দোতলা বাড়ির সামনে এসে গেছে। কাঠের গেট খুলতে খুলতে তপতী বলল, আর মাস ছয়েক পর পুর্ণিয়া এলে তুই গোলাপ বাড়িতে উঠতিস না, তোকে এখানে এনেই তুলতাম।

    তার মানে?

    আলতো করে সোমার কাঁধে একটা টোকা দিয়ে তপতী বলল, এক নম্বরের হাঁদারাম তুই, মাথায় তোর কিছু নেই।

    বিদ্যুৎ চমকের মতো কী একটা আভাস পেয়ে গেল সোমা। বলল, তা হলে কি এটা তোর

    ভাবী শ্বশুর বাড়ি।

    এই দারুণ জিনিসটা দেখবার কথাই তখন বলেছিলি?

    ইয়েস ফ্রেন্ড।

    সোমেশ তাহলে—

    নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে তপতী বলল, আমার হৃদয়েশ্বর।

    তিন বছর একসঙ্গে আছি; এই সুখবরটা তো আগে দিসনি—

    ভেবেছিলাম, পূর্ণিয়ায় এনে তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

    সোমা খুব আগ্রহের গলায় বলল, দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছিস। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে তোর প্রাণেশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে–

    দুহাতের সবগুলো আঙুল এবং মাথা একসঙ্গে নেড়ে তপতী বলল, ওটি পারব না।

    কেন?

    প্রভু এখন ইন্ডিয়ার বাইরে; আমেরিকায় রিসার্চ করছেন।

    তোদের কদ্দিনের আলাপ?

    সেই ছেলেবেলা থেকে। এক শহরেরই ছেলে মেয়ে আমরা।

    সোমা হাসল, বেশ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।

    তপতীও হাসল, যা বলেছিস।

    হঠাৎ কী মনে পড়তে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বুড়োবুড়ি মানে তোর শ্বশুর শাশুড়ী মৃন্ময়বাবুকে দেখলে খেপে যাবে কেন?

    আর বলিস না, মৃন্ময়দাটা মহা ফাজিল। বুড়োবুড়ির বিদঘুঁটে কাটুন এঁকে একবার উপহার দিয়েছিল, তাতেই চটে আছে।

    সোমা কিছু বলল না। মৃন্ময় সম্বন্ধে তার বিরক্তি আরেকটু বাড়ল শুধু। দুটি বৃদ্ধ মানুষকে নিয়ে যে এমন অসভ্যতা করতে পারে সে যে কতখানি ইতর, বলে না দিলেও চলে।

    গেটের পর অনেকখানি খোলামেলা জায়গা। একধারে ছোটখাটো বাগান; আরেকধারে কুয়োতলা, ঘাসের জমি। মাঝখান দিয়ে শুরকির রাস্তা।

    কথা বলতে বলতে ওরা গাড়িবারান্দার নীচে এসে পড়ল। একটা মধ্যবয়সি হিন্দুস্থানি চাকর খুব পুরোনো মডেলের একটা ফোর্ড গাড়ি ঝাড়ামোছা করছিল। তপতীকে দেখে বালকের মতন আনন্দে সে প্রায় লাফিয়ে উঠল, আরে দিদিমণি, আপ কব আগয়ী?

    আজই। তপতী হাসল।

    আইয়ে আইয়ে, বলেই সে ভেতর দিকে খবর দিতে ছুটল।

    তপতী দাঁড়াল না, সোমাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে এল। আর উঠতেই দেখা গেল সিঁড়ির মুখে একটি বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনেই প্রচণ্ড মোটা; দেখেই টের পাওয়া যায় তাদের রাতের শরীর। এখন বেশ গরম পড়ে গেছে। তবু দুজনের পায়ে পুরু মোজা, গলায় কম্ফোটার। হয়তো ওঁরা শীতকাতুরে, কিংবা একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। তাই চারদিকে দুর্গ সাজিয়ে রেখেছেন। সোমা অনুমান করল, এঁরাই তপতীর ভাবী শ্বশুর-শাশুড়ি। দারুণ মোটা বলেই হয়তো এঁদের নিয়ে কার্টুন এঁকেছে মৃন্ময়।

    বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার পিছনে গন্ডাদুয়েক ঠাকুর-চাকর দাঁড়িয়ে ছিল। তপতীকে দেখে তারা ভারি খুশি, তাদের চোখে হাসি ছলকে ছলকে যাচ্ছে।

    তপতী বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে প্রণাম করল; দেখাদেখি সোমাও। স্নেহময় উজ্জ্বল চোখে বৃদ্ধা বললেন, এই মেয়েটি কে রে তপতী? আগে তো দেখিনি।

    সোমার পরিচয় দিল তপতী। এবার বৃদ্ধ বললেন, সোমা মা, তপতীর সঙ্গে তুমি আমাদের বাড়ি এসেছ, খুব খুশি হয়েছি। চল ভেতরে গিয়ে বসি।

    বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধা ওদের নিয়ে সামনের একটা ঘরে এলেন। তপতীদের সোফায় বসিয়ে পুরু গদিওলা দুটো ইজিচেয়ারে তারা প্রায় শুয়েই পড়লেন। সিঁড়ির মুখ থেকে ঘর পর্যন্ত আসতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেছেন; বড় বড় শ্বাস পড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে বৃদ্ধ তপতীর খবর নিলেন। কবে এসেছে, কদিনের ছুটি, কেমন আছে, এতদিন আসেনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তারপর বৃদ্ধা বললেন, সোমেশ তোকে এর মধ্যে চিঠিপত্র দিয়েছে?

    সোমা অনুমান করল, ছেলেবেলা থেকে দেখছেন বলেই ওঁরা তপতীকে তুই করে বলে।

    তপতী রক্তাক্ত মুখ নীচু করে বসে থাকল।

    বৃদ্ধা বললেন, তুমি না আজকালকার মেয়ে; অত লজ্জা কীসের?

    মৃদু গলায় তপতী বলল, মাসখানেক আগে একটা পেয়েছিলাম।

    কাল সোমেশের চিঠি এসেছে। তুইও নিশ্চয়ই পাবি। খুব সুখবর আছে।

    দ্রুত মুখ তুলেই নামিয়ে নিল তপতী; তার চোখ আগ্রহে ঝকমক করছে।

    বৃদ্ধ বললেন, সোমেশ ডক্টরেট পেয়ে গেছে; মাস তিনেকের মধ্যেই ফিরছে।

    তপতী এবারও কিছু বলল না। পাশ থেকে সোমা লক্ষ্য করল তপতীর চোখ মুখ সারা গায়ে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ছে।

    সোমেশের মা বললেন, সোমেশ এলে আমি কিন্তু আর কোনও কথা শুনব না। প্রথম যে তারিখটা পাব সেদিনই দুই হাত এক করে দেব। এখন তো তেমন জোর নেই কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাক, কলকাতায় পড়ে থাকা চলবে না।

    সোমেশের বাবা বললেন, কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। আমার একটা ছেলের বউ, সে চোখের আড়ালে দূরে দূরে থাকবে, সেটি হবে না। ছেলেকেও জানিয়ে দিয়েছি, ডক্টরেট হও আর যা-ই হও, চাকরির জন্যে দিল্লি-কলকাতা-বোম্বাই যেতে পারবে না, পুর্ণিয়াতেই যা পাও জুটিয়ে নিতে হবে। বেশি টাকা আমাদের দরকার নেই।

    সোমেশের মা বললেন, এই বুড়ো বয়সে ছেলে ছেলের বউকে ছেড়ে থাকতে পারব না বাপু। বলতে বলতে হাতের ভর দিয়ে উঠে বাইরে চলে গেলেন।

    একটু পর যখন ফিরে এলেন সঙ্গে দুটো চাকর। তাদের হাতে নানারকমকের প্লেটে রাজ্যের খাবার।

    সোমেশের মা নিজের হাতে দুটো ছোট টেবিল টেনে এনে তপতীদের সামনে রাখতে রাখতে চাকরদের বললেন, এখানে প্লেটগুলো দে

    খাবার দেখেই আদুরে কিশোরীর মতো নাকে কাঁদতে শুরু করল তপতী, এত কখনো খাওয়া যায়?

    সোমেশের মা বললেন, নিশ্চয়ই খাওয়া যায়, তোদর বয়সটাই তো খাবার বয়স। যা হাতে করে দেব লক্ষ্মীমেয়ের মতো খেয়ে নিবি। কখনও ধমকে কখনও পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি তপতীকে খাওয়াতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, কলকাতার হস্টেলে কী যে খাস, তুই-ই জানিস। ছমাস আগে দেখেছিলাম, তখনও কী সুন্দর চেহারা। আর এখন কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে পড়েছে, গায়ের রঙ কালি। দাঁড়াও তোমাকে একবার হাতে পাই–

    আরো কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে তপতীরা উঠে পড়ল। সোমেশের বাবা-মা বারবার বলে দিলেন বিয়ের সময় সোমা যেন নিশ্চয়ই আসে; আগে থেকেই তারা নিমন্ত্রণ করে রাখলেন। তারপর ওঁরা দুজনেই ভারী শরীর নিয়ে গেট পর্যন্ত তপতীদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

    রাস্তায় বেরিয়ে তপতী বলল, আমার শশুর বাড়ি কেমন দেখলি বল—

    সোমা বলল, খুব ভালো।

    আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি?

    চমৎকার। তোকে দারুণ ভালোবাসে।

    সবই ভালো। তবে–মুখ কাচুমাচু করে কপট ভয়ের গলায় তপতী বলল, এই শাশুড়ির পাল্লায় পড়লে খেয়ে খেয়েই আমি মরে যাব।

    তপতীকে কত উজ্জ্বল, সুখী এবং পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ভীষণ ঈর্ষা হতে লাগল সোমার। এমন একটা সুখের ঘরে সে-ও তো আসতে পারত। কিন্তু সেই লোকটা? স্মৃতির অতল থেকে উগ্র দুর্গন্ধের মতো উঠে এল বিকাশ। সেই পুরোনো বিষাদটা আবার যেন চারদিক থেকে জাল ছোট করে এনে তাকে ঘিরে ফেলতে লাগল।

    অন্যমনস্কর মতো তপতীর সঙ্গে টাঙ্গায় ফিরে এল সোমা। টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, গেলি পাঁচ মিনিটের জন্যে এলি তিন ঘণ্টা কাটিয়ে। বুড়োবুড়ির সঙ্গে কী এত গল্প করছিলি?

    সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন সোমেশদের বাড়ি যায় তখনও চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। কিন্তু এখন দিনের আলো বলতে কোথাও কিছু নেই, অন্ধকারে আলোটা ঝাপসা। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির বাতিগুলো চোখ মেলতে শুরু করেছে।

    তপতী বলল, এই কত রকম–

    মৃন্ময় বলল, বুড়োবুড়ির সঙ্গে এতক্ষণ কাটালি; সোমেশ থাকলে দেখছি গল্পে গল্পে রাত কাবারই করে ফেলতিস।

    সে যে একটা কলেজের অধ্যাপিকা, তপতীর মনে রইল না। চপলা বালিকার মতো সে জিভ ভ্যাংচাল, এ-হে-হে, তোমায় বলেছে–

    টাঙ্গা চলতে শুরু করেছিল। মৃন্ময় বলল, এখনই বাড়ি ফিরে কী হবে। চল কাপ্তান পুল পর্যন্ত ঘুরে আসি। একটু পর পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে। যা লাভলি লাগবে না

    তপতী উৎসাহের গলায় বলল, তাই চলো।

    টাঙ্গা লাইন বাজার ধরে কাপ্তান পুলের দিকে চলল। মৃন্ময় এবার সোমাকে বলল, তপীর শ্বশুর-শাশুড়িকে কী রকম দেখলেন ম্যাডাম? জোড়া বিন্ধ্য পর্বত, না? কার্টুনের এমন সাবজেক্ট আর হয় না–

    সোমা উত্তর দিল না।

    আর যেন কী একটা বলল মৃন্ময়, সোমা এবার আর শুনতে পেল না। কাপ্তান পুলের দিকে যেতে যেতে রুপোর আলোর মতো চাঁদটা কখন দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল, কখন লাইন বাজার পার হয়ে দুধারে ধু-ধু মাঠ আর বিল আর ঝোপছাপ গাছপালা কুয়াশার আবছা হয়ে যেতে লাগল, কখন দক্ষিণ দিক থেকে ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ বাতাস ছাড়ল সোমা জানে না। সেই লোকটা যার নাম বিকাশ, বিকাশ মিত্র এখন তার অস্তিত্ব জুড়ে একটা দুর্গন্ধময় কদর্য মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

    .

    বিকাশকে প্রথম দেখেছিল কবে? স্পষ্ট মনে আছে, বছর পাঁচেক আগে— এক পিকনিকে।

    লক্ষ্ণৌ থেকে সে বছরই প্রথম কলকাতায় এসেছে সোমা। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার এক হস্টেলে থাকত আর ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করত। ইউনিভার্সিটি আর হস্টেল ছাড়া জটিল অরণ্যের মতো এই বিশাল শহরের প্রায় সবটুকুই তার অচেনা। অবশ্য ছুটিছাটায় কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দু-একটা সিনেমা-টিনেমা দেখত। উত্তরে শ্যামবাজার, দক্ষিণে চৌরঙ্গি–তার কলকাতা এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

    ফিফথ ইয়ারের শেষাশেষি ক্লাসের এক বন্ধু, রুবি-রুবি দত্ত, দারুণ আপস্টার্ট, ঠোঁটে নখে টকটকে রঙ, গায়ে আট ইঞ্চি ঝুলের স্লিভলেশ ব্লাউজ–আঁকা চোখে চাকার মতো প্রকাণ্ড গগস, উন্মক্ত ঘাড় পেট এবং বুকের অনেকটা–একদিন বলল, এই সোমা, আসছে রোববার আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবি।

    কলকাতার মেয়ে বলেই হয়তো, কিংবা নিজের স্বভাবের মধ্যেই স্নিগ্ধ অনুদ্ধত একটি চিরকালের বাঙালি মেয়ে আছে বলেই কিনা, রুবিকে খুব একটা পছন্দ করত না সোমা। অথচ এই মেয়েটা সম্বন্ধে তার দুরন্ত আকর্ষণও ছিল। কেন ছিল, সে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুভূতির। সোমা বলেছিল, কোথায়?

    পিকনিকে।

    পিকনিকটা কলকাতাতেই হবে?

    আরে না, কলকাতায় পিকনিক করে মজা আছে নাকি? তার চাইতে ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে এলেই হয়। ঠিক করেছি ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে একটা বড় বাগানবাড়ি নেব

    সে এখান থেকে কতদুর?

    কাছেই। এতদিন কলকাতায় এসেছিস, শহরটা ভালো করে দেখলিই না; কারো সঙ্গে মেলামেশাও করিস না। একেবারে পল্লীবালার মতো ঘরের কোণে আটকে আছিস। তোকে মানুষ করতে হবে দেখছি।

    ভয়ে ভয়ে সোমা জিগ্যেস করেছিল, কখন যেতে হবে?

    সকালে।

    ফিরবি কখন?

    আগে তো যাই; তারপর ফেরার কথা।

    আর কে কে যাচ্ছে?

    এই আমাদের কজন বন্ধু-টন্ধু ক্লাসের কটি মেয়ের নাম করছিল রুবি। তারপর বলেছিল, তাছাড়া বাইরেরও আছে।

    তপতী জিগ্যেস করেছিল, বাইরের কারা?

    সে আছে, তুই চিনবি না।

    পিকনিকটা পুরোপুরি মেয়েদেরই তো?

    রুবি থমকে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থেকে আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল, হাসতে হাসতে তার পেটে খিচ ধরে যাচ্ছিল যেন। এমন অদ্ভুত মজার কথা আগে আর কখনও শোনেনি সে।

    বিমূঢ়ের মতো সোমা বলেছিল, হাসছিস যে?

    হাসব না তো কী! তুই কোন যুগের মেয়ে রে?

    সোমা থতিয়ে গিয়েছিল, না, মানে—

    মানে-টানে থাক; এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো কুড়িটা টাকা চাঁদা বার কর তো৷

    সেই রবিবারই ব্যারাকপুর গিয়েছিল সোমা। সেখানে গিয়ে দ্যাখে অনেক যুবক-যুবতী আগেই এসে গেছে। মেয়েদের চাইতে ছেলেদের ভিড়ই বেশি।

    ক্লাসের কটি বন্ধু ছাড়া অন্য ছেলে মেয়েরা তার অচেনা। মেয়েগুলোর সাজসজ্জা রুবির মতোই। ফাঁপানো চুল রাঙানো নখ, আধখোলা শরীর। ছেলেদের টাইট লো-কাট ট্রাউজার আর জ্যাকেট কিংবা শার্কস্কিনের কলারওলা পাঞ্জাবি। কঁধ পর্যন্ত নেমে আসা হিপি-মার্কা চুল, মোটা লম্বা জুলপি। কারো কাঁধে ক্যামেরা, কারো ট্রানজিস্টার। দেখতে দেখতে সোমার মনে হতে লাগল, এই যুবক-যুবতীরা নতুন অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি থেকেই বুঝিবা উঠে এসেছে।

    কবি সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল, হিয়ার ইজ আওয়ার নিউ ফ্রেন্ড সোমা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যাদের সঙ্গে পরিচয় করানো হল তাদের এক গাদা নাম বলে গেছে রুবি, এ হল পল্লব, এ সোনিয়া, এ জয়া, এ বিপ্লব, এ সোমনাথ, এ ইন্দ্রাণী, এ হল বরুণ

    সবার শেষে রুবি যার নাম করেছিল সে বিকাশ, বিকাশ মিত্র। এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে সে-ই সব চাইতে স্মার্ট, সব চাইতে ঝকঝকে, সব চাইতে ফর্সা। তার দিকে তাকিয়ে সোমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।

    রুবি বলেছিল, এ হল বিকাশ, আওয়ার ওল্ড প্যাল। এ বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। আর হয়েই দারুণ একখানা চাকরি বাগিয়ে ফেলেছে। স্টার্টিংয়ের দেড় হাজার টাকা। দু-এক বছরের ভেতর ওদের কোম্পানি ওকে আমেরিকা-টামেরিকা পাঠিয়ে দেবে।

    রুবি সমানে বকে যাচ্ছিল; সোমা কিন্তু বিশেষ শুনছিল-টুনছিল না। বিকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সে।

    এদিকে পরিচয়-টরিচয় হয়ে যাবার পর সোমা দুহাত জোড়া করতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিজের হাত বাড়িয়ে সোমার একটা হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলেছিল বিকাশ, সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ। নাই উই আর অল ফ্রেন্ডস, আমি কিন্তু তোমাকে আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না। অ্যান্ড আই উইল এক্সপেক্ট, তুমিও আমাদের তুমি করেই বলবে।

    রুবি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়েছিল, ও সিওর, সিওর। সোমা উত্তর দেয়নি।

    রুবি আবার বলেছিল, বুঝলে বিকাশ, আমার এই বন্ধুটা দারুণ শাই। ভেবেছিলাম আমিই ওকে মানুষ-টানুষ করব। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমার এফিসিয়েন্সি আমার চেয়ে অনেক বেশি। তুমিই ওর দায়িত্ব নাও।

    বিকাশ দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, মোস্ট গ্ল্যাডলি।

    তোমরা কথাবার্তা বলো; আমি পল্লবের কাছে যাই। দূরে আঁকড়া-মাথা প্রকাণ্ড জামরুল গাছের তলায় যে যুবকটি ট্রানজিস্টর শুনছিল, প্রায় উড়তে উড়তে তার কাছে চলে গিয়েছিল রুবি।

    একটু চুপ করে থেকে বিকাশ বলেছিল, চলো, কোথাও বসি; তোমার সঙ্গে জমিয়ে খানিকটা আড্ডা দেওয়া যাক।

    সোমার আপত্তি ছিল না, এমন অসঙ্কোচ স্মার্ট ছেলে আগে আর কখনও দ্যাখেনি সে। বেশ ভালোই লাগছিল, আর পায়ের তলার স্রোতের টান অনুভব করছিল সোমা।

    একটা পছন্দমতো জায়গার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল বিকাশ। চারধারে গাছপালা, মাধবীলতার, ঝোপ, ঝোপগুলোর ভেতর সিমেন্টের বেঞ্চ, সেগুলোর মাথায় লাল-নীল ছাতা; সেই দিনটার জন্য ওই ছাতাগুলো লাগানো হয়েছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড লম্বাটে দীঘি, এক দিকে সানবাঁধানো লাল ঘাট, আরেক দিকে ডাইভিং বোর্ড। বোর্ডটার ওপাশে পোশাক বদলাবার জন্য দুটো বড় ঘর। একটু পুরুষদের জন্য, অন্যটা মেয়েদের।

    দেখতে দেখতে দীঘির দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছায়াচ্ছন্ন নির্জন ঝোপ চোখে পড়েছিল বিকাশের। সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, গ্র্যান্ড, চলো, ওখানে গিয়ে বসি।

    ঝোপটার দিকে যেতে যেতে সোমা লক্ষ্য করছিল, মাধবীলতার ঝাড়গুলোর কিংবা বড় বড় গাছের তলায় জোড়া জোড়া যুবক-যুবতী বসে আছে। অনেকে আবার দলবদ্ধভাবে পুকুরপাড়ের সরু নুড়ি বিছানো রাস্তায় ঘুরছিল, অনেক আড্ডা দিতে দিতে হুল্লোড় করছিল।

    ওরা যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন আশপাশ থেকে নানারকম মন্তব্য ভেসে আসছিল, চিয়ার ইউ লাকি ডগ–কিংবা উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক

    হেসে হেসে সবার উদ্দেশ্যেই বিকাশ বলছিল, থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্

    কেউ কেউ আবার চোখ টিপে ইঙ্গিত করছিল। মন্তব্যগুলোয় কিংবা চোখের ইশারায় না বুঝবার কিছু ছিল না। সোমার কান গরম হয়ে উঠছিল, চোখ মুখ আঁ আঁ করছিল। তার ভেতরেই দীঘিপারের ঝোপে গিয়ে বসে ছিল।

    সোমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে বিকাশ বলেছিল, আমার কিউরিসিটির প্রায় ফেমিনিন বলতে পারো। এখন তোমার কথা বলো–ডিটেলস চাই, কিছু বাদ দেবে না।

    আমার কোন কথা?

    এই তোমার ফ্যামিলির, তোমার অ্যাম্বিসনের, তোমার ভবিষ্যতের।

    সোমা তাদের ফ্যামিলির কথা বলেছিল। অ্যাম্বিসান সম্বন্ধে ভাষা-ভাষা উত্তর দিয়েছিল। আর ভবিষ্যৎ? এ ব্যাপারে তখন তেমন কিছু ভাবেনি সে।

    বিকাশও তার সব কথাই বলেছিল। তার বাবা রেয়ার প্রিশিসান মেশিনারির ইমপোর্ট লাইসেন্স পেয়ে কিছু টাকা পয়সা করেছেন, নিউ আলিপুরে তাদের নতুন বাড়ি হয়েছে, বিকাশের ভাই বোন কেউ নেই, সে একা। জীবনে তার বিরাট উচ্চাশা; কিছুদিন এখানে চাকরি-বাকরি করে কোম্পানির পয়সায় সে আমেরিকায় যাবে; ওখানে রিসার্চ করবার খুব ইচ্ছা; ফিরে এসে একটা কারখানা খুলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    গল্পে গল্পে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। পুকুরের ওপারে একটা ঘর থেকে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছিল। বাবুর্চি-টাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছে, তারাই ওখানে রান্না-বান্না করছিল।

    এই সময় একটি যুবক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছিল খাবার রেডি, এবার সবাই স্নান করে নাও তারপরেই দেখা গেল, ঝোপঝাড় থেকে গাছতলা থেকে যুবক-যুবতীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ডাইভিং বোর্ডের ওপাশের ঘরে ছুটল। একটু পর সুইমিং কস্টিউম পরে যখন ওরা বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল, সে দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারছিল না সোমা।

    বিকাশ বলল, চলো, স্নান করি

    সোমা মাথা নাড়ল, আমি স্নান করে এসেছি। তাছাড়া সাঁতার জানি না। পুকুরে কখনও নামিনি।

    উৎসাহের গলায় বিকাশ বলল, তা হলে তো নামতেই হয়; একস্ট্রা কস্টিউম নিশ্চয়ই দু-একটা পাওয়া যাবে। চলো, তোমাকে সাঁতার শেখাই।

    জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সোমা বলল, না না, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি স্নান করে আসুন।

    হঠাৎ চোখ গোল করে বিকাশ বলল, এটা কী রকম হল? উই আর ফ্রেন্ডস; একটু আগে জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হল, আমরা তুমি করে বলব। অথচ তুমি এখনও আপনি করে চালাচ্ছ!

    একদিনে কি আর তুমি বলতে পারব! ওর জন্যে সময় লাগবে।

    তোমার বন্ধু রুবি কিন্তু প্রথম দিনই বলেছিল।

    আমি যে রুবি নই।

    একপলক সোমাকে দেখে নিয়ে বিকাশ বলেছিল, তা ঠিক; তুমি ডিফারেন্ট। বলেই সে টয়লেটের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল। তারপর বদ্ধ জলাশয়ে মাছের মতো যুবক-যুবতীরা যেভাবে খেলতে লাগল, তেমন খেলার দৃশ্য আগে আর কখনও দ্যাখেনি সোমা।

    স্নানের পর হইচই করে খাওয়া-দাওয়া। তারপর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছতলায় অনেকক্ষণ গড়িয়ে নিল। রোদের রঙ যখন হলুদ হয়ে এল, সেইসময় রুবি বলল, এবার একটু গান-টান হোক–

    গ্র্যান্ড আইডিয়া! লোকসভায় প্রস্তাব পাস করার মতো সবাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সায় দিল।

    বিকাশ হঠাৎ বলে উঠল, আমার একটা বক্তব্য আছে। আমাদের নিউ ফ্রেন্ড, মানে সোমা আজ গান-টান গেয়ে কিংবা বাজিয়ে কিংবা নেচে আমাদের আনন্দ বর্ধন করবে।

    লাভলি প্রোপোজাল। আমরা হোল-হার্টেডুলি সমর্থন করছি।

    বিব্রতভাবে চারদিকে তাকিয়ে সোমা বলল, দেখুন, আমি নাচ-গান-টান কিছু জানি না। ম্যাক্সিমাম একটা আবৃত্তি করতে পারি।

    একটা ছেলে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, আবৃত্তি! মানে রেসিটেসন। কী রিসাইট করতে চান?

    রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতা।

    রবীন্দ্রনাথ? দেখুন ওই মানুষটার ওপর আমাদের সবার দারুণ শ্রদ্ধা, কিন্তু আমাদের গেট-টুগেদারে রবীন্দ্রনাথকে টানাটানি না করাই ভালো। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা লাইট; হুল্লোড়বাজি আর কী। তার ভেতর গুরুগম্ভীর জিনিস ঢোকালে আনন্দটাই নষ্ট। আপনি বরং আজ আমাদের পারফর্মেন্স দেখুন। পরে আরেক দিন পার্টিসিপেট করবেন।

    মনে মনে ছেলেটাকে হাজারটা ধন্যবাদ দিল সোমা। মুখে বলল, সেই ভালো।

    একটি মেয়ে তার নাম ইন্দ্রাণী, বলল, তা হলে বিকাশ, তোমার পপ গান দিয়েই আজ শুভারম্ভ হোক–

    ইজিলি, বিকাশ উঠে দাঁড়াল। তারপর দুহাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করল, মাই ডার্লিং–মাই ডালিং, কেম ডাউন ফ্রম দা সিলভারি মুন–রাম্বা–রাম্বা–

    আরেকটি ছেলে স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে বিকাশকে সাহায্য করতে লাগল।

    পর পর আটটা গান গাইল বিকাশ। তার গলা বেশ ভালোই, সুরেলা। বিকাশের গানের পর রুবিরা কটি মেয়ে এবং কটা ছেলে টুইস্ট আর চা-চা-চা নাচল।

    তারপর শুরু হল ফোটো ভোলা। চারধারে শুধু ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক। সব চাইতে বেশি ফোটো তুলেছিল বিকাশ, তার সাবজেক্ট একটাই–সে হল সোমা। সোমার ফোটো তুলে তুলেই সে ফিল্ম শেষ করে ফেলেছে। ছবি তোলার পর সবাই ড্রিঙ্ক করল।

    সন্ধের পর ওরা কলকাতায় ফিরে এসেছিল। এমন কী মেয়েরাও। রুবি তো ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই গেল। সোমাকে সবাই অনুরোধ করেছিল। হাতজোড় করে সে কোনওরকমে আত্মরক্ষা করেছে। এক গাড়িতে রুবি, বিকাশ, ইন্দ্রাণী, পল্লব আর সোমা। গাড়িটা বিকাশের; সে-ই চালাচ্ছিল। তার পাশে সোমা, তারপর রুবি। সোমা অন্যমনস্কর মতো সারা দিনটার কথাই ভাবছিল। ফ্রি মিক্সিং বলে একটা শব্দ আছে, এই কি তার নমুনা?

    হঠাৎ পাশ থেকে রুবি বলে উঠেছিল, আজকের দিনটা কী রকম লাগল, সোমা?

    সোমা বলেছিল, ইন্টারেস্টিং; দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল।

    তুই তো আসতেই চাইছিলি না।

    সোমা উত্তর দ্যায়নি।

    বিকাশ ওধার থেকে বলেছিল, মাঝে মাঝেই আমরা এই রকম মিলে মিশে একটু আধটু আনন্দ করি। এবার থেকে সব গেট-টুগেদারে তোমাকে চাই কিন্তু।

    আধফোটা গলায় সোমা বলেছিল, পরীক্ষা আসছে; এখন আর সময় কোথায়?

    বিকাশ বলেছিল, রোজ রোজ তো আর পিকনিক-ফিকনিক হচ্ছে না। তাছাড়া পরীক্ষার এখনও এক বছর দেরি। শুধু বই নিয়ে থাকলেই কি হয়, প্যাস্টাইমও দরকার।

    এক সময় ওরা কলকাতায় পৌঁছে গেল। রুবির কথা মতো সোমাকে তার হোস্টেলের কাছে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল, তুমি এখানেই থাক নাকি? জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে হোস্টেল বাড়িটা ভালো করে দেখে নিয়েছিল সে।

    সোমা মাথা নেড়েছিল।

    বিকাশ আবার বলেছিল, হোপ টু মিট ইউ এগেন–ফির মিলেঙ্গে।

    উচ্ছ্বাস এবং অনুচ্ছ্বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গা থেকে সোমা শুধু বলেছিল, আচ্ছা।

    তারপর একটা সপ্তাহে কাটেনি। এক ছুটির দিনের দুপুরে হোস্টেলবাড়ির দোতলায় নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল সোমা, হঠাৎ বিকাশের স্লিপ এল। মেয়েদের হোস্টেল, তাই ওয়েটিং রুম থেকে স্লিপ পাঠাতে হয়েছে। নইলে ও যা ছেলে, দুম করে হয়তো ওপরেই চলে আসত। যাই হোক স্লিপটা হাতে নিয়েও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না সোমা। বিকাশ অবশ্য আবার দেখা করবার কথা বলেছিল। কিন্তু লোকে কত কথাই তো বলে; সব কথা কি রাখবার?

    হ্যাঁ আমিই। খুব অবাক হয়ে গেছ, না? বিকাশ হেসেছিল, সেদিনই কিন্তু বলেছিলাম, আবার দেখা হবে। মনে নেই?

    সোমা ঘাড় কাত করেছিল, অর্থাৎ আছে।

    বিকাশ এবার ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কী করছিলে?

    তেমন কিছু না। ভাবছিলাম একটু ঘুমোব।

    দুপুরবেলা ঘুমোয় না; চটপট রেডি হয়ে এসো–

    কী ব্যাপার?

    আর বোলো না, এক কাণ্ড করে ফেলেছি।

    কী?

    এলিটে দারুণ একটা ছবি এসেছে। তোমার আর আমার জন্যে দুখানা টিকিট কেটে ফেলেছি।

    একদিনের আলাপে কেউ যে এভাবে সিনেমার টিকিট নিয়ে হাজির হতে পারে, সোমা ভাবতে পারেনি। বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলেছিল, টিকিটটা কেটেই ফেললেন! আমি যদি এখন হোস্টেলে না থাকতাম?

    একটুও না ভেবে বিকাশ বলেছিল, না থাকলে আর কী হত? টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। আর দেরি কোরো না; শো কিন্তু দুটোয়।

    সোমা একবার ভেবেছিল, যাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে বিকাশকে না বলবার মতো শক্তি তার ছিল না। সে শুধু অনুভব করছিল দুর্দান্ত ঝড়ের মতো একটা কিছু তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে।

    সেই শুরু। তারপর থেকে প্রায়ই হোস্টেলে আসতে লাগল বিকাশ। কখনও সে সোমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেত, কখনও জি. টি. রোড ধরে অনেকদুর উধাও হত, কোনওদিন যেত ফিল্ম সোসাইটির দারুণ দারুণ এক্সপেরিমেন্টাল ছবি দেখাতে, যেগুলোর গায়ে শুধু সেক্সের ছড়াছড়ি। তবে সব চাইতে বেশি নিয়ে যেত পার্ক স্ট্রিটের বার-কাম-রেস্তোরাঁগুলোতে। তার ওপর পিকনিক-টিকনিক হুল্লোড়বাজি তো ছিলই।

    সোমা টের পাচ্ছিল, বিকাশ তাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আপস্টার্ট যুবক-যুবতীদের যে ছাঁচ, নরম মোমের মতো তার ভেতর তাকে ঢেলে অন্যরকম একটা আকার দিতে শুরু করেছিল বিকাশ। সোমার ব্লাউজের ঝুল ছোট হতে হতে আট ইঞ্চিতে ঠেকেছিল, হাতা অদৃশ্য হয়ে স্লিভলেস হয়ে গিয়েছিল। তখন তার ঠোঁট রঞ্জিত, নখ ম্যানিকিওর কথা। চুলে শ্যাম্পু, চোখে চাকার মতো গোল চশমা এবং নাভি পর্যন্ত পেট উন্মুক্ত হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁয় বসে এক-আধদিন বিকাশ এবং অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার কি শেরি খেয়ে দেখেছে সে। তবে রুবিদের মতো পাঁড় মাতাল হয়ে উঠতে পারেনি। সোমা টের পাচ্ছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না; পাহাড়ের ঢালে এক টুকরো পাথরের মত সে দ্রুত অতলে নেমে যাচ্ছিল।

    এর মধ্যে বছর দেড়েকের মতো কেটে গেছে। এম.এ পাশ করে গিয়েছিল সোমা। তারপরও কলকাতাতেই থেকে গেছে। বিকাশদের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হবার পর লক্ষ্ণৌতে বিশেষ যেত না সে। দশবার যাবার তাড়া দিলে একবার হয়তো যেত। কলকাতা নামে এই শহর জাদুকরের মতো তখন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

    এম.এ. পাশ করায় সোমার হাতে প্রচুর সময়। তখন বিকাশের সঙ্গে দারুণ ঘুরছে সে। কোনও কোনও দিন ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত, এক আধদিন ফিরতই না। এই নিয়ে হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে রোজ কথা-কাটাকাটি, রোজ ঝগড়া। বাড়ি থেকেও ফিরে যাবার জন্য চিঠি আসছিল। বাবা ছেলে দেখছেন, সোমার বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে চান। সোমার তখন কোনওদিকেই চোখ ছিল না।

    মনে আছে এই সময় বিকাশ অফিস থেকে কদিনের ছুটি পেয়েছিল। ছুটিটা কাটাবার জন্য সে গিয়েছিল দার্জিলিং, সঙ্গে সোমা। দার্জিলিং থেকে ফেরার তিন মাস পরেই সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা সোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, সে প্রেগনেন্ট। উঠতে-বসতে-চলতে ফিরতে নিজের দেহের মধ্যে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব সে টের পেতে লাগল। ভীত বিমূঢ় সোমা বিকাশকে বলেছিল, আমার কী হবে?

    সব শুনে শার্ট থেকে টোকা দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মতো বিকাশ বলেছিল, ম্যাটার অফ ফাইভ মিনিটস। তোমাকে কালই একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সে তোমাকে ফ্রি করে দেবে।

    কিন্তু

    কী?

    চোখ-কান বুজে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার মতন সোমা বলেছিল, তুমি আমাকে বিয়ে করো।

    বিয়ে! এমন একটা অদ্ভুত ভীতিকর শব্দ আগে আর যেন শোনেনি বিকাশ। সে বলেছিল, এই সামান্য ব্যাপারের জন্যে বিয়ে! জানোনা, রুবি দুবার অ্যাবরসান করিয়েছে, ইন্দ্রাণী একবার। করবী-হেমারা কতবার ডাক্তারের কাছে গেছে হিসেব নেই। ইটস এ শর্ট অফ এনজয়মেন্ট। বিয়ে করে এর মধ্যেই ফেঁসে যেতে চাই না। ডাক্তার-ফাত্তার ওষুধ-টোষুধের ব্যবস্থা থাকতে কে ওসব ঝামেলায় যায়। কালই তোমাকে আবার পবিত্র কুমারী করে দিচ্ছি।

    সোমা বুঝেছিল, বিকাশ বিয়ে করবে না। অথচ তার কথা না শুনে উপায়ও ছিল না। পরের দিন ডাক্তারের প্রাইভেট নার্সিং হোমে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে সোমা যখন ফিরে এসেছিল তখন তার দুশ্চিন্তা নেই; বিকাশের ভাষায় আগের মতোই সে কুমারী। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টায় তার মধ্যে নিদারুণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কিছু একটা ঘটে গেছে। নিজেকে সে ততক্ষণে আবিষ্কার করে ফেলেছে। যতই ঠোঁট নখ ম্যানিকিওর করুক, যতই হেয়ার-টনিকে চুল ফাপাক, বিয়ারের গেলাসে চুমুক দিক নাভির তলায় শাড়ি পরুক, তার ভেতর চিরদিনের সংস্কার-ভীরু একটি মেয়ে আছে। সেদিন থেকে সে আর হোস্টেল থেকে বেরুত না। জীবন মানে এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড় খোলামকুচির মতো তাকে অসীম শূন্যতায় ছুঁড়ে দিয়েছিল। সমস্ত পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছিল সোমা; তাকে ঘিরে অন্তহীন বিষাদ জমতে শুরু করেছিল।

    তারপরও বিকাশ অনেকবার এসেছে, রুবিরা এসেছে। সোমা দেখা করেনি। ওয়েটিং রুম থেকেই ওরা ফিরে গেছে। লক্ষৌতে এক-আধবার গেছে কিন্তু দু-চার দিনের বেশি থাকতে পারেনি। তার মনে হয়েছে, বেশিদিন থাকলে বাবা-মার চোখে সে ধরা পড়ে যাবে। নিদারুণ পাপবোধ তখন তাকে নিয়ত দগ্ধ করছে।

    যাই হোক এই সময় একটা কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে গিয়েছিল সোমা। পড়াতে গিয়ে ওখানেই তপতীর সঙ্গে আলাপ। আলাপের দিন থেকেই এই উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়েটা তার বন্ধু। যতদিন গেছে তপতীর প্রীতি, তপতীর ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। পৃথিবীতে আলো-হাওয়া-জলের মতো তপতীর বন্ধুত্বের তুলনা নেই।

    বিষণ্ণ বিবর্ণ মুর্তির মতো তাকে সারাদিন চুপচাপ থাকতে দেখে তপতী কতদিন ধরে বলে আসছে, পূর্ণিয়ায় নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এত কাল পর পূর্ণিয়া আসার সময় হল তার।

    .

    কতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল, সোমা জানে না। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে চমকে উঠল সে। দারুণ হাসছে তপতী; টাঙ্গাওলার পাশে বসে মৃন্ময়ও হাসছে।

    মৃদু গলায় সোমা বলল, কী হল, হাসছিস যে?

    তপতী বলল, তোর কাণ্ড দেখে। কী ভাবছিলি অত?

    সোমা থতিয়ে গেল, কই, কিছু না তো।

    সামনের সিট থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, কিছু না বললেই হবে! আমরা দুজনে কম করে আটাত্তর বার ডেকেছি; আপনার সাড়া নেই। যার ধ্যান করছিলেন, সত্যিই সে ভাগ্যবান।

    সোমার একবার ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে লোকটার গালে চড় কষায়। কিন্তু কিছুই করল না।

    আরো ঘন্টাখানেক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তারা গোলাপবাড়িতে ফিরে এল।

    .

    ০৭.

    বাড়ি ফিরে দেখা গেল তপতীর বাবা এসে গেছেন। তপতীর মার মতো তপতীর বাবার দিকে তাকিয়েও চোখ ফেরানো যায় না। তাকে দেখলে মনে হয়, গ্রিক পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে দেবদূত নেমে এসেছে।

    তপতীর বাবার সঙ্গে আলাপ হল। মানুষটি ভারী সরল, অমায়িক। চোখ দুটি স্নেহে ভাসো-ভাসো। বললেন, তুমি কিছু মনে করোনি তত মা?

    বুঝতে না পেরে সোমা বলল, কী ব্যাপারে?

    তোমরা যখন এলে তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। তোমার জন্যে অন্তত থাকা উচিত ছিল।

    না না, কিছু মনে করিনি। মাসিমাই তো ছিলেন। দোলন-ঝুলন পিন্টু ছিল। আপনি না থাকতে একটুও অসুবিধা হয়নি।

    দুম করে মৃন্ময় বলে উঠল, যাঃ বাবা, আমি যে একদিন আগে গিয়ে মনিহারি ঘাট থেকে নিয়ে এলাম, আমার কথাটাই বাদ চলে গেল! একেই বলে বরাত। সোমা উত্তর দিল না।

    কথায় কথায় অনেক রকম প্রসঙ্গ এল। সোমাদের বাড়ির কথা, দেশের কথা, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, কলকাতার কথা। দেখা গেল, তপতীর বাবা কোনও ব্যাপারেই বিশেষ খবর-টবর রাখেন না, রাখার উৎসাহও নেই। নাইনটিন ফরটি ওয়ানে তিনি শেষবার কলকাতায় গিয়েছিলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সম্বন্ধে তার ধারণা ভাসা-ভাসা। আলাপ-টালাপ করে মনে হতে লাগল, ভদ্রলোক এ যুগের নন।

    ওঁদের গল্পের মধ্যেই তপতীর মা এসে তাড়া দিতে লাগলেন, রাত হয়েছে এবার খেতে চল সব।

    .

    খাবার টেবলে বসে আবার গল্প শুরু হল।

    হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী তাড়াতাড়ি তার মাকে বলল, মা, তুমি নাকি মৃন্ময়দাকে চিঠি দিয়ে আনিয়েছ?

    তপতীর মা বললেন, হ্যাঁ।

    কেন?

    ওর একটা বিয়ে দেব। আমি মেয়ে দেখেছি।

    টেবলের দূর প্রান্ত থেকে সোমা নিজের অজান্তেই মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। কী আশ্চর্য, মৃন্ময়ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিল সোমা। আর মৃন্ময় হেসে হেসে তপতীর মাকে বলল, ইঁদুর কলে পা দিতে আমি আর রাজি না।

    তপতীর মা বললেন, বিয়েটাকে ইঁদুর কল বলছিস কেন মৃন্ময়?

    মৃন্ময় বলল, আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে ওই কথাটা ছাড়া আর কিছুই মনে আসে না।

    বারবার এক রকম হবে তার কি কিছু মানে আছে?

    ঘরপোড়া গরু তো বুঝতেই পারছ?

    আগেরবার নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলি, এবারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে দ্যাখ, ভালো হয় কিনা।

    মৃন্ময় চুপ করে রইল।

    কিছুক্ষণ নীরবতার পর তপতীর বাবা একসময় ডাকলেন, মৃন্ময়

    মৃন্ময় তাকাল। তপতীর বাবা বললেন, সোমা এসেছে, তোরা ওকে পূর্ণিয়ার চারদিকটা ভালো করে দেখিয়ে দে।

    মৃন্ময় উৎসাহিত হয়ে উঠল, নিশ্চয়ই। শুধু পূর্ণিয়া কেন, একদিন যোগবাণীতে গিয়ে নেপাল বর্ডার দেখিয়ে আনব, একদিন যাব মহানন্দ ব্রিজে–একের পর এক তালিকা দিয়ে যেতে লাগল মৃন্ময়।

    .

    ০৮.

    দিন দুয়েকের মধ্যে তপতীদের বাড়ির জীবনযাত্রা মোটামুটি জেনে ফেলল সোমা। তপতীর বাবা সকাল হলেই স্নান-টান সেরে চা খেয়ে টিফিন কেরিয়ারে খাবার-টাবার বোঝাই করে পুরোনো আমলের একটা সাইকেলে বেরিয়ে পড়েন। মানুষটি অদ্ভুত, সারাদিন নাকি নির্জন মাঠের মাঝখানে বসে থাকেন। পাখি দ্যাখেন, ফুল দ্যাখেন, আকাশ দ্যাখেন, গাছপালা পাখি-টাখি দ্যাখেন। মানুষের সঙ্গ বিশেষ পছন্দ করেন না। ফিরতে ফিরতে সন্ধে, কোনওদিন হয়তো খবর এল, দশ মাইল দূরের বনে সাদা শজারু বেরিয়েছে, শুনেই শজারু দেখতে ছুটলেন। কেউ হয়তো বলল অমুক জায়গায় বিচিত্র পাখি দেখা দিয়েছে, কানে আসা মাত্র রওনা হলেন। বিভূতি ভূষণের লেখায় প্রকৃতির মনোহর ছবি দেখেছে সোমা; কিন্তু এমন প্রকৃতি প্রেমিক আগে আর দ্যাখেনি সে।

    সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তপতীর মায়ের ওপর। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে কার অসুখ-বিসুখ করল, চাকর-বাকররা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা–সব দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

    তপতীর ভাইবোনেরা ভারি শান্ত, ভদ্র বিনয়ী। বাড়িতে তারা আছে কিনা, টের পাওয়া যায় না। তবে তপতীটা দারুণ চঞ্চল। দুমদাম হাঁটছে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে, জোরে জোরে শব্দ করে হেসে উঠছে। আর একজনের অস্তিত্বও দারুণভাবে টের পাওয়া যায়–সে মৃন্ময়। নিস্তব্ধ বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ সে গেয়ে ওঠে, তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে। আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে। কিংবা মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সেদিন ভরা সাঁঝে কিংবা কইও কথা বন্ধুর কাছে, জল ছাড়া মীন কয়দিন বাঁচে কিংবা এ দেখো তো য়ঁহা, কোই নহী হ্যায়, কোই ভী নহী, পাশ আ যাও না– ইত্যাদি ইত্যাদি

    মৃন্ময় সম্বন্ধে আরো কিছু কিছু জেনেছে সোমা। নিজে যেচে জানতে যায়নি, তপতীদের কথাবার্তা থেকে টুকরো টুকরো কানে এসেছে। মৃন্ময়ের মা-বাবা নেই। ছেলেবেলা থেকেই ফুলমাসি অর্থাৎ তপতীর মার কাছে সে মানুষ। তার স্বভাবটা অদ্ভুত; কোনও কিছুর প্রতিই বিশেস আকর্ষণ নেই। বড় বড় পাবলিসিটি ফার্মে ভালো ভালো চাকরি নিয়ে কতবার কলকাতা-বোম্বাই গেছে। কিন্তু দু-চার মাস, ভালো না লাগলেই দুম করে ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে এসেছে। আপাতত আছে নয়া দিল্লিতে, কবে ছেড়ে দেবে ঠিক নেই। মৃন্ময়ের জীবনে একটা দুঃখ আছে, তা বিবাহ-ঘটিত। দুঃখটা ঠিক কী ধরনের এখনও জানা হয়নি।

    .

    যাই হোক মৃন্ময় আর তপতীর সঙ্গে একদিন নেপাল বর্ডার দেখে এল সোমা, একদিন মহানন্দা ব্রিজ পেরিয়ে গেল ওয়েস্ট দিনাজপুর। আরেকদিন গেল ফরবেসগঞ্জ। মাঝে মাঝে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সাইকেল রিকশায় দূর দেহাতেও চলে যেতে লাগল।

    এর মধ্যেই একদিন খবর এল সোমেশ আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে। দেশে আসার কথা ছিল আরো পরে। কিন্তু হঠাৎ সুযোগ পেয়ে যাওয়ার আগেই এসে গেছে।

    সোমেশের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল তপতী। ভদ্র, নম্র, বুদ্ধিদীপ্ত সোমেশকে দেখে যত না খুশি হল সোমা তার চাইতে অনেক বেশি হল বিষণ্ণ। এমন বিষাদ আগে আর কখনও অনুভব করেনি সে। তার মনে হতে লাগল, চারপাশের সবাই যেন তাকে বঞ্চিত করেছে।

    সোমেশ আসার দুদিন পর ছিল হোলি। সোমার রঙ খেলার ইচ্ছা ছিল না। তপতী সোমেশ আর মৃন্ময় জোর করে তাকে ঘরের বাইরে বার করল। অনিচ্ছুক সোমা কারো গায়ে রঙ-টঙ দিল না; তপতীরা অবশ্য আবির-টাবীর দিয়ে ওকে ভূত সাজিয়ে ছাড়ল।

    রঙটা শুধু গায়েই লাগল। মনের ভেতরটা একেবারে বর্ণহীন বলা যায়, শীতের আকাশের মতো ধূসর।

    হোলির পর থেকে নিজেকে আবার গুটিয়ে আনতে লাগল সোমা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গা, তার গাছপালা, মানুষ এবং সুন্দর দৃশ্যপট তাকে খুব বেশিদিন অন্যমনস্ক রাখতে পারল না। সেই পুরোনো বিষাদ আবার সোমার চারপাশে ঘন হতে লাগল। ঘর থেকে বেরুতে আর ইচ্ছা হয় না।

    সোমেশ ফিরে আসার পর বাড়িতে আর কতটুকু সময় থাকে তপতী। সারাদিনই সে সোমেশের সঙ্গে ঘুরছে। অবশ্য সোমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলে, সোমেশও দু-একবার এসে অনুরোধ করেছে, সোমা যায়নি। তার কিছুই ভালো লাগে না।

    .

    ০৯.

    তাদের জন্য নির্দিষ্ট সেই ঘরটায় সারাদিনই চুপচাপ বসে থাকে সোমা, মাঝে মধ্যে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সামনের বড় জানালাটার বাইরেই গোলাপ-বাগান, বাগানের পর রাস্তার ওধারে গাছপালা, অনেক উঁচুতে আকাশ।

    সে-সব দিকেও চোখ যায় সোমার, কিন্তু কিছু যেন দেখতে পায় না সে।

    দোলন-ঝুলন কদাচিৎ এ ঘরে আসে। এসেও–কী করছেন? চা খাবেন কি? জাতীয় দু-একটা কথা বলেই চলে যায়। তপতীর মা অবশ্য অনেকবার এসেই তার খোঁজ নিয়ে যান।

    তবে সব চাইতে যে বেশি আসে সে মৃন্ময়। দরজার বাইরে থেকেই চিৎকার করে বলে, মে আই কাম ইন বলেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। অনুমতির জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করে না।

    সোমা বিরক্ত চোখে তাকায়; কিছু বলে না।

    চেয়ারে জাঁকিয়ে বসতে বসতে মৃন্ময় বলে, আপনি একটা ফ্যাস্টাফ্যাটাস, সারাদিন ঘরের ভেতর কী করে যে বসে থাকেন!

    নীরস গলায় সোমা বলে, আমার শরীরটা ভালো না।

    কী হয়েছে?

    সোমা উত্তর দেয় না।

    মৃন্ময় উদ্বেগের গলায় বলে, ডাক্তারকে খবর দেব?

    সোমা বলে, না। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

    একটু চুপ। তারপর সোমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে মৃন্মম নীচু গলায় বলে, আমার কী মনে হয় জানেন?

    কী? কপাল কুঁচকে যেতে থাকে সোমার।

    শরীর আপনার ভালোই আছে, গোলমালটা অন্য জায়গায়।

    তার মানে?

    নিজেই ভেবে দেখুন

    লোকটা কি অন্তর্যামী? সোমা চমকে ওঠে। তারপরেই তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, অনুগ্রহ করে আপনি এখন যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

    কখনও এসে মৃন্ময় বলে, আপনাকে আজ একটা জিনিস দেখাব।

    সোমা বিরক্ত অথচ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। মৃ

    ন্ময় বলতে থাকে, নওটঙ্কী কাকে বলে জানেন?

    না।

    প্রচুর নাচ গান দিয়ে একটা পালার মতো। বাংলাদেশে যেমন যাত্রা, অনেকটা সেই রকম।

    নিস্পৃহ সুরে সোমা বলে, ও–

    আজ ভাট্টাবাজারের কাছে নওটঙ্কীর গান আছে। শুনতে যাবেন? উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলতে থাকে, খুব ভালো লাগবে; দারুণ এনজয় করবেন। জিনিসটা যাকে বলে একেবারে সয়েল থেকে উঠে এসেছে, এখানকার মাটির গন্ধ মাখানো।

    না।

    কী না?

    এসব আমার ভালো লাগে না।

    জিনিসটা আগে দেখুন, শুনুন। তারপর তো ভালো-লাগা খারাপ-লাগার প্রশ্ন।

    আমাকে ক্ষমা করুন; এ ব্যাপারে আমার কিছুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

    একদিন মৃন্ময় এক কাণ্ডই করে বসল। সোমার ঘরে এসে বলল, আজ আপনাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই।

    উপহার! বিমূঢ়ের মতো উচ্চারণ করল সোমা।

    ইয়েস ম্যাডাম।

    কিন্তু

    কী?

    আপনার উপহার আমি হাত পেতে নেব কেন?

    খুব সামান্য জিনিস।

    সামান্যই হোক আর অসামান্যই হোক, আমি নিতে পারব না। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল সোমার। লোকটার স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

    মৃন্ময় বলল, দেখুন, জিনিসটা আমি পয়সা দিয়ে কিনিনি। কেনা হলে দিতাম না। আমি একজন আর্টিস্ট, জানেন তো?

    শুনেছি।

    আমি একটা ছবি এঁকেছি, সেটাই দিতে চাই।

    সোমা উত্তর দিল না।

    মৃন্ময় পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে সোমার সামনের টেবলটায় রাখল। যে ছবিটা আঁকা হয়েছে সেটা একপলক দেখেই সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে চড়ল সোমার। ছবিটা তারই; তলায় লেখা আছে–বিষাদের প্রতিমা–দুঃখিনী। কখন কোন ফাঁকে চোরের মতো তার ছবি এঁকে নিয়েছে মৃন্ময়, কে জানে।

    ঘাড়ের কাছে একটা শির কট করে ছিঁড়ে গেল যেন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করে উঠল সোমা, অসভ্য, জানোয়ার! বেরিয়ে যান এখান থেকে বেরিয়ে যান

    ফস করে আলো নিভে যাবার মতো মুখটা কালো হয়ে গেল মৃন্ময়ের। নিজেকে টেনে তুলতে তুলতে সোমাকে একবার দেখল সে, তারপর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে গেল।

    তার পর থেকে সোমার ঘরে আর আসেনি মৃন্ময়। কিন্তু যখনই সোমা চোখ তুলে জানালার বাইরে তাকিয়েছে তখনই দেখেছে, একজোড়া চোখ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ কোমল, সহানুভূতিময়, আর্দ্র। অভদ্র ইতর মৃন্ময় যে এভাবে তাকাতে পারে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা খুবই অস্বস্তিবোধ করতে লাগল।

    .

    ১০.

    আরো কদিন পর হঠাৎ সোমা বলল, আমি আজ কলকাতা চলে যাব।

    বাড়ির সবাই চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কিছুতেই না কিছুতেই না। আজ যাওয়া হতেই পারে না।

    দোলন-ঝুলন-পিন্টু, অনেক করে থাকতে বলল, তপতীর বাবা বোঝালেন, তপতীও চিৎকার-টিৎকার করল, তপতীর মা বললেন, তিন বছর পর যা-ও এলে, দুদিন থাকতে না থাকতেই চলে যাবে? আর কটা দিন থেকে যাও মা! কিন্তু কারো কথা শুনল না সোমা।

    তপতী বলল, কলকাতায় তো তোর কোনও কাজ নেই।

    অবুঝের মতো সোমা বলল, না থাক, তবু যাব। এখানে আমার আর ভালো লাগছে না।

    শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক হল। কিন্তু তাকে কাটিহারে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে কে? তপতীর বাবা যাবেন না, পিন্টুর দুদিন ধরে জ্বর, আর তপতী আগে থেকেই সোমেশের সঙ্গে এক জায়গায় যাবার প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে।

    সোমা বলল, কারোকেই যেতে হবে না; শেয়ারের ট্যাক্সিতে তুলে দিলে আমি একাই চলে যেতে পারব।

    তপতীর মা বললেন, তাই কখনও হয়? ভালো কথা, মৃন্ময়ই তো আছে। সে-ই কাটিহারে তুলে দিয়ে আসবে।

    সোমা একবার ভাবল, আপত্তি করে। কিন্তু কিছু বলল না।

    .

    কাটিহার থেকে দুপুর দুটোয় মনিহারি ঘাটের ট্রেন। শেয়ারের ট্যাক্সি না, কোত্থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি যোগাড় করে আনল মৃন্ময়। এখান থেকে কাটিহার আর কতক্ষণের রাস্তা; মোটরে গেলে বড় জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বারোটা বাজবার আগেই খানিকটা সময় হাতে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

    ড্রাইভার নেই; গাড়িটা মৃন্ময় নিজেই চালাচ্ছিল। পিছনের সিটে চুপচাপ বসে আছে সোমা। কেউ কথা বলছিল না।

    সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য মনে মনে লজ্জিত ছিল সোমা; রাগের মাথায় ওভাবে বলা তার উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দ্বিধার গলায় সে ডাকল, মৃন্ময়বাবু

    সামনের দিকে চোখ রেখেই মৃন্ময় সাড়া দিল, বলুন

    সেদিনের ব্যাপারটার জন্যে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।

    ক্ষমা আবার কী।

    দেখুন, ওইসব কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। জীবনে হয়তো আর কখনও আপনার সঙ্গে দেখা হবে না; আপনি যদি ওই ব্যাপারটা মনে করে রাখেন আমি খুব কষ্ট পাব।

    মনে করে রাখব না। তাছাড়া

    কী?

    কেউ কিছু বললে আমার বেঁধে না; আমার গায়ের চামড়া গন্ডারের মতো পুরু।

    সোমা আর কিছু বলল না। মৃন্ময়ও চুপ করে থাকল।

    আজ মৃন্ময় বড় বেশি সংযত। সোমা কথা না বললে আগে থেকে সে কিছু বলছে না, কোনওরকম মন্তব্যও করছে না। এমন কী পিছন ফিরে একবার সোমাকে দেখছেও না।

    এক ঝলক মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সোমা।

    গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই। দুধারে আদিগন্ত মাঠ, পানিফলে বোঝাই মাইলের পর মাইল বিল, টুকরো টুকরো রবিশস্যের খেত, সিসম গাছের জটলা, ঝোপ-ঝাড়।

    কতক্ষণ গাড়িটা চলেছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সোমা, চারটে বাজে। সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, এ কী, চার ঘণ্টা গাড়ি চলছে, এখনও কাটিহার গিয়ে পৌঁছালাম না?

    মৃন্ময় খুব সহজ গলায় বলল, আমরা কাটিহারের দিকে গেলে তো পৌঁছুবেন—

    তার মানে?

    তার মানে আমরা অন্য রাস্তায় চলে এসেছি।

    উদ্বিগ্ন মুখে সোমা বলল, তা হলে কলকাতায় যাব কী করে?

    মৃন্ময় বলল, কলকাতায় আজ আর যাওয়া হচ্ছে কই? দুটোর ট্রেন দুঘন্টা আগে কাটিহার ছেড়ে চলে গেছে। আজ আর মণিহারি ঘাটের ট্রেন নেই। যেতে হলে কাল। নিশ্চয় আপনাকে কাটিহারে ট্রেন ধরিয়ে দিয়ে আসব।

    আপনি ভেবেছেন কী?

    কী ব্যাপার?

    আমার কলকাতা যাওয়া কি আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর?

    আপাতত।

    লোকটার মতলব কী কে জানে। ভাত ভাবে জানালার বাইরে তাকাতে লাগল সোমা। এখন গাড়িটা যেখানে সেটা একটা মেঠো পথ। দুধারে ঝুপসি আম বাগান। মৃন্ময় কী বুঝেছিল, সে-ই জানে। বলল, এই জায়গাটাকে আমাদের বিহারের পলাশী বলতে পারেন। আরেকটা খবর আপনাকে দিচ্ছি, এখান থেকে তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনও দেহাত নেই, লোকজন নেই। চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ আসবে না।

    ভয়ার্ত রুদ্ধ গলায় সোমা বলল, আপনি কী চান?

    গাড়ি থেকে নামুন, বলছি।

    নিজের ইচ্ছায় নয়, অদৃশ্য কোন শক্তি সোমাকে যেন ধাক্কা মেরে মেরে গাড়ির বাইরে নামিয়ে নিয়ে গেল। তাকে একটা আমগাছের মোটা শিকড়ের সঙ্গে বসিয়ে খানিকটা দূরে মুখোমুখি বসল মৃন্ময়; তারপর পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে নিল।

    কাঁপা গলায় সোমা বলল, কী বলবেন বলুন

    অত তাড়াতাড়ি কি আছে, আজ তো আর ট্রেন ধরতে হবে না।

    না হোক; আমি তপতীদের বাড়ি ফিরে যেতে চাই।

    নিশ্চয়ই। আমিও তোত সেখানেই ফিরব। আর তপীদের বাড়ি যেতে হলে আমার সঙ্গেই আপনাকে যেতে হবে।

    সোমা চুপ করে রইল।

    সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকগুলো ধোঁয়ার আংটি ছাড়ল মৃন্ময়। তারপর বলল, আপনার কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে।

    জেনে লাভ?

    লাভ হয়তো নেই।

    তবে?

    কৌতূহল।

    আমি যদি আপনার কৌতূহল না মেটাই?

    মেটাতেই হবে।

    আপনার হুকুমে?

    না। আপনার নিজের জন্য।

    তার মানে?

    হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়, অন্যমনস্কর মতো ক পা হাঁটল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব গাঢ় গলায় বলল, আপনি খুব দুঃখী, না?

    আচমকা বুকের ভেতর অনেকগুলো এলোমেলো ঢেউ খেলে গেল সোমার। স্মমিত স্বরে সে বলল, কে বলেছে আপনাকে?

    নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এখানে একটা দুঃখী মানুষ আছে, সে-ই বলে দিয়েছে।

    মৃন্ময়ের জীবনে যে বেদনা আছে, সোমা তার কিছু আভাস পেয়েছে। সে বলল, আপনার ধারণাটা ভুলও তো হতে পারে।

    বুকের ওপর আঙুলটা ছিলই। মৃন্ময় বলল, এখান থেকে যে বলে সে ভুল বলে না। তা ছাড়া

    কী?

    আপনি নিজেও বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনি কত দুঃখী।

    আমি?

    হ্যাঁ। আপনার চলা-ফেরা, আপনার চুপচাপ বসে থাকা, আপনার চাউনি—এ সবের মধ্যে কী আছে, যে বুঝবার সে ঠিকই বুঝতে পারবে।

    সোমা চুপ।

    মৃন্ময় আবার বলল, আমার আরো কী মনে হয় জানেন?

    সোমা তাকাল।

    মৃন্ময় বলতে লাগল, আপনার দুঃখের কথা কোনদিন কারোকে আপনি বলেননি, বা বলতে পারেননি। চেপে রেখে শুধু কষ্টই পাচ্ছেন। আর নিজেকে ধ্বংস করছেন।

    লোকটা কি অন্তর্যামী? যাকে সে ভেবেছিল অত্যন্ত হাল্কা ধরনের বাজে লোক তার মধ্যে যে এমন গভীর হৃদয়বান মানুষ আছে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা চকিত হয়ে উঠল।

    মৃন্ময় বলেই যাচ্ছে, আপনি আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে পারেন, বলুনএকজনের কাছে বলেও মনের ভার অন্তত খানিকটা কমান।

    হঠাৎ সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর কী যে হয়ে গেল, কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়া, সোমা বলতে পারবে না। এ ভাবে কেউ কোনদিন তার কথা শুনতে চায়নি।

    বিচিত্র এক সম্মোহের ঘোরে বিকাশের সঙ্গে জড়ানো তার জীবনের সেই দুর্ঘটনাটার কথা বলে গেল সোমা। বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে লাগল।

    কতক্ষণ কেঁদেছে জানে না, এক সময় সোমা অনুভব করল, তার পিঠে একটি সহানুভূতিময় হাতের কোমল স্পর্শ এসে পড়েছে। চমকে মুখ তুলতেই দেখতে পেল দুচোখে অপার স্নেহ তাকিয়ে আছে মৃন্ময়! চোখাচোখি হতেই সে বলল, পুওর গার্ল।

    সোমা উত্তর দিল না।

    মৃন্ময় আবার বলল, কিন্তু এত ভেঙে পড়লে তো চলবে না। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। জানেনা, আমার জীবনেও কিছু দুঃখ আছে। একটি মেয়েকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে আমাকে ঠকিয়ে আমার যথাসর্বস্ব নিয়ে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে একদিনে চলে গেল। তারপরেও দ্যাখ আমি কেমন হাসি, গান গাই, হই-হল্লা করি। ওই ঘটনাটা একেবারে ভুলেই গেছি।

    হঠাৎ যেন চোখের ওপর ধারালো আলো এসে পড়ল। মৃন্ময়ের এই গান-টান, হল্লা-হুঁল্লোড়–সব যেন কান্নারই ছদ্মবেশ। রবীন্দ্রনাথের কী একটা কবিতা যেন আছে, এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না সোমা।

    অনেকক্ষণ পর সোমা বলল, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।

    মৃন্ময় বলল, ধুস, এর জন্যে কোন কিছুই শেষ হয় না।

    মৃন্ময়ের চোখে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে সোমা বলল, সত্যিই হয় না?

    না, তোমার মাথায় ওটা ফিক্সেশানের মতো আটকে আছে। কিন্তু জীবনে শেষ বলে কোন কথা নেই। রোজ সেখানে নতুন করে শুরু করা যায়। সন্ধে দুজনে উঠে পড়ল।

    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়
    Next Article অলৌকিক নয়, লৌকিক – ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.